১০. প্রাচীন ভারতবর্ষে শান্তি-র সংজ্ঞা

প্রাচীন ভারতবর্ষে শান্তি-র সংজ্ঞা

শান্তি’ কাকে বলে? নঞর্থক ব্যাখ্যার সাহায্যে এ প্রশ্নের সমাধান সূত্র পেতে পারি। ‘শান্তি’র অভাবে দেখা যায় অনৈক্য, অস্থিরতা এবং দ্বন্দ্ব; সুতরাং শান্তি নির্ভর করে সঙ্গতিবোধ, নিরুপদ্রবতা ও সৌহার্দ্যপুর্ণতার উপর। এর বিভিন্ন প্রকারভেদ দেখা যায়: ব্যক্তিগত, পারিবারিক, কৌমগত, সমাজগত এবং রাজনৈতিক। বর্তমান সময়ে বিশ্বযুদ্ধের পথে পৃথিবী এক সামগ্রিক অবলুপ্তির সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়েছে; তাই, আজ মানবজাতির ভবিষ্যৎ কর্মপন্থায় অত্যন্ত প্রাধান্যের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে শান্তি। একবার পুনর্বিচার করে দেখা যেতে পারে প্রাচীন ভারতে শান্তি’র সংজ্ঞা কী ভাবে নির্ধারিত হয়েছে।

ভারতবর্ষে প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋগবেদ-এ পারিবারিক শান্তির জন্য কয়েকটি প্রার্থনা দেখা যায়। ৩:৬] সূক্তে দেখা যায় অসঙ্গতিপূর্ণ যে সব সম্পর্ক সেখানে বিবাদ ভঞ্জনের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। শেষতম সূক্ত (১০:১৯১)-তে বলা হয়েছে:

সমবেত হও সকলে সমসুরে, কথা বল; তোমাদের মন ঐক্যবদ্ধ হোক; যেমন করে পূর্বকালে দেবতারা সুষম ভাবে তাঁদের অর্ঘ্যের ধর্মীয় অংশগ্রহণ করতেন। তোমাদের মতামত এক হোক; তোমাদের সভা এক হোক তোমাদের সংকল্প, হৃদয় এক হোক; যেন তোমরা একত্রে দীর্ঘকাল বাস কর— ঐক্যে ও সংহতিতে।।[১]

অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালে রচিত বৈদিক সংহিতা অথর্ববেদ-এ কয়েকটি ‘সমভাববিষয়ক’ সূক্তের দেখা পাওয়া যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে যেটি বিখ্যাত (৩:৩০), সেখানে বলা হয়েছে:

আমি তোমাদের ঐক্যবদ্ধ হৃদয়ে ও মনে বিদ্বেষ রহিত করি; একে অপরকে ভালবাস, যেমন গাভী ভালবাসে তার বৎসকে, যাকে সে জন্ম দিয়েছে; পুত্র পিতার অনুগামী হোক, মাতার সমমনস্ক হোক… পত্নী স্বামীর প্রতি নম্র এবং মধুর ভাষিণী হোক ভ্রাতা যেন কখনও ভ্রাতার প্রতি দ্বেষ না করে; অথবা ভগ্নী ভগ্নীকে আঘাত না করে; হৃদয়ে এবং কার্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একত্রে প্রীতিপূর্ণ ভাবে সমান আচরণ কর…নম্র ভাবে সর্ব কার্যে, পরিকল্পনায় ঐক্যবদ্ধ হও… মধুর বাক্যে এক চিত্তে, সংঘবদ্ধ ভাবে সমমনস্কতায়।[২]

একই ভাব প্রতিফলিত হয়েছে অন্য সূক্তগুলিতেও। (১-৩, ৬, ৭৪:২; ৬:৯৪:১-৩)।[৩] মানুষ সমগ্র প্রকৃতির কাছে প্রার্থনা করেছে শান্তিপূর্ণ ভাবে মানুষের প্রতি সদয় আচরণ করার জন্য। বন্ধুর সঙ্গে ঐক্য রেখে বাস করা কঠিন নয়; কিন্তু প্রাচীন ভারত উপলব্ধি করেছিল অপরিচিতদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়া কত কঠিন। কিন্তু এ কথাও সে বুঝেছিল, যতই কঠিন হোক এই কাজ সাধন করতেই হবে। তাই এই প্ৰাৰ্থনা:

হে আমার অন্তরাত্মা, ভয় কোর না, যেহেতু আকাশ ও পৃথিবী ভীত হয় না; যেমন দিন এবং রাত্রি…সূর্য এবং চন্দ্র…ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয়…সত্য আর অসত্য….অতীত আর বর্তমান ভীত হয় না।[৪]

শান্তির জন্য যে প্রার্থনা করে তার পক্ষে কঠিনতম কাজ হল ‘যারা আমাদের আপন তাদের সঙ্গে যেন এক হতে পারি এবং যারা আমাদের থেকে ভিন্ন তাদের সঙ্গেও যেন এক হতে পারি।[৫]

একটি সূক্তে প্রার্থনা করা হয়েছে:

‘প্রশান্ত দ্যৌ, প্রশান্ত পৃথিবী, প্রশান্ত অন্তরীক্ষ ও ভূমি,
জলাধারের জলভার প্রশান্ত, আমাদের জল প্রশান্ত,
আমাদের ওষধি প্রশান্ত হোক…যা কিছু ঘোর,
যা কিছু ক্রুর, যা পাপ সব কিছু হোক
প্রশমিত, শুভ; সব কিছু প্রশান্ত হোক।’[৬] (অথর্বসংহিতা ১৯.৯)

প্রাচীন মানুষ অন্তরীক্ষবাসী এক শক্তির অস্তিত্ব কল্পনা করেছিল এবং বারংবার সেই শক্তির কাছে প্রার্থনা করেছিল সহৃদয় বদান্যতা।[৭] বিবাহে, দম্পতির মধ্যেও পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ, সুসমঞ্জস্য ঐক্যের প্রার্থনা করা হয়েছে।[৮]

যখন কোনও বিদ্যার্থী তার গুরুর কাছে আনুষ্ঠানিক দীক্ষা প্রাপ্ত হয় তখন গুরু শিষ্য উভয়েই শিক্ষাকালীন দীর্ঘ সময়ের জন্য পারস্পরিক সম্পর্কের সামঞ্জস্যের জন্য প্রার্থনা করেন। এই সময়টুকুতে এবং তাদের জীবৎকালের জন্যও শিক্ষক ছাত্রের পিতৃতুল্য। এই ভাবে প্রার্থনার মধ্যে তাদের সামাজিক সম্পর্কের সমগ্র সময়টুকুই সূচিত হয়। গোষ্ঠীগত জীবনে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, ঘৃণা ও প্রতিযোগিতা সহজেই দেখা যেত। এমনকী যখন যাযাবর আর্যরা দেশীয় জনগোষ্ঠীকে পরাজিত করে কৃষিজীবীর জীবনধারায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়ল তখন আন্তঃগোষ্ঠী দ্বন্দ্বের অসংযত উচ্ছ্বাস বহু দেখা যেত। তবু তারা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করে, সমৃদ্ধির মূল শর্ত হল শান্তি। তাই শান্তি রক্ষার প্রচেষ্টা দেখা গেল। যুদ্ধের এমনকী জয়ের অভিজ্ঞতা ছিল তিক্ত।

বিখ্যাত সম্রাট অশোক। তাঁর কলিঙ্গ যুদ্ধের রক্তক্ষয়ী করুণ অভিজ্ঞতার পরে এ রকমই তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন।[৯] ফলত যুদ্ধ ত্যাগ করে তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন, প্রজাদের মধ্যে অহিংসা প্রচার করেন এবং নির্মম বিচারকের পরিবর্তে স্নেহময় পিতার মতো শাসন পরিচালনা করতে থাকেন। তক্ষশিলা স্তম্ভে তার আরামায়িক শিলালিপিতে বলা হয়েছে: ধর্ম হচ্ছে সৃষ্টির জন্য, প্রাণীদের জন্যে অনাঘাত যা কিছু অহিংসা তারই জন্যে।[১০] গ্রিক ভাষায় রচিত তাঁর কান্দাহার লিপিতে আছে: ‘যারা এখানে বসবাস করতেন তাঁরা ভালবাসতেন এবং বন্ধু ও স্বজনদেরকে পরস্পরকে প্রতারণা থেকে বিরত থাকতেন, ক্রীতদাস ও ভৃত্যদের প্রতি যথাসম্ভব কোমল ব্যবহার করতেন— যদি এঁদের মধ্যে কারও মৃত্যু হত বা দেশান্তরিত হতে হত তবে সে ঘটনা অন্যদের কাছে ব্যক্তিগত বেদনার মতোই অনুভূত হত।’ তাঁর প্রস্তর লিপি ৪ (কালসি) বলে, ‘সম্রাট প্রিয়দর্শী নির্মিত দয়ার বিধি… সর্ব জীবনে হিংসা পরিহার।’ নবম প্রস্তর লিপি বলে, ‘ক্রীতদাস ও ভৃত্যের প্রতি ন্যায্য ব্যবহার, গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা, জীবিত প্রাণীর প্রতি (হিংসায়) সংযম।’ ত্রয়োদশ শিলালিপি ঘোষণা করে, ‘দেবগণের প্রিয়’ আকাঙ্ক্ষা করেন সর্বজীবের হিংসা হতে মুক্তি, আত্মসংযম, যথাযথ আচরণ ও মৃদুতা।

প্রকৃতপক্ষে এ ঘটনা উল্লেখযোগ্য যে, ভারতবর্ষের ইতিহাসে যে প্রথম সম্রাট এক বিশাল ভূখণ্ডের অধীশ্বর ছিলেন এবং যিনি এক অশুভ-রক্তস্নানের মাধ্যমে প্রতিবেশী রাজ্য কলিঙ্গকে পরাজিত করে নিজের রাজ্যসীমা বাড়িয়েছিলেন, তিনিই যুদ্ধলোভী, রাজ্যখণ্ডপিপাসু সম্রাটদের গতানুগতিক পথকে পরিত্যাগ করেছিলেন। অশোকের পক্ষে এই রকম একটি যুদ্ধের রক্তক্ষয়ী অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট ছিল; তিনি তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় দিগ্বিজয়ী চক্রবর্তী সম্রাটের পথ পরিত্যাগ করলেন এবং অহিংসা, সাম্য ও শান্তির পথ অবলম্বন করলেন।

