এমনই করিয়া কাটিয়া গেল কতদিন–পরিপূর্ণ দুইটি বৎসর।
পৌষ-সংক্রান্তির পূর্বদিন স্নানের সময় ননদিনী কমলের দুয়ার খোলা দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেল। এ-দিনে তো পোড়ারমুখী বউ কখনও ঘরে থাকে না। সংক্রান্তির দিন গঙ্গাস্নান করিয়া বনওয়ারীবাদে বনওয়ারীলালের দরবারে তাহার যাওয়া চাই-ই। কাদুর আশঙ্কা হইল। কমলের অসুখ করিল নাকি? সে আগড় ঠেলিয়া আগড়ায় প্রবেশ কারিয়া ডাকিল, বউ!
কমল তখন স্নানে যাইবার উদ্যোগ করিতেছিল। ঘরের ভিতর হইতে সে উত্তর দিল, যাই।
কাদু প্রশ্ন করিল, তোর শরীর ভাল তো?
কলসি কাঁখে লইয়া কমল বাহিরে আসিল। খোলা হাতখানি কাদুর মুখের কাছে নাড়া দিয়া বলিল, বলি, ও ওলো ননদী, আজকে হঠাৎ হলি যে তুই এমন দরদী? হঠাৎ শরীরের খবর যে?
তবে যে বড় বনওয়ারীলালের দরবারে যাস নাই? নাগরের ডাক হেলা করে বেলা খোয়াচ্ছিস যে?
যাব না?
কেন?
মান করেছি।
মান! কাদু একান্ত দুঃখের সহিতই হাসিল। তারপর বলিল, মান ভাঙাবে কে কমল?
কমল স্বপ্নপ্রবণ চোখে আকাশপানে চাহিয়া রহিল।
কাদু বলিল, বউ, মিছে দেহপাত করিস না। ও হবার নয়।
কমল, বোধহয় কোনো স্বপ্ন-কল্পনা করিতে করিতেই পথ চলিতেছিল, কোনো উত্তর না দিয়া এতক্ষণে স্থির দৃষ্টি কাদুর মুখের উপর রাখিয়া চাহিয়া রহিল। কাদু বলিল, এমন করে চেয়ে থাকিস না ভাই। তোর ওই চাউনিকে আমার বড় ভয় করে।
কমল তবু হাসিল না। স্নান করিতে করিতে কাদু হাসিয়া বলিল, তার চেয়ে বউ, আমায় তোর শ্যাম মনে কর। আমি তোকে বুকে করে রাখব।
কমলের নগ্ন সুন্দর বুকে সে আঙুলের একটি টোকা মারিল। সে তখন দুই হাতের আঘাতে আঘাতে জলের হিল্লোল তুলিতে তুলিতে গাহিতেছিল, ‘সাগরে যাইব কামনা করিব সাধিব মন্ধুে সাধা। ফিরিবার পথে কমল অকস্মাৎ বলিয়া উঠিল, তাই ভাল ননদিনী।
কি?
তোকেই আমার শ্যাম করব।
মর।
সন্ধেতে আসিস ভাই। একলা আজ থাকতে পারব না।
তুই যাস ভাই। ছেলেপিলের খাওয়াদাওয়া, চ্যাঁ-ভ্যাঁ, সন্ধেতে আমার আসা হবে না।
আচ্ছা, যাব। নন্দাই কিছু বলবে না তো?
খিলখিল করিয়া হাসিয়া কাদু বলিল, তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখব, নয়ত রাম মোড়লের মজলিসে তামাক খেতে পাঠিয়ে দোব।
কমল একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।
কিন্তু দ্বিপ্রহর না। যাইতেই কমল ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে করিয়া পথে বাহির হইয়া পড়িল। অকস্মাৎ তাহার মনে হইল জয়দেবের কথা! জয়দেবের শ্যামচাদের দরবারে–সে কখনও তো যায় নাই! জয়দেবের শ্যাম প্রেমের ঠাকুর। জয়দেবের কাহিনী মনে করিয়া সে আশান্বিত হইয়া উঠিল। নানদিনীকে চাবি দিয়া তুলসীমন্দিরে প্রদীপ দিবার কথা বলিবার তাহার অবসর হইল না।
বহুদূর পথ, ক্রোশ-পঁচিশেকের কম নয়। কমল স্থির করিল, দিনরাত্রি চলিয়াও সে আগামীকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনোরূপে পৌঁছিবেই।
কমল একাই পথ ধরিল। গ্রামের পর গ্রাম, মাঠের পর মাঠ অতিক্রম করিয়া সে চলিয়াছিল। পথে যাত্রীর দল পাইবে, সে আশা করিয়াছিল। কিন্তু যাত্রীরা সব পূর্বেই চলিয়া গিয়াছে। দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যার মুখে একখানা গ্রাম পার হইবার সময় সে শুনিল, সম্মুখে একখানা মাঠ পার হইয়াই আর একখানি গ্রাম, তারপরই জয়দেবের আশ্রম।
মাঠখানা একটু কিন্তীর্ণ। ক্রোশ-দুই হইবে। কমল মাঠের বুকে নামিয়া পড়িল। সদ্য ফসল-কাটা শুভ্ৰ ক্ষেতগুলিকে বেড়িয়া বেড়িয়া পায়ে-চলা পথের নিশানা ঘুরিয়া ফিরিয়া চলিয়া গিয়াছে। শুক্লপক্ষের রাত্রি। দিগন্ত হইতে দিগন্ত পর্যন্ত স্তর-মেঘের মেলা আকাশ ছাইয়া থাকিলেও মেঘের আড়ালের দশমীর চাঁদের জ্যোৎস্নার আভায় ধরিত্রীর বক্ষ অস্পষ্ট উজ্জ্বল। সে অস্পষ্টতায় দেখা বেশ যায়, কিন্তু ভাল চেনা যায় না। কমল সন্তৰ্পণে পথ চলিয়াছিল। শীর্ণ পথ লতার মত আঁকিয়া বাকিয়া কত দিকে শাখা-প্রশাখা মেলিয়াছে।
অল্প অল্প বাতাস বহিতেছিল। শীত তীক্ষ্ণ হইয়া উঠিয়াছে। কমল কাপড়খানাকেই বেশ করিয়া গায়ে জড়াইয়া লইল। হাসিও আসিল তাহার। কাদুশুনিলে তাহাকে নিশ্চয় রাই-উন্মদিনী বলিয়া ঠাট্টা করিবে। আর পাগল হইতে বাকিই বা রহিয়াছে কোথায়? কিন্তু পাগল হইয়াও তো আকাশে ফুল ফোঁটানো গেল না! কমল একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মনে মনে সঙ্কল্প করিল, এই শেষ। ইহার পর আর সে আকাশে ফুল ফুটাইবার কল্পনা করিবে না। কমল একবার দাঁড়াইল। চারিদিক বেশ করিয়া দেখিয়া লইয়া মনে মনে কথা কহিতে কহিতে আবার চলিল। চারিদিকের গ্রামের বানশোভা ঘষা কালো ছবির মত দেখা যাইতেছিল। মাথার উপরে কাটা মেঘের মধ্য দিয়া আলো-আঁধারির খেলা খেলিতে খেলিতে চান্দও চলিয়াছিল। এই একাকিনী যাক্রিণীর সঙ্গে।
কিন্তু পথ যে ফুরায় না! পথ ভুল হইল না তো? চারিদিকেই তো পথ!
কমল থমকিয়া দাঁড়াইল। আকাশে চাহিয়া দেখিল, চাদ প্রায় মাথার উপরে আসিয়াছে। রাত্রি তবে তো অনেক হইয়াছে। চারিপাশে চাহিয়া দেখিল, গ্রাম সেই দূরে, ছবির মত মনে হইতেছে-যত দূরে ছিল তত দূরেই আছে, এতটুকু নিকটবর্ত হয় নাই। মধ্য-প্রান্তরের মধ্যে সে শুধু এক দীড়াইয়া। কমলের কান্না পাইল।
এই সীমাহারা প্রান্তরে একা সে পথ ভুলিয়া ঘুরিয়া মরিতেছে। কেন এমন ভুল সে করিল, কেন সে সন্ধ্যার মুখে একা এই বিস্তীর্ণ মাঠে নামিল? কে তাহাকে পথ দেখাইবে?
দেহ-মন যেন তাহার ভাঙিয়া, পড়িতেছিল। সেইখানেই বসিয়া পড়িয়া কমল কাঁদিতে আরম্ভ করিল। কতক্ষণ সেইভাবে বসিয়া ছিল কে জানে? হঠাৎ তাহার কানে কোন পথচারীর কণ্ঠস্বর আসিয়া পৌঁছিল। পথিক যেন গান গাহিতে গাহিতে পথ চলিয়াছে। কমল উঠিয়া পড়িল। স্বর লক্ষ্য করিয়া পাগলের মত ছুটিয়া চলিল। অদূরে ছায়ার মত মানুষের কায়া যেন দেখা যাইতেছে।
সে আর্তম্বরে ডাকিল, কে গো?
আবার ডাকিল, ওগো, কে গো তুমি? একটু দাঁড়াও। পথিক দাঁড়াইল।
কমল ডাকিয়া বলিল, একটু দাঁড়াও গো। পথ হারিয়েছি আমি।
পথিক এবার শব্দ লক্ষ্য করিয়া ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কে তুমি? সে সেই দিকেই হাঁটিতে শুরু করিল। আলপথের একটি বাঁকের উপরে দুই জনের মুখোমুখি দেখা হইল। কমল দেখিল, পথিক যুবা। শুধু যুবা নয়, রূপও আছে তাহার।
মেঘের একটা স্তর ছাড়াইয়া আকাশের চাঁদ তখন পরিপূর্ণভাবে উঠিয়াছে। অকস্মাৎ পুরুষটি বিস্ময়-ভরা কণ্ঠস্বরে বলিয়া উঠিল, কমল? চিনি?
কমলও বুঝি চিনিয়াছিল, সে থারথার করিয়া কাঁপিতেছিল। তাহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া রঞ্জন–তাহার লঙ্কা।
কমলের মনে একটি গোপন আশঙ্কা জাগিয়াছিল। একবার মনে হইল, এ সেই। তাহার শ্যামচাদ, রঞ্জনের রূপ ধরিয়া আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। এমন অনেক গল্প সে শুনিয়াছে। যেখানে যে শ্যাম-বিগ্রহের দরবারে সে চলিয়াছে, সেই শ্যামই তো জয়দেব গোস্বামীর রূপ ধরিয়া পদ্মাবতীকে ছলনা করিয়া কবির অসমাপ্ত গান সম্পূর্ণ করিয়া দিয়াছিলেন। স্থিরদৃষ্টিতে সে রঞ্জনের দিকে চাহিয়া রহিল।
রঞ্জন আবার ডাকিল, কমল! রাইকমল!
সে তাহার হাত ধরিয়া ডাকিল। এবার। রাইকমলের চেতনা ফিরিয়া আসিলা। এতক্ষণ, পর আপনাকে সংযত করিয়া বুঝিল, সত্য সত্যই এ রঞ্জন। অস্পষ্ট ছায়ালোকের মধ্যে ক্ষেতের বুকে তাহার দেহের দীর্ঘ ছায়াখানি বাকীভাবে পড়িয়া আছে। দেবতার ছায়া পড়ে না। রঞ্জন-এ সেই রঞ্জন! দেবতা নয়, মানুষ!
আশ্চর্য! তবুও তাহার বুক বিপুল আনন্দে ভরিয়া উঠিল।
রঞ্জনই আবার কথা বলিল, তুমি এখানে এত রাত্রে কেমন করে এলে কমল?
কমল তখনও তাহাকে দেখিতেছিল। রঞ্জনের বৈষ্ণবের বেশ। তাহার মনে পড়িল, রঞ্জন পরীকে লইয়া বৈষ্ণব হইয়াছে। রঞ্জনের প্রশ্নে সে সজাগ হইয়া উঠিল। বলিল, জয়দেব যাব কিন্তু তুমি-কি বলব তোমাকে, কি নাম নিয়েছ? তুমি কোথা যাবে?
রঞ্জন বৈষ্ণবের মতই মৃদু হাসিয়া বলিল, নাম এখন আমার রাইদাস মহান্ত।
কমল অকারণে লজ্জা পাইল। রঞ্জন বলিল, আমিও জয়দেব যাব। আমার সঙ্গেই এস, কি বল?
কমল কহিল, চল।
কমলের মনের মধ্যে কত প্রশ্ন ঘুরিয়া ফিরিয়া মরিতেছিল, কিন্তু কথা যেন জিভে জড়াইয়া যাইতেছে। পথ চলিতে চলিতে রঞ্জন আবার বলিল, রসিকদাস চলে গেল?
কমল উত্তর দিল না। রঞ্জন বলিল, আমি তোমাদের খবর সবই জানি। বাউলের যে শেষ পর্যন্ত জ্ঞান হয়েছে, এও ভাল। তারপর দুজনেই নীরব। শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ পশ্চিম আকাশে অস্ত যাইতেছিল। মেঘের ছায়া ঘন হইয়া কায়া গ্ৰহণ করিতেছিল। অন্ধকার হইয়া আসিতেছে চারিদিক। কমল মৃদুস্বরে প্রশ্ন করিল, পরী ভাল আছে?
রঞ্জন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিল, শেষ-জীবনে বড় কষ্টই সে দিলে আমায়-নিজেও পেলে; রোগের যন্ত্রণায় দিনরাত্রি চিৎকার! আর সে কি ভয়ঙ্কর মূর্তি-অস্থিকঙ্কালসার! উঃ! মনে করতেও শরীর আমার শিউরে ওঠে!
সমবেদনায় কমলও একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিয়া উঠিল, আহা! পরী মরিয়া গিয়াছে!
আক্ষেপ করিয়া, রঞ্জন বলিল, গুরু, পেয়েছিলাম ভাল। ভাল আখড়া, দেব-সেবা, কিছু দেবোত্তর-সবই তিনি আমায় দিয়ে গেছেন। দিনও কিছুদিন মন্দ কাটে নাই। কিন্তু তারপর এই অশান্তি। একদিকে দেবতার সেবা, একদিকে মানুষের সেবা…এ কি চিনি, শীতে যে কাঁপছ তুমি! গায়ে কাপড় দাও।
কমল বলিল, থাক।
না না, এ ঠাণ্ডায় কঠিন ব্যারাম হতে পারে। গায়ে কাপড় দাও।
এবার বাধ্য হইয়া কমলকে জানাইতে হইল, সে গায়ের কাপড় আনিতে ভুলিয়াছে।
রঞ্জন বলিল, তাই তো! তা হলে এক কাজ কর, আমার গায়ের কাপড়খানা—
কমল প্রতিবাদ করিয়া কহিল, না।
পথ চলিতে চলিতে রঞ্জন বলিল, ভাল মনে পড়েছে। দাঁড়াও, আমার কাছে যে আরও দুখানা নতুন গরম কাপড় রয়েছে।
সে আপনার পোটলা খুলিয়া দুইখানি গায়ের কাপড় বাহির করিল—একখানি গাঢ় নীল, অপরখানি হলুদ রঙের। নীল রঙের কাপড়খানি সে কমলের দিকে বাড়াইয়া দিয়া বলিল, না নিলে আমার বড় দুঃখ হবে চিনি।
কমল ‘না’ বলিতে পারিল না। নীল গায়ের কাপড়খানি তাহাকে মানাইলও বড় ভাল। রঞ্জন ভাল করিয়া দেখিয়া বলিল, আমার দেওয়া মিছে হয় নাই রাইকমল। প্রতিবার আমি জয়দেবে। আসি, আর রাধাগোবিন্দকে শীতবস্ত্ৰ ভেট দিই।
তাঁর গায়ের কাপড়ের রঙ হলুদ, রাধার গৌর অঙ্গে নীল রঙই মানায় ভাল।
কমল দারুণ লজ্জায় মৃদুস্বরে বলিল, ছিঃ তুমি করলে কি!
রঞ্জন বলিল, ঠিক করেছি। রাধারানীই নিয়েছেন রাইকমল।
পরদিন প্ৰভাতে কমল অজয়ে স্নান করিয়া মন্দিরে গেল। মনে হইল, বিগ্রহ যেন হাসিতেছে। চারিদিকে বাউল বৈষ্ণবে গান ধরিয়াছে। সেও মন্দিরা বাজাইয়া গান ধরিয়া দিল—
বহুদিন পরে বঁধুয়া আইলে
দেখা না হইত পরান গেলে।
তাহার কণ্ঠস্বরের মাধুৰ্যে, সঙ্গীতের শিল্পচাতুর্যে মুগ্ধ শ্রোতার দল ভিড় জমাইয়া ফেলিয়াছিল। গান শেষ হইলে পূজারী আসিয়া একগাছি প্রসাদী মালা দিয়া তাহাকে আশীৰ্বাদ করিয়া বলিলেন, ভক্তি তোমার অচলা হোক।
প্ৰসাদ গ্রহণ করিয়া সে জল খাইবার জন্য যাইতেছিল অজয়ের ঘাটে। মন্দিরসীমার বহিৰ্দ্ধারে রঞ্জন দাঁড়াইয়া ছিল। সে বলিল, কি প্রসাদ পেলে, আমায় ভাগ দাও কমল।
কমল পূর্ণদৃষ্টিতে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। তারপর বলিল, প্রসাদ পেয়েছিশ্যামচাঁদের আশীৰ্বাদী মালা।
রঞ্জন বলিয়া উঠিল, তাই দাও আমায়।
কমল এ কথার উত্তর দিল না। সে শূন্যদৃষ্টিতে শুধু চাহিয়া রহিল। রঞ্জন বলিল, রাধারানীর কি দয়া আমার ওপর হবে না কমল?
কমল বলিল, তাই নাও। তারপর স্বর নামাইয়া অন্য দিকে চাহিয়া বলিল, অনেক ভেবে দেখলাম-বাউল বল, দেবতা বল, সবার ভেতর দিয়ে তোমাকেই চেয়ে এসেছি। এতদিন।