অধ্যায় ১০. নবীরা
নবীরা ভবিষ্যদ্বক্তা নন, তারা প্রকাশ বা প্রচার করেন। ঈশ্বরের কাছ থেকে তারা যা কিছু শোনেন সেটি যতটা তার প্রকাশ ও প্রচার করে থাকেন, সেভাবে তারা। ভবিষ্যতে কী হবে সেটি নিয়ে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করেন না। তারা এমন কিছু প্রচার করেন, যা শুধুমাত্র ঐশী প্রত্যাদেশের মাধ্যমে জানা সম্ভব। তারা ঈশ্বরের নির্দেশ ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন। তারা ঈশ্বরের সত্যকে এমনভাবে সবাইকে জানান যা মূলত শ্রোতাদের প্রভাবিত করার জন্যেই পূর্বপরিকল্পিত। ভবিষ্যৎ নিয়ে পূর্বধারণা তারা অবশ্য করতে পারেন, যদি সেভাবেই তারা সেটি ঈশ্বরের কাছ থেকে শোনেন। মেসোপটেমিয়ানদের মূর্তি দেবতাদের উপহাস করা ঈশ্বরের কণ্ঠ আব্রাহাম শুনেছিলেন। মোজেস শুনেছিলেন সেটি তাকে মিশরে ইজরায়েলাইটদের ত্রাণকর্তা হতে নির্দেশ দিচ্ছে, যেন তিনি পথ দেখিয়ে তাদের ঈশ্বর-প্রতিশ্রুত দেশে নিয়ে যেতে পারেন। যখন ইজরায়েলের সন্তানরা আবার কানানে তাদের বসতি গড়েছিলেন এবং রাজারা তাদের শাসন করেছিলেন, তখনো ঈশ্বরের কণ্ঠ নীরব হয়ে যায়নি। আর এটি শুনেছিলেন খুব সাধারণ কিছু মানুষ, যারা তাদের সাধারণ জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে, পবিত্র পর্বতে মোজেসকে দেওয়া ঈশ্বরের আইনগুলো রক্ষা করতে শক্তিশালীদের ব্যর্থতাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। নবীরা ছিলেন প্ররোচিত করার মতো বক্তা, সাধারণ মানুষকে তাদের বার্তাগুলো বোঝাতে যারা গল্প ব্যবহার করতেন। এবং এমনকি রাজারাও তাদের নজরের বাইরে থাকতেন না। যেমন, একটি গল্পে আমরা দেখি, কীভাবে একজন নবী ইজরায়েলের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা ডেভিডকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। যার সাথে আমরা এর আগে পরিচিত হয়েছিলাম, গুলতি ব্যবহার করে, পাথর ছুঁড়ে যিনি দানব গলাইয়াথকে হত্যা করেছিলেন।
ডেভিড ইজরায়েলের সিংহাসনে বসেছিলেন কমন এরা শুরু হবার ১০০০ বছর আগে। তার রাজধানী জেরুজালেম (শান্তির নগরী) প্রতিষ্ঠা করার জন্যে তিনি একটি দুর্গসংরক্ষিত পাহাড়, মাউন্ট জাইওনকে নির্বাচন করেছিলেন। সুন্দর, যে-শহরটি বহু মিলিয়ন মানুষের কাছে এখনো পবিত্র একটি শহর। যদিও ডেভিড সাহসী যোদ্ধা আর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের একজন নেতা ছিলেন, কিন্তু তিনি কোনোভাবেই ক্রটিমুক্ত একজন মানুষ ছিলেন না। একদিন নাথান নামের একজন নবী এসে তাকে সাম্প্রতিক একটি ঘৃণ্য ঘটনার বিবরণ দিয়েছিলেন : গ্রামের একজন ধনী ব্যক্তি, যার বহু হাজার মেষ ও গবাদি পশু ছিল এবং কোনোকিছুরই অভাব ছিল না। তার একজন ভাড়াটে ছিল, যে খুবই দরিদ্র একজন ব্যক্তি, তার একটি ভেড়া ছাড়া আর কিছুই ছিল না, যাকে তিনি তার নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসতেন। একবার যখন অপ্রত্যাশিতভাবে একজন অতিথি সেই ধনী ব্যক্তির বাড়িতে হাজির হয়েছিলেন, তিনি তার নিজের হাজার ভেড়া বাদ দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করতে সেই গরিবের ভেড়াটিকেই বেছে নিয়েছিলেন।
যখন রাজা ডেভিড এই গল্পটি শুনেছিলেন, তিনি দ্রুত দাঁড়িয়ে উঠে দাবি করেছিলেন, এই অশুভ দানবটা কে? নাথান উত্তর দিয়েছিল, আপনিই হচ্ছেন সেই ব্যক্তি’। নাথান জানতেন, ডেভিড ইউরাইয়া’র স্ত্রী বাথশেবার সাথে রাত কাটিয়েছেন, যিনি ছিলেন তার সেনাবাহিনীর একজন অনুগত সৈন্য, এবং একটি সেনা-অভিযানে তখন তিনি ঘরের বাইরে ছিলেন। তার এই অপরাধ গোপন রাখতে তিনি ইউরাইয়াকে যুদ্ধক্ষেত্রেই হত্যা করার ব্যবস্থা করেন। তারপর তিনি বাথসেবাকে বিয়ে করেছিলেন গোপনে। নাথানের চ্যালেঞ্জের কারণে ডেভিড তার অপরাধ স্বীকার করেন এবং প্রায়শ্চিত্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। নবীরা জানতেন, গল্পের শক্তি কারো জীবনে মোড়পরিবর্তন করানোর ক্ষমতা রাখে। কিন্তু সব গল্পই তাদেরকে ঈশ্বরের অসন্তুষ্টির মুখোমুখি করার জন্যে পরিকল্পিত নয়। কখনো তিরস্কার বা সমালোচনা ছাড়াও, এগুলো সান্ত্বনা আর ভবিষ্যতের জন্যে আশার জোগান দেয়। যেমন আরেকটি গল্প –
ডেভিডের মৃত্যুর প্রায় চারশো বছর পরে, যখন ইজরায়েলাইটরা ব্যাবিলনে নির্বাসিত এবং হতাশা নিয়ে তারা তাদের প্রিয় জেরুসালেমকে স্মরণ করেছিলেন, তখন নির্বাসিতদের একজন তাদের জন্যে একটি বার্তা নিয়ে এসেছিলেন। বার্তাটি তিনি তাদের ঈশ্বরের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। তার নাম ছিল ইজেকিয়েল। প্রথমে তিনি তাদের অতীতের জন্য গালমন্দ করেছিলেন। ঈশ্বর তাদের একদিন মিশরের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে প্রতিশ্রুত-দেশে এই কারণে নিয়ে আসেননি যে, তারা অন্যসব জাতির মতো একটি জাতিতে পরিণত হবে। অন্য জাতিগুলো বৈষয়িকভাবে সফল আর ধনী হতে চেয়েছিল এবং বিশ্বমঞ্চে দম্ভের সাথে তারা তাদের বিত্ত প্রদর্শন করতে চেয়েছিল। আর সেই অবস্থানে পৌঁছাতে তাদের সাহায্য করার জন্যে তারা দেবতাদের ব্যবহার করেছিল। ধর্ম তাদের জন্যে রাজনীতিরই একটি শাখা ছিল।
বেশ, ইসরায়েলের ঈশ্বর কোনো মূর্তি ছিলেন না, যা-কিনা রাজনীতিবিদরা ক্ষমতার খেলায় নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারতেন। একইভাবে অন্য কোনো জাতির মতো জাতি হবার কথাও ছিল না তাদের। কথা ছিল তাদের একটি পবিত্র জাতি হতে হবে, তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হবে এই পৃথিবীতে তাদের ঈশ্বরের সেবা করা। কিন্তু স্থানীয় রাজনীতির ক্ষমতা দখলের খেলায় তারা নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছিলেন। সুতরাং ব্যাবিলনে তাদের নির্বাসন দেবার মাধ্যমে ঈশ্বর তাদের শাস্তি দিয়েছিলেন।
ইজরায়েলাইটদের এই নির্বাসনের কারণ হিসাবে ইজরায়েলের ‘পাপ’ দায়ী, ইজেকিয়েলের এই ব্যাখ্যাটি ধর্মের ইতিহাসের আরেকটি কৌতূহলোদ্দীপক ধারণা যুক্ত করেছিল। যখনই ইজরায়েলের জনগণ এলাকার ক্ষমতার সংগ্রামের কারণে দুর্দশায় পতিত হয়েছে, নবীরা তাদের সেই দুঃখের জন্যে তাদের উপর নির্যাতন করা শক্ৰ-সেনাদের দায়ী করেননি বরং ঈশ্বরের প্রতি তাদের বিশ্বাসের দুর্বলতা অথবা বিশ্বাসহীনতাকে দায়ী করেছিলেন। সেই ধারণাটির জন্ম হয়েছিল, যদি আপনার সাথে খারাপ কিছু ঘটে, সেটি ভাগ্যের খেলা নয়, এটি আপনার পাপের শাস্তি। আর যেহেতু ইজরায়েলের সাথে ক্রমাগতভাবেই খারাপ কিছু ঘটা অব্যাহত ছিল, সারাক্ষণই তারা তাদের পাপাচারের জন্যে নবীদের তিরস্কারও শুনেছিলেন। কিন্তু এমন সময়ও ছিল যখন ঈশ্বর এই তিরস্কার করা বন্ধ করে ইজরায়েলবাসীকে আশ্বস্ত করেছিলেন। এবং সান্ত্বনার সবচেয়ে মর্মস্পর্শী বার্তাগুলোর একটি তাদের কাছে এসেছিল ইজেকিয়েলের মাধ্যমে।
ইজেকিয়েল শুধুমাত্র কণ্ঠস্বরই শোনেননি, তিনি তার মনশ্চক্ষে নানা দৃশ্যও দেখেছিলেন। এবং এভাবে দেখা তার দৃশ্যগুলোর একটি বন্দি ইজরায়েলের জন্য একটি আশার বার্তা বহন করে এনেছিল। তার দেখা সেই দৃশ্যে তিনি একটি পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে প্রশস্ত একটি উপত্যকার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, যে উপত্যকাটি শুষ্ক হাড় দিয়ে পূর্ণ ছিল। সেই কণ্ঠস্বরটি অস্থিগুলোকে উদ্দেশ্য করে একটি ভবিষ্যদ্বাণী করতে বলেছিল, যেন তিনি তাদের বলেন, তাদের মধ্যে নিশ্বাস প্রবেশ করবে, মাংশপেশি আবার তাদের আচ্ছাদিত করবে এবং তারা আবার একটি জীবন পাবেন। নির্দেশমতোই তিনি সেটি করেছিলেন। তাৎক্ষণিকভাবেই সব অস্থিগুলো পরস্পরের সাথে যুক্ত হবার শব্দ শুনতে পেলেন তিনি এবং মানুষের কঙ্কালে পূর্ণ হয়ে উঠেছিল উপত্যকাটি। এরপর সন্ধি, মাংসপেশি আর চামড়া সেই কঙ্কালগুলো আচ্ছাদিত করতে শুরু করেছিল, আর মৃত শরীরগুলো পূর্ণ করেছিল সেই উপত্যকা। একেবারে শেষে নিশ্বাস শরীরগুলোর মধ্যে প্রবেশ করেছিল আর তারা উঠে দাঁড়িয়েছিল। যেন প্রাণবন্ত সেনাদের একটি বিশাল দল পুরো উপত্যকাটিকে পূর্ণ করে রেখেছে। সেই কণ্ঠস্বরটি ইজেকিয়েলকে বলেছিল, এই অস্থিগুলো ইজরায়েলের সন্তানদের, যারা ভেবেছিল তাদের জীবন শেষ হয়ে গেছে। এবং তারা মৃত এবং ব্যাবিলনে তাদের সমাহিত করা হয়েছে। কিন্তু ঈশ্বর খুব শীঘ্রই তাদের নিজেদের প্রিয় জীবনে পুনরায় স্থাপন করবেন এবং তাদের প্রিয় ইজরায়েলে তিনি তাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন।
আর ঠিক সেটাই ঘটেছিল, কমন এরা শুরু হবার ৫৩৯ বছর আগে (খ্রিস্টপূর্বাব্দে)। পারস্যবাসীরা আসিরীয়দের পরাজিত করেছিল এবং পারস্যবাসীদের রাজা সাইরাস নির্বাসিতদের ইজরায়েলে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এবং আসিরীয় বাহিনীদের ধ্বংস করা মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ এবং তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য পুনরায় প্রতিষ্ঠা করতে বলেছিলেন। এরপর দুইশো বছর ইজরায়েলাইটরা তাদের নিজেদের ধর্মীয় প্রথা কোনো বাধা ছাড়াই পালন করতে পেরেছিলেন। অবশেষে, তারা তাদের দেশের সেই নামকরণের মর্যাদা রাখতে পেরেছিলেন, যেখানে শুধুমাত্র ঈশ্বরই রাজত্ব করেন। অন্য কোনো জাতির মতো তারা নিজেদেরকে শুধুমাত্র মানব কোনো নেতার নেতৃত্ব দেওয়া একটি জাতি হিসাবে ভাবেননি বরং তারা তাদের দেশটি শাসন করেছিলেন একটি ধর্মীয় সমাজ হিসাবে, যেখানে ঈশ্বরই রাজা, একটি ধর্মতন্ত্র বা থিওক্রেসি। এবং তারা তাদের সেই মন্দিরটি পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন, যে-মন্দিরটি ছিল তাদের মধ্যে ঈশ্বরের উপস্থিতির একটি প্রতীক। তাদের অস্তিত্বের প্রাণকেন্দ্র। মন্দিরটির নির্মাণশেষে তারা সেটি ৫১৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নিবেদন করেছিলেন।
ইজরায়েলের আর কোনো রাজা ছিল না, সুতরাং মন্দিরের প্রধান পুরোহিতই দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। পৃথিবীতে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবেই তাকে বিবেচনা করা হয়েছে। আর দেশটির নিজেকে সুসংহত করার এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় কিছু জিনিস হারিয়েও গিয়েছিল, আব্রাহামের সময় থেকেই, যা তাদের। ইতিহাসেরই অংশ ছিল। সবধরনের ভবিষ্যদ্বাণীর সমাপ্তি ঘটেছিল, নবীদের সেই কণ্ঠ শোনাও শেষ হয়েছিল। এখন জীবন্ত নবীরা, যারা ইজরায়েলাইটদের কাছে নিরন্তর ঈশ্বরের নতুন বার্তার বিস্ময় বহন করে আনতেন, তাদের প্রতিস্থাপিত করতে ধর্মীয় বইগুলোর সংকলন করা হয়েছিল, যে-বইগুলো তাদের ঈশ্বর নির্দেশিত ইতিহাসের সব কাহিনি এবং তাদের জীবন-পরিচালনাকারী আইনগুলোকে একত্র করেছিল।
এই বইগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণটি ছিল বাইবেলের প্রথম পাঁচটি বই, যাদের বলা হয়, ‘পেন্টাটিউখ’ বা ‘ফাইভ স্ক্রলস’। প্যাপিরাসের স্ক্রল বা গোল করে প্যাচানো শুকনো প্যাপিরাসের পাতার উপর কালি দিয়ে প্রাচীন লিপিকারকরা লিখতেন। আর নির্বাসন থেকে ফিরে আসার পর, এই শান্তিপূর্ণ পর্বটিতে ঈশ্বরের সাথে ইজরায়েলের দীর্ঘ সম্পর্কটির কথা অবশেষে কাগজে-কলমে লিপিবদ্ধ করা শেষ হয়েছিল। এবং ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর শোনা জাতি থেকে তারা একটি পবিত্র গ্রন্থের জাতিতে পরিণত হয়েছিলেন।
শুরুর দিকে ইজরায়েলবাসীদের এই ধর্মটিকে নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করার প্রবণতা ছিল। আমরা এমনকি এটিকে একটি ফ্রিল্যান্স বা স্বাধীনভাবে পালিতধর্ম হিসাবেও বর্ণনা করতে পারি। তখনো এটি পেশাজীবী ধর্মযাজকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং পরিচালিত হয়নি, বরং সেই কাজটি করেছিলেন প্রতিভাবান অপেশাজীবীরা, যারা সরাসরি তাদের মাধ্যমে ঈশ্বরকে কথা বলতে শুনেছিলেন। আর এভাবেই সব ধর্মের সূচনা হয়ে থাকে। এগুলো শুরু হয় বিশেষ গুণাবলির কিছু মানুষদের মাধ্যমে, যাদের আমরা নবী বা সাধু বলি, তারা ঈশ্বরের কণ্ঠ শোনেন বা কোনো স্বর্গীয় দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। আর তারা কী দেখেছেন বা কী শুনেছেন সেটি তারা অন্যদের বলেন। যারা এধরনের কোনো দৃশ্য দেখেননি বা কোনো কণ্ঠ শোনেননি, বিশ্বাসের মাধ্যমে তারা সেই। ধারণাগুলোকে তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত করেন, অর্থাৎ তাদের যা কিছু বলা হয়েছে সেগুলো তারা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন। এবং এভাবে ধর্মীয় কাঠামো গড়ে ওঠে।
এইসব কাঠামো যখন আরো বিস্তারিত হয়, নতুন একধরনের নেতার তখন প্রয়োজন হয়। আর এটি সৌখিন অপেশাদারিত্ব থেকে বিস্তারিত জটিল পেশাদারিত্বের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। একত্রে সংকলিত করা গল্পগুলোকে ব্যাখ্যা করার জন্যে শিক্ষকের দরকার হয়। পুরোহিত আর যাজকদের দরকার পড়ে পবিত্র বইতে লিপিবদ্ধ নানা উৎসব পরিচালনা আর গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো উদযাপন করতে। মন্দিরের দরকার হয়, যেখানে এই কর্মকাণ্ডগুলোর সিংহভাগই সংঘটিত হয়। এবং যখন এই দীর্ঘ প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হয়, পৃথিবী এর ধর্মের ভাণ্ডারে পূর্ণমাত্রার একটি ধর্ম পায়।
এই প্রক্রিয়ায় চিরতরে কিছু উপাদান হারিয়ে গেছে এমন একটি অনুভূতি অবশিষ্ট থেকে যায়। আর সে-কারণে ধর্ম সবসময়ই অতীতে তাদের শুরুর দিনগুলোর দিকে অনুশোচনা-মিশ্রিত একটি কামনা নিয়ে ফিরে তাকায়। সেই দম্পত্তির মতো, যারা পরস্পরের সাথে দীর্ঘদিন থাকার কারণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, যখন তাদের ভালোবাসা জীবনের সেই শুরুর দিনগুলোর আবেগ হারিয়ে যায়। তারা অতীতের দিকে সেই কামনাসহ ফিরে তাকান, যখন তাদের সম্পর্কে সেই আবেগের সহজ প্রবাহ ছিল। আর সে-কারণে ধর্ম এই আদি মূল তীব্র ভালোবাসাটিকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টায় প্রচুর সময় ব্যয় করে। কিন্তু বিষয়টি সহজ হয় না, কারণ স্বর্গীয় সেই প্রেমিকের কণ্ঠস্বর নীরব হয়ে গেছে, যা বাকি থাকে সেগুলো তার শব্দমালা।
অথবা, এমন কি হতে পারে, যারা ধর্মের ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন, ঈশ্বর যখন তাদের ফোন করেন, তারা আর ফোন ধরেন না, কারণ তাদের নিয়ন্ত্রিত এই প্রতিষ্ঠিত কাঠামো আর পদ্ধতির ভারসাম্য ঈশ্বর যেন নষ্ট না করতে পারেন, এটাই তাদের একান্ত কাম্য হয়ে ওঠে? সংঘটিত ধর্ম থেকে এই টানাপড়েনটি কখনোই দূরে ছিল না, যেমন, ইতিহাস আপনাদের সেটি দেখাবে। ব্যাবিলেনের নির্বাসন থেকে ফেরার পরপরই ইজরায়েল এর অবস্থান ক্রমশ আরো দৃঢ়তর করতে শুরু করেছিল ঠিক এভাবে। সেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এর অস্থিগুলো বাড়ি ফিরেছিল আবার একত্রে যুক্ত হয়ে। এর পরের দুই শতাব্দীর সেই মধ্যবর্তী বিরতির পর্বটি এসেছিল, যখন এটি শান্তি খুঁজে পেয়েছিল, যা এটি হাজার বছর ধরে খুঁজেছিল। এই সময়ে ইজরায়েল শাসন করেছিল সেই সাম্রাজ্যগুলো, যার নেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তারা তাদের প্রজাদের ধর্মীয় আচারে কোনো হস্তক্ষেপ করবেন না। কিন্তু এটি বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেনি।
কমন এরা শুরু হবার ৩৩৩ বছর আগে গ্রিক সম্রাট আলেক্সান্ডার যখন মানুষের জানা পৃথিবীর অধিকাংশ এলাকাটি শাসন করতেন, তখন পরিবর্তনের আরেকটি চক্র শুরু হয়েছিল ইজরায়েলে। আলেক্সান্ডার ইজরায়েলাইটদের তাদের নিজেদের ধর্ম পালন করতে অনুমতি দিয়েছিলেন এবং এই বিষয়ে তিনি হস্তক্ষেপ করেননি। যখন তিনি মারা যান, তার রাজ্যের অংশগুলো, যা আমরা আজ চিনি আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন আর প্যালেস্টাইন নামে, সেগুলোর ক্ষমতা নিয়েছিলেন অন্য নেতারা, আর তাদের শাসনপদ্ধতিও ছিল ভিন্ন। তারা তাদের নিজস্ব সংস্করণের ধর্ম তাদের প্রজাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সুতরাং ইসরায়েলের হিংস্র হিংসুটে ঈশ্বরের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার ছিল। যে রাজা এই যুদ্ধ শুরু করেছিলেন তিনি ছিলেন চতুর্থ অ্যান্টাইওকাস। বংশানুক্রমে একজন গ্রিক, এলাকার সাম্রাজ্যের রাজনীতিতে নিজের অবস্থান আরো বৃদ্ধি করার উচ্চাকাঙ্ক্ষায় হতাশ হয়ে তিনি তার ইহুদি প্রজাদের তাদের আধিপত্যপ্রবণ ঈশ্বরের কাছ থেকে টেনে বের করে আনার চেষ্টা করেছিলেন, এবং তিনি তাদের ওপর গ্রিকধর্ম আর সংস্কৃতির অভিজাত আর সূক্ষ্ম আচারগুলো চাপিয়ে দিয়েছিলেন।
কমন এরা শুরু হবার ১৬৭ বছর (খ্রিস্টপূর্বাব্দ) আগে তিনি জেরুজালেমের মন্দিরটিকে গ্রিকদেবতা জিউসের একটি মন্দিরে রূপান্তরিত করেছিলেন, এবং সারা ইসরায়েল জুড়ে তিনি তার পেটোয়াবাহিনী পাঠিয়েছিলেন নিশ্চিত করতে, ইহুদিরা যেন অবশ্যই দেবতা জিউসের উপাসনা করেন। যখন তাদের একজন জেরুজালেমের কাছে একটি গ্রাম মডিনে এসে পৌঁছিলেন, তিনি গ্রামের যাজক, বৃদ্ধ মাত্তাথিয়াসকে রাজার নির্দেশ মান্য করে বিসর্জন দিতে অথবা মৃত্যুকে বরণ করতে বলেছিলেন। মাত্তাথিয়াস এর উত্তরে বিসর্জনের জন্য প্রস্তুত মেষের শরীরে ছুরি না ঢুকিয়ে, রাজার নির্দেশ নিয়ে আসা প্রহরীর শরীরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, তাকে বিসর্জনে পরিণত করেছিলেন। তিনি ও তার ছেলেরা তাদের নিষ্ঠুর রাজার বিরুদ্ধে তিন বছরব্যাপী যুদ্ধ করেছিলেন। রাজার বিরুদ্ধে তিনটি যুদ্ধে তারা জয়লাভ করেছিলেন এবং তাদের কলুষিত করা মন্দিরও তারা আবার দখল করতে পেরেছিল। ১৬৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ১৪ ডিসেম্বর, তারা আবার সেটি পবিত্রকরণ, সংস্কার আর পুনরায় ঈশ্বরকে নিবেদন করা শুরু করেছিলেন। এটি করতে তাদের আটদিন সময় লেগেছিল। এই পর্বটি ‘ফেস্টিভাল অব লাইটস’ বা হানুকা নামে ইহুদিরা উদ্যাপন করেন। হানুকার সময় প্রতিটি দিন তাদের আটটি বাহুর মোমদানি বা মেনোরায় একটি করে মোমবাতি জ্বালান, রাজা অ্যান্টিওকাসের দ্বারা কলুষিত জেরুজালেমের মন্দিরটি সংস্কারে পুনর্নির্মাণের কথা স্মরণ করতে।
অ্যান্টিওকাস ১৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মারা যান এবং ইসরায়েলের জন্যে জীবন আবার অপেক্ষাকৃত সহজতর হয়ে উঠেছিল। আশঙ্কাজনক একটি স্বাধীনতার পরিস্থিতিতে এটি নিজেকে টিকিয়ে রেখেছিল আরো এক শতাব্দী, এরপর ৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোম এটির দখল নিয়েছিল। এবং খেলার চূড়ান্তপর্বটি শুরু হয়েছিল।