জীবনে অমঙ্গলের মূলোচ্ছেদ করার জন্য বুদ্ধদেব যে মার্গ নির্দেশ করেছিলেন সেই পথই অশোক বেছে নিলেন: অমঙ্গলের এই উৎস ছিল আকাঙ্ক্ষা, ‘তন্হা’ (তৃষ্ণা)— যার প্রেরণায় মানুষ নূতন থেকে নূতনতর বস্তু প্রাপ্তির জন্য চেষ্টা করে। যখন সহজে এই আকাঙ্ক্ষা নিবৃত্তি হয় না, তখন সংঘর্ষ হয়ে পড়ে অনিবার্য। উচ্চাশার মূলে আছে আকাঙ্ক্ষা, আকাঙ্ক্ষা আত্মকেন্দ্রিক এবং এই আত্মবোধের পুষ্টি হতে পারে কেবল প্রতিদ্বন্দ্বীর স্বার্থকে আঘাত করে, বিনষ্ট করে। যখন নিজের আত্মস্বার্থের সন্ধানে প্রণোদিত মানুষ ধাক্কা খায় তখন প্রতিদ্বন্দ্বীর বিনিময়েও মানুষকে নিজের স্বার্থ সন্ধানে প্রবৃত্ত করে তার অহংকার এবং এই অহংকারের ভিত্তি হল তার নিজের মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করার নির্মম উচ্চাশা।

কারণ, ব্যক্তিগত মর্যাদাকে অতিক্রম করে যে সমষ্টিগত মর্যাদাবোধের মহত্তর প্রতিষ্ঠা, মানুষকে সে কথা শেখানো হয়নি। তার নিজের সংগ্রাম শুধু সংকীর্ণ, নিষ্ঠুর, নিরন্তর। এই আত্মপ্রতিষ্ঠার তাড়না যত বেশি, বিপর্যয় আর বিনাশ ততই বৃহত্তর। দুটি বিশ্বযুদ্ধ আমাদের সামনে সুস্পষ্ট করে দিয়েছে যে, জাতীয় আত্মম্ভরিতার সংঘর্ষ মানবতার কত সুদূরপ্রসারী বিনাশ করতে পারে। যুদ্ধ শেষ হয়, সই হয় শান্তির সন্ধি, ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। কিন্তু ক্ষতস্থান কখনও নিরাময় হয় না, তার চিহ্ন থেকে যায়। তবু এখনও কোনও কোনও মহাশক্তি, অদ্ভুত সাবলীলতায় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিকল্পনা করতে থাকে; নির্লজ্জ স্পর্ধায় তারা বিশ্বজনীন ধ্বংসের পথে দ্রুত ধাবমান হতে চায়।

ধ্রুপদী সংস্কৃত নাটকে কোনও চরিত্রের মুখে একটি অন্ত-শ্লোক উচ্চারণের প্রথা আছে, তাকে বলা হয় ‘ভরতবাক্য’। মঞ্চস্থ অন্যান্য কুশীলবের প্রতি, সেই সঙ্গে অন্যান্য দর্শকদের প্রতি এটি প্রযোজ্য। অন্য ভাবে বলা যায়, এই প্রার্থনাগুলি সমগ্র গোষ্ঠীর মনোবাসনাকে রূপায়িত করে। প্রায়ই দেখা যায় এই সব ‘ভরতবাক্য’-তে সমষ্টির শান্তি ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করা হয়েছে। প্রাচীন নাট্যকার ভাস, তাঁর অবিমারকনাটকের শেষে বলেছেন: ‘যেন পৃথিবীর সমস্ত প্রজা সুখে থাকে।[১১] তাঁর কর্ণভার নাটকের সমাপ্তিতে বলছেন: তোমরা সকলে সুখে সমৃদ্ধিতে থাক, সর্ব বিঘ্ন বিনাশ হোক, রাজোচিত গুণসম্পন্ন রাজা পৃথিবী শাসন করুন। মহাবীর চরিতের সমাপ্তি অংশটি গুরুত্বপূর্ণ: যেন জ্ঞানী ব্যক্তিগণ তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বীর কার্যকলাপে আনন্দ খুঁজে পান।

কালিদাস, তাঁর বিক্রমোর্বশীয় এবং অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ নাটক শেষ করছেন এই প্রার্থনা দিয়ে, যেন সুশাসক রাজা দৃঢ় হাতে, ন্যায্য ভাবে প্রজাদের যৌথ সমৃদ্ধি ও একত্র বিকাশের জন্য সুশাসন করেন। তাঁর মালবিকাগ্নিমিত্র নাটক সমাপ্তিতে বলা হয় :

‘সমগ্র জগৎ সুখী হোক; সর্ব প্রাণীকুল অপরের কল্যাণে নিজেদের উৎসর্গ করুক; অমঙ্গল বিনষ্ট হোক, সর্বত্র সকলে আনন্দিত হোক।’

বৌদ্ধ বিষয়বস্তু নিয়ে রচিত শ্রীহর্ষের নাগানন্দ নাটকের সমাপ্তি হচ্ছে এই বাক্য দিয়ে যেন সকল প্রাণী (প্রজাগণ), সর্ব বিপন্মুক্ত হয়ে সৎকর্মে রত থাকে এবং বিদ্বেষশূন্য চিত্তে, ঘনিষ্ঠ বন্ধুমণ্ডলীর মধ্যে আনন্দ উপভোগ করে

এখানে নাট্যকার আনন্দের মূল সুরটির সন্ধান পেয়েছেন। ‘বিদ্বেষশূন্য চিত্তে’ এবং ‘সৎকর্মে আত্মনিয়োগ করা’—কেবলমাত্র এগুলির মাধ্যমেই সামগ্রিক শান্তি ও সুখলাভ নিশ্চিত হতে পারে আর এই পথেই আনা যায় সমষ্টির শান্তি।

ভারতবর্ষে যুদ্ধ ও শান্তির শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্য গ্রন্থ এ দেশের, সম্ভবত পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য— মহাভারত। এখানে কুরুসিংহাসনের অধিকার নিয়ে দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী ভ্রাতৃসম্পর্কিত বংশধারার মধ্যে নিষ্ঠুর, রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম হয়েছিল। যখন বিপুল ধ্বংসের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শেষ হল, তখন স্বজনের রক্তমাখা পথে হেঁটে যে সিংহাসন তাঁরা জয় করেছেন সেই সিংহাসনে বসতে বিজয়ীরা বিতৃষ্ণা অনুভব করলেন। বিজয় তার গৌরব হারাল। তাদের অভিজ্ঞতার অভিব্যক্তি এই:

যেমন কোনও ব্যক্তি কূপখনন করার পর দেখে সেখানে জল নেই, তাকে কর্দমাক্ত, ক্লিন্ন অবস্থায় ফিরে আসতে হয় আমাদের এই প্রচেষ্টার ফলও অনুরূপ হয়েছে।[১২]

যে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার প্রাপ্য এই সিংহাসন, অথচ যিনি বৈরাগ্য ও তীব্র আত্মিক ক্ষোভে বিচলিত, তাঁকে মধ্যম ভ্রাতা বলেন:

যে যুদ্ধে তীর কার্যকরী হয় না, যেখানে শত্রু মিত্র কারও কোনও উপকারিতা নেই। হে রাজন্ আজ সেই যুদ্ধ তোমার সম্মুখে উপস্থিত, যে যুদ্ধ, নিজের অন্তর্লোকে একাকী করতে হয়।[১৩]

তিনি অগ্রজকে প্রায়শ্চিত্তের পরামর্শ দেন, ক্ষত্রিয় বংশে জাত ব্যক্তির পক্ষে যুদ্ধ অবশ্য কর্তব্য এবং প্রশংসনীয় কর্তব্য এই যুক্তিতে সান্ত্বনা দিতে থাকেন।

উত্তরে অগ্রজ বলেন:

যে সম্রাট এই সমগ্র পৃথিবী শাসন করবেন, এমনকী তাঁরও কেবল একটিই উদর; তবে কেমন করে তুমি যুদ্ধের প্রশংসা কর?…. তুমি (যুদ্ধে বিজিত) ভোগ্যবস্তু সমূহের ভোগ সুখের প্রশংসা করছ, কিন্তু যারা এগুলি ভোগ করেন না, যাঁরা দুর্বল, তাঁরাও উচ্চ (আত্মিক) স্তর প্রাপ্ত হয়ে থাকেন।

মিথিলাপতি জনক বলেন:

আমি কিছুরই অধিকারী নই, তবু আমার সম্পদ অসীম; মিথিলা দগ্ধ হয় তবু আমার কোনও কিছুই দগ্ধ হয় না।[১৪]

যে চিরন্তন আভ্যন্তরীণ অস্থিরতা মানুষকে অধিকার বোধের প্রশ্নে তাড়িত করে, প্রাচীন ভারতের প্রজ্ঞা এখানে সামগ্রিক ভাবে তার গভীর মূলে অনুসন্ধান করেছে। মানুষ যখন এমন একটি সীমায় পৌঁছায় যেখানে ব্যক্তি, সম্প্রদায় বা জাতিগত ভাবে অধিকার প্রাপ্তির যুক্তিহীন তাড়না কোনও বাহ্যিক শক্তির মাধ্যমে বাধা পায় তখন শান্তি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। যখন জনক বলেন যে তাঁর রাজধানী মিথিলা অগ্নিদগ্ধ হলেও তাঁর কিছু দগ্ধ হচ্ছে না, তখন তিনি সমস্ত পার্থিব অধিকারবোধ থেকে নিজেকে বিযুক্ত করেন এবং এর ফল অন্তরের শান্তি, সমস্ত জগৎকে অধিকার করার এক উল্লসিত বোধ। ঈশোপনিষদের প্রারম্ভিক শ্লোকেও এই প্রকার একটি উপলব্ধি দেখতে পাই:

সমগ্র জগৎ ঈশ্বরের দ্বারা আচ্ছাদিত, তাঁর দ্বারা যা পরিত্যক্ত তাই-ই ভোগ কর। অপরের ধনে লোভ করে না।

যখন ব্যক্তি হয় আত্মকেন্দ্রিক, সংকীর্ণতায় আচ্ছন্ন, তখন তুচ্ছ কণাটির বিয়োগও অসহ্য হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ বলেন: অল্প লইয়া থাকি, তাই মোর যাহা যায় তাহা যায়। অন্য ভাবে বলা যায়, কোনও কিছু হারাবার উপায় হল অল্পের অধিকার মদে মত্ত না হওয়া, ব্যক্তিগত অধিকারবোধের ঊর্ধ্ব চেতনাকে প্রসারিত করা। অধিকারের আকাঙ্ক্ষায়, ব্যক্তিগত ভাবে নিঃশেষে অধিকার করার তাড়নায় অস্থির মানসিকতা থেকেই সৃষ্টি হয় দ্বন্দ্ব, অসাম্য আর সংঘর্ষের আকাঙ্ক্ষা। এর পরে তা মানুষকে নিয়ে যায় প্রভুত্বের অধিকারের পথে, যার সঙ্গে ঘটনার প্রবাহে সংঘর্ষ হয় প্রতিদ্বন্দ্বী আকাঙ্ক্ষার। এর ফলে পারস্পরিক দ্বন্দ্বে। এই আকাঙ্ক্ষা মানুষের শান্তিহরণ করে, নিদ্রাহরণ করে। আর্ত, ক্রোধী এবং প্রেমিকের জন্য নিদ্রা কোথায়?[১৫] যখন শেষতম কৌরব রাজপুত্র মৃত্যুমুখে পতিত, তখন তাঁর বিজয়ী জ্ঞাতিভ্রাতাদের একজন বলেছিলেন: ‘অনুশোচনা কোর না, আমরা যারা অবশিষ্ট রইলাম তারাই করুণার পাত্র।’[১৬] দীর্ঘ এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরে বিজয়ীর কাছে জয়ের উপলব্ধি কেমন করে ধরা দিয়েছে, এই তার উপলব্ধি। এ শুধু সন্তুষ্টির লেশশূন্যতা নয়, উপরন্তু এক নিশ্চিত দুঃখের ইঙ্গিতবাহী, কারণ এই প্রক্রিয়াতে সকল সঙ্গী এমনকী ভ্রাতারাও নিহত হয়েছেন।[১৭] মৃত্যুপথযাত্রী মহাকাব্যের নায়ক তাঁর জীবিত জ্ঞাতি ভ্রাতাদের কাছে আবেদন জানিয়েছেন— ‘আমার সঙ্গে সঙ্গে যেন এই যুদ্ধেরও অবসান হয়, যেন এই পৃথিবীর রাজগণ পুনরায় সুস্থ থাকেন। [১৮]

তাহলে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা একপ্রকার অসুস্থতা! গান্ধারী, পরাজিত বিধ্বস্ত এবং মৃত রাজপুত্রদের অন্ধ বৃদ্ধা জননী যুদ্ধের প্রেরণাদাতা কৃষ্ণকে অভিশাপ দিয়েছিলেন: কৃষ্ণের মৃত্যু হবে বড় নির্মম, কারণ যুদ্ধে তাঁর কোনও প্রত্যক্ষ লাভ ছিল না; তিনি এই অযথা রক্তপাত বন্ধ করতে পারতেন— কারণ উভয়পক্ষই তাঁর কথা শুনত— তবু তিনি তা করেননি।[১৯] মহাকাব্যের কবি গান্ধারীর বাক্যগুলিকে সত্য প্রমাণিত করেছেন। তাঁর অভিশাপ অনুযায়ীই কৃষ্ণের মৃত্যু ঘটেছিল। অন্য ভাবে বলা যায়, মহাকবির মতে রক্তক্ষয়ের প্রতিরোধ না করা ছিল প্রথম পর্যায়ের অপরাধ। যুদ্ধের অবসানে, যখন লোভী, উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজপুত্রদের শবদেহে ভূমি আকীর্ণ তখন সেই দৃশ্যের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এই ভাবে— ‘এই পৃথিবীর অধীশ্বরগণ, সর্বাঙ্গ দিয়ে ভূমিকে আলিঙ্গন করে, ভূমির জন্যই ভূ-শয্যায় শুয়ে আছেন।’ যুদ্ধে কার লাভ হয়? মহাকাব্যের কবি বলেন: শূকর আর কুকুরের মধ্যে যখন সংঘর্ষ হয়, তখন লাভবান হয় কেবল শ্মশানরক্ষক।’[২০] পরে আমরা এই রূপকল্প বিষয়ে আবার আলোচনা করব।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে একজন আচার্য যুদ্ধের বিরুদ্ধে উপদেশ দিয়েছিলেন: ‘ভ্রাতাদের সঙ্গে ভাগ করে পৃথিবী (রাজ্য) উপভোগ কর, হয়তো তোমার পীড়া আরোগ্য হবে।[২১] যখন কেউ তার স্বজনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তখন আভ্যন্তরীণ শান্তি ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে ভেঙে পড়ে: এই অস্থির বিবেক যন্ত্রণার সঙ্গেই পীড়ার তুলনা করা হচ্ছে। প্রকৃত অর্থে যুদ্ধারম্ভের পূর্ব মুহূর্তে ধর্মনিষ্ঠ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা তাই ছুটে গেলেন বিপক্ষ শিবিরে, বয়োজ্যেষ্ঠ ও গুরুজনদের পায়ে ধরে, আকুল আবেদন জানালেন যুদ্ধ না করার জন্য, আসন্ন হত্যালীলাকে রোধ করার জন্য। উত্তর পেলেন:

মানুষ বিত্তের দাস, বিত্ত কারো ভৃত্য নয়; হে রাজন, জেনে রাখ, এই-ই প্রকৃত সত্য। বিত্তের পরিবর্তে আমরা স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়েছি; তাই আমরা নপুংসকের মতো কথা বলছি।[২২] এই মহাকাব্যে একটি ছোট রূপক আছে: প্রজাপতি ব্রহ্মা লোকসংখ্যার আধিক্যে চিন্তিত হয়ে পড়লেন: তাঁর দুশ্চিন্তা উদ্বেগ থেকে এক নারীর উদ্ভব হল: ব্রহ্মা তাকে সৃষ্টি ধ্বংসের নির্দেশ দিলেন। নারী ক্রন্দন করে উঠল, তার সেই অশ্রু ব্রহ্মা অঞ্জলি বদ্ধ করে ধারণ করলেন; সেই অশ্রু হল ব্যাধিসমূহ। তারপরে আবার ব্রহ্মা আদেশ দিলেন সৃষ্টি ধ্বংসের; নারী এক অনুগ্রহ প্রার্থনা করল— মানুষের নিজের দোষই যেন তার মৃত্যুর কারণ হয়। বিধাতা বললেন ‘তথাস্তু’।[২৩] যে কারণে বহুসংখ্যক মানুষের বিনাশ ঘটে, মানুষের অভিজ্ঞতায়, তার মধ্যে তীব্রতম, ব্যাপকতম হল যুদ্ধ। রূপক কাহিনির মতে এই সব মৃত্যুর কারণ হল মানুষের নিজেরই দোষ। কার দোষ? তা কিন্তু যে ভুক্তভোগী তারই দোষ আবশ্যিক ভাবে নয়, দোষ সেই শক্তির, সেই গোষ্ঠীর এমনকী সেই ব্যষ্টির যে বা যারা স্থির শীতল বুদ্ধিতে এই সব তাণ্ডবের পরিকল্পনা করে এবং মৃত্যুর ফসল ঘরে তোলে। শূকর এবং কুকুর ঝগড়া করে, মারা যায়। যে শ্মশানরক্ষক— তাদের চামড়া বিক্রি করে আনুষঙ্গিক আয় করে— সে তাদের বিদ্বেষের সুযোগ নিয়ে নিজে লাভবান হয়। স্পষ্টদর্শী মহাকবি যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ভাগ্যের পরিহাস অনুভব করেছেন। তিনি মহাকাব্যের মহাযুদ্ধ, ব্যাপক ধ্বংস কাণ্ডের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন, আর মানব জাতি যে সব শিক্ষা নিতে অসম্মত হয়, সেই সব তত্ত্বকথা নিরাবেগ কঠিন ভাবে বর্ণনা করেছেন।

সমাপ্তিসূচক আখ্যান রূপে আমরা একাদশ শতকের একটি নাটক, বাঙালি নাট্যকার ভট্টনারায়ণ বিরচিত বেণী সংহার[২৪]-এর গর্ভাঙ্ক দৃশ্যের দিকে তাকাতে পারি। মহাভারত যুদ্ধের শেষাংশের ঘটনা অবলম্বনে নাটকটি রচিত। ঘটনার শেষ ভাগে যখন আঠারো দিন ধরে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ভ্রাতৃরক্তপাত চলেছে তখন আমরা একটি গর্ভ-দৃশ্যে[২৫] দেখতে পাই রাক্ষস রুধিরপ্রিয়[২৬] আর তার রাক্ষসী সঙ্গিনী বসাগন্ধার২৭] সংলাপ। রাক্ষসীর স্বগতোক্তিতে বোঝানো হয়েছে, তাদের ভাণ্ডার পরিপূর্ণ; দীর্ঘদিন চলার মতো যথেষ্ট রক্ত, মাংস, হাড়, চর্বি, ইত্যাদি সে মৃত বীরদের দেহ থেকে সংগ্রহ করে রেখেছে। তাই স্বামীকে সে ভোজনে আপ্যায়ন করতে চায়। রাক্ষস তার গৃহিণী প্রবৃত্তির প্রশংসা করে বলে যে, সে নিজে তৃষ্ণার্ত, ঈষদুষ্ণ (অর্থাৎ টাটকা) রক্ত পান করতে চায়; রাক্ষসী সেইরূপ পানীয়ই দেয়, রাক্ষস তৃপ্ত হয়। সানন্দে তারা এই আত্মক্ষয়ী যুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ স্মৃতিচারণার মাধ্যমে বর্ণনা করে; বলে শবদেহের স্তূপের কথা যা, তাদের কাছে প্রচুর সুস্বাদু খাদ্যভাণ্ডার স্বরূপ। রাক্ষসী দেখায় তার পুরাতন সম্ভার আর নূতনতর সংগৃহীত খাদ্যভাণ্ডার। সে বলে, যুদ্ধ যদি এই ভাবে চলতে থাকে তবে তার আর খাদ্যচিন্তা থাকবে না। সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের মনে পড়ে পূর্বোক্ত শূকর আর কুকুরের দ্বন্দ্বের কথা। যাদের মৃত্যুতে লাভবান হয়েছিল অপর এক তৃতীয় পক্ষ। রাক্ষস দম্পতির সংলাপে একটি রূপক অর্থ আছে: যতদিন মানুষ তার ভ্রাতার বিরুদ্ধে অর্থাৎ অপর মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, ততদিন যুদ্ধ ব্যবসায়ীরা— অর্থাৎ অস্ত্রবণিক বা যুদ্ধের অধিপতিরা— সমৃদ্ধ, বর্ধিষ্ণু হতে থাকবে। যুদ্ধ কেবল রাক্ষসদেরই সমৃদ্ধির জন্য। শান্তি তাদের স্বার্থের পরিপন্থী। তাই বিশ্বশান্তির যে কোনও সম্ভাবনার বিরুদ্ধে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং স্ব স্ব রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের আড়ালে থেকে তারা শান্তির বিরূপ পদক্ষেপ পরিকল্পনা করে যায়। যাঁরা শান্তি ভালবাসেন, যাঁরা জীবনকে ভালবাসেন তাঁদের ঐক্যবদ্ধ ভাবে এই যুদ্ধ ব্যবসায়ীদের কার্যকলাপ অনুমান করতে হবে, বুঝে নিতে হবে, তার দৃঢ় প্রতিবাদ করতে হবে।

পরিবারগত ভাবে, দাম্পত্য সম্পর্কে, পিতামাতা ও সন্তানদের মধ্যে অথবা গুরু শিষ্যের মধ্যে, প্রতিবেশীদের মধ্যে— যেখানেই হোক না কেন, দ্বন্দ্বের মূল কিন্তু এক। লোভ, দম্ভ, অহংকার, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অসহিষ্ণুতা এবং প্রতিযোগিতামূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। বুদ্ধদেব যথাযথ ভাবেই নির্ণয় করেছিলেন: তন্হা— ‘তৃষ্ণা’ আকাঙ্ক্ষাই এই সামগ্রিক বিষচক্রকে আবর্তনে প্রবৃত্ত করে। তবু আকাঙ্ক্ষা নিজে জীবনের এক অনুষঙ্গ স্বরূপ। কখন তবে আকাঙ্ক্ষার মধ্যে বিষ সঞ্চারিত হয়? যখন অপরের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে ভ্রষ্ট আকাঙ্ক্ষা হতাশায় প্রত্যাঘাত করে।

যেহেতু আমরা নিজেদের নিয়ে শান্তিতে থাকার শিক্ষা পাই না তাই আমরা সেই আকাঙ্ক্ষা পোষণ করি যা অপরের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বিরোধ বাধায়। বৌদ্ধগ্রন্থ ললিতবিস্তার-এ আমরা একটি নূতনতর সামাজিক সুস্থ ভাবনার পরিচায়ক সুর শুনতে পাই: বহুজনহিতায়, বহুজনসুখায়, লোকানুকম্পায়ৈ মহতো জনকায়স্যঅর্থায়— ‘অনেকের মঙ্গলের জন্য, অনেকের আনন্দের জন্য, মানবজাতির প্রতি সহানুভূতিতে, সর্বাপেক্ষা অধিক সংখ্যক লোকের প্রয়োজনে।’ এই প্রকার লক্ষ্যের একটি স্বাভাবিক পরিণাম আছে: যখন গোষ্ঠীর বৃহত্তর স্বার্থের সঙ্গে সংঘাত বাধে, তখন ব্যক্তি তার নিজস্ব অবাধ আত্মস্বার্থকে রূপান্তরিত করতে বাধ্য হয়।

এই প্রকার শিক্ষা ফলপ্রসূ ভাবে কার্যকার হওয়ার পূর্বে, অবশ্যই গোষ্ঠীগুলির আর্থিক এবং রাজনৈতিক গঠন আমূল পরিবর্তিত হওয়া উচিত। বর্তমানে অধিকাংশ সমাজব্যবস্থাই পুঁজিবাদী। অন্যান্য প্রতিবেশীকে বঞ্চিত করে আত্মসমৃদ্ধি সাধনের জন্য কোনও সম্প্রদায়বিশেষের উদগ্র আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে এই সব সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এমনকী এই সব সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরেও কেবল মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী ব্যক্তিই জনগণের পরিশ্রমের ফল নিজেরা ভোগ করে থাকে। শোষণ যে ভাবেই করা হোক, তার মূলে থাকে লোভ এবং অনৈতিক, দ্বন্দ্বমূলক আকাঙ্ক্ষা। সমাজবাদের ভিত্তি হল প্রতিযোগিতার পরিবর্তে সহযোগিতা, মুষ্টিমেয়ের দ্বারা বহুজনকে শোষণ করার পরিবর্তে সকলের জন্য করুণা ও সহানুভূতি। এর প্রচলনের মাধ্যমে সর্ব প্রকার সামাজিক ও বিশ্বনৈতিক অমঙ্গল দূরীভূত হতে পারে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, রাতারাতি অথবা আপনা হতেই সর্বপ্রকার অমঙ্গল অন্তর্হিত হবে, কারণ আমাদের মানবিক পরম্পরার অধিগঠন গড়ে উঠেছে বহু সহস্রাব্দ ধরে এবং একে উন্মুল করতে সময় লাগবে। কিন্তু একবার যখন সামগ্রিক ভাবে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে অপরকে শোষণ করা, পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অপরকে আঘাত করা বা অপ্রতিভ করার প্রবণতা মুছে যাবে, তখনই পৃথিবীতে প্রকৃত শান্তির বাতাবরণ আসবে, পারিবারিক সাম্প্রদায়িক এবং রাষ্ট্রগত শান্তি দেখা দেবে।

যুদ্ধের আশঙ্কা যেহেতু অতি স্পষ্ট এবং নিষ্ঠুর বাস্তব, সেহেতু যাঁরা বিশ্বশান্তির স্বপ্ন দেখেন সেই সব মানুষের সক্রিয়তা আশু প্রয়োজন। কারণ, রক্তপিপাসু দানবেরা ক্রিয়াশীল, তাদের মূলধন হল পারস্পরিক ঘৃণা, উচ্চাশার সংঘাত, মানুষের অন্তর্নিহিত নিষ্ঠুরতা-বিলাস এবং তার বোধহীন আত্মঘাতী মনোবৃত্তি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই সব অত্যাচারী তাদের তাণ্ডব চালিয়ে এসেছে। আশা করতে পারি— শান্তিকামীরা তাঁদের উদ্দেশ্যকে সকল করার জন্য সচেষ্ট হবেন, দানবের অ-শিব চক্রন্তকে বিনষ্ট করবেন। অস্ত্র ব্যবসায়ীরা সুকৌশলে প্রচারমাধ্যম, বিজ্ঞাপন, সাহিত্য এমনকী জ্ঞানের অন্যান্য শাখার মাধ্যমেও অতি সূক্ষ্ম ভাবে আবার কখনও কখনও অনতি সূক্ষ্ম ভাবেও এই যুদ্ধোদ্মাদনাকে উচ্চকিত করে চলেছে। শান্তি জীবনকে নিশ্চিত করে, সুতরাং শেষ কথা বলার অধিকার শান্তিরই থাকা উচিত। কিন্তু আণবিক অস্ত্রযোগে বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে শান্তির সম্ভাবনা বিলীয়মান মনে হয়। যুদ্ধকারীদের সংকেতকে বিনষ্ট করে আমাদের তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করতে হবে। জনগণকে তাদের সমষ্টিগত স্বার্থে জাগ্রত করতে হবে। ওই সব অমঙ্গলকামী স্বার্থান্বেষীদের লক্ষ হল সাধারণ মানুষের স্বার্থ বিনষ্ট করা, পৃথিবী থেকে প্রাণকে মুছে ফেলা। মানুষ যখন এই আসন্ন বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে এক বিশ্বব্যাপী ধ্বংসের তাণ্ডবের সম্ভাবনা বুঝবে তখন মানুষের এই শত্রুদের অ-শিব শক্তিকে বিনষ্ট করার জন্য তারা প্রাণপণ চেষ্টা করবে।

শান্তির প্রতীক বড় মনোরম কিন্তু সে দুর্বল, তবু মানুষের মধ্যে যা কিছু মহৎ এই শান্তির আশা তাকে অনুপ্রাণিত করে; মানুষ যদি তার পিছনে সঙ্ঘবদ্ধ হয় তবে শান্তির রূপক এই পবিত্র কপোত সিংহ বা সাপের বিরোধিতা করে অবশ্যই জয়ী হবে। যে পদ্ম সূর্যকিরণের স্পর্শে বিকশিত হয়, যার কোনও চোখ ধাঁধানো চমৎকারিত্ব নেই, আছে নীরব শান্ত সৌন্দর্য আর স্নিগ্ধ সুবাস তাকেই প্রাচীন ভারতবর্ষ বরণ করেছিল শান্তি আর সমৃদ্ধির প্রতীক রূপে। পদ্ম বিকশিত হয় প্রভাতে আর সন্ধ্যায় সে সলিল। তবু এর মধ্যে আছে অমরত্বের ইঙ্গিত, কারণ প্রতিদিনই সে একটু করে ফুটে ওঠে, এ ফুল আকাশ-মাটি-জলের মধ্যে মালিন্য আর পবিত্রতার মধ্যে বিচরণশীল; এ ফুল নিজে এক শান্তিপূর্ণ, মর্যাদাময় তৃপ্ত জীবনবোধের পবিত্র প্রতীকস্বরূপ। তাই প্রাচীন ভারতবর্ষ একে সম্পর্কিত করেছিল কেবল সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মীর সঙ্গেই নয়, সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার সঙ্গে, বাগদেবী সরস্বতীর সঙ্গে, শান্তির দূত বুদ্ধের সঙ্গে— যাঁর চরণপাতে ফুটে উঠত শান্তিকমল। জীবনের জন্যই শান্তিকে কামনা করা হয়, সেখানেই পদ্মের পেলব প্রতীক তার শক্তিলাভ করে থাকে।

***

সূত্রাবলি

১. অনুবাদ: আর পানিক্কর— মন্ত্রমঞ্জরী ১, পৃ. ৮৫৪

২. ৩.৩০; ১০৩, ৫; অনু. আর. পানিক্কর, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৫৭

৩. তুলনীয় অথর্ববেদ ৬:৭৩:১-৩; ৬:৭৪:২; ৬:৯৪:১-৩

৪. ঋগ্বেদ ২:১৫:১-৬

৫. অথর্ববেদ ৭:৫২.১

৬. অথর্ববেদ ১৯:৯:১-৪

৭. এই পংক্তিটি বিখ্যাত শিবসংকল্পসূক্ত— ৩৪:১-৬-এর ধ্রুবপদ।

৮. তুলনীয় অথর্ববেদ ৭:৩৬-৩৭, ১৪:১:১৭, ৪২; ১৪:২:৬৪, ৭১; অন্যান্য পরবর্তী ধর্মশাস্ত্রেও একই সুরে আলোচনা করা হয়েছে।

৯. যিনি খ্রিস্ট পূর্ব তৃতীয় শতকে উত্তর ভারতে রাজত্ব করেন।

১০. তক্ষশিলা স্তম্ভলিপি

১১. খ্রিস্ট পূর্ব প্রথম শতকের শেষাংশ।

১২. মহাভারত; পুণা সং ১২-১০:৯

১৩. মহাভারত ১২:১৬:২১

১৪. মহাভারত ১২:১৭:৩

১৫. মহাভারত ১০:৪:২১

১৬. মহাভারত ৯:৫৯:২৭ বাংলা সংস্করণ

১৭. এখানে তুলনীয় উইলফ্রেড ওয়েনের মর্মস্পর্শী কবিতা, লাস্ট মিটিং (শেষ দেখা)

১৮. মহাভারত ৬:১১৭:২

১৯. মহাভারত ১১:২৫:৪০, ৪১

২০. মহাভারত ৭:১৮০:৮ বাংলা সংস্করণ

২১. মহাভারত ৫:১২৬:১৮

২২. মহাভারত ৬:৪:৪১

২৩. মহাভারত ১২:24৪:25০

২৪. খ্রিস্টিয় ১০৭৭ সাল

২৫. তৃতীয় অঙ্কের পূর্বে

২৬. আক্ষরিক অনুবাদ ‘রক্তলোভী’

২৭. ‘চর্বির গন্ধ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *