হার্নান কর্টেজ তাঁর দলবল নিয়ে ১৫১৯ সালে মেক্সিকো আক্রমণ করেন। তখনকার মেক্সিকো ছিলো একটা আলাদা দুনিয়া, বাকি পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন। সেখানকার অধিবাসীরা নিজেদের পরিচয় দিত অ্যাজটেক (Aztecs) নামে। অ্যাজটেকরা খুব দ্রুতই আবিষ্কার করলো, তাদের দেশের এই আগন্তুকদের মধ্যে হলুদ রঙের বিশেষ একটি ধাতুর ব্যাপারে একটু বেশিরকম আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। তাদের আগ্রহ এত বেশি যে তারা এই একটা জিনিস ছাড়া আর কিছুই বুঝতো না। অ্যাজটেকরা যে সোনা চিনত না তা নয়। দেখতে সুন্দর, আর সহজে নানারকম আকার দেওয়া যায়, তাই সোনা দিয়ে মূর্তি আর গয়না বানাত তারা। মাঝেমধ্যে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে সোনার গুঁড়োও ব্যবহৃত হতো। তবে অ্যাজটেকরা কিছু কিনতে গেলে দাম দিত কোকো বীজ কিংবা কাপড়ের মাধ্যমে। তাই সোনার প্রতি স্পেনীয়দের আকর্ষণটা তাদের কাছে বেশ অদ্ভুত ঠেকলো। খাওয়া যায় না, মাথায়ও দেওয়া যায় না, এমনকি জিনিসটা এত নরম যে সেটা দিয়ে কোনো হাতিয়ার বা যন্ত্রপাতিও বানানো যায় না – তাহলে এটাতে কী আছে যে স্পেনীয়রা এর জন্য এমন পাগল হলো? কোনো এক অ্যাজটেকের এই প্রশ্নের উত্তরে কর্টেজ বলেছিলেন, “আমরা সবাই এমন এক রোগে আক্রান্ত যা সারাবার একমাত্র ওষুধ হলো সোনা।”১
স্পেনীয়দের নিবাস আফ্রো-এশিয়ান ভূখণ্ডে তখন স্বর্ণের মোহ মহামারীর মতো ছড়িয়ে গেছে। শত্রু-মিত্র সকলের কাছেই তখন সেটা এক পরম আরাধ্য বস্তু। মেক্সিকো দখলের শতিনেক বছর আগে কর্টেজের পূর্বপুরুষেরাই আইবেরিয়া ও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোর সাথে এক ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যিশুখ্রিস্টের অনুসারী আর আল্লাহর বান্দাদের মধ্যকার সেই যুদ্ধে প্রাণ হারায় হাজার হাজার মানুষ, নষ্ট হয় অগণিত সাজানো বাগান আর ফসলের মাঠ। আল্লাহ ও যিশুর মহিমা বৃদ্ধি করতে গিয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় অনেক সমৃদ্ধ নগরী।
যুদ্ধে খ্রিস্টানরা যখন একটু এগিয়ে গেল, তখন তারা তাদের বিজয় চিহ্ন হিসেবে মসজিদ ভেঙে গির্জা গড়তে শুরু করল। শুধু তাই নয়, খ্রিস্টানরা তখন চালু করল নতুন স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা। সে মুদ্রায় ছিলো ক্রুশ চিহ্ন, আর অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্য করার জন্য ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতার বাণী। এর সাথে তারা চালু করল ‘মিলারেস’ (millares) নামে একরকম চারকোনা মুদ্রা, যার কথাগুলো অন্যরকম। খ্রিস্টানদের তৈরি সেই মুদ্রায় আরবিতে লেখা ছিলো “আল্লাহ ছাড়া কোনো ঈশ্বর নেই, মুহাম্মদ তাঁরই দূত”। মেলগিউয়েল(Melgueil) আর অ্যাগডের(Agde) ক্যাথলিক যাজকরাও এসব মুদ্রা তৈরি করতেন, আর ঈশ্বরভীরু খ্রিস্টান জনতাও সেগুলো ব্যবহার করতেন নিঃসঙ্কোচে।২
ওদিকে মুসলিমদের ক্ষেত্রেও প্রায় একই রকম ঘটনাই ঘটেছিলো। উত্তর আফ্রিকার মুসলিম ব্যবসায়ীরা খ্রিস্টানদের মুদ্রাও ব্যবহার করত। ফ্লোরেন্সের ফ্লোরিন, ভেনিসের ডুকাট বা নেপলসের গিগলিয়াটো – কোনো মুদ্রায়ই তাদের আপত্তি ছিলো না। এমনকি অবিশ্বাসী খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা মুসলিম শাসকেরাও যিশুখ্রিস্ট এবং তাঁর কুমারী মায়ের নামাঙ্কিত মুদ্রায় খুশি মনেই খাজনা গ্রহণ করতেন।৩
ফেলো কড়ি, মাখো তেল
শিকারি-সংগ্রাহক মানুষের টাকা ছিলো না। নিজেদের প্রয়োজনীয় সব জিনিস তারা শিকার করে বা কুড়িয়ে পেত, অথবা বানিয়ে নিত নিজেরাই। খাবার, ওষুধ, জামা, জুতা – সবকিছুই। গোষ্ঠীর এক একজন মানুষ এক একটা কাজে পারদর্শী হতো, কিন্তু তারা একে অপরকে সাহায্য করত সবসময়। একজন কারও কাছ থেকে খাবার জন্য মাংস পেলে বিনিময়ে হয়তো তাকে চিকিৎসা সেবা দিত। প্রত্যেক গোষ্ঠীই অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিলো। কড়ি, রঙ, পাথর – এরকম অল্প কিছু জিনিসের জন্য তাদের নিজ গোষ্ঠীর বাইরের লোকের কাছে যেতে হতো। তাদের লেনদেনগুলোও হতো খুব সহজে – অল্প কয়েকটা কড়ির বিনিময়ে হয়তো পাওয়া যেত একটা চকমকি পাথর।
কৃষি বিপ্লবের পরেও মানব সমাজের অর্থনীতি খুব বেশি বদলায়নি। কৃষিযুগে মানুষ ছোট ছোট গ্রাম তৈরি করে বসবাস করতে শুরু করে। এই গ্রামগুলোও অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন ছিল। গ্রামবাসীরা নিজেরাই নিজেদের এবং আশেপাশের মানুষজনের বেশিরভাগ প্রয়োজন মেটাত, গ্রামের বাইরে লেনদেন করতে হতো খুব কম। কেউ হয়তো ভালো জুতো তৈরি করত, কেউ হয়তো নানান রোগের চিকিৎসায় পারদর্শী ছিলো। গ্রামের বাকি লোকেরা জানত জুতো হারালে বা অসুস্থ হলে কার কাছে যেতে হবে। কিন্তু গ্রামগুলো ছিল ছোট আর তাতে মানুষও ছিলো কম, তাই সারাদিন ধরে জুতো তৈরি বা চিকিৎসা করতে পারত না কেউ, গৃহস্থালির অন্যান্য কাজগুলোও তো করতে হবে।
