দশম পরিচ্ছেদ
ওসিআর ভার্সন। ভুল সংশোধন করা হয়নি।
দেন-পনরোর বেশি থাকতে সাহস হ’ল না শ্যামার। মুখে সে ঘরের অজুহাতই দেখায়, ‘কি জানি মা, মুখপোড়া চক্কত্তী যদি জোর ক’রে তালা ভেঙে এসে ঢেকে সেই ভয়!’ কিন্তু আসল ভয় তার অন্যত্র সেটা উমা বুঝতে পারে। নরেন যদি ইতিমধ্যে এসে ফিরে যায়
আর যদি কোনদিন না ফেরে রাগ ক’রে চলে যায় চিরকালের মত এই ভয়ই ওর সবচেয়ে বেশি। একদিন উমা সেই কথাই স্পষ্ট তুললে, বললে, ‘অত ভাবিস নি, জামাইবাবু এসে যদি দেখেন ঘরে চাবি দেওয়া ত বুঝতেই পারবেন এখানে
চলে আসবেন সোজা।’
এসেছিস ‘হ্যাঁ
তার ভাবনায় ত আমার ঘুম হচ্ছে না। তুইও যেমন। তা নয় ঘরটার জন্যেই। আশ্রয় চলে গেলে কোথায় দাঁড়াব বল!’
উমা একটুখানি চুপ ক’রে থেকে বলল, ‘যদি তার ভাবনাই না থাকে ত অত ভাবছিস কেন, আর সেখানে উপোস করতেই বা যাবি কেন? এখানেই থাক না দুজনে থাকলে তবু সুবিধে, যা হয় ক’রে চালাব। না হয় দু বোনে পৈতে কাটব, ঠোঙা গড়ব –তাতেই দুটো ছেলেমেয়ে মানুষ হয়ে যাবে।’
‘বাপ রে!’ শিউরে ওঠে শ্যামা, ‘অমন কথা মুখে উচ্চারণ করিস নি ভাই, স্বামীকে ছেড়ে চিরকাল বাপের বাড়ি দাসীবিত্তি করা, সে আমি পারব না। বাপ থাকতে ছেলেমেয়েগুলোকে পিতৃপরিচয়ে বঞ্চিত করলে এর পর ওরা কি বলবে! তার চেয়ে সেখানে উপোস ক’রে পড়ে থাকাও ভাল। আর ক’টা দিন গেলে, ছেলেটা আট বছরের হ’লেই পৈতে দিয়ে দেব যেমন ক’রে পারি— তারপর ত আর ভাবনা নেই। ও ঘরটা ত বজায় থাকবেই চাই কি অন্য যজমানী ক’রেও খেতে পারবে। মেয়ের বিয়ে দিতে হবে– সে ভাবনাও আছে।’
উমার মুখ আজও অপমানে রাঙা হয়ে উঠল। শ্যামা কি বোঝে না তার কথা না, ইচ্ছে ক’রেই আঘাত দেয়!
খানিকটা চুপ ক’রে থেকে তবু শান্ত কণ্ঠে বলে, ‘ছেলেকে পুরুত-বামুন করবি?’
‘তা কি করব বল্! সবাই কি আর লেখাপড়া শিখতে পারে? অল্প বিদ্যা শাঁখে ফুঁ –চলতি কথাতেই ত আছে। তা ছাড়া শিষ্যি-যজমান দেখা ত ওদের কুলকর্ম।’
উমা আর কথা বলে না। এদের সামনে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতেও তার লজ্জা করে।
শ্যামা গছিয়ে পুঁটলি বাঁধে। মার কাছ থেকে জোর ক’রে সোনা যোগাড় ক’রে দু’গাছা পেটি গড়িয়ে নেয়। রাসমণি বলেন শুধু, ‘ক’দিন রাখতে পারবি মা ত বাঁধা দিতে হবে, নয়ত বিক্রি করতে হবে!
আবার
শ্যামা অম্লান বদনে বলে, সেজন্যেও দরকার। আর বাপের বাড়ি এসেও এমনি কড় নোয়া সার ক’রে যদি যাই ত লোকে বলবে কি?’
চাল ডাল তেল নুন মশলাপাতি গুছিয়ে নিতে কিছু ভুল হয় না। মায় বাসন-কোসন কাপড়-চোপড় পর্যন্ত। একদিন দিদির বাড়ি গিয়ে তার ছেলের পরিত্যক্ত ছোট-হয়ে- যাওয়া গরম জামা সব চেয়ে নিয়ে আসে। সামনে শীত আসছে। কমলা ওর লোলুপতা দেখে বিস্মিত হয় একটু লজ্জিতও হয় বুঝিবা, বলে ‘আমি না হয় নতুন জামা করিয়ে দিচ্ছি। ওগুলো
‘না, না। কি দরকার! সে তুমি বড়জোর দুটোই দেবে দুজনকে। এ আমি অনেকগুলো পাচ্ছি। এ ত তোমার কোন কাজে আসবে না। ঝিয়ের ছেলেমেয়েকে দেবে শেষ পর্যন্ত। তার চেয়ে আমাকে দুটো নগদ টাকা দিও, খেয়ে বাঁচবে ওরা।’
কমলা ভেবেছিল, কথার কথা! কিন্তু যাবার সময় সত্যিই শ্যামা চাইলে, কৈ দিদি, টাকা দুটো? ভেবে দেখো, নতুন জামা করাতে গেলে কত বেশি পড়ত তোমার!
কমলা দুটো নয় পাঁচটা টাকাই এনে ওর হাতে দিলে, তার সঙ্গে নিজের দুটো পুরোনো আর একটা নতুন শাড়ি।
কিন্তু শ্যামার এই নির্লজ্জতায় সে যেন মরমে মরে গেল।
তার সেই ফুলের মত সুন্দরী বোন! শৌখিন ভদ্র বিবেচক বোনের বদলে সে দেহে এ কে এল? এ কি মৃত্যু ঘটল শ্যামার?
সব গুছিয়ে নিয়ে গাড়ি ডাকিয়ে যাবার সময় শ্যামা মাকে উপদেশ দিয়ে গেল, ‘আপনার গুরুদেবকে ডাকিয়ে এনে উমিকে যা হোক একটা দীক্ষা দিন মা। তবু পূজো- আস্তায় মনটা ভুলে থাকবে। সত্যি, ও কী নিয়েই বা থাকে বলুন!’
রাসমণি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘তুমি নিজের চরকায় তেল দাও মা, আমাকে আর জ্ঞান দিতে এসো না।’
শ্যামাকে মুখে যাই বলুন, কথাটা নিয়ে রাসমণিও খুব নাড়াচাড়া করেন মনে মনে। এ কথা ওঁরও যে মনে হয় নি তা নয়। বংশ পরম্পরায় এই কথাই ত শুনে এসেছে সকলে হিন্দুর ঘরে বিশেষত বাঙালী হিন্দুর ঘরে
মেয়ের যদি কপাল পুড়ে থাকে তবু ইষ্টকে নিয়ে ভুলে থাকবে।
ত যা হয় ক’রে তাকে একটা মন্তর দিয়েই দাও ভগবানের দিকে মন থাকলে সংসারের প্রলোভন জয় করতে পারবে।’ এ কথা শুনতে শুনতে সংস্কারে দাঁড়িয়ে গেছে। সে সংস্কার রাসমণির রক্তেও আছে বৈ কি।
তবু রাসমণির মনে সংশয় জাগে। এ সংশয় বহুকালই জেগেছে হয়ত বা নিজের মন দিয়েই অপরের মনের হদিস পেয়েছেন খানিকটা ঈশ্বরকে চিন্তা ক’রে এ জন্মের দৈহিক ভোগ-সুখ-প্রলোভন কি সত্যিই ভোলা যায়? কোন শক্ত আঘাত পেয়ে মনে বৈরাগ্য না আসা পর্যন্ত মন কি ফেরানো যায় সংসার থেকে?
সংস্কার ও সংশয়ের, শ্রুতি ও অভিজ্ঞতার এই দ্বন্দ্বে ক্লান্ত হয়ে পড়েন রাসমণি
১১০-
কিন্তু কিছুতেই যেন কূলকিনারা পান না কোথাও– পথ তাঁর চোখে পড়ে না।
অবশেষে একদিন উমাকেই জিজ্ঞাসা করেন, ‘দুই দীক্ষা নিবি মা? নিতে চাস? শ্যামা সেদিন বলছিল, কিন্তু আমি জোর ক’রে দেব না। নেবার জন্যে পরামর্শও দেব না। তোর মন যা বলে তাই কর্।
উমা স্তব্ধ হয়ে ভাবে খানিকটা। জীবনতরী তার অকূল সমুদ্রে ভাসছে। নাবিক নেই, পথের সন্ধান নেই। তীরের চিহ্ন পর্যন্ত নজরে পড়ছে না। নিবিড় নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ঘিরেছে তাকে
এর মধ্যে পারবে কি কেউ পথ দেখাতে? ঈশ্বর তিনি কেমন? শুনেছে ত যে তিনিই পরম নাবিক, দিক্দিশাহীন জীবনযাত্রার একমাত্র পথ-প্রদর্শক। তাঁকেই অবলম্বন করবে নাকি শেষ পর্যন্ত?
হয়ত আছে ওখানেই পথের ইঙ্গিত, নূতন উষার স্বর্ণাভাস। তাঁর দিকে টেনে নেবেন বলেই হয়ত ভগবান দুঃখ দিয়ে দিয়ে তার মন ফিরিয়ে নিচ্ছেন সংসার থেকে। পুড়িয়ে পুড়িয়ে তাকে খাঁটি সোনা ক’রে নিতে চান তিনি। হয়ত সুখও আছে ঐখানে– তাঁকে চিনিয়ে দেবেন, হাত ধরে তাঁর কাছে নিয়ে যাবেন যিনি, তিনিই গুরু। অজ্ঞানতিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জনশলাকয়া চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।’ ত মাকে প্রত্যহ পাঠ করতে শোনে সে।
মন্দ কি!
উমা আরও একটু চুপ ক’রে থেকে বলে, ‘সেই ব্যবস্থাই করুন মা। আমি দীক্ষা নেব।’
‘ভাল ক’রে ভেবে দ্যাখো। তাড়াহুড়ে ক’রো না। যে-সে জিনিস নয় ইষ্টমন্ত্র!’ উমা ভেবে দেখেছে বৈ কি। তবু একটা কিছু অবলম্বন ত পাবে। সেই কথাই
জানায় মাকে সে।
কুলগুরু আছেন, তাঁর
কিন্তু রাসমণি আরও বিপদে পড়েন। সেকালে ইচ্ছামত শৌখিন গুরু বেছে নেবার প্রথা ছিল না। কুলগুরু ত্যাগ করতে নেই ‘গুরু ছেড়ে গোবিন্দে ভজে, সে পাপী নরকে মজে’ এই ছিল ওঁদের বিশ্বাস। যে মেয়ের বিয়ে হয়েছে, শ্বশুরবংশের গুরুই তার কুলগুরু। কিন্তু তার সন্ধান দেবে কে? অনেক ভেবেচিন্তে মেয়েকে বললেন, ‘তুই না হয় আমার জবানীতে
না না কাজ নেই কমলার জবানীতে জামাইকে একটা চিঠি লেখ
তোদের কে
ঠিকানাটা যদি পাওয়া যায়!’ উমা শিউরে উঠল অন্ধকার পথে সাপ দেখলে মানুষ যেমন শিউরে ওঠে, তেমনি। থরো-থরো-কাঁপা ঠোঁটে সে বললে, ‘না মা দরকার নেই। সবই যখন ত্যাগ করলুম তখন ও গুরু-ইষ্টও থাক। তবে ওঁরা শাক্ত সেটা জানি শাশুড়ীর ঘরে দশমহাবিদ্যার পট টাঙানো আছে, সেইখানে বসে নিত্য সন্ধ্যা- আহ্নিক করেন তিনি
‘না মা। তুমি চিঠি লেখো। কুলগুরু ত্যাগ করতে নেই। তাছাড়া তোমাকে স্বামীর অনুমতিও নিতে হবে।’
স্বামীকে চিঠি লিখতে হবে! এই প্রথম উমার মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ছেলেখেলা?
এতকাল পরে তাও পরের জবানীতে!
কেন তাকে নিয়েই বা বার বার এই
কুলগুরু? কিসের কুল তার
কে-ই বা তার স্বামী! যে স্বামী একবার মাত্রও
স্পর্শ করলেন না তাকে, পায়ে স্থান দিয়েও স্ত্রী ব’লে স্বীকার করলেন না!
আবার মনে হয়, স্বীকার করেছেন বৈ কি।
সেদিনের কথাটা মনে পড়ে যায়,
কাজ কোরো না, ছি!’
না না উমা, এ আমি ভাবতেই পারি না। এ
স্বীকার করেছেন বৈ কি। কিন্তু এভাবে চিঠে লেখা?
তবু লেখে সে। লিখতে বাধ্য হয়। তিন-চারখানা চিঠি ছিঁড়ে দিদির জবানীতে একটা চিঠি লেখে . শুষ্ক, প্রয়োজনীয় চিঠি।
এই প্রথম চিঠি। প্রথম স্বামী-সম্ভাষণ
চিঠি লেখার স্বপ্ন দেখে মেয়েরা। হায় রে!
উত্তর আসে তিন-চার দিনের মধ্যেই। অস্পষ্ট হস্তাক্ষর
―
কৈশোরে পা দেওয়ার পর থেকেই যে
আঁকাবাঁকা লাইন
তবু চিঠি। এই প্রথম চিঠি স্বামীর কাছ থেকেও।
প্রিয়–প্রিয়তম দয়িতের চিঠি
কল্পনা করতে চেষ্টা করে উমা, খোলবার আগে।
চিঠিটা তাকেই লেখা
‘কল্যাণীয়াসু –তোমার পত্র পাইয়া নিজেকে আরও অপরাধী মনে হইতেছে। ঈশ্বর আমাকে কোনোদিনই ক্ষমা করিবেন না
অথচ যে জালে জড়াইয়াছি
ছাড়া পাইবারও উপায় নাই। যাক্ যখন আমাদের কোন সংস্রব রাখ নাই
গুরুর ব্যাপারেও আর যোগ রাখিও না। তোমার মার গুরুদেবের কাছেই মন্ত্র লইও। আমি অনুমতি দিতেছি, তাহাতে দোষ হইবে না আমার হইবে। ইতি তোমার হতভাগ্য স্বামী শরৎ।
যদি কোন পাপ হয়
সেও
পুঃ কোন অধিকার নাই, তবু সেদিনের কথাটা ভুলিতে না পারিয়া তিন- চারদিন থিয়েটারে গিয়াছিলাম, কিন্তু তোমাকে দেখিতে না পাইয়া বুঝিয়াছি আমারই ভুল, ক্ষমা করিও।’
বার বার পড়ে উমা। বার বার বুকের কাছে রেখে দেয়। চোখের জলে আর বুকের ঘামে অক্ষর অস্পষ্টতর হয়ে ওঠে মেটে না।
তবু যেন আশা
আশাও জাগে কোথায়, হয়ত তার স্বামী তার কাছে একদিন ফিরে আসবেন, নইলে এত খবর রাখতেন না। চিঠিতে অনুতাপের সুরও স্পষ্ট। সারারাত চিঠিটা গালের নিচে রেখে জেগে কাটিয়ে দেয় উমা।
দুই
আর এক নতুন সমস্যা দেখা দিল। গুরু কাকে করবেন এই নিয়ে মহা চিন্তায় পড়লেন রাসমণি। সব শুনে কিছুক্ষণ চুপ ক’রে থেকে বললেন ‘যখন কুলগুরুই ত্যাগ করতে হবে তখন আর আমার গুরুবংশ ধরে কাজ নেই। গুরুদেব দেহ রেখেছেন, গুরুভাই যে আছে শুনেছি লোক ভাল নয়, মদ গাঁজা খায়
১১২
হয়ত অভক্তি
হবে তার ওপর। তার চেয়ে বড় জমাইয়ের সন্ন্যাসী গুরু আছেন এক, তাঁর কাছেই নয়ত দীক্ষা নে। কী বলিস?’
উমা আর কি বলবে, সে চুপ ক’রেই রইল।
–
তবে দিদির গুরুকে দেখে তার শ্রদ্ধাই হ’ল। দীর্ঘদেহ, গৌরবর্ণ প্রৌঢ় সন্ন্যাসী। গেরুয়া পরেন কিন্তু জটা নেই। পিঠ পর্যন্ত এলানো দীর্ঘ কেশ। কপালে তান্ত্রিকদের মত রক্তচন্দনের ফোঁটা। অত্যন্ত মিষ্টভাষী–সস্নেহ ব্যবহার সকলের সঙ্গেই। গানের গলাটি ভাল– যখন-তখন রামপ্রসাদী গান ধরেন, উমা সে গান শুনে
চোখে জল রাখতে পারে না।
যত্ন করে দীক্ষা দিলেন, প্রতিদিন এসে অভ্যাস করান, উপদেশ দেন, শিক্ষা দেন। উমা প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে এই নতুন জীবনকে। দিনে দিনে অন্তত একটা বেরাগ্য ঘিরে ধরে ওকে, জগৎ থেকে সে যে প্রত্যহই দূরে সরে যাচ্ছে এটা সে অনুভব করে নিজে নিজেই।
গুরু প্রথম নিত্য আসতেন, তারপর নিয়মিত দুদিন অন্তর আসতে লাগলেন। উমা তাঁকে ভক্তি করে দেবতার মত, সেবা করে সন্তান বা পিতার মত। রাসমণি তার এই ভাব দেখে মনে মনে শান্তি পান।
হঠাৎ একদিন গুরুদেব বললেন, ‘উমা, তোমাকে মা নিজে পাঠিয়েছেন আমার কাছে। তোমার জীবন সার্থক। মহাভাগ্য তোমার, তাই লোকে যেটাকে সৌভাগ্য বলে তা থেকে বঞ্চিত হয়েছ।’
হেঁয়ালি বুঝতে না পেরে উমা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
গুরুদেব হাসেন, ‘পাগলী, এটা আর বুঝলি না! আমার সিদ্ধির জন্যে এমনি একটি মেয়েই দরকার ছিল যখন খুঁজে খুঁজে প্রায় আশা ছেড়ে দিয়েছি তখন মা তোকে মিলিয়ে দিলেন অভাবনীয় ভাবে। এ তাঁর দয়া ছাড়া আর কি? তোর ওপরও দয়া কম ভাবিস নি। সাধনার কাজে লাগবি এ কি এক জন্মের সুকৃতী ভেবেছিস! জন্ম-জন্মান্তরের পূণ্য। স্বামী যদি তোকে গ্রহণ করতেন, তাহ’লে সম্ভব হত না।’
সর্বাঙ্গে রোমাঞ্চ হয় উমার। সত্যিই কি মার এত দয়া তার ওপর? সত্যিই কি এ তার জন্মান্তরের সুকৃতী? তার জীবন অধিকতর সার্থক করবেন বলেই কি তাকে আপাত-সার্থকতা থেকে বঞ্চিত ক’রে রেখেছেন?
সে যেন বিশ্বাস করতে পারে না কথাটা, তবু খুশির ঢেউ বয়ে যায় তার মনের ওপর দিয়ে। সাধনার সহায় হবে সে? তপস্যার সঙ্গিনী হবে গুরুদেবের? তপস্বিনী, সন্ন্যাসিনী হবে সে?
সাগ্রহে প্রশ্ন করে গুরুদেবকে, ‘সে সাধনা কবে শুরু করবেন বাবা? কী করতে হবে তাতে আমাকে?’
‘বলব রে, বলব! ওর ডান হাতখানা নিজের হাতে নিয়ে সস্নেহে চাপ দেন তিনি। প্রায়ই প্রশ্ন করে
চষ্টা করে অনেক রকম কিন্তু কোনটাই
যেন মেলে না।
আনার পর ক
১১৩
গুরুদেব ঠিক স্পষ্ট জবাব দেন না। নীরবে সস্নেহে পিঠে হাত বুলোন। নয়ত ওর বিপুল কেশভার-সুদ্ধ মাথাটা নিজের কোলে টেনে নিয়ে মাথায় হাত দিয়ে আদর
করেন।
ইদানীং ওর কথাবার্তাও যেন কি রকম অদ্ভুত হয়ে উঠেছে। উনি অবশ্য বলেন, ‘গুরুর কাছে শিষ্যের কোন অবস্থাতেই কোন সঙ্কোচ নেই’ কিন্তু উমা লজ্জাই পায়। উনি পুরাণ থেকে গল্প বলেন, সব আদিরসাত্মক। জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে নানা উদাহরণ দেন উপদেশের মধ্যে, তাও যেন কেমন কেমন!
উমার ভাল লাগে না এসব। অথচ গুরুদেবের সামনে থেকে যেতেও পারে না। সে কেবল বলে, ‘ওসব কথা থাক বাবা আপনি আমাকে করে তপস্যার কাজে টেনে নেবেন তাই বলুন, কী করতে হবে আমাকে বুঝিয়ে দিন। সন্ন্যাসিনী হ’তেই চাই।’
অবশেষে একদিন শোনে সে কী করতে হবে তাকে।
ছুটে এসে মার কাছে মাথা খোঁড়ে –ঢিক্ চিক্ করে।
‘কী হ’ল রে, কী হ’ল?’
‘মা, কেন গুরুদেবের ওপর ভক্তি রাখতে পারছি না, কেন এমন সব সন্দেহ জাগছে মনে? কী হবে আমার?
‘কী হ’ল বল্ ত’, জোর ক’রে ওর মুখখানা তুলে ধরেন রাসমণি।
‘উনি ত বলছেন এ বড় পুণ্যের কাজ, ওঁর সাধনার সহায় হওয়া — কিন্তু আমি তা–না মা–সে আমি পারব না। আমি যে ওঁকে সাক্ষাৎ ইষ্ট বলেই জানি মা।’
পাথর হয়ে যান রাসমণি।
‘তুই বোস। আমি আসছি।’ তিনি উঠে এসে গুরুদেবের সামনে হাতজোড় ক’রে বললেন, ‘ভগবান যাকে মারেন তার আশ্রয় কোথাও নেই, এইটেই আজ বুঝলুম। আপনি ওকে অব্যাহতি দিন। আর আপনি আসবেন না।’
গুরুদেব মুখ কালি ক’রে চলে গেলেন।
উমা রাসমণির সামনে মাথা খুঁড়তে খুঁড়তে বললে, ‘এ সংশয় কেন এল মা? সত্যিই কি আমার কোথাও আশ্রয় নেই? তবে আমি কি করব?’