॥ ১০ ॥
দুপুরে লাঞ্চের পর ফেলুদা বলল, যে, যে গ্রুপ ছবিটা ও মিঃ মজুমদারের স্টাডি থেকে এনেছে, সেটা নিয়ে ওকে একবার ফোটোগ্রাফির দোকান দাশ স্টুডিওতে যেতে হবে। ‘তা ছাড়া, একবার থানায় গিয়ে সাহার সঙ্গে দেখা করাও দরকার। কতকগুলো জরুরী ইনফরমেশন চাই, সে কাজটা আমার চেয়ে পুলিসের পক্ষে অনেক বেশি সহজ। তোরা এই ফাঁকে কোথাও ঘুরে আসতে চাস ত আসতে পারিস। আমি বাড়ি ফিরে আর বেরোব না। কারণ আমার অনেক কিছু চিন্তা করার আছে। কেসটা এখনো ঠিক দানা বাঁধেনি।’
ফেলুদা বেরিয়ে গেল। কী আর করি—আমরাও দুজনে বেরিয়ে পড়লাম। বাইরে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে, হাঁটতে কোনো অসুবিধা নেই।
হোটেলের বাইরে এসে আমি লালমোহনবাবুকে বললাম, ‘আপনার একটা জিনিস এখনো দেখা হয়নি; সেটা আমি দেখেছি। সেটা হল মজুমদারের বাড়ির পিছনের ঝাউবন। অবিশ্যি আমিও গেছি মাত্র দু মিনিটের জন্য, কিন্তু তাতেই মনে হয়েছে বনটা দারুণ। যাবেন?’
‘সেটা যেতে হলে মজুমদারের বাড়ির ভিতর দিয়ে যেতে হয়?’
আমি বললাম, ‘তা কেন? ওদের বাড়িতে পৌঁছবার আগেই মেন রোড থেকে একটা রাস্তা বাঁদিকে বেরিয়ে বনের দিকে চলে গেছে—দেখেননি?’
আমরা দুজন রওনা দিয়ে দিলাম। ফেলুদার কথাটা মন থেকে দূর করতে পারছি না। ও যে কয়েকটা ক্লু পেয়েছে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু সেগুলো যে কী সেটা এখন আমাদের বলবে না। ওর হালচাল আমার খুব ভালো করেই জানা আছে। এখন ওর চিন্তা করা আর ইনফরমেশন জোগাড় করার সময়। সব সূত্র খুঁজে পেয়ে কেসটা মাথায় পরিষ্কার হলে তারপর বম্বশেলটা ছাড়বে।
পথে যেতে যেতে লালমোহনবাবু বললেন, ‘এখানে যে রহস্যটা কোথায় সেটা আমার কাছে ক্লিয়ার হচ্ছে না, তপেশ। লোকনাথ বেয়ারা খুন করে মূর্তি চুরি করে পালিয়েছে—ব্যস্, ফুরিয়ে গেল। তোমার দাদা এত যে কী সাতপাঁচ ভাবছেন! বাকিটা ত পুলিসের ব্যাপার। তারা কালপ্রিটকে খুঁজে পেলেই খেল খতম।’
আমি বললাম, ‘আপনি ফেলুদাকে এতদিন চেনেন, আর এটুকু বুঝছেন না যে, কোথাও একটা গণ্ডগোল না থাকলে ফেলুদা মিথ্যে এত ভাবত না? এক ত চোখের সামনে দেখতে পেলেন যে ওঁকে মেরে ফেলার চেষ্টা হল খাদে ফেলে। সেটা নিশ্চয়ই লোকনাথ বেয়ারা করেনি। তা ছাড়া, মিঃ মজুমদারের জীবনে একটা কেলেঙ্কারি রয়েছে। উনি নিজে একজনকে অজান্তে খুন করেছিলেন। তারপর তাঁর ব্যাঙ্ক থেকে একজন টাকা চুরি করে পালিয়েছিল। তাকে ধরা যায়নি। তারপর আপনি নিজে সেদিন শুনলেন মজুমদার একজনকে ধমক দিচ্ছেন, সেটা যে কে সেটা এখনো বোঝা যায়নি। এত রকম জিলিপির প্যাঁচ সত্ত্বেও আপনি বলছেন, কেসটা সহজ?’
সত্যি বলতে কি, আমার নিজের মনের মধ্যে সব কিছু এমন তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল যে আমি কোনোটার সঙ্গে কোনোটার যোগ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কাজেই মনে মনে ঠিক করেছিলাম যে, ভাবার কাজটা ফেলুদার উপরেই ছেড়ে দেব।
ঝাউবনটাতে একবার ঢুকেই বুঝেছিলাম যে সেটা একটা আশ্চর্য জায়গা। আজ ভালো করে দেখে আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। এটাকে ঝাউবন বলা ঠিক নয়, কারণ এখানে পাইন, ফার, রডোডেনড্রন ইত্যাদি অনেক রকম চেনা-অচেনা গাছই আছে। গাছের মাঝে মাঝে ঝোপ রয়েছে, তাতে আবার লাল নীল হলদে ফুল। আজ দিনটা মেঘলা, তাই সমস্ত বনটাই আবছা অন্ধকারে ঢাকা। মনে হয়, অজস্র থামওয়ালা একটা বিরাট গির্জার মধ্যে আমরা এসেছি। যেখান দিয়ে এখন হেঁটে চলেছি সেখান থেকে পশ্চিমে চাইলে গাছের ফাঁক দিয়ে নয়নপুর ভিলা দেখা যায়। অবিশ্যি বনের মধ্যে দিয়ে যতই এগোচ্ছি ততই বাড়িটা দূরে সরে গিয়ে গাছপালায় ঢেকে যাচ্ছে। এটা মানতেই হবে যে, এই নিস্তব্ধ দুপুরে এই ঘন বনের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে গাটা বেশ ছমছম করছিল। লালমোহনবাবু তাই বোধ হয় একবার বললেন, ‘এখানে কাউকে খুন করলে লাশ আবিষ্কার করতে মাসখানেক অন্তত লাগবে।’
আমরা আরো এগিয়ে চললাম। এবার আর নয়নপুর ভিলা দেখা যাচ্ছে না। একটা মাত্র পাখির ডাক কিছুক্ষণ থেকে কানে আসছে, কিন্তু সেটা যে কী পাখি তা জানি না।
উত্তর দিকে চোখ পড়াতে হঠাৎ দেখি মেঘ সরে গিয়ে দুটো পাইন গাছের মধ্যে দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার খানিকটা অংশ দেখা যাচ্ছে। আমি লালমোহনবাবুকে সেই দিকে দেখতে বলব বলে ডাইনে ঘুরেই দেখি ভদ্রলোক চোখ বড়-বড় করে থমকে দাঁড়িয়ে গেছেন। কী দেখছেন ভদ্রলোক?
ওঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে পূবে চাইতেই বুঝলাম ব্যাপারটা কী।
একটা গাছের গুঁড়ির পাশে একটা ঝোপ, আর সেই ঝোপের পিছনে এক জোড়া জুতো-পরা পা দেখা যাচ্ছে।
‘এগিয়ে গিয়ে দেখবে?’ ফিসফিস গলায় জিগ্যেস করলেন লালমোহনবাবু।
আমি এ প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে এগিয়ে গেলাম। ওই জুতো জোড়া আমি আগে দেখেছি।
ঝোপটা পেরোতেই ব্যাপারটা বুঝলাম।
একটা লাশ পড়ে আছে মাটিতে।
একে আমরা চিনি।
এ হল লোকনাথ বেয়ারা।
একেও বুকে ছুরি মেরে খুন করা হয়েছে, যদিও অস্ত্রটা কাছাকাছির মধ্যে নেই।
তার বদলে আছে একটা পাথরের সামনে একটা ভাঙা বোতল, আর সেই বোতলের চারিদিকে ছড়ানো গোটা ত্রিশেক বড়ি। সেই বড়ি এককালে সাদা ছিল, কিন্তু এখন জল আর মাটি লেগে সেটা আর সাদা নেই।
আমরা আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে সোজা ফিরে এলাম হোটেলে। ফেলুদাও বলল সে ফিরেছে মিনিট পাঁচেক আগে। লালমোহনবাবু ‘সেনসেশন্যাল ব্যাপার—’ বলে নাটক করতে আরম্ভ করেছিলেন। আমি ওঁকে থামিয়ে এক কথায় ব্যাপারটা বলে দিলাম।
ফেলুদা তৎক্ষণাৎ থানায় ফোন করে দিল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সাহাকে নিয়ে দুটো জীপ চলে এল, একটায় চারজন কনস্টেবল।
আমরা আবার ফিরে গেলাম ঝাউবনে যেখানে লাশ পাওয়া গিয়েছিল, সেই জায়গায়।
‘ইনিও দেখছি ছুরিকাঘাতে মৃত’, বললেন সাহা। ‘আসলে আমরা খুঁজছিলাম লোকালয়ে, ভাবছিলাম লোকটা কোনো গোপন ডেরায় লুকিয়ে রয়েছে। এই ডিসকাভারির জন্য পুরো ক্রেডিট পাবেন মিস্টার মিত্তিরের বন্ধু এবং কাজিন। সত্যিই আপনারা কাজের কাজ করেছেন।’
মৃতদেহ চলে গেল পুলিশের জিম্মায়, আমরা ফিরে এলাম হোটেলে।
‘এ যে মোড় ঘুরে গেল!’ আমাদের ঘরে এসে খাটের উপর ধপ্ করে বসে বললেন লালমোহনবাবু।
‘ঘুরেছে ঠিকই’, বলল ফেলুদা, ‘কিন্তু অন্ধকারের দিকে নয়, আলোর দিকে। এখন শুধু কয়েকটা খবরের অপেক্ষা। তারপর চুড়ান্ত নিষ্পত্তি।’
সন্ধ্যায় এল ফেলুদার টেলিফোন—সাহার কাছ থেকে। একপেশে কথা শুনে, আর ফেলুদার গোটা বিশেক ‘হ্যাঁ’ আর ‘আই সী’ আর ‘ভেরি গুড’ শুনে আন্দাজ করলাম যে খবর যা আসবার তা এসে গেছে। শেষে ফেলুদা বলল, ‘তাহলে কাল সকাল দশটার সময় সকলকে বলুন যেন মিঃ মজুমদারের বৈঠকখানায় জমায়েত হয়। নয়নপুর ভিলার সকলে এবং মাউন্ট এভারেস্টের পুলক ঘোষাল, রাজেন রায়না, মহাদেব ভার্মা আর ক্যামেরাম্যান সুদেব ঘোষ। আপনাদের উপস্থিতিও অবশ্যই এসেনশিয়াল।’