দশম অধ্যায় – দারা-বাবালাল সংবাদ
১
পঞ্জাব প্রদেশে বাবালালী নামে এক সম্প্রদায় আছে। মধ্যযুগে উত্তর ভারতে বাবালাল নামধারী একাধিক* সাধুপুরুষ আবির্ভূত হইয়াছিলেন। ইহাদের মধ্যে এই প্রবন্ধোক্ত বাবালাল (আসল নাম — লালদাস) বোধহয় সর্বপ্রাচীন। ইনি জাতিতে ছত্রী বা ক্ষত্রিয় ছিলেন; সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে (১৬০৫-১৬২৭ খ্রি) মালব প্রদেশে তাঁহার জন্ম। লালদাসের পূর্বাশ্রমের পরিচয় বিশেষ জানা যায় না। কথিত আছে একদিন চেতনস্বামী নামক একজন যোগীপুরুষের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎকার হইয়াছিল। সন্ন্যাসী বাবালালের কাছে কিছু চাল ও জ্বালানী কাঠ ভিক্ষা করিয়া রান্না চড়াইলেন; তাঁর উনুন কিংবা ইট প্রয়োজন হইল না, পায়ের গোড়ালির উপর ভাণ্ড রাখিয়া তিনি নীচে আগুন জ্বালিয়া দিলেন। যোগীর দেহে অগ্নির দাহিকাশক্তি নিষ্ক্রিয় হইল দেখিয়া বিস্ময়াবিষ্ট লালদাস স্বামীজীর পায়ে পড়িয়া তাঁহার শিষ্যত্ব প্রার্থনা করিলেন। ভোজন শেষ করিয়া চেতনস্বামী তাঁহাকে মাত্র একদানা অন্নপ্রসাদ দান করিলেন। প্রসাদ গ্রহণ করিয়া লালদাস বুঝিতে পারিলেন তাঁহার অজ্ঞানান্ধকার দূর হইয়াছে; আধ্যাত্মিক ও আধিভৌতিক জগতের জটিল রহস্যসমূহ তাঁহার জ্ঞাননেত্রে দর্পণ প্রতিবিম্ববৎ সুস্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে। ইহার পর লালদাস কয়েক বৎসর চেতনস্বামীর সহিত নানা স্থান পরিভ্রমণ এবং গুরুর কৃপায় হঠযোগ এবং রাজযোগ শিক্ষাপূর্বক অণিমালঘিমাদি অষ্টসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। লাহোরে অবস্থানকালে চেতনস্বামী এক দিন পরীক্ষাচ্ছলে চেলাকে দ্বারকাতীর্থ হইতে হরিচন্দন আনিবার হুকুম করিলেন। আজকালকার দিনে রেল-জাহাজে লাহোর হইতে দ্বারকা তীর্থ অন্তত চারিদিনের রাস্তা, মোগল আমলে কোন্ পথে কি ভাবে বাবালাল দ্বারকা প্রয়াণ করিয়াছিলেন জানা নাই। কথিত আছে আদেশমাত্র অতিসত্বর লালদাস দ্বারকা হইতে হরিচন্দন আনিয়া গুরুকে নিবেদন করিয়াছিলেন। চেলা যোগসিদ্ধ হইয়াছে বুঝিতে পারিয়া চেতনস্বামী তাহাকে আশীর্বাদ করিলেন––সাবাশ বেটা! অব্ গুরু বন্ জা! এই কাহিনী জনশ্রুতি মাত্র বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা নয়। সাধু মহাপুরুষদের কার্যাবলীর বিচার ঐতিহাসিক সমালোচনার গণ্ডির বাহিরে; সুতরাং “যথা পঠিত** তথা লিখিতং” ব্যতীত এ সমস্ত ব্যাপারে অন্য পন্থা নাই। তাঁহাদের অলৌকিক ক্ষমতায় অন্ধবিশ্বাস পৃথিবীর সর্বত্র অশিক্ষিত অতিশিক্ষিত গ্রামীণ নাগরিক সর্বশ্রেণীর লোকের মনে আবহমান কাল হইতে বদ্ধমূল; জড়বিজ্ঞান এই বিশ্বাসকে স্থানচ্যুত করিতে পারে নাই। এই বিশ্বাস ও সংস্কারগুলি উপেক্ষা করিলে ইতিহাসের পটভূমিকায় দেশ কাল ও সমাজের চিত্র ফুটিয়া উঠে না।
[* অন্য তিনজন বাবালালের মঠ পঞ্জাবের ভেরা, গুরুদাসপুর এবং পিণ্ডিদাদন জিলায় বিদ্যমান। পিণ্ডিদাদনের বাবালাল তেলীওয়ালা নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। লোকে বলে তিনি শুষ্ক ডালপালাকে অলৌকিক শক্তিবলে জীবন্ত শিশম (পঞ্জাবী নাম তেহলী) গাছ করিতে পারিতেন। এইজন্য তিনি তেহলীওয়ালা নামে পরিচিত। (Rose Glosary of Tribes and Castes, ii. 31)
** Garcin de Tassy; Historie de la Litterature Hindoui et Hindustani, Tome I, pp. 94-96.]
যাহা হউক, লালদাস গুরুর নিকট হইতে বিদায়গ্রহণ করিয়া পঞ্জাবের সরহিন্দ জিলার অন্তর্গত ধ্যানপুরে মঠ স্থাপন করিলেন। সন্ন্যাসী হইলেও তাঁহার মাথায় জটার বহর ছিল না; মাথা মুড়াইয়া ফেলিতেন বলিয়া লোকে তাঁহাকে মুণ্ডিয়া বা নেড়ে বাবালাল বলিত। দারা তাঁহার ‘শতাহৎ’* নামক পুস্তকে বাবালালকে কবীর-পন্থী বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। কিন্তু হঠযোগী মুণ্ডিত-মস্তক, শাস্ত্রজ্ঞ, মূর্তিপূজার সমর্থক সাধু বাবালালকে স্বয়ং কবীর সাহেব** কবীর-পন্থী বলিয়া স্বীকার করিতেন কিনা সন্দেহ। কবীর তাঁহার জন্মগত ইসলামী সংস্কার লইয়া হিন্দুর মূর্তিপূজার নিন্দা করিয়াছেন; উহার অন্তর্নিহিত রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা তিনি করেন নাই। অপরপক্ষে বাবালালের মতে মূর্তিপূজা নিন্দনীয় নহে; যাহারা প্রকৃত সত্যের সন্ধান পায় নাই, অবিবাহিত বালিকার ন্যায় যে পুতুলকে পুতুলের চেয়ে অধিক কিছু মনে করে, মূর্তিপূজাদি ধর্মের বহিরঙ্গ তাহাদের পক্ষে অপরিহার্য। দারার অনুভূতি এ বিষয়ে আরও প্রাণস্পর্শী। শাহজাদা তাঁহার অন্যতম পীর শাহ দিলরুবার নিকট এক চিঠিতে লিখিয়াছিলেন—
“দরু হর্ বুতে জান্ ইজ্ পিন্হান্।
বে-জের্-ই-কুপ্ফার ইমান ইস্ত্ পিন্হান্।
অর্থাৎ প্রত্যেক মূর্তির মধ্যে প্রাণ লুক্কায়িত আছে; কাফেরী বা বেইমানীর আড়ালে ইমান লুক্কায়িত আছে।
যাহা হউক, কবীর সাহেব সাম্প্রদায়িক মৈত্রী ও রাম-রহিমের অভেদ-বুদ্ধির বাণী এ দেশে প্রথম প্রচার করিয়াছিলেন। পরবর্তী ধর্মসংস্কারকগণ এবং স্বয়ং সম্রাট আকবরও এই হিসাবে কবীর-পন্থী। প্রপিতামহের পদাঙ্ক অনুসরণকারী শাহজাদা দারা এবং তাঁহার গুরুস্থানীয় বাবালালও কবীরের বাণী ও আদর্শের দ্বারা প্রভাবান্বিত হইয়াছিলেন এ বিষয়ে সন্দেহ নাই।
[* উর্দু অনুবাদ, মুস্তাবাই প্রেস, লাহোর।
** কবীর ও যোগী :-
মথবা মুড়ায় জোগী কপড়া রঙ্গৈলে’
গীতা, বাঁচি কৈ হোই গৈলে …
কবীর ও মূর্তিপূজা
পাইন (পাথর) পুজে হরি মিলে, তো মৈ পুজঁ পহার।]
২
অনিচ্ছায় ভগ্নহৃদয়ে শাহজাদা দারাশুকো কান্দাহার অবরোধ প্রত্যাহার করিয়া মুলতানের পথে ২২শে নভেম্বর (১৬৫৩ খ্রি’) লাহোরে ফিরিয়া আসিলেন। শাহজাদা আওরঙ্গজেবের সুপরিচিত রণকৌশল ও শৌর্য এবং হিন্দুস্থানের বুর্জজমিহির সাদুল্লার নীতি যে কার্যে দুই বার বিফল হইয়াছে, সম্রাট শাহজাহান দারাকে সেই দুঃসাধ্য ব্যাপারে অদৃষ্ট পরীক্ষার জন্য নিযুক্ত করিয়াছিলেন। আওরঙ্গজেবকে জব্দ করবার গোপন মতলবও হয়তো শাহজাহানের ছিল; কিন্তু দারার অপ্রত্যাশিত পরাজয়ে তিনিই অধিক বিব্রত হইলেন— ভাবী অমঙ্গলের ছায়া বরং ঘনীভূত হইয়া তাঁহার মনকে অভিভূত করিল। তাঁহার আদেশে পরাজিত দারা সর্বত্র বিজয়ী সেনাপতির ন্যায় সাড়ম্বরে সম্বর্ধিত হইলেন। কিন্তু স্নেহাতুর পিতার এই প্রলেপে দারার মনের ঘা শুকাইল না। স্বপ্নবিলাসী দারার মন বাস্তবতার প্রথম প্রচণ্ড আঘাতে সম্পূর্ণ ভাঙিয়া পড়িল; পরাজয়ের অপমান ও অবসাদ তাঁহাকে