১০. পরিবর্তিত হোন
একজন বড়ো মানুষ হওয়ার জন্য আপনি নিজেই নিজেকে আবিষ্কার
করুন, যা হতে আপনি এক সময় স্বপ্ন দেখেছিলেন।
.
প্রিয় বন্ধুরা, আমি দৃঢ়ভাবে অনুভব করি, আজকের দিনের কোনো তরুণেরই ভবিষ্যতের কথা ভেবে ভয় পাওয়া উচিত নয়। কেন? তরুণদের আলোকিত মন পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সম্পদ।
আমি কয়েকটি মানুষের উদাহরণ দিতে চাই, যাঁরা নিজেদেরকে পরিবর্তিত করে তাদের মনকে আলোকিত করেছেন। আমি মাদুরাই গিয়েছিলাম ২০১১ এর ৭ জানুয়ারিতে মীণাক্ষী মিশন হসপিটালের পেডিয়াট্রিক ওনকোলোজি ক্যান্সার ইউনিটের উদ্বোধন করতে।
উদ্বোধনের কাজ সমাপ্তির পর হঠাৎ করে শ্রোতাদের ভেতর থেকে একজন আমার কাছে এল। তার মুখটি আমার পরিচিত বলে মনে হলো। সে আমার কাছে এলে আমি তাকে চিনতে পারলাম। আমি ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ল্যাব (ডিআরডিএল) হায়দ্রাবাদে ১৯৮২-৯২ এ থাকাকালে সে আমার ড্রাইভার ছিল। তাঁর নাম ভি. কাথিরেসান। সে আমার সঙ্গে দিনরাত দশ বছর কাজ করেছিল। ওই সময় আমি লক্ষ করেছিলাম, সে সব সময়ই বই, খবরের কাগজ ও জার্নাল পড়ত, যখনই সে তার গাড়িতে বসে অপেক্ষা করত। পড়াশোনায় সে নিবেদিত থাকায় আমি তার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি। তাকে আমি একটি প্রশ্ন করেছিলাম। ‘কেন তুমি অবসর সময়ে পড়াশোনা করো?’ আমার প্রশ্নের উত্তরে আমাকে সে বলে যে, তার ছেলে-মেয়েরা তাকে অজস্র প্রশ্ন করে থাকে। উত্তর জানা না থাকায় সে সব সময় তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। তাই সে সময় পেলেই বই পড়ে যাতে সে তাদের প্রশ্নের জবার দিতে পারে।
শেখার প্রতি তার উদ্যম দেখে আমি অভিভূত হই। আমি তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে দূর শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে পড়াশোনা করার কথা বলি। ওই কোর্সের অংশ গ্রহণ করার জন্য আমি তাকে ছুটি পাওয়ার ব্যবস্থা করি। এই কোর্স সমাপ্ত করার পর সে হায়ার এডুকেশনে অংশ গ্রহণ করতে পারবে। সে আমার উপদেশকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে গ্রহণ করে পড়াশোনা চালিয়ে যায়। সে পড়াশোনা করে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। সে ইতিহাসে বি.এ. ডিগ্রি লাভ করে। তারপর সে ইতিহাস ও রাষ্ট্র বিজ্ঞানে এম.এ. পাস করার পর বিএড. ও এমএড. ডিগ্রি অর্জন করে। ১৯৯২ পর্যন্ত সে আমার কাজ করেছিল। এক সময় ডক্টরাল স্টাডিসের জন্য সে তার নাম নিবন্ধন করে এবং ২০০১ এ পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করে। সে তারপর তামিলনাড়ু সরকারের শিক্ষা বিভাগে যোগদান করে এবং সে সেখানে কয়েক বছর কর্মরত থাকে। ২০১০ এ মাদুরাইয়ের নিকবর্তী মেলুরে অবস্থিত গভর্নমেন্ট আর্টস কলেজে সহকারি প্রফেসর হয়।
কোভিলপাত্তির ইউপিএমএস স্কুলের ছাত্রদের কাছে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমি যখন আমন্ত্রিত হয়ে গেলাম, তখন প্রফেসর কাথিরেসানকে ডায়াসে বসে থাকতে দেখে আমি তাকে কাছে ডেকে এনে সমবেতজনদের কাছে তার পরিচয় করিয়ে দেই। আমি তাদের বলি একই শহরের স্থানীয় একজন মানুষ কীভাবে নিজেকে পরিবর্তিত করেছে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করে। দু’দশক কঠিন পরিশ্রমের পর সে এখন একটি কলেজে শিক্ষাদান করছে। এই ঘটনার কথা আমার মুখ থেকে শুনে তরুণ শ্রোতৃমণ্ডলী আনন্দে উল্লাস করে ওঠে।
বন্ধুরা, একটি দৃশ্য আমার দৃষ্টিগোচর হয়। স্কুলটিতে ৫০ জন শিক্ষক ও ৭৫০ জন ছাত্র। এটা একটি সত্য সুন্দর ও সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ জায়গা, যেখানে সৃজনশীলতার মাধ্যমে শিক্ষাদীক্ষাকে লালন করা হয়। এটা কীভাবে সম্ভব? এটা সম্ভব হয়েছে স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি শিক্ষাদান করতে ভালোবাসে ও ছাত্রদেরকে তাদের নিজের সন্তানসন্ততি বা গ্রান্ড চিলড্রেন হিসাবে মনে করে বলে শিক্ষায় নিবেদিত প্রিন্সিপাল ও শিক্ষকদের নিয়োগ দান করেছে। সুচারুভাবে শিক্ষাদানের জন্যই স্কুলের ছেলে- মেয়েরা শিক্ষকদেরকে শুধুমাত্র রোল মডেল হিসাবেই ভাবে না, শিক্ষকদের জীবনাচারকে তারা অনুসরণ করে।
আমি সেখানে লক্ষ করি, স্কুলটিতে ভালো ছাত্র, মধ্যম ছাত্র কিংবা গরিব ছাত্র বলে কেউ নেই। স্কুলটির শিক্ষাদান পদ্ধতির উদ্দেশ্য ছাত্রদের মঙ্গল করা। ছাত্ররা ক্লাসের ভেতরে ও বাইরে শিক্ষকদেরকে অনুসরণ করে। উত্তম শিক্ষকরা ছাত্রদের সঙ্গে সব সময় সম্পৃক্ত থাকেন। ছাত্ররা তাদের কাছ থেকে জ্ঞানের উত্তাপ পায়। শিক্ষকদের জীবনের শুদ্ধতা ছাত্রদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়।
একটি শিশু এক সময় বয়ঃসন্ধিক্ষণে পৌঁছে, তারপর এক সময় পূর্ণবয়স্ক হয়। ধীরে ধীরে তার জীবনে নানা ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়। শিক্ষা সমাপ্তির পর সে ভাবে কী করব। সে কি একটি চাকরি পাবে?
শিক্ষক ও পিতামাতারা খুশি হন ও তাঁদের মুখে হাসি ফোটে যখন ছেলে-মেয়েরা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষা ভালোভাবে শেষ করতে পারে। ছাত্রটি আস্থা অনুভব করে এটা ভেবে যে, ‘আমি এটা করতে পারব।’ ছেলে হোক কিংবা মেয়ে হোক, তাদের আত্মবিশ্বাসী হতে হয় চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা অর্জনের উদ্দেশে। একজন ভালো শিক্ষকই শুধুমাত্র ছাত্রছাত্রীদেরকে লালনপালন করতে পারেন তাদেরকে পরিবর্তিত হওয়ার উদ্দেশে।
আমি সব সময়ই ক্লাসে গিয়ে বসতে পছন্দ করে থাকি। ভারত ও বিদেশের কোনো স্কুল ও কলেজ পরিদর্শনকালে আমি দেখতে পছন্দ করি শিক্ষকরা কীভাবে ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদেরকে শিক্ষা দিচ্ছেন ও মত বিনিময় করছেন। সম্প্রতি আমি অন্ধ্র প্রদেশের একটি স্কুলের একটি ক্লাসে গিয়েছিলাম। স্কুলটিতে পঞ্চম গ্রেড পর্যন্ত ক্লাস ছিল। আমি ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষাদানরত শিক্ষকের সঙ্গে সময় কাটিয়েছিলাম ছেলে-মেয়েরা খুব সুখী ছিল! শিক্ষকটি তরুণ শিক্ষার্থীদেরকে বলছিলেন, “প্রিয় ছেলে-মেয়েরা, তোমরা পূর্ণিমার আকাশ দেখেছ। আকাশের সুন্দর দৃশ্যে হাসি আর আনন্দ লেগে আছে। তোমরা মনে রেখ, তোমাদের মুখের হাসিতে তোমাদের পরিবারেও হাসি ফোটে। তোমাদের কতজন তোমাদের পিতামাতাকে সুখী করতে পার?’ ক্লাসের সব ছেলে-মেয়েরা তাদের হাত তুলে বলেছিল যে তারা পিতামাতাকে সুখী করে। আমিও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আমার হাত তুলেছিলাম।
আমি আর একটি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলাম অন্য একটি সফরকালে। আমি দুবাইতে একটি ভারতীয় স্কুল উদ্বোধন করি। উদ্বোধন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিলগ্নে আমি স্কুলের এক স্থান থেকে আর এক স্থান ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। আমি ক্লাসরুমগুলোও পরিদর্শন করলাম। সেখানে ক্লাস ফাইভ ও ক্লাস সিক্স এ পাঠদান করা হচ্ছিল। শিক্ষিকাটি আমাকে দেখামাত্র তিনি আমাকে একটি ক্লাস নিতে বললেন। তাই আমি ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করলাম। ক্লাসের লেসনের পরিবর্তে আমি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আমাদের সূর্যের কয়টি গ্রহ আছে? অনেক হাত উঠল। একজন মেয়ে বলল, ‘নয়টি গ্রহ আছে।’ কয়েকটি ছাত্র বলল যে আটটি গ্রহ আছে। আমি বললাম যে, সঠিক উত্তর হচ্ছে আটটি। প্লুটোকে গ্রহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ায় এখন আটটিই গ্রহ হিসাবে বিবেচিত হয়। পুটোকে এই তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার কারণ, পুটো আকার, ওজন, ও কক্ষপথের গতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই পুটো গ্রহ নয়। তারপর আমি তাদের জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বলতো দেখি, আমাদের গ্রহ কোনটি?’ তারা সমবেত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘পৃথিবী।’ তারপর আমি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম,’পৃথিবী সম্বন্ধে কে কী বলতে পারবে?’ ষষ্ঠ শ্রেণির একজন ছাত্র উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমাদের পৃথিবী আপন অক্ষের উপর ঘোরে,’ অনেক ছাত্রছাত্রী বলল, ‘আপন অক্ষে একবার ঘুরতে পৃথিবীর ২৪ ঘণ্টা লাগে, তার ফলেই দিনরাত হয়।’ সৌরজগৎ সম্বন্ধে ছোট্ট বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের জ্ঞান দেখে আমি বিস্মিত হলাম। তারপর আমি ক্লাসকে প্রশ্ন করলাম যে, পৃথিবী কী করে। ক্লাসে পিনপতনের শব্দ নেই। তারপর এক সময় পঞ্চম শ্রেণির একজন ছাত্র বলল, ‘পৃথিবী কক্ষপথে সূর্যের চারপাশে ঘোরে। ‘কক্ষপথে একবার ঘুরতে কত সময় লাগে?’ অনেক ছাত্রছাত্রী হাত তুলল। তারা বলল যে ৩৬৫ দিন। আমাদের সূর্য কোন্ গ্যালাক্সিতে অবস্থিত? শুধুমাত্র একজন উত্তরে বলল, ‘মিল্কিওয়েতে।’ ‘আমাদের গ্যালাক্সির কক্ষপথে সূর্যের পরিক্রমণ করতে কত সময় লাগে?’ আমি আবার প্রশ্ন করলাম। তাদের কাছ থেকে কোনো জবাব এল না। অবশ্য এ প্রশ্নের উত্তর কঠিন। আমি নিজেই উত্তরে বললাম, কোটি বছর।’ একথা শুনে ছাত্রছাত্রীরা অবাক হলো। আমি ক্লাস পরিদর্শন করে অভিভূত হলাম। আমি তাদেরকে অভিনন্দন জানিয়ে ওখান থেকে প্রস্থান করলাম।
আমি আপনাদের এই উদাহরণটা দিলাম এটা ব্যাখ্যা করার উদ্দেশে যে, ছাত্রছাত্রীরা নিজের আস্থা গড়ে তুলবার জন্য কতটা উৎসাহী। আমি নিশ্চিত, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে দৃঢ় প্রত্যয় ও আগ্রহ গড়ে তোলার জন্য শিক্ষকরা কতিপয় পদ্ধতি অবলম্বন করে ক্লাসকে গতিশীল ও সৃজনশীল করতে পারেন।
(২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ এ ভিলা নাজরেথ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল অ্যান্ড আদার্স স্কুল, আয্যানন্দ থিরুভানানথাপুরম এবং ২০ মার্চ ২০১৫ এ সিআরপিএফ পাবলিক স্কুল, হাকিমপেট, তেলেঙ্গানায় ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মতবিনিময় ও ভাষণ থেকে।)