১০. ডনকে থামাও
সারা অস্ট্রেলিয়া ১৯৩২-এ সফরকারী ইংরেজ ক্রিকেটারদের ধিক্কার দিল। আশঙ্কা করা হল জনতা হয়তো মাঠে নেমে এসে ওদের মারধর করতে পারে, তাই সর্বত্র ওদের বিশেষ পুলিশ প্রহরায় রাখা হল। খবরের কাগজে তীব্র কশাঘাত হানা হল ইংরেজদের প্রতি এবং এক-এক সময়ে মনে হচ্ছিল আর বুঝি কখনো টেস্ট খেলা হবে না।
সব কিছুর মূলে : তথাকথিত ‘বডিলাইন বোলিং।’ বলগুলি নিক্ষিপ্ত হয়েছিল ইংল্যাণ্ডের ফাস্ট বোলারদের, বিশেষ করে নটিংহ্যামশায়ারের নানকার্গেটের প্রাক্তন কয়লাখনি শ্রমিক হ্যারল্ড লারউড দ্বারা, যার তুল্য ফাস্ট বোলার তখনও দেখা যায়নি।
এই বিতর্কমূলক বোলিংয়ের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ডন ব্র্যাডম্যান নামক রান সংগ্রাহক অতিমানবকে পরাজিত করা। ডনকে থামানোর জন্যই এই বোলিং পদ্ধতির উদ্ভাবন। গুণের স্বীকৃতি, অবাঞ্ছনীয়ভাবে হলেও, এমন বিরাট ভঙ্গিতে খুব কম লোককেই জানানো হয়েছে।
বডিলাইনটা কী? আজও এই নিয়ে বিতর্ক রয়ে গেছে। তবে মূলত ব্যাপারটা শর্টপিচে ফাস্ট বোলিং। মতলব : জমিতে বাম্প করে বল তোলা এবং লেগ-সাইডে তখন ছয় থেকে আট জন লোক রাখা হয়।
তর্কটা হল, লেগ স্টাম্প না ব্যাটধারী, লক্ষ্যবস্তু কোনটি? অস্ট্রেলীয়দের মনে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই যে, এই বোলিংয়ের উদ্দেশ্য ব্যাটধারীকে ভয় পাইয়ে তার মনে এমন এক উদবেগ এনে দেওয়া যাতে সেতার উইকেটের নিরাপত্তার থেকেও বেশি চিন্তা করে নিজের দেহের নিরাপত্তা সম্পর্কে; ব্যাটধারীকে লক্ষ করেই এই বল করা হয় এবং আউট হওয়া নয়তো আঘাত নেওয়া এই দুইয়ের একটি ছাড়া তার আর কিছু করার থাকে না। নিখুঁতভাবে নিয়ন্ত্রিত, অব্যর্থ লক্ষ্য, লারউডের বলের গতি ঘণ্টায় ৯৫ মাইলের মতো। সুতরাং মানুষ আঘাত পেয়েছে, উইকেট হারিয়েছে, এবং সন্ত্রস্ত অস্ট্রেলীয়রা কোমরে-বুকে প্যাড পরেছে।
প্রথম টেস্টে ডন খেলতে পারেনি। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ড আপত্তি জানিয়ে বলল, খবরের কাগজে ডন লিখতে পারবে না। ডন বলল, চুক্তি করেছি যখন তা রক্ষা করব। তাই নিয়ে সরগরম হয়ে ওঠে অস্ট্রেলিয়া। অবশেষে খবরের কাগজটিই জানাল, ডনকে লিখতে হবে না। এই নিয়ে ডনকে প্রচুর মানসিক টানাপোড়েন সহ্য করতে হয়।
এরপর শারীরিক ধকল, এমসিসি-র বিরুদ্ধে অস্ট্রেলীয় একাদশের পক্ষে খেলার জন্য সিডনি থেকে পার্থ পাঁচ রাত ট্রেনে কাটিয়ে ডনকে পুরো দু-দিন ফিল্ড করতে হয়। তারপর বৃষ্টিভেজা উইকেটে ৩ ও ১০ রান করে আবার সিডনিতে ফিরেই ডন ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে খেলতে নামে। সে-খেলায় ডন ১৯৫ মিনিটে ২৩৮ করে এবং প্রথম শতরানটি ৭০ মিনিটে। দ্বিতীয় ইনিংসে ৫২ অপরাজিত। বিপক্ষে বোলার ছিল ফ্লিটউড-স্মিথ। এরপর ডনের শরীর পরিশ্রমের ধকল নিতে পারছিল না। তবু মেলবোর্নে গিয়ে আবার এমসিসি-র বিরুদ্ধে আর একটি ম্যাচ খেলে এবং রান করে ৩৬ ও ১৩। দু-বারেই আউট হয় লারউডের বলে। এই ম্যাচে জার্ডিন বডিলাইন আক্রমণের চেহারাটি প্রথম দেখালেন। খেলা, ট্রেনভ্রমণ এবং তর্কবিতর্ক—এই তিনের চাপ ফুটে উঠল নিউ সাউথ ওয়েলসের সঙ্গে এমসিসি-র খেলাটিতে। ডন করল ১৮ ও ২৩।
ডন বোর্ডকে জানাল, তার শরীর টেস্ট ম্যাচ খেলার উপযুক্ত নেই। ডাক্তার জানাল ওর পূর্ণ বিশ্রাম দরকার। সিডনিতে প্রথম টেস্ট ম্যাচটি সেদেখল দর্শকাসন থেকে। দেখল ম্যাককেবের অপরাজিত অসাধারণ ১৮৭, দেখল লারউডের অনবদ্য ফাস্ট বোলিং, বিশেষ করে দ্বিতীয় ইনিংসে দীর্ঘক্ষণের প্রচন্ড গতি বলের দ্বারা ২৮ রানে পাঁচটি উইকেট পাওয়া ১৮ ওভারে। অস্ট্রেলিয়া হারল ১০ উইকেটে।
মেলবোর্নে দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচে ডন খেলতে নামল। তার আগে ডনকে অনেকেই হুঁশিয়ার করে দেয়, ‘তোমার জন্য ইংল্যাণ্ড ফাস্ট বোলারদের এনেছে। তোমার ওপর তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে।’ ডন শুনেছে, এমসিসি-দল অস্ট্রেলিয়ায় আসার পথে জাহাজে রোজই শলাপরামর্শ করত। প্রধানত ডনকে রোখার জন্যই হত শলাপরামর্শ। সেজানত তার ১৯৩০ সফরের প্রতিটি ইনিংস তন্নতন্ন করে ওরা বিশ্লেষণ করেছে তাকে অকেজো করার পথ খুঁজে বার করতে।
ওদের বিশ্বাস, শুধু ডনকে যদি বড়ো রান তোলা থেকে নিবৃত্ত করা যায়, তাহলেই অস্ট্রেলিয়াকে হারানো সম্ভব। ওরা খুঁজেপেতে দেখল ডনের একমাত্র দুর্বলতা, শক্ত পিচে খাঁটি ফাস্ট বোলিংয়ে। তারা এর সঙ্গে মেলাল লেগ থিয়োরিকে।
সমুদ্রতীরে এক বন্ধুর নির্জন সৈকতাবাসে ডন তার পরিকল্পনা তৈরি করল একাকী সারারাত।
সেব্যাটিং মধ্যমণি। সুতরাং লারউডের বজ্র থেকে সরে যাওয়া বা শুধুই ব্যাট দিয়ে আটকানো তার পক্ষে শোভা পায় না। ওসব কাজ বোলাররা করবে, তাকে করতে হবে রান। তাই সেপদ্ধতি বার করল : উইকেট থেকে সরে গিয়ে বল মারতে চেষ্টা করবে অফ-সাইড ফিল্ডের দিকে।
তার মানে, বোলারকে তখন অফ-সাইড জোরদার করতে হবে। যদি তা করে তাহলে তাকে লেগ-সাইড ফিল্ড কমজোরি করতে হবে। তাহলে ডন স্বাভাবিক ব্যাটিংয়ে ফিরে আসতে পারবে।
ঝুঁকি নিয়ে, বে-কেতাবি খেলা। কিন্তু তা ছাড়া উপায় নেই। এখনকার মতো এটাই যা-কিছু কাজের ছক।
মেলবোর্নে ডন যখন ব্যাট হাতে নামল, জনতা তুমুল অভিনন্দনে ফেটে পড়ল। অস্ট্রেলিয়ার ওস্তাদ নেমেছে। প্রথম টেস্ট হারের শোধ নেবেই নেবে। জনতার দারুণ প্রত্যাশা।
ডন ক্রিজের দিকে এগোচ্ছে। হারবার্ট সাটক্লিফ বলল, ‘কী দারুণভাবে স্বাগত জানাচ্ছে।’
‘যখন ফিরব, তখনও এটা এইরকম দারুণ থাকবে কি?’ গম্ভীর স্বরে ডন বলেছিল।
থাকেনি। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে অসাড় স্তব্ধতার মধ্য দিয়ে ডন হেঁটে ফিরেছিল প্যাভিলিয়নে। বাওয়েসের প্রথম বল শর্টপিচ। ডন পুল করতে চেষ্টা করল এবং বলটিকে টেনে আনল লেগস্টাম্পে। প্রথম বলেই আউট ডনের জীবনে এই প্রথম এবং এই শেষ বারই ঘটল। জীবনের শেষ টেস্ট ইনিংসে সেআউট হয় দ্বিতীয় বলে।
অস্ট্রেলিয়ার দুঃসময়ে তার নায়ক দেশকে ডুবিয়ে দিল। সাফল্যের এইটাই জরিমানা; যদি একশোর কম রান করে তাহলে ধরে নেওয়া হয় ডন ব্যর্থ হয়েছে। অন্যান্য সাধারণ ব্যাটধারীকে আর ডনকে মাপার মানদন্ড এক নয়।
কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে ডন যথারীতি আবার নিজের খেলায় ফিরে এসে ১০৩ করল দলের ১৯১ রানের ইনিংসে। বডি লাইন শুরু হয়ে গেছে কিন্তু এই টেস্টে তা কার্যকরী হয়নি। আগের সপ্তাহে বৃষ্টি হওয়ায় উইকেট অস্বাভাবিক মন্থর ছিল বাউন্সারের পক্ষে।
ডন আবার বিগ্রহরূপে পূজিত হল। মাঠেই চাঁদা তুলে ডনকে দিল দর্শকরা। তাই দিয়ে সেমস্ত এক পিয়ানো কিনেছিল। পিয়ানোবাদনেও ডন রীতিমতো দক্ষ। অস্ট্রেলিয়া দ্বিতীয় টেস্ট ১১১ রানে জিতেছিল।
অ্যাডিলেডে তৃতীয় টেস্টে বডি-লাইনের ঝড় মাতন তুলল। এমন বিশ্রীভাবে আর কখনো টেস্ট খেলা হয়নি। অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক বিল উডফুল দু-বার আঘাত পেলেন লারউডের বাউন্সারে। ওল্ডফিল্ড মুখে আঘাত পেয়ে অবসর নেন। ডন আট রান করে কট হয় লারউডের বলে।
গ্রীষ্মের শুষ্ক দিনে, ইংরেজ বোলিং পদ্ধতির বিরুদ্ধে বজ্রনির্ঘোষ ছড়িয়ে পড়ল মাঠ ঘিরে। দ্বিতীয় ইনিংসে ডন খেলতে নামল চোয়াল শক্ত করে। এবার সেতার পরিকল্পনা অনুযায়ী উইকেট থেকে পিছিয়ে গিয়ে অফের দিকে বল মারার চেষ্টা করতে লাগল। এভাবে খেলার জন্য অরক্ষিত থাকছিল তার স্টাম্প। দর্শকরা হইচই শুরু করে; তারা বুঝতে পারছে না ডনের এভাবে খেলার কী মানে হয়। দেখে মনে হচ্ছিল সেযেন বলের লাইন থেকে সরে যেতে চাইছে।
ডন মাথাখারাপের মতো ইনিংস খেলল। কেতাবে আছে এমন মার বোধ হয় সেএকটিও মারেনি।
বার বার সেক্রস ব্যাট চালাল কিন্তু রানও করল। খেলার যোগ্য বলগুলিকে সেপিটিয়ে ছাতু করল।
শর্ট-স্কোয়্যার লেগে ক্যাচ পাওয়ার জন্য জার্ডিন নিজে দাঁড়ালেন। ঝিকিয়ে উঠল ডনের চোখ। কয়েক মিনিট পরেই সেঘুরিয়ে বল মারল প্রচন্ডভাবে। কোনোক্রমে মাথাটা সরিয়ে নিয়ে ইংরেজ অধিনায়ক নিজেকে রক্ষাকরলেন। জায়গাটা ছেড়ে আর একজনকে দাঁড় করিয়ে জার্ডিন সরে গেলেন। ডন রসিকতা করছে কি না সেটা তিনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না।
লারউডের জায়গায় ল্যাটা স্পিনার হেডলি ভেরিটি আসতেই ডন তাকে সদস্য স্ট্যাণ্ডে তুলে দেয় এবং এক বৃদ্ধা অল্পের জন্য রক্ষা পায়। এক ঘণ্টা উইকেটে থেকে ডন ৬৬ রান করে ভেরিটির বলে তার হাতেই কট হয়।
কিন্তু অস্ট্রেলিয়াকে দ্বিতীয় পরাজয় থেকে রক্ষার জন্য এই প্রয়াস যথেষ্ট নয়। ইংল্যাণ্ড ৩৩৮ রানে জেতে। এই টেস্ট শেষ হওয়ার আগেই অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ড নজীরবিহীন এক টেলিগ্রাম লণ্ডনে এমসিসি-র কাছে পাঠায়। তাতে বলা হল :
বডিলাইন বোলিং এমন আকার নিয়েছে যে, ক্রিকেটের সর্বোত্তম স্বার্থের পক্ষে তা মারাত্মক হয়ে উঠেছে। ব্যাটধারীদের দেহকে রক্ষাই প্রধান বিবেচ্য বিষয় করে তুলেছে।
এতদ্বারা খেলোয়াড়দের মধ্যে তীব্র বিদ্বেষ এবং সেইসঙ্গে চোট-আঘাত ঘটছে। যদি-না এখুনি বন্ধ করা হয় তাহলে এটা অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যাণ্ডের মধ্যে বর্তমান প্রীতির সম্পর্ককেক্ষুণ্ণ করবে।
ইতিমধ্যে দুই দলের সম্পর্কে প্রীতির লেশটুকুও আর নেই। পরে আরও খারাপ হয়ে পড়ে। ইংরেজরা যখন ব্যাট করছে, কোনো কোনো অস্ট্রেলীয় ফিল্ডসম্যানকে দেখা গেল উইকেটের দিকে বল ছোড়ার সময় যেন প্রতিযোগিতা করেই চেষ্টা করছে যাতে তা ব্যাটধারীকে আঘাত করে। পালটা জবাব দিতে ইংরেজদেরও মাঝেমধ্যে বাউন্সার দেওয়া হয় বটে কিন্তু উডফুলের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, ‘প্রতিশোধ নয়।’
অস্ট্রেলীয়দের সম্পর্কে লারউডের কয়েকটি মন্তব্যও অবস্থার অবনতি ঘটায়। সেবলে, ডন ভয় পেয়ে গেছে আর উডফুলের নড়াচড়া এমনই মন্থর যে, যে-বল লাফিয়ে উঁচু হয়ে ওঠেনি তাতেও সেমাথা নীচু করেছে।
ইংল্যাণ্ড দলের সবারই কিন্তু এই পদ্ধতির বোলিংয়ে সায় ছিল না। এই সফরের ১৪ বছর পর টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে ওয়াল্টার হ্যামণ্ড বলেন :
আমি সর্বতোভাবে এর নিন্দা করি। বডি-লাইন বিপজ্জনক। আমি বিশ্বাস করি, নিছক সৌভাগ্যবশতই বডি-লাইনে কেউ মারা যায়নি। যদি এটাকে চলতে দেওয়া হত তাহলে আমি খেলা থেকে বিদায় নিতাম।
কিন্তু লণ্ডনে ক্রিকেটের মাতব্বররা ভেবেছিলেন, অস্ট্রেলিয়া থেকে পাঠানো খবরে বাড়াবাড়ি রয়েছে, এমনটা হতেই পারে না। ভালোমতো তদন্ত না করে তারা তখুনি ব্যবস্থা নেবার কোনো দরকার আছে মনে করলেন না। এদিকে লারউড ক্রমশই ভয়ংকর হয়ে উঠতে লাগল। তার বলের গতি দ্রুত থেকে আরও দ্রুত হচ্ছে। খেলার পর তার শ্রান্ত তপ্ত শরীরে বরফ ঘষে দিত সতীর্থরা। বল করার সময় তার বঁা-পা এত জোরে পড়ত যে তার বুট ফেটে যেতে লাগল। নিজেকে নি:শেষ করে, ক্ষমতার শেষ প্রান্তে নিজেকে ঠেলে নিয়ে গিয়ে লারউড এমনভাবে বল করে যে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সেনিজেকেই বোল্ড আউট করে দেয়। অস্ট্রেলিয়ার রোদে-পোড়া পাথুরে জমিতে বল ডেলিভারির সময় তার বঁা-পা এত কঠিনভাবে ফেলার জন্য গোড়ালিটা প্রায় থেঁতলেই গেছিল। সফর থেকে ফিরে আর সেঅত জোরে বল করতে পারেনি। আটাশ বছর বয়সেই লারউড শেষ হয়ে যায়।
তার বলের গতি অস্ট্রেলীয়দের আপত্তির কারণ ছিল না। তাদের বক্তব্য, সেই গতিকে ব্যাটধারীদের জখম করবার জন্য ব্যবহার করাটাই আপত্তিকর।
ইংল্যাণ্ড চতুর্থ টেস্ট ৬ উইকেটে জিতে ‘রাবার’ পায় প্রধানত লারউডের জন্য। সিরিজে ডন আট ইনিংস থেকে চার বার আউট হয় লারউডের বলে। সেরান করে— ০ ও ১০৩*, ৮ ও ৬৬, ৭৬ ও ২৪, ৪৮ ও ৭১। প্রতি ১০০ বলে ৭৫ রান করে।
সন্দেহ নেই, যে-কাজের জন্য বডিলাইন বোলিংয়ের উদ্ভাবন, তা সম্পন্ন হয়েছিল সফলভাবেই। ডনকে খর্ব করে তার রানের গড়কে (৫৬.৫৭) সাধারণ খেলোয়াড়ের পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পেরেছিল। ডনের জীবনে এমনটি শুধু এই এক বারই ঘটে।
বস্তুত বডিলাইন বল খেলা প্রায় দুঃসাধ্য ব্যাপার। প্রথাসিদ্ধ ব্যাটিং— আক্রমণেই হোক বা রক্ষণেই হোক, এর বিরুদ্ধে অক্ষম হয়ে পড়েই। ব্যাটসম্যান যদি মেরে খেলতে চায় তাহলে সাধারণত লেগ ফিল্ডে কট হবে। আর যদি তা না করে, বোল্ড অথবা আহত হবে।
বডিলাইন চূর্ণ করা সম্ভব কি না সেটা দেখা আর সম্ভব হল না যেহেতু এই একটি মরসুমেই তার উদয় ও অস্ত ঘটেছিল।
যেভাবে ডন বডিলাইন খেলার চেষ্টা করে বা তার সচরাচর অভ্যস্ত মোটা অঙ্কের রান করতে না পারার জন্য তাকে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। এতে সেমনে আঘাত পায়। তার বক্তব্য : ‘আর কেউ কি এর থেকে কিছু ভালো করেছে?’
নিশ্চয়ই ডনের থেকে কেউ ভালো পারেনি। সিরিজে আট ইনিংসে তার রান ৩৯৬, গড় ৫৬.৫৭। যারা পাঁচটি টেস্টই খেলেছে তাদের থেকে ডনের চার টেস্টে রান বেশি, কিন্তু তার সবথেকে বড়ো মুশকিল, ‘ভেলকিওয়ালা’ হিসাবে এখন তার গায়ে ছাপ পড়ে গেছে। তার কাছ থেকে সবাই এখন একটা-কিছু ভেলকি আশা করে।
ডন ইংল্যাণ্ডের বিজয় রুখতে পারেনি, কিন্তু সেই জয় সর্বত্রই ক্রিকেটারদের মুখ বিস্বাদে ভরিয়ে দেয়। ইতিমধ্যে এমসিসি এই সফরের পূর্ণাঙ্গ কাহিনি জানতে পেরেছে। তারা ফতোয়া জারি করল, যেকোনো ধরনের বোলিং ‘যা বোলার কতৃক ব্যাটসম্যানের উদ্দেশ্যে সরাসরি আক্রমণ, তা খেলার প্রেরণার প্রতি অপরাধ।’
এমসিসি পরে একথাও মেনে নিল যে, ‘গত ক্রিকেট মরশুমে বোলার কতৃক ব্যাটসম্যানের প্রতি কখনো কখনো সরাসরি আক্রমণ ঘটেছে, এমন ঘটনারও প্রমাণ মিলেছে।’
অবশেষে আঘাতের উদ্দেশ্যে বোলিংয়ের বিরুদ্ধে আইন রচিত হয়। যদি এ ধরনের বোলিং চলতে দেওয়া হত, সন্দেহ নেই তাহলে ক্রিকেট খেলাটাই ধ্বংস হত। বডিলাইনের উৎপত্তিও কিন্তু সম্ভব হত না যদি প্রতিপক্ষ ক্রিকেটাররা ডনকে এত বিরাটভাবে এবং এত সম্মানভরে স্বীকার করে না নিত।
ওই মরসুম সম্পর্কে উইজডেন লিখল :
এ ধরনের বোলিং পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়—প্রধানত ব্র্যাডম্যানের রান সংগ্রহ প্রবণতাকে খর্ব করার কথা ভেবেই—যাকে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটাররা ও দর্শকরা একযোগে ধিক্কৃত করে এবং যখন এর সম্পর্কে আসল সত্যটি এইদেশে শেষপর্যন্ত জানা গেল, তখন ঘরের লোকেরা—তার মধ্যে অনেকেই বিখ্যাত খেলোয়াড়—বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে ভাবে, রাবার জয়ের বিনিময়ে এই বৈরিতালাভ সত্যিই কি লাভজনক হয়েছে!
বডিলাইনের প্রয়োগ সম্পর্কে ক্রিকেট দুনিয়ার অপছন্দ এমনই প্রবল হয়ে ওঠে যে, জার্ডিন পরের বছর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে প্রায় আর খেলেননি। তবে পরবর্তীকালে চমৎকার এক ব্যাপার ঘটে।
১৯৩২-এ অস্ট্রেলিয়ায় যে-লোকটি সবথেকে ঘৃণ্যরূপে গণ্য হয়েছিল, সেই লারউড ১৮ বছর পর ১৯৫০ সালে সপরিবারে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন এবং সম্মানিত নাগরিকরূপে সেখানে গণ্য হন। তিক্ততা এই ১৮ বছরে ধুয়ে-মুছে গেছে। কিন্তু অন্যান্য বহু টেস্ট ক্রিকেটারের মতো, ডন ১৯৩২-এর স্মৃতি রোমন্থনে এখনও অনাগ্রহী।