অপ্রকৃতিস্থ করিয়া তুলিয়াছিল। এক বৎসর পূর্বে অনুরূপ অবস্থায় পতিত হইয়া আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্য যাত্রার পথে হীরাবাঈর রূপের পেয়ালা পান করিয়া প্রকৃতিস্থ হইয়াছিলেন; ইহার পরে গোলকুণ্ডা-বিজাপুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও ষড়যন্ত্র তাঁহার প্রকৃতির অনুযায়ী মনের খোরাক যথেষ্ট জোগাইতেছিল। দারা ও আওরঙ্গজেবের রুচি ছিল বিভিন্ন; সুতরাং তাঁহাদের মনোব্যাধির ওষুধও স্বতন্ত্র। দারা প্রৌঢ় বয়স পর্যন্ত অধ্যয়ন, পুস্তক রচনা, সুফী ধ্যান-ধারণায় সময় কাটাইয়াছিলেন। তাঁহার ছিল ধর্মের বাতিক এবং সাধুফকিরদের সহিত তত্ত্বালাপ করিবার নেশা। বোধ হয় বিমর্ষচিত্ত দারাকে প্রকৃতিস্থ করিবার জন্য তাঁহার অনুগ্রহভাজন ফার্সি ভাষায় সুকবি মুনশী চন্দ্রভান ব্রাহ্মণ এই সময়ে সাধু বাবালালের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। এই সময় বাবালাল লাহোর শহরের বাহিরে কোতল-মেহরা* নামক মহল্লায় অবস্থান করিতেছিলেন। রায় চন্দ্রভান বাবালালের একজন ভক্ত ছিলেন বলিয়া মনে হয়। লাহোরের নিউলা** (নৌলাখা) মহল্লায় অবস্থিত চন্দ্রভানের হাভেলিতে দারা ও বাবালালের সাক্ষাৎকার সম্ভবত এই বৎসরের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহেই ঘটিয়াছিল। প্রকাশ্য সভায় সকাল বিকাল দুই বার নয় দিন পর্যন্ত বাবালাল ও দারার শাস্ত্রালাপ ও তত্ত্বকথালোচনা হইয়াছিল। বিচারের প্রারম্ভে স্থির হইয়াছিল উভয়পক্ষ যেখানে শাস্ত্রবিষয়ক কোনও কথা উদ্ধৃত করিবেন, উহার নির্ভুলতা প্রমাণের জন্য দরকারি পুস্তক হাতের কাছে রাখা হইবে। তত্ত্বজ্ঞানী হইলেও শাহজাদার পাণ্ডিত্যাভিমান কিছু কিছু ছিল। কয়েক বৎসর পূর্ব হইতেই তিনি পণ্ডিতগণের সাহায্যে হিন্দুদর্শন ও অন্যান্য শাস্ত্র অধ্যয়ন করিতেছিলেন; এবং তাঁহার পুস্তকাগারে নানা ভাষার লক্ষাধিক পুস্তক সংগৃহীত হইয়াছিল। ইহার এক অংশ সফরের সময় শাহজাদার সঙ্গে সঙ্গেই থাকিত। প্রথম কয়েক দিন পুঁথি ঘাঁটাঘাঁটি করিয়া স্বয়ং শাহজাদাই হয়রান হইয়া পড়িলেন। অবশেষে তিনি বাবালালের কাছে প্রস্তাব করিলেন পুঁথির নজির প্রমাণ দরকার নাই। ***
[* লাহোর গেজেটিয়র পুস্তকে (পৃ. ১৯২) কুই-মিরান্ নামক লাহোরের এক শহরতলীর উল্লেখ আছে। ইহাই সম্ভবত কোতলমেহরান।
** লাহোরের রেলস্টেশন এবং নূতন শহরের চৌরাস্তা (Mall) মধ্যবর্তী স্থানে নৌলাখা মহল্লা অবস্থিত ছিল (লাহোর গেজেটিয়র, পৃ. ১৬৪)। ‘নিউলা’র কোনও উল্লেখ গেজেটিয়রে নাই। বোধ হয় নৌলাখাই নিউলার শুদ্ধ নাম।
*** “If it be necessary in every question and answer to quote word for word the terms mentioned in the book present here, where will we not be car- ried by this process? Because it will be necessary to persue them, to stop for a moment to search for them. Now over conversation is aimed at the heart, it is then in our hand to take rest, we will be satisfied by it, and the truth, when dis- covered will be precious to us.”]
