তুতান্-খামেন্
হাজার তিনেক বছর হল মিশরের এই রাজ্যটি জীবনযাত্রার চেয়ে বেশি আড়ম্বরে মরণ-যাত্ৰা করেছিলেন। খাবার-দাবার, পোশাক-পরিচ্ছদ, গন্ধ-অলংকার–সেগুলি ভরে নেবার নানারকম শৌখিন বাক্স-পেটরা, খাট-পালঙ্ক, চৌকি-সিংহাসন, যান-বাহন, এমনকী বৈতরণীর খেয়া পারের নীেকে পর্যন্ত সঙ্গে ছিল। তিন ঘর বোঝাই এইসব আসবাবপত্র এপার থেকে ওপারের পথ কতটা সুগম করেছিল জানার জো নেই, কিন্তু ওগুলো যে মহারাজকে ওপার থেকে এপারে তিন হাজার বছরের ব্যবধান নিমেষে পার করে এনেছে তাতে সন্দেহ নেই। মহারাজকে তো এ season-এ ইউরোপের leader of fashion বললেই চলে। তার পোশাকের cut-এ লন্ডনে জামা কাটা হচ্ছে, তার কোমরবন্ধের কায়দায় প্যারিতে মেয়েদের কোমরবন্ধ তৈরি হচ্ছে। আশা করা যায়, কলকাতার রাস্তায়ও ‘তুতানখামেন। চটিজুতার বিজ্ঞাপন শীঘ্রই দেখা যাবে।
মিশরের সভ্যতার প্রকাণ্ড দীর্ঘ ইতিহাসে তুতান-খামেন খুব প্রাচীন রাজা নন। ঐতিহাসিক জ্ঞান বর্তমানে যে রাজবংশে গিয়ে ঠেকেছে বলে তাকে বলা হয় প্রথম রাজবংশ, মিশরের সেই রাজবংশের রাজারা এখন থেকে প্ৰায় সাত হাজার বছর আগেকার লোকঅর্থাৎ তাদের সময় থেকে তুতান-খামেনের সময়ের ব্যবধান, তুতান-খামেনের ও বর্তমান কালের মধ্যের ব্যবধানের চেয়ে বেশি ছাড়া কম নয়। আর তুতান-খামেনের কবরে জিনিসপত্র, ছবি, মূর্তি যা-সব পাওয়া গেছে, বিস্ময়ের প্রথম চমক কেটে গেলে হয়তো প্রমাণ হবে, ওদের সোনার পালিশ আর মণি-মাণিক্যের দু্যতি ইতিহাসের অন্ধকারকে বড় বেশি আলো করেনি–মিশরের প্রাচীন সভ্যতার ওরকম সব নিদর্শন বেশির ভাগই ইতিপূর্বেই আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু এ-সব নাস্তিকতার কথা আজ নয়। আজ জয় মহারাজ তুতান-খামেনের জয়’। দুয়েটারের বিদ্যুৎ সবাইকে ধাক্কা দিয়ে জানাচ্ছে, মানুষের সভ্যতা কিছু সেদিনকার বস্তু নয়; ও-জিনিসটি প্রাচীন ও বুনিয়াদি। চেয়ে দেখ তিন হাজার বৎসর আগেকার মিশরের ঐশ্বৰ্য, শিল্প-কলা, বিলাস, ব্যসন। যা নিতান্ত আধুনিক হালফ্যাশান ভেবেছিলে তাও গ্রিস জন্মাবার হাজার বছর আগে মানুষের সমাজে চলতি ছিল।
কিন্তু কেবল কথায় খুশি না থেকে কাগজওয়ালাদের ছবি ছাপতে বললে কে? তাদের ছবিতে কি সোনার রং ওঠে, না মণি-জহিরতের জ্যোতি ফোটে? ও-ছবিতে তো দেখছি তুতানখামেনের পেটা-সোনার সিংহাসন আর তাঁর আবলুশ কাঠের বেড়াবার ছড়ি দুয়ের একই কালো কালির রং। তার সোনার লতা-কাটা গজদন্তের আসনকে আমার সেগুন কাঠের চেয়ারখানার জ্ঞাতি-ভাই বলেই মনে হচ্ছে। যাহোক এ-সব আসবাবপত্রের ছবি তবুও ছিল একরকম। কালির কালো আঁচড়কে শিল্পীর সোনালি রেখা কল্পনা করা খুব কঠিন নয়। কিন্তু তুতানখামেনের কবরে পাওয়া ছবি ও ভাস্কর্যের ফটোগুলো নির্বিচারে কেন ছাপানো? ওই মহারাজ তুতান-খামেন দাঁড়িয়ে রয়েছেন বিজয়ী বীরের দৃপ্ত ভঙ্গিতে। বেশ, দেখে মন খুশি হল। কিন্তু ওই ওরা আবার কারা? ওই যাদের ঘাড়ের বোঝার ভারে কোমর নুইয়ে পড়েছে। প্রাচীন মিশরের ঐশ্বর্ষে ওদের অংশটা কী সে খবর তো রয়টার দেয়নি। দেশ-বিদেশের দ্রব্যসম্ভার ওরা রাজপ্রাসাদে বয়ে নিয়ে আসছে? বাঃ, তবে তো দেখছি মানুষের সভ্যতার সবটাই সুপ্রাচীন। তুতানখামেনের রাজ-ঐশ্বৰ্যও প্রাচীন, আজকের রাজপথের কুলি-মুটেও সমান প্রাচীন। যাঁরা তুতানখামেনের দিনে ঘাড়ে বোঝা বইত, আর যাঁরা আজকের দিনে মাথায় মোট বয় তাদের মধ্যে তো কোনও তফাত নেই। সেই কটিতে কৌপীন, শরীরে ক্লান্তি, মনে দীনতা— সবই এক। মানুষের সভ্যতা দেখছি উদভ্ৰান্ত প্রেমের’ শ্মশানের মতো, ঈশা বল, মুশা বল, রামমোহন রায় বল, এমন সাম্য-সংস্থাপক জগতে আর নাই।’ যেখানে ওর প্রকাশ সেখানেই ওই এক মূর্তি। বহু মানুষের নৈপুণ্যের সৃষ্টি, বহুলোকের পরিশ্রমের ফল ওই দু-একজন ভোগ করছে, অপব্যয় করছে, নষ্ট করছে, তুতানখামেনের মতো নিজের মরা শরীরের সঙ্গে মাটির নীচে কবর দিচ্ছে। তিন হাজার বছর আগেও যা, তিন হাজার বছর পরেও তাই। মানুষের সভ্যতার গোমুখী থেকে আজ পর্যন্ত ওই একই ধারা চলে এসেছে। কোনও ভগীরথের শঙ্খ ওকে নতুন খাদে বহাতে পারবে, না। ওই খাদ দিয়ে চলেই ওকে মহাসাগরে বিলীন হতে হবে, তা মানুষেও জানে না, দেবতাও জানে না।
কান দিয়ে মন যে নেশা করেছিল তা চোখ দিয়ে ছুটে গেল–কাগজওয়ালাদের ছবির দোষে। তুতানখামেনের কবরের খবরে প্রাচীন মিশরের ঐশ্বৰ্য-বৰ্ণনা শুনে ভেবেছিলাম যাহোক, বাংলার বাইরেও একদিন একটা সোনার বাংলা ছিল; সেখানে সকলেরই গোলােভরা ধান, অর্থাৎ যব, গম, গোয়ালভরা গোরু, মুখভরা হাসি। কিন্তু তুতানখামেনের ছবির কালি দেখছি দুই সমুদ্র তিন নদী পার হয়ে সোনার বাংলার সোনাতেও এসে লাগল। বাংলা ছিল সোনার বাংলা’ তা তো বটেই। কিন্তু কবে ছিল? কল-কারখানা, ম্যাঞ্চেস্টারের কাপড় আসবার পূর্ব পর্যন্ত কি? সেই সময়েই তো ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। তাতে নাকি সোনার বাংলার এক পােয়া লোকের উপর না খেয়ে মরেছিল! মোগল পাঠানের আমলে বোধ হয়? বিদেশিদের বর্ণনা, আবুল ফজলের গেজেটিয়ার, মুকুন্দরামের কবিতা রয়েছে। গোলায় ধান, গোয়ালে গোরু অবশ্যই ছিল— এখনও আছে। কিন্তু এখনকার মতো তখনও সে গোলা আর গোয়ালের মালিক অল্প কজনই ছিল। সোনার বাংলার অনেক সোনার ছেলে তখন চটের কাপড় পরীত এমনও আভাস আছে। তবে হিন্দুযুগে নিশ্চয়। কিন্তু সে যুগেও কি এখনকার মতো দেশে শূদ্রই ছিল বেশি? তাদের Standard of living তো মনু বেঁধে দিয়েছেন–
‘উচ্ছিষ্টমন্নং দাতব্যং জীর্ণনি বসনানি চ।
পুলাকাশ্চৈব ধন্যানাং জীর্ণশ্চৈব পরিচ্ছদাঃ ॥‘
ঋষি গৌতমেরও ওই ব্যবস্থা— ‘জীর্ণনুপানচ্ছত্রবাসঃ–কুচ্চাণুচ্ছিষ্টাশনং’। পুরনো জুতো, ভাঙা ছাতা, জীর্ণ কাপড় তাদের পোশাক পরিচ্ছদ, ছেড়া মাদুর তাদের আসন, উচ্ছিষ্ট অন্ন তাদের আহার। ‘পুলাক’ কথাটার অর্থ ধানের আগড়া; টাকাকারদের ভাষায় ‘অসার ধান’। দেশে গোলাভরা ধান থাকলেও দেশবাসীর বেশির ভাগের কপালে কেবল খুদকুঁড়ো জুটতে কোনও আটক নেই।
যাক, এসব ‘আনপেট্রিয়টিক’ খবর চাপা দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু মহারাজ তুতান-খামেন একটা বিষয়ে বড় নিরাশ করেছেন। তাঁর নাড়ি-ভূড়ির চারপাশে বাক্স সিন্দুক যা সব সাজিয়েছিলেন তাতে যদি কেবল কাপড়-চোপড় টুকিটাকি বোঝাই না দিয়ে তাঁর ‘পেপিরাসের’ লাইব্রেরিটাও পুরে নিতেন তা হলে long journey-তে তারও bored হবার ভয় থাকত না, আমরাও চিরকৃতজ্ঞ থাকতাম। তুতানখামেনের দিনে মিশরের কবিরা নীল’ নদের জোয়ার-ভাটার যে গান গেয়েছিল, নদী-তীরের কুটিরবাসীদের সুখ, দুঃখ, প্রণয়, বিরোধের যে কাহিনি রচেছিল, সে-যুগের জ্ঞানীরা জীবন-মৃত্যুর রহস্য কোন চাবি দিয়ে খুলতে চেয়েছিলেন, তার পণ্ডিতদের চোখে পৃথিবীর চেহারা কেমনতর ছিল, মহারাজ যদি আমাদের এগুলি জানাবার ব্যবস্থা করতেন তবে তার তিন হাজার বছরের মরা যুগ আজকের দিনে সজীব হয়ে উঠত— তারের খবরে নয়, দরদি লোকের মনে। আমরা মন-প্ৰাণ দিয়ে অনুভব করতেম— সেই তিন হাজার বছর আগেকার মানুষ ঠিক আমাদেরই মতো মানুষ। খবর এসেছে, সমাধির ঘরে গোটা কয়েক ‘পেপিরাস’-এর গোলাও পাওয়া গেছে। কিন্তু তাতে যে মহারাজের বীর্য ও বিজয়ের উপাখ্যান ছাড়া আর কিছু আছে এমন ভরসা নেই। সুতরাং মনের আপসোস মনেই থেকে যাবে।
এক বন্ধু খবর দিলেন, লুক্সরে যে কবর আবিষ্কার হয়েছে তা তুতানখামেন-ফ্যামেন। কারও নয়। মিশরতত্ত্বজ্ঞ ফরাসি পণ্ডিতরা নাকি বলেছেন ওটা একটা ডাকাতের আডডা, ‘bandat’s den —রাজ-রাজড়াদের কবর লুটে, লুটের মাল ডাকাতরা একটা সুবিধামতো কবরে লুকিয়ে রেখেছে। এবং ওরকম সব ‘ডেন’ নাকি এর পূর্বেও আরও আবিষ্কার হয়েছে। ফরাসি পণ্ডিতদের এ-চালাকি চলছে না। আমরা সবাই বুঝেছি তাদের এ-সব কথা কেবল হিংসা ও ঈর্ষার কথা। ব্রিটিশ আর আমেরিকান মিলে এই আবিষ্কারটি করেছে, আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সমান অংশীদার ভারতবর্ষের ক্ষত্রিয় রাজা ‘তোদন ক্ষম’ নাম ভাড়িয়ে হয়েছিলেন ‘তুতান-খামেন’ এটা প্রমাণ হয়-হয় হয়েছে, এই শুনেই তাঁরা এ-সব সন্দেহ রটাচ্ছেন। ইংরেজ-বাঙালি কো-অপারেট করে হয় কালীঘাটে, নয়। ডালহাউন্সি ইনস্টিটিউটে এখনই প্ৰতিবাদ সভা ডাকা উচিত।
বৈশাখ ১৩৩০