পরদিন রমজান আলী ফিরে এল। গায়ে জ্বর। সারা শরীরে ব্যথা। মারের চোটে কাহিল হয়ে পড়েছে বেচারা। বিছানা থেকে উঠতে পারে না। বুড়ি দেখতে গিয়েছিল। ওকে দেখে রমজান আলী কিছু বলেনি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল। বুড়ি অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। রমজান আলীর বৌ গায়ে তেল মালিশ করে দেয়। ও উঠে যেতেই বুড়ি কাছে আসে।
–রমজান ভাই কষ্টটা মনে না গায়ে?
–গায়ে।
রমজান আলী স্থির কণ্ঠে বলে।
–ওরা একটা ভাল কাজে গেছে রমজান ভাই।
–সে আমি জানি।
–ওদের তুমি দোয়া করো। এতক্ষণে রমজান আলী সামান্য হাসে।
–রইসের মা কলীম গেছে তবু তুমি ভাঙনি।
বুড়ি কথা না বাড়িয়ে নিঃশব্দে সরে আসে। কাদের আর হাফিজ চলে যাওয়ার দরুন রমজান আলী মার খেয়েছে। এজন্যে ওর মনে কোন কষ্ট নেই দেখে বুড়ি আশ্বস্ত হয়। এটুকুই চেয়েছিল। যত কষ্টই হোক সইতে হবে। ওদের যাওয়ার পথ খুলে রাখতে হবে। সেটা বন্ধ হতে দেয়া যাবে না।
গোয়াল থেকে গরু বের করে এনে বুড়ি বাঁশবনে এসে বসে। অনেকদিন পর আজ গরুটা ছেড়ে দেয়। একটু উঁচুকণ্ঠেই বলে, তুই আজ তোর খুশি মত চরে বেড়া। তোকে আজ বাঁধবো না। বুড়ি লটকন গাছের গুঁড়িতে হেলান দেয়। রমজান আলীকে মনে মনে শ্রদ্ধা জানায়। মার খেয়েছে তবু বলেনি যে ওরা কোথায় গেছে। শুধু ওরা দুজন অক্ষম মা ছেলে হলদী গাঁ-র জন্যে কিছু করতে পারছে না। গোটা গাঁ জুড়ে তোলপাড় হয়ে বয়ে যায় ঘটনা। কত নিত্যনতুন খবর আসে। খবর আসে যুদ্ধের। ছেলেদের কৃতিত্বের! খবর আসে দানব হত্যার। কখনো কোন প্রিয় মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর। শব্দ আসে মেশিনগানের ব্রাশফায়ারের। প্রচণ্ড শব্দে ফেটে যাওয়া ডিনামাইটের, বোমার। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ছেলেদের হাতের রাইফেল হয়ে যেতে, ডিনামাইট হয়ে যেতে, বোমা হয়ে যেতে। ঐ রকম প্রচণ্ড শব্দে ফেটে গিয়ে যদি একটা পুল উড়িয়ে দিতে পারতো? পারতো যদি মিলিটারি ক্যাম্প ধ্বংস করে দিতে? অসংখ্য মৃত সৈনিকের বুকের ওপর দিয়ে ঝোড়ো হাওয়ার মত বয়ে যেতে? মাঝে মাঝে মনে হয় যে একটা মেশিনগান হয়ে গেছে। ছেলেদের কাঁধে সওয়ার হয়ে কখনো ছুটে যাচ্ছে। কখনো পিঠের ওপর চড়ে বুকে-হাঁটা ছেলেদের সঙ্গী হয়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে। যাচ্ছে। রাতের অন্ধকারে পাট ক্ষেতে শুয়ে পঁচিশ বছরের দুর্দান্ত ছেলেটির স্বাধীনতার স্বপ্ন হয়ে গেছে। বুড়ির ইচ্ছে করে সেই যৌবন ফিরে পেতে। সেই আশ্চর্য যৌবন যা নিয়ে আকাঙ্ক্ষার বস্তুকে নাগালে পাওয়ার জন্যে দুর্বিনীত হওয়া যায়। মাঝে মাঝে শিরশির করে উঠে বুড়ির অনুভূতি। কে যেন ওর গা ছুঁয়ে ভয়ানক শপথ করছে। কারা যেন বুড়ির বুকের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। আর তখনই নাড়িতে গেঁথে থাকা কষ্ট মোচড় দিয়ে ওঠে। গরুটা নিজের কাছে ফিরে পাবার জন্যে ব্যাকুল হয়। ও দ্রুত চলতে গিয়ে বাঁশের মুথায় হোঁচট খায়। বুড়ো আঙ্গুলের নখ উল্টে যায়। রক্তাক্ত পা চেপে বুড়ি বসে পড়ে। হাতের কাছে শিয়ালমুথার পাতা ছিল। চিবিয়ে লাগিয়ে দেয়। ব্যাথায় টনটন করে। পা টেনে উঠে দাঁড়ায় বুড়ি। গরুটা কাছেই ছিল, বেশিদূর যায়নি। দড়িটা হাতের মুঠোয় ধরে ঘরে ফিরে আসে। কোনরকমে ওটাকে সজনে গাছের সঙ্গে বেঁধে বারান্দায় চাটাইয়ের ওপর শুয়ে পড়ে।
মাথা কেমন জানি করছে। ব্যথা বাড়তেই থাকে। হঠাৎ মনে হয় কষ্টটা ওর ভালই লাগছে। উপলব্ধি করলো কখনো নিজের শরীরের ব্যথা যন্ত্রণার বদলে আনন্দ হয়। নইলে তরুণ টগবগে ছেলেগুলো গুলী খেয়েও হাসিমুখে মরতে পারতো না। ওদের বুকের সুখভরা পদ্মদীঘি স্বাধীনতার থৈ-থৈ জলে উথাল হয়। বুড়ি রইসের দিকে তাকায়। ও আপন মনে হাসছে। রইস ওদের কারো মত নয়। ওর বুকে স্বাধীনতার পদ্মদিঘী নেই। পদ্মের গন্ধে মাতাল হয়ে ও নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে দুর্দমনীয় রোষে ছুটে যায় না। ওর মুখের দিকে চেয়ে বুড়িকে এক অপরাধবোধে পেয়ে বসে। মনে হয় হলদী গাঁ ওদের চায় না। ওরা হলদী, গাঁ-র জন্যে কিছুই করতে পারছে না, ওরা মা ছেলে কেবল খায় আর ঘুমোয়। আর কোন কাজ নেই। হলদী গাঁ-র জন্যে ওদের যত ভালবাসাই থাকুক না কেন সব অর্থহীন। কলীম মরে গেছে, সলীম যুদ্ধ করছে। বুড়ির মনে হয় এটুকুই যথেষ্ট নয়। কিছু করা দরকার। আরো বড় কিছু। অনেক বড় ত্যাগ। ঐ যুদ্ধরত ছেলেগুলোর মত প্রাণের মায়া তুচ্ছ করা ত্যাগ। নিঃস্বার্থভাবে ছুটে গিয়ে বুক পেতে দেয়া। ঘুরে ফিরে আবার ভাবনা এসে আক্রমণ করে। হলদী গাঁ বুঝি ঘৃণা করছে। অকেজো, অকর্মণ্য বলে ঘৃণা। ঐ বাঁশবন, খালের ধার, শিমুলতলা, স্টেশনের। রাস্তা সবখান থেকে ঘৃণার ধুলো উড়ছে। সমস্ত শরীর ধুলোয় ধূসরিত। বিশ্রী নোংরা। চারদিকে। বুড়ির শরীর কেমন করে। নখের ব্যথা ভুলে গিয়ে উঠে বসে। রইস উঠোনে নেমে গেছে, বাঘার পাশে বসে ওর লেজ নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।
খবর আসে অনেক। যুদ্ধ জোর বাড়তে থাকে। রমজান আলীর ঘরে বসে কখনো চুপি চুপি স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান শোনে ওরা। বুক ভরে ওঠে গর্বে, আনন্দে। রমজান আলী চরম পত্র শোনার জন্যে উন্মুখ থাকে। বুড়ি সব কথা বুঝতে পারে না। তবু শুনতে ভাল লাগে। কি যেন যাদু আছে ঐসব কথায়। ইদানীং দিনের বেলাও গুলি গোলার শব্দ ভেসে আসে। একে দুয়ে গায়ের অনেক ছেলে চলে গেছে। মনসুরের মত শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের ভয়ে ওরা মুখে বুড়ো আঙ্গুল পুরে চুপ করে বসে থাকেনি। মনসুরের মত লোকদের বুকের জ্বালা বাড়িয়েছে। বুড়ির মনে হয় মনসুররা আর কয়জন? ওদের সংখ্যা হাতে গোনা যায়। কিন্তু সলীমরা অনেক। সলীম একটি ছেলেকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে। ও ভাল আছে। মাকে নির্ভাবনায় থাকতে বলেছে। মায়ের কাছে অনেক ভালবাসা জানিয়েছে। আরো বলেছে, একদিন ও স্বাধীন দেশের ছেলে হয়ে মার সামনে এসে দাঁড়াবে। বুড়ির চোখে পানি আসে। আনন্দ হয়। সলীম যুদ্ধ করছে। এমন ছেলেই তো চেয়েছিল। অহংকারে মাথা উঁচু করে বিজয়ীর বেশে যে এসে দাঁড়াবে ওর সামনে। শুধু কলীমের নিরুপায় মৃত্যু ভুলতে পারে না। ও কোন সুযোগ পায়নি। সুযোগ পেলে প্রতিশোধ নিয়ে মরতো। তবু নাড়িতে গেঁথে থাকা কষ্ট এখন আর তেমন কাদায় না। সাহস ভেঙে দেয় না। বুড়ির মনে জোর ফিরে আসে।