বড় বড় শহর ও রাজ্য প্রতিষ্ঠা আর যোগাযোগ অবকাঠামো তৈরি হওয়ার পর একজন মানুষ একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে পুরোপুরি মনোনিবেশ করার সুযোগ পেলো। ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোতে এক একজন মানুষ হয়ে উঠতে লাগলো পেশাদার চিকিৎসক, কাঠমিস্ত্রি, ধর্মযাজক, সৈন্য কিংবা উকিল। অনেক গ্রামেই উৎকৃষ্ট মানের মদ, জলপাই তেল আর মাটির পাত্র তৈরি হতো। সেসব গ্রামের মানুষ ভাবল, যে জিনিসটা তারা ভাল বানাতে পারে শুধু সেটা বেশি করে বানালেই তো হয়। বাকি সব দরকারি জিনিস তো এগুলোর বিনিময়ে অন্যদের কাছ থেকে যোগাড় করা যায়। বুদ্ধিটা খারাপ না। সব জায়গার আবহাওয়া আর মাটির গুণাগুণ তো সমান নয়, তাই সবকিছু সব জায়গায় সমানভাবে হয় না। আমার বাগানে যদি ভালো আঙুর না হয়, তবে পাশের গ্রামের চমৎকার মদ রেখে কেন কেন নিজের বানানো যেন তেন মদ খাব? আমার গ্রামের মাটিতে যদি ভালো পাত্র তৈরি না করা যায়, তবে পাশের গ্রাম থেকে ভালো পাত্র কেনাই তো উচিত। শুধু মদ আর মাটির পাত্রের মান নয়, সেইসময় মানুষের পেশাগত দক্ষতাও বেড়ে গেল। প্রচুর চর্চার ফলে চিকিৎসক ও উকিলের মতো পেশার মানুষেরা তাদের দক্ষতা ঝালিয়ে নেওয়ারও সুযোগ পেলো। কিন্তু এর ফলে তৈরি হল নতুন একটি সমস্যা। এক একজন মানুষ এক একটা জিনিস ভালোভাবে তৈরি করতে শিখলেও, প্রয়োজন তো আছে সবকিছুরই। তাহলে অন্যের তৈরি করা জিনিসের সাথে নিজের তৈরি জিনিসের বিনিময়টা কীভাবে হবে?
অন্যের প্রয়োজনে নিজের উৎপাদিত পণ্য দেয়া এবং নিজের প্রয়োজনে অন্যের থেকে নেয়া – অনেকগুলো অচেনা মানুষ নিয়ে গড়ে ওঠা একটা সমাজে এরকম বিনিময় প্রথা চালু রাখা কঠিন। নিজের পরিবারের সদস্য বা প্রতিবেশীদের সাহায্য করা সহজ, কিন্তু বাইরের মানুষের ক্ষেত্রে? বহিরাগত মানুষকে সাহায্য করে বিনিময়ে কিছু পাওয়ার আশা কম। আবার কাউকে কোনোভাবে সাহায্য করলে সেও যে পাল্টা সাহায্য করতে পারবে তারও নিশ্চয়তা নেই। তারপরেও যদি পণ্যের সংখ্যা কম হয় তাহলে সেক্ষেত্রে বিনিময় পদ্ধতি চললেও চলতে পারে। কিন্তু কোনো জটিল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এই পদ্ধতির উপর গড়ে উঠতে পারে না।৪
ব্যাপারটা আরেকটু তলিয়ে দেখা যাক। মনে করুন, আপনি সেই সময়ের একজন আপেল-চাষী। সারা দেশের সবচেয়ে মিষ্টি আপেল যে বাগানে ফলে, সেটা আপনার। পাহাড়ের কোলের সেই আপেল বাগানে সারাদিন খাটতে খাটতে একদিন আপনার জুতো গেলো ছিঁড়ে। তো আপনি তখন একটা গাধায় চড়ে রওনা দিলেন নদীর ধারের বাজারে, ওখানে যে মুচি আছে তার কাছে থেকে শক্তপোক্ত একজোড়া জুতো বানিয়ে আনতে। গিয়ে মুচিকে বললেন এমন একজোড়া জুতো বানিয়ে দিতে যেটা টিকবে কমসে কম পাঁচ বছর, বিনিময়ে আপনি তাকে দেবেন আপনার বাগানের চমৎকার কিছু আপেল।
মুচি মাথা চুলকে ভাবতে লাগলো, একজোড়া জুতোর বদলে কতগুলো আপেল চাইবে সে? প্রতিদিন অনেক মানুষকেই সে জুতো বানিয়ে দেয় – বিনিময়ে কেউ দেয় আপেল, কেউ দেয় গম, না হয় একটা ছাগল, নয়তো খানিকটা কাপড় – সবাই যে ভালো জিনিসটাই দেয় তাও নয়। আবার এমন লোকও জুতো কিনতে আসে যাদের রাজদরবারে ভালো যোগাযোগ আছে, কিংবা হয়তো পিঠের ব্যথা সারিয়ে দিতে পারে, জুতোর দাম হিসেবে সেটাও মন্দ নয়। আগেরবার যখন কেউ আপেল দিয়ে জুতো কিনতে এসেছিলো, সেও মাস তিনেক আগের কথা। তখন জুতোর বিনিময়ে সে তিন বস্তা না চার বস্তা আপেল দিয়েছিলো তা এখন মনে নেই। তবে এটা মনে পড়ছে যে আপেলগুলো বেশ টক ছিলো। আবার সেবার সে যে জুতোটা বানিয়েছিলো সেটা ছিলো মেয়েদের জুতো, ছোট আকারের, এবারেরটা তা নয়। এদিকে গত কয়েক মাস ধরে কী একটা রোগে গরু-ছাগল মরে যাচ্ছে, চামড়াওয়ালারা তাই চামড়ার বদলে একজোড়ার জায়গায় দুজোড়া করে জুতো চাইছে। সেটাও ভাববার বিষয়।
এই বিনিময়ের অর্থনীতিতে প্রতিদিন আপেলচাষী আর মুচিকে নতুন করে আপেল আর জুতোর বিনিময় মূল্য ঠিক করতে হবে। এখন বাজারে যদি একশ রকমের পণ্য থাকে তাহলে সবাইকে মোট ৪ হাজার ৯৫০ রকমের বিনিময়ের হিসাব মাথায় নিয়ে ঘুরতে হবে। আর এক হাজারটা পণ্য থাকলে সংখ্যাটা দাঁড়াবে ৪ লক্ষ ৯৯ হাজার ৫০০!৫ এভাবে কি চলে?
এখানেই শেষ নয়। ধরুন একজোড়া জুতোর বদলে কতগুলো আপেল দেওয়া যায় সেটাও কোনো একভাবে ঠিক করা গেলো। তাহলেও কি লেনদেন সম্ভব? বিনিময় হতে হবে দুপক্ষের সম্মতিতে। মুচি যদি বলে তার আপেলের কোনো দরকার নেই, আপাতত সে তার স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার পথ খুঁজছে, তাহলে? আপনি হয়তো ভাবলেন, এ আর এমন কী, আপেল নিতে চায় এমন একজন উকিলকে খুঁজে বের করতে পারলেই তো বেশ একটা ত্রিপক্ষীয় বিনিময় করে ফেলা যায়। কিন্তু উকিল যদি আবার বলে আপেল চাই না, চুল ছাঁটাতে চাই – তখন?
এই সমস্যার সমাধান করতে কিছু কিছু সমাজে একটা কেন্দ্রীয় বিনিময় ব্যবস্থা তৈরি হলো। এই ব্যবস্থায় যে যা কিছু উৎপাদন করে তা সংগ্রহ করা হলো, তারপর সেগুলো সবার মাঝে প্রয়োজন অনুযায়ী বিলিবণ্টন করে দেওয়া হলো। এই ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় এবং ব্যর্থ উদাহরণ ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। ওখানে “সবাই সাধ্যমতো কাজ করবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পদ গ্রহণ করবে” – এই নীতিটা বাস্তবে পাল্টে গিয়ে হয়ে গেলো “সবাই যথাসম্ভব কম কাজ করবে এবং যত বেশি সম্ভব সম্পদ আদায় করবে”। কয়েক জায়গায় এই উদ্যোগ কিছুটা সফল হয়েছিল, তার মধ্যে একটা হলো ইনকা সাম্রাজ্য। তবে ঘুরে ফিরে সব সমাজই একটা সমাধানে থিতু হয়েছে – সেটা হলো টাকা।
কড়ি আর বিড়ি
টাকা জিনিসটা নানা জায়গায় নানাভাবে আবিষ্কৃত হয়েছে। টাকা আবিষ্কারের জন্য কোনো প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের দরকার হয়নি, এটা ছিলো সম্পূর্ণ মানসিক বিপ্লব। ষষ্ঠ অধ্যায়ে আমরা মানুষের যেসব সামষ্টিক কল্পনানির্ভর ধারণাগুলোর কথা বলেছিলাম, তার মধ্যে অন্যতম হলো টাকা।
টাকা মানে ধাতব পয়সা বা কাগজের নোট নয়, টাকা হলো এমন কিছু যা দিয়ে যেকোনো কিছুর একটা সুনির্দিষ্ট তুলনামূলক মূল্য নির্ধারণ করা যায়। টাকায় মূল্য নির্ধারণ করলে খুব সহজে বিভিন্ন জিনিসের বিনিময় মূল্য বের করা যায়। কতগুলো আপেল দিয়ে একজোড়া জুতো পাওয়া যাবে সেটা খুব সহজে বোঝা যাবে যদি আমরা দুটো জিনিসের দামই টাকায় হিসাব করি। টাকার কারণে এই বিনিময়টাও খুব সহজ হয়ে যায়, সম্পদ সঞ্চয় করতেও সুবিধা হয়। টাকা অনেক রকমের হয়, তার মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত রূপ হলো ধাতব পয়সা। তবে পয়সা তৈরির বহু আগেই মুদ্রা ব্যবস্থা চালু হয়। মুদ্রা হিসেবে অনেক কিছুই ব্যবহৃত হয়েছে – কড়ি, গৃহপালিত পশু, চামড়া, লবণ, খাদ্যশস্য, কাপড় কিংবা প্রতিজ্ঞাপত্র (নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পরিশোধ করার অঙ্গীকার করা কাগজ- অনেকটা এখনকার চেকের মতো)। ৪ হাজার বছর আগে আফ্রিকা, দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়া আর ওশেনিয়াতে কড়ির মুদ্রা চালু ছিলো। ব্রিটিশ শাসিত উগান্ডাতে গত শতাব্দীতেও কড়ি দিয়ে কর পরিশোধ করেছে মানুষ।
আজকের দিনের জেলখানা আর বন্দীশিবিরগুলোতে মুদ্রা হিসেবে সিগারেট বেশ চলে। এমনকি অধূমপায়ী বন্দীরাও এই মুদ্রায় বেচাকেনা করে। সব ধরনের দ্রব্য ও সেবার দাম হিসাব করা হয় সিগারেট দিয়ে। আউশভিৎস (Auschwitz) বন্দীশিবির থেকে ফেরা এক যুদ্ধবন্দীর মুখেই শোনা যায়, “আমরা সবাই সিগারেটকে মুদ্রা হিসাবে গ্রহণ করেছিলাম। সবকিছুর দাম হিসাব করতাম সিগারেটে। … ‘স্বাভাবিক’ সময়ে, মানে যখন গ্যাস চেম্বারের জন্য নিয়মিত নতুন কয়েদিরা আসত, তখন বারোটা সিগারেট দিয়ে একটা পাউরুটি পাওয়া যেত। ত্রিশটা সিগারেট দিয়ে পাওয়া যেত একটা তিনশ গ্রামের মাখনের প্যাকেট, আশি থেকে দুইশ সিগারেটে একটা হাতঘড়ি। এক লিটার অ্যালকোহলের দাম ছিলো পুরো চারশটা সিগারেট!”৬
সত্যি বলতে কি, আজকের দিনেও ছাপানো নোট আর পয়সাও টাকার ধারনার একটা ছোট্ট উদাহরণ বৈ আর কিছু নয়! ২০০৬ সালে সারা পৃথিবীর সব মানুষের মোট অর্থসম্পদের পরিমাণ ছিলো ৬০ লক্ষ কোটি ডলার, কিন্তু পৃথিবীর সব কাগজের নোট আর পয়সা জড় করলে তার মোট মূল্যমান হতো ৬ লক্ষ কোটি ডলারেরও কম।৭ অর্থাৎ মোট সম্পদের ৯০ শতাংশেরও বেশি হলো স্রেফ ব্যাংকের খাতায় বা কম্পিউটারের ডিস্কে লেখা কিছু সংখ্যা। আজকের দিনে বেশিরভাগ ব্যবসায়িক লেনদেন হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে। হাতে নগদ টাকা লেনদেন না করে সেটা করা হচ্ছে চেকের মাধ্যমে অথবা এক কম্পিউটার থেকে কিছু তথ্য অন্য এক কম্পিউটারে পাঠিয়ে। এক ফেরারী আসামী ছাড়া আর কেউ কি আজকের দিনে একটা বাড়ি কিনতে বস্তাভর্তি টাকা নিয়ে যাবে? নোট আর পয়সার চেয়ে টাকার পরিমাণটা ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে একটা তথ্য হিসেবে বহন করা অনেক সহজ, হিসাব রাখাও সহজ।
জটিল বাণিজ্যিক পরিবেশে একটা মুদ্রাব্যবস্থা থাকা অপরিহার্য। এই মুদ্রাব্যবস্থা থাকার কারণেই একজন মুচির শুধু বিভিন্ন রকম জুতোর দাম জানলেই চলে, একজোড়া জুতো কয়টা আপেলের সমান সেটা নিয়ে তাকে মাথা ঘামাতে হয় না। আবার এই মুদ্রাব্যবস্থার জন্যই একজন আপেলচাষীকে জুতোর জন্য আপেল-ভক্ত মুচি খুঁজে বেড়াতে হয় না। টাকার সবচেয়ে মৌলিক বৈশিষ্ট্য সম্ভবত এটাই যে, টাকা সর্বজনগ্রাহ্য। একজন মানুষের কাছে টাকা গ্রহণযোগ্য কারণ সমাজের বাকি সবার কাছেও সেটা গ্রহণযোগ্য। টাকার বিনিময়ে সবাই তার উৎপাদিত পণ্য বা সেবা বিক্রি করতে রাজি, কারণ টাকা দিয়ে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসটাও কিনে ফেলা যায়।
টাকা হলো এমন এক সর্বজনীন মাধ্যম, যা ব্যাবহার করে যেকোনো কিছুকে অন্য যেকোনো কিছুতে রূপান্তর করা যায়। এই টাকার মাধ্যমেই পেশিশক্তি জ্ঞানে পরিণত হয় যখন একজন সৈনিক ছুটি নিয়ে তার সৈনিকজীবনের জমানো টাকা খরচ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়। একজন জমিদার যখন তাঁর জমি বিক্রি করা টাকায় কর্মচারীদের বেতন দেন, আসলে তিনি তখন জমির বিনিময়ে অর্জন করেন আনুগত্য। টাকার মাধ্যমেই স্বাস্থ্যসেবা পরিণত হতে পারে আইনগত সাহায্যে যখন একজন চিকিৎসক তাঁর পারিশ্রমিক থেকে উকিলের পারিশ্রমিক দেন। এমনকি যৌনতার মতো ব্যাপারকেও পরকালের পাপমুক্তির কাজে লাগাতে পারে এই টাকা – পঞ্চদশ শতাব্দীতে কিছু নারী পতিতাবৃত্তির মাধ্যমে অর্জিত টাকা খরচ করতেন ক্যাথলিক গির্জা থেকে পাপমুক্তির সনদ কিনতে।
টাকা শুধু এক জিনিসকে অন্য জিনিসে রূপান্তরই করে না, টাকার আরেকটা গুণ হলো সেটা সম্পদ সংরক্ষণের জন্যও খুব উপযোগী। অনেক মূল্যবান জিনিস আছে যা ধরেই রাখা যায় না, যেমন সময় বা সৌন্দর্য। আবার অনেক সম্পদ ধরে রাখা যায় অল্প সময়ের জন্য, যেমন স্ট্রবেরি। কিছু সম্পদ আছে যা রেখে দেওয়া যায়, কিন্তু তাতে জায়গা আর যত্ন দুইই দরকার, যেমন খাদ্যশস্য। খাদ্যশস্য বছরের পর বছর রাখা যায়, কিন্তু সেজন্য বিরাট গোলা বানাতে হবে, শস্য শুকনো রাখতে হবে, চোর আর ইঁদুরের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। অন্যদিকে টাকা, সেটা কাগজ হোক, কড়ি হোক বা কম্পিউটারের ডিস্কের কোনো সংখ্যাই হোক, এইসব সমস্যা থেকে মুক্ত। কড়ি পচে যায় না, ইঁদুরে খায় না, আগুনেও পোড়ে না, আবার রাখতে বেশি জায়গাও লাগে না।
সম্পদকে পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করতে হলে, সম্পদ শুধু এক জায়গায় রেখে দিলে চলে না, মাঝে মাঝে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ারও প্রয়োজন হয়। স্থাবর সম্পদ, যেমন ঘরবাড়ি, নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। খাদ্যশস্য নিয়ে যাওয়া সম্ভব, কিন্তু কষ্টসাধ্য। কল্পনা করুন টাকার প্রচলনের আগের সেই প্রাচীন পৃথিবীর কথা। সেখানে একজন ধনী কৃষকের আছে বিশাল বাড়ি আর মাঠভরা ধান। সে যদি দূরে কোথাও চলে যেতে চায়, তার এত সম্পদের কী হবে? বাড়ি আর মাঠের ধান কোনোটাই সাথে নেওয়ার মতো নয়। এগুলোর বিনিময়ে সে প্রচুর পরিমাণে চাল বা অন্য কোনো শস্য জোগাড় করতে পারে, কিন্তু সেটা নিয়ে যাওয়াও কি এত সহজ? টাকা থাকলে এটা কোনো সমস্যাই নয়। সে সোজা তার বাড়ি আর জমি বিক্রি করে দেবে, তারপর একথলে কড়ি সাথে নিয়ে চলে যাবে যেখানে ইচ্ছা।
টাকার তারল্যের কারণে তাকে যেকোনো কিছুতে পরিণত করা যায়, জমিয়ে রাখা যায়, আবার এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়েও যাওয়া যায়। এই গুণের কারণেই বর্তমান গতিময় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার পিছনে টাকার গুরুত্ব অপরিসীম। টাকা ছাড়া এমন বিশাল, জটিল ও গতিশীল অর্থনীতির কথা কল্পনাও করা যেত না।
টাকা কীভাবে কাজ করে?
কড়ি থেকে ডলার, যে রূপেই থাকুক, টাকা মূল্যবান কারণ এর মূল্য আছে আমাদের সম্মিলিত কল্পনায়। এই মূল্য কড়ির রাসায়নিক গুণাগুণ বা কাগজের রঙ বা আকার-আকৃতির জন্য নয়। অন্যভাবে বলতে গেলে টাকা আসলে কোনো বস্তু নয়, একটা মানসিক ধারণামাত্র। তার মানে আমরা যখন কিছু বিক্রি করে টাকা নিই, তখন টাকা বাস্তব বস্তুকে রূপান্তরিত করে একটা কাল্পনিক বস্তুতে। তাই প্রশ্ন আসে, এই ধারণাটা কাজ করে কেন? কেন একজন কৃষক মাঠভরা ধানের বদলে কতগুলো কড়ি গ্রহণ করত? কেন আজকের দিনে কয়েকটা রংচঙে কাগজের জন্য ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় নানা রকম কাজ করে মানুষ?
মানুষ এসব কাজ করে তাদের সম্মিলিত কল্পনার উপর বিশ্বাস রেখে। পৃথিবীতে যত রকম মুদ্রাব্যবস্থা চালু আছে, তাদের প্রত্যেকটার মূল ভিত্তি হলো এই বিশ্বাস। একজন কৃষক যখন কিছু কড়ির বিনিময়ে তার সব সম্পত্তি বেচে দিয়ে দূরদেশে পাড়ি জমায়, সে তখন বিশ্বাস করে যে সে যেখানে যাচ্ছে সেখানকার মানুষও এই কড়ির বিনিময়ে তাকে খাবার ও আশ্রয় দেবে। টাকাকে মানুষের পারস্পরিক বিশ্বাসের উপকরণ বললে কম বলা হয়, আসলে টাকা হলো সারা পৃথিবীর মানুষের সর্বজনীন ও সর্ববৃহৎ সমন্বিত বিশ্বাসের আধার।
এই বিশ্বাসটা একদিনে তৈরি হয়নি, এটা অনেকদিনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার ফল। আমি কেন কড়ি, স্বর্ণমুদ্রা বা কাগজের নোটে বিশ্বাস করব? আমি বিশ্বাস করব কারণ আমার আশেপাশের সব মানুষ এতে বিশ্বাস করে। আবার আমার আশপাশের মানুষ বিশ্বাস করে কারণ আমি এতে বিশ্বাস করি। আমরা সবাই বিশ্বাস করি কারণ দেশের রাজাও এতে বিশ্বাস করেন, খাজনা আদায় করেন এর মাধ্যমেই। আমাদের পুরোহিতরাও এতে বিশ্বাস রেখেই সকল খাজনা গ্রহণ করেন। একটা ডলারের নোটের একপাশে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের কোষাধ্যক্ষের স্বাক্ষর, অন্যপাশে লেখা ‘ঈশ্বরে আমাদের বিশ্বাস’ (In God We Trust)। এই বিশ্বাসই আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও আদর্শিক কাঠামোর সাথে মুদ্রাব্যবস্থাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে। এ সম্পর্ক এতই গভীর যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দেয়, ব্যবসায়ীদের মেজাজ-মর্জির উপর নির্ভর করে শেয়ার বাজার ওঠে আর নামে।
শুরুতে যখন ‘টাকা’ জিনিসটার প্রচলন হয়, তখন এই বিশ্বাসের ব্যাপারটা ছিলো না। তাই তখন মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হতো এমন কিছু যার একটা সত্যিকারের মূল্য আছে। মানুষের জানামতে প্রথম অর্থ ছিলো সুমেরীয় এলাকায় ব্যবহৃত বার্লি-টাকা। মজার ব্যাপার হলো টাকা হিসেবে বার্লির প্রচলন হয়েছিলো ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে, ঠিক যখন মানুষ সেই একই জায়গায় লিখন-পদ্ধতি আবিষ্কার করে। এই দুটো ঘটনা সমসাময়িক হওয়ার কারণ হলো, মানুষ লিখতে শুরু করে মূলত তাদের প্রশাসনিক কাজকর্মের সুবিধার্থে। আর প্রশাসনিক তৎপরতা বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও বেড়ে যায়। সেই বর্ধিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার চাহিদা পূরণ করতেই টাকার উদ্ভব।
বার্লি-টাকা আসলে বার্লিই, একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ বার্লিকে তখন কোনো জিনিসের মূল্য পরিমাপ ও বিনিময়ের জন্য একক হিসেবে ধরা হতো। সবচেয়ে বেশি প্রচলিত পরিমাণটার নাম ছিলো ‘সিলা’ (sila), সেটা প্রায় এক লিটারের সমান। বার্লি পরিমাপের জন্য এক সিলা প্রমাণ আয়তনের পাত্রও তখন প্রচুর পরিমাণে তৈরি করা হতো, তাই বার্লি দিয়ে লেনদেন করাটা বেশ সহজ হয়ে গিয়েছিলো। সে সময় কর্মীদের বেতনও দেওয়া হতো বার্লিতে। একজন পুরুষ শ্রমিক তার কাজের জন্য পেত মাসে ষাট সিলা বার্লি, নারী শ্রমিক পেত তার অর্ধেক। শ্রমিকদের সর্দার পেত মাসে ১২০০ থেকে ৫০০০ সিলা। সবচেয়ে বড় খাদকের পক্ষেও এক মাসে ৫০০০ সিলা বার্লি খাওয়া সম্ভব নয়, তবে অতিরিক্ত বার্লি দিয়ে অন্য সব দরকারি জিনিস কেনা যেত।৮
বার্লির নিজের একটা মূল্য থাকলেও একটা পণ্যকে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহারে অভ্যস্ত হতে মানুষকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো। হওয়ারই কথা। আজ যদি আপনি এক বস্তা বার্লি নিয়ে কোনো ফাস্ট ফুডের দোকানে গিয়ে সেটার বিনিময়ে একটা পিজা অর্ডার দেন, দোকানের লোকজন সম্ভবত পুলিশে খবর দেবে। তবে ‘টাকা’ জিনিসটার উপর সবাইকে যে বিশ্বাস স্থাপন করতে হয়, বার্লির ক্ষেত্রে সেটা বেশ সহজেই হয়েছিলো। কারণ বস্তু হিসেবে বার্লির তো আসলেই একটা সহজাত মূল্য আছে, খিদে পেলে সেটা খাওয়া যায়। কিন্তু বার্লি জমিয়ে রাখা বা নিয়ে ঘুরে বেড়ানোটা তত সহজ নয়। টাকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিপ্লবটা ঘটে যখন মানুষ আপাত মূল্যহীন, সঞ্চয় ও বহনযোগ্য কোনো বস্তুকে মুদ্রা হিসেবে গ্রহণ করে। সেটা ঘটেছিলো খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময়ে, মেসোপটেমিয়াতে। রূপাকে মুদ্রা হিসেবে গ্রহণ করে সেখানকার মানুষ। একে বলা হতো শেকেল (Shekel)।
সেই রূপার শেকেলকে ঠিক পয়সা বলা যাবে না, মোটামুটি ৮.৩৩ গ্রাম রূপাকে এক শেকেল বলা হতো। হাম্মুরাবির আইনে যে বলা হয়েছিলো কোনো উচ্চতর মানুষ কোনো দাসীকে হত্যা করলে দাসীর মালিককে বিশ শেকেল রূপা ক্ষতিপূরণ দেবে, এর মানে হলো তাকে ১৬৬ গ্রাম রূপা দিতে হবে, বিশটা রৌপ্যমুদ্রা নয়। বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের কিছু জায়গায়ও রৌপ্যমুদ্রা নয়, রূপা দেওয়ার কথা আছে। জোসেফের ভাইয়েরা তাকে বিশ শেকেল, অর্থাৎ ১৬৬ গ্রাম রূপার বিনিময়ে বেচে দিয়েছিলো ইসমায়েলিদের কাছে।
বার্লির সাথে রূপার পার্থক্য হলো, বার্লির মতো রূপার বিশেষ কোনো উপযোগিতা নেই। রূপা খাওয়া যায় না, গায়েও দেওয়া যায় না, রূপা দিয়ে কোনো কাজের জন্য যন্ত্রপাতিও বানানো যায় না (রূপা দিয়ে লাঙলের ফলা বা তলোয়ার বানালে প্রথম আঘাতেই সেটা দুমড়ে মুচড়ে যাবে)। হ্যাঁ, একটা কাজে সেটা লাগত বটে – সোনা আর রূপা দিয়ে গয়না বানানো হতো, আর সেটা ছিলো আভিজাত্যের চিহ্ন। অর্থাৎ রূপা দিয়ে কোনো প্রয়োজন না মিটলেও বিলাসিতার জন্য, সামাজিক মর্যাদা বাড়ানোর জন্য সেটা ব্যবহৃত হতো। রূপার মূল্য ছিলো পুরোপুরিই সাংস্কৃতিক।
মূল্যবান ধাতুগুলোর নির্দিষ্ট ওজনকে মানদণ্ড ধরে লেনদেন করতে করতে একসময় মানুষ ধাতব পয়সা আবিষ্কার করে ফেলে। খ্রিস্টপূর্ব ৬৪০ সালের দিকে ইতিহাসের প্রথম পয়সা তৈরি হয় পশ্চিম আনাতোলিয়ায়, লিডিয়ার রাজা আলিয়াতেসের (King Alyattes of Lydia) রাজত্বে। একটা সুনির্দিষ্ট পরিমাণ সোনা বা রূপা দিয়ে এক একটা পয়সা তৈরি হতো। পয়সাগুলোর উপরে খোদাই করা থাকত কোনো একটা চিহ্ন। এই চিহ্ন দিয়ে দুটো কাজ হতো। এক, পয়সার মূল্যমান বোঝা যেতো, আর দুই, পয়সাটা যে যথাযথ কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে তৈরি হয়েছে সেটা নিশ্চিত হতো। আজকের পৃথিবীতে চালু থাকা প্রায় সব পয়সাই সেই একই নীতিতে তৈরি।
ধাতবখণ্ডের চেয়ে ধাতব পয়সা ব্যবহার করা দুটো কারণে বেশি সুবিধাজনক। প্রথমত, ধাতুখণ্ড দিয়ে বেচাকেনা করতে গেলে প্রতিবার সেটার ওজন মাপতে হতো, আর দ্বিতীয়ত, খালি ওজন মাপলেই নিশ্চিত হওয়া যেত না। যে রূপার টুকরোগুলো গ্রহণ করবে সে কীভাবে জানবে যে ওগুলো আসল রূপা, রূপার প্রলেপ দেওয়া সীসা নয়? পয়সা ব্যবহার করলে দুটো সমস্যাই দূর হয়। পয়সার উপরের চিহ্নটাই নিশ্চিত করে যে ওটার ওজন ঠিক আছে, দাঁড়িপাল্লায় না মেপেই ওগুলো গ্রহণ করা যায়। আর তার চেয়েও বড় কথা হলো ওই চিহ্ন দেখেই বোঝা যায় যে পয়সাগুলো বানিয়েছে কোনো উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ।
যুগে যুগে পয়সার ওজন, আকার ও চিহ্ন নানাভাবে বদলেছে, কিন্তু তার অন্তর্নিহিত নীতি একই আছে। পয়সার উপরের চিহ্নটা হলো রাজার বাণীঃ “আমি, মহান সম্রাট, নিশ্চিত করছি যে এই পয়সাটায় ঠিক পাঁচ গ্রাম সোনা আছে। কেউ যদি এই পয়সা জাল করার দুঃসাহস দেখায়, অর্থাৎ আমার স্বাক্ষর নকল করে, সেটা হবে আমার মর্যাদার উপর চরম আঘাত, আর সে অপরাধের জন্য সে পাবে চরমতম শাস্তি।”। এজন্যই টাকা জাল করাকে শুধু লোক ঠকানো নয়, তার চেয়েও বড় মাপের অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। টাকা জাল করার অর্থ হলো সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন, স্বয়ং রাজার ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ। এ ধরনের অপরাধে সাধারণত শাস্তি হতো নির্যাতন ও মৃত্যু। মানুষ যতদিন রাজা ও তার রাজত্বে বিশ্বাস করবে, ততদিন ওই রাজার নামাঙ্কিত মুদ্রাকেও বিশ্বাস করবে। রোমান সাম্রাজ্যের বাইরের মানুষও রোমের ডিনেরিয়াস (Denarius) মুদ্রা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করত, কারণ তারা রোমান সম্রাটকে বিশ্বাস করত, আর ওই মুদ্রায় আঁকা থাকত সেই সম্রাটেরই নাম ও ছবি।
আবার উলটোভাবে রোমান সম্রাটের ক্ষমতাও নিহিত ছিলো এই ডিনেরিয়াস মুদ্রার মাঝে। শুধু চিন্তা করে দেখুন তো, ওই বিশাল রোমান সাম্রাজ্যের প্রজাদের কাছ থেকে যদি খাজনা আদায় করা হতো গম আর বার্লিতে, কেমন হতো সেটা? আবার সেই খাজনা রোমের রাজকোষে জমাই বা হতো কীভাবে, আর সেটা ব্রিটেনে নিয়ে গিয়ে সেখানকার সৈন্যদের বেতনই বা দেওয়া যেত কীভাবে? কী হতো যদি শুধু রোমের মানুষএই মুদ্রা ব্যবহার করত আর বাইরের লোকে সেটা গ্রহণ না করে কড়ি ব্যবহার করত? সেক্ষেত্রেও সেই পুরনো সমস্যা রয়েই যেত।
স্বর্ণের মহিমা
রোমান মুদ্রা ডিনেরিয়াসের উপর মানুষের আস্থা এতটাই বেশি ছিলো যে রোমান সাম্রাজ্যের বাইরের মানুষও সেটা সাদরে গ্রহণ করে। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে ভারতেও এই ডিনেরিয়াস চলত, যদিও রোমান সৈন্যবাহিনী তখনও ভারত থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে। এই মুদ্রার উপর ভারতীয়দের আস্থা এতই বেশি ছিলো যে তারা ডিনেরিয়াসের আদলে মুদ্রা তৈরি করতে শুরু করে, এমনকি রোমান সম্রাটের ছবিসহ! ‘ডিনেরিয়াস’ শব্দটাই মুদ্রার প্রতিশব্দে পরিণত হয়। এই রোমান ‘ডিনেরিয়াস’ নামটাই আরব খলিফাদের হাতে হয়ে যায় আরবি ‘দিনার’। আজও জর্দান, ইরাক, সার্বিয়া, মেসিডোনিয়া, তিউনিসিয়াসহ বেশ কিছু দেশের রাষ্ট্রীয় মুদ্রার নাম দিনার।
এই লিডীয় ধাঁচের মুদ্রা যখন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে ভারত মহাসাগরের দিকে ছড়িয়ে পড়ছে, ঠিক তখনই চীনে গড়ে উঠছিলো নতুন এক মুদ্রাব্যবস্থা। সেই ব্যবস্থার মুদ্রা ছিলো ব্রোঞ্জের পয়সা আর চিহ্নবিহীন সোনা ও রূপার পিণ্ড। তবে এই দুরকম মুদ্রার মধ্যে একটা জায়গায় মিল ছিলো, সেটা হলো সোনা ও রূপার ব্যবহার। এ কারণেই চৈনিক অঞ্চলের সাথে লিডীয় অঞ্চলের আর্থিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরি হতে সমস্যা হয়নি। মুসলিম ও ইউরোপীয় বণিক ও দিগ্বিজয়ীদের হাত ধরে স্বর্ণের মহিমা ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর আনাচে কানাচে। আর আজকের গোটা পৃথিবীটা জুড়েই একই মুদ্রাব্যবস্থা চলে, যার মূলে আছে সোনা ও রূপা, আর আছে ব্রিটিশ পাউন্ড ও মার্কিন ডলারের মতো কয়েকটা মুদ্রা।
এই বহুজাতিক মুদ্রার উদ্ভব প্রথমে এশিয়া ও আফ্রিকা আর পরে পুরো পৃথিবীকেই অর্থনৈতিকভাবে একীভূত করে ফেলে। মানুষ আগের মতোই নানা ভাষায় কথা বলে, বিভিন্ন শাসকের প্রতি আনুগত্য জানায়, ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম পালন করে, কিন্তু স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রায় লেনদেন করতে তাদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। সোনা ও রূপার মূল্যের উপর সকল মানুষের এই যৌথ বিশ্বাস না থাকলে আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। ষোড়শ শতকে আমেরিকায় পাওয়া সোনা দিয়ে ইউরোপীয়রা পূর্ব এশিয়া থেকে সিল্কের কাপড়, চিনামাটির বাসন আর মসলা কিনেছিলো। এভাবেই ইউরোপ ও পূর্ব এশিয়া উভয় স্থানের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হয়। মেক্সিকোর খনি থেকে তোলা সোনা আর রূপা ইউরোপের ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরে গিয়ে পৌঁছায় চীনের সিল্ক ও চিনামাটি ব্যবসায়ীর টাকার থলেতে। কর্টেজের মতো ‘স্বর্ণই যার একমাত্র ওষুধ’, সেই রোগে আক্রান্ত না হলে কি চীনা ব্যবসায়ীরা সোনা আর রূপার বিনিময়ে তাদের পণ্য বিক্রি করত?
এখন প্রশ্ন জাগে, চীনা, ভারতীয়, মুসলিম আর স্পেনীয় – এই বিভিন্ন জাতির মানুষের মধ্যে এমন কিছুই ছিলো না যাতে তাদের সবাই বিশ্বাস করে। কিন্তু মুদ্রা তৈরির বেলায় সোনা ব্যবহার করেছে এদের সবাই, এই এক জায়গায় এদের কারও মধ্যে কোনো মতবিরোধ নেই। কীভাবে সম্ভব হলো এটা? এমন কি হতে পারত না যে একই সময়ে মুদ্রা হিসেবে স্পেনীয়রা ব্যবহার করছে সোনা, মুসলিমরা বার্লি, ভারতীয়রা কড়ি আর চৈনিকরা সিল্ক? এর একটা উত্তর পাওয়া যায় অর্থনীতিবিদদের কাছে। দুটো অঞ্চলের মাঝে যখন একটা বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তখন চাহিদা আর যোগানের ভারসাম্য রাখতে বহনযোগ্য পণ্যগুলোর দাম সমান হয়ে যেতে থাকে। এটা বোঝার জন্য ভাবুন, ভারত আর ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার মধ্যে যখন ব্যবসা বাণিজ্য শুরু হলো, ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় তখন সোনা মর্যাদার চিহ্ন, তাই তার মূল্যও বেশি। ওদিকে তখন ভারতে সোনার কানাকড়িও দাম নেই। এরপর কী হলো?
ভ্রাম্যমাণ বণিকেরা দেখলো ভূমধ্যসাগর আর ভারতে সোনার দামের অনেক ফারাক। তাই লাভের আশায় তারা ভারত থেকে সস্তায় সোনা কিনে ভূমধ্যসাগরে চড়া দামে বেচতে শুরু করলো। এর ফলে ভারতে সৃষ্টি হলো সোনার আকাশছোঁয়া চাহিদা, তাই সেটার দামও গেলো বেড়ে। ওদিকে ভূমধ্যসাগরের দিকে সোনার যোগান দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় তার দামও কমতে লাগলো। এর ফলে কিছু দিনের মধ্যেই দুই জায়গাতেই সোনার দাম কাছাকাছি এসে গেলো। তখন ভারতীয়দের কাছে সোনা তেমন দরকারি বা মূল্যবান না হলেও ভূমধ্যসাগরে এটার ব্যাপক চাহিদা দেখে তারাও এটাকে মূল্যবান ভেবে নিলো।
একইভাবে আমরা যখন দেখি একজন মানুষ, যে বন্ধু হোক বা শত্রু, কড়ি, ডলার কিংবা ইলেক্ট্রনিক তথ্যকে মূল্যবান বলে বিশ্বাস করছে, তখন সেই বিশ্বাস আমাদের মাঝেও সঞ্চারিত হয়। এভাবে সেই জিনিসটার উপর সব মানুষের যৌথ বিশ্বাস আরও পাকাপোক্ত হয়। খ্রিস্টান ও মুসলিমরা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে এক হতে পারেনি, কিন্তু একই মুদ্রা ব্যবস্থায় বিশ্বাস করেছে ঠিকই। এর কারণ হলো, ধর্মের ক্ষেত্রে বেঁধে দেওয়া কোনো কিছুতে বিশ্বাস করলেই হয়, কিন্তু মুদ্রার বেলায় অন্যরা যা বিশ্বাস করে তাতেই নিজের বিশ্বাস স্থাপন করতে হয়।
হাজার হাজার বছর ধরে অনেক দার্শনিক, ধর্মপ্রচারক ও চিন্তাশীল ব্যক্তি টাকাকে হেয় করেছেন, বলেছেন অর্থই অনর্থের মূল। কিন্তু তার পরেও, মানুষের সহিষ্ণুতার চূড়ান্ত নিদর্শন হলো টাকা। মানুষের ভাষা, আইনকানুন, সংস্কৃতি, ধর্ম ও সামাজিকতার চেয়ে টাকা অনেক বেশি উন্মুক্ত আর সর্বজনীন। টাকা হলো মানুষের তৈরি একমাত্র জিনিস যা সবরকম সাংস্কৃতিক দূরত্ব ঘুচিয়ে দিতে পারে। টাকার কাছে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সব মানুষই সমান। যে মানুষটাকে আমরা চিনি না বা বিশ্বাস করি না, তার সাথেও আমরা নির্দ্বিধায় আর্থিক লেনদেন করতে পারি এই টাকারই বদৌলতে।
টাকার মূল্য
সব ধরনের মুদ্রার দুটো বৈশিষ্ট্য থাকেঃ
ক। সর্বজনীন বিনিময়যোগ্যতাঃ প্রাচীন আলকেমিস্টরা যেমন যেকোনো কিছুকে সোনা বানাতে পারতেন বলে বলা হয়, তেমনি টাকাও যেকোনো কিছুকে যেকোনো কিছুতে পরিণত করতে পারে, যেমন জমিকে আনুগত্যে কিংবা সন্ত্রাসকে শিক্ষায়।
খ। সর্বজনীন বিশ্বাসঃ যেকোনো দুজন মানুষের মাঝে কোনো কাজে লেনদেনের মাধ্যম হতে পারে টাকা।
এই দুটো নীতির কারণেই পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষ বাণিজ্য ও শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর একটা অন্ধকার দিকও আছে। যখন যেকোনো কিছুকে যেকোনো কিছুতে রূপান্তর করা সম্ভব হয়, আর যখন সব মানুষ একই ধারণায় বিশ্বাস করে, তখন ঐতিহ্য, মানবিক সম্পর্ক আর মূল্যবোধে ভাঙন ধরে, আর এদের জায়গা নিয়ে নেয় চাহিদা-যোগানের হিসাব।
মানুষের পরিবার ও সমাজ যেসব ভিত্তির উপর গড়ে ওঠে, তার মধ্যে আছে মর্যাদা, সততা, আদর্শ ও ভালোবাসার মত কিছু জিনিস। এগুলোর প্রত্যেকটিই ‘অমূল্য’, এগুলো বাজারে বেচাকেনা হয় না, টাকায় এগুলোর দাম নির্ধারণ করা যায় না। এসব মানবীয় গুণের জন্যই মা-বাবা তার সন্তানকে দাস হিসেবে বিক্রি করতে পারে না, একজন ধার্মিক পাপ করতে পারে না, একজন অনুগত সৈনিক দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে না।
নদীর খরস্রোত যেমন বাঁধের ফাটল ভেদ করে যেতে চায়, তেমনি টাকাও ভেঙে দিতে চায় মানুষের এই নীতি ও আদর্শের দেয়াল। বাবা-মা পরিবারের অন্যদের খাবার যোগাতে নিজের সন্তানকে বেচে দিয়েছে – এমনও তো শোনা যায়। ধার্মিক মানুষও চুরি করে, মানুষকে ঠকায় বা হত্যা করে টাকার জন্য, আবার সে টাকা খরচ করে প্রার্থনালয়ে, স্রষ্টার কাছ থেকে ক্ষমা পাওয়ার জন্য। উচ্চাকাঙ্ক্ষী সৈনিক টাকার বিনিময়ে হাত মেলায় শত্রুর সাথে।
টাকার আরও অন্ধকার দিক আছে। টাকা অপরিচিত মানুষদের মাঝে একটা সর্বজনীন বিশ্বাস তৈরি করতে পারে বটে, কিন্তু এই বিশ্বাস কখনও মানুষ, সমাজ বা মানুষের মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত হয় না – সে বিশ্বাস কাজ করে কেবল টাকার উপরেই। আমরা একজন অপরিচিত মানুষকে, এমনকি পাশের বাড়ির মানুষটাকেও বিশ্বাস করি না, কিন্তু তার পকেটের টাকাকে বিশ্বাস করি ঠিকই। টাকা ফুরালে ফুরায় সেই বিশ্বাসও। টাকা যতই মানুষের সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রের নীতি ও আদর্শে ফাটল ধরায়, ততই এই পৃথিবীটা ধীরে ধীরে পরিণত হয় মানবিক অনুভূতিহীন একটা বাজারে।
মানুষের অর্থনৈতিক ইতিহাস দ্বন্দ্বময়। যে মানুষ একদিকে অপরিচিত মানুষের সাথে লেনদেন করছে টাকার উপর নির্ভর করে, সেই মানুষই আবার শঙ্কিত হচ্ছে টাকার কাছে মানবিক সম্পর্ক ও মূল্যবোধ হারানোর ভয়ে। টাকার জন্যই মানুষ নীতি ও আদর্শকে পায়ে ঠেলছে, আবার মানুষই টাকার কাছে সবকিছু বিকিয়ে না দেওয়ার জন্য চেষ্টা করছে প্রাণপণ।
ইদানীং মানুষ ধরেই নিয়েছে যে টাকার আগ্রাসনকে হয়তো রাষ্ট্র, ধর্ম ও সমাজের চেষ্টায় আর প্রতিহত করা যাবে না। কিন্তু সেটা আসলে ঠিক নয়। এমন অনেকবারই হয়েছে যে বীর যোদ্ধা, গোঁড়া ধার্মিক আর সচেতন নাগরিকেরা চতুর ব্যবসায়ীদের সব হিসাবকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অর্থনীতিরই মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। তাই সমগ্র মানবজাতি কীভাবে এক হলো সেটা বুঝতে হলে শুধু অর্থনীতির দিক থেকে চিন্তা করলেই হবে না। এই সুদীর্ঘ সময়ে হাজারো ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ মিলে যে একটা বৈশ্বিক সমাজ গড়ে তুলেছে, এর পিছনে সোনা আর রূপার বড় ভূমিকা আছে ঠিকই, কিন্তু তাই বলে ইস্পাতের কথাটা ভুলে গেলে চলবে না।
————–
1 Francisco López de Gómara, Historia de la Conquista de Mexico, vol. 1, ed. D. Joaquin Ramirez Cabanes (Mexico City: Editorial Pedro Robredo, 1943), 106.
2 Andrew M. Watson, ‘Back to Gold – and Silver’, Economic History Review 20:1 (1967), 11–12; Jasim Alubudi, Repertorio Bibliográfico del Islam (Madrid: Vision Libros, 2003), 194.
3 Watson, ‘Back to Gold – and Silver’, 17–18.
4 David Graeber, Debt: The First 5,000 Years (Brooklyn, NY: Melville House, 2011).
5 Glyn Davies, A History of Money: From Ancient Times to the Present Day (Cardiff: University of Wales Press, 1994), 15.
6 Szymon Laks, Music of Another World, trans. Chester A. Kisiel (Evanston, Ill.: North-western University Press, 1989), 88–9. The Auschwitz ‘market’ was restricted to certain classes of prisoners and conditions changed dramatically across time.
7 Niall Ferguson, The Ascent of Money (New York: The Penguin Press, 2008), 4.
8 For information on barley money I have relied on an unpublished PhD thesis: Refael Benvenisti, ‘Economic Institutions of Ancient Assyrian Trade in the Twentieth to Eighteenth Centuries BC’ (Hebrew University of Jerusalem, unpublished PhD thesis, 2011). See also Norman Yoffee, ‘The Economy of Ancient Western Asia’, in Civilizations of the Ancient Near East, vol. 1, ed. J. M. Sasson (New York: C. Scribner’s Sons, 1995), 1,387–99; R. K. Englund, ‘Proto-Cuneiform Account-Books and Journals’, in Creating Economic Order: Record-keeping, Standardization and the Development of Accounting in the Ancient Near East, ed. Michael Hudson and Cornelia Wunsch (Bethesda, Md.: CDL Press, 2004), 21–46; Marvin A. Powell, ‘A Contribution to the History of Money in Mesopotamia Prior to the Invention of Coinage’, in Festschrift Lubor Matouš, ed. B. Hruška and G. Komoróczy (Budapest: Eötvös Loránd Tudományegyetem, 1978), 211–43; Marvin A. Powell, ‘Money in Mesopotamia’, Journal of the Economic and Social History of the Orient 39:3 (1996), 224–42; John F. Robertson, ‘The Social and Economic Organization of Ancient Mesopotamian Temples’, in Civilizations of the Ancient Near East, vol. 1, ed. Sasson, 443–500; M. Silver, ‘Modern Ancients’, in Commerce and Monetary Systems in the Ancient World: Means of Transmission and Cultural Interaction, ed. R. Rollinger and U. Christoph (Stuttgart: Steiner, 2004), 65–87; Daniel C. Snell, ‘Methods of Exchange and Coinage in Ancient Western Asia’, in Civilizations of the Ancient Near East, vol. 1, ed. Sasson, 1,487–97.