১০. দশম উপাখ্যান

বেতাল কহিল, মহারাজ।

গৌড়দেশে বর্ধমান নামে এক নগর আছে। তথায়, গুণশেখর নামে, অশেষগুণসম্পন্ন নরপতি ছিলেন। তাঁহার প্রধান অমাত্য অভয়চন্দ্ৰ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। নরপতিও, তদীয় উপদেশের বশবর্তী হইয়া, বৌদ্ধধর্ম অবলম্বন করিলেন; এবং, স্বয়ং শিবপূজা, বিষ্ণুপূজা, গোদান, ভূমিদান, পিতৃকৃত্য প্রভৃতি শাস্ত্ৰবিহিত অবশ্যকর্তব্য ক্রিয়াকলাপে এক কালে জলাঞ্জলি দিয়া, মন্ত্রিপ্রধান অভয়চন্দ্রের প্রতি আদেশ দিলেন, আমার রাজ্যমধ্যে, যেন এই সমস্ত অবৈধ ব্যাপার। আর প্রচলিত না থাকে।

সর্বাধিকারী, রাজকীয় আজ্ঞা অনুসারে, রাজ্যমধ্যে এই ঘোষণাপ্রদান করিলেন, যদি, অতঃপর, কোনও ব্যক্তি এই সকল রাজনিষিদ্ধ অবৈধ কর্মের অনুষ্ঠান করে, রাজা তাহার সর্বস্বহরণ ও নির্বাসনারূপ দণ্ডবিধান করিবেন। প্রজারা, কুলক্ৰমাগত আচার ও অনুষ্ঠানের পরিত্যাগে নিতান্ত অনিচ্ছা ও রাজার প্রতি মনে মনে নিরতিশয় অসন্তুষ্ট হইয়াও, দণ্ডভয়ে, প্রকাশ্য রূপে তদনুষ্ঠানে বিরত হইল।

এক দিবস, অভয়চন্দ্র রাজার নিকট নিবেদন করিলেন, মহারাজ! সংক্ষেপে ধর্মশাস্ত্রের মর্মপ্রকাশ করিতেছি, শ্রবণ করুন। এ জন্মে, কোনও ব্যক্তি কাহারও প্ৰাণহিংসা করিলে, হতপ্রাণ ব্যক্তি, জন্মান্তরে, ঐ প্রাণঘাতকের প্রাণহন্তা হয়। এই উৎকট হিংসাপাপের প্রবলতাপ্রযুক্তই, মানবজাতি, সংসারে আসিয়া, জন্মমৃত্যুপরম্পরারূপ দুর্ভেদ্য শৃঙ্খলে বদ্ধ থাকে। এই নিমিত্তই, শাস্ত্রকারেরা নিরূপণ করিয়াছেন, অহিংসা, মনুষ্যের পক্ষে, সর্বপ্রধান ধৰ্ম। মহারাজ! দেখুন, হরি, হর, বিরিঞ্চি প্ৰভৃতি প্ৰধান দেবতারাও, কেবল কর্মদোষে, সংসারে আসিয়া, বারংবার অবতার হইতেছেন। অতএব, অতি প্রবল জন্তু হস্তী অবধি, অতি ক্ষুদ্র জন্তু কীট পর্যন্ত, প্রত্যেক জীবের প্রাণরক্ষা করা সর্বপ্রধান কর্ম ও পরম পবিত্র ধর্ম। আর, বিবেচনা করিয়া দেখিলে, মনুষ্যেরা যে পরমাংস দ্বারা আপন মাংসবৃদ্ধি করে, ইহা অপেক্ষা গুরুতর অধর্ম ও যার পর নাই অসৎ কর্ম আর নাই। এবংবিধ ব্যক্তিরা, দেহান্তে নরকগামী হইয়া, অশেষ প্রকারে যাতনাভোগ করে। বিশেষতঃ, যে ব্যক্তি, স্বদৃষ্টান্ত অনুসারে, অন্যের দুঃখ বিবেচনা না করিয়া, প্ৰাণহিংসাপূর্বক, মাংসভক্ষণ দ্বারা, স্বীয় রসনা পরিতৃপ্ত করে, সে রাক্ষস; তাহার আয়ু, বিদ্যা, বল, বিত্ত, যশ প্রভৃতি হ্রাস প্রাপ্ত হয়; এবং সে কাণ, খঞ্জ, কুব্জ, মূক, অন্ধ, পঙ্গু, বধির রূপে পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করে। আর, সুরাপান অপেক্ষা গুরুতর পাপ আর নাই। অতএব, জীবহিংসা ও সুরাপান, সর্ব প্রযত্নে, পরিত্যাগ করা উচিত।

ঈদৃশ অশেষবিধ উপদেশ দ্বারা, অভয়চন্দ্ৰ বৌদ্ধধর্মে রাজার এরূপ শ্রদ্ধা ও অনুরাগ জন্মাইল যে, যে ব্যক্তি, তাঁহার সমক্ষে, ঐ ধর্মের প্রশংসা করিত, সে অশেষ প্রকারে রাজপ্ৰসাদভাজন হইত। ফলতঃ, রাজা, সবিশেষ অনুরাগ ও ভক্তিযোগ সহকারে, স্বীয় অধিকারে, অবলম্বিত অভিনব ধর্মের বহুল প্রচার করিলেন।

কালক্রমে রাজার লোকান্তরপ্রাপ্তি হইলে, তাহার পুত্র ধর্মধ্বজ পৈতৃক সিংহাসনে অধিরোহণ করিলেন। তিনি, সনাতন বেদশাস্ত্রের অনুবর্তী হইয়া, বৌদ্ধদিগের যথোচিত তিরস্কার ও নানাপ্রকার দণ্ড করিতে লাগিলেন; পিতার প্ৰিয়পাত্ৰ প্ৰধান মন্ত্রীকে, শিরোমুণ্ডনপূর্বক, গর্দভে আরোহণ ও নগর প্রদক্ষিণ করাইয়া, দেশবহিস্কৃত করিলেন; এবং, বৌদ্ধধর্মের সমূলে উন্মূলন করিয়া, বেদবিহিত সনাতন ধর্মের পুনঃস্থাপনে অশেষপ্রকার যত্ন ও প্রয়াস করিতে লাগিলেন।

কিয়ৎ দিন পরে, ঋতুরাজ বসন্তের সমাগমে, রাজা ধৰ্মধ্বজ, মহিষীত্রিয় সমভিব্যাহারে, উপবনবিহারে গমন করিলেন। সেই উপবনে এক সুশোভন সরোবর ছিল। রাজা, তাহাতে কমল সকল প্রফুল্প দেখিয়া, স্বয়ং জলে অবতরণপূর্বক, কতিপয় পুষ্প লইয়া, তীরে আসিয়া, এক মহিষীর হস্তে দিলেন। দৈবযোগে, একটি পদ্ম, মহিষীর হস্ত হইতে স্থলিত হইয়া, তদীয় বাম পদে পতিত হওয়াতে, উহার আঘাতে তাহার সেই পদ ভগ্ন হইল। তখন রাজা, হা হতোহস্মি বলিয়া, অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া, প্রতীকারচেষ্টা করিতে লাগিলেন। সায়ংকাল উপস্থিত হইল। সুধাকরের উদয় হইবামাত্র, তদীয় অমৃতময় শীতল কিরণমালার স্পর্শে, দ্বিতীয়া মহিষীর গাত্ৰ স্থানে স্থানে দগ্ধ হইয়া গেল। আর, তৎকালে অকস্মাৎ এক গৃহস্থের ভবনে উদূখলের শব্দ হইল; সেই শব্দ শ্রবণবিবরে প্রবিষ্ট হইবামাত্র, তৃতীয়া মহিষীর শিরোবেদনা ও মূর্ছা হইল।

ইহা কহিয়া বেতাল জিজ্ঞাসিল, মহারাজ! উহাদের মধ্যে কোন-কামিনী অধিক সুকুমারী। রাজা কহিলেন, সুধাকর করম্পর্শে যে রাজমহিষীর দেহ দগ্ধ হইল, আমার মতে, সেই সৰ্বাপেক্ষা সুকুমারী।

 

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *