১০. জিপটা ধর্মপুরে যাচ্ছে

১০

“জিপটা ধর্মপুরে যাচ্ছে। ওখানে কিছু কাজ আছে। যাবে নাকি একবার বোনের কাছে?” কমলেশ জিজ্ঞেসা করে।

“তুমি?” মল্লিকার ইচ্ছে স্বামীও সঙ্গে যায়।

সে পরে একদিন হবে । আজকে অনেকগুলো জরুরি মিটিং রয়েছে। মেশিন বসাতে যে জাপানিগুলো এসেছে তাদের কাছ থেকে কাজ বুঝে নিতে হবে। প্রিলিং টাওয়ারে জার্মানরা কাজ করছে। সেখানেও একটু কথাবার্তা আছে।”

ব্রিটিশ এক্সপ্লোসিভ কোম্পানির অফিসে সমরেন্দ্রবাবুকে টেলিফোনে পাওয়া গেলো । তিনি খুব উৎসাহিত হয়ে উঠে আশ্বাস দিলেন, “কোনো চিন্তা নেই। রিংকি শুনলেই লাফাতে আরম্ভ করবে। ভালো কথা, ঝুমুর হাতে আপনাদের একটা যুগল ছবি পাঠাতে ভুলবেন না। রিংকির দরকার আছে।”

টেলিফোন নামিয়ে রেখে কমলেশ এবার বউকে ছবির কথা বললো ।

মল্লিকা হাসলো। “রিংকি ছবি নিয়ে কী করবে?”

“কী আর করবে? অ্যালবামে রেখে দেবে,” কমলেশ উত্তর দিলো ।

বিশ্বাস করলো না মল্লিকা। “তুমি রিংকিকে জানো না। ওর মাথায় নিশ্চয় কোনো মতলব আছে।

কমলেশ হাসলো। মল্লিকা বললো, “সমরদা যখন হুকুম করেছেন তখন নিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু ওদের একটা ছবি না পেলে কিছুতেই দেবো না।”

“অফিসের কাজ সেরে গাড়িটা চারটে নাগাদ তোমাকে আবার তুলে নেবে,” কমলেশ মনে করিয়ে দিলো ।

যাবার পথে কমলেশকে প্রোজেক্ট অফিসে নামিয়ে দিয়ে গাড়িটা বেরিয়ে গেলো।

কমলেশ অফিসে না ঢুকে সাইটের দিকে হাঁটতে লাগলো। এই ভোরবেলায় পুরোদমে কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। কয়েকজন শ্রমিক অবশ্য জটলা পাকাচ্ছিল, সায়েবকে দেখে তারা যে যার কাজে মন দিলো । অনেকে ম্যানেজার সায়েবকে সেলাম জানাচ্ছে। প্রতি নমস্কার জানাতে-জানাতে কমলেশ এগিয়ে চললো ।

ইউরিয়া রি-এক্টরের কাছে এসে জাপানিদের দেখতে পেলো কমলেশ। ছোট-ছোট খাকি হাফপ্যান্ট এবং গেঞ্জি পরে লোকগুলো যন্ত্রের মতো কাজ করে যাচ্ছে। সুদর্শন সেন কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন। ভদ্রলোক ফিসফিস করে কমলেশকে বললেন, “কী জিনিস দিয়ে যে ভগবান এদের তৈরি করেছিলেন! কাজ ছাড়া কিছু বোঝে না। ভোরবেলা থেকে ডিউটিতে আসে, কারুর সঙ্গে কথা বলে না; এমনকি নিজেদের দলের লোকের সঙ্গেও নয়। মাঝে-মাঝে পকেট থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে সুখটান মারে– সোনা বাঁধানো দাঁতগুলো চকচক করে ওঠে।”

“জানেন স্যার, অনেক ব্যাটা লোকাল সুপারভাইজার ফরেন সিগারেট খাবার লোভে ওদের কাছে আসে। কিন্তু সে গুড়ে বালি । পয়সা বাঁচাবার জন্যে ওরা সস্তা দামের কাঁচি সিগারেট, না হলে চারমিনার ফোঁকে।”

সুদর্শনবাবু বললেন, “অথচ এদের সমস্ত কাগজপত্তর তো আমি দেখি। বিদেশে থাকবার সব খরচ জাপানি কোম্পানি দেবে। একদিন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ছোকরা এক জাপানিকে। বাপু, কোম্পানিই যখন খরচ দেবে তখন অত হাতটান কেন? তখন ব্যাটা ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে বললো, ‘আমি যদি কম খরচ করি তাহলে আমার কোম্পানির বেশি লাভ হবে। আর বেশি লাভ হলে কোম্পানি আমাকে বেশি বোনাস দেবে। ইউ ফলো?’ বুঝুন ব্যাটাদের মনস্তত্ত্ব।”

সুদর্শনবাবুর কথায় কমলেশ হেসে ফেললো। বললো, “ওইরকম নিষ্ঠা আছে বলেই জাপানিরা দেশ গড়তে পেরেছে।

সুদর্শনবাবুও বললেন, “জার্মানরাও তো স্যার দেশ গড়েছে । কাজ এবং ফুর্তি কোনোটাতেই ফাঁকি নেই। ওদের তো দেখছি। দামি সিগারেট, মদ, ভালো খাবার না হলে চলে না। ত্রিশ বছরের মধ্যে দু-দুটো যুদ্ধে ফেঁসে গিয়ে জার্মানরা বুঝেছে, ক’দিনের জন্যে আর এই পৃথিবীতে আসা। কাজের ফাঁকে-ফাঁকে তাই জীবনটা উপভোগ করতে ওরা ছাড়ে না।

“এদের সকলকে রেখেছেন কোথায়?” কমলেশ জিজ্ঞেস করে ।

“গেস্টহাউসে। ইস্ট উইংয়ে জাপানিদের আর ওয়েস্ট উইংয়ে জার্মানদের।”

“দেখবেন আদর-আপ্যায়ন যেন ভালো হয়, হাজার হোক অতিথি!”

কমলেশের কথায় সুদর্শন সেন হেসে ফেললেন। “সে আপনি ভাববেন না স্যার । আট-দশটা সায়েব এই অধমের কাছে নস্যি! চন্দনপুর যখন তৈরি হলো তখন আড়াইশ সায়েবের সেবাযত্ন করেছে ইওরস ফেথফুলি। তখন কী সব বাঘা-বাঘা সায়েব! পান থেকে চুন খসলে লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে বসততা। সায়েবদের প্রত্যেক ঘরে পায়রার বাক্স বসাতে হয়েছিল চার দিনের নোটিশে।”

“এয়ার কুলার?” কমলেশ জিজ্ঞেস করলো ।

একগাল হেসে সুদর্শনবাবু বললেন, “ঠিক ধরেছেন ।

কমলেশ বললো, “তবে একটা ব্যাপার। জাপানিরা যেন নিজের কাজটুকু নিয়েই ব্যস্ত থাকে । অন্য কোথায় আমরা কী করছি তা যেন না দেখে।“

চোখ দুটো পাকিয়ে বিচক্ষণ সুদর্শন সেন উত্তর দিলেন, “সে আর বলতে ৷ জানি না ভাবছেন যে, বৈজ্ঞানিক প্রসেস টুকলিফাই করতে জাপানিদের তুলনা নেই । জার্মানগুলোর ওসব দোষ নেই । তবে স্যার, ওরাও খাটতে পারে। যেমন দেবতার মতো দেখতে, তেমন হাতের কাজ।

সুদর্শন সেন এবার কমলেশের কাছে সরে গিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “জাপানিদের যোগাড়ে হিসেবে সিকিউরিটির দুটো লোক ভিড়িয়ে দিয়েছি। ওরা বলছিল হেল্পার দরকার নেই, কিন্তু আমরা রাজি হইনি। ওয়াচার দুটোকে সাবধান করে দিয়েছি, ঘুণাক্ষরেও বলবে না যে তোমরা সিকিউরিটির লোক । “

কমলেশ বিদায় নিচ্ছিল। সুদর্শন সেন বললেন, “আপনার সঙ্গে জরুরি দরকার!”

“বলুন,” কমলেশ অনুমতি দেয় ৷

“ওই আদিবাসী মেয়েদের সঙ্গে আমাদের স্টাফদের ঘটকালির যে দায়িত্ব দিয়েছেন– এরকম ডেঞ্জারাস কাজ আমার হোল লাইফে করিনি!”

“কেন? ওরা সবাই তো রাজি হয়েছে বিয়ে করতে,” সুদর্শনবাবুকে ভরসা দেবার চেষ্টা করে কমলেশ ।

“হ্যাঁ স্যার, কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট বললেন শুভস্য শীঘ্রম! পরে বিগড়ে গেলে কাউকে নাকি চাপ দিয়ে বিয়ে দেওয়া যাবে না।’

“তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে অসুবিধা কী?” কমলেশ জানতে চাইলো ।

“আমার তো মাত্র তিনটে ইন্সপেক্টর । একজনকে পাঠিয়েছি জামসেদপুরে পাইপের তদারক করতে, একজন গিয়েছে ধানবাদ হারিয়ে যাওয়া ওয়াগনের খোঁজে। আর একজন কোর্টকেসে ধর্মপুর গিয়েছে– স্টোর থেকে এক ব্যাটা ক্যাজুয়াল লেবার আড়াই কিলো সিমেন্ট চুরি করেছিল । কেস চলছে। এই অবস্থায় বিয়ে দিই কী করে?”

হেসে ফেললো কমলেশ। বললো, “বিয়ে তো আপনি দেবেন না ।“

“আপনি স্যার নতুন এসেছেন এ-লাইনে, চেনেন না এঁদের। বাবুরা ফুর্তিও করেছেন, শ্রীঘরের ভয়ে বিয়ে করতে রাজি হয়েছেন, কিন্তু বিয়ের জন্যে কোম্পানির কাছ থেকে ধার চাইছে।”

“কিছু আগাম দিয়ে দিন। উপায় কী?” কমলেশ হেসে প্রয়োজনীয় অনুমতি দিলো ।

“আপনি যখন বললেন, দিচ্ছি। কিন্তু এর পরে কী আসছে, তা শুনে রাখুন। কোয়ার্টার চাইবে স্ত্রীর সঙ্গে বসবাসের জন্যে। আর ঐ পাজি মেয়েগুলো যারা কুঁড়েঘরে থাকতো, তারাই লিখিত পিটিশন করবে ইলেক্ট্রিক আলো, পাখা, এসব ছাড়া এক মুহূর্ত চলছে না । “

সুদর্শন সেন এবার অফিসের দিকে এগোলেন। কিন্তু জিপে চড়ে ড্রাইভারকে বললেন, “চল বাবা বাড়িতে–একটু ঘোল খেয়ে আসি । পেট ঠাণ্ডা না রাখলে মাথা ঠাণ্ডা থাকবে না ।”

সুদর্শন-গৃহিণী স্বামীকে দেখে বললেন, “ঘোলের বোতলটা ফেলে রেখেই আপিসে চলে গেলে? তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না।”

“ঘোল অফিসেই যথেষ্ট খাচ্ছি গিন্নি,” দুঃখ প্রকাশ করলেন এডমিন ম্যানেজার সুদর্শন সেন।

“কাজ করছে তো ইঞ্জিনিয়াররা। তুমি এতো ব্যস্ত কেন?” মুখ ঝামটা দিলেন সুদর্শন গৃহিণী ।

“এতো বড় কথা বললে গিন্নি? ইঞ্জিনিয়ারদের সাধ্য আছে কারখানা তৈরি করে মাইনাস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্ট?” সুদর্শন সেন গভীর আত্মবিশাসের সঙ্গে বললেন, “এটা জেনে রেখে দাও গিন্নি, এই শর্মা ছাড়া তোমার দিগম্বর বনার্জি এবং কমলেশ রায়চৌধুরীর তাজমহল স্বপ্নই থেকে যাবে।”

গৃহিণী ঘোল এগিয়ে দিলেন। ঘোলের গেলাসে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে সুদর্শনবাবু বললেন, “এখন অবশ্য আমার সন্দেহ হচ্ছে সুদর্শন সেন থেকেও তরী শেষ পর্যন্ত তীরে ভিড়বে কিনা ।”

“কেন?” ভয় পেয়ে যান গৃহিণী ।

সুদর্শনবাবু যে-কথা অফিসে বলতে সাহস করেন না, সেটাই বলে ফেললেন । “তখন সাহেবরা ছিল । দায়িত্ব যদি নিয়ে নিলো –আর তোমার কোনো ভাবনাই নেই । কারখানা বসিয়ে চালু করে হাতে চাবিটি দিয়ে বলতো, এই নাও তোমাদের টার্ন-কি ফ্যাক্টরি । এখন দিগম্বর বনার্জি বারফট্টাই মারছে, কম বয়েসের ছোকরাদের তাতাচ্ছে–তোমরা নিজেরা কারখানা বানাও।”

“ভালোই তো,” গৃহিণী বললেন । “এরাও তো হীরার টুকরো ছেলে ।”

“তুমি তো বলে খালাস। এই যে কমলেশ রায়চৌধুরী নকশা দেখে দেখে ডিরেক্টরের সঙ্গে কথা বলে বলে লোহার তাজমহল বানাচ্ছে, তারপর যদি ইউরিয়া না বেরোয়?”

“অ্যাঁ!” গৃহিণী ভয় পেয়ে গেলেন ।

“অফিসের সব সমস্যার কথা তোমাকে তো বলি না, ভয় পেয়ে যাবে । অথচ জলের মতো টাকা খরচ হচ্ছে। আমার হাত দিয়েই তো চেক যাচ্ছে। কত লাখ টাকা যে এরই মধ্যে এই ছোট্ট পাইলট প্ল্যান্টের জন্যে বেরিয়ে গিয়েছে তা ভাবলে মাথা ঘুরে যাবে। আর কয়েক লাখ না হয় সায়েরা নিতো। আমার তাতে কাজ বাড়তো, কিন্তু সে করা যেতো । আগে তো দেশ, তারপর তো নিজের সুখ।”

“তোমার তাহলে কাজই থাকতো না,” গিন্নি সন্দেহ প্রকাশ করলেন।

“বটে! ছোটখাট জিনিস নিয়ে শাদা সায়েবরা যে কী ধরনের হট্টগোল বাধায় তা তো জানো না । চন্দনপুরে ফ্যাক্টরি যখন তৈরি হচ্ছে– পঁচাত্তরটা সায়েব এসে পড়েছে। কিন্তু প্রোজেক্ট ধসে পড়ে আর কী! সায়েবদের কলঘরে টয়লেটপেপার দেওয়া হয়নি । সে হৈ হৈ ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত এই শর্মাই রাতারাতি কলকাতায় গিয়ে সায়েবদের টয়লেট পেপার নিয়ে এলো।”

“আগে তো বলোনি এটা,”কাল্পনিক ঘেন্নায় গিন্নি মুখ বিকৃত করলেন ।

“অফিসের সব কথা বলা যায় না, গিন্নি! অনেক ব্যাপার টপ-সিক্রেট থাকে ।”

ঘোলের গেলাস শেষ করে সুদর্শন সেন আবার উঠলেন। নিজের মনেই কললেন, “আমার কত যে কাজ। অথচ ফ্যাক্টরি চালু হলে নাম হবে শুধু ইঞ্জিনিয়ারদের। ছবি বেরুবে শুধু বৈজ্ঞানিকদের। ঠাকুমা বলতেন, ছেলে পেটে ধরা এক জিনিস আর সেই ছেলে মানুষ করা আরেক জিনিস।”

প্রোজেক্ট ম্যানেজারের স্টেনো মিস দাসে ঘরে উঁকি মেরে সুদর্শন সেন জিজ্ঞেস করলেন, “সায়েবকে কোথায় পাঠালে?” সুদর্শনবাবুকে দেখেই সুজাতা দাসের গম্ভীর মুখে হাসি ফুটে উঠলো । টাইপরাইটারের বোতাম টেপা বন্ধ রেখে সুজাতা বললো, “পাঠাবার মালিক আমি! সায়েব নিজেই চরকির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন।”

সায়েব যে কেন চরকির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন তা সুদর্শনবাবু এবং সুজাতা দাসের অজানা নয় । সুজাতা বললো, “আমাদের এখানকার কাজকর্ম তো ভালোই চলছিল । কিন্তু এবার বিলেত থেকে ফিরে ড. বনার্জির মাথায় ভূত চেপেছে–কৃষিনগরের উৎপাদন চালু করবার তারিখ এক সপ্তাহ এগিয়ে দিতে বলে গেলেন।’

ছিপছিপে শ্যামলী চেহারা সুজাতা দাসের। বছর আটাশ বয়স । মুখে-চোখে স্নিগ্ধতা থাকলেও দেহে যৌবনের সমৃদ্ধি নেই। দেখলেই মায়া পড়ে যায়–বোঝা যায় গেরস্ত ঘরের মেয়ে। কোনো পাকে পড়ে চাকরির লাইনে এসেছে। প্রথম দিন একে দেখেই সুদর্শন সে বলেছিলেন, “আজ জায়গা পেলে না মা! এই কৃষিনগরে কাজ করতে এলে?”

প্রথমে কোনো উত্তর দেয়নি সুজাতা দাস। তারপর বলেছে, “পাকা চাকরির বয়স পেরিয়ে গিয়েছে; তাই টেমপোরারি চাকরির পিছনেই ছুটতে হয়?”

সুদর্শন সেন অনেক চেষ্টা করে নার্স কোয়ার্টারের পাশে একটা কোয়ার্টার সুজাতাকে পাইয়ে দিয়েছিলেন। একলা মেয়েমানুষ এখানে কোথায় থাকবে?

“কোয়ার্টার বড় সহজ জিনিস নয়,” সুদর্শন সেন বউকে বলেছিলেন । কেরালার তিনটে নার্স অমন অখাদ্য দেখতে–কিন্তু টপাটপ ভালো ভালো বিয়ে হয়ে গেলো। বুদ্ধিমান ছেলেরা দেখলো সাধারণ পথে কোয়ার্টার পেতে অনেক দেরি। তার থেকে রেডিমেড কোয়ার্টার, সেই সঙ্গে বউ। সুদর্শন সেনের যদি ক্ষমতা থাকতো এসব লিখে ফেলতেন । কমলেশকেও বলেছেন, কিন্তু সে বিশ্বাস করে না, শুধু হাসে ।

কমলেশ বলে, “তাহলে তো সুজাতারও এতোদিন বিয়ে হয়ে যাওয়া উচিত ছিল।”

মিস দাসের বিয়ে না হওয়ার কারণটা অবশ্য মিস দাস ছাড়া এখানকার কেউ জানে না । ইন্ডিয়ান ছেলেদের ওপর মোটেই বিশ্বাস নেই সুজাতার। একটা জাতক্রোধ দাঁড়িয়ে গিয়েছে দেশি ছেলেদের ওপর। তাছাড়া ওর হার্টে একটু গোলমাল আছে। স্বাস্থ্য পরীক্ষা তেমন খুঁটিয়ে হয়নি বলেই সুজাতা দাস চাকরি পেয়েছে ।

সুদর্শনবাবু ও সুজাতার মধ্যে প্রায়ই সুখ-দুঃখের আলোচনা হতো। সুদর্শনবাবুও জানেন বড় কর্তার সেক্রেটারির সঙ্গে আলাপ রাখাটা বিশেষ প্রয়োজনীয় । তাই সময় পেলেই একবার সুজাতার সঙ্গে দেখা করে যান ।

চিঠির খাম টাইপ করতে-করতে সুজাতা বললো, “সায়েবরা থাকলে এই কৃষিনগরের রূপই পাল্টে যেতো, মি. সেন ৷

“সে কথা বলে,” সায় দেন মিস্টার সেন। “সত্যি কথা বলতে কি, সায়েব দেখলে কাজে অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়,” সুদর্শন সেন দুঃখ করলেন ।

“তাছাড়া ওরা দায়িত্ব নিতে জানে,” সুজাতা বলেছিল ।

“সেটা ঠিক । নিজে দোষ করে শ্যামবাবুকে ঠেকিয়ে দেওয়ার বদ অভ্যাসটি ওদের নেই,” সুদর্শন সেন বললেন ।

“ওরা কাজও জানে,” সুজাতা বললো। “দেখুন ওই জার্মান ছোকরাদের। সারাদিন পাগলের মতো খাটছে, অথচ মুখে কেমন মিষ্টি হাসিটি লেগে আছে ।

“তা সত্যি। সায়েব দুটো খুব হাসে,” সুদর্শন সেন একমত হলেন । কালো হরিণ-চোখ দুটো বড় করে সুজাতা এবার সুদর্শনবাবুর দিকে তাকালো । তারপর টাইপ করা বন্ধ রেখে প্রশ্ন করলো, “সায়েরা কেন বড় হয়েছে বলুন তো?”

খুবই দামি কোশ্চেন, কিন্তু এ-বিষয়ে সুদর্শনবাবু কখনও মাথা ঘামাননি । তাই তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ঝটিতি উত্তর দিতে পারলেন না । কিছুক্ষণ টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, “রাজার জাত বড় তো হবেই ।”

“জার্মানরা তো রাজা ছিল না,” সুজাতা মনে করিয়ে দেয়।

“ছিল ছিল। ইংলন্ডেশ্বরের সঙ্গে কাইজারের খুব নিকট সম্পর্ক ছিল–মামাতো পিসতুতো ভাই-টাই এরকম একটা কি,” সুদর্শনবাবু ঠিক মনে করতে পারলেন না ।

সুজাতা বললো, “ওসব জানি না। তবে মেয়েমানুষকে সম্মান করতে জানে বলেই ওরা বড় হয়েছে।

“মেয়েমানুষকে তো এখানেও মা বলা হয়।” সুদর্শনবাবু মৃদু আপত্তি জানালেন । সুজাতার মুখে অভিমানের চিহ্ন ফুটে উঠলো। বেশ বিরক্তির সঙ্গেই বললো, “ওসব মুখে! মিস্টার রেমার্ক কিংবা মিস্টার শীলার যখন এখানে আসে দেখবেন। কী অপূর্ব ব্যবহার । ইন্ডিয়ানরা সাত জন্ম চেষ্টা থাকলেও শিখতে পারবে না ।“

ঘড়ির দিকে তাকালেন সুদর্শন সেন। দুঃখের সঙ্গে বললেন, “বৈজ্ঞানিক সমস্যা ছাড়া আর কিছু নিয়ে আমাদের সায়েব মাথা ঘামাচ্ছেন না। অনেকগুলো অফিসের সমস্যা জড়ো হয়ে রয়েছে, কিন্তু ওঁকে ধরতেই পারছি না।”

“কিছু বলতে হবে?” সুজাতা জিজ্ঞেস করে ।

টাক চুলকে সুদর্শনবাবু বললেন, “সায়েবের সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনার দরকার । এমন ব্যাপার যে লিখিত নোট দেওয়াও নিরাপদ নয়। ওই আদিবাসী মেয়েমানুষদের কেস।”

“বজ্জাত ছোঁড়াগুলোর কেস বলুন,” সুজাতা দাস প্রতিবাদ করলো। “সরল মেয়েগুলো সর্বনাশ করে বকাটে ছোঁড়াগুলো কেমন কেটে পড়ছিল । আর বলিহারি যাই মেয়েগুলোকে। ওদেরই আবার বিয়ে করছে।”

সুদর্শন সেন দুঃখ করলেন, “রায়চৌধুরী সায়েব আমাকে যে কি বিপদেই ফেললেন; পরে অডিট আপত্তি না তোলে । জেলে না ঢুকিয়ে বদ্ ছোকরাগুলোকে বাসরঘরে পাঠাচ্ছেন। জামাইবাবু হতে চলেছেন জেনে এঁরাও আশকারা পেয়ে গেছেন। আগাম টাকা চাইছেন । সায়েব দিতে বললেন। এখন জামাইবাবুরা বলছেন, ছুটি চাই। একটা ছোঁড়ারও ক্যাজুয়াল লিভ পর্যন্ত পাওনা নেই । কামাই করলেই মাইনে কাটা যাবে । এখন সিক লিভ একমাত্র ভরসা । অথচ অসুখের কথা লিখে ছুটি চাইতে সাহস পাচ্ছে না। অফিসের চাপে পড়েই তো বিয়ে হচ্ছে।”

কমলেশকে এবার ফিরে আসতে দেখা গেল। বেচারা ঘামে নেয়ে উঠেছে। হাতে অনেকগুলো নকশা এবং কাগজপত্র ।

সুদর্শনবাবুর সমস্যা শুনে কমলেশ জানতে চাইলো, “কী করা উচিত?”

সুদর্শনবাবু বললেন, “আগেকার সময় হলে আপনার কাছে আসবারই দরকার হতো না। সত্যি কথা বলতে কি, আমার নিজের বিয়েও তো বেআইনি পথে। আমি ছাদনাতলায়, কিন্তু অফিসের খাতায় লেখা সিরিয়াস পেটের গোলমাল! অবশ্য এখন ভাবি, খুব মিথ্যে লেখা হয়নি–বিয়েটা এক ধরনের সিরিয়াস ডায়োরিয়াই!“

অফিসের অন্য কাগজপত্তর সই করতে-করতে কমলেশ বললো, “ওদের স্পেশাল ছুটি উইথ মাইনে দিয়ে দিন। তারপর দেখা যাবে।”

সুদর্শন সেন ভয় পেয়ে যান। “অডিট আপত্তি হলে?”

“হলে হবে। আমাদের ডিরেক্টর বলেন, অডিট হাজার চিঠি লিখুক, তোমার অন্তর থেকে যদি কোনো আপত্তি না থাকে, তাহলে মাভৈঃ ।’

১১

টিলার উপর কমলেশের জিপ থামতেই বাড়ির দরজা খুলে গেলো। জিপের চালককে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে মল্লিকা তার বোন রিংকির সঙ্গে বেরিয়ে এলো।

চোখ পাকিয়ে, বেণী নাচিয়ে, কোমর দুলিয়ে কনকলতা ভগ্নীপতিকে আক্রমণ করলো, “আপনি তো লোক খুন করতে পারেন কমলেশবাবু!”

“সে কি!” সহাস্য কমলেশ এ-হেন মন্তব্যের কারণ খুঁজে পাচ্ছে না ।

“হনিমুন পিরিয়ডে কেউ কাউকে একলা ছেড়ে দেয়, কখনও শুনিনি,” কনকলতা মুখের ওপর বললো ।

“ঝুমুটা নরম মেয়ে, মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। তাই আমি এলাম বোনের হয়ে কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে,” কনক জানিয়ে দিলো ।

“খুব ভালো করেছেন । কর্তাটিকে সঙ্গে এনেছেন তো?” কমলেশ জানতে চায় ৷

মল্লিকা বললো, “শনিবারে সমরদার ছুটি। তাই দুজনকেই ধরে এনেছি।”

সোফায় বসে সমরেন্দ্রবাবু বললেন, “শনিবার আপনারও তো অর্ধেক ছুটি?”

“কোথায় ছুটি? কাজকর্ম এখন পুরোদমে চলছে,” কমলেশ দুঃখ প্রকাশ করলো । কনক বললো, “ওঁদের ছুটি মানে এই নয় যে, ব্রিটিশ এক্সপ্লোসিভের কারখানা বন্ধ । কিন্তু কাজ তো করবে শ্রমিকরা, তার সঙ্গে অফিসারদের সম্পর্ক কী? হাতে কাজ করা আর মাথা ঘামিয়ে কাজ করা তো এক জিনিস নয়।

হাসলো কমলেশ । তারপর সমরেন্দ্রবাবুকে একটা সিগারেট দিয়ে এবং নিজে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বললো, “মাথা ঘামানোর ব্যাপারটা তো চন্দনপুর ল্যাবরেটরি আগেই সেরে ফেলেছে–এখন আমরা হাতেই কাজ করছি। আপনার বোনের স্বামীকে একজন মজদুর বলতে পারেন!”

ছেড়ে কথা বলবার মেয়েই নয় কনকলতা । সঙ্গে সঙ্গে ভগ্নীপতিকে শুনিয়ে দিলো, “রাখুন ওসব সৌখীন মজদুরীর কথা।” কোনোরকম দয়ামায়া না দেখিয়েই কনক বললো, “কিছু মনে করবেন না, লোকে তো জানে সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজই হয় না। কোটি কোটি টাকা লোকসান দিয়েও সরকারি কোম্পানির নির্লজ্জ বড়কর্তার বুক ফুলিয়ে সমাজে ঘুরে বেড়ায়। বলে নেশনের সেবা করছি!”

কমলেশ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললো, “বেশ মজার কথা বলেছেন আপনি। প্রাইভেট কোম্পানি, সরকারি কোম্পানি, সৎ লোক, অসৎ লোক, এমনকি জালজোচ্চুরির জন্যে যারা ভারতবিখ্যাত, সবাই দাবি করছে যে তারা নেশনের সেবা করছে। খবরের কাগজে স্বাধীনতা দিবসের ক্রোড়পত্র দেখে আমাদের ডিরেক্টর ড. দিগম্বর বনার্জি তো অবাক । একটা চোরা কোম্পানি, যাদের বিরুদ্ধে আমরা লোকঠকানের রিপোর্ট দিয়েছি সিবিআইকে, তারাও বুক ফুলিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছে যে নেশনের সেবা করছে। আবার সেই পাতাতেই লেখা রয়েছে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস কী ভাবে জাতির সেবা করেছিলেন।”

কনকলতা বললো, “নেশনের সেবা আপনি যত ইচ্ছা করুন, কিন্তু আমার বোনের কথাও মনে রাখতে হবে। অগ্নিসাক্ষী রেখে অনেকগুলো প্রতিশ্রুতি কিছুদিন আগে দিয়েছেন!”

সমরেন্দ্রবাবু হাসতে হাসতে মন্তব্য করলেন, “কমলেশবাবু, আমাদের এখন থেকে সাবধান হতে হবে–মেয়েরা এদেশে জেগেছে।

স্বামীকে পরোয়া না করেই কনক বললো, “জাগেনি, তবে জাগছে । ছাদনাতলায় মন্ত্ৰ পড়ে বিনা পয়সায় একটা দিনে-ঝি এবং রাতে-শয্যাসঙ্গিনী যোগাড় করার মজা চিরকাল থাকবে না।”

বোনের বাক্‌চাতুর্যে মল্লিকাও অবাক হয়ে গেলো । মুখ টিপে হাসতে হাসতে বললো, “রিংকি, তোকে আমরা মেয়েদের প্রতিনিধি করে লোকসভায় পাঠাবো ।”

স্বামী এবং ভগ্নীপতিকে শুনিয়ে কনক বললো, “আমাদের অধ্যাপিক এবং লেখিকা সুলোচনা সান্যালের সাম্প্রতিক উপন্যাসটা আপনাদের পড়াবো। সুলোচনা সান্যাল যা বলেছেন, তাতে অনেকের মাথা ঘুরে যাচ্ছে। কিন্তু ভদ্রমহিলা ১১০% খাঁটি সত্য কথা লিখেছেন।”

“আজকালকার বাংলা নভেল পড়া বেশ শক্ত কাজ, রিংকি। তার থেকে সুলোচনা দেবী কী লিখেছে শুনিয়ে দাও।” অনুরোধ করলেন সমরেন্দ্রবাবু ।

স্ত্রী বললেন, “লেখিকা দেখিয়েছেন পতিতাবৃত্তির সঙ্গে এদেশের সাধারণ গৃহবধূর কোনো পার্থক্য নেই। পতিতারা পয়সার জন্য দেহ দেয়, আর এদেশের লক্ষ লক্ষ মেয়ে নিরাপত্তা এবং ভরণপোষণের বদলে স্বামী-দেবতার কাছে দেহ বন্ধক রাখে।”

“সর্বনাশ! এ যে একেবারে বিপ্লব।” এই কথা বলতে যাচ্ছিল কমলেশ। কিন্তু তার আগেই টেলিফোন বেজে উঠলো ।

চন্দনপুর থেকে দিগম্বর বনার্জি ফোন করছেন। অতিথিরা শুনতে পেলো কমলেশ বলছে, “হ্যাঁ স্যার, আপনি চিন্তা করবেন না। এক্স-রে টেস্টে পাইপের কয়েকটা জোড়ে গোলমাল পাওয়া গিয়েছে। সেগুলো আবার ওয়েল্ডিং হচ্ছে। হাইড্রলিক টেস্টিং না করে আমরা এগোচ্ছি না।…. ঠিক আছে, নর্মাল প্রেসারের দেড়গুণ চাপেই আমরা পরীক্ষা করবো।”

আরও যেসব বিচ্ছিন্ন কথা মল্লিকা শুনলো তার মধ্যে ৭ ডিসেম্বর এবং ৩০ নভেম্বর অনেকবার কানে এলো। কারখানা চালু করার তারিখ যে এক সপ্তাহ এগিয়ে আনতে দিগম্বর বদ্ধপরিকর মল্লিকা তা বুঝতে পারছে। কমলেশেরও দোষ আছে। বললেই পারে, তা সম্ভব নয়। দিগম্বর বনার্জি সম্পর্কে ওর কোথাও যে প্রচণ্ড দুর্বলতা আছে তা মল্লিকার কাছে ধরা পড়ে গেছে।

রাত্রে পাশাপাশি ঘরে দুই দম্পতি শুয়েছিল । জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে কমলেশ ও মল্লিকার বিছনায়। মল্লিকা জিজ্ঞেস করলো, “পর্দা টেনে দেবো?”

“থাক না,” কমলেশ বললো। “নতুন বিয়ের সঙ্গে নতুন চাঁদের নিকট-সম্পর্কের কথা সব দেশেই চলে আসছে।” কিন্তু মল্লিকা তেমন উৎসাহ বোধ করছে না। ধর্মপুর থেকে ফিরে ও বেশ পাল্টে গিয়েছে।

কমলেশ বললো, “কলকাতায় কিছু টাকা পাঠাতে হবে, একটু মনে করিয়ে দিও তো।”

মল্লিকা রাজি হলো । তারপর কী ভেবে জিজ্ঞেস করলো, “হ্যাঁগো, তুম কী রকম মাইনে পাও?”

মাইনের পরিমাণ আশানুরূপ নয়। তার থেকে আবার ট্যাক্স, প্রভিডেন্ট ফান্ড বাদ যায়।

মল্লিকার মন খারাপ হয়ে গেলো । এতো লোক যার আন্ডারে কাজ করে, এতো যার দায়িত্ব, তাকে তেমন মাইনে দেয় না এরা।

“তোমাকে কিন্তু ওরা খুব খাঁটিয়ে নেয়।” মল্লিকা আস্তে আস্তে বললো ৷

“সরকারি কোম্পানিতে মাইনে বিশি নয়, মল্লিকা। দিগম্বর বনার্জি নিজেই মাসে তিন হাজারের কম পান।” কমলেশ বললো ।

“রিংকির ধারণা, তুমি কিন্তু অনেক টাকা পাও,” মল্লিকা এবার বলে ফেললো ।

“প্রাইভেট অফিসে মাইনেটা গোপন ব্যাপার, কিন্তু আমাদের এখানে নয়। যে-কেউ খোঁজ করলেই জানতে পারে,” কমলেশ বললো ।

মল্লিকা বললো, “সমরবাবুর বেশ রুচি আছে। ওদের বাংলো দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।”

“যাবো, একবার দেখে আসবো,” কমলেশ আগ্রহ প্রকাশ করে ।

“ঠিক যেন ছবির মতন সাজানো রয়েছে,” মল্লিকা আবার জানালো । “পর্দার কাপড় নাকি কোম্পানি বোম্বাই থেকে স্পেশাল অর্ডার দিয়ে তৈরি করিয়েছে।”

“বিলিতী অফিসে ঐটাই হয়তো ধারা,” কমলেশ বললো, “ইউরোপীয়ানরা সুখে থাকতে না পারলে কেন নিজের দেশ ছেড়ে এই গোবিন্দপুরে আসবে?” কমলেশ স্ত্রীকে বোঝাবার চেষ্টা করে ।

“সমরেন্দ্রবাবু তো আর ইংরেজ নয়। আমি রিংকির ফ্ল্যাটের কথা বলছি,” মল্লিকা বললো ।

“সায়েবদের সমান পদে যারা আছে, তারা ইন্ডিয়ান বলে কী চাকরের মতো থাকবে? স্বাধীন ভারতে সেটা কোনো গভরমেন্ট সহ্য করবে না ঝুমু ।

পাশের ঘরে স্বামীর কাছে সরে এলো রিংকি । তারপর ফিসফিস করে জানতে চাইলো, “তোমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে, তাই না?”

সমরেন্দ্র বললো, “না, তেমন কিছু নয় । আমাদের সুদর্শন চোপরা এক মাসের ছুটি নিয়ে দেশে গিয়েছিল। কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যে পালিয়ে আসতে পথ পেলো না। রাত্রে এয়ারকুলার চালু না থাকলে ওদের ঘুম আসে না।”

রিংকি বললো, “চোপরার আর দোষ কি? রবারের বিছানায় শুয়ে এমন অভ্যেস হয়ে গিয়েছে আমারই অন্য কোথাও রাত কাটাতে অস্বস্তি হয়।”

“মনে করো পিকনিকে এসেছো,” সমরেন্দ্র সান্ত্বনা দেয়।

রিংকি বললো, “গভরমেন্টের নজর বড় নীচু। ঝুমুর বর এতো ব্রাইট, এতো খাটে, ভারত সরকার তবু এদের একটু সুখে রাখবার চেষ্টা করে না।”

সমরেন্দ্র বললো, “আদর্শের নাম করে দিগম্বর বনার্জি ওকে ঠকাচ্ছে। লোকটা পিক্যুলিয়ার ।”

“তোমরা চেনো নাকি?” রিংকি জিজ্ঞেস করে ।

“শোনা যায়, এক সময় দিগম্বর বনার্জি আমাদের অফিসে চাকরির চেষ্টা করেছিল । তেমন স্মার্ট নয় বলে সায়েবরা সিলেকশন করেনি। সেই থেকে ফরেন কোম্পানির ওপর লোকটার জাতক্রোধ। ওকে ‘স্বদেশি’ দিগম্বর বনার্জি বলে ডাকেন আমাদের দিল্লির রেসিডেন্ট ডিরেক্টর দেব সাহেব। লোকটার এতো বড় আস্পর্ধা, বলে কিনা, ব্রিটিশ এক্সপ্লোসিভকেও একদিন চন্দনপুরের কারিগরি বিদ্যে কিনতে হবে।’

স্বামীর বুকের কাছে সরে গিয়ে কনক জিজ্ঞেস করে, “তোমাদের কোম্পানি কী বলছে?”

যুবতী স্ত্রীর উষ্ণ এবং কোমল সান্নিধ্য উপভোগ করতে-করতে সমরেন্দ্র বললো, “ব্রিটিশ এক্সপ্লোসিভ থোড়াই তোয়াক্কা করে ইন্ডিয়াকে। বেশি বেগড়বাই ওরা সিঙ্গাপুরে চলে যাবে । ব্রাজিলে কারখানা খুলবে।”

“বলো কী?” কনক ভয় পেয়ে যায়।

সমরেন্দ্র শয্যাসঙ্গিনীকে আশ্বাস দিলো, “ভয় নেই। কিছুই হবে না। ব্রিটিশ এক্সপ্লোসিভ ধর্মপুরে যেমন আছে তেমন থেকে যাবে। আমরা তো চুরি করছি না, লোক ও ঠকাচ্ছি না–আমরাও তো খেটে খাই। সরকারি কোম্পানির ফড়েগুলোর মুখে বড়-বড় কথা–কাজে অষ্টরম্ভা। যাদের ওপর দায়িত্ব চাপিয়েছে তাদের সুখে-স্বচ্ছন্দে না রাখার বিপদ অনেক!”

“কেন?” আলিঙ্গনশৃঙ্খলে বন্দিনী রিংকি স্বামীর পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে জিজ্ঞেস করে।

“কমলেশের আগে যে ভদ্রলোক এখানকার ম্যানেজার ছিলেন তাঁর নাম নগেন বসু । আমাদের ধর্মপুর ক্লাবেও কয়েকবার বেড়াতে গিয়েছেন। দিগম্বর বনার্জির ডান হাত। দৈত্যের মতো পরিশ্রম করতেন, কিন্তু টাকা পেতেন না! ভদ্রলোক লোভ সামলাতে পারলেন না। ঘুষ খেলেন। ধরাও পড়লেন।”

“অ্যাঁ!” রিংকি একটু ভয় পেয়ে গেলো। “গভরমেন্ট আপিসে সবাই তো ঘুষ খায়, তার জন্যে কেউ ধরা পড়ে নাকি?”

সমরেন্দ্র বললো, “এখন সিবিআই কিছু লোককে ধরে। মিস্টার বসু ইউরোপে বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন । বড় হোটেলে হোস্টেসদের সঙ্গে ফুর্তির লোভ সামলাতে পারেনি। ঠিকাদারের কাছে পয়সা এবং সুযোগ-সুবিধে প্রাইভেট কোম্পানির লোকেরা কম নেয় না। কিন্তু ধরা পড়ে গভরমেন্টের লোকেরা। বাজারে গুজব, কন্ট্রাক্ট না পেয়ে বিরক্ত বিদেশি কোম্পানি নিজেই সিবিআইকে খবরাখবর দিয়েছে ।

পাশের ঘরে মল্লিকা বললো, “ধর্মপুর জায়গাটা বেশ। ব্রিটিশ এক্সপ্লোসিভের অফিসাররা বেশ সুন্দরভাবে আছে।”

কমলেশ স্ত্রীর পিঠে হাত রেখে বললো, “কৃষিনগরও একদিন মাঝারি সাইজের একটা শহর হয়ে উঠতে পারে। যদি আমাদের আবিষ্কারটা শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকে।

“এই আবিষ্কারের পিছনে তোমারও তো অনেক দান আছে?” মল্লিকা জিজ্ঞেস করে ।

“তা বলতে পারো,” কমলেশ উত্তর দেয় । “কিন্তু আজকালকার আবিষ্কার সাধারণত একটা দলের কাজ । সিমফনি অর্কেস্ট্রার মতো, সে-দলের একজন নেতা থাকেন।”

গুঁফো দিগম্বর বনার্জির মুখটা মনে পড়তেই মল্লিকার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো । সেই রাতে ভদ্রলোকের ব্যবহার এখনও পর্যন্ত সে ক্ষমা করতে পারেনি। বনার্জি এমনভাবে কথা বললেন, যেন বউরা স্বামীদের কাজ ভণ্ডুল করে। কমলেশ রায়চৌধুরীর সঙ্গে এই কৃষিনগরে তার নববিবাহিতা বধূ না থাকলেই যেন তিনি সন্তুষ্ট হতেন।

মল্লিকার মনের অবস্থা কমলেশ বুঝতে পারছে। মুখ ফুটে না বললেও ওদের যুগলজীবনে আশাননুরূপ আনন্দ আসছে না, কোথায় যেন ছন্দপতন হচ্ছে, কিছু ত্রুটি থেকে যাচ্ছে। অথচ ভারি মিষ্টি মেয়ে মল্লিকা! ওর কোনো লোভ নেই, স্বামীকে পুতুল করে রাখবার স্বভাব ওর নয়।

ভোরবেলায় আবার হৈ-হৈ আরম্ভ হলো। কনকলতা চোখ রগড়াতে রগড়াতে বোনকে বললো, “পাশের ঘরে সারারাত কপোত-কপোতীর বকুম-বকুম হলে, ঘুম আসবে কী করে?”

লজ্জা পেয়ে গেলো মল্লিকা। কিন্তু বোনের কাছে হার মানলো না। বললো, “ঠিক উল্টো! তোর গুঞ্জনের উৎপাতে চোখের পাতা বোজাতে পারলাম না ।

সমরন্দ্রবাবু হাসতে-হাসতে মনে করিয়ে দিলেন, “ছি ঝুমু, আমরা তোমাদের অতিথি ।”

“আপনি অতিথি–আপনাকে তো কিছু বলিনি। কিন্তু বোনকে ছেড়ে কথা বলবো না ।”

মল্লিকা চায়ের টেবিল গোছাতে গোছাতে বললো, “চিরকাল রিংকির বকবক করা অভ্যেস! মামার বাড়ি গেলে এক বিছানায় শুয়ে সারারাত বকে যেতো ।

““

রিংকি বোনকে সাহায্য করতে-করতে বললো, “বরকে বনবাসে পাঠিয়ে কান্নাকাটি হচ্ছিল, আমি চেষ্টা চরিত্র করে মিলন ঘটিয়ে দিলাম–এখন আমার বিরুদ্ধে বলবিই তো।”

“দুই বোনে এমনভাবে ঝগড়া বাধালে আমাদের বাড়ি ছেড়ে পালাতে হবে,” সমরেন্দ্রবাবু বললেন।

অমনি আপস হয়ে গেলো দুই বোনে । স্বামীর বিরুদ্ধে রণরঙ্গিণী মূর্তি ধরলো কনক । “দড়ি ছেঁড়ার চেষ্টা করে দ্যাখো না। আমাদের এখনও চেনোনি!” এই বলে সে হুমকি ছাড়লো । মল্লিকা বললো, “আমার কর্তাটিরও প্রাণের ইচ্ছা তাই । ওদের অফিসের অনেকেই তো আদিবাসী মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক করে রেখেছেন।”

“সিজ ফায়ার! গোলাগুলি ছোঁড়া থামাও! আমরা ক্ষমা চাইছি।” সমরেন্দ্রবাবুর বিনাশর্তে আত্মসমর্পণে নারীপক্ষ শান্ত হলো ।

এর পরেও সারাদিন হৈ-চৈ চলেছিল । কিন্তু কমলেশ থাকতে পারেনি। কারখানায় গিয়েছিল। তারপর অফিসে। অফিস থেকে আবার কারখানয়, সেখানে জার্মান দুজন কাজ করছেন । সুজাতা দাসই খবর দিয়েছিল, মিস্টার শীলার দেখা করতে এসেছিলেন ।

তরুণ শীলার প্রতিদিনই কোনো এক সময়ে সুজাতার সঙ্গে দেখা করে যায়। জার্মানদের চিঠিপত্তর প্রোজেক্ট ম্যানেজারের ঠিকানাতে আসে। মোটা-মোটা অক্ষরে লুডউইগ রেমার্কের নামলেখা এয়ারমেল খামগুলো সুজাতাই টেবিলের একপাশে রেখে দেয়। ম্যাক্স শীলারের নামে চিঠি কিন্তু বেশি আসে না। অথচ ম্যাক্সই চিঠি সংগ্রহ করতে আসে।

রাজপুত্রের মতো চেহারা ম্যাক্স শীলারের। সাতাশ-আটাশের বেশি বয়স হবে না! সাড়ে ছ’ফুট লম্বা~ইটালিয়ান মার্বেল পাথরের মতো গায়ের রঙ। পাথর থেকে খোদাই করা অলিম্পিক দৌড়বীরের মতো নীটোল ধারালো দেহ।

সুজাতা লক্ষ্য করেছে, মেয়েদের কি করে সম্মান দেখাতে হয় সাহেবরা জানে। করিডরে দুজনের দেখা হয়ে গেলো । শীলার সুপ্রভাত জানালো সুজাতাকে, বিনয়ে মাথা নিচু করলো। তারপর নিজে এগিয়ে এসে সুজাতা দাসের অফিস-ঘরের দরজাটা খুলে দাঁড়ালো ।

চিঠিপত্তরের ভিড়ের মধ্যে দ্রুত চোখ বুলিয়ে একখানা এয়ারমেল খাম তুলে নিলো সুজাতা। তারপর মিষ্টি হেসে সহানুভূতি জানিয়ে বললো, “স্যরি, একখানা মাত্র চিঠি; তাও তোমার বন্ধু মিস্টার রেমার্কের নামে ।“

ইংরিজি ভাষা শীলারের তেমন সড়গড় নয়, অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে সে যা বললো তার অর্থ, “কী করা যাবে! সবাই তো আর লুডউইগের মতো ভাগ্যবান নয়!” কোন সুদূর বিদেশ থেকে বেচারা এসেছে এই ঈশ্বর পরিত্যক্ত কৃষিনগরে যন্ত্র বসাতে। এরা না জানে এখানকার ভাষা, না পারে এখানকার মানুষদের সঙ্গে মিশতে। সুজাতা বললো, “মিস্টার শীলার, “আমি উইশ করছি দেশ থেকে যেন তোমার নামে অনেক মিষ্টি চিঠি আসে।”

ম্যাক্স সহজেই সুজাতার ইঙ্গিত বুঝলো। তারপর হেসে উত্তর দিলো, “অসংখ্য ধন্যবাদ, সুন্দরী মিস দাস ৷ না চাইতেই তুমি নিশ্চয় অনেক চিঠি পাও । তোমার পাওয়া উচিত–তোমার মতো একজন চার্মিং তরুণী ইন্ডিয়ান মহিলা প্রতিদিন এক লেটারবক্স বোঝাই চিঠি পাওয়ার যোগ্য!”

মেয়েদের প্রতি সাহেবদের স্বাভাবিক সৌজন্যবোধ সুজাতা দাসের খুব ভালো লাগে । ইন্ডিয়ানদের এই ভদ্রতা শিখতে আরও দেড়শ’ বছর লেগে যাবে। না-ও শিখতে পারে কোনোদিন। বাঙালি পুরুষদের ওদ্ধত্য দিনদিন বাড়ছে। খাতায়-কলমে সমান অধিকার দিয়েও মেয়েদের স্বাধীনতা এরা মোটেই স্বীকার করে না। মেয়েদের সম্পর্কে ওরা যা বোঝে তা হলো গায়ের রঙ, সৌন্দর্য আর বাপের পয়সা । এই তিনটেই যাদের নেই, সেই সব সুজাতা দাসরা, সহজেই পুরুষমানুষদের অবহেলা এবং অপমান বুঝতে পারে। তার ওপর কোনো সুন্দরী বাঙালি মেয়ের যদি আত্মসম্মান জ্ঞান এবং ব্যক্তিত্ব থাকে, তাহলে তার যন্ত্রণার শেষ নেই ।

সাহেবরা মেয়েমানুষদের মঙ্গলের জন্যে অমুক করেছি তমুক করেছি বলে ঢাক পিটিয়ে ভণ্ডামি করে না। কিন্তু নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সৌজন্যবোধ ওদের কথাবার্তা, চালচলন ও ভাবভঙ্গির অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মেডিক্যাল কোয়ার্টারে বিয়ে–হ্যাংলা নার্সগুলো সুজাতার কথা বিশ্বাস করে না। মাইনে এবং ফ্রি কোয়ার্টারের লোভ দেখিয়ে যদুমধু স্বামী পাকড়াও করতে পেরেই ওরা বর্তে যাচ্ছে । মেয়েগুলো লেখাপড়া শিখে আধুনিকা হয়েও মধ্যযুগের মনোবৃত্তি নিয়ে বসে আছে। একটা বর যোগাড় হলেই ইহকাল পরকালের হিল্লে হয়ে গেলো। সুজাতা সভ্য ইংরেজ সমাজে মিশেছে, কিন্তু কিছু ইংরেজি গল্প-উপন্যাস পড়েছে। যে-বিয়েতে পুরুষ ও নারীর পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নেই তেমন মিলনে রাজি হবার কথা সে ভাবতেই পারে না ।

বর-হ্যাংলা নার্স মেয়েগুলোকে সুজাতা বিদেশিদের গল্প বলে। “সায়েবদের সঙ্গে অনেক কাজ করেছি। ওরা ইন্ডিয়ান পুরুষদের মতো মেয়েমানুষের ক্ষিদেয় সারাক্ষণ জ্বলে পুড়ে মরে না । ওরা মেয়েদের সমান বলে মনে করে । না করেও উপায় নেই, কারণ ওদেশে মেয়েরা পুরুষমানুষের দেওয়া ভাতকাপড়ের থোড়াই তোয়াক্কা করে।” সুজাতা দাস অনেক দেখেছে। দেখে দেখে এখন তার ঘেন্না ধরে গিয়েছে। যে-মেয়েকে বিয়ের কথা ভাবতে পারে না, সুযোগ পেলে ফুসলে ফাসলে তারই সর্বনাশ করবার জন্যে এদেশের ছোকরাগুলো সবসময় উঁচিয়ে আছে। এদেশের পুরুষমানুষদের সঙ্গে সুজাতার কথা পর্যন্ত বলতে ইচ্ছে করে না ।

অফিসে ফিরে এসে কমলেশ অনেকগুলো কাগজপত্র দেখলো। তারপর চন্দনপুরের সঙ্গে ফোনে মিনিট দশেক কথা বললো। দিগম্বর বনার্জির সঙ্গে এই সময় বিস্তারিত আলোচনা হয় ।

কমলেশ সম্পর্কে সুজাতার কোনো অভিযোগ নেই ভদ্রলোক আদর্শবাদী এবং কাজকর্ম বোঝেন । অমানুষিক খাটতেও পারেন কিন্তু খাটছেন বলে মেজাজ বিগড়ে থাকে না, সর্বদা হাসিমুখ। কমলেশের মঙ্গল হোক, এই কারখানা চালু করে দিয়ে আরো উন্নতি করুন তা সুজাতা মনেপ্রাণে চায় ৷

সুজাতা বুঝতে পেরেছে, কমলেশ প্রাণখোলা মানুষ । আসবার পর দু-একবার সুজাতাকে সে বাড়িতেও যেতে বলেছে, বিশেষ করে মল্লিকা এবং সুজাতা যখন একই স্কুলের ছাত্রী । সুজাতা কিন্তু এড়িয়ে গিয়েছে। যে মল্লিকা ইস্কুলে তার থেকে জুনিয়র ছিল, বিয়ের ম্যাজিকে সে এখন সুজাতার সিনিয়র । সুজাতা দাস এখন সামান্য একজন স্টেনো, আর মল্লিকা তার সায়েবের বউ । যিনি সুজাতার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, তাঁর মাথাটাই একরত্তি মেয়েটার কাছে বাঁধা।

সুজাতা জানে মল্লিকার সঙ্গে এখন সে সমানভাবে মিশতে পারবে না । মল্লিকা যদি ওপরের মহলে মিশে একেবারে অমানুষ না হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে সেও চক্ষুলজ্জায় ভুগবে এবং অস্বস্তি বোধ করবে।

সিঁদুরের অলৌকিক শক্তি দেখে সুজাতা মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যায়। স্কুলে যে ছোট মেয়েটাকে সুজাতা একদিন শাসন করেছে, সিঁথিতে সিঁদুর চড়িয়ে সে-ই এখন সুজাতার অনেক ওপরে উঠে গেলো। সাধে কি আর এদেশের সমস্ত মেয়েমানুষ এতো অত্যাচার এবং অপমান সত্ত্বেও সিঁদুরের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে!

কমলেশের গলার স্বর শুনতে পেলো সুজাতা। “মিস দাস, আমার বাড়িতে একটু লাইন দেবেন?”

লাইন ট্যাপ করে সুজাতা দু-একবার নববধূর সঙ্গে কর্তার কথাবার্তা শুনেছে । কিন্তু যা আন্দাজ করেছে তাই । ইন্ডিয়ান পুরুষমানুষদের মধ্যে প্রেম জিনিসটা নেই। কমলেশ রায়চৌধুরীও বউকে শুধু স্তোকবাক্য দিয়ে ভুলিয়ে রাখতে চায় ।

কমলেশ ফোনে বউকে জানালো জার্মানদের সম্পর্কে তার একটু দুশ্চিন্তা ছিল। কিন্তু তাদের কাজও প্রায় শেষ । একজনকে রেখে দ্বিতীয় জার্মান এবং পাঁচজন জাপানি কয়েকদিনের মধ্যে কৃষিনগর ছেড়ে চলে যাবে। কমলেশের ইচ্ছে ওদের একদিন আপ্যায়ন করে ।

মল্লিকা উৎসাহভরেই রাজি হলো। কমলেশ জানতে চাইলো সেই সঙ্গে সুদর্শনবাবু ও তাঁর স্ত্রী এবং সুজাতা দাসকে বলবে কিনা ।

“ভালোই তো বলো না,” মল্লিকা জানালো ।

১২

শনিবার রাত্রেই কনক এবং সমরেন্দ্রবাবু নিজেদের গাড়িতে ধর্মপুরে ফিরে গিয়েছিলেন।

একটা দিন তবু মল্লিকার মন্দ কাটলো না। রিংকি যতই মুখরা হোক, ওর প্রাণচাঞ্চল্য আছে। নবযৌবনের অস্থির আনন্দ সে অপরের মধ্যে ছড়িয়ে বেড়ায়। নিজেও আনন্দ খুঁজে নিতে জানে। যাবার আগে সে বোনকে বলেছিল, “গুডি গুডি মেয়েদের যুগ চলে গেছে ঝুমু। শরৎবাবুর নভেলের নায়িকা হলে এ-যুগে ফ্যাসাদে পড়তে হবে। তুই হাত গুটিয়ে বসে থাকবি না। স্বামীকে নিজের বিদ্যেবুদ্ধি মতো চালাবি।”

পুরুষ-পরিচালনায় অনভিজ্ঞ ও দুর্বল মল্লিকা হতাশভাবে হেসেছিল। ওর চিবুক নেড়ে দিয়ে কনক বলেছিল, “পুরুষমানুষের মাথা খাবার মতো চেহারাটি তো করেছিস, কিন্তু ফোঁস নেই কেন? পাওনা আদায় করতে হয়, কেউ নিজে থেকে দেয় না। বরকে সোজা বলবি কৃষিনগরে তাজমহলই বানাও আর পিরামিডই গড়ো, বউকে কিছুটা সময় দিতে হবে এবং ভালোবাসতে হবে।

মল্লিকার দাবি করতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু কিছুতেই বোনের মতো মুখ খুলতে পারে না । রিংকির স্বভাবে যেমন মিষ্টতা আছে, তেমনি বোতল থেকে সদ্যঢালা কোকাকোলার মতো কামড়ও আছে। রিংকি যেখানে যায় সেখানে সবাইকে চাঙ্গা করে তোলে। আর মল্লিকা বেচারা ভয়েতেই অস্থির। মুখ ফুটে নিজের ন্যায্য পাওনাটুকু চাইতেও লজ্জা পায় ।

কিন্তু তার থেকে বড় কথা বিয়ে সম্বন্ধে মল্লিকার ধারণা পাল্টে যাচ্ছে। সিঁথিতে সিঁদুর পরেই অনেক মেয়ে কেমন আনন্দের হাটে হারিয়ে যায়, অথচ সে পারছে না। নিঃসঙ্গ দুপুরে মল্লিকা চিঠি লেখে । বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ী, সুতপা মাসি সবাইকে বড়-বড় চিঠি পাঠায় । বাবা, মা এবং কমলেশের বাবা ছোট-ছোট উত্তর দেন। সুতপা মাসি রসিয়ে রসিয়ে সুদীর্ঘ চিঠি লেখেন, নানা অন্তরঙ্গ অথচ অস্বস্তিকর প্রশ্নের উত্তর চান। তার কৌতূহল মিটিয়েও মল্লিকার হাতে অনেক সময় পড়ে থাকে। হাতের কাছে যত পত্র-পত্রিকা এবং বই আছে তা পড়ে, যত কাজ আছে তা শেষ করে, যত ভাবনা আছে তা ভেবেও অনেক সময় পড়ে থাকে । শুয়ে কিংবা বসে মল্লিকাকে তখন চুপচাপ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। ঘড়িটা বোধহয় সব বোঝে, গৃহবধূকে অধৈর্য হতে দেখলেই নিজের গতি কমিয়ে দেয়, শুধু টিক টিক আওয়াজ হয় কিন্ত কাঁটাগুলো এগোয় না অন্তহীন এই প্রতীক্ষাপর্বে মল্লিকার ভয় ধরে যায়। সুতপা মাসি লিখেছেন, যুগল-জীবনের প্রথম বছরটা চোখের পলকেই ফুরিয়ে যায় । কিন্তু দুপুরবেলায় মল্লিকা যেমনভাবে স্বামীর জন্যে অপেক্ষা করে তেমনভাবে ত্রিশ দিন গেলে তবে একমাস হবে । এমনি বারোটা মাস সহ্য করতে পারলে তবে তো এক বছর।

কমলেশের আর কী! কৃষিনগর সফল হলে, হলদিয়া না কোথায় যাবার পরিকল্পনা আছে; কিংবা বিশাখাপত্তনম। সেখানে এর থেকে শতগুণ বড় কারখানা তৈরি হবে । বিশাখাপত্তনম শেষ হলেও ছুটি নেই। আরো অনেক জায়গায় ততদিন সার কারখানার পরিকল্পনা হবে। সেইসব জায়গায় কাজপাগল কমলেশ রায়চৌধুরীদের প্রয়োজন হবে। স্বামীর জন্যে অপেক্ষা করতে-করতে মল্লিকা একদিন আবিষ্কার করবে সে বুড়ি হয়ে গিয়েছে–যার জন্যে এতো অস্থিরতা, এতো উত্তেজনা এবং উত্তাপ সেই যৌবন কখন নিঃশব্দে বিদায় নিয়েছে। দেহের মালিক পর্যন্ত জানতে পারেনি।

কমলেশ এসব ভাববার সময় পাচ্ছে না। কৃষিনগরের জটিল দায়িত্ব ক্রমশ তাকে গ্রাস করেছে। অ্যামোনিয়া প্ল্যান্ট চালু করে সাহসও বেড়ে গিয়েছে। একেবারে অঙ্কের মতো স্টার্ট আপ হলো! মাত্র একুশ দিনে ওরা যা করলো, ভারতবর্ষে আগে ত কখনো হয়নি, একথা দিগম্বর বনার্জি নিজেই জানালেন ।

দিগম্বর বনার্জি একবার নিজে তাঁর সাধের অ্যামোনিয়া প্ল্যান্ট দেখতে আসবেন আশা করছিল কমলেশ। কিন্তু আকজাল চন্দনপুরের বাইরে তিনি বিশেষ যেতে চান না। কথায় কথায় বিনা নোটিশ যিনি প্ল্যান্টে হাজির হতেন, তিনি এখন টেলিফোনেই কাজ সারেন । তবে টেলিফোনে কথা বলেও খুব উৎসাহ পেয়েছে কমলেশ। বনার্জি বলেছিলেন, “বুড়োদের কাছ থেকে আমি কিছু প্রত্যাশা করি না, কমলেশ। ছোকরাদের যদি আশা-আকাঙ্ক্ষা থাকে তবেই এদেশ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। শুধু মিছিল করে এবং শ্লোগান তুলে কোনো দেশের দুঃখ দূর হয় না। কমলেশ, তোমরা হাতে-কলমে দেখিয়ে দাও, দেশকে বড় করতে হলে কল-কারখানায় জিনিসপত্তর এবং ক্ষেতখামারে ফসল ফলাতে হবে।

কমলেশ শুনেছে, অনেক লোককে ডিঙিয়ে তাকে কৃষিনগরের দায়িত্ব দেওয়ায় কোনো কোনো মহলে বনার্জি সায়েবের বিরুদ্ধে মৃদু গুঞ্জন উঠেছিল । তাঁরা কমলেশের কম বয়সের কথা তুলেছিলেন। বনার্জি কিন্তু তোয়াক্কা করেননি। সোজা বলেছিলেন, “লে ব্লাঙ্ক যখন অ্যালকেলি তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন, তখন কত বয়স ছিল তাঁর? ছাব্বিশ বছর বয়সে আইনস্টাইন কেন আপেক্ষিকতত্ত্বের কাজ শুরু করেছিলেন? ডারউইন যখন বিবর্তনবাদের সন্ধান করেছেন তখন কেন তাঁর বয়স মাত্র সাতাশ? মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে জেমস ওয়াট স্টিম ইঞ্চিনের রহস্য উম্মোচনে হাত দিয়েছিলেন। তখন কথা ওঠেনি কেন? স্যামুয়েল কোল্ট একুশ বছর বয়সে কীভাবে রিভলবারের পেটেন্ট নিয়েছিলেন?”

বয়সের ব্যবধানে বিশ্বাস করেন না বনার্জি । তিনি শুধু বলেন, “বিজ্ঞানের এই নবযাত্রাকে তোমরা চাকরি হিসেবে নিও না। চাকরির সঙ্গে আমাদের দেশে চাকরের মনোবৃত্তি মিশে থাকে। ভারতবর্ষের ভালো-ভালো ছেলেরা সবাই যদি নির্ঝঞ্ঝাট চাকরি চায়–তাহলে বিজ্ঞান এক-পা এগোবে না।”

কমলেশ বুঝতে পারে, বনার্জি যা বলেছেন তার মধ্যে অনেক সত্য রয়েছে। হাজার হাজার বিজ্ঞানী এবং ডজন-ডজন গবেষণাগার থাকা সত্ত্বেও আমরা নির্লজ্জের মতো পরনির্ভর হয়ে রয়েছি। বিদেশের উচ্ছিষ্ট কারিগরি বিদ্যা দিয়ে আমরা দেশে শিল্পবিপ্লব আনবার অলীক স্বপ্ন দেখছি।

কমলেশের মনে আছে চন্দনপুর ল্যাবরেটরিতে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে দিগম্বর বনার্জি একদিন ভীষণ রেগে উঠেছিলেন। চিৎকার করে বলেছিলেন, “কমলেশ, দেশটার কী হলো? শার্ট, জাঙিয়া, বডিস, পেনের কালি, পাউডার, স্নো তৈরির জন্যেও বিদেশ থেকে আমরা কারিগরি বিদ্যে আনাচ্ছি–আবার গর্ব করে সেগুলো বিজ্ঞাপন দিয়ে লোককে জানাচ্ছি।”

“এসব সামান্য ব্যাপার,” দিগম্বর বনার্জিকে শান্ত করবার জন্যে কমলেশ বলেছিল । “মোটেই সামান্য ব্যাপার নয়, কমলেশ।” বিরক্ত দিগম্বর বনার্জি জানতে চেয়েছিলেন, “জাপানিদের কথা আমাদের খবরের কাগজে ফলাও করে বেরোয় না কেন বলো তো? ওদের প্রাকৃতিক সম্পদ নেই, নিজেদের বাজারও নেই। বাইরে থেকে লোহা আনিয়ে পেট্রল কিনেও বড়-বড় দেশকে নাস্তানাবুদ করেছে।”

দিগম্বর বনার্জির ধারণা, জাপান যা পারে আমরা তার দশ গুণ ভালো পারবো — যদি আমাদের বিজ্ঞানীরা একটু আত্মনির্ভর হয়; যদি আমাদের কমবয়সী গবেষকরা দশটা বছর মনে করে তারা চাকরি করছে না, দেশের প্রতি অবজ্ঞা অপমান অত্যাচারের উত্তর দিচ্ছে।

একটু থেমে বনার্জি বলেছিলেন, “আমি বুঝি, দেশসেবা কথাটা স্বাধীন ভারতবর্ষে বড় সস্তা হয়ে গিয়েছে। ঠিক আছে, দেশসেবা কোরো না, কিন্তু বিজ্ঞান এবং টেকনলজির সেবা করো। বিজ্ঞানের অলিম্পিক দৌড়ে সামান্য পুঁজি এবং সামান্য অভিজ্ঞতা নিয়েও যে বাঘা-বাঘা জাতদের কাছাকাছি যাওয়া যায় তা দেখিয়ে দিক আমাদের ছেলেরা।

সুতপাদি বলতেন, “ভদ্রলোকের মস্তিষ্কে বোধহয় দু-একটা স্ক্রু আলগা আছে। স্বনির্ভরতার মন্ত্র এমন জপতে লাগলেন যে বউ ওঁর ওপর নির্ভুল করতে পারলো না। পালিয়ে বাঁচলো।” দিগম্বর বনার্জি মাঝে-মাঝে আরও বড় কথা তোলেন। কবে কোন দূর শতাব্দীতে প্রাচ্যের মানুষ আমরা পৃথিীতে কয়েকটা বৈজ্ঞানিক সত্য উপহার দিয়েছিলাম । অঙ্কে শুন্য আবিষ্কারের গৌরব নাকি আমাদের। রসায়নও আমরা শুরু করেছিলাম। আমাদের দেশ থেকে সেসব আবিষ্কার আরব দেশে চালান হলো। আরব দেশ থেকে ইউরোপীয়রা সেই জ্ঞান নিয়ে গেলো স্বদেশে। তারপর উর্বরতার কী বিচিত্র উৎসব। পশ্চিমী জগতে বিজ্ঞানের নবজন্ম হলো। এবং তখন থেকে আমরা শুধু নিয়েই চলেছি । নির্লজ্জ বেহায়ার মতো আমরা পশ্চিমের বিদ্যে গ্রহণ করছি; কেউ প্রশ্ন করলে বলছি, আমরা এতোদিন পরের অধীনে ছিলাম, আমরা কী করবো? আমাদের নাকি পুঁজি নেই, যন্ত্রপাতি নেই । এসব কথা আমার আর শুনতে ইচ্ছে করে না, কমলেশ । পৃথিবীকে আমাদের কিছু দেবার সময় এসেছে। অন্যলোক না বুঝুক, আমাদের দেশের শিক্ষিতদের লজ্জাবোধের যথেষ্ট কারণ আছে।

কথাগুলো ভাবলে কমলেশের মনেও ঘেন্না আসে । আমাদের দেশের লোকেরা দারিদ্র্যের দোহাই দিয়ে দু’শ বছর পিছিয়ে থাকবে; জনসংখ্যা বাড়িয়ে চলবে; আর আমরা শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা বড়-বড় শহরে পায়ের ওপর পা তুলে সুখভোগ করবো; বড়জোর একটু রাজনীতি করবো; আর বিদেশের বৈজ্ঞানিকরা জনসমস্যা, খাদ্যসমস্যা, স্বাস্থ্যসমস্যার সমাধান করবে এটা আত্মসম্মানে লাগারই কথা। বিদেশের ল্যাবরেটরিতে ডিডিটি আবিষ্কার হলো, আমরা ম্যালিরিয়া মুক্ত হলাম, বিদেশের ল্যাবরেটরিতে পেনিসিলিন আবিষ্কার হলো, আমাদের মৃত্যুদিন পিছিয়ে গেলো, বিদেশের ল্যাবরেটরিতে ইউরিয়া বার হলো, আমরা পেটের জ্বালা থেকে বাঁচবার পথ খুঁজে পেলাম! এসব কতদিন চলবে? এই নির্লজ্জ নির্ভরতা কোনো আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন জাতের পক্ষে স্বাস্থ্যকর নয় ৷

কিন্তু কে এর বিহিত করবে? ভারবর্ষের শিক্ষিত মানুষেরাই তো সবচেয়ে বেশি নেবার জন্যে উঁচিয়ে আছেন । তাঁরাই তো সবচেয়ে বেশি পরনির্ভর। বিজ্ঞানের যা-কিছু আশীর্বাদ তাঁরাই ভোগ করেন । অজস্র গ্রামবাসী এখনও বিদ্যুৎ কাকে বলে জানে না । একমাত্র এই কৃষি সারের সংবাদ গ্রামে পৌঁছেছে। চাষীরা এখন রাসায়নিক সারের মূল্য বুঝতে আরম্ভ করেছে।

কমলেশের চিন্তায় বাধা পড়লো । মল্লিকা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছে । স্বামী গভীর কোনো বৈজ্ঞানিক সমস্যার সমাধান করছে ভেবে এতোক্ষণ সে জ্বালাতন করেনি।

হাতের গোড়ায় কয়েকটা নুড়ির মতো জিনিস নিয়ে খেলতে খেলতে কমলেশ বউয়ের দিকে তাকালো । মল্লিকা বেচারা মুখ ফুটে কিছু বলে না। রিংকির মতো মুখরা হলে ভালো হতো কমলেশের পক্ষে। বুঝতে পারতো কোনদিকে ওর মন যাচ্ছে। ও শুধু শান্ত হয়ে চুপচাপ বসে থাকে ।

মল্লিকার দিকে আবার তাকালো কমলেশ। তারপর জিজ্ঞেস করলো, “কী ভাবছো?”

“কই? ভাবছো তো তুমি।” মল্লিকা উত্তর দেয় ।

মল্লিকা শান্ত হয়ে গেলো। কমলেশ বললো, “আমি ভাবতে চাই না মল্লিকা। কিন্তু ভাবনাগুলো আমাকে ঘিরে ধরে।”

টেলিফোন বেজে উঠলো । কারখানা থেকে কেউ ফোন করেছে। এই এক মুশকিল ৷ স্বামীকে বাড়িতেও ঠিকমতো পাওয়া যায় না । সময়ে অসময়ে টেলিফোন বেজে চলেছে । কমলেশের যেন বিশ্রামের প্রয়োজন নেই; প্রোজেক্ট ম্যানেজারের যেন ঘরসংসার নেই ।

পনেরো মিনিট ধরে টেলিফোনে কী সব কথাবার্তা বলে কমলেশ আবার মল্লিকার সামনে এসে বসলো। বিরক্তভাবে বললো, “অ্যামোনিয়া রিকভারি ডিপার্টমেন্টে একটা মেশিন চালিয়ে দেখার কথা ছিল । কিন্তু যন্ত্র চালালেই অস্বাভাবিক আওয়াজ হচ্ছে, সেই সঙ্গে ভিত পর্যন্ত নড়ছে। আমি বললাম, ডায়াল গেজ দিয়ে অ্যালাইনমেন্ট চেক করতে।”

অফিসের অত খুঁটিনাটি শোনবার কোনো আগ্রহ নেই মল্লিকার । বিরক্তি চেপে রেখে সে গম্ভীর হয়ে রইলো । মল্লিকার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে কমলেশ বললো, “দুজন ছোকরা ইঞ্জিনিয়ার মেশিন বসাচ্ছে। কোনো অভিজ্ঞতা নেই, তাই ভয় পেয়ে ফোন করছিল।

কথা শেষ হতে-না-হতে আবার ফোন বেজে উঠলো । লিক টেস্টিংয়ের ইনচার্জ মিস্টার দাস ফোন করেছেন। বিভিন্ন প্রেসার সারকিটে কিছু অ্যামোনিয়া ঢুকিয়ে ওরা পরীক্ষা করে দেখছে! দু-একটা পাইপের জোড়ের মুখে সন্দেহ জাগছে। কমলেশ বললো, “আগে তো কথাই ছিল হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড দিয়ে জোড়গুলো আমরা পরীক্ষা করবো।”

স্ত্রীর কাছে আবার ক্ষমা চাইলো কমলেশ। বললো, “জানো মল্লিকা, এই যে আমরা কারখানা চালু করবার আগে ছোটখাটো খুঁতগুলো খুঁজে বার করছি, এতে আসল সময়ে কাজ কমে যাবে।”

স্বামীর কথা মল্লিকা শুনলো, কিন্তু বিশ্বাস করলো কিনা সে সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ রয়ে গেলো কমলেশের মনে।

মল্লিকা জিজ্ঞেস করলো, “এখানে তোমার কোনো বন্ধু নেই? এতো ফোন আসে, কিন্তু কেউ তো তোমার সঙ্গে গল্পগুজব করে না।”

“বন্ধু বলতে তুমি, মল্লিকা। আর সবার সঙ্গে হয় স্বার্থের, না-হয় কাজের সম্পর্ক । আমি এদের থেকে বেশি জানি বলে নয়; ওদের থেকে আমার চাকরি উঁচু বলে ৷ তাছাড়া ওরা ভয় পায়। ভুল হলে দায়িত্ব কে নেবে?”

“তার মানে, যত দায়িত্ব সব তোমার? কিছু গোলামল হলে তোমার ঘাড়ে দোষ চাপবে?” মল্লিকা একটু ভয় পেয়ে যায়। ব্যাপারটা মোটেই পছন্দ হচ্ছে না তার।

“তাই তো নিয়ম ঝুমু। যারা সাধারণের থেকে বড় হতে চায়, তারা অনেক বেশি কষ্ট পায়,” কমলেশ ইতিহাসের একটা সাধারণ সত্য স্ত্রীকে মনে করিয়ে দিলো।

মল্লিকা ভাবছে ধর্মপুরে রিংকিদের সংসারের কথা । ওখানকার কোম্পানিও তো এতদিন বিস্ফোরক দ্রব্য তৈরি করে এসেছে। ধর্মপুরের কাছে বিরাট ফার্টিলাইজার কারখানা ওরাও তো তৈরি করেছে। কিন্তু সেখানে তো একজনের ওপর এমন নির্ভরতা নেই–সেখানে লোক অনেক বেশি নিশ্চিন্ত এবং স্বাধীন । তারাও খাটছে, কিন্তু একজন খেয়ালি ভদ্রলোকের নির্ধারিত দিন রাখতে গিয়ে ওখানকার বিজ্ঞানীরা নিজেদের ঘরসংসার ভাসিয়ে দিচ্ছে না ।

কমলেশ নিজেও ঝুমুর সঙ্গে গিয়ে কিছুদিন আগে কনকলতার সংসার দেখে এসেছে । নতুন ভগ্নীপতিকে রিংকি খুব আদর-যত্ন করেছিল। বলেছিল, “এতো কাছাকাছি বোন ভগ্নীপতি থেকে লাভ কী হলো?”

“এই তো এলাম আমরা,” কমলেশ বলেছিল ।

“কিন্তু কত সাধ্যসাধনার পরে? এর মধ্যে আমাদের তো ছ’-সাতবার যাওয়া হয়ে গেলো,” রিংকি বলেছিল ।

“ওরে বাবা, আপনি এতো হিসেব রাখেন?” কমলেশ বিস্ময় প্রকাশ করেছিল ।

“গোমস্তার বউ আমি কেন হিসেব করবো না!” রিংকি জবাব দিয়েছিল ।

“স্বামীর পেশার কথা তুলবেন না, তাহলে আপনার বোনকে রসায়ন জানতে হবে,” কমলেশ বলেছিল ।

“হবে মানে? আমাকে একলা পেলে ঝুমু তো লেকচার দিয়ে কান ঝালাপালা করে! আপনার ক্যাটালিস্ট, নিজের বউ থেকে যাকে বেশি ভালোবাসেন, শুনেছি তার কথা । ঝুমু বলেছে, দিগম্বর বনার্জির ইউরিয়া তৈরির নতুন পদ্ধতির কথা, যার ফলে ভদ্রলোকের বউ পর্যন্ত পালিয়ে গেলো।’

“এই জন্য বউ পালায়নি। তার আগেই বোধহয় কিছু গোলযোগ হয়েছিল,” বোনের বক্তব্য সংশোধন করলো ঝুমু ।

কমলেশকে রিংকি বললো, “খোঁজ করে দেখুন, এই জন্যেই হবে। আপনারা জানবার আগে এই মহিলা নিশ্চয়ই দিগম্বর বনার্জির আবিষ্কারের ঠেলা সামলেছেন।”

হাসলো কমলেশ । রিংকি বললো, দিগম্বর বনার্জির সাহসিনী পাঞ্জাবি বউ ছিল । নিজের বউ দুর্বল বাঙালি বলে আপনি ওভারকনফিডেন্ট। ভাবছেন সে পালাতে পারে না।”

“বলতো একটু,” বোনকে সমর্থন করেছিল মল্লিকা ।

রিংকি ঠাণ্ডা ড্রইংরুমে বসে বোনের স্বামীকে বলেছিল, “শুধু কেমিস্ট্রির বই পড়ে এ-যুগে বউ সামলানো যায় না, রায়চৌধুরী মশাই। দু-চারটে মনস্তত্বের বই, দু-চারটে নভেল এবং মাঝে-মাঝে এক-আধটা সিনেমা দেখতে হয়। দেখবেন, স্বামীকে ত্যাগ করে যেসব বউ পালিয়েছে তারা অভাবের তাড়নায় যায়নি। অনেকক্ষেত্রে স্বামীরা তাদের সোনারুপোয় মুড়ে রেখেছিল, কিন্তু সান্নিধ্য দেয়নি। যেখানে এই গোলমাল থাকে সেখানেই নভেল লেখার সুযোগ এসে যায় ।

“আমাদের নিয়ে তুই গল্প লিখবি নাকি, রিংকি?” মল্লিকা জানতে চায় ৷

কমলেশ বললো, “বেশ সুন্দর আরম্ভটা হয়। তরুণ বিজ্ঞানীর সুন্দরী নববিবাহিতা স্ত্রী মধুযামিনী যাপনের জন্যে স্বামীর কর্মক্ষেত্রে এলো । স্বামী তাকে ভালোবাসে, কিন্তু কাজকে আরও ভালোবাসে । তারপর…”

রিংকি বললো, “বেশ তো গুছিয়ে প্লট ভাঁজতে শিখেছেন। নভেলটা আপনিই শেষ করুন। বউকে এরপর কোথায় নিয়ে যাবেন?”

“তুই তো লিখবি?” মল্লিকা বোনকে মনে করিয়ে দিলো ।

“আমি কোন দুঃখে লিখতে যাবো? আমার বর রয়েছে, তাকে সামলাতেই আমার জান যাচ্ছে! আমার কর্তার মতো বর থাকলে আগাথা ক্রিস্টির মতো বহুপ্রসবিনী লেখিকা একখানা নভেল শেষ করতে পারতেন না ।

“সমরদা বুঝি অফিস থেকে ফিরেই প্রেমালাপ করতে চায়?” মল্লিকা মুখ টিপে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করেছিল ।

“তা নয়। কিন্তু নিজের কোনো কাজ করবে না । নিজের গেঞ্জি পর্যন্ত কোথায় রাখতে হবে জানে না–অথচ এই লোক বিলেতে পাঁচ বছর একলা থেকে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হয়েছে। তার উপর পেটুক । বউ রান্নাঘরে না ঢুকলে মন ভরে না । এ ছাড়া ধর্মপুরে পার্টি লেগেই আছে।”

“সন্ধেবেলায় পার্টিতে গেলে তোর ঘরসংসার কে দেখে?” মল্লিকা জিজ্ঞেস করেছিল।

রিংকি বললো, “কোম্পানি সেখানে মুখ বন্ধ করে রেখেছে। আমাদের জন্যে একটা চাকর, একটা মালি, একটা বাবুর্চি এবং একটা জমাদার দিয়েছে।”

মল্লিকা অবাক হয়ে গিয়েছিল । রিংকি বললো, “একটু সুখের মুখ না দেখলে, বিলেত থেকে লেখাপড়া শিখে কে গোবিন্দপুরে জীবন কাটাবে ভাই?”

“ওদের হেডঅফিস থেকে স্টাফ ম্যানেজার এসেছিল । আমরা বলেছি, ধর্মপুরে কী রকম ধুলো নিজের চোখে দেখে যান। একটা জমাদারের পক্ষে এই বাড়ি পরিষ্কার রাখা সম্ভব? গুজব শুনেছি, আর একটা করে সুইপার স্যাংশন হবে।”

সমরেন্দ্রবাবু বললেন, “হয়ে যেতো, কিন্তু গভরমেন্ট আজকাল বাগড়া দিচ্ছে। বিদেশি কোম্পানি স্টাফদের যা দিচ্ছে তা দিতে দাও না হলে ওদের লাভ বাড়বে, দেশ থেকে আরও টাকা বাইরে চলে যাবে। দিল্লিতে যাদের কাছে আমাদের কেসগুলো যায় তাদের বুক জ্বলে যায় । ডাল রুটি খেতে-খেতে অন্য লোকের পরোটা আলুচচ্চড়ি স্যাংশন করতে ইচ্ছে হয় না, তাই যতটা পারে কেটে দেয় । আমাদের কথা–তোমরাও সৎপথে থেকে কাজ করো, লুচি মাংস খাও, আমরা মোটেই হিংসে করবো না, বরং খুশি হবো ।”

সমরেন্দ্রবাবুর প্রতিবেশী তরুণ বিজ্ঞানী ডক্টর অমিতাভ সেন এই সময় ওদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। অমিতাভ সেনের স্ত্রী ইংরেজ। ভদ্রলোক অনেকদিন বিদেশে ছিলেন । অমিতাভ সেন চিন্তিতভাবে বললেন, “দিল্লির আইসিএস এবং আইএএস সোস্যালিস্টরা এদেশের সর্বনাশ না করে ছাড়বে না । নিজেদের মাইনে না বাড়লে অন্য কাউকে তারা সুখে থাকতে দেবে না। এদের সঙ্গে তর্ক করেও পারবেন না, কারণ প্রত্যেক কথায় আপনাকে আসমুদ্রহিমাচলের কোটি-কোটি আধপেটা গরিবদের দেখিয়ে দেবে। আরে বাবা, গরিবদের জন্যে যদি এতোই দুঃখ তাহলে তোমরা যা পাচ্ছ তাও তো নেওয়া উচিত নয় । গাড়ি চড়ছ, বড় বাড়িতে থাকছ, প্রতি মাসে রেভিনিউ স্ট্যাম্পের ওপর সই লাগিয়ে তিন-সাড়ে-তিন হাজার পকেটে পুরছ, অশোকা হোটেলে ডিনার খেতে-খেতে দেশসেবা সম্পর্কে সেমিনার করছ, কথায় কথায় বিলেত আমেরিকা যাচ্ছ, তাতে সমাজতন্ত্রের ক্ষতি হচ্ছে না! কিন্তু যারা ঘরের খেয়ে বিদেশ থেকে টেকনলজি আয়ত্ত করেছে, মাথা ও গতর খাঁটিয়ে দেশে নতুন নতুন জিনিস উৎপাদন করছে, অথচ দু-নম্বর টাকায় ভল্ট বোঝাই করছে না, দু-খানা খাতা রাখছে না, যারা নিজেদের যোগ্যতা দেখিয়ে ধুরন্ধর মালিকদের কাছ থেকে ভদ্রস্থ মাইনে আদায় করছে তারাই পাপী । আজ এই ধর্মপুরে কিছু গোলমাল হোক তখন ব্রিটিশ এক্সপ্লোসিভ কোম্পানি আমাদের সবাইকে ঘাড় ধাক্কা দেবে, কোম্পানির লাভ কমুক আমাদের অর্ধেক লোকের চাকরি যাবে। কিন্তু দিল্লির মাস-মাইনের সোস্যালিস্টদের জন্য অন্য ব্যবস্থা। দেশের সব স্কুল বন্ধ হয়ে গেলেও শিক্ষাসচিবের মাইনে বাড়বে, এক পয়সা রপ্তানি না হলেও বিদেশ-বাণিজ্যসচিবের পদোন্নতি হবে।’

অমিতাভ সেন বললেন, “কিছু মনে করলেন না তো?”

“মনে করার কি আছে? দেশটা তো আমাদের সবারই। সুতরাং সবাইকে ভেবে-চিন্তে পথ বার করতে হবে,” কমলেশ উত্তর দিলো ।

অমিতাভ সেন দুঃখ করে বললেন, “ভারতবর্ষকে আমরা এক অদ্ভুত জগাখিচুড়ি অবস্থায় এনে ফেলেছি, ডক্টর রায়চৌধুরী। সর্বঘটে কাঁঠালি এই আইসিএস এবং আইএএস আমলাদের নেতৃত্বে আমরা জাপান কিংবা পশ্চিম জার্মানি হতে পারবো না; চীন অথবা রাশিয়ার ও নাগাল পাবো না ।

“এই দোটানায় পড়ে সবচেয়ে ঠকছে দেশের অসহায় গরিব মানুষ। আমাদের মতো টেকনোক্রাটদের আর কী? স্বদেশে অসুবিধে হলে কানাডায়, জার্মানিতে এখনও দরজা খোলা আছে।”

কমলেশ শুনলো, অমিতাভর ‘হবি’ আছে। শবি-রবিবারে সে ছবি আঁকে, বউয়ের সঙ্গে ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল সংগীতের চর্চা করে । অথচ কমলেশের মতো দায়িত্বপূর্ণ পদেই তো রয়েছে অমিতাভ । ব্রিটিশ এক্সপ্লোসিভের কারখানাও যে চলছে না এমন নয় ।

মল্লিকা নিশ্চয় সব লক্ষ্য করছে। সুযোগ পেলেই অমিতাভ সেনের কথা সে তুলবে । কী উত্তর দেবে কমলেশ? একমাত্র যা বলতে পারে, এদের কারিগরি বিদ্যা এবং নকশা বিমান ডাকে লন্ডন থেকে আসছে। কোনো সমস্যা দেখা দিলে লন্ডন ডিজাইন অফিসে টেলেক্সে খবর যাচ্ছে। টেলেক্সেই সমাধান আসছে। কমলেশদের ওসব সুবিধে নেই । নিজেদেরই পথ খুঁজে বার করতে হচ্ছে।

অমিতাভ সেন বললেন, “রাজধানীর সাড়ে-তিন হাজার সোস্যালিস্ট মনসবদাররা এমন মেজাজ দেখাচ্ছেন যেন ওঁরা ছাড়া দেশের জন্যে কেউ কিছু করছে না । যেন ধর্মপুর কারখানায় আমরা যা তৈরি করছি তা মানুষের কাজে লাগছে না। আমাদের মালিকরা যেন দেশকে লুটেপুটে খাবার জন্যেই ধর্মপুরে কারখানা বসিয়েছে। আরে বাবা, অতই যদি সন্দেহ তাহলে আদর করে এদের ডেকে এনেছিলে কেন? এতোই যদি দেশপ্ৰেম তাহলে মহাত্মা গান্ধীর মতো কষ্ট করো, দেশের লোকের মাথা-পিছু যা গড় রোজগার সেই রোজগারের মধ্যে সবাই থাকো। হাঁটুর ওপর গামছা পরে খালি পায়ে ঘুরে বেড়াও।”

“দেশটা গরিব সে কথা তো মনে রাখতে হবে, মিস্টার সেন,” রিংকি বললো ।

“একশোবার রাখতে হবে। কিন্তু দেশ গরিব বলে আমরা বোয়িং-এরোপ্লেন কিনবো না বলতে পারছি কী? দেশ গরিব বলে পাঁচতারা হোটেল তৈরি বন্ধ হয়েছে কী? জানি আপনারা ফরেন ট্যুরিস্টদের কথা তুলবেন। কিন্তু এরাই কি কলকাতা, দিল্লি, বম্বে, মাদ্রাজের সমস্ত হোটেলে সিট বোঝাই করে রেখেছে?”

কমলেশ তবু বুঝছে না । তার যা বলতে ইচ্ছে করছে তা হলো, আমলাদের সঙ্গে টেকনলজিস্টরা ইজ্জতের লড়াই চালাতে পারে, পরস্পরকে গালিগালাজ করতে পারে, কিন্তু তাতে দেশের অভাগ্য মানুষদের কিছু সুরাহা হবে না। প্রশ্নটা হলো, আমরা কবে নিজের পায়ে দাঁড়াবো? আমাদের কারখানার মালিক সরকার, না অন্য কেউ সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা আমাদের কারখানাতে সত্যিই মানুষের কাজে লাগার মতো কিছু উৎপাদন হচ্ছে কিনা ।

ধর্মপুরের ছিমছাম চকচকে ভাব মল্লিকাকে আকৃষ্ট করেছে। অমিতাভ সেন এবং সমরেন্দ্রবাবুদের জীবনযাত্রা তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। ধর্মপুরের অফিসাররা যখন কারখানায় যান তখন কাজে ফাঁকি নেই; কিন্তু কাজের নাম করে জীবনেও ফাঁকি নেই । যারা কাজ করে, তারা চুলও বাঁধে। তারা পিকনিকে যায়, বিকেলে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে গল্প করে, তাস খেলে এবং ধর্মপুর ক্লাবে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আসতে সঙ্কোচ বোধ করে না ।

ধর্মপুর ক্লাবের সব কর্তৃত্বই ব্রিটিশ এক্সপ্লোসিভ অফিসারদের হাতে। কিন্তু বাইরের লোক নিতে তাঁদের মোটেই আপত্তি নেই । কাছাকাছি কোলিয়ারির অনেকে সভ্য হয়েছেন । জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিস সুপার, এডিএম এঁরাও সম্মানিত সভ্য । কমলেশ ইচ্ছে করলে সভ্য হতে পারে । মাত্র ত্রিশ মাইলের পথ । সভ্যদের অনেক সুযোগ-সুবিধে আছে । অতিথিদের ক্লাবে এনে আপ্যায়ন করা যায়। খরচ পড়ে না। বউদের জন্যে আলাদা চাঁদা নেই ।

আজকাল অনেকে আবার খেলাধুলো করছেন। গোপন খবরটা রিংকি ফাঁস করে দিয়ে বললো, “এঁরা বেজায় কুঁড়ে মেরে যাচ্ছিলেন। বউদের কথায় কিছু হলো না । শেষে হেডঅফিস থেকে বড়সায়েব এলেন । তিনি বললেন, টেনিস এবং গল্ফ আধুনিক এক্সিকিউটিভ কালচারের অঙ্গ । ত্রিশ বছরের পরেই ধর্মপুর কারখানার অফিসাররা যে-রকম ওজন বাড়িয়ে ফেলছেন তা তাঁর চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’

অবাক হয়ে গিয়েছিল কমলেশ। “ওঁরা অত চিন্তা করেন?”

“চিন্তা না করে উপায় কী? ইদানীং হাই ব্লাড-প্রেসার এবং হার্ট অ্যাটাক বাড়ছে ম্যানেজারদের মধ্যে । যেমন একটা পিক্যুলিয়র ব্যাপার, অফিসারদের বউরা সিজারিয়ান ছাড়া সন্তানের জন্মই দিতে পারছেন না!” সমরেন্দ্রবাবু বললেন ।

ধর্মপুর ক্লাবে সরকারি কর্মচারীরা আসেন। কিন্তু নিজের খরচে তাঁরা বিশেষ কিছু খান না । প্রয়োজনও হয় না। বহু লোক টানাটানি করে আতিথ্য গ্রহণের জন্যে । রাজশক্তি এবং গুণের সমাদর আছে এই নতুন শিল্প-সংস্কৃতিতে ।

ধর্মপুর ক্লাবে কমলেশকে সবাই সমাদর করলো। কমলেশ যে প্রতিভাবান বিজ্ঞানী তা এখানকার অনেকের কাছে অজানা নয় ৷ ক্লাবের সেক্রেটারি বললেন, “আমরা শুধু এখানে ফুর্তিই করি না। সাধ্যমতো দেশের ভাবনা-চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হই । প্রতি মাসে প্রথম শুক্রবার রাত্রে আমরা বক্তৃতা শুনি । অনেক মাননীয় মন্ত্রী এখানে পায়ের ধুলো দিয়েছেন। যাদুকর পি সি সরকার, মিসেস অমলাশঙ্কর, অধ্যাত্মিক মিশনের স্বামী অদ্বৈতানন্দজী, আর্মির ব্রিগ্রেডিয়ার হরবচন সিং এখানে বক্তৃতা করে গিয়েছেন। আপনিও একদিন মেম্বারদের অ্যাড্রেস করুন। আপনার পছন্দতো যে-কোনো বিষয়ে বলুন। সমকালীন বাস্তবতা থেকে ধর্মপুর ক্লাবের মেম্বাররা দূরে থাকতে চান না। সুযোগ পেলে আমরা সোস্যালিস্ট, কম্যুনিস্ট এবং উগ্রপন্থী নেতাদের বক্তৃতা শুনতে রাজি আছি।”

কমলেশ অবাক হয়ে সেক্রেটারির কথা শুনছিল । ভদ্রলোক বললেন, “আমাদের মেম্বারদের স্ত্রীরা যেমন ড্রিঙ্ক করেন, কলকাতায় রেসে যান, ফ্ল্যাশ খেলেন এবং ডান্সে অংশ নেন, তেমনি অনাথ ছেলেমেয়েদের জন্যে চাঁদা তোলেন এবং নিজেদের সুখস্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে জওয়ানদের জন্যে সোয়েটার বোনেন । বিগ্রেডিয়ার হরবচন সিং প্রতিরক্ষায় আমাদের সাহায্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন ।

রিংকি বললো, “বাটিকের কাজ, ইকাবেনা এবং চাইনিজ রান্নার স্পেশাল ক্লাস খোলার ব্যবস্থা হচ্ছে। তুই যদি জাপানি প্রথায় ফল সাজানো কিংবা চাইনিজ রান্না শিখতে চাস, আমাকে জানাস, ঝুমু ৷

ধর্মপুর থেকে কৃষিনগরে ফেরার পথে ঝুমু জানতে চেয়েছিল, চাইনিজ রান্নার ক্লাসে ঢুকলে কেমন হয়? প্রতিদিন ত্রিশ মাইল যাবার এবং ফেরবার তেল কমলেশকে কিনতে হবে শুনে সে একটু দমে গেলো । মল্লিকা গভীর দুঃখের সঙ্গে স্বামীকে বললো, “কোম্পানির জন্যে এতো করো, একটু জিপগাড়িটা নিলেই অপরাধ ।

কমলেশ শান্তভাবে বউকে বোঝালো, “ঝুমু, সরকারি প্রতিষ্ঠানে জিপগাড়ির একটা লগ বুক আছে। সেখানে লিখতে হয়, গাড়িটা কত কিলোমিটার গেলো এবং কাজটা নিজের না অফিসের। নিজের কাজকে অফিসের কাজ বলে দেখাতে হলে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়।”

ঝুমু হয়তো বুঝলো, কিন্তু এইচএসির ওপর তার রাগ বেড়ে গেলো । “নিজের সময়ে যখন অফিসের কাজ করো তখন তো কেউ কথা তোলে না।”

“আইনত নিজের সময় বলে আমাদের কিছু নেই ঝুমু । চব্বিশ ঘণ্টাই আমরা হিন্দুস্থান অ্যাগ্রো-কেমিক্যালসের কর্মচারী।”

মল্লিকা বললো, “এসব অমানুষিক আইন ডিকেন্সের সময় ইংলন্ডের কলকারখানায় চলতো–এখন অচল ।”

১৩

কাজের নেশায় আবার মেতে উঠেছে কমলেশ । সবাইকে সে অনুপ্রাণিত করছে। বলছে, এই কৃষিনগরে আমরা যা করছি তা শুধু চাকরি নয়–চাকরি থেকেও কিছু বড় ।

বেশির ভাগ শ্রমিক এবং ইঞ্জিনিয়ারদের সমর্থন ও সহানুভূতি পেয়েছে সে । দু-চারজন লোক কুঁড়েমি করছে, কাজটা পিছিয়ে গেলে কিছু লোকের রোজগারও বেশি হয়, কিন্তু তারা এখন সুবিধে করতে পারছে না। দ্রুত তালের নাটকের মতো এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিটি কাজ।

কিন্তু কাজের সীমা আছে। দিগম্বর বনার্জি অবুঝের মতো সাত দিন এগিয়ে আসতে চান। চেষ্টার ত্রুটি করছে না কেউ, কিন্তু এখনই প্রতিশ্রুতি দিতে পারেনি কমলেশ। জটিল কাজের মধ্যে কত চোরাবালি থাকে- হঠাৎ কিছু বিগড়ে যেতে পারে। তার জন্যে হাতে কিছু সময় রাখতেই হবে।

মিস সুজাতা দাসের কাছে কমলেশ খবর করলো, জাপানি এবং জার্মানরা তার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছে কিনা ।

মিস দাস বললো, “জাপানিরা সবাই আসছেন । মিস্টার শীলার এবং মিস্টার রেমার্কও আসছেন। আমিও আসছি।”

কমলেশ বললো, “আপনারা ট্রান্সপোর্টের চিন্তা করবেন না । একটা জিপ আপনাকে এবং জার্মানদের তুলে নিয়ে আসবে। জাপানিদের জন্যে মিস্টার সেন আলাদা ব্যবস্থা করেছেন।”

পার্টিতে যাবার জন্যে সুজাতা দাস একটু আগে থেকেই তৈরি হয়েছিল। জার্মানরা জিপ চালিয়ে সেবিকা সদনের সামনে এসে দাঁড়ালো। ঝলমলে একটা শাড়ি পরেছে সুজাতা । জার্মানরা এই সুসজ্জিতা যুবতীর সম্মানে হর্ষধ্বনি করে উঠলো I

রেমার্ক বললো, “মিস দাস, তোমার সুন্দর পোশাকের প্রশংসা করবার মতো যথেষ্ট ইংরিজি আমার জানা নেই ।”

শীলার বললো, “এই যে ইউরিয়া প্ল্যান্টের প্রিলিং টাওয়ার তৈরি করলাম আমরা, তার থেকেও সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে ৷

খুশি হয়ে সুজাতা বললো, “অসংখ্য ধন্যবাদ।”

রেমার্ক জানতে চাইলো, “তোমাদের এই লাভলি শাড়ির লেংথ কত?”

“পাঁচ মিটার,” সুজাতা বললো ।

“পাঁচ মিটার! তোমরা ইন্ডিয়ান লেডিরা কেমন করে অত লম্বা কাপড় ম্যানেজ করো? তোমরা সত্যিই রহস্যময়ী, তোমরা ম্যাজিক জানো।” শীলার অবাক হয়ে যায় ।

রেমার্ক বললো, “মিস দাস, কালকে এই সময় আমি লুফৎহানসার প্লেনে। আমার নামে যদি কোনো চিঠি আসে আমার বন্ধুর কাছে দিও ।

সুজাতা বললো, “তোমার বন্ধু যদি খবরাখবর নেয়, অবশ্যই পাবে!”

ও মিস দাস! চিঠি আসুক না আসুক, তোমার মতো একজন শাড়িপরা সুন্দরীর সঙ্গে কথা বলার দুর্লভ সুযোগের জন্যে যে-কোনো জার্মান যুবক প্রতিদিন তিন মাইল হাঁটতে পারে।” ম্যাক্স শীলার সিগারেটে টান দিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে মন্তব্য করলো।

“মুখে তোমরা বড্ড মিষ্টি, কিন্তু যা বলো তা মিন করো না।” সুজাতা একই সঙ্গে প্রশংসা ও প্রতিবাদ করলো।

ম্যাক্স বললো, “মোটেই না। যদি কোনোদিন আমাদের দেশে বেড়াতে যাও, দেখবে তোমাকে নিয়ে হৈ-হৈ পড়ে যাবে।

সুজাতা শাড়ির আঁচল বুকের উপর ছড়িয়ে দিয়ে শীলারকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনার বন্ধু তো চললেন; আপনি আর কতদিন আছেন?”

রসিক মিস্টার রেমার্ক বন্ধুর হয়ে উত্তর দিলেন, “আমার পিছুটান আছে, একটি নীল চোখের সন্দেহপরায়ণা যুবতী আমাকে প্রতি আটচল্লিশ ঘণ্টা অন্তর চিঠি লিখে যাচ্ছে । ম্যাক্স যতদিন খুশি থাকতে পারে, ওর ওসব টান নেই ।”

ম্যাক্স শীলার হাসলো। তারপর বললো, “আমারও দিন হয়ে এলো । বড় জোর চার সপ্তাহ। তারপর ইচ্ছে থাকলেও তোমাদের কোম্পানি আমাকে থাকতে দেবে না । প্রিলিং টাওয়ারে যন্ত্র চালু করে দিয়েই আমার ছুটি ।”

“এরপর কোথায় যাবে?” সুজাতা জিজ্ঞেস করে।

“প্রথমে স্বদেশ। তারপর যেখানে পাঠায়। খুব সম্ভব থাইল্যান্ডে।” সুজাতা মন্তব্য করলো, “তোমরা তো থাইল্যান্ড খুব পছন্দ করো।”

“আমরা নই, ফ্রয়লিন! আমেরিকানরা — যারা বিশ্বাস করে ডলার ফেললেই বালিকা বান্ধবীর ইন্সট্যান্ট ভালোবাসা পাওয়া যায় ।

জিপ এসে থামলো কমলেশ রায়চৌধুরীর বাড়ির সামনে। সুদর্শনবাবু দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন । লাল বেনারসি পড়ে মল্লিকাও বেরিয়ে এলো । ভারী সুন্দর সেজেছে সে । সুজাতা তা লক্ষ্য করলো। মনে-মনে ভাবলো, “এদেশে তো ডলপুতুলদের রাজত্ব। উঁচুতলার মানুষরা ডলপুতুল দেখলেই বিয়ে করে মাথায় চড়িয়ে বাড়িতে আনে। মেয়েদের অন্য কোনো গুণের দাম দেয় না কেউ।”

জাপানিরা এসে গিয়েছেন । পরিচয়-পর্ব শেষ হবার পর সুদর্শন সেন বললেন, “মিসেস রায়চৌধুরী, আমাদের সুজাতা ভারি ভালো মেয়ে।”

মল্লিকা বললো, “উনিও তো খুব প্রশংসা করেন। আমি রসিকতা করে বলেছিলাম, আগেকার দিনে প্রত্যেকটি সাকসেসফুল লোকের পিছনে একটি ভালো বউ থাকতো, এখন থাকেন একজন এফিসিয়েন্ট সেক্রেটারি।’

মল্লিকা এবার সুজাতাকে বললো, “আপনি ডায়োসেশারে পড়েছেন? স্কুলে দেখেছি আপনাকে, আমার থেকে কয়েক বছর সিনিয়র ছিলেন।”

অতিমাত্রায় উৎসাহ না দেখিয়ে সুজাতা বললো, “হ্যাঁ-হ্যাঁ, মনে পড়ছে বটে।” ডক্টর রায়চৌধুরীর কাছে কথাটা সে যে আগেই শুনেছে তা সুজাতা চেপে গেলো । মল্লিকা অনেক আগেই তার কোয়ার্টারে গিয়ে আলাপ করবে এবং বাড়িতে একান্তে নিমন্ত্রণ করবে এই আশা করেছিল সুজাতা ।

মল্লিকার মাথায় এতো বুদ্ধি আসেনি। চাকরিতে ঢুকলে মানুষ যে অত্যন্ত শ্ৰেণী সচেতন এবং স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে তা এখনও সে জানতে পারেনি। সরল মনে মল্লিকা এবার সুজাতার সঙ্গে গল্প করতে লাগলো । “আপনি এই বনবাসে পড়ে আছেন কী করে? আমি তো হাঁপিয়ে উঠেছি।”

সুদর্শন সেনের পতিব্রতা স্ত্রী হেসে বললেন, “একথা শুনছি না, মা। অমন হীরের টুকরো স্বামী সঙ্গে রয়েছেন। স্বামী যেখানে থাকেন মেয়েদের কাছে সেইটেই স্বর্গ।”

“রক্ষে করুন,” মল্লিকা বললো। “কিন্তু আমার না-হয় উপায় নেই; কিন্তু আপনি?” সুজাতাকে প্রশ্ন করলো মল্লিকা ।

সুজাতা প্রথমে একটু অস্বস্তি বোধ করলো। তারপর সহজভাবেই বললো, “কলকাতায় সবাই তো চাকরি পায় না। তা ছাড়া কলকাতায় এতো চেনাজানা লোক যে হাঁপিয়ে উঠছিলাম । সবার এক প্রশ্ন, বিয়ে করছো না কেন? যেন বিয়ে করা ছাড়া আইবুড়ো বাঙালি মেয়েদের অন্য কোনো কাজ নেই ।”

মল্লিকা এবার সুজাতার হাতে একটা গেলাস দিয়ে মিষ্টি হেসে একটু চাপা গলায় বললো, “বুঝেছি, হৃদয়ঘটিত ব্যাপার আছে ।

সুজাতা প্রতিবাদ করলো না। বরং ‘হৃদয়ঘটিত’ কথাটা বেশ লাগলো । হার্টের গোলমালের জন্যেই তো আর বিয়ে হয়নি– জেনেশুনে কোনো ইন্ডিয়ান ছেলে ওসব হাঙ্গামায় জড়াবে না । অথচ মিথ্যে কথাটাও বলা যায় না। রোগ চেপে বিয়ে করেছে জানলে বউকে রাস্তায় ফেলে রেখে স্বামীদেবতা চলে যাবেন।

ঘরের অন্য কোণে জাপানি-পরিবৃত হয়ে কমলেশ দাঁড়িয়ে রয়েছে। মিসেস সেন বুফে ডিনার টেবিল সাজাচ্ছেন। মল্লিকা এবার সুজাতাকে জার্মানদের দিকে ঠেলে দিলো।

জাপানি অতিথিদের ইংরিজি জ্ঞানের বহর ভয়াবহ। কিন্তু অবস্থা জটিল হয়ে উঠেছে এইজন্যে যে জাপানিদের ধারণা তাঁরা ভালোই ইংরিজি জানেন । এঁদের সঙ্গে ভাব বিনিময় করতে গিয়ে সুদর্শনবাবু হাঁপিয়ে উঠছেন।

সুদর্শনবাবু এরই মধ্যে কমলেশকে চাপা গলায় বললেন, “খুব বেঁচে গিয়েছি স্যার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এরা জিতলে আমরা ইন্ডিয়ানরা স্রেফ মারা যেতাম। এদের আন্ডারে কী করে কাজ করতাম? মালিকদের হুকুমই বুঝতে পারতাম না।”

কমলেশ নিজেও একটু হতাশ হচ্ছে । কাজ ছাড়া এরা কিছুই বোঝে না । কারখানায় কমলেশ এদের দেখেছে। তদারকি করার কেউ নেই; চন্দনপুর থেকে টেলিফোনে তাগাদা দেবার দিগম্বর বনার্জিও এদের নেই; তবু কাজে ফাঁকি নেই। ফাঁকি তো দূরের কথা, আট-দশটা লোক যা করছে, এখানে তার জন্যে পঞ্চাশটা লোক প্রয়োজন হতো । এদের মধ্যে পাস করা ইঞ্জিনিয়ারও কেউ নেই। এরা হাতে-কলমে কাজে বিশ্বাসী । কথায়-কথায় গ্র্যাজুয়েট ইঞ্জিনিয়ার চায় না। তরোয়াল দিয়ে পেন্সিল বাড়াবার বদ্ অভ্যাস জাপানিদের নেই ৷

কিন্তু কাজের বাইরে এদের যেন কোনো অস্তিত্ব নেই। মাঝে-মাঝে দুশ্চিন্তা হয় কমলেশর। ভারতবর্ষে আমরা এই ধরনের লোক চাইছি–চোখ আর হাত ছাড়া যাদের কিছু নেই । বহু অনুশীলনে হাত দুটো এমন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে যে দশভূজের মতো কাজ হচ্ছে। তার সঙ্গে আছে উৎপাদনের লোভ ৷ যত প্রোডাকশন বাড়বে তত পয়সা–তার পরে আবার বোনাস এবং ওভারটাইম। বাড়ির বউরা এইসব যন্ত্রমানব নিয়ে তেমন সুবিধে করতে পারে না। এরা আবার মদের নেশায় পড়ে। প্রচুর প্রোডাকশন দেখিয়ে প্রচুর টাকা রোজগার ছাড়া এদের আর কোনো আশা-আকাঙ্ক্ষা থাকে না। শিল্পে উন্নত পৃথিবীর নানা দেশ এই ধরনের অসম্পূর্ণ যন্ত্রমানুষের বোঝাই হয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু যতই সমালোচনা হোক, ভারতবর্ষে এখন এই ধরনের লোক অনেক প্রয়োজন । ক্ষেতে, খামারে, কারখানায়, অফিসে এরাই বিপ্লব আনবে, এরাই এদেশের নবনায়ক এবং পরিত্রাতা ।

কমলেশের কাছে এসে সুদর্শন সেন বললেন, “একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করবো ভাবছি। আপনারা বলছেন নিজস্ব বিদ্যে দিয়ে এই কারখানা তৈরি করছেন। অথচ, এতোগুলো জাপানি এবং জার্মান সায়েবকে দেখছি।

কমলেশ মুখ টিপে হেসে বললো, “নিজেদের ডিজাইন বটে, কিন্তু যন্ত্রপাতি যে বিদেশ থেকে আনবো না এমন কথা তো ডক্টর বনার্জি বলেন না। বহু যন্ত্রপাতি আছে যা এখনও আমাদের দেশে তৈরি হয় না। সুতরাং এইচএসিকে বিদেশ থেকে কিছু মেশিন আমদানি করতে হবে।“

সুদর্শন সেন ফিসফিস করে বললেন, “সায়েব হলে কি হবে স্যার, এরা আসলে মিস্ত্রি । এদের সঙ্গে অন্য কিছু আলোচনা করতে হলে একেবারে ঠকে যাবেন। মায় সার শিল্প সম্বন্ধে এরা খবরাখবর রাখে না। শুধু ডিজাইন দেখে মেশিনের নাটবল্টু টাইট করতে জানে । তবে খাটতে পারে বটে ।

কমলেশ বললো, “খাটতে আমাদের দেশের লোকও পারে। আপনি আমাদের অভাগা মুটে-মজুর, রিকশাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা, মাটি-কাটা-মজুরের কথা ভাবুন। কিন্তু আমরা শিক্ষিত লোকরা তাদের পথ দেখাতে পারছি না। ওদের বাহুবলকে যদি বিজ্ঞানের সাহায্যে কাজে লাগানো যেতো তাহলে এদেশও সোনার দেশ হয়ে উঠতো ।

সুদর্শন সেন বললেন, “হাজার হোক আমি বয়োজ্যেষ্ঠ–একটা অ্যাডভাইস শুনবেন? অফিসের কাজে স্বপ্ন দেখবেন না। তাতে জীবনটা নয়-ছয় হয়ে যাবে। কেউ আপনাকে দাম দেবে না।“

কমলেশ হাসলো । সুদর্শন সেন বললেন, “দিগম্বর বনার্জির একটা খেয়াল মেটাবার জন্যে আপনি কী চেষ্টা করছেন, আমি তো দেখছি। এতে শরীর খারাপ হবে, ডক্টর রায়চৌধুরী ।”

“দায়িত্ব জিনিসটা যে খারাপ, মিস্টার সেন,” কমলেশ বললো।

সুদর্শন উত্তর দিলেন, “দায়িত্ব এদেশে কেউ নেয় না স্যার, শুধু মুখে চিৎকার করে । যতটা পারেন কাজ করে যাবেন–কিন্তু অফিসে আদর্শ দেখাতে যাবেন না ।“

“কী বলছেন,আপনি?” কমলেশ প্রশ্ন করে ।

“অভিজ্ঞতা তো কম হলো না। প্রথমজীবনে চন্দনপুর প্রোজেক্ট তৈরি হতে দেখেছি । তারপর হরিয়ানা ফার্টিলাইজার। তারপর আসাম প্রোজেক্টের হিসেবপত্তর এই শৰ্মাই নিজের হাতে রেখেছে । আর শেষ দেখছি কৃষিনগর । আপনি যত চেষ্টা করছেন, দিগম্বর বনার্জি আপনার ঘাড়ে তত দায়িত্ব চাপিয়ে যাচ্ছেন। অন্য যে-কেউ প্রোজেক্ট ম্যানেজার হলে কারখানা এক বছর পিছিয়ে যেতো । ভদ্রলোক এখন আপনাকে বলছেন, কারখানা চালু করবার দিন এগিয়ে নিয়ে এসো। কেন?”

“কেন বলুন তো?” কমলেশ জিজ্ঞেস করে ।

“একটা খেয়াল। কিছু মনে করবেন না, ছোট মুখে বড় কথা মানায় না । তার সঙ্গে একটা নামের মোহ। মিনিস্টার বলবে, বনার্জি তুমি একটা কাজের কাজ করেছো। হয়তো ছাব্বিশে জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি দিল্লিতে ডেকে রায়বাহাদুর করে দেবেন।”

“রায়বাহাদুর, স্যার, এসব খেতাব দেশ থেকে উঠে গিয়েছে সুদর্শনবাবু।”

“ওই হলো–এখন পদ্মকুমার না কী বলে,” মিস্টার সেন উত্তর দিলেন ।

কমলেশ বললো, “চলুন জার্মানরা এক কোণে পড়ে রয়েছে, ওখানে একটু যাওয়া যাক ।”

রেমার্ক এবং শীলার বেশ খোসমেজাজেই রয়েছে। ওরা জানালো, “মোটেই আমরা ‘লোনলি’ বোধ করছি না। স্বয়ং মিস ইন্ডিয়া আমাদের দেখাশোনা করছেন ।

কমলেশ, সুজাতা এবং মিস্টার সেন একসঙ্গে হেসে উঠলো। ম্যাক্স বললো, “ডক্টর রায়চৌধুরী, আমাদের বিশ্বাসই হচ্ছে না, এইসব খাবার তোমার স্ত্রী নিজের হাতে তৈরি করেছেন।”

কমলেশ বললো, “টেকনিক্যাল কোলাবরেশন দিয়েছেন মিসেস সেন ।”

ম্যাক্স বললো, “জার্মানিতে রান্নার এই নো-হাউ বেচেই তোমরা লক্ষ-লক্ষ ডয়েটস মার্ক রোজগার করতে পারো।’

পার্টির শেষে সুদর্শন সেন জিজ্ঞেসা করলেন, “সুজাতা, তোমাকে কি আমি পৌঁছে দেবো?”

সুজাতা বললো, “কিছু প্রয়োজন নেই । যেভাবে এসেছি, সেইভাবেই চলে যাবো।”

ফেরার সময় ম্যাক্স জিপ চালাচ্ছিল। মধ্যিখানে বসেছিল সুজাতা। ধারে রেমার্ক ।

আঁকা-বাঁকা উঁচু-নিচু পথ পেরিয়ে জিপটা ফ্যাক্টরির কাছে এসে পড়লো । চাঁদের আলো পড়েছে মনুমেন্টের মতো উঁচু প্রিলিং টাওয়ারের ওপর। জলেভেজা কাদার মতো থকথকে ইউরিয়া এখানে এসেই মেশিনের ধাক্কা খেয়ে বহু উপরে উঠে যাবে। সেখানে চাকার সাহায্যে বনবন করে ঘুরিয়ে ফেনানো ডালের মতো বড়ি দেওয়া হবে। জল শুকিয়ে শুকনো গরম ইউরিয়া নিচে পড়বে ।

ম্যাক্স শিস দিয়ে উঠলো। তারপর জিপ থেকে মাথা বার করে ঘাড় বেঁকিয়ে একবার টাওয়ারটা দেখলো। সুজাতা চাঁদের আলোয় প্রিলিং টাওয়ার দেখার লোভ সামলাতে পারলো না। এতোদিন কারখানাকে অবহেলা এবং অবজ্ঞা করে এসেছে সে। পেটের দায়ে শিল্পনগরীতে কাজ করতে এসেছে, বিরাট বিরাট যন্ত্রপাতিতে তার কোনো আগ্রহ নেই । কিন্তু অকস্মাৎ সুজাতার মনে হলো, চাঁদের আলোয় নতুন তৈরি প্রিলিং টাওয়ারটা ভারি সুন্দর। বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মানবশিল্পের সহজাত কোনো বিরোধ নেই, এরাও মেড ফর-ইচ-আদার।

ম্যাক্স জিজ্ঞেস করলো, “কেমন বুঝছেন, মিস ইন্ডিয়া?”

এদের সঙ্গে সুজাতা বেশ সহজ হতে পেরেছে। সে খিলখিল করে হেসে বললো, “গ্লোরিয়াস!” ভারত ললনার সদয় মন্তব্যে জার্মান যুবকদ্বয় ধন্য হলো।

সুজাতার কোয়ার্টারের সামনে এসে ওরা তিনজন গাড়ি থেকে নেমে পড়লো । একটা পোশাকি নমস্কার জানিয়ে চলে যাবে ভেবেছিল সুজাতা। কিন্তু রেমার্ক কথা তুললো । গম্ভীর, বিষণ্ণ এবং আন্তরিক কণ্ঠে বললো, “মিস দাস, বোধহয় আমাদের এই শেষ দেখা । সুতরাং অল দি বেস্ট।”

বিদায় জানিয়ে লুডউইগ রেমার্ক হাত বাড়িয়ে দিলো। অপরিচিত যুবকের দেহ স্পর্শ করতে সুজাতা মুহূর্তের জন্যে মানসিক ইতস্তত করলো, কিন্তু পরমুহূর্তেই কুমারীসঙ্কোচ কাটিয়ে হাত বাড়িয়ে রেমার্কের সঙ্গে করমর্দন করলো । ম্যাক্স ইতস্তত করছিল, কিন্তু স্বাভাবিক সৌজন্যবশত সুজাতা বললো, “কাম অন।“

মর্দনে অনভ্যস্ত সুজাতার নরম হাত মুহূর্তের মধ্যে ম্যাক্সের বিরাট হাতের মধ্যে হারিয়ে গেলো । সুজাতার মনে হলো দেহে বিদ্যুৎ সঞ্চার হচ্ছে। ম্যাক্স হাতটা দুলিয়ে ছেড়ে দিলো; তারপর শুভরাত্রি জানিয়ে ওরা বিদায় নিলো ।

বাড়ির মধ্যে ঢুকতে-ঢুকতে সুজাতা বুঝলো তার হাতটা ভিজে উঠেছে, উত্তেজনায় নাক বুক পিঠ ঘামছে।

১৪

কৃষিনগরের জীবনযাত্রা আরও দ্রুত তালে চলতে শুরু করেছে। সর্বস্তরের কর্মীদের মধ্যে কমলেশ কাজের অনুপ্রেরণা ছড়িয়ে দিয়েছে। কাজের নেশায় সে নিজেও মেতে উঠেছে।

শুধু সকালের দিকে চন্দনপুরের টেলিফোনটা তার আজকাল ভালো লাগে না । দিগম্বর বনার্জি পনেরো মিনিট ধরে অজস্র প্রশ্ন করেন, তারপর জিজ্ঞেস করেন ত্রিশে নভেম্বরের মধ্যে কাজ চালু হচ্ছে কিনা ।

কাজ সবার বেড়েছে। একজন শুধু বুঝতে পারে না, সময় নিয়ে সে কী করবে। মল্লিকার কাছে কৃষিনগর ক্রমশ সব আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছে । অফিসে এবং সাইটে কমলেশ ব্যস্ত থাকে এবং বাড়িতে ফিরে এসে শুধু টেলিফোন ধরে । আজকাল রাত্রেও বিছানার কাছে টেলিফোন নিয়ে শোয় । রাত্রি দেড়টার সময় সেদিন টেলিফোন এলো। মল্লিকার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল ।

একদিন ধর্মপুরে ওদের নেমন্তন্ন ছিল। মল্লিকা সাজগোজ করে বসেছিল । কমলেশ অফিস থেকে ফিরলো, জামাকাড়র পাল্টালো। স্বামীর দেহে একটু অডিকোলন ছড়িয়ে দিচ্ছে মল্লিকা । এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠলো । এখনই আসছি বলে সেই যে কমলেশ জিপ নিয়ে উধাও হলো, আর দেখা নেই। দু-তিন জায়গায় ফোনে খবর করেছিল মল্লিকা । কিন্তু কোথায় কমলেশ?

অনেক রাত্রে বাড়ি ফিরে কমলেশ দেখে মল্লিকা গুম হয়ে বসে আছে । বাইরে যাবার জামাকাপড় সে সব ছেড়ে ফেলেছিল । লজ্জিত কমলেশ ওকে আদর করবার চেষ্টা করলো । কিন্তু মল্লিকা এই প্রথম অভিমানে ওর হাত সরিয়ে দিলো।

“আমি অত্যন্ত লজ্জিত ঝুমু,” কমলেশ ক্ষমা চেয়েছিল । “জানো ঝুমু, অ্যামোনিয়া প্ল্যান্টের রিফরমিং চেম্বারে সিনথেটিক গ্যাসের তাপ হঠাৎ বাড়তে আরম্ভ করেছিল। ডিজাইন সীমার বাইরে চলে যাচ্ছিল। হয়তো ট্যাঙ্ক ফেটে যেতো। ডক্টর বনার্জিকে ফোন করতে হলো।”

মল্লিকার চোখে জল । “চন্দনপুরে ফোন করলে, আর আমাকে খবর দিতে পারলে না? আমার বোন ধর্মপুরে রান্নাবান্না করে অপেক্ষা করছে। তুমি তাদের মানুষ মনে না করতে পারো, কিন্তু তারাও খেটে খায় ।’

ঝুমুর মতো নরম মেয়েও যে এরকম কথা বলতে পারে কমলেশ তা ভাবতে পারেনি । “এসব কী বলছো, ঝুমু?” কমলেশ আবার ক্ষমা চায়, ধর্মপুরে খবর দেওয়ার কথাটা তার মনেই ছিল না ।

অনেক সাধ্যসাধনার পর মল্লিকা শান্ত হয়েছিল। ওরা ফোন করেছিল ধর্মপুরে। কমলেশ বললো, “আমি নিজে ক্ষমা চাইছি।”

মল্লিকা বললো, “না, তোমাকে আর কথা বাড়াতে হবে না । একেই তো রিংকির ধারণা, কাজ নিয়ে তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করো।”

মল্লিকা নিজেই বোনকে ফোন করলো, “রিংকি, খুব গালাগালি করছিস নাকি?”

“তুই আমার সঙ্গে কথা বলিসা না, ফোন কেটে দে!” রিংকির অভিমানভরা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ।

মল্লিকা বললো, “লক্ষ্মী বোনটি আমার শোন ৷ তোর ওখানে যাবো বলে জামাকাপড় পরে বেরোচ্ছি, ঠিক সেই সময় শরীরটা কি রকম ঘুলিয়ে উঠলো। দু-একবার বমিও হয়ছে। ভাবলুম একটু বিশ্রাম করে দেখি। ও সাহস করলো না। তোকে ফোন করতে যাচ্ছিল, আমি বললাম, আর একটু দেখি। দেখি দেখি করতে-করতে এই দেরি হয়ে গেলো ।”

রিংকির মেজাজ মন্ত্রবৎ পাল্টে গেলো। প্রবল উৎসাহে চড়া গলায় প্রশ্ন করলো, “বমি-টমি! কী ব্যাপার? দে তো একবার ভদ্রলোককে। ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করি । এদিকে তো অফিসের কাজে খুব ব্যস্ত থাকেন–তাহলে বউয়ের বমি-টমি কেন?”

“তুই যা ভাবছিস, তা নয়,” মল্লিকা বোনকে বোঝাবার চেষ্টা করলো । কিন্তু বোন বুঝতে চায় না।

ফোন নামিয়ে মল্লিকা বেশ লজ্জায় পড়ে গেলো । বললো, “নতুন এক ফ্যাসাদ বাধলো । রিংকি অন্য কিছু সন্দেহ করছে। শনিবারেই চলে আসবে বললো ।”

কমলেশ ঠিক করলো, এবার রিংকিদের যথেষ্ট আদর আপ্যায়ন করবে। রাত্রে দু-একজনকে খেতেও বলবে। ঝুমুকে বুঝিয়ে দেবে রিংকিদের সেও ভালোবাসে। সেও আড্ডা দিতে জানে ।

.

রিংকি এসে ঝড়ের বেগে বোনকে পাকড়াও করলো এবং জড়িয়ে ধরে আদর করলো । তারপর বললো, “আমি কোথায় ভাবছিলাম, ভগ্নীপতিটি উদাসী বিজ্ঞানী, কাজকর্মের নেশা রয়েছে। বউয়ের দিকে নজর নেই।”

“নেই তো,” মল্লিকা বলে ।

“তাহলে বমি-টমি হচ্ছে কেন?” রিংকি বোনকে মৃদু ঠেলা দিলো ।

“বিশ্বাস কর, স্রেফ অম্বল। দেরি করে খাওয়া হয়েছিল,” মল্লিকা বোনের বিশ্বাস উৎপাদনের জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করছে।

রিংকি বললো, “সেদিন যা রাগ হচ্ছিল না। কর্তা আবার মিস্টার ডিকসনকে নেমন্তন্ন করেছিলেন। ওদের ফার্টিলাইজার প্রোজেক্টের ডিরেক্টর। দু-তিনটে সিনিয়র বিজ্ঞানী নেবে ওরা। মাইনে চার হাজারের ওপর। তারপর তোরা আসছিস না দেখে আমাদের চিন্তা ও বললো, দ্যাখো ঝুমুর বর হয়তো ভুলেই গিয়েছে। আমি বললাম, তা হতেই পারে না ৷ ঝুমু ঠিক পাকড়ে নিয়ে আসবে। ঝুমু জানে, আমরা স্পেশাল ব্যবস্থা করছি। তোর ফোন আসায় আমার মুখ রক্ষে হলো। বললাম, পুরুষমানুষের আর কী? যখন যা-খুশি করছো। মেয়েরাই বিপদে পড়ে যায়।”

মল্লিকা হাসলো । আর অনন্যোপায় কমলেশ ওদের সামনে মিথ্যে অভিনয় করলো। রিংকি বোনের জন্যে ইমপোর্টেড কসমেটিক এনেছে। সেগুলো মল্লিকার হাতে দিয়ে বললো, “তোর জন্যে লন্ডন থেকে আনিয়েছি। আমাদের ওখানে লোক হরদম ফরেনে যাচ্ছে।”

কমলেশ বললো, স্নো, লিপস্টিক, মেকআপ এসব আজকাল শুনি ইন্ডিয়াতে ভালোই হচ্ছে?”

রিংকি বললো, “দোহাই আপনাদের। চাষীদের জন্যে স্বদেশি সার তৈরি করছেন করুন, কিন্তু আমাদের এই চুনের ডেলাগুলো মাখতে বলবেন না।“

“কসমেটিক আমদানি হয় আজকাল?” কমলেশ জিজ্ঞাসা করে । “সরকারিভাবে হয় না; কিন্তু বেসরকারিভাবে কত চাই আপনার?”

রিংকি বললো, “আমি তো বিলেত থেকে ফেরবার সময় বুক ফুলিয়ে কাস্টমসকে দেখিয়ে সব নিয়ে এলাম । কাস্টমসের একটা ছোঁড়া কোশ্চেন করতে যাচ্ছিল । আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, বিয়ে করেছেন? বেচারা ঘাবড়ে গিয়ে বললো, না। আমি সঙ্গে-সঙ্গে শুনিয়ে দিলুম, বিয়ে হলে জানবেন, মেয়েদের চামড়ার স্বাস্থ্য একবার নষ্ট হয়ে গেলে তা আর কখনও ভালো হয় না। ব্যাচেলার ছোকরা ভয় পেয়ে আর কিছু বললো না ।“

সন্ধ্যাবেলায় কমলেশ আবার ডুবিয়েছিল । সুদর্শনবাবু, তাঁর স্ত্রী, রিংকি, সমরেন্দ্রবাবু সবাই তৈরি হয়ে বসে আছেন। কমলেশ এলেই খাবার দিয়ে দেবে মল্লিকা। কিন্তু কোথায় কমলেশ? সাড়ে-সাতটা নাগাদ ড্রাইভার এলো সঙ্গে চিঠি; একটা পরিষ্কার গেঞ্জি, জামা এবং প্যান্ট পাঠিও। আর সম্ভব হলে কয়েকটা স্যান্ডুইচ। তোমরা আমার জন্যে অপেক্ষা কোরো না ।

মুখ কালো হয়ে উঠলো মল্লিকার । সুদর্শনবাবু বুঝতে পেরে বললেন, “বয়লার টিউবে একটা গণ্ডগোল চলছিল । ইঞ্জিনিয়ার নীলমণি পট্টনায়কের সঙ্গে রায়চৌধুরী সায়েবও দাঁড়িয়ে ছিলেন ।”

রিংকি জিজ্ঞেস করলো “বয়লার টিউবের গোলমাল যদি না মেটে তাহলে কি কমলেশ আজ বাড়ি ফিরবে না?”

“কিছুই বলা যায় না,” সুদর্শনবাবু উত্তর দিলেন! “রায়চৌধুরী সায়েব বলেন, এখন তো সাধারণ সময় না । কোথাও একটু পিছিয়ে গেলে সময়মতো কারখানা চালু করা যাবে না । উনি নিজে দাঁড়িয়ে থাকেন, পথ বাতলে দেন। অনেক সময় বনার্জি সায়েবকে ফোন করেন।

“বনার্জি সায়েব নিজে এখানে এসে থাকলেই পারেন,” রিংকি বিরক্তভাবে বলে ।

“তাহলে আমাদের আর আস্ত থাকতে হবে না,” সুদর্শনবাবু আঁতকে উঠলেন “তবে এবার কেন যে ঘন-ঘন আসছেন না, জানি না । গুজব শুনছি শরীরটা তেমন সুবিধে যাচ্ছে না।

স্বামীকে কিছু খাবার পাঠিয়ে দেবে ভাবছিল মল্লিকা। সুদর্শনবাবু বারণ করলেন । বললেন, “ওঁর যা স্বভাব, সবাই না খেলে, উনি খাবেন না।”

অনেক রাত্রে ফিরেছিল কমলেশ। রিংকি বললো, “যুদ্ধের সময় চার্চিলও দুপুরবেলায় কিছুক্ষণ গড়িয়ে নেবার এবং রাত্রে ডিনারের সময় করে নিতেন।

খুব লজ্জা পেয়ে কমলেশ বললো, “শেষ পর্যন্ত সেকেন্ডারি রিফরমারের ওপরদিকটা খুলতে হলো। ওদের একলা ছেড়ে দিয়ে চলে আসতে সাহস হলো না। তাছাড়া, পট্টনায়কের বিবাহ-বার্ষিকী, তাকেই আটকে রাখলাম, আমি চলে আসবো কি করে?”

সমরেন্দ্রবাবু কিছুই বললেন না। মল্লিকার মনে হলো, তিনি একটু ক্ষুণ্ণ হয়েছেন । রাত্রে বিছানায় মল্লিকা অভিমানে মুখ ফিরিয়ে রইলো। আর সমস্ত দিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত কমলেশ প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লো ।

ধর্মপুরে ফিরে যাবার আগে রিংকি বলেছিল, “এই শেষবার। তোদের আর জ্বালাতে আসবো না। ও-বেচারাকে জোর করে টেনে আনি, তোর কর্তা পাত্তাই দেয় না ৷

কমলেশ হাত ধরে ক্ষমা চেয়েছিলো দুজনের কাছে।

রিংকি হঠাৎ বললো, “আমাদের ক্লাবে দম্পতি-কম্পিটিশনের কথা মনে আছে তো তোদের? টেলিফোনে কথা মতো তোদেরও নাম দিয়ে দিয়েছি । আমরা তো আগেই নাম পাঠিয়েছিলাম । প্রথম পুরস্কার বিনা খরচে স্বামী-স্ত্রীর কাশ্মীর ভ্রমণ ।”

“সঙ্গে তো ছবি দিতে হয়?” মল্লিকা জিজ্ঞেস করলো ।

‘তোদের একটা ছবি ছিলো আমাদের কাছে, সেইটা পাঠিয়ে দিয়েছি। দেখিস, এবার যেন আমাদের মান সম্মান থাকে ।

ব্যাপারটা কমলেশ বুঝতে পারছিল না । মল্লিকা জানালো স্বামীর অনুমতি না নিয়েই সে ধর্মপুরে ক্লাবের মেড-ফর-ইচ-আদার দম্পতি-প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছে। বিয়ের আগে থেকেই ওর ইচ্ছা মেড-ফর-ইচ-আদার হয়। বউকে খুশি করার এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করলো না কমলেশ। উৎসাহের সঙ্গে রাজি হয়ে গেলো। শ্যালিকাকে বললো, “আপনারা থাকতে আমাদের যদিও প্রাইজ পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই, তবুও আমরা লড়ে যাবো ।” কমলেশ বললো, “প্রতিযোগিতার দিন একহাত অন্তর বজ্রপাত হলেও আমাদের ধর্মপুরে দেখতে পাবেন ।“

কমলেশকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে সমরেন্দ্রবাবু বললেন, “আমাদের ফার্টিলাইজার প্রোজেক্টের ডিরেক্টর মিস্টার ডিকসন তোমার সম্বন্ধে খুব ইন্টারেস্টেড। এই রকম উৎসাহী একজন সায়েন্টিস্ট চাইছেন তিনি। চাকরিতে ঢোকবার পর, ছ’মাস এডিনবরায় ট্রেনিং । একটু চাপ দিলে বউকেও নিয়ে যেতে দেবে। তারপর সপ্তাহকয়েক কোম্পানির খরচে কন্টিনেন্ট ঘুরে নতুন প্রোজেক্টে জয়েন করো। তিন বছর লাগবে তৈরি হতে আমাদের নতুন কারখানা ।

মল্লিকার কাছে এসে রিংকি ফিসফিস করে বললো, “দিগম্বর বনার্জি যত মাইনে পায়, তার থেকেও কমলেশকে বেশি দেবে ওরা।”

“একটা অ্যাপ্লিকেশন করো না,” মল্লিকা অনুরোধ করলো স্বামীকে ।

সমরেন্দ্রবাবু বললেন, “এসব চাকরির জন্যে অ্যাপ্লিকেশন করতে হয় না। তোমার সব পার্টিকুলারস আমি তো জানি। আমিই মিস্টার ডিকসনকে দিয়ে দিতে পারবো। তাছাড়া ডিকসন তোমাকে দেখেছেন।”

“আমাকে? কোথায় দেখলেন?” কমলেশ অবাক হয়ে গেলো ।

“দিল্লিতে ফার্টিলাইজার সেমিনারে । উনিও তো গিয়েছিলেন, ব্রিটিশ এক্সপ্লোসিভের পক্ষ থেকে। তুমি এবং দিগম্বর বনার্জি দুজনে মিলে কি একটা পেপার দিয়েছিলে।” সমরেন্দ্রবাবু জানালেন ।

যাবার আগে সমরেন্দ্রবাবু আরও জানিয়ে গেলেন, দম্পতি-প্রতিযোগিতার দিনে ডিকসন ধর্মপুরে থাকবেন ।

রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে স্বামীর সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করবার ইচ্ছে ছিল মল্লিকার। রিংকির কাছে শুনেছে, সমরেন্দ্রবাবুর সঙ্গে প্রেমালাপ করতে-করতে সে অনেক সময় ভোর চারটে বাজিয়ে দিয়েছে। কমলেশ কিন্তু বিছানায় শোয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পড়লো । একটু একটু নাক ডাকছে ওর; মল্লিকার কিছুতেই ঘুম আসছে না।

এই অল্পদিনেই বিবাহিতজীবন সম্বন্ধে মল্লিকার আকর্ষণ কমে আসছে। গতকাল মনে হচ্ছিল গাইগোরুর মতো সারাক্ষণ গোয়ালে বাঁধা রয়েছে সে ।

তার ওপর রিংকি আজ দুপুরে মনের মধ্যে ভয় ধরিয়ে দিলো। ঝুমু নাকি স্বামীকে বাগ মানাবার চেষ্টাই করছে না। ভালোমানুষ বউরা নাকি চিরদিন কষ্ট পায়। পুরুষমানুষেরা নাকি শান্ত নরম মেয়েদের বেশি অবহেলা এবং অবজ্ঞা করে। ধরে নেয় হাতের পাঁচ বউ তো ঘরেই রয়েছে। রিংকি বলেছিলো, “তোর যে সাধ-আহ্লাদ আছে তা মাঝে-মাঝে বুঝিয়ে দিবি–না হলে সারাজীবন দুঃখ পাবি।”

মল্লিকা ঠিক করেছিল স্বামীকে একটু পরীক্ষা করবে। বউ যে খুশি নয়, তা একটু বুঝিয়ে দেবে। কিন্তু কমলেশ সে সুযোগ দিলো না। নিজেই উৎসাহের সঙ্গে ধর্মপুরে দম্পতি-প্রতিযোগিতায় যেতে রাজি হলো। ও যে এসব ভালোবাসে না তা মল্লিকা লিখে দিতে পারে। কিন্তু বউকে সন্তুষ্ট করবার জন্যেই সে আগ্রহ দেখালো ।

ঘুমের ঘোরে কমলেশ পাশ ফিরলো । ধর্মপুরে রিংকি এখনও নিশ্চয়ই স্বামীর সঙ্গে গল্প চালিয়ে যাচ্ছে । মল্লিকা এখন একটু শান্ত বোধ করছে। রিংকি বলেছিল, “কোনো কিছুকেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে ধরে নেওয়া যায় না। স্বামী-স্ত্রীর প্রেম যতই অমর হোক, মাঝে মাঝে ভালোবাসার প্রমাণ দরকার। কমলেশ আজ একটা প্রমাণ দিয়েছে। কিন্তু রিংকি যাবার আগে বললো, “এতেই যেন বরের কাছে গলে পড়িস না। মাঝে-মাঝে বরের কাছে অভিমান করবি, গম্ভীর হয়ে থাকবি, ছোটখাটো পাওনাগন্ডা জোর করে আদায় করবি।”

একেবারে মিথ্যা বলেনি রিংকি । মল্লিকা এখন থেকে প্রমাণ চাইবে। দিগম্বর বনার্জি ছাড়াও আর একটা মানুষ যে তোমার জীবনে এসেছে তার প্রমাণ দিতে হবে কমলেশকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *