১০.
সকালে পাখিকে জল ছোলা দিতে গিয়ে শিউরে উঠল অদিতি। ব্যালকনিতে ছড়িয়ে আছে অজস্র ছোট ছোট পালক, খাঁচা ঢাকার কাপড় মেঝেতে লুটোচ্ছে। টিয়া টলছে খাঁচায়। বাঁ ডানায় তার গভীর ক্ষত, সবুজ শরীরে ছোপ ছোপ রক্ত শুকিয়ে কালচে হয়ে আছে।
মেরেই দিল পাখিটাকে?
সুপ্রতিমের সঙ্গে অদিতির সম্পর্ক এখনও স্বাভাবিক হয়নি, বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া পরস্পরের কথা হয় না। যাও বা হয়, ভাববাচ্যে। ক্রিয়াপদবিহীন। অফিস যাওয়ার আগে সুপ্রতিম হয়ত চেঁচিয়ে বলল, মোজা? রান্নাঘর থেকে অদিতি উত্তর দিল, আলনার পেছনে। রাত্রে হয়ত সুপ্রতিম প্রশ্ন করল, কখন খেতে বসা হবে? অদিতি জবাব দিল, টেবিলে বসলেই দেওয়া হবে। কখনও আবার সরাসরিও নয়, কথা চলছে ছেলেদের মাধ্যমে। তাতাই জিজ্ঞেস কর তো, ছোটপিসির বাড়িতে কি অফিস থেকেই চলে যাবে, না এখানে এসে যাবে? পাপাই বলে দে, রিঙ্কির জন্মদিন পরশু, কাল ভেবে ডিসাইড করা হবে।
ছোট্ট একটা ঝাপটাও অনেক সময়ে বুকের পাষাণভার নামিয়ে দেয়।
অদিতি সব ভুলে আর্তনাদ করে উঠল,—এই শুনছ, শিগগির একবার এদিকে এসো।
ঘুমচোখে দৌড়ে এসেছে সুপ্রতিম। পাখির রক্তাক্ত দশা দেখে তারও চক্ষু স্থির।
নিজের অজান্তে অদিতি খামচে ধরেছে সুপ্রতিমকে। থরথর কাঁপছে,—কী হবে এখন? ও কি মরে যাবে?
সুপ্রতিম খাঁচার কাছে গিয়ে ঝুঁকে দেখছে পাখিটাকে। দায়িত্বশীল অভিভাবকের মতো বলল,—অত ভেঙে পড়লে চলবে? কিছু তো একটা করতেই হবে।
—কী করব?
খাঁচার দরজা খুলল সুপ্রতিম। পাখিকে একবার ছুঁতে গিয়েও হাত সরিয়ে নিল,—ইস, জোর চোট লেগেছে। মারল কী করে বলো তো?
অদিতি প্রায় কেঁদে ফেলল,—বুঝতে পারছি না। কিছু একটা করো প্লিজ্।
—এই হল গিয়ে পাখি পোষার বখেড়া। কতবার বলেছি পুষতে হলে অ্যালসেশিয়ান পোষো, ডোবারম্যান পোষো, কেউ কাছে ঘেঁষতে পারবে না। তা নয়, পাখি! যাও, একটা পরিষ্কার তোয়ালে নিয়ে এসো।
হন্তদন্ত হয়ে ছুটল অদিতি। তোয়ালের সঙ্গে সঙ্গে পাপাই তাতাইকেও ঘুম থেকে তুলে এনেছে। সন্তর্পণে পাখিটাকে তোয়ালেতে তুলে নিয়েছে সুপ্রতিম, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আঘাতটা দেখছে। অদিতির টিয়া একেবারে নির্জীব, গলায় শব্দটি নেই, একবার করে তাকাচ্ছে আর চোখ বুজে ফেলছে।
পাপাই বলল,—ও বাঁচবে না। খাবি খাচ্ছে।
তাতাই বলল, —না না, বেঁচে যাবে। চোটটা ডানার ওপর দিয়ে গেছে।
—পাখিদের ডানাটাই আসল।
—মোটেই না, ডানা ছাড়াও পাখি বাঁচতে পারে। মেন হল বডি। হার্ট লাঙস্ ব্রেন অ্যাবডোমেন্। … শরীরের কোথাও তেমন ইনজুরি হয়নি।
—স্টিল, ডানা চলে গেলে পাখির আর পাখিত্ব রইল কি?
সুপ্রতিম বলল,—তর্ক থামিয়ে কাজের কাজ কিছু কর। তোর মার ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে আমাদের কোম্পানির অ্যান্টিসেপ্টিক ক্রিম আছে, জলদি নিয়ে আয়।
—তার আগে একটু ডেটল দিয়ে ওয়াশ করে নিলে ভাল হত না বাবা?
—না বাবা, ডেটলে ভীষণ জ্বালা করবে। তার থেকে গরম জল দিয়ে পরিষ্কার করে নেওয়া ভাল।
সুপ্রতিম বলল,—আমাদের ক্রিম লাগালে জল ডেটল কিছু লাগে না। তুমি যাও তো, ক্রিমটা নিয়ে এসো তো।
দিশেহারা অদিতি ছুট্টে ক্রিম নিয়ে এল।
পাখির পরিচর্যা চলছে। বাপ আর দুই ছেলে মিলে ওষুধের প্রলেপ লাগাচ্ছে পাখির ডানায়। অবিরাম মন্তব্য চলেছে। ডাক্তারি শাস্ত্র এমনই একটা বিষয় যাতে প্রতিটি মানুষেরই অগাধ জ্ঞান। তবে একজনের সঙ্গে আর এক জনের জ্ঞান কিছুতেই মিলতে চায় না। একজন যদি বলে ব্যান্ডেজ করে দাও, অন্য জন বলে খোলা থাকাই ভাল। পাপাই বলল বেবি ডোজের অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো উচিত, তাতাই বলল পেইনকিলার। ছেলেদের মতে পাখিকে এক্ষুনি কোনও ভেটেরিনারি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত। সুপ্রতিমের মত, কিচ্ছু লাগবে না, তার ক্রিমেই পাখির ক্ষত শুকিয়ে যাবে। বরং আয়রন টনিক ড্রপারে করে খাইয়ে দেওয়া হোক, রক্ত তৈরি হবে তাড়াতাড়ি।
পশুপাখি জীবজন্তুর স্বভাবচরিত্র সম্পর্কেও বাপ ছেলেদের পাণ্ডিত্য কম নয়। সবাই অভিজ্ঞ মতামত জানাচ্ছে।
পাপাই ব্যালকনির গ্রিলটাকে এরকুল পোয়ারোর মতো তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করল,—এইটুকু ফাঁক দিয়ে বেড়াল ঢুকল কী করে? আমার মনে হয় ব্যাটা কোনওভাবে বাড়ির ভেতরেই ছিল।
—কী বুদ্ধি! তাতাই ভেংচে উঠল,—ভেতরে থাকলে বেরিয়েই বা গেল কী করে? বেড়াল কি দরজার ছিটকিনি খুলে ব্যালকনিতে এসেছিল? বেড়ালের বড়ি খুব ফ্লেক্সিবল্ হয়। এইটুকু সরু ফাঁকের মধ্যে দিয়েও গলে আসতে পারে।
সুপ্রতিম বলল,—আমি শিয়োর, বেড়াল যখন অ্যাটাক করে, পাখিটা নির্ঘাত গাধার মতো ঘুমোচ্ছিল। না হলে একটা চিৎকার-টিৎকার অন্তত করত।
—খাঁচার বাইরে থেকে মারল কী করে বলো তো?
—পাখিটা নিশ্চয়ই সাইডে ছিল, ইজিলি থাবা মেরে দিয়েছে। বেড়ালের থাবা খুব সুইফ্ট চলে। ইন্ফ্যাক্ট ডোমেস্টিক অ্যানিমেলের মধ্যে বেড়ালই সব থেকে ফাস্ট মুভিং ক্রিচার।
—এবং সব থেকে শয়তান। সাংঘাতিক বেইমান। তুই একটা বেড়ালকে বেবি অবস্থা থেকে দুধটা মাছটা খাইয়ে বড় কর, দেখবি চান্স পেলে তোর কিচেনই সাফ করে দিচ্ছে। চোখে চোখে কেমন তাকিয়ে থাকে লক্ষ করিসনি? সব সময়েই কেমন বেপরোয়া অ্যাটিচিউড্।
অদিতি নির্বাক শুনছিল। তার আর্দ্র চোখ পাখিতে স্থির। আহত টিয়াকে দেখার পর থেকেই হাত পা কেমন অসাড় হয়ে গেছে তার। স্বামী ছেলেরা খুব যত্ন করেই পরিচর্যা করছে পাখির, পাখিসুদ্ধ খাঁচাটাকে ফ্ল্যাটের অন্দরে নিয়ে এসেছে। পাখিটাকে ছুঁতে কিছুতেই সাহস হচ্ছিল না অদিতির। কাজে মন বসছে না, বুকের ভেতর টিপটিপ করছে একটা কষ্টের দানা, ঘুরে ফিরে অদিতি দেখে যাচ্ছে টিয়াকে। নড়ে না টিয়া, ঝিমিয়ে আছে।
বড় মায়া। বড় মায়া।
অফিস বেরোনোর আগে সুপ্রতিম অদিতির কাঁধে হাত রাখল,—মন খারাপ কোরো না। তোমার পাখি ঠিক হয়ে যাবে।
আশ্চর্য অত বড় আঘাতটাও সামলে উঠল অদিতির টিয়া, বেঁচে গেল। সুপ্রতিমের মলমের গুণেই হোক, অদিতির মায়ার টানেই হোক, কী পাপাই তাতাই-এর দেখভালেই হোক, অথবা নিজেরই জীবনীশক্তির জোরে এক একটু করে সুস্থ হয়ে উঠল টিয়া। ক্ষত শুকোল, নিস্তেজ পাখি চাঙা হল ধীরে ধীরে। প্রথম দু দিন টিয়া মুখে তোলেনি কিছু, ড্রপারে করে তাকে গ্লুকোজের জল খাইয়ে টিকিয়ে রাখল তাতাই। তৃতীয় দিন থেকে ক্ষুধা তৃষ্ণার বোধ জাগল টিয়ার, নিজে নিজেই ঠোঁট ছোঁয়াল ছাতুতে। তার ডানা বেশ কমজোরি হয়ে গেছে, তবু নাড়ে মাঝে মাঝে, একটুখানি ছড়িয়ে রেখে দাঁড়ে উঠে বসে।
শেষে একদিন স্বরও বেরোল। কর্কশ নিনাদ, তবু কী মধুর! যেন শুধু ডাক নয়, বেঁচে থাকার এক প্রবল ঘোষণা।
টিয়ার আতোয়ীকে শনাক্ত করেছে তাতাই। পরদিনই। সেটা এক চ্যাপ্টামুখো হুলো বেড়াল, গোটা বিল্ডিং কমপ্লেক্সে তার প্রবল দাপট, অনেক ফ্ল্যাটই তার ডাকাতির জ্বালায় অতিষ্ঠ। তবে সে হুলোও সেদিন রাত্তিরে পুরোপুরি রেহাই পায়নি, টিয়াও তার চোখের নিচে ঠোক্কর মেরে গর্ত করে দিয়েছে। তাতাই স্থির করেছে, হুলোটাকে দেখতে পেলেই পেটাবে।
পাখির চিন্তায় অদিতি কদিন লেখা নিয়েও বসতে পারেনি। দুপুর হলে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থেকেছে চুপচাপ। সে সময়ে হুলোটাকে অনেকবার চোখে পড়েছে তার। গালে একটা কুৎসিত ঘা নিয়ে বিমর্ষ মুখে পাঁচিলে পাঁচিলে ঘুরে বেড়ায়, কখনও বা উল্টো দিকের ফ্ল্যাটের কার্নিশে মুখ গুজে বসে থাকে। বেড়ালটার জন্যও অদিতির কেমন মায়া হয়। আহারে বেচারা নিজেও জানে না তার আচরণ কত নির্মম! কী করবে বেড়াল, পাখির সঙ্গে চিরকাল যে তার খাদ্যখাদকের সম্পর্ক, সেই চোখেই তো সে দেখে এসেছে পাখিকে! মগজহীন বেড়ালটা যদি বুঝত তাদের আদি বাসভূমি বনজঙ্গল সৃষ্টি হয়েছে ওই পাখিরই ঠোঁটে ঠোঁটে!
অদিতি ছোট ছেলেকে বলে,—বেড়ালটাকে মারিস না রে তাতাই। ও ওর মতোই থাক। ও কি বোঝে কোন কাজটা ভাল, কোন কাজটা খারাপ?
সুপ্রতিম শুনে হাসে খুব। বলে,—এবার তুমি ওই বেড়ালের চিকিৎসাতেও নেমে পড়বে না কি? বলো তো অফিস থেকে আরও কয়েকটা ক্রিম নিয়ে আসি।
সুপ্রতিমের সঙ্গে অদিতির সম্পর্ক আবার মসৃণ। ছোট্ট একটা ঢেউ এসেছিল, ফিরে গেছে। সংসার তো এরকমই। ঢেউ আসে, ফেনা রেখে চলে যায়। ফেনাও শুকোয় ক্রমশ, পড়ে থাকে সিক্ত বেলাভূমি। আবার সেখানে নিশ্চিন্তে পা ফেলে মানুষ, বালুতটও প্রতীক্ষা করে নতুন ঢেউয়ের। অদিতি এক সামান্য মানবী মাত্র, তার ক্ষেত্রেই বা এর ব্যতিক্রম ঘটবে কেন?
সব কিছুই নিয়মমতো চলছে আবার। লিখছে অদিতি। হেমেন একদিন এসে একটা গল্প নিয়েও গেলেন, বড় কোনও পত্রিকায় পাঠাবেন। সুপ্রতিম টুক করে আড়াই দিনের জন্য রাঁচি ঘুরে এল। তাতাইয়ের এখনও গরমের ছুটি চলছে, কিন্তু সারা দিনে তার টিকি পাওয়া মুশকিল। পাপাই সামনের সপ্তাহে বন্ধুদের সঙ্গে দার্জিলিং বেড়াতে যাচ্ছে, দিন দশেকের জন্য। মাঝে হঠাৎ এক রবিবার সন্ধেতে সুজাতা বাড়ি খুঁজে খুঁজে হাজির। মেয়ে নিয়ে। সারা সন্ধে আড্ডা মেরে গেল অদিতি সুপ্রতিমের সঙ্গে। খুব হাহা হিহি করল। সুপ্রতিমের মুখে অদিতির গল্প লেখার গল্প শুনে সুজাতা এই মারে তো সেই মারে। কী অসভ্য রে তুই? আমাকে সেদিন বলিসনি কেন? দে দে, তোর লেখাগুলো দে, পড়ে ফেরত দেব। সুজাতার মেয়েটাও দারুণ সপ্রতিভ, চোখেমুখে কথা, তাতাইয়ের মতো বক্তৃতাবাজও মুনিয়ার কথার তোড়ে কাহিল। অদিতিকেও কম অপ্রস্তুতে ফেলল না মেয়েটা। ও মাসি, তুমি কী নিষ্ঠুর গো! পাখিটাকে খাঁচায় বন্ধ করে রেখে দিয়েছ! সুপ্রতিমের খুব মজা লেগেছে শুনে। বন্দি থেকে থেকে ও পাখির কি আর ওড়ার ক্ষমতা আছে! খাঁচা খুলে ছেড়ে দিলেও দু পা গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়বে।
এ বছর জোর বর্ষা নেমেছে। গ্রীষ্মের তীব্র দাহের পর বর্ষা এবার একটু দেরিতেই এল। আকাশ এখন সর্বক্ষণই সীসে বরণ, মেঘের ভারে নেমে এসেছে নীচে। দেরিতে আসার ঘাটতি বর্ষা পুষিয়ে দিচ্ছে পুরোমাত্রায়। একের পর এক নিম্নচাপ চলছে, টানা বৃষ্টিতে পথঘাট থই থই, এক এক সময় কলকাতাকে ভেনিস বলে ভ্রম হয়। শুধু রাস্তায় গণ্ডোলাই নেই, এই যা। সূর্য এখন এক নিরুদ্দিষ্ট নক্ষত্র, এই বুঝি কাগজে টিভিতে তার সন্ধান চেয়ে ছবি বেরোয়!
বৃষ্টির বিকেলে সুপ্রতিমের আধভেজা শার্টপ্যান্ট ইস্ত্রি চালিয়ে শুকিয়ে নিচ্ছিল অদিতি। সুপ্রতিমরা নতুন একটা শ্যাম্পু ছাড়ছে বাজারে, সেই উপলক্ষে কাল সন্ধেবেলা বড়সড় পার্টি দিচ্ছে কোম্পানি। সঙ্গে ফ্যাশান প্যারেড। চুল ফাঁপিয়ে নিতম্ব দুলিয়ে হাঁটবে সুন্দরীরা। অনুষ্ঠানে এই শার্টটাই পরে যেতে চায় সুপ্রতিম। মোড়ের ইস্ত্রিঅলাটা বসছে না কদিন, সে বোধহয় সূর্যের খোঁজে গেছে।
ডোরবেল বাজল।
দরজা খুলে অবাক হয়েছে অদিতি। দাদা এসেছে। এই বর্ষায় দাদা!
অলকেশের এক হাতে ভেজা ছাতা, অন্য হাতে প্লাস্টিকের প্যাকেট, বগলে পেটমোটা চামড়ার ব্যাগ। ঈষৎ অপ্রস্তুত মুখে হাসল অলকেশ,—চমকে গেলি তো?
অনেক দিন আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িতে যাওয়া হয়নি অদিতির। শেষ গিয়েছিল মাস দুয়েক আগে। দাদা সেদিন বাড়ি ছিল না, ছুটির দিনে কোনও এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল।
দাদাকে দেখে অদিতি খুশিই হল। বলল,—চমকানোরই তো কথা। এরকম বৃষ্টি মাথায় করে কেউ আসে!
—কী করি, তুলতুলিটার ইউনিভার্সিটি বন্ধ, বহুদিন তোদের খোঁজখবর পাই না।…
অলকেশের ছাতা বাথরুমের সামনে মেলে দিয়ে তোয়ালে এনে দিল অদিতি,—নে, আগে ভাল করে মাথা মোছ। এই সেদিন পা ভাঙলি, এই জলকাদায় আবার …
অলকেশ বোনের বাড়িতে আসে কম, তবে এলে কখনও খালি হাতে আসে না। প্লাস্টিকের ঠোঙা অদিতির হাতে দিয়ে বলল,—হাঁটু আমার পুরো সেরে গেছে। আয় আমরা ভাইবোনে আজ একটু বেগুনি আলুর চপ খাই। তোর ছেলে দুটো কোথায় গেল?
—এই বিকেলে ওরা বাড়ি বসে থাকবে! কোথায় চরে বেড়াচ্ছে। পাপাইটা তো আবার সোমবার দার্জিলিং যাচ্ছে।
—বর্ষায় দার্জিলিং যাচ্ছে কী রে! কোথায় কখন ধস্ নামে, রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে যায় …
—আমরাও তো সেই চিন্তা। কে শোনে! বর্ষায় নাকি দার্জিলিং-এর আলাদা চার্ম।
—কী চার্ম?
—সে ওরাই জানে। বোস্, চা করে আনি। আমার রান্নার মেয়েটা এ-বেলা বোধহয় ডুব মারল।
তোয়ালেতে মুছে ব্যাগ সেন্টার টেবিলে রাখল অলকেশ। ঘষে ঘষে মাথা মুছছে। সোফায় বসেও উঠে দাঁড়াল, হাত বুলিয়ে দেখল সোফা ভিজছে কি না। ভেজেনি। নিশ্চিন্ত হয়ে হেলান দিয়েছে।
গ্যাসে জল বসিয়ে ভাবছিল অদিতি। দাদা তো কারণ ছাড়া এ বাড়িতে বড় একটা আসে না! এই দুর্যোগের দিনে যখন এসেছে, দরকারটা নিশ্চয়ই জরুরি। মুখটা শুকনোও লাগছে যেন! অদিতি গলা তুলল,—তুই কি অফিস থেকে আসছিস?
—হ্যাঁ, একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম। তোর এখানে আসব বলে।
—তা হলে তো তোর খিদে পেয়েছে। কটা লুচি ভেজে দিই?
—না না, তোকে আর হ্যাঙ্গাম করতে হবে না। মুড়ি থাকলে দে।
অদিতি সামান্য অস্বস্তিতে পড়ল। এ বাড়িতে তার দুই ছেলের কেউই মুড়ি ছোঁয় না। বাঘের ঘাস খাওয়ার মতো সুপ্রতিম ন মাসে ছ মাসে খায়, তার জন্য এই বর্ষার দিনে ঘরে মুড়ি কিনে রাখার কোনও মানেই হয় না।
অদিতি আবার বলল,—লুচি ভেজে দিই না? সেই কখন ভাত খেয়েছিস …
—ঘরে বুঝি মুড়ি নেই? দু-এক মুহূর্ত উত্তরের প্রতীক্ষায় থেকে অলকেশ বলল,—তোকে ব্যস্ত হতে হবে না, চা তেলেভাজা নিয়ে চলে আয়। তোকে একটা জিনিস দেখাতে এসেছি।
—কী জিনিস?
—আছে। আয় না।
পলকের জন্য বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল অদিতির। দাদা যখনই কোনও কাগজ সই করাতে আসে এই ভাষাতেই কথা বলে। এরকমই নরম সুরে। মা-র একটা এন এস সি ছিল না? ম্যাচিয়োর করল? সুপ্রতিম নেই আন্দাজ করেই কি এই বিকেলবেলা…! ছোট্ট শ্বাস ফেলল অদিতি। নিজের দাদার সঙ্গে এই তিক্ততা আর ভাল লাগে না।
বড় প্লেটে তেলেভাজা সাজিয়ে চা নিয়ে দাদার সামনে বসল অদিতি,—দেখি কী জিনিস।
—দেখাচ্ছি। নিচু হয়ে গোটানো প্যান্টের ভাঁজ খুলছে অলকেশ,—তোদের এখানে এবার জল জমেনি দেখছি!
—করপোরেশানের দয়া হয়েছে। রাস্তা উঁচু করে দিয়েছে। আমাদের ফ্ল্যাটের পেছনেই এখন কাউন্সিলার থাকে যে।
—তাই বল।
—তোদের রাস্তা তো ডুবে আছে। তোর বাড়িতে এবার জল ঢোকেনি?
অলকেশ পলকের জন্য স্থবির,—কত দিন বারণ করেছি না খুকু, তোর বাড়ি তোর বাড়ি করবি না?
অদিতি আলুর চপে কামড় দিয়ে বলল, —বাহ্, বাড়ি তো তোরই। বললেই দোষ?
—না খুকু। ওটা আমাদের বাড়ি। তোরও। আমারও। অলকেশ বড় করে একটা নিশ্বাস টানল, —কাগজে-কলমে লেখাপড়া করা না থাকলে কি অধিকার চলে যায়? বাড়ি সারাইটারাই করার জন্য অফিসের লোন নিতে অনেক প্রবলেম হয়, তাই আমার নামে…
যুক্তি, না ভাবের ঘরে চুরি? অদিতি খুচ করে খোঁচা দিল,—বাড়ি কিন্তু তুই একবারও সারাসনি দাদা। ও সব কথা থাক। কী দেখাবি বলছিলি দ্যাখা।
অলকেশ ঝিম মেরে গেল। ঝমঝম বৃষ্টি নেমেছে আবার। চায়ের কাপ হাতে ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে রয়েছে অলকেশ। ব্যালকনির এ-পাশে ছোট্ট প্যাসেজে পাখির খাঁচা ঢুকিয়ে রাখা আছে, সেদিকেও দৃষ্টি ফেলে রাখল কিছুক্ষণ। কাপ নামিয়ে ফোলিও ব্যাগটা টেনেছে কোলে। চেন খুলে একটা বাদামি কাগজের মোটা প্যাকেট বার করল।
অদিতি জিজ্ঞাসা করল,—কী ওটা?
—খুলে দ্যাখ।
মোড়ক খুলতেই জোর এক ঝাঁকুনি খেয়েছে অদিতি। খাতা! খাতা! তার সমস্ত পুরনো গল্প লেখার খাতা। স্কুলের। কলেজের। খাতার নীচে তার স্কুল কলেজের ম্যাগাজিনও আছে কয়েকটা।
অদিতি বিহ্বল স্বরে বলল,—কোত্থেকে পেলি এগুলো?
অলকেশের মুখে মেঘলা বিকেলের হাসি,—তুই আবার লেখা ধরেছিস … মা-র কালো ট্রাঙ্কে গাদা হয়ে পড়েছিল … খুঁজে খুঁজে বার করলাম।
দ্রুত হাতে একের পর এক খাতা উল্টোছে অদিতি। কোনও পাতায় শুধুই কাটাকুটি। কোথাও বা অপটু হাতে আঁকা মেয়েলি মুখের ছবি, দেখে কার্টুন মনে হয়, তলায় কোনও বান্ধবীর নাম। কোনও পাতায় একই লাইন বিশ পঁচিশবার লেখা। কবিতা। গল্প। উপন্যাসের ছক, পাশে পাত্রপাত্রীদের সম্ভাব্য চেহারা আর গুণাগুণ। একটা পাতায় অতিকায় হরফে অদিতিরই হাতে লেখা—অদিতি তুই একটা হাঁদি। তোর দ্বারা লেখা হবে না। কলেজ ম্যাগাজিনে কুয়াশা গল্পটাও রয়েছে।
অদিতি আঙুল বোলাচ্ছে পাতায়, অক্ষরগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। অক্ষর, না প্রাণ? অক্ষর, না সময়? অক্ষর, না স্মৃতি? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাতারা বিবর্ণ, হলদেটে, নীল কালির আঁচড় ফিকে অনেক, তবুও কী মুখর! অসংখ্য স্মৃতি ছুটে এল টগবগিয়ে, তিরতির করে, দুলতে দুলতে। অদৃশ্য এক কুবো পাখি ডেকে চলেছে বুকে। কুব কুব কুব কুব।
অলকেশ মৃদু স্বরে বলল,— তুই খুশি হয়েছিস খুকু?
অদিতি চোখ তুলল। দাদাকে দেখছে অপলক। তিপান্ন বছরের দাদাকে নয়, চোদ্দ বছরের দাদাকে। টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে বোনের জন্য হজমিগুলি এনেছে দাদা, খাওয়া শেষে কাগজ চাটছে বোন।
ছ বছরের মেয়ের মতো কাঁধ পর্যন্ত ঘাড় হেলিয়ে দিল অদিতি। আধফোটা স্বরে বলল,—শুধু এটা দেওয়ার জন্য এই দুর্যোগের দিনে এত দূর ছুটে এলি।
—ভেবেছিলাম তুলতুলির হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেব। অলকেশও যেন অনেকটা বছর পিছিয়ে গেছে। বলল,—তোর জন্য হঠাৎ বড় মন কেমন করছিল রে। ভাবলাম কত দিন তোকে নিজে হাতে কিছু দিইনি। তোর কাছ থেকে শুধু নিয়েই গেলাম।
অদিতির চোখে এক অসহ্য চাপ। এই বুঝি ফিন্কি দিয়ে জল বেরিয়ে আসে।
—ছোটমামাও সেদিন বলছিল তুই নাকি খুব ভাল লিখছিস। তুলতুলিও তোর কথায় পঞ্চমুখ। আমি ছাপোষা মানুষ, সাহিত্য-টাহিত্য অত বুঝি না, তবু শুনলে বুকটা ফুলে ওঠে। সময়টা হারিয়ে ফেলেছিলি, ফিরে পেয়েছিস, লেখ, আরও লেখ।
অলকেশ উঠে পড়েছে। ভিজে ছাতা হাতে ঝুলিয়ে নিল, চিমসে যাওয়া ফোলিও ব্যাগ আবার চেপেছে বগলে। ফিরে যাচ্ছে।
দরজায় দাঁড়িয়ে অদিতি দেখছিল দাদাকে। ধীরে পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে দাদা। অদিতি চিৎকার করে একবার ডাকতে চাইল অলকেশকে। সেই শৈশবের স্বরে।
স্বর ফুটল না।
ল্যান্ডিং-এর বাঁকে হারিয়ে গেল অলকেশ। অদিতির গরিব স্বার্থপর দাদা।
বৃষ্টি নেই। ফ্ল্যাটময় ফিরে বেড়াচ্ছে এক স্যাঁতসেঁতে বাতাস। সেন্টার টেবিলে ছড়িয়ে আছে অদিতির খাতা। নাকি মণিমুক্তো!
দাদা কি এর চেয়েও বেশি কিছু নিয়ে গিয়েছিল অদিতির কাছ থেকে?
পায়ে পায়ে খাঁচার ধারে গেল অদিতি। খাঁচার দরজা খুলে টিয়ার পিঠে আলতো হাত রাখল। এই প্রথম পাখিটাকে সাহস করে স্পর্শ করছে অদিতি।
ক্ষতস্থান শুকিয়ে যাচ্ছে, পাখির দেহে আবার পেলব শ্যামলতা, তবু পাখি ছিটকে যায় ভয়ে। ছোট্ট ছোট্ট ঠোকর মারছে অদিতিকে।
অদিতির ব্যথা লাগছিল না।
.
১১.
সিঁড়ির নীচে সার সার লেটারবক্স। আটটা ফ্ল্যাটের আটটা। মজুমদার লেখা বাক্সে আজ অনেক চিঠিপত্র। পাপাই সুপ্রতিমের নামে বড় বড় দুটো খাম। ইনসিয়োরেন্স-এর নোটিস। ইলেকট্রিক বিল। লখনউ থেকে সুপ্রতিমের ভাইয়ের চিঠি, ইন্ল্যান্ডে।
ইলেক্ট্রিক বিলের অঙ্ক দেখে ভুরু কুঁচকোল অদিতি। তিনশো বাহান্ন। গত মাসে তিনশো এগারো ছিল না। মানে একচল্লিশ টাকা বেশি। একই তো কারেন্ট পোড়ে, এত তফাত কী করে যে হয়!
অদিতি চোখ ছোট করে পাপাইয়ের খামের প্রেরকের নাম পড়ল। মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটি। প্রায়শই বিদেশ থেকে এরকম খাম আসছে পাপাইয়ের। গত মাসে কী এক ইউনিভার্সিটি থেকে এসেছিল, আরিজোনা না ওরিগন। ভেতরে ছিল ইয়া মোটা বুকলেট্। মা খাম খুলে দেখেছে বলে কী উষ্মা ছেলের! অন্যের চিঠি খোলা কিন্তু খুব বাজে হাবিট মা! পাপাই কি বাইরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছে? ভাঙে না কেন? থাক পড়ে, এ চিঠি পাপাই দার্জিলিং থেকে ফিরেই খুলবে।
সুপ্রতিমের খামটাও খুলে দেখার দরকার নেই। এ হল এক রহস্যময় রাজেশ গুলাটির কাছ থেকে আসা অদরকারি কাগজ, অদিতি জানে। সুপ্রতিম একে চেনে না, কোত্থেকে লোকটা সুপ্রতিমের ঠিকানা পেয়েছে তাও জানে না, কিন্তু অজ্ঞাত শুভাকাঙক্ষীর মতো লোকটা মাঝে মাঝেই কাগজপত্র পাঠিয়ে দেয় সুপ্রতিমকে। হাজারো কোম্পানি প্রতিদিন যে শেয়ার ছাড়ছে বাজারে, সেই সব শেয়ার কেনার কাগজ এগুলো। প্রায় প্রতিবারই সময় পার করে পৌঁছোয় কাগজ, সুপ্রতিম এক ঝলক দেখে ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ফেলে দেয়। দৈবাৎ কখনও সময়মতো এলে অসীম কৌতূহল নিয়ে বিনিয়োগে লাভ আর ঝুঁকির সম্ভাবনা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে। এবং ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ফেলে দেয়। শেয়ার কেনার জন্য অফিসে নিজস্ব পরিচিত লোক আছে সুপ্রতিমের। এ খামও বাজে কাগজের ঝুড়িতে যাবে। বেচারা রাজেশ গুলাটি!
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে অদিতি দেওরের চিঠিটা পড়ছিল। দাদা বউদি দুজনকে এক সঙ্গে চিঠি লিখেছে পার্থপ্রতিম। জা কাবেরীও। নেহাতই ঘরোয়া চিঠি। বাবাই ক্লাশ সেভেনে উঠেই স্কুলের হকি টিমের ট্রায়ালে ডাক পেয়েছে, দিবারাত্র এখন স্টিক নিয়ে ছুটছে। কাবেরীর লু লেগে গিয়েছিল, শয্যাশায়ী ছিল ছ সাত দিন, বৃষ্টি নামার পর সে এখন সুস্থ। এবার হয়তো পুজোয় পার্থপ্রতিমরা কলকাতা আসতে পারে, তবে দিন সাতেকের বেশি থাকা হবে না, বাবাইয়ের স্কুলে ছুটি নেই। বউদির গল্প লেখা কেমন চলছে, জানতে চেয়েছে পার্থপ্রতিম। কাবেরীও। দুজনে পাপাই তাতাইয়েরও খোঁজ নিয়েছে নিয়মমাফিক। সুপ্রতিম শরীরস্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখছে কি না সে সম্পর্কেও…।
অদিতি চিঠিটা পড়তে পড়তে হাসছিল মনে মনে। পার্থটা ক্রমশ কেমন নিরুত্তাপ হয়ে গেল! অথচ বিয়ের পর পার্থই ছিল শ্বশুরবাড়িতে অদিতির প্রথম বন্ধু। দুই ননদ এখন খুব সমীহ করে বটে তবে তখন তাদের চোখে অদিতি ছিল যেন শত্রুপক্ষের লোক। যেন অনাহুতের মতো এসে ভালমানুষ দাদাকে কেড়ে নিয়েছে অদিতি। কী ছেলেমানুষিই না করত ননদ দুটো! গল্প করার ছলে ইচ্ছে করে রাত দুটো অবধি আটকে রাখত অদিতিকে! পাউডার ক্রিম পারফিউম যা কিনে আনত সুপ্রতিম, খাবলা মেরে গায়েব করে দিত! পার্থ ছিল অন্যরকম। হাসিখুশি, দিলদরিয়া ধরনের। টিউশনির টাকা থেকে অদিতিকে শাড়ি কিনে দিয়েছিল একবার। কাবেরীর সঙ্গে প্রেম করার আদ্যোপান্ত গল্পও শোনাত বউদিকে। এখন সেই দেওরই কত দূরের লোক, ননদরা অনেক বেশি বন্ধু। সময় আর সংসার মানুষকে কত রকম ভাবে যে ভাঙে গড়ে!
তিনতলার ল্যান্ডিং-এ পৌঁছে অদিতি থমকাল। একটি বছর কুড়ির মেয়ে তাদের ফ্ল্যাটের দরজায়! বেল টিপছে। পরনে সালোয়ার কামিজ, কাঁধে ওড়না। বাসন্তীরঙ ওড়নার প্রান্ত পেঁচাচ্ছে আঙুলে। ঘাড় ঘুরিয়ে কল্যাণীদের বন্ধ দরজার দিকে তাকাচ্ছে ঘন ঘন।
সেলস্ গার্ল কি? সঙ্গে তো কিছু নেই?
অদিতি তরতর করে উঠে এল,—কাকে চাই?
মেয়েটি চমকে ঘুরল,—সায়ন্তন মজুমদার এই ফ্ল্যাটে থাকে না?
—হ্যাঁ থাকে। অদিতি হাসিমুখে বলল,—আমি সায়ন্তনের মা।
—ও। মেয়েটি ঢোক গিলল,—সায়ন্তন বাড়ি নেই?
—না। ও তো দার্জিলিং গেছে।
—তাই? মেয়েটির কথার সঙ্গে খানিকটা বাতাস ঝরে পড়ল যেন। খুব ধীরে ধীরে প্রশ্ন করল,—কবে ফিরবে সায়ন্তন?
—কাল তো নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ট্রেনে চাপার কথা। পরশু ফিরবে।
—ও।
—সায়ন্তন ফিরলে কিছু বলতে হবে?
—না না। মেয়েটি কেমন সন্ত্রস্ত হয়ে গেল। সজোরে মাথা নাড়ছে দু দিকে, —আমি পরে যোগাযোগ করে নেব।
অদিতির একটু সন্দেহ হল। মেয়েটিকে এত নার্ভাস দেখাচ্ছে কেন? গলাটাও যেন শোনা শোনা!
মন্থর পায়ে নামছে মেয়েটি, অদিতি ডাকল,—শোনো।
মেয়েটি দাঁড়িয়েছে।
—তোমার নামটা বলে গেলে না তো?
—আম-আম-আমার? সায়ন্তনকে নাম বলতে হবে না।
অদিতির সংশয় ঘনীভূত হল। হেসে বলল,—আমি তোমার নাম জিজ্ঞেস করছি।
—শ্রেয়া।
মুহূর্তে মস্তিষ্ক হাতড়াল অদিতি। পাপাইয়ের বহু সহপাঠিনীর নাম তার শোনা, চন্দনা সুতনুকা বৈশাখী এরকম কয়েকজন এসেছেও বাড়িতে, তাদের কারও মুখে কি শ্রেয়া নামটা শুনেছে অদিতি? অদিতির কৌতুহল বাড়ছিল। জিজ্ঞাসা করল,—তুমি সায়ন্তনের সঙ্গে পড়ো?
—ন্ন্না।
—কী পড়ো তুমি?
—ইংলিশ অনার্স।
—সায়ন্তনদের কলেজে?
—না। যাদবপুরে।
—থাকো কোথায় তুমি?
—বেলেঘাটায়।
এতক্ষণে গলাটা যেন চেনা যাচ্ছে! এই মেয়েটিই কি পাপাইকে ফোন করে?
অদিতি মেয়েটিকে আটকাতে চাইল। বলল,—ওমা, অত দূর থেকে এসেই ফিরে যাবে? এসো, একটু বসে যাও।
—আমি বাড়ি থেকে আসছি মাসিমা। মেয়েটির কথার গতি বেড়ে গেছে অকস্মাৎ, — কলেজে এসেছিলাম, কলেজে আজকে ক্লাশ হল না, সেই জন্য এখান থেকে একবার …
—বারে, তা বললে কী হয়! সায়ন্তন যদি এসে শোনে তার বন্ধু দরজা থেকে ফিরে গেছে, আমাকে আস্ত রাখবে? এসো এসো।
দরজার লক খুলল অদিতি। মেয়েটি ল্যান্ডিং-এই দাঁড়িয়ে আছে। ইতস্তত ভাব।
গোয়েন্দা চোখে কয়েক সেকেন্ড মেয়েটিকে দেখল অদিতি। ভারী মিষ্টি মুখ। চোখ দুটো বড় বড়, টানা টানা। স্টেপকাট্ চুল মাথার পিছনে ঢেউ হয়ে আছে। চাপা সংকোচে ফর্সা মুখে লাল আভা। ঘামছেও খুব।
অদিতি ঈষৎ আদেশের সুরে বলল,—কই, এসো।
কদিন টানা বৃষ্টির পর কাল থেকে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে আকাশ। তবে মেঘ এখনও পুরোপুরি কাটেনি, ভারী শরীর নিয়ে অলস মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ হারানো সূর্য দেখা দিয়ে যায়। তার লাজুক আলোয় দুপুরের আকাশ যেন জলরঙে আঁকা ছবি। অদিতির ঘরেও এক মায়াবী আলোছায়া।
শ্রেয়া সঙ্কুচিত মুখে সোফার এক কোণে বসে আছে, ভিতু খরগোশের মতো দেখছে চারদিক, ওড়নায় ঘাড় গলা মুছছে আড়ষ্ট ভাবে।
অদিতি শরবত করে এনে শ্রেয়ার সামনে বসল,—সায়ন্তন তো সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়ে, তোমার সঙ্গে সায়ন্তনের আলাপ হল কী করে?
—ওদের অ্যানুয়াল ফেস্টিভাল হয়, জাভোৎসব … ওখানেই …
—তাই বলো। তার মানে তোমার সঙ্গে খুব বেশি দিনের বন্ধুত্ব নয়।
—নাহ্। সাত আট মাস।
—আচ্ছা, দাঁড়াও দাঁড়াও। অদিতি একটু চিন্তা করার ভান করল,—তুমিই রাত্তিরের দিকে টেলিফোন করো, তাই না? সায়ন্তনের বাবা ফোন ধরলেই কেটে দাও!
শ্রেয়া শরবতে চুমুক দিয়েছিল, বিষম খেয়ে কাশতে শুরু করেছে। কাশতে কাশতে লাল টকটকে হয়ে গেছে মুখ। হাঁপাচ্ছে।
শ্রেয়ার অবস্থা দেখে মজা লাগছিল অদিতির। সহাস্য মুখে বলল,—যাওয়ার আগের দিনও তো তোমার সঙ্গে আধ ঘণ্টা কথা হল, তখন তোমাকে বলেনি দার্জিলিং যাচ্ছে?
শ্রেয়া হঠাৎ স্থির। নিষ্পলক তাকিয়ে আছে অদিতির দিকে,—আমি তো এর মধ্যে ফোন করিনি মাসিমা!
—কার সঙ্গে কথা হচ্ছিল তা হলে! আমার তো মনে হল তোমার গলা!
—বিশ্বাস করুন মাসিমা, দু মাসের ওপর সায়ন্তনের সঙ্গে আমার কোনও যোগাযোগই নেই।
—কেন?
শ্রেয়া উত্তর দিল না, নত মুখে বসে আছে।
মায়ের চোখে সরলতার কাজল থাকলে অনেক দৃশ্যমান জিনিসও গোচরে আসে না, আবার মাতৃ ইন্দ্রিয় প্রখর হয়ে উঠলে অনেক অদেখা ছবিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ঠোঁটে হাসি বজায় রেখে অদিতি বলল,—তোমাদের কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছে?
শ্রেয়া চুপ।
অদিতি গার্জেনের মতো বলল,—তোমার এত লজ্জা, তবু তুমি সায়ন্তনের খোঁজে বাড়ি অবধি ছুটে এসেছ? এ তো ভারী আশ্চর্য কথা!
শ্রেয়া তবু মুখ খোলে না।
—তোমাদের শেষ কবে দেখা হয়েছিল?
—পঁচিশে বৈশাখ।
—কোথায়?
—আমরা একসঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম।
—কী ছবি?
শ্রেয়া আবার চুপ।
অদিতি আর প্রশ্ন করল না। তার জেরার তোড়ে যেটুকুনি কথা বেরিয়ে এসেছে তাই যথেষ্ট। মনে হয় সেদিনই কোনও ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিল। পাপাইয়ের মধ্যে একটা অন্য ধরনের চাপা জেদ আছে। তাতাইয়ের জেদ অনেক খোলামেলা, বোঝা যায় তাকে। পাপাই নিজেকে সহজে প্রকাশ করে না, গোঁজ মেরে থাকে। একবার পাপাইকে আইসক্রিম খেতে মানা করেছিল অদিতি, গলা ব্যথা হয়েছিল বলে। দু তিনবার বায়না করে চুপ মেরে গেল পাপাই, কিন্তু জেদটাকে মনে মনে একটা অন্য আকার দিয়ে নিল। তারপর থেকে অন্তত কয়েক মাস অদিতি সুপ্রতিম সাধলেও প্রিয় আইসক্রিম অবলীলায় প্রত্যাখ্যান করত পাপাই, হাসি মুখে।
শ্রেয়ার ওপরও কি সেরকমই কোনও অভিমান হয়েছে পাপাইয়ের?
অদিতি বলল, —দ্যাখো, কী নিয়ে তোমাদের ঝগড়া হয়েছে তা যদি আমাকে না বলতে চাও, আমি জিজ্ঞেস করব না। তবে…
—আমার সঙ্গে সায়ন্তনের কোনও ঝগড়াই হয়নি মাসিমা। শ্রেয়া জড়তা কাটিয়ে হঠাৎ সোজাসুজি তাকিয়েছে।
—তা হলে?
—আমি জানি না মাসিমা। ওইদিনের পর থেকে কোনও কারণ ছাড়াই সায়ন্তন আমাকে অ্যাভয়েড করছে। দেখা করতে বললে এড়িয়ে যায়, ফোন করলে কথা বলে না।
যথেষ্ট ঋজু থাকার চেষ্টা করেও শ্রেয়ার গলা ধরে যাচ্ছে, অদিতি বুঝতে পারছিল। শ্রেয়া চলে যাওয়ার পরেও খটকাটা কাটছিল না তার। পাপাই শুধু শুধু মেয়েটির সঙ্গে রুক্ষ ব্যবহার করছে? নিশ্চয়ই মেয়েটির কোনও আচরণে পাপাই আহত। ছেলে তার এমনিতেই অন্তর্মুখী, হয়তো বাদবিসম্বাদে না গিয়ে নিঃশব্দে সরে আসতে চায়!
সারা দুপুর লেখাতেও মন বসল না অদিতির। কাগজ কলম নাড়াচাড়া করাই সার! বারবার নতমুখী মেয়েটির মুখ মনে পড়ে। শ্রেয়া কেমন মেয়ে? চেহারা হাবভাবে তো ভাল ঘরের মেয়ে বলেই মনে হয়। নিষ্পাপ মুখেও কীট লুকিয়ে থাকতে পারে। তার ছোট ননদ বিনা তো পাত্রপক্ষের আশীর্বাদের দিন সকালেও তার প্রেমিক অজয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল! বিয়ে যে স্থির হয়ে গেছে সে কথা তখনও অজয়কে বলেনি! অদিতিকে পথে ধরে অজয়ই একদিন পরে মনোবেদনা জানিয়েছিল। বিয়ের দিন রিনার আপ্লুত মুখ দেখে কেউ বুঝতে পেরেছে টানা দেড় বছর ধরে অজয়কে কড়ে আঙুলে নাচিয়েছে রিনা? শেয়ার ক্ষেত্রেই বা পাঁচ দশ মিনিট কথা বলে কতটুকু আন্দাজ করতে পারে অদিতি? সে রাত্রেই বা পাপাই কার সঙ্গে কথা বলছিল? একই নিবিষ্ট ভঙ্গিতে? নিচু স্বরে? হাসি মুখে?
সন্ধের মুখে বাড়ি ফিরল সুপ্রতিম। কদিন ধরেই সুপ্রতিমের মুখ শুকনো, আজ যেন আঁধার নেমেছে। কী নিয়ে সুপ্রতিমের উদ্বেগ, জানে অদিতি। জেমসন ইন্ডিয়ার সঙ্গে লোটাস ইন্ডিয়ার সংযুক্তির ব্যাপারটা অনেক দূর এগিয়ে গেছে, সুপ্রতিমদের অফিসে এখন এক জোর গোলমেলে অবস্থা। কিন্তু এত কালো মুখ কেন? ফিরেই হুড়হুড় করে স্নান করল সুপ্রতিম, চা জলখাবার খেল না, টিভি চালিয়ে বোতল খুলে বসে গেল।
অদিতি পাশে এসে বসে রইল একটুক্ষণ। অফিসের কথা তুললে চটে যাচ্ছে সুপ্রতিম, ও কথা তুলল না। কোমলভাবে বলল, —এই, একটা কথা বলব?
সুপ্রতিম টিভির দিকে তাকিয়ে আছে, দেখছে না। পর্দাতেই চোখ রেখে বলল, —কী?
সুপ্রতিম মন খারাপ করে থাকলে অদিতির একটুও ভাল লাগে না। টিপ্পনি কাটবে, গাঁক-গাঁক চেঁচাবে, হো-হো হাসবে, অদিতির ওপর মেজাজ দেখাবে—সেই মানুষটাই তো সুপ্রতিম।
অদিতি সুপ্রতিমের মেজাজটা ছন্দে আনতে চাইল, —চলো না, আজ নাইট শো-এ সিনেমা যাই।
ঠাণ্ডা চোখে তাকাল সুপ্রতিম, —কেন?
—অনেক দিন যাইনি তাই।
সুপ্রতিম হুইস্কিতে ছোট্ট চুমুক দিল, —তোমার কি মনে হচ্ছে এটা এখন ফুর্তি করার সময়?
অদিতি একটু রাগাতে চাইল সুপ্রতিমকে, তাতলে যদি ধাতে ফেরে। বলল, —তোমাকে দেখে তাই তো মনে হচ্ছে। রোজ যেভাবে এসেই তড়িঘড়ি গ্লাস বোতল নিয়ে বসে পড়ছ।
সুপ্রতিমের চোখ কুঁচকে গেল, —তোমার আপত্তি আছে?
—অবশ্যই আছে। গত মাসে তোমার প্রেসার কত ছিল মনে আছে? একশো চল্লিশ বাই নাইন্টি ফাইভ।
—তা হবে। নিজের ব্লাড প্রেসার মুখস্থ রাখা ছাড়াও আমার অন্য কাজ কাছে।
সুপ্রতিমের স্বর বড় নিষ্প্রাণ। অদিতি মিনিট খানেক নীরব থেকে আবার খোঁচাল, —শুধু শুধু খাচ্ছ কেন? তাতাইকে দিয়ে চানাচুর পোট্যাটো চিপস কিছু আনিয়ে দেব?
—না। থ্যাঙ্কস।
—খালি পেটে ড্রিঙ্ক করলে তোমার অম্বল হয়। সারা রাত বুক জ্বালা করছে বুক জ্বালা করছে করে ছটফট করবে।
—তোমার অসুবিধে হলে বোলো, সোফায় শুয়ে থাকব।
সুপ্রতিমের বদলে এবার অদিতিই খেপে গেল। বিকেলে ভেবেছিল সুপ্রতিম এলে শ্রেয়ার কথাটা বলবে, বেবাক ভুলে গেল। রাগ রাগ গলায় বলল, —কী এমন আজ ঘটেছে অফিসে, যে বাড়ি এসেও ভোলো হাঁড়ি হয়ে বসে আছ?
হাসিঠাট্টা কোমলতায় যা হয়নি, মেজাজ দেখানোতে তাই হল। ঘড়ঘড়ে গলায় সুপ্রতিম বলল, —হয়ে গেল।
—কী হয়ে গেল?
—অ্যামালগামেশান। আজ মুম্বাইতে দুই বোর্ডের জয়েন্ট মিটিং ওভার। ডিসিশান ফাইনাল হয়ে গেছে।
—তো কী হয়েছে? তুমিই তো বলেছিলে অ্যামালগামেশান হলে তোমাদের চাকরির কোনও ক্ষতি হবে না।
—হোয়াট ডু ইউ মিন বাই চাকরির ক্ষতি? জানো, আজ আমার অফিসে সুইসাইড করতে ইচ্ছে হচ্ছিল?
—সে কী! কেন? অদিতি প্রায় আঁতকে উঠল।
—মিস্টার গিলানি ইজ নো মোর।
—তোমাদের গিলানিসাহেব মারা গেলেন? স্ট্রোক?
—দুৎ, মারা যাবেন কেন! রিজাইন করেছেন। গিলানি আমাকে কী চোখে দেখতেন তুমি জানো না ফুল। অ্যাজ ইফ আই ওয়্যার হিজ সান।
স্বামীর গলায় আদরের ডাকটি শুনে অদিতি দিব্যি বুঝে গেছে নেশার পারা চড়েছে সুপ্রতিমের। তবু বলে ফেলল, —মিস্টার গিলানি তোমার বাপ হতে যাবেন কোন দুঃখে? তিনি তোমার সমবয়সী না?
—ওই হল। ওটা কথার মাত্রা। এজ হ্যাজ নাথিং টু ডু উইথ ফাদারহুড। তিনি আমাকে পিতার মতো প্রতিপালন করেছেন, তাই তিনি আমার পিতা। বুঝলে?
—খুব বুঝেছি। বোতলের ছিপি আটকাল অদিতি, —তুমি খাটবে, কোম্পানির বিজনেস বাড়াবে, কে মাথার ওপর রইল না রইল, তোমার কী দায়?
মর্মাহত চোখে অদিতির দিকে তাকিয়ে রইল সুপ্রতিম।
অদিতি শাসন করল, —ওঠো। খেয়ে নেবে চলো। তাতাইকেও ডাকছি খেতে, দয়া করে তাতাইয়ের সামনে আর প্রলাপ বোকো না।
তাতাই টের পেয়েছে সব কিছুই। খাবার টেবিলে বসে হাসছে মিটিমিটি। অদিতি চোখ পাকিয়ে তাকাল ছেলের দিকে। ঠোঁটে আঙুল রেখে ইশারায় বলল, চুপ।
পরদিন সম্পূর্ণ অন্য মূর্তিতে অফিস থেকে ফিরল সুপ্রতিম। ক্রোধে গরগর করছে, শূন্যে হাত ছুড়ে আস্ফালন করছে। হেতু কী, না পূর্বভারতের সর্বময় কর্তা হয়ে গিলানির জায়গায় আসছে কোন এক বিবেক আহুজা। সে নাকি এক বত্রিশ বছরের চ্যাংড়া ছেলে, তারই হুকুমবরদার হয়ে কাজ করতে হবে সুপ্রতিমকে! সব থেকে শোকাবহ ঘটনা বিবেক আহুজা লোটাস ইন্ডিয়ার লোকই নয়, সে জেমসন ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যানের ভাইপো। নাহ্, এই চাকরি ছেড়েই দেবে সুপ্রতিম। কলকাতার আরও দশটা কোম্পানি সুপ্রতিম মজুমদারকে পাওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে।
এমত এক সময়ে দার্জিলিং থেকে কলকাতায় নেমে এল পাপাই। ট্রেন চার ঘণ্টা লেট, কামরায় পাখা জল কিছুই ছিল না, হাক্লান্ত পাপাই সারা দুপুর সারা বিকেল পড়ে পড়ে ঘুমোল।
চিত্ত বিক্ষেপ ঘটলে মানুষ অনেক সাধারণ জিনিসও ভুলে যায়। পাপাইকে দেখেও শ্রেয়ার কথা মনে পড়ল না অদিতির। সে এখন ঘোরতর চিন্তান্বিত। তেইশ বছরের যৌথ জীবনে বহুবারই স্বামীকে অফিস নিয়ে দুর্ভাবনায় আক্রান্ত হতে দেখেছে অদিতি, এবার যেন বড় বাড়াবাড়ি চলছে। সুপ্রতিম যথেষ্ট হিসেবি মানুষ, সংসারজ্ঞান তার খুবই টনটনে, তার ওপর অদিতির যথেষ্ট আস্থাও আছে, তবু ঝোঁকের মাথায় যদি কিছু করে বসে মানুষটা…! লোটাস ইন্ডিয়া সুপ্রতিমের প্রাণ, প্রায়শই রসিকতা করে বলে কোম্পানি রানস ইন মাই ভেইনস, সেই মানুষ এই পঞ্চাশ বছর বয়সে অন্য কোথাও চাকরি করে কি শান্তি পাবে?
শ্রেয়ার কথা অদিতির মনে পড়ল দিন দুয়েক পর। বিচিত্র এক মুহূর্তে। পাপাই সেদিন সকালে বেরিয়েছিল, ফিরেছে দুটো আড়াইটের সময়, ফিরেই কী সব কাগজপত্র নিয়ে বসে গেছে, অদিতি ছেলের ঘরে এল, —কীরে, ঘড়ির দিকে দেখেছিস? স্নান খাওয়া করবি না?
পাপাই একটা কী ফর্ম ফিল আপ করতে করতে মুখ তুলল, —করব। আগে একটু পোস্ট অফিসে যেতে হবে।
—এক্ষুনি? এই চড়া রোদ্দুরে ফিরলি, আবার বেরোবি? একবারে কাজ সেরে আসতে পারতিস?
মা-র মতো নাবালিকার কথায় বহুদর্শীর মতো হাসল পাপাই, —একবারে সেরে ফেলা গেলে তাই তো করতাম না। যাও, একটু শরবত নিয়ে এসো।
—তুই কি চাকরির চেষ্টা করছিস?
—না।
—তা হলে কীসের দরখাস্ত পাঠাচ্ছিস?
—আছে। সময়ে জানবে।
—তুই জি আর ই-তে বসতে চাইছিস, না? পাস করে স্টেটসে পড়তে যেতে চাস?
পাপাই চোখের কোণ দিয়ে মার দিকে তাকাল, —গুড গেস।
—তুই বাইরে পড়তে যাবি? কেন, এখানে কী অসুবিধে?
—ও মা প্লিজ, আমি যাইনি এখনও অ্যাপ্লাই করছি শুধু। ফট করে ডট পেন বন্ধ করল পাপাই, —বলছি এক গ্লাস শরবত খাওয়াতে! গলা শুকিয়ে গেছে!
ফ্রিজ থেকে স্কোয়াশের বোতল বার করতে করতে শ্রেয়ার কথা মনে পড়ে গেল অদিতির। কেন যে পড়ল! পাপাইয়ের সঙ্গে নিরালায় কথা বলছে বলে কি? নাকি শেষবার এই স্কোয়াশের বোতল বার হয়েছিল শ্রেয়ার জন্য, সেই কারণে?
কমলা বর্ণ তরল পাপাইয়ের সামনে রেখে অদিতি কায়দা করে প্রশ্ন করল, —হ্যাঁ রে, যে মেয়েটা রোজ রাত্তিরে তোকে ফোন করে, তার নাম কী রে?
—কেন বলো তো?
—না, এমনিই জানতে চাইছিলাম।
—ও।
—মেয়েটা তোর ক্লাশমেট নয়, তাই না?
—ভালই তো অনুমান করো। পাপাই শরবত শেষ করে ঝটিতি দরখাস্তে মন দিল।
পরবর্তী প্রশ্ন ঠিক খুঁজে পাচ্ছিল না অদিতি। শ্রেয়ার সঙ্গে সম্পর্ক কতটা কি না জেনেই মেয়েটির বাড়িতে আসার কথা বলা উচিত হবে? প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেকে কত দূর জেরা করা মা-র পক্ষে সঙ্গত?
অদিতি দ্বিধাভরে জিজ্ঞাসা করল, —শ্রেয়াকে চিনিস?
পাপাই দৃশ্যতই চমকেছে। ডটপেন থেমে গেল, —কে শ্রেয়া?
—সে তুই আমার থেকে ভাল জানিস।
—আমি কোনও শ্রেয়া-ফেয়াকে চিনি না। পাপাই অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, —তুমি কোত্থেকে ওই নাম পেলে? ও নামে কেউ ফোন করেছিল?
না, সশরীরে বাড়িতেই এসেছিল। বলতে গিয়েও নিজের জিভকে টেনে রাখল অদিতি। ছেলের মুখ দেখে ব্যাপারটা কি শুধু মান-অভিমান বলে মনে হয়? কৌশলে সরল সত্যটাকে এড়িয়ে গেল অদিতি। বলল, —মা-র কাছে কি ছেলের কিছু গোপন থাকে রে? তোর মুখ দেখে আমি বুঝতে পারছি…
—স্টপ ইট মা। দম দেওয়া পুতুলের মতো ঘাড় ঘোরালো পাপাই। ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসছে, —তোমাকে কে কী বলেছে জানি না, তবে তুমি আমার মুখ থেকে শুনে রাখো, শ্রেয়া বলে কোনও মেয়ের সঙ্গে আমার কোনওদিন কোনও সম্পর্ক ছিল না। এখনও নেই।
—তুই শ্রেয়াকে চিনিস না?
—চিনব না কেন? চিনতাম। বাজে মেয়ে। আমার পেছনে খুব লেগেছিল, পাত্তা দিইনি।
ছেলের বিকারহীন মুখভাব দেখে উত্তরোত্তর বিস্ময় বাড়ছিল অদিতির। ফ্যালফ্যাল মুখে বলল, —যে মেয়েটার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে কথা বলতিস, সে শ্রেয়া নয়?
—নো।
—তা হলে কে সে?
—তোমার এত কৌতুহল কেন বলো তো?
—বারে, ছেলের সম্পর্কে মা-র কৌতুহল থাকবে না?
—থাকবে। ছেলে যতটুকু বলবে ততটুকুই। কাটো এখন। আমাকে কাজ করতে দাও।
অদিতি আহত মুখে সরে গেল। মনের কোণে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া ঘন হচ্ছে ক্রমশ। পাপাই কি অদিতির কাছ মিথ্যে কথা বলছে? নাকি শ্রেয়াই…? মিথ্যে বলে পাপাই বা শ্রেয়া কার কী লাভ? অদিতি এমন কিছু আদ্যিকালের মা নয় যে পাপাইকে তার কাছে কথা গোপন করতে হবে! শ্রেয়া কি সত্যিই খারাপ মেয়ে? সাজিয়ে গুছিয়ে পাপাইয়ের নামে মিথ্যে অভিযোগ জানাতে এসেছিল? তাই বা কী করে হয়? মেয়েটা তো ফিরেই যাচ্ছিল, অদিতিই জোর করে..? শেয়ার আসার কথাটা না বলা কি ভুল হল?
ভেবে ভেবে কূল পাচ্ছিল না অদিতি। একে সুপ্রতিমকে নিয়ে দুশ্চিন্তা চলছে, সঙ্গে পাপাই মাথায় আর একটা গুবরে পোকা ঢুকিয়ে দিল, অদিতির গল্প লেখা প্রায় লাটে। দুদিন ধরে দুপুরবেলা একটা গল্প নিয়ে কত ঘষাঘষি করল অদিতি, এগোতে পারল না একটুও।
অদিতি যে তিমিরে সেই তিমিরে। স্বামী সন্তান নিয়ে। লেখা নিয়ে। বুঝি বা নিজেকে নিয়েও।
.
১২.
উদ্বেগেরও প্রাণ আছে, প্রাণীদের মতো তার রূপভেদও অজস্র। কখনও সে তুষের আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলে। কখনও বা একছিটে মেঘ হয়ে দেখা দেয় মনের আকাশে, ক্রমশ দখল করে নেয় হৃদয়গগন। আবার কখনও বা নিজের ফুঁয়েই নিজে হাওয়া ভরা বেলুনের মত অতিকায় হয়ে ওঠে।
অফিস নিয়ে সুপ্রতিমের উদ্বেগটা এই বেলুন প্রজাতির। অন্যবারের চেয়ে এবার মাত্রার কিছু তারতম্য থাকতে পারে কিন্তু গুণগত কোনও তফাত নেই।
অচিরেই এক সন্ধ্যায় হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে ফিরল সুপ্রতিম। হাতে প্রকাণ্ড খাবারের প্যাকেট। থরে থরে কেক পেষ্ট্রি প্যাটিজ। পার্ক স্ট্রিটের মহার্ঘ দোকান থেকে কেনা।
উল্লাসে টগবগ ফুটছে সুপ্রতিম। দৈবাৎ ঘরে থাকা পাপাই তাতাইকে ডাকছে চেঁচিয়ে, —এই পাপাই, এই তাতাই, আয় আয়। চটপট খেয়ে নে।
অদিতি চোখ বড় বড় করে দেখছিল। লটারি পেয়েছে, না শোকেতাপে পাগল হয়ে গেল মানুষটা! বলল, —হলটা কী তোমার? এত কেক পেষ্ট্রি তো ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরাও খেয়ে শেষ করতে পারবে না!
সুপ্রতিম নিজস্ব সুরে গান ধরেছে, —দিল হ্যায় কি মানতা নেহি..
তাতাই ব্ল্যাক ফরেস্টে কামড় দিয়ে বলল, —বাবা প্লিজ, ওই গানটার সিচুয়েশান আলাদা।
—কী রকম সেটা?
—ঠিক ফ্যামিলি সিচুয়েশান নয়। একটু নীল আলো… তাতাই ফিক ফিক হাসছে, —তোমার বয়সটাও ধরো আরও পঁচিশ বছর কমাতে হবে… কোমরটা কমাতে হবে… মাকেও আরও…।
অদিতি ধমক লাগাল ছেলেকে, —মহা ডেঁপো হয়েছিস তো? বাবা মাকে নিয়েও ইয়ার্কি?
—আরে যেতে দাও। পড়োনি, প্রাপ্তে তু যোড়শে বর্ষে… সুপ্রতিম হোঁচট খেতে খেতে চাণক্য শ্লোকটা হাতড়াল, —ওই তো বাপ ছেলেতে কী যেন একটা হয়! কী যেন পুত্ৰং মিত্রং…! এই পাপাই, বল না।
পাপাই চিকেন প্যাটিজ চিবোচ্ছিল। উদাস মুখে বলল, —আমাদের স্কুলে স্যানসক্রিট ছিল না বাবা।
—ছিল না? স্ট্রেঞ্জ! আমাদের সময়ে তো থাকত। আঃ ল্যাঙ্গুয়েজটা এত সুন্দর ছিল! ঝনঝন কানে বাজত। এনি ওয়ে, তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমি কী বলতে চাইছি?
—বিলক্ষণ। অদিতি হাত উল্টোল, —কিন্তু বিকজটা কী?
—আছে। যবনিকা কম্পমান। ধীরে ধীরে উত্তোলিত হবে। বলেই ঘরে ঢুকে গেছে সুপ্রতিম। প্যান্টশার্ট বদলে, মুখ হাত পা ধুয়ে, পাজামা পাঞ্জাবি শোভিত হয়ে বসেছে সোফায়। সিগারেট ধরিয়ে দু পা তুলে দিয়েছে সেন্টার টেবিলে, —আমার অ্যাসেসমেন্টটা ভুল ছিল, বুঝলে?
—সে আর নতুন কথা কী!
—না না, বুঝছ না, এটা প্রায় ব্লান্ডার হতে যাচ্ছিল। গরম খেয়ে চাকরিটা ছেড়ে দিলে একেবারে ম্যাসাকার হয়ে যেত।
অদিতি লম্বা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। যাক, এবারও তা হলে উদ্বেগটা মেঘ ছিল না। এবং বেলুনটা ফেটে গেছে।
অদিতি চোখ নাচাল, —আজ আর তা হলে তোমার গ্লাস বোতল বেরোচ্ছে না?
—প্রশ্নই ওঠে না। আমি কি ড্রাঙ্কার্ড? জমিয়ে কফি বানাও তো।
সবিতা তাড়াতাড়ি রান্না সেরে চলে গেছে। অদিতি ছেলেদের জন্য দুধকফি বানাল, নিজেদের জন্য কড়া। কফি নিয়ে সোফায় এসে বসেছে।
যবনিকা উঠতে দেরি হল না। সুপ্রতিম সাড়ম্বরে জানাল কোম্পানি তাকে সব সময়ে ব্যবহারের জন্য গাড়ি দেবে স্থির করেছে, পার্কাস-টার্কাসও বাড়ছে প্রচুর, বড়সড় পে-হাইক তো হয়েছেই। তবে তার পরিমাণটা নিয়ে ছেলেদের সামনে সে আলোচনা করল না। সুপ্রতিমকে সামনের সপ্তাহে একবার মুম্বাই যেতে হবে, কোম্পানির নতুন ম্যানেজিং ডিরেক্টর সমস্ত ডিপার্টমেন্ট-এর এরিয়া ম্যানেজারদের সঙ্গে বসতে চান।
সুপ্রতিমের এই নাটুকে ভঙ্গিটা অদিতির ভারী প্রিয়। স্বামীর সুসংবাদে সেও খুশি, যেমনটি তার হওয়া উচিত। যতটা উৎফুল্ল হওয়া সুপ্রতিম তার কাছ থেকে প্রত্যাশা করে, ঠিক ততটাই উৎফুল্ল সে এখন।
পাপাই বেরিয়ে গেছে। তাই ঘরে গিয়ে গান চালিয়েছে। অদিতি আর সুপ্রতিম গল্প করছিল।
অদিতি হাসতে হাসতে বলল, —আমি কিন্তু সত্যিই এতটা আশা করিনি।
—কী ভেবেছিলে?
—তোমার নাচ দেখে ভাবছিলাম বোধহয় তোমার গিলানিসাহেব আবার ফিরে এসেছেন।
—আরে ছোহ্। ও ব্যাটা চোরস্য চোর। গাঁটকাটা। আমাদের কোম্পানির কত টাকা ঝেড়ে দিয়ে গেছে জানো? সব ওই বিবেক আহুজা এসে ধরেছে। কোম্পানি তো ভাবছে ওর এগেনস্টে ক্রিমিনাল কেস লজ্ করবে কি না।
অদিতির মুখ অল্প হাঁ, —তুমিই না কদিন আগে গিলানিকে বাবা দেবতা কি সব বলতে!
—আহ্, ও সব এখন দূর অতীত। গিলানি এখন কোম্পানির দুঃস্বপ্ন।
—তোমাদের বিবেক আহুজা তা হলে লোক ভাল?
—ভাল কী, জেম অব আ ম্যান। আমি জানতাম না, হাভার্ড থেকে এমবিএ করেছে। মার্কেট সম্পর্কে কী নলেজ, কী কনসেপশান! কী মডেস্ট বিহেভিয়ার!
—আর সেই গিলানি এখন কোথায়? টাকাপয়সা নিয়ে ফেরার?
—ধ্যাৎ, তুমি যে গাঁওয়ার সেই গাঁওয়ারই রয়ে গেলে। অত হাই পোস্টের লোকরা কি এলেবেলে চোরেদের মতো লুকোয় নাকি? বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এখন পিটারসন অ্যান্ড পিটারসনে জয়েন করেছে।
—তারা চোর জোচ্চোর জেনেও নিল?
—আরে, ওপর মহলে চুরি করার ক্ষমতাটা হচ্ছে এক্সট্রা ক্যারিকুলার অ্যাক্টিভিটি। পাপাইটার যেমন হকি, তাতাইয়ের সাঁতার, তোমাদের ওই শিপ্রার মেয়েটার টেবিলটেনিস…। এই ধরো যেমন তোমার গল্প লেখা…। এদের টাকাপয়সা চুরিটাও ঠিক তেমনি। জুতসই উপমাগুলো দিতে পেরে সুপ্রতিম অট্টহাসি হাসছে। আপন মনে আক্ষেপ উক্তিও করল, —আমি শালা বুরবকই রয়ে গেলাম। কোম্পানির থেকে হাত্তা লুটতে পারলাম না।
অদিতি ভুরু কুঁচকে বলল, —পারলে না কেন?
—ইটস নট মাই ফল্ট্। দ্যাট ওল্ড ম্যান, তোমার শ্বশুর, এমন সব জিনিস ছোটবেলা থেকে আমার মাথায় ইনজেক্ট করে দিল! সৎ পথে খেটে খাবি ব্যাটা। মরে গেলেও চুরি জোচ্চুরি করে পকেট ভরাস না, দেখবি পেট আপনি চলে যাবে। যাচ্ছেও তো, যাচ্ছে না?
শ্বশুরমশাই মানুষটাকে কোনওদিনই কট্টর আদর্শবাদী বলে মনে হয়নি অদিতির, বরং একটু যেন ভিতু ধরনের, নির্বিরোধী। একটা অ্যালুমিনিয়াম কারখানার হেড অফিসে মাঝারি অফিসার ছিলেন, বইপত্র পড়ার নেশা ছিল খুব, রাত জেগে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের অনুষ্ঠান শুনতে যেতেন, কারওরই সাতেপাঁচে থাকতেন না বড় একটা। তিনিও ছেলের মধ্যে একটা সৎ গুণ বপন করে দিয়ে গেছেন ভাবতে ভাল লাগছিল অদিতির। সৎ গুণ, না নিষেধের বেড়ি? অসৎ লোকদের স্ত্রীরা নিজেদের কাছে নিজেরা মুখ দেখায় কী করে? অদিতি হলে তো পারত না।
অদিতি বলল, —চলেই যখন যাচ্ছে, তখন হাহুতাশ করছ কেন?
—না, চারপাশে দেখি তত দিনরাত…
ঝপ করে একটা প্রশ্ন মাথায় এল অদিতির। বলল, —আচ্ছা, তোমাদের গিলানিসাহেব যে চুরি করতেন তা তুমি জানতে?
—সে কে না জানত। বলেই সচকিত হয়েছে সুপ্রতিম। গম্ভীর হয়ে গেল, —বড্ড ফালতু কথা বলো তো। মুড খারাপ করে দিয়ো না।
অদিতি চুপ করে গেল। চুপ নয়, স্থাণু।
আনন্দসন্ধ্যায় ছায়া পড়ছিল। পলকের জন্য সুপ্রতিম বদলে যাচ্ছিল অদিতির চোখে। পলকের জন্যই। সৎ কর্মঠ স্বামীকে নীতিহীন, শিরদাঁড়াবিহীন, চোরের বন্দনাকারী এক অন্তঃসারশূন্য মানুষ বলে মনে হচ্ছিল অদিতির।
অদিতি ধমকাল নিজেকে। এতদিন ঘর করার পরে এ-সব ভাবনার কোনও মানে হয়!
সুপ্রতিম টিভি চালিয়েছে। সেন্টার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কেব্ল চ্যানেলের সিনেমাটা বার করল। দেখছে। আলগা হাত রাখল বউয়ের কাঁধে, —আজ রাত্রে মেনু কী গো?
—ভাত আর ইলিশ মাছ। অদিতি হাতটা নামিয়ে দিল।
—আম-টাম নেই?
—আছে। খাওয়ার সময়ে কেটে দেব।
—আজ তাড়াতাড়ি খেয়ে নেব। ভাল করে একটা শান্তির ঘুম দরকার। আজকের কাগজটা একটু এনে দাও তো। চশমাটাও।
কাগজ চশমা দিয়ে ব্যালকনিতে এল অদিতি। টিয়াটাকে ঘরে তুলবে।
পিঠে মুখ গুঁজে ঘুমোচ্ছে টিয়া। অদিতি কাছে যেতে একবার মুখ তুলেই আবার মুখ গুজল। অদিতির গন্ধও বুঝি আজকাল চিনে গেছে টিয়া, ভয় পায় না। নিশ্চিন্তে নিদ্রা যায়।
গেটের সামনে কাদের যেন জটলা চলছে, তিন চারটে ছেলে চেঁচাচ্ছে জোর জোর। স্ট্রিটলাইটটা দপদপ জ্বলছে নিবছে, বড় চোখে লাগে। তারা নেই, আকাশ আবার লাল হয়েছে আজ। বাতাস বইছে। মৃদু, অতি মৃদু, প্রায় না বওয়ারই মতো। রাত্রে আবার ঢালবে নাকি!
টিভির পর্দায় চলমান ছায়াছবি, কাগজের ওপর সুপ্রতিমের ঘুরন্ত পেনসিল, ছেলেদের ঘর থেকে ভেসে আসা পাশ্চাত্ত্য সুর—কেমন অলীক ঠেকছিল অদিতির। সুপ্রতিম আঙুল দিয়ে সেন্টার টেবিলে তবলা বাজাচ্ছে মাঝে মাঝে, কখনও টিভির গানের তালে ঘাড় দোলাচ্ছে, কখনও বা ছেলের ঘর থেকে ভেসে আসা সুরের তালে। কী আজব যে দেখাচ্ছে দূর থেকে!
সুপ্রতিমের কি নিজস্ব কোনও তাল নেই?
অদিতি মুখ ঘুরিয়ে নিল।
পরদিন তুলতুলি এল। বিকেলের দিকে। ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পথে। তখন সবে মলিনার মাকে বিদায় করেছে অদিতি, লেখা নিয়ে বসেছে দ্বিতীয় রাউন্ড।
শোওয়ার ঘরের দরজায় উঁকি দিয়ে জিভ কাটল তুলতুলি, —এমা, তুমি লিখছিলে! অসময়ে এসে লেখা চৌপাট করে দিলাম তো!
ঘরের মেঝেতে এলোমেলো কাগজ ছড়ানো, তিনটে বালিশ তিন দিকে ছিটকে আছে, মশলার কৌটো পাউডারের কৌটো অ্যাশট্রেরা পেপারওয়েট হয়ে চেপে রেখেছে কাগজদের। একটা মোটা অভিধানও গড়াচ্ছে মাটিতে, বাংলা।
লেখাতে ছেদ পড়লেও অদিতি বিরক্ত হয়নি একটুও, তুলতুলিকে দেখলে হয়ও না। বরং মনটা এক নির্মল প্রসন্নতায় ভরে যায়। বাপের বাড়ির সৌরভ বয়ে নিয়ে আসে বলেই কি? হবে হয়তো।
অদিতি বলল, —ছাড় তো আমার লেখা। এ হল অন্ধ মানুষের সেলাইফোঁড়াই নিয়ে বসা, স্রেফ সময় কাটানো।
—সে তুমি যাই বলো পিসি, লেখাটাও তো একটা কাজ। তিন চারটে গল্প ছাপা হয়ে গেল, তুমি এখন পুরোদস্তুর লেখক ছাড়া আর কী!
অদিতির মনটা থইথই করে উঠল। বাড়ির লোকে না পুছুক, ভাইঝি তাকে লেখক বলে মানে! মানে দাদাও, যদিও সে পড়েনি কিছুই।
অদিতি মধুর হেসে বলল, —তুই কিন্তু অনেক দিন পর এলি তুলতুলি।
—ইউনিভার্সিটি না থাকলে আসা হয় না গো।
—কবে খুলল?
—তা হল গিয়ে ধরো আট দিন। রোজই ভাবি ফেরার পথে নামব, আকাশ দেখে সাহস হয় না। কাল রাত্রে বাবা খুব খ্যাচখ্যাচ করছিল, তাই আজ জয় মা বলে…
মুহূর্তের জন্য অলকেশের মুখটা দেখতে পেল অদিতি। মলিন বিষণ্ণ এক দাদা বোনের মাথায় খুশির জাদুকাঠি ছুঁইয়ে দিয়ে নেমে যাচ্ছে ধীর পায়ে অবসন্নের মতো।
অদিতি লজ্জিত মুখে বলল, —আজ আমার লেখাগুলো দিয়ে দেব, নিয়ে যাস তো। দাদাকে পড়তে দিস। সেদিন অমন ভরা বর্ষায় এল… যাওয়ার সময় আমারও মনে পড়ল না…
—বাবা এসেছিল নাকি? কবে?
—এই তো দিন পনেরো আগে। কেন, তোদের বলেনি?
—না তো!
অদিতি আর বেশি কিছু বলল না। কাগজপত্র গোছ করে রেখে তুলতুলিকে শোওয়ার ঘরে বসাল। ফ্রিজে কালকের পেস্ট্রির পাহাড় পড়ে আছে, ভাইঝির জন্য নিয়ে এল দুটো। তুলতুলিকে দেখার পর থেকেই একটা প্রশ্ন মাকুর মতো বুকে ঘুরে চলেছে। দোনামোনা করে বলেই ফেলল, —তুই আমাকে একটা খবর এনে দিতে পারবি?
—কী খবর?
—একটা মেয়ের সম্পর্কে। তোদের যাদবপুরেই পড়ে। ইংলিশে অনার্স।
—কোন ইয়ার? কী নাম?
—ইয়ার বলতে পারব না। নাম শ্রেয়া। টাইটেলটাও ঠিক জানি না।
চামচেতে পেসট্রি কেটেও মুখে পুরছে না তুলতুলি। হাত স্থির, চোখ অদিতির চোখে।
—তুমি কী জানতে চাও?
—তুই মেয়েটিকে চিনিস?
—আগে তুমি কী জানতে চাও বলবে তো?
—তেমন কিছু নয়। এই… মেয়েটি কেমন.. মানে…
—কেন বলো তো?
তুলতুলির দৃষ্টি বড় অন্তর্ভেদী। অদিতির অস্বস্তি হচ্ছিল। সঙ্কোচও। পাপাই তার এত ভাল ছেলে, তাকে সে কি বিশ্বাস করে না? সংশয় যে তবু যায় না মন থেকে!
দ্বিধা ঝেড়ে অদিতি বলেই ফেলল তুলতুলিকে। সব কথা। শ্রেয়ার আসা থেকে শুরু করে পাপাইয়ের উত্তর। সব। শুনে তুলতুলির মতো প্রাণচঞ্চল মেয়েও চিত্রার্পিতের মতো বসে রইল কিছুক্ষণ।
মাথার ওপর বনবন পাখা ঘুরছে। ছিরছিরে বৃষ্টি নেমেছে বাইরে। তবু যেন গুমোটে গায়ে জ্বালা ধরে। মাকবিকেলেই আলো কমে এসেছে খুব। বাঁকে পোঁছে হুইসিল দিচ্ছে ইলেকট্রিক ট্রেন, লেভেল ক্রসিং-এর গেট পড়েনি বোধহয়।
তুলতুলি প্লেটটা রান্নাঘরের সিঙ্কে রেখে এল। মাখন-রঙ দোপাট্টার কোণ দিয়ে আলগা মুছছে মুখ। নিচু গলায় বলল, —আমি মেয়েটাকে চিনি পিসি। ইন ফ্যাক্ট চিনতাম না, পাপাইয়ের সঙ্গে আমাদের ক্যাম্পাসে ঘোরাঘুরি করতে দেখে যেচেই আলাপ করেছিলাম। শ্রেয়া খুব ভাল মেয়ে পিসি। যেমন লেখাপড়ায়, তেমন স্বভাবচরিত্রে। শান্ত। কুল।
অদিতি ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিল। ঢোক গিলে বলল, —তা হলে হয়তো ওদের কোনও ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে! লজ্জায় দুজনেই বলতে চাইছে না!
তুলতুলি বিছানায় বসল। একটু কিন্তু কিন্তু করে বলল, —পাপাইকে দেখে আমরা যেরকম ভাবি পাপাই ঠিক সেরকম নয় পিসি। আমারও ধারণা ছিল পাপাই শুধু অ্যাকাডেমিক মাইন্ডের ছেলে, চারদিকের কিছু বোঝে না, জানে না, খেয়াল করে না… তুলতুলি একটা বড় করে নিশ্বাস নিল, —আমারই ভাই, বলতে খারাপ লাগে, শ্রেয়া ছাড়াও আরও দু-তিনটে মেয়ের সঙ্গে ওর একইরকম সম্পর্ক আছে।
অদিতির চোখে অবিশ্বাস, —তুই কী করে জানলি?
—জেনেছি। শ্রেয়াও বলেছে। পাপাইকে জিজ্ঞেস কোরো নন্দিনী বলে একটা মেয়ের সঙ্গে ঘুরত কিনা! তারপর দেবাঞ্জলি! তারপরেও একটা মেয়ে, সে অবশ্য আমাদের যাদবপুরের স্টুডেন্ট নয়, বোধহয় গোলপার্ক-টোলপার্কের দিকে থাকে…। গরমের ছুটির পর শ্রেয়া আমার কাছে এসে খুব কান্নাকাটি করছিল একদিন। পাপাইয়ের ব্যাপারে মেয়েটা ভীষণ সিরিয়াস গো। আমি ঠিক করেছিলাম পাপাইয়ের সঙ্গে নিজেই কথা বলব। এর মাঝে যে এত কিছু ঘটে গেছে… শ্রেয়া এখানে এসেছে…। পাপাই কিন্তু ভাল কাজ করছে না। পিসি।
তুলতুলি কথা বলছে না, যেন এক অদৃশ্য হাত সপাসপ চড় মারছে অদিতিকে। এই সেদিনের পাপাই, মা ভাত খাইয়ে না দিলে খেতে পারত না, তাতাই হওয়ার পর মা-র কোল না পেয়ে মা-র একটা শাড়ির কোন মুঠোয় চেপে সারারাত ঘুমোত—সেই পাপাই মেয়েদের নিয়ে খেলা করতে শিখে গেছে! অদিতির বড় দর্প ছিল তার ছেলেরা শুধু লেখাপড়াতেই ভাল হয়নি, তাদের চরিত্রও দৃঢ়ভাবে গড়ে দিতে পেরেছে অদিতি, এই তার নমুনা!
রাগটাকে দলামোচড়া কাগজের মতো পাকিয়ে রাখল অদিতি, রাত্তিরে খেতে বসে সকলের সামনে ফাঁস করল কথাটা। ইচ্ছে করেই। সুকৌশলে।
পাপাইয়ের বাঁ হাতে ইংরিজি থ্রিলার, খেতে খেতে পড়ছে পাপাই। টিভি খোলা, হরর্ মুভি চলছে, দূর থেকেও তাতাইয়ের চোখ সেঁটে আছে পর্দায়। সুপ্রতিম, তৃপ্ত সুখী সুপ্রতিম, জরিপ করছে কাটা আমের টুকরো, স্যালাডের প্লেট।
অদিতি অনেক দূর থেকে প্রসঙ্গে এল। পাপাইয়ের পাতে রুটি দিয়ে ঠাণ্ডা গলায় প্রশ্ন করল, —হ্যাঁ রে পাপাই, তুই যে জি আর ই দিচ্ছিস, বাবা জানে?
পাপাই বই থেকে চোখ সরাল না, —হুঁ।
—ও, বাবাকেও বলা হয়ে গেছে? আমার বেলাই যত লুকোছাপা?
—বাবাকে তো বলতেই হয়। আফটার অল পরীক্ষার ফি-টা তো বাবাকেই দিতে হবে।
—কত?
—হাজার তিনেক।
—পাশ করলে কী করবি?
—বাইরে পড়তে যাব।
—কেন, এখানে এম এসসি পি এইচ ডি করা যায় না?
—যায়। কিন্তু লাভ কী?
—মানে?
—এখানে রিসার্চের স্কোপ অনেক কম। ওখানে কত অ্যাডভান্সড ল্যাবরেটরি, শয়ে শয়ে জার্নাল, দুর্দান্ত গাইড… পড়াশুনোর পরিবেশই কত ভাল। এক একটা কলেজ ইউনিভার্সিটিতে কী বিশাল বিশাল লাইব্রেরি আছে কল্পনাও করতে পারবে না।
—শুধু তোর পড়ার মগজটা এখান থেকে তৈরি করে নিয়ে যাচ্ছিস, তাই তো?
বইয়ের পাতা আঙুলে মুড়ে অদিতির দিকে তাকাল পাপাই। বুড়ো আঙুল নেড়ে বলল, —সরি। বুঝলাম না।
অদিতি শান্ত মুখে বলল, —এ কথা তুই বুঝিস না তা তো নয় পাপাই। ওখানকার সবই ভাল। মানছি। কিন্তু ওখানে পৌঁছনোর জন্য এখানকারই সব অযোগ্য অচল অখদ্যে জায়গাগুলো থেকে বেস তৈরি করে নিয়ে যেতে হয়, তাই না?
পাপাই কাঁধ ঝাঁকাল, —কী করব, এমন দেশে জন্মেছি…
সুপ্রতিম কথা শুনছে মা ছেলের। হাসছে। মজা পাচ্ছে।
অদিতি বলল, —সেই জন্মস্থানে ফিরবি তো পাপাই?
—এখনই এসব কথা বলছ কেন বলো তো মা? আগে চান্সটা তো পাই…
—ধর পেলি। কী করবি?
—এটা একটা হাইপথিটিক্যাল কোয়েশ্চেন হয়ে গেল মা।
—তবু তোর মনে তো কিছু একটা ভাবনা আছে…
—তোমার কি মনে হয়? ফেরা উচিত?
—আমার কথা বাদ দে। তুই বল।
দু-এক পলক ভাবল পাপাই। তারপর বলল, —আচ্ছা তুমিই বলো, এখানে ফিরে কী লাভ? ধরো ওখানে যদি ভাল একটা জায়গায় রিসার্চ করার সুযোগ পাই, এখানে চলে এলে তা কি কন্টিনিউ করতে পারব? আমার ন্যাক স্পেস সায়েন্সে, অ্যাস্ট্রো ফিজিক্সে। মহাকাশ। এখানে তার স্কোপ কোথায়? নাসার মতো জায়গার কথা বাদই দাও, একটা ভাল অবজারভেটরি আছে ইন্ডিয়ায়? বলতে বলতে বাবা আর ভাইকে একঝলক দেখে নিল পাপাই, —এখানে ফেরা মানে আইদার কলেজ ইউনিভার্সিটিতে ছাত্র ঠেঙানো, নয়তো মান্ধাতা আমলের যন্ত্রপাতি নিয়ে রাতদিন ঘচর-ঘচর করা। উইদাউট এনি সিরিয়াস গেইন।
তাতাই হি-হি হেসে উঠল। আসল কথাটা চেপে যাচ্ছিস কেন রে দাদা? বল না ওদেশে মাল্লু বেশি। রাজার হালে থাকবি…
ভুরু কুঁচকে ভাইকে দেখল পাপাই। বলল, —হাঁ, সেটাও একটা কারণ। ওখানে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য। এখানকার মতো হকার ভিড় বস্তি পলিউশন… একটা কাম কোয়ায়েট লাইফ কে না চায়!
তাতাই বলল, —আমার বাবা নোংরা দেশই ভাল। খামচে খুমচে ঠিক টাকা রোজগার করে নেব। এত চারদিকে দুশো পাঁচশো হাজার কোটি টাকা গলে যাচ্ছে, কোথাও থেকে খাবলা মারতে পারব না?
অদিতি বলল, —তার মানে টাকা রোজগারই তোদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য, তাই তো?
সুপ্রতিম এতক্ষণে মুখ খুলেছে। প্রশ্রয়ের ভঙ্গিতে বলল, —চোখ কান খোলা মানুষ হলে তাই তো হওয়া উচিত। আমি তেমন কামাতে পারিনি কোনওদিন, তা বলে আমার ছেলেরাও পারবে না?
এই মুহূর্তে এই ঘরে নিজেকে ভিন্ন গ্রহের মানুষ মনে হচ্ছিল অদিতির। ছেলেদের পিছনে যে এত পরিশ্রম করেছে, এত সময় দিয়েছে, তার ফল তা হলে এই? এক বৃহৎ অশ্বডিম্ব?
অদিতি শুকনো স্বরে বলল, —তা হলে বলো, ওদেশে গবেষণা করতে যাচ্ছি বলাটা একটা অজুহাত। বলো সুখ কিনতে যাচ্ছে তোমার ছেলে।
সুপ্রতিম কী যেন বলতে যাচ্ছিল, পাপাই হাতের ইশারায় থামাল, —তোমার কি ধারণা মা ওদেশে সুখ এমনি এমনি মেলে? রিসার্চ করে, খেটে আমি যদি কোনও সার্ভিসই না দিতে পারি, ওরা মুখ দেখে আমাকে গাড়ি বাড়ি দেবে?
—সে তুই ওদের দেশকে সার্ভিস দিবি, তাতে আমাদের কী?
—বিজ্ঞানের এ-দেশ ও-দেশ নেই মা। নিউটনের আবিষ্কার কি শুধু নিউটনের দেশে কাজে লেগেছে?
—নিউটন তো আর গরিব দেশের মানুষ হয়ে জন্মে বড়লোকের দেশে মগজ বিক্রি করতে যায়নি!
পাপাই মুখ টিপে হাসল, —যদি সত্যি আমার মগজ বিক্রি হয়, তুমি কিন্তু তার শেয়ার পাবে মা। ডলারে।
অদিতি পাপাইয়ের কপটতার সীমা দেখবে আজ। মনের কষ্ট মনে চেপে বলল, —বাপ মা নয় বুড়ো বয়সে তোর পাঠানো ডলার চিবিয়ে সুখী হল, ওদেশে সেটল্ করলে তোর আমাদের জন্য মন কেমন করবে না?
সুপ্রতিম ফস করে বলে উঠল, —তুমি আজ আমার বড় ছেলেটাকে নিয়ে পড়লে কেন বলো তো? বেচারা একটা ব্রাইট ফিউচারের জন্য চেষ্টা করছে, কোথায় এনকারেজ করবে…
—ডিসকারেজ তো করিনি। আমি বোকাসোকা মানুষ, শুধু বুঝতে চাইছি। অদিতির ঠোটে বিদ্যুৎ, —এইটুকু বুঝতে পারি, ও নাসায় বসে চাঁদে রকেট পাঠালে আমাদের মলিনার মা-র উপকার হবে না। যতই যা হোক, ওর এখানকার স্কুল কলেজের খরচায় মলিনার মা-র তো পাঁচটা পয়সাও আছে। কিরে তাতাই, তোদের ইকনমিকস্ বই কী বলে?
দাদাকে জাঁতাকলে পড়তে দেখে তাতাই খুব খুশি। বলল, —হ্যাঁ, লেখাপড়াতে তো স্টেট কম সাবসিডি দেয় না, সেখানে তো মলিনার মারও কনট্রিবিউশান আছে।
অদিতি বলল, —মরুক গে যাক মলিনার মা। আমার কথাটার উত্তর দে পাপাই, বাবা মা-র জন্য মন কেমন করবে?
পাপাইয়ের স্থৈর্যে চিড় ধরেছে যেন। বিরক্ত মুখে বলল, —তোমার হাইপথিটিকাল কোয়েশ্চেন ইজ গোয়িং টুউ ফার মা। অতই যখন বোঝো, তখন এটাও নিশ্চয়ই জানো, পৃথিবী এখন একটা বিশাল গ্রাম। তোমরা এক পাড়ায় থাকবে, আমি থাকব আর এক পাড়ায়। ইচ্ছে হলে আমরা এ পাড়া ও পাড়ায় যাওয়া আসা করব। বাবা মা দেশে পড়ে রইল… মন কেমন করা… এ-সব মধ্যযুগীয় সেন্টিমেন্ট আর চলে না মা। তুমি কি চাও শুধু তোমাদের বুড়ো বয়সে দেখভাল করার জন্য, টু বি মোর প্রিসাইজ, তোমার ছেলে শুধু তার মুখখানা তোমাদের দেখানোর জন্য, নিজের ভূত ভবিষ্যৎ নষ্ট করে পচে মরুক? এটা কি একটা সুস্থ চিন্তা?
এই তো ছেলেকে চিনতে পারছে অদিতি। মুখোশটা সরে যাচ্ছে। শীতল হৃদয়হীন এক রোবট সামনে এখন।
রোবটের শক্তি পরখ করা দরকার। অদিতি অতর্কিতে আঘাত হানল, তুই বল কোনটা সুস্থ চিন্তা রে পাপাই? বিদেশে পালাবি প্ল্যান করে রেখেছিস বলে এখানে একটার পর একটা মেয়েকে নিয়ে ফুর্তি করে বেড়াবি, এটাও কি সুস্থ চিন্তা? নাকি একটা নিষ্পাপ ফুলের মতো মেয়েকে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলার জন্য বাজে মেয়ের বদনাম দেওয়াটা সস্থ চিন্তা?
টেবিলে যেন বাজ পড়ল। পাপাই পাথর। তাতাইয়ের হতচকিত চোখ ঘুরছে সকলের মুখের দিকে। সুপ্রতিমের হাত থেকে আমের আঁটি পিছলে গেল, মোজাইক মেঝেতে গড়াচ্ছে।
অদিতি ধারালো দৃষ্টিতে পাপাইকে দেখছে, —চুপ মেরে গেলি যে? বল কী মহৎ ধারণা থেকে তোর দেবাঞ্জলি, নন্দিনী, শ্রেয়া, তারপর ওই গোলপার্কের মেয়েটা…
—মা। পাপাই উঠে দাঁড়িয়েছে, —তুমি কিন্তু লিমিট ক্রশ করে যাচ্ছ।
—লিমিট কে ক্রশ করছে? তুই, না আমি? বল আমি একটাও বাজে কথা বলছি? ওই মেয়েগুলোর সঙ্গে তুই বাঁদরামি করে বেড়াচ্ছিস না?
—আমি যা করছি সেটা আমার ব্যাপার। তুমি এর মধ্যে নাক গলাচ্ছ কেন?
—গলাচ্ছি, কারণ আমি তোমার মা।
—তো?
রাগে মুখ দিয়ে আর কথা বেরোচ্ছিল না অদিতির। চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল। হেঁটমাথা হয়ে বসে আছে।
পাপাই দুম-দুম করে ঘরে ঢুকে গেল। তাতাইও মানে মানে সরে পড়েছে। সুপ্রতিম এখনও চুপ।
বৃষ্টি পড়ছিল। মুষল ধারে, বড় বড় দানায়। জলের ঝাপটায় ভেসে যাচ্ছে ব্যালকনি। টিয়া অস্থির নড়াচড়া করছে খাঁচায়।
সুপ্রতিম এঁটো হাতেই বসে আছে। ফিসফিস করে বলল, —কাজটা কিন্তু তুমি ভাল করলে না।
অদিতি মুখ তুলল।
—বোঝে না কেন, ছেলেরা বড় হয়ে গেছে। ওদের একটা পারসোনাল লাইফ তৈরি হয়েছে, সেখানে কি ওরা আর আমাদের খবরদারি মেনে নেবে?
অদিতি নাক টানল, —তুমি পাপাইকে সাপোর্ট করো?
—সাপোর্ট-টাপোর্ট করার কথা হচ্ছে না। ওরা ওদের মতো থাক, আমরা আমাদের মতো থাকব। ছেলেরা বড় হয়ে গেলে এ-ভাবে তাদের সঙ্গে কথা বলা ঠিক নয়।
—ছেলে চোখের সামনে অন্যায় করছে দেখলেও মুখে কুলুপ এঁটে থাকব?
—থাকবে। তুমিই তো সেদিন আমাকে বললে, কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে ইন্টারফিয়ার করা উচিত নয়?
বিমূঢ় চোখে তাকাল অদিতি, —সে তো দীপক শর্মিলার ব্যাপারে! তারা তো বাইরের লোক! ডিভোর্স একটা প্রাইভেট ব্যাপার।
—এটাও তোমার ছেলের প্রাইভেট ব্যাপার। দীপক শর্মিলা অ্যাডাল্ট, তোমার ছেলেও অ্যাডাল্ট, সেই মেয়েগুলোও কেউ কচি খুকি নয়। একটাতে নাক গলানো অন্যায় হলে, অন্যটাও অন্যায়। তাদের ব্যাপার তারা বুঝবে, হু দা হেল ইউ আর? সুপ্রতিম সেকেন্ডের জন্য থেমে বলল, —তাদের কেউ যদি এখানে মায়াকান্না কাঁদতে আসে, কান ধরে বাড়ি থেকে বার করে দেবে। গল্প লিখছ, গল্প লেখা নিয়ে থাকো, তা নয় যত সব…। আমার অত মেরিটোরিয়াস ছেলে..। না না, কাজটা ভাল করোনি অদিতি।
বৃষ্টির হুঙ্কার বাড়ছে। ধোঁয়া ধোঁয়া জলকণা মথিত করছে ত্রিভুবন। রুপোলি তলোয়ার ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে আকাশ।
অদিতি কাঁদছিল। কিন্তু কার জন্যে।
.
১৩.
হেমেন ফ্ল্যাটে ঢুকেই হেঁকে উঠলেন, কই, অদিতি কোথায়? শিগ্গির মিষ্টি নিয়ে এসো।
হেমেনের পিছনে রঞ্জন, তার স্বরে মার্জিত উল্লাস, —শুধু মিষ্টিতে হবে না হেমেনদা, আমাদের একদিন পেট পুরে মাংসভাত চাই।
সোফায় আংটা লাগানো রঙিন পর্দার স্তূপ। টাঙাচ্ছিল অদিতি, তাতাইকে সঙ্গে নিয়ে। প্রতি বছরই পুজোয় অদিতির ফ্ল্যাটে নতুন পর্দা ঝোলে, এ বছর সেলাই করাতে করাতে দেওয়ালি ভাইফোঁটা পার হয়ে গেল।
চটপট পর্দাগুলো শোওয়ার ঘরে রেখে এল অদিতি। হাসিমুখে বলল, —খাওয়াতে হবে তো বুঝলাম, কিন্তু উপলক্ষটা কী?
—তুমি আজকের কাগজে বিজ্ঞাপন দ্যাখো নি?
—কীসের বিজ্ঞাপন?।
—ও হো, সরি। তোমার বাড়িতে তো আবার রোববার ছাড়া বাংলা কাগজ ঢোকে না।
—ও হেমেন মামা, হেঁয়ালি ছেড়ে আসল কথাটা বলুন না।
হেমেনের আগে রঞ্জনই বলল, —আজ বিজ্ঞাপনে আপনার নাম বেরিয়েছে। আগামী কাল রবিবারের পাতায় আপনার গল্প থাকবে।
হৃৎপিণ্ড চলকে উঠল অদিতির, শিরা-উপশিরায় রক্তচাপ বেড়ে গেছে সহসা। যা শুনছে তা কি সত্যি?
মনের উচ্ছ্বাস যাতে ছেলেমানুষি মনে না হয় তার জন্য সতর্ক হল অদিতি। কৃতজ্ঞ স্বরে বলল, —এ কিন্তু সবটাই হেমেন মামার কৃতিত্ব।
—কেন? গল্পটা তোমার কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছিলাম বলে? আমি তো শুধু ক্যুরিয়ারের কাজ করেছি।
—আপনি না নিয়ে গেলে…আপনার কত জানাশোনা…
—আহ্ অদিতি, এ-সব কী কথা! তোমার গল্প তার নিজের মেরিটেই বেরোচ্ছে। আমি কাউকে কিচ্ছু বলিনি। নিজের লেখা নিয়ে ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স থাকা একদম ভাল নয়।
রঞ্জন বলল, —আমি প্রথম গল্পটা পড়েই বুঝেছিলাম আপনার মধ্যে ফ্ল্যাশ আছে। এখন আপনার দরকার শুধু অধ্যবসায়, পড়াশুনো, আর অবিরাম লিখে লিখে লেখা আরও শানানো।
তাতাই সোফায় বসে কথা শুনছে সকলের। বাইরের মায়াবী হেমন্তের বিকেল অনেকক্ষণ ধরেই টানছে তাকে, পর্দা টাঙানোর মতো নগণ্য কাজে মাকে সাহায্য করতে গিয়ে ইঁদুরকলে আটকে পড়েছিল সে, অতিথিদের আগমনে তার নিমপাতা খাওয়া মুখ বেশ প্রফুল্ল এখন। চনমনে গলায় জিজ্ঞাসা করল, —খবরের কাগজে গল্প লিখলে টাকা পাওয়া যায় না?
—সে তো যায়ই। মজলিশি ভঙ্গিতে বসেছেন হেমেন, —কর্মাশিয়াল কাগজ লেখা ছাপবে, সম্মানমূল্য দেবে না?
—মা-ও পাবে?
—অবশ্যই।
তাতাইয়ের কৌতুহল বাড়ছে। একবার মাকে দেখল, একবার অন্য দুজনকে। বলল,— কত দেবে?
—তা ধরো পাঁচ-ছশো তো দেবেই। বেশিও দিতে পারে।
—ওয়াও! পাঁচ-ছশো! মা, এটা তোমার জীবনের প্রথম কামাই, তাই না?
অদিতি মুখ টিপে হাসল।
—পয়লা কামাই কিন্তু ব্যাগে পুরতে নেই মা, পুরোটাই খরচ করতে হয়।
অদিতির হাসি অম্লান।
তাতাই উঠে পড়ল, —আমার কিন্তু চাইনিজ বুক করা রইল মা।
তাতাই চলে যাওয়ার পর গল্পগুজব জমে উঠেছে। হেমেন এসেছেন দিন কুড়ি পর। শেষ যেদিন এসেছিলেন সেদিন অদিতির বাড়ি ভর্তি লোকজন। পার্থ কাবেরী বাবাই তো ছিলই, সঙ্গে সুপ্রতিমের দুই বোন ভগ্নিপতি আর তাদের ছেলেমেয়েরাও। পার্থ লখনউ ফিরে যাওয়ার আগে সেদিনই ছিল ভাইবোনদের শেষ মিলনদিবস। হেমেনমামার সঙ্গে অদিতি ভাল করে কথাই বলতে পারেনি সেদিন।
আজ হেমেন গল্পের মেজাজে আছেন। বহু প্রবীণ লেখকের জীবনের অজস্র অকথিত ঘটনা হেমেনের মুখস্থ, হেমেন রসিয়ে রসিয়ে চুটকির মতো শোনাচ্ছেন সে-সব। মাঝে মাঝে হেমেন আর রঞ্জনের তর্কও হচ্ছে জোর। সাহিত্যে পরাবাস্তবতা জাদুবাস্তবতা, মিথ ফ্যান্টাসির সঙ্গে বাস্তবের কোথায় মিল, কোথায় বা গরমিল, লেখার বিষয় ও আঙ্গিকের দ্বন্দ্ব, কত কী যে তর্কের বিষয়।
রঞ্জন যখন যাব যাব করছে, অদিতি জিজ্ঞাসা করল, —আবার আসছেন কবে?
রঞ্জন বলল, —দেখি। চলে আসব যে কোনওদিন।
অদিতি বলল —এ কথা আপনি আগের দিনও বলেছিলেন, এলেন তিন মাস পরে।
হেমেন বললেন, —আসবেটা কী করে? ওর পুজোর লেখা ছিল না? পুজোয় কী কী লিখলে রঞ্জন?
রঞ্জন সলজ্জ মুখে বলল, —গোটা কয়েক গল্প, একটা উপন্যাস, আর একটা হাল্কা প্রবন্ধ।
অদিতির চোখ বড় বড় হয়ে গেল, —এত লিখেছেন?
হেমেন বললেন, —উঠতি লেখকদের কাছে পুজো সংখ্যায় লেখা যে কী নেশার তা তুমি বুঝবে না অদিতি। এই একটা পত্রিকায় লিখছে, ওই একটা পত্রিকায় লিখছে। আমি নয় বার করিনি, কিন্তু কত পত্রিকা যে বার হয় এ সময়ে…
রঞ্জন বলল, —এ আর আপনাকে বলে বোঝাতে হবে না হেমেনদা, দু-এক বছর লেখার জগতে থাকলে উনি নিজেই বুঝে যাবেন। তখন পুজোর আগে কে বাড়িতে এল কে এল না তা মনেই থাকবে না। সুরার নেশা মানুষ ত্যাগ করতে পারে, সাহিত্যের আকর্ষণ ত্যাগ করা বড় কঠিন।
হেমেন ঘন ঘন ঘাড় দোলাচ্ছেন, —তা বটে! তা বটে! আচ্ছা অদিতি, এবার তো একদিন আমরা তোমার এখানেই বসতে পারি!
—আমার এখানে! খুব ভাল হয় তা হলে। কবে আসবেন বলুন? কে কে আসবেন?
—সে অনেক লোক হয়ে যাবে। রঞ্জন, তোমাদের ওখান থেকেও কয়েক জনকে আসতে বলো না। আনিসুরকেও এনো।
—শেয়ালদের ভাঙা বেড়া দেখাচ্ছেন? রঞ্জন অদিতির দিকে তাকিয়ে হাসছে,—এ লাইনে কম পাগল আছে! একবার গ্রিন্ সিগনাল দিলেই দেখবেন আপনার ফ্ল্যাট প্যাকড্ হয়ে গেছে।
—ভালই তো। ফ্ল্যাটটা তাও পাগলদের কাজে লাগবে।
হেমেন জিজ্ঞাসা করলেন, —কবে তা হলে বসছি আমরা?
অদিতি বলল, —আপনিই বলুন। কাল রব্বিারের পরের রবিবারে আসবেন?
—তোমার কোনও অসুবিধে হবে না তো?
—একটুও না।
খুশিতে ঝলমল করছিল অদিতি। হৃদয়ের গভীরে, অনেক গভীরে, এক ঝর্না বয়ে চলেছে কুলকুল। পাথর ভাঙছে। অসংখ্য নুড়ি সরে সরে গিয়ে পথ খুলে দিচ্ছে ঝর্নার। নিস্তরঙ্গ খাতে বইতে থাকা জীবন আবার যেন ছোঁয়া পেল প্রাণের।
সুপ্রতিম ফিরল একটু রাত করে। মুম্বাই থেকে কোম্পানির কিছু কেষ্টবিষ্টু এসেছে, তাদের সঙ্গে সেলস্ প্রোমোশন নিয়ে অফিসে মিটিং চলেছে বহুক্ষণ, তারপর ক্লাবে বসেছিল সবাই। আহারাদি সেরে এসেছে সুপ্রতিম, মদ্যপানও ভালই করেছে, মেজাজ দিব্যি আমোদিত হয়ে আছে তার। ফিরেই শুরু হয়েছে অফিসের কথা, —জানো আজ ভোগলে কী বলেছে আমাকে? বলেছে মজুমদার ইউ আর জিনিয়াস্। বলো তো কেন বলেছে?
গল্প বেরোনোর খবরটা সুপ্রতিমকে দেওয়ার জন্য ছটফট করছিল অদিতি। পাপাই তাতাই খেতে বসেছে, তাদের আয়োজন সাজিয়ে অদিতি ড্রয়িং স্পেসে এল। নিজের উৎসাহ চেপে প্রশ্ন করল, —কেন?
সোফায় অদিতির পাশে ধুপ করে বসল সুপ্রতিম, —আমাদের কোনও জোন্ই এবার হাফইয়ারলি টার্গেট রিচ করতে পারেনি, একস্ক্লুডিং দিস্ মজুমদারস জোন্। নট ওনলি টার্গেট, আমাদের নতুন শ্যাম্পু বিল্কি সব জায়গায় ফ্লপ, এক্সেপ্ট্ দিস্ ইস্টার্ন এরিয়া। আরে বাবা, রঙ্গনাথের খেলা কি চিরকাল চলে? জানো তো ব্যাটা কী করেছিল?
অদিতি না শুনে বলল, —আমার একটা দারুণ খবর আছে।
—তোমার?
—হ্যাঁ গো হ্যাঁ, আমার।
—কী খবর?
—ওই যে হেমেনমামা আমার একটা গল্প নিয়ে গিয়েছিল, সেটা কালকের কাগজে বেরোচ্ছে।
—অ। তাই বলো। আমি ভাবলাম কি না কি! এমনভাবে বললে…
—বারে, এটা বড় খবর নয়?
সুপ্রতিম ঢুলু-ঢুলু চোখে হাসল, —তোমার বলার ধরন দেখে কী মনে হচ্ছিল জানো?
—কী ?
আহাররত ছেলেদের এক ঝলক দেখে নিয়ে ফিস ফিস করে সুপ্রতিম বলল, —ভাবলাম বুঝি পাপাই তাতাইয়ের পরে আবার কেউ আসছে।
—শুধু ইয়ার্কি। অদিতি হেসে ফেলল, —তোমার এটাকে দারুণ খবর বলে মনে হয় না?
—ভালই তো। গুড নিউজ। তোমার উন্নতি হচ্ছে। তবে এর জন্য তোমার আমাকে ক্রেডিট দেওয়া উচিত।
—কেন?
—তোমার কি ধারণা তোমার হেমেনমামাই তোমাকে একা উৎসাহ দিয়েছে? আমি দিইনি? আমি তোমাকে বলিনি দুপুরগুলো নষ্ট না করে লেখো? বলিনি ঝুটঝামেলায় জড়ানো বা শুয়ে-বসে সময় কাটানোর থেকে লেখা অনেক ভাল কাজ?
অদিতি দূরমনস্কভাবে ঘাড় নাড়ল, —তা তো বটেই।
—গুড। মাথায় রেখে কথাটা। জুতো খুলে মোজা দুটো জুতোর ভেতর চালান করল সুপ্রতিম, —হ্যাঁ, যা বলছিলাম। কী বলছিলাম যেন?
—কী বলছিলে?
সুপ্রতিম এক সেকেন্ড মাথা চুলকোল, —হ্যাঁ, সেই রঙ্গনাথন। সে কী করেছিল জানো? আন্ইম্যাজিনেবল্ থিং। রেল কোম্পানিকে ধরে বেয়াল্লিশ লাখ টাকার ডিটারজেন্ট্ বেচে দিল। কী করে করল বলো তো?
অদিতি উদাস গলায় বলল, —কী করে?
—ক্যাচ্ ছিল। রেলওয়ে বোর্ডের মেম্বার ব্যাটার মামাশ্বশুর। হি ইজ দা কিই। নইলে ভাবতে পারো রেল ডিটারজেন্ট কিনছে! আমাদের পারচেজের মুখার্জি তো শুনে বলেছিল, মজুমদারদা আপনার ছেলেদের ধরে ধরে ধাপার মাঠে পাঠিয়ে দিন! পারফিউম বেচে আসবে! হা হা কী জোক! সেই রঙ্গনাথনের মুণ্ডু এখন মাটিতে লুটোবে। পুছো কিউ? পুছো। পুছো।
অদিতি বড় করে একটা শ্বাস ফেলে বলল, —কেন?
—বিকজ ওই মামাশ্বশুরের এগেন্স্টে সি বি আই লেগেছে। দ্যাট ম্যান্ ইজ আ ডেড মিট্। সো রঙ্গনাথনের অর্ডার গন্। এখন গেরুয়া পরে ব্যাটাকে মাদ্রাজের রাস্তায় নামতে হবে। দে দে অর্ডার দে, অর্ডার দে, অর্ডার দেএ রে… হামে অর্ডার দে। হা হা হা।
বাবার সুরেলা কণ্ঠসঙ্গীত আর অট্টহাসির দাপটে খাওয়া শেষ করে উঠে এসেছে দুই ভাই।
সোফায় পা তুলে বসে তাতাই বলল, —বাবাকে রোজ একটা করে এরকম সিটিং দিতে বোলো না, দারুণ দারুণ গল্পের প্লট পেয়ে যাবে। তোমার ইনকামও হু হু করে বেড়ে যাবে।
—তুমি লিখে টাকা পাচ্ছ নাকি?
অদিতি হাসল সামান্য, খবরের কাগজে গল্প লিখলে টাকা তো পাবই।
তাতাই ফুট কাটল, —পার স্টোরি মিনিমাম পাঁচ-ছ শো।
সুপ্রতিম থমকেছে। নাক নাচাচ্ছে ঘন ঘন। ঠোঁট কুঁচকে বলল, —মন্দ কী! যত সামান্যই হোক, মানি ইজ মানি। শাড়ির ব্যবসায় লেগে থাকতে পারলে এর থেকে অবশ্য বেশিই আসত। তবে এটা বলতে পারো, এখানে ইন্ভেস্টমেন্টটা কম। শুধু কাগজ কলম আর কালি। ব্যস্, আমি প্লট সাপ্লাই করে যাচ্ছি, তুমি লিখে যাও। হা হা।
প্রয়োজন ছাড়া পাপাই আজকাল বাড়িতে বিশেষ কথা বলে না। অদিতি সুপ্রতিম তাতাই কারও সঙ্গেই না। তার জি আর ই পরীক্ষার আর দিন পনেরো বাকি, বি এসসি-র রেজাল্ট বেরোতে মাসখানেক। বাড়িতে যেটুকু সময় থাকে বেশ চিন্তিত দেখায় তাকে। সে’ও আজ চুপ থাকতে পারল না। তরলভাবে বলল, —তোমরা লেখকদের অত হালাফালা কোরো না, লিখেও প্রচুর রোজগার হয়। বিদেশে এক একজন রাইটার শুধু লিখেই প্যালেস এরোপ্লেন দ্বীপ কত কী কিনে ফেলছে।
ব্যস, কথা ঘুরে গেল। কোন্ দেশে কোন্ লেখকের কী পরিমাণ রোজগার, কে কত বিলাসবহুল জীবনযাপন করে, কে মাতাল, কে লম্পট, কে গাঁজা টেনে লিখতে বসে, কে চুল্ল, তাই নিয়ে ভুলভাল পর্যালোচনা শুরু হয়ে গেছে।
অদিতির হঠাৎ খুব কষ্ট হচ্ছিল। এত কিছু নিয়ে গবেষণা চলছে তিনজনের, কই একবারও তো কেউ জিজ্ঞাসা করল না কোন লেখাটা বার হচ্ছে অদিতির! সব কিছুর মধ্যেই টাকার গন্ধ খোঁজে, এরা কারা? অদিতিরই স্বামী? অদিতিরই সন্তান? ওই যে পাপাই, কৃতকার্যের জন্য এতটুকু অনুতপ্ত হল না, উল্টে ভাব দেখায় যেন অদিতিই তার ব্যক্তিগত জীবনে এক হীন অনুপ্রবেশকারী, এখনও বিভিন্ন মেয়ের সঙ্গে ফোনে একইভাবে ফস্টিনস্টি করে চলে, তাকে তো ক্ষমা করেছিল অদিতি, তবু যে কেন এক তীক্ষ্ণ শলাকা বুকে বিঁধে থাকে! ছেলেকে মার্জনা করা মা-র পক্ষে খুব সহজ কাজ, কিন্তু সন্তানের দুষ্কর্ম বিস্মৃত হওয়া বড় কঠিন, বড্ড কঠিন। আর ওই যে তাতাই, অদিতির সদাহাস্যমুখ ছোট ছেলে, সে তো এক ভাবী বানিয়া! না হলে ওইটুকু ছেলে এখন থেকেই শেয়ারবাজার নিয়ে মাতামাতি করে!
অদিতি ঘরে যেতে গিয়েও ফিরে এল। সুপ্রতিমকে বলল, —তোমাকে আরেকটা দরকারি কথা বলা হয়নি। সামনের রবিবার এই ফ্ল্যাটে একটা সাহিত্য সভা হবে।
—এখানে? রবিবার? ছুটির দিনে?
—একটা রবিবার নয় হলই। অদিতি গম্ভীর।
অদিতির মুখের দিকে তাকিয়ে সুপ্রতিম কি বুঝল কে জানে, হাত উল্টে বলল, —ও কে। ও কে। শুধু একটা প্রবলেম…
—কী?
—তথাগত বলছিল সামনের রবিবার আসবে…
—বারণ করে দিয়ো। পরের রবিবার আসতে বোলো। ও হ্যাঁ, আরও একটা কথা। হেমেনমামা আর রঞ্জনকে ওই দিন দুপুরে খেতে বলব ভাবছি।
—হঠাৎ?
—আমার ইচ্ছে।
অদিতি আর দাঁড়াল না। এক নিঃসীম শূন্যতা ছেয়ে ফেলছিল তাকে।
পরদিন খুব ভোরে, গোটা ফ্ল্যাট যখন ঘুমিয়ে আছে, অদিতি বেরিয়ে পড়ল নিঃসাড়ে। বাড়িতে খবরের কাগজ আসার এখনও অনেক দেরি, তার আগেই নিজের গল্পটাকে একবার ছুঁতে চায় অদিতি।
একা।
.
১৪.
এক হেমন্তের শুরুতে এসেছিল টিয়া, পরের হেমন্ত ফুরোবার আগেই অপরূপ এক বদল ঘটেছে তার। বুলি ফুটেছে মুখে। টিয়ার শব্দভাণ্ডারটি বড় নয়, বরং খুবই ছোট, মাত্র একটি শব্দ জমা হয়েছে তার ভাঁড়ারে। খুকু। শিস নয়, অন্য কোন নাম নয়, শুধু খুকু।
ওই শব্দটুকুই ঘুরে ফিরে আওড়ায় টিয়া। সকাল নেই, দুপুর নেই, বিকেল নেই, যখনই শোন শুধু খুকু আর খুকু। শুনতে শুনতে বাড়িসুদ্ধু সকলের কান ঝালাপালা হয়ে গেল। এক অদিতি ছাড়া। একটি শব্দেই অদিতির টিয়া প্রমাণ করেছে সে গোঙা নয়, এর বেশি আর টিয়ার কাছে কী চাওয়ার আছে অদিতির!
পাখির আজকাল তেজও বেড়েছে। খুব ডানা ঝাপটায়, ঝটপট ঝটপট শব্দে তোলপাড় হয় খাঁচা। চট করে দেখে মনেও পড়ে না কোন্ ডানাটা কমজোরি হয়েছিল টিয়ার, কোথায় বা থাবা বসিয়েছিল বেড়াল।
অদিতি অবশ্য টিয়ার দিকে নজর দেওয়ার সময় পায় না এখন। কোন্ দিকেই বা পায়! গল্প লেখা এক সময়ে তার কাছে ছিল স্রেফ ব্যসন, অবসরের সঙ্গী। এখন আর তা নেই। ক মাসের শখ কখন যেন সাধনা হয়ে গেছে। শুধু দুপুরই নয়, লেখা এখন সারাদিনই অদিতিকে অধিকার করে থাকে। লেখার মাঝে সে সহজে ওঠে না, লেখার সময়ে পাড়াপ্রতিবেশী বা আত্মীয়স্বজন এলে সে ভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে থাকে। পাপাই তাতাই হুটহাট এসে পড়লেও অবলীলায় বলে দেয় অমুক জিনিস অমুক জায়গায় আছে, নিজেরা নিয়ে নাও। সন্ধেটুকুই শুধু লেখে না অদিতি। রাত্রে বসে আবার। রোজ না হলেও প্রায়ই। নির্জন রাতে শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা থাকে না, অদিতি অনেক বেশি মনোযোগী হয়ে উঠতে পারে তখন।
রাতের সাধনাতেও বিঘ্ন এল। একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল সুপ্রতিমের। ফটফটে আলো জ্বলছে ঘরে, মেঝেতে বালিশ নিয়ে উপুড় হয়ে লিখছে অদিতি, সেদিকে তাকিয়ে চোখ রগড়াতে রগড়াতে সুপ্রতিম বলল, —কী আরম্ভ করলে! একটু শান্তিতে ঘুমোতে দেবে না?
অদিতি বলল, —কেন, আমি তো তোমার ঘুমিয়ে পড়ার পর লিখতে বসেছি।
সুপ্রতিম বলল, —এই রাত দুপুরে কি না লিখলেই নয়?
অদিতি হাসল একটু, —কী করি বলো, রাত্রে যে অনেক সুন্দর সুন্দর চিন্তা এসে যায় মাথায়! জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়ালে কত পুরনো ছবি দেখতে পাই, চোখের সামনে কত ঘটনা ভেসে ওঠে। লেখার সময়ে এগুলো বড় কাজে লাগে গো।
সুপ্রতিম বেজার মুখে বলল, —সে চিন্তাদের গুছিয়ে গাছিয়ে দিনভর লেখো না, কে তোমাকে বারণ করেছে!
অদিতি বলল, —ঘুম থেকে উঠলে ছবিগুলো যে আর মাথায় থাকে না, পুরো ভ্যানিশ হয়ে যায়।
সুপ্রতিম গজগজ করল, —তার জন্য আমাকেও রাতভর জেগে বসে থাকতে হবে! জানো আমি আলোয় ঘুমোতে পারি না। সারাদিন খেটেখুটে এসে এ-সব আর ভাল্লাগে না।
অদিতি বলতে পারত গত চব্বিশ বছরে বহু দিন সুপ্রতিম রাত জেগে অফিসের কাজ করেছে। অদিতিরও অন্ধকার ছাড়া ঘুম আসে না, তা সত্ত্বেও সুপ্রতিম আলো নেবায়নি। এখনও মাঝে মধ্যে তাতাই-এর সঙ্গে বসে টিভিতে লেট নাইট মুভি দেখে সুপ্রতিম, গত হপ্তাতেও রাত তিনটে অব্দি ফুটবল খেলা দেখল, তখন তো রাত জাগার কথা ওঠে না! অদিতিরও তো সে সময়ে অসুবিধে হয়, অদিতি কোনওদিন বলতে গেছে! অদিতির শরীর কি শরীর নয়!
কিছুই বলল না অদিতি। শান্তভাবে কাগজপত্র গুছিয়ে আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ল সে রাতে। পরদিনই বেরিয়ে দোকান থেকে একটা টেবিল ল্যাম্প কিনে এনেছে। কী আর করা, মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে খেতে লেখার অভ্যাসটা রাত্রে ঝেড়ে ফেলতে হবে।
টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে অদিতিকে লিখতে দেখে প্রথম দু চার দিন সুপ্রতিম হাসাহাসি করল। তুমি দেখছি নোবেল লরিয়েট না হয়ে ছাড়বে না! তারপর দুম করে একদিন বলে বসল, —এটা কিন্তু তোমার বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে অদিতি।
অদিতি বলল, —এতেও কি তোমার অসুবিধে হচ্ছে?
সুপ্রতিম বলল, —আমার সুবিধে অসুবিধের কথা হচ্ছে না। সব কিছুর একটা ডিসেন্সি আছে। তুমি তো আর লিখে রোজগার করে খাচ্ছ না, যে রাতদিন এরকম মুখ গুজে লিখে যেতে হবে! আমার দেখতে খারাপ লাগে।
অদিতি বলে ফেলল, —তার মানে বলতে চাইছ রোজগার করে খেতে গেলে ডিসেন্সি, লিমিট এ সব না রাখলেও চলে?
সুপ্রতিম গুম হয়ে গেল।
অদিতি পড়াশুনোও শুরু করছে নতুন করে। তার এতদিনকার ছোট্ট পৃথিবীটার বাইরেও যে এক বৃহৎ জগত আছে তাকে জানার জন্য তার এখন উদগ্র পিপাসা। বিষয় নিয়ে খুব একটা বাছাবাছি নেই অদিতির। গল্প উপন্যাস শিল্প সংস্কৃতি ইতিহাস যা হেমেন মামা এনে দেয় তাই গোগ্রাসে পড়ে ফেলে। গোলপার্কে রামকৃষ্ণ মিশনের একটা বড় লাইব্রেরি আছে, তার মেম্বার হয়েছে অদিতি, সেখান থেকেও বই নিয়ে আসে। রঞ্জনের কাছ থেকে পায় হরেক কিসিমের লিট্ল ম্যাগাজিন, তাও কম চিত্তাকর্ষক নয়।
অদিতির বাড়িতে সাহিত্যসভাও শুরু হল। বেশ কিছু তরুণ লেখকের সমাবেশ ঘটল বাড়িতে। হেমেন এবং রঞ্জনই মূল উদ্যোক্তা। স্বরচিত গল্প পাঠ হল, অদিতির ড্রয়িং স্পেস কাঁপিয়ে প্রবল তর্ক বিতর্কের তুফান উঠল, গল্প নিয়ে কাঁটাছেড়াও চলল প্রচুর। বিকেল থেকে সন্ধে অদিতির ফ্ল্যাট জমজমাট। হেমেনের সঙ্গে প্রেমতোষের সভাতেও বার কয়েক আরও গেছে অদিতি, তবে সেখানকার পরিবেশ অনেক বেশি গুরুগম্ভীর, তুলনায় অদিতির বাড়ির আসর অনেক স্বচ্ছন্দ। প্রেমতোষের বাড়িতে সবাই প্রায় শ্রোতা, এখানে লেখকদেরই সাবলীল জটলা। কত ধরণের ছেলে যে আসে! কেউ সারাক্ষণ অস্বাভাবিক গম্ভীর, কেউ বা তুবড়ির মতো কথা বলে চলেছে। কেউ অসম্ভব লাজুক, স্বপ্নালু চোখে নিজের গল্পটি পড়ে মাথা হেঁট করে আক্রমণের প্রতীক্ষায় বসে থাকে, কেউ বা সামান্যতম সমালোচনাতেই বুনো কুকুরের মতো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সকলের মধ্যেই এক ধরণের উত্তাপ টের পায় অদিতি। সহমর্মীর উত্তাপ। সহধর্মীর উত্তাপ। তরুণদের সান্নিধ্যে বেশি দিন জড়তা বজায় রাখা কঠিন, অদিতি এখন নিঃসঙ্কোচে যে কোনও লেখা সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করতে পারে।
প্রথম দিনের সভায় এলাহি জলখাবারের বন্দোবস্ত করল অদিতি। লুচি আলুর দম ভেজিটেবল্ চপ মিষ্টি। নিজের হাতে লুচি ভেজে আনল সকলের জন্য, চা করল বার দু তিন।
সেদিন সভা শেষ হওয়ার পরেই হেমেন ধরলেন অদিতিকে, —এখানে যত বারই সভা হবে, তত বারই এত আয়োজন করবে নাকি?
অদিতি বলল, —বারে, সবাইকে আমন্ত্রণ করে এনেছি…
হেমেন বললেন, —সে তো এখানে সভা করার জন্য, খাওয়ানোর জন্য নয়। এর পর থেকে তুমি আর এত ঝামেলায় যাবে না।
অদিতির মুখ করুণ হয়ে গেল। ওই সব প্রাণবন্ত ছেলেদের খাওয়াতে ভালই লেগেছে তার, হেমেন মামা শুধু শুধু আপত্তি করছে কেন! বলল, —তা হলে নেক্সট্ সভা থেকে খাওয়া বন্ধ?
হেমেন বললেন, —বন্ধ করবে কেন? সাহিত্যের যা নির্ভেজাল সঙ্গী, তা তো থাকবেই। মুড়িবাদাম আর চা। ওই চায়ের কষ্টটুকুই তোমাকে করতে হবে বার কয়েক। তোমার ছেলেদের বোলো না, তোমাকে একটু হেলপ্ করে দেবে।
অদিতি শুনে হেসেছিল মনে মনে। তার ছেলেরা করবে সাহিত্য সভায় অংশগ্রহণ! সাহিত্যের নাম শুনলেই দুই ছেলে দু দিকে পোঁ পোঁ দৌড়তে থাকে। এত্ত বোরিং! এত বোরিং! পাপাইএর জিআরই পরীক্ষা হয়ে গেল, বিএসসির রেজাল্টও বেরিয়ে গেছে। যথারীতি ফার্স্ট ক্লাশ পেয়েছে পাপাই, এমএসসিতে ভর্তিও হয়ে গেছে। তবে এখনও তার মন জিআরইর রেজাল্টের দিকে, অদিতি বুঝতে পারে। যাক, যে যেভাবে থেকে খুশি থাকে থাকুক।
আশ্চর্যের বিষয়, সুপ্রতিম কিন্তু প্রথম দিনের সাহিত্যসভায় ছিল। হয়তো বা অদিতির অনুরোধ রাখতে। অথবা নতুন ধরণের মজা চাখার বাসনায়।
থাকার ফলটা অবশ্য শুভ হল না। অদিতির পক্ষেও। সুপ্রতিমের পক্ষেও না।
উৎসাহের ঝোঁকে নবীন লেখকদের মধ্যে থেকে এক কোমলদর্শন যুবককে পাকড়াও করল সুপ্রতিম। মুরুব্বি চালে আলাপ জমাল ছেলেটির সঙ্গে।
আলাপটাই কাল হল। ছেলেটা এ-কথা সে-কথার মাঝখানে ঝপ করে বলে বসল, —আপনি তো খুব বড় চাকরি করেন, তাই না?
সুপ্রতিম হাসতে হাসতে বলল, —বাহ্ এ-খবরও জানা হয়ে গেছে! কে বলল?
—হেমেনদা বলছিলেন। …আপনি নাকি লোটাস ইন্ডিয়ার গোটা পূর্বাঞ্চলের সর্বেসর্বা।
—নারে ভাই, ওই সেলস্টা দেখাশোনা করি আর কী।
ছেলেটি টুপ করে বলল, —আপনাদের কোম্পানী তো বিজ্ঞাপনে অনেক খরচা করে, আমাদের পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন দিন না।
অদিতি সুপ্রতিমের পাশে বসে ছেলেটির কথা শুনছিল, বায়নার সুরে বলল, —হ্যাঁগো, দাও না।
—হ্যাঁ, তা ব্যবস্থা একটা করা যায়। কী নাম আপনার পত্রিকার?
—রোহিণী।
সুপ্রতিম পেশাদারী স্বরে জিজ্ঞাসা করল, —সেল্ কী রকম?
—ভাল। বেশ ভাল। লাস্ট ইস্যুটা আমাদের চারশো কপি ছাপা হয়েছিল, তার মধ্যে হার্ডলি ষাট কপি পড়ে আছে। …গোটা চল্লিশ কম্প্লিমেন্টারি গেছে…তার মানে শ তিনেক কপি তো বিক্রি হয়েছেই।
সুপ্রতিম তাকাল এদিক ওদিক। বুঝি দু চারটে নিশ্বাস নিল, —মাত্র তিনশো?
—কেন, তিনশো কম নাকি? আমাদের এন্টায়ার কাগজের দাম উঠে গেছে।
—আর ছাপার খরচ?
—ওই দু একটা বিজ্ঞাপনও আসে, বাকি যা শর্ট পড়ে পকেট থেকে যায়।
সুপ্রতিম হা হা হাসল, —তার মানে আপনার ট্যাঁকের জোর আছে।
—জোর থাকলে কী আর বিজ্ঞাপন চাইতাম! টিউশনির টাকায় সব ইস্যু টাইম্লি বার করতে পারি না…
সুপ্রতিমের চোখ গোল হয়ে গেল, —আপনি চাকরি করেন না?
ছেলেটা বলল, —চাকরি করলে কি আর ভাবনা ছিল! পত্রিকাটা কত বড় করে বার করতে পারতাম।
সুপ্রতিম আরও অবাক, —শুধু পত্রিকা বার করার জন্যই চাকরি পাওয়া দরকার?
ছেলেটা দিব্যি বলে দিল, —চাকরি পেয়ে যদি পত্রিকাই না বড় করতে পারি তা হলে সে চাকরি করে আমার লাভ কী!
—আপনার বাড়িতে কেউ নেই? মা, বাবা?
—হ্যাঁ, সবাই আছে। মা বাবা ভাই বোন। কেন বলুন তো?
সুপ্রতিম ধন্দ মারা মুখে বসে রইল খানিকক্ষণ, তারপর উঠে চলে গেল। রাত্রে ধরল অদিতিকে, —তোমার সাঙ্গোপাঙ্গোরা যে দেখছি সব বন্ধ পাগল!
অদিতি টেরচাভাবে হাসল, —একটা বিজ্ঞাপন চেয়েছে বলে পাগল হয়ে গেল!
—তিনশো কপি কাগজ বিক্রি হয় তার জন্য আমাকে বিজ্ঞাপন দিতে হবে? টাকা কি খোলামকুচি?
অদিতি তর্ক জুড়ল, —টিভিতে অসভ্য নাচগানের জন্য তোমরা লাখ লাখ টাকার বিজ্ঞাপন দিতে পারো, আর এই সামান্য একশো দুশো টাকা… একটা ভাল কাজের জন্য নয় দিলেই। তবু একটা ক্রিয়েটিভ কিছুর মধ্যে রয়েছে ছেলেগুলো!
—ক্রিয়েটিভ না হাতি। উচ্চণ্ড পাগলামি। ফ্যামিলির চিন্তা নেই, টাকা উড়িয়ে পত্রিকা বার করা! হুঁহ্।
—সবাই কি এক ছাঁদের হবে নাকি! অফিস আর রোজগার!
—থাক থাক জ্ঞান মেরো না। তোমাদের ওই ফালতু ব্যাপারে আমাকে আর জড়াবে না।
ব্যস্ হয়ে গেল। আর চোরে কামারে দেখা নেই। দ্বিতীয় সাহিত্যসভার দিন আগরতলায় ছিল সুপ্রতিম, তৃতীয় আসরের দিন প্রথম অতিথি ডোরবেল্ বাজাতেই চোস্ত্ পাঞ্জাবির ওপর শাল জড়িয়ে সোজা বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। ফিরল দুপুররাতে। পুরো চুর হয়ে। যা সে কদাচ হয়।
ফিরেই হুঙ্কার, —তোমার সব অপোগণ্ডের দল গেছে?
অদিতি স্তম্ভিত। সংবিৎ ফিরে পেয়ে ধমকাল সুপ্রতিমকে, —হচ্ছেটা কী? মাঝরাতে ফিরে হল্লা করছ কেন?
—বেশ করছি। আমার বাড়িতে আমি যা খুশি তাই করব। কোথায় তোমার সেই হারামজাদার দল?
—ও কী ভাষা! হারামজাদা শব্দের মানে জানো?
—না। তোমার কাছে শিখতে হবে। চটি খুলে দরজার দিকে ছুড়ল সুপ্রতিম। বেসামাল পায়ে শোওয়ার ঘরে গেল। গজরাচ্ছে, —খুব ভাষার ধ্বজা ওড়াতে শিখেছ অ্যাঁ? ওফ্, জীবনটা আমার হেল্ করে দিল!
অদিতি শান্ত করার চেষ্টা করল সুপ্রতিমকে। বলল, —এরকম করছ কেন? মাসে তো মাত্র একটা দিন…
—তাই বা হবে কেন? আমার একটা ছুটির দিনে আমারই ফ্ল্যাটে একপাল সুগ্রীব আর অঙ্গদ নাচানাচি করবে, এ কি মামদোবাজি?
অদিতি তাড়াতাড়ি দরজা ভেজিয়ে দিল, —কী আরম্ভ করলে কী? পাপাই তাতাইয়ের ঘুম ভেঙে যাবে যে!
—যাক। সব্বাই শুনুক। স্ফলিত পায়ে দরজা খুলে দিয়েছে সুপ্রতিম, —অ্যাই পাপাই, অ্যাই তাতাই, তোরাই বল্, এ কি মামদোবাজি?
অদিতি টেনে হিঁচড়ে সুপ্রতিমকে বসিয়ে দিল বিছানায়। হিসহিসিয়ে উঠল —আমার বন্ধুরা এখানে আসে বলেই যত রাগ, তাই না? তোমার বন্ধুরা যে সারা সন্ধে তাণ্ডব করে যায়, তার বেলা?
সুপ্রতিম ফুঁসে উঠল, —আমার বন্ধুরা তোমার ওই লাফাঙ্গাদের মতো ভিখিরির বাচ্চা নয়। কোত্থেকে শালা এক বুড়ো ভাম মামা জুটেছে, মাথাটা একেবারে চিবিয়ে ঝরঝরে করে দিল! তোমাকে লেখিকা বানানোর জন্য তার এত কীসের ইন্টারেস্ট, আঁ? গাদা গাদা ছেলে এনে আমার ফ্ল্যাটে ঢুকিয়ে দিচ্ছে, যখন তখন তোমাকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, মানে কী এ-সবের বোঝো?
অদিতি স্তব্ধ হয়ে গেল। কার্নিশের বেড়ালটা যেন হৃৎপিণ্ডে নখের আঁচড় টানছে। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে আসছে শরীর। কেটে কেটে বলল, —মাতলামির ঝোঁকে তুমি কী বলছ তুমিই জানো। একটা কথা শুনে রাখো, আমার বন্ধুরা এখানে আসবে। আমার মামাও আসবে। এটা যেমন তোমার ফ্ল্যাট, আমারও ফ্ল্যাট।
—তোমার বাপ দাদা এই ফ্ল্যাট উইল করে দিয়ে যায়নি। এটা আমার রোজগারের টাকায় করা, বুঝেছ?
—সংসারের পেছনে আমার বুঝি কোনও খাটুনি নেই? তার বুঝি দাম নেই?
—চোপ। একটা কথাও নয়। মাগ্না খাটছ? যা চাও তাই তো দেওয়া হয়। সুপ্রতিম অসংলগ্ন স্বরে চেল্লাচ্ছে, —আমার ফ্ল্যাটে এ-সব আর চলবে না। আই ডু হিয়ার বাই ডিক্লেয়ার…
অদিতি মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় শোনা যায় না এমন স্বরে বলল, —এ কথা এতদিন পরে মুখ থেকে বেরোল?
—আগেও বলতে পারতাম। বলিনি। মার্সি। ওয়াচ করছিলাম। ভেবেছিলাম কাজকর্ম নেই, একটা কিছু নিয়ে থাকবে…। সাহিত্যফাহিত্য অনেক হয়েছে। এবার ও-সব ছাতার মাথা বন্ধ করো। এটা হল গিয়ে হোম। আ প্লেস অফ হ্যাপিনেস্। এখানে আমাদের সুখ বিঘ্নিত হওয়া আমি অ্যালাও করব না।
অদিতি চৈতন্যের শেষ সীমায়। মাতালের প্রলাপ, না মনের কথাই উগরে দিচ্ছে সুপ্রতিম? হৃদয়ের গভীরে, অনেক গভীরে, কোথায় যেন একটা ভূমিকম্প হচ্ছে, টের পাচ্ছিল অদিতি। চব্বিশ বছর ধরে গড়ে ওঠা ধারণার ইমারত— অদিতিই এই সংসারের চালিকাশক্তি— ভেঙে চুরচুর হয়ে যাচ্ছে যেন।
নিশ্বাস বন্ধ করে অদিতি বলল, —বেশ, তোমরা যা চাও তাই হবে।
বাতাসে এখন হিমরেণু। দূরের পর্বত তার জমাট দুঃখের নিশ্বাস পাঠাচ্ছে এই শহরে। নিজের ডানায় ঠোঁট গুজে ওম খুঁজছে পাখি। বড় শীত। এত শীত যে হাড় মজ্জা কাঁপছে অদিতির।
বিড়বিড় করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে সুপ্রতিম। একটা পা খাটের বাইরে ঝুলছে। অদিতি পা-টা তুলে দিল বিছানায়, নরম লেপে ঢেকে দিল সুপ্রতিমকে, মশারি টাঙাল। মেঝেতে লুটিয়ে থাকা সুপ্রতিমের শাল গুছিয়ে রাখল ওয়ার্ড্রোবে।
আলো নিবিয়ে লেখার চেয়ারে এসে বসেছে অদিতি। বসেই আছে।
সুইচ টিপে অদিতি টেবিল ল্যাম্প জ্বালাল। মুহূর্তে ঘরের কোণ ঝলসে উঠেছে আলোয়। পরক্ষণে নেবাল। অন্ধকার। আবার জ্বালাল বাতি। আবার নেবাল। জ্বালাচ্ছে। নেবাচ্ছে। জ্বালাচ্ছে।
অনেক প্রশ্ন। অনেক প্রশ্ন।
দিন পাঁচেক পর একদিন ছোট ননদের বাড়ি গেল অদিতি। দু দিন ধরে ফোন আসছে, রিনার বড় মেয়েটা খুব অসুস্থ, একবার না গেলে খারাপ দেখায়। গিয়ে দেখল জ্বর একটু কমেছে, তবে সাংঘাতিক কাশিতে ভুগছে মেয়েটা। ডাক্তার সন্দেহ করছে ব্রংকাইটিস, এক্সরে করতে বলেছে, হয়েও গেছে আজ, রিনার বর অফিস থেকে ফেরার পথে রিপোর্টটা আনবে।
ডাক্তারকে রিপোর্ট দেখিয়ে রিনার বর বাড়ি ফিরল দেরিতে। অদিতি অপেক্ষা করছিল। এক্সরেতে কিছু পাওয়া যায়নি, সাধারণ কাশি, কাফ সিরাপ দিয়েছে ডাক্তার। রিনার বরের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বেরোতে বেরোতে নটা বেজে গেল অদিতির।
বাড়ি ফিরে অদিতি দেখল সুপ্রতিম সকাল সকাল ফিরে এসেছে আজ। সেন্টার টেবিলে পা তুলে, শরীর শালে মুড়ে, একটা অ্যাকশান ফিলম্ দেখছে টিভিতে। অদিতিকে দেখে বলল, —কেমন আছে রিঙ্কি?
অদিতি এখন চুপচাপ হয়ে গেছে খুব। প্রবল এক অভিমানে বুকের ভেতরটা পুড়ে গেছে তার, কিন্তু মুখে সে কিছুই প্রকাশ করে না। নিয়ম মতোই কাজকর্ম করে যাচ্ছে সংসারের, যেখানে যা কর্তব্য আছে পালন করছে, দুপুরবেলা এক অপ্রতিরোধ্য মানসিক তাড়নায় লিখতে বসেছিল দু দিন, শুধু বাড়ির কারও সঙ্গে অদিতি যেচে কথা বলছে না। ছেলেদের অবশ্য তাতে কিছু যায় আসে না। মা-র কোনও পরিবর্তন এলেও তাদের এখন দেখার চোখ কোথায়! অথবা সময়! যে যার মনে বেরিয়ে যায়, ফেরে, খায়, শুয়ে পড়ে এবং রুটিনমাফিক হুকুম ছুড়ে যায় মাকে। সুপ্রতিমও তার সেদিনের ব্যবহারের জন্য খুব একটা অনুতপ্ত বলে মনে হয় না। যেন সেদিন নেশার ঝোঁকে কিছুই তেমন হয়নি। যেন সেদিন কিছুই তেমন বলেনি অদিতিকে।
শীতটা জাঁকিয়ে এসেছে। খালি পা মেঝেতে পড়লে ছ্যাঁৎ ছ্যাঁৎ করে। বাইরের চটি ছেড়ে হাওয়াই চপ্পল পায়ে গলাল অদিতি। বলল, —ভালই আছে। কাশিটা জ্বালাচ্ছে একটু।
—সিরিয়াস কিছু?
—না।
সুপ্রতিম টেবিলে পা নাচাচ্ছে, —এদিকে তো একটা ভাল খবর আছে।
অদিতি কৌতূহল দেখাল না।
সুপ্রতিম নিজেই বলল, —পাপাইয়ের আজ জি আর ই-র রেজাল্ট বেরিয়েছে। দারুণ রেজাল্ট করেছে তোমার ছেলে। নাচতে নাচতে বন্ধুদের নাইট শোয়ে সিনেমা দেখাতে নিয়ে গেল।
—তাই বুঝি? অদিতির স্বর নিরুত্তাপ।
—আমি অবশ্য ওদের রেজাল্ট-ফেজাল্ট তেমন বুঝি না, তবে পাপাই বলল ওর স্কোর নাকি খুব ভাল। হয়তো কোনও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়ে যেতে পারে।
—ভালই তো। অদিতি শাড়ি বদলাতে ঘরে ঢুকে গেল।
তাতাই ঘরে আছে, টেবিলে খাবার সাজিয়ে তাকে ডাকল অদিতি। সুপ্রতিমকেও। খাচ্ছে তিনজনে।
আলুকপির ডালনায় রুটি ডুবিয়ে সুপ্রতিম বলল, —আমি একটা কথা ভাবছিলাম, জানো?
—কী
—তুমি তো অনেক দিন ধরেই ফ্ল্যাটটা রঙ করানোর কথা বলছ। গত শীতে হল না, এই শীতে করিয়ে দিই, কি বলো?
—করাও।
—কী রঙ করলে ভাল হয় বলো তো?
তাতাই ঝাঁপিয়ে বলল, —বেজ্ কালার। বেজ্ কালার।
সুপ্রতিমের ভুরু কুঁচকোল, —সেটা কী রঙ?
—ঠিক চন্দনও নয়, মাটিও নয়, ও আছে একটা। চার্ট দেখলে বুঝতে পারবে।
সুপ্রতিম চোখের কোণ দিয়ে দেখল অদিতিকে, —না না। তোমার মা যে রঙ চুজ করবে সেটাই হবে।
—মা-র বেজ্ কালার খুব পছন্দ, আমি জানি। তাই না মা?
—তোমাদের পছন্দই আমার পছন্দ। ক্যাসারোলের দিকে হাত বাড়াল অদিতি, —তুই আর রুটি নিবি?
—একটা।
সুপ্রতিম বলল, —কাল তা হলে মিস্ত্রির সঙ্গে কথা বলি। ঘরদোর দেখে একটা এস্টিমেট করে দিয়ে যাক।
অদিতি নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ল।
সুপ্রতিম ঠোঁট ছুঁচোল করে দেখছে অদিতিকে। হঠাৎ বলে উঠল, —বুঝলি তাতাই, আমি আরেকটা কথাও ভাবছিলাম।
—কী?
—ওই যে তোর দাদা একবার বলেছিল না, তোর মা লিখতে পারলে একটা বই বার করে দিতে! তোর মা তো অনেকগুলো গল্প লিখে ফেলল, ভাবছি সব কটা এক জায়গায় করে একটা বই ছেপে দিই। কেমন হয়?
চতুর তাতাই মুচকি হাসল। দেখল বাবা মাকে। বলল, —দারুণ।
—তুই তো কলেজ স্ট্রিটের দিকে যাস, খোঁজখবর নিস্ তো কীরকম খরচ-খরচা পড়বে।
অদিতি নিস্পৃহ স্বরে প্রশ্ন করল, —কপির তরকারিতে নুন ঠিক আছে? সবিতার আজকাল নুনের হাতটা বড় বেড়েছে।
সুপ্রতিম যেন হোঁচট খেল একটু। কথা থামিয়েছে এতক্ষণে। মন দিয়ে খাওয়া শেষ করে উঠে গেল।
শোওয়া হল আজ রাত করে। পাপাই ফেরার পর তাকে খাবার গরম করে দিল অদিতি। জি আর ই-র রেজাল্ট নিয়ে স্বভাববিরুদ্ধ উল্লাস প্রকাশ করল পাপাই, অদিতিও হাসল। মাপা হাসি।
লেপের তলায় ঢুকে সুপ্রতিম বলল, —তোমার কী হয়েছে বলো তো?
অদিতি আলো নিবিয়ে দিয়েছে। আলগাভাবে বলল, —কিছু না তো।
—তুমি কি আমার ওপর রেগেই থাকবে ফুল? নেশার ঝোঁকে কী বলে ফেলেছি…
অদিতি বলল, —আমাকে দেখে কি মনে হয় আমি রাগ করে আছি?
—একটা ভাল খবর পেলে, দু দুটো এক্সাইটিং প্ল্যান শোনালাম, তোমার মুখে হাসি নেই কেন?
—কোন্টা তোমার এক্সাইটিং প্ল্যান? বাড়ি রঙ করা, না আমার বই ছেপে দেওয়া?
অন্ধকারে চুপ সুপ্রতিম। নীরবতায় ঘরের অন্ধকার আরও গাঢ় যেন। তলহীন। মিশমিশে।
হঠাৎ সুপ্রতিম হাত বাড়িয়ে ছুঁল অদিতিকে, —দ্যাখো ফুল, আমাদের বিয়ের পঁচিশ বছর হতে চলল, তুমিও আর কনে বউটি নেই, আমিও আর সেই নার্ভাস বর নয়, এখন কি আমাদের মধ্যে কোনও মান-অভিমান খেলা সাজে? আমরা দুজনে দুজনকে হাতের তালুর মতো চিনি, এখন কি আমাদের মধ্যে কোনও মিস্আন্ডারস্ট্যান্ডিং আসা উচিত?
অদিতি উত্তর দিল না।
সুপ্রতিম আরেকটু ঘন হয়েছে, —হ্যাঁ, ছোটখাটো ভুল বোঝাবুঝি হয়। হতেই পারে। তুমিও জানো আমি তোমাকে কতটা ভালবাসি, আমিও জানি তুমি আমাকে কতটা ভালবাসো, আমরা কেউই কারও খারাপ চাই না। চাই কি?
সুপ্রতিমের স্বরে বুঝি সংশয়! না হলে বিয়ের চব্বিশ বছর পরে এত ভালবাসি বলার আধিক্য কেন?
অদিতি বলল, —ও কথা থাক্।
—থাকবে কেন? এ-সব কথা বলা দরকার। সুপ্রতিম কাশল খুক খুক। গলা ঝেড়ে বলল, —তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারো আমি যা করি তোমার ভালর জন্যই করি। তুমি ভুল পথে গেলে আমি তোমাকে আটকাতে চাইব, আমি ভুল করলে তুমি। দীপক শর্মিলার ঝঞ্ঝাটে তুমি আমাকে থাকতে বারণ করলে, আমি সরে এলাম। তারপর দীপক শর্মিলার ডিভোর্স হয়ে গেল শর্মিলা ছেলের কাস্টডি পেল, আমি আর ওখানে মাথা গলিয়েছি? দীপককে স্ট্রেট বলে দিয়েছি, আমার বউ পছন্দ করছে না, আমি আর তোর সঙ্গে নেই। বিশ্বাস না হয় দীপকের সঙ্গে দেখা হলে তুমি জিজ্ঞেস কোরো। আমাদের এখন কত সুন্দর একটা ফ্যামিলি লাইফ, দু দুটো এবল্ ইন্টেলিজেন্ট ছেলে, একটা ওয়েলনিট্ ফ্যামিলি…ঝকঝকে ফ্ল্যাটে শ্রাবণ মাসে জমিয়ে পঁচিশ বছর সেলিব্রেট করব… আমরা এখন আমাদের মধ্যে ইনট্রুডার আসতে দেব কেন?
অদিতি অন্ধকারে হাসল। বিষণ্ণ হাসি। ঘরের শীত যেন দ্বিগুণ হয়ে গেল হাসিতে।
সুপ্রতিম জড়িয়ে ধরেছে অদিতিকে। কানের কাছে মুখ এনে বলল, —যদি রাগ না করো তো একটা কথা বলি।
—বলো।
—তোমার হেমেনমামা আজ এসেছিলেন। আমি তাঁকে খুব ভদ্রভাবে বুঝিয়ে দিয়েছি, তুমি একজন সম্মানিত মহিলা। একজন হাউসওয়াইফ। তোমার পক্ষে তাঁর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া সম্ভব নয়।
অদিতি আর স্থির থাকতে পারল না। লেপ ফেলে ছিটকে উঠে বসেছে, —কখন এসেছিল হেমেনমামা?
—সন্ধেবেলা। আগামী সপ্তাহে তোমাকে বারাসত না কোথায় নিয়ে যাবে বলছিল, আমি না বলে দিয়েছি। খারাপ ব্যবহার করিনি, খুব ভাল ভাবেই বলেছি। তাতাই সামনে ছিল, তাতাইকে জিজ্ঞেস কোরো। সুপ্রতিমের স্বরে এতটুকু জড়তা নেই, নির্দ্বিধায় বলে যাচ্ছে, —তোমার মধ্যে একটা কোয়ালিটি আছে, ভদ্রলোক সেটাকে এক্সপ্লোর করেছেন, তার জন্য আমরা গ্রেটফুল। তোমার গুণের কদর তো আমরাই করতে পারি। করেছিও তো। করিনি? পাঁচজনকে বলে বেড়াই না তোমার গুণের কথা? তা বলে ঘরদোর ফেলে অত নাচানাচি করার কী আছে? মেয়েদের একটু দূরত্ব রেখে চলাই ভাল। এতে সম্মান বাড়ে, সংসারেরও বনেদটা শক্ত থাকে। নিজে বিয়ে থা করেননি, উনি বিবাহিত মেয়েদের মানসম্মানের কথা কী বুঝবেন? তুমি তো লেখার জন্য সংসার ভাসিয়ে দিতে চাও না। নাকি চাও?
বাইরে শীতার্ত রাত। লেপ ছাড়া ঠায় বসে আছে অদিতি। ঠাণ্ডা লাগছে না তার।
সে এখন নিজেই বরফ।