পিজি হাসপাতালের গেটের সামনে পরিচিতদের ভিড় দেখেই প্রতাপ থমকে গেলেন। সবাই নীরব। এরপর আর কোনো প্রশ্ন করার দরকার হয় না। প্রতাপ ভেতরে ঢুকলেন না, রেলিং-এর এক পাশে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালেন। কাছেই দু’ গাড়ি ভর্তি পুলিশ। এখন হাসপাতালের গেটেও পুলিশ পাহারা রাখতে হয়।
হাইকোর্টের বিচারপতি কিরণলাল রায়কে কুমোরটুলিতে তাঁর বাড়ির সামনেই গাড়ির মধ্যে গুলি করা হয়েছিল গতকাল। হাসপাতালে এনেও তাঁকে বাঁচানো গেল না। বিদ্বান ও সজ্জন। ছিলেন তিনি, তবু কয়েকটি অল্পবয়সী ছেলে নিছক একটি খুন করার জন্যই তাঁকে পৃথিবী থেকে অসময়ে সরিয়ে দিয়ে গেল। সরকারি কর্মচারি, পুলিশ, শিক্ষক, বিচারপতি এইরকম সমাজের নানা স্তরের মানুষদের এলোমেলো ভাবে খুন করে এরা সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে চায়। একমাত্র ব্যবসায়ীদের গায়েই এরা হাত ছোঁয়াচ্ছে না।
একটু পরে বিমানবিহারী বেরিয়ে এলেন হাসপাতালের চত্বর থেকে। ভুরু দুটো কুঁচকে আছে, শোকের বদলে তাঁর মুখে অসম্ভব একটা বিরক্তির ছাপ। প্রতাপকে দেখতে পেয়ে তিনি কাছে এসে বললেন, বডি বার করতে দেরি আছে, তুমি কি এখনো থাকবে?
প্রতাপ নিঃশব্দে দু’দিকে ঘাড় নাড়লেন।
বিমানবিহারী বললো, চলো, তাহলে আমার সঙ্গে চলো। পরে খবর নিয়ে না হয় শ্মশানে যাওয়া যাবে।
গাড়ির দরজা খুলে তিনি প্রতাপকে ভেতরে বসালেন। তারপর নিজে ঢুকেই প্রচণ্ড ঝাঁঝের সঙ্গে বললেন, এসব কী হচ্ছে বলো তো! কিরণ আমার ছেলেবেলার বন্ধু, গত সপ্তাহেও দেখা হয়েছিল তার সঙ্গে… এমনি ভাবে হঠাৎ তাকে চলে যেতে হলো। কয়েকটা বকাটে গুণ্ডা ছেলের জন্য! কোনো প্রোটেকশান নেই, এর কোনো বিহিত নেই!
প্রতাপ কোনো উত্তর না দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন।
বিমানবিহারী বললেন, আমি এখনও ভাবতে পারছি না, কিরণ আর নেই! এমন অকারণে একজন মানুষের জীবন যাবে! জানো প্রতাপ, আজ পর পর দুটো খারাপ খবর পেলুম। আজ কাগজে সন্তোষ ভট্টাচার্যের কথা পড়েছো?
প্রতাপ বললেন, না, খেয়াল করতে পারছি না তো! সন্তোষ ভট্টাচার্য কে?
–বহরমপুরের সৈদাবাদে খুন হয়েছেন সন্তোষ ভট্টাচার্য! আমার বিশেষ পরিচিত। আমাদের পাবলিকেশনের বই নিতে এসেছেন কতবার। শিক্ষক আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট নেতা এই সন্তোষবাবু, এবার পালামেন্টারি ইলেকশনে দাঁড়াবার কথা ছিল…সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরছিলেন ভদ্দরলোক, কটা ছেলে এসে তাকে ছুরি মেরে গেল। আচ্ছা বলো তো, অরাজকতা আর কাকে বলে! এইরকমভাবে আর কিছুদিন চললে সমাজ, সভ্যতা সব গোল্লায় যাবে। এ ওকে মারবে, সে তাকে মারবে! বুড়ো অজয় মুখার্জি দ্বিতীয়বার চীফ মিনিস্টার হয়ে এলো, একটা জোড়াতালি দেওয়া গভর্নমেন্ট, এরা ওয়েস্ট বেঙ্গলের সর্বনাশ করে দেবে না?
প্রতাপ ধীর স্বরে বললেন, যতবার এই রকম খুনের খবর কাগজে পড়ি কিংবা লোকের মুখে শুনি, আমার ভেতরটা পুড়তে থাকে। একটা প্রচণ্ড অপরাধবোধ,…এর জন্য আমিও তো কিছুটা দায়ী। আচ্ছা বলো তো বিমান, কী প্রায়শ্চিত্ত করা সম্ভব আমার পক্ষে?
।এক মুহূর্তে বিমানবিহারীর সমস্ত উত্তেজনা মিলিয়ে গেল, তিনি বিবর্ণ মুখে প্রতাপের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বন্ধুর হাত চেপে ধরে তিনি বললেন, না, না, প্রতাপ, আমি তোমাকে আঘাত দেবার জন্য কিছু বলিনি, বিশ্বাস করো, একই দিনে দু’জন চেনা মানুষের এরকম ঘটনা শুনে আমার এমন লেগেছে…না, না, তুমি এজন্য দায়ী হতে যাবে কেন?
–আমার দায়িত্ব নেই? আমার নিজের ছেলেই তো এইসব শুরু করেছে!
–ননসেন্স! তুমি এখনো ঐ ভুল ধারণাটা আঁকড়ে বসে আছো? তোমাকে তো কতবার বলেছি যে বাবলুর অ্যাকশানটা ছিল পিওরলি সেলফ ডিফেন্সে। রণজিৎ গুপ্ত নিজে আমাকে বলেছে। যে-ছেলেটা খুন হয়েছিল, সে ছিল একজন কনফার্মড ক্রিমিন্যাল, ওরা কয়েকজন বোমাড় নিয়ে বাবলুদের অ্যাটাক করেছিল। মনে করো, রাস্তায় একটা গুণ্ডা হঠাৎ তোমাকে মারতে এলো, তুমি উল্টে রেজিস্ট করবে না? সেই ছেলেটার সঙ্গে যে আর দু’জন ছিল, তাদের স্টেটমেন্ট আর বাবলুর বন্ধু তপনের স্টেটমেন্ট মিলে গেছে!
–বাবলুর কাছে রিভলভার কী করে এলো? রিভলভার ছোঁড়া শিখলই বা কবে? অথচ সে নিজের হাতে ফায়ার করেছে, তাতেও তো কোনো সন্দেহ নেই!
–রিভলভার ছোঁড়া শিখতে দোষ নেই। শিখে ভালোই করেছিল। নইলে সে নিজেই মরতো। তোমার দুটি ছেলের একটিও আর থাকতো না। তাছাড়া, বাবলুদের ঘটনাটা ঘটেছিল এখনকার এইসব পলিটিক্যাল খুনোখুনি শুরু হবার অনেক আগে,একটা স্ট্রে ইনসিডেন্ট, এসবের সঙ্গে কোনো যোগই নেই! প্রতাপ, তুমি ঐ এক ব্যাপার নিয়ে অবসেল্ড হয়ে থেকো না। ওসব তো চুকেবুকে গেছে!
–সত্যিই কি চুকে গেছে? বাবলু আর কোনোদিন দেশে ফিরতে পারবে?
–কেন পারবে না? ধরে নিতে পারো, প্র্যাকটিক্যালি বাবলুর নামে কেস ড্রপড হয়ে গেছে। বাবলুর যে অ্যাকমপ্লিস ছিল, যে বাবলুকে রিভলভারটা সাপ্লাই করেছে, সেই মানিক ভট্টাচার্যও মারা গেছে শুনেছো তো? কাগজেও বেরিয়েছিল খবরটা। রণজিৎ আমাকে বলেছে যে কোটে নাকি ঐ কেসের কাগজপত্রই আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সুতরাং ও নিয়ে আর কেউ কোনোদিন মাথা ঘামাবে না। এখন চতুর্দিকে এত সব কাণ্ড হচ্ছে, দু’আড়াই বছর। আগেকার ঐ সামান্য একটা ঘটনা কে মনে রাখবে?
প্রতাপ আবার একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন।
বিমানবিহারী প্রতাপের কাঁধ ছুঁয়ে বললেন, এবার যখন বাবলুকে চিঠি লিখবে, ওকে লিখে দিও ও এখন ইচ্ছে করলেই দেশে ফিরতে পারে। কোনো ভয় নেই। অবশ্য ও যদি আরও দু’এক বছর থেকে কিছু টাকা জমিয়ে আনতে চায়, সেটাও মন্দ না। মমতার নিশ্চয়ই ছেলেকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে!
গাড়িটা বিমানবিহারীর বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছে, হঠাৎ দেখা গেল গলির মুখে একটা হুড়োহুড়ি, লোকজন এদিকে সেদিকে ছুটছে। কিসের যেন একটা চিৎকার! ওখানে একটা কিছু সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটেছে। বিমানবিহারী ড্রাইভারের কাছে ঝুঁকে এসে আতঙ্কে চেঁচিয়ে বললেন, গাড়ি ঘোরাও, গজু, শিগগির গাড়ি ঘোরাও!
কয়েকটি রিকশা ও সাইকেল এলোমেলো ভাবে পালাচ্ছে, তারই মধ্য দিয়ে ড্রাইভার একটা ইউ টার্ন নিয়ে ঘুরিয়ে নিল গাড়ি। এলগিন রোডের কাছাকাছি এসে গাড়িটা থামলো। এখানে রাজপথের চিত্র একেবারে স্বাভাবিক। ট্রামবাস চলছে, লোকজন ঠিকঠাক হেঁটে যাচ্ছে, কোমারে চেন দিয়ে বাঁধা রিভলভার সমেত একজন ট্রাফিক পুলিশ হাত দেখাচ্ছে, তাকে পাহারা দিচ্ছে আর একজন পুলিশ!
বিমানবিহারী সাঙ্ঘাতিক মর্মবেদনার সঙ্গে বললেন, দিনে-দুপুরে নিজের বাড়িতেও ফিরতে পারব না? এই বর্বর দেশে আমরা বাস করছি! প্রতাপ, ওরা আমার বাড়ি অ্যাটাক করেনি তো? আমরা ভয়ে পালিয়ে এলাম!
প্রতাপ বললেন, না, না, তোমার বাড়ি অ্যাটাক করবে কেন?।
–কেন অ্যাটাক করবে, তার কি কোনো যুক্তি খোঁজার দরকার আছে? আমাদের কৃষ্ণনগরের বাড়িতে কারা আগুন লাগালো, কেন আগুন লাগালো, তা তো আজও জানা গেল না!
–তা হলে চলো আমরা ফিরে যাই। আমরা গাড়ির মধ্যে আছি, চাচামেচি দেখেই তক্ষুনি ফিরে না আসাই উচিত ছিল। একটু দেখে নিলে হতে।
–গাড়িতে থাকলেই বা কী সুবিধে? জাস্টিস কিবলাল রায় তো নিজের বাড়ির সামনে গাড়িতেই বসে ছিলেন! তিনি বাঁচতে পারলেন? এখন কী হবে, বাড়িতে মেয়েরা রয়েছে, একবার লালবাজারে যাবো?
–আমার মনে হয়, বিমান, একবার কাছাকাছি ফিরে গিয়ে দেখে নেওয়া যাক। আগে থেকেই বেশী প্যানিক করা ঠিক হবে না।
–আমাদের দেখতে পেলেই যদি… তোমার ওপরেও রাগ থাকতে পারে, একবার তোমার ওপর অ্যাটেমট নিয়েছিল, না, না, রিস্ক নেওয়া ঠিক হবে না, লালবাজারে গিয়ে ইনফর্ম করাই ভালো।
–আমার মনে হয়, আগে একবার তোমার বাড়িতে গিয়ে দেখে নেওয়াই উচিত। বাড়িতে মেয়েরা রয়েছে, যদি সত্যিই কিছু হয়ে থাকে…এখন তো দেখছো, পুলিশও প্রটেকশান দিতে পারছে না। গাড়িতে আমরা দু’জনে রয়েছি, ড্রাইভার আছে, এত ভয় কিসের?
ড্রাইভারও বললো, একবার বাড়িতে গিয়েই দেখুন না স্যার! আমার মনে হচ্ছে সীরিয়াস কিছু নয়, উটকো ঝামেলা।
গাড়ি আবার ফিরে এলো ভবানীপুরে। এখন তেমন উত্তেজনা নেই, গলির মুখটায় কিছু লোক জমে আছে শুধু, গলির মধ্যে বিমানের বাড়ির সামনে কেউ নেই। আজকাল ভিড় দেখলেই বরং অভয় পাওয়া যায়।
গাড়িটা গলির মধ্যে ঢুকতেই বিমানবিহারী জানলা দিয়ে মুখ বার করে জিজ্ঞেস করলেন, এই, কী হয়েছিল গো এখানে একটু আগে?
একটি ফার্মতন যুবক এগিয়ে এসে বললো, বিমানকাকা, ডেঞ্জারাস ব্যাপার হয়ে গেল। ঐ যে ইলেকট্রিকের দোকানটা দেখছেন, ওর ভেতরে একটা ছেলে বসে ছিল, মালিকের ভাইপো, সিউড়িতে থাকে, কালই এসেছে সিউড়ি থেকে। হঠাৎ একটা ট্যাক্সি এসে এখানটায় থামলো, ঐ যে ঠিক ঐ ল্যাম্পপোস্টের গা ঘেষে, তার থেকে তিনটে ছোকরা বেরিয়ে এসে, দোকানে ঢুকে সেই সিউড়ির ছেলেটাকে জাপটে ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল!
–কোথায় নিয়ে গেল?
–সেই ট্যাক্সিতে। ট্যাক্সিটায় স্টার্ট দেওয়াই ছিল।
–তোমরা সব দেখলে?
নিজের চোখে দেখলুম, এই তো, এই পানের দোকানের সামনেটায় আমি দাঁড়িয়ে ছিলুম। ওদের হাতে পাইপ গান, আর এই অ্যাত বড় ড্যাগার, কে আটকাতে যাবে বলুন! ওদের চ্যালেঞ্জ করতে গেলেই জানে মেরে দিত!
–ছেলেটাকে ধরে নিয়ে গেল কেন?
–দোকানের মালিক তো সে কথা কিছুই বুঝতে পারছে না। সে বলছে যে তার ভাইপো বি এ-তে ফার্স্ট ক্লাস অনার্স পাওয়া ভালো ছেলে, পাটি ফার্টি করতো না। অবিশ্যি সিক্রেটলি কিছু করত কিনা…।
বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থেকে নামবার পর বিমানবিহারী বললেন, নাঃ, বাবলুকে এখন আসতে বারণ করে দাও! কোনো দরকার নেই এর মধ্যে ফিরে আসার। এই রকম হঠাৎ যদি তাকে তিনটে ছেলে এসে ধরে নিয়ে যায়! তুমি-আমি কিছুই করতে পারবো না তখন। আজ যে ছেলেটাকে ধরে নিয়ে গেল, নির্ঘাৎ কালকে তার ডেড বডি পাওয়া যাবে কোনো রেললাইনের ধারে।
দ্রুত দোতলায় উঠে এসে বিমানবিহারী বললেন, তুমি একটু অফিস ঘরটায় বসো। তোমাকে একটা জিনিস দেখাচ্ছি!
বিমানবিহারী চলে গেলেন তিনতলায়। প্রতাপ অফিসঘরে এসে বসবার আগে এক কোণায় কুঁজো থেকে নিজেই গড়িয়ে নিয়ে পর পর দু’ গেলাস জল খেলেন। গলা শুকিয়ে গিয়েছিল তাঁর। যদি এসে দেখতেন, এ বাড়ির মধ্যে দুতিনটে ছেলে ঢুকে পড়ে বোমা মেরে সব কাগজপত্র জ্বালিয়ে দিয়েছে, তাতেও কিছুই আশ্চর্যের ছিল না। এখন সব কিছুই সম্ভব।
টেবিলের ওপর থেকে খবরের কাগজটা তুলে নিলেন তিনি। যদিও পড়া কাগজ, তবু তিনি সন্তোষ ভট্টাচার্যের খবরটা খুঁজলেন। কয়েকদিন আগেও, প্রায় প্রত্যেকদিনই প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় করে এইসব খুনের খবর ছাপা হতো। এখনও খুন-জখম একই রকম ভাবে চলছে যদিও, কিন্তু সেই সব খবরের আর গুরুত্ব নেই। ভেতরের পৃষ্ঠায় ছোট করে দেওয়া থাকে পাঁচটি খুন, সাতটি খুন!
এখন খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠা জুড়ে প্রায় সবটাই পূর্ব পাকিস্তানের সংবাদ। রংপুর, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, চুয়াডাঙ্গা, বগুড়া এইসব নামগুলো কতবছর পরে আবার ফিরে এসেছে। কলকাতার খবরের কাগজের পাতায়। পূর্ব পাকিস্তানকে এখানকার কাগজগুলো বাংলাদেশ। বলে লিখতে শুরু করেছে, বিশেষত বাংলা পত্রিকাগুলো। কী করে বাংলাদেশ হলো। পাকিস্তানী সরকার কি ছেড়ে দিয়েছে? কাদের নিয়ে বাংলাদেশ? শেখ মুজিব কোথায়, তিনি মৃত না জীবিত, তা কেউ জানে না। আওয়ামী লীগের অন্য নেতারাই বা কোথায়?
একটু বাদেই বিমানবিহারী দারুণ উৎকণ্ঠা নিয়ে ফিরে এসে বললেন, দেখেছো কাণ্ড? অলি এখনও বাড়ি ফেরেনি। সে নাকি প্রেসে গেছে। মেয়েটাকে এত করে বারণ করেছি আমহাস্ট স্ট্রিট কলেজ স্ট্রিটের দিকে যেতে, তবু কিছুতেই শুনবে না। এখন কী করা যায় বলো তো? প্রেসের টেলিফোন খারাপ, খবর নেবারও কোনো উপায় নেই।
প্রতাপ বললেন, এক কাজ করো, ড্রাইভারকে গাড়ি নিয়ে প্রেসে পাঠিয়ে দাও, অলিকে নিয়ে আসুক প্রেস থেকে।
বিমানবিহারী একটু চিন্তা করে বললেন, হ্যাঁ, ঠিক বলেছো, ড্রাইভারকেই পাঠিয়ে দেওয়া। যাক।
প্রতাপ আবার খবরের কাগজে মন দিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের সুশিক্ষিত, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও সরঞ্জামে সুসজ্জিত নিষ্ঠুর সেনাবাহিনীর সঙ্গে বাঙালী মুক্তিবাহিনী প্রায় খালি হাতে লড়ে যাচ্ছে, এই যুদ্ধের খবর বারবার পড়তেও তাঁর ভালো লাগে। কলকাতার খবরের কাগজগুলো অত্যুৎসাহে হয়তো কিছুটা বাড়িয়ে লিখছে। যশোরে সত্যিই কি একটা স্যাবার জেট ফেলে দিয়েছে মুক্তিবাহিনী? চট্টগ্রামের বিমানবন্দর দখল করে নিয়েছে? ময়মনসিংহ থেকে সব পাকিস্তানী বাহিনী পালিয়ে গেছে?
কিছুটা অতিরঞ্জিত হলেও ঘোরতর লড়াই যে চলছে সেখানে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রতাপ নিজে বি বি সি’র খবর শুনেছেন, ব্রিটিশ কাগজের সংবাদদাতারাও যুদ্ধের খবর দিচ্ছে। তারা প্রশংসা করছে মুক্তিবাহিনীর। পচিশে মার্চের পর দু’তিন দিন সাংঘাতিক অত্যাচার চলার পর পূর্ব বাংলার বাঙালীরা আর শুধু পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে না। সেখানকার তরুণরা রুখে দাঁড়িয়েছে, দেশের সর্বত্র তারা ছড়িয়ে দিয়েছে প্রতিরোধ।
সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে সাধারণ নাগরিকেরা, তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে কিছু প্রাক্তন পুলিশ আর সীমান্ত রক্ষী আর মাত্র কয়েকজন বাঙালী মেজর আর কর্নেল। বাঙালীরা সত্যি সত্যি যুদ্ধ করছে? এর আগে বাঙালীরা যুদ্ধ করেছিল সেই কবে, বার ভূঁইঞাদের আমলে! বাঙালী ছেলেদের বীরত্বের কাহিনী পড়লে প্রতাপের গর্বে বুক ভরে যায়।
মুক্তিবাহিনী যে কোনো কোনো জায়গায় সত্যি বীরত্বের পরিচয় দিচ্ছে, তার কংক্রিট প্রমাণও আছে। কিছু কিছু পাকিস্তানী খানসেনা এর মধ্যেই সীমান্ত পেরিয়ে এসে ধরা দিচ্ছে ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের কাছে। তাদের বিশাল বিশাল চেহারা ক্ষত বিক্ষত, মুখ ভয়ে পাণ্ডুর। খবরের কাগজে এরকম ধরা-দেওয়া পাকিস্তানী সেনাদের ছবি বেরিয়েছে। তারা নাকি বলছে, মুক্তি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার চেয়ে ভারতীয় সেনাদের হাতে ধরা দেওয়া তাদের কাছে অনেক বেশী কাম্য। রোগা রোগা বাঙালী ছেলেদের তারা এত ভয় পায়?
ওপারের তরুণরা জাতীয় সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য এরকম জীবনপণ লড়ছে, আর কী করছে এপারের তরুণরা? এখানে চলেছে শুধু ভ্রাতৃবিরোধ! এপারের যুবকদের সামনে আর কোনো শত্রু নেই, শুধু নিজের ভাই, বন্ধু কিংবা সমবয়েসী অন্য ছেলেরা অন্য পার্টির কর্মী হলেই তাকে খুন করতে হবে! খুনের বদলা খুন! চীনের মাও সেতুঙ মার্কসবাদের নতুন এক ব্যাখ্যা দিলেন, আর তাই নিয়ে মারামারি কাটাকাটি করে চলেছে পশ্চিম বাংলার ছেলেরা। এরপর কোনোদিন যদি মাও সে-তুঙ বলেন, যে, না, না, আমার ঐ ব্যাখ্যায় একটু ভুল হয়েছিল, ওটা অন্যরকম হবে, কখনো কখনো অন্য পক্ষের লোকের সঙ্গে হাত মেলানো যায়, তখন কি এইসব বিনষ্ট প্রাণ আর ফিরে আসবে? কত হীরের টুকরো ছেলে, পড়াশুনোয় ব্রিলিয়ান্ট, সৎ, আদর্শবাদী, অথচ কোন্ অন্ধ আবেগের তাড়নায় তারা হাতে ছুরি আর রিভলভার তুলে নিয়েছে। শুধু কিছু নিজেরই বয়েসী ছেলেদের অথবা কিছু নিরীহ মাস্টার, কেরানি, জজদের খুন করার জন্য। এর কাপুরুষতার দিকটাও তাদের চোখে পড়ছে না? ওপারের ছেলেরা প্রায় নিরস্ত্র অবস্থায় লড়ছে অটোমেটিক রাইফেল আর লাইট মেশিনগানধারী সৈন্যদের বিরুদ্ধে। আর এ পারের ছেলেরা এক অসহায় শিক্ষককে বাড়ি ফেরার পথে পেটে ছুরি মারছে।
প্রতাপ আবার কুমিল্লা রণাঙ্গনের বিবরণ পড়ায় মন দিলেন। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে এগিয়ে আসছিল খান সেনা, মুক্তিবাহিনী তাদের আটকে দিয়েছে, সাতজন পাঠানকে নদীতে চুবিয়ে মেরেছে বাঙালী ছেলেরা। কুমিল্লা শহরটা প্রতাপের চোখে চলচ্চিত্রের মতন ভেসে উঠলো। মনে পড়লো তাঁর ছাত্র বয়েসের বন্ধু মামুনের কথা। কোথায় আছে সে? কিছু বিপদ হয়নি তো মামুনের? বুলাদের বাড়ি সেই বাড়িতে কি এখন আর কেউ থাকে? সেই এক ঝড় বৃষ্টির রাতে মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে মামুনদের বাড়ি যাওয়া, তারপর বুলাদের বাড়িতে
–প্রতাপকাকা, আপনি কখন এসেছেন?
চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে প্রতাপ দেখলেন অলিকে। একটা লাল শাড়ী পরে আছে অলি, এই গরমে তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, তবু যেন ঝলমল করছে তার মুখোনি। কী সতেজ, সুন্দর হয়েছে অলি, ঠিক যেন শরৎকালের একটা স্থলপদ্ম গাছের মতন।
প্রতাপ বললেন, তুমি কোথায় ছিলে এতক্ষণ? সবাই চিন্তা করছে, তোমার জন্য গাড়ি পাঠানো হলো একটু আগে! এ পাড়ায় কী কাণ্ড হয়েছে জানো তো?
কাছে এসে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে অলি বললো, জানি। বাস থেকে নেমেই শুনলুম। মোড়ের দোকানটা থেকে একজনকে জোর করে ধরে নিয়ে গেছে কয়েকটা ছেলে। নিশ্চয়ই ঐ ছেলেটা সিউড়িতে কোনো অ্যাকশান করে এসেছে।
প্ৰতাপ বললেন, অ্যাকশান! এই কথাটা এখন খুব চালু। আগে আমরা একশ্যান শব্দটার অন্য মানে জানতুম। প্রতিটি ক্রিয়ারই ঠিক ঠিক বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে, এটা একটা বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত। তা কি এরা জানে না?
সম্পূর্ণ প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে অলি বললো, প্রতাপকাকা, আজ কলেজ স্ট্রিটে বাবলুদার এক পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো, সে আমার কাছে বাবলুদার খবর জানতে চাইলো। তা আমি তো লেটেস্ট খবর কিছুই জানি না।
প্রতাপ অলির মুখের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে রইলেন। আজকাল বাবলুর চিঠি নিয়মিতই আসে তার মায়ের কাছে। সেই চিঠি পড়ে মনে হয়, বাবলু লন্ডন থেকে আমেরিকায় যাবার পর বেশ ভালোই আছে, ফুর্তিতে আছে। সে কি অলিকে চিঠি লেখে না?
তিনি বললেন, বাবলু তো একটা নতুন চাকরি পেয়েছে, শিগগিরই বোধহয় নিউ ইয়র্ক থেকে ওয়েস্টে চলে যাবে। এর মধ্যে ওর ড্রাইভিং লাইসেন্স হয়ে গেছে। তুমি বাবলুর চিঠি পাও না!
খুব স্বাভাবিক ভাবে হেসে অলি বললো, নাঃ, বাবলুদা আর আমাদের চিঠি-টিঠি লেখে না। আমাদের ভুলেই গেছে বোধ হয়।
–ওর চিঠি লেখার অভ্যেসটাই কম। আমাকেও লেখে না, শুধু নিজের মাকে লেখে, তাও কাটা কাটা কথা। আট-দশ লাইনের বেশী না। নতুন কী কী কোর্স নিয়েছে, সেই নিয়ে ব্যস্তও নাকি খুব।
–প্রতাপকাকা, আমি একবার আমেরিকায় যাবো ভাবছি।
–বাঃ খুব ভালো কথা। ঘুরে এসো। তোমার বাবাকে বললে এক কথায় রাজি হয়ে। যাবেন।
–আমি ওখানকার সাতটা ইউনিভার্সিটিতে অ্যাপ্লাই করেছিলুম, তার মধ্যে তিন জায়গা থেকে ভর্তির কল পেয়েছি, ইচ্ছে করলেই যাওয়া যায়। শুধু একটা ব্যাপারই চিন্তা করছি, আমি চলে গেলে বাবার এই পাবলিশিং ব্যবসা কে দেখবে? বাবা একলা একলা আজকাল আর সব দিক সামলে উঠতে পারেন না।
–তা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমরা তো আছি! পাবলিশিং-এ এখন এমনিই মন্দা চলছে, তুমি ব্যবস্থা করো, চলে যাও।
প্রতাপ বেশ উদ্দীপিত হয়ে উঠলেন। অলি আমেরিকায় গেলে সবচেয়ে খুশী হবেন মমতা। বাবলু সম্পর্কে মমতার এখনও দুশ্চিন্তা যায়নি। আমেরিকা সম্পর্কে বাবলুর মনে একটা ঘোর বিতৃষ্ণা ছিল, সেখানে সে কিছুতেই যেতে চায়নি, বাধ্য হয়ে যেতে হয়েছে, এখন মোটামুটি ভালোই আছে মনে হয়, তবু যা মাথা গরম স্বভাব ওর! যদি হঠাৎ কোনোদিন কারুর সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে বসে! অলি গেলে বাবলুকে সামলে রাখতে পারবে, অলির কাছ থেকে খবরাখবরও পাওয়া যাবে সব রকম। হয়তো অলিকে নিয়ে বাবলু একদিন সংসারী হবে। তিনি বললেন, তুমি কোন ইউনিভার্সিটিতে অ্যাডমিশান নিতে চাও, ঠিক করে ফেলল। আমি বাবলুকে টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দেবো।
অলি বললো, তার দরকার নেই কিছু। আমি যদি যাই, ওখানে পৌঁছে বাবলুদাকে টেলিফোন করে চমকে দেবো!
একটু পরে অলি চলে গেল ওপরে! তার পরেই বিমানবিহারী নেমে এলেন। হাতে একটা পুরোনো আমলের কারুকার্য করা আখরোট কাঠের বাক্স। তিনি বললেন, চাবিটা খুঁজে পাচ্ছিলুম না। সেইজন্য আসতে দেরি হলো। দেখলে তো, তোমার কথা শুনে গাড়িটা পাঠালুম, তারপরেই অলি ফিরে এলো। গাড়িটা শুধু শুধু তেল পুড়িয়ে অতটা যাবে।
সারাদিনের নানা রকম ঘটনায় প্রতাপের মনের মধ্যে যে অপ্রীতিকর বাষ্প জমে উঠেছিল, তা যেন হঠাৎ মুক্ত হয়ে গেছে অলিকে দেখে ও তার কথা শুনে। তিনি বললেন, তা একটু তেল পুড়বে পুড়ুক। ওহে বিমান, অলির তো এখন আবার বিদেশে গিয়ে পড়াশুনো করার ইচ্ছে হয়েছে। এতদিন যেতে চায় নি, এখন নিজে থেকেই অনেকগুলো জায়গায় অ্যাডমিশান চেয়ে চিঠি লিখেছে শুনলুম, চান্সও পেয়েছে!
বিমানবিহারী একটা পেতলের চাবি দিয়ে আখরোট কাঠের বাক্সটা খোলার চেষ্টা করতে করতে বললেন, তা যেতে পারে, যদি ইচ্ছে করে!
বিমানবিহারীর কণ্ঠস্বরে উষ্ণতার অভাব লক্ষ করে প্রতাপ কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার, তোমার খুব একটা ইচ্ছে নেই নাকি? আগে তো তুমি নিজেই ওকে কতবার যেতে বলেছো।
বিমানবিহারী মুখ না তুলে বললেন, আমার ইচ্ছে থাকবে না কেন! ঐ মেয়ে কী ধাতুতে গড়া তা তো জানো না। ঐরকম নরম সরম চেহারা। কিন্তু কী সাংঘাতিক জেদী! আমি বেশী ইচ্ছে প্রকাশ করলে অমনি বেঁকে বসবে। ভাববে, আমি ওকে জোর করে পাঠাচ্ছি। যা। দিনকাল পড়েছে, ইয়াং ছেলেমেয়েরা যত কলকাতা থেকে দূরে চলে যায়, ততই তো মঙ্গল! কিন্তু এতদিন আমি বুঝিয়েছি, ওর মা বুঝিয়েছে, তবু যেতে চায়নি।
-এবার কিন্তু ইচ্ছে হয়েছে, নিজে থেকেই যখন অ্যাপ্লিকেশান পাঠিয়েছে, ওর রেজাল্ট ভালো, স্কলারশীপও পেয়ে যাবে নিশ্চয়ই।
–টাকা পয়সার অসুবিধে হবে না। ওর রেজাল্ট অনুযায়ী ফুল ব্রাইট থেকেও প্যাসেজ মানি পেতে পারে। যদি নাও পায় সে টাকা আমি দেবো, সে সাধ্য আমার আছে। এখন তুমি ধীরে সুস্থে ওকে বোঝাও। বেশী চাপাচাপি করো না।
–আমি কালই ওর জন্য পাসপোর্ট ফর্ম আনাবো।
বাক্সের ডালাটা খুলে ফেলে বিমানবিহারী বললেন, এই দ্যাখো, বিউটি, বিউটি, একেবারে নতুনের মতন রয়েছে এখনও।
প্রতাপ মহা অবাক হয়ে দেখলেন, সেই বাক্সের মধ্যে গাঢ় নীল ভেলভেটের ওপর রাখা এক জোড়া রিভলভার!
সে-দুটির গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বিমানবিহারী বললেন, মাউজার গান! আমার ঠাকুর্দা রড়া কম্পানি থেকে কিনেছিলেন। দারুণ জিনিস!
প্রতাপ অস্ফুট স্বরে বললেন, রড়া কম্পানি-মাউজার পিস্তল…মলঙ্গা লেনের হাবু
–তার মানে?
–কোথায় যেন পড়েছিলাম, পরাধীন আমলে, কয়েকজন টেররিস্ট ঠেলাওয়ালা আর ঝাঁকা মুটের ছদ্মবেশ ধরে মলঙ্গা লেনের কাছে রড়া কম্পানির পঞ্চাশটা মাউজার পিস্তল চুরি করেছিল। তারপর সেই পিস্তলগুলো দিয়েই শুরু হয়েছিল সারা ভারতে সাহেব খুন করার অভিযান!
–এগুলো সেই চুরি করা পিস্তল নয়। আমার ঠাকুর্দা কিনেছিলেন। এ দুটো আমাদের পারিবারিক সম্পত্তি।
–বুঝলাম, কিন্তু তুমি হঠাৎ এ-দুটো বার করলে কেন? তোমার কাছে এই অস্ত্র আছে তা জানাজানি হলেই বিপদ আছে!
–বিপদ আবার কী! এর একটা আমি সবসময় সঙ্গে রাখবো। আর একটা তোমার কাছে রাখতে পারো ইচ্ছে করলে। আমি তোমার নামে লাইসেন্স বার করে দেবো, তাতে কোনো অসুবিধে হবে না। এবার আমি ঠিক করেছি। বিপ্লবের নাম করে ঐ গুণ্ডাগুলো হামলা করতে এলেই আমি ওদের কুকুরের মতন গুলি করে মারবো।
–খবর্দার। বিমান, ওরকম চিন্তাও মাথায় স্থান দিও না। গুলি করতে তুমি পারবে না, তোমার হাত উঠবে না। বরং উল্টো ফল হবে। ওরা এখন অস্ত্র কাড়ার একটা অভিযান। চালাচ্ছে, তোমার কাছে এই জিনিস আছে, ঘুণাক্ষরেও তার সন্ধান পেলে ওরা এই অস্ত্র কাড়তেই আসবে, তোমাকেও মেরে রেখে যাবে!
–মেরে রেখে যাবে, অত সোজা? কেড়ে নেবে, অত সোজা! দু’একটাকে না মেরে আমি মরবো না! কিরণলালকে গাড়ির মধ্যে অসহায় অবস্থায় গুলি করে মারলো, তার পর থেকেই আমার মাথার মধ্যে আগুন জ্বলছে! এমনি এমনি আমার জীবনটা কেড়ে নেবে? নাঃ, বাধা। দিতেই হবে, সোজা গুলি চালাবো! তোমাকে যদি মারতে আসে, তুমি আত্মরক্ষা করবে না?
ওদের সঙ্গে অস্ত্র থাকে, আমরাও অস্ত্র রাখবো!
প্রতাপ দুদিকে মাথা নাড়লেন।
তিনি মুখে আর কিছু উচ্চারণ করলেন না, কিন্তু মনে মনে বললেন, না, আমি ওদের মারতে পারবো না। এইসব ছেলেরা, এরা তো তাঁর বাবলুরই মতন। ভুল করুক, দোষ করুক, তবু এরা সন্তানতুল্য। এরা যদি পিতৃহত্যা করে বিপ্লব আনতে চায়, তাহলে এদের বাধা দিয়েও কোনো লাভ হবে না। বরং তারপর যদি ওদের অনুতাপ হয়, ওরা ভুল বুঝতে পারে, তবে সেটুকই যথেষ্ট। ভবিষ্যতের পৃথিবীটা তো ওদেরই জন্য। প্রতাপ একটা পিস্তল হাতে তুলে নিলেন। জিনিসটা এমনই মসৃণ, সুদৃশ্য ও ওজনদার যে হাতে নিলেই মনে হয় বেশ দামী ধরনের অস্ত্র। সেই ঠাণ্ডা ইম্পাত প্রতাপ গালে ছোঁয়ালেন। তিনি ভাবলেন, এইরকম একটা অস্ত্র নিয়ে যদি সীমান্তের ওপারে অত্যাচারী বর্বর সৈন্য বাহিনীর বিরুদ্ধে একজন নিপীড়িত বাঙালীকেও সাহায্য করা যেত, তাহলে জীবনটা ধন্য হতো।