অধ্যায় ১০ : তুমি আমার পিঠ চুলকে দাও, আমি তোমার পিঠে চড়বো
আমরা ইতিমধ্যেই সারভাইভাল বা টিকে থাকার যন্ত্রগুলোর পিতামাতা সংক্রান্ত, যৌন ও লিঙ্গ নির্ভর এবং আগ্রাসী ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছি– যারা একই প্রজাতির সদস্য। কিন্তু আরো কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয় আছে বিভিন্ন জীব সদস্যদের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে, যে বিষয়গুলো খুব সুস্পষ্টভাবে আগের কোনো অধ্যায়েই আলোচনা করা হয়নি। এর একটি হচ্ছে বহু জীবের একত্রে কোনো গ্রুপ হিসাবে বসবাস করার প্রবণতা। পাখিরা ঝাক বেধে ওড়ে, কীটপতঙ্গরাও একত্রে ঝাক বাধে, মাছ কিংবা তিমিরা দলবদ্ধ হয়ে বাস করে, সমতলে স্তন্যপায়ীরা একসাথে দল বেধে চরে বেড়ায় কিংবা একসাথে দল বেধে শিকার করে। এই একসাথে জড়ো হবার ব্যাপারটি মূলত ঘটে শুধুমাত্র একই প্রজাতির সদস্যদের মধ্যে। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও আছে, জেব্রা অনেকসময় চরে বেড়ায় ‘নু’দের সাথে এবং মিশ্র প্রজাতির পাখির ঝাকও মাঝে মাঝে দেখা যায়।
প্রস্তাবিত যে উপকারিতাগুলো স্বার্থপর কোনো সদস্য গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে অন্য সদস্যদের বসবাস করার মাধ্যমে আদায় করে নেয় তার তালিকাটি বরং একটি বিবিধ মিশ্র তালিকা। সেই পুরো তালিকার বিবরণ আমি এখানে ব্যাখ্যা করবো না, কিন্তু শুধুমাত্র অল্প কিছু প্রস্তাবনা এখানে উপস্থাপন করবো। এবং এটি করার প্রক্রিয়ায় আমি ফিরে আসবো অবশিষ্ট আপাতদৃষ্টিতে কিছু পরার্থবাদী আচরণের আলোচনায়, যা আমি প্রথম অধ্যায়ে উল্লেখ করেছিলাম এবং যা আলোচনা করার জন্য আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এই আলোচনা সামাজিক কীটপতঙ্গগুলোর বিষয় বিবেচনা করতে আমাদের নির্দেশ করবে, যে বিষয়টি ছাড়া জীবজগতে পরার্থবাদীতা সংক্রান্ত কোনো বিবরণই সম্পূর্ণ হবে না। অবশেষে বরং এই বিবিধ বিষয় নিয়ে আলোচনার এই অধ্যায়ে, আমি উল্লেখ করবো রেসিপ্রোকাল অ্যালটুইজম বা পারস্পরিক পরার্থবাদীতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, সেটি হচ্ছে ‘তুমি আমার পিঠ চুলকে দাও, আমিও তোমার পিঠ চুলকে দেবো মূলনীতিটি (অর্থাৎ তুমি আমাকে সাহায্য করো, আমি তোমাকে সাহায্য করবো)।
যদি প্রাণীরা একসাথে দলবদ্ধ হয়ে বাস করে, তাহলে সেই সহযোগিতাপূর্ণ সংশ্লিষ্টতায় তাদের জিনগুলোকে অবশ্যই বেশী সুবিধা পেতে হবে, তারা যা বিনিয়োগ করছে তার চেয়ে বেশী। হায়েনাদের একটি দল, কোনো একটি একক হায়েনার চেয়ে তাদের শিকার হিসাবে অনেক বেশী বড় আকারের কোনো প্রাণীকে পরাস্ত করতে পারে, সে কারণেই প্রতিটি স্বার্থপর হায়েনা সদস্যদের জন্য একসাথে দল বেধে শিকার করা লাভজনক, এমনকি যখন তাদের শিকারের খাদ্য পরস্পরের সাথে ভাগ করে নিতে হচ্ছে। এবং সম্ভবত একই ধরনের কিছু কারণে মাকড়শারা বিশাল কমুনাল বা সামাজিক মাকড়শার জাল তৈরী করার জন্য পরস্পরের সাথে সহযোগিতা করে। শরীরের তাপ সংরক্ষণ করতে এম্পেরর পেঙ্গুইনরা একসাথে গায়ে গা লাগিয়ে একত্রে জড়ো হয়ে থাকে, প্রত্যেকেই লাভবান হয় পুরোপুরি শরীরকে উন্মুক্ত না করে বরং সবাই শরীরের অল্প খানিকটা এলাকা ঠান্ডায় উন্মুক্ত করে রাখার মাধ্যমে, একা থাকলে যেটি সম্ভব নয়। কোনো একটি মাছ যে আরো একটি মাছের পেছনের খানিকটা বাকা হয়ে সাঁতার কাটলে সে একটি হাইড্রোডায়নামিক সুবিধা পায় সামনের মাছের সৃষ্টি করা টারবুলেন্স এর কারণে। আংশিকভাবে এটাই কারণ কেন মাছরা একটা সাথে দল বা স্কুল তৈরী করে। একটি সম্পর্কযুক্ত কৌশল যার সাথে বাতাসের টারবুলেন্স জড়িত, সেটি ব্যবহার করতে শোনা যায় রেসিং সাইকেল চালকদের, এবং এটাই হয়তো পাখিদের ‘ভি’ এর মত একটি ফরমেশন তৈরী করে ওড়ার কারণ। সম্ভবত সেই ঝাঁকে পাখিদের মধ্যে প্রতিযোগিতা আছে ঝাকের একেবারে মাথার অসুবিধাজনক অবস্থানটি এড়িয়ে চলার। সম্ভবত পাখিরা হয়তো পালাক্রমে এই অনিচ্ছুক নেতা হবার দ্বায়িত্বটা মেনে নেয়– এই অধ্যায়ের শেষে এই ধরনে বিলম্বিত পারস্পরিক পরার্থবাদীতার এই বিশেষ রুপটি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করা অনেকগুলো প্রস্তাবিত উপকারিতা মূলত শিকারী প্রাণীর খাদ্য হওয়া থেকে নিজেদের সুরক্ষা সংক্রান্ত। এই তত্ত্বটির একটি চমৎকার রুপ দিয়েছিলেন ডাবলিউ. ডি. হ্যামিলটন, তার ‘জিওমেট্রি ফর দ্য সেলফিশ হার্ড’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে। ভুল ব্যাখ্যা করা হতে পারে এই আশঙ্কায় আমি যে বিষয়টির উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার আবশ্যিকতা মনে করছি, সেটি হচ্ছে ‘সেলফিশ হার্ড’ বা ‘স্বার্থপর পশুর পাল’ দ্বারা তিনি বোঝাতে চাইছেন, “স্বার্থপর সদস্যদের দিয়ে তৈরী কোনো পশুর পাল।
আরো একবার আমরা শুরু করবো সরল কোনো ‘মডেল’ দিয়ে, যদিও নৈর্ব্যক্তিক, এটি আমাদের সত্যিকার পৃথিবীটাকে বুঝতে সাহায্য করে। ধরুন একটি জীব প্রজাতি যা কোনো শিকারী প্রাণীর দ্বারা আক্রান্ত হয়, যে শিকারী প্রাণীটি সবসময় সবচেয়ে কাছের শিকার প্রাণীটিকে আক্রমণ করে। শিকারী প্রাণীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটি একটি যৌক্তিক কৌশল, কারণ এটি অযথা শক্তির অপচয় রোধ করে। আর শিকার হওয়া প্রাণীটির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এর একটি কৌতূহলোদ্দীপক পরিণতি আছে। এর অর্থ হচ্ছে শিকার হতে পারে এমন প্রতিটি সদস্য নিরন্তরভাবে চেষ্টা করবে শিকারী প্রাণীর সবচেয়ে নিকটবর্তী না হওয়া থেকে। যদি শিকার হওয়া প্রাণী দুরে আক্রমণরত শিকারী প্রাণীকে দেখে, এটি দ্রুত সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু যদি শিকারী প্রাণী খুব দক্ষ হয় হঠাৎ করে কোনো সতর্ক সংকেত ছাড়াই দৃশ্যে উপস্থিত হতে, ধরুন এটি লম্বা ঘাসের মধ্যে লুকিয়ে থাকে সুযোগের অপেক্ষায়, তাহলে প্রতিটি আক্রম্য সদস্য শিকারের প্রাণীর সবচেয়ে নিকটবর্তী হওয়া এড়াতে কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে। আমরা প্রতিটি শিকার হওয়া প্রাণী সদস্যদের চারপাশে একটি বিপদজ্জনক এলাকা’ দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতেদেখতে পারি। এই এলাকাটিকে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে এমন একটি এলাকা হিসাবে যেখানে কোনো একটি বিন্দু সেই সদস্যদের কাছে সবচেয়ে বেশী নিকটবর্তী অন্য যেকোনো সদস্যদের তুলনায়। যেমন, যদি শিকার হয় এমন সদস্যরা এমনভাবে একসাথে চলাচল করে তারা একটি সাধারণ জ্যামিতিক সংগঠন তৈরী করে, তাদের প্রত্যেকটি সদস্যকে ঘিরে থাকা বিপজ্জনক এলাকাটি (যদি না সেই সদস্য তার প্রান্তে অবস্থান করে) হয়তো হতে পারে স্কুলভাবে ষড়ভুজাকৃতি আকারের একটি এলাকা। যদি কোনো শিকারী প্রাণী কোনো একটি আক্রম্য সদস্য ‘ক’কে ঘিরে থাকা বিপজ্জনক এলাকায় লুকিয়ে থাকে আক্রমণের অপেক্ষায়, তাহলে সদস্য ‘ক’ এর শিকারী প্রাণীর খাদ্য হওয়া সম্ভাবনা থাকে অন্যদের চেয়ে বেশী। গোষ্ঠীবদ্ধ প্রাণীদের পালের প্রান্তে অবস্থিত সদস্যরা বিশেষ ভাবে আক্রম্য হবার সম্ভাবনা থাকে, যেহেতু তাদের বিপদের এলাকা অপেক্ষাকৃতভাবে ছোট ষড়ভুজ না বরং এর মধ্যে একদিকে উন্মুক্ত দিকে বিশাল পরিসর অন্তর্ভুক্ত আছে।
এখন স্পষ্টভাবে কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন কোনো সদস্য তার বিপদের এলাকাটা যতটা ছোট রাখা সম্ভব সেটারই চেষ্টা করবে। বিশেষ করে, পালের একেবারে প্রান্তে যেন তাকে অবস্থান করতে না হয়। সেই চেষ্টা অব্যাহত রাখবে। যদি সে নিজেকে কোনোভাবে পালের প্রান্তে আবিষ্কার করে, তাৎক্ষণিকভাবে সে পদক্ষেপ নেয় পালের কেন্দ্রের দিকে সরে আসার জন্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কাউকে না কাউকে প্রান্তে অবস্থান করতেই হয়, কিন্তু যতক্ষণ একক ভাবে কোনো সদস্যের সাথে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট, সে সর্বোতভাবে প্রচেষ্টা করবে সে নিজে যেন সেই অবস্থানে না থাকে। কোনো একটি পালের প্রান্ত থেকে বিরামহীনভাবে কেন্দ্র অভিমুখে সরে আসার প্রচেষ্টা দেখা যাবে। যদি সেই সদস্যদের গ্রুপটি এর আগে শিথিল বা বিশৃঙ্খল হয়, দ্রুত আমরা তাদের একসাথে দৃঢ়ভাবে একত্রিত হতে দেখবো এই কেন্দ্র অভিমুখে সরে আসার পরিণতি হিসাবে। এমনকি যদি আমরা আমাদের মডেল শুরু করি একসাথে জমায়েত হবার কোন প্রবণতা না থাকা সত্ত্বেও এবং আক্রম্য, শিকার হয় এমন প্রাণী যদি শুরু করে ছড়ানো ছিটানো এলোমেলোভাবে অবস্থায়, প্রতিটি একক সদস্যদের স্বার্থপর তাড়না হবে তাদের পরিবেষ্টন করা বিপদজ্জনক। এলাকাটিকে ক্রমেই হাস করে আনা, অন্য দুজন সদস্যদের মধ্যে নিজেকে অবস্থানটি সরিয়ে নিয়ে এসে। এবং এটাই দ্রুত জমায়েত বা দলবদ্ধ একটি সংগঠন সৃষ্টি করবে যা ক্রমেই আরো বেশী ঘনভাবে জমায়েত হবে।
অবশ্যই, বাস্তব জীবনে একই সাথে একত্রিত হবার প্রবণতাটি বিপরীতমুখী চাপের জন্য সীমাবদ্ধ: অন্যথায় সব সদস্যরাই একটি স্তূপে এসে পরিসমাপ্তি হবে, কিন্তু তারপরও মডেলটি তার আকর্ষণ ধরে রাখে কারণ এটি প্রদর্শন করে যে এমনকি খুব সাধারণ কোনো প্রাকধারণা এই একসাথে জমায়েত বা গোষ্ঠীবদ্ধ হবার আচরণটির ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে। অন্য, আরো বিস্তারিত মডেলও প্রস্তাব করা হয়েছে। বাস্তব সত্য হচ্ছে তারা আরো বেশী বাস্তবসম্মত বিষয়টি সরলতম হ্যামিলটনের মডেলের মূল্য থেকে কোনো কিছু পরিত্যাগ করেনা যা আমাদের প্রাণীদের গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে জমায়েত সৃষ্টি করার সমস্যাটি নিয়ে ভাবতে সাহায্য করে।
স্বার্থপর-পশুর পাল বা ‘সেলফিশ হার্ড’ মডেলটিতে কোনো সহযোগিতাপূর্ণ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার জায়গা নেই। কোনো পরার্থবাদীতা নেই এখানে, শুধুমাত্র প্রতিটি সদস্য একে অপরকে স্বার্থপর স্বার্থে ব্যবহার করার প্রচেষ্টা করে। কিন্তু বাস্তবে এমন কেসও আছে যেখানে সদস্যরা আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় শিকারী প্রাণীর আক্রমণ থেকে তাদের গ্রুপের সদস্যদের সুরক্ষা করার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ নেয়, পাখিদের সতর্ক সংকেতের কথা মনে পড়ে এক্ষেত্রে। এগুলো অবশই কাজ করে সতর্ক সংকেত হিসাবে যারা সেগুলো শোনে, এগুলো তাদের তাৎক্ষণিকভাবে দ্রুত সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা গ্রহন করার কারণ হয়; এমন কোনো প্রস্তাব নেই যে এই সতর্ক সংকেতটি যে দিচ্ছে সে শিকারী প্রাণী দৃষ্টি অন্য দিকে পরিচালিত করে তার গোষ্ঠীর অন্য সদস্যদের আক্রমণ থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। সে শুধুমাত্র একটি শিকারী প্রাণীর উপস্থিতি জানান দেয়– সাবধান করে। যাই হোক, এই ডাক দেবার আচরণটি মনে হয়, অন্তত প্রথম দৃষ্টিতে, পরোপকারীমূলক, কারণ এর প্রভাব আছে শিকারী প্রাণীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে, যে কিনা সেই সতর্ক সংকেতটি উচ্চারণ করছে তার ক্ষেত্রে। আমরা পরোক্ষভাবে এখান। থেকে উপসংহারে পৌঁছাতে পারি সেই বাস্তব সত্যে, যা লক্ষ করেছিলেন পি, আর, মারলার। যে সতর্ক সংকেত দিচ্ছে, তাদের উচ্চারিত সতর্ক সংকেতগুলোর ভৌত বৈশিষ্ট্য আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় এমন রুপের, যে তাদের অবস্থান শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। যদি কোনো শব্দ প্রকৌশলীকে জিজ্ঞাসা করা হয় এমন কোনো শব্দ ডিজাইন করার জন্য, কোন শিকারী প্রাণীর পক্ষে যার উৎস খোঁজা খুব কঠিন হয়ে পড়বে, তাহলে সে এমন কিছু তৈরী করবে যা অনেকটাই অনেক ছোট গানের পাখিদের সত্যিকারের সতর্ক সংকেতের মত। কিন্তু প্রকৃতিতে এই সতর্ক করে দেবার ডাকের এই রুপটিকে অবশ্যই আকার দিয়েছিল প্রাকৃতিক নির্বাচন, এবং আমরা। জানি এর অর্থ কি, এর অর্থ হচ্ছে বিশাল সংখ্যক সদস্যরা মারা গিয়েছে কারণ তাদের সতর্ক করে দেবার ডাক পুরোপুরিভাবে নিখুঁত ছিলনা। সুতরাং সতর্ক করে দেবার সংকেতগুলোর আপাতদৃষ্টিতে বিপদজ্জনক। স্বার্থপর জিনের তত্ত্বকে একটি বিশ্বাসযোগ্য সুবিধা প্রস্তাব করতে হবে এই সতর্ক করে দেবার সংকেত দেবার আচরণের সপক্ষে, এবং সেই সুবিধাটি যথেষ্ট বড় হতে হবে এর জন্য সম্ভাব্য বিপদের ঝুঁকিকে মোকাবেলা করার জন্য।
বাস্তবিকভাবে এটি কিন্তু খুব কঠিন একটি কাজ না। পাখিদের সতর্ক সংকেতগুলো বহুবার উপস্থাপন করা হয়েছে ডারউইনীয় তত্ত্বের জন্য ‘অসামঞ্জস্যপূর্ণ হিসাবে যে এর জন্য ব্যাখ্যা কল্পনা করা একধরনের খেলায় পরিণত হয়েছে। পরিণতিতে, আমাদের কাছে এখন অনেকগুলো খুবই ভালো ব্যাখ্যা আছে, এখন খুব কঠিন হবে মনে করা যে এই প্রসঙ্গে এত উত্তেজনা আসলে কোথায় ছিল। অবশ্যই, যদি কোনো সম্ভাবনা থাকে যে পাখির পালে কিছু নিকটাত্মীয় আছে, সেক্ষেত্রে সতর্ক করে দেবার সংকেতটির একটি জিন পুলে সফলতার সাথে টিকে থাকে কারণ একটি ভালো সম্ভাবনা। আছে জিনটির কিছু সদস্যের শরীরে থাকার যারা বেঁচে যাবে এই সতর্কমূলক ডাকের কারণে। এটি সত্য, এমনকি যদি যে সতর্ক সংকেত দেয়, পরার্থবাদীতার জন্য হয়তো তাকে চরমতম মূল্য দিতে হয় শিকারী প্রাণীর দৃষ্টি তার দিকে আকর্ষণ করার মাধ্যমে।
আপনি যদি সন্তুষ্ট না হন এই ‘কিন-সিলেকশন’ ধারণাটির সাথে, আরো অনেক তত্ত্ব আছে যেখান থেকে আপনি বেছে নিতে পারেন। অনেক উপায় আছে যেখানে সতর্ক সংকেত প্রদানকারী তার স্বার্থপর সুবিধা অর্জন করতে পারে তার গোষ্ঠীর অন্য সদস্যদের সতর্ক করে দেবার মধ্যে। ট্রিভার্স মোট পাঁচটি ভালো ধারণার কথা উল্লেখ করেছিলেন, কিন্তু আমি নিজে নিচের দুটি ধারণাকে বরং বেশী বিশ্বাসযোগ্য মনে করি।
প্রথমটি আমি বলবো কেভি (cave) তত্ত্ব, ল্যাটিন ভাষায় যার অর্থ ‘সাবধান’, স্কুলের ছাত্রদের দ্বারা এটি এখনও ব্যবহৃত হচ্ছে (cave উচ্চারণ হয় এভাবে: কে-ভি) যখনই তারা তাদের সহযোগীদের সতর্ক করে দেয় এগিয়ে আসা স্কুলের কর্তৃপক্ষের ব্যাপারে। এই তত্ত্বটি প্রযোজ্য ছদ্মরুপে থাকা বা কেমোফ্লেজ করা পাখিরা যারা কোনো ঝোঁপের নীচে সুস্থিরভাবে বসে থাকে যখন বিপদের ঝুঁকি থাকে। ধরুন এমন কোনো একঝাক পাখি একটি মাঠে খাদ্য সন্ধান করে খাচ্ছে। একটি বাজ পাখি বেশ দুরে উড়ে যাচ্ছে। যে এখনও মাঠে খেতে থাকা পাখির ঝাকটাকে দেখেনি, এবং সে তাদের দিকে সরাসরি উড়ে যাচ্ছে না, কিন্তু একটি বিপদ আছে তার তীক্ষ্ম দৃষ্টি তাদের শনাক্ত করতে পারবে যে কোনো মূহুর্তে, আর তখনই সে তাদের দিকে সরাসরি উড়ে যেতে পারে আক্রমণের জন্য। ধরুন এই ঝাকের একটি সদস্য বাজ পাখিটিকে দেখলো, বাকীরা এখনও যা দেখিনি। এই তীক্ষ্ম দৃষ্টি সম্পন্ন সদস্যটি সাথে সাথে চুপ হয়ে ঘাসের মধ্যে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু তার জন্য এই কাজ খুব একটা লাভজনক হবে না। কারণ তার সঙ্গীরা তখনও কিচির মিচির করে শব্দ করছে আর চোখে পড়ার মত একটি অবস্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের যে কেউই বাজ পাখির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে, তখন সমস্ত পাখির ঝাকটি বিপদের সম্মুখীন হবে। বিশুদ্ধভাবে একটি স্বার্থপর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সবচেয়ে সেরা নীতি হবে সেই সদস্যের জন্য যে প্রথম বাজপাখিটি শনাক্ত করে, সে যদি তার সহগোত্রদের সতর্ক করার জন্য একটি দ্রুত সতর্ক সংকেত প্রদান করে, এবং যে সংকেত তাদের সবাইকে চুপ করিয়ে দেয়, যা তাদের নিজেদের অজান্তে বাজপাখিকে তাদের নিজেদের কাছে আমন্ত্রণ জানানোর সম্ভাবনাকে হ্রাস করবে।
আরেকটি তত্ত্ব যা আমি উল্লেখ করতে চাই সেটি হচ্ছে কখনোই ‘দল না ভাঙ্গার’ তত্ত্ব। এই তত্ত্বটি প্রযোজ্য সেই সব প্রজাতির পাখিদের জন্য যারা উড়ে পালিয়ে যায় যখন কোনো শিকারী প্রাণী তাদের আক্রমণ করে, হয়তো কোনো একটি গাছে। আবারো, কল্পনা করুন পাখিদের ঝাঁকে একটি পাখি যে শিকারী প্রাণীকে শনাক্ত করে, কি করবে সে? খুব সহজে সে নিজেই উড়ে চলে যেতে পারে, তার ঝাকের সঙ্গীদেও কোনো সতর্ক সংকেত না জানিয়ে। কিন্তু এখন সে তাহলে এমন পাখি হবে যে ‘দলছুট’, আর নামহীন কোনো পাখির ঝাকের মাত্র একজন সদস্য নয় আর বরং তাদের সবার থেকে ব্যতিক্রম কেউ। বাজপাখিরা আসলেই পরিচিত এই ধরনে ব্যতিক্রমী দলছুট আলাদা কবুতরদের নিশানা করার জন্য। কিন্তু এমনকি যদিও তারা সেটি না হয়, দলত্যাগ করাটিকে একটি আত্মহত্যামূলক একটি নীতি হিসাবে ভাবার অসংখ্য তাত্ত্বিক কারণ আছে। এমনকি যদি তার সঙ্গীরা পরে তাকে অনুসরণও করে, যে সদস্যটি প্রথম মাটি থেকে উপরে উড়ে যাবে সাময়িকভাবে তার বিপদের এলাকাটি আকারে অনেক বৃদ্ধি করে ফেলে। হ্যামিলটনের বিশেষ তত্ত্বটি সঠিক কিংবা ভুল যাই হোক না কেন, দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করার আচরণে অবশ্যই কিছু না কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা থাকে, নতুবা পাখিরা সেটি করতো না। আর সুবিধাটা যাই হোক না কেন, যে সদস্য অন্য সবার আগে দল ছেড়ে উড়ে যায়, অন্তত আংশিকভাবে তার সেই সুবিধাকে পরিত্যাগ করে। যদি সে দল না ভাঙ্গে অবশ্যই, তাহলে সেই পাখিটি কি করবে? হয়তো তার উচিৎ হবে এমনভাবে তার কাজ অব্যাহত রাখা যেন কোনো কিছুই ঘটেনি এবং তাদের সুরক্ষার উপর তারা নির্ভর করে যেটি তারা অর্জন করে কোনো একটি গোত্রের সদস্য হবার কারণে। কিন্তু এটিও গুরুতর ঝুঁকি বহন করে। কারণ সে তখনও উন্মুক্ত অবস্থায়, অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে,সহজে আক্রম্য। গাছের উপরে কোনো জায়গায় অবশ্যই সে অনেক নিরাপদ হবে। ভালো নীতি হবে আসলেই উড়ে গিয়ে গাছের উপর বসা, কিন্তু এটাও নিশ্চিৎ করতে হবে অন্য সবাই যেন সেই কাজটি করে। সেভাবে, সে কখনোই সবার থেকে আলাদা হবে না, এবং সেও ত্যাগ করবে না দলবদ্ধ হয়ে বাস করার সুবিধাগুলো, কিন্তু সে অর্জন করবে সেই সুবিধাটা কোনো আড়ালে গিয়ে উড়ে বসার সুবিধা। আরো একবার, একটি সতর্কবাণী উচ্চারণ করার আচরণকে দেখা যায় বিশুদ্ধভাবে স্বার্থপর আচরণ হিসাবে। ই. এল. চার্নভ এবং জে. আর, ক্রেবস একই ধরনের একটি তত্ত্ব প্রস্তাব করেছিলেন যেখানে তারা এমনকি আরো অগ্রসর হয়ে ম্যানিপুলেশন বা নিজের স্বার্থের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন তাদের ঝাকের অন্য পাখিদের জন্য সতর্ক সংকেত দান করা পাখিটিকে বর্ণনা করার জন্য। এখানে আমরা বিশুদ্ধ স্বার্থহীন পরার্থবাদী থেকে বহু দূরে চলে এসেছি।
উপরিভাবে, এই তত্ত্বগুলো মনে হতে পারে অসামঞ্জস্যপুর্ণ সেই সব বক্তব্যর সাথে, একক সদস্যটি যে কিনা সতর্ক সংকেতের ডাক দেয় সে নিজেকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। আসলেই এখানে কোনো অসংগতি নেই। সে তার নিজেকে বিপদের মধ্যে ফেলে আরো বেশী বরং না সতর্ক সংকেত ডেকে। কিছু সদস্য যারা মারা গেছে কারণ তারা সতর্ক সংকেত দিয়েছিল, বিশেষ করে তারা, যাদের ডাক সহজে শনাক্ত করা যায়। অন্যান্য সদস্যরা মারা যায় কারণ তারা সতর্ক সংকেত দেয়নি। কেভি’ তত্ত্ব এবং কখনো দলত্যাগ না করার তত্ত্ব হচ্ছে বহু তত্ত্বের মধ্যে মাত্র দুটি তত্ত্ব যা এর কারণটি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে।
থমসন গ্যাজেলদের ‘স্টটিং’ বা লাফ দিয়ে প্রদর্শনী করার বিষয়টি বা কি, যা আমি প্রথম অধ্যায়ে উল্লেখ করেছিলাম এবং যাদের আপাতদৃষ্টিতে আত্মঘাতী পরোপকারিতা, আর্সেকে প্রণোদিত করেছিল সরাসরিভাবে উল্লেখ করতে যে, এটিকে কেবলমাত্র ব্যাখ্যা করা সম্ভব ‘গ্রুপ সিলেকশন দিয়ে। এখানে স্বার্থপর জিন তত্ত্ব আরো বেশী কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। পাখিদের ক্ষেত্রে সতর্ক সংকেত কাজ করে কিন্তু সেগুলো কার্যত এমনভাবে পরিকল্পিত যে সহজে শনাক্ত করা সম্ভব হয় না শব্দের উৎস কোথা থেকে আসছে, এবং যতটা হওয়া সম্ভব ততটুকু সতর্ক। স্টটিং বা এই উচ্চ লাফ ঝাঁপ এর ক্ষেত্রে এটা কিন্তু সেভাবে সম্ভব নয়। তারা যথেষ্ট পরিমান আড়ম্বরময় যাকে বলা যায় সরাসরি উসকানি দেবার মত। গ্যাজেলদের দেখলে মনে হয় যেন তারা সুপরিকল্পিতভাবে শিকারী প্রাণীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছে, প্রায় যেন তারা শিকারী প্রাণীকে আক্রমণ করার জন্য উসকানি দিচ্ছে। এই আচরণ চমৎকার একটি সাহসী তত্ত্ব প্রস্তাব করার সুযোগ দিয়েছে। এই তত্ত্বটি প্রাকধারণা করেছিলেন এন. স্মাইথ, কিন্তু এটিকে যদি যৌক্তিক কোনো উপসংহারের দিকে নিয়ে যাওয়া যায়, এটি নির্ভুলভাবে এ. জাহাভীর স্বাক্ষর দেখতে পাওয়া যায়।
জাহাভীর তত্ত্বকে আমরা এভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি। গুরুত্বপূর্ণ যে পার্শ চিন্তাটি আমাদের মনে রাখতে হবে যে স্টটিং এর ধারণাটি, অন্যান্য গ্যাজেলদের প্রতি সতর্ক সংকেত হওয়া তো দুরের কথা, সত্যিকারভাবে তাদের এই প্রদর্শনীর লক্ষ্য হচ্ছে শিকারী প্রাণী। অন্য গ্যাজেলরা এটি লক্ষ করে এবং তাদের আচরণকে এটি প্রভাবিত করে, কিন্তু এটি ঘটনাচক্রে ঘটে, এটি মূলত প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হয় শিকারী প্রাণীর প্রতি সংকেত হিসাবে। স্কুলভাবে এটি ইংরেজী ভাষায় অনূদিত করলে এর অর্থ হয়, “দেখো আমি কত উর্দুতে লাফাতে পারি, আমি স্পষ্টভাবে অনেক যোগ্য এবং স্বাস্থ্যবান গ্যাজেল, তুমি আমাকে ধরতে পারবে না, তোমার জন্য বুদ্ধিমান হবে আমার পাশে দাঁড়ানো অন্যান্য গ্যাজেলদের ধরা যারা এতটা উঁচুতে লাফাতে পারেনা!’ আরো খানিকটা কম নরাতৃরোপ অর্থে, উঁচু লাফ দেবার জিনগুলো এবং সাড়ম্বরভাবে সেটি প্রদর্শন করার জিনগুলো শিকারী প্রাণীর খাদ্য হবার সম্ভাবনা কম কারণ শিকারী প্রাণীদের প্রবণতা আছে এমন শিকারকে ধরা যাদের সহজে ধরা যায়। বিশেষ করে, অনেক স্তন্যপায়ী শিকারী প্রাণী পুরো দল থেকে বৃদ্ধ আর অসুস্থদের শিকার হিসাবে ধরার জন্য পরিচিত। কোনো একটি সদস্য যে কিনা অনেক উঁচুতে লাফায়, সে কোনো বিজ্ঞাপন করছে না, অতিরিক্ত মাত্রায়, বাস্তব সত্য হচ্ছে সে না বৃদ্ধ না দুর্বল। এই তত্ত্বানুযায়ী, এই প্রদর্শনী পরার্থবাদী অবশ্যই না। যদি কোনো কিছু এর সম্বন্ধে বলতেই হয় তবে এটি স্বার্থপর, কারণ এর উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্য আরেকজনকে ধরার চেষ্টা করার জন্য শিকারী প্রাণীকে প্ররোচিত করা। সুতরাং এক অর্থে চলে কে সবচেয়ে উঁচুতে লাভ দিতে পারে সেটি দেখার জন্য সেখানে একটি প্রতিযোগিতা চলমান এবং এই প্রতিযোগিতায় যারা হারে শিকারী প্রাণী শিকার হিসাবে তাদের মধ্যে থেকে কাউকে বাছাই করে।
অন্য উদাহরণটি যা আমি বলেছিলাম, আমি আবার সেই বিষয়ে আলোচনায় ফিরে আসবো– কামিকাজি মৌমাছিদের কেসটি, যা মধু খেতে আসা প্রাণীদের আক্রমণ করে তবে সেটি করতে গিয়ে তারা প্রায় নিশ্চিৎ মৃত্যুর মুখোমুখি হয়। উচ্চমাত্রার সামাজিক কীটপতঙ্গের অনেক উদাহরণের মধ্যে শুধুমাত্র একটি মৌমাছি। অন্যান্য উদাহরণ যেমন, ওয়াস্প বা বোলতারা, পিপড়া, উইপোকা বা সাদা-পিপড়া। আমি সাধারণভাবে সামাজিক প্রাণী নিয়ে আলোচনা করতে চাই, শুধুমাত্র আত্মঘাতি মৌমাছিদের নিয়ে না। সামাজিক কীটপতঙ্গের নানা ধরনের কর্মকাণ্ড প্রায় কিংবদন্তীর মত, বিশেষ করে তাদের সহযোগিতা বা আপাতদৃষ্টিতে পরার্থবাদী আচরণের বিস্ময়কর সব আচরণগুলো। আত্মঘাতী কামড় দেবার মিশন তাদের আত্মোৎসর্গ করার প্রতিভারই প্রতিনিধিত্ব করে। ‘হানি-পট’ পিপড়াদের মধ্যে একটি শেণীর শ্রমিকরা আছে, তাদের অদ্ভুতভাবে স্ফীত, খাদ্য-ভর্তি পেট থাকে, যাদের জীবনের একটি মাত্র কাজ হচ্ছে তাদের বানানো সুড়ঙ্গের ছাদ থেকে ঝুলে থাকা, স্ফীত কোনো লাইট বাল্বের মত, অন্যান্য শ্রমিক পিপড়ারা যাদের খাদ্য উৎস হিসাবে ব্যবহার করে। মানুষের বোধগম্য ভাষায় তারা আদৌ কোনো একক সদস্য হিসাবে জীবন কাটায় না, তাদের একক অস্তিত্ব তাদের পুরো সমাজের কল্যাণের জন্যবন্দী আর নিয়ন্ত্রিত। পিপড়াদের, মৌমাছিদের বা উইপোকাদের কোনো সমাজ উচ্চতর পর্যায়ে এক ধরনের স্বকীয়তা অর্জন করে। খাদ্য সেখানে যেভাবে ভাগ করে নেয়া হয় সবার সাথে, আমরা হয়তো বলতে পারি যেন কোনো একটি সামাজিক পাকস্থলী। রাসায়নিক সংকেতের দ্বারা এত দক্ষতার সাথে তথ্য আদান-প্রদান করে, কিংবা মৌমাছিদের বিখ্যাত নাচের সাহায্যে যে পুরো গ্রুপটি এমনভাবে আচরণ করে যেন তারা একটি একক সত্তা, যাদের একটি স্নায়ুতন্ত্র আছে এবং একটি অনুভব করার ইন্দ্রিয় আছে– যা তাদের নিজস্ব। বহিঃশত্রুদের শনাক্ত করা হয় এবং তাদের প্রতিরোধ করা হয় শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মত খানিকটা সুনির্দিষ্টতার সাথে। কোনো একটি মৌচাকে বিদ্যমান উচ্চ তাপমাত্রা মানুষের শরীরের তাপমাত্রার মতই সূক্ষ্মভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, এমনকি যদিও কোনো একক মৌমাছি কিন্তু “উষ্ণ রক্ত বিশিষ্ট প্রাণী নয়। পরিশেষে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, এই উপমা সম্প্রসারিত করা যেতে পারে প্রজননের ক্ষেত্রেও। কোনো সামাজিক পতঙ্গ কলোনীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা মূলত প্রজনন অক্ষম বা স্টেরাইল কর্মীদের দ্বারা তৈরী। জার্ম লাইন– অমর জিনের ধারাবাহিকতার সেই বংশধারা– সংখ্যালঘু কিছু সদস্যদের শরীরের মাধ্যমে হস্তান্তরিত হয়– যারা প্রজনন করে। এদের আমরা তুলনা করতে পারি আমাদের অণ্ডকোষ আর ডিম্বাশয়ের সাথে। প্রজননে অক্ষম বা নির্বীজ কর্মীদের আমরা তুলনা করতে পারি আমাদের যকৃত,মাংসপেশী এবং স্নায়ুকোষের সাথে।
শ্রমিকদের কামিকাজি বা আত্মঘাতী আচরণ এবং অন্যান্য ধরনের পরার্থবাদীতা ও সহযোগিতা আদৌ বিস্ময়কর না, যদি আমরা একবার স্বীকার করে নেই যে তারা নীর্বিজ বা প্রজনন অক্ষম। জিনের টিকে থাকার বিষয়টি নিশ্চিৎ করতে কোনো একটি সাধারণ প্রাণীর শরীর উদ্দেশ্যমূলকভাবে পরিচালিত হতে পারে দুটি উপায়ে, সেটা হতে পারে সন্তানের জন্ম দিয়ে কিংবা অন্য একজন সদস্যদের দেখাশোনা করা মাধ্যমে, যারা কিনা একই জিন বহন করে। অন্য সদস্যদের দেখাশোনা করার স্বার্থে আত্মহত্যা করা কারো নিজের সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য অসামঞ্জস্যপূর্ণ। আত্মঘাতী আত্মবিসর্জন সেকারণে কদাচিৎ বিবর্তিত হয়। কিন্তু কোনো একটি শ্রমিক মৌমাছি তার নিজের কোনো সন্তান উৎপাদন করেনা, তার সব প্রচেষ্টা নিজের সন্তান নয় বরং অন্যান্য আত্মীয়দের দেখাশোনা করার মাধ্যমে তার জিনের সূরক্ষা করার জন্য নির্দেশিত। প্রজনন অক্ষম একটি মৌমাছির মৃত্যু এর জিনের জন্য হেমন্তের সময় পাতার ঝরে গেলে গাছের জিনের জন্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ নয়।
সামাজিক কীটপতঙ্গদের আচরণের উপর আধ্যাত্মিক দুর্বোধ্যতার প্রলেপ লাগাবার একটি প্রলোভন আছে, কিন্তু আসলেই তার কোনো প্রয়োজন নেই। একটু বিস্তারিতভাবে দেখার প্রয়োজন আছে কিভাবে স্বার্থপর জিন তত্ত্ব এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করে, এবং বিশেষ করে, কিভাবে এটি কর্মীদের প্রজনন অক্ষমতার অসাধারণ প্রপঞ্চটির বিবর্তনীয় উৎসটি ব্যাখ্যা করে, যেখান থেকে আরো অনেক কিছুই আপাতদৃষ্টিতে আমরা অনুসরিত হতে দেখি।
সামাজিক পতঙ্গদের কোনো কলোনী হচ্ছে একটি বিশাল পরিবার, সাধারণত সবাই একই মায়ের সন্তান। কর্মীরা, যারা কদাচিৎ বা কখনোই নিজেরা প্রজনন করে না, তারা শ্রেণীবিন্যস্ত কিছু সংখ্যক সুস্পষ্ট শেণীতে, যেমন, ক্ষুদ্র কর্মী, বৃহদাকার কর্মী, সৈন্য এবং অতিমাত্রায় বিশেষায়িত শ্রেণী যেমন, হানি-পট সসদ্য। প্রজননক্ষম স্ত্রী সদস্যদের বলা হয় “কুইন’ বা রানি। প্রজনন-সক্ষম পুরুষদের কখনো কখনো বলা হয় ‘ড্রোন’ অথবা ‘কিং”। এবং আরো অগ্রসর। সমাজে, প্রজননক্ষমরা প্রজনন ছাড়া কখনোই আর কলোনির জন্য অন্য কোনো কাজ করেনা, তবে এই একটি কাজে তারা অত্যন্ত দক্ষ। তারা কলোনীর কর্মীদের উপর নির্ভর করে তাদের খাদ্য আর সুরক্ষার জন্য এবং কর্মীদের দ্বায়িত্ব হচ্ছে গ্রুপের সব সন্তানদের দেখাশুনা করা। কিছু পিপড়া আর উইপোকার প্রজাতির মধ্যে রানিরা স্ফীতকায় বিশালাকার ডিমের কারখানার মত একটি রুপ নেয়, খুবই কঠিন তখন একে পতঙ্গ হিসাবে শনাক্ত করা, শতগুণ বেশী আকারের বড় যেকোনো কর্মীর চেয়ে, রানি তার আকারের জন্য নড়াচড়া করতে প্রায় অক্ষম। রানীকে সারাক্ষণই দেখাশোনা করছে। কর্মীরা, তাকে খাওয়াচ্ছে, তার নিরন্তরভাবে প্রসব করা ডিমগুলো তারা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাদের যৌথ সামাজিক নার্সারীতে। যদি এমন একটি দানবাকৃতির রাণীকে কখনো তার রাজকীয় কক্ষ থেকে স্থানান্তরিত করতে হয়, তাকে সেই সেই বিশাল কর্মী বাহিনীরা ঘাড়ে করে তার জায়গা পরিবর্তন করতে সাহায্য করে।
অধ্যায় ৭ এ আমি সন্তান ধারণ আর প্রতিপালনের মধ্যে পার্থক্যের বিষয়টি উপস্থাপন করেছিলাম। আমি বলেছিলাম যে, মিশ্র কৌশলগুলো, প্রতিপালন এবং সন্তান ধারণে মিশ্রণ, খুব সাধারণভাবেই বিবর্তিত হবে। অধ্যায় ৫ এ আমরা দেখেছি মিশ্র বিবর্তনীভাবে স্থিতিশীল কৌশল দুটি সাধারণ ধরনের হতে পারে। কোনো জনগোষ্ঠীতে হয় প্রতিটি সদস্য একটি মিশ্র উপায়ে আচরণ করবে: এভাবে সদস্যরা সাধারণত সন্তান ধারণ ও প্রতিপালনের একটি বিচক্ষণ মিশ্রণ অর্জন করে; অথবা, জনগোষ্ঠী হয়তো দুটি ভিন্ন ধরনের সদস্যে বিভাজিত হতে পারে। এবং এভাবেই আমরা প্রথম সেই দৃশ্য দেখেছিলাম হক এবং ডাভদের মধ্যে একটি ভারসাম্যময় পরিস্থিতিতে। তবে এটি তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব সন্তান ধারণ এবং প্রতিপালনের মধ্যে বিবর্তনীয়ভাবে স্থিতিশীল একটি ভারসাম্য অর্জন করা যেতে পারে পরবর্তী ধরনের উপায়ে: জনগোষ্ঠীকে সন্তান ‘ধারক’ এবং প্রতিপালকে ভাগ করা যেতে পারে। কিন্তু এটি বিবর্তনীয়ভাবে স্থিতিশীল হবে শুধুমাত্র যদি প্রতিপালকরা সেই সব সদস্যদের নিকটাত্মীয় হয় যাদের তারা প্রতিপালন করে, অন্ততপক্ষে এই আত্মীয়তা সেই পরিমান নিকটবর্তী হয়, যেমন তাদের যদি কোনো সন্তান থাকে, তাদের সাথে যে পরিমান নিকটবর্তী সম্পর্ক হতো। যদিও এটি তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব বিবর্তনের জন্য এই পথে অগ্রসর হওয়া, কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে শুধুমাত্র সামাজিক কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রেই এটি আসলেই ঘটে (১)।
সামাজিক পতঙ্গদের গ্রুপে সদস্যরা দুটি প্রধান শ্রেণীতে বিভক্ত, সন্তান উৎপাদনকারী এবং প্রতিপালনকারী। উৎপাদনকারীরা হচ্ছে। প্রজননক্ষম পুরুষ এবং স্ত্রী সদস্যরা। প্রতিপালকরা হচ্ছে কর্মীরা– অনুর্বর পুরুষ এবং স্ত্রী সদস্যরা যেমন, উইপোকাদের ক্ষেত্রে, অনুর্বর স্ত্রী সদস্যরা অন্য সব সামাজিক কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে। উভয় ধরনের সদস্যরা তাদের কাজ অনেক বেশী দক্ষতার সাথে করে কারণ তাদের পরস্পরের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয় না। কিন্তু কার দৃষ্টিভঙ্গিতে এই প্রক্রিয়াটি দক্ষ? যে প্রশ্নটি ডারউইনীয় তত্ত্বের দিকে ছুঁড়ে দেয়া হয়, সেই খুব পরিচিত একটি চিৎকার: এখানে কর্মীদের কি লাভ থাকতে পারে?
কিছু মানুষ এর উত্তর দিয়েছে, কোনো কিছু না। তারা অনুভব করেন যে, রানি তাদের নিজের ইচ্ছামতই সব কিছু পাচ্ছে, সে তার কর্মী বাহিনীকে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ব্যবহার করছে রাসায়নিক অণুর সাহায্য নিয়ে, তারা কর্মীদের বাধ্য করে তার অসংখ্য সন্তানের প্রতিপালন করতে। এটাই আলেকজান্ডারের প্যারেন্টাল ম্যানিপুলেশন’ এর একটি সংস্করণ, যে তত্ত্বটির সাথে আমরা পরিচিত হয়েছি অধ্যায় ৮ এ। বিপরীত ধারণাটি হচ্ছে যে কর্মীরা আসলে প্রজননকারীদের চাষ করে, কর্মীরা তাদেরকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহার করে তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্যে, কর্মীদের জিনের অনুলিপি প্রজন্মান্তরে হস্তান্তর করার জন্য। নিশ্চিৎ বিষয়টি হচ্ছে সারভাইভাল মেশিনগুলো, যা রানিরা জন্ম দেয় তারা কর্মীদের সন্তান নয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা নিকটাত্মীয়। হ্যামিলটনই প্রথম অসাধারণ দক্ষতায় অনুধাবন করেছিলেন যে, অন্তত পিপড়া, মৌমাছি আর বোলতাদের ক্ষেত্রে, কর্মীরা হয়তো আসলেই সম্পর্কে রানির নিজের চেয়েও রানির সন্তানদের অনেক বেশী নিকটাত্মীয়। এবং এই বিষয়টি তাকে এবং পরে ট্রিভার্স এবং হেয়ার, স্বার্থপর জিন তত্ত্বের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজয়ের ধারণায় উপনীত হতে সাহায্য করেছিল। এবং তাদের যুক্তি প্রক্রিয়াটি ছিল এরকম।
হাইমেনোপটেরা (Hymenoptera) গ্রুপের কীটপতঙ্গ, যেমন, পিপড়া, মৌমাছি এবং বোলতাসহ অন্যদের লিঙ্গ নির্ধারণ করারএকটি অদ্ভুত পদ্ধতি আছে। টারমাইটরা এই গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত না এবং তাদের এই অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যটিও নেই। একটি হাইমেনোপটেরাদের কলোনীতে সাধারণত একটি প্রাপ্তবয়স্ক রানি থাকে। রানি প্রজননের জন্য একবার মাত্র ওড়ে (মেটিং ফ্লাইট) যখন সে বয়সে তরুণ এবং তার বাকী দীর্ঘ জীবন ধরে সে শুক্রাণুগুলো তার শরীরে জমা করে রাখে– দশ বছর কিংবা আরো দীর্ঘ সময়। ধীরে ধীরে সে তার ডিম্বাণুগুলোর জন্য এই শুক্রাণুগুলো ব্যবহার করে দীর্ঘ সময় ধরে, যা এই ডিম্বাণুগুলোকে নিষিক্ত হবার সুযোগ দেয় যখন সেগুলো তার প্রজনন নালীর মধ্য দিয়ে বাইরে বের হয়ে আসে। কিন্তু সব ডিম্বাণুগুলো নিষিক্ত হতে পারেনা। যেগুলো অনিষিক্ত সেগুলো পুরুষ হিসাবে জন্ম নেয়। পুরুষদের সেকারণে কোন বাবা নেই এবং তাদের শরীরে শুধুমাত্র এক সেট ক্রোমোজোম থাকে (পুরোটাই আসে তার মায়ের কাছ থেকে) দুই সেট এর বদলে ( যা আসে একটি বাবা থেকে ও আরেকটি মায়ের নিকট থেকে, যেমন, আমাদের মধ্যে থাকে। অধ্যায় ৩ এ সমরুপ উদাহরণটি ব্যবহার করলে, একটি পুরুষ হাইমেনোপটেরা সদস্যের প্রতিটি ‘খণ্ডের একটি করে অনুলিপি তার সব কোষের মধ্যে অবস্থান করে, সাধারণত দুটো থাকার বদলে।
কিন্তু একটি স্ত্রী হাইমেনোপটেরা সদস্যের ক্ষেত্রে এটি স্বাভাবিক, কারণ তার একজন বাবা আছে এবং তার শরীরে প্রতিটি কোষে এক জোড়া ক্রোমোজোম থাকে। হাইমেনোপটেরান কোনো স্ত্রী সদস্য, কর্মী হিসাবে বড় হবে, নাকি রানি হবে সেটি তার জিনের উপর নির্ভর করেনা বরং নির্ভর করে কিভাবে তাকে প্রতিপালিত করা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে বলা যে, প্রতিটি স্ত্রী সদস্যদের রানি হিসাবে গড়ে ওঠার পুরো সেট জিন থাকে এবং কর্মী-তৈরী করার পুরো সেট জিন থাকে (অথবা বরং, জিনের সেট থাকে প্রতিটি বিশেষায়িত শ্রেণীর কর্মী কিংবা সৈন্য ইত্যাদি হিসাবে গড়ে তোলার জন্য); কোন সেট জিনগুলো সক্রিয় হয়ে উঠবে, সেটি নির্ভর করে কিভাবে স্ত্রী সদস্যটিকে প্রতিপালিত হয়েছিল, বিশেষ করে কি ধরনের খাদ্য সে গ্রহন করেছিল।
যদিও অনেক জটিলতা আছে তবে মূল বিষয়টি মূলত এরকমই। আমাদের জানা নেই কেন এই অসাধারণ পদ্ধতির যৌন প্রজনন পদ্ধতি বিবর্তিত হয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু কারণ ছিল, কিন্তু এই মুহূর্তে আমাদের অবশই এটিকে হাইমেনোপটেরাদের বিষয়ে অদ্ভুত একটি বাস্তব সত্য হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। এই ব্যতিক্রমী ব্যপারটির সূচনার মূল কারণ যাই থাকুক না কেন, এটি অধ্যায় ৬ এর আত্মীয়তা পরিমাপ করার সুন্দর সুস্পষ্ট নিয়মটা ওলট পালট করে দেয়। এর মানে হচ্ছে কোনো একটি একক পুরুষ সদস্য থেকে আসা শুক্রাণু, আমাদের শরীরে যেমন তারা ভিন্ন, তা না হয়ে সবগুলো হুবহু একরকম হয়। পুরুষ সদস্যদের শরীরে শুধুমাত্র একটি পুর্ণ সেট থাকে, দুটি সেট নয়। প্রতিটি শুক্রাণু সেকারণে একটি পুরো সেট জিন পায়, পুরো নমুনার ৫০ শতাংশ পাবার বদলে এবং সে কারণে সব শুক্রাণু হুবহু একই রকম। আসুন এবার আমরা চেষ্টা করি মা এবং সন্তানদের মধ্যে সম্পর্ক পরিমাপ করতে। যদি কোনো পুরুষ সদস্য– আগেই থেকে জানা থাকে যে– একটি জিন ধারণ করে, যেমন ‘ক’, কি পরিমান সম্ভাবনা আছে সেই একই জিন তার মার শরীরেও থাকার? এর উত্তর অবশ্যই হবে ১০০ শতাংশ, কারণ পুরুষদের কোনো বাবা নেই এবং তারা সব জিন পেয়েছে তাদের মার কাছ থেকে। কিন্তু ধরুন রানির শরীরে একটি জিন আছে, ‘খ’, তার ছেলের শরীরে সেই জিনটির থাকার সম্ভাবনা মাত্র ৫০ শতাংশ, কারণ সে শুধুমাত্র তার ‘অর্ধেক’ জিন পায়। বিষয়টি শুনতে কেমন যেন পরস্পরবিরোধী মনে হচ্ছে, আসলে কিন্তু সেরকম কিছু নয়। কোনো একটি পুরুষ সদস্য তার সব জিন পায় তার মায়ের কাছ থেকে, কিন্তু মা তার জিনের অর্ধেক কেবল তার ছেলেকে দেয়। আপাতদৃষ্টিতে এই পরস্পরবিরোধীতার সমাধান হচ্ছে সাধারণত যে পরিমান জিন থাকার কথা, পুরুষ সদস্যদের শরীরে এর অর্ধেক পরিমান জিন আছে। সুতরাং কোন কারণই নেই সংশয়গ্রস্থ হওয়া যে সত্যিকারের আত্মীয়তার ইনডেক্স ১/২ নাকি ১; ইনডেক্স বা সূচকটি মানব নির্মিত একটি পরিমাপ, এবং সেকারণেই এটি বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করে, আর সেকারণে আমাদের হয়তো এটি পরিত্যাগ করা উচিৎ এবং প্রথম মূলনীতিতে প্রত্যাবর্তন করা উচিৎ। কোনো একজন রানির শরীরে থাকা একটি ‘ক’ জিনের দৃষ্টিভঙ্গিতে সেই জিনটি তার ছেলের শরীরে থাকার সম্ভাবনা ১/২, ঠিক একইভাবে তাদের কন্যাদের জন্যে সেটি প্রযোজ্য। রানির দৃষ্টিভঙ্গিতে সুতরাং তার সন্তানরা, যে কোনো লিঙ্গের হোক না কেন, মানব সন্তানরা তাদের মায়েদের যতটা নিকটাত্মীয় ঠিক ততটাই নিকটাত্মীয় হয়।
পুরো বিষয়টি আরো বেশী কৌতূহলোদ্দীপক হয়ে ওঠে, যখন আমরা। বোনদের সম্পর্কটি পর্যালোচনা করি। পুর্ণ বোনরা শুধুমাত্র একটি বাবার সন্তানই না, দুটি শুক্রাণু যা তাদের জন্ম দিয়েছে, তারা প্রতিটি জিন পর্যায়ে হুবহু একই রকম। বোনরা সেকারণে হুবহু যমজের সমতুল্য, যদি আমরা পিতার জিনের কথা বিবেচনা করি। যদি কোনো একটি স্ত্রী সদস্যের ‘ক’ জিন থাকে, সে অবশ্যই সেটি পেয়েছে তার বাবা অথবা মায়ের কাছ থেকে। যদি সে এটি পেয়ে থাকে তার মায়ের কাছ থেকে, তাহলে ৫০ শতাংশ সম্ভাবনা আছে। তার বোনেরও সেই একই জিন থাকবে, কিন্তু জিনটি যদি সে তার বাবার কাছ থেকে পায়, তাহলে তার বোনের সেই জিনটি থাকার সম্ভাবনা ১০০ শতাংশ। সুতরাং হাইমেনোপটেরান পুর্ণ বোনদের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক সাধারণ যৌন প্রজননক্ষম প্রাণীদের মধ্যে যেমন ১ হয়, তা না হয়ে বরং হয় ৩/৪।
এর অর্থ হচ্ছে একটি হাইমেনোপটেরান স্ত্রী সদস্য তার পূর্ণ বোনদের অনেক নিকটাত্মীয় তাদের যে কোনো লিঙ্গের সন্তানদের চেয়ে (২); যেমন, হ্যামিলটন অনুধাবন করেছিলেন (যদিও তিনি ঠিক সেভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করেননি) এই বিষয়টি হয়তো কোনো একটি স্ত্রী সদস্যদের মধ্যে পূর্ব প্রবণতা সৃষ্টি করে তার নিজের মাকে একটি দক্ষ কন্যা সন্তান তৈরীর যন্ত্র হিসাবে চাষ করার জন্য। কোনো একটি জিন যা প্রতিনিধিকভাবে বোন তৈরী করবে সেটি তার নিজেকে অনেক দ্রুত অনুলিপি করবে সরাসরিভাবে সন্তান উৎপাদনকারী জিনের অপেক্ষায়। সেকারণেই কর্মীদের প্রজনন অক্ষমতা বিবর্তিত হয়েছে। সম্ভবত কোনো দুর্ঘটনা না, যে সত্যিকারের সামাজিকতা, কর্মীদের প্রজনন অক্ষমতাসহ, হাইমেনোপটেরানদের মধ্যে স্বতন্ত্রভাবে সম্ভবত বিবর্তিত হয়েছিল অন্ততপক্ষে এগারোবার এবং সেটি শুধুমাত্র একবার ঘটেছিল বাকী প্রাণী জগতে, সেটি হচ্ছে উইপোকাদের মধ্যে।
তবে, এখানে একটি বিষয় লক্ষ করার আছে। যদি কর্মীরা সফলভাবে তাদের মাকে তাদের বোন সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। হিসাবে চাষ করতে পারে, তাদের অবশ্যই কোনো না কোনোভাবে তার সমসংখ্যক ভাইয়ের জন্ম দেবার প্রাকতিক প্রবণতাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কোনো একজন কর্মীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একটি ভাইয়ের তার কোনো একটি জিন ধারণ করার সম্ভাবনা মাত্র ১/৪, সুতরাং, যদি কোনো রানিকে সুযোগ দেয়া হয় একই পরিমান পুরুষ এবং নারী প্রজননক্ষম সন্তান জন্ম দেবার জন্য, কর্মীদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেএই খামার লাভজনক কিছু হবে না। তারা তাদের গুরুত্বপূর্ণ জিনগুলো হস্তান্তরের সুযোগ সর্বোচ্চ পরিমানে বাড়িয়ে দেয় না।
ট্রিভাস এবং হেয়ার অনুধাবন করেছিলেন যে, কর্মীরা স্ত্রী সদস্যদের পক্ষে লিঙ্গ অনুপাতের ভারসাম্যটি পরিচালিত করার জন্য অবশ্যই চেষ্টা করবে। তারা ফিশারের সবচেয়ে অনুকূল লিঙ্গ অনুপাতের গণনা ( যা আমরা এর আগের অধ্যায়ে দেখেছি) নিয়েছিলেন এবং সেটি নতুন করে উপস্থাপন করেন হাইমেনপটেরাদের বিশেষ ক্ষেত্রে। ফলাফলে দেখা যায় যে কোনো একটি মায়ের জন্য বিনিয়োগের স্থিতিশীল অনুপাত হচ্ছে, যথারীতি ১:১। কিন্তু কোনো একটি বোনের জন্য স্থিতিশীল অনুপাত ভাইদের অপেক্ষা বোনদের পক্ষে ৩:১। যদি আপনি কোনো হাইমেনোপটেরান স্ত্রী সদস্য হন, তাহলে আপনার জিনের ভবিষ্যৎ টিকিয়ে থাকার জন্য সবচেয়ে দক্ষ উপায় হবে আপনার নিজেকে প্রজনন থেকে বিরত রাখা এবং আপনার মাকে বাধ্য করা আপনার জন্য ৩:১ অনুপাতে প্রজননক্ষম বোন ও ভাইয়ের জন্ম দেয়া। কিন্তু যদি আপনি বাধ্য হন আপনার নিজের সন্তান জন্ম দেবার জন্য, আপনি আপনার জিনের জন্য সবচেয়ে উপযোগী যে কাজটি করতে পারবেন সেটি হচ্ছে সমান অনুপাতে প্রজননক্ষম কন্যা এবং পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়া।
যেমনটি আমরা দেখেছি, রানীদের এবং কর্মীদের মধ্যে পার্থক্য জিনগত নয়। যতদুর তার জিন নিয়ে কথা হচ্ছে, কোনো একটি ভ্রূণ স্ত্রী সদস্য হয়তো নিয়তিবদ্ধ কর্মী হবার জন্য, যে ‘চায়’ ৩:১ লিঙ্গ অনুপাত অথবা একটি রানি যে ‘চায়’ একটি ১:১ লিঙ্গ অনুপাত। বেশ এই ‘চাওয়া’ বলতে আমরা কি বোঝাচ্ছি? এর অর্থ হচ্ছে কোনো একটি জিন যে তার নিজেকে কোনো একটি রানির শরীরে খুঁজে পায় সে সবচেয়ে ভালোভাবে তার বংশবিস্তার করতে পারে যদি সেই শরীর সমানভাবে বিনিয়োগ করে তার প্রজনন সক্ষম পুত্র এবং কন্যাদের জন্য। কিন্তু সেই একই জিন যখন তার নিজেকে খুঁজে পায় কোনো কর্মীর শরীরে সে তার বংশ বিস্তার করতে পারে সবচেয়ে ভালো সেই শরীরের মাকে পুত্র অপেক্ষা আরো বেশী কন্যা সন্তান উৎপাদন করানোর মাধ্যমে। কোনো সত্যিকারের ধাঁধা কিন্তু এখানে নেই। একটি জিন অবশ্যই শ্রেষ্ঠতম সুযোগটি গ্রহন করবে শক্তির সেই চালিকাশক্তিটির যা ঘটনাচক্রে তার অধীনস্থ। যদি এটি একে এমন কোনো অবস্থানে পায় যা কিনা কোনো শরীর তৈরী প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলতে পারে এমনভাবে যে এটি কেবল রানি হবার জন্য নির্দিষ্ট হয়। এর জন্য সবচেয়ে অনুকল কৌশল সেই নিয়ন্ত্রণকে তার স্বার্থে ব্যবহার করা, এবং এটি হচ্ছে একটি বিষয়। আর যদি সে নিজেকে এমন কোনো অবস্থানে আবিষ্কার করে যেখানে সে এমনভাবে প্রভাব খাটায় যে কৰ্মীর শরীর তৈরী হয়, তার এই ক্ষমতাটি নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার সবচেয়ে অনুকূল কৌশলটি ভিন্ন একটি ব্যাপার।
এর মানে হচ্ছে সেই খামারের অভ্যন্তরে স্বার্থের সংঘাত আছে। রানি ‘চেষ্টা করে পুরষ এবং স্ত্রী সদস্যদের প্রতি সমানভাবে বিনিয়োগ করতে। কর্মীরা চেষ্টা করে প্রজননক্ষমদের অনুপাত পরিবর্তন করার জন্য, একটি পুরুষ প্রতি তিনটি স্ত্রী সদস্যের দিক বরাবর। আমরা যদি ঠিক হয়ে থাকি কর্মীদের এমনভাবে দেখতে যে তারা কৃষক। এবং তাদের রানি হচ্ছে সন্তান উৎপাদনকারী কোনো স্ত্রী ঘোড়া, সম্ভবত কর্মীরা সফল হবে তাদের ৩:১ অনুপাত অর্জন করার জন্য। যদি তা না হয়, যদি রানি আসলেই তার নামের মতই রানি হয়ে থাকে এবং কর্মীরা তার ক্রীতদাস আর রাজকীয় নার্সারীর অনুগত রক্ষণাবেক্ষণকারী হয়, তাহলে আমাদের উচিৎ হবে ১:১ অনুপাত আশা করা– রানি যে পরিস্থিতি পছন্দ করবেন সেখানে বিরাজ করুক। কে আসলে বিজয়ী হয় আন্তঃপ্রজন্ম যুদ্ধের বিশেষ ক্ষেত্রটিতে? এটি হচ্ছে এমন একটি বিষয় যাকে পরীক্ষার মুখোমুখি করা যেতে পারে এবং ঠিক সেটাই করেছিলেন ট্রিভার্স এবং হেয়ার, বহু সংখ্যক প্রজাতির পিপড়াদের ব্যবহার করে।
যে লিঙ্গ অনুপাতটি আমাদের জন্য কৌতূহলের সেটি হচ্ছে প্রজননক্ষম স্ত্রী সদস্যদের সাথে প্রজননক্ষম পুরুষ সদস্যদের অনুপাত। এগুলো হচ্ছে বড় ডানাসহ রুপ যারা পিপড়াদের কলোনীর নীড় থেকে বেরিয়ে আসে নির্দিষ্ট বিরতির পর পর প্রজননের জন্য উড়তে, যারা পরে তরুণ রানি হিসাবে হয়তো চেষ্টা করবে নতুন কলোনী খুঁজে বের করতে। এবং এই সব ডানাসহ রুপগুলো গুণতে হবে লিঙ্গ অনুপাতের একটি পরিমাপ গণনা করার জন্য। পুরুষ এবং স্ত্রী প্রজননক্ষম সদস্যরা, অনেক প্রজাতিতে, আকারে ও আকৃতিতে খুবই অসমান। বিষয়টি জটিলতা সৃষ্টি করে কারণ যেমনটি আমরা এর আগের অধ্যায়ে দেখেছি, ফিশারে গণনা হচ্ছে সবচেয়ে অনুকুল লিঙ্গ অনুপাত খুব কঠোরভাবে প্রযোজ্য, স্ত্রী এবং পুরুষ সদস্যদের সংখ্যার প্রতি না, বরং পুরুষ এবং স্ত্রী সদস্যদের উপর বিনিয়োগের পরিমানের উপর। ট্রিভার্স এবং হেয়ারের জন্য প্রয়োজনীয় ছাড় দিয়েছিলেন আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়ে। তারা মোট ২০টি প্রজাতির পিপড়ার উপর কাজ করেন এবং তাদের লিঙ্গ অনুপাত নির্ণয় করেন প্রজননক্ষম সদস্যদের তৈরীতে বিনিয়োগের পরিমান কেমন ছিল সেই ভাষা ব্যবহার করে। তারা বিশ্বাসযোগ্যভাবেই বরং সেখানে খুঁজে পান যা তাত্ত্বিকভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা পুরুষের সাথে স্ত্রী সদস্যদের অনুপাত ৩:১ এর খুব কাছাকাছি অবস্থান করে, যে তত্ত্ব দাবী করে কর্মীরা পুরো প্রক্রিয়াটি ব্যবহার করে তাদের নিজেদের স্বার্থে (৩)।
তাহলে মনে হতে পারে, যে পিপড়াগুলো এখানে গবেষণা করা হয়েছে, স্বার্থের এই সংঘাতে ‘জয় লাভ করে কর্মীরা। এবং এটি বেশী বিস্ময়কর না কারণ শ্রমিকদের শরীর, যারা নার্সারীর প্রতিপালক হবার কারণে, রানির শরীর অপেক্ষা বাস্তব ক্ষেত্রেই অনেক বেশী ক্ষমতাময়। রানীর শরীরের মাধ্যমে বিশ্বকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার জন্য প্রচেষ্টারত জিনকে বোকা বানিয়ে দেয় কর্মীদের শরীর ব্যবহার করে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টারত জিনগুলো। ব্যাপারটা বেশ কৌতূহলোদ্দেীপক হবে সেই বিশেষ কোনো পরিস্থিতির সন্ধান করা যেখানে আমরা হয়তো প্রত্যাশা করতে পারি যে রানিদের ব্যবহারিক পর্যায়ে কর্মীদের চেয়ে বেশী ক্ষমতা আছে। ট্রিভার্স এবং হেয়ার অনুধাবন করেন যে এমন কিছু পরিস্থিতি আছে যা কিনা ব্যবহার করা যেতে পারে এই তত্ত্বটির একটি নীরিক্ষাধর্মী পরীক্ষা করার জন্য।
এই বিষয়টির উদ্ভব হয় সেই বাস্তব সত্য থেকে যে, কিছু কিছু প্রজাতি পিপড়া আছে যারা অন্য প্রাণীদের দাস হিসাবে ব্যবহার করে। কোনো দাস-বানানোর প্রজাতির কর্মীরা হয় তারা কোন সাধারণ কাজ করে না অথবা তারা সেই সব সাধারণ কাজে খুব অদক্ষ। তারা যে কাজে ভালো সেটা হলো দাস সংগ্রহের জন্য অভিযানে যোগ দেয়া। সত্যিকারের যুদ্ধ, যেখানে প্রতিপক্ষের বিশাল সংখ্যক সেনারা আমৃত্যু যুদ্ধ করে, যা আচরণ সুপরিচিত শুধুমাত্র মানুষ এবং সামাজিক কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে। পিপড়াদের অনেক প্রজাতির মধ্যে কর্মীদের বিশেষায়িত শ্ৰেণী, যেমন, সৈন্যরা, তাদের মারামারি করার উপযোগী ভয়ঙ্কর ধরনের শক্তিশালী চোয়াল আছে এবং তারা তাদের সময় ব্যয় করে অন্যান্য পিপড়া সেনাদের আক্রমণ থেকে নিজেদের কলোনীকে রক্ষা করার জন্য। দাস সংগ্রহ করার অভিযান শুধুমাত্র একটি বিশেষ ধরনের যুদ্ধ প্রচেষ্টা। দাস সংগ্রহকারী ভিন্ন প্রজাতির কোনো পিপড়াদের কলোনীর নীড়ে আক্রমণ করে, সেখানে প্রতিরোধ করতে আসা কর্মী এবং সৈন্যদের হত্যা করে এবং তারা এখনও ডিম ফুটে বের না হয়ে আসা লার্ভাদের নিয়ে যায়। এই সব বাচ্চারা তাদের বন্দী করে রাখা পিপড়াদের নীড়ে ডিম ফুটে বের হয়ে আসে। তারা অনুধাবন করতে পারে না যে তারা আসলে দাস, এবং তাদের ভিতরে ইতিমধ্যেই বিদ্যমান স্নায়ুতন্ত্রের প্রোগ্রাম মোতাবেক তারা কাজে লেগে যায়, তারা নিজেদের নেস্টে যা করতে তারা সাধারণভাবে সেই কাজগুলো করতে শুরু করে। দাস সংগ্রহকারী কর্মী বা সৈন্যরা যখন আরো দাস সংগ্রহ করার অভিযানে বের হয়, তখন এই দাসরা তাদের ঘরে অবস্থান করে, এবং পিপড়াদের নেস্ট এর দৈনন্দিন কাজগুলো সম্পাদন করে: পরিষ্কার,খাদ্য সংগ্রহ, নেস্টে থাকা বাচ্চাগুলোকে যত্ন করা ইত্যাদি।
দাসরা অবশ্যই, সুখকরভাবেই অজ্ঞাত থাকে যে তারা আসলে রানির এবং সেই সব শিশুদের আত্মীয় নয়, যাদের দেখাশোনা তারা করছে। নিজেদের অজান্তেই তারা দাস বানানো কর্মীদের নতুন দলের প্রতিপালন করে। কোনো সন্দেহ নেই, প্রাকৃতিক নির্বাচন দাস প্রজাতির জিনের উপর প্রভাব খাঁটিয়ে, দাস-বিরোধী অভিযোজনে সহায়তা করছে। তবে,স্পষ্টতই এগুলো পুরোপুরিভাবে কার্যকর না কারণ দাসত্ব হচ্ছে আরো ব্যাপকভাবে বিস্তৃত একটি প্রাকৃতিক ঘটনা।
দাসত্বের পরিণতি যা আমাদের বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গিতে কৌতূহলোদ্দীপক সেটি হচ্ছে: দাস বানানোর প্রজাতির রানি এখন এমন একটি অবস্থানে থাকে যা লিঙ্গ অনুপাতকে প্রভাবিত করে যেকোনো দিকে যা সে পছন্দ করে। এবং এর কারণ তার নিজের সত্যিকারের সন্তান, দাস বানানো কর্মীরা, আর নার্সারীর উপর বাস্তবিকভাবে কোনো ক্ষমতা অনুশীলন করতে পারেনা। এই নতুন ক্ষমতার মালিক এখন দাস। দাস ‘ভাবে তারা নার্সারীতে তাদের নিজেদের ভাইবোনদের প্রতিপালন করছে, এবং খুব সম্ভবত সেই সবই কাজ করছে যা কিছু তারা তাদের নিজেদের কলোনীতে থাকলে প্রযোজ্য হিসাবে মনে করতো তাদের পছন্দের সেই অনুপাত অর্জন করার জন্য, তাদের বোনদের সাপেক্ষে ৩:১ অনুপাত। কিন্তু দাস বানানোর প্রজাতির রানির এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই অন্য ব্যবস্থা গ্রহন করার ক্ষমতা আছে এবং দাসদের উপর রানীর বিপরীত প্রক্রিয়াটিকে নিষ্ক্রিয় করতে এখানে কোনো নির্বাচন কাজ করেনা, কারণ দাসরা রানির সন্তানদের থেকে জিনগতভাবে সম্পূর্ণ আলাদা।
যেমন ধরুন, যেকোনো একটি পিপড়া প্রজাতিতে, রানি ‘চেষ্টা করে তার পুরুষ ডিমগুলোকে একটি ছদ্ম রুপ দেবার জন্য, স্ত্রী ডিমগুলোর মতো একই ধরনের গন্ধ সৃষ্টি করে। প্রাকৃতিক নির্বাচন সাধারণত কর্মীদের যেকোন প্রবণতাকে সহায়তা করবে এই প্রতারণার কৌশলটি শনাক্ত করার জন্য। আমরা হয়তো একটি বিবর্তনীয় যুদ্ধ কল্পনা করতে পারি, যেখানে রানি “নিরন্তরভাবে কোড বা নিয়ম পরিবর্তন করছে এবং কর্মীরা সেই ‘কোড বা নিয়ম ভাঙছে। এই যুদ্ধে জয় হবে তাদের, যারাই তাদের জিনের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে প্রজননক্ষমদের শরীর ব্যবহার করে পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তর করতে পারে। সাধারণত কাজটি করে কর্মীরা, যেমনটি আমরা দেখেছি। কিন্তু দাস-বানানো প্রজাতির রানি নিয়ম পরিবর্তন করে, দাস কর্মীরা সেই নিয়ম ভাঙ্গার মত কোনো দক্ষতা বিবর্তিত করতে পারেনা। এর কারণ হচ্ছে কোনো দাস কর্মীর শরীরে ‘সংকেত ভাঙ্গার জন্য কোনো জিন প্রজননক্ষম কোনো প্রাণী সদস্যের শরীরে প্রতিনিধিত্ব করে না, সুতরাং এটি প্রজন্মান্তরে হস্তান্তরিতও হয়না। প্রজননক্ষমরা সবাই দাস বানানো প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত এবং তারা দাস না, রানিদের আত্মীয়। প্রজননক্ষমরা সবাই দাস-বানানো প্রজাতির সদস্য কিন্তু তারা দাসদের আত্মীয় নয়। যদি দাসদের জিন কোনো প্রজননক্ষম সদস্যের শরীরে আদৌ কোনোভাবে জায়গা করে নেয়, সেটি হবে সেইসব প্রজননক্ষম সদস্য, যারা মূল সেই কলোনীর নীড় থেকে বেরিয়ে এসেছিল যেখান থেকে তাদের অপহরণ করা হয়েছিল একসময়। দাস কর্মীরা, যদি কিছু করে, সেটি হচ্ছে তারা ভুল নিয়মের মর্মোদ্ধারে ব্যস্ত থাকবে! সেকারণে কোনো একটি দাস বানানো প্রজাতির রানিরা তাদের কোড স্বাধীনমত পরিবর্তন করে পার পেতে পারে, কোনো ধরনের আশংকা ছাড়াই যে কোড ভাঙ্গার জিন পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তরিত হবে।
এই সংশ্লিষ্ট যুক্তিটির পরিণতি হচ্ছে যা আমাদের প্রত্যাশা করা উচিৎ, দাস-বানানোর প্রজাতিতে প্রজননক্ষমদের বিনিয়োগের অনুপাত দুই লিঙ্গের মধ্যে ১:১ এর কাছাকাছি হবে, বরং ৩:১ এর এর থেকে। অন্তত একবার, রানি তার নিজের মত করে সুযোগ পাবে। এটাই ঠিক ট্রিভার্স এবং হেয়ার খুঁজে পেয়েছিলেন, যদিও তারা মাত্র দুটি দাস বানানো প্রজাতির মধ্যে গবেষণা করেছিলেন।
আমি এখানে অবশ্যই জোর দিতে চাই, আমি এই গল্পটি বলেছি একটি আদর্শরুপ অনুসারে। বাস্তব জীবন এত পরিষ্কার আর সুশৃঙ্খল নয়। যেমন, সবচেয়ে পরিচিত সামাজিক পতঙ্গ, মৌমাছি, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় পুরোপুরিভাবে ভুল কিছু করে। রানিদের তুলনায় পুরুষ সদস্যদের জন্য অনেক বাড়তি পরিমান বিনিয়োগ আমরা দেখি– যা আপাতদৃষ্টিতে অর্থবহ কিছু বলে মনে হয়না, কর্মীদের কিংবা মা রানির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। হ্যামিলটন আমাদের এই ধাঁধার একটি সম্ভাব্য সমাধান প্রস্তাব করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে যখন কোনো একটি রানী মৌমাছি মৌচাক ছেড়ে চলে যায় সে সাথে করে তাকে দেখাশোনা করার জন্য একঝাক কর্মীও নিয়ে যায়, যারা তাকে নতুন কলোনি তৈরী করতে সাহায্য করে। জন্মের মৌচাক থেকে এই কর্মীরা চিরকালের জন্য হারিয়ে যায় এবং এদের তৈরী করার মূল্য অবশ্যই প্রজনন মূল্যের অংশ হিসাবে গণ্য করে নেয়া হয়: প্রতিটি রানি যে মৌচাক ত্যাগ করে, বহু ‘বাড়তি’ কর্মী তাদের জন্য তৈরী করতে হয়। এই সব বাড়তি কর্মীর জন্য বিনিয়োগকে প্রজননক্ষম স্ত্রী সদস্যদের প্রতি বিনিয়োগের অংশ হিসাবে ভাবা উচিৎ হবে। বাড়তি কর্মীদের ওজন করা উচিৎ হবে পুরুষদের ভারসাম্যের বিপরীতে যখন লিঙ্গ অনুপাত পরিমাপ করা হয়। সুতরাং সর্বোপরি এটি খুব একটি গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক সমস্যা নয়।
এই তত্ত্বটির অসাধারণ কাঠামোর আরো অদ্ভুত একটি বিষয় হচ্ছে সেই বাস্তব সত্যটি যে, কিছু প্রজাতির ক্ষেত্রে তরুণ রানিরা তাদের প্রজননের জন্য ওড়ার সময় একজনের পরিবর্তে বেশ কয়েকজন পুরুষের সাথে মিলিত হয়। এর মানে হচ্ছে যে তার কন্যাদের মধ্যে গড় আত্মীয়তার পরিমান ৩/৪ এর কম এবং চরম কোনো পরিস্থিতিতে এটি এমনকি ১/৪ এর কাছাকাছি অবস্থান করতে পারে। সেকারণে লোভনীয় যে, যদিও সম্ভবত খুব বেশী যৌক্তিক নয়, এটিকে কর্মীদের উপর রানিদের ধূর্ত কোনো আক্রমণ হিসাবে গণ্য করা! ঘটনাচক্রে, এটি হয়তো এমন কোনো প্রস্তাব করছে বলে মনে হতে পারে কর্মীদের কোনো রানীকে তার প্রজননের জন্য ওড়ার সময় চোখে চোখে রাখার দরকার আছে, যেন তাকে একাধিকবার প্রজনন করা থেকে বিরত রাখা যায়। কিন্তু সেটি কর্মীদের নিজের জিনের জন্য কোনো উপকারে আসবে না– শুধুমাত্র আগামী প্রজন্মের কর্মীদের জিন ছাড়া। শ্ৰেণী হিসাবে কর্মীদের মধ্যে কোনো ট্রেড ইউনিয়ন স্পিরিট’ নেই। তাদের প্রত্যেকেই তাদের নিজেদের জিনের কথা ছাড়া আর কিছু ‘ভাবে না। কোনো একটি কর্মী হয়তো পছন্দ করতো তার নিজেদের মাকে চোখে চোখে রাখতে, কিন্তু তার সেই সুযোগ থাকে না, কারণ তার সেই সময় জন্ম না হবার কারণে। তার ‘মেটিং ফ্লাইটে একটি তরুণ রানি হচ্ছে বর্তমান প্রজন্মের কর্মীদের বোন, তাদের মা নয়। সুতরাং পরবর্তী প্রজন্মের কর্মীদের চেয়ে বরং তারা তার পক্ষেই থাকে, যারা শুধুমাত্র তাদের ভাইঝি হবে। আমার মাথা এখন ঘুরছে, এই প্রসঙ্গটির ইতি টানার উপযুক্ত সময় এটি।
হাইমেনোপটেরান কর্মীরা তাদের ‘মা’দের সাথে করে থাকে সেটিকে আমি একটি খামারের সাথে তুলনা করেছিলাম। যে খামারটি হচ্ছে জিনের খামার। নিজেরা যতটুকু করতে পারতো তারচেয়ে আরো বেশী দক্ষতার সাথে তারা তাদের মাকে তাদের। নিজেদের জিনের অনুলিপি উৎপাদন করার জন্য ব্যবহার করে। জিনগুলো প্রজননক্ষম সদস্য হিসাবে প্রোডাকশন লাইন থেকে বের। হয়ে আসে। এই খামারের তুলনামূলক উদাহরণের সাথে কোনো সংশয় থাকার উচিৎ না যে সামাজিক কীটপতঙ্গদের প্রসঙ্গে যা ‘চাষ’ বলা হচ্ছে সেটির অর্থটি খুব ভিন্ন। সামাজিক কীটপতঙ্গরা আবিষ্কার করেছিল, যা মানুষ করেছিল বহুদিন পর, কোন একটি জায়গায় স্থিতিশীল হয়ে খাদ্য ‘চাষ’ করা, ‘শিকার কিংবা খাদ্য-সংগ্রহ করার চেয়ে অনেক বেশী দক্ষ একটি উপায় হতে পারে।
যেমন, নিউ ওয়ার্ল্ডে (উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা) বেশ কিছু প্রজাতির পিপড়া এবং পুরোপুরি স্বতন্ত্রভাবে আফ্রিকার টারমাইটরা। (উইপোকা) “ফাঙ্গাস বা ছত্রাকের বাগান চাষ করার কৌশল বিবর্তিত করেছিল। এই ক্ষেত্রে দক্ষিণ-আমেরিকার ‘প্যারাসল’ পিপড়ারা সবচেয়ে সুপরিচিত। তারা ভীষণভাবে সফল একটি প্রজাতি। তাদের একটি কলোনীতে দুই মিলিয়নেরও বেশী সদস্য খুঁজে পাওয়া গেছে। তাদের নীড়গুলো মাটির নিচে, প্রায় ১০ ফুট কিংবা আরো গভীরে বিস্তৃত জটিল সুড়ঙ্গপথ আর খোলা জায়গার একটি আন্তসংযোগকৃত সুবিশাল একটি জালের মত ছড়িয়ে থাকে। যা তৈরী করতে তাদের প্রায় ৪০ টন পরিমান মাটি খুড়তে হয়েছে। মাটির নীচের কিছু কক্ষে থাকে ছত্রাকের বাগান। পিপড়ারা পরিকল্পিত উপায়ে একটি বিশেষ প্রজাতির ছত্রাক রোপন করে বিশেষায়িত একটি কম্পোষ্ট বিছানো মাটিতে যা তারা নিজেরা তৈরী করে পাতা চিবিয়ে নরম টুকরো টুকরো করে। সরাসরি নিজেদের খাদ্য সন্ধান করে সংগ্রহ করার বদলে, এই প্রজাতির পিপড়ারা কেবল পাতা সংগ্রহ করে কম্পোষ্ট তৈরী করার জন্য। পাতার জন্য প্যারাসল পিপড়াদের পুরো কলোনীর ক্ষুধা দানবসদৃশ। এটাই তাদের চিহ্নিত করেছে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিকর একটি পতঙ্গ বা পেস্ট হিসাবে। কিন্তু পাতাগুলো তাদের খাদ্য নয় বরং তাদের চাষ করা ছত্রাকের জন্য খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। পরবর্তীতে পিপড়ারা এখানে ছত্রাকের চাষ করে এবং ছত্রাক খায় এবং তাদের সন্তানদের খাদ্য হিসাবে খাওয়ায়। পাতার উপাদানগুলো ভাঙ্গার জন্য পিপড়াদের পাকস্থলী থেকে এই ছত্রাকগুলো আরো অনেক বেশী দক্ষ, আর এভাবেই পিপড়ারা সুবিধাপ্রাপ্ত হয় এই বন্দোবস্ত থেকে। সম্ভবনা আছে যে ছত্রাক প্রজাতিটিও লাভবান হয়, যদিও তাদের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে: কারণ, তাদের নিজেদের স্পোর বিস্তার করে প্রজননের প্রক্রিয়া যা অর্জন করতে পারতো, এই পিপড়ারা তার চেয়ে আরো দক্ষভাবে তাদের বংশবিস্তারে সহায়তা করে। উপরন্তু, পিপড়ারা তাদের ছত্রাক বাগানের আগাছা পরিষ্কার করে, অন্যান্য ছত্রাক প্রজাতিদের সেখানে বংশবিস্তার করার সুযোগ দেয় হয়না। প্রতিদ্বন্দ্বিতা সরিয়ে দেবার কারণে এটি হয়তো তাদের ‘গৃহপালিত’ ছত্রাকের বংশবৃদ্ধিতে বাড়তি সহায়তা করে। পিপড়া এবং ছত্রাক প্রজাতির মধ্যে বিদ্যমান একধরনের পারস্পরিক পরার্থবাদীতার সম্পর্ক আছে তাই বলা যেতে পারে। বিস্ময়কর একটি ব্যাপার হচ্ছে, প্রায় একই ধরনেরই একটি ছত্রাক চাষাবাদের পদ্ধতি বিবর্তিত হয়েছিল স্বতন্ত্রভাবে, পুরোপুরিভাবে ভিন্ন এক প্রজাতি, টারমাইটদের মধ্যে।
পিপড়াদের নিজস্ব ‘গৃহপালিত প্রাণীও আছে, “গৃহপালিত’ ফসল (ছত্রাক) যেমন থাকে। এফিড– গ্রিনফ্লাই এবং সদৃশ কিছু পোকা—অত্যন্ত বিশেষায়িত কোনো উদ্ভিদের রস শুষে খাওয়ার জন্য। তারা যতটা দক্ষভাবে উদ্ভিদের রসনালী থেকে রস শুষে নিতে পারে তত দক্ষতার সাথে এর পরে সেটি তারা পরিপাক করতে পারে না। ফলাফলে তারা একটি তরল নিঃসরণ করে যার থেকে খুব সামান্যই পুষ্টিগুণ শোষিত হয়েছে। শর্করা সমৃদ্ধ এই ‘হানিডিউ’ ফোঁটা এফিডদের শরীরের পেছন থেকে অত্যন্ত দ্রুত হারে বের হতে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতি ঘন্টায় পতঙ্গটির নিজের শরীরের ওজনের চেয়ে বেশী। হানিডিউ সাধারণত বৃষ্টির মত মাটিতে ঝরে পড়ে– এটি হয়তো সেই স্বর্গীয় খাদ্য হতে পারে, ওল্ড টেস্টামেন্ট এ যাকে বলা হয়েছে ‘মান্না। কিন্তু বেশ কিছু প্রজাতির পিপড়া এই প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে যেই মুহূর্তে সেটি এফিডের পেছন থেকে বের হয়ে আসে। পিপড়ারা এফিডের শরীর থেকে দুধ দোয়ানোর মত করে রস বের করে আনে এফিডদের শরীরের পেছনে ফিলার আর পা দিয়ে টোকা দিয়ে। এফিড তাদের এই আহবানের সাড়া দেয়, কিছু ক্ষেত্রে এমনকি তাদের সেই হানিডিউর ফোঁটা আটকে রাখে যতক্ষণ না পর্যন্ত পিপড়া তাদের পিছনে টোকা না দেয় বা এমনকি সেই ফোঁটাটি আবার সরিয়ে নেয় শরীরের ভেতরে যদি না পিপড়াটি সেটি গ্রহন করার জন্য প্রস্তুত না থাকে। প্রস্তাব করা হয়েছে যে, কিছু এফিড তাদের পেছনের অংশ এমনভাবে বিবর্তিত করেছে যে দেখতে এবং অনুভব করতে পিপড়ার মুখের মত মনে হয়, পিপড়াদের আরো ভালো করে আকর্ষণ করার জন্য। এফিডরা এই সম্পর্ক থেকে যা অর্জন করে সেটি হচ্ছে আপাতদৃষ্টিতে তারা তাদের প্রাকৃতিক শত্রুর হাত থেকে সুরক্ষা পায়। আমাদের গবাদী পশুদের মত তারাও একটি সুরক্ষিত জীবন কাটায়। যে সকল এফিড প্রজাতিদের বিশেষভাবে প্রতিপালন করে পিপড়ারা, এবং তারা তাদের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পিপড়া এমনকি এফিডদের ডিমও দেখাশোনা করে মাটির নিচে তাদের ঘরে, বাচ্চা এফিডদের তারা খাওয়ায় এবং অবশেষে যখন তারা পুর্ণবয়ষ্ক হয়, সুরক্ষিত কোনো গাছের কাণ্ডে রস শুষে খাবার জন্য তাদেরকে সাবধানে সেখানে তুলে নিয়ে যায়, অনেকটা চরে বেড়াবার জন্য তার চারণ ভূমিতে।
পারস্পরিক উপকার করার এই সম্পর্ক, যা ঘটে ভিন্ন প্রজাতির সদস্যদের মধ্যে সেটি পরিচিত মিউচালিজম অথবা সিমবায়োসিস বা মিথোজীবিতা হিসাবে। বিভিন্ন প্রজাতির সদস্যরা প্রায়শই অনেক কিছু পরস্পরকে নিবেদন করে, তারা এই অংশীদারিত্বের সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন দক্ষতার যোগান দেয়। এই ধরনের মৌলিক অপ্রতিসাম্যতা পারস্পরিক সহযোগিতার বিবর্তনীয় ভাবে স্থিতিশীল একটি কৌশল সৃষ্টির পথ সুগম করে। উদ্ভিদের রস খাওয়ার জন্য এফিডদের সঠিক মুখোপাঙ্গ থাকে, কিন্তু এই ধরনের শুষে খাবার উপযোগী মুখোপাঙ্গ আত্মরক্ষার জন্য উপযোগী নয়। উদ্ভিদের রস শুষে খাবার জন্য পিপড়ারা খুব একটা দক্ষ না, কিন্তু তারা খুব ভালো যুদ্ধ করতে পারে। এফিডদের প্রতিপালন ও তাদের রক্ষা করার পিপড়ার জিনটির সংখ্যা পিপড়ার জিনপুলে বিশেষ সুবিধা পারেন। পিপড়াদের সাথে সহযোগিতা করার এফিডদের জিন বিশেষভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত হয় এফিডদের জিনপুলে।
পারস্পরিক আদান প্রদানের এই মিথোজীবি সম্পর্কগুলো প্রাণী এবং উদ্ভিদের জগতে প্রায়শই দেখা যায়। একটি লাইকেন আপাতদৃষ্টিতে যেকোনো একটি বৃক্ষের উপরের পৃষ্ঠে বসবাস করে, কিন্তু তারা আসলে একটি ছত্রাক ও সবুজ শৈবালের খুবই ঘনিষ্ঠ মিথোজীবি একটি সম্পর্ক। এই অংশীদারিত্বের কোনো অংশই এককভাবে। টিকতে পারেনা, তাদের পারস্পরিক সহায়তার প্রয়োজন হয়। যদি তাদের এই সম্মিলন আরো খানিকটা অন্তরঙ্গ হয় আমরা তাহলে হয়তো আর বলতে পারবো না যে একটি লাইকেন হচ্ছে দুটি জীবের একটি মিশ্রণ। হয়তো এরকম আরো দুটি বা বহু জীবের সংমিশ্রণ অছে যাদের আমরা এখনও সেভাবে শনাক্ত করতে পারিনি। হয়তো এমনকি আমরাও?
আমাদের প্রত্যেকের শরীরে প্রতিটি কোষের মধ্যে অসংখ্য ক্ষুদ্র অঙ্গাণু থাকে, যাদের ‘মাইটোকন্ড্রিয়া’ বলা হয়। মাইটোকন্ড্রিয়ারা হচ্ছে রাসায়নিক কারখানা, আমাদের শরীরের প্রয়োজনীয় শক্তির বেশীর ভাগ অংশের যোগান দেবার দ্বায়িত্ব তারা পালন করে থাকে। কোনোভাবে যদি আমরা আমাদের মাইটোকন্ড্রিয়াদের হারাই তাহলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমরা মারা যাবো। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তিগ্রাহ্যভাবে প্রস্তাব করা হয়েছে যে, মাইটোকন্ড্রিয়া হচ্ছে, এর উৎসে, মূলত মিথোজীবি ব্যাকটেরিয়া, যারা আমাদের কোষের সাথে জোড় বেধেছিল বিবর্তনের প্রায় শুরুর দিকে। একই ধরনের প্রস্তাব করা হয়েছে আমাদের কোষের ভিতরের থাকা অন্যান্য অঙ্গাণুদের ক্ষেত্রেও। এবং এটি সেই সব বৈপ্লবিক ধারণার একটি যার প্রতি অভ্যস্ত হবার জন্য সময়ের প্রয়োজন, কিন্তু এটি হচ্ছে এমন একটি ধারণা যার প্রয়োজনীয় গুরুত্ব পাবার সময় হয়েছে। আমি ধারণা করছি যে, আমরা আরো অনেক বেশী বৈপ্লবিক ধারণা, যেমন, আমাদের প্রত্যেকটি জিন আসলে স্বতন্ত্র মিথোজীবি ইউনিট– একসময় গ্রহন করতে পারবো। আমরা হচ্ছি মিথোজীবি জিনদের একটি দানবাকৃতির একটি কলোনী। আমরা আসলেই এই ধারণার সপক্ষে কোনো প্রমাণের কথা বলতে পারিনা, কিন্তু আমি চেষ্টা করেছি। প্রস্তাব করতে এর আগের অধ্যায়গুলোতে, এটি আসলেই সেই প্রক্রিয়াটির অন্তর্গত, যৌন প্রজননের মাধ্যমে প্রজনন করা প্রজাতির সাথে জিন কিভাবে কাজ করে, যেভাবে সেটি আমরা ভাবি। এই মুদ্রার অন্য পিঠ, ভাইরাসরা হতে পারে জিন, যারা এই ধরনের কলোনী, যেমন, আমরা, থেকে নিজেদের মুক্ত করেছে। ভাইরাসরা মূলত তৈরী বিশুদ্ধ ডিএনএ (বা সমগোত্রীয় স্ব-অনুলিপনকারী অণু) যাদের ঘিরে থাকে একটি প্রোটিনের আচ্ছাদন। তারা সবাই মূলত পরজীবি। প্রস্তাবটি হচ্ছে তারা সবাই বিবর্তিত হয়েছে তথাকথিত বিদ্রোহী জিনগুলো থেকে যারা কলোনী থেকে পলায়ন করেছে এবং এখন এক শরীর থেকে অন্য শরীরে যাতায়াত করে সরাসরি বাতাসের মধ্য দিয়ে, বরং সেই প্রথাগত উপায়, শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু দ্বারা শরীর থেকে শরীরে হস্তান্তর হবার প্রক্রিয়াটির বদলে। যদি এটি সত্যি হয়, আমরা হয়তো আমাদের গন্য করতে পারি আসলে ভাইরাসদের একটি কলোনী হিসাবে! যাদের কিছু অংশ মিথোজীবি হিসাবে পরস্পরের সহযোগিতা করে, শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুর মাধ্যমে এক শরীর থেক অন্য শরীরে তারা যাতায়াত করে। এরাই হচ্ছে প্রথাগত ‘জিন। অন্যরা টিকে থাকে পরজীবি হিসাবে। এবং তারা যাতায়াত করে তাদের পক্ষে সম্ভব যেকোন উপায়ে। যদি পরজীবি ডিএনএ ভ্রমণ করে শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুর মাধ্যমে, এটি হয়তো তৈরী করে সেই ‘ধাঁধার মত বাড়তি ডিএনএ, যা আমি এর আগে উল্লেখ করেছিলাম অধ্যায় ৩ এ। আর যদি এটি বাতাসের মাধ্যমে বা অন্য কোনো সরাসরি উপায়ে যাতায়াত করে, এটিকে সাধারণ অর্থে ‘ভাইরাস’ বলা হয়।
কিন্তু এই সব ধারণাগুলো ভবিষ্যতের জন্য। বর্তমানে আমরা অনেক উচ্চ পর্যায়ের সম্পর্কের মিথথাজীবিতা নিয়ে ব্যস্ত, যা ঘটে বহুকোষী প্রাণীদের মধ্যে, তাদের নিজেদের শরীরের অভ্যন্তরে যেটি ঘটে সেটি না। ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ককে বোঝাতে ‘মিথোজীবি’ শব্দটি সাধারণত ব্যবহার করা হয়, কিন্তু, যেহেতু আমরা প্রজাতির জন্য যা কিছু ভালো’ বিবর্তনের এমন দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিহার করতে শিখেছি, আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে বিভিন্ন প্রজাতির সদস্যদের মধ্যে সহযোগিতাকে একই প্রজাতির সদস্যদের মধ্যে সহযোগিতা থেকে পৃথক করার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। সাধারণভাবে, পারস্পরিক সহযোগিতার এই সম্পর্ক বিবর্তিত হয় যদি প্রতিটি অংশীদার যতটুকু সেই সম্পর্কে বিনিয়োগ করছে তারচেয়ে বেশী উপকার পায়। এবং এটা সত্যি যখন আমরা হায়েনাদের একটি দলের সদস্যদের কথা বলছি বা অনেক বেশী ভিন্ন কোনো জীব প্রজাতির মধ্যে সম্পর্কের কথা বলছি যেমন, পিপড়া এবং এফিডরা বা মৌমাছি আর ফুলরা। কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে সত্যিকারের দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার সম্পর্ক থেকে একপাক্ষিক স্বার্থপর সুবিধাজনক সম্পর্কের উদাহরণগুলো আলাদা করা বেশ কঠিন হতে পারে।
পারস্পরিক সুবিধার সম্পর্কের বিবর্তন তাত্ত্বিকভাবে কল্পনা করা সহজ যদি কোনো বিশেষ সুবিধার আদান প্রদান যুগপৎভাবে ঘটে থাকে, যেমনটি ঘটে সেই সব অংশীদারদের মধ্যে যারা একটি লাইকেন তৈরী করে। কিন্তু সমস্যা উদ্ভূত হয় যদি কোনো উপকার প্রদানের পর এর প্রতিদান পেতে দেরী হয়। এর কারণ প্রথম উপকার গ্রহীতা হয়তো প্রলুদ্ধ হতে পারে প্রতিদান না দিয়ে প্রতারণা করতে যখন তার প্রতিদান দেবার সময় আসে। এই সমস্যার সমাধান বেশ কৌতূহলদ্দীপক এবং ব্যাপকভাবে আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা আছে। আমি সেই কাজটি ভালোভাবে করতে পারবো যদি একটি হাইপোথেটিকাল উদাহরণ ব্যবহার করি।
মনে করুন একটি প্রজাতির পাখিদের পরজীবি হিসাবে আক্রান্ত করে খুব খারাপ ধরনের একটি টিক, যারা একটি ভয়ঙ্কর রোগ বহন করে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে এই সব টিকগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরিয়ে ফেলা উচিৎ। সাধারণত কোনো একটি একক পাখি নিজেই তার টিককে সরিয়ে ফেলে নিজের পালক পরিষ্কার রাখার সময়। কিন্তু একটি জায়গা– মাথার ঠিক উপরের অংশ– সে নিজের ঠোঁট দিয়ে পরিষ্কারের কাজটি করতে পারেনা। এই সমস্যার একটি সমাধান কি হতে পারে সেটি যে কোনো মানুষ সাথে সাথেই চিন্তা করতে পারবে। কোনো একজন হয়তো তার নিজের মাথা ছুতে পারেন না, এবং কোনো একজন বন্ধুর সাহায্য নিয়ে কাজটি করার মত সহজতর আর কোনো সমাধান নেই। পরবর্তীতে, যখন সেই বন্ধুটির নিজেই টিক দ্বারা আক্রান্ত হবে, তার সেই ভালো কাজটির প্রতিদান দেয়া যেতে পারে। পাখি এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে পারস্পরিক ‘গ্রুমিং’ বা পারস্পরিক পরিষ্কার আর পরিচর্যা করে রাখার আচরণটি বাস্তবিকভাবে খুবই দৃশ্যমান একটি আচরণ।
বিষয়টি খুব দ্রুত সজ্ঞালদ্ধ জ্ঞানেই বোধগম্য মনে হয়। যে কেউই যার সচেতন ভবিষ্যৎ দৃষ্টি আছে সে দেখতে পারে যে একটি পারস্পরিক ‘পিঠ চুলকে দেবার’ বা সহায়তার একটি সম্পর্কে প্রবেশ করা বুদ্ধিমানের মত কাজ হবে। কিন্তু আমরা শিখেছি সতর্ক হতে, আপাতদৃষ্টিতে সহজাতভাবে যা অর্থময় মনে হতে পারে। কারণ জিনের কোনো দুরদৃষ্টি নেই। তাহলে কি স্বার্থপর জিনের তত্ত্বটি পারবে এই পারস্পরিক ‘পিঠ চুলকে’ দেবার সম্পর্কটির বা যাকে বলা যেতে পারে ‘পরস্পরমুখী পরার্থবাদীতার’ (রেসিপ্রোকাল অ্যালট্রইজম) ব্যাখ্যা দিতে, যেখানে কোনো উপকার আর সেটির প্রতিদান পাবার ক্ষেত্রে বিলম্ব হয়? উইলিয়ামস তার ১৯৬৬ সালে বইটিতে এই বিষয়টি সংক্ষিপ্তভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন, যার কথা আমি ইতিমধ্যেই উল্লেখ করেছি। তার উপসংহার ছিল, যেমন ছিল ডারউইনেরও, বিলম্বে ঘটা পরস্পরমুখী পরার্থবাদিতা কোনো একটি প্রজাতির মধ্যে বিবর্তিত হতে পারে, যে প্রজাতির সদস্যরা একে অপরকে পৃথক সদস্য হিসাবে চিনতে এবং মনে রাখতে পারে। ট্রিভার্স, ১৯৭১ সালে বিষয়টির আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন, যখন তিনি লিখেছিলেন, তার কাছে তখনও মেনার্ড স্মিথের বিবর্তনীয়ভাবে স্থিতিশীল কৌশল বা ‘ইএসএস’ এর ধারণাটি ছিল না। যদি সেটি তার জানা থাকতো, আমার ধারণা তিনি তার সদ্ব্যবহার করতেন। কারণ এটি তাকে তার ধারণাগুলো প্রকাশ করার জন্য একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক উপায় নিশ্চিৎ করতো। তার প্রিজনার’স ডাইলেমা’র প্রতি তথ্যনির্দেশ- গেম তত্ত্বের একটি প্রিয় ধাঁধা– প্রদর্শন করছে তিনি ইতিমধ্যে সেভাবেই ভাবতে শুরু করেছিলেন।
ধরুন, ‘খ’ এর মাথার উপর একটি পরজীবি আছে, ‘ক’ সেটি তার মাথা থেকে খুটে তুলে ফেলে। পরে যখন সময় আসবে, ‘ক’ এর নিজের মাথার উপরেই একটি পরজীবি থাকে, খুব স্বাভাবিকভাবে সে ‘খ’ কে খুঁজে বের করে যেন ‘খ’, তার মাথার উপর থেকে পরজীবিটি খুটে ফেলে দিয়ে তার পূর্বে করা সেই উপকারটির প্রতিদান দেয়। দেখা গেল, ‘খ’ তার এই আহবানে কোনো কর্ণপাত না করে নাক ঘুরিয়ে অন্য দিকে চলে গেল। ‘খ’ এখানে একজন প্রতারক, একজন সদস্য যে অন্য একজন সদস্যদের উপকারের সুযোগ ঠিকই গ্রহন করে কিন্তু সে এর প্রতিদান দেয়না বা সে এর প্রতিদান যতটুকু দেয়া উচিৎ ছিল, তা দেয়না। প্রতারকরা স্বভাবতই নির্বিচারে অন্যের উপকার করে যাওয়া পরার্থবাদীদের তুলনায় ভালো করে কারণ তারা কোনো মূল্য পরিশোধ ছাড়াই সুবিধা ভোগ করে। নিশ্চিৎ হবার জন্য, অন্য একজন সদস্যর মাথা পরিষ্কার করার মূল্য মনে হতে পারে খুব সামান্য, যদি ক্ষতিকর পরজীবিকে সরিয়ে দেবার ফলে প্রাপ্ত সুবিধার কথা বিবেচনা করা হয়, কিন্তু এটি একেবারে উপেক্ষা করার মত সামান্য নয়। কিছু গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ও সময় এর পিছনে ব্যয় করতে হয়।
ধরা যাক সেই জনগোষ্ঠী এমন সদস্যদের দিয়ে তৈরী যারা দুটি কৌশলের যেকোনো একটিকে বেছে নেয়। মেনার্ড স্মিথের বিশ্লেষণের মত, আমরা কোনো “সচেতন’ কৌশলের কথা ভাবছি না, কিন্তু ভাবছি অবচেতন মনে প্রোগ্রাম করা আচরণের কথা, যার মূল রচয়িতা হচ্ছে ‘জিন’। এই দুটো কৌশলের নাম দেয়া যাক, ‘সাকার’ এবং ‘চিট’। সাকাররা’ যে-কারো মাথা থেকে পরজীবি বেছে দেয় যাদের সেটি প্রয়োজন আছে, নির্বিচারে। “চিটরা’ উপকার গ্রহন করে ‘সাকারদের কাছ থেকে, কিন্তু তারা কখনো অন্য কারো মাথা থেকে পরজীবি বেছে দেয়না। এমনকি সেই সদস্যকেও সে প্রতিদানে কোনো উপকার করেনা, যে এর আগেই তাদের মাথা থেকে পরজীবি বেছে দিয়েছিল। “হক’ এবং “ডাভদের ক্ষেত্রে যেমন ঘটেছিল, আমরা মনগড়া একটি উপায়ে তাদের জন্য উপকারের বিনিময় মূল্য পয়েন্টের মাধ্যমে চিহ্নিত করি। তাদের সঠিক মূল্যমান কি, কোনো কিছু যায় আসে না, যতক্ষণ নিজের মাথা থেকে কারো পোকা বেছে পরিষ্কার করে দেবার কাজটির উপকারিতা, অন্য কারো মাথা থেকে পরজীবি পরিষ্কার করার কাজ থেকে প্রাপ্ত সুবিধার চেয়ে বেশী হবে। যদি পরজীবিদের প্রকোপ অনেক বেশী থাকে, কোনো ‘সাকার’ সাকারদের জনগোষ্ঠীতে মনে করতে পারে সে যতবার অন্য কারো মাথা থেকে পরজীবি সরাবে, সে নিজেও এই ধরনের সুযোগ পাবে অন্য সাকারদের কাছ থেকে। সে কারণে গড়পড়তাভাবে কোনো একটি সাকার জনগোষ্ঠীতে উপকারের বিনিময় মূল্য ধনাত্মক। সেখানে তারা সবাই বেশ ভালোই করে বাস্তবিকভাবে এবং “সাকার’ শব্দটিও প্রযোজ্য নয় বলেই মনে হয়। কিন্তু এখন মনে করুন একটি ‘চিট’ বা প্রতারকের জন্ম হলো সেই জনগোষ্ঠীতে। এবং একা ‘চিট’ হবার সুবাদে সে আশা করতে পারে সবাই তার মাথা থেকে পরজীবি সরিয়ে দেবে, কিন্তু বিনিময়ে সে কাউকে সেই উপকারটির প্রতিদান দেয় না। তার গড়পড়তা লাভ কোনো একজন ‘সাকারের’ গড়পড়তা লাভের চেয়ে বেশী। ‘চিটদের’ জিন একারণে জনগোষ্ঠীতে বিস্তার লাভ করবে। ‘সাকারদের’ জিন খুব দ্রুত বিলুপ্তির পথে হারিয়ে যাবে। এর কারণ জনগোষ্ঠীতে যে অনুপাতই থাকুক না কেন, “চিটরা সবসময়ই সাকারদের চেয়ে ভালো করবে। যেমন, এমন এক পরিস্থিতির কথা ভাবুন যখন জনগোষ্ঠীতে মোট ৫০ শতাংশ ‘সাকার’ আর ৫০ শতাংশ ‘চিট’ থাকে। গড় লাভ, সাকার এবং চিট উভয়েরই কম হবে, যে-কোনো সদস্যের জন্যে, যারা ১০০ শতাংশ ‘সাকার’ সম্বলিত জনগোষ্ঠীর সদস্য। কিন্তু তারপরও চিটরা বেশী ভালো করবে সাকারদের তুলনায় কারণ তারা সব সুবিধাই পাচ্ছে– যেমন আসলে তারা– এবং কোনো প্রতিদান না দিয়ে। যখন ‘চিটদের’ অংশ জনগোষ্ঠীর মোট ৯০ শতাংশ হবে, তখন সব সদস্যের গড়পড়তা লাভ খুব কম হবে: এই দুটি প্রকারের বহু সদস্যই এখন মারা যাবে টিকদের (একটি পরজীবি) বহন করে আনা সংক্রামক ব্যাধির আক্রমণে। কিন্তু তখনও ‘সাকারদের চেয়ে ‘চিটা’ ভালো করে। এমনকি যদি পুরো জনগোষ্ঠীর সংখ্যা যদি কমে যেতে থাকে বিলুপ্তির দিকে, তাহলেও এমন কোনো সময় আসবে না, যেখানে ‘সাকাররা’ ‘চিটদের চেয়ে ভালো করবে। সুতরাং, আমরা যতক্ষণ এই দুটি কৌশলকে শুধুমাত্র বিবেচনা করি, কোনো কিছুই সাকারদের বিলুপ্তিকে থামাতে পারেনা এবং খুব সম্ভবত, পুরো জনগোষ্ঠীর বিলুপ্তিও।
কিন্তু এখন ধরুন তৃতীয় একটি কৌশল আছে যাকে বলা যায়, ‘গ্রাজার। গ্রাজারএই’ অপরিচিতদের মাথা থেকে পরজীবি খুটে খুটে সরিয়ে দেয়, তেমনি ভাবে তারা একই কাজ করে যারা এর আগে তাদের উপকার করেছে একই কাজ করে। তবে, যদি কোনো সদস্য তাদের সাথে প্রতারণা করে, তারা সেই ঘটনাটি মনে রাখে, এবং একটি ‘অসন্তোষ পুষে রাখে: তারা সেই সদস্যদের মাথা থেকে পরজীবি পরিষ্কার করার ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করে, যারা ভবিষ্যতে তাদের জন্য কিছু করতে অস্বীকার করে। কোনো একটি জনগোষ্ঠীতে যেখানে গ্রাজারস’ এবং ‘সাকাররা আছে, অসম্ভব বলা যে কোনটি কি। দুই প্রকারই বাকী সবার প্রতি পরার্থবাদী আচরণ প্রদর্শন করে, এবং উভয়ে সমান এবং উচ্চ পরিমানে লাভবান হয়। কোনো একটি জনগোষ্ঠী যেখানে মূলত সবাই ‘চিট’, কোনো একটি একক অসন্তোষ গোপন করে রাখা ‘গ্রাজার’ খুব একটা বেশী সফল হবেনা। তাকে প্রচুর পরিমান শক্তি ব্যয় করতে হবে তার সাথে দেখা হওয়া প্রত্যেকটি সদস্যকে তাদের মাথা থেকে পরজীবি পরিষ্কার করা প্রক্রিয়া সাহায্য করতে গিয়ে– কারণ তার জন্য সবার প্রতি তার অসন্তোষ বা চাপা ক্ষোভ গড়ে তুলতে সময় লাগবে। অন্যদিকে, তার করা উপকারের বিনিময়ে কেউই শরীরের পরজীবিগুলো পরিষ্কার করার জন্য তাকে সাহায্য করবে না। যদি ক্ষোভ পুষে রাখা বা গ্রাজাররা প্রতারক বা চিটদের তুলনায় সংখ্যায় দুর্লভ হয়, তাহলে ‘গ্রাজার’দের জিন বিলুপ্ত হবে। যখনই ‘গ্রাজার’রা সুযোগ পাবে তাদের সংখ্যায় বাড়তে, অর্থাৎ তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ দখল করবে, তবে তাদের পরস্পরের সাথে দেখা হবার সম্ভাবনা যথেষ্ট বেশী হবে যা, তাদের চিটদের উপকার করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা খানিকটা প্রশমন করবে। যখন এই প্রয়োজনীয় বা ক্রিটিকাল ভগ্নাংশ তারা দখল করতে পারে তখন তারা চিটদের থেকে গড়পড়তায় বেশী লাভ অর্জন করতে শুরু করে। এবং চিটরা আরো দ্রুততর হারে বিলুপ্ত হতে শুরু করে। যখন চিটরা প্রায় বিলুপ্তির মুখোমুখি তাদের সংখ্যায় অবনতি হারও ক্রমশ কমে আসবে। এবং তারা হয়তো সংখ্যালঘু হিসাবে বেশ দীর্ঘ একটি সময় ধরে টিকে থাকবে। এর কারণ হচ্ছে যে কোনো একটি দুর্লভ চিটের একই গ্রাজারের সাথে দুইবার দেখা হবার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ: সেকারণে কোনো একটি জনগোষ্ঠীতে সদস্যদের অংশ যারা কোনো একটি বিশেষ ‘চিটের প্রতি ক্ষোভ পুষে রাখে তা খুব সামান্য পরিমান হবে।
এইসব কৌশলগুলোর গল্প আমি এমনভাবে বললাম যেন খুব সহজাতভাবে এটা অবশ্যই ঘটবে। বাস্তবে বিষয়টি এত স্পষ্ট নয়। সেই সহজাত অন্তর্গত জ্ঞান সঠিক কিনা কম্পিউটারে সিমুলেশন করার সময় পরীক্ষা করতে আমি সেই সতর্কতা অবলম্বনও করেছিলাম, দেখা যায় আসলেই সাকার এবং চিটদের বিরুদ্ধে ‘গ্রাজার’ বিবর্তনীয়ভাবে স্থিতিশীল একটি কৌশল, এই অর্থে যে, কোনো একটি জনগোষ্ঠীতে যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হচ্ছে গ্রাজাররা, না কোনো চিট বা না কোনো সাকার সেখানে অনুপ্রবেশ করতে পারবে। চিটও একটি ইএসএস বা বিবর্তনীয়ভাবে স্থিতিশীল কৌশল, যদিও, যেহেতু কোনো জনগোষ্ঠী যার মূল অংশ তৈরী করে চিটরা সেখানে গ্রাজার অথবা সাকার কেউ অনুপ্রবেশ করতে পারেনা। কোনো একটি জনগোষ্ঠী এই দুটি ‘ইএসএস’-এর যেকোনো একটি গ্রহন করতে পারে। এবং পরে কোনো একসময় তারা একটির বদলে অন্যটিও গ্রহন করতে পারে। সঠিক লাভের মূল্যমানের উপর নির্ভর– এই সিমুলেশনের প্রাকধারণাগুলো অবশ্যই পুরোপুরিভাবে মনগড়া– দুটি স্থিতিশীল অবস্থার কোনো একটির অপেক্ষাকৃত বড় আকারে ‘আকর্ষণ বলয় থাকবে, এবং সেটি পূর্ণ হবার সম্ভাবনাও বেশী। লক্ষ করুন, ঘটনাচক্রে যে, কোনো একটি গ্রাজার’দের জনগোষ্ঠীর তুলনায় যদিও একটি ‘চিট জনগোষ্ঠীর হয়তো বিলুপ্ত হবার বেশী সম্ভাবনা থাকবে,, কিন্তু কোনোভাবে এটি একটি ‘ইএসএস’ হিসাবে তার পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করেনা। যদি কোনো একটি জনগোষ্ঠী এমন কোনো ‘ইএসএস’-এ উপনীত হয় যে এটি একে বিলুপ্ত করে, তাহলে সেটিও বিলুপ্ত হয় এবং সেটাই সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক (৪)।
কোনো কম্পিউটার সিমুলেশন দেখা আসলেই বেশ মজার, যেটি শুরু হয় “সাকারদের শক্তিশালী একটি সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে, সংখ্যালঘু ‘গ্রাজার’ যাদের সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ হারের সামান্য উপরে এবং প্রায় একই আকারের সংখ্যালঘু ‘চিট’দের নিয়ে। প্রথম যে জিনিসটা ঘটে সেটি হলো সাকারদের জনগোষ্ঠী নাটকীয়ভাবে হ্রাস পায়, যেহেতু চিটরা নির্দয়ভাবে তাদের ব্যবহার করে তাদের নিজেদের স্বার্থে। চিটরা একটি বড় মাপে তাদের জনসংখ্যার বিস্ফোরণ উপভোগ করে, যা একেবারে শিখরে উপনীত হয় যখন শেষ সাকার সদস্য বিলুপ্ত হয়। কিন্তু চিটদের তখনও গ্রাজারদের সমঝে চলতে হয়। সাকারদের ভয়াবহ রকমের পতনের সময়ে, গ্রাজারদের সংখ্যাও ধীরে ধীরে কমতে থাকে, তারাও চিটদের উন্নতির সাথে সাথে একইভাবে তাদের স্বার্থে ব্যবহৃত হবার কুফল ভোগ করে, কিন্তু তারা নিজেরা কোনো মতে টিকে থাকে। শেষ সাকাররা চলে যাবার পর এবং যখন চীটরা সহজে নিজেদের স্বার্থে অন্যকে ব্যবহার করে আর পার পায়না, গ্রাজারদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে চিটদের বিনিময়ে। ধীরে ধীরে তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি একটি সুসম গতি লাভ করে। খুব দ্রুত এটি বাড়তে থাকে, চিট জনসংখ্যার পতন হয় প্রায় বিলুপ্তি অবধি, তারপর এটি একটি স্থির গতিতে স্থিতিশীল হয় যখন তারা দূর্লভ হবার সুবিধার কারণে এবং তুলনামূলকভাবে গ্রাজারদের ক্ষোভ থেকে স্বাধীনতা পায়। তবে, ধীরে এবং অপ্রতিরোধ্যভাবেই চিটদের বিলুপ্তি ঘটে এবং শুধুমাত্র গ্রাজাররা জনগোষ্ঠীতে টিকে থাকে। ধাঁধার মত একটি বিষয় হচ্ছে সাকারদের উপস্থিতি আসলেই গ্রাজারদের বিপদের কারণ হয় কাহিনী শুরুতেই কারণ তারাই মূলত চিটদের সাময়িক উন্নতির জন্য দায়ী।
প্রসঙ্গক্রমে, মাথার পরজীবি পরিষ্কার না করার বিপদ সংক্রান্ত আমার এই হাইপোথেটিকাল উদাহরণ খুবই সম্ভাব্য। বিচ্ছিন্ন করে রাখা ইঁদুররা তাদের মাথার সেই সব অংশে অস্বস্তিকর ক্ষতে আক্রান্ত হয়, যে অংশগুলো তারা নিজেরা পরিষ্কার করতে পারেনা। একটি গবেষণায়, গ্রুপে রাখা ইঁদুরদের এই সমস্যায় আক্রান্ত হতে হয়না, কারণ তারা একে অপরে মাথা উপরের অংশ চেটে পরিষ্কার করে দেয়। বেশ কৌতূহলোদ্দীপক একটি ব্যপার হবে এই ‘পরস্পরমুখী পরার্থবাদীতার তত্ত্বটি পরীক্ষমূলকভাবে নীরিক্ষা করে দেখা যায় এবং আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে ইঁদুররা এই ধরনের গবেষণার জন্য উপযুক্ত।
ক্লিনার ফিশদের বিস্ময়কর মিথোজীবিতা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন ট্রিভার্স। প্রায় ৫০ টি প্রজাতি, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছোট মাছ এবং শ্রিম্পরা, অন্য প্রজাতির বড় মাছদের শরীরের উপর থেকে পরজীবিদের খুটে খুটে তুলে পরিষ্কার করার জন্য তারা সুপরিচিত। বড় মাছরা অবশ্যই এইভাবে পরিস্কার হবার মাধ্যমে লাভবান হয়, এবং এর বিনিময়ে ক্লিনাররা ভালো পরিমান খাদ্য সংগ্রহ করে নেয়। এই সম্পর্ক মিথোজীবিতা নির্ভর। অনেক ক্ষেত্রে বড় মাছগুলো তাদের মুখ হা করে ক্লিনার ফিশদের তাদের মুখের ভিতরে ঢুকে তাদের দাঁত পরিষ্কার করার জন্য সুযোগ করে দেয়, এবং তাদের ফুলকার মধ্য দিয়ে সাঁতার করে বের হয়ে যাবার জন্য, যে ফুলকাগুলোও তারা পরিষ্কার করে দেয়। কেউ হয়তো ভাবতে পারেন চালাকী করে কোনো বড় মাছ হয়তো পুরোপুরি পরিষ্কার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা নাও করতে পারে, এরপর ক্লিনার মাছদের নিজেরাই খাদ্য হিসাবে গিলে ফেলতে পারে। কিন্তু এর পরিবর্তে সে সাধারণত ক্লিনার মাছগুলোকে কোনো ধরনের আক্রমণ ছাড়াই চলে যেতে দেয় তাদের কাজ শেষ করার পর। এবং অবশ্যই এটি উল্লেখযোগ্য পরিমানের একটি আপাতদৃষ্টিতে পরার্থবাদীতা, কারণ বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই বড় মাছের স্বাভাবিক শিকারের মত ক্লিনার মাছগুলো একই আকারের।
ক্লিনার মাছের একটি বিশেষ ধরনের দাগ কাটা নক্সা থাকে এবং বিশেষ একটি নাচের প্রদর্শনী যা তাদের চিহ্নিত করে ক্লিনার ফিশ হিসাবে। বড় মাছগুলো সাধারণত এইসব ছোট মাছদের খাওয়া থেকে নিজেদের বিরত রাখে যাদের শরীরে সঠিকভাবে এই ধরনের দাগাঙ্কিত আছে, যারা তাদের সামনে সঠিক ধরনের নাচ প্রদর্শন করে এগিয়ে আসে। এর বদলে বড় মাছগুলো এক ধরনের গভীর ঘোর লাগা কোনো অবস্থায় প্রবেশ করে, এবং ক্লিনার মাছকে তারা অনুমতি দেয় তাদের বাইরে ও ভিতরে অবাধ বিচরণের জন্য। অবাক হবার কোনো কারণ নেই যে স্বার্থপর জিন তাদের বৈশিষ্ট্যগত কারণেই নিষ্ঠুর, স্বার্থপর চিটরা এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে নেয়। ছোট মাছের বেশ কিছু প্রজাতি আছে তারা দেখতে ঠিক ক্লিনার মাছের মত এবং তারা ঠিক একইভাবে নাচতে জানে, যেন বড় মাছগুলোর আশে পাশে থেকে যেন নিরাপদে সরে যেতে পারে। যখনই বড় মাছ তাদের প্রত্যাশিত সেই ঘোরের মধ্যে থাকে যেন ক্লিনার মাছরা তাদের পরিষ্কার করছে, এই চিটরা পরজীবি পরিষ্কার করার বদলে উল্টো বড় মাছের ফুলকার একটুকরো কামড়ে নিয়ে দ্রুত প্রস্থান করে। কিন্তু সেই চিটগুলো ছাড়া, ক্লিনার মাছ এবং তাদের খদ্দেরদের সম্পর্ক মূলত বন্ধুসুলভ এবং স্থিতিশীল। এই পরিষ্কার করার পেশা প্রবাল প্রাচীরের মাছের সমাজে গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা রাখে। প্রতিটি ক্লিনার মাছের একটি নিজস্ব এলাকা আছে, এবং বড় মাছরা ঠিক কোন নাপিতের দোকানের সামনে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা খদ্দেরদের মত দাঁড়িয়ে থাকে সেই এলাকার ক্লিনার মাছের জন্য। সম্ভবত এই ‘সাইট-টেনাসিটি’ বা বড় মাছদের বার বার একই জায়গায় ফিরে যাবার প্রবণতাটি একটি বিলম্বিত
পরস্পরমুখী পরার্থবাদিতা সম্ভব করে। কোনো একটি বড় মাছের বার বার একই ‘নাপিতের দোকানে ফিরে আসার সুবিধা অবশ্যই বেশী হতে হবে ক্লিনার মাছদের খাদ্য হিসাবে খাওয়া থেকে বিরত থাকার সুবিধা থেকে। যেহেতু ক্লিনাররা আকারে খুব ছোট, এটি বিশ্বাস করা খুব কঠিন বিষয় না। কিন্তু ক্লিনার মাছ সেজে থাকা ও তাদের অনুকরণ করা প্রতারকরা সম্ভবত পরোক্ষভাবে বিপদে ফেলে প্রতারণা করে এমন প্রকৃত ক্লিনার মাছদের বিপদগ্রস্থ করে, বড় মাছগুলোর উপর দাগসহ নাচতে থাকা ছোট মাছগুলো খেয়ে ফেলার জন্য মৃদু চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বার বার ফিরে আসার কারণে বা সাইট টেনাসিটি আচরণটি কোন বড় মাছ খদ্দেরকে প্রতারকদের এড়িয়ে প্রকৃতি ক্লিনার মাছদের খুঁজে বের করতে সাহায্য করে।
মানুষের মধ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতি এবং একক সদস্যদের শনাক্ত করার ক্ষমতা বিশেষভাবে বিকশিত। সেকারণে আমরা হয়তো আশা করতে পারি যে, পরস্পরমুখী পরার্থবাদীতা মানব বিবর্তনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো। ট্রিভার্স এমনকি অনেক দুর আগ বাড়িয়ে প্রস্তাব করেছিলেন যে, আমদের অনেক মনোজাগতিক বৈশিষ্ট্যাবলী, হিংসা, অপরাধবোধ, কৃতজ্ঞতা, সহমর্মিতা ইত্যাদি– তাদের বর্তমান রুপ পেয়েছে প্রতারণা করা, প্রতারক শনাক্ত করা এবং প্রতারক হিসাবে শনাক্ত হবার সম্ভাবনা এড়ানোর আরও উন্নততর দক্ষতার জন্য প্রাকৃতিক নির্বাচনী চাপের ফলে। বিশেষ করে যেটি উল্লেখযোগ্য, সুক্ষ্ম প্রতারকরা, যারা আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় উপকারের প্রতিদান দিচ্ছে, কিন্তু সবসময়ই তারা যে পরিমান উপকার গ্রহন করে তারচেয়ে খানিকটা কম উপকার প্রতিদান হিসাবে দেয়। এটি এমনকি সম্ভব যে মানুষের স্ফীত মস্তিষ্ক এবং গাণিতিকভাবে তার যুক্তি প্রস্তাব করার প্রবণতা, বিবর্তিত হয়েছে আরো বেশী ধূর্তভাবে প্রতারণা করা এবং অন্যদের প্রতারণা শনাক্ত করার প্রক্রিয়া হিসাবে। টাকা হচ্ছে বিলম্বিত পরমুখী পরার্থবাদিতার একটি আনুষ্ঠানিক উপকরণ। কোন শেষ নেই পরস্পমুখী পরার্থবাদীতার এই সব বিস্ময়কর ধারণাগুলোর, যেগুলো সৃষ্টি হয় যখন আমরা ধারণাগুলো আমাদের নিজেদের প্রজাতির উপর প্রয়োগ করি। যদিও প্রলুব্ধ করে বিষয়টি, আমি আর সবার মতই খুব বেশী উত্তম কিছু ধারণা করার জন্য যোগ্য নই এবং এই বিষয়টি বরং পাঠকদের উপর ছেড়ে দেই, তারা তাদের কল্পনাশক্তির অবাধ ব্যবহার করে নিজেদের তৃপ্ত করতে পারবেন।
নোটস (অধ্যায় ১০)
(১) এটাই আমরা সবাই ভেবেছিলাম, সম্বন্ধে, এটাই আমরা বিবেচনা করেছিলাম শুধুমাত্র ন্যাকেড মোল র্যাটদের উদাহরণটি বাদে। ন্যাকেড মোল র্যাটরা হচ্ছে লোমহীন, প্রায় অন্ধ খুব ছোট একটি রোডেন্ট প্রজাতি, যারা মাটির নিচে সমাজবদ্ধ হয়ে বড় একটি কলোনী তৈরী করে বসবাস করে, বিশেষ করে, কেনিয়া, সোমালিয়া, ইথিওপিয়ার শুষ্ক এলকায়। তাদের আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় স্তন্যপায়ীদের জগতে সত্যিকারের একটি সামাজিক ইনসেক্ট’। ল্যাবরেটরীতে বন্দী ন্যাকেড মোল র্যাট কলোনী নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব কেপটাউনের গবেষক জেনিফার জার্ভিসের যুগান্তকারী গবেষণাটি এখন কেনিয়ায় মাঠ পর্যায়ের রবার্ট ব্রেটের পর্যবেক্ষণগুলো আরো সম্প্রসরিত করেছে। বন্দী কলোনী নিয়ে আরো গবেষণা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের রিচার্ড আলেক্সান্ডার এবং পল শেরম্যান। এই চার গবেষক প্রতিজ্ঞা করেছেন একটি যৌথ প্রকাশনার, এবং আমি অবশ্যই অত্যন্ত আগ্রহের সাথে তার অপেক্ষা করছি। ইতিমধ্যে, এই ব্যাখ্যাটির মূল উৎস বেশ কিছু গবেষণা পত্র যা প্রকাশিত হয়েছে এবং পল শেরম্যান ও রবার্ট ব্রেট এর গবেষণা বক্তৃতা। এছাড়া আমি ভাগ্যবান লন্ডন চিড়িয়াখানার তৎকালীন স্তন্যপায়ী প্রাণীদের কিউরেটর ব্রায়ান বেরট্রাম আমাকে ন্যাকেড মোল র্যাটদের একটি কলোনি দেখিয়েছিলেন।
মাটির নিচে অত্যন্ত জটিল শাখা প্রশাখার সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কে ন্যাকেড মোল র্যাটরা বসবাস করে। কলোনিগুলোতে সাধারণত মোট ৭০ অথবা ৮০ জন সদস্য থাকে, কিন্তু তাদের সংখ্যা বেড়ে একশর উপরেও হতে পারে। মাটির নীচের যে সুড়ঙ্গে যেখানে একটি কলোনী বসবাস করে, সেটি দুই থেকে তিন মাইল দীর্ঘ হতে পারে। বছরে কোনো একটি কলোনী তিন থেকে চার টন মাটি খনন করে। সুড়ঙ্গ বানানো তাদের জন্য একটি সামাজিক উদ্যোগ। সামনের একজন কর্মী বা ফেস ওয়ার্কার তার দাঁতের সামনে অংশ দিয়ে মাটি খুড়তে থাকে, এবং সে খনন করা মাটিকে পেছন দিকে পাঠিয়ে দেয় একটি জীবন্ত কনভেয়ার বেল্ট দিয়ে, অস্থিরভাবে কম্পমান, দ্রুত নড়াচড়া করতে থাকা অর্ধ ডজন গোলাপী প্রাণী সারি বেধে সেই কাজটি করে। মাঝে মাঝে, সামনে থাকা কর্মী বা ফেস ওয়ার্কারকে তার কাজ থেকে অব্যাহতি দেয় তার পেছনে থাকা আরেকটি কর্মী ন্যাকেড মোল র্যাট।
পুরো কলোনীতে একটি মাত্র স্ত্রী সদস্য প্রজনন করে, বেশ কয়েক বছর বিস্তৃত একটি পর্ব জুড়ে সে সন্তানের জন্ম দেয়, জার্ভিস আমার মতে, সঠিকভাবেই ‘সামাজিক কীটপতঙ্গ’ সংক্রান্ত শব্দ গ্রহন করেছেন এবং এই সন্তান জন্ম দেয়া একক স্ত্রী সদস্যটিকে আখ্যা দিয়েছেন কলোনীর রানি হিসাবে। রানি শুধুমাত্র দুটি বা তিনটি পুরুষের সাথে প্রজনন করে। দুটি লিঙ্গের অন্যান্য সদস্যরা প্রজনন অক্ষম, ঠিক পতঙ্গ কর্মীদের মত। এবং অন্যান্য অনেক সামাজিক ইনসেক্ট প্রজাতির ক্ষেত্রে যা ঘটে, যদি রাণিকে কলোনী থেকে সরিয়ে নেয়া হয় তবে এর আগে কিছু প্রজনন অক্ষম, অনুর্বর স্ত্রী সদস্য প্রজননক্ষম হয়ে ওঠে, এবং একে অপরের সাথে যুদ্ধ করে রাণির অবস্থানটি পাবার জন্য।
অনুর্বর সদস্যদের বলা হয় “কর্মী এবং আবারো আমার মনে হয়। এই শব্দটি যথেষ্ট পরিমান সঠিক এই ক্ষেত্রেও। দুটি লিঙ্গের সদস্যরাই কর্মী, যেমন, টারমাইটদের ক্ষেত্রে ( কিন্তু পিপড়া বা মৌমাছি কিংবা বোলতাদের ক্ষেত্রে না, সেখানে কর্মী শুধু স্ত্রী সদস্যরা)। মোল র্যাট কর্মীরা আসলে কি করে তা নির্ভর করে তাদের আকারের উপর। সবচেয়ে ক্ষুদ্রগুলো, যাদের জার্ভিস নাম দিয়েছিলেন ‘ফ্রিকোয়েন্ট ওয়ার্কার’, তারা সুড়ঙ্গ খোড়ে এবং বাচ্চাদের খাওয়ায়, সম্ভবত রাণিকে তার বাচ্চা জন্ম দেবার কাজে পুরোপুরি মনোনিবেশ করার সুবিধা প্রদান করার নিমিও। রাণীর বাচ্চার সংখ্যা বা লিটারের আকারের অন্যান্য রোডেন্ট প্রজাতির তুলনায় অপেক্ষাকৃত বড়, এবং আবারেআ কীটপতঙ্গের রাণিদের কথা মনে করিয়ে দেয়। সবচেয়ে বড় প্রজনন অক্ষমরা মনে হয়। খাওয়া আর ঘুমানো ছাড়া কিছুই কাজ করেনা, অন্যদিকে মধ্যম আকারের প্রজনন অক্ষমরা আচরণ করে অন্তবর্তী বা মধ্যবর্তী একটি উপায়ে। একটি ধারাবাহিকতা আছে এই স্তর বিন্যাসে যেমনটি থাকে মৌমাছিদের মধ্যে, বহু প্রজাতির পিপড়াদের মধ্যে দৃশ্যমান সুস্পষ্ট শ্রেণী বিন্যাস যেমন থাকে তেমনটি নয়।
জার্ভিস মূলত সবচেয়ে আকারে বড় প্রজনন অক্ষমদের বলেছেন ‘নন-ওয়ার্কার’, তারা কর্মী নয়। কিন্তু আসলে কি তারা কোনো কিছুই না করে থাকতে পারে? এখন বেশ কিছু প্রস্তাব আছে, আর সেই প্রস্তাবগুলো এসেছে গবেষণাগার এবং মাঠ পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ, উভয় প্রক্রিয়া থেকে। এরা হচ্ছে সৈন্য, যারা কলোনীকে রক্ষা করে যদি কোনো হুমকির সম্মুখীন হয়। তাদের জন্য প্রধান আক্রমণকারী প্রাণী হচ্ছে সাপ। এমনকি সম্ভাবনা আছে তারা আসলে ‘খাদ্য-ভাণ্ডার হিসাবেও কাজ করে, যেমন ‘হানিপট’ পিপড়াদের মত (মূল বইয়ের ২২৩ পৃষ্ঠা); মোল র্যাট হচ্ছে ‘হোমোকপরোফ্যাগাস’, এর মানে ভদ্র ভাবে বলা যে তারা পরস্পরের মল খায় (শুধুমাত্র মল নয়; যদি তা হয় সেটি মহাবিশ্বের নিয়ম ধ্বংস করে দিতো)। হয়তোবড় আকারের সদস্যরা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে শরীরের মধ্যে মল জমা করে যখন প্রচুর পরিমানে খাদ্য থাকে, যখন খাদ্য ঘাটতি হয়, তখন এই মল জরুরী খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়, একটি ‘কনস্টিপেটেড কমিসারিয়াট’ বা কোষ্ঠকাঠিন্যে আক্রান্ত খাদ্য ভাণ্ডারের মত।
তবে আমার কাছে ন্যাকড মোল র্যাটদের সবচেয়ে ধাঁধার মত বৈশিষ্ট্যটি হচ্ছে যদিও তারা বহুভাবেই সামাজিক কীট পতঙ্গদের মত, কিন্তু তাদের তরুণ ডানাসহ প্রজননক্ষম পিপড়া বা টারমাইট সদস্যদের মত কোনো সমতুল্য শ্রেণী নেই। অবশ্যই তাদের প্রজননক্ষম সদস্যরা আছে, কিন্তু তারা তাদের জীবন শুরু করেনা, ডানা গজিয়ে নতুন কোনো দেশে তাদের জিন নিয়ে কলোনি শুরু করার মত। জানামতে, ন্যাকেড মোল র্যাটদের কলোনি আকারে বাড়ে এদের প্রান্তসীমা বাড়ার সাথে, ভূগর্ভ সুড়ঙ্গ সম্প্রসারণের মাধ্যমে। আপাতদৃষ্টিতে তারা দুরে ছড়িয়ে পড়া সদস্যদের পরিত্যাগ করেনা, সমতুল্য প্রজননক্ষম ডানাসহ পতঙ্গ সদস্যদের মত। আমার ডারউইনীয় অন্তর্জানের জন্য এটি এত বেশী বিস্ময়কর যে কোনো কিছু ধারণা করতে আসলেই প্রলুব্ধ করে আমাদের। আমার ধারণা হচ্ছে একদিন না একদিন আমরা দুরে ছড়িয়ে পড়ার পর্বটি খুঁজে পাবো, যা এযাবৎ, কোনো না কোনো কারণে, সঠিকভাবে লক্ষ করা হয়নি। যদিও খুব বেশী মাত্রাতিরিক্ত হবে ছড়িয়ে পড়া সদস্যরা সবাই ডানা গজাবে এমন কোনো ধারণা পোষণ করা। কিন্তু তারা হয়তো নানা বিচিত্র কোনো উপায়ে স্বশস্ত্র থাকে মাটির উপরে বেঁচে থাকার জন্য, নীচে নয়। তারা হতে পারে লোমশ, যেমন, মাটির নীচে বাস করার লোমহীন নগ্ন হবার বদলে। সাধারণ স্তন্যপায়ীরা যেভাবে করে ন্যাকেড মোল র্যাটরা সেভাবে তাদের দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে না। তারা অনেকটাই ‘শীতল রক্ত’ বিশিষ্ট সরীসৃপদের মত। হয়তো তারা তাদের তাপমাত্রা সামাজিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে– মৌমাছি বা টারমাইটদের সাথে আরো একটি সদৃশ্যতা। অথবা তারা কি সেই সুপরিচিত যে কোন ভালো সেলার এর তাপমাত্রাকে ব্যবহার করে তাদের স্বার্থে? যে কোনো অবস্থায়, আমার হাইপোথেটিক্যাল সেই ছড়িয়ে পড়া সদস্য হয়তো, মাটির নিচে কাজ করা কর্মীদের ব্যতিক্রম প্রচলিত অর্থে উষ্ণরক্ত বিশিষ্ট? এমনকি অনুমান করা যেতে পারে কিছু ইতিমধ্যেই লোমশ রোডেন্ট, যাদের এতদিন অবধি শ্রেণীবিন্যস্ত হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি প্রজাতি হিসাবে, তারা হয়তো হতে পারে ন্যাকেড মোল র্যাটদের হারিয়ে যাওয়া কোনো একটি শ্রেণী?
কারণ আর যাই হোক এরকম ঘটনার আরো উদাহরণ আছে। যেমন, লোকাষ্টরা। লোকাস্টরা হচ্ছে একধরনের রূপান্তরিত ঘাসফড়িং, তারা সাধারণত নিঃসঙ্গ, গোপন, সুস্থির জীবন কাটায়, যে জীবন সাধারণ ঘাসফড়িংদের মত। কিন্তু বিশেষ কিছুর পরিস্থিতির প্রভাবে তারা পুরোপুরিভাবে বদলে যায় এবং ভয়ঙ্কর হয় তাদের সেই পরিবর্তন। তারা তাদের সহজে প্রকৃতির সাথে মিশে থাকা ছদ্মবেশটি বা ক্যামোফ্লেজটি হারিয়ে ফেলে এবং এর বদলে তাদের শরীরে আমরা খুব উজ্জ্বলভাবে ডোরা কাটা দাগ কাটা দেখি। প্রায় কল্পনা করা সম্ভব এয, তাদের এই দাগগুলো সতর্কতামূলক। যদি তাই হয়, সেটি বিনা কারণে নয়, কারণ তাদের আচরণও বদলে যায়। তারা তাদের একাকী নিঃসঙ্গ জীবনাচরণ পরিত্যাগ করে এবং একসাথে দল বাধে, যার ফলাফল ভয়ঙ্কর। বাইবেলের কিংবদন্তীর সেই প্লেগ থেকে আজ অবধি মানুষের সম্মদ্ধি ধ্বংসকারী হিসাবে আর কোনো প্রাণীকে এতটা ভয় পাওয়া হয়না। তারা দল বাধে বহু মিলিয়ন সংখ্যায়, একটি সম্মিলিত ফসল কাটার মেশিন বা হারভেস্টার এর মত যা বহু মাইল জুড়ে বিস্তৃত, কখনো এই পঙ্গপালের দলটি প্রতিদিন শত মাইল পাড়ি দেয়, প্রতিদিন ২০০০ টন ফসল তারা খেয়ে ফেলে, যাকে অনুসরণ করে আসে দুর্ভিক্ষ, মন্দা আর ধ্বংস। এবং এখন আমরা আসি মোল র্যাটদের সাথে তাদের সম্ভাব্য সদৃশ্যতা প্রসঙ্গে। কোনো একটি নিসঙ্গচারী সদস্য আর তার অতি সামাজিক পুনর্জন্মের রুপটির মধ্যে পার্থক্য যথেষ্ট পরিমান বড় দুটি শ্রেণীর পিপড়াদের গোত্রের মধ্যে পার্থক্যের মত। উপরন্তু, ঠিক যেমন করে আমরা প্রস্তাব করছিলাম মোল র্যাটদের ‘হারিয়ে যাওয়া একটি শ্রেণী’, ১৯২১ সাল অবধি ঘাসফড়িং জেকিলরা ও তাদের লোকাষ্ট হাইডরা শ্রেণীবিন্যস্ত ছিল ভিন্ন ভিন্ন দুটি প্রজাতিতে।
কিন্তু হায়, খুব বেশী সম্ভাবনা নেই বলেই মনে হয় যে, স্তন্যপায়ী বিশেষজ্ঞরা আজ অবধি এ বিষয়ে ভুল বুঝে আসছেন। আমার বলা উচিৎ যে ঘটনাচক্রে, সেই সাধারণ রূপান্তরিত ন্যাকেড মোল র্যাটরা কখনো কখনো মাটির উপরে দেখা গেছে এবং হয়তো সাধারণভাবে যেমনটা ভাবা হয় তার চেয়ে বেশী দুরত্ব তারা অতিক্রম করতে পারে। এই রূপান্তরিত প্রজননক্ষমদের ধারণা পুরোপুরি পরিত্যাগ করার আগে বরং লোকাষ্টদের উদাহরণ আরেকটি সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। হয়তো ন্যাকেড মোল র্যাট আসলেই রূপান্তরিত প্রজননক্ষম সদস্যদের জন্ম দিতে পারে, তবে শুধুমাত্র কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে যে পরিস্থিতি আমরা সাম্প্রতিক দশকগুলোতে আর সৃষ্টি হতে দেখিনি। আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে, লোকাষ্টদের আক্রমণ এখনও একটি ভয়ঙ্কর সমস্যা, ঠিক যেমনটি ছিল বহু প্রাচীন আমলে। কিন্তু উত্তর আমেরিকায় পরিস্থিতি ভিন্ন। কিছু ঘাসফড়িং প্রজাতির দলবদ্ধ পঙ্গপালের সৃষ্টি করার সেই সম্ভাবনা আছে। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে, পরিস্থিতি অনুকুল না থাকার কারণে কোনো লোকাষ্টের আক্রমণ আমরা এই শতাব্দীতে উত্তর আমেরিকায় দেখিনি (যদিও সাইকাদা, একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতির পতঙ্গ, যারা পঙ্গপালের মত আচরণ করে থাকে, এখনও নিয়মিতভাবে তাদের জনসংখ্যায় বিস্ফোরণ ঘটে এবং সংশয়াচ্ছন্নভাবে, তাদের এমনকি লোকাস্টও বলা হয়, আমেরিকার কথ্য ভাষায়); তবে যাই হোক, যদি কোনো সত্যিকারের লোকাষ্ট পঙ্গপালের আজ আমেরিকায় আক্রমণ করে, বিষয়টি খুব বেশী বিস্ময়কর হবে নাঃ আগ্নেয়গিরি বিলুপ্ত হয়নি, শুধুমাত্র সুপ্তাবস্থায় আছে। কিন্তু যদি আমাদের কাছে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের লিখিত ঐতিহাসিক দলিল এবং তথ্য না থাকতো বিষয়টি খুব বাজে একটি বিস্ময়কর ঘটনা হতো কারণ এই প্রাণীরা হবে, যতটুকু যে কেউ জানে, খুব সাধারণ, নিভৃতচারী, কোনো ক্ষতি করে না এমন ঘাসফড়িং। কিন্তু কি হবে যদি ন্যাকেড মোল র্যাট আমেরিকান গ্রাসহপারদের মত, যার পুর্বপ্রস্তুতি থাকে একটি স্বতন্ত্র, চারিদিকে ছড়িয়ে পাড়ার মত কোন স্বতন্ত্র শ্রেণী সৃষ্টি করার জন্য, তবে সেটি হয় শুধুমাত্র এমন কোনো পরিস্তিতিতে, যে কোনো না কোনো কারণে এই শতাব্দীতে যা উদ্ভূত হয়নি? উনবিংশ শতাব্দীর পুর্ব-আফ্রিকাকে হয়তো লোমশ মোলদের পঙ্গপালের আক্রমণ হয়তো সহ্য করেছিল, যেমন, মাটির উপরে লেমিঙ্গসদের মত, যে ঘটনার কোনো লিপিবদ্ধ ইতিহাস আমাদের জন্য আর টিকে নেই। অথবা হয়তো সেগুলো লিপিবদ্ধ আছে স্থানীয় গোত্রগুলোর কিংবদন্তী আর পুরাণ কাহিনীতে?
(২) হ্যামিলটনের ‘৩/৪ আত্মীয়তার’ হাইপোথিসিসটির স্মরণীয় উদ্ভাবনপটুতা হাইমেনোপটেরাদের বিশেষ ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে, তবে বিস্ময়করভাবে তার আরো সাধারণ এবং মৌলিক তত্ত্বের জন্য বিষয়টি খানিকটা ধাঁধার মত একটি বিব্রতকর বিষয়। ‘হ্যাপলোডিপ্লয়েড’ ৩/৪ আত্মীয়তার কাহিনী সবার জন্য যথেষ্ট সহজ একটু চেষ্টা করে বোঝার জন্য, কিন্তু তবে সেটি অবশ্যই ততটা যথেষ্ট পরিমানে কঠিন যে, কেউ হয়তো বিষয়টি পুরোপুরি বুঝতে পেরেছেন এমন আত্মতৃপ্তি প্রকাশ করতে পারবেন না, এবং সেই সাথে বেশ ব্যস্তও হবেন অন্যদের মধ্যে বিষয়টি ছড়িয়ে দিতে। এটি একটি ভালো ‘মিম’। আপনি হ্যামিলটন সম্বন্ধে জানতে পারবেন তার লেখা পড়ে না বরং কোনো একটি পাবে কথোপথনের সময়, খুব ভালো একটি সম্ভাবনা থাকবে আপনি “হ্যাপলোডিপলয়ড়ি’ ছাড়া আর কিছুই হয়তো শুনবেন না। এখন বায়োলজির প্রতিটি পাঠ্য বইয়ে, সেটি যত সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করুক না কেন, ‘কিন সিলেকশন’, প্রায় আবশ্যিকভাবে একটি অনুচ্ছেদ পুরোপুরিভাবে নিবেদন করবে ‘৩/৪ আত্মীয়তার সম্পর্কটি ব্যাখ্যা করার জন্য। একজন সহকর্মী, যাকে এখন গণ্য করা যেতে পারেন বড় স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সামাজিক আচরণ বিষয়ে বিশ্বসেরা একজন বিশেষজ্ঞ, আমার কাছে স্বীকারোক্তি করেছিলেন যে বহু বছর ধরে তিনি ভেবেছিলেন যে হ্যামিলটনের কিন সিলেকশন তত্ত্বটি শুধুমাত্র ছিল ৩/৪ রিলেটেডনেস হাইপোথিসিস মাত্র আর কিছুই নয়! এইসব কিছুর একটি পরিণতিয় হচ্ছে যদি কোনো নতুন বাস্তব তথ্য আমাদের মনে সন্দেহের উদ্রেক করে ৩/৪ রিলেটেডনেস হাইপোথিসিসের গুরুত্ব বিষয়ে, মানুষ খুব তৎপর এমন কিছু ভেবে নিতে যে, এটি পুরো কিন সিলেকশন তত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রমাণ। এটি তুলনা করা যেতে পারে, যদি কোনো মহান সুরস্রষ্টা দীর্ঘ আর গভীর মূল সিম্ফোনী লিখলেন, কিন্তু, যেখানে একটি সুনির্দিষ্ট সুর এর মাঝখানে সংক্ষিপ্তভাবে যুক্ত করেন, যা তাৎক্ষণিকভাবে এত বেশী আকর্ষণীয় যে, রাস্তায় যে কেউ শীষ বাজিয়ে সেই সুরটি বাজাতে থাকে। পুরো সিম্ফোনীটি পরিচিত হতে থাকে সেই একটি সুরের দ্বারা। পরে যদি মানুষ সেই সুরের প্রতি তাদের মোহ কাটিয়ে উঠতে পারে তারা ভাবে যে পুরো সিম্ফোনীটিকেই আসলে তারা অপছন্দ করে।
যেমন ধরুন, ন্যাকেড মোল র্যাটদের নিয়ে নিউ সায়েন্টিষ্ট প্রত্রিকায় সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত লিন্ডা গামলিনের একটি অন্যথায় উপযোগী নিবন্ধটির কথা। খুবই গুরতরভাবে এটি নানা ইঙ্গিতে পূর্ণ যে, ন্যাকেড মোল র্যাট এবং টারমাইটরা হ্যামিলটনের হাইপোথিসিসের জন্য বিব্রতকর, শুধুমাত্র তারা হ্যাপলোডিপ্লয়েড নয়। খুবই কঠিন বিশ্বাস করা যে নিবন্ধটির লেখক হ্যামিলটনের সেই ক্ল্যাসিক দুটি পেপার আদৌ দেখেছেন, কারণ হ্যাপলোডিপলয়ডি মোট পঞ্চাশ পাতার মাত্র চারটি পাতা জুড়ে বিস্তৃত ছিল। তিনি নিশ্চয়ই এর জন্য অন্য সেকেন্ডারী উৎস খতিয়ে দেখেছিলেন– আমি আশা করি সেটি যেন ‘দ্য সেলফিশ জিন’ না হয়।
আরেকটি উন্মোচনকারী উদাহরণ সংশ্লিষ্ট সৈন্য এফিডদের নিয়ে যা আমি অধ্যায় ৬ এর নোটে উল্লেখ করেছিলাম। সেখানে যেভাবে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছিল, যেহেতু এফিড় হুবহু অনুলিপি বা তাদের ক্লোন তৈরী করে, পরার্থবাদী আত্ম-বিসর্জন তাদের মধ্যে খুব বেশী প্রত্যাশা করা যেতে পারে। ১৯৬৪ সালে হ্যামিলটন বিষয়টি লক্ষ করেছিলেন এবং বেশ সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন এই অদ্ভুত বাস্তব সত্যটি ব্যাখ্যা করার জন্য সেই সময় অবধি জানা ছিল যে– ক্লোন থেকে আসা প্রাণীরা পরার্থবাদী আচরণ করার কোনো বিশেষ প্রবণতা প্রদর্শন করেনা। সৈন্য এফিডদের আবিষ্কার, যখন এটি আবিষ্কৃত হয়েছিল, হ্যামিলটনের তত্ত্বের জন্য আর কোনো কিছুই এর চেয়ে বেশী সামঞ্জস্যপুর্ণ হতে পারেনা। তারপরও মূল পেপারটি ঘোষণা দিয়েছিল এই আবিষ্কারটি এফিড সৈন্যদের ব্যপারে এমন আচরণ করেছিল যেমন তারা হ্যামিলটনের তত্ত্বটির জন্য একটি সমস্যা সৃষ্টি করে, এর কারণ এফিডরা হ্যাপলোডিপলয়েড নয়!
একটি সুন্দর রসিকতা বলা যায়।
যখন আমরা টারমাইটদের লক্ষ করি • আবারো প্রায়শই যাদের উদাহরণকে হ্যামিলটনের তত্ত্বের জন্য একটি বিব্রতকর বিষয় হিসাবে ভাবা হয়– সেই একই বিষয় এখানে চলমান। আর হ্যামিলটন নিজে, ১৯৭২ সালে তিনি সবচে উদ্ভাবনপটু অসাধারণ তত্ত্ব প্রস্তাব করেছিলেন কেন তারা সামাজিক প্রাণীতে রূপান্তরিত হয়েছে এবং এটিকে গণ্য করা যেতে পারে ‘হাপলোডিপলয়ডি’ হাইপোথিসিসের একটি বুদ্ধিদীপ্ত তুলনা হিসাবে। এই তত্ত্বটি, সেই চক্রাকারে আন্তঃপ্রজনন তত্ত্বটি (সাইক্লিক ইনব্রিডিং তত্ত্ব) সাধারণত মনে করা হয় এস, বার্টজ এর প্রস্তাবিত একটি তত্ত্ব হিসাবে, যিনি এটি প্রস্তাব করেছিলেন হ্যামিলটন এটি প্রথম প্রকাশ করার সাত বছর পর। বৈশিষ্ট্যসূচকভাবে হ্যামিলটন নিজেই ভুলে গিয়েছিলেন যে তিনি এটিকে প্রথমে ‘বার্টজ থিওরী’ ভেবেছিলেন এবং আমাকে তার নিজের লেখা পেপার তার চোখের সামনে মেলে ধরতে হয়েছিল তাকে বিশ্বাস করানোর জন্য! গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বাদে, এই তত্ত্বটি এত বেশী কৌতূহলোদ্দীপক যে আমি দুঃখিত আমি প্রথম সংস্করণে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করিনি। আমি আমার সেই বাদ দেবার বিষয়টি এখন সংশোধন করার চেষ্টা করবো।
আমি বলেছিলাম যে তত্ত্বটি হ্যাপলোডিপলয়ডি হাইপোথিসিসের একটি বুদ্ধিমান তুলনামূলক উদাহরণ। আমি যেটা বোঝাতে চাইছি সেটা হচ্ছে এটি। সামাজিক বিবর্তনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হ্যাপলোডিপলয়েড প্রাণীদের আবশ্যিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, কোনো একটি সদস্য তাদের সন্তানদের থেকে বরং তাদের ভাইবোনের। সাথে জিনগতভাবে বেশী নিকটাত্মীয় হবে আর এই বিষয়টি তার পিতামাতার নেস্টে থেকে তার ভাইবোনদের প্রতিপালন করার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয় তার নিজের সন্তান ধারণ ও প্রতিপালন করার চেয়ে। হ্যামিলটনের একটি কারণ খুঁজে পেয়েছিলেন, টারমাইটদের মধ্যেও, ভাইবোনরা হয়তো একে অপরের জিনগতভাবে বেশী নিকটবর্তী তাদের পিতামাতারা তাদের সন্তানদের সাথে জিনগতভাবে যতটা নিকটবর্তী। ইনব্রিডিং বা আন্তঃপ্রজননের একটি ধারণা দেয় কেন এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। যখন প্রাণীরা তাদের ভাইবোনদের সাথে প্রজনন করে, যে সন্তান তারা তৈরী করে তারা আরো বেশী জিনগতভাবে সুসম হয়ে ওঠে। সাদা র্যাটরা কোনো একটি ল্যাবরেটরীতে প্রজনন হওয়া স্ট্রেইনে জিনগতভাবে প্রায় একই, হুবহু বা আইডেন্টিকাল যমজ প্রাণীদের মত। এর কারণ তাদের জন্ম হলো ভাই-বোনের প্রজননের মাধ্যমে জন্ম হওয়া দীর্ঘ বংশধারা। তাদের জিনোম উচ্চমাত্রায় হোমোজাইগাস, যদি আমরা সেই টেকনিকাল শব্দটি ব্যবহার করি। তাদের প্রত্যেকটি জিনগত লোকাসে দুটি জিন হুবহু একই রকম এবং একই সাথে হুবহু একই লোকাসে থাকা জিনগুলো সাথে যা তাদের একই গ্রুপের অন্যান্য সদস্যের থাকে। প্রকৃতিতে সাধারণত আমরা দীর্ঘ কোনো বংশধারা দেখি না যা সৃষ্টি হয় এধরনের আন্তঃপ্রজনন বা ভাই-বোন প্রজননের মাধ্যমে, কিন্তু সেখানে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম আছে– টারমাইটরা!
একটি বৈশিষ্ট্যসূচক টারমাইট নেস্ট প্রতিষ্ঠা করে একজোড়া রাজকীয় দম্পতি, রাজা এবং রানি, এরপর তারা শুধুমাত্র একে অপরের সাথে প্রজনন করে, যতক্ষণ না অবধি তাদের কোনো একজন মারা না যায়। তখন সেই জোড়ের শূন্যস্থান পুরণ করে তাদের কোনো একটি সন্তান, যে তাদের পিতামাতার মধ্যে যে জীবিত থাকবে তার সাথে প্রজনন অব্যাহত রাখতে প্রজনন শুরু। করবে। যদি মূল রাজকীয় জোড়ার উভয় সদস্যই মারা যায়, তাদের জায়গা নেয় ভাই-বোন প্রজনন জুটি। এবং এভাবেই চলতে থাকে। একটি পূর্ণবয়স্ক কলোনির সাধারণত বহু সংখ্যক রাজা রানি থাকার সম্ভাবনা থাকে। এবং কয়েক বছর পর যে প্রজন্ম সৃষ্টি হয় সেই প্রজন্ম মূলত খুব বেশী মাত্রায় আন্তঃপ্রজননের মাধ্যমে সৃষ্ট– ল্যাবরেটরিতে প্রজনন করা ইঁদুরদের মত। গড় হোমোজাইগোসিটির পরিমান এবং আত্মীয়তা গড় সম্পর্ক, কোনো একটি টারমাইট নেস্টে বছর প্রতি বাড়তে থাকে এবং রাজকীয় প্রজননক্ষমরা সফলভাবে প্রতিস্থাপিত হয় তাদের সন্তান অথবা তাদের ভাইবোনদের দ্বারা। কিন্তু এটি আসলে হ্যামিলটনের প্রস্তাবে প্রথম ধাপ মাত্র। তার যুক্তির অসাধারণ অংশটি এসেছে এর পরে।
কোনো সামাজিক পতঙ্গ কলোনীর শেষ উৎপাদনটি হচ্ছে নতুন, ডানাসহ প্রজননক্ষম পতঙ্গ যে তাদের জন্ম হওয়া কলোনী থেকে উড়ে বের হয়ে যায়, প্রজনন করে এবং নতুন একটি কলোনি তৈরী করে। যখন এই নতুন রাজা রানি প্রজনন করে, সম্ভাবনা থাকে এই প্রজনন আন্তঃপ্রজননজনিত বা ভাই-বোনের প্রজনন নয়। সত্যি, যেন। দেখে মনে হয় একটি সুসম প্রথা এমনভাবে পরিকল্পিত যা নিশ্চিৎ করে কোনো একটি এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন টারমাইট নেস্টগুলোর সবগুলো একই দিনে ডানাসহ প্রজননক্ষম সদস্যদের তৈরী করে, সম্ভবত বহিঃপ্রজননের বিষয়টি নিশ্চিৎ করার জন্য। সুতরাং, কলোনী ‘ক’ থেকে আসা একটি তরুণ রাজা এবং কলোনী ‘খ’ থেকে আসা তরুণ রানির প্রজননের জিনগত পরিণতির বিষয়টি বিবেচনা করুন। তারা নিজেরা দুজনেই অতিমাত্রায় আন্তঃপ্রজননের ফসল, দুজনেই ল্যাবরেটিতে প্রজনন করা ইঁদুরদের সমতুল্য। কিন্তু যেহেতু তারা দুটি ভিন্ন, স্বতন্ত্র নিকটবর্তী সম্পর্কের আন্তঃপ্রজনন প্রোগ্রামের ফসল, তারা নিজেরা জিনগতভাবে পরস্পর থেকে পৃথক আন্তঃপ্রজননের মাধ্যমে সৃষ্ট হওয়া সাদা ইঁদুরের মত, তবে যারা দুটি ভিন্ন ল্যাবরেটরী স্ট্রেইনের সদস্য। যখন তারা এক অপরের সাথে প্রজনন করে, তাদের সন্তানরা অতিমাত্রায় হেঁটেরোজাইগাস হবে, কিন্তু সেটি সুসমভাবে। হেঁটেরোজাইগাস মানে বহু জিন লোকাসে থাকা জিনগুলো একে অপরের থেকে ভিন্ন হবে। আর সুসমভাবে হেঁটেরোজাইগাস মানে প্রায় বেশীর ভাগ সন্তানই হেঁটেরোজাইগাস হবে ঠিক একইভাবে। তারা জিনগতভাবে প্রায় হুবহু হবে তাদের ভাইবোনদের সাথে, কিন্তু একই সাথে তারা আবার খুব বেশী হেঁটেরোজাইগাসও হবে।
এখন সময়ে আরো এক ধাপ সামনে এগিয়ে যাওয়া যাক। রাজকীয় জুটির প্রতিষ্ঠা করা নতুন কলোনী আকারে বড় হয়। যেখানে প্রচুর পরিমানে হুবহু হেঁটেরোজাইগাস তরুণ সদস্যদের আমরা দেখতে পাবো। এবার ভাবুন কি ঘটতে পারে যদি একজন বা দুজন প্রতিষ্ঠাতা জুটির মৃত্যু হয়। পুরোনো সেই ভাইবোন বা পিতামাতা সন্তানের প্রজনন চক্র পুনরায় শুরু হয় যার পরিণতি উল্লেখযোগ্য। নিকটাত্মীয়দের প্রজননের মাধ্যমে সৃষ্ট প্রজন্ম নাটকীয়ভাবে এর আগে প্রজন্ম থেকে অনেক বেশী বিচিত্র হবে। আমরা যে প্রজননের কথাই ভাবিনা কেন, ভাই-বোন প্রজনন, পিতা-কন্যা বা মাতা-পুত্র প্রজনন যাই হোক না কেন। মূলনীতিটি সব ক্ষেত্রেই এক, কিন্তু ভাই বোন প্রজননের ব্যাপারটা ব্যাখ্যার জন্য বিবেচনা করা সহজতর। যদি ভাই ও বোন দুজনেই হুবহু ‘হেঁটেরোজাইগাস’ হয়, তাদের সন্তানরা অত্যন্ত বৈচিত্রময় জিনগত সমাবেশ-বিন্যাসের একটি মিশ্রণ হবে। এবং এটি ঘটে মৌলিক মেন্ডেলীয় জিনতত্ত্বের কারণে এবং নীতিগতভাবে, এটি প্রয়োগ করা যায়, সব প্রাণী এবং উদ্ভিদের ক্ষেত্রে, শুধুমাত্র টারমাইট নয়। যদি আপনি সুসমভাবে হেঁটেরোজাইগাস সদস্যদের আলাদা করেন ও তাদের মধ্যে প্রজননের মাধ্যমে সংকর সৃষ্টি করেন, হয় তাদের একে অপরের সাথে, অথবা হোমোজাইগাস তাদের কোনো আদি পৈতৃক পরিবারের সদস্যদের সাথে, একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, জিনগতভাবে যদি বলি। এর কারণ সহজে নির্নয় করা সম্ভব যেকোনো মৌলিক জিনতত্ত্বের পাঠ্যপুস্তক পর্যালোচনা করলে এবং আমি সেটা বিস্তৃতভাবে আলোচনা করবো না এখানে। আমাদের বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যেটা দরকার সেটি হচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ পরিণতি হচ্ছে যে টারমাইট কলোনীদের এই মুহূর্তের বিকাশ পর্যায়ে, কোনো একটি সদস্য বৈশিষ্ট্যসূচকভাবে জিনগতভাবে তাদের ভবিষ্যৎ সন্তানের অপেক্ষায় তার ভাইবোনদের নিকটাত্মীয়। এবং এটাই আমরা যা দেখেছি ‘হ্যাপলোডিপলয়েড’ হাইমেনোপটেরাদের ক্ষেত্রে, খুব সম্ভবত সেই পূর্বশর্ত পরার্থবাদী প্রজনন অক্ষম কর্মী শ্রেণীর বিবর্তনের জন্য।
কিন্তু এমনকি যেখানে কোনো বিশেষ কারণ নেই এমন কোনো প্রত্যাশা করা যে একক সদস্যরা তাদের সন্তানদেও চেয়ে বরং ভাইবোনদের বেশী নিকটাত্মীয় হবে, সেখানে প্রত্যাশা করার চেয়ে একক সদস্যরা তাদের ভাইবোনদের সাথে সমপরিমান নিকটাত্মীয় হবার খুব ভালো কারণ থাকে, যতটা তারা তাদের সন্তানদের নিকটাত্মীয়। যে একটি শর্ত এখানে প্রয়োজনীয় এই পরিস্থিতিটির সত্যি হবার জন্য সেটি হচ্ছে একটি পরিমান পর্যন্ত একগামীতা। একটি উপায়ে হ্যামিলটনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে আরো অনেক বেশী সংখ্যক প্রজাতি আমরা দেখিনা, যেখানে প্রজনন অক্ষম কর্মীরা তাদের ছোট ভাইবোনদের দেখাশোনা করে। যেটি বরং ব্যাপকভাবে দেখা যায় সেটি হচ্ছে, আমরা ক্রমবর্ধমান হারে অনুভব করছি, সেটি হচ্ছে এই স্টেরাইল ওয়ার্কার বা অনুর্বর প্রজনন অক্ষম কর্মীদের প্রপঞ্চটির একধরনের লঘুকৃত সংস্করণ, যা পরিচিত ‘নীড়ে থেকে সাহায্য করা” শিরোনামে। বহু প্রজাতির পাখী এবং স্তন্যপায়ীদের তরুণ সদস্যরা, পারিবারিক নীড় থেকে বের হয়ে নিজেদের পরিবার সৃষ্টি করার আগেই, তাদের ছোট ভাইবোনদের প্রতিপালনে সহায়তা করতে তাদের বাবামায়ের সাথে একটি কিংবা দুটি ঋতু অবস্থান করে। এটি করার জন্য ভাইবোনদের শরীরের মাধ্যমে জিনদের কপি হস্তান্তরিত হয়। যদি ধরে নেয়া হয় এর সুফল ভোগকারীরা পূর্ণ (আংশিকের পরিবর্তে) ভাইবোন, কোনো ভাইবোনের জন্য বিনিয়োগকৃত প্রতিটি আউন্স খাদ্যের ঠিক সমপরিমান প্রতিদান আমরা পাই বিনিয়োগ থেকে। জিনগতভাষায়, যেমনটি হলো, যদি সেটি বিনিয়োগ করা হতো একটি শিশুর জন্য, কিন্তু সেটি শুধুমাত্র যদি বাকী সব কিছুই সমান থাকে। আমাদের অবশ্যই অসাম্যের কথা ভাবতে হবে, যদি আমরা ব্যাখ্যা করতেই কোন পিতামাতার নীড়ে সাহায্য করার বিষয়টি ঘটে কিছু প্রজাতিতে এবং অন্য অনেক প্রজাতিতে না।
যেমন, ভাবুন একটি প্রজাতির পাখি যা ফাপা কোনো গাছে বাসা বানায়। এই গাছগুলো সহজে পাওয়া যায় না, সীমিত সংখ্যায় তারা বিদ্যমান। আপনি যদি তরুণ কোনো সদস্য হয়ে থাকেন, যার পিতামাতা এখনো বেঁচে আছে, সম্ভবত বিদ্যমান কোনো ফাপা গাছ তাদের আয়ত্বে থাকে (অন্তত সাম্প্রতিক সময়ের আগ অবধি তাদের অবশ্যই দখলে ছিল, অন্যথায় আপনার অস্তিত্বই থাকতো না।) সুতরাং আপনি হয়তো কোনো একটি ফাপা গাছে বসবাস করেন, সেটি একটি প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর এবং এই উর্বর বাচ্চা তৈরীর কারখানা, যেখানে নতুন শিশু বাসিন্দারা আপনার পূর্ণ বা আসল ভাইবোন, জিনগতভাবে তারা আপনার নিজের সন্তান যতটা হবে ততটাই আপনার নিকটাত্মীয়। আপনি যদি সেটি ত্যাগ করে একা একা শুরু করার চেষ্টা করেন, ফাপা গাছ খুঁজে পাবার আপনার সম্ভাবনা খুব কম। এমনকি যদি আপনি সফলও হন, যে সন্তানদের আপনি সেখানে প্রতিপালন করবেন তারা আপনার ভাইবোন অপেক্ষা জিনগতভাবে আপনার বেশী নিকটাত্মীয় হবে না। নির্দিষ্ট পরিমান কিছু প্রচেষ্টা যা আপনি আপনার পিতামাতার ফাপা বৃক্ষে বিনিয়োগ করেছিলেন, সেখান থেকেই বেশী লাভ হয়, যদি তুলনা করা হয় সেই একই পরিমান পরিশ্রমের সাথে যা আপনাকে হয়তো বিনিয়োগ করতে হতো এককভাবে অন্য কোথাও শুরু করার জন্য। এই শর্তগুলো তাহলে হয়তো ভাইবোনদের প্রতিপালন বিষয়টিকে বিবর্তিত হতে সহায়তা করে- ‘নীড়ে থেকে সাহায্য করা।
এইসব কিছু সত্ত্বেও, যা সত্যি থাকে সেটি হচ্ছে যে কিছু সদস্যকে– বা সব সদস্যকে কোনো কোনো সময়– অবশ্যই বাইরে যেতে হবে এবং নতুন ফাপা গাছ খুজতে হবে বা তাদের প্রজাতির জন্য যে কোনো সমতুল্য কাজ সম্পাদন করতে হবে। অধ্যায় ৭ এর সন্তান ধারণ এবং প্রতিপালন করার ভাষা যদি ব্যবহার করি, কাউকে না কাউকে অবশ্য কিছু সন্তান ধারণ করতে হবে, অন্যথায় প্রতিপালন করার জন্য কোনো বাচ্চাই থাকবে না! এখানে যে বিষয়টি বলা হচ্ছে সেটি কিন্তু এমন না যে, অন্যথায় প্রজাতি বিলুপ্ত হবে। বরং কোনো একটি জনগোষ্ঠী যেখানে বিশুদ্ধ প্রতিপালন করার জিনগুলো প্রাধান্য বিস্তার করে, সেখানে সন্তান ধারণের জিনের একটি বাড়তি কিছু সুবিধা থাকার কথা। সামাজিক পতঙ্গদের ক্ষেত্রে সন্তান ধারণের দ্বায়িত্ব প্রতিপালন করে রানি ও প্রজননক্ষম পুরুষরা। তারা কিন্তু সেই সদস্যরা যারা ঘরের বাইরে যায়, নতুন কোনো ফাপা গাছের সন্ধান করে, এবং একারণেই তাদের ডানা থাকে, এমনকি পিপড়াদের ক্ষেত্রে, যেখানে কর্মীরা ডানাহীন। এই প্রজননক্ষম শ্ৰেণীরা তাদের পুরো জীবনের জন্য বিশেষায়িত। পাখি এবং স্তন্যপায়ীরা যারা নীড়ে সাহায্য করে কাজটি অন্যভাবে করে। প্রতিটি সদস্য তাদের জীবনের একটি অংশ (সাধারণ প্রাপ্তবয়স্ক হবার প্রথম অথবা দ্বিতীয় ঋতু) কাটায় কর্মী হিসাবে, তার ছোট ভাই বোনদের প্রতিপালন করতে সাহায্য করে, আর বাকী জীবনে তারা চেষ্টা করে প্রজননক্ষম জীবন কাটাতে।
তাহলে এর আগের পাদটীকায় উল্লেখিত ন্যাকেড মোল র্যাটদের বিষয়টি তাহলে কি? তারা ব্যাখ্যা করে সেই চিরন্তন প্রচেষ্টাকে বা ‘হলো ট্রি’ বা ফাপা বক্ষ মূলনীতিটাকে, যদিও তাদের প্রধান চিন্তা আক্ষরিকভাবে কোনো ফাপা বৃক্ষ খুঁজে বের করা না। তাদের কাহিনীর মূল বিষয়টি হয়তো সাভানার নীচে তাদের খাদ্য উৎস বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে। তারা মূলত মাটির নিচে থাকা কন্দমূল খাদ্য হিসাবে গ্রহন করে। এই কন্দ বা টিউবারগুলো আকারে অনেক বেশী বড় হতে পারে এবং অনেক গভীরে প্রোথিত থাকতে পারে। এধরনের কোনো প্রজাতির একটি করে ওজন ১০০০ মোল র্যাটের ওজনেরও বেশী হতে পারে। একবার যখন তারা সেটি খুঁজে পায়, যা পুরো কলোনীর খাদ্য সরবরাহ করতে পারে বেশ কয়েক মাস এমনকি বছরেরও বেশী। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই ধরনের কন্দগুলোকে মাটির নীচে খুঁজে বের করা, কারণ তারা বিক্ষিপ্ত আর এলোমেলোভাবেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে পুরো সাভানা জুড়ে। মোল র্যাটদের জন্য খাদ্য উৎস খুঁজে বের করা খুব কঠিন কিন্তু সেটি খোঁজার প্রচেষ্টার জন্য করা পরিশ্রম করা যথার্থভাবেই সার্থক। রবার্ট ব্রেট পরিমাপ করেছিলেন যে একটি একক মোল র্যাট, একা একা যদি পরিশ্রম করে, তাহলে তাকে একটি একক কন্দ খুঁজে বের করতে বহু সময় ব্যয় করতে হবে, আর তার জন্যে খনন কাজ করতে গেলে সে তার দাঁত নষ্ট করে ফেলতে পারে। একটি বিশাল সামাজিক কলোনী, বহু মাইল জুড়ে যে সুড়ঙ্গ পথ, বহু মোল র্যাট আসা যাওয়া করে, সেটি আসলেই একটি দক্ষ কন্দ খনি। প্রতিটি সদস্য অন্যান্য খনি-শ্রমিকদের সাথে সংঘবদ্ধ হয়ে বাস করার কারণেঅর্থনৈতিকভাবে ভালো থাকে।
একটি দীর্ঘ সুড়ঙ্গ পদ্ধতি, তাহলে যেখানে পাহারা দেয় বহু পরস্পরকে সহযোগিতাকারী কর্মীরা, সেটিও একটি সফল সিস্টেম ঠিক আমাদের কল্পিত ‘হলো ট্রী’র মত, এমনকি এরচেয়েও বেশী। যেহেতু আপনি একটি সমৃদ্ধ সামাজিক গোলকধাঁধা বা সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কে বাস করেন এবং যদি আপনার মা এখনও আপনার পূর্ণ ভাইবোনদের তৈরী করা অব্যহত রাখে সেই সুড়ঙ্গ গোলকধাঁধার মধ্যে, সেখান থেকে বের হয়ে এসে আপনার একা একা কোনো পরিবার সৃষ্টি করার তাড়না আসলেই খুব সামান্য। এমনকি যখন পূর্ণ ভাইবোন নয় এমন কিছু শিশুরও জন্ম হয়, তখনও এই ‘গোয়িং কনসার্ন’ যুক্তি তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের ঘরে থাকার জন্য তারপরও যথেষ্ট শক্তিশালী হবে। (অ্যাকাউন্টিং পরিভাষায় ‘গোয়িং কনসার্ন’ হচ্ছে কোনো একটি কোম্পানী, অনির্দিষ্ককালের জন্যে কাজ করা অব্যহত রাখার জন্যে যার যথেষ্ট পরিমান সম্পত্তি আছে, বড় কোনো আর্থিক সংকট ছাড়া যা তার দ্বায়িত্ব পালন করে যেতে পারে, যতক্ষণ না পরিস্থিতি এর বিপরিত হয়)।
(৩) রিচার্ড আলেক্সান্ডার এবং পল শেলমান একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন ট্রিভার্স এবং হেয়ারের পদ্ধতি ও উপসংহারকে সমালোচনা করে। তারা একমত হয়েছিলেন যে স্ত্রী-সদস্য ঘেষা লিঙ্গ অনুপাতগুলো সামাজিক কীট পতঙ্গদের মধ্যে খুব স্বাভাবিক, কিন্তু তারা সেই দাবীটি মানতে রাজি হননিঃ ৩:১ অনুপাতের সাথে এটি বেশ ভালোভাবে সামঞ্জস্যপুর্ণ বা একটি ‘গুড ফিট”। তারা স্ত্রী-সদস্য নির্ভর লিঙ্গ অনুপাতের একটি বিকল্প ব্যাখ্যা পছন্দ করেছিলেন, একটি ব্যাখ্যা যে, ট্রিভার্স ও হেয়ারের মত প্রথম প্রস্তাব করেছিলেন হ্যামিলটন। আমি আলেক্সান্ডার ও শেরমানের যুক্তি প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট বেশী বোধগম্য ও বিশ্বাসযোগ্য মনে করেছি, তবে তারা একটি অন্তর্গত ধারণার স্বীকারোক্তি করেছিলেন যে কাজটি এত বেশী সুন্দর যে, ট্রিভার্স এবং হেয়ার পুরোপুরিভাবে ভুল হতে পারেন না।
হাইমেনোপটেরানদের লিঙ্গ অনুপাত সম্বন্ধে যে তথ্য দেয়া হয়েছিলো এই বই এর প্রথম সংস্করণে, অ্যালান গ্রাফেন আমাকে জানিয়েছিলেন সেখানে আরো একটি এবং বেশী চিন্তা করার মত সমস্যা আছে। আমি এটি ব্যাখ্যা করেছিলাম ‘দি এক্সটেন্ডেড ফিনোটাইপ’ বইটিতে (মূল বইয়ের পৃষ্ঠা ৭৫-৬)। সেখান থেকে সংক্ষিপ্ত খানিকটা অংশ আমি এখানে উল্লেখ করছিঃ
সম্ভাব্য একটি কর্মী ‘তারপরও জনসংখ্যার যেকোনো সম্ভাব্য লিঙ্গ অনুপাতে, ভাইবোনের প্রতিপালন ও সন্তানদের প্রতিপালন, এই দুটি সিদ্ধান্ত নিয়ে নির্বিকার। এভাবে, মনে করুন যে, জনসংখ্যার লিঙ্গ অনুপাত স্ত্রী সদস্য ঘেষা, এমনকি ধরুন এটি ট্রিভার্স এবং হেয়ার যা ধারণা করছেন তার সাথে মিলে যায়: ৩:১। যেহেতু কর্মীরা তাদের ভাইবোনদের বেশী নিকটাত্মীয় তাদের যেকোনো লিঙ্গের সন্তানদের তুলনায়, হয়তো এটা মনে হতে পারে যে সে হয়তো তার ভাইবোনদের প্রতিপালন করাটিকে শ্রেয়তর মনে করে, যখন ঠিক এমনটাই স্ত্রী সদস্যদের প্রাধান্যপূর্ণ লিঙ্গ অনুপাত থাকে। সে কি মূলত মূল্যবান বোনদের অর্জন করছে না ( সেই সাথে অল্প কিছু অপেক্ষাকৃত মূল্যহীন ভাইদের) যখন যে ভাইবোনকে প্রতিপালন করার দ্বায়িত্বটা বেছে নিচ্ছে? কিন্তু এই যুক্তি প্রক্রিয়াটি এমন জনগোষ্ঠীতে তাদের দুর্লভ হবার পরিণতি হিসাবে পুরুষদের অপেক্ষাকৃতভাবে বিশাল প্রজননজনিত মূল্যটি উপেক্ষা করে। কোনো কর্মী হয়তো তার প্রতিটি ভাইয়ের সাথে সমানভাবে নিকটাত্মীয় নয়। কিন্তু পুরুষরা যদি সেই জনগোষ্ঠীতে মোটের উপর দুর্লভ হয়ে থাকে, তাহলে ঐ ভাইদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই ভবিষ্যত প্রজন্মেও পূর্বসূরি হবার অনুরূপভাবে উচ্চ সম্ভাবনা থাকবে।
(৪) সুবিখ্যাত দার্শনিক জে, এল, ম্যাকি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। সেই বাস্তব সত্যটির একটি কৌতূহলোদ্দীপক পরিনতির প্রতি, যে সত্যটি দাবী করছে যে আমার ‘চিট’ এবং গ্রাজারদের’ জনগোষ্ঠী যুগপৎভাবে স্থিতিশীল। দূর্ভাগ্যজনক, এটি হতে পারে যদি জনগোষ্ঠীতে এমন একটি ‘ইএসএস’ স্থিতিশীল হয় যা তাদের বিলুপ্ত করে। ম্যাকি আরো একটি বাড়তি বিষয় প্রস্তাব করেছিলেন যে, কিছু ধরনের ‘ইএসএস’-এর বেশী সম্ভাবনা থাকে কোনো একটি জনগোষ্ঠীকে বিলুপ্ত করার জন্য অন্যান্য ‘ইএসএস’-এর তুলনায়। এই বিশেষ উদাহরণে ‘চিট’ এবং গ্রাজার’ উভয় গ্রুপই বিবর্তনীয়ভাবে স্থিতিশীল: কোনো জনগোষ্ঠী হয়তো স্থিতিশীল ‘চিট’ ভারসাম্যে অথবা ‘গ্রাজারদের’ মূল ভারসাম্যে। ম্যাকি’র প্রস্তাব হচ্ছে যে জনগোষ্ঠী ঘটনাচক্রে ‘চিট’ ভারসাম্যে স্থিতিশীল হয়, সেটির বিলুপ্ত হয়ে যাবার সম্ভাবনা অনেক বেশী থাকবে সুতরাং সেকারণে এধরনের উচ্চতর পর্যায়ের, মধ্যবর্তী ‘ইএসএস’ নির্বাচন থাকবে পরস্পরমুখী পরার্থবাদীতার সপক্ষে। এটি বিকশিত হতে পারে একটি যুক্তিতে একধরনের ‘গ্রুপ সিলেকশন’ প্রস্তাবের পক্ষে, যা বেশীর ভাগ গ্রুপ সিলেকশন তত্ত্বেরই ব্যতিক্রম, হয়তো আসলেই কাজ করতে পারে। আমি আমার In Defence of Selfish Genes নিবন্ধে সেই যুক্তিটি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি।