১০. টেলিফোনের শব্দে মনজুরের ঘুম ভেঙে গেল

টেলিফোনের শব্দে মনজুরের ঘুম ভেঙে গেল

টেলিফোনের শব্দে মনজুরের ঘুম ভেঙে গেল।

সব কেমন ঘুলিয়ে যাচ্ছে। সে কোথায়? অফিসে ঘুমিয়ে পড়েছিল তা মনে আছে। এখনো কি অফিসেই ঘুমাচ্ছে? তাকে রেখে অফিস বন্ধ করে সবাই চলে গেছে? না, তা কেমন করে হয়? চারদিক অন্ধকার। অফিস এত অন্ধকার হবে না। আরো এ তো তার নিজের বিছানা! সে বাসায় কখন ফিরল? টেলিফোন বেজেই চলছে। টেলিফোন ঠিক হয়ে গেল নাকি? নিশ্চয়ই ভৌতিক কোনো ব্যাপার। ঐ ছেলেটিই বোধহয় টেলিফোন করছে—‘ভিমরুল’। একমাত্র ঐ ছেলেটিই টেলিফোন করে তাকে পায়। আর কেউ পায় না।

মনজুর আধো ঘুম আধো জাগরণে রিসিভার কানে লাগিয়ে বলল, হ্যালো ভিমরুল?

ওপাশ থেকে অভিমানী গলা শোনা গেলা–আপনি আমাকে ভিমরুল বলছেন কেন?

ঠাট্টা করছি। তোমাকে খ্যাপাচ্ছি।

আমার কিন্তু খুব রাগ লাগছে।

খুব বেশি রাগ লাগছে?

হ্যাঁ।

খুব বেশি রাগ হলে তুমি কী কর?

কিছু করি না।

কাঁদো না?

না। আমি তো ছেলে। ছেলেদের কাঁদতে নেই।

তা তো বটেই–আমি যখন তোমার মতো ছিলাম তখন ছেলে হয়েও খুব কাঁদতাম। তারপর হঠাৎ একদিন কান্না বন্ধ করে দিলাম।

কেন?

সেটা এক মজার গল্প। তখন আমার মা মারা গেছেন। বাবা, আমি আর একটা কাজের ছেলে–এই তিনজন থাকি। বাবা খুব কঠিন মানুষ। কথায় কথায় শাস্তি দেন। একবার কী অন্যায় যেন করেছি। বাবা আমাকে শাস্তি দিলেন–বাথরুমে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর কী হলো জান? তিনি আমার কথা ভুলে গেলেন। চলে গেলেন বাইরে। সেই রাতে আর ফিরলেন না। আমি সারারাত অন্ধকার বাথরুমে আটকা পড়ে রইলাম।

কাজের ছেলে আপনার খোঁজ করল না?

না। সে ভেবেছিল আমি বাবার সঙ্গে গিয়েছি।

আপনি কান্নাকাটি করলেন না? চিৎকার করলেন না?

প্রথম কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কাঁদলাম তারপর কান্না বন্ধ করে দিলাম। পরদিন ভোরে বাবা এসে বাথরুমের দরজা খুলে আমাকে বের করলেন।

উনি তখন কী করলেন?

সেটা আমি তোমাকে বলব না–এ-কী ভিমরুল তুমি কাঁদছ নাকি?

না।

আমি যেন ফুপিয়ে কাদার শব্দ শুনলাম।

কাঁদলে কী?

কিছুই না–নাথিং…

ওপাশের কথা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল।

টেলিফোন পুরোপুরি ডেড। মনজুর উঠে বাতি জ্বালাল। ঘড়ি দেখল–রাত দুটো। রাত দুটার সময় ইমরুল নিশ্চয় তাকে টেলিফোন করে নি। পুরো ব্যাপারটিই কি তার কল্পনা? তার কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে?

মনজুর বাথরুমের দিকে রওনা হলো।

বাথরুম সেরে গরম এক কাপ চা খাবে। চিনি, দুধ সবই কেনা আছে। চিনি সে রেখেছে ‘সমুদ্র’ নামের কোটায়। এটা ঠিক হয় নি। সমুদ্র নামের কোটায় রাখা উচিত ছিল লবণ–চিনি নয়। আমরা সব সময় যাকে যেখানে রাখার কথা সেখানে না রেখে ভুল জায়গায় রাখি।

আপনার কিছু লাগবে?

মনজুর চমকে তাকাল। পনের-ষোল বছরের লাজুক ছেলেটিকে সে চিনতে পারল না। সে কে? এখানে এলইবা কোত্থেকে?

তুমি কে?

স্যার আমার নাম ফরিদ।

ফরিদ নামের কাউকে চিনি বলে তো মনে পড়ছে না।

আমি জাহানারা আপার ছোট ভাই।

ও আচ্ছা আচ্ছা। জাহানারা তোমাকে এখানে পোস্টিং দিয়ে গেছে?ত

জ্বি।

মেয়েটা তো বড় যন্ত্রণা করছে।

ফরিদের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে মনজুর বলল, আমার এই কথায় তুমি কি মন খারাপ করলে?

জ্বি না স্যার।

স্যার বলছ কেন? আমি তো তোমার স্যার না। তুমি কী পড়?

এইবার এসএসসি দেব।

সায়েন্স না। আর্টস?

কমার্স। আমি পড়াশোনায় খুব খারাপ।

তুমি কি চা বানাতে পার?

জ্বি না।

শুধু পড়াশোনায় না, তুমি তো মনে হচ্ছে কাজকর্মেও খারাপ। পানি গরম করতে পার?

জ্বি পারি।

ভেরি গুড। পানি গরম কর। আমি বাথরুম থেকে এসেই চা বানাব এবং তোমাকে চা বানানো শিখিয়ে দেব।

ফরিদ হেসে ফেলল।

রাত আড়াইটা।

দুজন নিঃশব্দে চা খাচ্ছে। মনজুর সিগারেট ধরিয়ে সহজ গলায় বলল, ফরিদ সিগারেট খাবে নাকি?

ফরিদ চমকে উঠল।

মনজুর হাসতে হাসতে বলল, অল্পবয়স্কদের সিগারেট সাধা হচ্ছে আমার সস্তা ধরনের রসিকতার একটি। এই রসিকতা করে একবার কী বিপদে পড়েছিলাম শোন। ক্লাস টুতে পড়ে একটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম–খোকা সিগারেট খাবে? সে গম্ভীর গলায় বলল, জ্বি খাব। দিন একটা।

মনজুর খুব হাসতে লাগল।

হাসছে ফরিদও। প্রথম দিন এই মানুষটিকে খুব খারাপ লেগেছিল। আজ লাগছে না। আজ ভালো লাগছে।

ফরিদ।

জ্বি।

আমি একটা ছেলের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলছিলাম। তুমি কি কিছু শুনতে পেয়েছ?

জ্বি না।

তুমি কি জেগে ছিলে?

জ্বি জেগে ছিলাম। নতুন জায়গায় আমার ঘুম হয় না।

তুমি যদি জেগে থেকে কিছু না শুনে থাক তাহলে ধরে নিতে হবে। আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তুমি একটা কাজ কর-আমাকে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস কর। দেখি বলতে পারি। কিনা। পাগলেরা ধাঁধার উত্তর পারে না।

ফরিদ বলল, আপনি শুয়ে থাকুন। আপনার বিশ্রাম দরকার।

এখন আমার শরীরটা খুব ভালো লাগছে। বিশ্রামের কোনোই দরকার নেই। এস দুজন বারান্দায় বসে থাকি।

আপনার ঠাণ্ডা লাগবে।

তা লাগবে। লাগুক না। চল–ভোর হওয়া দেখি।

ভোর হতে এখনো অনেক দেরি।

মোটেই দেরি নয় ফরিদ সাহেব। সময় অত্যন্ত দ্রুত যায়। আমরা জীবন শুরু করি, তারপর হঠাৎ একদিন দেখি–সময় শেষ–দুয়ারে পাল্কি এসে দাঁড়িয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *