১০. পূর্ণিমার পরের দিন

১০.

পূর্ণিমার পরের দিন কিকিরা দলবল নিয়ে ঘোড়া-সাহেবের কুঠিতে হাজির হলেন। তখন সন্ধে হয়-হয়। কুঠির বাইরে জিপগাড়িতে লোচন আর নকুল। চারদিকে নজর রেখে বসে থাকার কথা, কিন্তু এই বিশাল কুঠিবাড়ির চারদিক তাদের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। যতটা চোখ যায়, দেখছিল। কাল কোজাগরী গিয়েছে, আজও ফুটফুটে জ্যোৎস্না, আকাশ মাঠ ভেসে যাচ্ছে চাঁদের আলোয়।

কিকিরা আজ ফকিরকে সঙ্গে নিয়েছেন। ফকির প্রথমটায় আসতে চাননি, কিকিরা তাকে বুঝিয়ে বলেছেন, “তোমার যাওয়া দরকার। তুমি না গেলে আমার কাজের কাজ কিছুই হবে না। কাজেই, ফকিরও এসেছেন। সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটছিলেন।

নিচের তলায় ঘোরাঘুরির কোনো দরকার ছিল না; সোজা দোতলায় উঠে এসে কিকিরা বারান্দায় দাঁড়ালেন। সন্ধে যত ঘন হয়ে আসছে, জ্যোৎস্না তত উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। গাছপালার মাথায় জ্যোৎস্না, অর্ধেকটা বারান্দায় চাঁদের আলো এসে পড়েছে। চারদিক নিঝুম। বাতাস দিচ্ছিল। অনেকটা তফাতে রাশি-রাশি জোনাকি উড়ছে।

কিকিরার হাতে বড় টর্চ, আর সেই সরু ছড়ি। ফকিরের হাতেও রড় টর্চ। তারাপদর এক হাতে লণ্ঠন বাড়ি থেকে বয়ে আনতে হয়েছে; কেননা, কুঠিবাড়ির ঘরে যে-লণ্ঠনটা আছে, সেটা জ্বলবে কি না কে জানে। এসব কিকিরার পরামর্শ। তারাপদর অন্য হাতে একটা ঝোলানো ব্যাগ, তার মধ্যে খুচরো কতক জিনিস, চন্দনের কাঁধে বন্দুক। ফকির বন্দুকটা সঙ্গে করে এনেছেন। চন্দন বন্দুক বইছিল।

বারান্দায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর কিকিরা ফকিরকে বললেন, “চলো, ঘরে যাই।”

দোতলায় সেই ঘর যেমন ছিল, সেই রকমই পড়ে আছে। তারাপদ লণ্ঠনটা জ্বালাল। কিকিরা জানলা দুটো খুলে দিলেন।

চারজনে বসে-বসে সিগারেট শেষ করলেন। তারাপদ একবার বারান্দায় গেল, ফিরে এল।

ফকির বললেন, “তুমি কি সত্যিই মনে করো, অমূল্য আসবে?”

 মাথা নাড়লেন কিকিরা। “আসবে। আসা উচিত।”

চন্দন বলল, “যদি না আসে?”

“তা হলে বুঝব, আমার চালাকি খাটল না।”

ফকির আর কিছু বললেন না। চন্দন তারাপদকে নিয়ে আবার বারান্দায় চলে গেল।

সময় যেন আর কাটছিল না। চুপচাপ বসে থাকাও যায় না। কিকিরা ফকিরের সঙ্গে মাঝে-মাঝে কথা বলছিলেন। তারাপদ আর চন্দন ঘরে এল।

তারাপদ বলল, “কোথাও কোনো ট্রেস পাচ্ছি না কিকিরা, অমূল্য বোধহয় এলেন না।”

কিকিরা বললেন, “দেখো, শেষ পর্যন্ত কী হয়।”

আরও খানিকটা সময় কাটল। কিকিরা উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারি করলেন। ফকিরকে মাঝে-মাঝে এ-কথা সে-কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। আবার একসময় ফিরে এসে লোহার খাটটায় বসলেন।

ফকির ক্লান্ত হয়ে হাই তুললেন। চন্দন হতাশ হয়ে নিশ্বাস ফেলল। বলল কিছু।

কিকিরাও হতাশ হয়ে পড়েছিলেন।

হঠাৎ একেবার আচমকা ঘর কাঁপানো শব্দ হল, আর সঙ্গে-সঙ্গে ছিটকে গেল লণ্ঠনটা, কাঁচ ভাঙল, মাটিতে পড়ে দপদপ করে জ্বলতে জ্বলতে নিবে গেল। ঘরের মধ্যে কেমন ধোঁয়াটে ভাব, কেরোসিম আর গন্ধকের গন্ধ।

কিকিরা আর ফকির প্রায় লাফ মেরে খাটের তলায় বসে পড়েছেন ততক্ষণে, তারাপদ আর চন্দন দেওয়ালের দিকে সরে গেছে।

জানলার দিকে তাকালেন কিকিরা। জানলা দিয়ে এসেছে গুলিটা। ঘর অন্ধকার। টর্চ জ্বালানো উচিত নয়, জ্বালালেই বিপদ। কিকিরা ফকিরের হাতে। চাপ দিলেন, ফিসফিস করে বললেন, “টর্চ জ্বেলো না।”

ঘর থমথম করতে লাগল।

জানলা দিয়ে কেউ ভেতরে আসছিল। বাইরের জ্যোৎস্নার দরুন তাকে অস্পষ্ট, ভুতুড়ে ছায়ার মতন দেখাচ্ছিল।

“কে, অমূল্য?” ফকির অস্ফুট গলায় আচমকা বললেন।

 মূর্তি ততক্ষণে ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে, জানলার কাছে। বলল, “হ্যাঁ।”

“তুমি আমাদের ওপর বন্দুক চালালে?”।

“বন্দুক চালাইনি। পটকা চালিয়েছি। বাতিটা নিবিয়ে দিলাম। টর্চ। জ্বালাবার চেষ্টা করো না। তোমার সেই পুরনো বন্ধু কোথায়?”

ফকির চুপ করে থাকলেন। কিকিরা জবাব দিলেন, “আমি হাজির। রয়েছি।”

“হাজির রয়েছেন, তা জানি। আমিও হাজির। আপনি আমায় আসতে বলেছিলেন?”

“শশিপদ বলেছে?”

“হ্যাঁ।”

“হ্যাঁ, বলেছিলাম।”

“কেন?”

“কথা বলব বলে।”

“কিসের কথা?”

“তোমাকে তুমিই বলছি, রাগ করো না, তুমি ফকিরের ছোট ভাই।”

“বেশ বলুন।”

কিকিরা যে অন্ধকারে সন্তর্পণে কী করছিলেন, ফকিরও জানতে পারছিল না। কিকিরা বললেন, “এই কুঠিবাড়ি নিয়ে তোমাদের দুই ভাইয়ের ঝগড়ার মিটমাট হয় না?”

অমূল্য রাগল না, তবু গলার স্বর অন্যরকম শোনাল। “আপনি আমাদের মধ্যে নাক গলাতে কেন এসেছেন? বাড়ির ব্যাপার বাড়ির মধ্যেই মিটে যাওয়া ভাল।“

“তুমি আমায় ভুল বুঝছ! আমি নাক গলাতে আসিনি। তা ছাড়া আমি এসে খারাপ তো কিছু করিনি। ধরো, এই বাড়ির মধ্যে যে-জিনিসটা রয়েছে সেটার হদিস তো পেয়েছি।”

এবারে অমূল্য উপহাসের গলায় বলল, “আমার চোখে আপনি ধূলো দেবার চেষ্টা করবেন না। কলকাতা থেকে দুটো ছোকরার সঙ্গে করে এনেছেন। তার মধ্যে একটাকে আপনি পুলিসের নোক বলে চালাতে চাইছিলেন। সে ডাক্তার।”

কিকিরা ঘাবড়ালেন না। বললেন, “তোমার সব দিকে নজর আছে। লোকজনও জায়গা-মতন রেখে দিয়েছ, দেখছি। ফকিরের বাড়িও বাদ দাওনি। কিন্তু, এই ব্যাপারটায় ভুল করছ।”

“কোন ব্যাপারে?”

“এই বাড়ির মধ্যে কী আছে, তা আমি জানতে পেরেছি।”

“অসম্ভব। আপনি পারেন না।”

“বেশ, তা হলে তুমি আমার জানার একটা নমুনা দেখো। …যেখান দিয়ে তুমি উঠে এসেছ, সেখানে যাও। ওই জানলাটার কাছে। প্রথম জানলার ডান দিকের কাঠের মাথার দিকে হাত দাও। একটা জায়গায় ছোট্ট গর্ত-মতন দেখবে। একটা আঙুল বড় জোর ঢুকতে পারে। সেখানে আস্তে-আস্তে চাপ দাও…। সোজা চাপ দেবে। যখন বুঝবে লোহার মতন কিছুতে আঙুল ঠেকছে–তখন জোরে চাপ দেবে। যাও, দেখো।”

অমূল্য সামান্য চুপ করে থাকল, ভাবল।”কী হবে চাপ দিলে?”

“যা হবে, দেখতেই পাবে। জানলার ডান দিকের কাঠ সরে ফোকর বেরুবে।”

“আপনি যে সত্যি কথা বলছেন, তার প্রমাণ কী?”

“দেখতেই পাবে। সাধুবাবা ওই জিনিসটি হাতছাড়া করেননি।”

“তা হলে আপনিই বা করছেন কেন?”

“আমি যা বলেছি তুমি মন দিয়ে শোনোনি। আমি বলেছি, হদিস পেয়েছি, বলিনি সেটা আমার হাতে এসেছে।”

“আপনি হদিস পেয়েছেন অথচ হাতাননি? দাদা আপনাকে বৃথাই এনেছে?” অমূল্য বিদ্রূপ করল যেন।

“না, হাতাতে পারিনি। এক জায়গায় আটকে গিয়েছি।”

অমূল্য আর কোনো কথা বলল না, জানলার দিকেই ফিরে গেল।

কিকিরা তাঁর সেই ছড়ির মধ্যে থেকে লিকলিকে গুপ্তিটা আগেই বার করে নিয়েছিলেন। আস্তে আস্তে নিঃশব্দে উঠলেন। ওঠার আগে ফকিরের হাতে। চাপ দিলেন সামান্য।

অমূল্য জানলার কাঠের ফ্রেমে হাত রেখে দাঁড়াল। বন্দুকটা বাঁ হাতে নিয়ে ডান হাতে কাঠের চারদিক হাতড়াতে লাগল।

কিকিরা ছায়ার মতন অমূল্যর পিছনে গিয়ে গুপ্তির ডগাটা একেবারে তার ঘাড়ের কাছে ছোঁয়ালেন।

চমকে উঠে অমূল্য হাত নামাল।

কিকিরা শান্ত গলায় বললেন, “বন্দুক ধরার চেষ্টা আর কোরো না। আমার। গুপ্তি দিশি নয়, বিলিতি, উইনস্টন কোম্পনির, তোমার গলা ফুটো হয়ে যাবে।”

অমূল্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

কিকিরা ফকিরকে টর্চ জ্বালতে বললেন। টর্চ জ্বালালেন ফকির! আলোয় অমূল্যকে দেখা গেল। কেমন যেন স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে।

কিকিরা তারাপদকে বন্দুকটা সরিয়ে নিতে বললেন। তারাপদ এগিয়ে এসে বন্দুক সরিয়ে নিল। একনলা বন্দুক।

ফকির কিকিরার পড়ে-থাকা টর্চটা মাটি থেকে উঠিয়ে নিয়ে সেটাও জ্বেলে ফেললেন।

সামান্য চুপচাপ। কিকিরা অমূল্যকে ঘুরে দাঁড়াতে বললেন।

জোড়া টর্চের আলোয় অমুল্যকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। কালো প্যান্ট, কালো জামা, পায়ে মোটা কেডস। স্বাস্থ্যবান চেহারা।

কিকিরা বললেন, “তুমি যথেষ্ট সাহসী; কিন্তু চালাক নও। আমি ম্যাজিশিয়ান, কথায় ভুলিয়ে দশ আনা কাজ হাসিল করি। যাক গে, তোমার সঙ্গে সরাসরি কয়েকটা কথা বলতে চাই। ফকির এখানে রয়েছে। কথা বলতে রাজি আছ?”

অমূল্য ভাবল কিছু। বলল, “রাজি। কিন্তু একটা কথা, আমি আপনাদের কাউকে গুলি করতে চাইনি। চাইলে করতে পারতাম। আমার গুলি ফসকায় না। তা ছাড়া, আমি কিন্তু একা আসিনি। আপনাদের মতন আমারও লোক আছে নিচে। আমার যদি কোনো ক্ষতি হয়, তা হলে..”

কিকিরা বললেন, “না, তোমার ক্ষতি হবে না। আমি জানি, তুমি আমাদের কারও ওপর গুলি চালাওনি।”

“বেশ, তা হলে বলুন।” কিকিরা গুপ্তিটা নামিয়ে নিলেন। বললেন, “তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে এই কুঠিবাড়ি নিয়ে রেষারেষি শুরু হল কেন হঠাৎ?”

অমূল্য কোনো জবাব দিল না।

কিকিরা বললেন, “সাধুবাবা এখানে আসার পর তোমাদের এই রেষারেষি। ওই সাধুবাবা যে তোমাদের ছোটকাকা, তা নিশ্চয় জানতে পেরেছিলে!”

“পেরেছিলাম। কাকা নিজেই লোক মারফত গোপনে খবর দিয়েছিল।”

“তাঁকে তোমরা বাড়িতে নিয়ে যাওনি কেন?”

অমূল্য একবার ফকিরের দিকে তাকাল।”সেটা অসম্ভব ছিল।”

“তোমাদের কাকা তা হলে এখানে এসেছিলেন কেন?”

“দাদাকে জিজ্ঞেস করুন।”

 কিকিরা ফকিরের দিকে তাকলেন।

ফকির সামান্য চুপচাপ থাকার পর বড় করে নিশ্বাস ফেললেন। বললেন, “আমি যা বলতে চাইনি, কিঙ্কর, এবার আর তা না বলে উপায় নেই। আমি যা বলছি, তা সত্যি। …আমাদের ছোটকাকা আমাদের বংশের কুলাঙ্গার। অনেক কাল আগের কথা, আমার বাবা, মেজকাকা–মানে অমূল্যর বাবা–দুজনেই জীবিত। মেজকাকার নতুন বাড়িও তৈরি হয়ে গিয়েছে। আমাদের তখন বয়েস কম, বাড়িতে প্রায়ই ছোটকাকাকে নিয়ে গণ্ডগোল হতে শুনতাম। দিন দিন অশান্তি বেড়েই চলল। শেষে একদিন ছোটকাকা উধাও হয়ে গেল। কিছুদিন পরে ফিরে এল গেরুয়া পরে। আবার একদিন উধাও। তারপর শুনলাম, কাকা আমাদের বংশের সমস্ত সৌভাগ্যের যা মূল সেটা চুরি করে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে। আমাদের বাড়িতে চার পুরুষের এক মনসামূর্তি ছিল, সোনার মুর্তি, অপরূপ দেখতে, মূর্তির চোখে হীরে। আরও কিছু দামি পাথর ছিল গায়ে। মূর্তির সঙ্গে ছিল একটা সোনার সাপ, তার দু চোখে দুটো লাল চুনি। এই মূর্তি কোনোদিন বাইরে থাকত না, থাকত সিন্দুকের চোরা-খোপের মধ্যে। মনসাপুজোর দিন তার পুজো হত বাড়িতে। ঠাকুরঘরে। আবার সেটা সিন্দুকে তুলে রাখা হত।” ফকির থামলেন, যেন একটু দম নিচ্ছিলেন।

কিকিরা বললেন, “নিশ্চয় খুব মূল্যবান মূর্তি?”

“তা তো হবেই–টাকায় শুধু মূল্যবান নয়, অমন মূর্তি ভূ-ভারতে খুঁজে পাবে কি না সন্দেহ! …আমাদের বংশে ওই মূর্তির অন্য মূল্য। সে তোমরা বুঝবে না। ছোটকাকা ওই মূর্তি নিয়ে পালিয়ে যাবার পর কাকাকে আমরা ত্যাগ করলুম। বাবা আর মেজকাকা শপথ করিয়ে নিলেন, ভবিষ্যতে কোনোদিন ওই কুলাঙ্গার, আর এই বংশের কারও কাছে যেন একদিনের জন্যেও আশ্রয় না পায়। তাকে বিষয় সম্পত্তির এক কানাকড়িও যেন না দেওয়া হয়। আমরা এই প্রতিজ্ঞা ভাঙিনি। কেমন করে ভাঙব?”

কিকিরা বললেন, “বেশ, প্রতিজ্ঞা না হয় না ভাঙলে কিন্তু তোমাদের ছোটকাকা যেন জীবিত, এটা জানতে?”

মাথা নাড়লেন ফকির।”না, আমরা জানতাম, কাকা মারা গিয়েছে। বিশেষ করে সাপের কামড়ে মারা যাবার খবর শুনে আমাদের মনে হয়েছিল, যা হওয়া উচিত তাই হয়েছে। মা মনসাই তাঁর শোধ নিয়েছেন।”

“কিন্তু ওই কাকা এখানে কেন এসেছিলেন? তাঁর উদ্দেশ্য কী ছিল?”

“উদ্দেশ্য কী ছিল, আগে বুঝিনি। যখন খবর পেলাম কাকা এসে ঘোড়া-সাহেবের কুঠির কাছাকাছি রয়েছে, গোপনে দেখা করতে বলেছে–তখন ভেবেছিলাম হয়ত কাকা বুড়ো বয়সে তার কৃতকর্মের জন্যে অনুতাপ জানাতে চায়। তারপর শুনলাম, কাকা আমাদের বংশের সেই মূর্তি আর সাপ নিজের কাছেই গচ্ছিত রেখেছিল, এখন তা ফেরত দিয়ে যেতে চায়।”

“কে তোমায় এ কথা বলেছে?”

“বিশু।”

“তুমি নিজে কেন কাকার সঙ্গে দেখা করতে যাওনি?”

“রাগে, ঘেন্নায়। তা ছাড়া আমি গেলে কাকা কিছু বলত না। বিশুকেই যেতে বলেছিল।”

কিকিরা অমূল্যর দিকে তাকালেন। বললেন, “তুমিও কি নিজে যাওনি, অমূল্য?”

“আমি নিজেই একদিন গিয়েছিলাম। কাকা আমায় ওই একই কথা বলেছিল–দাদা যা বলল।”

“তারপর? সাধুবাবা যেদিন বিশুকে নিয়ে এই কুঠিবাড়িতে এল, সেদিন তুমি নিজে না এসে তোমার শালা চরণকে পাঠালে কেন?”

অমূল্য চুপ। তার মুখ কেমন শক্ত, কালো হয়ে আসছিল। দাঁতে দাঁত চাপল অমূল্য। হঠাৎ দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলল।”আমি বলব না, বলতে পারব না।”

তারাপদ, চন্দন দুজনেই পাথরের মতন দাঁড়িয়ে।

কিকিরা বললেন, “আমি বলছি। জানি না, ঠিক বলছি কি না! …তোমার কাকা তোমায় বলেছিলেন, তিনি বিশুকে ভুলিয়ে কুঠিবাড়ির এই ঘরে নিয়ে আসবেন। তোমার কাজ হবে, বিশুকে গুলি করে মারা। তাকে আগে মারব, তারপর তিনি তোমায় মনসা-মূর্তি দেবেন। তাই না?”

অমূল্য ছটফট করছিল। বলল, “হ্যাঁ। কাকা তাই বলেছিল। কিন্তু আমি অমূল্য রায়। মামলা-মোকদ্দমা, জমিজিরাত নিয়ে লাঠালাঠি ফৌজদারি করতে পারি; নিজের ভাইপোকে গুলি করতে পারি না।”

“নিজের হাতে পারবে না বলে চরণদের পাঠিয়েছিলে?”

অমূল্য রুক্ষভাবে কিকিরার দিকে তাকাল।”হ্যাঁ। …কিন্তু আপনি যা বলছেন, তা নয়। আমি চরণকে বলেছিলাম, ওই শয়তানের কাছ থেকে আগে মূর্তির খবর জেনে নেবে, তারপর তাকে কুকুরের মতন গুলি করে মারবে। বিশুর গায়ে যেন আঁচড় না পড়ে।” কথা শেষ করার আগেই অমূল্য প্রায় কেঁদে ফেলল; জড়ানো গলায় বলল, “আমি ইতর নই, জন্তু নই; বিশুকে চরণরাই যে পরে কুঠির বাইরে এনেছে, সে-খবর আপনি রাখেন?”

“না। তবে আমার সন্দেহ ছিল।”

“দাদা আপনাকে যা বলেছে, আপনি তাই বিশ্বাস করেছেন।”

কিকিরা সামান্য অপেক্ষা করে অমূল্যকে বললেন, “আমি তোমার সমস্ত কথা। বিশ্বাস করছি, অমূল্য। বিশুকে গুলি করার দরকার হলে চরণরা যে-কোনো সময়ে সেটা করতে পারত। সাধুবাবার সঙ্গে বচসা করত না।” বলে অমূল্যের কাঁধে হাত দিলেন, যেন সান্ত্বনা জানালেন।

অমূল্য ক্ষোভের গলায় বলল, “দাদা আপনাকে ভুল বুঝিয়েছে। বিশুর সঙ্গে আমার শত্রুতা নেই।”

ফকির চুপ করে ছিলেন।

কিকিরা ফকিরকে বললেন, “ফকির, তুমি আমার কাছে অনেকগুলো বাজে কথা, মিথ্যে কথা বলেছ। শুধু মিথ্যে বলোনি, নিজের ছেলেটাকে তুমি লোকের চোখের আড়ালে রেখেছ, তাকে অনর্থক একগাদা ঘুমের ওষুধ খাইয়েছ, অ্যাবনরমাল করে রেখেছ! কেন? তোমার কি সবসময় ভয় হত, বিশু স্বাভাবিক থাকলে সব কথা সাফসুফ বলে দেবে?”

ফকির মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। অনেকক্ষণ পরে বললেন, “হ্যাঁ সে-ভয় ছিল। তবে তোমায় আমি আগেই বলেছি, আমাদের বংশের এমন কয়েকটা কথা আছে, যা আমরা বাইরে বলতে চাই না। বলতে পারি না। বলা নিষেধ। ছোটকাকার কথা, মনসার মূর্তির কথা আমি বাইরে প্রকাশ করতে চাইনি। আজ বাধ্য হয়ে বললাম তোমায়।”

“তা অবশ্য বললে, ফকির,” কিকিরা একটু ইতস্তত করে বললেন, “আমার কিন্তু মনে হচ্ছে, তুমি আমার অমূল্য–দুজনেই আলাদা-আলাদা ভাবে তোমাদের কাকার কাছ থেকে মূর্তিটি পেতে চেয়েছিলে। তার জন্যেই এত!”

ফকির চুপ। অমূল্যও কথা বলল না।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর কিকিরা বললেন, “ফকির, আমি যেদিন তারাপদকে নিয়ে তোমার বাড়িতে এলাম, দোতলা থেকে কে বন্দুক ছুঁড়েছিল? তুমি বলছ বিশু। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয়নি।”

“আমি ছুঁড়েছিলাম,” ফকির বললেন।

”কেন?”

“তোমায় ঠকাতে চেয়েছিলাম। না না, ঠকানোই বা কেন। আমি তোমায় বোঝাতে চেয়েছিলাম, বিশু কেমনকী বলব–পাগল-পাগল ব্যবহার করছে। …আমায় তুমি ক্ষমা করো, ভাই।”

কিকিরা কেমন ম্লান মুখ করে হাসলেন। বললেন, “আমায় তুমি সব কথা যদি খুলে বলতে ফকির, ভাল হত। তুমি অন্যায় করেছ! তা ছাড়া, আমার মনে হয় তুমি আমায় অন্যভাবে একটা কাজে লাগাতে চেয়েছিলে–সেই মনসামূর্তি যদি আমি খুঁজে বার করতে পারি এই কুঠিবাড়ি থেকে, তাই না?”।

মাথা নাড়লেন ফকির।”না কিঙ্কর আমি মোটেই তা চাইনি। তুমি কলকাতা থেকে হঠাৎ আমার কাছে সেবার বেড়াতে এলে! এসে দেখলে আমি ঝঞ্ঝাটে রয়েছি। আমি তোমায় সব কিছু খুলে বলতে পারছিলাম না। বিশু তখনো ধাক্কা সামলাতে পারেনি। আমি যে কী করব ঠিক করতে না পেরে বোকার মতন নিজের পায়ে কুড়ল মেরেছি। তোমায় মিথ্যে কথা বলেছি, ছেলেটাকেও জবুথবু করে রেখেছি। তুমি না এলে ব্যাপারটা এতদূর গড়াত না বোধহয়। তবে সত্যি বলছি, পরে আমার মনে হয়েছিল, তুমি যদি কুঠিবাড়ি থেকে মনসামূর্তি উদ্ধার করতে পারো–ভালই হয়। অবশ্য সে-আশা আমার কমই ছিল।”

“কম ছিল, তবু তোমাদের বিশ্বাস ছিল মূর্তিটা এই বাড়িতেই আছে।”

 “হ্যাঁ,” অমূল্য বলল, “কাকা যদি ও-ভাবে পালিয়ে যায় তবে মূর্তি কোথায় থাকবে?”

কিকিরা বললেন, “সে-মূর্তি উদ্ধার হবে কেমন করে! তোমাদের ছোটকাকা অনেক আগেই বেচেবুচে দিয়েছেন। বাইরে সন্ন্যাসী হলেও ভেতরে কি তিনি তাই ছিলেন? যে মানুষ বাড়ি থেকে লক্ষ টাকার জিনিস চুরি করে, সে-মানুষ সাধু?” অমূল্য বলল, “তাই যদি হবে, তবে কাকা এসেছিল কেন এখানে?”

“কেন এসেছিল বুঝতে পারো না?”

“না।”

“প্রতিশোধ নিতে। যাকে তোমরা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছ, বংশ থেকে বাদ দিয়েছ, এক কানাকড়ি সম্পত্তিও দাওনি, সে যে তোমাদের ক্ষমা করবে, একথা বিশ্বাস করা মুশকিল। তার হাতে যতকাল টাকা পয়সা ছিল, ফুর্তি ফাতা করে দিন কাটিয়েছে। তারপর হয়ত তার দুর্দিন গিয়েছে। শেষে যখন বুঝল, তোমাদের ভাইয়ে-ভাইয়ে সম্পত্তি নিয়ে ভাগাভাগি গণ্ডগোল রেষারেষি চলছে, তখন সে এল। এল মতলব নিয়ে। তোমাদের মধ্যে আরও রেষারেষি, খুনোখুনি বাধিয়ে এই বংশ প্রায় শেষ করে দিতে। ধরো, অমূল্য–তুমি যদি বিশুকে সত্যিই খুন করতে, ফকির তোমায় ছাড়ত না, সেও তোমায় খুন করত। দু’তরফে বিদ্বেষ, খুনোখুনি, রক্তারক্তি চলত। তারপর কোথায় গিয়ে এই শত্রুতার শেষ হত, ভগবানই জানেন।”

“কাকা এত নীচ?”

“নীচ, উন্মাদ। তার যদি অনুতাপ হত, সে গাছতলায় বসেই তোমাদের দুজনকে ডেকে মনসামূর্তি ফেরত দিত। কেন সে এই ষড়যন্ত্রের মধ্যে যাবে?”

অমূল্য রাগে কাঁপছিল। বলল, “আমি সেদিন চরণকে বলেছিলাম, ওকে কুকুরের মতন গুলি করে মারতে। আর কোনোদিন যদি দেখতে পাই, আমি তাকে নিজের হাতে গুলি করে মারব।”

“আর কোনোদিন তাকে পাবে না। আর কি সে আসে? …নাও চলো, রাত হয়ে যাচ্ছে।”

ঘরের বাইরে এসে কিকিরা অমূল্যকে বলল, “ওই ঘোরানো সিঁড়ি, ওই জানলার কথা তুমি আগে জানতে?”

মাথা নাড়ল অমূল্য।”না, কেমন করে জানব। এখানে কে আসে? যদি জানতাম, তা হলে কি কাক পালাতে পারত! আমরা ভেবেছিলাম, গুলি খেয়ে জানলা দিয়ে লাফ মেরেছে। পরের দিন খোঁজ করতে গিয়ে সিঁড়িটা দেখি। সিঁড়িটা বড় অদ্ভুত, বাগানে গিয়ে শেষ হয়েছে। গাছপালার মধ্যে। কাকা ওখান থেকেই পালিয়েছে।”

কিকিরা বললেন, “শশিপদ বলেছে, তোমাদের কাকা এখনো বেঁচে আছে।”

“শশিপদ কাকার হয়ে খবরাখবর দিত। আমি তাকে পয়সা দিয়ে কাজে লাগিয়েছিলাম। আজ সে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে। ভয়ে। সহজে আর আসছে না।”

কুঠিবাড়ির নিচে এসে কিকিরা বললেন, “তোমার লোকজন কোথায়? ডাকো।”

অমূল্য একটু হাসল। তারপর শিস দেওয়ার মতন করে শব্দ করল। তীক্ষ্ণ শব্দ। বলল, “চলুন, ওরা আসবে। পেছনেই।”

হাঁটতে হাঁটতে কিঙ্কর বললেন, “একটা কথা তোমাদের দুজনকেই বলি। রক্তে যদি তোমাদের মামলা-মোকদ্দমা থাকে ভাই, সেটা আর কে রুখবে। তবে এই খুনোখুনি-রক্তারক্তিটা ভাইয়ে-ভাইয়ে না থাকাই ভাল। …তা ছাড়া, যা গিয়েছে তা যখন আর ফিরে আসবে না, তখন তোমরা ও নিয়ে আর চিন্তা কোরো না। তোমাদের কাকা যা চুরি করে নিয়ে পালিয়েছেন, সেটা তোমাদের বংশের সৌভাগ্যের লক্ষ্মী হতে পারে কিন্তু তিনি যা দিতে এসেছিলেন, সেটা দুভাগ্য। তোমরা বেঁচে গিয়েছ।”

ফকির চঞ্চল হয়ে পড়েছিলেন, কিকিরার হাত ধরে ফেললেন আবেগে। বললেন, “কিঙ্কর, আমি তোমার কাছে বড় ছোট হয়ে গেলাম। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি যা করেছি, তা দায়ে পড়ে। বোকার মতন কাজ করেছি। আমায় ক্ষমা করো।”

কিকিরা ফকিরের কাঁধে হাত রেখে হেসে বললেন, “আমি সবই বুঝেছি। নাও, চলো। চলো, অমূল্য।”

পেছনে পায়ের শব্দ শোনা গেল। মুখ ফিরিয়ে তাকালেন কিকিরা। তারপর হেসে অমূল্যকে বললেন, “তুমি দেখছি, অনেক সৈন্যসামন্ত এনেছিলে।”

অমূল্য লজ্জা পেয়ে হাসল।

তারাপদ আর চন্দন কিকিরার পেছনে। চাঁদের আলোয় অতগুলো মানুষ ঘোড়া-সাহেবের কুঠির বাগান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, যেতে-যেতে শুনল দমকা বাতাস এসে গাছপালার পাতায় কেমন এক শব্দ তুলেছে।