নাগদত্ত
কালঃ ৩৩৫ খৃষ্টপূর্ব
“বিষ্ণগুপ্ত! উচিত কাজের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। আমরা মানুষ তাই আমাদের কিছু কর্তব্য আছে। আর সেই জন্যে আমাদের উচিত-অনুচিত সম্বন্ধে খেয়াল রাখা দরকার।”
“কর্তব্য কি ধর্ম নয়?”
“আমি ধর্মকে ছলনা বলে মনে করি। ধর্ম কেবলমাত্র পরম্বাপহারীদের শাস্তিতে পরের ধনকে উপভোগের সুগোগ দেয়। ধর্ম কি কখনও গরীব এবং দূর্বলের কোনো খবর রাখে? পৃথিবীতে এমন কোন জাত নেই যারা ধর্ম মানে না। দাসেরও যে মানুষ—ধর্ম কি তা কখনও স্বীকার করে? দাসেদের কথা ছেড়েই দিলাম, কিন্তু স্ত্রী-জাতির প্রতি—তা সে অ-দাস হোক না কেন, ধর্ম কি কখনও ন্যায় করেছে? টাকা হলেই তুমি দু-চার-দশ কিংবা একশ বিয়ে করতে পার। সেই স্ত্রী দাসী ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না; ধর্ম কিন্তু একে উচিত কাজ বলেই মনে করে। আমি যে কর্তব্যের কথা বলছি সেটা ধর্মজাত কর্তব্য নয়, সুস্থ মানুষের মন যেটাকে কর্তব্য বলে মনে করে।”
*আজ থেকে একশ’পুরুষ আগেকার একটি ঐতিহাসিক কাহিনী। এই সময় সামাজিক বৈষম্য খুবই বেড়ে গিয়েছিল। ধনী ব্যবসায়ী-শ্রেণী সমাজের মধ্যে গুরুত্বপূর্ন স্থান অধিকার করে ছিল। এই সময়ের মধ্যে জন্মেছেন অনেক পথ প্রদর্শক—যাঁরা নরক থেকে মানুষকে উদ্ধার করে পরলোকের পথ দেখান। কিন্তু যে নরকের অগ্নিকুণ্ড গ্রামে গ্রামে দাউদাউ করে জ্বলছিল তার দিকে সবাই চোখ বুঁজে ছিল।
“তা’হলে আমি বলব যে, প্রয়োজনীয় যা কিছু তাই হল কর্তব্য।”
“তবে তো উচিত-অনুচিতের মধ্যে কোনো প্রভেদ থাকবে না।”
“থাকবে বন্ধু! আমার প্রয়োজনীয় কথার অর্থ শুধু একজনের প্রয়োজন নয়।”
“একটু পরিষ্কার করে বল,বিষ্ণুগুপ্ত!”
“আমাদের এই তক্ষশিলা গান্ধারের কথাই ধর না কেন! আমাদের কাছে নিজ স্বতন্ত্রতা কত প্রিয় এবং সেটা খুব স্বাভাবিকও বটে। কিন্তু আমাদের দেশ এত ছোট যে তার পক্ষে বড় শত্রুর মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। যতদিন পর্যন্ত মাত্র, পশ্চিম গান্ধারের মতো ছোট ছোট প্রজাতন্ত্রগুলি আমাদের প্রতিবেশী ছিল ততদিন সুখেই ছিলাম। কখনও কখনও যু্দ্ধ হত বটে কিন্তু পরিণামে সামান্য কিছু লোকই মরত শুধু। আমার স্বাতণ্ত্রা অপহৃত হয়নি। কারণ আরও ছিল, তক্ষশিলা জয় করা—কণ্টকাকীর্ণ রাজ্য জয় করা কারও পক্ষে সহজ ছিল না। কিন্তু যখন পার্শবরা (ইরাণী) পশ্চিমের প্রতিবেশী হয়ে দাঁড়াল তখন আমাদের স্বাতন্ত্র্য শুধু তাদের ক্বপার ওপর নির্ভর করে রইল। এখন আমাদের স্বতন্ত্রতা রক্ষার জন্য আবশ্যক পার্শবদের মতো শক্তিশালী হওয়া।”
“শক্তিশালী হওয়ার জন্য কি করা উচিত?”
“ক্ষুদ্র প্রজাতন্ত্রে কাজ হবে না। ছোট-ছোট স্বতণ্ত্র জনপদের জায়গায় বিশাল রাজ্য কায়েম করতে হবে।”
“সে বিশাল রাজ্যে ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র জনপদের কি কোনো স্বাধিকার থাকবে?”
“সকলেই রাজ্যকে আপন বলে মনে করবে।”
“খুবই গোলমালের কথা বিষ্ণুগুপ্ত! দাস কি কখনও প্রভূকে আপন মনে করে?”
“তবে শোন বন্ধু নাগদত্ত,স্থান পাওয়াটা শুধু ইচ্ছা বা খেয়ালের ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে যোগ্যতার ওপর।যদি তক্ষশিলা—গান্ধারদের যোগ্যতা থাকে তবে তারা ওই বিশাল রাজ্যও শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করবে। তা না হলে সাধারণভাবেই থাকবে।”
“গোলামের স্থান অধিকার করে?”
“কিন্তু বন্ধু! দারয়োশ রাজ্য পশ্চিম গাণ্ধাররা যে স্থান পেয়েছে তার থেকে এ গোলাম স্থান অনেক ভালো হবে। আচ্ছা আমার বক্তব্য ছেড়েই দাও। তুমিই বল না, আমাদের স্বতন্ত্রতা রক্ষা করার জন্য কি করা উচিত। এ কথা খুবই সত্যি যে, আমাদের মতো ক্ষুদ্র জনপদের পক্ষে আপন অস্তিত্ব রক্ষা করা দীর্ঘকাল আর সম্ভব নয়।”
“আমি বলব বিষ্ণুগুপ্ত! প্রথমত আমাদের নিজস্ব গণ-স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা উচিত যা কোনো রাজার বশ্যতা স্বীকার করবে না। কিন্তু আমি জানি, আমাদের মতো একটি ক্ষুদ্র গণের (রাষ্টের) পক্ষে স্বতণ্ত্রতা রক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই আমাদের কর্তব্য হল, সমস্ত উত্তরাপথের (গান্ধারের) গণগুলিকে (রাষ্ট্রগুলিকে) সংঘবব্ধ করা।”
“ সে সংঘে প্রত্যেকটি গণ স্বতণ্ত্র থাকবে—না, সংঘ সর্বোপরি থাকবে?”
“গণকে আমি সর্বোচ্চ বলে মনে করি আর সেইভাবেই গাণ্ধার, মাদ্র, মল্ল এবং শিবি প্রভূতি গণগুলির আপন শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করতে হবে।”
“কেমন করে তা স্বীকার করবে? শেষ পর্যন্ত তো গণকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সৈন্য রাখতেই হবে, বলি (কর) আদায় করতে হবে।”
“গণ(প্রজাতন্ত্র) যেমন তার কাজ সাধারণ মানুষের দ্বারা পরিচালনা করে, তেমনি সংঘ তার কাজ চালাবে গণগুলি সাহায্যে।”
“গণের মধ্যে প্রথম থেকেই আমরা এক জনের (গোষ্ঠী) এক রক্তের পরিবার হিসাবে বাস করে আসছি। আর অনাদিকাল থেকে এই পরিবার অর্থাৎ গণকে মেনে চলতে অভ্যস্ত। কিন্তু গণগুলির মিলিত সংঘ একটি নতুন জিনিস। এখানে রক্তের কোন সম্বন্ধ নেই, বরং এদের মধ্যে অনাদিকাল হতে চলে আসছে রক্তক্ষয়ী দ্বন্ধ ও প্রতিদ্বন্ধিতা। এ ক্ষেত্রে কেমন করে আমরা সবাইকে দিয়ে সংঘের নিয়ম-কানুন স্বীকার করাতে সক্ষম হব? বন্ধ! তুমি যদি এদের পারস্পরিক সম্পর্ক বিচার করে দেখতে তা’হলে আর তুমি এ কথা বলতে না। যদি বাধ্য করা হয়, তা’হলে সংঘের কথা না হয় ধরলাম যে গণগুলি মেনে নেবে, কিন্তু বাধ্য করাবার শক্তি আসবে কোথ্থেকে?”
“আমি মনে করি যে, সে শক্তি ওরিই মধ্যে থেকে সৃষ্টি করা উচিত।”
“আমি ও মনে করি যে গণগুলির ভেতর থেকে যদি সে শক্তি সৃষ্টি হত তা’হলে খুবই ভালো হত। কিন্তু পার্শবদের কাছে বারবার মার খেয়ে বুঝেছি যে, শক্তি ভিতর থেকে স্বষ্টি হবে না। তাই আমাদের প্রয়োজন, অন্য উপায়ে সে শক্তি সৃষ্টি করা।”
“রাজাকে মেনে নিয়েও?”
“শুধু তক্ষশিলা নয়। তক্ষশিলা গান্ধারের মতো জনপদগুলির জন্য একজন রাজা অর্থাৎ রাজচক্রবর্তীকেও স্বীকার করে নিলে কোনো ক্ষতি নেই।”
“তা’হলে পার্শব দারয়োশকেই বা কেন রাজা বলে মেনে নাও না?”
“পার্শব দারয়োশ যে আমাদের লোক নয় তা তুমি নিজেও ভালোভাবেই জানো। আমার জম্বূদ্বীপের লোক।”
“আচ্ছা, তা’হলে নন্দকে স্বীকার করে নাও।”
“আমরা যদি উত্তরাপথের সব গণগুলিকে সংঘবদ্ধ করতে না পারি, তা’হলে নন্দকে স্বীকার করে নিতে আপত্তি করা উচিত নয়। পশ্চিম গান্ধারদের মতো দারয়োশের অধীন হওয়া ভালো—না নিজেদের জম্বুদ্বীপের চক্রবর্তীর অধীনতা স্বীকার করা ভালো?”
“বিষ্ণুগুপ্ত তুমি এখনও রাজ-শাসিত দেশ দেখনি, যদি দেখতে তা’হলে বুঝতে যে, সেখানে সাধারণ লোকেরও দাসদের অপেক্ষা বেশী অধিকার নেই।”
“স্বীকার করছি। আমি পশ্চিম গান্ধার ছাড়া আর কোথাও যাইনি; কিন্তু দেশ ভ্রমণের ইচ্ছা আমার খুবই আছে। আমি লেখাপড়া শেষ করে পর্যটনে বার হব। বিদেশী দাসত্বের হাত থেকে বাঁচতে হলে ক্ষুদ্র গণ্ডী ভেঙে ফেলা সম্পর্কে দ্বিমত থাকতে পারে না। পোরাস আর দারয়োশদের সফলতার এই হল চাবিকাঠি।”
“তারা কতটা সাফল্য লাভ করেছে তা আমি কাছে থেকে দেখেছি।”
“কাছে থেকে?”
“হ্যাঁ, আমি প্রাচীতে মগ্ধ পর্যন্ত দেখেছি। আর নন্দের রাজত্ব, যা আমাদের পূর্ব গান্ধারের (তক্ষশিলা) তুলনায় নরক, তাও দেখেছি। গরীবদের দাবিয়ে দেওয়ার শক্তি তার আছে এবং মেহনতকারী কৃষক, শিল্পী ও দাসেরা যে তাতে কত নিপীড়িত তার বর্ণনা করা যায় না।”
“এ সবের কারণ হল নন্দের রাজ্যে তক্ষশিলার মতো কোনো স্বাভিমানী স্বতন্ত্রতাপ্রেমী, গণ (প্রজাতন্ত্র) সম্মিলিত হয়নি।”
“সম্মিলিত হয়েছে, বিষ্ণুগুপ্ত! লিচ্ছবিদের গণ গান্ধার থেকেও শক্তিশালী ছিল, কিন্তু এখন বৈশালী মগধের চরণদাসী আর লিচ্ছবিরা মগধ-শিকারীদের জবরদস্ত ডালকুত্তা। বৈশালীতে দেখবে, দেশটা উজাড় হয়ে যাচ্ছে; গত দেড়শ’বছরের মধ্যে জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশও এখন অবশিষ্ট নেই। শতাব্দী ধরে অর্জিত স্বতন্ত্রতা, স্বাভিমানী ভাব—এ সব এখন মগ্ধ রাজার সৈন্য বানাবার কাজে লাগানো হচ্ছে। একবার বড় রাজ্যের হাতে নিজেকে অর্পণ করলে তার হাত থেকে রেহাই পাওয়া বড় মুস্কিলের ব্যাপার।’
“বন্ধু নাগদত্ত! আমিও একদিন এই মতই পোষণ করতাম, কিন্তু এখন আমি মনে করি যে, ছোট ছোট গণের যুগ আর নেই। আর বড় গণ (প্রজাতন্ত্র) ও সংঘ গড়ে তোলবার চিন্তা স্বপ্নমাত্র। যুগের প্রয়োজনাকেই মেনে চলা উচিত। কিন্তু তুমি কি পশ্চিমের যাবার জন্য তৈরি হচ্ছ?”
“হ্যাঁ, প্রথমে পার্শবদের দেশ। আমাদের মতো তাদেরও গণ আছে, তাই নিজের চোখে দেখতে চাই যে কিভাবে তারা মহান দারয়োশ ও তার বংশধরদের উদ্দেশ্য সফল হতে দেয়নি।”
“আর আমিও যাচ্ছি! প্রাচ্যকে দেখব। দেখব যে, সমস্ত জম্বুদ্বীপকে একত্রিত করার শক্তি মগধের আছে কি নেই। চল, আমরা পড়া শেষ করে ধর্নাজন ও পরিবারপোষণ করা যায় এমন জায়গায় গিয়ে কাজ করি। বন্ধু, তুমি আয়ুবেদশাস্ত্র পড়ে বৈত্য হয়ে ভালোই করেছ, কেন না কোথাও গিয়ে থাকবার পক্ষে এ খুবই লাভজনক বিদ্যা। আমি জানি না বলে এখন অনুতাপ হচ্ছে।”
“তুমি ওর চেয়ে ও লাভজনক জ্যোতিষ বিদ্যা এবং সামুদ্রিক তন্ত্রমন্ত্র জানো।”
“মিত্র! তুমি তো জানো, এ বিদ্যা স্রেফ ফাঁকিবাজী।”
“কিন্তু বিষ্ণূগুপ্ত, এই বিদ্যা সত্য কি মিথ্যা তাতে চাণক্যের কি যায় আসে!”
ছেলেবেলা থেকে এক সঙ্গে খেলাধূলা ও পড়াশুনার সাথী—তক্ষশিলার নাগদত্ত কাপ্য এবং বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্যের বিদ্যার্থী জীবনের এই শেষ দেখা। একাধিকবার তক্ষশিলা পার্শবদের হস্তগত হয়েছিল, আর তার স্বাধীনতা বাঁচাবার জন্য দু’জনেই নিজ নিজ বিবেচনা অনুসারে পথ খুজে বেড়াচ্ছিল।
২
চারিদিক বৃক্ষ-বনস্পতিবিহীন, ছোট ছোট নগ্ন পাহাড়। সেখানে সবুজের আশায় চোখ পিপার্সাত হয়ে উঠছিল। পাহাড়ের মাঝখানটায় বিস্তীর্ণ উপত্যকা—তার মধ্যেও কচিৎ কোথাও জল এবং বনস্পতির চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল। এই উপত্যকার ধারে ধারে সার্খের (ক্যারাভ্যাম) রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে সর্বদা লোক যাওয়া-আসা করত। আর সার্থ এবং তার পশুদের আরামের জন্য পাস্থাশালা নির্মিত হয়েছিল। আশেপাশের অবস্থা দেখে এ রকম আশা করা যেত না যে এই পান্থশালায় সমস্ত সুখ-সুবিধা আছে। এই মরুভূমিতে এত জিনিস কোথা থেকে আসা তা জানা যায়নি। এই পর্বতের মধ্যে একাধিক পান্থশালা ছিল; তাদের কোনোটা সাধারণ রাজকর্মচারীদের জন্য, কোনোটা সৈনিকদের আবাসস্থল, কিছু ব্যবসায়ীদের জন্য, আর একটা থাকত বাদশাহ্দের প্রাস্থ-প্রাসাদ হিসেবে। সেখানে শাহ্আর তাঁর ক্ষত্রপরা বিশ্রাম করত।
আজ বাদশাহী পাস্থ-প্রাসাদের কেউ এসেছে। পান্থশালার আস্তাবলে ঘোড়া বাঁধা, আঙ্গিনায় অনেক দাস-কর্মচারী। কিন্তু সকলের চেহারায় ঐদাস্যের ভাব ফুটে উঠছিল। এত লোকের সমাগমেও পান্থ-প্রাসাদ আশ্চর্য রকমের নীরবতায় মগ্ন। এমন সময় দরজা দিয়ে হস্তদস্ত হয়ে তিনজন রাজকর্মচারী বেরিয়ে এল এবং তারা সাধারণ পান্থশালার মধ্যে ঢুকে পড়ল। তাদের বহু মূল্যের বস্ত্র ও আভিজাত্যপূর্ণ চেহারা দেখার সঙ্গে সঙ্গে অন্য লোকেরা ভয় ও সম্মানের সঙ্গে একধারে সরে দাঁড়াল। সেখানে কোনো বৈদ্য আছে কিনা তারা প্রশ্ন করল। অবশেষে সাধারণ পান্থশালার খবর পাওয়া গেল যে, সেখানে একজন হিন্দু বৈদ্য আছে।
এখানে এমনিতেই বৃষ্টি কম তাতে বর্ষাঋতু অনেক আগেই শেষ হয়েছে। মনাক্কা, বাদাম, আঙ্গুর, খরমুজের মতো ফল সস্তায় বিক্রী হচ্ছিল। রাজকর্মচারীটি যখন বৈম্ভের নিকট গেল তখন সে একটি বড় খরমুজ কাটছিল। তার আশেপাশে তারেই মতো ভিক্ষুকের বেশে আরও অনেক বসে ছিল, তাদের সামনেও খরমুজ। রাজকর্মচারীকে দেখেই অন্যান্যরা ভর্য়াত হয়ে সরে দাঁড়াল।
একজন বলল,“প্রভূ! ইনি হিন্দু বৈদ্য।”
বৈদ্যের ময়লা কাপড়ের দিকে তাকিয়ে রাজকর্মচারীর মুখে একটু বিরক্তি প্রকাশ পেল। পুনরায় সে তার চেহারার প্রতি তাকাল। তার চেহারা ওই কাপড়ের সঙ্গে মানাচ্ছিল না। তার মূখে ভয় ও দৈন্যের লেশমাত্র নেই। তার নীল চোখের দীপ্তি রাজকর্মচারীটিকে প্রভাবিত করল। তার ললাটের কুঞ্চিত ভাব বিলীন হয়ে গেল। সে কিছুটা শিষ্ট স্বরে প্রশ্ন করল,“তুমি বৈদ্য?”
“হ্যাঁ।”
“কোথাকার?”
“তক্ষশিলার।”
তক্ষশিলার নাম শুনে রাজকর্মচারী আরও নম্র হয়ে বলল, “আমাদের বক্ষু-সোগ্দেরক্ষত্রপের স্ত্রী শাহানশাহের বোনের অসুখ। তুমি তার চিকিৎসা করতে পারবে?”
“কেন পারব না,আমি তো বৈদ্য।”
“কিন্তু, তোমার এই পোশাকে?”
“পোশাকে তো আর চিকিৎসা করবে না, চিকিৎসা করব আমি।”
“কিন্তু, এ খুব বেশী ময়লা।”
“আজ আমার এগুলি বদলাবারই কথা। এক মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা কর”—বলে বৈদ্য পরিহিত বস্ত্রের চেয়ে পরিস্কার একটি পশমের চোগা পরল, এবং হাতে ঔষধের মোড়ক ভর্র্তি একটি চামড়ার থলি নিয়ে রাজকমচারীর সঙ্গে চলল।
বাদশাহী পান্থশালার অঙ্গনে গাধার বিষ্ঠা কিংবা ভিখারী ঠগদের কোনো আস্তানা ছিল না। সেখানকার সব জায়গাই পরিষ্কার। ওপরে যাওয়ার সিঁড়িতে নানা রঙের গাল্চে বিছানো, সিঁড়ির দু’দিকটায় সুন্দর কারুকার্য করা এবং ঘরের মেঝেতে মহামূল্যবান ফরাস বিছানো। দরজায় দ্বিধাবিভক্ত সূক্ষ্ম পর্দা ঝোলানো, তার পাশে মার্বেল পাথরের মূর্তির মতো অনেক সুন্দরী নীরবে দাঁড়িয়ে। দরজায় গিয়ে রাজকর্মচারী বৈদ্যকে দাঁড়াবার জন্য ইশারা করল এবং একটি সুন্দরীর কানে কানে কিছু বলল। সে খুব আস্তে আস্তে দরজা খুলল। ভিতরকার পর্দার জন্য সেখানটায় কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তরুণী ফিরে এল এবং বৈদ্যকে তার সঙ্গে যেতে বলল।
ঘরের ভিরে ঢুকতেই মধুর সুগন্ধের সুরভি বৈদ্যের নাকে এল। ক্ষিপ্র দৃষ্টিতে সে ঘরের চারিদিকে তাকাল। গৃহসজ্ঝার নিপুণতায় সূক্ষ্ম রুচির পরিচয় বহন করছিল। ফরাস, পর্দা, মসনদ, দীপদানী, চিত্র এবং মূর্তিগুলি সবই এ রকম ভাবে সাজানো ছিল যে, বৈদ্যি ইতিপূর্বে কখনও দেখেনি। সম্মুখে একটি গদীর ওপর দেওয়ালের পশে দু’তিনটি মসনদ ছিল, তার একটিতে একজন মাঝারি বয়সের বয়সের স্থুলকারয় পুরুষ বলে। তার আকর্ণবিস্তৃত গোঁফে শাদা রঙ ধরেছি। তার পিঙ্গল চোখে রাত্রি জাগরণও তীব্র দুশ্চিন্তার ছাপ। তার কাছে এক অনুপম সুন্দরী রমণী উপবিষ্ট যার রঙ মাখনের মতোই নয়, মাখনের চেয়েও অধিক কোমল বলে মনে হচ্ছিল। তার কপোলের ওপরটা ছিল হালকা লাল কিন্তু এখন তা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। পাতলা ঠোঁটের সঙ্গে শুক চঞ্চুরই উপমা দেওয়া যায়। ধমুকের মতো বাঁকা ক্ষীণ ভ্রু-যুগল সোনালী ;তায় দীর্ঘ পক্ষবিশিষ্ট নীল চোখ বিষন্ন ও আরত্তিম । কেশদাম সুবর্ণ সূক্ষ জালে সজ্জিত। সোনালী ভেলভেটের কাঁচুলি ও লাল লালোয়ার তার অঙ্গাবরণ। সেই অনিন্দাকান্তি অঙ্গে মণিমুত্তার অলস্কার বাহূল্য মনে হচ্ছিল। এ দু’জন ছাড়াও ঘরের ভেতর আরও অনেক সুন্দরী দাড়িয়ে ছিল। তাদের চেহারা ও বিনীতভাব দেখে বৈদ্য বুঝতে পারল যে, এরা সবাই ক্ষত্রপের অন্তঃপুরপরিচারিকা। পুরুষ বলতে সেখানে শুধু ক্ষত্রপই ছিল। সে একবার বৈদ্যের মাথা হতে পা পর্যন্ত দেখল কিন্তু তার নীল নেত্রের দিকে তাকিয়ে ক্ষত্রপের বুঝতে অসুবিধা হল না যে, যদি আমি আমার পোশাক একে পরিয়ে দিই তা’হলে এই পশুপুরীর (পর্সপোলীস) সুন্দরতম তরুণদের মধ্যে তাকে ও একজন বলে গণ্য করা যাবে।
ক্ষত্রপ বিনীতভাবে বলল,“তুমি তক্ষশিলার বৈদ্য?”
“হ্যাঁ, মহাক্ষত্রপ!”
“আমার স্তীর খুব অসুখ। কাল থেকে অবস্তা অত্যন্ত খারাপের দিকে। আমার নিজের দু’জন বৈদ্যের ঔষধের কোনো ফলই দেখা যাচ্ছে না।”
“আমি ক্ষত্রপের স্তীকে দেখবার পর বৈদ্যদের সঙ্গে কথা বলতে চাই।”
“তারা এখানে উপস্তিত আছে । আচ্ছা, তবে চল-ভেতরে যাই।”
শ্বেতপাথরের দেওয়াল থেকে যেমনি শ্বেত পর্দাটা সরিয়ে দেওয়া হল, তখনই ভেতরে যাবার রাস্তা দেখা গেল! ক্ষএপ এবং ষোড়শী আগে আগে—বৈদ্য তাদের পেছনে পেছনে চলল। ভিতরে হাতীর দাঁতের পায়াওয়ালা একটি পালঙ্কে বিছানা, তার ওপর ফেনসদৃশ কোমল সাদা শয্যার ওপর রোগিণী শুয়ে ছিল। তার শরীর শ্বেত কদলী-মৃগচর্মের আবরণে ঢাকা শুধুমাত্র চিবুকের উপরিভাগ খোলা। ক্ষত্রপকে আসতে দেখে পরিচারিকা সরে দাঁড়াল। বৈদ্য কাছে গিয়ে দেখল, রোগিণীর চেহারার সঙ্গে ষোড়শীর চেহারায় অবিকল মিল কিন্তু তার তরুণ সৌন্দর্যের স্থলে রোগিণীর ভেতর প্রৌঢ়াবস্থার প্রভাব এবং তার ওপর আবার দীর্ঘ রোগভোগের ঝড়-ঝাপটার চিহ্ন। তার লাল টুকটুকে ঠোঁট এখন ফিকে, পরিপুষ্ট গাল বসে গিয়েছে। চোখ কোটরে ঢুকে গেছে। ক্ষত্রপ মুখ কাছে নিয়ে গিয়ে বলল,“অফ্শা!”
রোগিণী একটুখানি চেয়েই আবার চোখ বন্ধ করল।
বৈদ্য বলল, “আংশিক মূর্চ্ছা।” সে তার হাত বের করে নাড়ী দেখল—বড় কষ্টে নাড়ী পেল। শরীর প্রায় ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল।
ক্ষত্রপ, বৈদ্যের মুখ গম্ভীর হতে দেখল। বৈদ্য একটু ভেবে বলল,“একটুখানি দ্রাক্ষা সুরা চাই, যত বেশী পুরনো হয় ততই ভালো।”
ক্ষত্রপের নিকট এর অভাব ছিল না। রক্তের মতো লাল পুরনো দ্রাক্ষা সুরায় পরিপূর্ণ শুভ্র কাঁচের ঘড়া নিয়ে আসা হল—আর তার সঙ্গে এল মণিমুক্তা খচিত সোনার চষক (পেয়ালা)। বৈদ্য একটি পুঁটলী খুলল এবং ডান হাতের আঙ্গুলের বড় নখ দিয়ে এক রত্তি ওষুধ বের করে রোগিণীকে হাঁ করাতে বলল। হাঁ করাতে ক্ষত্রপের বেশী কষ্ট হল না। সে ঔষধ মুখের ভেতর ঢেলে দিয়ে এক ঢোক সুরা মুখে ঢেলে দিল, রোগীকে গিলতে দেখে বৈদ্য সন্তুষ্ট হয়ে ক্ষত্রপকে বলল, “এখন আমি বাইরে মহাক্ষত্রপের বৈদ্যদের সঙ্গে দেখা করতে চাই, কিছুক্ষণ পরে মহাক্ষত্রপানী চোখ মেলবেন তখন আমার কাছে থাকা প্রয়োজন।” বৈদ্য অন্য ঘরে পার্শব বৈদ্যদের সঙ্গে পরামর্শ করল। রোগিণী সোগ্দ (পার্শব) থেকে আসার সময় যে জর নিয়ে এসেছিল, তখন হতে আজ পর্যন্ত অবস্থা পার্শব বৈদ্যরা বর্ণনা করল। এই সময় পরিচারিকা এসে সংবাদ দিল যে প্রভুপত্নী মহাক্ষত্রপকে ডাকছেন। মহাক্ষত্রপের চেহারার ওপর দিয়ে নতুন আশার ঝলক বয়ে গেল। বৈদ্যকে সঙ্গে করে ভেতরে গেল। ক্ষত্রপানীর চোখ সম্পূর্ণ খোলা—তার চেহারায় জীবনের স্পন্দন দেখা যাচ্ছিল।
ক্ষপত্র বলল,“এ কথা আমাকে এ হিন্দু বৈদ্যও বলেছিল।”
আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠে ক্ষত্রপানী বলল,“হিন্দু বৈদ্য শুনেছে—কি আমার অসুখ; আমার অসুখ কি সেরে গেছে বৈদ্য?”
“হ্যাঁ, অসুখ সেরে গেছে, কিন্তু মহাক্ষত্রপানী! একটু বিশ্রাম নিতে হবে। আমি ভাবছি যে কত তাড়াতড়ি আপনাকে পর্শুপুরী যাওয়ার উপযুক্ত করে তোলা যায়; আমার নিকট অভূতপূর্ব রসায়ন আছে, হিন্দুদের রসায়ন আপনাকে দিচ্ছি। একটু একটু দ্রাক্ষা এবং ডালিমের রস দিয়ে খেতে হবে।”
“বৈদ্য! তুমি রোগ চেন, অন্যরা তো গাধার চেয়ে গাধা! তোমার নির্দেশ মতোই চলব। রোশনা!”
ষোড়শী সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “মা।”
“বেটি! তোমার চোখের জল মুছে ফেল। ওই হাকিমগুলো আমাকে মেরে ফেলত। কিন্তু এখন আর কোনো চিন্তুা নেই। হিন্দু বৈদ্যকে অহ্বর মজদা পাঠিয়েছেন। এর যেন কোনো কষ্ট না হয়। বৈদ্য আমাকে যা খেতে বলবে তা তুমি নিজ হাতে আমাদে দিও।”
বৈদ্য রোশানাকে কয়েকটি কথা বলে বাইরে চলে গেল। ক্ষত্রপের চেহারা ম্লান হয়ে গিয়েছিল। বৈদ্য কিছু ঔষধ ভুর্জপত্রের টুকুরোয় বেঁধে ক্ষত্রপের নিকট দিয়ে যখন নিজে পান্থশালায় ফিরে যেতে চাইল তখন ক্ষত্রপ বলল,“আমাদের সঙ্গেই তুমি থাক।”
“কিন্তু আমি দরবারে থাকবার পদ্ধতি জানি না।”
“তবুও মানুষের-সঙ্গে থাকার আচার-ব্যবহার তুমি ভালোই জানো। ভিন্ন ভিন্ন জাতির ভিন্ন আচার ব্যবহার।”
“আমি থাকলে আপনার পরিচারিকাদের কষ্ট হবে।”
“আমি একদম আলাদা একটি তোমাকে দিচ্ছি। ুমি কাছে থাকলে আমি নিশ্চিত থাকব।”
“মহাক্ষত্রপানীর জন্য আর কোনো চিন্তার কারণ নেই। হাকিমরা অসুখ ঠিকমতো নির্ধারণ করতে পারেনি। আমি আর দু’ঘণ্টা পরে এলে বাঁচবার কোনো আশা ছিল না। কিন্তু তাঁর অসুখ সেরে গেছে।”
ক্ষত্রপের আগ্রহের জন্য বৈদ্য বাদশাহী পান্থশালায় থাকতে রাজী হল।
ক্ষত্রপানী চতুর্থ দিন থেকে উঠে বসতে লাগল এবং তোর চেহারার ম্লানতা খুব তাড়াতাড়ি মিলিয়ে যেতে লাগল। সবচেয়ে প্রসন্ন হল রোশনা। দ্বিতীয় দিন সে ক্ষত্রপের দেওয়া তার নিজের মহামূল্য দু’বছরের চোগাটি (পরিধেয় বস্ত্রখণ্ড) এনে বৈদ্যকে দিল। আজকের এই চোগা, সোনালী কোমর বন্ধনী আর স্বর্ণখচিত পাদুকায় সজ্জিত নাগদত্তের সঙ্গে সেদিনের সেই খরমুজ-খাওয়া লোকটির মিল ছিল না।
ক্ষত্রপানী এখন লঘু আহার গ্রহণ করতে আরম্ভ করেছে। ষষ্ঠ দিনের সন্ধ্যাবেলা সে বৈদ্যকে ঢেকে পাঠাল। বৈদ্যকে মহাক্ষত্রপানী কাছে এল বসতে বলল এবং বসার পরে বলল,“বৈদ্য! আমি তোমার নিকট বড়ই কৃতজ্ঞ। এই নির্জন পথিমধ্যে মজদা তোমাকে আমায় বাঁচাবার জন্য পাঠিয়েছেন। তোমার জন্মস্থান কোথায়?”
“তক্ষশিলা।”
“তক্ষশিলা ! খুব প্রসিদ্ধ নগর, বিদ্যার জন্য বিখ্যাত। তুমি তার রত্ন!”
“না, আমি সেখানকার একজন সাধারণ নতুন বৈদ্য।”
“কিন্তু তারুণ্য গুণের বৈরী নয়। তোমার নাম কি বৈদ্যরাজ?”
“না প্রদত্ত কাপ্য।”
“পুরো নাম বলা আমার পক্ষে কষ্টকর। নাগ বলাই যথেষ্ট, কেমন?”
“যথেষ্ট, মহাক্ষত্রপানী!”
“তুমি কোথায় যাচ্ছ?”
“এখন তো যাচ্ছি পর্শুপুরী(পর্সপোলীস)।”
থাকতে পেতে। কিন্তু সোফিয়া! তুমি আমাকে প্রভু বলো না। দাসপ্রথার কথা শুনলে আমার গায়ে জ্বর আসে।”
“কিন্তু আমি যে তোমার দাসী।”
“তুমি দাসী নও। আমি ক্ষত্রপ-দম্পতিকে বলে দিয়েছি যে, সোফিয়াকে আমি দাসত্ব বন্ধন থেকে মুক্ত করলাম।”
“তা’হলে এখন আর আমি দাসী নই!”
“না, তুমি এখন আমার মতোই স্বতন্ত্র ও স্বাধীন এবং এখন তুমি যেখানে যেতে চাইবে আমি তোমায় সেখানে পৌছিয়ে দিতে চেষ্টা করব।”
“কিন্তু, যদি তোমার কাছেই থাকতে চাই, তা’হলে তাড়িয়ে দেবে না তো?”
“সম্পূর্ণভাবে সেটা তোমার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে।”
“দাসত্ব মানুষকে কতই না খর্ব করে? পিতৃগ্রহে আমি আমাদের দাসদের দেখেছি, তারা আমোদ-প্রমোদ করত; কিন্তু আমি কখনও বুঝতে পারিনি যে তাদের হাসির মধ্যে এত ব্যথা লুকিয়ে ছিল। আমি যখন নিজে দাসী হলাম তখন অনুভব করলাম—দাসত্ব কি রকম নরক!”
“তুমি কেমন করে দাসী হলে, সোফী? যদি কষ্ট না হয় তবে বল।”
“আমার বাবা এথেন্স নগরের একজন সম্ভ্রান্ত নাগরিক ছিলেন। যখন স্যাসিযেনিয়ার রাজা ফিলিপ আমাদের নগর জয় করল, তখন বাবা পরিবারের লোকদের নিয়ে নৌকায় করে এশিয়ায় পালিয়ে এলেন। আমরা মনে করেছিলাম যে সেখানে আশ্রয় পাব, কিন্তু যে নগরে গিয়ে আমরা অবতরণ করলাম,কয়েক মাস বাদেই পার্শবরা তার ওপর আক্রমণ করল। নগরের পতন হল, আর পালানো-দৌড়ানোর মধ্যে কে কোথায় গিয়েছে, কত নাগরিককে পার্শবরা বন্দী করেছে জানি না। আমি দেখলাম, আমি সেই বন্দীদের একজন। আমি সুন্দরী ছিলাম, তার ওপর বয়সে তরুণী বলে তারা আমাকে সেনাপতির নিকট পাঠিয়ে দিল। সেনাপতির নিকট হতে বাদশার কাছে এলাম। বাদশার নিকট আমার মতো শত শত তরুণী ছিল, সে নিজের বোন আসছে শুনে আমাকে তার কাছে পাঠিয়ে দিল। যদিও আমি দাসী, কিন্তু নিজের রুপের জন্য খাস মহলের দাসী ছিলাম। তার জন্যই আমার অনুভূতি সাধারণ দাসীদের মতো হতে পারেনি, তবুও আমি জানি যে এর কি যাতনা! আমারও মনে হত যে আমি মানবী নয়।”
“তা’হলে সোফী, তোমার বাবার সঙ্গে আর দেখা হয়নি?”
“এখনও তিনি বেচে আছেন বলে আমার মনে হয়।এখন তো আমি হাওয়ায় ওড়ানো শুকনো ঝড়ো-পাতা। প্রিয় এথেন্স নগর ধ্বংস হয়ে গেছে, বাবা যদি এখনও জীবিত থাকেন তা’হলেও আমাদের মিলনের স্থান কোথায়?”
“এথেন্স কি মহানগরী, সোফিয়া?”
“একদিন ছিল! কিন্তু এখন তা ধ্বংসপ্রাপ্ত, আমাদের ‘গণ’ একদিন মহান দারয়োশদের কঠোর শিক্ষা দিয়েছিল তাকে ক্ষুদ্র ফিলিপ মাথা নত করতে বাধ্য করেছে।”
“কেন এমন হল সোফিয়া?”
“পার্শবদের অনেক আক্রমণের প্রতিকার করেও এথেন্সের কিছু মনীষীদের মাথায় খেয়াল চাপল যে, যতদিন পর্যন্ত আমরা পার্শবদের তুলা একটি বড় রাজ্য প্রতিষ্ঠা না করতে পারছি ততদিন আমাদের নিস্তার নেই।”
“আহা, তক্ষশিলা! তুমিও বিষ্ণুগুপ্তের মতো লোক সৃষ্টি করেছ!”
“তক্ষশিলা, বিষ্ণুগুপ্ত—এ সব কি, নাগ!?”
“তক্ষশিলা! আমার জন্মভূমি, আমাদের ‘গণ’ও মহানদারয়োশ এবং তাদের উত্তরাধিকারীদের অনেকবার মেরে তাড়িয়ে দিয়েছিল কিন্তু আমার সহপাঠী বিষ্ণুগুপ্ত এখন সেই কথাই বলছে যা একদিন ফিলিপের সাহায্যকারী এথেন্সের নাগরিকরা বলেছিল।”
“তক্ষশিলা ও কি আমাদের মতো ‘গণ’?”
“হ্যাঁ, ওইরুপ ‘গণ’! আর আমাদের তক্ষশিলায় কেউ দাস নেই, সেখানকার জমিতে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে সকলেই অ-দাস হয়ে যায়।”
“আহা, করুণাময়ী তক্ষশিলা! তাই নাগ, আমি প্রথম দিন থেকেই দেখছি যে দাসদের সঙ্গে ব্যবহার করতে তুমি জান না।”
“আর আমি কখনও তা তোমাকে জানতেও দেব না। আমি বিষ্ণুগুপ্তকে বলেছি যে, যদি তুমি মগধকে তক্ষশিলা গ্রাস করতে সাহায্য কর তা’হলে তক্ষশিলার পবিত্র ভূমি দাসত্বের কলঙ্ক-মুক্ত থাকবে না!”
“মগধ কি নাগ!”
“হিন্দের (হিন্দুস্থানের) ম্যাসিডোনিয়া—তক্ষশিলার পূর্বে এক বিশাল হিন্দুরাজ্য। পার্শবদের আক্রমণ আমরা প্রতিরোধ করে আসছি, কিন্তু জিতে জিতেও আমরা দুর্বল এবং হারার মতো হয়ে গেছি। বস্তুত তক্ষশিলা একা পার্শব শাহানশাহের মোকাবিলা করতে পারে না, কিন্তু আমি এর প্রতিরোধের একমাত্র প্রতিকার হিসেবে বলেছি, নিজেদের সমস্ত গণগুলিকে সংঘবদ্ধ হতে।”
“কিন্তু নাগ! আমাদের দেশে এও করে দেখা হয়েছে। আমাদের মতো হেল্লা জাতিকে দিয়ে ‘গণ-সংঘ’ তৈরী করে পার্শবদের মোকাবিলা করেছে কিন্তু সে সংঘ স্থায়ী হতে পারল না। ‘গণ-সংঘের’ মধ্যে নিজ নিজ গণের স্বতন্ত্রতার ওপর এত নজর যে, সেখানে সংঘকে ছেড়ে দিতে কেউ রাজি নয়।”
“তা’হলে কি আমিই ভুল প্রমাণিত হব এবং বিষ্ণুগুপ্ত সঠিক!”
“হ্যাঁ। সে বলে, আমাদের শত্রু যতটা শক্তিশালী গণের সীমা নষ্ট করে যদি একটি মহান ‘গণ’ তৈরী করা যায় তবে হয়ত সম্ভব হতে পারে, কিন্তু ‘গণ’ এ কথা স্বীকার করতে রাজী হবে না।”
“হয়ত তোমার বন্ধু ঠিকই বলেছে, নাগ! কিন্তু আমরা শেষ পর্যন্ত এথেন্সের স্বতন্ত্রতা ছেড়ে দেবার কথা মনে আসতে দিইনি।”
“তা’হলে সোফিয়া! ‘গণ’ হয়েও এথেন্স কেন এ দাসত্বকে স্বীকার করল?”
“নিজের পতন শীঘ্র ডেকে আনার জন্য। ধনীর লোভের জন্যই দাস-প্রথার প্রভাব বাড়ল এবং আস্তে আস্তে মালিকের চেয়ে দাসদের সংখ্যা বেড়ে গেল।”
“এখানে পার্শবদের ভেতর সব চেয়ে কোন প্রথা খারাপ বলে মনে হয়?”
“দাসত্ব, যা আমাদের ওখানেও ছিল। আর বাদশা এবং ধনীদের অন্তঃপুর।”
“তোমাদের ওখানে এ রকম হয় না?”
“আমাদের ওখানে ম্যাসিডোনিয়ার রাজা ফিলিপও একাধিক বিয়ে করতে পারে না। এখানে তো ছোট রাজকর্মচারীও বহু বিবাহ করে।”
“আমাদের দেশেও একধিক বিয়ে দেখা যায়, যদিও তার সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু আমি একে স্ত্রীজাতির দাসত্বের নিদর্শন বলে মনে করতাম। এথেন্স যদি দাসত্ব-প্রথা চালু করে থাকে তবে তক্ষশিলাও বহুবিবাহ প্রথা চালু রেখে সেই একই অন্যায় করেছে।”
“আর অল্পসংখ্যক ঘরেই সম্পদ জমা হওয়া?”
“আমি বিষ্ণুগুপ্তকে বলেছিলাম,‘গণ’-এ এত ধনররত্ন থাকতেও কেন অন্যের শ্যীবৃদ্ধি হচ্ছে না। তুমি রাজার মতো জলের ন্যায় ধন-সম্পদ উড়িয়ে দিতে পার না। এখানে তো তুমি দেখছ সোফী! মূল্যবান মৃগচর্ম, মণি, মুক্তা ইত্যাদি বস্তুর সঙ্গে কি রকম ব্যবহার। এ গোলাপী গাল, এ প্রবাল অধর একবার মনেও করে না যে, এগুলি উৎপন্ন করতে কত সহস্র লোক না খেয়ে মরেছে! আমাদের ঘরের পড়ে যাওয়া জল নিয়েই সমুদ্রের জলরাশি। মাটিতে যারা সোনা ফলায় তারা মরছে না খেয়ে, আর সোনাকে যারা মাটি করে দেয় তারা খাবার নষ্ট করছে। আমি যতবার বাদশার কছে গিয়েছি—প্রত্যেকবারই ফেরবার সময় আমার মাথা ধরেছে। আমি সমস্ত সমৃদ্ধি ভেতর শীতে জমে, গরমে জল হয়ে মরবার মাসুষ ওই কর্মকারদের দুঃখের নিশ্বাস ফেলতে শুনি, আমাকে সতর্ক করে যাওয়া তাদের লাল মদিরা প্রজাদের রক্ত রুপে দেখা যাচ্ছে। পশুপুরীতে আমার তিক্ততা এসেছে তাই তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালাতে চাই!”
“কোথায় যেতে চাইছ নাগ?”
“প্রথমে তোমার মতামত জানতে চাই।”
“কোথায় আমি বলব!”
“যবন-লোক(গ্রীস)?”
“খুব ভালো হয়।”
“তবে সেদিকেই যাব।”
“কিন্তু, রাস্তায় আবার আমাকে কেউ যদি কেড়ে নেয় এবং তারপর নাগের মতো ত্রাণকর্তা যদি না পাই!” সোফিয়ার কণ্ঠস্বর খুবই নরম, তার সুন্দর আয়ত নয়ন বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল।
নাগদত্তের তার কানের ওপর ঝুলে-পড়া সোনালী চুলগুলিকে স্পর্শ করে বলল,“আমি তার উপায় ঠিক করে রেখেছি কিন্তু তার জন্যে তোমারও সম্মতি প্রয়োজন।”
“কি?”
“ক্ষত্রপ, ক্ষত্রপানী এবং শাহানশাহার নিকট হতে আমার জন্য চিঠি নিয়ে নেব যে, এ শাহানশাহার সম্মানিত হিন্দু বৈদ্য।”
“তা’হলে আর আমাকে কেউ কেড়ে নেবে না?”
“আর যদি তুমি পৃথিবীসুদ্ধ লোককে দেখাবার জন্য বৈদ্যের স্ত্রী হতে চাও, তা’হলে চিঠিতে তোমার নামও লিখিয়ে নেব।”
সোফিয়া ছল-ছল চোখে নাগদত্তের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, “নাগ! তুমি কত উদার, তোমার মনের গভীরতা তুমি জানাতে চেষ্টা কর না। তুমি কত সুন্ধর কিন্তু তুমি কখনও এখানে তোমার প্রতি আকৃষ্টা পুষ্পরাগ এবং নীলিমা চোখে দেখনি? নাগ! রোশনা কতবার আমারকাছে তোমার জন্য প্রেম নিবেদন করেছে! তার কোন এক আধমরা ভাই আছে তাই তার বাপ-মা চায় রোশনকে তার সঙ্গে বিয়ে দিতে, কিন্তু সে চায় তোমাকে।”
“ভালোই হয়েছে যে আমি জানিনি, জানলে অস্বীকার করতে হত। সোফিয়া! আমি প্রাসাদপোষিতাদের জন্য নয়। আমি বোধহয় কারুর জন্যেই নয়। আমার সঙ্গে যে প্রেম করবে তার সুখ-নিদ্রার সুযোগ ঘটবে না। কিন্তু যদি তুমি চাও তবে শাহানশাহার চিঠিতে তোমার নাম নিজ স্ত্রী বলে লিখিয়ে নেব। যবন দেশে যদি তোমার কোনো প্রিয়পাত্র জুটে যায় তা’হলে তোমাকে নিজের পথ দেখতে হবে।”
বৈদ্য নাগদত্তের সব জায়গা থেকেই ডাকা আসত। সে হিন্দু বৈদ্য পার্শব শাহান-শাহ দারয়োশের একদা চিকিৎসক ছিল, আর তার চিকিৎসা ছিল অদ্ভুত রকমের।
পর্শুপুরীতে থাকাকালীন সে যবন-ভাষা শিখেছিল, তার ওপর সোফিয়া তার সহচারিণী। সে ম্যাসিডোনিয়া ঘুরে দেখল এবং ফিলিপের পুত্র অলিকসুন্দরের গুরু আরিস্টোটলের সঙ্গে পরিচিত হল।
নাগদত্ত নিজেও একজন দার্শনিক কিন্ত ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে আরিস্টোটলের শাহানশাহী তত্ত্বের সঙ্গে তার মতভেদ ছিল। তবুও সে আরিস্টোটলের প্রতি বিশেষ সম্মান দেখিয়ে ম্যাসিডোনিয়া থেকে বিদায় নিল। আরিস্টোটলের যে চিন্তাধারা তার পছন্দ হয়েছিল তা হল, সত্যের পরীক্ষার জন্য বুদ্ধি নয়, জাগতিক পাদর্থেরই প্রয়োজন। আরিস্টেটল প্রয়োগ-প্রমাণিত বস্তুকে উচ্চে স্থান দিত। নাগদত্তের আফসোস ছিল এ জন্য যে, ভারতীয় দার্শনিকরা সত্যকে মন থেকে সৃষ্টি করতে চায়। নাগদত্ত অরস্তর শিষ্য মনস্বীর অনেক প্রশংসা তার গুরুর মুখে শুনেছে এবং সে নিজেও কতবার তার বিষয়ে কথাবার্তা বলেছে। সেই তরুণের মধ্যেশুধুমাত্র অসাধারণ শৌষই ছিল না ছিল অসাধারণ বিচারশক্তিও। নাগদত্ত এথেন্স গিয়ে ফিরে আসার জন্য আরিস্টেটলের কাছ থেকে ছুটি নিয়েছিল, কিন্তু যবন দার্শনিকের সঙ্গে এই তার শেষ দেখা,তা সে কি করে জানবে!
বীরের জননী, গণতন্ত্রের বিজয়ধ্বজাধারিণী এথেন্স নগরে সে ততটাই শ্রদ্ধা ও প্রেমের সঙ্গে উপস্থিত হল যতটা যে তক্ষশিলার জন্য করত। নগর পুনরায় উর্বর হয়েছিল কিন্তু সোফিয়া বলল যে, এখন সেই পুরনো এথেন্স নেই। বেন্স জুপিটারের মন্দির এখনও অমর কারকার্যের সুন্দর কীর্তিতে অলঙ্কৃত। কিন্তু সোফিয়া একদিন এথেন্স নাগরিকদের প্রাণে যে উৎসাহ,যে জীবন-স্পন্দন দেখেছিল আজ আর তা নেই।
সোফিয়ার বাবার জমির ওপর তৈরী ঘরের মালিক একজন ম্যাসিডোনিয়ার ব্যবসায়ী। সে ঘর দেখে সোফিয়া এতদূর উদ্বিগ্ন হল যে, সে নিজেই তার স্বভাব-গাম্ভীর্যের বিরুদ্ধাচরণ করল। কিন্তু, সে কথা কম বলত। কখনও তার চোখ অশ্রুজলে ভরে যেত আবার কখনও সে পাথরের মূর্তির মতো হয়ে থাকব। নাগদত্ত বুঝতে পারল যে, নিজের প্রিয় বাল্যস্থানের ঐ রকম অবস্থা দেখে তার মনে বিকার জন্মেছে। শেষটায় সোফিয়ার মর্মান্তিক শোকচ্ছায়া নাগদত্তকেও আচ্ছন্ন করে ফেলল।
যখন সোফিয়া প্রকৃতিস্থ হল তখন সে একদম বদলে গেল। নিজের সাজ-সজ্জার ওপর তার কখনও বিশেষ খেয়াল ছিল না। কিন্তু এখন সে গণতন্ত্রী এথেন্সের তরুণীদের মতো নিজের খোলা সোনালী চুলগুলিকে ফুলের মালা দিয়ে খোঁপা বাঁধতে লাগল। তার শরীরের ওপর যবন-সুন্দরীদের পা পর্যন্ত ঝোলানো বিশেষ পছন্দ-করা সুন্দর কঞ্চুক এবং পায়ে অনেকগুলি ফিতা-যুক্ত স্তান্ডেল পরল। তার সুন্দর সাদা কপাল, লাল টুকটুকে ঠোঁটের তারুণ্যে—সৌন্দর্য এবং স্বাস্থ্যের অদ্ভুত সংমিশ্রণ ছিল। নাগদত্ত আশ্চর্য হল না বরং অপার আনন্দ লাভ করল।
এ ব্যাপারে নাগদত্ত একদিন প্রশ্ন করায় সোফিয়া বলল; “প্রিয় নাগ! আমি এতদিন পর্যন্ত জীবনটাকে একমাত্র শোক এবং অতীত চিন্তার বস্তু বলে মনে করে এসেছি কিন্তু এখন সে ধারণা আমার ভুল বলে মনে হচ্ছে। জীবন সম্বন্ধে এ রকম একপেশে দৃষ্টিভঙ্গী জীবনের মূল্যকে কমিয়ে দেয় ্বংে কার্য-ক্ষমতাকেও দুর্বল করে ফেলে। নাগ! শেষ পর্যন্ত তুমিও তক্ষশিলার ভবিষ্যতের জন্য কম চিন্তা করছ না, তবে তুমি মাথা ঠাণ্ডা রেখেই উপায় উদ্ভাবনের জন্য সমস্ত শক্তি নিয়োগ করছ।”
“সোফী! তোমাকে এতটা আনন্দিত দেখে আমি খু্বই খুশি।”
“কেন আনন্দ হবে না, আমি এথেন্সে ফিরে এসে নিজের প্রিয়কে খুঁজে পেয়েছি।”
নাগদত্ত হর্ষোল্পাসে পুলকিত হয়ে বলল,“খুবই আনন্দের কথা যে, তুমি এতদিন পরে নিজের প্রেয়কে ফিরে পেয়েছ।”
“নাগ! আমি দেখছি যে তুমি মানুষ নও, দেবতাদের চেয়েও বড়, ঈর্ষা তোমাকে স্পর্শ করতে পার না।”
“ঈর্ষা! ঈর্ষার এখানে প্রয়োজন কি? সোফী! আমি কি তোমাকে যবন দেশে পৌঁছে দেবার দাসিয়ত্ব নিইনি? আমি কি তোমাকে বলিনি যে, তুমি সেখানে গিয়ে তোমার প্রিয়কে খুঁজে নিও?”
“হ্যাঁ তা বলেছিলে।”
“তোমার এ অস্বাভাবিক আনন্দ দেখে আমার মনে হচ্ছিল যে, তুমি নিশ্চয়ই অসাধারণ কোনো প্রিয় বস্তু পেয়েছ।”
“তোমার মনে করাটা ঠিকই নাগ!”
“তা’হলে তোমার প্রিয়তমকে এখানে নিমন্ত্রণ করবার কিংবা যদি সে এখানে না আসতে পারে তবে সেখানে গিয়ে দেখা করবার অনুমিত আমাকে দাও।”
“কিন্তু, তুমি এতটা উতলা হচ্ছ কেন?”
“সত্যিই কি আমি অস্থির হচ্ছি? তুমি ভূল বলছ না?” নাগদত্ত নিজেকে সামলিয়ে নিতে চেষ্টা করল।
সোফিয়ার ভয় হতে লাগল যে পাছে সে অশ্রু সম্বরণ করতে না পারে। সে অন্যদিকে মুখফিরিয়ে বলল, “দেখা করতে পার কিন্তু তোমাকে এথেন্সের তরুণের বেশ ধারণ করতে হবে।”
“বেশ, কাল তুমি যে নতুন স্যাণ্ডেল কিনে এনেছআমি তা পরে নেব।”
“যাও, পরে এস, ইতিমধ্যে আমি আমার প্রিয়তমের জন্য মালা নিয়ে নিচ্ছি—লিদিয়া তার জন্যে মালা গাঁথছে।”
“বেশ”—বলে নাগদত্ত অন্য ঘরে চলে গেল। সোফিয়া বৈঠকখানার বড় আয়নার সামনে দাঁঢ়াল। সে নিজের কাপড় এবং ফুলে ভূষণের ওপর একবার হত বুলাল, আর একগাছা মালা আয়নার পিছনে রেখে আস্তে করে ঘরের দরজায় গিয়ে বলল,“নাগ! দেরী হয়ে যাচ্ছে, আমার প্রিয়তম আবার কোনো প্রমোদশালায় চলে না যায়!”
“তাড়াতাড়ি করছি সোফী?”
“আমি সাহায্য করব?”
“সে তোমার দয়া।”
নাগদত্ত নতুন স্যান্ডেল পরল। নাগদত্তের মুখের দিকে চাইতে সোফিয়ার সাহস হল না। সে তার হাত ধরে বলল,“ প্রথমে আয়নায় নিজের নতুন পোশাক দেখে নাও।”
“তুমি তো দেখে দিয়েছ সোফী! সেটাই ভালো। বিনীত পোশাকই প্রয়োজন।”
“হ্যাঁ, আমার তো বিনীত-পোশাক বলেই মনে হচ্ছে কিন্তু একবার দেখে নেওয়াটা মন্দ নয়।” সোফিয়া নাগদত্তকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল, নাগদত্ত তার নিজের পোশাক দেখতে লাগল। তখন সোফিয়া মালা বের করে বলল, “এ মালা ইম প্রিয়তমের জন্য তৈরী করেছি।”
“বেশ সুন্দর মালা সোফী!”
“জানি না, তার কি রকম লাগবে—তার দূসর চুলে লাল টুকটুকে গোলাপ মালা।”
“সুন্দর দেখবে।”
“তোমার মাথার ওপর রেখে একটু দেখব?”
“সেটা তোমার ইচ্ছা। আমারও চুল ধূসর।”
“তাই তো পরীক্ষা করে নিতে চাই।” মালা নাগদত্তের মাথার ওপর রেখে তাকে জিজ্ঞাসা করল,“তা’হলে তুমি আজ আমার প্রিয়তমকে দেখতে চাও নাগ? এখুনি দেখতে চাও তো এই দেখ।”
আয়নায় নাগদত্তের প্রতিবিম্ব পড়ল। সোফিয়া জলভরা চোখে বলল, “এই আমার প্রিয়তম!” আর পরক্ষণেই নিজের বাহুপাশে নাগদত্তকে বেঁধে তার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট মিলিয়ে দিল। নাগদত্ত কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। সোফিয়া তখন ঠোঁট সরিয়ে নিজের কপোল নাগদত্তের কপোলের সঙ্গে মিলিয়ে বলল,“আমার প্রিয়তম!”
“সোফী! আমি নিজেকে তোমার যোগ্য বলে মনে করি না।”
“নিজেকে আমি জানি। নাগ, এখন থেকে আমৃত্যু তোমার সঙ্গেই থাকব।”
নাগদত্তের অশ্রুর বাঁধ ভেঙে পড়ল, সে বলল, “মৃত্যু পর্যন্ত!”
৫
সলামীসের উপসাগর, যেখানটায় যবন নৌ-সৈন্যরা পার্শবদের বড় একটা যুদ্ধে পরাজিত করেছিল। নাগদত্তের খুবই ইচ্ছা ছিল সেটা দেখার। দু’জনেই পথা চলছিল। নাগদত্ত নিজের ভেতর নতুন উৎসাহ পাচ্ছিল এবং আস্তে আস্তে তার মন তক্ষশিলার দিকে ধাবিত হচ্ছিল। যখন দু’জনে রাস্তায় একটি গাছের নীচে বিশ্রাম করছিল তখন সোফিয়া বলল, “নাগ! ফিলিপ মারা গেছে, অলিকসুন্দর ম্যাসিডোনিয়ার রাজা হয়েছে আর সে শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী তৈরী করছে।”
“হ্যাঁ, সে সমস্ত যবন সাগরের (ভূমধ্য) পার্শ্ববর্তী অঞ্চল অধিকার করতে চাইছে। তার মধ্যে পূর্ব এবং দক্ষিণ (মিশর) অঞ্চল তো পার্শবদের হাতে।”
“তার মানে হল যে, সে পাশবদের সঙ্গে যু্দ্ধ করতে চায়।”
“আর এইভাবে গণতন্ত্রী যবনদের নিকট হতে নিজ রাজ্যে প্রতিষ্ঠায় সাহায্য নিয়ে এক ঢিলে দু’পাখী মারতে চায় সোফিয়া! শাহানশাহের যবন সাগর থেকে হটে যেতে হবে যদি স্বাদীনতা-প্রেমী যবনগণকে রাজভক্ত করানো সম্ভব হয়।”
“এ সবই আরিস্টোটলের শিক্ষা যা, তার সাহস বাড়াল!”
“র্দাশনিক আরিস্টোটল!”
“হ্যাঁ,আর তার গুরু প্লেটো একটি আর্দশ ‘গণ’-এর কল্পনা করেছিল কিন্তু সেও তাতে সাধারণ জনাতাকে রাখতে চেয়েছিল। আরিস্টোটল আদর্শ গণের জায়গায় আদর্শ রাজচক্রবর্তীর কল্পনা করে। কি জানি এই যবন-চক্রবর্তীর সন্ধানে বেরিয়েছে।”
“যবন এবং হিন্দু চক্রবর্তীদের সিন্ধুতীরে মিলন হবে না-কি?”
“হবে,প্রথম কিংবা দ্বিতীয় পুরুষে। কিন্তু পৃথিবী তখন কত ছোট হয়ে যাবে!”
সমুদ্র তীর হতে তারা নৌকায় করে সলামীসের দিকে রওনা হল। সমুদ্র শান্ত, বাতাস একেবারেই বন্ধ। সোফী এবং নাগদত্ত দু’জনেই বিগত শতাব্দীর ধ্বংস করতে সাহায্য করেছিল। অনেক দূর চলে যাওয়ার পর খুব বড় তুফান উঠল। দু’জনেরই মনে হল, যেন বিগত শতকের ঐতিহাসিক তুফান কিন্তু তখনই তাদের দৃষ্টি ভয়ভীত নৌকারোহীদের ওপড় পড়ল। আর দেখল যে পাল ছিঁড়ে গেছে এবং নৌকা ডুবছে।
সোফিয়া নাগদত্তকে নিজের বাহুপাশে বেঁধে বুকে বুক মিলিয়ে রইল। হাসি মুখে সে বলল,“মৃত্যু পর্যন্ত আমরা এক সঙ্গে থাকব।”
“হ্যাঁ, মৃত্যু পর্যন্ত”—বলে নাগদত্ত সোফিয়ার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট মিলিয়ে দিল আর দু’জনেই দু’জনের বাহু বন্ধনে আবদ্ধ হল!
পর মূহুর্তে নৌকা উল্টে গেল—সত্যিই মৃত্যু পর্যন্ত সাথী হয়ে রইল তারা!