১০
তিন্নি আজ সারা দিন ছাদে বসে আছে। সে ছাদে গিয়েছে সূর্য ওঠার আগে। এখন প্রায় সন্ধ্যা, কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য ডুবে যাবে। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে এক বারও সে নিজের জায়গা থেকে নড়ে নি। তার ছোট্ট শরীরটি পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে আছে। মাঝে-মাঝে বাতাসে তার চুল উড়ছে। এ থেকেই মনে হয়—এটি পাথরের মূর্তি নয়, জীবন্ত একজন মানুষ। সকালে কাজের মেয়ে নাশতা নিয়ে ছাদে এসে ক্ষীণ গলায় বলেছিল, ‘আপা, নাশতা আনছি।’
তিন্নি কোনো জবাব দেয় নি। কাজের মেয়েটি আধ ঘন্টার মতো অপেক্ষা করল। এর মধ্যে কয়েক বার নাশতা খাবার কথা বলল। তিন্নির কোনো ভাবান্তর হল না।
দুপুরবেলা বরকত সাহেব নিজেই এলেন। শান্ত গলায় বললেন, ‘খেতে এস মা।’
তিন্নি নিশ্চুপ। বরকত সাহেব তার হাত ধরলেন। হাত গরম হয়ে আছে। বেশ গরম। যেন মেয়েটির এক শ’ তিন বা চার জ্বর উঠেছে। তিনি গাঢ় স্বরে বললেন, ‘তোমার কি শরীরটা খারাপ মা?’
তিন্নি না-সূচক মাথা নাড়ল।
‘এস, ভাত দেওয়া হয়েছে। দু’ জনে মিলে খাই।’
সে আবার না-সূচক মাথা নাড়ল। বরকত সাহেব মেয়েকে নিজের দিকে টানতেই হঠাৎ তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলেন। যেন হাজার ভোল্টের ইলেক্ট্রসিটি চলে গেল কপালের মাঝখান দিয়ে। তিনি মেয়ের হাত ছেড়ে দিয়ে অনেকক্ষণ হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। তিন্নি তখন খুব সহজ গলায় বলল, ‘বাবা, তুমি চলে যাও।’
‘চলে যাব?’
‘হুঁ।’
‘তুমি আসবে না?’
‘না।’
‘কিছু খাবে না?’
‘খিদে নেই।’
এক গ্লাস দুধ খাও। দুধ পাঠিয়ে দিই?’
‘না।’
বরকত সাহেব নিচে গেলেন। এ কী গভীর পরীক্ষায় তিনি পড়লেন! মেয়ের এই বিচিত্র অসুখের সত্যি কি কোনো সমাধান আছে? তাঁর মনে হতে লাগল, সমাধান নেই। এই অসুখ বাড়তেই থাকবে, কমবে না। মিসির আলি নামের মানুষটির কিছুই করার ক্ষমতা নেই। মেয়েটিকে নিয়ে বিদেশে চলে গেলে কেমন হয়? ইউরোপ-আমেরিকার বড়-বড় ডাক্তাররা আছেন। তাঁরা দিনকে রাত করতে পারেন–এই সামান্য কাজটা পারবেন না? খুব পারবেন। তিনি নিজে দুপুরে কিছু খেতে পারলেন না। মাথায় ভোঁতা যন্ত্রণা হতে লাগল। বিকেলের দিকে সেই যন্ত্রণাা খুব বাড়ল। তিনি কয়েক বার বমি করলেন। অসম্ভব রাগে তাঁর শরীর কাঁপতে লাগল। কার উপর রাগ? সম্ভবত নিজের ভাগ্যের উপর। এত খারাপ ভাগ্যও মানুষের হয়?
তিন্নি সন্ধ্যা মেলাবার পর নিজের ঘরে ঢুকল। আজ অনেক দিন পর তার আবার ছবি আঁকতে ইচ্ছা হচ্ছে। রঙ-তুলি সাজিয়ে সে উবু হয়ে মেঝেতে বসল। তার সামনে বড় একটি কাগজ বিছানো। সে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে, অতি দ্রুত তুলি বোলাতে শুরু করল। প্রথমে মনে হচ্ছিল, কিছু লাইন এলোমেলোভাবে টানা হচ্ছে। এখন আর তা মনে হচ্ছে না। এখন কাগজে লতানো গাছের ছবি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আকাশে দু’টি সূর্য। তার আলো তেরছাভাবে গাছগুলির উপর পড়েছে।
তিন্নি মৃদুস্বরে বলল, ‘তোমরা কেমন আছ?’
ছবির গাছগুলি যেন উত্তরে কিছু বলল। তিন্নি একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমার কিছু ভালো লাগছে না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, খুব কষ্ট।’
গাছগুলি যেন তার উত্তরেও কিছু বলল। খুব কঠিন কোনো কথা। কারণ তিন্নিকে দেখা গেল দু’ হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠেছে। সেই কান্না দীর্ঘস্থায়ী হল না। সে ছবিটি কুচিকুচি করে দিয়ে শান্ত হয়ে নিচে নেমে গেল। কারণ সে বুঝতে পারছে, তার বাবা ঠিক এই মুহূর্তে তাকে নিয়ে ভাবছেন। সেই ভাবনাগুলি ভালো নয়। তার বাবা সমস্যার কাছ থেকে মুক্তি চান। কিন্তু যে-পথ তিনি বেছে নিতে চাচ্ছেন তাতে কোনো লাভ হবে না।
‘বাবা।’
বরকত সাহেব চমকে ফিরলেন। তাঁর ঘর অন্ধকার। তিনি ইজিচেয়ারে মাথা নিচু করে বসে আছেন। তিন্নি তাঁর সামনের খাটে পা ঝুলিয়ে বসল। বরকত সাহেব অস্বস্তির সঙ্গে তাঁর মেয়ের দিকে তাকাতে লাগলেন।
‘কিছু বলবে?’
‘বলব।’
‘বল শুনি। চেয়ারে বস। বসে বল।’
তিন্নি খুব নরম গলায় বলল, ‘তুমি আমাকে বাইরে নিয়ে যেতে চাও?’
‘হুঁ। বড় ডাক্তার দেখাব। পৃথিবীর সেরা ডাক্তার।‘
‘ডাক্তার কিছু করতে পারবে না।’
‘কী করে বুঝলে?’
‘আমি জানি। আমার কোনো অসুখ করে নি। আমি তোমাদের মতো না, আমি অন্য রকম।’
‘সেটা আমি জানি।’
‘না, তুমি জান না। সবটা জান না।’
‘ঠিক আছে, না জানলে জানি না। এত কিছু জানার আমার দরকার নেই। আমার টাকার অভাব নেই। তোমাকে আমি বড়-বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। ইউরোপ আমেরিকা।’
‘আমি এইখানেই থাকব। আমি কোথাও যাব না।‘
বরকত সাহেব কড়া চোখে তাকালেন। তাঁর নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এল। কপালে ঘাম জমতে লাগল। তিন্নি বলল, ‘তোমরা কিছুতেই আমাকে এখান থেকে নিতে পারবে না। তোমাদের সেই শক্তি নেই।’
বরকত সাহেব কিছু বললেন না। তিন্নি শান্ত সুরে বলল, ‘এই বাড়িটাতে আমি একা থাকতে চাই বাবা।’
‘একা থাকতে চাই মানে?’
‘আমি একা থাকব। আর কেউ না।‘
‘কী বলছ এসব!’
তিন্নি জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বরকত সাহেব কড়া গলায় বললেন, ‘পরিষ্কার করে বল, তুমি কী বলতে চাও।’
‘এই বাড়িটাতে আমি একা থাকব। আর কেউ থাকবে না। কাজের লোক, দারোয়ান, মালী, এদের সবাইকে বিদায় করে দাও। তুমিও চলে যাও। তুমিও থাকবে না।’
‘আমিও চলে যাব!’
‘হ্যাঁ।’
বরকত সাহেব উঠে এসে মেয়ের গালে প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিলেন। তিন্নি কিছুই বলল না। শান্ত পায়ে উঠে চলে গেল। বরকত সাহেব লক্ষ করলেন, তিনি বাগানে চলে যাচ্ছে। বাগান এখন ঘন অন্ধকার। বর্ষার পানি পেয়ে ঝোপঝাড় বড় হয়ে উঠেছে। সাপখোপ নিশ্চয়ই আছে। এই মেয়ে এখন এই সাপখোপের মধ্যে একা-একা হাঁটবে। অসহ্য, অসহ্য! কিন্তু করার কিছুই নেই। তাঁর মনে হল, মেয়েটি মরে গেলে তিনি মুক্তি পান। জন্মের পরপর তিন্নির জন্ডিস হয়েছিল। গা হলুদ হয়ে মরমর অবস্থা। মেয়েকে ঢাকা পিজিতে নিয়ে যেতে হয়েছিল। বহু কষ্টে তাকে সারিয়ে তোলা হয়েছে। সেই সময় কিছু-একটা হয়ে গেলে, আজ এই ভয়াবহ কষ্ট সহ্য করতে হত না।
তিনি কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে ঘরের ভেতর পায়চারি করলেন। এক বার ভাবলেন বাগানে যাবেন। কিন্তু সেই চিন্তা দীর্ঘস্থায়ী হল না। কী হবে বাগানে গিয়ে? তিনি কি পারবেন এই মেয়েকে ফেরাতে? পারবেন না। সেই ক্ষমতাই তাঁর নেই। হয়তো কারোরই নেই। পীর-ফকির ধরলে কেমন হয়? তিনি নিজে এইসব বিশ্বাস করেন না। সারা জীবন তিনি ভেবেছেন, অস্বাভাবিক কোনো ক্ষমতা মানুষের নেই, থাকতে পারে না। কিন্তু এখন দেখছেন, তাঁর ধারণা সত্যি নয়। অস্বাভাবিক ক্ষমতা মানুষের থাকতে পারে। তিন্নিরই আছে। কাজেই পীর-ফকিরের কাছে বা সাধু-সন্ন্যাসীর কাছে যাওয়া যেতে পারে।
‘স্যার।’
‘কে?’
তিনি দেখলেন, চায়ের পেয়ালা হাতে নিজাম দাঁড়িয়ে আছে। তিনি চায়ের পেয়ালা হাতে নিলেন। নিজাম বলল, ‘ঐ লোকটা আসছে।’
‘কোন লোক?’
‘আগে যে ছিলেন।’
‘ও, মিসির আলি?’
‘জ্বি। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।’
বরকত সাহেব বিরক্ত স্বরে বললেন, ‘দেখা করার কোনো দরকার নেই। আমি এখন ঘর থেকে বেরুব না। ভদ্রলোককে তাঁর ঘর দেখিয়ে দাও। খাবারদাবারের ব্যবস্থা কর। আর তিনি যদি তিন্নির সঙ্গে দেখা করতে চান, তাহলে তিন্নিকে খবর দাও। তিন্নি বাগানে গিয়েছে।’
নিজাম চলে গেল। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঝড়বৃষ্টি হবে বোধহয়। বাতাস ভারি হয়ে আছে। চারদিকে অসহ্য গুমট।
.
মিসির আলি এসেছেন সন্ধ্যাবেলায়, এখন রাত এগারটা। কিছুক্ষণ আগেই রাতের খাবার শেষ করেছেন। প্রায় চার ঘন্টার মতো হল, তিনি এ বাড়িতে আছেন। নিজাম এর মধ্যে দু’ বার জিজ্ঞেস করেছে, সে তিন্নিকে খবর দেবে কি না। তিনি বলেছেন, খবর দেবার দরকার নেই। কারণ তিন্নি নিশ্চয়ই জানে যে তিনি এসেছেন। আলাদা করে বলার কোনোই প্রয়োজন নেই।
‘তিন্নি আছে কোথায়?’
‘বাগানে।’
‘এই রাতের বেলায় বাগানে কী করছে!’
‘জানি না স্যার। কয়েক দিন ধরে সন্ধ্যার পর বাগানে যায়। অনেক রাত পর্যন্ত থাকে।’
‘তাই নাকি?’
‘জ্বি স্যার।’
‘এত রাত পর্যন্ত বাগানে সে কী করে?’
‘বাড়ির পিছনের দিকে একটা বড়ই গাছ আছে। সেই বড়ই গাছের কাছে একটা গর্ত, ঐখানে চুপচাপ দাঁড়ায়ে থাকে।’
‘ও, আচ্ছা।’
মিসির আলির মুখ দেখে মনে হল, তিনি এই খবরে তেমন অবাক হন নি। বেশ সহজভাবে বললেন, ‘তুমি বারান্দায় আমাকে একটা চেয়ার দাও। বারান্দায় বসে আকাশের শোভা দেখি। আর শোন, ভালো করে এক কাপ চা দিও। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বৃষ্টি হবে বোধহয়।
‘জ্বি।’
মিসির আলি বারান্দায় এসে বসবার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই টুপটুপ করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করল। মিসির আলি অপেক্ষা করতে লাগলেন, কখন তিন্নি বেরিয়ে আসবে। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। এ-রকম একটি ঝড়-জলের রাতে বাচ্চা একটি মেয়ে একা-একা বাগানে। কত রকম অদ্ভুত সমস্যা আমাদের চারদিকে। মিসির আলি সিগারেট ধরালেন। ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়েছে। কেরোসিনের বাহারি ল্যাম্প জ্বালানো হয়েছে। নিজাম একটি ল্যাম্প বাইরে নিয়ে আসতেই হাওয়া লেগে সেটি দপ করে নিভে গেল। ঠিক তখন মিসির আলি দেখলেন, তিন্নি বের হয়ে আসছে। ভিজে চুপসে গিয়েছে মেয়েটি। তিন্নিই তাঁকে দেখেছে। সে এগিয়ে এল মিসির আলির দিকে।
‘আপনি কখন এসেছেন?’
‘অনেকক্ষণ হল। তুমি বুঝতে পার নি?’
‘না। এখন দেখলাম।’
মিসির আলি বেশ অবাক। মেয়েটি বুঝতে পারল না কেন? টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা কি নষ্ট হয়ে গেছে?
নিজাম হাঁ করে তাকিয়ে আছে। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। মিসির আলি বললেন, ‘তিন্নি, তুমি হাত-মুখ ধুয়ে এস, আমরা গল্প করি। ঝড়বৃষ্টির রাতে গল্প করতে বেশ ভালো লাগে। আর নিজাম, তুমি আমাদের দু’ জনের জন্যে চা নিয়ে এস। তিন্নি, তুমি চায়ের সঙ্গে কিছু খাবে?’
‘না।’
নিজাম ফিসফিস করে বলল, ‘আপা আজ সারাদিন কিছু খায় নাই।’
মিসির আলি বললেন, ‘তাহলে কিছু খাবারও নিয়ে এস। হালকা কোনো খাবার।’
‘না, আমি কিছুই খাব না, খিদে নেই।’
‘ঠিক আছে, না খেলে। এস, গল্প করি। যাও, হাত-মুখ ধুয়ে এস। তোমার সমস্ত পা কাদায় মাখামাখি।’
তিনি চলে গেল। নিজাম এক পট চা এনে রাখল সামনে। মিসির আলি অপেক্ষা করতে লাগলেন, কিন্তু মেয়েটি সে রাতে আর তাঁর কাছে এল না। খুব ঝড় হল সারা রাত। শোঁ-শোঁ করে হাওয়া বইতে থাকল। মিসির আলি অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমুতে পারলেন না। তাঁর বারবার মনে হতে লাগল, হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েটি যোগাযোগ করবে তাঁর সঙ্গে। দু’ জন দু’ জায়গায় বসে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করবেন। কিন্তু তা হল না।
.
সূর্য এখনো ওঠে নি। মিসির আলি দ্রুত পা ফেলছেন। ব্রহ্মপুত্র নদী মনে হচ্ছে এখনো ঘুমিয়ে। দিনের কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয় নি। কাল রাতের বৃষ্টির জন্যেই বুঝি চারদিক ঝিলমিল করছে। মিসির আলি গত রাতটা প্রায় অঘুমেই কাটিয়েছেন। কিন্তু তার জন্যে খারাপ লাগছে না। শরীরে কোনো ক্লান্তি নেই, তিনি খুঁজছেন চা-ওয়ালাকে। পাওনা টাকাটা দিয়ে দেবেন। গল্পগুজব করবেন। তাঁর মনে একটা আশঙ্কা ছিল, হয়তো এই চাওয়ালা বুড়োর আর খোঁজ পাওয়া যাবে না। বাকি জীবন মনের মধ্যে এই ক্ষুদ্র ঘটনা কাঁটার মত বিঁধে থাকবে। আশঙ্কা সত্যি হল না! বুড়োকে পাওয়া গেল। কেতলিতে চায়ের পানি ফুটে উঠেছে। কেতলির নল দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। বুড়োর মুখ হাসি-হাসি।
‘কেমন আছেন বুড়োমিয়া?’
‘আল্লায় যেমন রাখছে। আপনের শইল বালা?’
‘জ্বি, ভালো। আমাকে চিনতে পারছেন না? ঐ যে চা খেয়ে পয়সা না দিয়ে চলে গেলাম।’
বুড়ো হেসে ফেলল। মিসির আলি বললেন, ‘জরুরি কাজে ঢাকায় চলে গিয়েছিলাম। কাল এসেছি। আপনার টাকা নিয়ে এসেছি। চা কি হয়েছে?’
বুড়ো চায়ের কাপে লিকার ঢালতে লাগল। মিসির আলি বললেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই মনে-মনে আমাকে খুব গালাগালি করেছেন।‘
‘জ্বি-না মিয়াসাব। অত অল্প কারণে কি আর গাইল দেওন যায়? আমি জানতাম আপনে আইবেন।’
‘কী করে জানতেন?’
‘বুঝা যায়।’
এই কথাটি ঠিক। অনেক কিছুই বোঝা যায়। রহস্যময় উপায়ে বোঝা যায়। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মিসির আলির মনে হল, তিন্নির ব্যাপার তিনি খানিকটা বুঝতে পারছেন। আবছাভাবে বুঝছেন।
‘কি ভাবেন মিয়াসাব?’
‘না, কিছু না। উঠি।’
মিসির আলি চায়ের দাম মিটিয়ে রওনা হবেন, ঠিক তখন মাথা ঝিম করে উঠল। তিন্নির পরিষ্কার রিনরিনে গলা, ‘আপনি ভালো আছেন?’ মিসির আলি আবার বেঞ্চিতে বসে পড়লেন। বুড়ো বলল, ‘কি হইছে?’
‘শরীরটা একটু খারাপ লাগছে। আমি খানিকক্ষণ বসি?’
‘বসেন, বসেন।’
মিসির আলি মনে-মনে তিন্নির সঙ্গে কথা চালিয়ে যেতে লাগলেন।
’গত রাতে তুমি আস নি কেন?’
‘ইচ্ছা করছিল না।’
‘না এসেও তো কথা বলতে পারতে। তাও বল নি।’
‘ইচ্ছা করছিল না।’
‘এখন ইচ্ছা করছে?’
‘হ্যাঁ করছে। কথা বলতে ইচ্ছা করছে।
‘বল, কথা বল। আমি শুনছি।’
‘আমি এখন এখানকার গাছের কথা বুঝতে পারি।’
‘বাহ্, চমৎকার তো!’
‘তাই রোজ সন্ধ্যাবেলায় বাগানে যাই। ওদের কথা শুনি।’
‘দিনের বেলা শুনতে পাও না?’
‘না, দিনের বেলায় ওরা কোনো কথা বলে না, চুপ করে থাকে। ওরা কথা বলে শুধু সন্ধ্যার দিকে। রাতে আবার চুপ করে যায়। ওরা তো আর মানুষের মতো না, যে, সারা দিন বকবক করবে।’
‘তা তো ঠিকই। ওরা কী কথা বলে তোমার সঙ্গে?’
‘আমার সঙ্গে তো কোনো কথা বলে না। ওরা কথা বলে নিজেদের মধ্যে, আমি শুনি।’
‘কী নিয়ে কথা বলে?’
‘অদ্ভুত জিনিস নিয়ে কথা বলে। বেশির ভাগই আমি বুঝতে পারি না।’
‘তবু বল। আমার শুনতে ইচ্ছা করছে।’
‘জীবন কী, জীবনের মানে কী–এইসব নিয়ে তারা কথা বলে। নিজেদের মধ্যে কথা বলে।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ। আর কথা বলে মানুষদের নিয়ে। পশুপাখিদের নিয়ে। এরা পৃথিবীর মানুষদের কথা জানে। এরা কী বলে, কী করে–এইসব জানে। মানুষদের নিয়ে ভাবে।’
‘বাহ্, চমৎকার তো!’
‘একটা গাছ যখন মারা যায়, তখন সারা জীবনে যা জানল–তা অন্য গাছদের জানিয়ে যায়। মানুষদের যখন কষ্ট হয়, তখন তাদের কষ্ট হয়। মানুষদের যখন আনন্দ হয়, তখন তাদেরও আনন্দ হয়।‘
‘মানুষ যখন একটা গাছকে কেটে ফেলে বা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে, তখন তারা মানুষদের উপর রাগ করে না?’
‘না। তারা রাগ করতে পারে না। তারা তো মানুষের মতো নয়। তারা শুধু ভালবাসে। জানেন, তাদের মনে খুব কষ্ট।’
‘কেন বল তো?’
‘কারণ, খুব শিগগিরই পৃথিবীতে কোনো মানুষ থাকবে না। কোনো জীব থাকবে না। পৃথিবী আস্তে-আস্তে গাছে ভরে যাবে। এই জন্যেই তাদের দুঃখ।’
‘মানুষ থাকবে না কেন?’
‘এরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে শেষ হয়ে যাবে। অ্যাটম বোমা ফাটাবে। পৃথিবী ছাড়াও তো আরো অনেক গ্রহ আছে যেখানে এক সময় মানুষ ছিল, এখন নেই। এখন শুধু গাছ।’
‘গাছদের জন্যে এটা তো ভালোই, তাই নয় কি তিন্নি? শুধু ওরা থাকবে, আর কেউ থাকবে না।’
তিন্নি দীর্ঘ সময় চুপ করে রইল। তারপর মৃদুস্বরে বলল, ‘না, ভালো না। ওরা সবাইকে নিয়ে বাঁচতে চায়। সারা জীবনে ওরা যত জ্ঞান লাভ করেছে, এগুলি মানুষকে বলতে চায়। কিন্তু বলার আগেই মানুষ শেষ হয়ে যায়। ওরা বলতে পারে না। এই জন্যে ওদের খুব কষ্ট।’
‘মানুষকে ওরা ওদের কথা বলতে পারছে না কেন?’
‘বলতে পারছে না, কারণ মানুষ তো এখনো খুব উন্নত হয় নি। ওদের অনেক উন্নত হতে হবে। কিন্তু তা হবার আগেই তো ওরা শেষ হয়ে যায়।’
‘এইসব কথা কি তোমার আশেপাশের গাছদের কাছ থেকে জানলে?’
‘না। অন্য গাছ আমাকে বলেছে। আমি যখন ঘুমিয়ে থাকি, তখন ওরা বলে।’
‘তুমি যে-সব গাছের ছবি আঁক, সেইসব গাছ?’
তিন্নি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘আমার আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।’
মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। বুড়ো চাওয়ালা বলল, ‘শইলডা কি অখন ঠিক হইছে?’
‘হ্যাঁ, ঠিক আছে। যাই বুড়োমিয়া।
‘কাইল আবার আইসেন।’
‘না, কাল আসতে পারব না। কাল আমি ঢাকা চলে যাব। আবার যখন আসব, তখন কথা হবে।’
.
বরকত সাহেবের সঙ্গে দেখা হল চায়ের টেবিলে। তাঁর মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। ভালোমতো চোখ তুলে তাকাচ্ছেন না। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে মিসির আলির উপর বেশ বিরক্ত। মিসির আলি এই বিরক্তির কারণ ঠিক ধরতে পারলেন না। মিসির আলি বললেন, ‘আপনার শরীর কেমন?’
‘আমার শরীর ভালোই। আমার শরীর খারাপ হওয়ার তো কোনো কারণ ঘটে নি। আপনি ঢাকায় এত দিন কী করলেন?’
‘তেমন কিছু করতে পারি নি, খোঁজখবর করছি।’
‘খোঁজখবর তো যথেষ্টই করা হল, আর কত?’
‘আপনি মনে হয় আশা ছেড়ে দিয়েছেন?’
‘হ্যাঁ, ছেড়ে দিয়েছি। এই সমস্যার কোনো সমাধান নেই। আপনি অনেক চেষ্টা করেছেন। সেই জন্যে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার পারিশ্রমিক হিসেবে আমি একটি চেক আপনার জন্যে তৈরি করে রেখেছি, নিজাম আপনাকে দেবে। আমি চাই না এ ব্যাপারটি নিয়ে আপনি আর মাথা ঘামান।
মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, ‘আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’
‘ভাগ্যকে স্বীকার করে নেবার চেষ্টা করছি। যা ঘটেছে, এটা আমার ভাগ্য।’
‘ভাগ্যটা কী জানতে পারি কি?’
‘না, জানতে পারেন না। আমি ঐ সব নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চাই না। সমস্ত ব্যাপারটা থেকে আমি হাত ধুয়ে ফেলতে চাই।’
মিসির আলি ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ‘গোড়া থেকেই আপনি অনেক কিছু আমার কাছ থেকে গোপন করেছেন, যেটা উচিত হয় নি।’
বরকত সাহেব ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ‘আমি ধারণা করেছিলাম আপনি নিজেই তা ধরতে পারবেন। এখন দেখছি আমার ধারণা ঠিক নয়। আপনি কিছুই ধরতে পারেন নি।’
‘একেবারেই যে ধরতে পারি নি, তা নয়। আমার ধারণা, আপনার স্ত্রী আপনাকে বলে গিয়েছিলেন, তিন্নি মেয়েটি বড় হলে কেমন হবে। অর্থাৎ আজকের এই সমস্যার ব্যাপারটি সম্পর্কে আপনার স্ত্রী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।’
‘এই জাতীয় ধারণা হবার পেছনে আপনার যুক্তি কী?’
‘যুক্তি অবশ্যই আছে। এবং বেশ কঠিন যুক্তি।’
‘বলুন, শুনি আপনার কঠিন যুক্তি।’
মিসির আলি সিগারেট ধরালেন। বরকত সাহেবের চোখের দিকে তাকালেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। এবং শান্ত স্বরে বললেন, ‘আমি প্রথমেই লক্ষ করলাম, আপনি আপনার মেয়ের অস্বাভাবিকতাগুলি মোটামুটি সহজভাবেই গ্রহণ করেছেন, তেমন বিচলিত হন নি। আমাকে ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তিকে জানান নি। এ থেকেই মনে হয়েছে, আপনার মেয়ের এইসব অস্বাভাবিকতা সম্পর্কে আপনি মানসিকভাবে প্রস্তুত। এই প্রস্তুতি কোথেকে আসতে পারে? আমার মনে হয়েছে কেউ নিশ্চয় আগেই আপনাকে বলেছে। কে বলতে পারে? আমার মনে হয়েছে আপনার স্ত্রীর কথা। কারণ আপনার স্ত্রী হচ্ছেন—’
বরকত সাহেব মিসির আলির কথা শেষ করতে দিলেন না। উঠে দাঁড়ালেন এবং কঠিন স্বরে বললেন, ‘আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে, আপনি এখন যান, পরে কথা বলব।’ মিসির আলি নিঃশব্দে উঠে এলেন। চলে গেলেন বাগানে। বড়ই গাছটি খুঁজে বের করবেন। তিন্নি বড়ই গাছের একটা গর্তে দাঁড়িয়ে থাকে, ঐ গর্তটিও পরীক্ষা করে দেখবেন। কিন্তু সেই সুযোগ হল না। ভয়াবহ একটি ব্যাপার ঘটল। প্রকাণ্ড একটা ময়াল সাপ হঠাৎ যেন আকাশ ফুঁড়ে নেমে এল। মিসির আলি চমকে উঠলেন। তাঁর চোখ থেকে চশমা খুলে পড়ল, আর ঠিক তখন মনে হল–এই দৃশ্যটি সত্যি নয়।
.
ময়মনসিংহ শহরের একটি বাড়িতে এত বড় একটি ময়াল এসে উপস্থিত হতে পারে না। তা ছাড়া কোনো সাপ পেটে ভর দিয়ে নিজের মাথাটা এত উঁচুতে তুলতে পারে না। এই দৃশ্যটি নিশ্চয়ই তিন্নির তৈরি করা। মেয়েটি এই ছবি দেখাচ্ছে। মিসির আলি চোখ বন্ধ করলেন, আর ঠিক তখন তিন্নির হাসি শোনা গেল। মেয়েটি তার ঘরে বসেই হাসছে, তিনি শুনতে পাচ্ছেন। তিন্নির হাসি থামল। সে রিনরিনে গলায় বলল, ‘খুব ভয় পেয়েছেন?’
‘তা পেয়েছি।’
‘কিন্তু যতটা ভয় পাবেন ভেবেছিলাম, ততটা পান নি। আপনি বুঝে ফেলেছেন যে এটা মিথ্যা সাপ।’
‘হ্যাঁ, তাও ঠিক।’
‘আপনার এত বুদ্ধি কেন বলুন তো?’
‘জানি না।’
‘সব মানুষের যদি আপনার মতো বুদ্ধি হত, তাহলে খুব ভালো হত। তাই না?’ মিসির আলি হেসে ফেললেন। হাসি থামিয়ে শান্ত গলায় বললেন, ‘তুমি আমাকে ভয় দেখালে কেন?’
‘আপনি বলুন কেন। আপনার এত বুদ্ধি, আর এই সহজ জিনিসটা বলতে পারবেন না?’
‘আন্দাজ করতে পারছি। তুমি চাও না আমি ঐ গর্তটি দেখি, যেখানে তুমি রোজ দাঁড়াও। তাই না?’
‘হ্যাঁ, তাই।’
দেখ তিন্নি, আমি তোমার ব্যাপারটা বুঝতে চাই। কিন্তু তুমি আমাকে বুঝতে দিচ্ছ না। তুমি আমাকে সাহায্য না করলে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারছি না। আমার এত ক্ষমতা নেই।’
তিন্নি ক্লান্ত গলায় বলল, ‘কোনো মানুষ আমাকে সাহায্য করতে পারবে না। যারা পারত, তারা করবে না।’
‘কারা পারত?’
তিন্নি জবাব দিল না।
মিসির আলির মনে হল, মেয়েটি কাঁদছে।