মাঝে মাঝে গুলির শব্দে বুড়ির অসহ্য নীরবতা চনমনে ভরপুর হয়ে ওঠে। জল ছুপছুপ নদীর মত মনে হয় নিজেকে। যে নদী কানায় কানায় ভরা। যে নদীর মাঝে কোন চর পড়েনি। বাঁশবনের মাথার উপর দিয়ে সাদা বক উড়ে যায়। শরতের আকাশ উজ্জ্বল নীল। বুড়ি খালের ধারে যায়। খালপাড়ের সাদা কাশফুল দেখে। কাশফুল তুলোর মত ধবধবে নয়। ওর মধ্যে অন্য রঙের আভা আছে। মনে হয় তুলোই ভালো। শিমুলের ডালে কিচির-মিচির করে চড়ইয়ের ঝাঁক। কখনো খাকী পোশাক-পরা লোকগুলো রাইফেল কাঁধে ঘুরে বেড়ায়। বুড়ির আর ভয় করে না। ওরাও ওকে কিছু বলে না। বুড়ি ভাবে, ওরা ওকে আমল দেয় না। ওদের শত্রুর মধ্যেই গণ্য করে না। বুড়ি ডিমার শাক খুটতে খুঁটতে হাসে। ওরা বুঝতে পারে না বুড়ি বুকের মধ্যে কি বিরাট এক আগুনের পিণ্ড সাজিয়ে রেখেছে। মুহূর্তে ওটা দপ করে জ্বলে উঠতে পারে। ভিনদেশী দানবগুলো কখনো দেখেনি যে শুকনো বাঁশপাতা কেমন দাউ দাউ করে জ্বলতে পারে। নদীনালা খাল-বিল জলাভূমির দেশ হলেও এর চরিত্রে পাথুরে কাঠিন্য আছে। মানুষগুলো কেবল স্যাঁতসেঁতে জলাশয় নয়। সেখানে আগুনের সঙ্গে একটা সহজাত সম্পর্ক আছে।
আজকাল কেবলই ইচ্ছে করে রমিজার মাছ-কাটা বঁটিটা দিয়ে সব কচুকাটা করে ফেলতে। তখন অনেক রক্তের কথা মনে হয়। রমিজার মাছ-কাটা বঁটির গা বেয়ে তাজা ফটফটে মাছের রক্তের স্রোত নামে। কলীমের রক্তের রেখা মাটির বুকে শুষে যায়। মার-খাওয়া রমজান আলীর পিঠে রক্তের দাগ শুকিয়ে কালো হয়ে থাকে। জবাই করা কবুতরটা বুড়ির উঠোনে লাফায়। ওর পায়ের আঙুল উপড়ে গিয়ে রক্ত ছুটতে থাকে। বুড়ির মনে হয় কোন ঘটনাই বিচ্ছিন্ন নয়।
হলদী গাঁ-র শরৎ এবার অন্য রকম। ওর মনের রঙের মত বদলে গেছে ঋতু। ভরদুপুর ঝিমায় না। পড়ন্ত বিকেল ক্লান্ত না। রাতের আঁধার বারুদের গন্ধের মৌতাতে মাতাল। হলদী গাঁ-র নিশুতি রাত কবে ফুরিয়ে গেছে। ঝি ঝি ডাকা, জোনাক-জ্বলা রাতগুলো এখন ফুটফাট ফাটে। তপ্ত কড়াইয়ে খই ফোটার মত ফেটে ছিটকে ওঠে। রাতের হদিস খুঁজতে খুঁজতে বুড়ির চোখ এখন উৎসবহীন জেগে থাকে না। মনে হয় রাতগুলো এখন পাখা মেলে উড়ে যায়। শুধু আঁধারে নিঃশেষ হয় না। ওর জন্যে এক টুকরো সলতের আলো জ্বেলে রাখে। সে আলোর রেখা ধরে ও হলদী গাঁয়ের সীমানা পেরিয়ে যায়। অনেকের সঙ্গে মিলেমিশে যেতে পরে। যন্ত্রণা পাশে রেখে বুকের পদ্মদীঘি ভেসে ওঠে।
বুড়ির খোপের মোরগগুলো যেন এখন অন্যস্বরে ভোরের কথা ঘোষণা করে। ও বিছানায় শুয়ে শোনে। রইসের গায়ে কাঁথা টেনে দেয়। ওর জন্যে বুকের ভেতর মমতা উথলে উঠে। এখন রইস বুড়ির অনেক কাছের। রক্তের মধ্যে রইসের উত্তাপ। প্রতি রোমকূপে রইসের নিঃশ্বাস। ওর মুখ থেকে ঝরে পড়া লালা বুড়ির চেতনার গ্রন্থি নিবিড় করে। অনেক দূরে ফেটে-পড়া পুলের শব্দ ওর হৃদয়ে জেগে থাকে। বুড়ি বোঝে না কেন ছেলেটা এমন করে টানছে! ওকে যত্ন করতে ভাল লাগে। গোসল শেষে চুল আঁচড়ে দিতে ভাল লাগে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ভাত খাওয়া দেখতে ভাল লাগে। হাঁ করে ঘুমিয়ে থাকা চেহারাটা বুড়ির চোখে অপরূপ। রইস যেন নতুন করে আবার বুড়ির কোলে ফিরে এসেছে। ওর শৈশবের দিনগুলোয় বিস্ময়, আনন্দ, উচ্ছ্বাস, নতুন মাতৃত্বের স্বাদ যেমন বুড়িকে মাতিয়ে রাখতো এখনো ঠিক তেমন লাগে। রইসও বুড়িকে তেমন করে আঁকড়ে ধরেছে। ও প্রায়ই রইসকে সঙ্গে নিয়ে বের হয়। ও, সঙ্গে থাকলে বুড়ির অনুভূতি পাল্টে যায়। মনে হয় আছে, আমারও কেউ আছে। এমনি একটা বোধ ওকে ঘিরে থাকে। ও অসহায় হয় না কিংবা দারুণ একাকিত্ব বিমর্ষ করে রাখে না। খাকি পোশাক পরা লোকগুলোর সৈনিক চেহারা মুছে যায়। বুড়ির হলদী গাঁ তার নিজস্ব চেহারায় ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। যেন এখানে কোন ভিনদেশীর আক্রমণ নেই, মৃত্যু নেই, রক্ত নেই, কান্না নেই। বুড়ির বুক চেপে আসে। আসলে তা নয়, শরতের হলদী গাঁ আশ্বিনের শিশির গায়ে মেখে দুপুর রাতের ছেলেগুলোর স্বপ্ন হয়ে যায়। বুড়িও সে স্বপ্নের অংশীদার।
কখনো কখনো বুড়ি রইসের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে।
–ও রইস, রইস তোর খুব কষ্ট না রে? তোর বুকে অনেক কথা, মুখে নেই ! তুই কথা বলতে পারিস না। আমারও অনেক কষ্ট, আমি যুদ্ধ করতে পারি না।
বোবা রইস হাঁ করে মার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
–কি দেখছিস কি? কথা বলার জন্যে বুকটা ফেটে যাচ্ছে তো? হ্যাঁ, আমারও এমনি হয়। কাউকে কিছু বোঝাতে পারি না। তুই যেমন আমিও তেমন। আমিও তোর মত হাবা বোবা অকেজো। হলদী গার জন্যে কিছু করতে পারলাম না।
রইস গোঁ গোঁ শব্দ করে। মার হাত ধরে টানাটানি করে। পথে পথে দাঁড়াতে ওর ভাললাগে না। বাড়ি যাবার জন্যে তাগাদা দেয়। বুড়ি শিমুলতলা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। পথ-ঘাট শুকনো খটখটে। বাতাসে হিম হিম ভাব। কার্তিকের শুরু হয়েছে। শিমের মাচায় বেগুনি ফুল ঝঝ করে। রইস একটা কঞ্চি দিয়ে ঘাস লতাপাতা খোচাতে খোচাতে পথ চলে। হঠাৎ করে বয়ে যাওয়া উত্তুরে বাতাসের দিকে মুখ করে দাঁড়ায় বুড়ি। বাতাসটা গায়ে মেখে নিয়ে বলে, শীত আসছে রে রইস। শীতের রাতে ছেলেগুলোর বড় কষ্ট হবে। কেমন করে যে কি করবে ভেবে পাই না।
রইস বুড়িকে ছেড়ে অনেকটা এগিয়ে যায়। ও বাড়ির কাছাকাছি চলে গেছে। বুড়ি দাঁড়িয়ে শিমের বেগুনি ফুল দেখে। মাচার ওপর ফিঙে ঝোলে। ক্ষেতে লাল শাকও হয়েছে প্রচুর। ওর মন কেমন করে। কলীম লাল শাক খুব পছন্দ করত। রইস হওয়ার। আগে কলীম ওর সঙ্গী ছিল। বুড়ির হাত ধরে লাল শাক তুলতে যেত, বুড়ির সঙ্গে মারবেল খেলত। বড় হওয়ার পর বুড়ি খলুই জাল গুছিয়ে না দিলে মাছ ধরতে যেত না। বুড়ি তাড়াতাড়ি হেঁটে ঘরে চলে আসে। ভাত রাঁধতে হবে। রইসের ক্ষিধে পেয়েছে। আজ হাড়িতে পান্তাও নেই। বারান্দার ওপর ধপ করে বসে পড়ে। চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা হয়ে যায়। পানি চিচিক্ করে চোখের কিনারে। জল থৈ-থৈ নদী এখন চোখ দুটো, নদীর তীরে কাশবন। কাশবনে সাদা বক। সাদা বকের ধবধবে পালক। বুড়ির মন এখন সাদা বকের ধবধবে পালক।
রমিজা খবর পাঠিয়েছে। ওরা ভাল আছে। ছেলেটা খুব হাশিখুশি হয়েছে। কান্নাকাটি নেই। সারাদিন ধুলোয় খেলে। কথা বলার চেষ্টা করে। রমিজা অনেক পিঠে দিয়েছে বুড়ির জন্যে। মাছ পাঠিয়েছে, ডিম পাঠিয়েছে। কিন্তু পিঠে কে খাবে? পিঠে পাগল সলীম তো আর নেই। প্রতিদিন এক একরকম পিঠে তৈরি হত সলীমের জন্যে। পিঠে না হলে ও রমিজাকে বকাবকি করত। বুড়িকেও ছাড়ত না। সলীম এখন যুদ্ধ করছে। পিঠে খাওয়ার কথা এখন আর ওর মনে নেই। বিরাট সুখের প্রত্যাশায় ওরা। ছোটখাটো সব সুখের কথা ভুলে গেছে। বুড়ির মনে হল রমিজা কি সলীমকে মনে করে এত পিঠে পাঠিয়েছে? বেচারী! কোন খবরই পাচ্ছে না সলীমের। ও হয়ত ভাবছে, কোনদিন রাতের অন্ধকারে সলীম যদি চুপিচুপি ঘরে ফেরে? এখানে থাকতে রমিজা এই প্রত্যাশা করতো। এখানে থাকলে তবু ওর ভাল হতো। না হয়ত খুব ভাল হত না। কিইবা ভাল হতো। এখানে ঐ লালমুখো সৈনিকগুলো যেমন উৎপাত করে! কত লোক সরে গেল উত্তর থেকে দক্ষিণে। দক্ষিণের প্রত্যন্ত সীমানায়। বুড়ির বাড়ি থেকে সিকি মাইলের মধ্যে মিলিটারি ক্যাম্প। ওরা যখন যা খুশি তা করে। হুটপুট করে এসে হাঁস মুরগি-গরু-ছাগল যেমন নিয়ে যায়, তেমন ডবকা মেয়েরাও যায় রশি বেঁধে টেনে নেয়া ছাগলের মত চেঁচাতে চেঁচাতে। বুড়ি এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দেয় যে রমিজা দূরে আছে ভালই আছে। কলীমের মৃত্যু সহ্য হয়েছে। কিন্তু চোখের সামনে রমিজার কোন দুর্ঘটনা সইবে না। ও ভাল থাকুক। ভাল।
কার্তিকের হিম হিম ভাব আর নেই। ফিনফিনে নীল কুয়াশা গাঢ় হয়েছে। অঘ্রাণের শেষ। আর দুএকদিন বাকি। জোর শীতের দাপট চারদিকে। মাচানের ওপরের ঝাঁকঝাঁক বেগুনি ফুল সবুজ শিম হয়ে গেছে। মাছরাঙার শরীর চর্চ করে। টুনটুনি উড়ে বেড়ায়। দেখতে ভাল লাগে। দেখতে দেখতে মনে হয় সবসময় শীতকালে রইসের শরীর ভাল হয়। এবারও বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে। মুখটা ভরা পুকুরের মত টলটলে। টানা বড় বড় চোখ জোড়া লাল শাপলার পাপড়ির মত। ও বেশ ছটফটে হয়েছে। ঝিম-ধরা ভাব নেই। ওকে দেখে বুড়ির দিন মুখর হয়ে ওঠে। বুকের দীঘি থৈ থৈ আনন্দে বেসামাল হয়। ওর পরিবর্তন মনে করিয়ে দেয় যে ওর মধ্যেও একটা মুখর প্রাণ আছে। কিন্তু আসলে ওর কোন ভাষা নেই। শীতে ও প্রাণের জোয়ারে প্লাবিত হয়। বাহ্যিক আচরণে তা জানান দেয়। ও আরো দামাল হোক, চঞ্চল হয়ে উঠুক। বুড়ি সারাক্ষণ এই প্রার্থনা করে। রাত্রিবেলা ওর পাশে শুয়ে থেকে ওর সঙ্গে অনেক কথা বলে। কখনো নিজের জীবনের গল্প করে। রইস ঘুমিয়ে গেলেও বুড়ি বলতে থাকে। বলতে একটুও ক্লান্তি নেই। সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা অঘ্রাণের কুয়াশার মত খুশির ফিনফিনে নীল পর্দা হয়ে থাকে মনটা।
সকাল থেকে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। একদম আষাঢ়ে বৃষ্টির মত একটানা। ঘনকালো মেঘ আকাশে। চারদিক অন্ধকার করে নেমেছে। রইস উঠে পান্তা খেয়ে আবার শুয়েছে। বুড়ি ভিজে ভিজে হাঁস-মুরগির খোয়াড় খুলেছে। গোয়াল পরিষ্কার করেছে। গরুকে খড়-ভূষি দিয়েছে। আর এসব করতে করতে বুড়ির মনে অনেকদিনের পুরোনো এক গান বারবার গুনগুনিয়ে উঠছে। বুড়ির যে প্রচণ্ড শীত করছে একথা একবারও মনে হয় না। মাথার কাপড় ফেলে দিয়ে আঁচলটা নিংড়াতে নিংড়াতে বুড়ি যখন বারান্দায় উঠে আসে তখন নীতা বৈরাগিণী ঢোকে। বুড়ি বিস্ময়ে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, সই?
নীতা কথা বলে না। ভিজে শরীর নিয়ে বারান্দার ওপর উঠে আসে।
–এমন ঝড়-বাদল মাথায় করে কোথা থেকে এলি?
নীতা কথা বলে না। দুহাতে মুখ ঢাকে।
–তুই কাঁদছিস সই? ঠাণ্ডা লেগে যাবে। আগে কাপড় ছেড়ে নে?
নীতার পোটলাটা আজ ওর সঙ্গে নেই। বুড়ি ঘর থেকে শুকনো কাপড় এনে দেয়।
–নে ভিজে কাপড় ছাড় আগে, তারপর তোর সব কথা শুনব। আজ আমার মন খুশি খুশি, তোকে পেয়ে আরো ভাল লাগছে। বৃষ্টি ভরা এই দিনটা দুজনে গল্প করে কাটিয়ে দেব। কতদিন যে মন খুলে কথা বলার মানুষ পাইনি।
নীতা কাপড় ছাড়তে ছাড়তে হি হি করে কাঁপে। অনেকটা পথ ভিজতে ভিজতে এসেছে। ঠাণ্ডা ওর হাডিড়র গায়ে লেগেছে। বুড়ি মালসায় করে কয়লা ধরিয়ে আনে।
–হাত-পা গুলো সেঁকে নে সই।
–আগে আমাকে ভাত দে। দুদিন ধরে মুড়ি আর জল ছাড়া কিছুই খাইনি।
–পান্তা আছে মরিচ পুড়িয়েছি। আগুন পোহাতে পোহাতে খাবি চল।
দুজনে ভাত খায়। নীতার কিছু একটা হয়েছে বুড়ি তা বোঝে। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে পারে না। ভয় হয়। এমন কিছু হয়তো শুনবে যে বুড়ির মন ভার হয়ে যাবে। সারাটা দিন খারাপ লাগবে।
–তোর এখানে আমি দুটো দিন থাকব সই।
–কি ভাগ্যি! আগে তো মোটেও রাখতে পারিনি।
নীতার চোখ দিয়ে জল গড়ায়।
–তুই থাকলে আমার ভালই লাগবে। একা একা আর দিন কাটে না।
বুড়ি খেয়েদেয়ে চিকন সুপপারি কাটে। অনেকদিন পর ও চিকন সুপোরি কাটতে বসেছে। নীতা মালসার ওপর হাত পা গরম করে।
–বৃষ্টি তো নয় একদম হাড়-কাঁপানো সুচ।
বুড়ি অন্যমনস্কর মত বলে, তোর অখিল বাউল কৈ সই?
–মরেছে।
–কি হয়েছিল?
–বুকে গুলি খেয়েছিল।
–সই!
বুড়ি আঁৎকে ওঠে।
আমার আখড়া আর নাইরে সই, যেখানে আমি ফিরতে পারি। সব পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে।
বুড়ি স্তব্ধ হয়ে থাকে। কথা বলতে পারে না। সুপোরি কাটাও হয় না। নীতা চোখে আঁচল চাপা দিয়েছে।
–কেন যে আমাদের আখড়া পুড়িয়ে দেয়া হলো, লোকগুলোকে গুলি করা হলো, বাকিদের ধরে নিয়ে গেল তার আমি কিছুই বুঝি না সই। তবু যদি ঐ ভিনদেশী কুত্তাগুলা করতো তাও প্রাণে সইতে। করেছে সব আমাদের জাত ভায়েরা। যাদের সঙ্গে আমাদের ওঠাবসা চলাফেরা; এই লজ্জা আমি কোথায় রাখি সই? অখিল বাউল মরেছে সেই দুঃখের চাইতেও বেশি বাধে যে ওকে গুলি করেছে আলী আহমদ। কিসে যেন বুকটা কামড়ে ধরে। কারো সঙ্গে কথা কইতে পারি না। যারা এমন কাজ করলো ওদের সবাইকে আমরা চিনি। আমাদের মুখের ওপর থুতু দিয়ে বলেছিল, আমরা নাকি দেশের শত্রু। এই শুনে অখিল বাউল গর্জে উঠেছিল, মিথ্যে কথা। মাটির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। দেশের জন্যে গান লিখেছি।
গান? হো হো করে হেসে উঠেছিল ছোড়াগুলো। বিশ্বাস কর সই ন্যাংটা অবস্থা থেকে ওদের আমি বড় হতে দেখেছি। যুদ্ধ লাগার আগেও ওরা আমাদের আখড়ায় আসতো গান শুনতে। দাঁত কিড়মিড় করে বলল, গান লিখেছো বাছাধন, ঘুঘু দেখনি, এইবার দেখ, এই নাও গান লেখার পুরস্কার!
–দুম করে মেরে দিল। লুটিয়ে পড়ল অখিল বাউল আর বাকিরা। কেউ আর কথা কইতে পারলো না। আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠতেই দুঘা দিয়ে ফেলে দিল। সুষমা, মালা, চন্দনা আর রাধাকে নিয়ে গেল।
ওরা চিৎকার করছিল। শুনলো না। আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম। বুড়ো মানুষ ওদের সঙ্গে পারব কেন?
–কেবল বলতে ইচ্ছে করছিল, ওরে কতদিন রাত জেগে তোরা আমাদের গান শুনেছিস। বলেছিস, তোমাদের গানের গলা বড় মিঠে গো। বলেছিস, তোমাদের এই জায়গাটা বড্ড শীতল। মনে হয় দিনরাত শুয়ে থেকে কাটিয়ে দি। ওরে তোরা এখন বলে যা আজ কি করে আমরা দেশের শত্রু হলাম। একথা তো তোরা আগে একদিনও বলিসনি? ওরা চলে যেতে বুকটা আমার পাথর হয়ে গেল সই। সব লাশগুলো টেনে টেনে নদীতে ভাসিয়ে দিলাম। ঘরের আগুন তখনো নেভেনি। জ্বলছিল ধিকিধিকি। আমি গাছের নিচে দুরাত কাটালাম। তারপর তোর কথা মনে হলো। শুরু হলো বৃষ্টি। মানলাম না। বৃষ্টি মাথায় করে চলে এলাম। বড়ড শীত করছে রে সই।
–চল কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়বি।
সেই শোয়াতে পনের দিন কাটিয়ে দিল নীতা। জ্বরে গা যেন পুড়ে যায়। বুড়ি কি করবে দিশে পায় না। গাঁয়ের কবরেজ ডেকে ওষুধ দেয়। মাথায় পানি ঢালে। বেহুশ অবস্থা নীতার। যমে মানুষে টানাটানির পর পনের দিনের মাথায় জ্বর ছাড়ে। দুর্বল ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, সই আমার কি হয়েছিল?
–জ্বর।
বুড়ি হেসে ফেলে।
–হাসছিস কেন? তোর এখানে কদিন কাটালাম রে?
–এই তো দিন পনের।
–দিন পনেরো? নীতা অনেক কিছু স্মরণ করার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। মাথা আবার এলিয়ে দেয়। বুড়ি সাগু গরম করে এনে খাওয়ায় ধরে বারান্দায় বসিয়ে দেয়। নীতা হলুদ নিপ্ৰভ দৃষ্টি মেলে আকাশ দেখে। গাছ-গাছালির মাথার ওপর সূর্যের আলো দেখে। কণ্ঠে গান গুনগুনিয়ে উঠতে চায়। দমে কুলোয় না। বুড়ি এসে পাশে বসে। নীতার জন্যে ও পুকুর থেকে শিং মাছ ধরিয়েছে। থানকুনি পাতা দিয়ে তার ঝোল বেঁধেছে। আজ ওকে ভাত দেবে। বুড়ির মন বেজায় খুশি। নীতাকে ও বাঁচাতে পেরেছে।
–আজ তোকে ভাত দেব সই।
–ভাত খেতে ইচ্ছে করে না।
–ইচ্ছে না করলে কেমন হবে? গায়ে বল করতে হবে না?
–আর বল? নীতা ফিকে হাসে। আমার সব বল ওরা কেড়ে নিয়েছে।
–বাজে কথা। তুই আবার বেঁচে উঠেছিস সই। এ কটা দিন যে কেমন করে কেটেছে একমাত্র আল্লাহ জানে।
–তোর খুব কষ্ট হয়েছে না রে?
–ধুত কি যে বলিস? নীতা চুপ করে থাকে।
–আমার দোতারাটা পুড়ে গেছে। অখিলেরটা ও বুকে জড়িয়ে ধরেছিল। ছোঁড়াগুলো পায়ে মাড়িয়ে ভেঙে ফেলেছে।
নীতা যেন আপন মনেই কথা বলে।
–যারা আমাদের গান ভালবাসতো তারা আমাদের শত্রু বলে কেন? আমরা কোন অপরাধে শত্রু হলাম? আমাদের মেয়েগুলোকে নিয়ে যেতে ওদের একটুও বাধলো না! এই বুঝি ওদের দেশপ্রেম?
–তুই কেবল ওদের কথা ভাবছিস কেন সই? ওদের মত আমাদের আরো অনেক ছেলে আছে যারা যুদ্ধ করছে?
–যুদ্ধ? সই দেখিস দেশ একদিন স্বাধীন হবে।
নীতা আবেগে উত্তেজনায় বুড়ির হাত চেপে ধরে।
–তোর ছেলে যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে ফিরে আসবে। কিন্তু তখন আমি কোথায় যাব? আমার ঘর নাই, মানুষ নাই, কেউ নাই। এই হলদী গা ছেড়ে আমার কোথাও যেতে মন চায় না রে সই।
–এখন এসব কথা থাক। তুই আগে সুস্থ হয়ে নে।
–তোর ছেলে ফিরে এলে ওকে বলবি গাঁয়ের মাথায় আমাকে একটা চালা তুলে দিতে। যে কটা দিন বাচি ভিক্ষে করে দিন কাটিয়ে দেব। এই গা ছেড়ে অন্য আখড়ায় আমি যাব না রে সই।
নীতা হু হু করে কেঁদে ফেলে।
–এখন তুই আমার কাছে থাকবি। আমি একলা একলা থাকি তোকে পেয়ে আমার কি যে ভরসা হচ্ছে। তোকে আমি ছাড়ছি না।
–শরীরের যা অবস্থা! হাঁটতেই তো পারি না। যাব আর কোন চুলোয়।
নীতা অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলে।
–যাই তোর ভাত নিয়ে আসি।
বুড়ি নীতার কান্না দেখতে চায় না। ওর সামনে থেকে উঠে পড়ে। নীতা জ্বরের ঘোরে বলতো, আমরা পথঘাটের মানুষ। ঘরের মায়া নেই। তবু বুকটা এমন হু হু করে পোড়ে কেন বলতো সই? শান্তি কমিটির নামে ওরা কত জাত ভায়েদের মারলো, ঘর পোড়ালো, মা বোনের সম্ভ্রম নিলো–ওরা এই মাটির শত্রু নয়, হলাম আমরা।
বুড়ি ভাত বাড়তে গিয়ে থমকে যায়। নীতার সব গেছে তাতে ওর দুঃখ নেই। ওর বুক খা হয়ে যাচ্ছে আলী আহমদের ঐ একটা কথায়। ঐ কথায় ওর সারা জীবনের ভিত নড়ে উঠেছে। অথচ দুঃখ নেই আলী আহমদের। ওরা নির্বিবাদে দেশের শত্রুর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। রইস এসে রান্নাঘরে ঢোকে। ইশারায় ক্ষিধের কথা বলে। বুড়ি তাড়াতাড়ি কাঠের চামচ দিয়ে ভাত ওঠায়।
নীতা এখন একদম ঘর থেকে বের হয় না। একদিকে ভয় অন্যদিকে শারীরিক দুর্বলতা। গুলি, মৃত্যু, আগুন নীতার সব সাহস ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ওর কণ্ঠের গান এখন বুড়ির ঘরের দেয়াল পেরোয় না। মুখে হাসি নেই। নীতা স্থবির হয়ে গেছে।
–তুই এমন ভেঙে পড়লি কেন সই?
–এত মৃত্যু আমি কখন দেখিনি রে। নীতা আনমনা হয়ে বলে।
–আমিও কি দেখেছিলাম।
বুড়ির কণ্ঠও খাদে নেমে যায়। তবু ওর সঙ্গেই দুচারটে কথা বলে বুড়ির সময় ভালই কাটে। মনসুর একদিন বাঁশবাগানে বুড়ির পথ আগলে দাঁড়ায়, কি গো রইসের মা বৈরাগিণীটা নাকি তোমার এখানে এসে জুটেছে?
–জুটলো কৈ? একা একা থাকি তো তাই আমিই কটা দিন রেখে দিলাম। ও তো রোজই চলে যেতে চায়। বুড়ো মানুষ আমারই বা ভরসা কি বল?
–না বাপু ওকে তাড়াতাড়ি বিদায় কর নইলে তোমারই আবার বিপদ হবে।
বুড়ি হি হি করে হেসে ওঠে।
–বিপদের আর বাকী কি? সংসার আমার মানুষ-শূন্য হয়ে গেল। উড়ো খবর পাই সলীমও নাকি যুদ্ধে মরেছে।
–তাই নাকি?
মনসুর লাফ দিয়ে বুড়ির কাছে সরে আসে।
–তা খবরটা কার কাছে পেলে।
–এ ও বলে। বুড়ি চোখে আঁচল চাপা দেয়।
–আহা কেঁদ না রইসের মা। বড় দুঃখের কপাল তোমার। নিজের ছেলেটাও হল হাবা আর বোবা। কোন কাজেই এলো না। যাক দুঃখ করো না। আমরা তো আছি। দরকার হলে খবর দিও। তবে হ্যাঁ ঐ বোষ্টমীটাকে আজই বিদায় কর।
–তা আর বলতে।
–যাই মেলা কাজ। সাবধানে থেক রইসের মা। মনসুর ছাতা মাথায় মেঠো পথে নেমে যায়। একটু পর ঘুরে আসে আবার।
–হ্যাঁ গো রইসের মা সলীমের খবরটা সত্যি তো?
–লোকে তো বলে। নিজের চোখে তো আর দেখিনি।
–তা তো ঠিকই। ওদের নিয়ে তোমারও আদিখ্যেতা আছে বাপু। তা আমি বলি। সতাই ছেলে দুটো গেছে তোমার ভালই হয়েছে। সম্পত্তি সব এখন তোমার রইসের। কি খুশি লাগছে না?
বুড়ির দম আটকে আসে। শক্ত হয়ে যায় শরীর।
–বুঝলে খুশিটা আমারও। যাই সলীমের খবরটা পৌছে দেই ক্যাম্পে।
মনসুর হনহনিয়ে হেঁটে যায়। বুড়ি থু করে একদলা থুতু ফেলে। ওর সঙ্গে কথা বলতেও শরীর কেমন ঘিনঘিন করে। শকুন! শকুন একটা। বুড়ি অকারণে কাটা ঝোপে লাথি মারে। সলীম ফিরে এলে তোর হাড়-মাংস চিবিয়ে খাবে। তোকে কুকুরের মুখে, শিয়ালের মুখে তুলে দেব আমি। উঃ সলীমের খবরটায় কেমন লাফিয়ে উঠলো শূয়োরটা। মাগো মাথা আমার খারাপ হয়ে যাবে। মিথ্যে বানিয়ে বলে ওকে ধোকা দিয়ে এখন নিজের বুকের মধ্যে কেমন ছটফট করছে। সলীম আমি তোকে পেটে ধরিনি ঠিকই কিন্তু তবুও তোর মা হয়ে বলছি আমার মুখে ঝাটা পড়ুক। তোর শত বছর পরমায়ু হবে রে। সলীম বিশ্বাস কর ও যাতে আমাকে আর নীতাকে না ঘটায় সেজন্য মিথ্যে বলেছি। বুড়ির অস্বস্তি তবু কাটে না। কেন এমন হঠাৎ করে সলীমের মৃত্যুর খবর মনে এল? সলীম তোর যুদ্ধের দোহাই, তোর মুক্তিযোদ্ধাদের দোহাই আমার মনে একটুও পাপ নেই রে। আমি সম্পত্তি দিয়ে কি করবো, ঐসব আমার চাই না। এ বুড়ি বিড়বিড় করতে করতে ঘরে ফিরে। বিড়বিড় করতে করতে ভাত চড়ায়। সারাদিন বুড়ি আচ্ছন্নের ঘোরে কাটিয়ে দেয়। নীতার সঙ্গেও কথা বলতে পারে না।
–তোর কি হয়েছে সই?
–আমি রটিয়ে দিয়েছি সলীম যুদ্ধে মরেছে। বুড়ি অবিচল কণ্ঠে বলে।
–কেন এমন করলি?
–সলীম মরে গেলে ওরা খুশি হবে। তাহলে আমাকে আর বেশি ঘটাবে না। তোর এখানে থাকা নিয়ে কথা বলবে না। জানিস নীতা এখন ঐ সৈনিকগুলোর চাইতে আমি মনসুরকে বেশি ভয় পাই রে। ও আমার ঘরের কাছের লোক। ও আমার হাঁড়ির খবর রাখে।
বুড়ি সারাদিনের পর এতক্ষণে কেঁদে ফেলে। নীতা বুড়ির মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। বুড়িকে বুঝতে পারে না। ওর মুখের রেখা পড়তে পারে না। বুড়ি এখন নীতার কাছে অচেনা এক মেয়েমানুষ।
বুড়ির রটনা বাতাসের বেগে সারা গায়ে ছড়িয়ে যায়। মনসুর পথে পথে যাকে পেয়েছে তাকেই সোল্লাসে খবর দিয়েছে। যারা সলীমের বিজয়ীর বেশে ফিরে আসার অপেক্ষায় আছে তারা চুপি চুপি বুড়ির কাছে আসে।
–খবরটা কি সত্যি রইসের মা?
–হ্যাঁ। বুড়ি গলা না কাঁপিয়ে উত্তর দেয়।
–খবরটা আনল কে?
–একটা ছেলে। চিনি না। রমজান আলী শুনে গর্জে ওঠে।
–মিথ্যে কথা। নিশ্চয় সলীম মরেনি। এটা ঐ মনসুরটার বানানো কথা।
বুড়ি রমজান আলীর প্রশ্নের উত্তর দেয় না। ওর কণ্ঠের গর্জনে স্বস্তি পায়। সে কণ্ঠ বুকের ভেতর ধরে রাখে। ঘরের ভেতর থেকে নীতা অনবরত চোখের জল মোছে। মনে হয় বুড়ির কাছাকাছি পৌছার সাধ্য এখন আর ওর নেই।
এইসব টানাপোড়েনে দিন কেটে যায়। বুড়ির বুকের দিগন্ত অনবরত প্রসারিত হয়। হলদী গায়ের সীমানা পেরিয়ে যায়। গুলির শব্দের জন্যে কান খাড়া করে রাখে। কখনো রমজান আলী ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে, তুমি কথা বলনা কেন রইসের মা? সলীমের খবরটা কি তোমার কাছে বাতাসে ভেসে এল? তোমার কাছে কে এসে খবর দিয়ে গেল আর আমরা কিছুই জানলাম না এটা হয় নাকি?
বুড়ি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তারপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়। রেগে যায় রমজান আলী।
–তোমাকে যে কোন ভূতে পেয়েছে আল্লাহই জানে?
বুড়ি রমজান আলীর দুপদাপ পা ফেলে চলে যাওয়া দেখে। দেখতে ভাল লাগে। বিড়বিড় করে, চারদিকে এমন দুপদাপ শব্দই তো আমি চাই। বুড়ি অনুভব করে বুকের সীমানায় গলগলিয়ে জনস্রোত ঢুকছে। ওর ভাবনার মাঠঘাট প্রান্তর স্বর্ণপ্রসবিনী করে তুলছে। বুড়ির পলিমাটি চেতনায় রাশি রাশি শস্যের কণা।
শুধু বাঁশবনে বা খালের ধারে দাঁড়িয়ে মনসুর যখন বিগলিত হেসে গদগদ স্বরে জিজ্ঞেস করে, কেমন আছ রইসের মা? তখন বুড়ির পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঘৃণার চাবুক লিকলিকিয়ে ওঠে। ও মুখ ঘুরিয়ে নেয়। একদলা থুতু ফেলে। মনসুর সহানুভূতি জানায়, আহা তোমার কি এখন মাথার ঠিক আছে? সতাই ছেলে হলেও তুমিই তো কোলেপিঠে করে মানুষ করেছ।
বুড়ি কথা শেষ করার আগেই হাঁটতে শুরু করে।
–ও রইসের মা? রইসের মা?
মনসুর জবাব না পেয়ে ফিরে যায়। বুড়ি গরুর খুঁটি আলগা করে বাঁশের কঞ্চি কুড়িয়ে বুনো লতায় সপাং সপাং পিটায়। বুড়ির শরীরের র-র দপদপানি কমে না।
পৌষের প্রথম রাতে গোলাগুলির ভীষণ শব্দে ঘুম ভেঙে যায় ওদের। বুড়ি গায়ের কাঁথা ছুড়ে ফেলে উঠে বসে। নীতাও গুটিসুটি উঠে আসে। ওর শরীর কাঁপে।
–কি হল সই?
–ঠিক আমাদের গাঁয়ের ক্যাম্পে আক্রমণ করেছে মুক্তিযোদ্ধারা।
–মাগো এখন কি হবে?
নীতা কাঁদতে শুরু করে।
–কি আর হবে, জঙ্গী ছেলেগুলো শীতের রাত গরম করে তুলেছে।
রইস কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে। ওকে আর জাগায় না। বুড়ি বাঁশের ঝোপের কাছে এসে বসে। বুক দুরুদুরু করে, এত কাছ থেকে এমন শব্দ কি ও আর কখনো শুনেছে! শব্দ ক্রমাগত জোরালো হয়। আশপাশের ঘরের লোকজনের ফিসফাস কথাবার্তা শোনা যায়। সব ভয়ে আতংকগ্রস্ত। তটস্থ মেয়েরা ছেলে বুকে নিয়ে পালাচ্ছে। পুবদিকে সরে যাচ্ছে। অন্ধকার রাতে পথ চলায় একটুও অসুবিধে হয় না। বরং অন্ধকারই ভাল। চারদিকের এত আঁধারের মাঝেও বুড়ির বুকের ভেতর প্রদীপ জ্বলে। রমজান আলী এসে বুড়িকে ডাকে।
–ও রইসের মা?
–কি!
–এখনি পালানো দরকার।
–কেন?
–যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আমরা সরে যাচ্ছি। যুদ্ধ থামলে ওরা আমাদের মেরে
ফেলবে।
–কি যে বল রমজান ভাই আমাদের ছেলেরা জিততেও তো পারে।
–জিতলে তো ভালই। না জিতলে? এখনই চল। তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার।
–আমার আর কি হবে? আমি যাব না।
–কি যে বল?
–না রমজান ভাই না। তুমি যাও। ছেলেটা ঘুমোচ্ছে। এই শীতের রাতে ওকে নিয়ে কোথায় যাব?
–মরণের শখ হয়েছে তোমার? তাড়াতাড়ি এস।
–না।
–যাবে না?
–না, রমজান ভাই। আপনি যান।
রমজান আলী রাগ করে চলে যায়। কলীমের মৃত্যুর কথা মনে হয় বুড়ির। ঘর থেকে উঠোনের ঐ জায়গাটা দেখা যাচ্ছে। বুকটা কেঁপে ওঠে। গুলির শব্দ মানেই মৃত্যু। নীতাও তা জানে। তবুও বুড়ি চুপচাপ বসে থাকে।
–সই? নীতার কণ্ঠে বুড়ি চমকে ওঠে। ওর হাত চেপে ধরে।
–সই তুই ওদের সঙ্গে চলে যা। সত্যি যদি কিছু হয়?
–তোকে ছেড়ে আমি যাব? তুই কি করে বললি?
–তাহলে দুজনে বসে থাকি। দেখি শেষ কোথায়।
বুড়ি কান পেতে প্রাণ ভরে শব্দ শোনে। এমন শব্দময় উষ্ণ রাত বুড়ির জীবনে আর কোন দিন আসেনি।
কাদের আর হাফিজের নেতৃত্বে মিলিটারি ক্যাম্পে আক্রমণ চালিয়েছে একদল মুক্তিযোদ্ধা। প্রথমদিকে ওরা চমৎকার পজিশনে ছিল। অতর্কিত আক্রমণ বলে বেশ কয়েকটা মেরেও ফেলে। কিন্তু সংখ্যায় কম ছিল বলে ওরা বেশিক্ষণ টিকতে পারে না। তার ওপর ওদের গুলিও ফুরিয়ে যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে ওরা পালাবার চেষ্টা করে। অন্ধকারে এক একজন এক একদিকে দৌড়ায়। কাদের হাফিজ গাঁয়ের পথ চেনে। চেনা পথে ওদের অসুবিধা হয় না। শুধু এলোমেলো পথ ঘাটে কখনো পা বেঁকে যায়। ওদের পেছনে ধাওয়া করে চারজন মিলিটারি। পেছন থেকে ওরা গুলি ছোড়ে। কানের পাশ দিয়ে আগুনের ফুলকি হলকা ছড়িয়ে যায়। কাদের আর হাফিজ প্রাণপণে ছুটছে। সৈনিকদের দৃষ্টি এড়াতে ওরা সোজা ছেড়ে মাঠের মধ্যে নেমে যায়।
উঠানে দুপদাপ্ শব্দ। দুলে ওঠে বুড়ির বুক। ওরা কি তবে পালিয়ে এল? যুদ্ধ কি শেষ? গুলির শব্দ আর তেমন জোরালো নয়। ফাঁকা আওয়াজ ভেসে যায় শূন্যে। পাল্টা জবাব আর গর্জে ওঠে না। বুড়ির বুক খালি হয়ে যায়। ওরা কি তবে হেরে গেল? ও নীতার হাত চেপে ধরে।
–সই ওরা কি হেরে গেলো? ওরা হারতে পারে না। আমার বিশ্বাস হয় না।
বুড়ি ফুঁপিয়ে ওঠে। নীতার হাঁটু কাঁপে থর থর করে। বারান্দায় উঠে এল ওরা। বুঝি ঝাপের ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করে।
–চাচি?
বুড়ির বুক কাঁপে। কে ওরা? চেনা ছেলে মনে হয়?
–চাচি দরজা খোলেন।
অস্থির কণ্ঠ। এক মুহূর্ত দেরি সইছে না। বুড়ি তৈরি হয়ে যায়। হ্যাঁ, এখনই প্রকৃত সময়। ওরাই এসেছে। সেই বীর যোদ্ধা ছেলেগুলো। ওরা আশ্রয় চাইছে। ওরা প্রার্থনার ভঙ্গিতে নিরাপত্তার আশ্বাস চাইছে। ওদের আশ্রয় দেয়া দরকার। একবার পালিয়ে এসেছে তাতে কি হয়েছে? ওরা আবার নতুন করে যুদ্ধে নামবে। শক্তিমান ঈশ্বরের মত মনে হয় নিজেকে। বুড়ি দরজা খুলে দেয়।
কাদের আর হাফিজ হুড়মুড়িয়ে ঢোকে।
–ওরা আমাদের পিছু নিয়েছে চাচি। তাড়া করে আসছে। বাবা মা কে তো পেলাম না। আপনি আমাদের আশ্রয় দেন চাচি।
মিনতিতে ভেঙে পড়ে কণ্ঠ। বুড়ি জানে না প্রার্থনার ভঙ্গি এমনি কি না। এত কিছুর প্রয়োজন ছিল না। ওরা যদি বুক টান করে বলতো, আমাদের বাঁচাও। তাতেই বুড়ি বিগলিত হয়ে যেত। বুড়ি জানে ওদের বেঁচে থাকা প্রয়োজন। হলদী গাঁয়ের প্রাণ এখন ওদের হাতের মুঠোয়। ওদের বাঁচাটা মাটির মত প্রয়োজন। বুড়ি কর্তব্য ঠিক করে নেয়। ওদের টেনে নিয়ে যায় ঘরের কোণে। খালি হয়ে পড়ে থাকা বড় মটকার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। মুখে ঢাকনা দেয়। ঢাকনার ওপর টুকরি। টুকরির ওপর পুরোনো কাপড়ের পুঁটলি।
নীতা হাঁ করে দেখে কেবল। বুড়ি ফিরে এলে ডাকে, সই! বুড়ি পরিতৃপ্তির হাসি হাসে।
–ওদের না বাঁচালে আমাদের জন্যে লড়বে কে?
বুড়ি আবার ঝাপের কাছে বসে। রমজান আলী ঘর ছেড়ে পালিয়েছে। তবে সবাই যায়নি। বুড়ির মত আরো কেউ কেউ রয়ে গেছে। একবার মার খেয়ে রমজান আলীর সাহস কমে গেছে। ওর কথা শুনে বুড়িও যদি পালাতো তবে কে ওদের আশ্রয় দিত? বুড়ি জানে এই কঘর বাসিন্দার মধ্যে আর কারো এত সাহস হতো না। গর্বে, ভয়ে, আশংকায়, আনন্দে বুড়ির বুক ওঠানামা করে। এখন কি করবে? ওরা যদি খোজ করতে আসে? আসে নয় আসবেই। বুড়ির মনে হয় বিশাল অরণ্যে ও একা। চারদিক থেকে নেকড়ের দল বন-জঙ্গল ভেঙে ছুটে আসছে আক্রমণ করতে। শিউরে ওঠে বুড়ি। কিছুই ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারে না। কি করা উচিত? পথ আগলে দাঁড়াবে? বলবে, আগে আমাকে মার তারপর ঘরে ঢোকো? কিন্তু তাতে লাভ? ছেলে দুটো কি তাতে বাচবে? বুড়ির মৃত্যুর বিনিময়ে তো ওরা বাঁচবে না? কি করবে? কি করা দরকার? মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করে। ওর ওপর নির্ভর করছে ওদের জীবন-মৃত্যু। ওদের বেঁচে থাকা একান্তই দরকার।
বুড়ি নীতাকে ধরে ঝাকুনি দেয়।
–কি করি সই? কেমন করে ওদের বাঁচাব?
নীতা কথা বলে না। আঁচলে চোখ মোছে। বুড়ি রেগে যায়।
–তোর কেবল চোখে জল। সব হারিয়ে তুই শিখেছিস কাঁদতে? একটুও ভাল লাগে না।
বুড়ি ঘরে পায়চারি করে।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে চারজন সৈনিক ক্ষুধার্ত নেকড়ের মত আঙিনায় এসে দাঁড়ায়। সার্চ লাইটে আলোকিত করে ফেলে চারদিক। এত ঝকমকে আলো হলদী গাঁয়ের এই কঘর বাসিন্দা ওদের জীবনকালে দেখেনি। সৈনিকগুলো চিৎকারে বাড়ি মাথায় তোলে। ওরা বুঝতে পারছে না যে ছেলেগুলো কোনদিকে গেল? ঘরে ঢুকলো না বাশবন, সুপপারি বাগানে গিয়ে আশ্রয় নিল? ওরা নিজেদের মধ্যে কি যেন বলাবলি করে। তারপর দুজন ঘরে ঘরে তল্লাসী শুরু করে। অন্যান্য ঘরের পুরুষদের উঠানে এনে দাঁড় করিয়েছে। বুড়ির হাত পা থরথর করে কাঁপে। বাঁশবনে চুপ করে বসে থাকা সাদা বকটার মত মনে হয় মৃত্যুর ছায়া। ঘরের বাইরে বাদাম গাছে পেঁচা ডাকে থেকে থেকে।
বুড়ি সারাঘরে পায়চারি করে। এক কোণে কুপি জ্বলে। রইসের মুখ থেকে কথা সরে গেছে। এত হট্টগোলেও ওর ঘুমের ব্যাঘাত হয়নি। ঘুমের মধ্যে গোঙায়। এটা ওর একটা অভ্যেস। বুড়ি ঝুঁকে পড়ে ওর মুখের ওপর। হ্যাঁ, ঠিক সেই গন্ধ আসছে। কাদের হাফিজ যেদিন মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে যাচ্ছিল সেদিন ওদের শরীর থেকে যেরকম গন্ধ এসেছিল ঠিক সে রকম গন্ধ আসছে রইসের মুখ থেকে। চারদিক আলো করে কারা যেন বুড়ির চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে। বুড়ি দৈববাণী শুনতে পাচ্ছে। ফিসফিস করে বলছে, আর সময় নেই ! বুড়ির মনে হয় প্রতিটি মুহূর্তই যেন ওর দিকে এগিয়ে আসছে। ঘুমের ঘোরে রইস পাশ ফিরে শশায়। চকিতে একটা চিন্তা এসে বুড়িকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।
নীতা দ্রুত বলে, সই আজ আমাদের সবাইকে মরতে হবে। বুড়ি ওর কথার উত্তর দেয় না। ওর কেবলই মনে হয় যে ছেলে জনযুদ্ধের অংশীদার হতে পারে না–যে ছেলে ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পারে না তার বেঁচে থেকে লাভ কি? কত হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছে। রইসও যদি যায়? না, পরক্ষণে মনটা মুষড়ে পড়ে। রইস ছাড়া বুড়ির পৃথিবী অন্ধকার। সব হারিয়ে কেমন করে বাঁচবে ও? পরক্ষণে সমস্ত হলদী গাঁ চোখের সামনে নড়ে ওঠে। বিরাট একটা ক্যানভাসে বুড়ির শৈশব, কৈশোর, যৌবন এবং সেই সঙ্গে নেংটি পরা মানুষগুলো উঠে আসে সামনে। ওদের পেটে ভাত নেই, পরনে কাপড় নেই, আছে কেবল বুকভরা তেজ। তাই বুড়ির একার স্বার্থ ওখানে। সামান্য। বুড়ি চিন্তা ঝেড়ে ফেলে। ওদের কথাবার্তা শোনা যায়। বুঝি ওর ঘরের দিকেই এগিয়ে আসছে। ও আর দেরী করে না। ঘুমন্ত রইসকে টেনে তুলে আনে বিছানা থেকে। চারদিকের এত আলোয় ও হকচকিয়ে যায়। বুড়ি লুকিয়ে রাখা এল.এম.জি, টা গুঁজে দেয় রইসের হাতে। রইস অবাক হয়ে একটুক্ষণ দেখে নতুন জিনিসটাকে। মুখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। মাথা নাড়ে। এবং ভীষণ খুশিতে খেলনা ভেবে অস্ত্রটা জড়িয়ে ধরে বুকের মাঝে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বুড়ির সমস্ত শরীর কেঁপে যায়।
–নীতা তীব্র কণ্ঠে বলে, কি করছিস সই?
ও রইসের হাত থেকে অস্ত্রটা কেড়ে নিতে চায়। বুড়ি ক্ষিপ্রগতিতে সামনে এসে দাঁড়ায়, না। তুই ওটা নিতে পারবি না। ওটা রইসের বুকেই থাকুক ! আমি ওকেই দিয়েছি।
বুড়ির দৃষ্টি দপদপিয়ে ওঠে। চোখে জল নেই।
সৈনিক দুজন বুড়ির বারান্দায় ওঠার সময় পায় না। পা সিড়িতে রাখার সঙ্গে সঙ্গেই বুড়ি রইসকে ঘর থেকে ঠেলে বের করে দেয়। সৈনিক চারজন কলরব করে ওঠে। দরজা আগলে দাঁড়িয়ে থাকে বুড়ি। ওদের কিছুতেই ঘরের মধ্যে ঢুকতে দেবে না। ঢুকতে হলে বুড়ির লাশ মাড়িয়ে ঢুকতে হবে। কিন্তু রইসকে পেয়ে সৈনিক চারজন আর অন্য কিছু ভাবে না। অত ভাবার ধৈর্য ওদের নেই। ওদের সোল্লাস মুখের দিকে তাকিয়ে ওর দম আটকে আসতে চায়। নিঃসীম বুকের প্রান্তরে হু হু বাতাস বয়ে যায়। বুড়ি হাজার চেষ্টা করেও কাঁদতে পারে না। ছুটে বেরুতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ে। আরো দুটো প্রাণ ওর হাতের মুঠোয়। ও ইচ্ছে করলেই এখন সে প্রাণ দুটো উপেক্ষা করতে পারে না। বুড়ির সে অধিকার নেই। ওরা এখন হাজার হাজার কলীমের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিচ্ছে। ওরা হলদী গাঁর স্বাধীনতার জন্যে নিজের জীবনকে উপেক্ষা করে লড়ছে। ওরা আচমকা ফেটে যাওয়া শিমুলের উজ্জ্বল ধবধবে তুলল। বুড়ি এখন ইচ্ছে করলেই শুধু রইসের মা হতে পারে না। বুড়ি এখন শুধুমাত্র রইসের একলার মা নয়।
সৈনিক কজন তাদের নিজস্ব ভাষায় বুড়িকে ধন্যবাদ জানায়। উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে। দেশের জন্যে সত্যিকার কাজ করেছে বলে পুরস্কার দেবার কথাও বলে। বুড়ি এক অক্ষরও বুঝতে পারে না। নির্বাক পুতুলের মত দরজা আঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ওদের হাতে বন্দী রইস কেবল নেড়েচেড়ে অস্ত্রটাই দেখে। কারো দিকে তাকাবার সময় ওর নেই। উঠানে দাঁড় করানো লোকগুলো সব থ। কারো মুখে কথা নেই। ওরা বুঝতে পারছে না যে কোথা দিয়ে কি হচ্ছে। হাবা-বোবা রইসের হাতে অস্ত্র দেখে কেউ প্রতিবাদও করে না। সব চুপ। ওরা কেবল অনুভব করে বুড়ির চোখ দুটো জ্বলছে। চোখের অমন আলো ওরা আর কোথাও দেখেনি। কোন সন্দেহের অবকাশ না রেখে রইসকে লুফে নিয়ে ওরা চলে যায়। আকাক্সিক্ষত শিকার এখন ওদের হাতের মুঠোয়। শিকার ঝলসানোর জন্যে ওরা এবার আগুন জ্বালবে। ওরা চলে যাচ্ছে। বুড়ি অনুভব করে ওর কলজেটা খাবলে নিয়ে ওরা চলে যাচ্ছে।
বুড়ি দরজা ছেড়ে বারান্দায় নামে। সিড়ি বেয়ে উঠানে। রাত্রি প্রায় শেষ। আবছা আলো চারদিকে। পঁাচার ডাক থেমে গেছে অনেকক্ষণ। উঠানে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো বুড়িকে ঘিরে ধরেছে। কত কি যেন বলছে। বুড়ি কিছুই শুনতে পায় না। ওদের ভিড় সরিয়ে উঠানের শেষ মাথায় আসে। এবং পরক্ষণেই শুনতে পায় গুলির শব্দ। বুড়ি দৌড়ে বের হয়। কলীমের লাগানো জামরুল গাছের নিচে রইস রক্তের স্রোতে ভাসছে। ও বেড়া আঁকড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। মনে হয় বুকের ভেতরের পুলটা দুম করে ভেঙে পড়লো। রইস একটা টকটকে লাল তাজা বোমা। চারজন সৈনিক সদম্ভে মাটি কাঁপিয়ে ক্যাম্পের দিকে চলে যাচ্ছে।
যখন বাড়ির সবাই রইসের দিকে ছুটে গেল তখন বুড়ি আবার দৌড়ে ঘরে এলো। ধানের মটকার মুখ খুলে ওদের ডাকল। ওরা বেরিয়ে এলো। মনে আশংকা। শংকিত দৃষ্টিতে চারদিকে তাকায়। বুঝতে পারে না কিছুই।
–ওরে তোরা পালা। ওরা চলে গেছে।
–চলে গেছে?
ওদের বিশ্বাস হয় না। নীতা বৈরাগিণীর উঁচুকণ্ঠের কান্না ভেসে আসছে।
–কাঁদে কে চাচি?
–তোদের এত কথার সময় নেই। তারা এখন পালা। তোদের তো আবার লড়তে হবে।
বুড়ির কণ্ঠ রুক্ষ হয়ে ওঠে।
–আপনার জন্যে বেঁচে গেলাম চাচি।
–খালি কথা। যা এখন।
বুড়ি ওদের পিঠে হাত দিয়ে ঠেলে দেয়। বুকের ভেতর থেকে কান্নার ঢেউ পাহাড় সমান উঁচু হয়ে ছুটে আসছে। কিন্তু ওদের সামনে কিছুতেই তা প্রকাশ করবে না বুড়ি।
ওরা বুড়ির পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। দ্রুত বাইরে আসে। মৃত রইসকে দেখে থমকে দাঁড়ায়। ওদের কোরবান চাচার কাছে সব শুনে বধির হয়ে যায় ওদের অনুভূতি। পায়ে পায়ে ফিরে আসে বুড়ির সামনে। বুড়িকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
–আপনার একটি মাত্র ছেলে। আমাদের জন্যে এ আপনি কি করলেন?
–তোদের যে আরো লড়তে হবে।
–তবু ওদের কান্না থামে না। বুড়ি ওদের হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধার চোখে পানি বেমানান।
–এখনও না পালালে তোরাও ধরা পড়বি। আর সময় নেই রে। তোরা যদি ধরা পড়িস বৃথাই রইস মরল। এক্ষুণি বেরিয়ে পড়।
বুড়ির কঠিন শাসনে ওরা আর দ্বিধা করে না। মনে হয় বুড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস ওদের নেই।
–মাগো যাই।
ওরা দুজন দৌড়ে বেরিয়ে যায়। বুড়ি বেড়ার গায়ে হেলান দিয়ে নিজেকে সামলে নেয়। প্রবল কান্নার ধ্বনি আসছে জামরুল গাছের নিচ থেকে। সবাই কাঁদছে। বুড়ির বুক তোলপাড় করে ওঠে।
–তুই আমাকে একদিনও মা বলে ডাকিনি রইস। আমি জানি একটু পরে হলদী গাঁয়ের মাটি তোকে বুকে টেনে নেবে। তুই আর কোনদিন মা বলে ডাকবি না। আমিও আর অপেক্ষায় থাকব না। কৈশোরে, যৌবনে যে স্বপ্ন আমাকে তাড়িত করতো বার্ধক্যে যে স্বপ্ন আমি মুছে ফেলেছিলাম এখানেই তার শেষ। রইস তুই আমার কত আদরের কত ভালবাসার কত সাধনার ধন রে! তবু তোকে নিয়ে আমার বুকে কাঁটা ছিল। আজ আমি তোর রক্তে সে কাটা উপড়ে ফেললাম। তোর অপূর্ণতা–তোর অভাব আমি আমার জীবন দিয়ে শোধ করলাম। তুই মরে বেঁচে গেলি। আমি রইলাম তোর শোক বহন করার জন্যে। রইস আমি তোর মা ডাক না শোনা মা। আমি কত নির্মম, নিষ্ঠুর হয়েছিলাম তা তুই বুঝতে পারিসনি। আমি তো জানি যে কটা দিন বাঁচবো তোর কষ্টে বুক পুড়িয়ে বাঁচবো। তবু এই কষ্ট থেকে আমি পার পেয়ে যাইরে যখন দেখি হলদী গাতো আমারই নিঃশ্বাসের। আমারই প্রতি রোমকূপের। আমি তখন আর সব কিছু ভুলে যাই। রইস তোর মাতৃত্বে আমার যে অহংকার–হলদী গাঁও আমার তেমন অহংকার। রইস তুই আমাকে মাফ করে দে। মাফ করে দে।
বুড়ি বেড়ার গায়ে মাথা ঠুকে ডাক ছেড়ে কেঁদে ওঠে। নীতা এসে দাঁড়ায়।
–সই?
বুড়ির কান্না থামে না।
–সই চল, দেখবি না বুক পিঠ কেমন ঝাঁঝরা হয়েছে? রক্তে মাখামাখি হয়ে কেমন পদ্মের মত ফুটে আছে তোর রইস?
নীতার কথায় বুড়ি শক্ত হয়ে যায়। ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে।
–হাঁ করে দেখছিস কি? চল। নাড়ি ছেঁড়া ধন চাই বলে পাগল হয়ে উঠেছিলি। তাকে আজ নিজ হাতে বলি দিয়ে কাকে তুষ্ট করলি সই?
বুড়ি কোন কথা বলে না।
নীতার প্রশ্নের উত্তর হয় না। বুড়ির ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়া বুক এখন সমতল পলিমাটি। অনবরত বন্যায় ক্রমাগত উর্বরা হয়। খরায় নিরেট। তবুও শ্যামল খাল বিল নদী নালাময় বুড়ির বুকে আশ্চর্য পদ্মের সৌরভ।
–চল সই?
নীতা বুড়ির হাত ধরে নিয়ে আসে।
বুড়ি রইসের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে। জনযুদ্ধে উপেক্ষিত ছেলেটার উষ্ণ তাজা রক্ত হাত দিয়ে নেড়ে দেখে। রইসের ঠোঁটের কোণে লালা নেই। লালচে ক্ষীণ রেখা গড়াচ্ছে। রক্তের থোকায় কাত হয়ে পড়ে থাকা রইসের মাথাটা সোজা করে খুব আস্তে খোলা চোখের পাতা বুজিয়ে দেয় বুড়ি।
কারা যেন চারপাশে কথা বলছে। কেউ বুড়িকে গালাগালি করছে। ওর মনে হয় সলীম বুঝি ফিরে এসেছে। মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। সব কিছু অন্ধকার হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত বুড়ির আর কোন কিছুই মনে থাকে না।