৩
দারা ও বাবালালের নয় দিন ব্যাপী বিতর্কের স্থান এ প্রবন্ধে হইতে পারে না। তাঁহাদের আধ্যাত্মিক জ্ঞান সংশয় এবং সাধনার বিভিন্ন স্তরের উপর আলোকপাত করিতে পারে এরূপ কয়েকটি প্রশ্নোত্তর মাত্র আমরা উদ্ধৃত করিব।*
[* সেকালে স্টেনোগ্রাফি না থাকিলেও শর্টহ্যান্ড ছিল – পাকা মুনশীরা দরবার মজলিশে উচ্চারিত প্রত্যেক শব্দ শিকস্তা অর্থাৎ ভাঙা উর্দুতে অতি তাড়াতাড়ি লিখিয়া যাইত। লাহোরে নয়দিনব্যাপী সভায় দারা এবং বাবালালের প্রশ্নোত্তর যদুদাস বা যাদব দাস ক্ষেত্রী নামক এক মুনশী তাঁহার খসড়া বহিতে লিখিয়া রাখিয়াছিলেন। দারা ও বাবালাল দুজনেই উর্দু ভাষায় কথাবার্তা বলিয়াছিলেন। এই উর্দু খসড়া কিছুদিন পরে রায় চন্দ্রভান ফার্সি ভাষায় তর্জমা করিয়া দারার অনুরোধে প্রকাশিত করিয়াছিলেন। এই পুস্তকের নাম ‘নাদির্-উল্-নুকাৎ’। কালক্রমে ইহাই পুনরায় উর্দুতে অনুবাদ হইয়াছে— অনুবাদের নাম ‘রিসালা-ই-উসুলাহ ওয়া আজুবাহ-ই দারাশুকো ওয়া বাবালাল’। সর্বপ্রথম সুপণ্ডিত উইলসন সাহেব এই পুস্তক সম্বন্ধে ইংরেজিতে প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন (Asiatic Researches, XVII, p. 296)। কিছুদিন পূর্বে ফরাসি পণ্ডিত হুয়ার্ট (Huart) এবং ম্যাসিনো (L. Massignon) একাধিক পাণ্ডুলিপির সাহায্যে এই পুস্তকের পাঠোদ্ধার এবং উহার ফরাসি অনুবাদ প্রকাশিত করিয়াছেন (Journal Asiatique, 1926 Oct. Decr.)। কিন্তু মনে হয় ‘নাদির-উল-নুকাৎ’ তিন নকলে আসল খাস্ত অবস্থায় পৌঁছিয়াছে। অনেক স্থলে প্রশ্ন ও উত্তরের মধ্যে গরমিল এবং বক্তব্য বিষয় অস্পষ্ট ও অর্থশূন্য হইয়া পড়িয়াছে। প্রকাশিত মূল ও অনুবাদ হইতে এই প্রবন্ধের উপাদান গৃহীত হইয়াছে। কিন্তু প্রশ্নগুলি বিষয়ক্রম হিসাবে মূল হইতে ভিন্ন ভাবে লিপিবদ্ধ করা হইয়াছে।]
অথ ধর্মজিজ্ঞাসা
দারা—নাদ এবং বেদের মধ্যে বিভিন্নতা কি?
বাবালাল-বাদশাহ এবং বাদশাহী হুকুমের মধ্যে যে পার্থক্য, এই উভয়ের মধ্যেও সেই পার্থক্য।
(অর্থাৎ “নাদ” ব্রহ্ম; “বেদ” তাঁহারই বাণী। ইসলামে “আল্লা” এবং “কালামুল্লা”র (কোরানশরীফ) মধ্যে বিভিন্নতার তুলনা করাই বোধ হয় প্রশ্নের উদ্দেশ্য ছিল)
দারা—পবিত্র “ওম্” শব্দ উচ্চারণ করিলে মানুষ কি স্বর্গে যায়?
বাবালাল—বস্তুত শব্দের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম ওম্ উচ্চারণ করিবার ফল এরূপই বটে। একরকম ছাপ থাকিলেও যিনি আসল ও মেকি চিনিয়া লইতে পারেন, যাঁহার জ্ঞান মলিন ও পঙ্গু হয় নাই তাঁহার সম্বন্ধে এই কথা।
দারা—”পরমাত্মা” কি এবং “জীবাত্মা”ই বা কি? “জীবাত্মা” কেমন করিয়া পুনরায় পরমাত্মার সহিত একীভূত হয়?
বাবালাল — জল হইতে মদ্যের উৎপত্তি; কিন্তু মদ যখন মাটির উপর ঢালিয়া ফেলা হয় উহার মধ্যে দূষণীয় পদার্থ— নেশা অপবিত্রতা––যাহা কিছু থাকে সমস্তই মাটির উপরিভাগে থাকিয়া যায়; কিন্তু জল মাটির নীচে গিয়া আবার বিশুদ্ধ জলে পরিণত হয়। “জীবাত্মা” যতক্ষণ মানুষের মধ্যে থাকে ততক্ষণ তাহারও সেই অবস্থা। কিন্তু দেহত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে যদি মানুষ ইন্দ্রিয়সমূহের ময়লা (অর্থাৎ কর্ম এবং উহার দোষগুণ) ত্যাগ করিয়া যাইতে পারে, সে পুনরায় “পরমাত্মা”র সহিত এক হইয়া যায়।
দারা—”আত্মা” এবং “পরমাত্মা”র মধ্যে কি প্রভেদ?
বাবালাল—মূলত কোনও প্রভেদ নাই।
দারা—তাহা হইলে শাস্তি ও পুরস্কার কেন দেখিতে পাওয়া যায়?
বাবালাল—এই সমস্ত দেহের ধর্ম (“তাসির”); দাগ দেহকেই চিহ্নিত করে–যেমন গঙ্গা এবং গঙ্গার জল।
দারা—এই উদাহরণ দ্বারা কি পার্থক্য সূচিত হয়?
বাবালাল—এই পার্থক্যের অনেক দিক আছে এবং উহা অসংখ্য। মোট কথা গঙ্গাজীর জল যদি একটি কুজাতে রাখা যায় এবং এক ফোঁটা শরাব উহার মধ্যে পড়ে তাহা হইলে ওই জল শরাবের মতো হারাম ও অপবিত্র হইয়া যায়। অপরপক্ষে যদি গঙ্গানদীতে শত সহস্র কলসি মদ ঢালিয়া দেওয়া হয়, তবুও গঙ্গার জল অপবিত্র ও দূষিত হয় না — গঙ্গাজী গঙ্গাই থাকিবেন।
দারা—”স্রষ্টা” এবং “সৃষ্ট জীব”–এই উভয়ের মধ্যে প্রভেদ কি? এই প্রশ্ন আমি কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করিয়াছি। তাঁহারা বলেন — গাছ ও বীজের মধ্যে যে প্রভেদ; ইহা কি ঠিক, না অন্য রকম?
বাবালাল — “স্রষ্টা” যেন মহাসমুদ্র; “সৃষ্ট জীব” জলপূর্ণ একটি ঘট। যদিও মহাসমুদ্র এবং ঘট—উভয়ের আধেয় বস্তু একই পদার্থ (অর্থাৎ জল), কিন্তু আধারদ্বয়ের মধ্যে পার্থক্য খুবই বেশি। সেই প্রকার স্রষ্টা স্রষ্টাই বটেন; সৃষ্ট জীব জীব মাত্র।
দারা—হিন্দুদের মধ্যে মূর্তিপূজা কি রকম ধর্ম? কে এইরূপ ব্যবস্থা প্রচলন করিয়াছে?
বাবালাল—এই প্রথা দিলকে (হৃদয়কে) মজবুত করিবার জন্য প্রচলিত হইয়াছে। যে ব্যক্তি ইহার প্রকৃত মর্ম জানিতে পারিয়াছে সে এই বাহ্যিক অনুষ্ঠানের ঊর্ধ্বে উঠিয়াছে। কিন্তু যে ব্যক্তি ইহার অন্তর্নিহিত মর্ম জানিতে পারে নাই, সে এই জাহিরী সুরৎ বা বাহ্যিক রূপকেই অবলম্বন করিয়া থাকে। যথা—ছোট ছোট অবিবাহিতা বালিকারা পুতুল লইয়া খেলা করে, কিন্তু বিবাহের পর আর পুতুলখেলা খেলে না। মূর্তিপূজাও এই রকম ব্যাপার। যে পর্যন্ত কেহ “বাতিন” অর্থাৎ আসল গুপ্তরহস্য জানিতে পারে না সে পর্যন্ত লোক বাহ্যিক আকৃতির প্রতি আসক্ত থাকে। মূর্তির ভিতর কি আছে যিনি জানিতে পারিয়াছেন, তিনি বাহিরের দিকটা বর্জন করেন।
দারা-হিন্দুদের পুস্তকে লেখা আছে, যাহারা কাশী-বারাণসীতে দেহত্যাগ করে তাহারা নিশ্চয়ই “মোক্ষ” লাভ করে। যদি ইহাই হয়, তবে ধর্মাত্মা ও পাপীর অবস্থার মধ্যে কোন পার্থক্যই থাকে না।
বাবালাল — বাস্তবিকপক্ষে “কাশী” বলিতে ব্যক্তিবিশেষের জীবনের “পূর্ণাবস্থাকে ই বুঝায়। যিনি ওই পূর্ণাবস্থায় প্রাণত্যাগ করেন তিনি নিশ্চয়ই মোক্ষ লাভ করেন।
দারা—প্রত্যেক মানুষ জীবন লাভ করিয়াছে; সুতরাং প্রত্যেকেই মোক্ষলাভ করিবে?
বাবালাল—”মহাপুরুষ” ব্যতীত কেহ জীবনের পূর্ণতা (কামনাশূন্য) অবস্থায় মরিতে পারে না; অপরত্ত মানুষ “বাসনা” লইয়াই প্রাণত্যাগ করে। “বাসনা” (খায়েশ) ও “আসল সত্তা” (ওজুদ) সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। কারণ বাসনা মানুষের মধ্যে আরও বহুবিধ বাসনা জাগাইয়া তোলে এবং এই কারণে মানুষ মোক্ষ বা নির্বাণ লাভ করিতে পারে না।
দারা—হিন্দুধর্ম মতানুসারে শ্রীকৃষ্ণ তাঁহার আসল রূপ ব্রজধামে গোপীগণের নিকট প্রকটিত করিয়াছিলেন। তাঁহার ওই রূপ মানুষ কি দেখিতে পারে?
বাবালাল––যাহারা সংসারের প্রতি আসক্ত, এই অশরীরী রূপ তাহাদের দর্শনীয় নয়;…মানুষের মধ্যে যে-সমস্ত ফকির সাধুপুরুষ দেহের মধ্যে সমস্ত বাসনাকে দমন করিয়াছেন, ভাবাবেগ স্তব্ধ অথচ প্রাণবন্ত রাখিতে জানেন—যেন নিজের মন এদিক-ওদিক না যায় এই অশরীরী রূপ কেবল তাঁহাদের পক্ষেই অভিগম্য।
দারা–রামায়ণে (অধ্যাত্ম রামায়ণ?) বলা হইয়াছে শ্রীরামচন্দ্র যখন লঙ্কা জয় করিয়াছিলেন, উভয়পক্ষে বহু সৈন্য মারা গিয়াছিল; যখন ‘আব-ই-ইয়াৎ” বা অমৃত উহাদের উপর সিঞ্চিত হইল তখন শ্রীরামচন্দ্রের সৈন্যগণ নূতন জীবন পাইয়া খাড়া হইল অথচ রাবণের ফৌজ মৃত পড়িয়া রহিল। যদি সিঞ্চিত বস্তু অমৃত না হইত, উহা সমস্ত মরা মানুষের উপর না পড়িত এবং শ্রীরামচন্দ্র অন্য মানুষ হইতে স্বতন্ত্র হইতেন, তাহা হইলে আমাদের কিছুই বলিবার থাকিত না। কিন্তু কতকগুলি বাঁচিয়া উঠিল, অন্যগুলি বাঁচিল না—উহা কেমন ব্যাপার?
বাবালাল––যেহেতু রাবণের সৈন্যগণ দিনরাত কেবল শ্রীরামচন্দ্রকেই চিন্তা করিয়াছিল এবং মরিবার সময়ও শ্রীরামচন্দ্রের ভাবনা ভাবিয়াছিল, তাহারা নিষ্পাপ কল্পনা এবং বিশুদ্ধাত্মা ব্যক্তিগণের ন্যায় মুক্ত হইয়া গিয়াছিল; সেজন্য তাঁহাদের আত্মা মৃতদেহে পুনরায় ফিরিয়া আসে নাই।
দারা—রাবণ সীতাকে হরণ করিয়া নিজগৃহে রাখিয়াছিলেন; অথচ সীতার সহিত তাঁহার কোনও সংস্রব ঘটিল না, ইহা কি রকম?
বাবালাল––বস্তুত সীতা ছিলেন মূর্তিমতী অকৃত্রিম ন্যায়, রাক্ষসের সঙ্গে তাঁহার কোনও সংস্পর্শ ঘটে নাই।
দারা—রাবণ যখন নিজগৃহে সীতাকে কারারুদ্ধ করিয়াছিলেন তখন সীতা নিশ্চয়ই অত্যন্ত ভয় পাইয়াছিলেন। তবে রাবণ এই পবিত্র ন্যায়ের ক্রোধাগ্নি দ্বারা ভস্মীভূত হইয়া গেলেন না কেন?
বাবালাল—প্রকৃতপক্ষে সীতা ছিলেন পূর্ণা প্রকৃতি (সুফী মতে “ইনসান-ই-কামিল” —রাগ-দ্বেষ-বর্জিত পূর্ণ জীব)। সুতরাং তাঁহার ক্রোধের উদ্রেক হইতে পারে না।
দারা—ফার্সি পুস্তকে লেখা আছে সৃষ্টির উপাদান চারি ভূত——মাটি, জল, অগ্নি ও বায়ু দ্বারা খোদাতালা মানুষ সৃষ্টি করিয়াছেন; পরন্তু হিন্দুদের পুস্তকে দেখিতে পাওয়া যায় মানুষ পঞ্চভূতের সমষ্টি। পঞ্চম উপাদানটি কি?
বাবালাল — পঞ্চম ভূত “আকাশ” (শব্দগুণাত্মক) যাহাকে শ্রবণ শক্তি বলা হয় এবং যাহা দ্বারা ভালোমন্দ অনুভব করিতে পারি। শ্রবণ শক্তি আমাদিগকে খোদাতালার দিকে আকৃষ্ট করে।
দারা—যে ব্যক্তির কদর (পুরুষকার) আছে তিনি প্রকৃতই অসাধারণ মানুষ; পুস্তাকাদিতে ইহাও বলা হইয়াছে যাহার কদর আছে তিনি অতিশয় সুখী, কিন্তু কেমন করিয়া ইহা ব্যাখ্যা করা যায়?
বাবালাল – কদর নিজেই খোদাতালা এবং উহা খোদাতালা কর্তৃক সৃষ্টও বটে।
দারা—উভয় ক্ষেত্রে অর্থাৎ স্রষ্টা এবং সৃষ্ট জীবের মধ্যে আমরা কেমন করিয়া ইহার অস্তিত্ব নিশ্চিতরূপে জানিতে পারি?
বাবালাল—যতক্ষণ সন্তান মাতৃগর্ভে থাকে, ততক্ষণ কদর মায়ের মধ্যে থাকে….যখন ভূমিষ্ঠ হয় তখন কদর অর্ধেক সন্তানের মধ্যে চলিয়া যায়; অপর অর্ধেক খোদার রহমত রূপে মায়ের স্তনে দুগ্ধ সঞ্চার করে। সন্তান কাঁদিয়া উঠিলেই মা দুধ দিয়া থাকেন। শিশু যখন বয়স্ক হইয়া উঠে, রিপু ও বাসনার সহিত বিশেষ ভাবে পরিচিত হয় এবং ভালোমন্দের সংস্পর্শে আসে, তখন সে স্বয়ং পূর্ণ কদর হইয়া যায়। কারণ খোদাতালা ভালোমন্দের বহু ঊর্ধ্বে।
দারা—”দিল” (অন্তঃকরণ) যাহা দেখা যায় না, তাহার রূপ কি প্রকার?
বাবালাল––উহা বায়ু প্রবাহের ন্যায়।
দারা—’দিলে”র কার্য কি?
বাবালাল––ইহা আমাদের মনের দালাল (মন এবং ইন্দ্রিয়-গ্রামের মধ্যস্থ)।
দারা—দুনিয়ার মানুষ মাত্রেই শরীরের উপাদানভূত শক্তিসমূহকে বলবান করিবার নিমিত্ত পান, আহার, দর্শন, শ্রবণ, শয়ন ইত্যাদি কার্যে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গসমূহ পরিচালনা করে, এমন কি যাঁহারা বিশুদ্ধাত্মা তাঁহারাও এই সমস্ত বিষয়ে ইহাদের অর্থাৎ প্রাকৃত জনের সমধর্মী — যদিও মাত্রায় কিছু কম। তাহা হইলে সাধারণ মানুষ এবং বিশুদ্ধাত্মা ব্যক্তিদের মধ্যে পার্থক্য কি?
বাবালাল-মনের অবস্থার বিভিন্নতাই পার্থক্যের পরিমাপ। যাঁহারা বিশুদ্ধাত্মা তাঁহারা মনের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখেন এবং সাংসারিক ভাব ও চিন্তা পরিহার করেন। উদাহরণ—একজন যুবা এবং একটি বালক ইন্দ্রিয়াদির ব্যাপার অর্থাৎ ভোজন শয়ন দর্শন শ্রবণ ইত্যাদি কার্য সম্বন্ধে সমধর্মী; কিন্তু তৎসত্ত্বেও উহাদের মধ্যে পার্থক্য এই বিষয়ে দেখা যায়, যদি একজন অপরিচিত স্ত্রীলোক একটি বালককে কোলে করে উহা আপত্তিকর হয় না; কিন্তু পরিবারের সহিত অপরিচিত কোনও যুবক যদি তাহার প্রতি দৃষ্টিক্ষেপ করে তাহা হইলে শত পাপ হয়। তদ্রূপ যাঁহাদের আত্মা পাপশূন্য তাঁহাদের অবস্থা শিশুর মতো নিষ্পাপ।
দারা—কোন্ অবস্থায় বলা যায় ফকির দুনিয়া হইতে ফারেগ (বন্ধনমুক্ত) হইয়াছে। বাবালাল – প্রাণী মাত্রই ভোজন, পান, দর্শন, শ্রবণ, শয়ন ইত্যাদি নিত্যই করিয়া থাকে। তাহারা এ সমস্ত বিষয়ে অসহায়ভাবে আসক্ত এবং বদ্ধ। কিন্তু যিনি এই সমস্ত কার্য অনাসক্তভাবে করিয়া থাকেন এবং ভোজনাদির অভাব ঘটিলেও যিনি নির্বিকার থাকিতে পারেন, তাঁহাকে আমরা দুনিয়া হইতে “ফারেগ” বা মুক্ত মনে করি।
দারা—মালিক (খোদাতালা) বান্দার এবাদৎ (প্রার্থনা ও ধর্মকার্য) কবুল করিয়াছেন কি না কেমন করিয়া জানা যায়?
বাবালাল––ফকির যদি নিজের ফকিরীর বড়াই না করিয়া বলে–আমার এবাদৎ কিছুই নয়, অতি সামান্য; তখন আমাদের বুঝা উচিত এই ব্যক্তি যাহা হউক কিছু কাজ করিয়াছে। অন্যথা যে ধর্মকার্য করিয়াছে বলিয়া আত্মপ্রসাদ অনুভব করে এবং এ সম্বন্ধে বিশেষ সচেতন, তখনই আমরা মনে করিব এই ব্যক্তির এবাদৎ তাহার কাছেই রহিয়াছে—উহা কবুল হয় নাই (ইহা সুফীদিগের রীয়া বা আত্মাভিমান সম্বন্ধে প্রশ্নের উত্তর)।
৪
শাহজাদা প্রকৃত জিজ্ঞাসুর ন্যায় শ্রদ্ধা ও সহানুভূতির সহিত বাবালালের সঙ্গে নানাবিষয়ক তত্ত্ব আলোচনা করিয়াছিলেন। ইহা ‘তজুক-ই-জাহাঙ্গীরী’ পুস্তকে বর্ণিত বাদশাহী দরবারে হিন্দু পণ্ডিতগণের মুণ্ডপাত, অথবা কবি ভারতচন্দ্র কল্পিত ধর্মবিষয়ে জাহাঙ্গীর কর্তৃক ভবানন্দ মজুমদারের জেরা ও মজুমদারের নির্ভীক পাল্টা জবাব নহে। এই সাক্ষাৎকারের ফলে দারা পরাজয়ের গ্লানি ভুলিয়া কিছুদিন পরেই একাগ্রমনে শাস্ত্রালোচনা এবং হিন্দুদর্শনাদি অনুবাদের কার্যে আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন। অপর পক্ষে বাবালাল পাইয়াছিলেন একজন ভক্তিমান উপযুক্ত শিষ্য।*
বহুকাল হইতে শুনিয়া আসিতেছি, হিন্দু ও মুসলমান একেবারে বিপরীতধর্মী। তেল আর জলের মতো দুই সম্প্রদায় কিছুতেই মিশ খাইবে না। এ বিষয়ে মোল্লা ও পণ্ডিত উভয়েই একমত। বিরোধে ঘৃতাহুতি দেওয়া যত সহজ, হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ধর্মে সাম্যমৈত্রীর মূলসূত্র আবিষ্কার করিয়া সমাজে ও রাষ্ট্রে উভয়ের মিলন কার্যকরী করিয়া তোলা তেমনই কঠিন ও বিঘ্নসঙ্কুল। বিংশ শতাব্দীর ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষবহ্নির ধ্বংসলীলা দেখিয়া মনে হয়, ভারতবর্ষে কবীর নানক, আকবর-আবুলফজল, দারা-বাবালাল, মজহর-রামমোহন** বৃথাই জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। বৃথাই গান্ধী-রবীন্দ্রনাথ ঐক্যের বাণী প্রচার করিতেছেন। এই সাম্প্রদায়িক ব্যাধির চিকিৎসাবিভ্রাটে ঐতিহাসিক স্থিরচিত্তে বসিয়া শুনিতেছে ইতিহাসের সেই অনাহত ধ্বনি—”নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে অয়নায়”—অন্য পথ নাই! আকবরের “সুলহ্-ই-কুল” (Peace with all) ব্যতীত হিন্দু-মুসলমানের দ্বিতীয় পন্থা নাই।
মনের বন্ধনদশা না ঘুচিলে সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা এ দেশে স্থায়ী হইবার নয়। শাহজাদা দারার নিগমবোধ প্রাসাদ দিল্লি নগরীর ধূলায় মিশিয়া গিয়াছে; কিন্তু তাঁহার উদাত্ত নিগমবাণী আজও ভারতের আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হইতেছে। দারার ছিন্নমুণ্ড হুমায়ু-মরার মিনার হইতে আজও যেন সকরুণ স্বরে আজান দিতেছে— “বিসমিল্লাহু…
তাঁহারই নামে যাঁহার কোনও নাম নাই, কিন্তু যিনি যে নামে ইচ্ছা নিজকে প্রকটিত করেন; (দৃশ্যত) পরস্পর-বিরোধ ভাবাপন্ন ইসলাম ও হিন্দুধর্ম জুলফদ্বয়ের (অলকগুচ্ছ) ন্যায় যাঁহার নিরুপম মুখমণ্ডলে শোভা পাইতেছে, অথচ উভয়ের মধ্যে কোনও একটি পর্দার মতো তাঁহার মেহেরবান চেহারাকে ঢাকিয়া ফেলে নাই; ইসলাম ও হিন্দুধর্ম উভয়ই যাঁহার তালাশে ফিরিতেছে…।” ***
ইতিহাস কবির সুরের প্রতিধ্বনি তুলিয়া বলিতেছে, “রে মৃত ভারত, শুধু সেই এক আছে, নাহি অন্য পথ।“
[* দারা মুখ্যত হজরত মোল্লা সাহ বদশীর মুরীদ হইলেও তত্ত্বজ্ঞান আহরণে তিনি ভ্রামরী বৃত্তি অবলম্বন করিয়াছিলেন। তাঁহার একাধিক গুরু ছিল। বম্বে শহরের প্রিন্স অব ওয়েলস মিউজিয়মে দারার গুরুবৃন্দের একটি চিত্র দেখিয়াছিলাম। উহার মধ্যে একটি বাবালালের ছবি বলিয়া মনে হয়।
**মির্জা জান-জানান্ মজহর দিল্লিবাসী ছিলেন। তাঁহার জন্ম ১৭০১ খ্রিস্টাব্দে, ৮০ বৎসর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন। তিনি এক প্রসিদ্ধ সুফী-সাধক ও কবি ছিলেন। তাঁহার জীবনী ও রচনাবলী পড়িলে মনে হয়, শাহজাদা দারা যেন দ্বিতীয় বার দিল্লিতে আবির্ভূত হইয়াছিলেন।
*** দারা-কৃত ‘মজমুয়া-অল্-বহারিন’ (দুই সাগর-সঙ্গম) পুস্তকের নমস্ক্রিয়া হইতে উদ্ধৃত।
[প্রবাসী––জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ ও অগ্রহায়ণ ১৩৫৩ সংখ্যায় পূর্ব তিনটি অধ্যায় প্রকাশিত হইয়াছে।]]