পীর সাহেব বলেছিলেন টুকু সাতদিনের মাথায় ফিরে আসবে। কিন্তু সত্যিই যে সাতদিনের মাথায় টুকু এসে উপস্থিত হবে এই বিশ্বাস হীরুর ছিল না। কাজেই ভোর বেলা দরজা খুলে টুকুকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখে সে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেছে। মনে মনে দুবার বলল, এ ভেরি গ্রেট পীর সাহেব! এ ভেরি গ্রেট পীর সাহেব।
মুখে সে অবশ্যি রাগ এবং বিরক্তির ভঙ্গি ফুটিয়ে বলল, টুকু নাকি? একি চেহারা হয়েছে। তুই তো দেখি কংকাল হয়ে গেছিস; স্কেলিটন। শরীরে তো হাডিড ছাড়া কিছু দেখছি না। ছিলি কোথায়?
টুকু জবাব দিল না। কথা না-বলা তার অভ্যেস হয়ে গেছে।
হীরু বলল, বাসার সবাই একটা গ্রেট চিন্তার মধ্যে ছিল; আমি অবশ্যি চিন্তা করছিলাম না। পীর সাহেব চিন্তা করতে নিষেধ করেছিলেন। কলতা বাজারের পার। তোকে এক’দিন নিয়ে যাব। হেভি পাওয়ার লোকটার। আমার ধারণা শ খানেক জ্বীন তার হাতে আছে। বেশিও হতে পারে।
টুকুকে ফিরতে দেখে বাসার কেউ কোন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল না। মিনু একটি কথাও বললেন না।
সকালে খিচুড়ি নাশতা হল। সেই খিচুড়ির এক থালা টুকুর সামনে রেখে তিনি কঠিন গলায় বললেন খা। খেয়ে আমাকে উদ্ধার কর। টুকুর সঙ্গে এই হল তার প্রথম কথা।
তিথি ভাইকে দেখল। কিন্তু কিছু বলল না, হাসল। সেই হাসি চিন্তা দূর হবার হাসি। যা পরিষ্কার বুঝিয়ে দেয় টুকু ফিরে আসায্য সে খুশি হয়েছে।
জালালুদ্দিন রাগী গলায় খানিক ক্ষণ বকাঝকা করলেন; বকাঝকার ফাকে ফাকে উপদেশ দিলেন বাড়ি পালানো হচ্ছে একটা অসুখ। সরল অসুখের চিকিৎসা আছে কিন্তু বাড়ি পালানো অসুখ এবং ক্যানসার এই দুয়ের কোনো চিকিৎসা নেই। একবার যার বাড়ি পালানো রোগ হয়েছে সে দু’দিন পর পর পালাবে। এটা জানা কথা।
তিনি বেশিক্ষণ উপদেশ দিতে পারলেন না। তার প্লেটের খিচুড়ি শেষ হয়ে গেছে। শূন্য থালা সামনে নিয়ে কথা বলতে তার ভাল লাগে না। তিনি নিচু গলায় বললেন, ও মিনু খিচুড়িটা তো আসাধারণ হয়েছে। আতপ চাল ছিল তাই না? আতপ চাল ছাড়া এই জিনিস হয় না। আছে নাকি আরো?
মিনু বললেন না। এক হাতা দাও দেখি। মুখের ক্ষিধেটা যাচ্ছে না। পেট অবশ্যি ভর্তি। তবু মুখের ক্ষিধের ব্যাপার আছে
বললাম তো নাই।
ও আচ্ছা, ঠিক আছে। না থাকলে কী আর করা। আজ দুপুরেও খিচুড়ি করলে কেমন হয়? আতপ চাল কী আরো আছে?
চুপ কর তো। খাওয়া, খাওয়া আর খাওয়া। খাওয়া ছাড়াও তো আরো জিনিস আছে।
সেই জিনিসটা কী?
চুপ কর।
জালালুদ্দিন চুপ করতে পারলেন না। টুকুকে আবার উপদেশ দিতে শুরু করলেন বুঝলি টুকু, ঘর হচ্ছে মানুষের মা। শিশু থাকে মায়ের পেটের ভেতর। আমরা থাকি ঘরের পেটের ভেতর। সেই জন্যে ঘর হচ্ছে আমাদের মা! ঘর থেকে পালান মাকে অপমান করা। এই কাজ খবরদার করবি না। মায়ের পেট থেকে যে বের হয়ে যায় সে আর মায়ের পেটে ঢুকতে পারে না। তেমনি ঘর থেকে যে বের হয়ে যায় সে আর ঘরে ঢুকতে পারে না। বুঝলি?
টুকু মাথা নাড়ল। যেন সে এই জটিল ফিলসফি বুঝে ফেলেছে। তার মাথা নাড়া জালালুদ্দিন দেখতে পেলেন না। তবে টুকু যখন নিজের থালার খিচুড়ি বাবার থালায় ঢেলে দিল তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। চিকন গলায় বললেন, তুই খাবি না?
না।
না কেন? জিনিসটা তো ভাল হয়েছে।
ক্ষিধে নেই।
এইটুকু খিচুড়ি খেতে ক্ষিধে লাগে নাকি? এ তো দেখি পাগলের প্রলাপ।৷ ও মিনু একটা শুকনো মরিচ পুড়িয়ে এনে দাও তো।
টুকু বসে বসে বাবার খাওয়া দেখল। তার বড় ভাল লাগল। দুপুরে গেল বজলু ভাইয়ের খোঁজে।
বজলু তাকে দেকে আঁৎকে উঠে বলল, কী সর্বনাশ তোর একি অবস্থা! কোথায় ছিলি? টুকু সহজ গলায় বলল, এক জায়গায় বেড়াতে গিয়েছিলাম।
বেড়াতে যাবি, বলে যাবি না? তোর বড় ভাইকে এক’দিন জিজ্ঞেস করলাম–টুকু কোথায়? সে বলল, আমি কী করে বলব কোথায়? আমি কী ডিটেকটিভ? কী কথার কী উত্তর। তা তোর স্বাস্থ্যের এই অবস্থা কেন?
জ্বর হয়েছিল।
কাজের সময় জ্বরজারি বঁধিয়ে দিস, আশ্চর্য। তোর জন্যে শ্রাবণ সংখ্যা দেয়াল পত্রিকা বের হল না। শিল্প-সাহিত্য এইসব তো ছেলেখেলা না। এক’দিন করবি দশদিন করবি না তা তো হবে না। কমিটমেন্ট দরকার।
দুপুর থেকেই টুকু কাজে লেগে গেল। এবারে শ্রাবণ সংখ্যা দেয়াল পত্রিকা নতুন আঙ্গিকে বেরুচ্ছে। পুরো দেয়াল পত্রিকা পলিথিনের কাগজে মুড়ে বৃষ্টির মধ্যে রেখে দেয়া হবে। শ্রাবণ ংখ্যা পড়তে হলে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে পড়তে হবে। এই অসাধারণ আইডিয়া বজলুর মাথাতে এসেছে। এরকম আইডিয়া তার প্রায়ই আসে।
সন্ধ্যা না মেলানো পর্যন্ত টুকু দেয়াল পত্রিকার কাজ করল। সন্ধ্যা মেলাবার পরপর কাউকে কিছু না বলে চলে গেল বস্তির ঐ ঘরে।
বুড়ো লোকটি বারান্দায় বসে কাঠের চেয়ারে বেতের কাজ করছিল সে টুকুকে দেখে গলা ফাটিয়ে চোঁচাতে লাগল–ও মতির মা, ও মতির মা! ঐ পুলা আবার আসছে। জবান বন্ধ পুল। ঐ হারামজাদা তুই কৈ গেছিলি? আমরা চিন্তায় চিন্তায় অস্থির! ঐ পুলা দেহি এদিকে আয়।
শুধু মতির মা না, ঘরের সবাই বের হয়ে এল। টুকু এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন সে কিছুই বুঝতে পারছে না। মতির মা বলল, নয়া বৌ এই পুলাডার খাওন দাও। এ না খাইয়া সারাদিন কই কই যেন ঘুরছে।
নতুন বৌ তৎক্ষণাৎ ভাত বেড়ে ফেলল। ভাত এবং ডাটা দিয়ে রান্না করা ছোট মাছের তরকারি। তরকারিতে এমন ঝাল দেয়া হয়েছে যে মুখে দিলেই চোখে পানি এসে যায়। টুকু সেই আগুন ঝাল তরকারি তৃপ্তি করে খেল। ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসছে। তার ঘুমের জন্যে জায়গাও করে দেয়া হয়েছে। তবে সে ঘুমুচ্ছে না, অনেক কষ্টে জেগে আছে। তার এখানে আসার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে–শাড়ি দিয়ে ঘেরা অংশে নতুন বৌ এবং তার স্বামীর অভিনীত অংশটা দেখা। টুকু মনে মনে আশা করছে আজো যেন কুপী নিভাতে ওরা ভুলে যায়।