১০. নইহারে ছোট্ট অফিস

দশ

নইহারে ছোট্ট অফিস। তার পাশে রেঞ্জারের কাঠের দোতলা বাংলো। রাস্তার বিপরীত দিকে অনেকখানি ধূ-ধূ মাঠ—ওরা বলে টাঁড়। যশোয়ন্ত বলে বিশ্ব-টাঁড় জায়গা। কোনও নির্জন স্থান বোঝাতে হলেই যশোয়ন্ত এই কথাটা ব্যবহার করে।

একতলায় বসবার ঘর একটি—তাতে হাতির পায়ের টিপয়, বাঘের চামড়ার গালচে, মোটা সেগুন গাছের গুঁড়ির মোড়া, টেবলের উপর ব্যাম্বুসা আরডেনসিয়ার ফুলদানিতে একগুচ্ছ ফিকে, হালকা-রং নাম-না-জানা ফুল। দেওয়ালে টাঙানো বাইসনের মাথা, ভাল্লুকের মুখ, শম্বরের শিং, বুনো-মোষের শিং, দরজার সামনে চামড়ার পাপোষ এবং আরও কত কী। ঘরের বাইরে একপাশে একটি নেয়ারের চৌপাই—তার উপরে একটি চিতল হরিণের চামড়া বিছানো।

ঘরে ঢোকার আগেই চোখে পড়ল যে, ছোট ছেলেরা যেমন করে বাতাবি লেবু দিয়ে ফুটবল খেলে, তেমনি করে একটা ভাল্লুকের গাবলু-গুবলু কেলে-কুচকুচে বাচ্চাকে নিয়ে যশোয়ন্তের চাকর সামনের মাঠের করবী গাছগুলোর পাশে পাশে ফুটবল খেলছে।

তাকে কিছু বলার আগেই সে আমার কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ইসকো কুছভি তকলিফ নেই হো রহা হ্যায় হুজৌর—অ্যাইসেহি রোজ সুবে রেঞ্জার সাব ইসকা সাথ খেলতে হ্যায়।

আমি সভয়ে বললাম, এই কি খেলা?

ও বললে, হ্যাঁ।

বুঝলাম, যশোয়ন্ত নিশ্চয়ই বলেছে, ভাল্লুকরা খুব একসারসাইজ করনেওয়ালা জানোয়ার—বাড়িতে বেশিদিন বসে খেলে স্টিভেডরের বাড়ির মেয়েদের মতো নাদুস নুদুস হয়ে যাবে; সুতরাং রোজ সকালে উঠে গুনে গুনে ওকে পঞ্চাশবার লাথি মারবে। নইলে ওর গায়ে ব্যথা হবে। কিন্তু তারপর নিজের পায়ের ব্যথা সারাবার জন্যে বেচারা রমনলাল যে কুয়োতলায় বসে কাড়ুয়া তেল গরম করে পায়ে লাগাবে, এটা আর যশোয়ন্ত ভাবেনি হয়তো।

শোবার ঘরেও একটি নেওয়ারের খাট। তার উপরে ভাগলপুরি চাদর বিছানো। রাবারের একজোড়া বাথরুম স্লিপার। একজোড়া গামবুট। দেওয়ালের পাশে কাঠের স্ট্যান্ডে পর পর বন্দুক সাজানো। একটি বারো বোরের দোনলা বন্দুক, একটি ফোর-ফিফটি-ফোর হান্ড্রেড ডাবল ব্যারেল রাইফেল, অন্যটি থার্টি ও সিক্স ম্যানলিকার যা দিয়ে ও গাড়ুয়া-গুরাং-এর ঢালে হরিণ মেরেছিল। তা ছাড়া পয়েন্ট টু-টুও একটি।

জানালার পাশে একটি আয়না, তার নীচে একটি ব্রাশ এবং চিরুনি। কোনও রকম কসমেটিক বা আফটার-শেভ লোশান ইত্যাদি ব্যবহার করে না যশোয়ন্ত। আয়নার পাশে একটি কালীমায়ের ছবি। ছবির নীচে দু’টি শুকনো রক্তমুখী জবা।

যশোয়ন্তের ঘরটা ওর মনেরই প্রতীক। নিরাভরণ। বইপত্র ইত্যাদির বালাই নেই। দেওয়ালের মধ্যে একটি ছোট কুলুঙ্গীর মতো। তাতে নানা রঙের নানা সাইজের নিজৌষধির বোতল সাজানো।

ঘরের সংলগ্ন বাথরুম। কাঠের দরজা ঠেলে ঢুকলাম।

জানালা দিয়ে রাস্তাটা চোখে পড়ে। লাল ধুলোর রাস্তাটা সকালের রোদে শুয়ে আছে। ডাক-হরকরা চিঠির খয়েরি ঝুলি ঝুলিয়ে ধুলো উড়িয়ে সাইকেল চালিয়ে আসছে। বাথরুমের জানালায় শিক অথবা পরদা নেই। একটা বড় টার্কিশ তোয়ালে মেলা রয়েছে। মুখ-খোলা জবাকুসুমের শিশির গন্ধ ভুর-ভুর করছে। পরিষ্কার না-করা অবস্থায় সেফটি-রেজারটা পড়ে রয়েছে কাঠের বেসিনের উপর। সামনের দেওয়ালে-ঝোলানো আয়নাতে, নীচের লতানে-ফুলের ছাওয়া জানালায় বসে বড় বড় কামুক ঠোঁটে হাঁ করে যে দাঁড়কাকটা ডাকছে, তার ছায়া পড়েছে।

রেঞ্জ অফিসে নানান জায়গা থেকে ফরেস্ট গার্ডরা এসে হাফপ্যান্টের নীচে খাকি শার্ট গুঁজে হাত নেড়ে কী সব আলোচনা করছে। দু’-একজন ফরেস্ট বাবুও এসেছেন। যশোয়ন্তের ঘোড়া ‘ভয়ংকর’কে আস্তাবলে সহিস দলাই-মলাই করছে। তার চটাং-ফটাং আওয়াজ ভেসে আসছে।

যশোয়ন্তের এই ছোট বাংলোয় বেশ কেমন একটা শান্ত তৃপ্তি আছে। বুদ্ধিমতী মধ্যবিত্ত মিষ্টি মেয়েদের মুখে যেমন দেখা যায়। যশোয়ন্ত যেন বুঝেছে সুখ কোথায় আছে। সুখকে যেন ও হাত দিয়ে ছুঁয়েছে—ছুঁয়ে, মুঠি ভরে, কারও মসৃণ স্তনের মতো নেড়ে-চেড়ে দেখেছে। ভরা-মুঠি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নিজেকে টুকরো টুকরো করে দূরে ছুঁড়ে ফেলেনি। সে সুখ ও জঙ্গলে পাহাড়ে ঘুরেই পাক, কি হুইস্কির বোতল ছুঁয়েই পাক। কী করে যে সে পেয়েছে তা জানি না, কিন্তু ও সুখকে যে নিঃসন্দেহে পেয়েছে, তা আমি নিশ্চিত বুঝতে পাই।

এগারো

একদিন সন্ধ্যার মুখে মুখে নয়াতালাও থেকে একজোড়া হাঁস মেরে টাবড়ের সঙ্গে ফিরছি; অন্ধকার প্রায় হয়ে এসেছে। এমন সময় পথের পাশে একটি পত্র-বিরল নাম না-জানা গাছে আকাশের পটভূমিতে দেখি স্পষ্ট হয়ে একটি হাঁসের মতো পাখি, গাছের প্রায় মগডালে বসে আছে।

পাখিটাকে হাঁসের মতো দেখতে, অথচ এ কেমন হাঁস? যে জল ছেড়ে রসিকতা করবার জন্য গাছের মগডালে বসে থাকে? তা ছাড়া, জোলো কোনও হাঁস গাছে বসে, এমন কথা তো শুনিনি।

আমি নতুন শিকারি। বাছ-বিচার পরে করি। গুলি করি, পাখি মাটিতে পড়ুক, তারপর চেনা যাবে কী পাখি এবং আদপে পাখি কি না।

গুলি করলাম।

ওঃ, আজকাল যা মারছি, সে কী বলব। একেবারে গুরুর মতন। গোলি অন্দর জান বাহার, একদ্দম্ সাথে সাথ।

লদলদিয়ে পড়ল পাখিটা নীচে। এ যে দেখি, হাঁসেরই মতো। জোড়া ঠোঁট, জোড়া পা। আশ্চর্য।

বাংলোর হাতায় ঢুকেই দেখলাম, যশোয়ন্ত বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে।

কখন এলে? কবে এলে? বলে ওকে আপ্যায়ণ করতে না করতে ও টাবড়ের হাতে ঝোলানো পাখিটাকে দেখে আমার দিকে চোখ কটমটিয়ে বলল, ও পাখিটা মারলে কেন? এটা কী পাখি জানো?

আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, না তো জানি না।

যশোয়ন্ত বেশ রাগ-রাগ গলায় বলল, কী পাখি জানো না, ফটাস করে মেরে দিলে? এক রকমের wood-duck। অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য পাখি। একে আমি আজ দু মাস হল লক্ষ করছি—ভাবছিলাম অন্য কোথা থেকে আর একটা উড়ে এলে আমার রেঞ্জে একজোড়া পাখি হবে। আর তুমি মেরে বসলে পাখটাকে?

টাবড়কে খুব ধমকাল যশোয়ন্ত। আমাকে মারতে বারণ করেনি বলে। মানে, ঝিকে মেরে বউকে শেখানো। তারপর বেশ বিরক্তির সুরে, টেনে টেনে আমাকে বলল, আগে জঙ্গলকে চেনো, জানোয়ার, পাখিদের চেনো, তাদের ভালবাসতে শেখো, তারপরই দুম-দুম করে গুলি চালিয়ো। গাছে-বসা পাখিকে গুলি করে মারাতে কোনও বাহাদুরি নেই—যে কেউ মারতে পারে—কিন্তু মারবার আগে যে-পাখির প্রাণটা নিচ্ছ, সে কী পাখি সেটা অন্তত ভাল করে জেনে নিয়ো। তাকে আদপে মারা উচিত কিনা, সেটা জেনে নিয়ো। গাছ চেনো, পাখি চেনো, ফুল চেনো। জঙ্গলের এই শিক্ষাটাই বড় শিক্ষা। বুঝলে, লালসাহেব। গুলি করাটা কোনও শিক্ষার মধ্যেই পড়ে না। ওটা সবচেয়ে সোজা। গুলি করার মধ্যে কোনও বাহাদুরি নেই।

জুম্মান কফি করে নিয়ে এল।

খুব লজ্জিত হয়ে রইলাম।

কিছুক্ষণ পর শুধোলাম, তোমার মা কেমন আছেন?

যশোয়ন্ত বলল, এখন নর্মাল। মা তোমাকে একবার হাজারিবাগে নিয়ে যেতে বলেছেন। মানে, টুটিলাওয়াতে।

আমি বললাম, যাব, নিশ্চয়ই যাব।

যশোয়ন্তকে এমন খারাপ মেজাজে আমি কোনওদিন দেখিনি। সত্যিই তো, ও জঙ্গলের রেঞ্জার। কোনও রকম অনুমতি-টনুমতি নিই না, তার উপর এমন যথেচ্ছভাবে যা মারবার নয় তাই মেরে বেড়াই। রাগ হওয়া স্বাভাবিক। আমি হলেও রাগ করতাম।

কফি আর চিঁড়ে ভাজা খেতে খেতে যশোয়ন্ত হয়তো ভাবল যে, ওরও আমার প্রতি ব্যবহারটা একটু বেশিরকম রূঢ় হয়ে গেছে। জানিনে সে জন্যে কিনা, কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, জানো লালসাহেব, আমি যখন তোমার মতো জঙ্গলে নতুন ছিলাম, তখন এমনই ভুল করে আমি একটা পাখি মেরেছিলাম। হলুদ-বসন্ত পাখি।

আমি তখন একটি মেয়েকে ভালবাসতাম। ডি এফ ও সাহেবের মেয়ে। আমি তখন ছোকরা রেঞ্জার। মেয়েটির নাম ছিল নিনি। শুধু এই হলুদ-বসন্ত পাখি মারার অপরাধে সে আমার সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছিল। তা নইলে আজ আমার জীবন হয়তো অন্যরকম হত।

অনেকক্ষণ আমরা দু’জনে চুপ করে বসে রইলাম।

আমি বললাম, আমার খুবই অন্যায় হয়েছে wood-duck-টা মেরে। বিশ্বাস করো যশোয়ন্ত, আমি জানতাম না।

যশোয়ন্ত বলল, তোমার তো অন্যায় হয়েছেই, কিন্তু তোমার চেয়ে বেশি অন্যায় টাবড়ের। ও জানত, ওটা কী পাখি এবং ও পাখি কতবার দেখতে পেয়েও মারিনি। ভারী বদমাশ শালা।

আমরা দু’জনে আবার অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম।

আমি বললাম, বহুদিন পর আজ এলে, আজ রাতে আমার কাছে থেকে যাও যশোয়ন্ত; বেশ গল্প-গুজব করা যাবে—তুমি হাজারিবাগে যে ক’দিন ছিলে সে ক’দিন ভারী একা একা লেগেছে। তোমার আমার বন্ধুত্বটা যে রীতিমতো সর্বনাশা হয়ে উঠেছে, তা বোঝা যাচ্ছে।

যশোয়ন্ত বলল, কথাটা মন্দ বলোনি। থেকে গেলেও হয় আজ। তবে একটু হুইস্কি খেতে হবে। আর একটা শর্ত। কাল ভোরে উঠেই চলে যাব আমি। অনেকদিন ছুটিতে ছিলাম। অফিসে কাগজপত্র বহু জমে আছে। তা ছাড়া, পরশু আমাকে পাটনা যেতে হবে একটা একসেস ফেলিং-এর কেসে। কেস উঠবে পরশুর পরদিন। ক’দিন থাকতে হবে পাটনায় কে জানে? জুম্মানকে বলো তো, তোমার ওই wood-duck-টাকেই তাড়াতাড়ি রোস্ট করুক। শালাকে খেয়ে শালার দুঃখ মোচন করা যাক।

এই বলে, যশোয়ন্ত উঠে গিয়ে ‘ভয়ংকরে’র পিঠে ঝোলানো রাইফেল ও একটা ঝোলা নিয়ে এল। রাইফেলটাকে ঘরে রেখে এল; ঝোলা থেকে একটা হুইস্কির বোতল বের করল, তারপর ঝোলাটিও ঘরে রেখে এল। তারপর ভয়ংকরকে লাগাম খুলে পেছনের মহুয়া গাছের নীচে বেঁধে এসে বলল, রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর তোমার গ্যারেজে জিপের পাশে থাকবে ভয়ংকর।

বাইরেটায় বেশ জমাট বাঁধা অন্ধকার। আকাশটা মেঘলা আছে বলে। মাঝে মাঝেই মেঘ ফুঁড়ে সদ্য-বিধবার শ্বেতা বিষণ্ণতা নিয়ে শ্রাবণ মাসের চাঁদ উঁকি মারছে। ঝিঁ-ঝিঁ ডাকছে একটানা রুম-ঝুম রুম-ঝুম। অনেক রকম ব্যাঙ, পোকা, জংলি ইদুর সবাই ডাকছে; চলা-ফেরা করছে।

আমার বাংলোর চারপাশে কার্বলিক অ্যাসিড ভাল করে ছিটোই প্রতি সপ্তাহে। গরম আর বর্ষায় সাপের উপদ্রব বড় বেশি। এ-অঞ্চলে শঙ্খচূড় আর বাদামি গোখরোই বেশি। একবার কামড়ালে আর রক্ষা নেই। মাঝে মাঝে তারা আবার শর্ট কাট করার জন্য বাংলোর হাতার মধ্যে দিয়ে এমনকী, কখনও-সখনও আমার বারান্দার উপর দিয়েও যাতায়াত করে থাকে। প্রথম-প্রথম কী যে অস্বস্তি লাগত, কী বলব। আজকাল গা-সওয়া হয়ে গেছে।

গেটের পাশের নালায় প্রায় রোজই সন্ধে-রাত্তিরে সাপে ব্যাঙ ধরে। আর সে এক উৎকট আওয়াজ। আজকাল আর মাথা ঘামাই না। শব্দ শুনে বুঝতে পারি, পুরোটা গেলা হল কি না। মনে মনে বলি, গেলা হয়েছে, এখন যাও বাবা, আর জ্বালি য়ো না।

জুম্মান বারান্দায় আরও চেয়ার বের করে দিল। আমরা দু’জনে বসলাম। যশোয়ন্ত হুইস্কির বোতলটা খুলল। মাঝে মাঝে শালপাতার চুট্টায় টান লাগাতে লাগল।

আমি বললাম, যশোয়ন্ত একটা গল্প বলো। তোমার অভিজ্ঞতার গল্প। বলব বলব করো, কিন্তু বলো না কোনওদিন। তোমার তো কতরকম অভিজ্ঞতা আছে এই জঙ্গল পাহাড়ে।

যশোয়ন্ত কী বলতে গেল, এমন সময় হঠাৎ দূরাগত মাদলের শব্দ কানে এসে পৌঁছল।

রাস্তাটা বাংলোর গেট পেরিয়ে কিছুদূর গিয়ে যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেখান থেকে। তারপরেই একটি হ্যাজাকের আলোর রেশ নাচতে-নাচতে এগিয়ে এল। তারপর রোশনাই। হ্যাজাক জ্বালিয়ে বরযাত্রীরা চলেছে। মধ্যে ডুলিতে বর। সব বরযাত্রীর হাতে একটি করে লাঠি। দু’জনের কাঁধে গাদা-বন্দুক! পায়ে নাগরা। মালকোঁচা মারা, সাজি মাটিতে কাচা ধুতি-কুর্তা। মাদল বাজিয়ে হাঁড়িয়া খেয়ে আনন্দ করতে করতে সকলে চলেছে।

ধীরে ধীরে বরযাত্রীর প্রসেশান আমাদের চোখের বাইরে চলে গেল; মাদলের আওয়াজ আবার ঝিঁঝিঁদের আওয়াজে ডুবে গেল। হ্যাজাকের আলোটা যেন লক্ষ লক্ষ ভাগে বিভক্ত হয়ে লক্ষ লক্ষ জোনাকি হয়ে এই বর্ষণসিক্ত পাহাড়-বনে ছড়িয়ে গেল। পিট-পিট মিট-মিট করতে লাগল। কাছে আসতে লাগল, দূরে যেতে লাগল; দলবদ্ধ হতে লাগল, দলছুট হতে লাগল।

যশোয়ন্ত বলল, এই জঙ্গলেই এক অদ্ভুত ডাকাতের পাল্লায় পড়েছিলাম, তার গল্পই শোনাই। আজকের রাতটা, কেন জানি না আমারও মনে হচ্ছে, গল্প শোনবার মতোই রাত।

হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে যশোয়ন্ত গল্প আরম্ভ করল। যশোয়ন্তের সে গল্প আজ আর হুবহু মনে নেই—তাই আমার জবানীতেই বলি:

গরমের দিন। ফুরফুর করে হাওয়া দিয়েছে শালবনের পাতায় পাতায়। মহুয়ার গন্ধে সমস্ত বন-পাহাড় মাতাল হয়ে উঠেছে। শাল ফুলের সুগন্ধি রেণু জঙ্গলময় উড়ে বেড়াচ্ছে হাওয়ার সঙ্গে।

আমি আর ঝুমরু বসে আছি একটা পাঁইসার গাছের ডালে। গাছের নীচে দিয়ে বয়ে চলেছে লুকুইয়া-নালহা। পাহাড়ি ঝরনা। এখন জল সামান্যই আছে। নদীরেখার এখানে ওখানে বড়-ছোট, কালো-সাদা পাথর। নদীর দু’পাশের বড় বড় শাল গাছের ছায়া ঝুঁকে পড়ে জলের আরসিতে মুখ দেখছে। আমরা বসে আছি ভাল্লুকের আশায়। আমাদের প্রায় হাত পঁচিশেক দূরে, নদীর প্রায় কিনার ঘেঁষে, একটি ফলভারাবনত ঝাঁকড়া মহুয়া গাছ। ঝুমরু গ্যারান্টি দিয়ে নিয়ে এসেছে যে, ভাল্লুক মহুয়া খাবেই। অতএব জুয়াড়ির মতো বসে আছি তো বসেই আছি। চাঁদটা আরও বড় হল। চাঁপাফুলের রং ছিল এতক্ষণ। এবার সেই প্রথম যৌবনের হরিদ্রাভা ঝরিয়ে দিয়ে অকলঙ্ক সাদা হল। তারপর ঝুরঝুরিয়ে ঝরতে লাগল চাঁদ, এই পালামৌ জঙ্গলের আনাচে-কানাচে। চাঁদ যত রূপক্ষরা হতে লাগল, ততই চারদিকে বন-পাহাড় ধীরে ধীরে আলোকিত হয়ে উঠতে লাগল। নদীরেখায় পাথরের ছায়াগুলোকে থাবা-গেড়ে বলো, এক একটি কালো শোন-চিতোয়া বলে ভুল হতে লাগল।

সোজা সামনে লাতের জঙ্গল। বাঁয়ে গাড়ুর বিখ্যাত পাহাড়। ডাইনে রাতের মোহাবরণে মুণ্ডুর জঙ্গলের সীমা দেখা যাচ্ছে। এই পূর্ণিমা রাতের মায়ায় সব মিলেমিশে এক হয়ে সমস্ত প্রকৃতি শুধুমাত্র একটি সুগন্ধি শ্বেতা সত্তায় প্রকাশিত হচ্ছেন।

আটটা প্রায় বাজে। তবুও ভাল্লুকের ‘ভ’ নেই। রাইফেলটা আড়াআড়িভাবে পায়ের উপর রেখে, পেছনের ডালে হেলান দিয়ে একটু আরাম করে বসবার চেষ্টা করছি।

ঝমরুর মুখ দিয়ে মহুয়ার তাড়ির এমনই খুশবু বেরোচ্ছে যে, আমার মনে হল ভাল্লুক যদি আদৌ আসে, তো মহুয়া গাছে না এসে ঝমরুর মুখ চাটতে আসবে। এদিকে পা-টাও টনটন করছে এমনভাবে এতক্ষণ বসে থেকে।

যথাসম্ভব কম শব্দ করে পা-টা ঠিক করে বসছি, এমন সময় নদীরেখায় আমাদের থেকে বেশ অনেকটাই দূরে কী একটা আওয়াজ শুনলাম। কান খাড়া করে শুনতে মনে হল যে, সে শব্দ দেহাতি নাগরা জুতোর নীচের লোহার নালের সঙ্গে পাথরের ঘষা লাগার শব্দ।

তার মানে, কোনও লোক লুকুইয়া-নাল্‌হা ধরে এদিকে আসছে।

কানে কানে ঝুমরুকে শুধোলাম—কোই বারুদী বন্দুকওয়ালা হ্যায় ক্যা?

ঝুমরু উত্তরে ওর হাত দিয়ে প্রায় আমার মুখচাপা দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল—বাত মতো কিজিয়ে হুজৌর। লগতা কি সুগান সিংহি আ রহা হ্যায়। বিলকুল চুপ রহিয়ে।

সুগান সিং কে? এবং তাকে এমন ভয় করারই বা কী আছে?

তখন শুধোবার উপায় ছিল না। তবু রাইফেলটাকে আনসেফ করে, ডান হাতটা কুঁদোর কাছে চেপে ধরে, সেই জ্যোৎস্নাপ্লাবিত বন-পাহাড়ে অপরিচিত ও ভয়ানক সুগান সিং-এর পদক্ষেপ শুনতে লাগলাম।

খটাং খটাং নালের আওয়াজ হচ্ছিল। যদি সে শিকারি হত, তবে সে নিজের আগমন বনে বনে এমন করে প্রকাশ করত না।

দেখতে দেখতে দূরে একটা বড় কালো পাথরের আড়াল থেকে একটি দীর্ঘদেহী কালো ছিপছিপে লোক বেরিয়ে এল। গায়ে একটি দেহাতি ফতুয়া, পরনে মালকোঁচা-মারা ধুতি, কাঁধের উপর শোয়ানো টেলিস্কোপিক লেন্স লাগানো একটি রাইফেল। চাঁদের আলোয় চকচক করছে। লোকটি বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে আসছিল। মাঝে মাঝে কেন্দুপাতার পাকানো বিড়িতে সুখটান লাগাচ্ছিল। সে আমাদের দেখতে পেল না। দেখতে পাবার কারণও ছিল না। কারণ আমরা যে পাঁইসার গাছে বসে ছিলাম, সেটা রীতিমতো ঝাঁকড়া। সুগান সিং নাগরা খটখটিয়ে আমাদের সামনে দিয়ে হেঁটে গিয়ে লুকুইয়া-নালহা ধরে ডাইনে মোড় নিল।

লোকটা চলে যাবার পর ঝুমরু নিশ্বাস ফেলে বলল—বাপ্পারে বাপ্পা, বনদেওতা কা দোয়াসে বড়ী জোর বাঁচ গ্যয়া আজ।

আমি শুধোলাম, লোকটা কে? তাকে এত ভয়েরই বা কী?

ঝুমরু চোখ বিস্ফারিত করে বলল—ডাকাইত বা। ঔর কৌন? কিতনা আদ্‌মীকো জাসে মারা উস্‌কো কই ঠিকানাহি নহী।

মারে কেন?

কৌন জানতা? সায়েদ বদলা লেতা হোগা।

বদলা কীসের?

উত্তরে ঝুমরু বলল, সুগান সিং-এর বাবা, মা, বুড়ি ঠাকুমা ও ছোট বোনকে পাশের পাহাড়ের অবস্থাপন্ন মাহাতো একসঙ্গে এক ঘরে পুড়িয়ে মেরেছিল। এ পর্যন্ত সুগান সিং সেই মাহাতো পরিবারের চারজনকে খুন করেছে। তা ছাড়া তার পথে যারা বাধা দিতে এসেছে, তারা যে কত খুন হয়েছে তার লেখাজোখা নেই।

বললাম, পুলিশ নেই? পুলিশ কী করে?

ঝুমরু বলল, পুলিশ থাকবে না কেন? ডি-আই-জি সাহেব একবার নিজে এসেছিলেন বড় ফৌজ নিয়ে। সুগান সিং-এর নাগাল পেলেন না। শোন্‌চিতোয়ার মতো সেয়ানা এই সুগান সিং। তা ছাড়া ধরতে পারলেও, সাক্ষীই হয়তো জোগাড় হবে না। কারণ, সাক্ষী রেখে তো কেউ কাউকে খুন করে না।

তারপর একটু থেমে বলল—বহত মুশকিল কা বাত। ঈ তামাম জংগল্লে উসীকা রাজ হ্যায়।

ভয় করে না? শিকারে শিকারে ঘুরিস?

ভয়?

ঝুমরু সগর্বে তাড়ি-খাওয়া, কামার্ত মুখখানা আমার দিকে ফিরিয়ে বললে—ঝুমরু কাউকে ভয় করে না।… বাপকি বেটা, সিপাহি কি ঘোড়া, কুছ নহিত থোড়া থোড়া।

শুধোলাম, ভয় করিস না, তো মারলি না কেন তখন সুগান সিংকে? ঝুমরু বলল, জীনে দিজীয়ে হুজৌর কুত্তাকো। সাল ডাকাইতকো।

এমন গড়গড় করে ইতিহাস বলার পরেও যে, কোনও জানোয়ার এ তল্লাটে আসবে—তা আমার মনে হল না। ঝুমরুকে সে কথা জানাতেই সে মহাবিক্রমে প্রতিবাদ করে বলল—বে-ফিক্কির রহিয়ে হুজৌর, হিঁয়াকা ভাল্ সব বহেড়া হ্যায়। অর্থাৎ ঘাবড়াবার কোনও কারণ নেই, এখানকার ভাল্লুকরা সব কালা।

অতএব, নড়ে চড়ে ঠিক হয়ে বসলাম—কতক্ষণ বসে থাকতে হবে এই তাড়িখোরের পাল্লায় জানি না। এমন সময়, আমাদের ঠিক পেছন থেকে জলদ-গম্ভীর গলায় কে যেন বলল—মেহেরবাণী করকে জরা উতারকে আইয়ে সাহাব।

চমকে তাকিয়ে দেখি, আমাদের দিকে রাইফেল উঁচিয়ে সুগান সিং দাঁড়িয়ে আছে। সেই মোহাবিষ্ট রাতে, চাঁদের আলোর বুটি-কাটা জাফরিতে দুটি পাকানো গোঁফসমেত সুগান সিং-এর মুখের কথা, এখনও মাঝে মাঝে মনে পড়ে।

রাইফেলটা আমার হাতে ধরাই ছিল, সেটাকে ওঠাবার চেষ্টা করতেই, সুগান সিং ওর রাইফেলের নলটা আমার পিঠে ঠেকিয়ে দিল। ঝুমরু সেই সময় ইচ্ছা করলে ওর গাদা বন্দুক দিয়ে গুলি করতে পারত, কিন্তু করল না। সুগান সিং নবাবী কায়দায় বলল, আপকো রাইফেল মুঝে দিজিয়ে সাহাব।

বুঝলাম, আপত্তি করে লাভ নেই। ভয় পেয়েও লাভ নেই।

সুগান সিং আমার রাইফেলটা কাঁধে ঝুলিয়ে ওর রাইফেলটা বগলে চেপে যেন অনুনয় করে বলল, অব চলা যায়।

ঝুমরুর গাদা বন্দুক গাছের ডালে যেমন ছিল তেমনই রইল। সুগান সিং মানা করল ঝুমরুকে ওতে হাত দিতে। তারপর আমাদের নিরুদ্দেশ যাত্রা শুরু হল।

আগে ঝুমরু, তারপর আমি, সকলের পেছনে সুগান সিং। মাঝে মাঝে পেছন থেকে সংক্ষিপ্ত আদেশ আসছে, ‘ডাইনে’, ‘বাঁয়ে’, ‘নিচুসে’,—ইত্যাদি।

চলতে চলতে ঝুমরু কথা বলল—হামলোগোঁকা কঁহা লে যা রহা হ্যায় জী?

বলার সঙ্গে সঙ্গে, আমাকে টপকে গিয়ে সুগান সিং ঝুমরুর ঘাড়ে পড়ল। ঘাড়ে পড়ে রাইফেলের কুঁদো দিয়ে চোখের নিমেষে ওকে এক ঘা কষাল। ঘা খেয়ে ঝুমরু পাথরের উপরই ছিটকে পড়ল। ওর কনুই কেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোতে লাগল। সুগান সিং ওকে লাথি মেরে উঠিয়ে বলল—চল চল, শো গ্যয়ে মেরি টীকায়েতকা বেটা।

আমার ডানদিকের একটা দাঁতে পোকা ছিল। বেশ ব্যথা ছিল গালে। মনে মনে প্রার্থনা করলাম ভগবানের কাছে যে, সুগান সিং আমাকে আর যেখানেই মারুক, ডান গালে যেন না মারে।

পথে যে কত পাহাড়ি নদী পেরোলাম, তার ইয়ত্তা নেই। কাক-জ্যোৎস্নায় হাসছে চারদিক। আর সেই অসহনীয় নিস্তব্ধতাকে মথিত করে বনে-পাহাড়ে আমরা হেঁটে চলেছি। সুগান সিং-এর নাগরার নালের সঙ্গে পাথরের ঘষা লেগে খটাং খটাং শব্দ হাওয়া ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।

প্রায় আধ ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর আমরা একটি সুন্দর ছোট মালভূমিতে এসে পৌঁছালাম। গভীর জঙ্গলের মধ্যে কিছুটা জায়গা আবাদ করা হয়েছে জঙ্গল কেটে। ছোট ছোট তিন-চারটি কুঁড়ে ঘর। মাটির দেওয়াল, খাপরার চাল। ঘরের মধ্যে, মধ্যের ঘরটি অপেক্ষাকৃত বড়। সেই বড় ঘরটিতে মিটিমিটি করে কেরোসিনের কুপি জ্বলছে। কিন্তু জায়গাটা এমন ভুতুড়ে মনে হল যে, বিশ্বাস হল না এখানে আদৌ কেউ থাকে বা থাকতে পারে। থাকেও না হয়তো। এখানেই বোধ হয়, আমাদের কোর্ট মার্শাল হবে। ভগবান জানেন।

সেই শব্দহীন জগতে, আমরা তিনটি প্রাণী প্রেতমূর্তির মতো এসে দাঁড়ালাম।

ঘরগুলোর কাছে একটি ঝাঁকড়া সাগুয়ান গাছ। তার নীচে গোটা দুই চারপাই পাতা আছে। সুগান সিং আমাদের সেখানে গিয়ে বসতে ইশারা করে, সাবধানে সেই মধ্যের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ভেতরে উঁকি দিল। তারপর ডাকল, সুরাতীয়া, এ-সুরাতীয়া।

চাঁদের আলোয় ডাকাইত সুগান সিং দাঁড়িয়ে ছিল। ভাল করে দেখলাম। ছিপছিপে হলে কী হয়, শরীরে অসম্ভব বল রাখে সে, তা গড়ন দেখলেই বোঝা যায়। চোখ দুটো দিয়ে যেন বুদ্ধি ঠিকরে পড়ছে। কিন্তু বেশ শান্ত সমাহিত। গোঁফ দুটো না থাকলে ওকে কেউ ডাকাত বলে বিশ্বাসই করত না।

কপালে কী আছে জানি না। তবে সত্যি বলতে কী, ঝুমরুর জামা-কাপড় রক্তে ভেসে যেতে দেখেও, আমার বেশ মজা লাগছিল। শেষ পর্যন্ত কী হয় দেখাই যাক না, এই কথাই প্রথম থেকে ভাবছিলাম। এদিকে ঝুমরু মাঝে মাঝে ওর রক্তাক্ত জামা-কাপড়ের দিকে তাকাচ্ছে আর বলছে,—‘হা রাম, হা রাম, ঔর জীনা নহী হ্যায়।’

আবার ডাকল সুগান সিং: সুরাতীয়া, এ-সুরাতীয়া।

সেই চাঁদনি রাতের ঘুমপাড়ানি রাতের ঘরে জানি না কোন সুন্দরী ঘুমিয়েছিল। সে আনন্দে ঘুম-ভাঙা গলায় চিকন স্বরে ভিতর থেকে শুধোল,—ক-ও-ন?

উত্তরে সুগান সিং হাসতে হাসতে বলল,—ঔর ক-ও-ন? তুহর সুগান বা।

তার পরের দৃশ্যের জন্যে মনে মনে তৈরি ছিলাম না।

মেয়েটি প্রায় দরজা ভেঙে বাইরে এসে, শ্রাবণ মাসের কোয়েল নদীর স্রোতের মতো, সুগান সিং-এর বুকে আছড়ে পড়ল। আর সুগান তারে রাইফেল ধরা হাতেই জড়িয়ে ধরে এমনভাবে ও এতক্ষণ ধরে চুমু খেল যে, আমার মনে হল, প্রথম দাড়ি-কামানোর পর থেকে ডাকাতের পুঞ্জীভূত সমস্ত কামনা সেই একটি চুমুতে কেন্দ্রীভূত হল।

সুগানের সব ব্যাপারেই ডাকাইতি।

আলিঙ্গনের ঘোর কাটতেই মেয়েটির নজর যেই হতভাগ্য আমাদের দিকে পড়ল, অমনি সে লজ্জায় মরে গিয়ে, শাড়িতে ঢেউ তুলে, জ্যোৎস্না সাঁতরে, ঘরে গিয়ে দুয়ার দিল।

আর সুগান সিং হাসতে লাগল। হাঃ হাঃ হাঃ করে।

এতক্ষণে সুগান সিং-এর যেন মনে পড়ল আমাদের কথা। হঠাৎই খুব বিনয়ের সঙ্গে বলল আমাকে,—তসরিফ রাখিয়ে সাহাব, তসরিফ রাখিয়ে।

সসংকোচে বসলাম চৌপায়াতে।

পাশের কুঁড়ে থেকে একটি লোক যেন মন্ত্রবলে বেরিয়ে এল। সুগান সিং তাকে আদেশ করল, এ রামরিচ, সরবৎ লাও।

প্রায় দশ মিনিটের মধ্যে পাথরের গেলাসে করে সরবৎ এল। মনে হল সিদ্ধির, কিন্তু জিজ্ঞাসা করতে সাহস হল না। তখন প্রাণের দায়। অমন সুগন্ধি সরবৎটাও রসিয়ে খেতে পারলাম না। কীসের সরবৎ তা কে জানে? এই হয়তো জীবনে শেষ খাওয়া।

সুগান সিং নাগরা খুলে মাটিতে বসে পড়ল, যেন আমাকে সম্মান করার জন্যেই। বসে বসে গোঁফে তা দিতে লাগল। কাছ থেকে ওকে দেখলাম। খুব বেশি হলে তিরিশ বছর বয়স হবে।

হঠাৎ সুগান সিং কথা বলল। বলল, মুঝপর নারাজ না হো সাহাব। আমি আপনাকে এবং আপনার মিথ্যেবাদী অনুচরকে এতখানি রাস্তা কষ্ট দিয়ে এনেছি, শুধু আমি যে ডাকাইত নই, সে কথাটা জানাতে। আমার পরিবারের সকলকে গিধ্বর মাহাতো পুড়িয়ে মারল। তখন আমার কী-ই বয়স সাহাব। একদিন কূপ কাটতে গেছি গাভুর জঙ্গলে। ফিরে এসে দেখি, সমস্ত বাড়ি পুড়ে ছাই। তার মধ্যে মা’র ঠাকুরমার এবং বোনের রুপোর গহনা খুঁজে পেয়েছিলাম, ছাইয়ের সঙ্গে মিশেছিল। বাবার কোনও চিহ্ন পাইনি। সবই ছাই হয়ে গিয়েছিল। আমার দিদিকে সে ঘটনার দু’মাস আগে একদিন মাহাতো ধরে নিয়ে গেছিল। সেখান থেকে পালাবার সময় রাতের বেলা ভাল্লুকের মুখে পড়ে। আপনারা তো ভাল্লুক শিকারে এসেছিলেন, তাই না? ভাল্ আমিও খুব মারি। দিদি মারা যাবার পর থেকে বেশি করে মারি। তা ছাড়া, মাহাতোও মারি। টীকায়েত মারিনি এ পর্যন্ত। আজই প্রথম মারব টীকায়েতের বেটাকে। বলে, ঝুমরুর দিকে আড়চোখে চেয়ে বলল, ওকে পেটে গুলি করে মারব, যাতে বেশি কষ্ট পেয়ে মরে। সাহাব, মাহাতো যে আমার পরিবারের সকলকে পুড়িয়ে মারল, কই তার তো কোনও বিচার হল না। বিচার নেই বলেই রাইফেল হাতে বিচার খুঁজতে বেরোতে হল আমাকে। আমার উপায় ছিল না।

হুজৌর, ইয়ে বাত তো সাহী হ্যায় যো ম্যায় উস লোগোঁকো গোলীসে ভুঁঞ্জ দিয়া। মগর দুখ মুঝে এহি হ্যায়, কি উসলোগোকো আগসে জ্বলানে নেহি সেকা।

সুগান সিং তারপর হঠাৎ শুধাল, আপ কাঁহাকে রহনেওয়ালা হ্যায় সাহেব? বানিয়ে বললাম, বঙ্গালকা। কাঁহাকা? ও আবার শুধোল। আবার বানিয়ে বললাম, কলকাত্তাকা।

কলকাতা শুনেই সুগানসিং প্রায় চমকে উঠল; বলল, আরে রাম। আপতো মেরি শ্বশুরালকে আদমী। বলেই হাঁক ছাড়ল, আরে এ সুরাতীয়া ইধির আওয়াত জেরা।

সুরাতীয়া দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে এক-পা এক-পা করে ঘর থেকে বেরিয়ে চাঁদে ভিজে সপসপে আঙিনা বেয়ে আমাদের কাছে এসে দাঁড়াল। মাথায় ঘোমটা টানা। একটু আগের লজ্জা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ঘোমটার ফাঁকে লজ্জাবনত মুখ থেকে একটি সুকুমারী চিবুক উঁকি দিচ্ছে।

সুগান সিং বললে, আরে সাহাব কলকাত্তাকা রহনেওয়ালা বাংগালি। মনে হল, ‘বাঙালি’ কথাটা শুনেই সুরাতীয়ার ভীষণ অস্বস্তি হল, কিঞ্চিৎ ভয়ও পেল। এমনকী, মনে হল, ওর পা দুখানি কোনও নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে যেতে চাইছে। সুগান সিং সাহস দিয়ে বলল, আরে ডর ক্যা, বাত করো।

সুরাতীয়া মুখ তুলল, লজ্জা ভেঙে। দেখলাম, একটি সংস্কৃত, লাবণ্যময়ী বাঙালি বাঙালি-মেয়ে। গড়নটি ভারী সুন্দর। মাথাভর্তি এত চুল যে, খোঁপার ভারটা যেন যৌবনের চেয়ে ভারী বলে ঠেকল। সুরাতীয় পরিষ্কার বাংলায় বলল, আমরা তিন পুরুষ বাংলা দেশে; কলকাতায়। আমার বাবার কয়লার ব্যবসা ছিল কলকাতায়। এখনও আছে—বলে অস্ফুটে থেমে গেল।

ঝুমরুর তাড়ির নেশা মারের চোটে কেটে গেলেও, সিদ্ধি খেয়ে আবার নেশার মতো হয়েছিল। কিংবা মৃত্যুভয়ে ওরকম করছিল কিনা জানি না। কিন্তু সে যে কারণেই হোক, সুরাতীয়াকে বাংলায় কথা বলতে দেখে, ওর আর সহ্য করার ক্ষমতা রইল না। এত বিস্ময় এক জীবনে অসহ্য। হা রাম! বলে সে চৌপায়ায় প্রায় অজ্ঞান হয়ে শুয়ে পড়ল।

সুরাতীয়াকে বললাম, বসো বসো। তোমার নামটি তো বেশ। কথা না বলে সুরাতীয়া মাথা নিচু করে হাসতে লাগল।

সুগান সিং বলল, ও নাম আমি দিয়েছি। ওর আসল নাম ছিল আরতি। আমাদের ঝুমুরের গানের সুরে মিলিয়ে আমি ওর নাম দিয়েছি। শোনেননি সে গান?

“তু কেহরো?

কচমচ ছাতি?

তোরা সুরত দেখি মোরা

বসল নজারীয়া, হো বসল নজারীয়া।

হো তন কৈসানা দিনা

দেখব নজারীয়া হো; দেখব নজারীয়া।”

তার সঙ্গে মিলিয়ে সুরাতীয়া। ভাল হয়নি?

সুরাতীয়া খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। সুগান সিং-কে কপট ধমক দিয়ে বলল, ধেৎ। আমি হেসে উঠলাম। মৃত্যুভয় থাকা সত্ত্বেও। তারপর বললাম, চমৎকার হয়েছে। তুমি তো রীতিমতো কবি হে সুগান।

সুগান উত্তর না দিয়ে বলল, আপলোগ গপ সপ কিজিয়ে সাহাব। ইতনা রোজ বাদ শ্বশুরালকা আদমী আয়ে হেঁ। ম্যায় চলে মোরগা পাকানে—চলরে রামরিচ, বলে লোকটিকে ডেকে নিয়ে চলে গেল সুগান সিং। যাবার সময় আমরা রাইফেল এবং ওর রাইফেল দুটোই আমার জিম্মায় রেখে গেল।

এ আচ্ছা ডাকাতের পাল্লায় পড়া গেল যা হোক। আরতি আস্তে আস্তে কথা বলছিল।

ওদের বাড়ির পাশেই, গোয়ালাদের খুব বড় বাথান ছিল। সে গোয়ালা সুগানের কীরকম আত্মীয় হত। বুড়ো মাহাতোকে খুন করে সুগান কলকাতায় গেছিল গা-ঢাকা দেবার জন্যে। আরতি তখন ক্লাস নাইনে পড়ত। একটু বেশি বয়সেই। আরতি কোনওদিন সুগানকে লক্ষ করেনি। গোয়ালাদের কাছে কত দেশোয়ালীই তো আসত-যেত।

একদিন শীতকালের বিকেলে, স্কুল থেকে বন্ধুর বাড়ি গেছিল পড়া দেখতে। ফিরতে রাত হয়ে গেছিল। টিপ টিপ করে বৃষ্টিও পড়ছিল। খুব শীত। গলির মোড়ে, দুধ বইবার বন্ধ ঘোড়ার গাড়িতে সুগান সিং এবং ওর দুজন সাকরেদ ওকে জোর করে উঠিয়ে নিয়েছিল। সেখান থেকে হাওড়া স্টেশান এবং সেখান থেকে এখানে।

অনেকক্ষণ চুপ করে রইল আরতি।

বুঝলাম, সেইসব প্রথম দিকের অনভ্যস্ত ও ক্লান্ত দিনগুলোর কথা ওর মনে পড়ছে।

আরতি বলল, প্রথম প্রথম অনেক কাঁদতাম, এই বর্বরের পাল্লায় পড়ে। আমার বুড়ো বাবার কথা মনে হত। আর তো আমার কেউ নেই। প্রায় তিন বছর হতে চলল, এসেছি। জানি না, বাবা বেঁচে আছেন কিনা। এখন ফিরে যাবার কোনও উপায়ও আর নেই। সুগান হয়তো ছেড়ে দিলেও দিতে পারে, কিন্তু আমাকে ফিরিয়ে নেবে কে? আপনাকে আমার বাবার ঠিকানা দেব। আপনি একটু খোঁজ করে আমায় জানাবেন, উনি কেমন আছেন? আমি যে বেঁচে আছি, একথা আবার বলবেন না যেন। বাবার কথা জানতে ইচ্ছা করে।

দেখলাম আরতির দু চোখে দু ফোঁটা জল চিকচিক করছে।

ওকে শুধোলাম, সুগান সিং তোমাকে খুব ভালবাসে, না?

আরতি লজ্জা পেল। তারপর লজ্জায় মাথা নোয়াল। বলল, নোকটা বড় ভাল। একেবারে ছেলেমানুষ। আমাকে ধরে নিয়ে এসে ও যে অন্যায় করেছে, তা ও সবসময় বলে। বলে, ওর জীবনের এটাই নাকি সবচেয়ে হীন অপরাধ। ও বড় দুঃখী। ওর সত্যিই কেউ নেই। পৃথিবীজোড়া ভয় আছে, বিপদ আছে, সন্দেহ আছে, আর থাকবার মধ্যে এক আমি আছি। তবে আমি মানিয়ে নিয়েছি। এখন আর তেমন খারাপ লাগে না। কেবল এই ভয়টা ছাড়া আর সব কিছুই ভাল লাগে।

শুধোলাম, তোমাদের কোনও সন্তান নেই সুরাতীয়া?

ও বলল, সন্তান হয়েই মারা গেছে। এইখানেই। দেড় বছর আগে। আমিও মরতে পারতাম। ডাক্তার ডাকার উপায় ছিল না। তারপর হঠাৎ কী মনে হওয়াতে বলল, আপনি একটু বসুন, আমি দেখে আসি ওরা রান্নার কী করল।

সুরতীয়া চলে যেতেই ঝুমরু বলল, চালিয়ে সাহাব, অব ভাগ যায়। দোনো রাইফেলভি তো আপকা পাসই হায়।

আমি বললাম, মোরগার ঝোল না খেয়ে আমি এক পাও নড়ছি না। বড় পরিশ্রম হয়েছে।

ঝুমরু প্রথমে আমার কথা বিশ্বাস করল না। তারপর অবিশ্বাস করার মতো মনের জোর সংগ্রহ করতে না পেরে আবার শুয়ে পড়ল।

আমি বললাম, ব্যথা কেমন? এখনও রক্ত পড়ছে? ও বলল, না। ব্যথাও নেই, রক্তও পড়ছে না। এ সরবৎ-এ কোন দাওয়াই ছিল।

সুরাতীয়ার কথা ভাবছিলাম। আমি যদি সুরাতীয়ার মতো কোনও সুগন্ধি মেয়ে হতাম, তাহলে আমি এই জীবনকে ঈর্ষা করতাম। কলকাতার থেকে কী হত জানি না। কলকাতায় একঘেয়ে, বৈচিত্র্যহীন দৈনন্দিনতার গ্লানির জীবনে ও এর চেয়ে কী এমন বেশি পেত, ওই জানে।

সে রাতে অনেক খেলাম। পরম তৃপ্তিভরে। রোটি, মোরগার ঝোল এবং লেবুর আচার।

বিদায় নিয়ে যাবার সময় আরতি কেঁদে ফেলল। ওর বাবার ঠিকানা দিল। আর বার বার বলল, কাউকে যেন বলবেন না যে, আমি বেঁচে আছি।

সুগান সিং আমাদের লুকুইয়া-নাল্‌হা পর্যন্ত পৌঁছে দেবে বলল। বারণ করলাম, শুনল না। বলল, চিনে যেতে পারবেন না; কেউই পারে না।

এক-আকাশ চাঁদের নীচে শহুরে আরতি, যে ডাকাইত সুগান সিং-এর ‘সুরাতীয়া’ হয়ে গেছে,—সে আমাদের পথের দিকে চেয়ে রইল। ওর কাছে অনেকদিন পর ওর শৈশব আর কৈশোরের কলকাতা এসেছিল, আবার ফিরে চলল; আমার সঙ্গে।

লুকুয়াই-নালহার মুখে এসে যখন পৌঁছালাম, তখন রাত প্রায় দুটো। পাহাড়তলিতে রাতচরা পাখি ডেকে ফিরছে।

সুগান সিং আমার হাত ধরে বলল, আব বিসওয়াস কিঁয়ে হ্যায় তো সাহাব, যো ম্যায় ডাকাইত নহী হুঁ?

ওর কাঁধে হাত রেখে আমি বললাম, তুমি ডাকাত কেন হতে যাবে সুগান সিং?

সুগান সিং কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল রাইফেলে হাত রেখে। ঝুমরুকে বলল, মুঝপর গোসসা না হো ভাই। তুম মুঝে কুত্তা বোলাথা উস লিয়ে তুমনে জেরাসা শিখলায়া। কুত্তা পহ্‌চান্তে পহ্‌চান্তে জিন্দাগী বরবাদ হো চুকা। মুঝে কুত্তা না কহো ইয়ার, কুত্তা না কহো। কভ্‌ভী না কহো।

তারপর আমাদের পিছনে সুগান সিং-এর ছিপ্‌ছিপে চেহারা টিটি পাখির ডাকের সঙ্গে চাঁদের সায়ান্ধকার বনে হারিয়ে গেল।

এই অবধি বলে যশোয়ন্ত থামল। এক চুমুকে খেয়ে নতুন করে একটা চুট্টা ধরাল। ওর গল্প শেষ হতেই ঝিঁঝিদের ঝুমঝুমি আবার প্রখর হল।

আমি বললাম, আর কখনও দেখা হয়নি সুরাতীয়া বা সুগান সিং-এর সঙ্গে?

যশোয়ন্ত বলল, সুগান সিং-এর মৃতদেহ দেখেছিলাম। রক্তাত্ত, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় প্রায় দেড় বছর বাদে।

ডালটনগঞ্জ থেকে পুলিশ ফোর্স এসেছিল। চারজন পুলিশও মারা গেছিল গুলিতে। আর সুরাতীয়া?

সুরাতীয়ার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। তবে শুনেছিলাম, ডালটনগঞ্জের চমনলালবাবু ওকে এনে নিজের বাড়িতে মেয়েদের সঙ্গে রেখেছিলেন সমস্ত শুনে। ও নাকি ঠিক করেছিলো, প্রাইভেটে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষাটাও দেবে। কিন্তু সমাজের শিরোমণি রায় দিয়েছিলেন যে, অমন ডাকাতের বউকে ভদ্রলোকের বাড়িতে রাখা মোটেই ভদ্রজনোচিত কাজ নয়। চমনলালবাবুর নামে ওরা সকলে চতুর্দিকে নানারকম কুৎসা রটাচ্ছিল। উনি নাকি নিজের লালসা চরিতার্থ করার জন্যে বুনো ময়না এনে নিজের খাঁচায় পুষেছেন।

অবশেষে যা হয়ে থাকে, তাই হল। সুরাতীয়াকে একদিন চমনলালের বাড়ির শেষ আশ্রয়ও ত্যাগ করতে হল। কলকাতায় সত্যি সে আর ফিরে যায়নি। এখনও ডালটনগঞ্জেই আছে। ডালটনগঞ্জের পাড়া-বিশেষে তার বিশেষ কদরও হয়েছে। ইংরেজি-জানা দেহপসারিণী সে পাড়ায় তখনও অচেনা ছিল। তারপর থেকে সুরাতীয়া বিকিকিনি শরীরিণী হয়ে গেছে।

গল্প বলা শেষ করে অনেকক্ষণ চুপ করে যশোয়ন্ত বলল, মাঝে মাঝে সুগান সিং-এর উপর রাগ হয়। সেদিন চাঁদনি রাতে সুরাতীয়ার গল্প শুনতে শুনতে সুগান সিংকে যে বীরপুরুষের আসনে মনে মনে বসিয়েছিলাম, তাকে সে আসনে এখন আর বসাতে পারি না। সত্যি কথা বলতে কী লালসাহেব, দু’-একটা শারীরিক বীরত্বের নিদর্শন রাখলেই বীর হওয়া যায় না। সুরাতীয়ার যে শাস্তি, তা সুগানের অপরিণামদর্শিতার জন্যেই। সুগান সিং-এর মতো লোকের, নিজের জীবনের সঙ্গে কোনও ভাল মেয়ের জীবন জড়ানো ঠিক হয়নি। সুগান সিং-এর দৃষ্টান্ত দেখে আমি নিজে অনেক শিখেছি।

কেন বলছ ও কথা?—আমি বললাম।

এ অঞ্চলের লোকেরা আমাকে একটা মস্ত সাহসী বীর বলেই জানে। কই, সব কিছু জেনেও, চমনলালবাবুর আশ্রয় হারানোর পর সুরাতীয়াকে তো আমিও আশ্রয় দিতে পারিনি। যত বড় বীরই ওই মূর্খ লোকগুলো আমাকে বলুক না কেন, আমার সাহসের প্রচুর অভাব আছে। ভিতরে ভিতরে আমরা সবাই ভীরু।

সমাজের প্রতীক বাজপাখিটা যখন আকাশে উঠে তুক্ষু সুরে ডাকতে ডাকতে আমাদের মাথার উপর ঘোরে, তখন আমাদের মতো অনেক সাহসী লোকই মেঠো ইঁদুরের মতো চুঁইচুঁই করতে করতে গর্তে ঢোকে। যদি কোনওদিন ওই বাজপাখিটাকে মারতে পারি লালসাহেব, সেদিন জানব, আমার রাইফেল ধরা সার্থক হয়েছিল।

জুম্মান এসে উড ডাক-এর রোস্টটা সামনে ট্রেতে রেখে গেল।

যশোয়ন্ত একসঙ্গে অনেক কথা বলে ফেলেছে। এখন কথা বলছে না। চুট্টার আলোয় বারান্দার সায়ান্ধকারে ওর চোখ দুটো চকচক করে উঠছে।

বারো

শুতে শুতে বেশ রাত হয়েছিল। শোবার আগে সুগান সিং আর সুরাতীয়ার কথা মাথা মধ্যে কেবলই ঘুরছিল।

জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল আকাশের মেঘ কেটে গেছে। ভিজে বন পাহাড়ে চাঁদের আলো পিছলে পিছলে যাচ্ছে। একটানা ঝিঁঝির ডাক মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করছে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই।

আচমকা ঘুম ভেঙে গেল প্রচণ্ড শব্দে, শুনে মনে হল রাইফেলের শব্দ। একসঙ্গে বোধ পয়, পাঁচ-ছটা গুলি হল। আমার হঠাৎ মনে হল, যশোয়ন্তের সুগান সিং-এক সঙ্গে বুঝি আবার পুলিশি ফৌজের লড়াই শুরু হয়েছে। তারপরই ভুল বুঝতে পারলাম। সুগান সিং তো কবে মরে গেছে।

পরমুহূর্তেই দরজায় জোর ধাক্কা পড়ল। লালসাহেব! লালসাহেব!

যশোয়ন্ত ডাকছে।

ধড়মড়িয়ে উঠে দরজা খুলতেই যশোয়ন্ত উত্তেজিত গলায় শুধোল, তোমার জিপে তেল আছে?

ব্যাপার বুঝতে পারলাম না। ঘুমের ঘোরেই বললাম, হ্যাঁ।

ও বলল, চাবিটা দাও। তোমার বন্দুকটাও নাও। শিগগির চলো। এই বলে পায়জামার উপরে হাতকাটা গেঞ্জি পরা অবস্থাতেই যশোয়ন্ত রাইফেল হাতে দৌড়ে গিয়ে জিপের স্টিয়ারিং-এ বসল। যন্ত্র-চালিতের মতো আমিও বন্দুকটা নিয়ে গিয়ে ওর পাশে বসলাম। যশোয়ন্ত ঘর থেকে বেরুবার সময় আমার পাঁচ ব্যাটারির টর্চটা নিয়ে গিয়েছিল হাতে।

অত জোর জিপ চালাতে যশোয়ন্তকে আমি কোনওদিন দেখিনি। ওকে যেন নিশিতে ডেকেছে।

গুলির আওয়াজ এসেছিল বাগেচম্পার ঢালের রাস্তায় বাংলোর কাছ থেকেই। সে দিক পানে আঁকাবাঁকা পথে প্রায় পঞ্চাশ মাইল বেগে জিপ ছোটাল যশোয়ন্ত। এখন রাত কত তা কে জানে। এখন চাঁদটা একেবারে মেঘে ঢাকা। জোরে হাওয়া লাগছে। জিপের পরদাটা ফ্রেমের লোহার রডের সঙ্গে পত্পত্ শব্দ করে আছড়াচ্ছে। হাওয়াটা ভীষণ ঠাণ্ডা। পাজামা-পাঞ্জাবি পরে শুয়েছিলাম। ওই অবস্থাতেই চলে এসেছি। ঠাণ্ডা হাওয়ায় হাড় কনকন করছে।

মিনিট কয়েক যাবার পরই চোখে পড়ল আমাদের সামনে পাহাড়ের উঁচুনিচু আঁকাবাঁকা পথে একটি জিপ তীব্রগতিতে ছুটছে সামনে-সামনে। হেডলাইটের আলোটা বিদ্যুতের মতো জঙ্গল-পাহাড় চিরে চিরে চলেছে।

যশোয়ন্ত দাঁতে দাঁত চেপে বলল, আমার রাইফেলটা ভাল করে ধরো, আছাড় না খায়।

তারপর দশ-পনেরো মিনিট হুঁশ ছিল না। আমরা যে কেন খাদে পড়িনি, গাছে ও পাথরে ধাক্কা খেয়ে ওইখানেই যে কেন মরিনি, পাহাড়ি নালার উপরের ভেজা কাঠের সাঁকোর উপর থেকে পিছলে কেন যে নদীতে জিপসুদ্ধ উল্টে যাইনি, তা এক ভগবানই জানেন।

সামনেই চেকনাকা। প্রতি চেকনাকায় তালা দেওয়া থাকে। এক একজন করে ফরেস্ট গার্ড প্রতি চেকনাকায় থাকে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ‘পাস’ দেখে কাঠের ট্রাক, বাঁশের ট্রাক ছাড়ে তারা। যাতে কেউ বে-আইনি শিকার করতে না পারে তার জন্যেও গেটে তালা লাগানো থাকে। সামনের জিপটা ওই চেকনাকায় গিয়ে আটকে গেল। বোধ হয় গেট বন্ধ।

অনুমান করতে চেষ্টা করছিলাম, এই সামনের জিপের আরোহীরা কারা? কী এদের উদ্দেশ্য? কোথাও ডাকাতি করতে এসেছিল কি? কিছুই জানি না। অনেক সময় এ অঞ্চলে শুনতে পাই, পথ-চলতি একলা মেয়েদের এমন জোর করে জিপে তুলে নিয়ে পালিয়ে যায় লোকে। শুনি নাকি, অনেক লেখাপড়া জানা নেতা হর্তাকর্তা; লোকেরাও এমন করেন। কিন্তু রাতে? এ কী ব্যাপার? কেন এরা এসেছে? কেনই বা এরা গুলি ছুঁড়ল? কেনই বা এরা এত জোরে পালাচ্ছিল আমাদের দেখে, কিছুই বুঝতে পারছি না।

ততক্ষণে যশোয়ন্ত আমার জিপটা নিয়ে একেবারে চেকনাকার সামনে ওই জিপের পাশে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

অদ্ভুত যাত্রীদের দেখে অবাক হলাম। জিপটির হুড খোলা। সামনে তিনজন লোক। পেছনে এদিক ওদিক মিলিয়ে চারজন লোক। প্রত্যেকের পরনে ট্রাউজার। কারও গায়ে জারকিন, কারও গায়ে ফুলহাতা গরম সোয়েটার। দু’জনের মাথায় বাঁদুরে টুপি। প্রত্যেকের হাতে হয় বন্দুক, না হয় রাইফেল। জিপের চাকায় ওড়া লাল ধুলো মেখে সকলে ভূত। ওই মাঝরাতে, ওই জংলি পরিবেশে, সমস্ত হ্যাপারটাই যেন ভুতুড়ে-ভুতুড়ে বলে মনে হচ্ছিল।

যশোয়ন্ত জিপ থেকে নেমে গিয়ে, ড্রাইভারের পাশে যে জাঁদরেল মাঝবয়সী ভদ্রলোক বসেছিলেন, তাঁকে হিন্দিতে শুধোল, আপনারা শিকার করছেন যে, পারমিট আছে?

ভদ্রলোক ইংরিজিতে জবাব দিলেন, হু দি ডেভিল আর য়্যু?

ততক্ষণে ফরেস্ট গার্ড তার কুঁড়ে ছেড়ে, লণ্ঠন হাতে করে এসে দাঁড়িয়েছে। যশোয়ন্তকে দেখেই সে বলল, সেলাম হুজৌর। ফরেস্ট গার্ড সেলাম করাতে লোকগুলো একটু ঘাবড়ে গেল।

যশোয়ন্ত তখন ইংরিজিতেই বলল যে, সে এখানকার রেঞ্জার।

তখন সেই ভদ্রলোক বিনয়ের সঙ্গে জারকিনের পকেট থেকে একটি চিরকুট বের করলেন।

যশোয়ন্ত বলল, এ যে দেখছি চানোয়া ব্লকের রিজার্ভেশন। আপনারা একানে শিকার করছেন কেন? তা ছাড়া গাড়ি থেকে আলো ফেলে শিকার করা বে-আইনি তা জানেন না?

ভদ্রলোক বললেন, আমরা সে ব্লকেই যাচ্ছি। এখানে শিকার করিনি, করবার ইচ্ছেও নেই। লাত থেকে আসছি, যাব চানোয়া।

যশোয়ন্ত বলল। একচু আগে গুলি করেছিলেন কেন? শিকার করছেন না তো কেন গুলি চালিয়েছিলেন?

জিপের পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল, য়্যু শাট আপ সোয়াইন। উই ডিড নট শুট অ্যাট এনিথিং।

যশোয়ন্ত চকিতে মুখ তুলে লোকটাকে ভাল করে একবার দেখল। তারপর সেই জাঁদরেল ভদ্রলোককে ইংরিজিতে বলল, আপনার সঙ্গীকে ভদ্রভাবে কথা বলতে বলুন, নইলে পরিণাম খারাপ হবে।

এ কথা বলতেই পেছনে বসা সেই লোকটি দাঁড়িয়ে উঠে জড়িয়ে জড়িয়ে বলল, তোমার মতো অনেক রেঞ্জার আমার দেখা আছে, শালা।

যশোয়ন্ত কোনও উত্তর দিল না।

ওদের জিপের বনেটের নিচ দিয়ে একটা তার এসে মিলিয়ে গেছে দেখলাম পেছনের সিটে। কোনও কথা না বলে যশোয়ন্ত এক টানে সেই তারটা গাড়ির ব্যাটারি থেকে ছিঁড়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে বলল, শিকার না করলে স্পটলাইটের কী প্রয়োজন? খুলে ফেলুন!

লোকগুলো আগুনের মতো চোখ করে চেয়ে রইল যশোয়ন্তের দিকে, আগেকার দিন হলে যশোয়ন্ত পুড়ে ছাই হয়ে যেত। ভ্রুক্ষেপ না করে যশোয়ন্ত নিচু হয়ে মাটিতে কী যেন দেখতে লাগল। তারপর টর্চ ফেলে দেখল। আমিও দেখতে পেলাম জিপের চাকার দাগ। ওই পাশ থেকে এসেছে চেকনাকা পেরিয়ে।

যশোয়ন্ত দাঁতে দাঁত চেপে বলল, আপলোগ লাত সে আ রহা হ্যায়? ওরা সমস্বরে বলল, জী হাঁ।

যশোয়ন্ত বিড় বিড় করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ঠিক হ্যায়, যাইয়ে। মগর আপলোগোকো অ্যায়সা শিখলায়েগা এক রোজ, আপলোগ জিন্দাগী ভর ইয়াদ করেঙ্গে।

জাঁদরেল ভদ্রলোক চমকে উঠে ইংরিজিতে বললেন, কাম অন।

পেছন থেকে সেই বাঁদরের মতো লোকটা বলল, শাট আপ।

জিপটা যেন যশোয়ন্তকে মিথ্যেবাদী এবং আমাকে মিথ্যেবাদীর সাকরেদ প্রতিপন্ন করেই আমাদের মুখে ধুলো উড়িয়ে চলে গেল।

যশোয়ন্ত ফরেস্ট গার্ডকে ডাকল। লোকটা কাছে আসতেই যশোয়ন্ত বাঘের মতো তার উপরে পড়ে, ঘাড়ে ধরে তাকে ওইদিক থেকে জিপ ঢোকার দাগ দেখাল। বুঝলাম যে, ফরেস্ট গার্ডই ওই জিপটাকে ঢুকতে দিয়েছিল। চানোয়ার পারমিট হয়তো ছিল, কিন্তু সেটা ছুতোমাত্র। বড় বড় ভদ্রলোক, দামি দামি বন্দুক-রাইফেল কাঁধে করে এমন দামি দামি মিথ্যে কথা যে কী করে বলেন তাই ভাবছিলাম।

এমন সময় যশোয়ন্ত ফরেস্ট গার্ডটাকে এমন মার মারতে আরম্ভ করল যে, কী বলব।

লোকটা তাড়ি খেয়েছিল। কিন্তু কপালের পাশে দুটো ঘুসি পড়তেই তার নেশা-টেশা উবে গেল। মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি দিতে লাগল লোকটা। তার কান্না শুনে তার বউ ঘর থেকে ঘোমটা মাথায় দৌড়ে এল, হাতে কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে। কোনওক্রমে যশোয়ন্তকে ছাড়িয়ে দিলাম। যশোয়ন্ত একটা লাথি মেরে বলল, শূয়ারকা বাচ্চা। মুঝে তুম ঝুট বোল রহা হ্যায়।

লোকটা মাটিতে পড়েই রইল। ওর বউ এসে ওর পাশে হাঁটু গেড়ে বসল।

যশোয়ন্ত জিপটা ঘুরিয়ে নিল। আমি শুধালাম, ওদের যেতে দিলে কেন?

যশোয়ন্ত বলল, আটকাব কী করে? সঙ্গে শিকার থাকলে আটকাতে পারতাম। তা ছাড়া ওদের ভাল করে শিক্ষা দেওয়া দরকার। কেস করলে ওদের কী হবে? দু-পাঁচশো টাকা ফাইন দিলে ওদের শিক্ষা কিছুই হবে না। ওদের যাতে মালুম হয় তেমন শিক্ষা দেব। আমি শুধোলাম, ওদের তুমি চেনো নাকি? যশোয়ন্ত বলল, বিলক্ষণ চিনি। ওঁরা ডালটনগঞ্জেই থাকেন। ওঁরা এই কর্মই করে বেড়ান। সঙ্গে কলকাতার বন্ধুবান্ধবও ছিলেন। তারপর একটু থেমে বলল, সবই শর্টকাট মেথড। একরাত শিকার করবে, যা চোখে পড়বে তাই মারবে। জিপ থেকে স্পট ফেলে মারবে, ভয়ের কোনও কারণই নেই। হরিণ হলেও মারবে, বাঘ হয় তো তাও মারবে। হরিণের গায়ে গুল লাগে তো নেমে তেড়ে গিয়ে মারবে। বাঘের গায়ে গুলি লাগে তো সটকে যাবে। তারপর শহরের ড্রইংরুমে বসে পাঙাস মাছের মতো চোখওয়ালা মেয়েদের কাছে বড় মুখ করে নিজেদের ডেয়ারিং একস্‌পিরিয়েন্সের গল্প করবে। এদের আমি ভাল করে চিনি লালসাহেব। বাগে পাচ্ছি না একবারও। যশোয়ন্ত বোস কাকে বলে তা একবার এদের সমঝে দেব। এদের এই পাশবিক যাত্রাপার্টির সঙ্গে সত্যিকারের শিকারের কোনও মিল নেই, তা বুঝিয়ে দেব।

ফেরার পথে যশোয়ন্ত খুব আস্তে আস্তে গাড়ি চালাচ্ছিল, পথের ধুলোয় কী যেন দেখতে দেখতে চলছিল।

হঠাৎ জিপ একদম থামিয়ে দিল যশোয়ন্ত। ভাল করে চেয়ে দেখি, পথের ভেজা ধুলোয় জিপের চাকার অনেক দাগ। এগোনোর, পেছোনোর, জিপ ঘুরানোর।

যশোয়ন্ত স্টার্ট বন্ধ করে দিল। হেডলাইট নিবিয়ে দিল। তারপর আমাকে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ইশারা করে বলল, চুপ।

চুপ করে বসে রইলাম।

চারিদিকে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। মেঘে চাঁদটা ঢেকে গেছে। পাতায় পাতায় সরসরানি তুলে একটা ভেজা হাওয়া বইছে। এখানে ঝিঁঝি নেই, আর কোনও শব্দ নেই। মনে হচ্ছে, এখানে এখনই কোনও দারুণ নাটকের অভিনয় হবে। অন্ধকারে রাস্তাটাও ভাল করে ঠাহর হচ্ছে না।

প্রায় পাঁচ মিনিট আমরা চুপচাপ বসে রইলাম। বেশ শীত করছে হাওয়াটাতে। এমন সময় পথের ডানদিক থেকে ঘাক ঘাক করে দু’বার আওয়াজ হল।

যশোয়ন্ত ফিসফিস করে বলল, যা ভেবেছিলাম।

আমার টর্চটা নিয়ে ও জিপ থেকে নামল। আমাকে বলল, বন্দুকটা নাও। বন্দুকটা নিয়ে পেছনে পেছনে এস। টর্চ জ্বালিয়ে যশোয়ন্ত আগে আগে চলল। ওর রাইফেল জিপেই পড়ে রইল।

জঙ্গলের বড় বড় ভেজা ঘাস। এদিকে জঙ্গলের বড় গাছ সব কপিসিং ফেলিং হয়েছে। মধ্যে মধ্যে কেবল কিছু বড় গাছ রয়ে গেছে। যশোয়ন্তের কানে কানে নিচু গলায় শুধোলাম। অমন করে ডাকল, ও কী জানোয়ার?

যশেয়ন্ত চাপা গলায় বলল, শম্বর। এখন কোনও কথা বোলো না।

আমরা আর একটু এগোতেই কতগুলো জানোয়ারের ভারী পায়ের শব্দ আমাদের বিপরীত দিকে পাহাড় বেয়ে খাদে মিলিয়ে গেল। যশোয়ন্ত যেন আলোটা দিয়ে এদিক-ওদিক করে কী খুঁজছিল। একটা উঁচু ঢিপির মতো জায়গায় আমরা চুপ করে আলো নিবিয়ে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই, আমাদের প্রায় গায়ের কাছে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলার আওয়াজ হল। অমন দীর্ঘশ্বাস জীবনে শুনিনি। বড় জোর ও বড় দীর্ঘস্থায়ী দীর্ঘশ্বাস। তার সঙ্গে একটা উৎকট গন্ধও পেলাম। যশোয়ন্ত অ্যালশেসিয়ান কুকুরের মতো নাক উঁচু করে হাওয়ায় দু’ বার কীসের যেন গন্ধ শুকল। তারপরই আওয়াজটা যেদিক থেকে এল, সেদিকে টর্চ ফেলে এগোল।

ততক্ষণে আলোটা ছড়িয়ে পড়েছে। একটু এগোতেই দেখি, একটি বিরাট শম্বর মাটিতে বসে আছে। আমরা কাছে যেতেই উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে লাগল, কিন্তু পারল না। গলাটা উঁচু করে শুয়ে শুয়ে আমাদের দেখতে লাগল। চোখ দুটো সবুজ হয়ে জ্বলতে লাগল। বড় বড় টানা টানা চোখের কোণায় দু’ফোঁটা জল জমেছিল। এতক্ষণে বুঝলাম, ওরই শরীর থেকে সেই দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। কাছে যেতেই দেখি, চাপ চাপ জমাট বাঁধা রক্ত, পেটে গুলি লেগেছে। মাদী শম্বর। ভাগ্যিস গর্ভিণী নয়। এতক্ষণ যে দুর্গন্ধটা পাচ্ছিলাম, সে রক্তের গন্ধ। শম্বরের রক্তে বড় বদ গন্ধ। জমাট বেঁধে কালো হয়ে গেছে রক্ত।

যশোয়ন্ত কী যেন স্বগতোক্তি করল। কী যেন বিড়-বিড় করল। বলল, ওদের শিক্ষা দেব ভাল করে, লালসাহেব। তুমি দেখে নিয়ো।

তারপর শম্বরটাকে চারিদিক দিয়ে প্রদক্ষিণ করে হঠাৎ আমাকে বলল, গলাতে বন্দুকের নলটা বসিয়ে গুলি করে দাও তো, কষ্ট শেষ হবে। আমি ইতস্তত করতে লাগলাম। শম্বরটার পেটে রাইফেলের গুলি এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে বেরিয়ে গেছে। নাড়িভুড়ি সব বেরিয়ে শালের চারায় আটকে আছে। এ-দৃশ্য দেখা যায় না। আমি গুলি করতে পারলাম না। যশোয়ন্ত ধমকে আমার হাত থেকে বন্দুকটা নিয়ে মাথা উঁচু করা শম্বরটার কানের কাছে নলটা ঠেকিয়েই গুলি করে দিল।

এল জি পোরা ছিল। উঁচু মাথাটা ধপাস করে সোজা মাটিতে আছড়ে পড়ল। চোখের যে দু’ফোঁটা জল এতক্ষণ কীসের অজানা প্রতীক্ষায় যেন অপেক্ষামাণ ছিল, সেই জল দু’ ফোঁটা গড়িয়ে গেল, এবং একটা শেষ দীর্ঘনিশ্বাস বেরুল অদ্ভুত শব্দ করে। কানের পাশ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরুতে লাগল।

যশোয়ন্ত বলল, চলো এবার ফেরা যাক।

জিপ নিয়ে যখন আমরা রুমান্ডির বাংলোয় ঢুকলাম, তখন রাত পৌনে তিনটে।

সুহাগীর গ্রামের কুকুরগুলো নির্জনতা খান-খান করে ভৌ ভৌ করে ডেকে উঠল। আমরা গিয়ে শুয়ে পড়লাম। এর পরও ঘুমুবার আশায়।

তেরো

বারান্দার ইজি-চেয়ারে বসে মোড়ার উপর পা তুলে মারিয়ানার বাড়ি থেকে যে ক’টি বই এনেছিলাম, তারই একটা পড়ছি। বোদলেয়ারের কবিতার বই। ইংরেজি অনুবাদ। ফ্লাওয়ারস অব ইভিল।

কবিতা পড়তে হলে আমার রুমান্ডির মতো জায়গা আর হয় না বোধ হয়। বিভোর হয়ে কবিতার পাতা ওলটাচ্ছি, এমন সময় একটি জিপ ধুলো উড়িয়ে এসে বাংলোর হাতায় ঢুকল। আশ্চর্য! ঘোষদা জিপ চালাচ্ছেন—আর মারিয়ানা পাশে বসে আছে।

ওঁদের অভ্যর্থনা জানাতে গিয়ে উঠে দাঁড়াতেই এত ক্লান্ত লাগল যে কী বলব। জ্বরের পর শরীরটা বড় খারাপ যাচ্ছে। কাল আবার জ্বর এসেছিল।

ঘোষদা বললেন, আচ্ছা লোক যা হোক তুমি। এমনভাবে একা একা অসুস্থ হয়ে পড়ে রইলে, একটা খবর পর্যন্ত দিলে না। এমন বে-আক্কেলে লোকও দেখিনি।

আমি কাঁচুমাচু মুখ করে বললাম, তেমন মারাত্মক কিছু তো হয়নি। আপনাদের সব্বাইকে তুচ্ছ ব্যাপারে বিরক্ত করতে চাইনি।

মারিয়ানা কপট রাগ দেখিয়ে বলল, তা কেন? কিছু একটা হলে তারপর খবর পাঠাতেন, আর লোকে আমাদের গায়ে থুথু দিত। বলত, ছিঃ ছিঃ এতগুলো লোক থাকতে ছেলেটা বেঘোরে…

আমি বললাম, আজ্ঞে না, দিব্যি ঘোরে ছিলাম। সেইজন্যেই খবর পাঠাইনি।

ঘোষদা বললেন, তোমার বউদিকে তো কলকাতা চালান করেছি। হঠাৎ-ই। ওঁর মার শরীর খারাপ হল, ট্রাঙ্ককল পেয়ে তাই পাঠালাম। এখন ওখানে গিয়ে মৌরসী-পাট্টা গেড়ে বসেছেন। বর্ষাকালটা কাবার করেই আসবেন।

আমি হেসে বললাম, ভালই তো। তবে আপনার নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হচ্ছে।

ঘোষদা জিপে উঠতে উঠতে বললেন, না, না, কষ্ট কী? কষ্টের কী আছে। তারপর মারিয়ানার দিকে ফিরে বললেন, তাহলে মারিয়ানা, আমি কিন্তু সন্ধে লাগার সঙ্গে সঙ্গে আসছি। তৈরি হয়ে থেকো।

জিপটা স্টার্ট করে আমায় বললেন,—মারিয়ানা সারাদিন তোমার তত্ত্ব-তল্লাশ করবে, আমি যাচ্ছি গাডুর রেঞ্জারের সঙ্গে দেখা করতে। রাস্তা বানানো নিয়ে ওঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলতে হবে। ফেরার পথে মারিয়ানাকে তুলে নেব। ভাল করে আদর-যত্ন করে খাইও মেয়েটাকে। এতদূর এসেছে শুধু তোমার অসুস্থতার খবর শুনে।

কী বলে যে মারিয়ানাকে কৃতজ্ঞতা জানাব জানি না। এই ভদ্রতা, শুধু ভদ্রতাই বা একে বলি কেন, এই বন্ধুত্ব, এর দাম দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব।

মেয়েরা যাদের ভালবাসে, তাদের সঙ্গে বোধ হয় সত্যিকারের বন্ধুত্ব করতে পারে না, কারণ তাদের সত্তা সব সময় সেই পুরুষের ব্যক্তিত্বে পরিব্যাপ্ত থাকে, সব সময় ওরা ভয় পায়; পাছে ধরা পড়ে। ফলে ওরা সেই পুরুষের কাছে সব সময় উচ্চমন্যতা দেখায় বা হীনম্মন্যতায় ভোগে। মনে মনে মরে থাকে বলে।

আমি ওর বন্ধু মাত্র। অন্য কিছুই নই। তবু কী করে অস্বীকার করি যে, মাঝে মাঝে আমারও যন্ত্রণা হয়। শুধুমাত্র ইনচেলেকচুয়াল বন্ধুতে মন ভরতে চায় না। এই জঙ্গল পাহাড়ের নির্জনতা, এই পুটুস ফুলের উগ্র গন্ধ, এই বনস্থলীর বর্ণচ্ছটা, এই সমস্ত কিছু আমাকেও কখনও কখনও কাঙাল করে তোলে।

দিনে দিনে শরীর এসে মনের উপর জবরদখল নিচ্ছে। প্রকৃতির সান্নিধ্যে এই একটা বড় অভিশাপ। একে অস্বীকার করার উপায় নেই। শপরের সভ্যতা-সংস্কৃতিতে নিজের আদিম সত্তার উপর যে মেকি আস্তরণটি জমিয়েছিলাম এতদিন, মেয়েদের মেক-আপের মতো, প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাতে চিড় ধরেছে—ফেটে পড়ছে তা। সাধারণ আদিম, প্রাকৃত ‘আমি’ বেরিয়ে পড়ছে।

দিনে দিনে বড়ই অসভ্য হয়ে উঠছি। তবে এখনও পুরোপুরি হারিনি। উত্তাল তরঙ্গে এখনও কোনওক্রমে হাল ধরে বসে আছি। তবে যে-কোনও মুহূর্তেই তরণী ডুবতে পারে। সভ্যতার সমুদ্রের পরপারে পৌঁছানো এ-জন্মে হবে বলে মনে হচ্ছে না। এই রুমান্ডির চাকরি আর যশোয়ন্তের দোস্তি আমার ব্যক্তিগত সভ্যতার রাজপথে কালাপাহাড়ের মতো পথ জুড়ে দাঁড়িয়েছে। সভ্যজগত আমাকে আর ফিরিয়ে নেবে না। সুরাতীয়ার যেমন ডালটনগঞ্জে নির্বাসন হয়েছে, আমারও তেমনই রুমান্ডিতে নির্বাসন হবে।

এলোমেলো ভাবনার ঘোর কাটিয়ে উঠে বললাম, ওকি দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? বসুন।

মারিয়ানা বলল, বসছি, বসছি। আপনি ব্যস্ত হবেন না।

চেয়ার টেনে বসল মারিয়ানা।

একেবারে সাদা পোশাকে এসেছে ও আজকে। কুমারী মেয়েরা সাদা পোশাক পরলে আমার বড় ভয় করে। ঠাকুর ঘরের মতো একটা ফুলের গন্ধমাখা পবিত্রতা তখন ওদের ওপর আরোপিত হয়। তখন মনে মনে, এমনকী চোখ দিয়ে আদর করতেও ভয় করে।

জ্বর আছে নাকি?

মারিয়ানা শুধোল।

না। জ্বর একেবারে ছেড়ে গেছে। তবে বড় দুর্বল করেছে শরীর। হাঁটা-চলা করতে পারি না মোটে। হাঁটুতে খুব ব্যথা। মাথাটা ঝিমঝিম করে। কথা বললে শরীর অস্থির লাগে।

মারিয়ানা চুপ করে চোখের দিকে চেয়ে বসে রইল।

বলল, কী খাবেন আজকে?

জুম্মান যা বেঁধে দেবে।

তারপর একটু ভেবে বললাম, কী খাওয়া উচিত?

ও বলল, আজ আমিই আপনাকে রান্না করে খাওয়াব।

বাঃ! বেশ বলেছেন। এই প্রথম এলেন আমার রুমান্ডিতে, আর প্রথম দিনই হেঁসেলে।

বা রে, তাতে কী হল? বন্ধুর কাছে আবার ফর্মালিটি কেন অত? বলে ভুরু নাচাল।

একটা হলুদ-বসন্ত পাখি এসে সজনের ডালে বসল। দুবার লেজ নাচাল। কুর-কুর করে গদগদ গলায় কী যেন স্বগতোক্তি করল, তারপরই ডানা মেলে উড়ে গেল নীল, ঘন নীল আকাশে।

বর্ষাকাল শেষ হয়ে এসেছে, রোদ্দুরে পুজো-পুজো রঙ লেগেছে। শিউলির দিন এল।

মারিয়ানা বলল, শিরিনবুরুতে সেই মেয়েটিকে দেখে এলেন না? যশোয়ন্তবাবুর সঙ্গে নেচেছিল? মেয়েটা সেদিন মারা গেল।

আমি চমকে উঠে বললাম, সেকি? কী হয়েছিল?

মারিয়ানা মুখ নিচু করে পায়ের গোলাপি নখ দিয়ে চটিতে দাগ কাটতে কাটতে বলল, খুব খারাপ অসুখ, গনোরিয়া।

ইস্। ভাবা যায় না।

আমার সেই রাতের মাদী শম্বরটার কথা মনে হল। পেটে গুলি লেগেছে। চোখ দিয়ে জল ঝরছে। ভাবা যায় না।

এ-রোগে কি অমন হঠাৎ করে মানুষ মরে?

মারুয়ানা বলল, আমি তো ডাক্তার নই। তবে অসুখে মরেনি। আত্মহত্যা করেছিল।

মোষের গলার কাঠের ঘণ্টার রেশ ভেসে আসছিল রোদভরা শালবন থেকে। কী মিষ্টি সকালটা। অসুখের পর এই সকালটা ভারী ভাল লাগছে। বাঁচতে ইচ্ছা করছে। মনে হচ্ছে, আমি যেন কোন মুঘল যুগের বাদশা। অভাব বলে কোনও কথা আমার অভিধানে লেখা নেই। এত তীব্রভাবে বাঁচার ইচ্ছা বহুদিন মনে জাগেনি।

কিন্তু ইস্! সেই সুন্দরী মেয়েটা সত্যিই মরে গেল।

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে রইলাম।

বললাম, চা খাবেন না? সঙ্গে কী খাবেন বলুন?

মারিয়ানা আস্তে হাসল, বলল, জুম্মান যা খাওয়াবে।

হাসিটা এত ভাল লাগল যে কী বলব। ভাবলাম, পরের জন্মে আমি মারিয়ানার মতো কোন মেয়ে হয়ে জন্মাব। অন্যকে অনুপ্রেরণা জোগানোর মতো সার্থকতা আর কী থাকতে পারে? পুরুষরা বড় স্বার্থপর জাত। মেয়েদের যোগ্য সম্মান কোনওদিন করতে শিখল না।

বললাম, এখন এ বারান্দায় রোদ এসে যাবে। তেতে উঠবে। চলুন আমরা পেছনে গিয়ে খাদের ধার ঘেঁষে ফলসা গাছের তলায় বসি। সেখানে চা খাওয়া খুব জমবে।

মারিয়ানা হুইসলিং টিলের মতো আমুদে গলায় বলল, চলুন।

জুম্মান আর রামধানীয়া চেয়ারগুলো পৌঁছে দিল।

এ-দিকটায় আমি একা একা আসি না বড়। ফলসা গাছ অনেকগুলো। নিবিড় ছায়া হয়ে থাকে। এখান থেকে নীচের পুরো উপত্যকাটা চোখে পড়ে। সেই বহুদূরের রুপোলি জলের ফালিটুকু, গালচের মতো ধান; এতদিন কচি কলাপাতা সবুজ ছিল, এখন গাঢ় সবুজ হয়েছে। আরও কিছুদিন গেলে হয়তো সোনালি হয়ে উঠবে।

ভারী ভাল তো জায়গাটা। মারিয়ানা বলল।

আমি বললাম, বলুন, সুন্দর না? সুন্দর জায়গায় বসেও কিন্তু আজ আমি কথা বলতে পারব না। আমার এখনও কষ্ট হয় কথা বলতে। আপনি আজ সারাদিন কথা বলবেন।

আমি শুনব।

মারিয়ানা বলল, আমার বলার মতো কথাই নেই। বুঝলেন, বলার মতো আমার কিছুই নেই।

বললাম, বলার মতো কথা নেই এমন লোক আছে নাকি? আমি তো টাবড়ের কথা শুনে দশ বছর কাটাতে পারি। আর আপনার শোনানোর মতো একবেলার কথাও নেই? আমার কিন্তু মনে হয় আপনার বলার মতো অনেক কথা আছে। হয়তো শোনাবার মতো লোক নেই। অথবা ইচ্ছে নেই বলার।

মারিয়ানা নিমেষে মুখ ঘুরিয়ে ওর সুন্দর মাধবপাশা দিঘির মতো চোখ দুটো আমার চোখে রাখল, চিকচিক করে উঠল জলভারে। অনেকক্ষণ চুপ করে আমার চোখে চেয়ে রইল। তারপর মুখ নিচু করে নিল।

মাঝে মাঝে আমার অমন হয়। আমার মতো নির্বোধ মানুষও বিক্রমাদিত্যের মাটি-ঢাকা রাজসিংহাসনে বসার মতো হঠাৎ করে বুদ্ধিমান হয়ে ওঠে। মারাত্মক ভাল সাইকো-অ্যানালিস্ট হয়ে ওঠে। তখন আমার সামনে তিষ্ঠোয় কার সাধ্যি।

জুম্মান চিঁড়ের পোলাও বানিয়ে নিয়ে এল। তখনও ধোঁয়া বেরুচ্ছে।

মারিয়ানা অবাক এবং কিঞ্চিৎ বিব্রত হয়ে বলল, ওমা, এই বাইরে বসে খাবান? খাবার ঘর?

আমি বললাম, করব না কেন, করি, তবে খুবই কম। বাইরে বসে খাওয়ার মতো মজা আছে? এই যে আপনি খাবেন, কাঠবিড়ালিটা চেরিগাছের ডাল থেকে চেয়ে দেখবে। পেঁপে গাছের পাতার ছায়ায় গিরগিটিটা সুড়সুড় করে লোভে জিভ বের করবে। ছাতার পাখিগুলো আপনার এ হেন ফ্যাসিস্ট মনোবৃত্তি দেখে সমস্বরে ছ্যাঃ ছ্যাঃ করবে, আর আপনি উপত্যকার দিকে চেয়ে ধীরে ধীরে খাবেন। কী মেজাজ বলুন তো।

মারিয়ানা প্লেটটা হাতে তুলতে তুলতে বলল, আপনি একটি বদ্ধ পাগল। আপনার দোষ নেই। যশোয়ন্তবাবুর চেলা হয়েছেন তো, আপনার উন্মাদ হতেও দেরি নেই।

জুম্মান টি-কোজিতে মুড়ে ট্রে-তে বসিয়ে চা নিয়ে এল।

মারিয়ানা শুধোল, সুজি আছে জুম্মান?

জুম্মান মাথা নাড়িয়ে সায় দিল।

মারিয়ানা বলল, আমি সাহেবের জন্য দুপুরে সুজির খিচুড়ি রাঁধব। তুমি কিছু রেঁধো না।

আমি বললাম, আর মারিয়ানা মেমসাহেবের জন্য তুমি ভাল করে ফ্রায়েড রাইস আর মোরগা বানাও তো জুম্মান। মেমসাহেবের তকলিফ যেন না হয়। একটু বেশি করে করো। যাতে ঘোষদার জন্যেও থাকে।

দুপুরে সুজির খিচুড়িটা যা রেঁধেছিল মারিয়ানা, কী বলব। অমন খিচুড়ি বহু বহু বছর খাইনি। সেই ঠাকুমা বেঁচে থাকতে বোধহয় খেয়েছিলাম। তারপর আর খেয়েছি বলে মনে পড়ে না।

মারিয়ানা স্নান করল গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে। আমি ফলসা গাছের তলায় বসে বসে ওর গুনগুনানি শুনলাম। আমার বাথরুম আজ কতদিন পরে যেন ধন্য হল। সাবানের সুগন্ধি ফেনা কেটে কেটে নর্দমা দিয়ে, জবা গাছের গোড়ার পাশ দিয়ে, ঘাসগুলোর মধ্যে দিয়ে বিলি কেটে এসে পেছনের মাঠে ছড়িয়ে গেল। মারিয়ানার শরীরের সুগন্ধি মাদকতায় ভরে গেল আমার রুমান্ডি।

খাবার ঘরে গল্প করতে করতে খেলাম আমরা দুজনে।

যে যাই বলুক, যশোয়ন্ত মুখে যতই বাতেল্লা করুক; যেখানেই হোক, সে নির্জন বাংলোয়, অথবা ভিড় গিজগিজে শহুরে ফ্ল্যাটে, একজন নরম মেয়ে না থাকলে সমস্ত অস্তিত্বটাই কেমন জোলো-জোলো লাগে। আমার নির্জন-বাসে আজকে মারিয়ানা এসেছে বলে বুঝতে পেলাম, আমাদের জীবনের কত বড় শূন্যতা পূরণ করে মেয়েরা। প্রত্যেক পুরুষের জীবনের।

খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা অনেকক্ষণ চুপচাপ বারান্দার চেয়ারে বসে রইলাম। একদল হলুদ-ঠোঁট শালিক এসে সভা বসাল বাংলোর হাতায়। অনেকক্ষণ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলল, হাত-পা নাড়ল। তারপর যখন বুঝলে মামলা নিষ্পত্তি হবার নয়, তখন ধুত্তোর বলে কিচিরমিচির করতে করতে সুহাগী বস্তির দিকে উড়ে গেল। একটু পরে এক ঝাঁক বুনো টিয়া এসে সামনের চেরি গাছটা ছেয়ে বসল। গাছটা ওদের সবুজ ভারে নুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ নাচানাচি করে ট্যাঁ-ট্যাঁ-ট্যাঁ করতে করতে ওরা উড়ে পালাল।

একটা নীলকণ্ঠ পাখিকে রোজ এই সময় এসে জ্যাকারান্ডা গাছটাতে বসতে দেখি। সে কোনও কথা বলে না। বোধহয় মারিয়ানার মতোই, বলার লোকের অভাবে ওর কথা বলা হয়ে উঠছে না। এ-ডাল থেকে ও-ডালে সাবধানী বুড়োর মতো কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে সে-ও উড়ে চলে গেল।

মনটা যখন খুব নির্লিপ্ত থাকে, তখন হোধ হয় কারওই কথা বলতে ইচ্ছে করে না। তখন চুপ করে থাকতে ইচ্ছে করে।

মারিয়ানা চুপ করে সুহাগী নদীর দিকে তাকিয়ে বসেছিল।

বেলা পড়ে আসছে। পাহাড়িবাজ আর শঙ্খচিলগুলো ঘুরতে ঘুরতে অনেক উপরে উঠেছিল। এখন নেমে আসছে। সুগাহী বস্তিতে বিচিত্র ও বিভিন্ন শব্দ উচ্চগ্রামে বাজছে। সুহাগীর পরের বস্তি যবটুলিয়াতে বেশ ক’দিন হল একটি গম-ভাঙা মেশিন বসেছে। কীসে চলে জানি না। বিকেল হলেই সেটার আওয়াজ শোনা যায় পাহাড় পেরিয়ে। পুপ-পুপ-পুপ-পুপ করে একটি অতিকায় খাপু পাখির মতো সকালে চার ঘণ্টা ও বিকেলে দু’ঘণ্টা সে ডাকে। পড়ন্ত রোদ্দুরে একা একা রুমান্ডিতে বসে সেই পুপ-পুপানি শুনতে ভারী ভাল লাগে।

দেখতে দেখতে বিকেল গড়াল।

জুম্মান কফি দিয়ে গেল। সঙ্গে ডালটনগঞ্জ থেকে আনানো ইদরখ দেওয়া বিস্কিট। কফি খেয়ে মারিয়ানা ঘরে গিয়ে চুল বেঁধে শাড়ি পালটে এল। ব্যাগ খুলে একটি পাতলা শাল নিয়ে এল।

সকাল-সন্ধ্যায় বেশ ঠাণ্ডা লাগে। শীত আসতে তো দেরি নেই বেশি। বনে পাহাড়ে নাকি শরৎ-হেমন্ত-শীতে বড় একটা প্রভেদ নেই শুনেছি। এবার স্বচক্ষে দেখা যাবে।

ছায়াগুলো বেশ বড় বড় হয়েছে। ঝুঁকে পড়েছে। শেষ বিকেলে উদার সূর্যের আঁজলাভরা আলো বনের মাথায় মাথায় ছড়িয়ে গেছে। কোন এক অদৃশ্য সেতারি হাওয়ার মেজরাপ পরে, রোদের আঙুলে, বনের তারে তারে হংসধ্বনি রাগে আলাপ করছেন। সে কী মীড়! ভাল লাগায় বুকের মধ্যেটা মুচড়ে মুচড়ে ওঠে।

মারিয়ানা আস্তে আস্তে বলল, আমি যেমন এলাম, তেমন আমার কাছে গিয়েও একদিন কাটিয়ে আসবেন। বেশিদিন থাকলে তো আরও মজা হয়। শরীরটা একেবারে ভাল করে নিন তাড়াতাড়ি।

মনে হয়, মারিয়ানার বড় একা একা লাগে মাঝে মাঝে। আমার মতোই। ওর এবং আমার সমস্যা অনেকটা একরকম। অসুবিধার কথা এই যে, সমাধানটা বা সমাধানের পথটা এক নয়। এবং আদৌ সমাধান আছে কিনা তাও অজানা। তবু এতবড় নির্দয় পৃথিবীতে আমরা দুজন যদি দুজনের একাকিত্বের শৈত্যটা বন্ধুত্বের উষ্ণতা দিয়ে ভরিয়ে রাখতে পারি, সেটাই বা কম লাভ কী? সেটা তো মস্ত লাভ। প্রেম ছাড়া বন্ধুত্বের মতো মহান অনুভূতি আর কী আছে?

এই এক বেলায় মারিয়ানার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা যেন অনেকখানি এগিয়ে গেল। এতদিন যেন ক্লাচ টিপে টপ গিয়ারে জিপ চালাচ্ছিলাম, আজ কোন মন্ত্রবলে সেই ক্লাচ থেকে পা-টা সরে গেছে। এক দমকে অনেকদূরই এগিয়ে গেছি।

দেখতে দেখতে অন্ধকার হয়ে গেল।

মারিয়ানাকে বললাম, আপনার বইগুলোর প্রায় সবকটিই পড়ে ফেলেছি। আজ নিয়ে যাবেন কিন্তু। আপনার কাছে দিয়ে কিংবা কারওকে দিয়ে আরও ক’টা বই আনিয়ে নেব।

মারিয়ানা শুধোল, আজ সকালে বারান্দায় বসে বসে বোদলেয়ারের বইটি পড়ছিলেন বুঝি?

আমি বললাম, হ্যাঁ। আপনি লক্ষ করেছেন দেখছি।

হঠাৎ মারিয়ানা বলল, আপনার কাছে কলম আছে? আমি উঠতে উঠতে বললাম, আছে। ঘরে, টেবিলের ওপর আছে, এনে দিচ্ছি।

মারিয়ানা আমাকে হাত দিয়ে উঠতে মানা করে বলল, আপনি উঠবেন না, আমি নিয়ে আসছি।

ঘর থেকে, টেবিলের পরে বসানো লণ্ঠনের আলোর রেখা বারান্দার থামে এসে পড়েছিল। সেই আলোর রেখায় একটি ছায়া পড়ল। তারপর অজন্তার দেয়ালে আলো হাতে করে ঢুকলে, নিখুঁত সুন্দরীদের ছায়া যেমন করে কাঁপে; বাংলোর থামে মারিয়ানার ছায়া তেমনি করে কাঁপতে লাগল।

একটু পরে বোদলেয়ারের বইটা নিয়ে ফিরে এল মারিয়ানা। বলল, বইটা আপনাকে দিলাম।

আপত্তি করে বললাম, এ কেন করলেন? আপনার কাছে থাকলে পড়তে তো পেতামই। মালিকানাস্বত্ব দেবার কী ছিল?

মারিয়ানা আমার ইজিচেয়ারের মাথার কাছে এসে বইটির প্রথম পাতা খুলে দুহাতে বইটি আমার মুখের সামনে মেলে ধরলে।

পড়লাম। সুন্দর হস্তাক্ষরে লিখেছে: ‘রুমান্ডির সন্ধ্যার স্মারক—মারিয়ানা।’

চোদ্দ

গোটা এলাকাই চঞ্চল হয়ে উঠেছে। লোকের মুখে মুখে ঘুরছে তখন একটি বাইসনের কীর্তিকলাপ। একের পর এক মানুষকে জখম করেই চলেছে এই জানোয়ারটা। কিন্তু কেউই বাগে আনতে পারছে না।

বেতলার রেঞ্জার সাহেব বাইসনটাকে ‘রোগ’ বলে ঘোষণা করে গেছেন। যে মারতে পারবে, সে পাঁচশো টাকা পুরস্কার পাবে বনবিভাগ থেকে।

সেই পাঁচশো টাকার লোভে স্থানীয় একজন ফরেস্ট গার্ড ওর একনলা বন্দুক নিয়ে কিছুদিন ধরে তাকে মারবার চেষ্টা করে বেড়াচ্ছিল। গতকাল ভরদুপুরে কোয়েলের পাশে সে লোকটিকেও একটি সেগুন গাছের গায়ে থেঁতলে দিয়ে উধাও হয়ে গেছে বাইসনটা।

লোকটি কপাল লক্ষ করে গুলিও করেছিল, কিন্তু কোথায় লেগেছিল কেউ জানে না, গুলিতে নাকি মরেনি বাইসনটা। বাইসনের গায়ে বন্দুকের গুলি বেশি দূর অবধি সেঁধোয় এমন তাগদ কোনও বন্দুকের নেই। বড় রাইফেল হলে অন্য কথা ছিল। তাতেই এই বিপত্তি।

শুনেছি, যশোয়ন্তকে খবর দেওয়া হয়েছে পাটনায়। কাজ সেরে যত শিগগির সম্ভব ফিরে আসতে। কারণ ওই বাইসন গুলি খাওয়ার পর আরও সাংঘাতিক হয়ে গেছে। কুলিদের ধাওড়া, ঠিকাদারের বাংলো সব ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। ঠিকাদারের একটি অ্যালসেশিয়ান কুকুর ছিল, সেটা ওকে ধাওয়া করাতে তাকে একেবারে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। ও জঙ্গলে কাজ একেবারে বন্ধ। ওই বাইসন যতক্ষণ মারা না পড়ে, বাগেচম্পার পথও খুব বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। লোকে হাট করতে যেতে পারছে না, ডাক নিয়েও যেতে পারছে না ডাক-হরকরা।

এতদিন রুমান্ডির বাংলো থেকে সুহাগীর বর্ষাবিধুর চেহারা তেমন খেয়াল করে নজর করিনি। কিশোরী এখন যৌবনবতী হয়েছে। ঘনঘোরে চল্‌কে চল্‌কে চলেছে লাল শাড়িতে। একদিন ইচ্ছে হল, যশোয়ন্তের সেই পাথরটায় গিয়ে বসি। গ্রীষ্মের ক্ষীণা শরীরে এখন কত প্রাণোচ্ছ্বাস, একবার দেখে আসে। কিন্তু টাবড় বলল, কে পাথর এখন ডুবে গেছে। জল তার আরও উপরে। তবা পাহাড়ি নদী, সব সময়ই যে বেশি জল রয়েছে তা নয়। পাহাড়ে বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার অব্যাহতি পরেই গিয়ে দেখতে হয় জলের তোড়।

আমাদের সুহাগীতেও অনেক মাছ ধরা পড়েছে এ ক’দিন। আজকাল যে সব মাছ আমি খাচ্ছি, তার অর্ধেক সুহাগীর, অর্ধেক কোয়েলের। পাহাড়ি পুঁটি, বাটা, আড়-ট্যাংরা ইত্যাদি।

এ এক নতুন আবিষ্কার। শখ হয়, একদিন গিয়ে মাছ ধরি। কিন্তু ওই ইচ্ছে পর্যন্তই। আমি বারান্দায় ইজি-চেয়ারে বসে কল্পনা করতে পারি। কল্পনায় বাঘ মারি, মাছ ধরি; আরও অনেক কিছু করি। কিন্তু যতক্ষণ যশোয়ন্তের মতো কেউ এসে হাত ধরে আমাকে না তোলে, ইজি-চেয়ারেই বসে থাকি।

বসে বসে আর ভাল লাগে না। কাজকর্ম ছাড়া কাঁহাতক আর ভাল লাগতে পারে। অবশ্য আর মাসখানেক পরেই পুজো। পুজোর পরেই আবার জঙ্গলের পথঘাট ট্রাক যাবার উপযুক্ত হবে। বাঁশ-কাটা, কাঠ-কাটা শুরু হবে। দলে দলে গয়া জেলার লোকেরা খয়ের বানাবে জঙ্গলে জঙ্গলে। মাঠে মাঠে পাহাড়ের ঢালে ঢালে যে সব ভাদুই শস্য সবুজ থেকে হলুদে রূপান্তরিত হচ্ছে, তাদের ওঠানো হবে। ধান, বাজরা, বুট, আরও কতশত ফসল। সমস্ত জঙ্গল পাহাড় অ-পালিত নবান্ন উৎসবে হেসে উঠবে। ভরন্ত ফসলের গন্ধে ম-ম করবে পাহাড়ি হাওয়া।

এ ফসল উঠে গেলে ক্ষেতে ক্ষেতে কুর্থী লাগবে, গেঁহু লাগবে, কাডুয়া লাগবে, শরগুজা লাগবে। হলুদে হলুদে ছেয়ে যাবে চষামাঠ আর অসমান পাহাড়ের ঢাল। সন্ধে হতে না হতেই চারিদিক থেকে মাদলের শব্দ আর গানের সুর ঝুম্ ঝুম্ করবে।

শীতকালে প্রচণ্ড শীত হলে কি হয়, জঙ্গলে পাহাড়ে শীতকালটাই নাকি সব থেকে সুখের সময়। বনবিভাগের বাংলোয় বাংলোয় শিকারির দল আসবেন কলকাতা, পাটনা এবং আরও কত বড় বড় জায়গা থেকে। গ্রামের গরিব লোকেরা কূপ কাটার ফাঁকে ফাঁকে এক-দুদিন সাহেবদের জন্যে ছুলোয়া করে নেবে। আধুলিটা টাকাটা যা পাবে তা পাবে, তাছাড়া শিকার কিছু হলে তার অর্ধেক মাংসের ভাগ। সেটাই আসল লাভ। মাংসকে ওরা বলে ‘শিকার’।

একদিন ভোরে যশোয়ন্ত এসে হাজির হল। অনেকদিন পর ভয়ংকরের চিঁ-হা-হ—চিঁ-হা-হ্ আওয়াজে রুমান্ডির বাংলা সরগরম হয়ে উঠল।

যশোয়ন্ত বলল, কনসার্ভেটর সাহেবের চিঠিটা পেয়েছ লালসাহেব?

পেলাম তো। কেস উঠবে কবে?

কেন, উঠবে হয়তো শিগগিরই, কিন্তু তুমি একটু সাবধানে থেকো।

শুধোলাম, একথা বলছ কেন?

বলছি, কারণ, জগদীশ পাণ্ডে সাংঘাতিক লোক। আমার চেয়েও সাংঘাতিক। করতে পারে না এমন কাজ নেই। তুমি আমার একমাত্র সাক্ষী। হয়তো ও দিলে তোমাকে খুন করিয়ে, লাশ গুম করে দেওয়া তো এই জঙ্গলে পাহাড়ে কিছুই নয়। বাচ্চোকা কাম।

আমি চিন্তাক্লিষ্ট হয়ে বললাম, তাহলে কী হবে?

যশোয়ন্ত হেসে বলল, আরে হবে আবার কী? ওরা আমাকেও চেনে। তোমার গায়ে একবার হাত দিয়ে দেখুকই না। তবে সাবধানের মার নেই। বাংলো থেকে যখনই বেরোবে, তখনই বন্দুকটা সঙ্গে নিয়ে বেরোবে। কোনও কিছু বেগতিক দেখলে, কোনও অচেনা লোককে অস্বাভাবিক অন্তরঙ্গতা করতে দেখলেই পাশ কাটাবে। আর সে রকম দেখলে, গুলি চালিয়ে খুপড়ি উড়িয়ে দেবে।

আমি বললাম, বললে বেশ। গুলি চালিয়ে খুপড়ি উড়িয়ে দিলে, তারপর ফাঁসিতে লটকাবে কে?

তুমিও যেমন। গুলি চালালেই যদি ফাঁসিতে লট্‌কাতে হত, তাহলে তো বেতলা থেকে রুমাণ্ডি অবধি প্রতি গাছে আমি একবার করে ঝুলে থাকতাম। এসব তোমার কলকাতা নয়। জোর যার মুলুক তার। এখন অবধি তাই আছে। পরে কী হবে জানি না। তা ছাড়া দারোগা সাহেব ভি বড়া জবরদস্ত ইমানদার লোক আছেন। উসব কিতাবী আইনের ধার ধারেন না। ঠাণ্ডা মাথায় গোঁফে পাক দিতে দিতে সবটা শোনেন। শুনে, যে সত্যি সত্যি অন্যায় করেছে বোঝেন, সঙ্গে সঙ্গে তার পশ্চাৎদেশে হানটারের বাড়ি। পইলে ডাণ্ডা পিছে বাত ইয়ার। শালা লোগোঁকো হাম শিখলায়েগা ঠিকসে।

যশোয়ন্ত রাইফেলটা খুলে তেল লাগিয়ে আবার লক-স্টক ব্যারেল জোড়া লাগিয়ে দেওয়ালের গায়ে দাঁড় করিয়ে রাখল। দাঁড় করিয়ে রাখবার আগে সাইট-প্রটেক্টরটা ফ্রন্ট সাইটে লাগিয়ে নিল। এই রাইফেলটাতে একটি পিপ-সাইট ফিট করা আছে। এমনিতেই যশোয়ন্তের হাত সোনা দিয়ে বাঁধানো। তারপর পিপ-সাইট ফিট করা থাকাতে এই রাইফেলটা দিয়ে যশোয়ন্ত মোক্ষম মার মারে। জানোয়ার তার চাঁদবদন একবার দেখালে হয়। তারপর সে বাইসনই হোক আর বাঘই হোক, পালায় কোথায় দেখা যাবে। আর চোটও বসায় রাইফেলটা। ভীমের গদার মতো। টাবড় নাম দিয়েছে গদ্দাম। ওজনও সেরকম! কাঁধে নিয়ে মাইল দুয়েক হেঁটে এলে, কলার-বোন ‘কে রে? কে রে?’ করে ওঠে।

টাবড়কেও খবর পাঠিয়েছিল যশোয়ন্ত। টাবড় এসে হাজির ওর টোপিওয়ালা বারুদী বন্দুক নিয়ে। টাবড়ের বন্দুকটা দেখলেই আমার বুয়োর ওয়ার-এর কথা মনে পড়ে যায়।

বন্দুক রাইফেল থেকে একটা গন্ধ বেরোয়, তেলের গন্ধ, বারুদের গন্ধ, টোটার গন্ধ। সব মিলিয়ে গন্ধটাকে কেমন পুরুষালী-পুরুষালী বলে মনে হয়। কসমেটিকসের গন্ধের সঙ্গে যেমন মেয়েদের ভাবনা জড়ানো থাকে; বন্দুক-রাইফেলের গন্ধের সঙ্গে তেমনই ছেলেদের ভাবনা জড়ানো থাকে। ভারী ভাল লাগে। এই গন্ধ নাকে গেলেই আমার কতগুলো উৎসাহিত-প্রাণ বেহিসাবী, যৌবনমত্ত পুরুষের কথা মনে হয়, যারা সবুজ বনে দু’হাত তুলে লাফাতে লাফাতে গান গায় নবযৌবনের দলের মতো—‘ঘূর্ণি হওয়ায় ঘুরিয়ে দিল সূর্য তারাকে। আমাদের ক্ষেপিয়ে বেড়ায়, ক্ষেপিয়ে বেড়ায়, ক্ষেপিয়ে বেড়ায় যে।’

আমরা জিপেই রওনা হলাম। যে জায়গায় গিয়ে নামলাম, সেটা——যেখানে হুইটলি সাহেবরা বাঘ মেরেছিলেন, তার কাছাকাছি।

সকালের রোদ্দুর বনের পাহাড়ে ঝলমল করছে। প্রায় মাথা-সমান উঁচু বর্ষার জল পাওয়া সতেজ গাঢ় সবুজ ঘাসের বন, রোদে জেল্লা দিচ্ছে। তার মাঝ দিয়ে একটা পায়ে-চলা শুঁড়িপথ, গাড়ি যাওয়ার প্রধান সড়ক থেকে নেমে কোয়েলের দিকে চলে গেছে। আমরা জিপটাকে বাঘ মারার সময় যেমন রেখেছিলাম, তেমনই প্রধান রাস্তার উপরে একটা বড় গাছের নীচে বাঁদিক করে পার্ক করিয়ে রাখলাম।

যশোয়ন্ত সাইট-প্রটেক্টরটা খুলে পকেটে রাখল। রাইফেলে গুলি ভরল। আমাকে বন্দুকের দু ব্যারেলেই বুলেট ভরতে বলল। টাবড় তার গাদা বন্দুকে তিন-অংগলি বারুদ কষ্‌কে ঠেসে এসেছে। সামনে একটি হুঁৎকো-মার্কা সীসার তাল। যে ভাগ্যবানের গায়ে ঠেকবে, তিনি পরজন্মে গিয়েও আশীর্বাদ করবেন।

যশোয়ন্ত আগে রাস্তা ছেড়ে শুঁড়িপথে ঢুকল। আমাকে ওদের দুজনের মাঝখানে নিল। পেছনে টাবড়। টাবড়কে ফিসফিসিয়ে বলল পেছনে দেখতে। আমাকে বলল ডাইনে-বাঁয়ে দেখতে। আমরা নিঃশব্দে এগিয়ে চললাম।

যেখানে ঘাসীবন, সেখানে বড় গাছ বেশি নেই। এমন কিছু জঙ্গলও নেই। তবে ঘাসীবনের ফালিটা সেখানে বোধহয় তিনশো গজ চওড়া ও এক হাজার গজ লম্বা হবে। তার দু-পাশেই গভীর বন। ডান দিক থেকে খুব ঘন ঘন ময়ূরের ডাক ভেসে আসছে। ওপাশে বেশ বড় এক ঝাঁক ময়ূর রয়েছে।

বেশ কিছুদূর সাবধানে এগোনোর পর আমরা কোয়েলের শব্দ শুনতে পেলাম। একটানা ঘরঘর শব্দ। ঘোলা জল বেগে বয়ে চলেছে। এ পর্যন্ত জলের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছাড়া আর কিছুই কর্ণগোচর হল না। এগোতে এগোতে আমরা প্রায় নদীর ধার অবধি গিয়ে পৌঁছালাম। অথচ বাইসনের সাড়াশব্দ নেই। নদীর পারে পৌঁছে যশোয়ন্ত টাবড়কে একটা গাছে উঠে চারদিক দেখতে বলল। টাবড় গাছে অর্ধেকটা উঠেছে, এমন সময় কুকুরের ডাকের মতো একটা ডাক শুনতে পেলাম ঘাসীবনের ভেতরে আমাদের বাঁ দিক থেকে। অমনি টাবড় তরতরিয়ে নেমে এসে বিস্ফারিত চোখে বলল, মুন্নি কোঁয়া হুজৌর, মুন্নি কোঁয়া উস্‌কো পিছে পড়া হ্যায়।

আমি কিছু বুঝতে পারলাম না।

যশোয়ন্তকে খুব উত্তেজিত দেখাল। ও টাবড়কে বলল, আমার বন্দুকটা নিয়ে নিতে। টাবড়কে আরও চারটে গুলি দিতে বলল। গুলি দিলাম। তারপর ওদের পেছনে পেছনে অদৃষ্টপূর্ব, অভূতপূর্ব মুন্নি-কোঁয়ার দর্শনাভিলাষে দুরু দুরু বুকে এগোলাম। টাবড়ের প্রাগৈতিহাসিক বন্দুকের বাহক হয়ে।

ঘাস ঠেলে সাবধানে এগোতেই চোখে পড়ল ঘাসবনের মাঝখানে একটা একলা খয়ের গাছ। সেই গাছের নীচে একটা অতিকায় বাইসন দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দিকে মুখ করে। তার গলায় একটা দগদগে রক্তাক্ত ক্ষত। সেটা পোকায় থকথক করছে। প্রকাণ্ড মাথাটা নিচু করে আছে, শিং দুটো পিঠের উপর শুয়ে আছে, মুখ উঁচু করা। কপালের মধ্যেটা সাদা। দু হাঁটুর কাছে মাজার মতো সাদা লোম। আমার মনে হয়, আমাদের আক্রমণ করার জন্যে বুঝি তৈরি হচ্ছে।

মুহূর্তের মধ্যে যশোয়ন্ত বাইসনটার দিকে রাইফেল তুলল, এবং আমাকে হতবাক করে দিয়ে টাবড়ও সঙ্গে সঙ্গে অন্য দিকে বন্দুক তুলল। রাইফেল ও বন্দুকের যুগপৎ বজ্র নির্ঘোষে সকালের কোয়েলের অববাহিকা গমগম করে উঠল। ওই বড় রাইফেলের গুলি বাইসনের কপালের মধ্যে দিয়ে কুড়ুলের মতো ঢুকে গেল এবং বড় গাছ কেটে ফেলবার সময় যেমন শব্দ হয়, তেমনই শব্দ করে বাইসনটা পড়ে গেল হুড়মুড় করে মাটিতে।

কিন্তু টাবড় যেদিকে গুলি করল, সেদিকে কিছু দেখতে পেলাম না। বাইসনটা পড়ে যেতেই টাবড় আর যশোয়ন্ত বাইসন যেদিকে পড়ে রইল সেদিকে না গিয়ে, যেদিকে টাবড় গুলি করেছিল সেদিকে দৌড়ল। ওদের পেছনে পেছনে আমিও বোকার মতো দৌড়ে গেলাম। একটু যেতেই দেখি, একটা অদ্ভুত জানোয়ার মরে পড়ে আছে। দেখতে কুকুরের মতো, গায়ের রং ম্যাটমেটে লাল, মুখটা কালো, লেজটা কালো, লেজের ডগাটা বেশি কালো।

ততক্ষণে আরও তিন-চারটি গুলির আওয়াজ পেলাম। এবং হঠাৎ প্রায় আমার গায়ের উপর দিয়ে একটা ওই রকম কুকুর পালাতে গেল। আমি সঙ্গে সঙ্গে টাবড়ের যন্তরখানি তুলে যন্ত্রচালিতের মতো সেদিকে ঘুরিয়ে ঘোড়া টিপে দিলাম। কুকুরটার গায়ে যেন কামানের গোলা লাগল। একটা বিরাশি সিক্‌কার থাপ্পড় খেয়ে পড়ে গেল যেন।

অগত্যা নিজেই নিজের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দেখে অবাক হয়ে গেলাম। কিন্তু যখন সংবিত ফিরে এল, তখন মনে হল, আমার ডান হাতটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। গাদা বন্দুকের সে যে কী ধাক্কা, তা বলে বোঝানো যায় না।

ইতিমধ্যে দু-পাশ থেকে আরও দু-একটি গুলি হয়ে গেছে।

টাবড়ের বন্দুকটা গাছে হেলান দিয়ে রেখে কাঁধে হাত বোলাতে বোলাতে আমি বাইসন দেখতে লাগলাম। দেখার মতো জানোয়ার বটে। ঘাড়টা দেখলে ভক্তি হয়। এমন জানোয়ার থাকতে লোক বৃষস্কন্ধদের প্রশংসা কেন করে জানি না। ঘাড়ের রং চকচকে, গাঢ় কালো। বড় বড় মোটা মোটা লোম। পায়ের খুরগুলো সাধারণ গৃহপালিত গরু-মোষের চেয়ে চারগুণ বড়। আর শিং দুটোও দেখবার মতো। শিং-এর গোড়ায় অনেক থেঁতলানো দাগ। জানি না গাছে গাছে ঘষেছে কিনা। ডান-দিকের শিং-টার ডগাটা চল্‌টা ওঠা। পেটের কাছে আর একটা ক্ষত দেখলাম। আড়াআড়িভাবে যেন ছুরি দিয়ে কেউ চিরে দিয়েছে। অন্তত দু ইঞ্চি চওড়া ও এক ফুট লম্বা।

ততক্ষণে ওরা ফিরে এসেছে। আমার মরা কুকুরটা দেখে যশোয়ন্ত বলল, আরে ইয়ার তুম ভি মার দিয়া একঠো। সাব্বাস।

আমি শুধোলাম, ওগুলো কী জানোয়ার? যশোয়ন্ত বলল, জঙ্গলে এর চেয়ে সাংঘাতিক কোনও জানোয়ার নেই। এরা জংলি কুকুর। এর চেয়ে বড়ও আছে এক জাতের, তাদের এখানে বলে রাজকোঁয়া। এরা যে জঙ্গলে ঢোকে, সে জঙ্গলে শম্বর হরিণ, শুয়োর, কারও নিস্তার নেই। এমনকী বাঘও এদের এড়িয়ে চলে।

সচরাচর বাইসনের কাছে এরা ঘেঁষে না। কিন্তু যেই দেখেছে যে বাইসনটা ধুঁকছে, যে কোনও মুহূর্তে মরতে পারে, অমনি ওর কাছে ঘুরছিল। উত্যক্ত করে মৃত্যুটা যাতে ত্বরান্বিত করা যায়, সেই চেষ্টা করছিল।

শুধোলাম, একসঙ্গে ওরা দল বেঁধে থাকে কেন?

ও বলল, দল বেঁধে থাকে, কারণ, এমনিতে তো একলা একলা ছোট জানোয়ারই। শম্বরের পেছনের পায়ের একটা চাঁট খেলে চিতাবাঘেরই মাথার খুলি ফেটে যায়, তো ওদের। সেই জন্যই দল বেঁধে ঘোরে। এবং এক সঙ্গে কোনও বড় জানোয়ারকে চারদিক থেকে আক্রমণ করে। জানোয়ার প্রাণভয়ে পালাতে থাকে আর ওরা সঙ্গে সঙ্গে ধাওয়া করে চলে, লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে গতিস্মান জানোয়ারের গা থেকে মাংস খুবলে খুবলে খায়। তারপর যখন সে জানোয়ারের চলবার মতো আর শক্তি থাকে না, তখন সে মুখ থুবড়ে পড়ে এবং মুন্নিকোঁয়া কি রাজকোঁয়ারা তাকে তিলে তিলে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়। বনে জঙ্গলে এর চেয়ে বীভৎস মৃত্যু আর হয় না।

আমি বললাম, আশ্চর্য! বাইসনটা আমাদের দেখল, অথচ তেড়ে এল না কেন যশোয়ন্ত?

ওর তেড়ে আসবার ক্ষমতা থাকলে আমরা ওকে দেখার অনেক আগেই স্টিম এঞ্জিনের মতো রে-রে করে ঘাসবন ভেঙে এসে ঘাড়ে পড়ত। কখন তেড়ে এল, তা বোঝবার সময় পর্যন্ত দিত না। আসলে ফরেস্ট গার্ডের গুলিটা বেশ জব্বর হয়েছিল। গুলি কপালে না লেগে গলাতে লেগেছিল। নেহাত বন্দুকের গুলি। বেশি দূর ভেতরে ঢুকতে পারেনি, কিন্তু ওর অবস্থা কাহিল হয়ে গিয়েছিল। দেখলে না, নড়তে পর্যন্ত চাইল না আমাদের দেখে। মৃত্যুর আগে সবাই একটু শান্তি চায়। তাই ও এই নদীর পাড়ের নিরিবিলি খয়ের গাছের নীচে দেহরক্ষা করবে বলে এখানে দাঁড়িয়ে ধুঁকছিল, আর কোথা থেকে মুন্নি-কোঁয়ারা খবর পেয়ে এসে হাজির।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *