১০. দামিনী সেদিন শুইয়াই ছিল

দামিনী সেদিন শুইয়াই ছিল। আগের দিন উপবাসে গিয়াছে, এঁটো-কঁটা নাই বাসন মাজা নাই; আর ঘরেও আপনার বলিতে কিছু নাই, যাহা দিয়া নূতন করিয়া উনান জ্বালে। যাহা আছে, তাহা সুবলের দেওয়া, কিন্তু সে স্পর্শ করিতে মন চাহিতেছিল না; বিশেষ করিয়া গোষ্ঠর সেই নির্লজ্জ খাওয়াটায় পেটের জ্বালার উপর তাহার ঘৃণার অন্ত ছিল না।

এক-একবার মনে জাগিয়া উঠিতেছিল আত্মহত্যার প্রয়াস; আবার মনে হইতেছিল, ওই উপচারে পরিপাটি করিয়া উদর পূর্ণ করিয়া খায়, সুবলকে ডাকিয়া পাঠায়, তাহার মুগ্ধ নয়নের আরতিতে সে নববধূর মত হইয়া ওঠে।

পরক্ষণেই মনে জাগে দারুণ ঘৃণা নিজের দেহের উপর, অক্ষম নির্লজ্জ স্বামীর উপর, দুনিয়ার ক্ষুধার উপর, সমস্তগুলার বীভৎসতা তাহাকে অতি কঠোরভাবে পীড়া দেয়। দীর্ঘদিনের উপবাসে ক্ষুধা তাহার ছিল না, কাজেই ওই আহার্যগুলার প্রতি কোনো আকর্ষণও তাহার কাছে ছিল না; ছিল শুধু দুর্বল চিত্তে অর্থশূন্য চিন্তা।

সহসা পিছনের সেই ছোট জানালাটায় একটা শব্দ হয়, খস–স খস–স।

দামিনী চমকিয়া সেদিকে চায়; দেখে, শিকের ফাঁক দিয়া একখানা কাপড় আগাইয়া আসে; চওড়া খয়েরপাড় শাড়ি একখানা।

দামিনী খয়েরপাড় শাড়ি পরিতে ভালবাসিত।

দামিনীর বুকে একটা লঘু চকিত ভাব জাগিয়া ওঠে; বক্ষস্পন্দন অকারণে দ্রুত হইয়া ওঠে, সে এ-পাশ ও-পাশ তাকায়, মনে হয়, ওই অন্ধকার কোণে দাঁড়াইয়া কে বুঝি দেখিতেছে।

সে বুঝিতে পারে কাপড়খানার ওপারে কে, তাহার মনের রুচিটি এমন নিখুঁতভাবে জানে। কে। তাহার মনে পড়ে কোন্ গাছটির আম সে বেশি ভালবাসিত, কোন্ কুলে তাহার রুচি বেশি, সে জানে কে। দামিনী ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিল, শব্দ করিতে শঙ্কা হয়, কে হয়ত আড়ি পাতিয়া আছে।

একবার সে কোমল মনোহর বসনখানার পানে তাকায়, আর একবার চায় আপন অঙ্গের ওই শীর্ণ ছিন্ন মলিন বসনখানার পানে।

সহসা আপন মনেই দুইটা আঙুল দিয়া নিজের পরনের কাপড়খানা ঘষে; জীর্ণ, অতি কর্কশ কাপড়খানা; আঙুল দুইটার ডগা জ্বলিয়া ওঠে, কাপড়খানা ছিড়িয়া যায়।

তাহার চক্ষে একটা বিচিত্র জ্বলজ্বলে দৃষ্টি ফুটিয়া ওঠে, সারা অঙ্গে কাঁটা দিয়া ওঠে।

একটা লঘু কোমল শব্দ হয়, কাপড়খানা ঘরের মেঝের উপর আসিয়া পড়িল। ওই লঘু শব্দেই দামিনী চমকিয়া উঠিল।

কাপড়খানার অন্তরাল হইতেই জানালাটার ওপাশে একখানা মুখ চকিতে দেখা যায়; পরমুহূর্তেই সে সরিয়া গিয়াছে।

দামিনীর অনুমান মিথ্যা নয়, সে সুবলই।

দামিনী বসিয়া বসিয়া ভাবে আর আঙুল দিয়া কাপড়খানা ঘষে।

কোমল, মসৃণ। ধীরে ধীরে সে কাপড়খানা আপন হাতের বাইরের উপর ঘষে, কাপড়খানার কোমলতার একটা মধুর অনুভূতি আসে; আর ওই দামিনীর শখের পাড়খানি, সুন্দর, চোখ জুড়াইয়া যায়।

দোষ কি?

কতজনের কথা মনে পড়ে; শত শত দৃষ্টান্ত তাহার মনে আসিয়া জাগে।

ওই ছোটলোক পাড়ার উহারা!

উহাদের নয় এই স্বভাব; কিন্তু এই সৎ-জাতি, ইহাদের মাঝেও তো অভাব নাই। ওই খেঁদীর অঙ্গে পয়েন্টসম্যানের দেওয়া উপহারের অন্ত নাই; সে কথা জানেও তো সকলে, দেীও তো গোপন করে না, তাহার তো ইহাতে লজ্জা নাই, সে তো প্রকাশ্যেই বলে, সগ্গে আমার কাজ নাই ভাই, সেথায় না হয় তারাই যাবি; হেথায় তো খেয়ে পরে বাঁচি।

খেঁদীর নয় রক্ষক নাই, কিন্তু ওই দাসী? তাহার তো স্বামী আছে—ওই হাঁপানি রোগী বাবুলাল; তবুও তো হাজারিবাবুর পয়সা নেয় সে। সে বলে, সতীগিরি ফলাতে গেলে তো স্বামীকে শুকিয়ে মারতে হবে; তা এতে যদি ও-ও বাঁচে, আমিও বঁচি, সেই আমার ভাল।

চিন্তায় চিন্তায় মন আজ মুখর হইয়া ওঠে, সে বলে, আর ওই যে মানুষটি, যে আমার জন্য সব ত্যাগ করিয়া হেথায় পড়িয়া আছে, না বলিতে, না জানাইতে অপরাধীর মত গোপনে সব। জানিয়া, গোপনে গোপনে যত পূজা যোগাইয়া যায়, তাহার পানে চাহিবার কি কোনো অধিকার নাই?

দামিনী কাপড়খানা তুলিয়া লয়।

কিন্তু কেমন একটা অস্থিরতা বুকের মাঝে জাগিয়া ওঠে, হৃৎপিণ্ডটা বুকের মাঝে ধকধক করে, বাহির হইতেও যেন সে শব্দ শোনা যায়।

সঙ্গে সঙ্গে আর একখানা মুখও তাহার বুকের মাঝে জাগিয়া ওঠে, দুঃখী স্বামীর ম্লান মুখখানি, তাহারই দিকে অতি নির্ভরশীল দৃষ্টিতে চাহিয়া আছে। সে তাহাকে সামগ্ৰী সম্ভারের উপহারে সুখ দিতে পারে নাই, কিন্তু তাহার বুকের একবিন্দুও তো দিতে বাকি রাখে নাই!

বাহির-দরজা খোলার শব্দ হয়; দামিনী চমকিয়া কাপড়খানা তাড়াতাড়ি একটা শূন্য হাঁড়ির গর্ভে লুকায়।

ও বউ, কাপড় এনেছি, কাপড়।

দামিনী চমকিয়া দরজায় খিল বন্ধ করিতে যায়, কিন্তু তাহার পূর্বেই ভেজানো দুয়ার খুলিয়া ছোট মিস্ত্রি সম্মুখে দাঁড়াইয়া হাসে, হাতে তাহার একজোড়া শাড়ি। দামিনী পাশের দেওয়ালে ঠেস দিয়া দাঁড়ায়, যেন ওই দেওয়ালের মাঝে গিয়া লুকাইতে চায়, সর্বশরীর থরথর করিয়া কাপে।

কাপড়খানা মেঝের উপর ফেলিয়া দিয়া ছোট মিস্ত্রি বেশ নরমভাবেই কহে, দেখ, পাড়ের কি বাহার! জানিতে পারিবে করিলে ব্যবহার।—বলিয়া সে ফ্যা-ফ্যা করিয়া হাসে।

কুৎসিত বীভৎস হাসি, কুৎসিত ইঙ্গিত করে, ইঙ্গিতে যেন দেনা-পাওনার পূর্ণ স্বরূপ প্রকট। হইয়া ওঠে, সে অতি বীভৎস, অতি ভীষণ।

মানসনেত্ৰে সুবলের সলাজ মুখখানাও অমনই বীভৎস ভীষণ হইয়া ওঠে।

সারা অঙ্গ তাহার যেন মোচড় দিয়া ওঠে, কণ্ঠে তাহার স্বর ফোটে না, কিন্তু আর সে সহিতেও পারে না; সে সর্বশক্তি একত্ৰিত করিয়া দুয়ারটা দড়াম করিয়া মিস্ত্রির মুখের উপরই বন্ধ করিয়া দিয়া হাঁপায়। ওপাশে মিস্ত্রির গলা শোনা যায়।

ভয় কি মাইরি, তুমি হুকুম কর, সোনায় অঙ্গ মুড়ে দেব, আর ও শালাকে বল তো আজই ওকে তাড়াই।

উত্তর কেহ দেয় না; ছোট মিস্ত্রি আপন মনে গান করিতে করিতে আপন ঘরে চলিয়া যায়, দরজা খোলার শব্দ পাওয়া যায়।

দামিনীর আর লজ্জার আত্মগ্লানির পরিসীমা থাকে না, অশিক্ষিতা সে, সুস্পষ্ট কথার যুক্তি তাহার মনে জাগে না, কিন্তু নারী, নারীত্বের অপমানবোধ তাহার জন্মগত সংস্কার; সে বোধ তাহার আছে; প্রলোভনে বশবর্তী হইয়া সুবলের কাপড়খানা বুকে করিয়া আত্মগ্লানিতে তাহার অন্তর যেন পুড়িয়া যায়, আর ওই পশুটা তাহাকে যে নগ্ন বীভৎস অপমান করিয়া গেল, তাহার জন্য ক্ষোভ আর লজ্জার তাহার অন্ত ছিল না। দামিনী মেঝের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া ফোঁপাইয়া ফোঁপাইয়া কাঁদে।

বাক্যহারা মন তাহার তখন বলিতেছিল, মা ধরণী, দ্বিধা হও মা। মাটির দিকে নিবদ্ধ দৃষ্টি বুঝি দ্বিধাবিভক্ত মৃত্তিকার অন্তরালে ধরণীমায়ের বিস্তৃত কোলের প্রতীক্ষায় ছিল; কিন্তু নিশ্চলা অকরুণ ধরণী দ্বিধা হয় না; বোধ করি শক্তিমত্ত সন্তানগুলার দম্ভের পদাঘাতে সে আজ বেদনায় মূৰ্ছিতা, চৈতন্যহীনা।

মৃদু বায়ুপ্রবাহে সহসা তাহার নাকে আসে ওই নতুন কাপড়ের গন্ধটা, সে মুখ তুলিয়া তাকায়।

অরুদ্ধ ঝাপসা দৃষ্টির সম্মুখে ওই রক্ত-রাঙা পাড়খানা মনে হয় যেন নাগপাশ, যেন অন্তহীন বেষ্টনে দামিনীকে বাঁধিতে আসে; আর হাঁড়িটার ভিতরে খয়রা রঙের কাপড়খানা যেন বিবরের নাগের মত কুণ্ডলী পাকাইয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া ফেরে।

দামিনীর দম বন্ধ হইয়া আসে যেন, সত্যই সে আপন দেহের সর্বাঙ্গে একটা কঠিন বন্ধন বেষ্টনী অনুভব করে; তাহার চোখ দুইটা কেমন বড় হইয়া ওঠে।

সে উন্মাদের মত এ বন্ধন-মুক্তির উপায় খোঁজে, চোখে পড়ে তার কুলুঙ্গির উপরে দেশলাইটা।

দামিনী ব্যগ্ৰ বাহুপ্রসারণে দেশলাইটা চাপিয়া ধরে; যেন উল্কামুখ গরুড় সে।

ও-পাশ হইতে কেরোসিনের ডিবাটা টানিয়া আনে।

একটা বিশ্রী পোড়া গন্ধ!

সে গন্ধে ছোট মিস্ত্রি বাহিরে ছুটিয়া আসে; চোখে পড়ে দামিনীর রুদ্ধ দ্বারের সঙ্কীর্ণ ফ্র্যাক দিয়া অনর্গল ধূমশিখা বাহির হইতেছে।

সে নিশ্চলভাবে আপন বারান্দায় দাঁড়াইয়া দেখে, চোখ দুইটা বিস্ফারিত, চিৎকার করতে কণ্ঠ ফোটে না।

মনে হয়, ওই রাঙা-পাড় কাপড়খানা সুতায় বোনা ছিল না, আগুনের শিখায় বোনা ছিল; সেই আগুন ওই ঘরের মাঝে সমস্ত গ্ৰাস করিয়া লেলিহান শিখায় জ্বলিতেছে।

সে আগুন যেন সমস্ত গ্রাস করিবে, তাহার উত্তাপও যেন সে অনুভব করে, সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজিয়া ওঠে; ভয়ার্ত হইয়া মিস্ত্রি পলাইয়া যায়।

কিছুক্ষণ পরেই গোষ্ঠ আসে টিফিনের ছুটিতে জল খাইতে, হাতে একটা খাবারের ঠোঙা; গত রাত্রের ব্যবহারের জন্য অনুতাপ করিয়া দামিনীর জন্যই খাবারটা আনিতেছিল, ভোরবেলা সেই খাবারগুলা খাইয়া তাহার নিজের বেশ ক্ষুধা ছিল না। কি বলিয়া দামিনীর কাছে মাফ চাহিবে তাহার কত কথাও মনে জাগিতেছিল।

বাড়িতে ঢুকিয়াই ওই বিশ্রী গন্ধে সে থমকিয়া দাঁড়াইয়া চারিপাশে চায়, দেখে তাহারই রুদ্ধ দুয়ারের ফাঁক দিয়া অনর্গল কালো ধোঁয়ার রাশি।

খাবারের ঠোঙা ফেলিয়া দিয়া সে ছুটিয়া আৰ্তকণ্ঠে ডাকে, ওগো! ওগো!

কেহ সাড়া দেয় না, গোষ্ঠ উন্মত্তের মত দুয়ারে ধাক্কা মারে, উন্মত্ত ধাক্কায় দরজাখানা ভাঙিয়া পড়ে।

ধূমকুণ্ডলীর মাঝে দামিনী নিশ্চল দাঁড়াইয়া, দৃষ্টি তাহার স্থিরভাবে নিবদ্ধ, সম্মুখে চরণপ্রান্তে ধূমোদারী এক অগ্নিস্থূপের উপর ছোট ছোট শিখাগুলি যেন তাহার আরতি করিতেছে, অগ্নিশিখার আভায় দীপ্ত মূৰ্তিখানি যেন ওই অগ্নিশিখায় স্নান করিয়া উঠিয়াছে।

গোষ্ঠ ভাল করিয়া চাহিয়া দেখে, একটা কাপড়ের স্তৃপ জ্বলিতেছে, আরও জ্বলিতেছে আহার্য-সামগ্রী।

গোষ্ঠ ব্যস্ত হইয়া কহে, এ কি, কাপড় পুড়ছে যে!

সে একটা পাত্ৰ লইয়া জল আনিতে ছোটে কিন্তু দামিনী তাহার হাত ধরিয়া বাধা দিয়া বলে, না।

গোষ্ঠ বলে, সে কি?

হ্যাঁ, তুমি তো দাও নাই।

গোষ্ঠ দামিনীর পানে চায়, কথাগুলার সূত্র যেন সে পাইয়াছে অনুভব করে, কিন্তু প্রত্যক্ষ হয় না।

দামিনী সহসা গোষ্ঠের পায়ে আছাড় খাইয়া পড়িয়া কাঁদে।

গোষ্ঠ তাহার হাত ধরিয়া তোলে, অশ্রুমুখী নারী তাহার দুইটি হাত ধরিয়া কাতর কণ্ঠে কহে, ওগো, পরতে কাপড় আর খেতে ভাত তুমি আমায় দিও গো।

গোষ্ঠ দামিনীর অঙ্গপানে চায়।

ছিন্নবাসা নারীর লজ্জা আজ অতি করুণভাবে সুপ্রকট হইয়া চোখের উপর ফুটিয়া ওঠে।

দগ্ধ কাপড়ের গাদার পানে আঙুল দেখাইয়া গোষ্ঠ পুরুষকণ্ঠে কহে, কে, দিলে কে?

ওই অজ্ঞাত হস্তের বস্ত্ৰদানের অন্তরালে সে বস্ত্রহরণের প্রয়াস দেখিতে পায়।

তা আমি জানি না গো, ওই জানালা দিয়ে গোষ্ঠর মূর্তি দেখিয়া সে শিহরিয়া উঠিল; অজ্ঞাতে একটা গোপনতার প্রয়াস তার ভীত মনকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল।

তাই পুড়িয়ে দিলে?

হ্যাঁ।

গোষ্ঠ যেন নিশ্চল পাষাণ হইয়া গেল, তাহার অন্তর-পুরুষ তাহাকে নিদারুণ ধিক্কারে মূক করিয়া দিল।

লজ্জার গ্লানির আর পরিসীমা থাকে না, তাহার সে লজ্জা, সে ধিক্কার দূতসভায় যাজ্ঞসেনীর বসনাকর্ষণে নিশ্চল অক্ষম পাণ্ডবদের চেয়ে বোধ করি কম নয়।

সে বসিয়া ভাবে কত কি। কে সে দুঃশাসন?

আক্রোশ গিয়া পড়ে সুবলের উপর, তাহার মন বলে, এ সেই। গোষ্ঠ ঝাড়া দিয়া ওঠে, তাহার সে ভঙ্গিমার মাঝে প্রতিহিংসার ভয়াল রূপ সুপ্রকট হইয়া ওঠে।

দামিনী তার হাত ধরিয়া কহে, কোথা যাচ্ছ?

খুন করব শালা মহান্তকে।

দামিনী শিহরিয়া কহে, সে নয়, না না, তুমি যেয়ো না।-বলিয়া সে স্বামীকে দুই হাতে প্ৰাণপণে জড়াইয়া ধরিল।

গোষ্ঠ তাহার একটা হাত চাপিয়া ধরিয়া কহে, কে তবে?

দামিনী কাতর কণ্ঠে কহে, ওগো, আগে নিজের দোষ ভাব, তুমি আমায় দিলে, ভালবাসলে। কার সাধ্যি যে

ক্ষোভে, ক্রোধে, অভিমানে তাহার কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া যায়, চোখ দিয়া ঝরঝর করিয়া অশ্রুর বন্যা বহিয়া যায়।

গোষ্ঠও আর ঠিক থাকিতে পারে না, নিদারুণ দুঃখে, লজ্জায় দামিনীর বুকে মুখ লুকাইয়া কাঁদে।

স্বামীর অশ্রুতে দামিনীর নারীহৃদয় গলিয়া যায়, সে বেশ আবদার-ভরা সহজ কণ্ঠে কহে, তুমি থাকতে আমার দুঃখ কি, আমার অভাব কিসের? নাও, ছাড়, জল খেতে দিই।

গোষ্ঠ স্ত্রীকে ছাড়িয়া দেয়, কিন্তু সে এমন সহজ হইতে পারে না; অক্ষমতার আত্মগ্লানিতে তাহার অন্তর-পুরুষ পাগল হইয়া উঠিয়াছে। দাওয়ায় আসিয়া বসিয়া ভাবে, কে সে দুঃশাসন?

দামিনী ঠিক বলিয়াছে, তাহার অক্ষমতা, ওই অভাব, ওই নির্মম কদৰ্য অভাবই সেই দুঃশাসন।

অভাবের উপায় খোঁজে সে।

উপায় মেলে না, নিরুপায় ক্ষোভে সে বলিয়া ওঠে, এর চেয়ে মরণ ভাল আমার।

বড় মিস্ত্রি আসিয়া বাড়ি ঢুকিল, গন্ধটার রেশ তখনও যায় নাই, বুড়া নাক সিটকাইয়া বলিয়া ওঠে, উঃ, কি পুড়ছে?

কেহ কথার উত্তর দিল না, বুড়া ধীরে ধীরে আসিয়া গোষ্ঠর কাছে দাঁড়াইল, এক জোড়া শাড়ি গোষ্ঠর সম্মুখে ফেলিয়া দিয়া কহিল, বউকে দিস।

সঙ্গে সঙ্গে গোষ্ঠর সমস্ত আক্রোশ গিয়া পড়ে ওই বুড়ার উপর, বাঘের মত লাফ দিয়া ফিটারের উপর পড়িয়া হাতের নখ দিয়া যেন তাহার গলার নলীটা ছিড়িয়া দিতে চাহিল।

আজন্ম লোহা আর আগুনের সঙ্গে লড়াই-করা সবল দেহ, কঠিন হাত দুইখানা লোহার মত কঠিন, ভাইস-যন্ত্রটার মত ওই হাতের কঠিন নিষ্করুণ পেষণে গোষ্ঠর হাত দুইখানা যেন মড়মড় করিয়া উঠিল, আপনা হইতেই গোষ্ঠর হাত দুইখানা শিথিল হইয়া পড়িল।

বুড়া আপনাকে মুক্ত করিয়া লইয়া আপন ঘরের বারান্দায় গিয়া ওঠে, ভাবলেশহীন সেই নিম্প্ৰভ কঠিন মুখ, একটি রেখারও ব্যতিক্ৰম নাই।

দুর্বল গোষ্ঠ এ-পাশে নিরুপায়ে গালি পাড়ে, লজ্জা করে না, বুড়ো ভেড়া, পরের পরিবারকে কাপড় দিতে, এই দেখ, তোর কাপড়ের কি দশা হয়, পুড়ক আগুনে।

কাপড়খানা আগুনে দিবার জন্য সে হাতে করিয়া তোলে। ফিটার-বুড়া এতক্ষণে ঘুরিয়া আসিয়া বাধা দিয়া কহে, আরে বেটা, বাপ বেটীকে কাপড় দেয় না, তত্ত্বতল্লাশ করে না?

হাতের কাপড় গোষ্ঠর হাতেই থাকিয়া যায়, সে হাঁ করিয়া ফিটার-বুড়ার মুখের পানে চাহিয়া থাকে, যেন কথাটা বুঝিতে পারে না। দামিনী নিঃসঙ্কোচে বাহির হইয়া আসে, মাথায় স্বল্প অবগুণ্ঠন, মুখখানি বেশ দেখা যাইতেছিল; সে গোষ্ঠর হাত হইতে কাপড়খানা তুলিয়া লইয়া যায়, যাইবার সময় বৃদ্ধকে প্রণাম করিয়া বলিয়া যায়, বাবা, এইখানে আজ খাবে তুমি।

গোষ্ঠ কাঁদে, আর থাকিতে পারে না।

ফিটারের ভাবলেশহীন মুখখানারও কেমন পরিবর্তন হইয়া যায়, উদাস দৃষ্টিতে শূন্যের পানে চাহিয়া থাকে, মনশ্চক্ষে কি যেন সে দেখে। তারপর ধীরে ধীরে আপন মনেই বলে, আমারও একটি মেয়ে ছিল রে গোষ্ঠ, মামরা-মেয়ে; এত রোজগার তখন আমার ছিল না, অভাবে খেতে না পেয়ে, অন্ধকূপের মাঝ থেকে সেও এমনই রোগা, ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল, তারও এমনই ভেঁড়া কাপড় পরে দিন গিয়েছে, শেষে সে

কথাটা আর সে শেষ করিতে পারে না, স্বর কেমন ভারী হইয়া ওঠে, ঠোঁট দুইটা কাপে, বুড়া আর কথা কয় না, ঠোঁট দুইটা টানিয়া কম্পন সে রোধ করিতে চায়, কিন্তু চোখের জল বাধা মানে না।

ছোট মিস্ত্রি আসিয়া সরাসরি আপন ঘরে প্রবেশ করে; ঘটনাটা সে বুঝিতে চায়।

ক্ষণপরে দিব্য হাসিমুখে আসিয়া গোষ্ঠকে কহে, এস, টাইম হয়ে গেল যে।

গোষ্ঠ কহে, না।

সে কি হে, কেন? আজ বিকেলে আবার–

না ভাই, ওতে হবেও না কিছু, আমি কাজই আর করব না। যে কাজ করে রক্ত জল করে খেটে দুটো মানুষের পেটের ভাত জোটে না, পরনের কাপড় জোটে না, সে কাজের মুখে ঝাটা; যাব না আমি।

ওর কণ্ঠস্বরে আক্ষেপের এমন করুণ প্রার্থনা ছিল যে, ছোট মিস্ত্রি পর্যন্ত বিচলিত না হইয়া পারিল না।

সবাই নির্বাক হইয়া বসিয়া ভাবে। ক্ষণপরে বড় মিস্ত্ৰি কহে, আচ্ছা মিস্ত্রি, আজ থেকে তো আর আমরা ওভারটাইম খাটব না, এ নিয়ে ধর একটা ছোটখাটো ঝগড়া হবেই, এই সঙ্গে যদি মাইনে বাড়ানোর আরজিটা রাখা যায়—

ছোট মিস্ত্রি সোৎসাহে লাফ দিয়া উঠিয়া কহে, বহুত আচ্ছা, চল, চল সব, বলা যাক, মাইনে বাড়াতে হবে।

গোষ্ঠ কহে, হা মাইনে বাড়াবে, বলে কমাতে পেলে বাঁচে। মনের আগুন উহাদের কথায়। লাগে, কণ্ঠ উত্তেজিত হইয়া ওঠে, কোন অজানা অহেতুকী আক্রোশ বুকের মাঝে আত্মপ্রকাশ করে।

ছোট মিস্ত্রি ওই কণ্ঠে বলে, আলবৎ বাড়াতে হবে, না বাড়ায় রইল কাজ। বাড়াবে না, চালাকি নাকি? এস তুমি। বিকেলে কি কাজ, এখুনি আমাদের সভা হোক, ওই বটতলায় এখুনি জমাটবস্তি করব, সব দিব্যি করিয়ে নোব, কি বল?

শেষ কথাটা বুড়া মিস্ত্রিকে বলিয়া তাহার মুখপানে তাকায়।

বুড়ার সেই নিম্প্রভ দৃষ্টি, সেই হিম-মৃদু কণ্ঠে কহে, ডাক সকলকে, বাউরিদের সুদ্ধ।

গোষ্ঠ, ছোট মিস্ত্রি বিপুল উৎসাহে উঠিয়া দাঁড়ায়।

বটতলায় দাঁড়ায় বড় মিস্ত্রি; একে একে শ্রমিকের দল আসিয়া জমিয়া যায়, মেয়ের দল, গাড়ি-বোঝাই করা মুটের দল, গাড়োয়ানের দল, স্টেশনের জমাদার, বুড়া ড্রাইভার, পয়েন্টসম্যান তাহারাও আসে। মেয়েরা প্রশ্ন করে, কি হবে কি?

বস বস, জমাটবস্তি হবে।

মেয়েরা বলে, ঢং নাকি, দুপুর রোদে জমাটবস্তি! চল চল, কত কাজ পড়ে আছে, শেষে হাজরি পাব না।

গোষ্ঠ হকে, যে যাবে সে বুঝে যাক, আমাদের সঙ্গে তার কোনো সম্বন্ধ নাই, রোগ হলে দেখব না, মলে ফেলব না।

মর, তুই মর; কেন রে মুখপোড়া, রোগ হলে দেখব না, দেখে তো সব উল্টে দিলে!

শোন সব।

বড় মিস্ত্রির মোটা গলার আওয়াজ গমগম করে, কাহারও আর পা ওঠে না, সব ফিরিয়া দাঁড়ায়।

বড় মিস্ত্রি বলে, যে সব আক্রা-বাজার চলেছে, তাতে আমাদের আর কুলোচ্ছে না।

চারিদিকে আলোচনা শুরু হইয়া যায়।

গাড়োয়ান-সর্দার বলে, যা বলেছ মিস্ত্রি, ঝিঙের দর দু পয়সা ছিল, দু আনা হল।

আর একজন বলে, নআনার কাপড়খানা, নসিকে।

মেয়েরা বলে, পোড়ারমুখোরা বলে আবার, যুদু লেগেছে গো, যুদ্দু লেগেছে।

বুড়ি সাবি বলে, আমরাই দেখলাম মা, পয়সায় দু সের ঝিঙে, আট আনা দশ আনা। চন্দ্ৰকোণা কাপড়। দু পয়সা সের চাল, বাবা বলত–

ছোট মিস্ত্ৰি হাঁকে, চুপ চুপ।

তারপর উত্তেজিত আলোচনা।

কথা কিন্তু এক—বেশি মাইনে চাই আমাদের, বেশি মাইনে চাই। খেতে পাই না, পরতে পাই না।

আবার ঘুরিয়া আসে, বেশি মাইনে চাই।

একজন বলে, সে যদি ওরা না দেয়?

না দেয় ধর্মঘট হবে।

তা হলে ধর্মঘট?

মাইনে না বাড়ালে জরুর ধর্মঘট।

যে না করবে সে একঘরে।

ছোট মিস্ত্রি, গোষ্ঠ সকলের চোখ দিয়া আগুন ছুটিয়া যায়, একটা উত্তেজনার প্রবাহ বুকে বুকে বহিয়া যায়।

অন্তরতম প্রদেশের অতৃপ্ত মানবাত্মা, এমনভাবেই বিরূপাক্ষের মত জটাজুট লইয়া জাগে চিরদিন।

কলের বয়লারের সিটিটা উচ্চ চিৎকার করিয়া ওঠে, ভোঁ ভোঁ।

গোষ্ঠ বলে, কে সিটি মারে রে?

একজন বলে, বোধ হয় বাবুরা কেউ।

গোষ্ঠ বলে, হাঁক হাঁক, হুকুম আজ শুনছি না।

 

বুড়া ফিটার, ছোট মিস্ত্রি, গোষ্ঠ এমনই কয়জন মাতব্বর শ্রমিক গিয়া অফিসের দুয়ারে দাঁড়ায়।

পিছনে কলের দুয়ারে বুভুক্ষু মজুরের দল।

বুড়া খাজাঞ্চী বলে, কোন্ লবারের বেটার বিয়ে কাজ কামাই করে বটতলাতে হচ্ছিল কি?

কে একজন বলে, তোর বাবার বিয়ে, তুই নিতবর যাবি?

বুড়া ফিটার বলে, মালিকবাবুর সঙ্গে দেখা করব একবার।

যাও যাও, কাজে যাও, এর পর দেখা কোরো মালিকের সঙ্গে; অনেক কাজ কামাই হয়ে গেছে আজ। সব মাইনে কাটব জেনে রেখো।

একজন বলে, মাইনে কাটলে আজ তোমার—

সমবেত জনতা চেঁচাইয়া ওঠে, ধর্‌ ধর্‌ বুড়ো ভালুককে ধর্‌।

খাজাঞ্চী ঘরে গিয়া দরজায় খিল আঁটে, খোলা জানালা দিয়া দাঁত খিঁচাইয়া হাঁকে পন্টু সিং! পল্ সিং!

ম্যানেজার উপরের বারান্দায় আসিয়া হাঁকে, কেয়া হ্যায়?

সমবেত জনতা চিৎকার করে, বেশি মাইনে চাই আমরা, খেতে পাই না, পরতে পাই না, আমরা বেশি মাইনে

ম্যানেজার বড় মিস্ত্রি আর ছোট মিস্ত্রিকে ডাকিয়া লয়, তোম দুনো হিয়া আও।

সমবেত জনতা অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষায় থাকে।

পন্টু সিং আসিয়া ক্যাশঘরের দরজায় বসিয়া বন্দুকটা খুলিয়া পরীক্ষা করে, শেষে সেটা বাগাইয়া ধরিয়া চাপিয়া বসে।

বহুক্ষণ পর বড় মিস্ত্রি, ছোট মিস্ত্রি ফিরিয়া আসে।

বহু কণ্ঠ একসঙ্গে প্রশ্ন করে, কি হল?

বড় মিস্ত্রি কিছু বলিবার আগেই ছোট মিস্ত্ৰি চেঁচায়, ধরমঘট, ধরমঘট।

জনতাও চিৎকার করে, ধরমঘট, ধরমঘট।

পল্টু সিং বন্দুক ধরিয়া কহে, চলা যাও, কলসে নিকাল যাও।

কেউ তাকে পাঁত খিঁচায়, কেউ গালি পাড়ে।

বড় মিস্ত্রি বলে, সুরেনবাবু আর শিবকালী বাবুরও জবাব হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *