১০. দ্বিতীয়বার আহত হলাম এবং স্মরণীয় বিয়ে

দশম অধ্যায় – দ্বিতীয়বার আহত হলাম এবং স্মরণীয় বিয়ে

  • লাঠিটিলা অপারেশনে দ্বিতীয়বারের মত গুরুতর আহত হলাম।
  • আহত অবস্থায় বিবিসিকে দেয়া আমার সাক্ষাৎকার।
  • অনিচ্ছাসত্ত্বেও চিকিৎসার জন্য আসতে হল কোলকাতায়।
  • থিয়েটার রোডে বেশকিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম।
  • স্মরণীয় বিয়ে।

যুদ্ধ এগিয়ে চলল। জুলাই মাসের শেষার্ধে লাঠিটিলার যুদ্ধে আমি দ্বিতীয়বারের মত আহত হই মর্টারের গোলা ও মেশিনগানের গুলিতে। চিকিৎসার জন্য আমাকে শীলচরের মাসিমপুর সিএমএইচ এ নিয়ে যাওয়া হয়। আহত অবস্থাতেও আমাকে হাসপাতাল কক্ষ থেকেই যুদ্ধ পরিচালনা করতে হয়। আমার ঘরটাতেই স্থাপন করি ছোট খাট একটি op’s room। এ ব্যাপারে আমাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেন ব্রিগেডিয়ার ভট্‌কে, কর্নেল বাগচী, মেজর দাস গুপ্ত ও ক্যাপ্টেন চ্যাটার্জী। আমি যখন আহত অবস্থায় হাসপাতালে তখন বিবিসি লন্ডন থেকে সাংবাদিকদের একটি প্রতিনিধি দল এলেন আমাদের সিলেট সেক্টরে। তারা আমার সাথে আলাপ করতে চান। আমার আপত্তি নেই জেনে তারা এলেন আমার হাসপাতালের রুমে। ঘরে আমি তখন শয্যাশায়ী। পরিচয়পর্ব শেষে তাদের একজন চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে বললেন,

—এতো দেখছি একটা ছোটখাটো op’s room. অসুস্থ অবস্থায় এ সমস্ত ম্যাপ, ওয়্যারলেস সেট প্রভৃতি নিয়ে আপনি কি করেন?

—আমি আহত হয়ে কিছুদিনের জন্য এখানে শয্যাশায়ী হয়ে আছি বলে যুদ্ধতো বন্ধ হয়ে যায়নি। যুদ্ধ চলছে এবং চলবে। সেক্ষেত্রে সাধ্যমত যতটুকু সম্ভব দায়িত্ব বিছানায় শুয়েও আমি পালন করে যাবার চেষ্টা করছি।

প্রশ্ন করলেন আর একজন,

—শুনেছি আপনি আরো দু’জন অফিসারের সাথে পাকিস্তান থেকে সর্বপ্রথম পালিয়ে এসে যুদ্ধে যোগদান করেছেন। আপনার আপন-পরিজনদের সবাইতো বাংলাদেশে রয়েছেন। তাদের উপর পাক বাহিনীর তরফ থেকে প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা হতে পারে। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কি?

—আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম জাতীয় সংগ্রাম। এ সংগ্রামে অবদান রাখার পবিত্র দায়িত্ব পালন করার জন্যই আমরা পালিয়ে এসেছি। আজ বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পরিবার থেকেই সদস্যরা এসে যোগদান করেছেন মুক্তিযুদ্ধে। দেশকে শত্রুর কবল থেকে স্বাধীন করার জন্যে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন তারা। তাদের এ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের পরিবার-পরিজনদের ভাগ্যে যা ঘটবে আমার আত্মীয়-স্বজনদের ভাগ্যেও ঠিক তাই ঘটবে। অতএব, এ নিয়ে আমার চিন্তা করার কিছু নেই। আপনজনদের শত্রুর পাশবিক নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে দেশকে স্বাধীন করতে হবে। তাইতো আমরা মরণপন যুদ্ধ করে যাচ্ছি দেশকে শত্রুমুক্ত করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আজাদী লাভ করার লক্ষ্যে। স্বাধীনতার প্রশ্নে কোন আপোষ নেই। দেশকে স্বাধীন করে ছাড়বোই ইনশাল্লাহ্।

আমার জবাব শুনে তাদের একজন মন্তব্য করেছিলেন,

—আপনাদের মত সন্তান যে দেশ জন্ম দিয়েছে তার স্বাধীনতা পৃথিবীর কোন শক্তিই রোধ করতে পারবে না।

ভদ্রলোকের কথাগুলো আজও মনে আশার আলো যোগায়, ভবিষ্যত সম্পর্কে আশাবাদী হয়ে উঠি। ১২ কোটি জাগ্রত বাংলাদেশী দাসত্বের সব শৃঙ্খল ভেঙ্গে চুর্নবিচূর্ন করে দেবে নিশ্চয়ই। স্বাধীন মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে সব চক্রান্তের জাল ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে মাথা উঁচু করে দাড়াবেই একদিন। আমার সাথে সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকারটি পরে বিবিসি থেকে প্রচারিত হয়েছিল। এ প্রচারণা থেকেই আমার আত্মীয়-স্বজনরা সর্বপ্রথম জানতে পারেন, আমি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছি।

বেশ কিছুদিন যাবত কোলকাতার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। আমার আহত হওয়ার খবরটা নিম্মীকে জানাইনি ইচ্ছে করেই। বেচারী অযথা চিন্তিত হয়ে পড়বে খবরটা শুনে। কিন্তু আমি না জানালেও থিয়েটার রোড থেকে খবরটা অতি সহজেই ওর কানে পৌঁছাতে পারে। শুয়ে শুয়ে এ সমস্তই ভাবছিলাম। কিছুক্ষণ আগে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কাদের, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বাবু ও আতিক এসেছিল। ওদের সাথে অপারেশনাল এবং অ্যাডমিনিষ্ট্রেটিভ কিছু বিষয় নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর তারা ইনস্ট্রাকশনস্ নিয়ে ফিরে গেছে। একান্ত অবসর খুব কমই পাওয়া যায়। কেউ না কেউ আসছেই। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সমস্যা। বেশ ব্যস্ততার মধ্যেই আমার সময় কেটে যায়। ডাক্তার-নার্সরা অনেক সময় লোকজনদের আসা-যাওয়ার ভীড় দেখে আমাকে এসে উপদেশ দেন বিশ্রাম নেবার জন্য। হাসিমুখে তাদের আন্তরিকতার প্রতিদান দেয়া ছাড়া আমার পক্ষে আর কিছুই করা সম্ভব হয় না। মিসেস ভকে প্রতিদিন খাবার পাঠাচ্ছেন হাসপাতালে। তার স্নেহের ঋনে আবদ্ধ হয়ে থাকতে হবে সারাজীবন। হঠাৎ একাকীত্ব যেন আমায় পেয়ে বসল। মনটাও কেমন যেন উদাস হয়ে গেল। নিম্মীকেই বিশেষ করে মনে পড়ছিল। স্মৃতিমধুর অতীত মনের পর্দায় ভেসে উঠছিল। কিছুক্ষণের জন্য তলিয়ে গিয়েছিলাম অতীত স্মৃতিমন্থনে। হঠাৎ দেখলাম দরজায় তিনজন এসে দাড়িয়েছে। মাহবুব ও ফারুক দু’জনেই আমার প্রিয় গেরিলা কমান্ডার। কিন্তু তাদের সাথে তৃতীয় ব্যক্তিকে দেখে চমকে উঠলাম। নিজের চোখকেই ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। কাছে আসতেই পরিষ্কার হয়ে গেল সব। বাপ্পিই বটে।

—একি। তুই এখানে? আশ্চর্য হয়ে গিয়ে বিছানায় উঠে বসলাম।

—থাক থাক উঠতে হবে না। বলে বাপ্পি এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। উষ্ণ আবেগে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলাম দু’জনেই দু’জনকে জড়িয়ে ধরে। ইতিমধ্যে মাহবুব বাপ্পিকে শয্যার পাশে একটা চেয়ার টেনে দিয়ে বসতে বলল।

—কিরে বাপ্পি। তুই এখানে এলি কি করে? পথ চিনলি কি করে? জানলিই বা কি করে আমি এখানে আছি?

—আগে বল আহত হবার কথা তুই আমাদের কেন জানাসনি? পাল্টা প্রশ্ন বাপ্পির।

—কেন জানাইনি সেটা সত্যিই কি বুঝতে পারছিস না?

—আমরা উদ্বিগ্ন হতাম ঠিকই বিশেষ করে নিম্মী। কিন্তু তবুও খবরটা তোর জানানো উচিত ছিল। তার যুক্তি মেনে নিলাম। ঝগড়া করে লাভ নেই, আমার ভুল হয়েছে মেনে নিলাম

—কিন্তু তুই হঠাৎ করে এখানে কেন?

—তোর আহত হবার খবর নূর ভাই এবং সালাহ্উদ্দিন ভাই নিজেরা বাসায় এসে আমাদের জানান। খবরটা জানিয়ে ওরা অবশ্য নিম্মীকে বোঝাতে চেষ্টার কোন ত্রুটি করেননি যে তুই ভালোই আছিস। ভয়ের কোন কারণ নেই। কিন্তু তাদের সে সান্ত্বনা বাণী নিম্মী পুরোপুরি মেনে নিতে পারছিল না কোন মতেই। তার একই সন্দেহ ওঁরা তার কাছে আসল অবস্থা লুকোচ্ছেন। নিম্মীর সে কি কান্না। সাথে সাথে খাওয়া-দাওয়াও ছেড়ে দিল। ওর অবস্থা দেখে আমি আর ঠিক থাকতে পারলাম না। ওকে বললাম, ‘ঠিক আছে আমি নিজেই যাচ্ছি শীলচরে ডালিমের অবস্থা দেখে আসতে।’ কিন্তু বাধ সাধলেন বাবা-মা। তারা বললেন, ‘ক্যানাডা যাবার সবকিছুই ঠিক হয়ে গেছে। এ অবস্থায় শীলচর যাবার প্রশ্নই উঠে না।’

—ওহ। তুই আর নিম্মী ক্যানাডা যাচ্ছিস বুঝি? কিছুটা অবাক হলাম আমি।

—হ্যাঁ। আমাদের দু’জনের মতের বিরুদ্ধেই বাবা আমাদের গামু কাক্কুর কাছে পাঠাবার সব বন্দোবস্ত করে ফেলেছেন। মা দিব্যি দিয়েছেন আমরা না গেলে তিনি আত্মহত্যা করবেন। এ অবস্থায় আমাদের কি আর করার আছে বল? কিন্তু নিম্মী কিছুতেই যেতে রাজি হচ্ছে না। এর জন্য ওর উপর বাবা-মা ভীষণ খ্যাপা। মারধরও তাকে খেতে হচ্ছে বেধুম। ওর এক কথা, তোকে এ অবস্থায় রেখে সে কোলকাতার বাইরে এক পাও নড়বে না। প্রয়োজনে সেও আত্মহত্যাই করবে তবুও ক্যানাডা যাবে না কিছুতেই। এ বিষয় নিয়ে বাড়িতে এখন অশান্তির ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সবদিক সামলাতে পারছি না কিছুতেই। বিশেষ করে নিম্মীর যে অবস্থা, কোন একটা অঘটন ঘটে যাওয়া অসম্ভব কিছুই নয়। অবস্থা দেখে আমিও বাবাকে মুখের উপর বলে ফেললাম, ‘ডালিমকে না দেখে ক্যানাডায় আমিও যাব না।’ আমার দৃঢ়তায় অবশেষে বাবা-মা রাজি হলেন আমাকে আসতে দিতে। আমার আসার অনুমতি পাওয়াতে নিম্মী বেচারীও কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছে। ওকে কথা দিয়ে এসেছি তোর যথাযথ ব্যবস্থা করেই আমি ফিরব। প্রয়োজন হলে কোলকাতায়ও নিয়ে যাব তোকে। তারপর ট্রেনে করে শীলচর। শীলচর ষ্টেশনে নেমে মুক্তিযোদ্ধাদের সদর দফতর খুঁজে পেতে এতটুকু বেগ পেতে হয়নি আমার। ওখান থেকে মাহবুব ও ফারুককে সঙ্গে দিয়ে দেয়া হল। তারাই পথ দেখিয়ে নিয়ে এল এখানে। মজার কথা কি জানিস। শীলচর পৌঁছে সবচেয়ে অবাক হয়ে গেয়েছিলাম এটা দেখে যে বাপ্পি নামটার মাধ্যমে আমি এখানে বহুলভাবে পরিচিত }

—হ্যাঁ। মাহবুব, ফারুক দু’জনেই আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন। ওরা ছাড়াও মারও অনেকেই তোদের ব্যাপারে সবকিছুই জানে। কথার ফাঁকে নার্স চা-নাস্তা রেখে গিয়েছিল বাপ্পিকে বললাম,

—আমার বা দিকের এত বড় ব্যান্ডেজ দেখে ঘাবড়াসনে। ব্যান্ডেজের তুলনায় ক্ষত অনেক ছোট। কাধে মাত্র তিনটি এলএমজি বুলেট আর তালুতে মর্টার শেলের স্প্রিন্টার লেগেছে এই যা। ডাক্তাররা বলেছেন, নন ষ্টপ ব্লিডিং এর মধ্যেও ৯০ মাইল গাড়িতে করে হাসপাতালে জীবিত অবস্থায় যখন পৌঁছতে পেরিছি তখন এ যাত্রায় মরার ফাঁরা কেটে গেছে। এখনতো বহাল তবিয়তেই রয়েছি। দেখতে পাচ্ছিস না কেমন op’s room সাজিয়ে বসেছি? কোন অসুবিধে নেই।

বাপ্পির ছলছল চোখ দেখে অনেকটা বাধ্য হয়েই ওকে আশ্বস্ত করার জন্য কথাগুলো বলতে হল আমার। আমার কথায় বাপ্পির উদ্বিগ্নতা কতটুকু কএল ঠিক বুঝতে পারলাম না। অল্পক্ষণ সে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠল,

—এখানে হাসপাতালে তোর পড়ে থাকা চলবে না। উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য তোকে কোলকাতায় নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।

—ঠিক বলেছেন বাপ্পি ভাই। ডাক্তাররাও তাই বলছেন। কোলকাতায় গিয়ে স্পেশালিষ্ট এর আন্ডারে চিকিৎসা করানো উচিত বলে তারাও মনে করছেন। কিন্তু হক ভাই কিছুতেই সেক্টর ছেড়ে যেতে রাজি নন। তিনি চলে গেলে আমাদের এখানে অনেক অসুবিধা হবে এটা ঠিক। কিন্তু কোলকাতায় গিয়ে উপযুক্ত চিকিৎসা করিয়ে সম্পুর্ন সুস্থ্য হয়ে তিনি আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন সেটাই আমরা সবাই চাই। তিনি সম্পুর্ন সুস্থ্য হয়ে ফিরে এলে তার সাময়িক অনুপস্থিতির ঘাটতি অনায়াসে পুষিয়ে নিতে পারব সুদে-আসলে। মাহবুব বাপ্পির কথায় সায় দিয়ে বলে উঠল।

—হক ভাইকে যে করেই হোক আপনাকে কোলকাতায় নিয়ে যেতেই হবে। এখানে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে তার অবস্থার চরম অবনতিও ঘটতে পারে। এর জন্য কিছু সময়ের জন্য তাকে কোলকাতায় অবশ্যই যেতে হবে। ফারুকও তার যুক্তিকে সমর্থন জানিয়ে বলল।

বাপ্পির জেদ ও সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের যুক্তির কাছে আমার কোন কথাই টিকল না। সবার কাছে বিদায় নিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই বাপ্পি আমাকে নিয়ে কোলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হল। বাই রোড আমরা গৌহাটি এলাম। সঙ্গে এল আমার প্রিয় গেরিলা কমান্ডাররা। গৌহাটি থেকে প্লেনে কোলকাতায়। সবাইকে ছেড়ে আসতে ভীষণ খারাপ লাগছিল। ওরা সবাই অশ্রুসিক্ত আবেগে বিদায় দিয়েছিল আমাদের। কথা দিয়েছিলাম, “যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসা সেরে ফিরে আসব।”

কোলকাতায় ফিরে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। ক্যাপ্টেন সালাহ্উদ্দিন তখন হেডকোয়াটার্সে গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত হয়েছে। ক্যাপ্টেন নূরুল ইসলাম শিশু স্বাস্থ্যগত কারণে সেক্টর থেকে হেডকোয়াটার্সে ষ্টাফ অফিসার হিসেবে যোগদান করেছেন। তিনি নাকি সেক্টরে অসম্ভবভাবে স্নায়ু দুর্বলতা এবং মানসিক রোগে ভুগছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তবতা কিছুতেই নাকি তার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। মেজর মঈনুল ইসলামকে যুদ্ধক্ষেত্রে কাপুরুষতা ও ভুল নেতৃত্বের জন্য কমান্ড থেকে অব্যাহতি দিয়ে হেডকোয়াটার্সে ডেকে পাঠানো হয়েছে। তিনি কিছুদিন যাবত হেডকোয়াটার্সেই অবস্থান করছেন।

যুদ্ধকালীন সময়ে কোলকাতায় বেশকিছু পরিবারের সাথে আমার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। তাদের মধ্যে মিত্রী মাসী, ডঃ গনী এবং তার পরিবার, অরূপ দা ও পারুমিতা বৌদি, জনাব আইয়ূব ও তার স্ত্রী গৌরিদী, প্রিতিশ নন্দী ও তার স্ত্রী রীনা, ইন্দু প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাদের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অসীম ভালোবাসা ও সহানুভূতি পেয়েছিলাম। তারা সবাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে বিভিন্নভাবে প্রচুর অবদান রেখেছিলেন। যুদ্ধের বিবরণ ও অগ্রগতি সম্পর্কে আমাদের কাছ থেকে শুনতে তারা সর্বদাই বিশেষভাবে উদ্গ্রীব হয়ে থাকতেন। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী চেতনা তাদের সবার মধ্যেই ধরা পড়ত প্রকটভাবে। কিন্তু যখনই তাদের বলেছি, “স্বায়ত্ব শাসনের দাবি জানিয়ে ব্যর্থ হয়ে স্বাধীনতার জন্য আমরাতো সংগ্রাম করে যাচ্ছি, কিন্তু পশ্চিম বাংলার আপনারা নিশ্চুপ হয়ে কেন্দ্রিয় শোষণ এবং জাতীয় নির্যাতন সহ্য করছেন কেন? পুরো বাঙ্গালী জাতির মুক্তির জন্য আপনাদের কি কিছুই করার নেই?”

এ ধরণের আলোচনায় সর্বদাই তারা পাশ কাটিয়ে যেতেন অথবা থাকতেন চুপ করে। কখনও যুক্তি দেবার চেষ্টা করতেন বাংলাদেশের সাথে তাদের অবস্থাকে তুলনা করা ঠিক নয়। বেশ অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ে যেতেন তারা এ ধরণের বিতর্কে। তাই আমরাও এ সমস্ত ব্যাপারে তেমন বিশেষ উচ্চবাচ্য করতাম না। সময় সময় আমরা এ ধরণের কথাও তাদের বলেছি, “বাংলাদেশের সংগ্রামের ছত্রছায়ায় কংগ্রেস সরকার সিআরপি এবং বিএসএফ বাহিনীর মাধ্যমে অসংখ্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী যুবক মেরে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহার অঞ্চলে।

এ ধরণের বক্তব্যকে অস্বীকার করতে পারতেন না তারা। কিন্তু সব সত্যকেই কেমন জানি নেতিবাচকভাবে মেনে নিয়ে চুপ করে থাকতেন। তাদের এই চুপ করে থাকার রহস্য আজও মাঝেমধ্যে আমাকে ভাবিয়ে তোলে।

থিয়েটার রোডেই আমার থাকার ব্যবস্থা হল। তখনকার দিনে প্রখ্যাত বোন স্পেশালিষ্ট ডঃ মুরালী মুখার্জীর সাথে আমার চিকিৎসার ব্যাপারে পারুমিতা বৌদি ইতিমধ্যেই আলাপ করেছেন। আমার ক্ষত পরীক্ষা করে তিনি বললেন, “গান পাউডার এবং বুলেট ইনজ্যুরির ফলে খারাপ ধরণের ইনফেকশন দেখা দিয়েছে। ইনফেকশনটাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে গ্যাংরিনে টার্ন নিতে পারে। প্রথমে চেষ্টা করতে হবে ইনফেকশন বন্ধ করার।” ঘাবড়ে গেলাম। কিন্তু কিছুই করার নেই। বাস্তবতাকে মেনে নিতেই হবে। তিনি ঔষধ, ইনজেকশন লিখে দিলেন এক সপ্তাহের জন্য। বৌদি আমাকে মনোবল জোগানোর জন্য বললেন, “কোন চিন্তা করবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে।” বেশিরভাগ সময় আমাকে শুয়েই থাকতে হয়। বাপ্পির সাথে নিম্মী এসে আমাকে দেখে গেছে। রোজ তার পক্ষে আসা সম্ভব নয়। সুযোগমত ও টেলিফোন করে আমাকে। বাপ্পির মাধ্যমে ভালোমন্দ খাবার পাঠায় প্রায়ই।

একদিন বাপ্পি এল। ভীষণ গম্ভীর ভাব। বুঝলাম বাসায় কিছু একটা ঘটেছে। ঠিক তাই। ক্যানাডা যাওয়া নিয়ে ঝড় বয়ে গেছে বাসায়। কথা কাটাকাটি তারপর বেধম প্রহার। বাপ্পি বলল, “বাসার অবস্থা সঙ্গিন হয়ে উঠেছে। এর একটা আশু সমাধান প্রয়োজন। তা না হলে যে কোন অঘটন ঘটিয়ে বসতে পারে নিম্মী। তার মত কোমল প্রকৃতির মেয়েও ভীষণ কঠিন হয়ে পড়েছে। ওকে কিছুতেই ক্যানাডায় পাঠাতে পারবে না বাবা-মা। মানসিক চাপে ক্রমান্বয়ে তার শারীরিক অবনতিও ঘটছে। রীতিমত অসুস্থ হয়ে পড়ছে সে। এ অবস্থায় সব চাপ সহ্য করা কতদিন সম্ভব হবে তার পক্ষে?” সব শুনে ভীষণ চিন্তায় পড়লাম। কি করে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব? কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না। নূর এবং সালাহ্উদ্দিনের সাথে পরামর্শ করা যেতে পারে। ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করলাম ওদের সাথে। তারা বলল, “সব দিক রক্ষা করার জন্য আমাদের বিয়ে হয়ে যাওয়া দরকার। একমাত্র বিয়ে হলেই নিম্মীর ক্যানাডা যাওয়া বন্ধ হতে পারে। একমাত্র তখনই ওর পক্ষে আমাকে সার্বক্ষণিক সঙ্গ দেয়া সম্ভব।” কিন্তু এ অবস্থায় বিয়ের জন্য তার বাবা-মা রাজি হবেন কি? নূর ও সালাহ্উদ্দিন একদিন আমার তরফ থেকে প্রস্তাব নিয়ে গেল নিম্মীদের বাসায়। প্রস্তাবে ওর বাবা-মা রাজি হলেন না। ওদের যুক্তি যেখানে সবকিছুই আজ অনিশ্চিত সেখানে কি করে তারা মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে রাজি হন? হতাশ হয়ে ফিরে এল নূর এবং সালাহ্উদ্দিন। ওদের কোন যুক্তিই তাঁরা গ্রহণ করলেন না। অবস্থার আরো অবনতি ঘটতে থাকে তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হবার পর। নিম্মী আমাকে পরিস্কার লিখে জানাল, “যেভাবেই হোক না কেন তাকে এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করতেই হবে। তা না হলে সে আত্মহত্যা করবে কিন্তু তবুও ক্যানাডায় আমাকে এ অবস্থায় ফেলে রেখে সে কিছুতেই যাবে না।” কি অসম্ভব দৃঢ়তা। দুঃশ্চিন্তায় অধীর হয়ে অনেক ভেবে-চিন্তে স্থির করলাম বিয়েই করব। নূর, সালাহউদ্দিন ওরাও আমার সিদ্ধান্তে একমত হল। ব্যাপারে গৌরিদী, গনী নানা, মিসেস জামানের সাথে আলাপ করে তাদের পরামর্শ চাইলাম। তারাও অভিমত প্রকাশ করলেন, “বিয়েই একমাত্র পথ।” নিম্মীকে পত্র মারফত জানিয়ে দিলাম, “আমরা কিছু একটা করছি। কিন্তু তাকে সুস্থ এবং স্থির থাকতে হবে।

বিয়ে তো হবে। কিন্তু নিম্মীকে কি করে ৩নং সোহরাওয়ার্দী এ্যাভেনিউ থেকে বের করে আনা যায়। বাড়িটা তখন একটি বিশেষ নিরাপত্তাধীন দুর্গই বটে। সমস্ত VIP-V.VIP-রা বাস করছেন সেখানে। তাদের নিরাপত্তার জন্য প্রায় ৩০-৪০ জন পুলিশ সার্বক্ষণিকভাবে পাহারায় মোতায়েন রয়েছে। তার উপর নিম্মীর উপর রয়েছে কড়া নজর। বাড়ির বাইরে যাওয়া ওর জন্য নিষিদ্ধ। সর্বোপরি সে শারীরিকভাবে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছে। সবাই মিলে তাকে বের করে আনার একটা পরিকল্পনা আঁটা হল। মিসেস জামান, নায়লা, লুবনা ও গৌরিদী যাবেন নিম্মীদের বাসায়। নায়লা, লুবনা নিম্মীর বন্ধু বিধায় মিসেস জামানের সাথেও নিম্মীদের পূর্ব পরিচিতি আছে। নায়লা, লুবনা এবং মিসেস জামান বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক দল গঠনের জন্য বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়ে কাজ করছিলেন সেটা তখন প্রায় সর্ব মহলেই জানা। নিম্মী খ্যাতিমান ক্ল্যাসিকাল নৃত্য শিল্পী তাই সেও যাতে দলে যোগদান করে সেই অনুরোধ জানাবার উছিলায় যাবেন তারা। ঠিক হল কথার ফাকে নায়লা ও লুবনা নিম্মীকে যে করেই হোক কোনমতে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে আসবে। বাইরে নূরেরা গাড়ি নিয়ে অপেক্ষায় থাকবে। এরপর গাড়ি করে সোজা মৈত্রী মাসীর বাড়ি। বিয়ে সেখানেই হবে। গনী নানা বিয়ের কাজী, রেজিষ্ট্রার এসব কিছুর দায়িত্ব নিবেন। সালাহ্উদ্দিনকে আনুসাঙ্গিক অন্যসব ব্যবস্থার ভার দেয়া হল। পরিকল্পনার ব্যাপারে অবগত থাকলেন থিয়েটার রোড হেডকোয়াটার্সের গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দোকার, ক্যাপ্টেন চৌধুরী। এছাড়া অন্য কাউকে কিছু বলা হল না। বিয়ের দিন ধার্য্য হল ১৬ই আগষ্ট সকাল দশটার দিকে। নায়লারা গিয়ে উপস্থিত হল ৩নং সোহরাওয়ার্দী এ্যাভেনিউতে। প্লানমত আলাপের এক ফাকে নায়লা এবং লুবনা বসার ঘর থেকে গিয়ে হাজির হল নিম্মীর ঘরে। সেখানে পৌঁছে নিম্মীকে লায়লা বলল, “এক্ষুণি চলো আমাদের সাথে। আজ তোমার বিয়ে।” প্রথমটায় হতচকিত হয়ে গিয়েছিল নিম্মী। কিন্তু মুহূর্তেই বুঝে নিল সবকিছু। অসীম সাহসের পরিচয় দিয়ে এক কাপড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রস্তুত হয়ে উঠে দাড়াল নিম্মী। যে কোন কুমারী মেয়ের পক্ষে এ ধরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা একটি অসম্ভব দুরহ্ কাজ। নিম্মীর ভালোবাসার একনিষ্ঠতা এবং গভীরতাই সেদিন শক্তি যুগিয়েছিল অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে। শারীরিক অসুস্থতা এবং স্নায়ু দুর্বলতার জন্যে বেচারী হাটতেও পারছিল না ঠিকমত। নায়লা ও লুবনা ওকে দু’দিক থেকে ধরে প্রায় বহন করে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে কোনমতে অতি কষ্টে নামিয়ে নিয়ে এল গেটের বাইরে। সেখান থেকে সোজা মৈত্রী মাসীর বাসায় নূর নিয়ে এল সবাইকে। ওখানে আমরা অপেক্ষা করছিলাম। সব বন্দোবস্ত প্ল্যানমত ইতিমধ্যে করা হয়েছে। সালাহ্উদ্দিন নিম্মীর জন্য বিশ-পচিশ টাকা দামের দু’টো শাড়ি এবং আমার জন্য দশ টাকা দামের একটা পাঞ্জাবী কিনে নিয়ে এসেছে। সেগুলো পড়েই আমাদের বিয়ে হল। সালাহ্উদ্দিন হল নিম্মীর উকিল বাপ। সাক্ষী হয়ে রইলেন গনী নানা, গৌরিদী, নূর এবং মিসেস জামান। বিয়ের পর উপস্থিত মুরুব্বীরা এবং মৈত্রী মাসী আমাদের আর্শীবাদ করলেন। বিয়ের দলিল রেজিষ্ট্রি করতে দু-তিন দিন সময় লাগবে। এ সময়টা লুকিয়ে থাকতে হবে আমাদের। কারণ নিম্মীর বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসে বিয়ে করার পরিপ্রেক্ষিতে যে অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে তার মোকাবেলা করার জন্য বিয়ের দলিলটা অপরিহার্য। গৌরিদীই ঠিক করে ফেললেন তার পরিচিত এক ধনী ব্যবসায়ীর পার্ক ষ্টিট্রের একটা গেষ্ট হাউস। ছোট্ট কিন্তু সাজানো গেষ্ট হাউস। সেখানেই হবে আমাদের বাসর এবং মধুচন্দ্রিমা। আমাদের গোপন আস্তানার খবর বিয়েতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিবর্গ ছাড়া আর কাউকে জানানো হবে না। সেদিন সন্ধ্যায় আমাদের চলে যেতে হল গেষ্ট হাউসে। নায়লা, গৌরিদী, নূর এবং সালাহ্উদ্দিন আমাদের পৌঁছে দিল। রজনীগন্ধা ও বেলী ফুল দিয়ে নায়লা, লুবনারা সুন্দর করে রুচিসম্মতভাবে সাজিয়ে দিয়েছিল আমাদের বাসর ঘর। ওরা চলে যাবার পর হঠাৎ করে আমরা দু’জন ভীষণ একলা হয়ে গেলাম। সারাদিনের ঘটনাবলী এত দ্রুত ঘটেছে যার ফলে চিন্তা-ভাবনার কোন অবকাশই আমরা পাইনি এতক্ষণ। একটা ঘোরের মাঝেই কেটে গেছে পুরো দিনটা। ফ্ল্যাটের নির্জন পরিবেশে ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রবাহের গুরুত্ব উপলদ্ধি করে কেঁদে উঠল নিম্মী। অতি স্বাভাবিক কারণেই ভেঙ্গে পড়ল সে। আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, “সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ধৈর্য্য ধরতে হবে। সময় সব সমস্যার সমাধান করে দেবে ইনশাল্লাহ্।” বেচারী ভীষণভাবে কাদঁতে কাদঁতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। অতীত ও ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমিও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম এক সময়। পরদিন সকালেই নূর এসে জানাল, আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। নিম্মীর বাবা অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাছে নালিশ করেছেন, “আমি তার মেয়েকে জোর করে অপহরণ করে নিয়ে গেছি বাসা থেকে।” প্রধানমন্ত্রী গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত সালাহ্উদ্দিনকে ডেকে হুকুম দিয়েছেন যে করেই হোক আমার এবং নিম্মীর খোঁজ করে তাকে বের করতেই হবে কোথায় আছি আমরা। প্রয়োজনে অপহরণকারী আর্মি অফিসারের কাছ থেকে নিম্নীকে উদ্ধার করার জন্য ভারতীয় পুলিশ এবং গোয়েন্দা বিভাগের সহায়তাও গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু বিয়ের দলিল রেজিস্ট্রি হয়ে হাতে না আসা পর্যন্ত কিছুই কাউকে বলার উপায় নেই। ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন কর্নেল ওসমানীও। ডিসিপ্লিন ভঙ্গ করে অন্যায়ভাবে জোর করে ভদ্রলোকের মেয়েকে যে অপহরণ করতে পারে তার কঠোর সাজা হওয়া উচিত। একই সাথে তিনি ভীষণভাবে দুঃখিতও হয়েছেন। নূরকে বলেছেন, “ডালিমের মত যোগ্য অফিসার কি করে এ ধরণের কাজ করতে পারে সেটা তিনি কিছুতেই ভেবে পাচ্ছেন না।” নূর আমাদের সাবধান করে দিয়ে বলল, “স্যার আপনারা ঘরের বাহিরে যাবেন না দলিল হাতে না পাওয়া পর্যন্ত 1 গনী নানা চেষ্টা করছেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দলিল রেজিষ্টি করার। দলিলটা হয়ে গেলেই সবাইকে বুঝিয়ে ব্যাপারটার আপোষ মীমাংসা করার উদ্যোগ নেয়া হবে।” একবার স্থির করেছিলাম বাপ্পিকে একটা ফোন করে সব কিছু জানিয়ে ওকে বলি আমরা ভালোই আছি। কিন্তু নূরের কথায় সেটা করা সম্ভব হল না। ১৯ তারিখে আমাদের হাতে দলিল পৌঁছে গেল। সেদিনই সমস্ত ব্যাপারটা সালাহউদ্দিন, নূর এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দোকার কর্নেল ওসমানী এবং তাজুদ্দিনকে বুঝিয়ে বললেন। সমস্ত কিছু বিস্তারিত জানবার পর জনাব তাজুদ্দিনকে সবাই অনুরোধ জানালেন ব্যাপারটার একটা মীমাংসা করে দেবার জন্য। জনাব তাজুদ্দিন সেদিনই নিম্মীর বাবাকে এবং আমাদের ডেকে পাঠালেন থিয়েটার রোডে। নিম্মীর বাবার পৌঁছার আগেই আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম। জনাব ওসমানী এবং জনাব তাজুদ্দিনকে সালাম করলাম দু’জনে, তারা আর্শীবাদ করলেন। জনাব তাজুদ্দিন রললেন যা হবার তা হয়ে গেছে। জনাব চৌধুরীকে তিনি ডেকে পাঠিয়েছেন। তিনি এলে তার কাছে মাফ চাইতে হবে আমাদের দু’জনকেই। এতেই কাজ হবে। কারণ জনাব চৌধুরী শক্ত অফিসার হলেও মনটা তার শিশুর মতই সরল এবং কোমল। অল্পক্ষণ পর জনাব চৌধুরী ও বাপ্পি এসে পৌঁছালো। নূর তাদের অভ্যর্থনা করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে এল। সেখানে কর্নেল ওসমানীও উপস্থিত ছিলেন। আমাদেরকেও হাজির করানো হল আসামীর মত। ঘরে ঢুকতেই জনাব তাজুদ্দিন গর্জে উঠলেন, “কি করেছ তোমরা? এত বড় দুঃসাহস হল কি করে? আমি মর্মাহত হয়েছি তোমাদের ছেলেমানুষী কার্যকলাপে। বিয়ে-শাদী বাচ্চাদের পুতুল খেলা নয়। মুরুব্বীদের আর্শীবাদ ছাড়া কেউ কোনদিন সুখী হতে পারে না। জলদি তোমরা বাবার কাছে মাফ চাও।” এরপর নিম্মীর বাবাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, “চৌধুরী সাহেব ওরা আপনারই সন্তান। ভুল করে ফেলেছে না বুঝে। ওদের আপনি ক্ষমা করে আর্শীবাদ করুন।” প্রধানমন্ত্রীর কথা শেষ হতেই আমরা বাবার পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। নিম্নী কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। ওতেই মোক্ষম কাজ হল। মোমের মত গলে গেলেন চাচা মানে নিম্মীর বাবা। নিম্মীকে জড়িয়ে ধরে তিনিও কাঁদতে লাগলেন। আমাকেও টেনে তুলে জড়িয়ে ধরলেন বুকে। নূর, সালাহ্উদ্দিন ওরা সব তৈরিই ছিল। মিষ্টির প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকল ব্যায়ারা। এক আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি হল থিয়েটার রোডে। চাচার কাছ থেকে জানতে পারলাম খালাম্মা মানে নিম্মীর মা ভীষণভাবে আঘাত পেয়েছেন নিম্মীর বাড়ি ছেড়ে চলে এসে বিয়ে করায়। তিনি ভীষণ জেদি এবং তীব্র অভিমানী। তার রাগ না কমলে বাড়িতে আমাদের যাওয়া ঠিক হবে না। এতে হিতে বিপরীত হবারই সম্ভাবনা। ঠিক হল আরো কিছুদিন আমাদের গেষ্ট হাউজেই থাকতে হবে। বাপ্পিকে সমস্ত ঘটনা থেকে বাদ রাখা হয়েছিল বলে সে ভীষণভাবে অভিমান করেছিল আমাদের উপর। অতি কষ্টে তার মান ভাঙ্গাতে হয়েছিল আমাদের দু’জনকে। বাবা চলে যাবার পর জনাব তাজুদ্দিন বলেছিলেন, “দু’জনে দু’জনকে পছন্দ করে দুঃসাহসিকভাবে বিয়ে করেছ; এখন থেকে তোমরা দু’জনেই হবে দু’জনের অবলম্বন। দুঃখ কর না সময়মতো সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের বিয়েও হয়েছিল ঠিক তোমাদের মত করেই সবার অমতে। আমি আর্শীবাদ করছি তোমরা চিরসুখী হও।” তাকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে আসতেই নূর, সালাহউদ্দিনরা সব আমাদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টায় পুরো থিয়েটার রোড মাতিয়ে তুলল। কর্নেল ওসমানীও এসে যোগ দিলেন আমাদের সাথে। সবাই সেদিন একসাথে রাতের খাওয়া খেলাম। বিশেষ খাবারের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল সেদিন। বিদেশের মাটিতে জীবনের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে সেদিন জনাব তাজুদ্দিন, কর্নেল ওসমানী, গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দোকার, ক্যাপ্টেন চৌধুরী, ক্যাপ্টেন সালাহ্উদ্দিন, লেফটেন্যান্ট নূর, মৈত্রী মাসী, গৌরিদী, গনী নানা, মিসেস জামান, নায়লা, লুবনা, জনাব আইয়ূব, প্রীতিশ নন্দী, রীণা, ইন্দু, ডঃ মুখার্জী, অরূপদা এবং ওদের মত অন্য সবার কাছ থেকে যে উষ্ণ আন্তরিকতা এবং নিঃস্বার্থ ভালোবাসা এবং সহযোগিতা পেয়েছিলাম সেটা জীবনে কখনোই ভোলা যাবে না। আমরা দু’জনেই তাদের কাছে চিরঋনী হয়ে থাকব সারাজীবন।

এ ক’দিনের টেনশনে ঠিকমত ঔষধপত্র খাওয়া হয়নি ফলে চিকিৎসা বিঘ্নিত হয়েছে। তার পরিণামে হাতের ব্যাথা হঠাৎ করে বেড়ে গেল। ব্যান্ডেজের নিচ থেকে পচা দুর্গন্ধ বেরুতে লাগল। তাড়াতাড়ি ডঃ মুখার্জীর ওখানে আমাকে আবার নিয়ে যাওয়া হল। ব্যান্ডেজ খুলে হাতের ক্ষতের অবস্থা দেখে তার মুখ কালো হয়ে গেল। তিনি বললেন, “ঠিকমত চিকিৎসা না হওয়ায় এবং ঔষধপত্র না খাওয়ায় হাতে গ্যাংরিন শুরু হয়েছে। এ পচঁনকে রোধ করতে হলে অবিলম্বে অপারেশন করতে হবে। তা না হলে পুরো হাতটাকেই কেটে ফেলতে হতে পারে।” ডাক্তারের কথা শুনে সবাই ভীষণভাবে ঘাবড়ে গেলেন। আমিও ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কি করা উচিত। আমি হাসপাতালে ভর্তি হলে নিম্নী একা একা ফ্ল্যাটে কি করে থাকবে। আবার সাহায্যের মুক্ত হাত বাড়িয়ে দিলেন ডঃ গনী, “নিম্মী আমার মেয়ে। ও আমার বাসায় থাকবে। তুমি এ নিয়ে চিন্তা কর না। আজই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যাও।” গনী নানার কথায় কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। পারুমিতা বৌদি আমার ভর্তির সব ব্যবস্থা করে দিলেন পিজি হাসপাতালে : আমার অপারেশন করলেন ডঃ মুখার্জী : গ্যাংরিন রোধ করার জন্য বা হাতের বিভিন্ন জায়গা থেকে কিছু কিছু অংশ কেটে ফেলে দিতে হয়েছে তবু আল্লাহর রহমতে বা হাতটা বাচানো সম্ভব হয়েছে। ডঃ মুখার্জী অপারেশন শেষে মন্তব্য করেছিলেন আর কয়েকটা দিন দেরি হলে পুরো বা হাতটাই কেটে ফেলতে হত। পরিবারের সবচেয়ে আদরের নিম্মীকে দেখে কষ্ট হয়। আমি বুঝতে পারি ভেতরে ভেতরে তার অন্তরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। বাড়িঘর, একান্ত আপনজন সবাই থাকতেও আজ ও ভীষণ একা। একটু আশ্রয়ের জন্য আজ তাকে এখানে-ওখানে থাকতে হচ্ছে রিফিউজির মত। তার উপর আমার শারীরিক অবস্থা নিয়ে ও বিশেষভাবে চিন্তিত বাপ্পির কাছ থেকে জানতে পারলাম আমাদের চিন্তায় চাচা ভেঙ্গে পড়েছেন; তিনি আমাদের এই মুহূর্তেই বাসায় নিয়ে যেতে চান কিন্তু খালাম্মার মানসিক অবস্থার কথা ভেবে তার কাছে কথাটা কিছুতেই উঠাতে পারছেন না জনাব চৌধুরী। অত্যন্ত স্নেহবৎসল খালাম্মা। তিনি নিম্মীর উপর যে অভিমান করেছেন সেটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ নিম্মী তার খুব আদরের আর সেই নিম্মীই এ ধরণের একটা কাজ করে বসবে সেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না খালাম্মা। তার বিশ্বাসের অবমাননা করেছে নিম্মী এটাই তার ক্ষোভের প্রধান কারণ। সবকিছু মিলিয়ে বাসায় একটা অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর সবটুকু চাপ পড়ছে নিম্মীর মনের উপর। বেচারী সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত; কিন্তু বাইরে তার কোন প্রকাশ নেই পাছে আমি মনে কষ্ট পাই এ কারণে। শুধু আমার জন্যই বেচারী জান আমার মুখ বুজে সবকিছুই মেনে নিয়ে স্বাভাবিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ওর ত্যাগ, সহনশীলতা এবং ভালোবাসার গভীরতা উপলব্ধি করে নিজেকে ভীষণ ছোট মনে হচ্ছিল। ভাবছিলাম, ওর এই অসহায় অবস্থার জন্য আমিই দায়ী। অত্যন্ত স্বার্থপর মনে হচ্ছিল নিজেকে। মনেমনে ঠিক করলাম যেভাবেই হোক না কেন তাকে এই করুণ অবস্থা থেকে উদ্ধার আমাকেই করতে হবে। সপ্তাহখানেক হাসপাতালে থাকতে হল। হাসপাতাল থেকে চলে আসার পর একদিন নিম্মীকে সঙ্গে নিয়ে সোজা গিয়ে উপস্থিত হলাম নিম্মীদের বাসায়। চাচা, বাপ্পি, মানু আমাদের আনন্দে জড়িয়ে ধরল। আমি বাপ্পিকে জিজ্ঞেস করলাম, “খালাম্মা কোথায়?” বাপ্পি জানাল আজকাল তিনি বেশিরভাগ সময় তার নিজের ঘরেই কাটান, বের হন না খুব একটা। কারো সাথেই তেমন কোন কথাবার্তা বলেন না প্রয়োজন ছাড়া। সবশুনে আমি সোজা চলে গেলাম তার ঘরে। তিনি বিছানায় শুয়ে ছিলেন। আমাকে দেখে ভূত দেখার মতই চমকে বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালেন। কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি এগিয়ে গিয়ে তাকে একহাতেই জড়িয়ে ধরে শূন্যে তুলে ধরে বললাম,

—খালাম্মা আমাদের মাফ করেন। মাফ

মাফ আপনাকে করতেই হবে। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে হঠাৎ বলে উঠলেন,

—আরে পাগল ছেলে কি করছ। হাতে ব্যথা পাবে যে। আমাকে নামাও শিগগির।

—আমি আপনাকে নামাবো না যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি আমাদের ক্ষমা না করছেন। দৃঢ়তার সাথেই বললাম আমি। আবেগের উষ্ণতায় জমা বরফ গলে গেল নিমিষে। মাতৃস্নেহের আকুলতায় তিনি আমাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলেন। তার চোখ বেয়ে ঝরছে অশ্রুধারা। ধরা গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

—নিম্মী কোথায়?

বললাম,

—বসার ঘরে।

—আমাকে নিয়ে চলো। বললেন আমার অতিপ্রিয় খালাম্মা। তাকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে এলাম ড্রইং রুমে। আমাদের দেখে সবাই অবাক। কি করে অসম্ভবকে সম্ভব করলাম সেটাই সবার চোখে প্রশ্ন হয়ে ফুটে উঠেছিল। নিম্মী প্রায় পাগলের মত দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল। আদরের নিম্মীকে বুকে ধরে আবেগের আতিশয্যে নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না খালাম্মা। সব বাধ ভেঙ্গে গেল। মান-অভিমান-রাগ সব ভেসে গেল অশ্রুর বন্যায়। দু’জনেরই সেকি কান্না। আমরা সব নিশ্চুপ দাড়িয়ে থেকে মা ও মেয়ের অভূতপূর্ব মিলন দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলাম। সেদিনই গনী নানার বাড়ি থেকে চলে আসতে হল আমাদের। খালাম্মার সেবা-শুশ্রুষায় দ্রুত ভাল হয়ে উঠতে লাগলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *