১০. জীবনের আর একটা অধ্যায়

১০.

জীবনের আর একটা অধ্যায় শুরু হল। জটিলতর। প্রথমে বুঝতে পারলাম না। নিজেকে আমার ঠিক চেনা ছিল না। বি. এ পাশ করে, য়ুনিভারসিটিতে বাংলা পড়া শুরু হল। দীপু এম. কম। য়ুনিভারসিটিতে আমার এক বছর পূর্ণ হবার আগেই সজল এঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বেরিয়ে এল। এবার ওর চাকরির দরকার। ভীষণভাবে দরকার। নিজের কাছে ওর একটা পয়সা থাকে না। এখন দাদার কাছে হাত পাততে ওর লজ্জা করে। সেটা খুবই স্বাভাবিক। বাধ্য হয়ে, ওর মতো এক জন এঞ্জিনিয়ার ছেলেকে ছাত্র পড়াবার কাজ নিতে হল। আর খবরের কাগজ দেখে, চলল দরখাস্তের পালা।

সজল যত দিন ছাত্র ছিল, তত দিন অন্য রকম ছিল। তখন ওর চোখে আশা ছিল। তখন ও শিবপুর থেকে ছুটে এলে ওকে অন্য রকম লাগত। আমিও কখনও কখনও শিবপুরে চলে গিয়েছি। যখন। কিছুতেই ভাল লাগত না, তখনই ছুটে গিয়েছি। এক সময়ে, মেয়েবন্ধুদের সঙ্গে অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি। তারপরে সজলের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি, এখনও বেড়াই। মাঝখানে আর একজনের সঙ্গে ঘুরেছি, অংশুমালী গুপ্ত। না, তাঁর সঙ্গে ঠিক ঘুরে বেড়াইনি। তাঁর ফ্ল্যাটেই গিয়েছি। হঠাৎ কোনও কোনও দিন গঙ্গার ধারে বা কখনও কোনও বিদেশি ফিলম দেখতে গিয়েছি। ওঁকে আমি ভুলে যাইনি। কিন্তু ওঁকে নিয়ে আমার ভিতরে কোনও সমস্যা নেই, ওঁর ওপর আমার কোনও অভিযোগও নেই। সজলকে অংশুমালীর কথা বলেছি। শুনে সজল বলেছে, জেলাস হয়ে যাচ্ছি। আর আমার তেরো বছর বয়সে, কৃষ্ণনগরে রায়বাড়ির ঘটনা শুনতে শুনতে, ওর চোখ ছলছলিয়ে উঠেছিল, বলেছিল, উহ, কী কষ্ট!’ দু হাতে আমার মুখ তুলে ধরেছিল।

কিন্তু সজল ক্রমে বদলে যাচ্ছে। ওর মুখে বিমর্ষতা, কালো চোখ দুটো নিষ্প্রভ। সজলের জন্য মামিমা মামাকে বললেন। মামা আজকাল খিটখিটে হয়ে গিয়েছেন। তাঁর রাত্রের আড্ডায় খানিকটা ভাঙন ধরেছে, বিশেষ করে, ওঁর কারখানায় সম্প্রতি আটচল্লিশ ঘণ্টা শ্রমিকদের ঘেরাওয়ের ঘটনার পরে। কারখানায় রোজ গোলমাল। তারপরেও মামা যখন সজলকে চাকরিতে নেবার জন্য রাজি হলেন, তখনই কারখানায় ধর্মঘট শুরু হল।

এই বছরটায়, চারদিকেই পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন আশা আর নিরাশার জটিলতা। বামপন্থী সরকার গঠিত হয়েছে। এক দিকে যেমন উৎসাহের জোয়ার, আর এক দিকে তেমনি নিরুৎসাহের ভাটা। বেকারের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। কলকারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাবার পিছনে কোনও চক্রান্ত আছে কি না, কে জানে। দীপু তা-ই বলে। ও বলে, নতুন সরকারকে বেকায়দায় ফেলবার জন্যই, কারখানার মালিকেরা চক্রান্ত করে এ সব করছে। সজলেরও তাই বিশ্বাস। মামাও তাঁর কারখানায় লক আউট ঘোষণা করেছেন। দীপু বলে, বাবাকে আলাদা করে দেখবার কিছু নেই। এঁরাও সংঘবদ্ধ, শ্রমিকরাও সংঘবদ্ধ। মামা চেয়েছিলেন, রমুদা কেমিস্ট্রিতে এম. এ পাশ করে, বিলেত থেকে আরও উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে এসে কারখানার কাজে লাগবে। দীপু এমকম্ করে, সি. এ পাশ করে, ব্যবসায়ের ফাইনান্স দিকটা দেখবে। রমুদা একভাবে কাজে লাগছে। দীপু কী করবে, বুঝতে পারি না। ও কি সত্যি রাজনীতি নিয়েই থাকবে! আমার সঙ্গে ওর মুখোমুখি কোনও বিবাদ নেই। দুজনের আদর্শই। আলাদা।

সবাই যেন কেমন বদলে যাচ্ছে। এ সময়ে সজল এক দিন কলেজ স্ট্রিটে হরিশদার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। বামপন্থী প্রৌঢ় নেতা। ষাটের কাছাকাছি বয়স। দেখলাম সজলকে খুব স্নেহ করেন। একটা প্রকাণ্ড বাড়ির নীচের তলার স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার ঘরে, হরিশদা ছাড়া আরও কয়েকজন বসেছিলেন। চেয়ার মাত্র একটি, আর সবই বেঞ্চ। টেবিল একটা। চারধারে কাগজপত্র ছড়ানো। ভেজা দেওয়ালের গন্ধ। এখান থেকে নাকি কী একটা কাগজ বেরোয়। দিনের বেলাও আলো জ্বলছে। দেওয়ালে সকলের বড় বড় ছায়া পড়েছে। এখানকার কথা অনেক দিনই সজল বলেছে। ওকে এখানে নিয়ে এসেছিল সুবীর। সুবীরকে আমি আজ অবধি চোখে দেখিনি। নামই শুনে এসেছি। আমাকে দেখে, হরিশদা সজলকে বললেন, কাকে নিয়ে এলে?

সজল বলল, আমার বন্ধু, যমুনা।

হরিশদা বললেন, দেখে মনে হচ্ছে, বড়লোকের রূপসী মেয়ে। এসো যমুনা, এখানে বসবে এসো। দম বন্ধ হয়ে যাবে না তো?

ওঁর মুখে এমন একটি হাসি ছিল, নিজেকে আমার সহজ মনে হল। আমি ওঁর পাশে, বেঞ্চিতে গিয়ে বসলাম। সকলের সঙ্গেই পরিচয় হল। দু-চার কথার পরে, হরিশদার মুখে নতুন কথা শুনলাম। বললেন, এ সরকার কখনও টিকতে পারে না, ভাঙল বলে। সরষের মধ্যেই ভূতগুলো সব বসে। তিনি এমন কোনও কোনও নেতার নাম করে সমালোচনা করলেন, হরিশদা নিজেই যাঁদের দলের লোক। আরও বললেন, একে শ্রেণীসংগ্রাম বলে না, বিপ্লবের পথ-ও বলে না। এ সব হচ্ছে মন্ত্রিত্বের পার্টি পলেটিকস, একটি পাক্কা সুবিধাবাদী রাস্তা। শুয়োরের খোঁয়াড়ে বসে বিপ্লব করা যায় না। তাই এখন দেখছি, আমরাই সেই সব কৃষকদের আর নেতাদের দমন করতে শুরু করেছি, যারা সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসী।

আরও কয়েকজন, হরিশদাকে সমর্থন করেই কথা বলল। বর্তমান রাজনীতি, মন্ত্রিত্ব কোনও সমস্যারই সমাধান করতে পারবে না। বেকারদের চাকরি দিতে পারবে না, কৃষকদের হাতে জমি তুলে দিতে পারবে না। কেবল এক জন বলল, এভাবে কোনও সমস্যার সমাধান করা যাবে, পার্টিও তা বিশ্বাস করে না।

হরিশদা তাকে বললেন, তুমি কী বলতে চাও জানি, বিপ্লবী পার্টি সংসদীয় সরকার গঠিত করে, গোটা ব্যবস্থাটাকে ভেঙে ফেলবে, শ্রমিক কৃষককে সশস্ত্র আন্দোলনের দিকে টেনে নিয়ে যাবে। সোনার পাথরবাটিতে তোমার বিশ্বাস থাকতে পারে, আমার নেই। তা হলে মন্ত্রিত্ব না করে, আমরা বিপ্লবকে। সংগঠিত করতে যেতাম, বুঝলে নীরেন?

নীরেন বলল, নির্বাচনের সংগ্রামটা ছেড়ে দিয়েই?

নির্বাচনকে আমরা মানতে যাচ্ছি কেন। সেই আবহাওয়া আমরা তৈরি হতে দেব না।

হরিশদার চোখগুলো জ্বলজ্বল করছে। নীরেন বলল, কিন্তু সশস্ত্র অভ্যুত্থানের সময় এসেছে বলে আপনি মনে করেন?

হরিশদা জোর দিয়ে বললেন, সময় আসে না নীরেন, সময়কে তৈরি করে নিতে হয়।

নীরেন বলল, তারও একটা অবস্থা চাই।

সে অবস্থা আছে বলে আমি বিশ্বাস করি।

নীরেন চুপ করে গেল। হরিশদা সিগারেট ধরালেন। আমার কানে রমার কথাগুলো বাজছে। হরিশদা হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, যমুনা, তুমি কী বলে?

সংকুচিত হয়ে বললাম, আমি এ সব বুঝি না।

হরিশদা সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, লাইট হাউসে এখন কী ছবি হচ্ছে বলো তো?

আমি বললাম, একটা মিউজিক্যাল কমেডি, নামটা–।

সজল ডেকে উঠল, বিন্দু!

আমি ওর দিকে তাকাতেই, বাকিরা সবাই হো হো করে হেসে উঠল; কেবল হরিশদা মিচকি মিচকি। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম, হরিশদা আমাকে একটু মিঠে খোঁচা দিয়েছেন। আমার মুখ লাল হয়ে উঠল। হরিশদা বললেন, শিবু, আমাদের ভাঁড়ের চা যমুনাকে একটু খাওয়াও।

আমি তা নিশ্চয়ই খাব। কিন্তু হরিশদাকে আমি মিথ্যা কথা বলিনি। তাই আবার বললাম, যা সত্যি, তাই আপনাকে বলেছি।

জানি, সেইজন্যই তোমার সঙ্গে একটু মজা করলাম। কিন্তু বুঝি না বললে তো হবে না, বুঝতে হবে।

চুপ করে রইলাম। রমার কথাই বারে বারে মনে হতে লাগল। রমাও তো আমাকে এইরকম করেই। বলে। শিবু নামে একজন যুবক বেরিয়ে গিয়েছিল। তার সঙ্গে একজন এল, এক হাতে কেতলি, আর এক হাতে থাকে থাকে সাজানো মাটির ভাঁড়। কোনও দিন খাইনি, তা না। বন্ধুরা মিলে লেকে ময়দানে অনেক বার খেয়েছি। হরিশদা চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, সজল, তোমাকে একটা খবর দিই। সুবীর এ পার্টির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছেদ করছে। ওকে ইতিমধ্যেই একস্ট্রিমিস্ট বলা হয়েছে।

আমার মনে পড়ে গেল, দীপু কাল না পরশুই যেন বলছিল, ওর সুবীরদা একস্ট্রিমিস্ট হয়ে যাচ্ছে, ভুল করছে। সুবীরদার সঙ্গে ওর আর কোনও সম্পর্ক নেই।