১০. জাদুকরী

দশম পর্ব
জাদুকরী

সমুদ্রে যেতে যেতে এরপর আমরা যে দ্বীপ সামনে পেলাম তা হলো দেবতাদের প্রিয় হিপ্লোটাসপুত্র অ্যাকোলাসের বাসভূমি। সমুদ্রগর্ভ হতে উথিত এক বিরাট পাহাড়ের উপর অবস্থিত সেই দ্বীপটি নিচ্ছিদ্র ব্রোঞ্জ ধাতু নির্মিত এক সুউচ্চ প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত। সেই দ্বীপের মধ্যে একটি প্রাসাদোপম বাড়িতে অ্যাকোলাস বাস করে। তার সেই বাড়িতে আছে তার স্ত্রী ছাড়া মোট বারোজন সদস্য–দুজন পুত্র আর দুজন কন্যা। সত্যিকথা বলছি, অ্যাকোলাস তার নিজের ছেলেদের সঙ্গে নিজের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে সবাইকে বাড়িতে রাখে। উৎসবের অনাবিল আনন্দে সবসময় মুখর হয়ে থাকত তার বাড়িটা। তার সেই প্রশস্ত প্রাঙ্গণে সারাদিন ধরে উৎসব আর ভোজসভার অবিচ্ছিন্ন অনুষ্ঠান চলত। বিচিত্র গন্ধদ্রব্যের প্রভাবে আমোদিত হয়ে থাকত সারা বাড়িটা। রাত্রিতে কাঠের পালঙ্কে ভাল বিছানায় আরামে নিদ্রা যেত বাড়ির সকলে।

অ্যাকোলাসের এই বাসভূমিতে গিয়ে পড়লাম আমরা। পুরো একটি মাস ধরে তার সেই প্রাসাদোপম বাড়িতে আমাদের আতিথ্য দান করে অ্যাকোলাস। ইলিয়াম নগরীর প্রতি গ্রীকদের অভিযান এবং যুদ্ধশেষে তাদের স্বদেশের প্রত্যাবর্তনের সমগ্র কাহিনী বিবৃত করে অ্যাকোলাসের কৌতূহল নিবৃত্ত করি আমি। আবার যখন আমি আমাদের যাত্রা শুরু করার কথা বলে তার সাহায্য প্রার্থনা করলাম তখনও সে বিরূপ হলো না

আমাদের প্রতি। সে আমাকে একটি চামড়ার থলে দিল। তার মধ্যে বিভিন্ন দিকের বায়ুকে বন্দী করে রেখেছিল অ্যাকোলাস। অ্যাকোলাসকে জিয়াস নিজে বিভিন্ন বায়ুপ্রবাহের প্রহরী নিযুক্ত করায় ইচ্ছামত কোন বায়ুপ্রবাহকে উত্তেজিত বা অবদমিত করতে পারত অ্যাকোলাস। সেই চামড়ার অলৌকিক থলেটির মুখ রূপোর তালা দিয়ে আবদ্ধ ছিল; তার মধ্যে কোন ছিদ্র ছিল না। তারপর সে প্রথমে পশ্চিমা বায়ুকে আহ্বান করে আমাদের জাহাজের প্রতি অনুকূল হবার জন্য অনুরোধ করল। কিন্তু তাতে আমাদের কোন কাজ হলো না। আমাদের অপরাধজনক কর্মের জন্য ব্যর্থ হলো অ্যাকোলাসের সে চেষ্টা এবং আবার আমাদের শুরু হলো দুর্দশা।

এরপর নয় দিন নয় রাত্রি ধরে ক্রমগত আমরা অবাধে এগিয়ে চললাম সমুদ্রপথে । আমাদের যাত্রাপথ ছিল সর্বতোভাবে নির্বিঘ্ন। দশ দিনের দিন আমরা দূরে দেখতে পেলাম আমাদের স্বদেশের মাটি। দূরে দেখতে পেলাম লোকে আগুন জ্বালাচ্ছে। আমি তখন নিবিড়তম ক্লান্তি আর অবসাদে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কারণ ঘরে ফেরার আগ্রহের আতিশয্যে আমি আমার জাহাজ নিজেই চালাচ্ছিলাম অবিশ্রান্তভাবে।

সহসা এই অবসরে আমার নাবিকরা আমার অর্জিত ধনসম্পদের কথা আলোচনা করতে লাগল নিজেদের মধ্যে। তারা ভেবেছিল অ্যাকোলাসপ্রদত্ত সেই চামড়ার থলেটির মধ্যে প্রচুর সোনা ও রূপো ছিল। তারা নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল, আমাদের অধিনায়ক যেখানেই যান প্রচুর সম্মান পান। যেখানেই জাহাজ থামে সেখানেই তিনি পান প্রচুর সম্মান আর ভালবাসা। ট্রয় থেকে প্রচুর ধনরত্ন লুণ্ঠন করে এনেছেন তিনি, অথচ আমরা আজ বাড়ি ফিরছি শূন্য হাতে। তার উপর অ্যাকোলাস আবার নিছক বন্ধুত্বের খাতিরে তাকে অনেক কিছু দিল। এখন এস সবাই মিলি দেখি, অ্যাকোলাসের দেওয়া এই থলেটার মধ্যে কত সোনা রূপো আছে।

এইভাবে তারা কিছু কথা বলাবলি করল। সারাদিন ধরে কুপরামর্শ করতে লাগল। তারপর দিনের শেষে সেই থলেটি তারা খুলে ফেলতেই অ্যাকোলাসের নিজের হাতে ভরে রাখা বিভিন্ন বায়ুপ্রবাহের আত্মারা বেরিয়ে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে এক প্রবল ঝড় উঠে আমাদের জাহাজটিকে টেনে নিয়ে গেল দূর সমুদ্রে। তারা তখন চোখের জলে ভাসতে লাগল; ক্রমে বিলীন হয়ে গেল ইথাকার ছবিটা।

আমি এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম। জেগে উঠে সবকিছু জেনেশুনে হতবাক হয়ে পড়লাম। আমার কেবলি মনে হচ্ছিল এইভাবে নিদারুণ বিপর্যয়ের মাঝে বেঁচে থাকার চেয়ে জলে ঝাঁপ দিয়ে মারা ভাল। যাই হোক, অবশেষে ঐ বিপদ মাথা পেতে সহ্য করারই সংকল্প করলাম আমি এবং বহির্বাস দিয়ে আমার মাথাটি ঢেকে আমি জাহাজেই শুয়ে পড়লাম। ক্রমে সেই অভিশপ্ত ঝড়ের আঘাতে আমাদের জাহাজগুলো আবার অ্যাকোলিয়া দ্বীপের বুকে গিয়ে ঠেকল। অনুতাপে জর্জরিত নাবিকরা হাহাকার করতে লাগল।

সেখানে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে আমরা নেমে পড়লাম জাহাজ থেকে। জাহাজের ভিতরেই আমরা আমাদের আহারের কাজ সেরে নিলাম। তারপর এক নাবিক আর একজন দূতকে সঙ্গে নিয়ে আমি চলে গেলাম অ্যাকোলাসের প্রাসাদে। সেখানে গিয়ে দেখলাম, অ্যাকোলাস তার স্ত্রী ও পরিবারবর্গে সঙ্গে বসে নৈশভোজন করছে। আমরা গিয়ে সেই ঘরের দরজার পাশে একটি তক্তার উপর বসলাম।

আমাদের দেখে বিস্ময়ে চমকে উঠল অ্যাকোলাস। বলল, ওডিসিয়াস, এখানে কেমন করে এলে আবার? এর জন্য কোন শয়তান দায়ী আমরা তোমাদের এখান থেকে পাঠাবার সময় তোমাদের দেশে ফেরার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুরই তো ব্যবস্থা করেছিলাম।

আমি অতিশয় বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলাম। আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম, এই ঘটনার জন্য দুটো বিষয় দায়ী। প্রথমে হলো আমার নাবিকদের নির্বুদ্ধিতা আর দ্বিতীয় হলো আমার কাল নিদ্রা। যাই হোক, যা হয়ে গেছে যেতে দাও। এখন ইচ্ছা করলে তুমি আমার সব ঠিক করে দিতে পার। কিন্তু আমার এই বিনীত আবেদনে কোন ফল হলো ্না। অ্যাকোলাসের পুত্ররা রেগে উঠল। সে নিজেও আমাদের ধিক্কার দিয়ে বলল, এখনি এই দ্বীপ ত্যাগ করে চলে যাও। তোমাদের মত পাপী লোক আর পৃথিবীতে নেই।

দেবতাদের দ্বারা ঘৃণিত কোন লোককে আমি কোনক্রমে সাহায্যদান বা আপ্যায়িত করতে পারি না। তোমাকে এখানে আশ্রয় দেওয়ার অর্থই হলো দেবতাদের সঙ্গে শত্রুতা করা। সুতরাং চলে যাও।

এইভাবে আমাদের তার প্রাসাদ থেকে তাড়িয়ে দিল অ্যাকোলাস। আমার সমস্ত প্রতিবাদ ব্যর্থ হলো। আমরা বিষণ্ণচিত্তে সেই দ্বীপ ত্যাগ করে আবার যাত্রা শুরু করলাম। যে অনুকূল বাতাস একদিন প্রচুর পেয়েছিলাম, আমাদের নির্বুদ্ধিতাহেতু সেই বাতাস আমরা আজ হারিয়েছি। তার ফলে আমার নাবিকদের অতিশয় কষ্টসহকারে দাঁড় টানতে হতে লাগল।

ছয়দিন ধরে আমরা সারা দিন রাত্রি দাঁড় টেনে জাহাজ চালিয়ে গেলাম। সপ্তম দিনে আমরা লেমাসের দেশ টেলিপাইলাসে পৌঁছলাম। সে দ্বীপে দিন রাত্রি এমনভাবে মিশে আছে যে অনেক লোক রাতে না ঘুমিয়ে পশুতাড়নে নিযুক্ত থাকে। অনেকে দিনে রাতে কাজ করে এবং দ্বিগুণ বেতন পায়। চারদিকে সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গে ঘেরা সেই দ্বীপের মধ্যে একটা সুন্দর পোতাশ্রয় পেয়ে গেলাম। সমুদ্রের একটি অংশ খালের মত তার মধ্যে ঢুকে গেছে। তখন আবহাওয়াটা ছিল বেশ শান্ত।

আমাদের দলের জাহাজগুলো সেই খালের মধ্যে প্রবেশ করে নোঙর করল। আমি আমার জাহাজটাকে একটা পাহাড়ের গায়ের দিকে বেঁধে রেখে সেই পাহড়ের চূড়ায় উঠে চারদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম দ্বীপটাকে। সেই দ্বীপের মাঝে কোথাও কোন কর্ষিত বা কৃষিযোগ্য ভূমি দেখতে পেলাম না। কোন মানুষের কাজকর্মের চিহ্নও পেলাম না কোথাও। শুধু দেখা গেল দূরে এক গ্রামাঞ্চলের মাথায় ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছে। আমি আমার দুজন নাবিক এ একজন দূতকে সেখানে পাঠালাম কোন ধরনের লোক বাস করে তা দেখার জন্য।

দূর পার্বত্য অরণ্য থেকে কাঠ কেটে সেই গ্রামাঞ্চলে নিয়ে যাবার জন্য একটা গাড়ি চলার পথ ছিল। সেই পথ ধরে আমার লোকেরা এগিয়ে চলল। কিছুদূরে গিয়ে তারা একটি বালিকার দেখা পেল। বালিকাটি নিকটবর্তী একটি ঝর্ণার জল নিতে এসেছিল। ঝর্ণাটির নাম আর্তেসি। সেই দ্বীপটির নাম ছিল ল্যাস্ট্রিগোনিয়া। আর সেই তরুণীটি ছিল ল্যাস্ট্রিগোনিয়ার দলপতি অ্যান্টিফেউস-এর কন্যা। আমার লোকেরা যখন সেই তরুণীটিকে জিজ্ঞেস করল সে দ্বীপে কোন জাতি বাস করে এবং সেখানকার শাসক কে? সে তখন পাহাড়ের উপর একটি বাড়ির দিকে আঙ্গুল বাড়িয়ে দেখাল। তারা তখন সেই বাড়িকে লক্ষ্য করে এগিয়ে গিয়ে অ্যান্টিফেউস-এর স্ত্রীকে দেখতে পেল।

ভীষণাকার রাক্ষসীর মত দেখতে সেই মহিলাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ভয় পেয়ে গেল আমার লোকেরা। তাদের দেখেই অ্যান্টিফেউস-এর স্ত্রী বাজার থেকে তার স্বামীকে ছুটে ডাকতে গেল। অ্যান্টিফেউসকে দেখতে ঠিক দানব ও রাক্ষসের মত। সে আমার লোকদের দেখার সঙ্গে সঙ্গে একজনকে খাবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর। তা দেখে অন্য দুজন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালিয়ে কোনক্রমে আমাদের জাহাজে এসে হাজির হলো। এদিকে অ্যান্টিফেউস তখন চিৎকার করে লোক ডাকাডাকি করতেই ল্যাস্ট্রিগোনিয়ার বহু লোক দলে দলে ছুটে আসতে লাগল আমাদের জাহাজের দিকে। তারা প্রকাণ্ড বড় বড় পাথর ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে এসে আমার দলের অন্যান্য জাহাজগুলোর সব লোকদের এক একটি মাছের মত ধরে নিয়ে গেল তাদের খাবার জন্য। আমার লোকেরা আর্তনাদ করতে লাগল অসহায়ভাবে। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারলাম না। অবশেষে নিজেকে বাঁচাবার জন্য যে দড়ি দিয়ে আমার জাহাজটাকে বাঁধা ছিল সেই দড়িটি আমার তরবারি বার করে কেটে দিয়ে আমার জাহাজের নাবিকদের অবিলম্বে জাহাজ ছাড়ার নির্দেশ দিলাম এবং তারাও ভয়ে কালবিলম্ব না করে জাহাজ ছেড়ে দিল। এইভাবে কোনমতে রক্ষা পেল আমার জাহাজটি। কিন্তু অন্যান্য জাহাজগুলো ও তাদের লোকেরা সব ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো নিঃশেষে।

এইভাবে জাহাজে করে বিষণ্ণচিত্তে এগিয়ে যেতে লাগলাম। আমরা এই কয়জনে উদ্ধার পাওয়ার জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলাম। কিন্তু আমাদের এতগুলো সহকর্মীকে হারিয়ে দুঃখ অনুভব না করে পারছিলাম না। এইভাবে যেতে যেতে আবার একট নতুন দ্বীপে গিয়ে পৌঁছলাম আমরা। দ্বীপটির নাম ঈয়া। সেই দ্বীপে এক মায়াবিনী জাদুকরী বাস করত; তার গলার স্বরটা ছিল সাধারণ নারীর মত। সে ছিল জাদুকর এঈতেসের বোন। তারা দুজনেই ছিল সূর্যের ঔরসে সমুদ্রকন্যা নার্সির গর্ভজাত সন্তান। আমরা নিঃশব্দে সে দ্বীপের উপকূলবর্তী হয়ে জাহাজগুলোকে থামালাম। কোন দেবতা নিশ্চয় আমাদের সেখানে পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা সেখানে জাহাজ থেকে অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গেই ক্লান্তি ও অবসাদের নিবিড়তাহেতু বেলাভূমির উপর শুয়ে পড়লাম। অ্যান্টিফেউসের ভয়ে আমরা সর্বশক্তি প্রয়োগ করে এত জোরে জাহাজ চালিয়েছিলাম যে আমাদের দেহে যেন আর কোন শক্তি ছিল না। পুরো দুদিন দুরাত্রি আমরা সেই বেলাভূমির উপর শুয়ে রইলাম।

তৃতীয় দিন আকাশে সূর্য উঠতেই আমি আমার বর্শা আর তরবারি নিয়ে দ্বীপের ভিতরে চলে গেলাম। এমন কিছু জিনিসের আমার প্রয়োজন ছিল যার জন্য মানুষের কোন বসতি বা জনপদ দরকার। আমি একটা পাহাড়ের মাথায় উপর উঠে চারদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। অবশেষে দেখতে পেলাম বহুদূরে ও ঘনসংবদ্ধ গাছের কুঞ্জে ঘেরা সেই জাদুকরীর কুটির হতে ধোঁয়া উঠছে। এই ধোঁয়া দেখার পর দোলায়িত চিত্তে আমি ভাবতে লাগলাম। আমি সেই ধোঁয়া লক্ষ্য করে সেইদিকে এগিয়ে যাব কি যাব না। তা স্থির করতে পারলাম না। অবশেষে আমি স্থির করলাম আপাতত আমার উচিত আমার জাহাজে ফিরে আমার লোকদের খাবারের ব্যবস্থা করে তাদের মধ্যে দুই একজন দূত হিসেবে পাঠানো। এই ভেবে আমি সেই পাহাড় থেকে আমার জাহাজের দিকে যেতেই পথে একটি হরিণ পেয়ে গেলাম ভগবানের কৃপায়। আমার বর্শার দ্বারা

সেটিকে মেরে গাছের লতা ছিঁড়ে হরিণটাকে আমার কাঁধে ঝুলিয়ে আমার জাহাজে নিয়ে গেলাম। তারপর আমার লোকদের বললাম, বন্ধুগণ ওঠ, আমাদের মনেপ্রাণে দুঃখ যতই থাক, উঠে আহারের ব্যবস্থা করো।

আমরা সকলে মিলে সারাদিন ধরে প্রচুর মাংস আর মদ খেয়ে সন্ধ্যা হতেই বেলাভূমির উপর শুয়ে পড়লাম। সকাল হতেই আমি আমার লোকদের একজায়গায় জড়ো করে বললাম, বন্ধুগণ, কোনটা পশ্চিমদিক আমরা তার কিছুই জানি না, শুধু সূর্যের উদয় অস্ত থেকেই তা নির্ণয় করি। আমরা কোথায় এসেছি তারও কিছু জানি না। সুতরাং আমাদের এবার তা সন্ধান করে দেখতে হবে। আমি যখন কিছুক্ষণ আগে একটা পাহাড়ের উপরে উঠে চারদিক নিরীক্ষণ করছিলাম তখন দেখলাম এটি একটি দ্বীপ যার চারদিকেই বিস্তৃত হয়ে আছে দিগন্ত প্রসারিত সমুদ্রের অনন্ত জলরাশি। এ দ্বীপের কোথাও কোন জন মানব দেখতে পেলাম না, শুধু তার মধ্যবর্তী স্থলে একটি ঘন কুঞ্জবনের মাঝে ধোয়ার এক ক্ষীণ কুণ্ডলী দেখতে পেলাম।

আমার লোকেরা একথা শুনে দুঃখ ও হতাশায় ভেঙ্গে পড়ল আবার। সাইক্লোপ জাতির লোকেরা অ্যান্টিফেটস ও ল্যাস্ট্রিগোনিয়ার নরখাদক অধিবাসীরা কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি করেছে সেকথা স্মরণ করে দুঃখিত না হয়ে পারল না তারা। তারা ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। জলের ধারা গড়িয়ে পড়তে লাগল তাদের চোখ থেকে। কিন্তু তাদের সে চোখের জল মুছে ফেলতে হবেই।

অবশেষে আমি আমার লোকজনদের দুই দলে ভাগ করে দুই ভাগেই একজন করে সেনাপতি নির্বাচিত করলাম। দুই দলের মধ্যে একটি দলের সেনাপতিত্বের ভার আমি নিজে নিলাম আর একটি দলের ভার দিলাম ইউরিলোকাসের উপর। আমরা ব্রোঞ্জের শিরস্ত্রাণ পরিধান করলাম। প্রথমে রওনা হলো ইউরিলোসের দল। তারা অপূর্ণ চোখে বিদায় দিল আমাদের কাছ থেকে। যথাসময়ে তারা উপনীত হলো সেই জাদুকরীর বাড়ির সামনে। ঘন বনের মাঝখানে একটুখানি পরিচ্ছন্ন জায়গায় ছিল বাড়িটা এবং সেই ছিল খাঁটি পাথরের তৈরি।

জাদুকরীর ঐন্দ্রজালিক প্রভাবে বশীভূত অসংখ্য নেকড়ে বাঘ আর সিংহে পরিপূর্ণ ছিল সেই কুটিরের প্রাঙ্গণটা। সেইসব নেকড়ে আর সিংহের দল কিন্তু আমার লোকজনদের কামড়াল না। তারা প্রভুভক্ত কুকুরের মত লেজ নেড়ে সাদর অভ্যর্থনা জানাতে লাগল। আমার লোকেরা তখন ভীত হয়ে সেই জাদুকরী দেবীর কুটিরদ্বারের সমীপবর্তী হলো। সেখান থেকে তারা বুঝতে পারল সেই কুটির মধ্যে জাদুকরী চরকায় সুতো কাটার তালে তালে মধুর কণ্ঠে গান গাইছে। সেরকম সূক্ষ্ম সুন্দর চোখ ঝলসানো সুতো একমাত্র দেবতারাই কাটতে পারে।

পোলাইতেস ছিল সেই দলের নেতা। সে ছিল যেমন আমার বিশ্বাসভাজন তেমনি প্রিয়। পোলাইতেস তার অধীনস্থ সঙ্গীদের বলল, বন্ধুগণ, এই কুটিরে কেউ একজন সুতো কাটছেন। তাঁর মধুর কণ্ঠস্বর ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সমগ্র বনভূমি। চল চিৎকার করে আমরা তাঁকে আমাদের আগমন সংবাদ জানাই।

তারা তখন তারস্বরে চিৎকার করতেই জাদুকরী পালিশকরা সুন্দর দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে তাদের ভিতরে প্রবেশ করতে বললেন। তারা সরল বিশ্বাসে তার পশ্চাদ অনুসরণ করল। কিন্তু একমাত্র ইউরিলোকাস সন্দেহের বশবর্তী হয়ে বাইরে রয়ে গেল। জাদুকরী তাদের তাঁর ঘরে নিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসিয়ে যবের আটা, মাখন আর মদ মিশিয়ে এক খাদ্য প্রস্তুত করে তাদের খেতে দিলেন। কিন্তু সেই খাদ্যের মধ্যে তিনি এমন এক ঔষধি মিশিয়ে দেন যা খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা সম্পূর্ণরূপে ভুলে যায় তাদের জন্মভূমির কথা। তারা সেই খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে জাদুকরী তাঁর জাদুকাঠি দিয়ে তাদের আঘাত করতেই তারা সবাই শূকরে পরিণত হয়ে গেল। তিনি তখন তাদের শূকরদের সঙ্গে একই খোয়াড়ে থাকার ব্যবস্থা করে একই খাদ্য খেতে দিল। কিন্তু তারা শূকরে পরিণত হলেও তাদের মানসিক জ্ঞান ও চেতনাশক্তি ঠিক ছিল যার ফলে তারা তাদের বর্তমান দূরবস্থার কথা বুঝতে পেরে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করছিল।

তাদের সেই দূরবস্থা দেখে ইউরিলোকাস ছুটে জাহাজে পালিয়ে আসে। তার সঙ্গীরা যে ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ে সম্মুখীন হয়েছে তার কথা সে আমাদের জানাতে আসে। কিন্তু দুঃখের চাপে সে কোন কথা বলতে পারছিল না, শুধু চাপা আর্তনাদের সঙ্গে ফুফিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। আমরা এ দৃশ্য দেখে আশ্চর্য হয়ে তাকে প্রশ্ন করতে লাগলাম।

অবশেষে উত্তর করল ইউরিলোকাস, হে আমার প্রভু ওডিসিয়াস আপনার আদেশমত সেখানে গিয়েছিলাম আমরা। কিন্তু সেই জাদুকরীর ঘরে প্রবেশ করে আমার সঙ্গীরা সব অদৃশ্য হয়ে গেছে।

তার কথা শুনে আমি আমার কাঁধে ধনুর্বাণ ও কটিতে রৌপ্য আচ্ছাদনে আবদ্ধ ব্রোঞ্জনির্মিত তরবারি ঝুলিয়ে ইউরিলোকাসকে বললাম, আমি সেখানে যাব, সে যেন আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু সে আমার পায়ে ধরে অনুনয় বিনয় করে বলল, হে আমার প্রিয় রাজন, আমাকে অন্তত এখান রেখে যান। আপনি সেখানে একবার গেলে আর ফিরতে পারবেন না আর আপনার নাবিকদেরও উদ্ধার করতে পারবেন না। তার থেকে আমরা যারা অবশিষ্ট আছি তাদের নিয়ে এই মুহূর্তে পালিয়ে চলুন জাহাজে করে।

আমি তখন তাকে বললাম, ঠিক আছে ইউরিলোকাস, তুমি এখানে এই জাহাজে থেকে পান ও ভোজনে কালক্ষেপ করো। কিন্তু আমাকে এক সহজ মানবিক কর্তব্যের খাতিরে সেখানে যেতেই হবে।

এই কথা বলে আমি দ্রুতপায়ে একাই চলে গেলাম সেই দ্বীপের ভিতরে। আমি যখন সেই মায়াময় বনপথের একটি ক্ষীণ রেখা ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলাম কোনমতে তখন সহসা স্বর্ণজাদুকাঠি ধারণকারী দেবতা হার্মিসের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তিনি এক তরুণ যুবকের বেশে আমার সামনে উপস্থিত হয়ে আমার একটি হাত ধরে অন্তরঙ্গভাবে বললেন, কোথায় যাচ্ছ হে হতভাগ্য মানব? এই দেশ তোমার অজানা এবং তোমার সঙ্গীরা জাদুকরীর ঘরে শূকররূপে বন্দী হয়ে আছে। তুমি হয়ত তাদের উদ্ধার করতে যাচ্ছ, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তুমি নিজেও তাদের মত শূকরে পরিণত হয়ে সেই জীবন যাপন করবে। যাই হোক, আমি তোমাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করব। এই ঔষধিটি সঙ্গে রেখে দেবে। জাদুকরী তোমার পানপাত্রে তার ঔষধি মিশিয়ে দিলেও তুমি এটি খেলে তার ঔষধিতে কোন কাজ হবে না। এই ঔষধির গুণ তার ঔষধির ক্রিয়াকে বিকল করে দেবে। জাদুকরী যখন তার জাদুকাঠি দিয়ে তোমায় আঘাত করার চেষ্টা করবে তুমি তখন তোমার তরবারি নিয়ে তার প্রাণ হরণ করার ভান করে তাকে তাড়া করবে। সে তখন তোমার ভয়ে তোমাকে তার রতিমন্দিরের সুরতশয্যায় আহ্বান করবে। যদি তুমি তার কবল থেকে তোমার লোকদের উদ্ধার করতে চাও, এবং তার কাছ থেকে সদয় ব্যবহার পেতে চাও তাহলে তার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করবে না। কিন্তু তাকে দিয়ে শপথ করিয়ে নেবে সে যেন তোমার পৌরুষ ও মনুষ্যত্ব হরণ করার জন্য আর কোন জাদু প্রয়োগ না করে।

একথা বলার পর হার্মিস মাটি থেকে একটি গাছের চারা উৎপাটিত করে আমার হাতে দিলেন। সেই চারার মূলটি কালো রঙের এবং তার মধ্যে দুধের মত সাদা একটি ফুল ছিল। দেবতারা সেই চারাটিকে বলে মলি’। মানুষের পক্ষে তার সন্ধান জানা সম্ভব নয়।

হার্মিস তখন সেই বনপথ দিয়ে অলিম্পাসে চলে গেল। আর আমি তখন শঙ্কাকীর্ণ হৃদয়ে জাদুকরীর কুটিরের পথে এগিয়ে চললাম। আমি তার কুটিরের সামনে গিয়ে চিৎকার করতেই সে ঘর হতে বেরিয়ে এসে যথারীতি আমাকে প্রবেশ করতে বলল তার মধ্যে। আমি সেখানে প্রবেশ করলে সে আমাকে বসতে দিয়ে এক পাত্র পানীয় প্রস্তুত করে তার মধ্যে ঔষধি মিশিয়ে দিল। কিন্তু আমার কাছে হার্মিসপ্রদত্ত ঔষধি থাকায় তার সে ঔষধি কোন কাজ করল না। তখন সে তার জাদুকাঠি দিয়ে আমায় আঘাত করে আমাকে শূকরের খোঁয়াড়ে নিয়ে গিয়ে আমার সঙ্গীদের সঙ্গে থাকার জন্য আদেশ করল। আমি তখন আমার তরবারি বার করে তাকে আক্রমণ করতেই সে আমার সামনে নতজানু হয়ে কাতরভাবে বলতে লাগল, কে তুমি, তোমার পিতামাতাই বা কে, কোথায় কোন নগরে তোমার বাস? আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি তোমায় দেখে, কারণ এমন কোন মানুষ আজ পর্যন্ত দেখিনি যে আমার ঔষধি পান করে অবিকৃত থাকতে পেরেছে। তোমার অন্তরের অন্তস্থলে নিশ্চয় এমন এক কঠিন অন্তর আছে যা কোন মায়ার দ্বারা বশীভূত হয় না কখনো। আমার মনেহয় তোমার নাম ওডিসিয়াস, ট্রয় থেকে এসেছ এক কৃষ্ণবর্ণ জাহাজে করে। হার্মিস তোমারই কথা আমায় বলেছিল একবার। কিন্তু আমার অনুরোধ, তুমি তোমার তরবারি কোষবদ্ধ করে আমার রতিমন্দিরে এসে আমার শয্যায় শয়ন করো। এক নিবিড় প্রেমালিঙ্গনের মধ্যে দিয়ে এক মধুর নিদ্রাসুখ উপভোগ করি। এক অক্ষয় বিশ্বাস ও ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হই আমরা ধীরে ধীরে।

আমি তখন উত্তর করলাম, শোন জাদুকরী, তুমি যখন আমার বন্ধুদের শূকরে পরিণত করে রেখেছ তোমার ঘরে এবং আমাকে যখন তোমার শয্যায় আহ্বান করে আমার পৌরুষ ও মানবতাকে হরণ করতে চাইছ তখন কি করে তুমি আমার কাছ থেকে সদ্ব্যবহার প্রত্যাশা করতে পার? তুমি আমার কোন ক্ষতি করবে না একথা যদি শপথ করে আমায় না বলে তাহলে কিছুতেই তোমার তোমার শয্যাসঙ্গী হব না।

জাদুকরী তখন আমার কথায় সম্মত হয়ে শপথ করে বলল আমার প্রতি তার কোন কুমতলব নেই। তার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পেয়ে আমি তার মনোরম রতিমন্দিরে গমন করলাম। বসন্ত, কুঞ্জবন ও দুটি সমুদ্রগামী নদীর কন্যা অর্থাৎ মোট চারটি মেয়ে জাদুকরীর যাবতীয় গৃহকর্ম সম্পাদন করছিল। আমাকে প্রথমে জাদুকরীর সেই পরিচারিকারা ঈষদুষ্ণ গরম জলে স্নান করিয়ে আমার গায়ে অলিভ তেল মাখিয়ে দিল। তারপর আমাকে উত্তম পোশাক পরিয়ে দিয়ে খাদ্য ও পানীয় দিল। কিন্তু আমি কোনকিছুই না খেয়ে স্থির হয়ে বসে ভাবতে লাগলাম। আমাকে এইভাবে বসে থাকতে দেখে জাদুকরী আমার কাছে এসে বলল, কেন এভাবে বসে রয়েছে ওডিসিয়াস? তুমি কি ফাঁদে পড়ার আশঙ্কা করছ? আমি তো তোমায় কথা দিয়েছি তোমার কোন ক্ষতি করব না।

আমি বললাম, আমি যদি সৎ লোক হই তাহলে আমার বিপন্ন সঙ্গীদের মুক্ত না দেখে কি করে উত্তম খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করতে পারি তা বলতে পার? তুমি যদি একান্তই চাও এ খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করি তাহলে আগে আমার লোকদের মুক্ত করো।

জাদুকরী তার জাদুকাঠি নিয়ে খোঁয়াড় হতে শূকররূপ আমার সহকর্মীদের নিয়ে এল। কী একটা তরল পদার্থ তাদের গায়ে মাখিয়ে দিতেই তাদের গা থেকে একটা অঙ্কুর ঝরে গেল। সেই অঙ্কুরটি জাদুকরির দেওয়া সেই ওষুধটি খাওয়ার ফলে বার হয়েছিল। সেই অঙ্কুরটি ঝরে যেতেই তারা আবার মানুষ হয়ে উঠল। তারা আমাকে দেখেই চিনতে পারল। আমাদের চোখ থেকে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। আমাদের চাপা কান্নার শব্দে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে লাগল সেই কুটিরের দেয়ালগুলো, এমন কি জাদুকরী নিজেও বিচলিত হয়ে উঠল আমাদের মিলনদৃশ্য দেখে।

জাদুকরী তখন আমার কাছে এসে বলল, হে লার্তেসপুত্র, তুমি তোমার অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছ। এখন তুমি সমুদ্রোপকূলে গিয়ে তোমার জাহাজটিকে টেনে এনে স্থলভাগে বেঁধে রাখ। যাবতীয় মালপত্র উপকূলভাগের একটি গুহায় রেখে তোমার সঙ্গীদের নিয়ে আমার কাছে ফিরে এস।

আমার দুঃসাহসী মন তার প্রস্তাবে সম্মত না হয়ে পারল না। আমি আমার জাহাজে ফিরে গিয়ে দেখলাম, আমার সহকর্মীরা সকলে দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে অশ্রুবিসর্জন করছে। দিনের শেষে গোচরণক্ষেত্র হতে গাভীরা বাসায় প্রত্যাবর্তন করলে গোবৎসগুলো যেমন তাদের মাতাদের চারপাশে ভিড় করে, তেমনি আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সঙ্গীরা ছুটে এল অপূর্ণ চোখে। তারা তাদের হারানো সহকর্মীকে ফিরে পেয়ে এতদূর আনন্দিত হলো যে দেখে মনে হলো তারা যেন তাদের বহু আকাক্ষিত জন্মভূমি পর্বতসঙ্কুল ইথাকায় প্রত্যাবর্তন করেছে। তারা আমাকে বলল, হে আমাদের প্রভু, প্রিয় রাজন, আপনাকে ফিরে পেয়ে মনে হচ্ছে আমরা যেন স্বচ্ছন্দে ফিরে এসেছি। কিন্তু আমাদের সহকর্মীদের খবর কি?

আমি আনন্দের সঙ্গে উত্তর করলাম, আমাদের প্রথম কাজ হবে আমাদের জাহাজটাকে কুলের কাছে টেনে নিয়ে গিয়ে জাহাজের সব মালপত্র একটা গুহাতে রাখা। তারপর জাদুকরীর সেই মায়াময় কুটিরে তোমাদের বন্ধুরা কিভাবে পানাহারে আপ্যায়িত হচ্ছে তা যদি দেখতে চাও তাহলে আমার সঙ্গে তোমরাও সেখানে যাবে।

একমাত্র ইউরিলোকাস ছাড়া আর সকলেই আমার প্রস্তাবে সম্মত হলো। কিন্তু ইউরিলোকাস অন্য সকলের মনে ভয়ের সঞ্চার করে বলল, আমরা কোথায় যাব? তোমরা কি নিজেদের বিপদকে নিজেরাই ডেকে আনতে চাও? তোমরা কি সেই ডাইনি মেয়েটাকে দেখতে গিয়ে তার কাছে ধরা দিয়ে নেকড়ে বা শূকরে পরিণত হতে চাও? এই হঠকারী অপরিণামধমী ওডিসিয়াসের সঙ্গে গিয়ে আমাদের অনেক সঙ্গী সাইক্লোপের ক্ষুধার খাদ্যে পরিণত হয়। এর নির্বুদ্ধিতার জন্যই তাদের জীবন যায়।

ইউরিলোকের কথা শুনে আমার মনে হচ্ছিল সে আমার আত্মীয় হলেও তরবারি দিয়ে তার মাথাটা কেটে ফেলে ধুলোয় লুটিয়ে দিই। কিন্তু আমার লোকজনদের সমবেত প্রতিবাদের ফলে আমি সামলে নিলাম নিজেকে। তারা ইউরিলোকাসের প্রতি সহানুভূতিবশত বলল, একে রক্ষী হিসেবে জাহাজে রেখে আমাদের সেখানে নিয়ে যেতে পারেন। আমরা জাহাজ ছেড়ে রওনা হবার উদ্যোগ করতেই ইউরিলোকাসও লজ্জায় ও আমার ভৎর্সনার ভয়ে আমাদের সঙ্গে যেতে চাইল। আমরা গিয়ে দেখলাম জাদুকরী আমার লোকজনদের স্নান করিয়ে তেল মাখিয়ে তাদের জন্য ভূরিভোজনের ব্যবস্থা করেছে। আমার সঙ্গে দ্বিতীয়বার যারা গিয়েছিল তারা যখন তাদের হারানো সহকর্মীদের দেখল তখন আনন্দাশ্রুতে ভরে উঠল তাদের সকলের চোখ। তারা এক চাপাকান্নায় ফেটে পড়ল। জাদুকরী তখন তাদের কান্না থামাবার জন্য আমায় অনুরোধ করল।

জাদুকরী আমার সঙ্গীদের বলল, আমি তোমাদের সব কথা জানি। জলপথে মৎস্যসঙ্কুল অকূল সমুদ্রের ও স্থলপথের বন্যবর্বর আদিম অধিবাসীদের হাতে অনেক কষ্ট ভোগ করেছ তোমরা। এখন পানাহারে তৃপ্ত হয়ে আগেকার মত আবার সুস্থ সবল মানুষ হয়ে ওঠ ঠিক ইথাকায় যেমন তোমরা একদিন ছিলে। তোমরা এখন ক্লান্ত ও অবসন্ন। সেই বিগত দুঃখকষ্টের কথা এখনো তোমরা ভুলতে পারছ না। দীর্ঘকাল দুঃখভোগের পর আনন্দের আস্বাদ ঠিকমত গ্রহণ করতে পারছ না।

আমার বীর সঙ্গীরাও একথা মেনে নিল। এইভাবে আমরা পুরো একটি বৎসর রয়ে গেলাম সেই জাদুকরীর প্রাসাদে প্রচুর আরামে ও স্বাচ্ছন্দের সঙ্গে। একটি বৎসর অতিক্রান্ত হবার পর আমার সঙ্গীরা একদিন আমাকে যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে বলল, মহাশয়, আপনি যদি স্বদেশে ফিরে যেতে চান তাহলে একবার ইথাকার কথা ভাবুন।

তাদের একথা যথেষ্ট হয়ে উঠল আমার স্বদেশচিন্তার পক্ষে। সারাদিন ধরে আমরা পানাহারে মত্ত হয়ে থাকলাম। কিন্তু সূর্য অস্ত গেলে আমার সঙ্গীরা যখন একটি প্রায়ান্ধকার প্রশস্ত কক্ষে শুয়ে পড়ল, আমি চলে গেলাম জাদুকরীর সুজ্জিত শয়নমন্দিরের সুরতশয্যায় যেখানে সে আগে হতেই শুয়েছিল। আমি সেদিন তার কাছে গিয়ে তার পা দুটো জড়িয়ে ধরে বললাম, হে আমার প্রিয় সহচরী, আমাকে নিরাপদে বাড়ি পাঠাবার যে প্রতিশ্রুতি একদিন আমায় দিয়েছিলে, আমার অনুরোধ সে প্রতিশ্রুতি আজ রক্ষা করো। এখন আমি এবং আমার লোকজন সকলেই বাড়ি ফিরতে চাই। তারা সকলেই অনুযোগ করছে আমার কাছে।

আমার কথার উত্তরে জাদুকরী দেবী বলল, হে বুদ্ধিমান লার্তেসপুত্র ওডিসিয়াস, আমি তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তোমাকে কিছুতেই রেখে দেব না আমার বাড়িতে। কিন্তু বাড়ি ফেরার আগে তোমাকে মৃত্যুপুরীতে গিয়ে গীবস-এর মৃত জ্যোতিষী পার্সিফোনের সঙ্গে তোমাকে পরামর্শ করতে হবে। পার্সিফোন এমনই একজন জ্ঞানী ব্যক্তি যে মৃত্যুর পরেও তার জ্ঞান লুপ্ত হয় নি। মৃত্যুর পরেও একমাত্র পার্সিফোনের অশরীরী আত্মার মধ্যে আছে এক তীক্ষ্ণ যুক্তিবোধ। অন্যসব আত্মাগুলো এক একটি অলীক ও নিগুণ ছায়ামাত্র।

একথা জানতে পেরে হতাশায় বেশকিছুটা ভেঙ্গে পড়লাম আমি। আমি জাদুকরীর সেই সুরতশয্যার উপর বসে বসে কাঁদতে লাগলাম। নিজের জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠলাম আমি। স্বর্গলোকে আর আমার কোন প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু অনেক অশ্রুপাত করার পর যখন ক্লান্ত হয়ে উঠলাম আমি তখন তাকে প্রশ্ন করলাম, কিন্তু বল জাদুকরী, কে তাহলে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে? নরক বা মৃত্যুপুরীর পথ তো মর্ত্যের কোন নাবিক জানে না।

জাদুকরী কলল, ওডিসিয়াস, নাবিকের অভাবে তোমাকে কূলে পড়ে থাকতে হবে না। পাল ও মাস্তুল খাঁটিয়ে তোমার জাহাজে গিয়ে তুমি বসে থাকবে। উত্তরের বায়ুপ্রবাহ পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে তোমায়। যখন এই বাতাসের সাহায্যে ওসিয়ান নদী অতিক্রম করতে পারবে তখনি দেখতে পারে পার্সিফোনের কুঞ্জবন। যার চারদিকে সারবন্দীবভাবে দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় পপলার আর উইলোগাছ। সেইখানে তোমার জাহাজ রেখে তুমি সোজা চলে যাবে মৃত্যুপুরীর দ্বারপথে। সেখানে দেখবে এক পাহাড়ের চূড়ার উপরে জ্বলন্ত আগুন আর শোকের দুটি নদীর স্রোত মিলিত হয়ে এক বিশাল জলধারার সৃষ্টি করেছে। আর সেই গর্জনশীল জলধারা সবেগে পতিত হচ্ছে অ্যাকেরণ সমুদ্রে।

আমি চাই তুমি সেখানে গিয়ে তিন ফুট লম্বা ও তিন ফুট চওড়া একটি খাল কাটবে। তারপর তার পাশে মধুর সঙ্গে দুধ ও সুমিষ্ট মদ মিশিয়ে মৃতদের উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য দান করবে। তারপর দেবে জলের অঞ্জলি। অঞ্জলি দান হয়ে গেলে মৃতদের অসহায় প্রেতাত্মাদের উদ্দেশ্যে শপথবাক্য উচ্চারণ করে বলবে ইথাকায় ফিরে গিয়ে। তুমি তাদের উদ্দেশ্যে একটি কুমারী বকনাকে বলি দেবে আর তাদের চিতায় ধনরত্ন সাজিয়ে দেবে। বিশেষ করে তিয়েরিসিয়াস এর উদ্দেশ্যে একটি মিশ-কালো ভেড়া বলি দেবার প্রতিশ্রুতি দেবে। তারপর একটি তরুণ ভেড়া ও কালো ভেড়ী বলি দিয়ে তাদের মুণ্ড দুটি নরকের দেবতা এরেবাসকে দিয়ে তোমরা পিছন ফিরে না তাকিয়ে ওসিয়ান নদী পার হয়ে আসবে।

জাহাজে গিয়ে দেখবে অসংখ্য মৃত লোকের প্রেতাত্মারা দলে দলে এসে ভিড় করছে। তাদের তৃপ্ত করার জন্য তুমি লোকদের যথাশীঘ্র ভেড়া কেটে আগুনে দগ্ধ করে মৃত্যুর দেবতা ও পার্সিফোনের কাছে প্রার্থনা করতে বলবে। ইত্যবসরে তুমি স্থির হয়ে বসে থাকবে। তোমার হাতে থাকবে একটি মুক্ত তরবারি, তিয়েরিসিয়াসের সঙ্গে তোমার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোমার কাছে কোন প্রেতাত্মাকে আসতে দেবে না। অবশেষে পার্সিফোনে নিজে তোমার কাছে এসে তোমার যাত্রাপথের বিবরণ দান করে কিভাবে কোন পথে যেতে হবে, কত পথ অতিক্রম করতে হবে তা সব বলে দেবে।

জাদুকরীর কথা যখন শেষ হলো তখন স্বর্গলোকের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন ঊষাদেবী। জাদুকরী আমায় পোশাক পরিয়ে নিজেও হালকা ধরনের রূপোলি সুতো দিয়ে তৈরি একটি বহির্বাস পরে ও অবগুণ্ঠনে মুখ ঢেকে আমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল। আমি প্রথমে আমার লোকজনদের তৈরি হতে বললাম। বললাম, তোমরা প্রভুকে বিদায় দিয়ে ওঠ। জাগো। জাদুকরী দেবী আমাদের যাবার আদেন দান করেছেন।

আমার কথা শুনে উৎসাহের আতিশয্যে আমার সঙ্গীরা হৈ চৈ শুরু করে দিল। আমাদের দলে এলপিনর নামে এক যুবক ছিল। সে ছাদের উপর শুয়েছিল। হঠাৎ জেগে উঠে তাড়াতাড়ি করে নামতে যেয়ে ছাদ থেকে নিচে পড়ে যায় সে। তার ঘাড় ভেঙ্গে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে তার মৃত্যু ঘটে। মই দিয়ে না নেমে ছাদ থেকে লাফ দিয়েছিল সে।

যাত্রার সময় আমি আমার লোকদের বললাম, তোমরা হয়ত ভাবছ তোমরা সোজা এখান থেকে ইথাকায় যাচ্ছ। কিন্তু জাদুকরী দেবী আমাদের মৃত্যুপুরী হয়ে ঘুরে যেতে বলেছেন, সেখানে আমাদের থীবসদেশীয় জ্যোতিষীর পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।

আমার কথা শুনে তারা বসে আকুলভাবে কাঁদতে লাগল। কেউ কেউ মাথার চুল ছিঁড়তে লাগল। কিন্তু কোন উপায় নেই। আমরা দুঃখিতচিত্তে অপূর্ণ চোখে জাহাজ ছেড়ে দিলাম। জাদুকরী একটি ছোট ভেড়া আর একটি কালো ভেড়ী আমাদের জাহাজে বেঁধে দিল। তারপর কোন কথা না বলে আমাদের চোখ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল জাদুকরী। দেবতাদের অন্তর্ধানরহস্য বোঝার সাধ্য মানুষের নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *