১০ নরকভ্রমণ
অধ্যাপিকা উপস্ত্রীটির সাথে দিন ভালো যাচ্ছে না রফিকের, এক সময় যে ছিলো রাশেদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যার সাথে আজকাল দেখা হয় না, বা দেখা হয় যখন রফিক হঠাৎ খারাপ থাকতে শুরু করে;-সহযোগী অধ্যাপিকা সহযোগিতা করছে না, ডাকে সাড়া। দিচ্ছে না, টেলিফোন করে পাওয়া যাচ্ছে না, আসবে বলে কথা দিয়ে আসছে না, বড়ো একবাক্স রাজার গায়ে ছাতা ধরছে, সে একটা প্রভাষক বালককে খাচ্ছে টের পাচ্ছে। রফিক, বালকটি অনেক বছর বেকার থাকার পর এখন খুব কর্মময় জীবন যাপন করছে, আর অস্থির হয়ে উঠছে রফিক; এবং বিশে ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যায়, রাশেদ যখন বেরোতে। যাচ্ছে, হঠাৎ এসে উঠেছে একটি মহৎ ভাবনা বুকের ভেতর পুষতে পুষতে। রফিক শহিদ মিনারে যেতে চায়, অনেক বছর তার ওই শুচিকর জায়গাটিতে যাওয়া হয় নি, অঢেল ময়লা জমে গেছে বুকের নর্দমায় নর্দমায়, ময়লা কিছুটা সে সাফ করতে চায় শহিদ মিনারে গিয়ে। রাশেদই কি আর শহিদ মিনারে যায়, সে-ই কি আর সাহস করে ওখানে যেতে? রফিক একটি মাঝারি মাপের আমলা হয়েছে, আর ভালো কাজ করেছে একটি যে বিয়ে করে নি, যদিও তার বিয়ে করার কথা ছিলো সবার আগে, আর বিয়ে করবে বলেও মনে হচ্ছে না; তার চারপাশে যতো দিন আছে রূপসী দয়াবতী বিষণ্ণ। প্রসন্ন বিধবারা আর অতৃপ্ত আপারা, ততো দিন রফিক বিয়ে করে উঠতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। আপা বলেই এ-সহযোগিণীর সাথে তার সম্পর্ক শুরু হয়েছিলো যখন। সে একটি মহাবিদ্যালয়ে পড়াতো, আজো আপাই বলে; রাশেদ রফিকের সাথে আপামণির বাসায়ও গিয়েছিলো একবার, দেখেছিলো রফিক অশেষ শ্রদ্ধা করে আপামণিকে, আপার ঝিমধরা স্বামীটিও তার বিনয়ে গলে যাচ্ছিলো, আর রফিক রাশেদ ও আপার স্বামীটিকে ড্রয়িংরুমে চা ও সামরিক আইনে ব্যস্ত রেখে ভেতরে টেলিফোন করতে গিয়ে মৃদু চুমো খেয়ে আসছিলো আপাকে, রফিকের ঠোঁট দেখে রাশেদের তাই মনে হচ্ছিলো। বিয়ে করে নি বলে রফিক একটি স্বাধীনতা উপভোগ করে, যেখানে ইচ্ছে সেখানে থাকতে পারে, থাকেও, এখন আছে সাংসদাবাসে, তার এক আত্মীয়। উদ্দিন মোহাম্মদের সাংসদ হয়ে একটি বড় কক্ষ পেয়েছে, যদিও সেখানে সাধারণত থাকে না। রফিক দরকারে ওই কক্ষটি ব্যবহার করে; উদ্দিন মোহাম্মদের দলে তার সমাজতন্ত্রী আত্মীয়টি যোগ দিয়েছিলো বলেই রফিক স্বর্গের স্বাদ পাচ্ছে। আপামণির একটা রোগ রয়েছে, যার নাম সতীত্বরোগ; প্রতিবারই সে একটি কথা বলে রফিককে, আমাকে কিন্তু তুমি অসতী ভেবো না, আমি অন্যদের মতো নই; রফিক আপামণিকে। জানায় যে তার মতো সতী রফিক কখনো দেখে নি, তখন আপার মুখটিকে অক্ষত। সুন্দর লাজুক নববধূর মুখের মতো দেখায়। রফিকের এক প্রিয় সুখ ওঠার পর আপার স্বামীটিকে ফোন করা; মজা করার জন্যেই এটা শুরু করেছিরো রফিক, পরে এটা তার প্রধান সুখ হয়ে দাঁড়ায়; প্রথম যেদিন ওঠার পর সে নম্বর ঘোরাতে শুরু করেছিলো। লাফিয়ে উঠে আপা তাকে মেঝের ওপর ফেলে দিয়েছিলো, কিন্তু অশ্বীটিকে বশ মানিয়ে নিয়েছিলো রফিক, চড়তে যে জানে সে পড়ে গেলেও আবার উঠতে জানে; তার পর থেকে আপা এটি উপভোগ করতে থাকে, টেলিফোন সেটটি দূরে থাকলে সে প্রস্তুতি হিশেবে সেটটি এনে রাখে বিছানার পাশে, পুলকের পূর্বমুহূর্তে সে চিৎকার করে, টেলিফোন টেলিফোন, রফিক নিশ্চল হয়ে আপার স্বামীকে ফোন করে, ব্যবসা কেমন চলছে তার সংবাদ নেয়, সামরিক আইন গণতন্ত্র সমাজ রাষ্ট্র নীতি সততা রাষ্ট্রধর্ম হিন্দি সিনেমা এনজিও পান নারী পর্নোগ্রাফি সম্পর্কে আলোচনা করে, আপার সংবাদও নেয়; চোখ বন্ধ করে আপা তখন অধিত্যকাপর্ব যাপন করতে থাকে, আর রফিক খোদা। হাফেজ বলার সাথে সাথে প্রচণ্ডভাবে বিস্ফোরিত হয় আপা। পুলক কাকে বলে আপা তা জানতো না তিনটি মেয়ে একটি ছেলে জন্ম দেয়ার পরও, রফিকই তাকে তা শেখায়, এবং এক সময় সে তিনটি চারটি পাঁচটি দশটি পনেরোটি বিশটি পুলকে চুরমার হয়ে যেতে থাকে। সেই আপা এখন একটি প্রভাষককে খাচ্ছে, রফিকের ডাকে সাড়া দিচ্ছে না, রফিকের মনে হচ্ছে মনের খোড়লে খালে নর্দমায় বড়ো বেশি ময়লা জমে গেছে; তার মনে পড়েছে শহিদ মিনারকে।
