১০. দূর থেকে সুন্দর দেখায়

॥ ১০ ॥

দূর থেকে যেমন শ্যামল সুন্দর দেখায়, চরটা আদতে তেমন নয়। যেটুকু সবুজের সমারোহ তা শুধু নদীর পাড় ধরেই। চরের মধ্যিখানে গাছপালা আছে, তবে তো মোটেই ঘন নয়। ছাড়া ছাড়া। ছ্যাকরা ছ্যাকরা। গাছ বলতে তাল আর নারকেলই বেশি, কিছু বাবলা শিমূল জারুল অপরিকল্পিতভাবে রোপণ করা হয়েছিল কখনও, তারাও বেড়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বাঁশঝাড়ও চোখে পড়ে দু’-চারটে। খেত প্রায় সবটাই ধানজমি, এখন সেখানে এবড়ো খেবড়ো মাঠ। অল্প স্বল্প জায়গা নিয়ে ঝিঙে ঢ্যাঁড়শ বোনা হয়েছে কোথাও কোথাও। তৈরি ফসল তুলে তুলে বস্তাবন্দি করছে চাষিরা, হয়তো আজই সন্ধেয় পৌঁছে যাবে টিয়াডাঙায়। হরেনবাবুর আড়তে।

এমন কিছু নয়নাভিরাম দৃশ্য নয়। তার বহতা জীবনটার মতোই জোলো, অনাকর্ষণীয়। অহনা হতাশ বোধ করছিল। আগে যখন এসেছিল, সেবারও চোখ টানেনি, ভেবেছিল এবার হয়তো…। তা তার কপালই তো এরকম, কোনও কিছুই কি ভালর দিকে এগোয়? বহুকাল পর একটু বা অন্য রকম বিকেল আজ আশা করেছিল, সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বেড়ানোর রংটাও যেন ফিকে হয়ে আসছে দ্রুত।

ঘুরে ঘুরে যে চরখানা দেখবে তার হ্যাঙ্গামা কম? রাস্তা বলতে তো প্রায় কিছুই নেই, মাঝে মাঝেই আলপথ ধরতে হয়…। আধা ঘণ্টা হেঁটেই অহনার দম নিঃশেষ। রোদ নেই, তবু ঘামছে দরদর।

অর্ঘ্যরও যেন ভ্রমণে মন নেই। এলোমেলো ঘুরছে এদিক ওদিক, চাষিদের সঙ্গে খানিক গল্প জুড়ল, সবজিখেতে নেমে স্বহস্তে পরীক্ষা করছে ফসল, নিরীক্ষণ করতে গেল লাঙলটানা বলদের গোয়াল, কিন্তু সবেতেই যেন একটা নিয়মরক্ষের ভাব।

অহনা বসে পড়েছিল, ঘাসে, তালগাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে। অর্ঘ্যর বুঝি হঠাৎ খেয়াল হয়েছে, অহনা পাশে নেই। খুঁজতে খুঁজতে অর্ঘ্য এল সেখানে। একটু যেন অবাক। বলল, “হল কী? আর যাবে না?”

অহনা শ্রান্ত গলায় বলল, “কোথায় আর ঘুরব? গোটা চরটাই তো এক রকম। ভেবেছিলাম, হয়তো কিছু বদলেছে…”

“কিছুই কি সেভাবে বদলায় দুনিয়ায়? বদলাই শুধু আমরা। আমাদের চারপাশটা কিন্তু একই থেকে যায়।”

অহনা কথাটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারল না। চারপাশ বলতে অর্ঘ্য কী বোঝাচ্ছে? চতুর্দিকের বাড়িঘর গাছপালা…? নাকি মানুষজন সমাজ নিয়ে গড়ে ওঠে আস্ত দুনিয়াটা। না, অর্ঘ্য মাঝে মাঝেই এমন কথা বলে, অহনা ঠিক ধরতে পারে না। সেদিন সুশোভন স্যারের মর্মান্তিক কাহিনি শুনে উদাস মুখে বলল, “দুঃখেই যার আনন্দ, তার দুঃখ কে খণ্ডায়!” দুঃখে কেউ আনন্দ পায় নাকি? কালই তো বলছিল, সুগত নাকি যতটা শয়তান, তার চেয়েও বেশি দুর্ভাগা! কেন এমন মনে হল অর্ঘ্যর কে জানে। তবে ও যে দুনিয়াটাকে একটু অন্য দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করে, এতে অহনার সংশয় নেই।

অর্ঘ্যর কথার অর্থ না খুঁজে অহনা জিজ্ঞেস করল, “তোর ভাল লাগছে এই চরটা?”

“ভালমন্দ মিশিয়েই তো মানুষের ভাল লাগা। ভাল না লাগাটা এক ধরনের অসুখ। আমাকে এখনও ওই রোগে ধরেনি।”

“ও। তার মানে তুই মোটামুটি এনজয় করছিস?”

“জানি না। উপভোগ করছি, কি করছি না তাই নিয়ে সেভাবে ভাবিনি তো।” অর্ঘ্য যেন সামান্য অন্যমনস্ক। তালগাছের মাথাটা দেখতে দেখতে বলল, “আর উপভোগ না করলে যে খারাপ লাগতেই হবে, তারও তো কোনও মানে নেই। অনেকে তো খারাপ লাগাটাকেই উপভোগ করে।”

“কী যে ছাইপাঁশ বকিস!”

“আমাকে বকালে তো এই সবই শুনবে। …এখন ওঠো ওঠো, চলো…”

“কোথায়?”

“চর হলেও এটা তো আদতে একটা দ্বীপ। ওপ্রান্তে যাবে না একবার?”

“সে কদ্দূর?”

“চাষিরা তো বলছিল কাছেই। পাঁচ-সাত মিনিটের হাঁটাপথ।”

“কী আছে সেখানে?”

“তুমি না বলছিলে চরে কী আছে গিয়েই দেখবি? এখন উলটো গাইছ?”

মোক্ষম কথার প্যাঁচ। অগত্যা অহনাকে উঠতেই হয়। অর্ঘ্যর সঙ্গে সঙ্গে চলেছে খাড়াপশ্চিমে। তিন চারজন চাষি ফিরছে জমি থেকে, মাথায় বস্তা চাপিয়ে। তাদের একজন অহনাদের দেখে দাঁড়িয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, “কোথা যাচ্ছেন গো আপনারা?”

অর্ঘ্য উত্তর দিল, “এই তো, চরের ওপাশটায়।”

“বেশি দেরি করবেন না। বড় ঝড় উঠবে মনে হচ্ছে।”

উত্তর-পশ্চিম কোণে চোখ পড়তেই অহনা ঈষৎ সন্ত্রস্ত, “ব্যাক করে গেলে হয় না?”

“অ্যাদ্দুর এলাম…আর তো এইটুকু…”

চাষিটা বলে উঠল, “তাড়াতাড়ি ঘুরে আসেন। আলাইপুরের ঘাটে যাবেন তো? তা হলে আমাদের নৌকোতেই…”

“চিন্তা নেই গো। আমাদের ফেরার নৌকো আছে।”

লোকটা আর দাঁড়াল না। পা চালিয়েছে। দুলে দুলে চলেছে পূবে। অহনারাও গতি বাড়াল। ছোট্ট একটা কলাবন পেরিয়ে পৌঁছেছে চরের কিনারে।

ওপার মোটেই তেমন দূর নয়। বরং আলাইপুরের থেকে যেন কাছেই। নদীও এদিকে যেন অনেকটা মরা মরা। ওপারের বাড়িঘর গাছপালা দেখা যায় স্পষ্ট। একটা মন্দিরও দৃশ্যমান, আলাইপুরের মতো।

অহনা নিরাশ গলায় বলল, “মিছিমিছি এলাম। এদিকেও তো ওপারটা একই রকম।”

“উঁহু। ভাল করে দেখো।” অর্ঘ্য আঙুল তুলল, “লক্ষ করো, ওই একটা জমিদারবাড়ি। এখন প্রায় ভগ্নস্তূপ। তা ছাড়া ঘরবাড়িও মোটেই আলাইপুরের মতো নয়। বোঝা যায়, বেশ পুরনো বর্ধিষ্ণু অঞ্চল। ওদিকটায় তো হুগলি জেলা, তাই না?”

“তাই তো শুনেছি। তবে চরের পুবপাড় আর পশ্চিমপাড়ে আমি তো কোনও তফাত দেখছি না।”

“তফাত আছে কি নেই, সেটা কোনও বড় ব্যাপার নয় অণুদি। আসল ব্যাপার হল, যে দেখছে তার মনটা।”

“মানে?”

“প্লেন অ্যান্ড সিম্পল। জীবনে একটা সময় সামান্য পার্থক্যও খুব প্রকট লাগে। আবার এমনও সময় আসে, যখন ডিফারেন্সগুলো খোঁজার দৃষ্টিটাই চলে যায়। তখন ভাল মন্দ সুন্দর কুত্সিত সব কিছুই মনে হয় এক রকম। জীবনের রংগুলোও তখন আলাদা করা যায় না। এভরিথিং বিকামস গ্রে। ধূসর।”

অর্ঘ্যর কথাটা মোটেই দুর্বোধ্য ঠেকল না তো? তার দিকেই আঙুল তুলছে যেন। সুগতয় মোড়া অতীতের দিকে ইঙ্গিত করে বোঝাতে চায়, এখন অহনার নজরটাই ভোঁতা হয়ে গেছে! কতটুকু জানে, কী কষ্টটাই যে সয়েছে অহনা? যতটা না শরীরে, তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি মনে। মেয়েরা কত আশা নিয়ে ঘর বাঁধে, অর্ঘ্যর কোনও আন্দাজ আছে? স্বপ্নভঙ্গের অভিঘাত অন্তরাত্মাকে যে কীভাবে চুরচুর করে দেয়, অর্ঘ্য তা অনুভবই করতে পারবে না। তাও তো অহনা আজ নিজেকে প্রাণপণে উজ্জীবিত করতে চেয়েছে। কাল সুগত এসে দিনটাকে বিষিয়ে দিয়ে গেছিল, তার পরেও। এখন যে আর সেই বানানো খুশি খুশি মেজাজটা বজায় রাখতে পারছে না, তার জন্য জ্ঞান দেওয়ার ছলে কটাক্ষ হানা কি সাজে অর্ঘ্যর?

অহনা সামান্য ব্যথিত স্বরে বলল “কী করি বল, আমি মানুষটাই যে এরকম। রসকষহীন, চোখে ন্যাবা, একটা জঘন্য বিরক্তিকর প্রাণী, যার কাছাকাছি থাকলেও অন্যদের জীবন বিষময় হয়ে ওঠে।”

অর্ঘ্য চোখ পিটপিট করল, “যাহ বাবা, আমার কথার তুমি এই অর্থ করলে? আসলে আমি বলতে চাইছিলাম…”

বাক্যটা শেষ হওয়ার আগেই আচমকা এক দমকা হাওয়া। এমনই এক ঝাপটা দিল, অহনার আঁচল ঠিকরে গেল গা থেকে। বেপথু অহনা কোনওমতে সামলাতে চাইল আবরু। আকাশ চিরে বিদ্যুৎ নেমে এল ধরায়, আরেকটা উলটোমুখো খ্যাপা বাতাস ছিটকে দিল অহনাকে।

পড়েই যাচ্ছিল অহনা, অর্ঘ্য তাকে ধরে ফেলেছে। বলল, “আর এক মুহূর্ত দেরি নয়, দৌড়োও।”

বলার প্রয়োজন ছিল না, ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের তাড়নায় ছুটতে শুরু করেছে অহনা। এক লহমায় ঝুপ করে কমে গেছে দিনের আলো, মেঘের আবরণে নেমে এল আঁধার। দিক ঠিক করতে পারছে না অহনা, দিশাহীন পা এঁকেবেঁকে অর্ঘ্যকে অনুসরণের চেষ্টা চালাচ্ছিল। অর্ঘ্য দাঁড়িয়ে পড়ল, চেপে ধরল অহনার করতালু। আবার ছুটছে দু’জনে। গাছেরা সব ঝাঁকুনি খেয়ে উন্মাদের মতো দোলাচ্ছে মাথা, মড়মড় আওয়াজ তুলে ভেঙে পড়ছে ডাল, ছিন্ন শাখা উড়ছে হাওয়ায়, ভয়ংকর বেগে আছড়ে পড়ল মাটিতে। হাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দের সঙ্গে মিলে বিকট রব উঠছে মুহুর্মুহু।

অহনা কাতরভাবে চেঁচিয়ে উঠল, “আমরা বোধহয় আর ফিরতে পারব না।”

অর্ঘ্য ধমক দিল, “আহ, কোনও কথা নয়। আমি তো আছি।”

“এই ঝড়ের মধ্যে আমাদের ঘাট অবধি পৌঁছোতে পারব?”

