পৃথু খুব মজার একটা স্বপ্ন দেখছে। বড়মামা হাঁচি কম্পিটিশনে নাম দিয়েছেন। তিনি সাদা রঙের জার্সি পরে বিশাল একটা মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে খুঁচি দিচ্ছেন। একজন সবুজ রঙের পোশাক পরা মহিলা রেফারি, হাতে স্টপওয়াচ নিয়ে হাঁচির সংখ্যা গুনছে–ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর, ফাইভ। মাঠের চারদিকে শত শত মানুষ। তারা খুব হৈ চৈ করছে। হাত তালি দিচ্ছে। বড়মামা হাঁচি দিয়েই যাচ্ছেন। ছোট্ট একটা সমস্যা হয়েছে। হাঁচির কারণে বড়মামার নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। তার সাদা রঙের জার্সি লাল হয়ে যাচ্ছে। রেফারি বাঁশি বাজাচ্ছে আর বলছে, হবে না, হবে না, ডিসকোয়ালিফাই…। রেফারির কথায় খুব হৈ চৈ শুরু হলো। তাদের হৈ চৈ-এ পৃথুর ঘুম ভেঙে গেল। পৃথু দেখল সে হাসপাতালের বারান্দায় কাঠের বেঞ্চিতে শুয়ে আছে। তার মাথার পাশে সবুজ পোশাক পরা অপরিচিত একটা মেয়ে। আশেপাশে বাবা বা মা কেউ নেই।
সবুজ পোশাক পরা মেয়েটি বলল, তোমার নাম পৃথু?
পৃথু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। মেয়েটি বলল, তোমার বড়মামার শরীর হঠাৎ করে খুব খারাপ করেছে। তোমার বাবা মা দুজনই তাকে নিয়ে ব্যস্ত। তুমি ভয় পেও না। আমি তোমার সঙ্গে আছি।
পৃথু বলল, আমি ভয় পাচ্ছি না।
সবুজ শাড়ি পরা মেয়েটি বলল, তুমি ভয় পাচ্ছি না জেনে আমার খুব ভালো লাগছে। সাহসী ছেলে আমার খুব পছন্দ।
পৃথু বলল, তোমার নাম কী?
সবুজ শাড়ি পরা মেয়েটি বলল, আমার নাম ইতি।
পৃথু বলল, ইতি, আমার খুব ক্ষিধে পেয়েছে।
বলতে গিয়ে লজ্জায় তার গলা ভেঙে গেল। চোখে সামান্য পানিও এসে গেল। ইতি পৃথুর হাত ধরে বলল, আমার সঙ্গে চল তো দেখি ক্যান্টিন খুলেছে কি-না।
শামসুদ্দিনের নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে। অল্প বয়স্ক ইন্টার্নি ডাক্তার অবাক হয়ে দৃশ্যটা দেখছে। তার ডাক্তারি জীবন অল্পদিনের। এ ধরনের রোগী সে আগে দেখে নি। শামসুদ্দিনের শরীর থর থর করে কাঁপছে। জয়নাল দু হাতে তার কাধ ধরে আছে। দেয়ালে হেলান দিয়ে রাহেলা দাঁড়িয়ে আছে। রাহেলাও শামসুদ্দিনের মতো কাঁপছে। রাহেলার হাত ধরে রফিক দাঁড়িয়ে আছে। রফিক নিশ্চিত কিছুক্ষণের মধ্যেই রাহেলা মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। তখন তাকে ধরতে হবে।
শামসুদ্দিনের জ্ঞান আছে। তিনি রফিকের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বললেন, রফিক, জয়নাল ছেলেটা আমেরিকা যাবার টিকিটের টাকা জোগাড় করতে পারছে না। আমার ড্রয়ারে তার টাকা আমি আলাদা করে রেখেছি। তুমি টাকাটা তাকে দিয়ে দিও।
রফিক কিছু বলার আগেই জয়নাল বলল, চাচাজি আমি টাকা জোগাড় করেছি। আমার টিকিটের টাকা নিয়ে আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না।
শামসুদ্দিন বললেন, আমেরিকা থেকে তুমি আমার বোনের জন্যে খুব ভালো সেন্ট কিনে পাঠাবে। সে দামি সেন্ট খুব পছন্দ করে।
মেডিকেল কলেজের প্রফেসর চলে এসেছেন। তার সঙ্গে দুজন ডাক্তার। শামসুদ্দিন সাহেবকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
ওটির সামনে সবাই ভিড় করে আছে। শুধু জয়নাল সেখানে নেই। সে বেবিটেক্সি নিয়ে তার বাসায় চলে গেছে। বাসা থেকে সে পাসপোর্টটা নেবে। সেখান থেকে যাবে বাদামতলী। বাদামতলী থেকে একটা নৌকা ভাড়া করে সে যাবে বুড়িগঙ্গার মাঝখানে। মাঝ বুড়িগঙ্গায় সে আল্লাহকে বলবে–আল্লাহপাক, আমি আমার জীবনের সবচে প্রিয় জিনিসের বিনিময়ে চাচাজির জীবন ভিক্ষা চাইছি। আমার সারা জীবনের শখ আমেরিকা যাওয়া। আমি আমেরিকা যাব না। আল্লাহপাক, আমি পাসপোর্টটা বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিচ্ছি।
সকাল দশটার সময় সত্যি সত্যি মাঝ বুড়িগঙ্গায় জয়নাল তার পাসপোর্ট ফেলে দিল। শামসুদ্দিন সাহেব মারা গেলেন সকাল এগারোটায়। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তার জ্ঞান ছিল। তিনি চারদিকে তাকিয়ে জয়নালকে খুঁজলেন। বিড়বিড় করে বললেন, পাগলাটা গেল কোথায়?
পরিশিষ্ট
সতেরো বছর পরের কথা। এক মেঘলা দুপুরে জয়নাল নিউইয়র্কে জন,এফ. কেনেড়ি এয়ারপোর্টে নামল। তার সঙ্গে তার স্ত্রী, দুই পুত্র-কন্যা।
জীবন তার মঙ্গলময় হাত দিয়ে জয়নালকে স্পর্শ করেছে। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় সে অনেকদূর উঠে এসেছে।
জয়নালের বড় মেয়ে শর্মি খুবই অবাক হয়ে বলল, মা দেখ তো কাণ্ড! বাবা কাঁদছে। শর্মির মা ইতি বলল, বাবার দিকে এইভাবে তাকিয়ে থেকো না। সে কাঁদছে কাঁদুক।
এরকম করে কাঁদছে কেন মা?
ইতি বলল, আমেরিকা আসা নিয়ে তোমার বাবার অনেক দুঃখময় স্মৃতি আছে। এই জন্যে কাঁদছে।
জয়নালের ছোট ছেলে টগর বলল, আমেরিকা বেড়ানো শেষ হলে আমরা ইউরোপ যাব। বাবা বলেছিল নিয়ে যাবে। সত্যি কি নিয়ে যাবে?
ইতি বলল, তোমার বাবা যদি বলে থাকে নিয়ে যাবে তাহলে অবশ্যই নিয়ে যাবে।
শর্মি বলল, বাবা কেমন হাউমাউ করে কাঁদছে। সবাই তাকাচ্ছে বাবার দিকে। আমার খুব লজ্জা লাগছে। মা, আমি কি বাবার কাছে যাব?
ইতি বলল, না। তোমার বাবাকে একা কাঁদতে দাও। এসো আমরা দেখি আমাদের নিতে গাড়ি এসেছে কি-না।
নিউইয়র্কে জয়নালের একটি ব্রাঞ্চ অফিস আছে। বড় সাহেব প্রথমবারের মতো আমেরিকা আসবেন এই খবর তারা পেয়েছে। তারা লিমোজিন নিয়ে এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছে।
———–
আহ! এমন লেখা যার হাতের ছোঁয়ায় ঝরে পড়তো তিনি আজ আর আমাদের মাঝে নেই।
আমাদের মাঝেই আছেন।