১০
পরদিন হাজি মুরাদ প্রিন্সের প্রাসাদে হাজির হওয়ার আগেই দর্শনার্থীদের ঘরটি লোকজনে ভরে গিয়েছিল। সেখানে গতকালের গুফো জেনারেলও ছিলেন, বিদায় নিতে এসেছিলেন বলে তার পরনে ছিল সব কটি পদক লাগানো পুরো সামরিক পোশাক। উপস্থিত ছিলেন রসদের তহবিল তছরুপ করার অভিযোগে সামরিক আদালতে বিচারের ঝুঁকিতে থাকা একজন রেজিমেন্ট অধিনায়ক। (ড, আন্দ্রিয়েভস্কির সুপারিশে) একজন ধনী মার্কিন নাগরিক এসেছিল সরকারের কাছ থেকে ভোদকা বিক্রির একচেটিয়া অনুমতি নবায়নের আশায়। যুদ্ধে নিহত একজন সামরিক কর্মকর্তার বিধবা কালো পোশাক পরে এসেছিল। উদ্দেশ্য, ভাতা বা সন্তানদের বিনা খরচে লেখাপড়ার সুবিধা পাওয়া। জাঁকালো পোশাক পরা এক উচ্ছন্নে যাওয়া জর্জীয় প্রিন্স এসেছিলেন বাজেয়াপ্ত করা গির্জার সম্পত্তি বরাদ্দ নিতে। সেখানে একজন কর্মকর্তার হাতে বিশাল একটা গোটান কাগজে ককেশাসকে আয়ত্তে আনার একটি পরিকল্পনা ছিল। একজন খানও উপস্থিত ছিল, যার একমাত্র উদ্দেশ্য। প্রিন্সের সঙ্গে দেখা করেছে, প্রতিবেশীদের কাছে এই অহংকার করা।
সবাই যার যার পালার জন্য অপেক্ষা করছিল। সুন্দর চুলের একজন তরুণ এডিসি তাদের একজন একজন করে প্রিন্সের দপ্তরে ঢুকিয়ে আবার বের করে আনছিল।
হাজি মুরাদ চটপটেভাবে একটু খুঁড়িয়ে হেঁটে ঘরে ঢুকলে সবার চোখ পড়ল তার দিকে, সে শুনতে পেল ঘরের বিভিন্ন দিকে লোজন ফিসফিস করে তার নাম উচ্চারণ করছে।
তার পরনে ছিল কলারে সুন্দর কারুকাজ করা ফিতা লাগানো বাদামি বেশমেতের ওপর লম্বা সাদা চাপকান। কালো আঁটসাঁট পায়জামা এবং একই রঙের নরম জুতা, পায়ের পাতার সঙ্গে তা দস্তানার মতো লেগেছিল। তার মাথায় ছিল পাগড়িঘেরা লম্বা টুপি, প্রকাশ্যে আহমেদ খানের বিরোধিতা করার জন্য জেনারেল ক্রুগানু তাকে গ্রেপ্তার করার সময় ঠিক এই পাগড়িটাই তার মাথায় ছিল। ওই গ্রেপ্তারের কারণ তিনি শামিলের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন।
হাজি মুরাদ দর্শনার্থীদের ঘরের নকশাকাটা কাঠের মেঝেয় চটপটেভাবে হেঁটে ঢুকেছিলেন। একটা পা খাটো থাকায় খুঁড়িয়ে হাঁটার জন্য তার ঋজু শরীর সামান্য দুলছিল। শান্তভাবে তাকানো চোখ দুটি যেন কাউকে দেখছিল না।
সুদর্শন এডিসি তাকে স্বাগত জানিয়ে প্রিন্সের কাছে তার আগমনের খবর দেওয়ার আগে একটু বসতে অনুরোধ করল। কিন্তু হাজি মুরাদ বসতে চাইলেন না এবং ছোরার ওপর হাত রেখে উপস্থিত সবার দিকে তাচ্ছিল্যভরে তাকালেন।
প্রিন্সের দোভাষী প্রিন্স তারখানভ হাজি মুরাদের কাছে এসে তার সঙ্গে কী বলল। হাজি মুরাদ অনিচ্ছা সত্ত্বেও সংক্ষেপে জবাব দিল। একজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে আসা এক কুমিক প্রিন্স কামরা থেকে বের হয়ে এলে এডিসি হাজি মুরাদকে দরজার কাছে নিয়ে ভেতরে যাওয়ার ইশারা করল।
তার টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে ভরন্তসভ হাজি মুরাদকে স্বাগত জানালেন। প্রধান সেনাপতির সাদা মুখে গতকালের মতো স্মিত হাসি ছিল না, বরং মুখটা ছিল কঠিন ও গম্ভীর।
বিশাল টেবিল এবং ভেনেশিয়ান ব্লাইন্ড টানানো বড় বড় জানালার ঘরটিতে ঢুকে হাজি মুরাদ তার রোদে পোড়া ছোট হাত দুটো দিয়ে চাপকানের পাশ দুটো মেলার জায়গায় স্পর্শ করলেন। তারপর চোখ নামিয়ে তাড়াহুড়া না করে তার ভাষায় স্পষ্টভাবে শ্রদ্ধাভরে কথা বলতে শুরু করলেন কুমিক আঞ্চলিক টানে, এই টানটি তিনি ভালো বলতে পারেন।
আমি মহান জারের প্রবল ক্ষমতা এবং আপনার কাছে নিজেকে সঁপে দিচ্ছি, তিনি বললেন, এবং কায়মনে আমার শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে জারের সেবা করার প্রতিজ্ঞা করছি, এবং আমি আশা করি আপনাদের এবং আমার শত্রু শামিলের সঙ্গে যুদ্ধে আমি কাজে লাগতে পারব।
দোভাষীর কথা শোনার পর ভরন্তসভ হাজি মুরাদের দিকে তাকালেন, হাজি মুরাদও তার দিকে তাকালেন।
দুজনের চোখে চোখে এত কথা হয়ে গেল, যা বলা যেত না এবং দোভাষীও তা কিছুতেই বোঝাতে পারত না। কোনো শব্দ ব্যবহার না করে তারা একে অন্যকে পুরো সত্য বলে দিল। ভরসভের চোখ বলল হাজি মুরাদ যা বলেছেন, তার একটি শব্দও তিনি বিশ্বাস করেননি এবং তিনি জানেন হাজি মুরাদ যেকোনো রুশ জিনিসের শত্রু ছিলেন এবং থাকবেন, এখন আত্মসমর্পণ করছেন বাধ্য হয়ে। হাজি মুরাদ তা বুঝতে পারলেও নিজের সততা নিশ্চিত করার চেষ্টা করতে থাকলেন। তার চোখ বলেছিল, বুড়ো তার যুদ্ধের নয়, তার মৃত্যুর কথা ভাবছে; বুড়ো ধূর্ত তাই তাকে সাবধান হতে হবে। ভরন্তসভ এটাও বুঝতে পেরেছিলেন, তা সত্ত্বেও হাজি মুরাদের সঙ্গে যুদ্ধে জেতার ব্যাপারে কথা বললেন।
তাকে বলো, ভরন্তসভ বললেন, আমাদের জার যেমন পরাক্রমশালী, তেমনি দয়ালু এবং হয়তো আমার অনুরোধে তাকে ক্ষমা করে দিয়ে কাজে লাগাতে পারে…বলেছ তাকে? হাজি মুরাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমি আমার ঊর্ধ্বতনের সিদ্ধান্ত না পাওয়া পর্যন্ত তাকে আমার কাছে রেখে দেব এবং আমাদের সঙ্গে ভালোভাবে সময় কাটানোর ব্যবস্থা করব। হাজি মুরাদ আবার তার বুকের কাছে হাত রেখে উৎফুল্লভাবে কিছু বলতে শুরু করলেন।
দোভাষী বলল, তিনি বলছেন ১৮৩৯ সালে আভারিয়ার শাসক থাকার সময় তিনি রুশদের বিশ্বস্তভাবে সেবা করেছেন এবং তার শত্রু আহমেদ খান তার ক্ষতি করার জন্য জেনারেল ক্লুগেনুর কাছে তার দুর্নাম না করা পর্যন্ত রুশদের ছেড়ে যাননি।
ভরন্তসভ বললেন, জানি জানি, (যেন তিনি তা আগে থেকেই জানতেন, কিন্তু ভুলে গিয়েছিলেন)। জানি, বলে ভরন্তসভ হাজি মুরাদকে দেয়ালের পাশের সোফায় বসতে ইশারা করলেন। কিন্তু হাজি মুরাদ বসলেন না। একজন গুরুত্বপূর্ণ লোকের সামনে বসবেন কি না, মনস্থির করতে পারছেন না, তার শক্তিশালী কাধ নাড়িয়ে বোঝালেন হাজি মুরাদ।
তারপর দোভাষীর মাধ্যমে বলতে শুরু করলেন, আহমেদ খান ও শামিল–দুজনেই আমার শত্রু। প্রিন্সকে বলল যে আহমেদ খান মৃত আর আমি তার ওপর প্রতিশোধ নিতে পারি না; কিন্তু শামিল বেঁচে আছে, তার ওপর প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত আমি মরব না, জেদে ভুরু কুঁচকে মুখ শক্ত করে বললেন হাজি মুরাদ।
হ্যাঁ, হ্যাঁ; কিন্তু তিনি কী করে শামিলের ওপর প্রতিশোধ নেবেন? শান্তভাবে ভরন্তসভ বললেন দোভাষীকে। তাকে বলে তিনি বসতে পারেন।
হাজি মুরাদ আবারও বসতে অস্বীকার করলেন; প্রশ্নের জবাবে বললেন রুশদের কাছে তার আসার উদ্দেশ্য শামিলকে ধ্বংস করতে তাদের সাহায্য করা।
বেশ, বেশ, কিন্তু তিনি ঠিক কী করতে চান? ভরন্তসভ বললেন, বসুন, বসুন।
হাজি মুরাদ বসে বললেন একদল সৈন্য সঙ্গে দিয়ে তাকে লেসগিয়ার সীমায় পাঠিয়ে দিলে তিনি নিশ্চিতভাবে দাগেস্তান দখলে নিতে পারবেন এবং শামিলের আর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।
চমৎকার হবে। আমি ভেবে দেখব, ভরন্তসভ বললেন।
দোভাষী তা বুঝিয়ে দিল।
হাজি মুরাদ চিন্তায় পড়লেন।
সরদারকে আরেকটা কথা বলো, হাজি মুরাদ আবার শুরু করলেন। আমার পরিবার আমার শত্রুর হাতে। তারা যত দিন সেখানে থাকবে, তত দিন আমি কিছু করতে পারব না। আমি প্রকাশ্যে বিরুদ্ধে গেলে শামিল আমার স্ত্রী, আমার মা এবং সন্তানদের মেরে ফেলবে। প্রিন্স আগে বন্দীদের বদলে আমার পরিবারকে ছাড়িয়ে আনলে আমি পরে শামিলকে শেষ করে দেব, না হয় মরে যাব!
ঠিক আছে, ঠিক আছে, ভরন্তসভ বললেন। আমি ভেবে দেখব। এখন তাকে সেনাপ্রধানের কাছে গিয়ে তার অবস্থা ও পরিকল্পনা বলতে বলো।
হাজি মুরাদ ও ভরন্তসভের মধ্যে প্রথম সাক্ষাৎ এভাবেই শেষ হলো।
সন্ধ্যায় প্রাচ্যরীতিতে সাজানো নতুন থিয়েটারে একটি ইতালীয় অপেরা মঞ্চস্থ হচ্ছিল। ভরন্তসভ তার কুঠুরিতে বসে ছিলেন। তখন মঞ্চের কাছের আসনগুলোর দিকে খুঁড়িয়ে চলা হাজি মুরাদের চোখে পড়ার মতো পাগড়ি মাথায় অবয়ব দেখা গেল। ভরন্তসভের এডিসি লরিস-মেলিকভের সঙ্গে তিনি এসেছিলেন। লরিস-মেলিকভের ওপর তার দেখাশোনার ভার পড়েছিল। হাজি মুরাদ সামনের সারির একটি আসনে বসলেন। প্রথম অঙ্কের সময়টা প্রাচ্যের ভাবলেশহীন, নিরানন্দ কঠোর-মুখো অভিজাত মুসলমানদের মধ্যে কাটিয়ে হাজি মুরাদ উঠে দাঁড়ালেন এবং চারদিকের দর্শকদের দিকে শান্তভাবে তাকিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বের হয়ে গেলেন।
পরদিন সোমবার, ভরসভের বাড়িতে নিয়মিত ভোজের আয়োজন। উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত বিশাল ঘরে গাছগুলোর আড়ালে বাদকদল বাজাচ্ছিল। তরুণী এবং ততটা তরুণী নয় মহিলারা বুক, বাহু ও কাঁধের ওপরের দিক খোলা পোশাকে ঝকঝকে সামরিক পোশাক পরা পুরুষদের জড়িয়ে কেবল ঘুরছিল আর ঘুরছিল। খাবার সাজানো টেবিলে লাল হংসপুচ্ছ কোট এবং হাঁটু পর্যন্ত আঁটা পাতলুন ও জুতা পরা খানসামারা মহিলাদের শ্যাম্পেন ও মিষ্টি খাবার বেঁটে দিচ্ছিল। বয়স হওয়া সত্ত্বেও সরদারের স্ত্রী তেমনি আধো পোশাকে আমন্ত্রিতদের ঘুরে ঘুরে যাচ্ছিলেন। শিষ্ট হাসিমুখে দোভাষীর মাধ্যমে নির্বিকারভাবে অতিথিদের দিকে তাকিয়ে থাকা হাজি মুরাদকে ভদ্রভাবে দু-একটি কথা বললেন। গৃহকতাঁর পর অন্যান্য আধা উলঙ্গ মহিলারা হাজি মুরাদের কাছে এসে নিঃসংকোচে তার সামনে দাঁড়িয়ে একই প্রশ্ন করল : সবকিছু কেমন লাগছে? কাঁধে সোনালি বিহ্ন ও পাকানো রঞ্জু এবং গলায় তার হোয়াইট ক্রস ঝুলিয়ে ভরন্তসভও তার কাছে এসে একই প্রশ্ন করলেন। স্পষ্টত নিশ্চিত হয়ে যে যা দেখছে তা ভালো না লেগে হাজি মুরাদের উপায় নেই। হাজি মুরাদ ভরন্তসভের কথার জবাব দিলেন, যেমন দিয়েছিলেন অন্য সবাইকে, তাদের সমাজে এমন কিছু হয় না। ভালো কি মন্দ, সে রকম কোনো মন্তব্য না করে।
নাচের এই আসরে হাজি মুরাদ ভরন্তসভকে তার পরিবার সম্পর্কে বলার চেষ্টা করল; কিছুই শুনতে পাননি, এমন ভাব করে ভরন্তসভ চলে গেলেন। পরে লরিস-মেলিকভ হাজি মুরাদকে বলল যে তখন কাজের কথা বলার উপযুক্ত সময় নয়।
১১টা বাজলে হাজি মুরাদ ভরন্তসভদের দেওয়া ঘড়িতে সময় দেখে লরিস-মেলিকভকে জিজ্ঞেস করল সে যেতে পারে কি না। লরিস-মেলিকভ বলল সে যেতে পারে কিন্তু থেকে যাওয়া ভালো। তা সত্ত্বেও হাজি মুরাদ থাকলেন না; তার ব্যবহারের জন্য দেওয়া ফিটন গাড়িতে চড়ে তাকে দেওয়া বাড়িতে চলে গেলেন।
১১
তিবলিসে হাজি মুরাদের পাঁচ দিনের দিন ভাইসরয়ের আদেশে তার এডিসি লরিস-মেলিকভ হাজি মুরাদের সঙ্গে দেখা করতে এল।
আমার মাথা ও হাত সরদারের সেবা করতে আনন্দিত, হাজি মুরাদ তার স্বাভাবিক কূটনৈতিক সৌজন্যে তার মাথা নিচু করে এবং দুহাত বুকের ওপর রেখে বললেন। নম্রভাবে লরিস-মেলিকভের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আদেশ করুন!
লরিস-মেলিকভ টেবিলের পাশে রাখা একটা আরামকেদারায় বসলেন, হাজি মুরাদ বসলেন তার উল্টো দিকের একটি গদিতে, হাঁটুর ওপর দুহাত রেখে। অন্যজনের কথা ভালো করে শোনার জন্য তিনি মাথা কাত করে ছিলেন।
লরিস-মেলিকভ বললেন হাজি মুরাদের অতীত সম্বন্ধে প্রিন্স জানলেও এখনকার অবস্থা পুরোপুরি জানতে চান। লরিস-মেলিকভ স্বচ্ছন্দে তাতার বলতে পারতেন।
আমাকে বলুন, আমি লিখে নিয়ে তা রুশ ভাষায় অনুবাদ করে দিলে প্রিন্স সেটা সম্রাটের কাছে পাঠিয়ে দেবেন।
হাজি মুরাদ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকলেন (অন্যে কথা বলতে থাকলে তিনি কখনো থামান না এবং যে বলছিল, তার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত চুপ করে থাকেন এই ভেবে যে অন্যজন হয়তো আরও কিছু বলবে)। তারপর তিনি মাথা তুলে টুপিটা নেড়ে বসালেন এবং তার সেই অদ্ভুত শিশুসুলভ হাসি হাসলেন, যে হাসি মারিয়া ভাসিলিয়েভনাকে মুগ্ধ করেছে।
সম্রাট তার কাহিনি পড়বেন, এই ভেবে খুশি হয়ে বললেন, আমি বলব।
তুমি আমাকে সব বলবে, (তাতার ভাষায় সম্মানসূচক তুমি নেই, তাই সাধারণ তুমিই তিনি বললেন) সব বলবে, একদম প্রথম থেকে, বলে লরিস-মেলিকভ একটা নোটবই বের করলেন।
আমি বলব, কিন্তু সে তো অনেক অনেক কথা। কত ঘটনা ঘটেছে, হাজি মুরাদ বললেন।
তুমি সব এক দিনে বলতে না পারলে আরও সময় নিতে পারো, বললেন। লরিস-মেলিকভ।
আমি কি একদম গোড়া থেকে শুরু করব?
হ্যাঁ, একদম গোড়া থেকে–তোমার জন্ম, তুমি যেখানে থাকতে, সেখান থেকে।
হাজি মুরাদ অনেকক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রইলেন। তারপর গদির পাশে রাখা একটা লাঠি হাতে নিলেন। খাপ থেকে হাতির দাঁতের ওপর সোনায় খোদাই করা হাতলের একটি ক্ষুরধার ছোরা বের করলেন। তারপর ছোরাটি দিয়ে লাঠিটার ওপর অল্প অল্প করে কাটতে আর কথা বলতে শুরু করলেন।
লিখুন : জন্ম তসেলমেস গ্রামের ছোট্ট একটা কুঁড়েঘরে। আমরা পাহাড়িরা যাকে গাধার মাথার মতো ছোট বলি, বললেন তিনি। এর থেকে খুব বেশি দূরে নয়, কামানের দুই গোলার প্রায় সমান দূরে ছিল খুনজাখ। সেখানে খানরা থাকত। তাদের সঙ্গে আমাদের পরিবারের খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল।
আমার সবচেয়ে বড় ভাই ওসমানের যখন জন্ম হয়, আমার মা তখন সবচেয়ে বড় খান আবু নুতসাল খানের দুধ-মা ছিলেন। তারপর তিনি খানের দ্বিতীয় ছেলে উম্মা খানকেও পেলে বড় করেন। আমার দ্বিতীয় ভাই আহমেদ তখন মারা যায়। আমার জন্ম হওয়ার সময় খান সাহেবের বেগম বুলাচ খানকে পেটে ধরেন। আমার মা তখন আর দাই হিসেবে যাননি। বাবা তাকে যেতে বলেছিলেন কিন্তু মা যাননি। তিনি বলেছিলেন, আমি আমার আরেকটা ছেলেকে মেরে ফেলব না; আমি যাব না। আমার জেদি বাবা তখন তাকে ছোরা বসিয়ে দেন। সবাই তাকে বাবার হাত থেকে না বাঁচালে তিনি মরেই যেতেন। মা আমাকে ছেড়ে যাননি, তারপর তিনি একটা গান বানিয়েছিলেন, কিন্তু আমি সেটা বলব না।
আমার মা দাই-মা হিসেবে গেলেন না, মাথা ঝাঁকিয়ে তিনি বললেন, খান সাহেবের বেগম আরেকজন দাই জোগাড় করেন। কিন্তু আমার মাকে তিনি পছন্দ করতেন। মা আমাদের নিয়ে তাদের বাড়িতে যেতেন। আমরা তার ছেলেদের সঙ্গে খেলতাম, তিনি আমাদেরও আদর করতেন।
খানদের তিন ছেলে : আবু নুতসাল খান, আমার ভাই ওসমানের পালক ভাই উম্মা খান এবং আমার ধর্মভাই বুলাচ খান। বুলাচ সবচেয়ে ছোট, শামিল তাকে খাড়া পাহাড় থেকে ফেলে দিয়েছিল, সেটা পরের কথা।
আমার বয়স যখন খোলো, মুরিদরা তখন গ্রামে আসতে শুরু করে। তারা পাথরের ওপর কাঠের খঞ্জর (ছোট বাঁকা তরবারি) দিয়ে শব্দ করত আর চিৎকার করে বলত, মুসলমানরা, জিহাদ আসছে! চেচেনরা মুরিদদের সঙ্গে যোগ দিল। আভাররাও যেতে শুরু করে। আমি তখন প্রাসাদে থাকতাম খানদের ভাই হিসেবে। আমি যা খুশি করতে পারতাম। বেশ ধনী হয়ে গিয়েছিলাম। আমার ঘোড়া, অস্ত্র ও টাকা-সবই ছিল। আমি তখন বেপরোয়া, ফুর্তিতে জীবন কাটাই। এ রকম চলছিল ইমাম কাজি-মোল্লা নিহত হওয়া পর্যন্ত। তার জায়গায় এল হামজাদ। হামজাদ খানদের কাছে দূত পাঠিয়ে জানাল তারা জিহাদে যোগ না দিলে খুনজাখ ধ্বংস করে দেওয়া হবে।
এটা ভাবনার বিষয় ছিল। খানরা রুশদের ভয় করত। জিহাদে যোগ দিতেও ভয় করত। বুড়ি বেগম আমাকে আর তার দ্বিতীয় ছেলে উম্মা খানকে তিবলিসে পাঠালেন। হামজাদের বিরুদ্ধে রুশ সেনাপতির সাহায্যের আশায়। তিবলিসে রুশ সেনাপতি ছিলেন ব্যারন রোজেন। তিনি আমার বা উম্মা খানের সঙ্গে দেখা করলেন না। তিনি সাহায্যের কথা বলে পাঠালেন, কিন্তু কিছুই করলেন না। শুধু কয়েকজন ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে এলেন আর উম্মা খানের সঙ্গে তাস খেলে গেলেন। তারা তাকে মদ খাইয়ে মাতাল করে খারাপ সব জায়গায় নিয়ে যেতেন। উম্মা খান তাদের কাছে তাস খেলায় সব হারান। তিনি ছিলেন ষাঁড়ের মতো জোয়ান, সিংহের মতো সাহসী কিন্তু তার মন ছিল খুব নরম। আমি তাকে বাধা না দিলে তিনি জুয়ায় তার সবকিছু হারাতেন।
তিবলিস ঘুরে আসার পর আমার ধারণা বদলে যায়। আমি বুড়ি বেগম আর খানদের জিহাদে যোগ দেওয়ার পরামর্শ দিলাম।
তোমার মত বদলে গেল কেন? লরিস-মেলিকভ জিজ্ঞেস করল। তুমি রুশদের ওপর সন্তুষ্ট ছিলে না?
হাজি মুরাদ থামলেন। না, আমি সন্তুষ্ট ছিলাম না, চোখ মুদে পরিষ্কার বললেন। আরেকটা কারণে আমি জিহাদে যোগ দিতে চেয়েছিলাম।
সেটা কী?
তসেলমেসের কাছে আমি ও উম্মা তিনজন মুরিদের মুখোমুখি হই। তাদের দুজন পালিয়ে যায়, তৃতীয়জনকে আমি পিস্তল দিয়ে গুলি করি।
আমি তার অস্ত্রগুলো নিতে কাছে গেলে দেখি সে বেঁচে আছে। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি আমাকে মেরে ফেলছ। আমি খুশি; কিন্তু তুমি
একজন মুসলমান, সবল তরুণ। জিহাদে যোগ দাও, আল্লাহ তাই চান!
এবং তুমি যোগ দিলে?।
না, কিন্তু কথাটা আমাকে ভাবিয়ে তুলল, হাজি মুরাদ গল্পটা বলতে থাকলেন।
হামজাদ খুনজাখের দিকে এলে মুরব্বিদের তার কাছে পাঠালাম এই বলে যে আমরা জিহাদে যোগ দিতে রাজি আছি, যদি ইমাম আমাদের বোঝাতে একজন জ্ঞানী লোককে পাঠান। হামজাদ মুরব্বিদের গোঁফ কামিয়ে, নাকে ফুটো করে তাতে পিঠা ঝুলিয়ে দিল। এই অবস্থায় তাদের আমাদের কাছে ফেরত পাঠাল।
মুরব্বিদের কাছে বলে দিল যে সে জ্ঞানী কাউকে পাঠাতে পারে, যদি বেগম সাহেবা তার ছোট ছেলেকে জামিন হিসেবে পাঠান। তিনি তার কথা মেনে নিয়ে ছোট ছেলে বুলাচ খানকে পাঠিয়ে দিলেন। হামজাদ তাকে সাদরে গ্রহণ করে বড় দুই ভাইকেও দাওয়াত পাঠাল। সে বলে পাঠাল যে তার বাবা খানদের বাবাকে যেমন সেবা করেছে, সে-ও খানদের তেমন সেবা করতে চায় আর সব এক মহিলার মতো বেগমও একজন দুর্বল, বোকা ও অহংকারী ছিলেন। তিনি দুই ছেলেকেই পাঠাতে ভয় পেলেন এবং কেবল উম্মা খানকে পাঠালেন। আমি তার সঙ্গে গেলাম। পৌঁছার মাইলখানেক আগেই আমাদের সঙ্গে মুরিদদের দেখা হলো। তারা আমাদের ঘিরে গান গাইতে গাইতে ঘোড়া নিয়ে আধা বৃত্তে নাচল। কাছাকাছি গেলে হামজাদ তাঁবু থেকে বের হয়ে উম্মা খানের ঘোড়র পাদানি ধরে তাকে খানের মতো স্বাগত জানিয়ে নামাল। সে বলল, আমি তোমাদের পরিবারের কোনো ক্ষতি করিনি, করতেও চাই না। আমাকে মেরে ফেলো না, আর লোকদের জিহাদে নামানোর কাজে আমাকে বাধা দিয়ো না। আমি আমার পুরো বাহিনী দিয়ে তোমাদের সেবা করব, যেভাবে আমার বাবা তোমাদের বাবাকে সেবা করেছে। আমাকে তোমাদের বাড়িতে থাকতে দাও। আমি তোমাদের পরামর্শ দেব এবং তোমরা যা খুশি করতে পারবে।
উম্মা খান কথা বলতে পারছিল না, বুঝতে পারছিল না কী বলতে হবে। তাই সে চুপ করে থাকল। আমি বললাম, তা-ই যদি হয়, তাহলে হামজাদ খুনজাখে আসতে পারে। বেগম ও খানরা তাকে সাদরে বরণ করবে কিন্তু আমার কথা শেষ করতে দেওয়া হলো না, তখনই আমি শামিলকে প্রথম দেখি। সে ইমামের পাশে ছিল। সে আমাকে বলল, তোমাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি, খান বলবে!
আমি চুপ করে গেলাম। হামজাদ উম্মা খানকে তার তাঁবুতে নিয়ে গেল। তারপর হামজাদ আমাকে ডেকে তার দূতদের নিয়ে খুনজাখে যেতে বলল। আমি সেখানে গেলাম। দূতরা তার বড় ছেলেকেও হামজাদের কাছে পাঠানোর জন্য বেগমকে বোঝাতে শুরু করল। আমার মনে হলো, সেটা বিশ্বাসঘাতকতা হবে। আমি তাকে বড় ছেলেকে পাঠাতে বারণ করলাম। কিন্তু মহিলাদের মাথায় ঘিলুর পরিমাণ খুবই কম। তিনি তার ছেলেকে যেতে বললেন। আবু নুতসাল খান যেতে চায়নি। তখন বেগম বললেন, বুঝেছি, তুমি ভিতু! তিনি মৌমাছির মতো জানতেন কোথায় হুল ফোঁটালে সে সবচেয়ে কাতর হবে। আবু নুতসাল খান লাল হয়ে গেল এবং বেগমের সঙ্গে আর কথা বলল না। তার ঘোড়া তৈরি করতে বলল। সঙ্গে গেলাম আমি।
হামজাদ আমাদের আরও সম্মান দেখাল। নিজে অভ্যর্থনা করল বন্দুকের দুই গুলি দূরত্বে নেমে এসে। বড় একটি অশ্বারোহী দল এবারও বাতাসে গুলি ছুড়ল, আমাদের ঘিরে গাইল এবং ঘোড়া নিয়ে আধা বৃত্তে নাচল।
শিবিরে পৌঁছালে খানকে নিয়ে তার তাঁবুতে চলে গেল হামজাদ আর আমি থাকলাম ঘোড়াগুলো নিয়ে।
আমি পাহাড়ের ঢালের অনেকটা নিচে থেকে হামজাদের তাঁবুতে গুলির আওয়াজ শুনলাম। দৌড়ে সেখানে গিয়ে দেখি, উম্মা খান রক্তে ভাসছে আর আবু নুতসাল মুরিদদের সঙ্গে লড়ছে। তার একটা গাল কেটে ঝুলছে। এক হাতে সেটা চেপে ধরে, আর অন্য হাতের ছোরা দিয়ে কাছে যে আসছে, তাকেই কোপাচ্ছে। হামজাদের ভাইকে কোপ মেরে ফেলে দিতে দেখলাম। আরেকজনকে আঘাত করতে গেলে মুরিদরা তাকে গুলি করে ফেলে দেয়।
হাজি মুরাদ থামলেন। তার রোদে পোড়া মুখ আর চোখ ভাটার মতো লাল।
আমি ভয়ে পালিয়ে এলাম।
সত্যি? আমি ভেবেছি তুমি ভিতু নও, লরিস-মেলিকভ বলল।
তারপর থেকে না, তারপর থেকে আমার সেই লজ্জার কথা মনে আছে। তা মনে পড়লে আমি আর কিছুই ডরাই না?
১২
বেশ, আর না! নামাজের সময় হয়েছে, বলে হাজি মুরাদ চাপকানের বুকপকেট থেকে ভরন্তসভদের দেওয়া ঘন্টা বাজানো ঘড়িটা (রিপিটার ঘড়ি) বের করে সাবধানে স্প্রিংয়ের ওপর চাপ দিলেন। সোয়া ১২টার ঘণ্টা বাজল। মাথাটা একদিকে কাত করে মুখে হালকা হাসি নিয়ে বাচ্চা ছেলের মতো হাজি মুরাদ তা-ই শুনলেন।
বন্ধু ভরসভের উপহার, হেসে বললেন হাজি মুরাদ।
খুব ভালো ঘড়ি, লরিস-মেলিকভ বলল। তাহলে তুমি নামাজ পড়ো, আমি বসে আছি।
ঠিক আছে, বলে হাজি মুরাদ তার শোবার ঘরে চলে গেলেন।
ঘরে একা থাকায় লরিস-মেলিকভ হাজি মুরাদের কথাগুলো মিলিয়ে দেখল। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল। শোবার ঘরের দরজাটার উল্টো দিকের দরজার কাছে গিয়ে সে শুনতে পেল কয়েকজন লোক তাতারি ভাষায় উত্তেজিত হয়ে কথা বলছে। সে মনে করল, তারা হাজি মুরাদের মুরিদ। দরজা খুলে বের হয়ে সে তাদের কাছে গেল। ঘরটা পাহাড়িদের গায়ের কটু গন্ধে ভরে আছে। মেঝেয় একটা বিছানো চাদরের ওপর বসে একচোখা লালচুলো গামজালো বসে। গায়ে একটি তেলচিটে ছেঁড়াফাটা বেশমেত। সে লাগামের দড়ি পাকাতে পাকাতে উত্তেজিতভাবে হেঁড়ে গলায় কিছু বলছিল। লরিস-মেলিকভ ঘরে ঢুকলে সে থেমে গেল। তার দিকে কোনো নজর না দিয়ে সে হাতের কাজ চলিয়ে গেল। খোশমেজাজি খান মাহোমা দাঁড়িয়ে ছিল গামজালোর সামনে। তার সাদা দাঁতগুলো বের করে, তার কালো পাপড়িহীন চোখ চকচক করছিল। সে কোনো কিছু বলছিল বারবার। সুদর্শন এলডারের সবল বাহুর ওপর আস্তিন গোটানো। সে একটি পেরেকে ঝোলানো জিনের পেটি পালিশ করছিল। মূল সহকারী খানেফি সেখানে ছিল না। বাড়ি দেখাশোনার ভার তার ওপর। সে রান্নাঘরে খাবার রাঁধছিল।
তাদের সালাম দিয়ে লরিস-মেলিকভ জিজ্ঞেস করল, কী নিয়ে তর্ক করছ?
সে সব সময় শামিলের গুণ গায়, লরিস-মেলিকভের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল খান মাহোমা। সে বলে শামিল ভালো মানুষ, জ্ঞানী, পবিত্র এবং দক্ষ ঘোড়সওয়ার।
সে তাকে ছেড়ে এসেও কী করে তার প্রশংসা করে?
সে তাকে ছেড়ে এসেছে, তারপরও প্রশংসা করে। আবার বলল খান মাহোমা।
সে আসলেই শামিলকে পীর মনে করে? জিজ্ঞেস করল লরিস মেলিকভ।
সে পীর না হলে লোকে তার কথা শুনত না, গামজালোর চটজলদি জবাব।
শামিল না, মনসুর পীর ছিল, জবাব দিল খান মাহোমা। সে-ই ছিল আসল পীর। সে ইমাম থাকার সময় মানুষ অন্য রকম ছিল। সে ঘোড়ায় চড়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে গেলে লোকজন তার কাপড়ের কিনার ধরে চুমু খেয়ে পাপ স্বীকার করত এবং আর পাপ না করার ওয়াদা করত। মুরব্বিরা বলে, তখন সব মানুষ পীরদের মতো ছিল। মদ খেত না, সিগারেট খেত না, নামাজ বাদ দিত না, খুনোখুনি হলেও অন্যদের দোষ মাফ করে দিত। টাকাপয়সা কুড়িয়ে পেলে লাঠির আগায় বেঁধে রাস্তার পাশে ঝুলিয়ে রাখত। তখন আল্লাহ মানুষকে কামিয়াব করত–এখনকার মতো না।
পাহাড়িরা এখনো মদ-সিগারেট খায় না, বলল গামজালো।
তোমার শামিল একটা লামোরি, লরিস-মেলিকভের দিকে চোখ টিপে খান মাহোমা বলল। (লামারি মানেও পাহাড়ি, তবে খারাপ অর্থে।)।
হ্যাঁ, লামোরি মানেও পাহাড়ি, গামজালো বলল। যে পাহাড়ে ইগল থাকে।
দারুণ, ঠিক বলেছ! পাল্টা জবাবে খুশি হয়ে হেসে খান মাহোমা বলল।
লরিস-মেলিকভের হাতে সিগারেটের রুপার কৌটা দেখে খান মাহোমা একটা সিগারেট চাইল। লরিস-মেলিকভ চোখ টিপে হাজি মুরাদের ঘরের দিকে ইশারা করে বলল, সিগারেট খাওয়া তো নিষেধ। খান মাহোমার মন্তব্য,
দেখলে অসুবিধা নেই। সে সঙ্গে সঙ্গে সিগারেটে টান দিয়ে না গিলে ধোয়া ছাড়তে শুরু করল। তার অনভ্যস্ত লাল ঠোঁট অদ্ভুত কায়দায় গোল করে।
এটা ঠিক নয়! জোরে বলে গামজালো ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
খান মাহোমা তার পেছনে আবার চোখ টিপল। সিগারেট টানতে টানতে লরিস-মেলিকভকে জিজ্ঞেস করল একটা রেশমি বেশমেত আর সাদা টুপি কোথায় ভালো পাওয়া যাবে।
তোমার কি অত টাকা আছে?
হ্যাঁ, কেনার মতো টাকা আছে।
জিজ্ঞেস করো টাকা সে পেল কোথায়, সুদর্শন মুখে হাসি ছড়িয়ে লরিস মেলিকভকে বলল এলডার।
আমি জিতেছি। খান মাহোমা চট করে জবাব দিল। তারপর বলল কেমন করে জিতেছে। আগের দিন তিবলিসে হাঁটতে গিয়ে রাস্তার ওপর কয়েকজন রুশ ও আর্মেনীয়কে অর্লিয়াঙ্কা (পয়সার এপিঠ-ওপিঠ ধরনের খেলা) খেলতে দেখে। বাজি ছিল তিনটি সোনার এবং অনেক রুপার টাকা। খান মাহোমা সঙ্গে সঙ্গে তাদের কাছে যায়। তার পকেটের পয়সাগুলো ঝনঝন করে সব টাকা বাজি ধরার কথা জানায়।
তুমি কী করে করলে, তোমার কত ছিল? লরিস-মেলিকভ জিজ্ঞেস করল।
আমার কাছে ছিল বারো কোপেক, খ্যাক খ্যাক করে হেসে জবাব দিল খান মাহোমা।
বেশ, হারলে কী করতে?
কেন, এই দেখো! তার পিস্তলটি দেখিয়ে বলল খান।
তুমি ওটা দিয়ে দিতে?
দেব কেন? আমি দৌড় দিতাম, কেউ পিছু নিলে গুলি করে মেরে ফেলতাম…সব খতম!
তাহলে তুমি জিতেছ?
হ্যাঁ, আমি সব জিতে নিয়ে এসেছি!
লরিস-মেলিকভ বেশ বুঝে গেল খান মাহোমা, এলডার কেমন মানুষ। খান মাহোমা আমুদে, বেপরোয়া আর যেকোনো হইহল্লার জন্য প্রস্তুত। তার উপচে পড়া জীবনশক্তি নিয়ে কী করা উচিত, সে জানে না। সে সব সময়ই আনন্দে থাকে আর হঠকারী। নিজের ও অন্যদের জীবন নিয়ে খেলতে সে ভালোবাসে। জীবন নিয়ে খেলতেই সে রুশদের কাছে এসেছে। একই কারণে সে শামিলের সঙ্গেও যোগ দিতে পারে।
এলডারকে বোঝা সহজ। সে তার নেতার (মুরশিদ) প্রতি পুরোপুরি বিশ্বস্ত। শান্ত, সবল ও দৃঢ়।
একমাত্র গামজালোকে লরিস-মেলিকভ বুঝতে পারেনি। লোকটা কেবল শামিলের প্রতি বিশ্বস্ত নয়, রুশদের প্রতি তার অনীহা, অবজ্ঞা, বিরোধিতা ও ঘেন্না অদম্য। তাই সে বুঝতে পারেনি গামজালো কেন রুশদের কাছে এসেছে। লরিস-মেলিকভের মনে হলো হাজি মুরাদের আত্মসমর্পণ, শামিলের সঙ্গে শত্রুতার গল্প প্রতারণাও হতে পারে। কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও সে রকম সন্দেহ করেন। হয়তো সে রুশদের দুর্বলতাগুলো জানার জন্য গোয়েন্দাগিরি করতেই আত্মসমর্পণ করেছে। হয়তো পাহাড়ি এলাকায় ফিরে গিয়ে তার বাহিনীকে সেভাবে কাজে লাগাবে। গামজালো লোকটি এই সন্দেহ পাকা করে দিল।
হাজি মুরাদসহ অন্যরা নিজেদের মনের কথা গোপন রাখতে জানে, কিন্তু এই লোকটি তা করতে না পেরে তাদের সঙ্গে বেইমানি করছে, লরিস মেলিকভ ভাবল।
লরিস-মেলিকভ তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল। তাকে জিজ্ঞেস করল একঘেয়ে লাগছে কি না। হাতের কাজ না থামিয়ে সে ঘেৎ ঘোঁৎ করে জবাব দিল, না, লাগছে না। আড়চোখে সে লরিস-মেলিকভকে দেখে নিল। লরিস মেলিকভের সব প্রশ্নের জবাব দিল সে একইভাবে।
লরিস-মেলিকভ ঘরে থাকতেই হাজি মুরাদের আরেক আভার মুরিদ খানেফি ঘরে ঢোকে। তার মুখ, ঘাড় ও চওড়া বুক এত রোমশ যে মনে হয় শেওলাটাকা। সে সবল, কঠোর পরিশ্রমী ও সব সময় কাজে নিবিষ্ট। এলডারের মতো সে-ও প্রশ্নাতীতভাবে মনিবের বাধ্য।
কিছু চাল নেওয়ার জন্য ঘরে ঢুকলে লরিস-মেলিক তাকে থামিয়ে জানতে চাইল বাড়ি কোথায় এবং কত দিন ধরে হাজি মুরাদের সঙ্গে আছে।
পাঁচ বছর, বলল খানেফি। আমাদের বাড়ি একই গ্রামে। আমার বাবা তার চাচাকে খুন করে। তারা আমাকে খুন করতে চেয়েছিল, শান্ত গলায় বলল খানেফি। তার জোড়া ভুরুর নিচের চোখ দুটো দিয়ে সোজাসুজি লরিস মেলিকভের মুখের দিকে তাকিয়ে। তখন আমি তাকে ধর্মভাই ডাকি!
ধর্মভাই কী?
আমি দুই মাস আমার চুল-নখ কাটা বন্ধ করে তাদের কাছে আসি। তারা আমাকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যায়। সে আমাকে তার বুকের দুধ দেয়। আর আমি তার ভাই হয়ে গেলাম।
পাশের ঘরে হাজি মুরাদের গলা শোনা যাচ্ছিল। এলডার তার ডাকে জবাব দিয়ে তাড়াতাড়ি হাত মুছে বসার ঘরে গেল।
আপনাকে যেতে বলেছে, ফিরে এসে সে বলল।
লরিস-মেলিকভ আমুদে খান মাহোমাকে আরেকটা সিগারেট দিয়ে বসার ঘরে চলে গেল।
১৩
লরিস-মেলিকভ বসার ঘরে এলে হাজি মুরাদ উজ্জ্বল হাসি হেসে তাকে স্বাগত জানালেন।
আমরা শুরু করব? গদিতে আরাম করে বসে তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
হ্যাঁ, অবশ্যই, বলল লরিস-মেলিকভ। তোমার লোকদের সঙ্গে কথা বলছিলাম…একজন বেশ মজার!
হ্যাঁ, খান মাহোমা একটু চপল স্বভাবের।
তরুণ সুদর্শন ছেলেটাকে আমার পছন্দ হয়েছে।
ওহ, এলডার। সে তরুণ কিন্তু বেশ শক্ত–লোহায় বানানো।
তারা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল।
তাহলে আমি শুরু করি!
হ্যাঁ, হ্যাঁ।
তোমাকে বলেছি খানদের কীভাবে খুন করা হয়েছে…। তাদের খুন করে হামজাদ খুনজাখে এসে তাদের প্রাসাদ দখল করল। পরিবারের একমাত্র বেগম সাহেবাই বেঁচে ছিলেন। হামজাদ তাকে ধরে আনতে গেলে তিনি বাধা দেন। তখন হামজাদের ইশারায় তার মুরিদ আসেলদার পেছন থেকে ছুরি মেরে তাকে হত্যা করে।
তাকে হত্যা করল কেন? লরিস-মেলিকভের প্রশ্ন।
সে আর কী করতে পারত? সামনের পাগুলো যেদিকে যাবে, পেছনের পাকেও সেদিকেই যেতে হবে। সে পুরো পরিবারকে মেরে ফেলল। শামিল ছোট ছেলেটাকে পাহাড়ের চূড়া থেকে ছুঁড়ে ফেলল…
তারপর পুরো আভার হামজাদের কাছে নত হলো। কিন্তু আমার ভাই আর আমি ধরা দিলাম না। আমরা খানদের খুনের বদলে তাকে খুন করতে চেয়েছিলাম। আমরা ধরা দেওয়ার ভান করলাম কিন্তু আমাদের মাথায় এক চিন্তা, কীভাবে তাকে শেষ করব। আমার দাদার সঙ্গে আলাপ করলাম। ঠিক করলাম সে প্রাসাদের বাইরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। তারপর চোরাগোপ্তা হামলা করে তাকে খুন করব। কেউ একজন আমাদের কথা শুনে ফেলে হামজাদকে বলে দেয়। সে দাদাকে ধরে নিয়ে গেল। তাকে বলল, তোমার নাতিরা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, এটা যদি সত্য হয়, তাহলে তুমি এবং তারা ঘরের আড়াকাঠে ঝুলবে। আমি আল্লাহর কাজ করছি। এতে বাধা
দাদা বাড়ি এসে আমাদের বলল।
আমার আর দেরি করতে চাইলাম না। ঠিক করলাম, মসজিদে ঈদের দিন কাজ শেষ করব। আমাদের সহযোগীরা আসতে চাইল না। কিন্তু আমি আর আমার ভাই অনড়।
আমরা দুটো করে পিস্তল চাদরের ভেতর নিয়ে মসজিদে গেলাম। হামজাদ মসজিদে ঢুকল জনা তিরিশেক মুরিদ নিয়ে। তাদের সবার হাতে তলোয়ার। তার সবচেয়ে প্রিয় মুরিদ আসেলদার (যে বেগম সাহেবার মাথা কেটে আলাদা করেছিল) আমাদের দেখে ফেলল। চিৎকার করে আমাদের চাদর খুলতে বলে আমার দিকে এগিয়ে আসে। আমার হাতের ছোরা দিয়ে তাকে খুন করে আমি হামজাদের দিকে ছুটে যাই। আমার ভাই ওসমান এর মধ্যেই তাকে গুলি করেছিল। কিন্তু সে মরেনি। ছোরা হাতে আমার ভাইয়ের দিকে যাচ্ছিল। কিন্তু মাথায় ছোরা মেরে আমি তাকে শেষ করে দিলাম। মুরিদ ছিল তিরিশজন আর আমরা মাত্র দুজন। তারা আমার ভাই ওসমানকে মেরে ফেলল। আমি তাদের ঠেকিয়ে জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে পালিয়ে এলাম।
হামজাদ খুন হয়েছে জানতে পেরে সব লোক বিদ্রোহ করল। মুরিদরা পালিয়ে গেল; যারা পালায়নি, তাদের মেরে ফেলা হলো।
একটু থেমে হাজি মুরাদ লম্বা শ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন।
ওই পর্যন্ত ভালো ছিল, কিন্তু তারপর সব গোলমাল হয়ে গেল।
হামজাদের জায়গায় নিল শামিল। সে রুশদের বিরুদ্ধে আমাকে তার সঙ্গে যোগ দিতে খবর পাঠায়। আর আমি যদি না যাই, তাহলে সে খুনজাখ ধ্বংস করে আমাকে খুন করবে।
আমি যাব না জানিয়ে দিলাম আর বলে দিলাম, তাকেও আমার কাছে আসতে দেব না…।
তুমি তার সঙ্গে যোগ দিলে না কেন?
হাজি মুরাদ ভুরু কোচকালেন। সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন না।
আমি পারতাম না। আমার ভাই ওসমান আর আবু নুতসাল খানের রক্ত তার হাতে। আমি তার সঙ্গে যোগ দিলাম না। জেনারেল রোসেন আমাকে অফিসার বানিয়ে কমিশন দিলেন এবং আভার শাসন করতে বললেন। সেটা ভালোই ছিল। কিন্তু সেই রোসেনই প্রথমে মোহাম্মদ মির্জা, পরে আহমেদ খানকে কাজি-কুমুখের খান বানালেন। আহমেদ খান আমাকে ঘেন্না করত। সে বেগম সাহেবার মেয়ে সুলতানাকে তার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু বেগম সাহেবা দেননি। আহমেদ মনে করত, আমি তা হতে দিইনি…হ্যাঁ, আহমেদ খান আমাকে ঘেন্না করত। আমাকে খুন করতে লোক পাঠিয়েছিল কিন্তু আমি পালিয়ে যাই। তারপর সে আমার বিরুদ্ধে জেনারেল ক্লুগেনুর কান ভারী করে। সে তাকে বলে যে রুশ সৈন্যদের কাঠ না দিতে আমি সবাইকে বলেছি। সে আরও বলে যে আমি এটা পরি (সে পাগড়িতে হাত দিয়ে দেখাল)। তার মানে আমি শামিলের সঙ্গে যোগ দিয়েছি। জেনারেল তার কথা বিশ্বাস করেননি। আমাকে টোকাও না দিতে আদেশ দিলেন। কিন্তু জেনারেল তিবলিসে গেলে আহমেদ খান তার ইচ্ছেমতো কাজ করে। আমাকে গ্রেপ্তার করার জন্য একদল সৈন্য পাঠায়। আমাকে শিকল দিয়ে কামানের সঙ্গে বেঁধে রাখে।
আমাকে ওইভাবে রাখে ছয় দিন, তিনি বলে চলেন। সাত দিনের দিন আমাকে নিয়ে তারা তেমির-খান-শুরার দিকে রওনা হয়। চল্লিশজন সৈন্য। তাদের হাতে গুলিভর্তি বন্দুক। আমার হাত বাঁধা। আমি জানতাম, পালাতে চেষ্টা করলে তারা আমাকে মেরে ফেলবে।
আমরা মানসুহার কাছে পৌঁছালে পথটা খুব সরু হয়ে যায়। ডান দিকে একটা খাদ। প্রায় এক শ বিশ গজ গভীর। আমি ডান দিকে প্রায় কিনারে চলে গেলাম। একজন সৈন্য আমাকে থামাতে চেষ্টা করল। কিন্তু আমি তাকে টেনে সঙ্গে নিয়ে লাফ দিলাম। সে সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। আর আমি, দেখতেই পাচ্ছ, এখনো বেঁচে আছি।
পাঁজর, মাথা, হাত, পা সব ভেঙে গিয়েছিল! হামাগুড়ি দিতে চেষ্টা শরীর রক্তে ভেজা। একজন রাখাল আমাকে দেখতে পেয়েছিল। সে কিছু লোক জড়ো করে আমাকে একটা গ্রামে নিয়ে গেল। আমার পাজর আর মাথা সেরে গিয়েছিল। পা-ও। শুধু একটু খাটো হয়ে গেল, বলে হাজি মুরাদ তার খাটো পাটি মেলে দিলেন। এখনো এটা কাজ করে, ওটাই যথেষ্ট।
লোকজন খবর পেয়ে আমার কাছে আসতে লাগল। আমি সুস্থ হয়ে তসেলমেসে গেলাম। আভাররা আমাকে আবার তাদের শাসনভার নিতে বলল, হাজি মুরাদ শান্ত এবং আস্থার সুরে বললেন, আমি রাজি হলাম।
হাজি মুরাদ উঠে দাঁড়িয়ে জিনের থলে থেকে একটা ফোলিও বের করলেন। তার ভেতর থেকে দুটো রংচটা চিঠি বের করে একটা লরিস মেলিকভের হাতে দিলেন। জেনারেল ক্লুগেনুর লেখা। লরিস-মেলিকভ প্রথম চিঠিটা পড়ল। ওতে লেখা ছিল–
লেফটেন্যান্ট হাজি মুরাদ। তুমি আমার অধীনে কাজ করেছ এবং আমি তোমার ওপর সন্তুষ্ট। তোমাকে ভালো লোক মনে করি।
সম্প্রতি আহমেদ খান আমাকে জানিয়েছে যে তুমি একজন বিশ্বাসঘাতক, তুমি পাগড়ি নিয়েছ এবং শামিলের সঙ্গে তোমার যোগাযোগ আছে। তুমি লোকজনকে রুশ সরকারকে অমান্য করার শিক্ষা দিচ্ছ। আমি তোমাকে গ্রেপ্তার করে আমার কাছে আনার আদেশ দিয়েছি। কিন্তু তুমি পালিয়ে গিয়েছ। জানি না এতে তোমার ভালো হবে কি না, যেমন আমি জানি না তুমি দোষী না নির্দোষ।
এখন আমার কথা শোনো। তোমার বিবেক পরিষ্কার থাকলে, তুমি মহান জারের ব্যাপারে দোষী না হলে আমার কাছে এসো। কাউকে ভয় কোরো না। আমি তোমার রক্ষক। খান তোমার কিছুই করতে পারবে না। সে নিজে আমার অধীন, তাই তোমার ভয় করার কিছু নেই।
ক্লুগেনু আরও লিখেছিল যে সে সব সময় তার কথা রাখে এবং ন্যায়বিচার করে, সে আবারও হাজি মুরাদকে তার সামনে হাজির হতে পরামর্শ দেয়।
লরিস-মেলিকভের পড়া শেষ হলে হাজি মুরাদ দ্বিতীয় চিঠিটা দেওয়ার আগে তিনি প্রথমটার কী জবাব দিয়েছিলেন বলেন।
আমি লিখেছিলাম, আমি শামিলের জন্য পাগড়ি পরি না। আমার আত্মার জন্য, মুক্তির জন্য পরি। আমি শামিলের কাছে যেতে চাই না বা পারিও না। কারণ সে আমার বাবা, আমার ভাই এবং আত্মীয়দের মৃত্যুর কারণ। কিন্তু আমি রুশদের সঙ্গেও যোগ দিতে পারি না। কারণ, তারা আমার অসম্মান করেছে। (খুনজাখে আমাকে যখন বেঁধে রাখা হয়েছিল, তখন এক হারামজাদা আমার ওপর থুতু ছিটিয়েছিল। ওই লোকটাকে না মারলে আমি আপনার সঙ্গে যোগ দিতে পারি না। তার ওপর আমি মিথ্যুক আহমেদ খানকে ভয় পাই।
তখন জেনারেল আমাকে এই চিঠিটি লেখেন, রংচটা দ্বিতীয় চিঠিটি লরিস-মেলিকভের হাতে দিয়ে বললেন হাজি মুরাদ।
তুমি আমার প্রথম চিঠির জবাব দিয়েছ বলে ধন্যবাদ। লরিস-মেলিকভ পড়ছিল। তুমি লিখেছ, তুমি ফিরে আসতে ভীত নও। কিন্তু একজন অমুসলমান তোমাকে অপমান করায় আসতে পারছ না। কিন্তু আমি আশ্বস্ত করতে পারি, রুশ আইনে ন্যায়বিচার হয়। তুমি দেখতে পাবে তোমার চোখের সামনে অপমানকারীর শাস্তি হবে। আমি এরই মধ্যে ঘটনাটা তদন্তের আদেশ দিয়েছি।
কথা শোনো, হাজি মুরাদ! আমার কথা এবং আমার ওপর বিশ্বাস না করার জন্য তোমার ওপর অসন্তুষ্ট হওয়ার অধিকার আমার আছে। কিন্তু আমি ক্ষমা করে দিচ্ছি। কারণ, আমি জানি পাহাড়িদের সন্দেহবাতিক কেমন। তোমার বিবেক যদি পরিষ্কার হয় এবং তোমার পাগড়ি পরা যদি আত্মার মুক্তির জন্য হয়, তাহলে তুমি ঠিক। এবং আমার ও রুশ সরকারের দিকে সরাসরি তাকাতে পারবে। যে তোমার অপমান করেছে, তার শাস্তি হবে, কথা দিচ্ছি। তোমার সম্মান তোমাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। তুমি দেখবে রুশ আইন কী। তার ওপর আমরা রুশরা সবকিছু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখি। কোনো বদমাশ তোমার অপমান করেছে বলে আমাদের কাছে তোমার দাম কমে যায়নি।
আমি নিজে শিমরিস্তদের পাগড়ি পরার অনুমতি দিয়েছি। আমি তাদের কাজ-কারবার সঠিক দৃষ্টিতে দেখি। তাই আমি আবারও বলছি, তোমার ভয়ের কিছু নেই। যে লোকটার মাধ্যমে এই চিঠি পাঠাচ্ছি, তার সঙ্গে আমার কাছে এসো। সে আমার বিশ্বস্ত এবং তোমার শত্রুদের দাস নয়। সরকারের বিশেষ সুবিধা পায়, এমন একজনের বন্ধু।
ক্লুগেনু হাজি মুরাদকে তার কাছে যেতে রাজি করানোর জন্য আরও অনেক কিছু লিখেছে।
আমি তাকে বিশ্বাস করিনি, লরিস-মেলিকভ পড়া শেষ করলে হাজি মুরাদ বললেন। ক্লুগেনুর কাছে যাইনি। আহমেদ খানের ওপর নিজে প্রতিশোধ নেওয়াই আমার কাছে বড় ছিল। রুশদের মাধ্যমে আমি তা করতে পারতাম না। তখন আহমেদ খান তসেলমেস ঘেরাও করে আমাকে ধরতে বা মেরে ফেলতে চায়। আমার তখন গুটিকয় লোক। তাকে ঠেকাতে পারতাম না। ঠিক তখন আমার কাছে একজন দূত এল শামিলের চিঠি নিয়ে। আহমেদ খানকে পরাজিত করে মেরে আমাকে পুরো আভারের শাসনভার দেওয়ার প্রস্তাব। আমি অনেকক্ষণ চিন্তা করে শামিলের কাছে যাই। তারপর থেকে সব সময় রুশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি।
এখানে হাজি মুরাদ যুদ্ধে তার কীর্তিকলাপের বিবরণ দেন, যার অনেক কিছুই লরিস-মেলিকভ জানত। তার সব আক্রমণ ও হামলা উল্লেখযোগ্য ছিল অসম্ভব দ্রুত চলাচলের জন্য এবং তীব্র আক্রমণের জন্য। তিনি সব সময় জয়ের মুকুট পেয়েছেন।
আমার ও শামিলের মধ্যে কখনো বন্ধুত্ব ছিল না, তার কাহিনি শেষে হাজি মুরাদ বললেন। সে আমাকে ভয় পেত এবং আমাকে তার দরকার ছিল। কিন্তু আমাকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো শামিলের পর কে ইমাম হবে, তখনই ঘটনাটা ঘটল। আমি জবাব দিলাম, যার তলোয়ারে সবচেয়ে বেশি ধার, সে ইমাম হবে!
কথাটা শামিলের কানে ভোলা হয়েছিল এবং সে আমাকে বাদ দিতে চেয়েছিল। সে আমাকে তাসবাসারানে পাঠায়। আমি গিয়ে এক হাজার ভেড়া এবং তিন শ ঘোড়া দখল করলাম। কিন্তু সে বলল আমি ঠিক কাজ করিনি এবং আমাকে নায়েবের পদ থেকে বরখাস্ত করল। সব টাকা তাকে পাঠানোর আদেশ দিল। আমি এক হাজার সোনার মুদ্রা পাঠালাম। সে তার মুরিদদের। পাঠিয়ে আমার সব সম্পত্তি নিয়ে গেল। তার কাছে যেতে আদেশ করল। জানতাম আমাকে মেরে ফেলবে, তাই আমি যাইনি। তারপর সে আমাকে ধরে নিতে পাঠাল। আমি বাধা দিয়ে ভরসভের কাছে গেলাম। আমি পরিবার সঙ্গে নিয়ে যাইনি। আমার মা, স্ত্রী এবং ছেলে তার হাতে। সরদারকে বলল, আমার পরিবার শামিলের হাতে থাকলে আমি কিছু করতে পারব না।
আমি তাকে বলব, লরিস-মেলিকভ বলল।
কষ্ট হলেও চেষ্টা কোরো! আমার যা কিছু আছে, সবই তোমার। শুধু প্রিন্সের কাছে আমার পক্ষে বলে আমাকে সাহায্য করো! আমি বাঁধা পড়ে আছি, আর দড়ির অন্য দিক শামিলের হাতে, তার কাহিনি শেষ করে বললেন হাজি মুরাদ।
১৪
২০ ডিসেম্বর ভরন্তসভ সমর বিভাগের মন্ত্রী চেরনিসভকে নিচের চিঠিটি লেখেন। চিঠিটি ফরাসি ভাষায় লেখা ছিল :
প্রিয় প্রিন্স, গত ডাকে আপনাকে চিঠি লিখিনি। কারণ, হাজি মুরাদকে নিয়ে আমরা কী করতে পারি, আমি প্রথমে সে সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েছিলাম। তা ছাড়া গত দু-তিন দিন আমি খুব সুস্থ ছিলাম না।
আগের চিঠিতে হাজি মুরাদের এখানে আসার খবর আপনাকে জানিয়েছি। সে আট তারিখে তিবলিসে আসে। আমার সঙ্গে দেখা হয় তার পরের দিন। পরের সাত-আট দিনে আমি তার সঙ্গে কথা বলেছি। ভেবেছি আমরা ভবিষ্যতে তাকে কীভাবে ব্যবহার করতে পারি। বিশেষ করে এখন আমরা তাকে নিয়ে কী করব। সে তার পরিবারের ভাগ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন। প্রতিবারই সে খোলাখুলি বলেছে তারা শামিলের হাতে থাকলে তার নড়ার শক্তি নেই এবং আমাদের জন্য কিছু করতে পারবে না। তাকে যে যত্ন করা হচ্ছে বা ক্ষমা করা হচ্ছে, তার জন্যও সে কৃতজ্ঞতা দেখাতে পারছে না।
প্রিয় মানুষদের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা তাকে অসুস্থ করে ফেলছে। তার কাজ করার জন্য যাদের লাগিয়েছি, তারা আমাকে বলেছে সে রাতে ঘুমায় না। খায় খুব কম আর সারাক্ষণ নামাজ পড়ে। সব সময় কিছু কসাক নিয়ে বের হওয়ার অনুমতি চায়। এটাই তার একমাত্র বিনোদন এবং কায়িক শ্রম হতে পারে। সারা জীবনের অভ্যাস বলে সেটা তার প্রয়োজন। প্রতিদিন সে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে তার পরিবারের কোনো খবর আছে কি না। শামিলকে আমাদের হাতে বন্দীদের বিনিময়ে তার পরিবারকে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব পাঠাতে বলে। সে কিছু টাকাও দিতে চায়। সে জন্য তাকে টাকা দেওয়ার মতো লোক আছে। সে সব সময় আমাকে বলে, আমার পরিবারকে বাঁচান এবং আমাকে আপনাদের সেবা করার সুযোগ দিন (তার মতে সে ভালো হবে লেসঘিয়ান রেখায়), আর এক মাসের মধ্যে যদি আপনাদের কোনো কাজে না আসি, তাহলে আপনাদের যা খুশি শাস্তি দিতে পারেন। আমি বলেছি, এগুলো আমার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়। কিন্তু তার পরিবার পাহাড়ি এলাকায় থাকলে এবং আমাদের হাতে পণবন্দী না থাকলে আমাদের মধ্যে অনেকেই তাকে বিশ্বাস করবে না। আরও বলেছি, আমাদের সীমান্তে সব বন্দীকে এক জায়গায় আনার জন্য সম্ভব সবকিছু করছি। তার পরিবারের মুক্তিপণ হিসেবে সে যা জোগাড় করতে পারবে, তার সঙ্গে যোগ করার জন্য আমাদের আইনে আমি তাকে টাকা দিতে পারব না। কিন্তু তাকে সাহায্য করার জন্য হয়তো অন্য কোনো উপায় বের করা যেতে পারে। তারপর আমি তাকে খোলাখুলি বলেছি যে আমার মতে শামিল তার পরিবারকে কোনোভাবেই ছাড়বে না। বরং শামিল তাকে ক্ষমা করে তার আগের পদ ফিরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিতে পারে। আর হাজি মুরাদ ফিরে না গেলে তার মা, স্ত্রী ও ছয় সন্তানকে মেরে ফেলার হুমকি দিতে পারে। আমি তাকে খোলাখুলি জিজ্ঞেস করেছি শামিলের কাছ থেকে এমন ঘোষণা এলে সে কী করবে। হাজি মুরাদ তার চোখ এবং হাত দুটো ওপরের দিকে তুলে বলেছে, সবই আল্লাহর হাতে। কিন্তু সে কখনো শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করবে না। কারণ, সে নিশ্চিত জানে, শামিল তাকে ক্ষমা করবে না। তাই সে বেশি দিন বেঁচে থাকতে পারবে না। তার পরিবারকে মেরে ফেলার ব্যাপারে তার মন্তব্য শামিল হয়তো অতটা বোকা হবে না। কারণ, প্রথমত, সে চাইবে না হাজি মুরাদ আরও মরিয়া ও বিপজ্জনক শত্রু হোক। দ্বিতীয়ত, দাগেস্তানে অনেকে, অনেক প্রভাবশালী লোক আছে, যারা শামিলকে ওই রকম কাজে বিরত করবে। সবশেষে সে কয়েকবার বলেছে আল্লাহ তার জন্য ভবিষ্যতে যা-ই রেখে থাকুন না কেন, এখন সে তার পরিবারের মুক্তি ছাড়া আর কিছুতে আগ্রহী নয়। সে আমাকে আল্লাহর নামে তাকে সাহায্য করার এবং তাকে চেচনিয়ার কাছাকাছি যেতে অনুমতি দেওয়ার অনুরোধ করেছে। সেখান থেকে আমাদের কমান্ডারদের অনুমতি ও সাহায্য নিয়ে সে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ও নিয়মিত খবর পেতে চায়। তাদের উদ্ধার করার সবচেয়ে ভালো উপায় কী, বের করতে চায়। সে বলেছে, ওই এলাকার কিছু লোক, এমনকি কিছু নায়েব তার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে ঘনিষ্ঠ এবং ওই এলাকায় রাশিয়ার অধীন অথবা নিরপেক্ষ লোকদের মধ্য থেকে আমাদের সাহায্য নিয়ে সে সম্পর্ক করতে পারবে, যা তার স্বপ্ন সফল করতে কাজে লাগবে। যে স্বপ্ন তার দিনরাত্রির ঘুম কেড়ে নিয়েছে। সে সফল হলে সহজে আমাদের উপকারের জন্য কাজ করতে পারবে এবং আমাদের আস্থা অর্জন করতে পারবে।
সে চাচ্ছে তাকে বিশ-ত্রিশজন বাছাই করা কসাকের পাহারায় গ্রজনিতে পাঠিয়ে দেওয়া হোক। কসাকরা তাকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা এবং আমাদের বিশ্বস্ত রাখার নিশ্চয়তা হিসেবে কাজ করবে।
প্রিয় প্রিন্স, আপনি বুঝতে পারছেন এসব কারণে আমি কী করব, বুঝে উঠতে পারছি না। কারণ, আমার ওপর দায়িত্ব অনেক। তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করা হবে হঠকারিতা। তার পালানোর সব পথ বন্ধ করতে হলে আটক রাখতে হবে। আমার মতে, তা অন্যায় হবে এবং কৌশলেও ভুল হবে। ওই রকম ঘটনার খবর খুব তাড়াতাড়ি পুরো দাগেস্তানে ছড়িয়ে পড়বে। তাতে যারা কমবেশি প্রকাশ্যে শামিলের বিরোধিতা করতে চাচ্ছে (সংখ্যায় তারা অনেক) বা যারা ইমামের সবচেয়ে সাহসী ও ঝুঁকি নিতে আগ্রহী নায়েব, তারা হাজি মুরাদ আমাদের কাছে আসার পর তার সঙ্গে আমাদের ব্যবহারের ওপর লক্ষ রাখছে এবং তাদের পিছিয়ে রাখলে আমাদের ভীষণ ক্ষতি হবে। আমরা হাজি মুরাদকে একজন বন্দী হিসেবে রাখলে পরিস্থিতির সবচেয়ে ভালো ফল হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাই আমি মনে করি, আমি যা করেছি, তার চেয়ে ভিন্ন কিছু করা যেত না। একই সঙ্গে আমি মনে করি হাজি মুরাদ আবার পালানোর কথা মাথায় আনলে আমাকেই বিরাট ভুলের জন্য দায়ী করা হবে। এই চাকরিতে এবং বিশেষ করে এ ধরনের জটিল পরিস্থিতিতে কোনো ঝুঁকি, ভুল বা দায়িত্ব ছাড়া কোনো সহজ উপায় পাওয়া অসম্ভব না হলেও খুব কঠিন। কিন্তু একবার সঠিক মনে করে কোনো পথ ধরলে তা অবশ্যই চালিয়ে যেতে হবে।
প্রিয় প্রিন্স, এই বিষয়টি মহামহিম সম্রাটের বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করতে আপনাকে অনুরোধ করছি। আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় সম্রাটকে আমার পদক্ষেপ সন্তুষ্ট করলে আমি খুব খুশি হব।
আমি ওপরে যা লিখেছি, তা জেনারেল জাভোদভস্কি এবং জেনারেল কলোভস্কিকেও লিখেছি, যা থেকে পরের জন হাজি মুরাদের সঙ্গে সরাসরি আলাপের নির্দেশনা পেতে পারেন। আমি হাজি মুরাদকে কজলোভস্কির অনুমতি ছাড়া কোনো কাজ করতে বা কোথাও যেতে নিষেধ করেছি। আমি তাকে আমাদের সেনাদলের সঙ্গে বের হতে বলেছি। তা না হলে তাকে আটক করা হয়েছে, শামিল এমন গুজব রটাতে পারে। একই সঙ্গে আমি তাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছি যে সে ভজভিঝেনস্কে যাবে না। কারণ, সে আমার ছেলের কাছে প্রথম আত্মসমর্পণ করে তাকে বন্ধু বানিয়েছে কিন্তু আমার ছেলে সেখানকার কমান্ডার নয় এবং সহজেই ভুল-বোঝাবুঝি হতে পারে। যা-ই হোক, ভজভিঝেনস্ক ঘন জনবসতির শত্রুভাবাপন্ন এলাকার বেশি কাছে এবং সে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে যা চায়, তার জন্য গ্রজনিই সব দিক থেকে উপযুক্ত।
তার অনুরোধে বিশজন কসাককে দেওয়ার পরও তার সঙ্গে ক্যাপ্টেন লরিস-মেলিকভকে দিয়েছি। সে একজন চমৎকার অত্যন্ত বুদ্ধিমান অফিসার। সে তাতার বলতে পারে এবং হাজি মুরাদকেও ভালো করে জানে। হাজি মুরাদও তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে বলে মনে হয়। হাজি মুরাদ দশ দিন এখানে থাকার সময় লেফটেন্যান্ট কর্নেল প্রিন্স তারখানভের সঙ্গে একই বাড়িতে ছিল। তারখানভ সুশিন জেলার কমান্ডার এবং সার্ভিসের কাজে এখানে আছে। সে সত্যি একজন যোগ্য লোক, তার ওপর আমার পুরো আস্থা আছে। সে-ও হাজি মুরাদের আস্থা অর্জন করেছে। সে খাঁটি তাতার জানে বলে তার মাধ্যমেই আমরা গোপন ও খুঁটিনাটি বিষয় আলাপ করেছি। আমি হাজি মুরাদের বিষয়ে তারখানভের সঙ্গে আলাপ করেছি। সে-ও একমত যে আমি যা করেছি, সেটাই করা দরকার ছিল অথবা হাজি মুরাদকে জেলে ঢুকিয়ে কড়া পাহারায় রাখতে হতো। (কারণ একবার তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে তাকে আটকে রাখা সহজ হতো না), আর তা না হলে তাকে দেশ থেকে বের করে দিতে হতো। কিন্তু পরের দুটোর যেকোনো একটা করলে শামিলের সঙ্গে হাজি মুরাদের ঝগড়ার ফলে আমরা যা সুবিধা পাচ্ছি, তা নষ্ট হয়ে যেত। আর ভবিষ্যতে শামিলের বিরুদ্ধে লোকের বিদ্রোহ বন্ধ হয়ে যেত। প্রিন্স তারখানভ আমাকে বলেছেন যে তার মনে হাজি মুরাদের সত্যবাদিতা নিয়ে সন্দেহ নেই এবং শামিল তাকে ক্ষমা করবে না এবং ক্ষমা করার ওয়াদা না করে মেরে ফেলবে, হাজি মুরাদের এমন বিশ্বাসের ব্যাপারেও তারখানভের নিজের কোনো সন্দেহ নেই। হাজি মুরাদের সঙ্গে মেশার সময় একমাত্র যে বিষয়টি উদ্বেগের বলে তার নজরে এসেছে, তা হলো হাজি মুরাদের ধর্মভক্তি। তারখানভ মানেন যে শামিল হয়তো সেদিক দিয়ে তার ওপর প্রভাব খাটাতে পারে। কিন্তু আমি আগেই যেমন বলেছি, শামিল হাজি মুরাদকে জীবনে তার কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য রাজি করাতে পারবে না।
প্রিয় প্রিন্স, আমাদের এখানকার বিষয়ে আপনাকে এটাই জানানোর ছিল।