“না পারার কী আছে? এখনও দিব্যি চারদিক দেখা যাচ্ছে।”

অর্ঘ্য বলল বটে, কিন্তু কিছুই প্রায় দেখতে পাচ্ছে না অহনা। শুধু যে আলোই কমে এসেছে তা নয়, বালি ভরতি শুকনো ধুলোর মত্ত দাপাদাপিতে চোখ খুলে তাকানোই দুঃসাধ্য।

অহনা বলে উঠল, “আমরা কিন্তু তোর সেই মাঝির জন্য ওয়েট করব না। সবজির নৌকাতেই চড়ে পালাব।”

“সে হবেখন। আগে নদীর ঘাট অবধি তো পৌঁছোই।”

মাত্র দশ-বারো মিনিটের দূরত্ব, ঝড়ের তাণ্ডবের সঙ্গে লড়ে ওটুকু পথ পেরোতেই যেন অনন্ত কাল কেটে যাচ্ছে। অবশেষে দেখা দিল নদী। কিন্তু ঘাট তো শুনসান। ক্ষীণ আলোতেও বেশ বোঝা যায় চাষি-ব্যাপারীদের তরী বিদায় নিয়েছে চর থেকে।

অহনা প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, “কী হবে এখন?”

অর্ঘ্য বলল, “ঘাবড়াচ্ছ কেন? ঝড়টা কমতে দাও। দুলাল এসে যাবে।”

“যদি না আসে?”

“আরে, আমরা কি জলে পড়ে আছি নাকি? তুফানে ভেসে যাব এমন সম্ভাবনা নেই। এক বেলা খাওয়া না জুটলে খিদেতে মরেও যাব না। তা হলে আর ভয়টা কীসের?”

“তা বলে সারাটা রাত এই জনমানবহীন একটা দ্বীপে…।”

“আগেই অতটা ভেবে নিচ্ছ কেন? একটু ধৈর্য ধরো…”

আঁধার নামছে ভেবেই অহনার বুক ঢিপঢিপ করছিল। সত্যি সত্যি অন্ধকার হয়ে গেলে যে কী হবে অহনার? দুলাল না কী একটা যেন নাম বলল অর্ঘ্য, সে কি ঝুলিয়ে দেবে? অহনাদের রেখে গেল, ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নেই তার?

কানে তালা লাগিয়ে বাজ পড়ল একটা। পরক্ষণে আবার একটা। হাওয়ার বেগ কমেছে সামান্য, কিন্তু মেঘের গুড়গুড় ধ্বনি যেন চড়ছে ক্রমশ। পড়পড় শব্দে বড় বড় কয়েকটা ফোঁটা পড়ল গায়ে। চমকে উঠেছে অহনা। উত্তাল ঝড়ের মধ্যে এই সম্ভাবনাটা যেন মাথায় ছিল না এতক্ষণ, জলবিন্দুর স্পর্শমাত্র মগজের স্নায়ু টানটান। কিছু ভাবার আগেই দাপট বেড়ে গেল বৃষ্টির। নূপুরের ছন্দে নয়, বুনো মোষের মেজাজে নেমেছে মুষলধারায়। তেমন ঘন ডালপালাওলা গাছও নেই যে তার নীচে আশ্রয় নেবে। দ্যাখ না দ্যাখ, ভিজে জাব হয়ে গেল অহনা।

অর্ঘ্যই বলে উঠল, “এ তো মহা বিপদ হল। এরকম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বোকার মতো ভিজব নাকি?”

অহনা করুণ স্বরে বলল, “কী হেল্পলেস সিচুয়েশন। আমাদের কিচ্ছু করার নেই?”

“তাই তো দেখছি। বাড়িটাড়িও তো নেই যে গিয়ে উৎপাত করব।”

“তখন গোয়ালটায় ঢুকেছিলি না? ওর মাথায় ছাউনি নেই?”

“ঠিক বলেছ তো।… হ্যাঁ, আছে বোধহয়… কিন্তু এই বৃষ্টির মধ্যে… অন্ধকারে…”

“মোবাইলটাকে টর্চ হিসেবে ইউজ় করলে…”

“কারেক্ট।…তবে দেখতে হবে যেন জল না লাগে।”

“ভাল করে মুঠোয় চেপে রাখ। আমি আমার মোবাইলটাও জ্বালাচ্ছি।”

একই দাপটে ঝরছে বারিধারা। দু’কুচি ক্ষীণ আলোয় পথ দেখে সন্তর্পণে এগোচ্ছে দু’জনে। বারবার অহনাকে সতর্ক করছে অর্ঘ্য, যেন সে আছাড় খেয়ে বাড়তি বিপদ না বাধায়।

গোয়ালে পৌঁছে একটু যেন স্বস্তি বোধ করল অহনা। তিনটে বলদ রয়েছে গোয়ালে, আঁধারে চকচক করছে ছ’-ছ’খানা চোখ, উত্কট একটা গন্ধ বেরোচ্ছে ঘরটায়, তবু যেন অসহায় বিপন্নতার শঙ্কা কমল খানিকটা। বাইরে থেকে আসা অবিরল বৃষ্টির ধ্বনি যেন এই মুহূর্তে বিপদের সংজ্ঞাটাই পালটে দিয়েছে। আশ্রয়হীনতা থেকে যা হোক কিছু একটা জোটার তফাতটা বুঝি টের পাচ্ছে মর্মে মর্মে।

বাবার রেখে যাওয়া বাড়িটার কথা কি অহনার মনে পড়ল একবার? এই মুহূর্তে? হয়তো না। বর্তমানের বিপন্নতা বুঝি মানুষকে, ক্ষণিকের জন্য হলেও, স্মৃতিহীন করে দেয়।

অহনাও তাই এখন কিছুই ভাবছে না, শুধু চরম অস্বচ্ছন্দ এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়ার চিন্তায় ব্যাকুল। একটা বলদ হঠাৎ গলা ছেড়ে ডেকে উঠল, ওই নিরীহ ধ্বনিতেও বুঝি বেড়ে গেল ধুকপুকুনি।

আতঙ্ক গোপন করে অহনা বলল, “এভাবেই থাকব নাকি সারা রাত?”

“বললাম তো, ঝড়বৃষ্টিটা কমতে দাও। দুলাল আসবে।”

অহনা একটুও ভরসা পেল না। বড্ড অন্ধকার, দুঃসহ অন্ধকার। অনেক বছর আগে, যখন তারা আসানসোলে থাকত, একবার শাকতোরিয়া কয়লা খনিতে নিয়ে গেছিল বাবা, নীচে খনির গহ্বরে নামার বন্দোবস্তও করে দিয়েছিল তখন। কপালে আলো বাঁধা যে অফিসারটি তাকে আর দাদাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খনির অন্দরটা দেখাচ্ছিল, খেলাচ্ছলে মিনিট কয়েকের জন্য নিবিয়ে দিয়েছিল আলো। চারপাশে ঘন কালো দেওয়াল সহ গোটা পৃথিবীটাই অমনি পলকে উধাও। নিজের হাতটা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিল না তখন। আজও এই গোয়ালঘরের অন্ধকার যেন তারই কাছাকাছি। অর্ঘ্য প্রায় তাকে ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে, তার নিশ্বাসটা পর্যন্ত অহনা টের পাচ্ছে, অথচ সেই মানুষটা তার অগোচর, এ যে কী গা শিরশিরে অনুভূতি!

সময় কাটছিল নিজের মনে। অথবা কাটছিল না। বৃষ্টি কিন্তু ক্লান্তিহীন, একই লয়ে আক্রমণ করে চলেছে ধরিত্রীকে।

হঠাৎ খানিক দূর থেকে অর্ঘ্যর গলা, “এদিকটায় এসো।”

অর্ঘ্যর স্বরে চাপা চঞ্চলতা। না নড়েই অহনা বলল, “কেন?”

”গোয়ালের পেছন দিকে একটু যেন ঢাকা স্পেস মতন আছে। মনে হচ্ছে, ওখানে বৃষ্টি লাগবে না।”

“ওমা তাই?”

এক পা এক পা করে বেরিয়ে এল অহনা। মোবাইলের সরু তীক্ষ্ন আলোয় আবছা আবছা দেখতে পেল জায়গাটা। সত্যিই তো খড়ের চালা রয়েছে এদিকটায়। ঘর নয়, তিন দিকে দেওয়ালও নেই, কিন্তু মাথায় খড়ের ছাউনি। কী কাণ্ড, গোটা পাঁচেক দড়ির খাটিয়াও অবিন্যস্তভাবে পড়ে!

কোনও কিছু না ভেবেই একটা খাটিয়ায় বসে পড়ল অহনা। আহ, ক্লান্ত পা দু’খানা যে কতক্ষণ পর বিশ্রাম পেল!

অর্ঘ্য বলল, “কী ব্যাপার বলো তো? খাটিয়া আছে, মানুষ নেই…”

“বোধহয় গোরুর মালিকের অস্থায়ী শেলটার। হয়তো কখনও সখনও রাতে থেকে যেতে হয়…।”

“হতে পারে। চাষবাসের সময় হয়তো দুপুরেও এখানে জিরোয়। ফসল পাহারার জন্যে মাঝেসাঝে নাইট স্টে-ও করতে হয় নিশ্চয়ই। ওইসব ভেবেই হয়তো একটা অস্থায়ী ঠেক বানিয়ে রেখেছে। আজ আমাদের কাজে লেগে গেল।”

“ওরা এক-আধজন আজ রয়ে যেতে পারত।” বাইরে বৃষ্টির ঝাঁঝ বাড়ল হঠাৎ। পাল্লা দিয়ে অহনার গলাও চড়ে গেল সহসা, “বদমাইশের দল। আমাদের ফেলে রেখে নৌকো নিয়ে ভেগে পড়ল? আরেকটু অপেক্ষা করতে পারত না?”

“খামোখা ওদের দুষছ কেন? ভুল তো আমাদের। আরও ঠিকঠাক ভাবে বললে আমার। ওরা তো আমাদের অফার দিয়েছিল। আমিই তো…”

“চুপ কর। বেড়াতে এসে আমাদের ত্রুটি-ভ্রান্তি ঘটতেই পারে। তা বলে ওরা এমন বেয়াক্কেলেপনা করবে?” অহনার গলা আর এক পরদা উঠল, “সব্বাই নেমকহারাম। ওদের ঘরের মেয়ে-বউদের জন্য উদয়াস্ত খেটে মরি, সেইটুকু কৃতজ্ঞতা বোধ যদি ওদের থাকত…”

“কী আজেবাজে বকছ? এরা হয়তো তোমাকে চেনেই না…”

“বললেই হল? আমাকে চেনে না এমন কেউ আছে এ তল্লাটে?” বলেই যেন হোঁচট খেল অহনা। এমন একটা ধারণা তার মনে বাসা বেঁধেছে, জানা ছিল না বলেই বুঝি নিজেই চমকেছে। মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে যেতে রাগ গিয়ে পড়ল সুগতর ওপর। এবং মনে হতেই শরীরে বিশ্রী জ্বালাপোড়া।

মুহূর্ত চুপ থেকে অহনা বলল, “আমি জানতাম একটা খারাপ কিছু ঘটবে আজ। ওই শয়তানটা এল, আমার কাছে ঝাড় খেল, একটা কিছু বিপদ হবে না? উফ, লোকটাকে যদি একটা চরম শিক্ষা দিতে পারতাম…”

কোনও সাড়াশব্দ নেই। অর্ঘ্য কি কথাগুলো নীরবে শুনে যাবে? বিনা মন্তব্যে? আর আঁধারের আবডালে হাসবে মুখ টিপে?

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল অহনার। চালার নীচের স্যাঁতসেতে বাতাসে মিশে গেল নিঃশ্বাসটা। অহনা মৃদু স্বরে ডাকল, “অর্ঘ্য?”

“উঁ?”

“আমি প্রলাপ বকছি…খুব মজা লাগছে, না?”

“নাহ। কষ্ট হচ্ছে। তুমিও বড় কষ্ট পাচ্ছ অণুদি।”

“হয়তো এটাই আমার প্রাপ্য। জীবন তো আমাকে আর কিছুই দিল না। বোকার মতো বেঁচে আছি, কেন বাঁচছি তাও জানি না… আমার মতো একটা হেরো পার্টি…”

“মোটেই না। তুমি একজন হানড্রেড পারসেন্ট উইনার। তোমার মতো একজন সেলফমেড ওম্যান… একা হাতে আশাবরীর মতো একটা প্রতিষ্ঠান গড়েছ… আমার তো তোমাকে দেখে হিংসে হয়।”

“সান্ত্বনা দিচ্ছিস?”

“না গো। মনের কথা বলছি। অন্ধকারের দিব্যি। আজকের এই ঝড়বৃষ্টির দিব্যি।”

“তা হলে আমার কিছু ভাল লাগে না কেন?” অহনার গলা কেঁপে গেল, “কেন মনে হয় সব কিছুর পাট চুকিয়ে কোথাও একটা চলে যাই? যেখানে কেউ আমায় চিনবে না, জানবে না, চেনাজানা কেউ আমার খোঁজ পর্যন্ত পাবে না…”

“সেখানে গিয়ে তুমি শান্তি পাবে? শিয়োর?”

অহনা জবাব দিল না। জবাব কি আছে? তাও সে জানে না।

বৃষ্টি কমেছে সামান্য। অর্ঘ্য হাত বাড়িয়ে পরখ করল বাদলধারা। চোখ সয়ে আসার পর অন্ধকার এখন আর তত গাঢ় নয়, দেখা যায় পরস্পরের অবয়ব। অহনার দিকে ফিরে অর্ঘ্য বলল, “তোমার সমস্যাটা কী জানো? কাজ করার তোমার ক্ষমতা আছে, ব্রেন আছে… দক্ষতা তো আছেই। শুধু হৃদয়টাই তোমার নেই।”

“হোয়াট?”

“হ্যাঁ। কাজটা তুমি করছ জেদের বশে। বিশেষ একজনকে দেখানোর জন্যে। প্রমাণ করতে চাও, সে তোমাকে ঠেলে জলে ফেলে দিতে পারেনি। এবং তুমি তার… শুধু তারই বা বলি কেন, দুনিয়ায় তুমি কারও কৃপাপ্রার্থী হওনি। যা করেছ, নিজের কবজির জোরে করেছ। সত্যি বলতে কী, নিজের অ্যাচিভমেন্টের ব্যাপারে তোমার খানিক অহংকারও আছে।”

অহনা একটু সংকুচিত বোধ করল, “না রে, তুই যা ভাবছিস তা নয়।”

“লজ্জা পেয়ো না। যেভাবে তুমি পরিশ্রম করো, গর্ব করা তোমার সাজে বই কী। কিন্তু এও সত্যি, কাজটাকে তুমি মোটেও ভালবাসতে পারনি। যাদের নিয়ে তোমার আশাবরী, তাদের সম্পর্কে তোমার কোনও আগ্রহ নেই। তারা তোমাকে আপনজনই ভাবে, অথচ তুমি কিন্তু তাদের কাছে ঘেঁসো না। তাদের সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না কোনও কিছুর সঙ্গে নিজেকে জড়াওনি। আশাবরী তোমার কাছে স্রেফ একটা রুটিন জব। প্লাস একটা চ্যালেঞ্জ। পরীক্ষায় তুমি উতরে গেছ, আর কোনও লক্ষ নেই, প্যাশন নেই আবেগ নেই, কাজে তুমি আর উত্সাহ পাবে কী করে!”

“হয়তো তুইই ঠিক।” অহনা বিড়বিড় করল, “তাই তো ভাবছি, আশাবরীর খেলা এবার শেষ করে দেব।”

“তাতেও শান্তি মিলবে কি? বরং… ভেতরের রাগটাকে ঝেড়ে ফ্যালো অণুদি। সুগতবাবুকে ক্ষমা করে দাও।”

“ওকে মাপ করব? আমি?” অহনা প্রায় ফুঁসে উঠল, “কেন? কোন সুকার্যটা সে করেছে শুনি? ইনিয়ে বিনিয়ে আমায় জপাচ্ছিল বলে?”

“না। তোমার নিজের জন্যে।”

“তুই কী রে? আমাকে সুগতর কাছে ফিরে যেতে বলছিস?”

“উঁহু। তা কি আর হয়? তুমি তোমার জায়গাতেই থাকো, সে বাঁচুক তার মতো করে। শুধু তার দোষত্রুটি অনাচার অবিচার সব মন থেকে ক্ষমা করে দাও। দেখবে, তোমার ভেতরটা কত হালকা হয়ে গেছে।”

“তুই হলে পারতিস?”

অর্ঘ্য উত্তর দিল না। ধীর পায়ে এসে বসল অন্য একটা খাটিয়ায়। বসেই আছে। অহনাও নিশ্চুপ। অর্ঘ্যর কথাগুলোই ভাবছিল। নাকি ভাবনার দোলাচলে ভুগছিল? কখন যে বৃষ্টি পুরো ধরে গেছে, তাও ঠিক খেয়াল করেনি।

অর্ঘ্যর স্বরে সংবিৎ ফিরল, “ওঠো, এবার পাড়ে গিয়ে দাঁড়াই।”

টানা বসে থেকে কোমর ধরে গেছিল অহনার। খাটিয়া ছেড়ে সোজা হতে সময় নিল একটু। চালার বাইরে এসে বলল, “প্রায় দশটা বাজে। দুলাল কি আর আসবে বলে মনে হয়?”

“চান্স কম। তবু…গিয়ে দেখি…”

“চল তবে।”

মেঘ সরে গেছে। চাঁদ নেই, এখনও ওঠার সময় হয়নি বোধহয়। দু’-চারটে তারা ফুটেছে আকাশে। ফিকে অন্ধকারে নদীতীরে যাচ্ছিল অহনা। অর্ঘ্য পাশে পাশে। কখনও হাঁটার ছন্দে অর্ঘ্যর বাহু ছুঁয়ে যাচ্ছে অহনাকে, কখনও বা অসমান পথে টাল সামলাতে অহনাই ধরে নিচ্ছে অর্ঘ্যর কবজি। ভিজে ঠান্ডা হয়ে আছে অর্ঘ্যর গা, তবু যেন একটা স্পর্শতাপ সঞ্চালিত হচ্ছে। অহনা টের পাচ্ছিল।

অনেকটা জল ঝরিয়ে বিকেলের গুমোট ভাব নেই আর। দিনের বেলার তাপও কোথায় উধাও। তবে বাতাস বেশ জোরেই বইছে। দিশাহীন ভাবে। ঝাপটা দিচ্ছে হঠাৎ হঠাৎ।

পাড়টায় এসে থামল অর্ঘ্য। একটু তফাতে অহনা। সামনে শুনশান নদী। ওপারে ছড়িয়ে থাকা আলোর কুচি, ভারী নরম এক আভা ছড়িয়েছে জলে। জোয়ার চলছে, কিনারায় এসে ভাঙছে ছোট ছোট ঢেউ। ওই কোমল বিচ্ছুরণ, তীর ছোঁয়া কল্লোলের ঝংকার আবিষ্ট করে ফেলছে যেন। অহনার অজ্ঞাতেই এক অন্য অহনা দখল নিচ্ছিল অহনার।

দু’হাত কোমরে রেখে অর্ঘ্য নদীকে দেখছিল। মিনিট পাঁচেক স্থির তাকিয়ে থেকে বলল, “কিছু নজরে পড়ছে?”

অহনার চোখে স্বপ্ন স্বপ্ন ঘোর। আধফোটা স্বরে বললল, “কী?”

“কোনও নৌকা? ডিঙি ফিঙি? এদিকে আসছে?”

“আসছে কি?”

অহনার গলার আওয়াজটা কি ফ্যাঁসফেঁসে শোনাল? নাকি পালটা প্রশ্নে অবাক হয়েছে অর্ঘ্য? অহনার চোখ থেকে কেন সরাচ্ছে না স্থির দৃষ্টি?

অর্ঘ্যর প্রশ্ন ধেয়ে এল, “এ কী, তুমি কাঁপছ?”

অহনার স্বর জড়িয়ে গেল, “বড্ড হাওয়া… শীত করছে…”

ফস করে অহনার কাঁধে হাত রাখল অর্ঘ্য। ঠিকরে এল উদ্বেগ, “তোমার শাড়ি-ব্লাউজ় তো সপসপ করছে।”

“হ্যাঁ…খুব ভিজে গেছে।”

“এ পরে থাকলে তুমি তো…।”

আর এগোতে পারল না অর্ঘ্য। হঠাৎই যেন বাকরোধ হয়েছে।

আচমকা অহনা ছুঁল অর্ঘ্যকে, ফিসফিস করে বলল, “তোর টি-শার্টও তো ন্যাতা হয়ে গেছে। ঠান্ডা লাগছে না তোর?”

নারীর মাদক স্বরে অপার্থিব আহ্বান। নাকি চরম পার্থিব? একজোড়া পুরুষালি হাত কখন যে বেড় দিয়ে ঘিরে ফেলল অহনাকে তা কি অর্ঘ্যও জানে! নারীর তৃষ্ণার্ত অধর অর্ঘ্যর বুকে ওম খুঁজছে, অহনার সাধ্য কি তাকে রোধ করে!

নদীতীর থেকে ফিরছিল অহনা। এক পা এক পা করে। অর্ঘ্যর হাত বুকের মাঝে আঁকড়ে। কী আশ্চর্য, কামক্ষুধা জাগছে না, বরং এক মধুর তৃপ্তিতে জুড়িয়ে যাচ্ছে অন্তরের দাবদাহ! দেহের কোনও অচিন কুঠুরিতে যে চুঁইয়ে চুঁইয়ে প্রবেশ করছে প্রশান্তির নীর! প্রেমের গোলাপি দিনগুলোয় সুগতর সঙ্গে অনেক তো শরীরী খেলায় মেতেছিল অহনা, এই অনুভূতির আস্বাদ তো পায়নি কখনও। এরই কি নাম হৃদয়ে হৃদয় যোগ করা?

চালায় ফিরে এক খাটিয়ায় বসেছে পাশাপাশি। অর্ঘ্যর কাঁধে মাথা রেখে। অর্ঘ্যর গাঢ় স্বর কানে এল, “আমাদের সম্পর্কের পরিণতি কি জানো অণুদি?”

“উঁহু।” অহনা ঠোঁট ঘষছে অর্ঘ্যর ঘাড়ে, গলায়। আদুরে স্বরে বলল, “জানতে চাইও না রে।”

“কিন্তু আমাকে যে বলতেই হবে।… আমি আলাইপুর ছেড়ে চলে যাচ্ছি। কালই।”

“হঠাৎ? এত তাড়াতাড়ি?” অহনা সোজা হল, “তোর সমীক্ষার কাজ শেষ?”

“আমার সব কাজই সমাপ্ত হয়েছে অণুদি।… আর বোধহয় আসাই হবে না আলাইপুরে। বোধহয় কেন, আসা হবেই না। আমি নিশ্চিত।”

“কেন?…তুই কোথায় যাচ্ছিস?”

“জানি না। হয়তো এখানকার মতোই কোনও অজ্ঞাতবাসে। কিংবা পরপারে।”

“মানে?” অহনার ঠোঁট নড়ল, “কী বলছিস তুই?”

“হয়তো তোমায় মিথ্যে বলেই পালাতাম। কিন্তু এখন তো আর তা সম্ভব নয়।” অর্ঘ্য কেটে কেটে বলল, “আমি বিশেষ রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী। আমরা চাই সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। পথ একটাই। সশস্ত্র শ্রেণিসংগ্রাম। এখানে ক’টা দিন লুকিয়ে ছিলাম। এবার তো যেতেই হবে।”

“তু…তু…তুই টেররিস্ট?”

“রাষ্ট্র সেরকমই একটা নাম দিয়েছে বটে।… আমাকে কি তোমার অত ভয়ংকর কিছু মনে হয়? আতঙ্কবাদী গোছের?”

“না তো।…তুই কি সত্যিই ভাবিস মানুষ মেরে মানুষের ভাল করা যায়?”

“কয়েক দিন আগেও করতাম। এখন করি না। তোমাকে দেখেই বুঝেছি, রাগ ঘেন্না পুষে রেখে, প্রতিশোধের জন্য ছটফট করে শেষ অবধি কিছুই মেলে না। এখানকার লোকদের সঙ্গে কথা বলেও দেখেছি, অবস্থার বদল হোক ছাই না হোক, হিংসাকেই তারা সবথেকে বেশি অপছন্দ করে। রোজ তারা যতই রক্তপাত দেখুক, খুনোখুনির পথ তারা কখনই মন থেকে মানবে না।”

“তা হলে তো চুকেই গেল। তুই তো তোর ভুল বুঝতেই পেরেছিস। আর কেন পালাবি মিছিমিছি।”

“তো কি এখানে থাকব? খেপেছ? জেনেশুনে তোমায় বিপদে ফেলব?… এমনিতেই তো তোমায় আমি অনেক ঠকিয়েছি। বিস্তর মিছে কথা বলেছি। আমার বাবা মা দিদি কেউ সিঙ্গাপুরে যায়নি, সবাই এখন আসানসোলে। মা প্রায় মরণাপন্ন, বাবা দিদি তার সেবা করছে। পুলিশ আমায় খুঁজছে বলে সেখানেও আমি আর…” অর্ঘ্যর গলা বুজে এল। জোরে নাক টেনে বলল, “বিপ্লবীর তো কান্না সাজে না, তাই না অণুদি।”

“দূর বোকা। দুঃখে যার কান্না আসে না, অন্যের দুঃখ সে ঘোচাতে পারে?” অর্ঘ্যর পিঠে মৃদু চাপড় দিল অহনা। ধমকের সুরে বলল, “তুই কোত্থাও যাবি না, আমার ছায়ায় থাকবি। আমি পাখির মতো তোকে আগলে রাখব। ভালবাসার দিব্যি।”

“তুমি জানো না অণুদি, আমার দলের লোকেরা… ওরা আমায়… লোক পাঠিয়ে…”

“আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না। যা বললাম, সেটাই ফাইনাল। নো নড়াচড়া ফ্রম আলাইপুর।… এখন শুয়ে পড়। ভোর ভোর নৌকা ধরে ফিরতে হবে না?”

দড়ির খাটিয়াই শয্যা। অদূরে অর্ঘ্য। ঘুমোচ্ছে? মনে হয় না। অহনাও কি দু’চোখের পাতা এক করতে পারছে? পারা সম্ভব? আজকের এই রাতটায়?

খড়ের ছাউনির ওপরে আকাশের অনন্ত চাঁদোয়া। শলমা-জরি ঝিকমিক করছে চাঁদোয়ার গায়ে। কৃষ্ণপক্ষ পড়েছে সবে, রাঙাভাঙা চাঁদে এখনও জোছনা অপার। বৃষ্টিধোয়া গাছপালা সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। বুনো বুনো। সুখমাখানো। ব্যাং ডাকছিল।

এমন রাত জীবনে মাত্র একবারই আসে। অহনা জানে। বুঝি বা অর্ঘ্যও।

.

॥ ১১ ॥

কাগজের স্তূপ নিয়ে হিমসিম খাচ্ছিল অর্ঘ্য। আশাবরীর রাশি রাশি ভাউচার। প্রতিটি গ্রাহকের কাছ থেকে প্রতিবার টাকা কালেকশনের চার্জ়, ব্যাঙ্কে টাকা জমা দেওয়ার রসিদ, রাহা খরচের বিল, এজেন্টদের কমিশন পেমেন্টের অতি দীর্ঘ তালিকা, আশাবরীর কর্মচারীদের মাইনে, মালপত্র কেনাবেচার অজস্র ডকুমেন্ট… কী আছে আর কী নেই। প্রতিটি সংখ্যা নিখুঁত ভাবে ভরতে হবে কম্পিউটারের মগজে। সোজা কাজ! চলছে আঙুল, উঠছে ফিগারের পর ফিগার। বেশিক্ষণ টানা চোখ রাখা যায় না মনিটরে, মিনিট চল্লিশেই মাথা প্রায় থান ইট।

কাজটা যে অর্ঘ্য ধীরেসুস্থে করবে, তারও কি জো আছে। যা ডেটলাইনের খাঁড়া ঝুলিয়ে দিয়েছে অণুদি! যত খাটুনিই হোক, কালকের মধ্যে শেষ হওয়া চাইই চাই। রানাঘাটে কে এক জয়ন্তবাবু আছেন, আশাবরী তথা অহনা ম্যাডামের ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন জমা করেন ভদ্রলোক। পরশু সূর্য মাঝ গগনে পৌঁছোনোর আগে ওই গন্ধমাদন সাজিয়ে গুছিয়ে জয়ন্তবাবুর হাতে তুলে দিতেই হবে, নইলে নাকি উনি আর আশাবরীর ফাইল স্পর্শই করবেন না। কী জ্বালা! আর এমন একটা ঝামেলার কাজ কিনা অর্ঘ্যর ঘাড়েই চাপল। পাহাড় প্রমাণ কাগজ সমেত তাকে কম্পিউটারে বসিয়ে দিয়ে দিব্যি নাচতে নাচতে কলকাতা চলে গেল আশাবরী ম্যাডাম!

ইলা উঁকি দিচ্ছে দরজায়। কী বোর্ডে আঙুল থামল অর্ঘ্যর। চোখ তুলে বলল, “কী বক্তব্য? বলে ফ্যালো।”

“টিফিনে যাব…দাদা।”

অর্ঘ্য খুশি হল। রোজই খানিকক্ষণ এখানে বসতে হচ্ছে, মেয়েগুলো তাকে স্যার স্যার করছিল, ধমকে ধামকে অভ্যাসটা ছাড়ানো যাচ্ছে তা হলে। প্রসন্ন স্বরে বলল, “তোমরা সকলেই যাবে নিশ্চয়? বেশি দেরি কোরো না।”

“এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরব।”

ইলা বেরিয়ে যাচ্ছিল, আচমকা জরুরি কথাটা মনে পড়ে গেল অর্ঘ্যর। পেছন থেকে ডাকল, “এক সেকেন্ড। স্টকের খাতাটা তোমার কাছে রয়েছে না?”

“হ্যাঁ দাদা। লাগবে আপনার?”

“একটু। দিয়ে যাও তো।”

বাঁধানো রুলটানা খাতাটা টেবিলে রেখে চলে গেল ইলা। পাতা উলটে দেখল অর্ঘ্য। বিল চালানের সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে এই খাতাটাও পরীক্ষা করতে হবে আজ, এই কাজটাও নাকি খুব জরুরি। কাগজের সমুদ্র ঘেঁটে প্রতিটি এন্ট্রি চেক… অর্ঘ্যর আজ কালঘাম ছুটে যাবে।

সত্যি, অহনা খাটাচ্ছে বটে অর্ঘ্যকে! যেই না সেদিন কাকভোরে একটা জেলে নৌকা ধরে চর থেকে আলাইপুর ফিরল, অমনি জারি হয়ে গেল নির্দেশ। অর্ঘ্যর তো আর সমীক্ষার ছলে গাঁয়ে গাঁয়ে চরে বেড়ানোর প্রয়োজন নেই, বসে বসে অহনার অন্ন ধ্বংস করাও চলবে না, আশাবরীর জন্য মেহনত দিক অর্ঘ্য।

ব্যস, ডিউটি চালু। গ্রামে গ্রামেই ঘোরো, কিন্তু আশাবরীর কাজে। দ্যাখো, স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ানো যায় কি না। অর্ঘ্যর মতো সবল জোয়ান সঙ্গী পেলে অহনার কীসের ভাবনা, স্বচ্ছন্দে সে আশাবরীকে আরও ছড়িয়ে দিতে পারে। সুতরাং দিনভর শুধু চরকি খাও। মেয়ে বউদের জড়ো করো, মিটিং বসাও, বোঝাও আশাবরীর ঋণ দেওয়ার নিয়ম কানুন। শত সহস্র প্রশ্ন থাকে মেয়েদের, গুছিয়ে গাছিয়ে তাদের উত্তর দিয়ে তাদের সংশয় নিরসন কি মুখের কথা। এক এক সময় তো অর্ঘ্যর মনে হয়, এর চেয়ে তাদের বিপ্লব করাটা ঢের সোজা কাজ ছিল। কোথায় কখন কীভাবে শত্রুর ঘাঁটি ধ্বংস করবে, তার প্ল্যান ছকাটাই যথেষ্ট, নিজেদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত, কাউকে জবাবদিহি করার কোনও দায় নেই। ভুল হলে নিজেরা মরবে, ঠিক হলে প্রতিপক্ষ খতম, এর কোনও মাঝামাঝি ব্যাপারই নেই। আর এই আশাবরীতে এত ফ্যাকড়া, প্রতিটি গোষ্ঠীর পরিবারে পরিবারে এত আজব আজব সমস্যা, শুনতে শুনতে সাত দিনেই অর্ঘ্যর মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে, তার বিপ্লবী হওয়ার চেয়ে মানুষকে নিয়ে মানুষের মাঝে নেমে কাজ করাটা অনেক বেশি কঠিন।

তবে হ্যাঁ, আশাবরীর জন্য খেটে এক ধরনের তৃপ্তিও মিলছে বই কী। মস্তিষ্কের অনেক গাদ যেন সরে যাচ্ছে। শ্রান্ত শরীরটা যখন বিছানায় পড়ে, পলকে নিদ্রা এসে যায়। কী আশ্চর্য, দুঃস্বপ্নও আর দেখছে না!

অহনাও ভারী মজায় আছে যেন। তার সেই দিবারাত্র হাঁড়ি মুখ উধাও, কারণে অকারণে চোটপাট নেই, ইলা-মায়াদের সঙ্গেও হেসে হেসে কথা বলছে। অর্ঘ্যর খেটে খেটে নাকাল হওয়ার গল্পে ব্যথিত তো হয়ই না, উলটে মুচকি মুচকি হাসে। গত শুক্রবার কী খেয়াল হল, মোপেডে চড়ে প্রজাপতির মতো উড়তে উড়তে ব্যাঙ্কে গিয়ে ওভারড্রাফ্টের ঊর্ধ্বসীমা এক লপতে ডবল করে এল! শেফালিকে পরশু নিয়ে এল কলকাতা থেকে, তার সঙ্গেও লড়াই-ঝগড়া বাধছে না! বয়সটাও যেন ঝুপ করে কমে গেছে অনেকটাই।

অর্ঘ্য রয়ে গেছে বলেই কি? নাকি অর্ঘ্যর কথামতো সুগতকে ক্ষমা করে দিয়ে মনটা সমে ফিরেছে? এমনও কি হতে পারে দুটোই মিলেমিশে অহনার এই পরিবর্তন?

স্ট্যান্ড ফ্যানটা ঝপ করে থেমে গেল। লোডশেডিং। গত কয়েক দিন খুব বেড়েছে, ঘনঘন যাচ্ছে বিদ্যুৎ। বেশিক্ষণের জন্য নয় অবশ্য, এসেও যায় অল্প সময়ে।

ডাটা সেভ করে কম্পিউটার বন্ধ করল অর্ঘ্য। দুটো বাজে, খিদেটা ভালই পেয়েছে। ছোট্ট একটা আড়মোড়া ভেঙে চেয়ার ছাড়ল। বেরিয়ে আসার আগে একবার তাকাল যন্ত্রপাতি তৈরির ঘরখানায়। মেয়েরা ফেরেনি এখনও, মেঝেয় ছড়িয়ে আছে মালপত্র। নাটবল্টু, স্ক্রুডাইভার, প্লাস, রেঞ্জ, শোল্ডারিং স্টিক…। গত পরশু এখানে কী কাণ্ডটাই না ঘটিয়েছিল সে! অহনা মাকে আনতে কলকাতায় গেল, তার হঠাৎ সাধ জেগেছিল ওই মেয়েগুলোর সঙ্গে বসে বানাবে সোলার ল্যাম্প। নিজের হাতে। কিন্তু ওই চেনা যন্ত্রপাতিগুলোও ঠিকঠাক ব্যবহার করা যে কী কঠিন, একটা ল্যাম্প বানাতে গোটা দিনটাই কাবার। তুলনায় মাইন পাতা কি কয়েকটা ডেটোনেটর ফিট করা তো নেহাত জলভাত। ইলা-মিতা-দিলারা-কেয়ারা পর্যন্ত তার নাজেহাল দশা দেখে মুখ টিপে হাসছিল সেদিন।

অর্ঘ্যর ঠোঁটে আবছা হাসি ফুটে উঠল। চোরা একটা শ্বাসও পড়ল যেন। একখানা সামান্য আলো বানানোর চেয়ে আস্ত একটা গ্রাম উড়িয়ে দেওয়া যে ঢের ঢের সোজা কাজ, এটুকু জানতে যে জীবনের কতগুলো বছর কেটে গেল!

ছোট্ট মাঠখানা পেরিয়ে বাড়ি ঢুকল অর্ঘ্য। শেফালি গ্রিল-বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। সামান্য ভারভার গলায় বলল, “এত দেরি করো কেন? তুমি খেয়ে নিলে আমি একটু বিছানায় টানটান হতে পারি।”

অর্ঘ্য পরশু থেকেই দেখছে, শেফালির হাবভাবে যেন বদল ঘটেছে অনেকটা। সহজ আপ্যায়নের সেই সুরটা আর নেই। বরং ঈষৎ অসন্তোষই যেন প্রকট হয়ে উঠছে হঠাৎ হঠাৎ। অণুদির সামনে অবশ্য স্বাভাবিকই থাকে, আড়ালে আবডালে একটু যেন অন্যরকম হয়ে যায়। তাকে আর অণুদিকে নিয়ে কিছু সন্দেহ করে কি? তারা তো কোনও বেচালপনা করেনি বাড়িতে। কোথাওই করেনি, কখনই অসংযত হয়নি। তা হলে?

অর্ঘ্য অবশ্য হাসিমুখেই বলল, “সরি মাসি। অণুদি এত ডিউটি চাপিয়ে গেছে…”

“কাঁধে নিয়েছ কেন? তোমার নিজের কাজকর্ম শেষ?”

মৃদু হেসে উত্তরটা এড়িয়ে অর্ঘ্য সোজা নিজের খুদে গলতায়। সেখান থেকেই শেফালির ডাক শুনতে পেল, “স্নান পরে কোরো। আমি কিন্তু ভাত বেড়ে দিয়েছি।”

অগত্যা বাথরুম গমন স্থগিত। সুড়সুড় করে ডাইনিং টেবলে হাজির। ডাল, পটলভাজা বাটামাছের ঝাল সহযোগে সারছে ভোজন।

শেফালি টেবিলের ওপারে। খাওয়া দেখছিল অর্ঘ্যর। জিজ্ঞেস করল, “আর ভাত নেবে?”

শেফালিমাসির এই তুই থেকে তুমিতে উত্তরণ বড্ড কানে লাগে। দূরত্ব বাড়ানোর সচেতন প্রয়াস? অণুদিকে জানাতে হবে। থাক, তুচ্ছ বিষয় নিয়ে অণুদিকে বিব্রত করার কী দরকার। মা-মেয়েতে এখন অশান্তি নেই, দুম করে হয়তো বেঁধে যাবে।

মাছের কাঁটা বাছতে বাছতে অর্ঘ্য বলল, “না গো মাসি। যা দিয়েছ তাতেই তো পেট জয়ঢাক হয়ে যাচ্ছে।”

“আমার মেয়ের জন্য খাটছ… না হয় দু’মুঠো বেশিই খেলে।” মোটেই হালকা নয়, বরং বেশ বিরস স্বরে বলল শেফালি, “যাক গে, আমি শুতে গেলাম। খাওয়া হলে থালা টেবিলে ফেলে রেখো না, রান্নাঘরে নামিয়ে দিয়ো।”

শেফালি চলে গেল। আঁচিয়ে উঠে অর্ঘ্য ঢুকেছে স্নানে। বৃষ্টিবাদলা হচ্ছে প্রায়ই, দুপুরের দিকে জলটা আর তত তেতে থাকে না, গা-মাথা ভিজিয়ে ভালই আরাম হয়। ঝাঁকড়া চুল তোয়ালেতে মুছতে মুছতে অর্ঘ্য বেরিয়ে দেখল ডাইনিং টেবলের পাখাটা ঘুরছে আপন মনে।

অর্থাৎ কারেন্ট এসে গেছে। উফ, কী স্বস্তি। ভরপেট খাওয়ার পর এখন একটা ভাতঘুম দিলে কেমন হয়? পাখা চালিয়ে বিছানায় গড়াতে গিয়েও মত বদলাল অর্ঘ্য। সারা সকাল বসে বসে গত বছরের এপ্রিল-মে শেষ হয়েছে, সবে আরম্ভ হয়েছে জুন, আরও ন-ন’টা মাস বাকি। এখন ঘুমোনো মানে অন্তত ঘণ্টা দেড়েকের জন্যে কাজের দফারফা। সন্ধেবেলা অণুদি ফিরলে তখন কী কৈফিয়ত দেবে অর্ঘ্য?

তার চেয়ে বরং সোফায় হেলান দিয়ে খানিক জিরোনো যেতে পারে। বাইরের ঘরে এসে অর্ঘ্য টিভি চালিয়ে দিল। ভলিউম কমিয়ে। পাছে শেফালির নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটে। রিমোট হাতে আধশোওয়া হয়েছে। ঘুরছে এ চ্যানেল ও চ্যানেল।

আচমকা আঙুল স্থির। খবরে কী দেখাচ্ছে ওটা? তেজসের ছবি না? কী করেছে তেজস? তড়াক করে উঠে বসল অর্ঘ্য। অজান্তেই বাড়িয়ে দিয়েছে টিভির আওয়াজ।

সমাচারটা শুনে, ভিডিও ক্লিপিংস দেখে, অর্ঘ্য বজ্রাহত। গোয়েন্দা সূত্রে নাকি খবর মিলেছিল, ওড়িশার নয়াগড় জঙ্গলে আস্তানা গেড়েছে উগ্রপন্থীরা, আজ সকালে কমান্ডো বাহিনী সেই গুপ্ত ঘাঁটিতে হানা দেয়, বিপুল সংঘর্ষ হয়েছে দু’ পক্ষের, গোলাগুলি চলেছে বিস্তর, আটজন উগ্রপন্থী নিহত হয়েছে। জখমের সংখ্যা চার। কম্যান্ডো বাহিনীর কেউই মারা যায়নি, তিনজন মাত্র আহত হয়েছে সংঘর্ষে। মৃত উগ্রপন্থীদের তালিকায় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাম তেজস সিং ওরফে বাবুরাম মারান্ডি ওরফে রামু ভার্গব ওরফে শংকরন নায়ার। সরকারের দাবি, উগ্রপন্থী দমন অভিযানে গত চব্বিশ মাসে এটাই নাকি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য। তেজস সিং-এর কর্মকাণ্ডেরও বর্ণনা দিচ্ছে টিভি রিপোর্টার। গত বছরে ট্রেনলাইনে নাশকতামূলক কাজ চালিয়ে আঠাশ জনের প্রাণহানি ঘটানো, আট মাস আগে মধ্যপ্রদেশে পুলিশফাঁড়ি আক্রমণ করে সাতজন পুলিশ খুন, দেড় মাস আগে ঝাড়খণ্ডে অ্যাম্বুলেন্স উড়িয়ে চালক-রোগী সমেত পাঁচজনকে হত্যা, অতি সম্প্রতি কোরাপুটে…

শুনতে শুনতে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল অর্ঘ্যর। তার মাইন পেতে অ্যাম্বুলেন্স ওড়ানোর কেসটাও তেজসের ঘাড়ে চেপে গেছে! এ তো এক দিক দিয়ে ভালই হল, নয় কি? কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, তার দীর্ঘদিনের কমরেড, অনেক সুখদুঃখের সাথী, তেজস আর নেই! দিল্লির জে-এন-ইউতে প্রথম পরিচয়, তেজসের ডাকেই পার্টিতে যোগ দিয়েছিল অর্ঘ্য, বস্তারের জঙ্গলে একসঙ্গে দু’জনে অস্ত্রচালনার ট্রেনিং নিল, কত লড়াইয়ে তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশ নিয়েছে…। কয়েক মাস ধরে তেজস অবশ্য কেমন পালটে যাচ্ছিল। পার্টিতে অর্ঘ্যর অনুগামীর সংখ্যা বাড়ছে, কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং-এও অর্ঘ্যর কথা বেশি গুরুত্ব পায়… এতে যেন বিরক্ত হচ্ছিল তেজস। শেষমেশ তো অর্ঘ্যকে পয়লা নম্বর শত্রু ঠাউরে…। তবু… তেজসের নিথর শরীর… জঙ্গলের মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে…, গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে…! তেজস তাকে যাই ভাবুক, একসঙ্গে অনেকটা পথ তো তারা পাশাপাশি হেঁটেছিল।

তেজসের মৃতদেহ দেখাচ্ছে বারবার। ভাল লাগছে না। একটুও ভাল লাগছে না। টিভি অফ করে ঝুম বসে রইল অর্ঘ্য। দু’ আঙুলে টিপছে রগ। আপন মনে মাথা ঝাঁকাচ্ছে জোরে জোরে।

সহসা মগজে বিদ্যুতের ঝিলিক। তেজসকে নিয়ে তো শোক করা বৃথা। বরং যুক্তি দিয়ে বিচার করলে এ তো শাপে বর। তেজসের মৃত্যু কি নতুন সম্ভাবনা খুলে দেয়নি? রাজন, সৌরভ, গণেশন, পানিক্কাররা নিশ্চয় এখন দিশেহারা, অর্ঘ্যকে তারা সম্ভবত মেনেও নেবে…। দলটাকে যদি আবার নতুন করে গড়া যায়…? অর্ঘ্য নিশ্চিন্তে নিজের মতো করে দল চালাবে…। তত্ত্বে বদল ঘটিয়ে… শ্রেণিসংঘর্ষ থেকে ব্যক্তিহত্যার অংশটা ছেঁটে ফেলে…?

নাহ, মতাদর্শ নিয়ে লড়ালড়ি পরে হবে, বাকি সব্বাইয়ের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করাটাই এখন মুখ্য কাজ। পার্টির বিপন্ন দশায় সে যদি কমরেডদের পাশে না দাঁড়ায়, তাদের ভরসা না জোগাতে পারে, কী করে তাদের নেতা হবে অর্ঘ্য? আর এক মুহূর্ত নষ্ট করা নয়, আজই বেরিয়ে পড়া দরকার। এক্ষুনি। বেলপাহাড়ির উদ্দেশে। ওখানকার ঘাঁটিতে পৌঁছে একে একে সকলকেই বার্তা পাঠাবে সে, আবার বাঁধবে জোট…।

ঝটিতি ঘরে গেল অর্ঘ্য। খাটের নীচ থেকে টানল ঝোলা, ঝটাঝট পুরছে নিজের জিনিসপত্র। ঢোকাল ল্যাপটপ, বই, ছড়ানো জামাকাপড়, এমনকী ভিজে তোয়ালেটাও পলিথিনে মুড়ে চালান করল অন্দরে। হাত চালিয়ে পরখ করে নিল, রিভলভারখানা ঠিক জায়গায় রাখা আছে কি না। ভাগ্যিস অণুদিকে মেশিনটা জমা করে দেয়নি!

জিন্‌স-টি-শার্ট গলিয়ে, ঝোলা পিঠে চাপিয়ে অর্ঘ্য প্রস্তুত। নিঃশব্দে বেরিয়ে যাচ্ছিল, কী ভেবে ঘুরে এল। শেফালি-অহনা তার প্রতীক্ষায় অনেক রাত অবধি গালে হাত দিয়ে বসে থাকবে, উদ্বিগ্ন হয়ে চতুর্দিকে খোঁজাখুজি শুরু করবে… সে ভারী বিশ্রী ব্যাপার।

শেফালির দরজায় এসে কণ্ঠগ্রাম সামান্য উঁচুতে তুলে অর্ঘ্য ডাকল “মাসি…।”

ফল হয়েছে। চোখ খুলে তাকাল শেফালি, “কী হল?”

অর্ঘ্য বিনা ভূমিকায় বলল, “আমি চলে যাচ্ছি।”

শেফালি উঠে বসল। চোখ রগড়ে বলল, “কোথায়?”

“যেখান থেকে এসেছিলাম, সেখানেই। আমার এখানের কাজ ফুরিয়ে গেছে তো।”

শেফালি সামান্য থতমত, “আমার ওপর রাগটাগ করে যাচ্ছ না তো? আমি কিন্তু তোমায় যেতে বলিনি।… তুমি হলে গিয়ে এখন অণুর স্পেশাল অতিথি…”

“ছাড়ো না মাসি।…তুমি কি আমার কম আদরযত্ন করেছ… আমার চিরকাল মনে থাকবে…”

“আমার সৌভাগ্য। সাবধানে যেয়ো।”

বাধ্য ছেলের মতো অর্ঘ্য ঘাড় নাড়ল। ঘুরতে গিয়েও থমকাল। পকেট থেকে কাগজের একটা ছোট্ট মোড়ক বার করে দিল শেফালির হাতে।

শেফালি অবাক স্বরে বলল, “কী এটা?”

“অণুদির একটা পুরনো সিমকার্ড। আমাকে ব্যবহার করতে দিয়েছিল। ওটা আর আমার লাগবে না। অণুদিকে ফেরত দিয়ে গেলাম।”

“ও।…ঠিক আছে, দিয়ে দেব।”

“অণুদিকে বোলো, তাড়া ছিল বলে ওয়েট করতে পারলাম না। অণুদি যেন কিছু না মনে করে…।”

“বলে দেব’খন। এসো।” কপালে হাত ঠেকাল শেফালি। “দুগ্গা, দুগ্গা…।”

অর্ঘ্যর জন্য শুভকামনা? নাকি অর্ঘ্য বিদেয় হলে বাঁচে মহিলা? ঠিক বুঝতে পারল না অর্ঘ্য। বোঝার তার সময়ও নেই। স্নিকার পরা পা চালিয়ে আশাবরীর কম্পাউন্ড ছাড়ল। মুহূর্ত ভাবল কী যেন, তারপর ধরেছে নদীর পথ।

সাড়ে তিনটে বাজে। রাস্তায় লোকজন নেই। চেনামুখের সঙ্গে এখন সাক্ষাৎ না হওয়াই মঙ্গল, পালানোর চিহ্ন থেকে যাবে। লাভ একটাই, পরে কখনও পুলিশ এলেও তার রুট আন্দাজ করতে গিয়ে খানিক ঘোল খাবে।

নদীতে আজ তিন-চারটে নৌকা। দুলাল নেই, থাকলেও তার নৌকায় উঠত না অর্ঘ্য। কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা নেমে এল প্রথম নৌকার পাটাতনে। বুড়োমতো মাঝিকে বলল, “কী গো ভাই, যাবে তো?”

মাঝি হাই তুলল, “কোথায় কত্তা?”

“ওপারে।”

“ওই চরে?…তিরিশ টাকা পড়বে।”

পলকে চিন্তার টোকা। টাকার জন্য নয়। ভেবেছিল, চরে পাক মেরে সরাসরি ওপারে গিয়ে উঠবে। এখন মনে হচ্ছে, এই মাঝিকে নিয়ে চর অবধি যাওয়াই নিরাপদ। চরের ওপার থেকে ফের নৌকা ধরবে, লোকটা আর হদিশ দিতে পারবে না অর্ঘ্যর।

অর্ঘ্য ঘাড় নাড়তেই মাঝি নৌকা ছাড়ল। পার্স খুলে তিনখানা দশ টাকার নোট বার করে অর্ঘ্য রাখল পকেটে, সেই সঙ্গে একবার নিরীক্ষণ করে নিল পয়সাকড়ির হাল। হাতখরচা বাবদ ক’দিন আগে হাজার টাকা পকেটে গুঁজে দিয়েছিল অণুদি। বলেছিল, মাগনা তোকে খাটাব কেন, কিছু অন্তত রাখ। বোঝহয় পার্সের হাল দেখে অণুদির মায়া হয়েছিল। যাই হোক, ওই টাকার পুরোটাই আছে এখনও। এতেই অর্ঘ্য দিব্যি বেলপাহাড়ি পৌঁছে যাবে। কিন্তু তারপর? বেলপাহাড়ির শিবিরে খরচা নেই বটে, কিন্তু সেখান থেকেও যদি কোথাও যেতে হয়? বেলপাহাড়িতে এখন টাকার জোগাড় কেমন কে জানে! ডাক্তার, উকিল, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা টাকাই আদায় হচ্ছিল, এখন অর্ঘ্যদের ছত্রভঙ্গ দশায় তারাও না বেঁকে বসে। ভয় না পেলেই তো বিপদ, অর্ঘ্যদের অস্তিত্ব ঝুরঝুর হয়ে যাবে।

চিন্তাটা বাজল অর্ঘ্যর মাথায়। ভবিষ্যৎ রাস্তা স্থির করার আগে এই কথাটা প্রথম মনে পড়ল কেন? আদর্শ নয়, ভয় দেখানোর ক্ষমতাই কি তাদের একমাত্র মূলধন এখন? রাজনদের কি অর্ঘ্য বলতে পারবে, সেস আদায় বন্ধ করো? টাকা আসবেই বা কোত্থেকে? অস্ত্র, গোলাবারুদ, মাইন, ডিনামাইটের খরচা নেই? প্লাস, এতজন কমরেডের খাওয়া-দাওয়া, এখানে ওখানে ছোটা, নিয়মিত বুলেটিন প্রকাশ, পোস্টার ছাপানো…

নৌকা কখন যে মাঝনদী পেরিয়ে গেছে অর্ঘ্য টেরই পায়নি। আষাঢ় মাস পড়েছে আজ। মেঘলা আকাশ, মায়া ছড়ানো আলো, নদীর টলটলে শোভা, আজও সবই মজুত, অথচ অর্ঘ্যর নজরে পড়ছে না। একটা বড় নৌকা গেল পাশ দিয়ে, ঢেউ এসে দুলিয়ে দিল অর্ঘ্যদের, মালুমই হল না অর্ঘ্যর। হৃদয়ের অস্থিরতা বুঝি অনেক স্বাভাবিক অনুভূতিকেও অসাড় করে দেয়।

মাঝিকে ভাড়া মিটিয়ে চরে নামল অর্ঘ্য। তরতরিয়ে উঠে এল উঁচু পাড়ে। ঘুরে একবার দেখল আলাইপুর। তখনই অর্ঘ্যর মনে পড়ে গেল সেদিন রাতে ঠিক এখানটাতেই এসে দাঁড়িয়েছিল না? আবছা দুলে গেল স্মৃতি। পা যেন সহসা অবশ। এখনও যেন সেই ছোঁয়া লেগে আছে শরীরে। ভেজা নরম এক দেহ অর্ঘ্যর বুকে আশ্রয় খুঁজছিল!

ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে অর্ঘ্য এগোল আবার। দল তাকে ডাকছে, ছিঁড়তে হবে পিছুটান। কিন্তু গিয়ে সে পৌঁছোবে কোথায়? পুরনো সেই জীবনে কি তার আস্থা অটুট আছে এখনও? বিশ্বাসই তো চিড় খেয়ে গেছে, নয় কি?

আবার অর্ঘ্যর পা আটকে গেল। ওই তো সেই গোয়ালঘরের লাগোয়া চালা! ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দড়ির খাটিয়া! এখানে বসেই না অর্ঘ্য উচ্চারণ করেছিল, সে খুন-খারাবির পথ ত্যাগ করতে চায়? তবে আজ সে কেন চলেছে? দলপতি হওয়ার সুযোগ মিলতে পারে বলে? তেজসের সঙ্গে অর্ঘ্যর ফারাকটা কোথায়? মারণযজ্ঞের নিষ্ঠুর পুরোহিত সাজার উত্কট মোহ আবার কি তার চেতনাকে ঘুলিয়ে দিচ্ছে না?

অর্ঘ্য দাঁড়িয়েই আছে। কোনটা বাছবে সে? হিংসা না ভালবাসা? ধ্বংস না নির্মাণ? এক অলৌকিক রাত তাকে নতুন স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিল, সেই রাতটাকেই অর্ঘ্য মিথ্যে করে দেবে?

অর্ঘ্য হঠাৎ দৌড়োতে শুরু করল। চরের ওপার পানে নয়, উলটো মুখে। পাড়ে পৌঁছে হাঁপাচ্ছে। মাঝি আর ঘাটে নেই, তাকে পৌঁছে দিয়ে চলে যাচ্ছে আলাইপুর।

অর্ঘ্য প্রাণপণে চেঁচাল, “অ্যাই, শুনছ? শুনছ…?”

নৌকা প্রায় নাঝনদীতে, তবু বুঝি মাঝির কানে গেছে ডাক। লোকটা উঠে দাঁড়িয়েছে পাটাতনে। দু’হাত তুলে জানতে চাইছে কেন এই আহ্বান।

চিৎকার করতে গিয়ে অর্ঘ্যর গলা প্রায় চিরে গেল, “আমি ফিরতে চাই, মাঝি। আমি ফিরতে চাই।”

অর্ঘ্যর আর্তি ছড়িয়ে গেল চরাচরে। ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে দুলছে। জলকে ছুঁয়ে মিশে যাচ্ছে প্রথম আষাঢ়ের মেদুর বাতাসে।

.

॥ ১২ ॥

হালকা একটা উদ্বেগ নিয়ে ফিরেছিল অহনা। কলকাতায় কাজ শেষ করে একবার সুশোভন স্যারের স্ত্রীকে দেখে আসবে ভেবেছিল আজ। হল না। স্যারই নিষেধ করলেন। গীতালি আন্টিকে নিয়ে এখন রোজই যেতে হচ্ছে হাসপাতালে, কখন ফিরবেন তার ঠিক নেই। সপ্তাহে চার-পাঁচ দিন চলছে ডায়ালিসিস, উন্নতির সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর ক্রমশ। স্যার একটা অনুরোধ জুড়লেন আজ। স্যারের অনাথ আশ্রমটা যদি মাঝে মাঝে অহনা একটু দেখে আসে, উনি নাকি খানিকটা নিশ্চিন্ত হতে পারেন।

নিজের কাজকর্ম সামলে কখন যাবে? নাকি অর্ঘ্যকেই দেবে দায়িত্বটা? এই নিয়েই দোটানা চলছিল অহনার মনে। কিন্তু বাড়িতে পা দিয়েই যা শুনল, অনাথ আশ্রম উবে গেল মগজ থেকে। উলটে দুম করে তেতে গেল মাথা।

অহনা বিরক্তিতে ফেটে পড়ল, “তুমি অর্ঘ্যকে যেতে দিলে? আটকালে না?”

“আমি তাকে বারণ করার কে অণু?” শেফালির স্বর নির্বিকার, “সে নিজের ইচ্ছেয় এখানে এসেছিল, দরকার ফুরোতেই চলে গেছে। এতে আমার কী করার আছে?”

“তুমি আমায় একটা ফোন করেও তো জানাতে পারতে, নয় কি?”

“সে তোমার অর্ঘ্যও তো ফোন করতে পারত, নয় কি? তা ছাড়া আমার মনেও হয়নি, অর্ঘ্য চলে গেলে তোমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে।”

“ওফফ মা, তুমি বুঝতে পারছ না।” অহনা অস্থির ভাবে মাথা ঝাঁকাল। উত্তেজিত ভাবে বলল, “ও কি এমনি এমনি এখানে ছিল? ও কত বিপদের মধ্যে আছে জানো?”

শেফালি সন্দিগ্ধ চোখে তাকাল, “কেন? কী করেছে ছেলেটা? খুন-জখম? চুরি রাহাজানি?”

অহনা ভুরু কোঁচকাল, “ওকে দেখে কি ওই ক্লাসের ছেলে মনে হয়?”

“দেখে কি আর আজকাল মানুষ চেনা যায়? যাকে সভ্য-ভব্য বলে মনে হয়, পরে দেখা যায় সে একটি আস্ত শয়তান।”

বলতে না চেয়েও অহনার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, “সুগতকে দিয়ে সবাইকে বিচার কোরো না মা।”

“সুগতকে টানছ কেন? তুমি ভাল করেই জানো, আমি সুগতর কথা বলিনি।” শেফালি এবার রীতিমতো গম্ভীর, “তা তোমার অর্ঘ্যবাবুটি কী মহান কাজ করেছেন শুনি? যার জন্য তাকে এখানে ঘাপটি মেরে থাকতে হয়েছিল?”

অহনা ব্যাখ্যাতে গেল না, তর্কতেও নয়। মা অর্ঘ্যকে বুঝতে পারবে না, উলটে ওর রাজনীতির কথা শুনলে হয়তো ভির্মি খাবে। অহনা সোফায় হেলান দিয়ে ভাবার চেষ্টা করল, হঠাৎ কেন এই প্রস্থান। আসানসোল থেকে কোনও খারাপ খবর পেয়ে…। কিন্তু কালও তো অহনার ফোন থেকে বাবাকে কল করেছিল অর্ঘ্য, তখন পূজার সঙ্গে কথাও হল অহনার। পূজা বলল, ওষুধে মা সাড়া দিচ্ছে, মাঝে মাঝে চিনতেও পারছে আপনজনদের। মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এমন কী খারাপ হতে পারে? মোবাইলে তো নম্বরটা আছেই, একবার ফোন করে দেখবে অহনা? তা হলে খানিকটা অন্তত নিশ্চিন্ত হতে পারে।

মোবাইল হাতে নিয়েও অহনা মত বদলাল। যদি আসানসোলে কিছু না ঘটে থাকে? অর্ঘ্য আলাইপুরে অহনার বাড়িতে আছে জেনে বহুকাল পর একটু স্বস্তি পেয়েছেন মেসোমশাই, ছেলে আবার নিরুদ্দেশ শুনলে প্রতিক্রিয়া শুভ হবে কি? কিন্তু সিম কার্ডটা রেখে গেল কেন? নিজের সিম ব্যবহার করতে পারছে না, ডুপ্লিকেটটাও না, তাই তো অহনা তার পড়ে থাকা একটা সিম কার্ড অর্ঘ্যকে দিয়েছিল। এখন তার মানে অর্ঘ্য প্রায় বিনা মোবাইলেই…। এমন অবস্থায় বেরিয়ে গেল আলাইপুর ছেড়ে? কী এমন জরুরি প্রয়োজন পড়ল?

শেফালি পাশেই বসে। অহনা ঘাড় বেঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এখান থেকে কোথায় গেল, কিছু বলেনি?”

“হেঁয়ালিমার্কা কী একটা যেন বলেছিল বটে।” শেফালি ভাবল দু’-এক সেকেন্ড। তারপর বলল, “হ্যাঁ… যেখান থেকে এসেছিলাম, সেখানেই ফিরে যাচ্ছি।”

ভুরুর ভাঁজ বাড়ল অহনার। কলকাতা থেকে এসেছিল অর্ঘ্য, মানে ফের কলকাতায়। কিন্তু কলকাতার ডেরায় নাকি আর যাওয়া সম্ভব নয়… অর্ঘ্যই তো বলছিল…।

কে যেন দিদি দিদি করে ডাকছে বাইরে থেকে? অহনা প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে এল। বিশ্বজিৎ।

অহনা বুকের শ্বাসটা চেপে বলল, “কী হয়েছে?”

বিশ্বজিৎ কাঁচুমাচু মুখে বলল, “মেজদি এখন কয়েক দিন কাজে আসতে পারবে না।”

“কেন?”

“রোজ সন্ধের সময়ে জ্বর আসছিল। আজ রক্ত পরীক্ষা করানো হয়েছে। একটু আগে রিপোর্ট এল। ম্যালেরিয়া। ডাক্তারবাবু ওষুধ দিয়েছেন। উনিই বললেন মেজদিকে ক’দিন বিশ্রাম নিতে।”

“ও। কেমন আছে জানিয়ে যেয়ো।”

বাধ্য ছেলের মতো ঘাড় নেড়ে চলে যেতে গিয়েও ঘুরল বিশ্বজিৎ। ঈষৎ কৌতূহলী মুখে বলল, “অর্ঘ্যদা আজ চলে গেলেন বুঝি?”

ধক করে অহনার বুকে বাজল প্রশ্নটা। আলাইপুরের সব্বাই বোধহয় খবরটা জানে, একমাত্র অহনা ছাড়া। কেন? অহনা কী অক্টোপাস হয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে অর্ঘ্যকে বাঁধছিল? কেটে পালিয়ে মুক্ত হল অর্ঘ্য? কী অপমান!

নাহ, নিজের কষ্ট নিজের বুকেই থাক, অন্যকে তা কেন টের পেতে দেবে অহনা?

স্মিতমুখে অহনা বলল, “তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল বুঝি?”

“উনি বোধহয় আমাকে খেয়াল করেননি। নদীর ধারের কালীমন্দিরে গেছিলাম, দেখলাম উনি পিছনে ঝোলা নিয়ে নৌকোয় উঠছেন।”

“ও।”

“নৌকা পার হয়ে কোথায় গেলেন? হুগলি? ওদিকে ওনার কেউ থাকে?”

অহনার গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছে করছিল, আমি জানি না। কিন্তু সুভদ্র স্বরই ফুটল, “হ্যাঁ, ওর মামার বাড়ি।”

“জিরাটের দিকটায়? নাকি সোমরা বাজার সাইডে?”

অল্প হেসে হ্যাঁ না এড়িয়ে অহনা বলল, “এইমাত্র কলকাতা থেকে ফিরেছি, খুব ক্লান্ত… একটু জিরিয়ে নিই…?”

ইঙ্গিতটা বুঝেছে বিশ্বজিৎ। অপ্রতিভ মুখে বলল, “সরি দিদি। আসছি।”

ছেলেটা চলে যাওয়ামাত্র মগজে দপদপ। এবার যেন অর্ঘ্যর কথার অর্থটা স্পষ্ট হচ্ছে। কলকাতা যায়নি অর্ঘ্য। তার মানে আবার সেই পুরনো পথে…? এত প্রতিশ্রুতি, এত ডায়লগবাজি, সব ভান? ওইসব বলে কয়েকটা দিন কাটিয়ে গেল শুধু? অহনা কিচ্ছুটি বুঝতে পারল না? তার ভালবাসা এইভাবে প্রত্যাখ্যান করল সেটা বড় কথা নয়, নিজের জীবনটাকে সেই সর্বনাশের দিকেই ছোটাল শেষমেষ। এটাই বোধহয় অহনার সবচেয়ে বড় হার। ওহহ, বাঁচাতে পারল না অর্ঘ্যকে সে কোনও মতেই!

মাথা নিচু করে শোওয়ার ঘরে এল অহনা। দরজায় শেফালি। তীক্ষ্নচোখে নিরীক্ষণ করছে মেয়েকে। বলল, “ফালতু ফালতু ছেলেটাকে নিয়ে কেন ভাবছিস? যা স্নান করে নে।”

অহনা নিরুত্তর। কী তার ভাবনা, মা বুঝবে কেমন করে?

শেফালি আবার বলল, “গেছে তো আপদ চুকেছে। যে দুষ্কর্মই সে করে থাকুক, আমাদের এখানে থাকলে তো আমরাও জড়িয়ে যেতাম। ঠিক কিনা? তা ছাড়া…”

“গোঁৎ খেলে কেন? তা ছাড়া কী?”

“আমরা মায়ে-ঝিয়ে এখানে দিব্যি ছিলাম। একটা উটকো দামড়া ছেলে এসে ঘাড়ে বসে অন্ন ধ্বংস করছিল…”

“বাজে বোকো না মা। ও আমার আশাবরীর অনেক কাজ করে দিচ্ছিল।”

“আহা রে মরে যাই।… অর্ঘ্য আসার আগে আশাবরী বুঝি চলছিল না?”

“আরও ভাল করে চলত। ওর সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল, ও পাকাপাকি ভাবে এখানে থাকবে, আমরা দু’জনে মিলে আশাবরীকে অনেক বড় করব…”

“অ্যাদ্দুর গড়িয়েছে, অ্যাঁ।” শেফালি ঝনঝন করে উঠল, “সুগত তা হলে ঠিকই আন্দাজ করেছিল। সাধে কি আমি ঘি-আগুন পাশাপাশি রেখে যেতে চাইনি।”

অহনা ধাক্কা খেয়েছে একটা। কড়া গলায় বলল, “হঠাৎ সুগত পিকচারে এল কোত্থেকে?”

“তুই ভাবিস, কলকাতা গেছি বলে আলাইপুরের কোনও খবর রাখি না? সুগত এখানে এসেছিল? অর্ঘ্যকে দেখে গেছে?”

“হ্যাঁ। তো?”

“পর দিনই বেহালায় গিয়েছিল। দুঃখ করে বলল, আপনার মেয়ে কিন্তু কাজটা ঠিক করছে না। আমার ওপর রাগ দেখিয়ে ও কিন্তু একটা কেলেঙ্কারি বাধাতে চলেছে।”

কী স্পর্ধা! কী সীমাহীন নির্লজ্জতা? মা কি অন্ধ? বোবা? কালা? ওই কথাটা বলার সময় ঠাস ঠাস করে চড় কষাতে পারল না? অবশ্য মা তো বোধহয় সুগতর নোংরামিতে দোষ দেখে না? সুগত পুরুষমানুষ যে! অর্ঘ্যকে সে ভালবাসে এতে তো মা পাপ দেখবেই?

বেশ কয়েক দিন পর হিংস্র রাগটা মাথা চাড়া দিয়েছে। স্নায়ুর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিল অহনা। কীভাবে আক্রমণ শানাবে, ঠিক করতে পারছিল না।

মোবাইল বাজছে। এই সময়েই কল আসতে হয়?

মনিটরে অচেনা নম্বর। বিরক্ত ভাবেই অহনা বলল, “কে? কী চাই?”

ওপারে চাঁচাছোলা স্বর, “টিয়াডাঙা পুলিশ স্টেশন থেকে বলছি। আপনি কী অহনা চৌধুরী?”

“হ্যাঁ। কেন বলুন তো?”

“খানিকক্ষণ আগে একজন উগ্রপন্থী নেতা আমাদের থানায় এসে সারেন্ডার করেছেন। নাম অর্ঘ্য রায়। আপনি কি তাকে চেনেন?”

ক্ষণপূর্বের রাগ, বিরক্তি পলকে নিশ্চিহ্ন। অহনা উদগ্র ভাবে বলল, “হ্যাঁ চিনি, ভীষণ ভাবে চিনি।”

“উনিও তাই দাবি করছেন। ফোনটাও উনিই করতে বললেন।”

“ও। অর্ঘ্য এখন…”

“আমাদের হেপাজতে। অর্ঘ্যবাবু আপনার সঙ্গে একবার মিট করতে চাইছেন। ইউজ়ুয়ালি এই ধরনের কেসে আমরা কাউকে দেখা করতে দিই না। তবে আমরা আপনাকে চিনি… সো ইউ মে কাম। আপনাকে আমাদের কিছু কোশ্চেনও আছে… আশা করি আপনার কো-অপারেশন পাব…।”

“আমি এক্ষুনি আসছি।”

“তাড়া নেই। ইনফ্যাক্ট, রাত্রে কোনও মহিলাকে থানায় আসার জন্য বলতেও পারি না। কাল ফার্স্ট আওয়ারে অর্ঘ্য রায়কে রানাঘাট কোর্টে তোলা হবে। সো… সকাল আটটার মধ্যে এলেই চলবে।”

অসম্ভব। সারা রাত সে এখন অপেক্ষা করতে পারবেই না। যদি আজ রাতেই অহনা মরে যায়, জীবনে তো আর দেখাই হবে না! অহনা এত বড় ঝুঁকি নেয় কোন ভরসায়? তা ছাড়া এক রাতের নিদ্রাহীন প্রতীক্ষা তো হাজার বছরের চেয়েও দীর্ঘ, এ কি পুলিশ অফিসারটির ঘিলুতে আছে!

অদ্ভুত এক শিহরন বইছে অহনার সর্বাঙ্গে। পারেনি, অর্ঘ্য তাকে ছেড়ে যেতে পারেনি। পুরনো পথে ফিরতেও না। পুলিশ স্টেশন আর নদী যে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ, অহনার চেয়ে বেশি কে জানে!

এই রাত্রিবেলায় কোথায় যাবে, কেন না গেলেই নয়, ঠান্ডা গলায় শেফালিকে বলল অহনা। শেফালির বিমূঢ় দৃষ্টি মেখে বেরিয়ে পড়ল মোপেড নিয়ে।

চলেছে অহনার মোপেড। আঁধার চিরে। অভিসারে। পুলিশের গুহায়।

.

॥ ১৩ ॥

দুপুর বারোটা চল্লিশে রায় ঘোষণা করলেন বিচারপতি। কী বলবেন তা মোটামুটি জানাই ছিল অহনার। অর্ঘ্য তার প্রতিটি নাশকতামূলক কাজের দায় স্বীকার করেছে, সুতরাং সাজা তো তার হবেই। রাজসাক্ষী হয়ে বাকি কমরেডদের ফাঁসিয়ে দিলে হয়তো বেকসুর খালাসও মিলত, পুলিশ তাকে সেরকম আশ্বাস দিয়েও ছিল, কিন্তু অর্ঘ্য তো সে পথে হাঁটেনি। অতএব দণ্ডের মাত্রা যে নেহাত কমবে না, এও তো অবধারিত।

অরবিন্দও এসেছিল কোর্টে। অর্ঘ্যর মা অনেকটাই সুস্থ, তাই শুনানির সময়ে সে অনেক দিনই থেকেছে অহনার পাশে। আজ ছেলের শাস্তির পরিমাণটা শুনে সে রীতিমতো বিমর্ষ।

উকিলের সঙ্গে কথা সেরে কোর্টের বাইরে এল দু’জনে। অরবিন্দ বলল, “জজটার দয়ামায়া নেই। আরেকটু হালকা পানিশমেন্ট দিতে পারত।”

দীর্ঘ পাঁচ-ছ’মাসের ছোটাছুটির পরিসমাপ্তি হল আজ। একটা বড়সড় অধ্যায় চুকল। শরীরটা ছেড়ে যাচ্ছে যেন। অহনা একটা শ্বাস ফেলে বলল, “কিছু তো করার নেই মেসোমশাই। মেনে তো নিতেই হবে।”

“হায়ার কোর্টে গেলে হয় না? যদি খানিকটা রেমিশন মেলে? নইলে ছাড়া পাওয়ার পর আর কি মায়ের সঙ্গে ওর দেখা হবে?”

“দেখুন কী করবেন?”

“তুমিই বলো না, কী করি?” অরবিন্দর স্বরে অনুনয়, “তোমার ডিসিশনই আসল।… তুমি যা করেছ… ফ্র্যাঙ্কলি বলছি ওর নিজের দিদিও এতটা…”

অহনা মনে মনে হাসল। দিদি নয় বলেই না সে এতটা জড়িয়ে পড়েছে! অর্ঘ্য আর অহনা পরস্পরকে কী চোখে দেখে জানলে এই অরবিন্দই যে তার কৃতজ্ঞ রূপটি বদলে ফেলে ভিন্ন মূর্তি ধরবে, এও তো সত্যি। নিজের মাকে দেখেই তো বুঝছে অহনা? এত মাস হয়ে গেল, মাঝে কত কী ঘটে গেল, এখনও কি মা তার মেয়ের গায়ে কালি ছেটাতে কসুর করছে?

অহনা আলগাভাবে বলল, “আমার মত যদি নেন তো বলব অর্ঘ্যর ইচ্ছেটাকেই মেনে নিন।”

“ও তো অ্যাপিলে যেতে রাজি নয়…”

“ঠিক। ও যখন রেহাই চায় না, কেন মিছিমিছি ওর ওপর জোরজবরদস্তি চালাবেন?”

কথাটা একেবারেই পছন্দ হয়নি অরবিন্দের। পলকে মুখ গোমড়া। বলল, “দেখি, একবার খুকির বরের সঙ্গেও কথা বলি…।”

অহনা আমল দিল না। গত কয়েক মাসে অর্ঘ্যর আপনজনদের নানান চেহারা দেখল কিনা। যে যেভাবে পারে, সম্পর্ক অস্বীকার করছে। পাশে পুলিশের হ্যাপা সইতে হয়! এখন তাদের পরামর্শ যদি মূল্যবান মনে হয়, তো অতি উত্তম। অর্ঘ্যকে এখনও এরা কেউ চিনলই না! এমনকী অর্ঘ্যর বাবাও না? আগ বাড়িয়ে অহনা আর কিছু বলবেই না।

মোবাইলে সময় দেখে অহনা বলল, “আপনি কি আজ আসানসোল ফিরবেন?”

“হ্যাঁ, ইন্টারসিটি ধরব।” অরবিন্দ ঘাড় নাড়ল, “তার আগে একটু কেনাকাটা আছে…”

“বেশ তো। আমি তা হলে আসি।”

বাস ট্রাম নয়, ট্যাক্সি ধরে অহনা সোজা শিয়ালদায়। কপাল ভাল, রানাঘাট লোকাল ছাড়ছে, ভিড়টাও সহনীয়। উঠে বসার সিটও মিলেছে।

ট্রেন দমদম পেরোতেই বাতাসে হালকা ঠান্ডার আমেজ। হেমন্ত অনেকটা গড়িয়ে গেছে, অঘ্রানের শুরুতেই এবার হাওয়ায় হিমকণার আভাস। দোপাট্টাখানা গলায় জড়িয়ে নিল অহনা। বছরের এই সময়টাই মারাত্মক, একটু বেখেয়াল হলেই বিছানায় আছড়ে ফেলবে। পুজোর আগে আগে গীতালিআন্টি চলে গেলেন, স্যার এখনও শোক সামলে পুরনো জোশে ফিরতে পারেননি, অনাথ আশ্রমের অনেকটা দায়িত্ব এখনও অহনার কাঁধে। ওদিকে মিস্ত্রি লেগেছে আশাবরীতে, পুরোদমে চলছে কাজ, শেষ না হলে সোলার প্যানেল তৈরির ইউনিটটা চালু করা যাচ্ছে না। অহনার কি এই সময়ে অসুখ বাধানোর শৌখিনতা সাজে?

একটা মিনি দঙ্গল উঠেছে ব্যারাকপুরে। বোধহয় একই অফিসের, দুপুর না ফুরোতেই অফিস কাটল কী করে কে জানে! ঠেসেঠুসে বসে পড়ল কয়েকজন, চেঁচিয়ে গল্প জুড়েছে নিজেদের মধ্যে। খেলা রাজনীতি ঘুরে ঢুকে পড়ল সুগত চৌধুরীর শ্রাদ্ধকর্মে। উত্তেজিত গলায় পিন্ডি চটকাচ্ছে সুগতর।

অহনার এই হয়েছে এক ফ্যাসাদ। বেশ কিছুদিন ধরেই সুগতর ব্লু হোয়েল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস নিয়ে বাজার গরম হচ্ছিল, কত হাজারে হাজারে লোক নীলতিমির গ্রাসে পড়ে সর্বস্ব হারিয়েছে তার খবর বেরোচ্ছিল কাগজে টিভিতে। হল্লাগুল্লার চাপে পড়ে অবশেষে গ্রেফতার করা হয়েছে সুগতকে। চন্দ্রাণীও ছাড়া পায়নি, সেও এখন শ্রীঘরে। এখন রোজই সুগতর নতুন নতুন প্রতারণার কাহিনি উন্মোচিত হচ্ছে জনসমক্ষে। ফলে পথেঘাটে, ট্রেনে বাসে সর্বত্রই সুগত এখন গরম তেলেভাজা। তার রইসি, নারীদোষ, লাখো মানুষকে টুপি পরানোর ফন্দিফিকির, সবই মহানন্দে চিবোচ্ছে জনগণ। মাঝে সাঝে অহনার প্রসঙ্গও আসে বই কী। সুগতর আসলি বউটা কোথায় ঘাপটি মেরে আছে, তাই নিয়েও পাবলিকের কৌতূহল কম নয়। নানান রসালো মন্তব্যও উড়ে আসে। বউটার মাধ্যমে নাকি বিদেশে টাকা পাচার করেছে সুগত কিংবা সেই বউটাই মালকড়ি ঝেঁপে ফোঁপরা করে দিয়েছে … আরও কত কী…। এবং সুগতর উত্থানের ঢের আগে পালিয়ে আসা অহনাকে এসব গিলতেও হয়। এমনকী বাবার বন্ধু পুলিশের এক প্রাক্তন বড়কর্তার মাধ্যমে লালবাজারের এক জাঁদরেল অফিসারের কাছে আবেদনও করতে হয়েছে অহনাকে, যাতে তাকে টানাহ্যাঁচড়া না করে পুলিশ।

সুগতর ওপর ধকল যাচ্ছেও বটে। আজ এই কোর্ট, কাল ওই কোর্ট, আজ এই জেলা তো কাল ওই জেলা… চরকি খাওয়াচ্ছে পুলিশ। বেচারার ছবি বেরোয় কাগজে, সুন্দর সপ্রতিভ চেহারাটি এখন গাঁজাখোরের মতো দেখায়। অর্ঘ্য ওকে দুর্ভাগা বলেছিল? এই দিনটার কথা অনুমান করেই কি…?

নাহ, সত্যিই আর সুগতর ওপর রাগ নেই অহনার। বরং করুণাই হয়। একটু একটু মায়াও। কত গুণ ছিল, মোহমেঘ সবই ঢেকে দিল!

তবে একটা ব্যাপারে সুগতর কাছে অহনাকে ঋণ স্বীকার করতেই হচ্ছে। নীলতিমির আতঙ্কে ওরকম সমস্ত দু’নম্বরি কারবারেই এখন ভাটার টান। ফলে অহনার আলাইপুরের শ্যামাঙ্গিনীও আপাতত শীতঘুমে। উটকো উত্পাত থেকে জোর বেঁচে গেছে অহনা।

সুগতকে গাল দেওয়া ছেড়ে আবার রাজনীতিতে মত্ত হল দলটা। ঈষৎ কাটা হয়ে ছিল অহনা, স্বস্তি পেল যেন। চোখ মেলে দিয়েছে জানলার ওপারে।

বিকেল বিকেলই টিয়াডাঙা পৌঁছোল ট্রেন। মোপেডে ফিরছে অহনা। জনপদ পেরিয়ে ধরল ভাঙাচোরা রাস্তা। বুকটা চিনচিন করছিল অহনার। আসামির কাঠগড়ায় নতমস্তকে দাঁড়িয়ে ছিল অর্ঘ্য। রায় শুনেও মাথা তোলেনি। শুধু কোর্ট থেকে নিয়ে চলে যাওয়ার আগে গাঢ় চোখে অহনার পানে তাকিয়েছিল একবার, একবারই। এখনও যেন হৃদয়ের গহিন কুঠুরিতে জমে আছে সেই দৃষ্টি। কতকাল যে থাকবে!

সহসা থেমে গেছে মোপেড। আপনা আপনি। স্টার্ট দিতে চেষ্টা করল অহনা। উঁহু, মোপেড অনড়। হলটা কী?

অহনা নামল মোপেড থেকে। মিটারগুলো দেখতে গিয়েই মাথায় হাত। আজ রায় বেরোবে বলে মনটা ভারী বিক্ষিপ্ত ছিল কাল। প্রতি রাতে নিয়ম করে চার্জ়ে বসায় গাড়ির ব্যাটারি, বেবাক ভুলে গেছে! সর্বনাশ কী হবে এখন? আরও তো প্রায় এক-দেড় কিলোমিটার বাকি। ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যেতে হবে?

উপায়ও তো কিছু নেই আর। পেরোতেই তো হবে পথটুকু। মোপেড ধরে ধরে চলছে ধীরে। একটু গিয়েই টান পড়েছে দমে। একটা কালভার্ট পড়ল, মোপেড দাঁড় করিয়ে বসল অহনা। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে।

সামনেই এক দিগন্তছোঁয়া ধানখেত। পাকা ধান দুলছে বাতাসে। খেতের ওপারে অস্তগামী সূর্য। সোনালি আলো পড়ে হলুদ ধানও সোনাবরণ। কুয়াশা নামছিল খেতে, বিছিয়ে দিচ্ছিল নরম বিষাদ। নীলাভ বিষণ্ণতায় ভরে উঠছে চরাচর।

শ্রান্ত অহনার বুক নিংড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। এখনও কতটা পথ পাড়ি দিতে হবে। অহনা পেরে উঠবে কি?

ওহ, দিনটাই বড় বিশ্রী যাচ্ছে আজ! দশ দশটা বছরের জন্য অর্ঘ্য চলে গেল গরাদের ওপারে!

তা কেন? আর এক অহনা ফিসফিস করছে কানে। দিনটা কী এমন মন্দ! আর দশটা বছর পরেই তো ফিরে আসছে অর্ঘ্য।

উবে যাচ্ছে ক্লান্তি। অনেকটা স্নিগ্ধ বাতাসে ফুসফুস ভরে নিয়ে অহনা উঠে দাঁড়াল। টানল মোপেড। এইটুকুই তো পথ। মাত্র দশটা বছর।

———

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *