দশম পরিচ্ছেদ
সেই দিন অপরাহ্নে ত্রিবেণীতে মুকুন্দদেবের ঘাটের অনতিদূরে একখানি বৃহৎ বজরা হইতে মধুর সঙ্গীতধ্বনি উখিত হইতেছিল; মধ্যে মধ্যে সঙ্গীতের পরিবর্ত্তে সেতারের মিঠা আওয়াজ শুনা যাইতেছিল। তীরে গীত বাদ্য শুনিবার জন্য লোক জমিয়া গিয়াছিল। বজ্রার মধ্যে একটি প্রশস্ত কক্ষে গালিচার উপরে বসিয়া একটি যুবতী সেতার বাজাইতেছিল, তাহার পার্শ্বে বসিয়া আর একটি যুবতী সঙ্গীত করিতেছিল, কক্ষের প্রান্তে একখানি ক্ষুদ্র হস্তিদন্তের খট্টায় একজন গৌরবর্ণ যুবক শয়ন করিয়াছিল। যুবক চেতনাহীন, তাহার সর্ব্বাঙ্গে ক্ষত চিহ্ন। ক্ষত স্থান সমূহ বহু বস্ত্র খণ্ডে আবদ্ধ, তাহা স্থানে স্থানে রক্তাক্ত। কিয়ৎক্ষণ পরে যুবক অস্ফুট স্বরে কি কহিল। তাহা শুনিয়া যুবতী সেতার রাখিল এবং শয্যাপার্শ্বে গিয়া দাঁড়াইল।
যুবক চক্ষুরুন্মীলন করিল এবং যুবতীকে দেখিয়া কহিল, “কে? ললিতা? কখন আসিলে?” যুবতী শয্যাপার্শ্বে উপবেশন করিয়া উভয় করে যুবকের দক্ষিণ হস্ত গ্রহণ করিল এবং জিজ্ঞাসা করিল, “কি বলিতেছ? আমাকে কি চিনিতে পারিতেছ না?” যুবকের অধরে হাস্যের ক্ষীণরেখা দেখা দিল, যুবক কহিল, “কেন পারিব না?”
“বল দেখি আমি কে?” “তুমি ললিতা।” “ললিতা কে? আমি যে গুলরুখ্।” “মিথ্যা কথা, তুমি ললিতা, এ ভীমেশ্বর। ললিতা, তুমি কখন আসিলে? আমি ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম।”
“তুমি কি বলিতেছ? এ যে সপ্তগ্রাম, সরস্বতী গঙ্গার মোহানায় আমাদের বজ্রা লাগিয়াছে। আমি গুল্রুখ, তুমি কি এখনও আমাকে চিনিতে পার নাই?” “চিনিয়াছি। ললিতা, তুমি বুঝি একটা নূতন মুসলমানী নাম শিখিয়াছ?” “অধিক কথা কহিও না। তোমার এখনও জ্ঞান হয় নাই।” “ললিতে, এ আবার কি ছলনা? সন্ধ্যাবেলায় গোপালের মন্দিরে আরতি দেখিতে যাইব বলিয়াছিলাম, চল যাই।”
যুবক শয্যা ত্যাগ করিয়া উঠিবার চেষ্টা করিল, তাহা দেখিয়া যুবতী তাহাকে বলপূর্ব্বক চাপিয়া ধরিল এবং কহিল, “উঠিওনা, উঠিওনা, এখনই ক্ষতমুখে রক্তস্রাব আরম্ভ হইবে।” যুবক মুখ বিকৃত করিয়া কহিল, “বড় বেদনা, উঠিতে পারিলাম না, আমার কি হইয়াছিল ললিতা?” “ললিতা কে?” “তুমি কি ললিতা নহ?” “আমি যে গুলরুখ্; জীবনসর্ব্বস্ব, তুমি আমায় চিনিতে পারিতেছ না কেন?” “চিনিতে পারিব না কেন, তুমি নিশ্চয় ললিতা।” “তবে অামি ললিতা।” “এতক্ষণ দুষ্টামি করিতেছিলে কেন? ললিতা, আমার সর্ব্বাঙ্গে বেদনা কেন?” “তুমি যে যুদ্ধে আহত হইয়াছ ” “যুদ্ধ? কোথায় যুদ্ধ?” “কেন সপ্তগ্রামের যুদ্ধ?” “সপ্তগ্রাম? আমি কি ভীমেশ্বরে নাই? তবে কি স্বপ্ন সত্য?”
এই সময়ে কক্ষের দ্বারের পরদা অপসারিত হইল, পূর্ব্ব রাত্রির বৃদ্ধ দ্বারে দাঁড়াইয়া কহিলেন, “মা, হকিম আসিয়াছেন।”
যুবতী শয্যাপার্শ্ব ত্যাগ করিয়া কহিল, “হকিমকে লইয়া আসুন, আমি কক্ষেই থাকিব।” বৃদ্ধ হকিমকে লইয়া কক্ষে প্রবেশ করিলেন, হকিম রোগীকে পরীক্ষা করিয়া কহিলেন, “আঘাত গুরুতর, তবে যুবা বয়স, সম্ভবতঃ আরোগ্য হইবেন। ইনি কোথায় আহত হইলেন?” বৃদ্ধ কহিলেন, “কল্য রাত্রির যুদ্ধে।” “ইনি কি বাদশাহী ফৌজের সেনা?” “হাঁ।” “শুনিয়াছি গোকুলবিহারীর একজন নায়ক বড় ভারি লড়াই করিয়াছে। আসদ্ খাঁ বলিতেছিলেন যে তাহার জন্যই সপ্তগ্রাম রক্ষা হইয়াছে।” “সে কি কাফের না মুসলমান?” “সে যুবা কাফের; হতভাগ্য হয় নিহত হইয়াছে, না হয় বন্দী হইয়াছে।” “ফিরিঙ্গির হস্তে বন্দী হওয়া অপেক্ষ মৃত্যু শতগুণে শ্রেয়ঃ।” “খোদা মালিক নুরউদ্দীন জহাঙ্গীর বাদশাহের রাজ্যে এ অত্যাচার অসহ্য। একটা প্রলেপ পাঠাইয়া দিব তাহা ক্ষতস্থানে লেপন করিবেন; দুই প্রকার ঔষধ আসিবে, তাহা প্রতি প্রহরে সেব্য।” “রোগী বড়ই অস্থির, চাঞ্চল্য বাড়িলে ক্ষতস্থান হইতে রক্তস্রাব হয়।” একটা জাফ্রাণ বর্ণের চূর্ণ পাঠাইয়া দিব, অস্থির হইলে তাহা সরবতের সহিত মিশ্রিত করিয়া সেবন করাইয়া দিবেন।”
হকিম প্রস্থান করিলেন। বৃদ্ধ ফিরিয়া আসিয়া যুবতীর হস্তে একটা কৌটা দিয়া কহিলেন, “মা, তোমার স্বামী অস্থির হইলে এই ঔষধের একমাত্রা সরবতের সহিত মিশাইয়া সেবন করাইও।” বৃদ্ধ কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। যুবক এতক্ষণ নীরব ছিল, এইবার সে যুবতীকে ডাকিয়া কহিল, “ললিতা বৈদ্য দাড়ি রাখিল কবে? ব্রজনাথ সেন ত বৈষ্ণব, সে ত গোঁফ, দাড়ি,চুল সমস্তই কামাইয়া ফেলিত?” “বৈদ্য হইবে কেন? ইনি সপ্তগ্রামের প্রসিদ্ধ হাকিম, আশ্রফ্ আলী খাঁ।” যুবক হাসিল, কহিল, “তুমি কি সপ্তগ্রামের স্বপ্ন দেখিতেছ?”
“স্বপ্ন কেন? এ ত সত্য সত্যই সপ্তগ্রাম?” যুবক বিরক্তি প্রকাশ করিয়া কহিল, “হয় তুমি পাগল হইয়াছ ললিতা, নয় আমি পাগল হইয়াছি। এ সপ্তগ্রাম নহে ভীমেশ্বর, তুমি ললিতা আমি ময়ূখ। সন্ধ্যা হইয়াছে, চল তোমাকে গৃহে লইয়া যাই, রাধিকা দিদি কোথায় গেল?”
যুবক পুনরায় শয্যা ত্যাগ করিবার উপক্রম করিল, যুবতী তাহাকে বাহু পাশে আবদ্ধ করিয়া বহু কষ্টে নিবারণ করিল। তখন ফতেমা হকিমপ্রদত্ত ঔষধ সরবতের সহিত মিশ্রিত করিয়া লইয়া আসিল, যুবতীর হস্ত হইতে যুবক তাহা পান করিল ও তৎক্ষণাৎ নিদ্রিত হইয়া পড়িল।
যুবতী ধীরে ধীরে শয্যাপার্শ্ব হইতে উঠিয়া পার্শ্বে কক্ষে প্রবেশ করিল, সেই স্থানে এক বৃদ্ধ দুগ্ধফেননিভ শয্যার উপরে বসিয়া পত্র লিখিতেছিলেন, তিনি যুবতীকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “কি হইয়াছে মা?” যুবতী কহিল, “কিছু নয়। আপনি কাহাকে পত্র লিখিতেছেন?” “আসদ্ খাঁকে। পুত্রকে লইয়া দিল্লী যাইব, ফৌজদার কলিমুল্লা খাঁ পলায়ন করিয়াছে। অাসদ্ খাঁর অনুমতি লইয়া পুত্রের সহিত দিল্লীতে ফিরিব, সেইজন্য অদ্য রাত্রিতে তাঁহাকে বজরায় আসিতে লিখিলাম।”;
বৃদ্ধের কথা শুনিয়া যুবতী প্রমাদ গণিল; সে ভাবিল যে যুবক যখন সৈনিক তখন সে নিশ্চয়ই আসদ্ খাঁর পরিচিত। আসদ্ খাঁ আসিলে বৃদ্ধের নিকট সমস্তই প্রকাশিত হইয়া পড়িবে। গুলরুখ্ ব্যস্ত হইয়া কহিল, “পিতা, অদ্য আসদ্ খাঁকে পত্র লিখিয়া কাজ নাই, উনি মুক্ত বায়ুর জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন চলুন, বজ্রায় অল্পদূরে ভ্রমণ করিয়া আসি।” “চল।”
মাল্লারা বজরা ছাড়িয়া দিল, বজরা দক্ষিণদিকে চলিল। তখন সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছে, ঘন কুজ্ঝটিকায় গঙ্গাবক্ষ আচ্ছন্ন। গঙ্গাবক্ষ শূন্য, ফিরিঙ্গির ভয়ে একখানিও নৌকা সপ্তগ্রাম ত্যাগ করে নাই। সহসা বজরার পশ্চাতে বহু তরণ্ডের শব্দ শ্রুত হইল। বজরার মাঝি বৃদ্ধকে জানাইল যে পশ্চাতে একখানি বড় নৌকা দ্রুতবেগে আসিতেছে। বজরার মুখ ফিরিল, দেখিতে দেখিতে একখানি বৃহৎ নৌকা আসিয়া পড়িল। নৌকাখানি ছিপ্ নহে, পশ্চিমবঙ্গে পারাপারের জন্য যেরূপ বৃহৎ নৌকা ব্যবহৃত হইয়া থাকে ইহা সেইরূপ একখানি নৌকা। নৌকা বজরার পার্শ্বে আসিয়া পৌঁছিলে, বৃদ্ধ দেখিলেন যে তাহাতে পঞ্চাশ ষাটজন অস্ত্রধারী পুরুষ দাঁড় টানিতেছে, মাঝির পার্শ্বে একজন শুভ্রবসনপরিহিত বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ দাঁড়াইয়া আছেন। বৃদ্ধ নৌকা দেখিয়া বিম্মিত হইলেন এবং বজরার মাঝিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মাঝি, এ কোথাকার নৌকা?” মাঝি পূর্ব্ববঙ্গের অধিবাসী, সে কহিল, “হুজুর, মুই কতি পারিনে, উত্তরের নাও হবে।”
এই সময়ে নৌকা আসিয়া বজরার পার্শ্বে দাঁড়াইল; সেই ব্রাহ্মণ বৃদ্ধকে কহিলেন, “মহাশয়, আপনি বজরা লইয়া কোথায় যাইতেছেন?” বৃদ্ধ কহিলেন, “আমি সপ্তগ্রাম হইতে জলপথে ভ্রমণ করিতে আসিয়াছি, সপ্তগ্রামে ফিরিয়া যাইব।”
“তবে শীঘ্র ফিরিয়া যাউন, আমিও সপ্তগ্রাম হইতে আসিতেছি। বন্দরে শুনিলাম যে, সন্ধ্যার পরে ফিরিঙ্গিদের সমস্ত ছিপ্ নৌকা লুঠিতে বাহির হইবে।”
“কাফের, তোমরা কোথায় যাইতেছ?” “হুগ্লীর বন্দরে।” “ফিরিঙ্গিরা কি তোমাদের ছাড়িয়া দিবে?” “আমরা ইচ্ছা করিয়া ফিরিঙ্গির হাতে ধন দিতে যাইতেছি।” নৌকা ছাড়িয়া দিল। বজ্রা সপ্তগ্রামের দিকে ফিরিল; তখন সন্ধ্যা হইয়াছে, কিন্তু গঙ্গাতীরে কোন গ্রামে দীপ জ্বলে নাই। গঙ্গাবক্ষ শূন্য, নিস্তব্ধ, কুয়াসায় আচ্ছন্ন। তখন সমুদ্রের জলরাশি জোয়ারের বেগে নদীতে প্রবেশ করিয়া আবার ফিরিয়া চলিয়াছে। ভীষণ স্রোতের বিপরীতে বৃহৎ বজ্রা অতি ধীরে ধীরে চলিতেছিল। সহসা অন্ধকার ভেদ করিয়া একখানি বৃহৎ ছিপ্ বজ্রার পার্শ্বে আসিয়া লাগিল, বন্দুক হস্তে চারি পাঁচজন ফিরিঙ্গি বজ্রায় উঠিল এবং নাবিকদিগকে বাঁধিয়া ফেলিল; নৌকার সমস্ত আরোহী বন্দী হইল, বজ্রা হুগলীর দিকে চলিল।
বজ্রা হুগ্লীর দুর্গের সম্মুখে পৌঁছিলে, ছিপ্ হইতে একটি হাউই ছুটিল; তাহা আকাশে উঠিলে, তাহা হইতে একটি নীল একটি লাল ও একটি শ্বেত তারকা ফুটিয়া উঠিল। তৎক্ষণাৎ দুর্গ হইতে আর একটি হাউই উঠিল, তাহা হইতেও ঐরূপ তিনটি তারা ফুটিয়া উঠিল। বজরা আবার চলিতে আরম্ভ করিল। দুর্গের সম্মুখে সেই উত্তরদেশীয় নৌকাখানি দাঁড়াইয়াছিল, বজরা দেখিয়া সেই ব্রাহ্মণ নৌকার কর্ণধারকে কহিলেন, “ভুবন, এত সেই বজ্রা, সপ্তগ্রামে না গিয়া হুগ্লীতে আসিল কেন? নিশ্চয়ই ফিরিঙ্গি হার্ম্মাদের নিকট বন্দী হইয়াছে।” ভুবন কহিল, “ঠাকুর, পথে ত ফিরিঙ্গির ছিপ্ বা কোশা দেখিতে পাইলাম না?” “হয়ত অন্ধকারে লুকাইয়া গিয়াছে। ভুবন বজরা মার।”
“সহসা ষাটজন বলিষ্ঠ ধীবর একসঙ্গে দাঁড় ফেলিল,.নৌকার আরোহিগণ একলম্ফে বজ্রার উপরে গিয়া পড়িল। ফিরিঙ্গিগণ সতর্ক ছিল না; তাহারা অনায়াসে বন্দী হইল। তখন ভুবন উচ্চৈঃস্বরে কহিল, “বজ্রার মুখ ফিরাইয়া দে, সপ্তগ্রামে যাইবে।” তাহার কণ্ঠস্বর শুনিয়া বজ্রার অভ্যস্তর হইতে সেই আহত যুবক ডাকিল, “ভুবন?” সে স্বর শ্রবণ করিয়া ভুবনের সমস্ত দেহ কম্পিত হইল, সে আবেগরুদ্ধকণ্ঠে উত্ত দিল, “মহারাজ, যাই।”
সহসা দুর্গের উপরে বিশাল অগ্নিকুণ্ড জ্বলিয়া উঠিল, তীব্র আলোকে নদীবক্ষ উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল, ভীষণ শব্দে দুই তিনটি তোপ গর্জ্জিয়া উঠিল। আলোক নিবিয়া গেল, সঙ্গে সঙ্গে বজরা ও নৌকা গঙ্গাগর্ভে নিমগ্ন হইল। তখন চারিদিক হইতে পাঁচ সাত খানি ছিপ্ আসিয়া আরোহী ও নাবিকগণকে বন্দী করিল।