শহিদ মিনারে গিয়ে সাফ হতে চায় রফিক, ভেতরটাকে ধুয়েমুছে ধবধবে করে। তুলতে চায়, আরেকবার দেখতে চায় ভেতরটা পরিষ্কার হলে সুখ লাগে কিনা; রাশেদের নিজেরও সাফ হওয়া দরকার, বিস্তর ময়লা জমে গেছে তারও ভেতরে;–কোথায় ময়লা জমে নি নষ্টভ্রষ্ট দেশে?–রাশেদের ভয় হতে থাকে যদি গিয়ে দেখতে পায়, রাশেদ ভাবনাটাকে ভিন্ন পথে চালানোর জন্যে ভিন্ন ভালো মহৎ কিছু ভাবার চেষ্টা করে, সে কি ভিন্ন ভালো মহৎ কিছু ভাবার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে?-আবার ভয়ানক ভাবনাটি এসে তার ওপর ভর করে, যদি গিয়ে দেখতে পায় মিনারের মনেও ময়লা লেগেছে? কেনো লাগবে না? মিনার তো মানুষেরই হৃদয়, সেই মানুষের ভেতরে ময়লা জমলে হৃদয় কেনো ময়লা হবে না, কেনো শুভ্র থাকবে? শহর আবর্জনায় ঢেকে গেলে মিনার কী করে এড়াবে আবর্জনা? মিনার, তোমার কোনো শক্তি আছে? তুমি শুধু স্মরণ করিয়ে দিতে পারো, যদি আমাদের থাকে, সে-প্রতিভা, সেই সব বিশ্বাস আর প্রতিশ্রুতির কথা; আমরা যখন পশু হয়ে উঠি, হয়ে উঠি দশকে দশকে, তখন আমাদের কিছু স্মরণে থাকে না। আমরা কি পশু হয়ে উঠছি না, নিজেকে জিজ্ঞেস করে রাশেদ, পশুর কি স্মৃতি বিশ্বাস প্রতিশ্রুতি থাকে অনেক বছর পর অনেকক্ষণ ধরে রফিকের সঙ্গ ভালো লাগছে রাশেদের, সুস্থ লাগছে, রফিকের ভেতর থেকে হঠাৎ-বেরিয়ে-পড়া কাতরতা কোমল। করে তুলছে রাশেদকে। রাশেদ কোমল হতে চায়, শিউলির মতো পাতার ওপরই ঝরে ভিজতে চায় শিশিরে, ছেলেবেলায় যেমন ঝরতো। রাত এগারোটার মতো হবে হয়তো তখন, মিনারের পশ্চিমের চৌরাস্তাটিতে গিয়ে পৌঁছোয় তারা, পুরোনো অভ্যাসে জুতো খুলে হাতে নেয়, হাতে নিয়েই বুঝতে পারে তারা মানাচ্ছে না সেখানে, গ্রাম্য মনে হচ্ছে তাদের; অন্য কারো হাতে জুতো নেই, সবাই ভদ্রলোকের মতো জুতো পরে আছে। অতীত থেকে দুটি মানুষ গিয়ে পৌঁচেছে নতুন কালের উৎসবে, তারা বুঝতে পারছে না উৎসবের রীতিনীতি, নিজেদের আগন্তুক মনে হচ্ছে। আমার মনেই শুধু ময়লা জমে নি, রফিক বললো, দেখছি সবার মনে থেকেই ময়লা উপচে পড়ছে, এতে ময়লা মিনার সহ্য করবে কীভাবে? উত্তরের দেয়ালটিতে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা বাণীগুলো পড়ে হো হো করে উঠলো রফিক, বললো, এ-বাণীগুলোতেও দেখছি প্রচুর ময়লা, এই সব পুরোনো বাণী আজো অর্থ প্রকাশ করে? দুটি বানান ভুলও ধরলো। বললো, বাঙালির বুক থেকে নতুন কোনো বাক্য বেরোয় নি, যা এখানে জ্বলজ্বল করতে পারতো? নতুন বাক্য কোথা থেকে বেরোবে, বেরোলেও সে-সব স্বীকার করবো কেননা, পুরোনো বাক্যই সত্য আমাদের কাছে, ওই পুরোনোকে পেরিয়ে আরো পুরোনোতে ফিরে যেতে হবে। রফিক আবার বললো, একটি মেয়েও যে দেখছি না? শহিদ দিবস এখন পুরুষদের দিবস? মেয়ে দেখা যাবে কেননা, দেশটা এখন অনেক বেশি পাকিস্থান হয়ে গেছে, যখন এটা পাকিস্থান ছিলো তখনো মেয়েরা আসতো, এখন আসে না, আসতে পারে না, দেশটা খাঁটি মুসলমানের দেশ হয়ে যাচ্ছে; একদিন হয়তো পাকিস্থানকে পেরিয়ে ইরান-আফগানিস্থান হয়ে উঠবে। তখন ফুল দেয়া যাবে না, মিলাদ পড়াতে হবে, বা এটিকে ভেঙে ফেলে একটা মসজিদ বা মাজার তোলা হবে। সেই আলপনা কই, সুর কই, বিষণ্ণতা কই, বেদনা কই, সুখ কই? এমন সময় কোলাহল শোনা গেলো, দৌড়োতে শুরু করলো। লোকজন, কয়েকটি বোমা ফাটলো; রাশেদ আর রফিক ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে। যাচ্ছিলো, কোন দিকে যাবে বুঝতে না পেরে দৌড়োতে লাগলো। তারা খুব হাঁপিয়ে উঠেছে, আর দৌড়োতে পারছে না, মনে হচ্ছে বহু দূর চলে গেলে তারা শান্তি পাবে, হয়তো পাবে না, তবু বহু দূর চলে যেতে হবে। তখন রফিক প্রস্তাবটি দিলো, তার। সাথে সাংসদাবাসে যাওয়ার; বললো, স্বর্গে থাকা হলো না, ময়লাও সাফ হলো না, চলো এবার নরকে যাই।
তারা যখন গিয়ে পৌঁছোলো তখন দেরি হয়ে গেছে, তবে উৎসব শুর হয় নি, দুটি মন্ত্রী জুয়ো ছেড়ে উঠতে চাইছে না বলে শুরু হতে পারছে না। জুয়ো খেলা চলছে দুটি টেবিলে, একটি করে মন্ত্রী আছে প্রত্যেক টেবিলেই, সঙ্গে খেলছে কয়েকটি সাংসদ আর আমলা, তাদের ঘিরে আছে আরো কয়েকটি আমলা আর সাংসদ। মন্ত্রী দুটিকে আর। আমলাগুলোর প্রায় সব কটিকেই চেনে রাশেদ, সাংসদগুলোকে চেনে না। একটা মন্ত্রী অনেক আগে তাকে ভাই ভাই করতো দেখা হলে, শ্রেণীসংগ্রাম বিপ্লব আবৃত্তি করতো, আজ তার দিকে তাকালো না, তাকাবার সুযোগ পেলো না, আমলাগুলো তাকে যেভাবে স্যার স্যার করছে তাতে সে রাশেদকে হয়তো আজ ভাই বলতে চায় না, বেঁচে গেলো রাশেদ, ভাই ভাই শুনতে আর ভালো লাগে না; আরেকটি রফিকের সহপাঠী ছিলো ইস্কুলে, প্রবেশিকায় ফেল করেছিলো একবার বা দুবার, নাম করেছিলো দু-তিনজনকে মাটির ওপরভাগ থেকে সরিয়ে দিয়ে, মাটির সাথে মানুষের সমন্বয় ঘটিয়ে, এখন মন্ত্রী হিশেবে নাম করছে, আরো নাম করবে। আমলা কটা নতুন যুগ্মসচিব হয়েছে, ঝিলিক, বেরোচ্ছে চোখমুখ থেকে; একটির বউ কিছু দিন আগে একটি সচিবের ঘরে গিয়ে উঠেছে বলে তাকে একটু বিষণ্ণ দেখাচ্ছে; তারা নিঃসন্দেহে খুবই যোগ্য, মন্ত্রী দুটিকে স্যার স্যার করে পাগল করে তুলছে; রাশেদ জুয়ো খেলা না বুঝলেও বুঝতে পারছে। বদমাশ মন্ত্রী দুটি পেরে উঠছে না প্রতিভাবান আমলাগুলোর সাথে, ওরা প্রথম শ্রেণী পেয়েছিলো বিএ (অনার্স)-এ;–রাশেদ জানে বাঙলাদেশের আমলাগুলোর মতো। প্রতিভাবান আমলা পৃথিবীতে নেই,–আমলাগুলো তো পুষিয়ে দিচ্ছে স্যার স্যার বলে, হয়তো অন্যভাবেও পুষিয়ে দেবে। রাশেদ আধঘণ্টা আগে বোমার মধ্যে পড়েছিলো, এখন মনে হচ্ছে বোমায় যদি একটা হাত ছিঁড়ে দুটি পা উড়ে গিয়ে সে পড়ে থাকতো। চৌরাস্তায়, তাহলে অনেক সুস্থ থাকতো। ময়লা সাফ করতে বেরিয়ে ময়লা জমে উঠছে বেশি করে তার ভেতরে, সে এতো ময়লা নিয়ে কী করে উঠে দাঁড়াবে? জুয়ো শেষ। হলে আরেকটি কক্ষে যেতে হলো, সেখানে উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে; বিদেশি গান বাজছে কান ছিঁড়েফেড়ে, টেবিলে ঝকঝক করছে সারি সারি বোতল, অল্প অল্প নাচছে দশবারোটি উঠতি অভিনেত্রী/মডেল, একটা বিজ্ঞাপনসংস্থা আজ রাতের জন্যে। উপহার দিয়েছে এই সজীব শিল্পকলাগুলো, একুশের মহৎ উৎসবে সামান্য উপহার দিতে পেরে সংস্থাটি নিজেকে ধন্য মনে করছে নিশ্চয়ই। হয়তো অনেক কাজ পেয়েছে সংস্থাটি, ভবিষ্যতে আরো অনেক কাজ পাবে, আরো অনেক শিল্পকলা উপহার দেবে।
রাশেদ কি বেরিয়ে পড়বে নরক থেকে বেরিয়ে গেলে কি স্বর্গের ধুলোকণার ওপর পড়বে তার পঙ্কিল পদযুগল? চারপাশে কি স্বর্গ ছড়িয়ে আছে? নাকি অতল আবর্জনায় পড়ে সে তলিয়ে যাবে, তার চিৎকারও কারো কানে গিয়ে পৌঁছোবে না? পান শুরু হয়ে গেছে, নাচছেও কেউ কেউ, উঠতিরা মন্ত্রী দুটিকে ঘিরেই নাচতে চেষ্টা করছে; নাচ রাশেদের সব সময়ই ভালো লাগে, এখনো লাগছে, দুটি আমলা এরই মাঝে দুটি উঠতিকে বাহুর ভেতরে ভরে ফেলেছে, সাধনা করছে আন্ডারওঅ্যারের ভেতর ভরে ফেলতে, তখন তারা হয়তো এ-কক্ষে থাকবে না। দুটি ঢলঢলে কলকলে টলটলে উঠতি সম্ভবত মন্ত্রী দুটির জন্যেই বরাদ্দ, আমলাগুলো সে-দুটিকে বাহুতে টানতে চেষ্টা করছে না, বারবার মন্ত্রী দুটির কাছে পৌঁছে দিচ্ছে, আমলারা মহর্ষিদের থেকেও নিষ্কাম হতে পারে কখনো কখনো, কিন্তু মন্ত্রী দুটি মনে হচ্ছে দাঁড়িয়ে নাচতে অভ্যস্ত নয়। তারা দাঁড়িয়ে থাকছে, পান করছে, উঠতি দুটি তাদের সামনে অল্প অল্প নাচছে, তারা মাঝেমাঝে উঠতি দুটির বাহু পরখ করছে, গাল পরখ করছে, একটু পরে হয়তো তাদের উপচানো চাঁদ দুটিকেও পরখ করবে। একটু দূরেই পানির ওপর যে-দালানটি দাঁড়িয়ে। আছে, সেটি কাত হয়ে পড়ছে বলে মনে হচ্ছে রাশেদের,তার শেকড় ঘেঁড়ার শব্দ পাচ্ছে রাশেদ,-পানির ওপর যা ভাসে তার কি শেকড় থাকে,-রাত শেষ হওয়ার আগে সারাটি দেশের মাথার ওপর ওটি ভেঙে পড়বে; তবে ওটি হয়তো ভেঙে পড়বে না, ওটি এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। রাশেদ আজ রাতে পান করবে না, কেনো পান করবে না; সেও কি পান করাকে খারাপ মনে করে, সে কি মনে করে পান করলে নষ্ট হবে একুশের পবিত্রতা? রাশেদ কয়েকটি বোমার শব্দ শুনতে পেলো মনে মনে, বোমা এবং পান, পান এবং বোমা, কোনটিকে সে বেছে নেবে? আজ সন্ধ্যায় রফিক যদি ময়লা সাফ করার উদ্দেশ্যে তার ওখানে গিয়ে না উঠতো, তাহলে সে এ-সংকটে পড়তো না, কোনো। বাছাবাছি তাকে পীড়িত করতো না, সে একটা সৎ মানুষ থেকে যেতো। এখনো সে। গ্লাশ হাতে তুলে নেয় নি, নেবে কিনা ভাবছে, এমন সময় সে-মন্ত্রীটি, যে আগে তাকে ভাই ভাই করতে, এসে তার পাশে বসলো। সে কাঁপতে শুরু করেছে, গলা জড়িয়ে আসছে তার, তবে অনেক কথা বলতে চায় বলে মনে হচ্ছে। প্রথমেই বললো যে রাশেদকে ওখানে দেখবে বলে সে ভাবে নি। রাশেদ বিব্রত বোধ করে বললো যে এমন ভালো ভালো জায়গায় সেও কখনো কখনো আসে, বলে হাসলো। মন্ত্রীটি আর কথা। বলছে না, কাঁপছে, সে এখন তার বরাদ্দ উঠতিটির দিকে তাকিয়ে মাথা দোলাচ্ছে, আর বলছে যে ওই ছেমরিগুলো খুব গরম দ্রব্য, সে অবশ্য দ্রব্য শব্দটি ব্যবহার করে নি, রাশেদের লাগলে রাশেদ যেনো তাকে বলে। রাশেদের লাগবে না। মন্ত্রীটি দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, আর রাশেদের হাত ধরে বলছে, ভাই, রাজনীতিবিদগুলোরে যেই জাত বিশ্বাস করে, সেইটা একটা হারামজাদা।
রফিক ওই পাশে বেশ ব্যস্ত, কিন্তু আপাকে সে ভুলতে পারছে না মনে হচ্ছে, রাশেদ বেরিয়ে পড়লো রফিককে কিছু না বলেই; তাকে অনেক দূর যেতে হবে, যদিও কতো দূর যেতে হবে, সে জানে না। পানির ওপর ভয়ঙ্করভাবে দাঁড়ানো দালানটির দিকে। তাকিয়ে নির্বোধ মনে হলো নিজেকে, নির্বোধের মতোই কিছুক্ষণ আগে তার মনে। হয়েছিলো দালানটি কাঁপছে, শেকড় ছেঁড়ার ভুল শব্দও সে শুনতে পেয়েছিলো; এ-সবই যারপরনাই বাজে কথা, দালানটি চমৎকার আছে, চমৎকার থাকবেও, দালানটির ছাদে উঠে যদি আজ রাতে উদ্দিন মোহাম্মদ তার সব উপপত্নী আর চাকরবাকর নিয়ে পান। করতে করতে নাচতে থাকে, তাহলেও ওটি কাঁপবে না। একবার সে ঢুকেছিলো দালানটির ভেতরে, আর ঢুকবে না; ভেতরে ঢুকেই তার মনে হয়েছিলো বিক্রমপুরের এক চাষী সে ভুল করে ঢুকে পড়েছে রাজাদের প্রাসাদে, সে পথ চিনতে পারছে না, বারবার পথ হারিয়ে ফেলছে; চারদিকে দেখতে পাচ্ছিলো রাজাদের, রাজারা খুব ব্যস্ত ছিলো নিজেদের নিয়ে; তারা বলছিলো নিজেদের প্রাসাদের কথা, রানীদের অলঙ্কারের কথা, মুকুটের কথা, তাকে দেখতেই পাচ্ছিলো না রাজারা; যদি সব গ্রামের সব চাষী এখানে ঢুকে পড়তো, তাহলেও রাজারা তাদের দেখতে পেতো না। সে আর ওই খোঁয়াড়ে ঢুকবে না, ওটি ভাঙবে না, ভাঙলেও তার কিছু যায় আসে না; তাকে এখন। অনেক দূরে যেতে হবে। তবে সে বেশি দূরে এগোয় নি, এখনো মাঠও পেরোতে পারে নি; চারপাশ খুব অন্ধকার বলে মনে হচ্ছে, সে হয়তো অন্ধকারে হারিয়ে যাবে, খুব বেশি দূরে যেতে পারবে না। একপাল বাঙালি শুয়ে আছে রাস্তার ওপর, দু-তিনটি পুলিশ লাঠি দিয়ে তাদের নিম্নভাগের ছেঁড়া কাপড় উঠিয়ে তাদের নিম্নাঙ্গের রূপরেখা পরীক্ষা। করছে; লোকগুলো খুব ঘুমোতে পারে, সুখী বাঙালি, পুলিশের লাঠির খোঁচায়ও তাদের ঘুম ভাঙছে না, তারা এমনভাবে ঘুমোচ্ছে যাতে লাঠি দিয়ে কাপড় উঠিয়ে তাদের। নিম্নঙ্গের রূপরেখা পরীক্ষা করতে পুলিশের অসুবিধা না হয়। এ-মাঝরাতে পুলিশ কি বেরিয়েছে এ-বাঙালিদের নিম্নাঙ্গের সম্পদ পাহারা দিতে, যা খোয়া গেলে দেশের খুব। ক্ষতি হয়ে যাবে? পুলিশদের ভেতরে প্রেমের দেবতা শক্তভাবে জেগে উঠেছে মধ্যরাতে, কাপড় সরিয়ে তারা প্রেমের মন্দির খুঁজছে। একটি মন্দির পাওয়া গেলো এই মাত্র, তার রূপরেখা পছন্দ হয়েছে আইনশৃঙ্খলার, ওই রূপরেখাকে এখন জেগে উঠতে হবে, কিন্তু সে জেগে উঠতে চাইছে না, যেতে চাইছে না আইনশৃঙ্খলার সাথে; তবে তাকে যেতে হবে, তার রূপরেখা পছন্দ হয়েছে আইনশৃঙ্খলার। আরো কয়েকটি রূপরেখা তাদের। দরকার নিশ্চয়ই, এখানে না পাওয়া গেলে অন্য কোথাও পাওয়া যাবে। কিন্তু রাশেদকে। অনেক দূরে যেতে হবে, যদিও সে জানে না কতো দূর যেতে হবে। রাশেদের ইচ্ছে করছে এদের পাশে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়তে, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা কি তা অনুমোদন করবে? তারা যদি লাঠি দিয়ে তার নিম্নাঙ্গের রূপরেখা পরীক্ষা করতে এসে দেখে তার জিন্স। ওপরের দিকে উঠছে না, তার রূপরেখা দেখা যাচ্ছে না, তখন নিশ্চয়ই একটা সোরগোল পড়বে। তার চেয়ে হাঁটাই ভালো, খুব ভালো খুব দূরে চলে যাওয়া।
এ-মাঝরাতে এক সামান্য বাঙালি/বাঙলাদেশি/বাঙলাস্থানি/ মুসলমান আমি হাঁটছি হাঁটতে পারছি না পা কোন দিকে পড়বে আমার পা বুঝে উঠতে পারছে না আমার কোনো গন্তব্য নেই কোনো বাঙালি/বাঙলাদেশি/বাঙলাস্থানি/মুসলমানের কোনো গন্তব্য নেই দশকে দশকে উল্টেপাল্টে যাচ্ছে গন্তব্য বাবা আপনিও এমন কোনো মাঝরাতে হেঁটেছেন হাঁটতে পারেন নি বুঝতে পারেন নি কোন দিকে যাচ্ছেন আপনাকে নিয়ে। একটা বড় গোলমাল রয়ে গেছে গোলমালটি রয়ে গেছে আমার রক্তে বাঙালি/ বাঙলাদেশি/বাঙলাস্থানি/মুসলমানের রক্তে আপনাকে ডাকতে পারি নি নিজের ভাষায় ডেকেছি ডাকছি তাদের ভাষায় যারা পরাজিত করেছিলো আপনার আমার পূর্বপুরুষকে জনক আপনাকে ডাকছি তুর্কি ভাষায় আমার কি জন্মের ঠিক আছে জনক আমার কন্যা যার মগজে দুঃস্বপ্ন ঢুকে গেছে বুট ঢুকে গেছে ট্রাক ঢুকে গেছে আমার পুত্র যে এখনো। জন্মে নি যে মগজে দুঃস্বপ্ন নিয়ে ট্রাক নিয়ে বুট নিয়ে জন্ম নেবে মাঝরাতে দুপুরবেলায়। হাঁটবে বুঝতে পারবে না কোথায় যাচ্ছে আপনার পিতার দেশ ছিলো না আপনার পিতা উদ্বাস্তু ছিলেন তিনি একটা দেশ চেয়েছিলেন কিনা জানি না আপনি দেশ চেয়েছিলেন একটা দেশ আপনার দরকার হয়েছিলো পাকিস্থান নাম দিয়েছিলেন দেশটার আপনি যে-পাকিস্থান চেয়েছিলেন আপনার নেতারা সে-পাকিস্থান চায় নি আপনি বছরের পর বছর দেখেছেন আপনার পাকিস্থান আর নেতাদের পাকিস্থানের মধ্যে মিল ছিলো না। নেতারা একটা দেশ চায় নেতা হওয়ার জন্যে কায়েদে আজম জাতির পিতা হওয়ার জন্যে আপনার আমার মতো মানুষ দেশ চায় বেঁচে থাকার জন্যে ধানের পাটের। কুমড়োর স্বাদের জন্যে নারীকে ভালোবাসার জন্যে এই দুই চাওয়ার মধ্যে মিল নেই আমি একটি দেশ চেয়েছিলাম আমার একটি দেশ দরকার হয়েছিলো তার নাম দিয়েছিলাম বাঙলাদেশ আমার নেতাদের বাঙলাদেশ আর আমার বাঙলাদেশ এক নয় আপনি বিশ্বাস করেছিলেন আপনার নেতাদের আমি বিশ্বাস করেছি আমার নেতাদের আপনার নেতারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে আপনার সাথে আমার নেতারা। বিশ্বাসঘাতকতা করেছে আমার সাথে আমার পুত্রকন্যার নেতারা বিশ্বাসঘাতকতা করবে আমার পুত্রকন্যার সাথে দেশটা মানুষের নয় যারা দখল করে তাদের এই এখন মাঝরাতে দেশটাকে আমি আমার বলে ভাবতে পারছি না দেশটা পাঁচতারাদের চারতারাদের বুটদের তাদের দাসদের চাকরদের দেশটা আমার নয় যারা রাস্তায় শুয়ে আছে তাদের নয় ভোরে উঠে যারা খেতের দিকে যাবে নদীর দিকে যাবে দেশটা তাদের নয় দেশটাকে একদিন দখল করবে রাজনীতিবিদরা তখনো দেশটা আমার হবে না হবে রাজনীতিবিদদের পাঁচতারা চারতারারা দখল করে বন্দুক দিয়ে জনগণ তাদের ব কিনে দিয়েছে বন্দুক দিয়ে তারা কী করতে পারে দেশ দখল করা ছাড়া রাজনীতিবিদদের বন্দুক নেই তাদের বন্দুক জনগণ দেশ দখল করার জন্যে তারা জনগণের ভেতর বারুদ ঢোকায় যেমন এখন তার প্রস্তুতি চলছে আমিও বারুদ হিশেবে ব্যবহৃত হচ্ছি একদিন রাজনীতিবিদরা দেশটা দখল করবে তবে তখনো দেশটা আমার হবে না জনগণের হবে না চাষীর হবে না রিকশঅলার হবে না।
অনেক দূর যেতে হবে রাশেদকে, তার তা-ই মনে হচ্ছে, যদিও সে জানে না কতো দূর। অনেক দিন এ-রাস্তায় আসে নি রাশেদ, অচেনা লাগছে সব কিছু, রাত ব’লে আরো অচেনা লাগছে, তার ভয় লাগছে না যদিও ভয়ই লাগার কথা বেশি। একটা ট্রাক এসে। তাকে তুলে নিয়ে যেতে পারে, পিষে যেতে পারে, একটা ছুরিকা এসে বলতে পারে। আমার সাথে চলো, বা সে যাতে আর চলতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে পারে, কিন্তু তার ভয় লাগছে না। পথে লোকজন দেখা যাচ্ছে দু-একজন, তারাও কি গন্তব্য খুঁজে পাচ্ছে না, তারাও কি অনেক দূরে যাওয়ার জন্যে বেরিয়েছে। তারা হয়তো শহিদ মিনারে যাবে, মিমারকে ভুলতে পারে নি তারা, তাদের বুকেও অনেক ময়লা জমেছে, পরিষ্কার। করতে যাচ্ছে ময়লা? শহিদ মিনার, হৃদয় দেয়ার ঝরনাধারা, যেখানে বুকের নর্দমা পরিষ্কার করতে গিয়ে আরো অনেক বেশি ময়লা জমিয়ে এসেছে রাশেদ, ঝরনার জলের ছোঁয়া সে পায় নি। বিমানবন্দরমুখি সড়কটায় উঠে এলো রাশেদ, দূরে একটা সেতু দেখা যাচ্ছে, অনেক আগে একটা কুষ্ঠরোগীকে ওই সেতুর ওপর দেখেছিলো সে, তার মুখ মনে পড়লো; রাস্তার পুব পাশে সে-বাড়িটা চোখে পড়লো, যে-বাড়িটা হোটেল ছিলো, যার ভেতরে একটা ছোট্ট পানশালা ছিলো, ওয়েসিস যার নাম ছিলো, যেখানে সে প্রথমবার পান করতে এসেছিলো বন্ধুদের সাথে, একটা বিয়ার চারজনে ভাগ করে খেয়ে মনে করেছিলো তারা মাতাল হয়ে গেছে। ওয়েসিস নামটা সে ভোলে নি দেখে অবাক হলো, বাড়িটা দেখামাত্রই নামটি মনে পড়লো, না দেখলে মনে পড়তো না; মাহমুদার মুখটিও মনে পড়লো। আশ্চর্য, আজ রাতে তার সব স্মৃতি জেগে উঠছে, জাতিস্মর হয়ে উঠছে সে। মাহমুদাকে নিয়ে রাশেদ এপ্রিলের এক রোববার একটি নরম নির্জন স্থান খুঁজেছিলো, কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলো না, বারবার ইস্কুটার নিয়ে স্থান বদলাচ্ছিলো, যেখানেই যাচ্ছিলো সেখানটাকেই মনে হচ্ছিলো বড়ো জনাকীর্ণ, শেষে তারা এ-হোটেলটিতে এসে চা খেয়েছিলো; এক ঘণ্টা মুখোমুখি বসে থেকেও রাশেদ মাহমুদাকে কিছু বলতে পারে নি। রাশেদ চৌরাস্তায় দাঁড়াতেই শুনলো একদল শিশু খলখল করে হাসছে, এমনভাবে হাসছে যে তাদের হাসি কোনো দিন থামবে না, সব ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরও তারা হাসতে থাকবে। সে কোন শিশু দেখতে পেলো না, কিন্তু তার মনে হলো শিশুরা তাকে ঘিরে ফেলেছে, তাকে ঘিরে খলখল করে হাসছে; হয়তো এখনি তারা তাকে আক্রমণ করবে। একটু পরেই রাশেদ শিশুদের তীব্র চিৎকার শুনতে পেলো। এ-শিশুদের রাশেদ কখনো দেখে নি, কিন্তু তারা তার বুকের ভেতরে। ঢুকে গেছে, এ-মধ্যরাতে তার বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে খলখল হাসছে আর তীব্র আর্তনাদ করছে মৃত শিশুরা। শিশু, তোমরা ইস্কুলে যাচ্ছিলে ভোরবেলা, তোমাদের। ফ্রকে তোমাদের শার্টে এসে পড়েছিলো ভোরের আলো, ভোরের আলোর মতো তোমরা ইস্কুলে যাচ্ছিলে, তোমাদের সবাই ভুলে গেছে, পিতামাতারাও হয়তো ভুলে গেছে, আমি ভুলি নি, একটা ট্রাক এসে লাফিয়ে পড়েছিলো তোমাদের ওপর তোমাদের আলোকমালাকে অন্ধকার করে দেয়ার জন্যে, তোমরা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিলে, তোমাদের আমি আজো বুকে বয়ে বেড়াই।
মমতাজ এখন মৃদুকে পাশে নিয়ে নিশ্চয়ই ঘুমোচ্ছে, সে কি ওই স্বপ্নটা আবার দেখছে, আবার কি মমতাজ ওই স্বপ্নটা দেখতে চায়? মমতাজের এক অদ্ভুত অভ্যাস মহাযুদ্ধের মতো প্রসঙ্গগুলো সে তোলে যখন রাশেদ আর কোনো প্রসঙ্গ মনে রাখতে পারে না, সে-রাতেও তুলেছিলো, গলে ভেঙে ভেসে যেতে যেতে মমতাজ বলছিলো কয়েক রাত আগে সে একটা স্বপ্ন দেখেছে, যার কথা সে কাউকে বলবে না, কিন্তু একটু পরই মমতাজ বলে সে স্বপ্ন দেখেছে রাশেদের এক বন্ধুর সাথে ঘুমোচ্ছ সে, কিন্তু সে বন্ধুটির নাম বলবে না, তাতে রাশেদ বন্ধুটিকে হয়তো আর দেখতে পারবে না, হয়তো সে বাসায় এলে দরোজা খুলবে না। কিন্তু মমতাজ একটু পরে, রাশেদ জানতে চাইলে, বন্ধুটির নামও বলে; গলে যেতে যেতে রাশেদ জানতে চেয়েছিলো স্বপ্নে কী দেখেছে। মমতাজ, ভেঙে পড়তে পড়তে মমতাজ বলে সবই দেখেছে সে, কিছুই বাকি ছিলো না। তার কেমন লেগেছে রাশেদ জানতে চেয়েছিলো, মমতাজ শুধু বলেছিলো, ভালো। রাশেদ মমতাজের কাছে জানতে চেয়েছিলো বাস্তবেও ওই বন্ধুটির সাথে সে ঘুমোতে চায় কিনা; মমতাজ দ্বিধায় পড়ে, অনেকক্ষণ কোনো কথা বলে নি, শেষে বলে আমি ঠিক জানি না চাই কি চাই না। আসলে মমতাজ কি চায়? রাশেদ বুকে একটা কাঁটা। খোঁজ করে, কিন্তু কোনো কাঁটা খচ করে ওঠে না; রাশেদও কি অমন অনেক স্বপ্ন দেখে নি? রাশেদ নিজে কি স্বপ্নে ও দিবাস্বপ্নে অজস্র নারীর সাথে সময় যাপন করে নি? তালিকাটি কি খুব দীর্ঘ হবে না, ওই তালিকার সব নাম কি সে কখনো প্রকাশ করতে পারবে? কয়েক মাস ধরে একটি পরহেজগার মহিলা কি তাকে স্বপ্নে কল্পনায় সুখ দিচ্ছে না? পরহেজগার মহিলাটির সাথে তার দেখা হয়েছিলো বেইলি রোডে এক। বিবাহ-অনুষ্ঠানে, তার বোরখার ভেতরে তাল তাল সোনা লোকোনো আছে বলে মনে হচ্ছিলো রাশেদের, এবং আশ্চর্য, তারপর থেকে সে কি রাশেদের স্বপ্নে দেখা দিচ্ছে না? মমতাজ আর কী কী স্বপ্ন দেখে? রাশেদ জানতে চেয়েছিলো মমতাজ আর কারো সাথে ঘুমোতে চায় কিনা, অন্য কারো সাথে ঘুমোতে তার কেমন লাগবে; অন্ধকারে রাশেদ মমতাজের মুখ দেখতে পায় নি, মমতাজ বলেছিলো, তুমি তো তা পছন্দ করবে না। অর্থাৎ মমতাজ চায়, আর মমতাজের বিশ্বাস রাশেদ তা পছন্দ করবে না। সত্যিই কি রাশেদ তা পছন্দ করবে না? ওই পরহেজগার মহিলাটি কি স্বপ্নে ঘুমোয় না কারো সাথে, বাস্তবে কি তার সাধ হয় না অন্য কারো সাথে ঘুমোতে?
অনেক দূর যেতে হবে রাশেদকে। মুজিব ফিরছে, দেখতে পাচ্ছে রাশেদ, অনেক দিন পর তার মুখের ওপর রোদ পড়েছে বলে মনে হচ্ছে; ট্রাকে মালা, আর যারা একদিন তাকে ডোবাবে, তাদের চাপে দম ফেলতে পারছে না মুজিব, সে খুব উপভোগ করছে, উল্লসিত পতঙ্গের মতো বাঙালির ভিড় চারপাশে, পতঙ্গপুঞ্জের মধ্যে শুধু সে-ই মানুষের মতো দেবতার মতো আচরণ করছে, রাশেদ দেখছিলো এক অপরিচিত প্রবেশ করছে। দেশে, মুজিবের চোখে দেশটাকে অচেনা লাগছে, দেশটার অচেনা লাগছে মুজিবকে। সে বুঝতে পারছে না সে কোথায় ফিরে এসেছে। যোলোই ডিসেম্বর থেকে দশই জানুয়ারির ওই দিনটা অনেক দূরের, অনেক আবেগ বদলে গেছে এর মাঝে, বাঙালি ভাগ হয়ে গেছে হাজি আর রাজাকারে। ভারত-ফেরত হাজিদের ভঙ্গি দেখার মতো, রাশেদ এখানে সেখানে দেখা পাচ্ছিলো হাজিদের, উপভোগ করছিলো তাদের মহত্ত্ব। যে ভারতে যায় নি, সে-ই রাজাকার, এমন ভাব করছে হাজিরা, যে ভারতে গেছে হাজি হয়ে ফিরেছে সে, তার অনেক পুণ্য জমেছে, পুণ্যের অনেক ফল তাকে পেতে হবে, পেতে শুরুও করেছে। কয়েক দিন আগে রাশেদের দেখা হয়েছিলো এক মহাহাজির সাথে, যে দেশে থাকলে আলবদরদের নেতা হতে পারতো, হতোই, যে এখন একটা বড়ো পদ খুঁজছে, সেও রাশেদকে বলেছিলো, তোমরা তো রাজাকার, দেশে ছিলে নিশ্চয়ই রাজাকারি করেছে। রাশেদ কষ্ট পায় নি, বেঁচে থাকার জন্যে তো অপমান সহ্য করতেই হবে। রাশেদ তখন দিকে দিকে দেখতে পাচ্ছিলো তার জ্বলজ্বলে পরিচিতদের, তারা ভারত থেকে ফিরেছে, রাশেদকে চিনতে পারছে না; একেকজন গাড়ি থেকে নামছে গাড়িতে উঠছে, ভারতে যাওয়ার আগে ছিলো সামান্য ফিরে এসেছে অসামান্য হয়ে। স্বাধীন। দেশটা হয়ে উঠেছে সাড়ে সাতকোটি রাজাকারের দেশ, সবাই পাপী, শুধু পুণ্যবান তারা। যারা ফিরে এসেছে ভারত থেকে পুণ্য অর্জন করে। শেখ মুজিব ফিরছে, সে ফেরার পর আর কোনো সমস্যা থাকবে না, সে যাদু জানে, তার যাদুতে সব সোনা হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই সোনা হচ্ছে না, বরং মুজিবের মুখে দাগ লাগছে, সে আরো অচেনা হয়ে উঠছে। আমি, আমি, আমি, মুজিবকে মনে পড়লেই মনে পড়ে আমি, আমি, আমি। মুজিবকে জাতির পিতা হতে হবে, তাকে জাতির পিতা করে তুলতে হবে; কায়েদে আজমের পর বাঙালিকে পেতে হবে জাতির পিতা। একটি চেনা মানুষ অচেনা হয়ে যাচ্ছে দিন দিন, দূরে সরে যাচ্ছে, নিজে বুঝতে পারছে না, দূরে সরে গিয়ে সুখ পাচ্ছে। বীরেরা খুন। হওয়ার আগে ধারাবাহিকভাবে আত্মহত্যা করতে থাকে, কিন্তু তারা তা বুঝতে পারে না, মুজিবও আত্মহত্যা করে চলছে, আত্মহত্যা করে চলছে, কিন্তু বুঝতে পারছে না। রাশেদকে অনেক দূর যেতে হবে। মুজিব কি মুহূর্তের জন্যেও ভাবতে পারতো সে আছে, কিন্তু ক্ষমতায় নেই? সে ও ক্ষমতা একই অর্থবোধক হয়ে উঠেছিলো তার কাছে, সে-ই বাঙলাদেশ এমন মনে হয়েছিলো তার। সে কি একটি রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত করছিলো না? সে-রাজবংশের ক্রিয়াকলাপের ফল কি পেতে শুরু করে নি বাঙালি? রেডিওতে জিয়ার ঘোষণাটি রাশেদ শুনেছিলো ঢাকা থেকে পালানোর সময়, হাতের ছোটো রেডিওটি শিউরে উঠেছিলো ওই ঘোষণায়, সে তার ঘোষণাকে ব্যর্থ হতে দেয় নি, ঘোষণার। পুরস্কার কড়ায় গণ্ডায় নিশেব করে নিয়েছে। আরেক অপরিচিত সে, অত্যন্ত অপরিচিত, ওই ঘোষণার মুহূর্তে ছিলো অচেনা, খুন হওয়ার সময়ও রয়ে গেলো অচেনা। মেজর, মেজর, মেজর, মেজরের ওপরে সে কখনো উঠতে পারে নি, যদিও সব কিছু হয়েছে সে। সে কি আর মুক্তিযোদ্ধা ছিলো? সবাই বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এখন আরেক অচেনা ভর করেছে। এই মাঝরাতে রাশেদকে অনেক দূরে যেতে হবে, সে জানে না কত দূর যেতে হবে।
রাশেদের মনে হচ্ছে সে ক্রমশ দোজখে ঢুকছে, তাকে কেউ পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, নরকের শেষে সে কোনো স্বর্গে গিয়ে পৌঁছোবে না, যে-দিকেই পা বাড়াচ্ছে। সে-দিকেই পাকে পাকে প্রসারিত হচ্ছে দোজখ; মহাজগত নয়, রাশেদের মনে হচ্ছে, . দোজখই অনন্ত ও সম্প্রসারণশীল; আর দোজখের পাকে পাকে কোটি কোটি নগ্ন পুরুষ, যারা আর পুরুষ নয়, যারা এক সময় পুরুষ ছিলো; তাদের লুঙ্গি খুলে পড়েছে, তাদের সম্মুখভাগে উদ্যত বা ঝুলন্ত প্রত্যঙ্গ নেই, ওই প্রত্যঙ্গগুলো কেটে নেয়া হয়েছে, কেটে নেয়ার পর শূন্যস্থান পূর্ণ করে দেয়া হয়েছে লবণ দিয়ে। প্রত্যঙ্গহীন পুরুষেরা তাকে। ঘিরে ধরছে, আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠছে তাকে দেখে। আর কোনো দিকে দেখার মতো কিছু নেই, দেখার মতো হচ্ছে ওই একদা-পুরুষদের লবণপূর্ণ গহ্বর, রাশেদের চোখ। গিয়ে বারবার পড়ছে ওই পুরুষদের প্রত্যঙ্গহীন গহ্বরে। তারা একদিন ওই প্রত্যঙ্গকেই দেবতা বলে মানতো, ওই প্রত্যঙ্গই ছিলো তাদের পতাকা, আজ তাদের ওই প্রত্যঙ্গ নেই। নেই বলে তারা লজ্জা পাচ্ছে না, গৌরব বোধ করছে; তারা চিৎকার করে বলছে, আমাদেরও একদিন ওই প্রত্যঙ্গ ছিলো, ওই প্রত্যঙ্গের জ্বালা আমরা সহ্য করতে পারি নি; আমরা জ্বালা থেকে এখন মুক্তি পেয়েছি। রাশেদ জানতে চায় তারা কী করে হারিয়েছে ওই প্রত্যঙ্গ। লিঙ্গঅণ্ডহীন পুরুষেরা চিৎকার করে বলতে থাকে, যুগে যুগে। আমরা লিঙ্গঅণ্ডহীন হয়েছি, আমাদের পিতামহদেরও লিঙ্গঅণ্ড ছিলো না, পিতাদেরও লিঙ্গঅণ্ড ছিলো না, তাদের পিতামহদেরও লিঙ্গঅণ্ড ছিলো না, পিতাদেরও লিঙ্গঅণ্ড ছিলো না, আমাদের পুত্রদেরও লিঙ্গঅণ্ড থাকবে না, পৌত্রদেরও লিঙ্গঅণ্ড থাকবে না, তাদের পুত্রদেরও লিঙ্গঅণ্ড থাকবে না, পৌত্রদেরও লিঙ্গঅণ্ড থাকবে না। যুগে যুগে বিদেশি প্রভুরা এসেছে, আমাদের শিশ্ন কেটে নিয়েছে; আমাদের ভেতর থেকেও কখনো কখনো কেউ। কেউ প্রভু হয়েছে, তারাও কেটে নিয়েছে আমাদের শিশ্ন; শিশ্নের বিনিময়ে আমরা। পেয়েছি ভবন, অন্ন, শকট, শিরোপা। রাশেদ দোজখের প্রথম পাকের মাঝভাগে দেখতে পায় এক নারী শুকনো শাপলা পাতায় একটি লাশ ঢেকে কাঁদছে, লাশ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, লাশের মুখে শুকিয়ে আছে সবুজ ঘাস নদীর রেখা বাঁশবন জোনাকি। ওই নারী বিচার চায়, আর ওই লিঙ্গহীন পুরুষেরাও বিচার চায়; তারা ওই নারীর সাথে সুর মিলিয়ে বিলাপ করছে থেকে থেকে। রাশেদ দোজখের প্রথম পাক পেরিয়ে দ্বিতীয় পাকে প্রবেশ করে, তার মাঝভাগে দেখতে পায় আরেক নারীকে, সেও একটি লাশ সামনে নিয়ে কাঁদছে, লাশ থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত, রাশেদ লাশের মুখে একটি বন্দুকের ছবি আঁকা দেখতে পায়; ওই নারীও বিচার চায়। তার সাথে সুর মিলিয়ে বিচার চাইছে, বিলাপ করছে দ্বিতীয় পাকের একদা-পুরুষেরা। রাশেদ দোজখের তৃতীয় পাকে প্রবেশ করে দেখতে পায় ঝলমল করছে একটি শয়তান, সে দেবতা হয়ে উঠেছে কোটি কোটি লিঙ্গঅণ্ডহীন একদা-পুরুষের, তারা স্তব করছে ঝলমলে শয়তানের, বলছে, তুমি উজ্জ্বল তুমি আলোকিত তুমি চিরন্তন তুমি আমাদের প্রভু, তোমাকে আমরা সব দিয়েছি, শিশ্ন দিয়েছি, অণ্ড দিয়েছি, নারী দিয়েছি, তুমি আমাদের আশ্রয় দিয়ো। চতুর্থ পাকে নামার। পর রাশেদ আর কোনো লিঙ্গঅণ্ডহীন পুরুষও দেখতে পায় না, দেখতে পায় পালে পালে অদ্ভুত কিম্ভুত পশু, যাদের প্রত্যেকের তিনটি করে মুণ্ড, একটি মুণ্ড শুয়োরের, আরেকটি মুণ্ড নেকড়ের, আরেকটি মুণ্ড এমন এক কুৎসিত পশুর, যার নাম রাশেদ জানে না। তিনমুণ্ড বিকট পশুদের মুখ থেকে রক্ত ঝরছে, তবু রক্তের জন্যে পাগল হয়ে ছুটছে তিনমুণ্ডরা, বিকট চিৎকার করছে, তাতে দোজখ কেঁপে উঠছে বারবার। তিনমুণ্ডদের মাথায় রক্তের রেখায় আঁকা রয়েছে চানতারা; রাশেদের কাছে বাল্যকাল থেকে চানতারা পবিত্র, সে শুয়োরদের কপালে চানতারা দেখে শিউরে ওঠে। তিনমুণ্ডা তার দিকে ছুটে আসতে থাকে, রাশেদ চিৎকার করে ওঠে, কিন্তু তার কণ্ঠ থেকে কোনো শব্দ বেরোয় না।
রাশেদ দোজখে ঢোকার আগে একবার ভেবেছিলো আবার যাবে সে ওই বিখ্যাত। ঝরনাধারার কাছে, সেখান থেকে অন্তত এক ফোঁটা জল মেগে এনে চিত্তটাকে দিনরাত ধুয়েমুছে চলবে, তা আর হলো না; মনে হতে লাগলো তার জন্যে পবিত্র জল কোথাও নেই। সে বাসার দিকে পা বাড়ালো, এবং যখন বাসা থেকে একটু দূরের মসজিদটির। কাছে পৌঁছোলো তখন সূর্য অনেকটা আকাশে উঠে গেছে। মসজিদের প্রাঙ্গণে বহু। লোকের ভিড় দেখে রাশেদ দাঁড়ালো। কেউ কি আজ ভোরে মারা গেছে? যে-লোকটি মারা গেছে সে কি খুব পাপী ছিলো, তাই কি এই ভিড়? পাপীদের নিয়ে আজকাল দারুণ কাণ্ড হচ্ছে জানাজায় জানাজায়, ইমামসাবরা পাপীর পাপের প্রকৃতি ও পরিমাণ কম্পিউটারের মতো এক নির্দেশে বের করে ফেলছেন, পাপমোচনের জন্যে দু-তিন লাখ টাকা জরিমানা করছেন; নইলে পাপী পায়ে দলা তেলাপোকার মতো শোচনীয়ভাবে। পড়ে থাকছে। তেমন কিছু হয়তো ঘটেছে। রাশেদ, কয়েক দিন আগে, একটা জানাজায় গিয়ে এমন এক পরিস্থিতিতে পড়েছিলো। ইমামসাব দারুণ ফিটফাট, মাথায় কী একটা ঝোলানো, পা পর্যন্ত ধবধবে পাঞ্জাবি, নাকি অন্য কোনো নাম আছে ওই বস্ত্রটার, তিনি পাপীর পাপের হিশেব করে চলছেন, মনে হচ্ছে বেহেস্ত-দোজখের সাথে তার সরাসরি টেলিফোন সংযোগ রয়েছে, দোজখের কম্পিউটারে তিনি পাপ মেপে তাকে টাকায় রূপান্তরিত করছেন, কয়েক লাখের নিচে কথা বলছেন না। তাঁর কথা শুনে মৃত। পাপীটির বড়ো পুত্রটি অসহায়ভাবে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে, সে লাখ টাকা কখনো। দেখে নি, পাপী পিতার লাশ নিয়ে সে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। শুধু ভাবছে আজ থেকে সে নামাজটা ধরে ফেলবে নিজের ছেলেটাকে বাঁচাতে। রাশেদ ইমামসাবের বাহাদুরি দেখে একটু বিরক্ত হয়েই বলে ফেলেছিলো, পাপের হিশেব আল্লার ওপর ছেড়ে দিন, আপনার কাজ জানাজা পড়ানো, জানাজা পড়ান। কয়েকজন বুড়ো সাথে সাথে সমর্থন করেছিলো রাশেদকে, আর তখন ইমামসাব তার কম্পিউটার বন্ধ করে নামাজ পড়াতে শুরু করেছিলেন। তেমন কিছু কি আজ ঘটেছে? রাশেদ এ-ইমামকে দু-একবার। দেখেছে, তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর বয়স হবে, এমন ভাব করেন যে তিনি মক্কামদিনাজেদ্দা রিয়াদফেরত তো বটেই, সম্ভবত দারুন্নাইম জান্নাতুল মাওয়া জান্নাতুল ফেরদৌস–ফেরতও। রাশেদের সন্দেহ হয় তার ঠিকানা জাহিম হাবিয়া জাহান্নামও হতে পারে একদিন; তাঁর সম্পর্কে শোনা গেছে ভোরের আজান দেয়ার কাজটি তিনি ক্যাসেট বাজিয়েই করে থাকেন, যদিও তার প্রমাণ মেলে নি। ধর্মের এ-আধুনিকীকরণে রাশেদের অবশ্য আপত্তি নেই। কিন্তু এমন উত্তেজনা কেনো চারপাশে? পুলিশও দেখা। যাচ্ছে। তাহলে কি ইমামসাব শহিদদিবসে শহিদদের গালি দিয়ে কোনো ফতোয়া প্রচার করে গোলমাল বাঁধিয়ে তুলেছেন? রাশেদ প্রাঙ্গণে ঢুকে একটি চেনা যুবকের পাশে দাঁড়িয়ে ঘটনাটি জানতে চায়। যুবকটি রাশেদকে যে-ঘটনাটি বলে তাতে রাশেদ শিউরে ওঠে না, কিছুক্ষণ আগে সে দোজখ ভ্রমণ করে এসেছে বলে এখন সে সবই সহ্য করতে পারে। পাশের বস্তির একটি বালিকা, ১০, ইমামসাবের কাছে প্রত্যেক ভোরে সবক নিতে আসে, আজো এসেছিলো; ইমামসাব তাকে ভেতরে টেনে নিয়ে ধর্ষণ করেছে। বালিকার চিৎকার কেউ শুনতে পায় নি, তবে দেরি হওয়ায় তার রিকশাঅলা পিতা তাকে ডাকতে এসে দেখতে পায় তার কন্যাটি রক্তের বন্যার মধ্যে পড়ে আছে। সে চিৎকার করে কন্যার বুকের ওপর পড়ে নাম ধরে ডাকতে থাকে, কিন্তু কন্যা সাড়া দেয় না। ইমামসাবকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রাশেদ কোনো উত্তেজনা বোধ করে না, সে ক্রমপ্রসারিত নরকের ওপর পা ফেলে ফেলে প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা। করতে থাকে।