১০. ডাক্তার কথা বলছেন

ডাক্তার কথা বলছেন। শ্রোতা রূপা। মদিনাকে পাশের কামরায় রাখা হয়েছে। ডাক্তার মধ্যবয়স্ক। সাইকিয়াট্রিস্টরা পেশাগত কারণে প্রচুর কথা বলেন। ইনি তার ব্যতিক্রম না। এক নাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছেন। রূপা মন দিয়ে শুনছে। ডাক্তার ভদ্রলোক কথা বলে আরাম পাচ্ছেন তা বুঝা যাচ্ছে।

মদিনা মেয়েটির সমস্যা স্নায়ুবিক। নিউরো ট্রান্সমিটার বিকার বলা যেতে পারে। তার রক্তে হিমোগ্লোবিন আশঙ্কাজনকভাবে কম। হিমোগ্লোবিনের প্রধান কাজ শরীরের অক্সিজেন সরবরাহ করা। সেই অক্সিজেনের ৭০ ভাগের বেশি প্রয়োজন হয় মস্তিষ্কের। মস্তিষ্ক যখন অক্সিজেন কম পায় তখন সে অদ্ভুত সব জিনিস দেখে। অদ্ভুত শব্দ শুনে।

যারা এভারেস্টের চূড়ায় উঠেন তারা অক্সিজেনের বোতল নিয়ে উঠেন। যখন বোতলের অক্সিজেন শেষ হয়ে যায় তখন শুরু হয় অক্সিজেন ডিপ্রাইভেশনজনিত হেলুসিনেশন। প্রায় সবাই বলেছেন ২৮ হাজার ফুট উচ্চতায় তারা উড়ন্ত মানুষ দেখেছেন। আশেপাশে অদ্ভুত জন্তু-জানোয়ার দেখেছেন যারা মানুষের ভাষায় কথা বলে। আপনি কি এভারেস্ট অভিযান নিয়ে লেখা–Into thin air বইটা পড়েছেন? লেখকের নাম, Jon Krakauer.

রূপা বলল, না।

বইটিতে হেলুসিনেশনের কথা বলা আছে। এভারেস্ট অভিযাত্রীদের ২৮ হাজার ফুট উচ্চতায় ওঠার পর যা হয় মদিনা মেয়েটিরও তাই হচ্ছে। সে একবার পানিতে ড়ুবে গেল। মস্তিষ্কে অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ হল। হেলুসিনেশনের শুরু। সে দেখল একটা মেয়ের মুখ।

তারপর যতবার অক্সিজেন ঘাটতি হল ততবারই সে এই মেয়েটিকে দেখল।

মাসের কিছুদিন মেয়েদের শরীরে রক্ত কমে যায়। আমি নিশ্চিত মদিনা ঐ সময়েই ভবিষ্যৎ দেখার কথা বলে।

ডাক্তার দম নেবার জন্যে থামলেন। রূপা বলল, আমাদের করণীয় কি?

ডাক্তার বললেন, আপনাদের কিছুই করণীয় নেই। আমি ওষুধ দিচ্ছি। ভিটামিন দিচ্ছি। আয়রণ ট্যাবলেট দিচ্ছি। আপনারা মদিনার কথার কোনো রকম গুরুত্ব দেবেন না। তার কথায় গুরুত্ব দেবার অর্থ তাকে উৎসাহিত করা। যত বেশি সে উৎসাহিত হবে এই ধরনের আজগুবি কথা সে তত বেশি বলবে। তাকে কড়া ঘুমের ওষুধ দিচ্ছি। মেয়েটার ভাল ঘুম দরকার। সে বলেছে রাতে তার ঘুম হয় না। মেয়েটার ব্রেইনের একটা সিটি স্ক্যান কি করাবেন? ব্রেইনে কোনো অস্বাভাবিকতা থাকলে এতে ধরা পড়বে। ব্রেইন টিউমারেও এমন সমস্যা হয়। টিউমার থাকলে সিটি স্ক্যানে ধরা পড়বে।

আপনি সিটি স্ক্যান করাতে বললে করাব।

বেশ খরচ পড়বে। একটা কাজের মেয়ের পেছনে এত টাকা খরচ করবেন?

হ্যাঁ করব।

তাহলে সিটি স্ক্যান করান। এর রিপোর্ট আমাকে দেখাবেন না। দেখাবেন একজন নিউরোলজিস্টকে। আমি তার নাম লিখে দিচ্ছি। ওষুধগুলি আগেই শুরু না করে সিটিস্ক্যানের রিপোর্ট দেখার পর শুরু করুন।

রূপা উঠতে যাচ্ছিল, ডাক্তার বলল, চা খান। চা খেয়ে তারপর যাবেন। আপনার সঙ্গে কথা বলে আরাম পেয়েছি। বেশির ভাগ সময় আমি কথা বলে আরাম পাই না। আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে জিজ্ঞেস করুন। রোগ বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে আমার ভাল লাগে।

রূপা বলল, কিছু কিছু মানুষ আছে যারা দাবি করে যে ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। তাদের সবারই কি হেলুসিনেশন সমস্যা?

অবশ্যই।

তাদের বলা ভবিষ্যৎ যদি মিলে যায় তার ব্যাখ্যা কি?

দুএকটা হয়ত মিলে। কাকতালীয়ভাবে মিলে। যেটা মিলে যায় সেটাই আমরা মনে রাখি। যেগুলি মিলে না সেগুলি মনে রাখি না। মৃগী রোগ কি নিশ্চয়ই জানেন?

রূপা বলল, জানি।

মৃগী বা এপিলেপসি শব্দটা এসেছে গ্রীক শব্দ এপিলেপসিয়া থেকে। যার অর্থ ভর করা। অপদেবতা বা দেবতা ভর করলেই এই রোগ হয় বলে ভাবা হত। মৃগী রোগের ক্ষেত্রেও এটাকের সময় রোগী ভবিষ্যতের কথা বলে।

অনেক কিছু দেখে। সবই মস্তিষ্কের ভেতরে।

 

মদিনার সিটিস্ক্যানের রিপোর্টে ব্রেইনের ফ্রন্টাল লোবে একটি টিউমার পাওয়া গেল। টিউমার মেলিগনেন্ট হবার সম্ভাবনা। নিউরোলজিস্ট বললেন, অবিলম্বে ফ্রন্টাল লুবোটমি করা প্রয়োজন।

রূপা এই খবর মদিনাকে দিল না। তার বাবাকেও জানালো না।

 

মদিনা রাতে ঘুমুতে গেছে। রূপা বলল, নীল দুটা ট্যাবলেট খাওয়ার কথা খেয়েছ?

মদিনা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।

ভূত যেটা চলে গিয়েছিল সেটা কি ফিরে এসেছে?

না।

আরাম করে ঘুমাও।

মদিনা ক্ষীণ স্বরে বলল, আমারে মার কাছে পাঠায়া দেন আফা। আমি বেশিদিন বাঁচুম না।

কে বলেছে, দিঘির পানিতে যে মেয়ে দেখা দিয়েছিল সেই মেয়েটা?

জী আফা।

ভুয়া মেয়েটার কথা ভুলে যাও। তুমি অনেকদিন বাঁচবে। বাতি নিভিয়ে দেই?

দেন।

মদিনা কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল। সারারাত জেগে রইল রূপা। তার একফোঁটা ঘুম এল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *