১০. জনক বংশ – দশম প্রকরণ
কুশবংশে পেয়েছি প্রাকৃতিক নিয়মে উত্তত শস্যপ্রদায়ী তৃণ। শস্যবীজ হতে গাছ হয় এবং সেই গাছ হতে পুনরায় শস্য উৎপাদিত হয়, এই তথ্যও কৃষিবিদ্যার অন্তর্গত। জনকবংশে সেই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
রামসীতার বিবাহ বাসরে সীরধ্বজ যে বংশ তালিকা পেশ করেন সেটি এখানে আলোচ্য বিষয়। নিমি হতে বংশের শুরু, সীরধ্বজে শেষ। সীরধ্বজ ও তার ভাই কুশধ্বজের পুরগণের সম্পর্কে রামায়ণে কোন উল্লেখ নাই। যেন দুই ভাই-এর চার কন্যার সঙ্গে দশরথের চার পুত্রর বিবাহের ভিতর দিয়ে বংশটি লোপ পেয়ে গেল। ইক্ষ্বাকুবংশের তুলনায় এই বংশে উপকাহিনীও কম। একমাত্র নিমি সম্পকীয় কাহিনী উল্লেখযোগ্য। এই কাহিনী উত্তরকাণ্ডে বর্ণিত হয়েছে। বালকাণ্ডে জনক বংশের পূর্বপুরুষের হরঃধনু প্রাপ্তির প্রসঙ্গটুকু মাত্র আছে। সীতার বিবাহের পর এই বংশটির আর কোনই ভূমিকা নাই।
জনক বংশের তালিকা,—১। নিমি ২। মিথি ৩। জনক ৪। উদাবসু ৫। নন্দিবর্ধন ৬। সুকেতু ৭। দেবরাত ৮। বৃহদ্ৰথ ৯। মহাবীর ১০। সুধৃতি ১১। ধৃষ্টকেতু ১২। হর্য্যশ্ম ১৩। মরু ১৪। প্রতীন্ধক ১৫। কীর্তিরথ ১৬। দেবমীঢ় ১৭। বিবুধ ১৮। মহীধ্রক ১৯। কীর্তিরথ ২০। মহারোমা ২১। স্বর্ণরোমা ২২। হ্রস্বরোমা ২৩। সীরধ্বজ এবং কুশধ্বজ।
হ্রস্বরোমার দুই পুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ সীরধ্বজের হলকর্ষণকালের প্রাপ্ত কন্যা অযোনিসম্ভব সীতা।
এই বংশ তালিকার ব্যক্তিগণের মধ্যে রামায়ণে একমাত্র প্রাধান্য নিমির। জনক; বংশের নামকরণেই মাত্র বিখ্যাত।
উদ্ভিদবিজ্ঞানে শুধু বীজ বললে হয় না, সেই সঙ্গে বীজের অংকুরোদগম এবং চারার পুষ্টি, বৃদ্ধি, ফুল, ফল সকল পর্যায় বিশ্লেষণ করা হয়। কিন্তু বীজ হতে অংকুরোদগম না হলে বাকীটুকু নিরর্থক। তাই জনকের প্রাধান্য স্বীকার করা হয়েছে।
সীরধ্বজ প্রদত্ত জনক বংশের তালিকায় নিমি উক্ত বংশের প্রথম পুরুষ। কিন্তু রামায়ণের উত্তরকাওে রাম কর্তৃক লক্ষণের নিকট নিমিবসিষ্ট-বৃত্তান্ত বিবৃত করার কালে নিমিকে ইক্ষ্বাকু পুত্ৰগণের মধ্যে দ্বাদশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই ইক্ষ্বাকু বংশীয় নিমি গৌতম মুনির আশ্রমের নিকট দেবপুরীর ন্যায় রমণীয় এক পুরী নির্মাণ করেছিলেন; যার নাম ছিল বৈজয়ন্ত।
পিতার মনে আহ্লাদ উৎপাদন করতে দীর্ঘসত্র করব, নিমি এরূপ সিদ্ধান্ত নিয়ে পিতা ইক্ষ্বাকুকে আমন্ত্রণ করে প্রথমে বসিষ্ঠ এবং পরে ভৃগু, অত্রি এবং অঙ্গিরাকে বরণ করেন। বসিষ্ঠ নিমিকে জানান যে ইন্দ্রর যজ্ঞে পূর্বেই তাকে বরণ করা হয়েছে সে কারণে নিমি যেন অপেক্ষা করে। বসিষ্ঠ প্রস্থান করলে নিমি গৌতমকে দিয়ে বসিষ্ঠর কর্তব্য সমাধা করে তার নগরের কাছে হিমালয়পাশ্বে পঞ্চসহস্ৰ বৎসর ব্যাপী একটি যজ্ঞ আরম্ভ করেন। অপরদিকে ইন্দ্রও সহস্রবর্ষ অশ্বমেধ যজ্ঞ করলেন। ইন্দ্রর যজ্ঞ সমাধা হলে বসিষ্ঠ নিমির নগরে এসে গৌতমকে যজ্ঞ করতে দেখে কুপিত হলেন। নিমি তখন নিদ্রায় অত্যন্ত অভিভূত ছিলেন। সে কারণে বসিষ্ঠ আরও ক্লদ্ধ হয়ে শাপ দিলেন, ‘রাজন! তুমি আমাকে অবজ্ঞা করিয়া অন্যকে যজ্ঞার্থে বরণ করিয়াছ, সুতরাং তোমার শরীর অচেতন হইবে।‘
বসিষ্ঠদত্ত শাপ শুনে নিমি জেগে উঠে বসিষ্ঠকে বললেন, ‘আমি অজ্ঞান হইয়া নিদ্রিত ছিলাম তথাপি তুমি কোপে কলুষিত হইয়া আমাকে দ্বিতীয় যমদণ্ডের ন্যায় শাপ দিয়াছ; ব্রহ্মর্ষে! সুতরাং তোমার দেহও বহুকাল অচেতন হইয়া থাকিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।’
শাপ ও প্রতিশাপের দরুণ উভয়েই বিদেহ হলেন।(১)
অতঃপর মহর্ষিগণ রাজা নিমিকে কায়াবিহীন দেখে তার সেই পরিত্যক্ত শবদেহ অবলম্বন করেই যজ্ঞদীক্ষায় প্রবৃত্ত হলেন এবং সকলে মিলে নিমির শবদেহ রক্ষা করতে লাগলেন। পরে যজ্ঞ সমাপ্ত হলে, মহৰ্ষি ভৃগু বললেন, ‘রাজন! আমি তোমার প্রতি পরম পরিতুষ্ট হইয়াছি, সুতরাং তোমার চেতনাকে পুনরানয়ন করিব।‘
দেবগণও নিমি-চেতনাকে পুনরানয়ন করার ইচ্ছায় বললেন, ‘রাজর্ষে! তুমি বর গ্রহণ কর, আমরা তোমার চেতনাকে কোথায় স্থাপন করিব?’
একথা শুনে নিমি-চেতনা বললেন, ‘আমি প্রাণীগণের নেত্রে বাস করিব।’ তখন দেবতারা বললেন, তাহাই হইবে; তুমি বায়ুস্বরূপ হইয়া সকল প্রাণীর নেত্রে বিচরণ করবে। তুমি বায়ুরূপে বিচরণ করিতে থাকিলে, প্রাণীগণ বিশ্রামার্থ তোমার জন্য নিমেষধর্ম পাইবে।’
দেবতারা একথা বলে চলে গেলে মহর্ষিরা নিমির পুত্রের জন্য তাঁর দেহে অরণি নিক্ষেপপূর্বক সকলে মন্ত্রহোম-দ্বারা মন্থন করতে লাগলেন। এইভাবে অরণিদ্বারা মন্থন করতে করতে একজন মহা তেজঃশালী ব্যক্তি প্রাদুর্ভূত হলেন। তিনি মন্থনদ্বারা জন্মিলেন এজন্য মহর্ষিগণ তাঁকে মিথি এবং ‘জনক’ নাম দিলেন। তিনি বিদেহ নিমি হতে উৎপন্ন হয়েছিলেন বলে ‘বৈদেহ নামেও প্রসিদ্ধ হলেন।(২)
এই কাহিনীর প্রথম লক্ষণীয় বিষয় রামের উপস্থিতিতে বিবাহ বাসরে সীরধ্বজ নিমি ও মিথিকে তাদের পূর্বপুরুষ বলেছেন। অথচ সেই রাম পরে নিমি ও মিথিকে ইক্ষ্বাক বংশীয় বলে উল্লেখ করেছেন। সেক্ষেত্রে জনক বংশের স্বাতন্ত্র্য থাকে না। এই আপাতবিরোধী উক্তির দরুণ নিমিকাহিনীটি অলীক মনে হতে পারে। কিন্তু রহস্য ভেদ করে অর্থবোধটা যখন দাঁড়াবে নিমি অর্থে বীজের মধ্যে সুপ্ত প্রাণশক্তি, তখন আর বক্তব্য অস্পষ্ট থাকে না। সকল উদ্ভিদের মূল উৎস বীজ; সেক্ষেত্রে প্রথম পুরুষ। বীজের উৎস বৃক্ষ, বৃক্ষের উৎস মৃত্তিকা, জল, বায়ু ও সৌরশক্তি। অতএব নিমিকে ইক্ষ্বাকুবংশীয় বলা অসংগত হয়নি।
নিমি শব্দটি সংস্কৃত নেম (কাল, অধ) শব্দ হতে নিষ্পন্ন হতে পারে। অথবা, নিমি—নি (নিবেশ, বন্ধন, আশ্রয়)—ম (লক্ষ্মী) +ডি কর্তৃ। অর্থাৎ, লক্ষ্মীর নিবেশস্থল বা আশ্রয়স্থল বা লক্ষ্মী যেখানে বাঁধা।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় জনক বংশের শেষ পর্যায়ে সীতার আবির্ভাব। সীতার কৃষিসত্তা ইতিপূর্বে ব্যাখ্যাত হয়েছে। সারখাত সৃজনের উদ্দেশ্য হল বীজ বপন; যে বীজ অঙ্কুরিত হয়ে পরিশেষে শস্য উৎপাদন করবে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে সীতার বংশের প্রথম পুরুষ তথা পর্যায়কে বীজ হিসাবে গ্রহণ করা ষায়। কারণ বীজের মধ্যে কৃষিশ্রী লক্ষ্মী সুপ্ত অবস্থায় বিরাজ করে। নিমি-কাহিনীর মধ্যে বীজের তাৎপর্য রহস্যে ব্যক্ত হয়েছে।
আপাতঃদৃষ্টিতে বীজের মধ্যে প্রাণের কোন স্পন্দন নাই। কিন্তু এই বীজকে উপযুক্ত পরিবেশে স্থাপন করলে অঙ্কুরোদগম হয়। পরবর্তীকালে সেই অঙ্কুর চারা বা গাছে পরিণত হয়ে ফল দান করে। বীজের বিশেষ যে স্থানের আবরণ ভেদ করে অঙ্কুরের উন্মেষ হয়, সেই স্থানটিকে বলে নেত্র বা চোখ। আলু, কচু, আখ প্রভৃতির ক্ষেত্রে সাধারণ চাষীদের মধ্যেও চোখ কথার প্রচলন আছে। দ্বিতীয়তঃ, উপযুক্ত পরিবেশ বলতে মাটি, জল, বাতাস এবং প্রয়োজনীয় তাপ বুঝায়। এই পরিবেশে বীজ রাখা হলে বীজের দেহস্থিত বস্তু, যাকে বলা হয় শ্বেতসার (কার্বো-হাইড্রেট), সেই বস্তুর মধ্যে রাসায়নিক প্রক্রিয়া ঘটার ফলশ্রুতি অঙ্কুরোদগম অর্থাৎ প্রাণের আবির্ভাব। সীরখাতে যে বীজ বপন করা হয়, মাটির রস ও তাপে সেই বীজগুলির মাটির নীচেই অঙ্কুরোদগম হয়ে পরবর্তী ধাপে ছোট ছোট চার মাটি ভেদ করে উপরে মাথা তুললে আমাদের চোখে পড়ে। বীজের যে নিদিষ্ট স্থান হতে অঙ্কুরোদগম হয় সেই স্থানটি কীটদ্ৰংষ্ট হলে সেই বীজ নিস্ফলা। নিমি-কাহিনীতে দেখা যায় নিমি হিমালয়ের পাদদেশে গৌতমের আশ্রমের পাশে বৈজয়ন্ত নগরে বাস করতেন। হিমালয় অর্থে দক্ষিণায়নাদি স্থান। গৌতম অর্থে শ্রেষ্ঠ রশ্মি, যা মনে করা যায় ঋতুচক্লে বর্ষাসমাগমের পূর্বকাল অর্থাৎ গ্রীষ্মঋতুর শেষ ভাগ। ইন্দ্রপুরীকেও বৈজয়ন্ত বলা হয়। বৈজয়ন্ত অর্থ কার্তিকেয়। অগ্নি পরিত্যক্ত শিববীর্যে গঙ্গা গর্ভধারণ করে সেই গর্ভ শরবনে স্থাপন করলে কার্তিকেয়র জন্ম হয়; ছয়জন মাতৃকা সেই শিশুকে পালন করেন। জড় পৃথিবীতে প্রাণের প্রথম প্রকাশ প্রাণকোষ (প্রটপ্লাজম) ছয়টি পদার্থ দ্বারা গঠিত। মনে হয় ‘বৈজয়ন্ত’ শব্দ দ্বার প্রাণের সেই প্রথম আবির্ভাবকে ইংগিত করা হয়েছে।
পিতাকে আনন্দিত করার উদ্দেশ্যে নিমি দীর্ঘসর, অর্থাৎ বহুকাল ব্যাপী যজ্ঞ করার মনস্থ করেন।
প্রাণকোষ হতে গুপ্তবীজি উদ্ভিদের আবির্ভাবের মধ্যে বহু সময় অতিবাহিত হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়কালকে ইংগিত করার জন্য কাহিনীতে বলা হয়েছে নিমি পাঁচ হাজার বছর যজ্ঞ করেছিলেন।
মহর্ষিগণ নিমির চেতনাহীন দেহ অবলম্বন করে যজ্ঞ-দীক্ষায় প্রবৃত্ত হয়ে শবদেহ রক্ষা করতে লাগলেন। অর্থাৎ, ফসল তোলার পর বীজ সংরক্ষণ করা হয় ৷ যজ্ঞ শেষে ভৃগু স্থির করলেন নিমির চেতনা পুনরানয়ন করবেন। আর দেবগণ নিমি-চেতনাকে নেত্ৰে স্থাপন করে বললেন, ‘প্রাণীগণ বিশ্রামার্থ তোমার জন্য নিমেষধর্ম পাবে’। শস্যদানা পেকে গেলে তার আর কোন হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে না যতদিন না উপযুক্ত পরিবেশে স্থাপন করে পরিবর্তন ঘটানো হচ্ছে। এই শস্যদানা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হলে একাধিক বৎসর পরেও সেই দানা হতে অঙ্কুরোদগম হবে।
নিমেষ বা নিমেয় অর্থ পরিবর্তন। অতএব নিমি-চেতনার পুনরানয়ন বীজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
অতঃপর মহর্ষিগণ অর্থাৎ ভূগু, অত্রি ও অঙ্গির নিমির শবদেহে অরণি নিক্ষেপ করে মন্থন করতে শুরু করলেন।
ভৃগু অর্থ পর্বতের সানুদেশ, অর্থাৎ মৃত্তিকা। সহজাত বৃক্ষ বা গুল্মর বীজ মাটিতে পড়ে থাকে। পুনরায় বর্ষাকালে ঐ বীজ হতে চারার উদ্ভব ঘটে। সুতরাং মৃত্তিক বীজকে ধারণ করে যথাসময়ে বীজের সুপ্ত প্রাণকে জাগরিত করে।
অত্রির নেত্রনীর হতে জাত চন্দ্র। চন্দ্র অর্থ জল। এই সুবাদে অরি জলের প্রতিভূ। অত্রি অর্থ জনক; জল ছাড়া বীজের অঙ্কুরোদগম হয় না, এই কারণে জল জনকের ভূমিকা পালন করছে।
অঙ্গিরা অর্থে অগ্নি।
অরণি অর্থ যাহা অগ্নিজনক, অর্থাৎ তাপের প্রতীক।
মন্থন অর্থে বীজদেহে রাসায়নিক প্রক্রিয়া হেতু পরিবর্তন।
এই যোগাযোগগুলির ভিতর দিয়ে অঙ্কুরের প্রথম প্রকাশ; কাহিনীতে যার নামকরণ হয়েছে মিথি। এরই অপর নাম জনক। অঙ্কুরের দুটি স্তর ধরা যায়। প্রথমতঃ, বীজদেহে রাসায়নিক প্রক্রিয়া হেতু বীজের আবরণের ভিতরেই অঙ্কুরের বিকাশ। দ্বিতীয় স্তরে আবরণ ভেদ করে অঙ্কুরের বহির্প্রকাশ।
প্রথমটিকে মিথি এবং দ্বিতীয়টিকে জনক বলা যায়। যেহেতু চেতনাহীন বীজ হতে পুনরায় চেতনার প্রকাশ, একারণে বৈদেহ।
বসিষ্ঠর শাপে যেমন নিমি কায়হীন হয়েছিলেন; তেমনি নিমির শাপেও বসিষ্ঠ কায়াহীন হন। নিমি-কাহিনীতে উভয়ের শাপ ও প্রত্যাভিশাপের পরই কায়াহীন বসিষ্ঠর পুনরায় কায়ালাভের উপাখ্যানটি ব্যক্ত করা হয়েছে।
শরীরহীন হয়ে বসিষ্ঠ শরীর লাভের আশায় পিতা ব্ৰহ্মার নিকট গিয়ে বায়ুরূপেই বললেন, ভগবান দেবষিদেব মহাদেব, আমি রাজা নিমির শাপে অশরীরি হইয়া সম্প্রতি বায়ু হইয়া আছি, প্রভো, দেহহীন হইলে সকলেরই নিতান্ত দুঃখ হইয়া থাকে এবং দেহহীন ব্যক্তির সকল কাৰ্যই বিলুপ্ত হয়, সুতরাং অন্য দেহ প্রদান করিয়া আমার প্রতি কৃপা প্রদর্শন করুন।’
স্বয়ম্ভ ব্রহ্মা বললেন, ‘তুমি মিত্রাবরুণ সম্ভূত তেজে প্রবিষ্ট হও। মিত্রাবরুণ তেজে প্রবিষ্ট হইলেও তুমি অযোনিজ হইবে এবং অশেষ ধর্ম উপার্জন করিয়া পুনরায় প্রজাপত্য লাভ করিবে।‘
এই কথা শুনে ব্রহ্মাকে প্রদক্ষিণ করে বসিষ্ঠ বরুণালয়ে গেলেন। সে সময় মিত্রদেবও ক্ষিরোদরূপী বরুণের সঙ্গে মিলে রাজত্ব করছিলেন। এমন সময়ে অপ্সরা-প্রধানা ঊর্বশী সখীগণ-পরিবেষ্টিতা হয়ে স্বেচ্ছাক্ৰমে সেখানে এলো। বরুণ ঊর্বশীকে মৈথুন নিমিত্ত প্রার্থণা করলে ঊর্বশী জানাল, ‘স্বয়ং মিত্রদেব পূর্বেই আমাকে প্রার্থনা করিয়াছেন।’
তখন বরুণ বললেন, ‘সুশ্রোণি, এই দেবনির্মিত কুম্ভে আমি বীৰ্য্য পরিত্যাগ করিব, তুমি যদি সঙ্গম ইচ্ছ না কর, তাহা হইলে এই রূপে বীর্য্য নিক্ষেপ করিয়া আমি পরিতৃপ্ত হইব।’
উৰ্বশী বলল প্রভো, ‘আমার হৃদয় তোমার প্রতি নিতান্ত আসক্ত এবং আমার প্রতি তোমারও অধিক অনুরাগ, কিন্তু সম্প্রতি আমার দেহ মিত্ৰদেবের অধীন।’
ঊর্বশীর এই কথা শুনে বরুণ প্রজ্বলিত অনলতুল্য স্বীয় মহৎ অদ্ভুত রেতঃ সেই কুম্ভে নিক্ষেপ করলেন।
এরপর ঊর্বশী মিত্রদেবের কাছে হাজির হলে, মিত্রদেব ক্রুদ্ধ হয়ে ঊর্বশীকে বললেন, ‘রে দুষ্টা আমি পূর্বে তোমাকে অভিলাষ করিয়াছি। সুতরাং তুমি আমাকে পরিত্যাগ করিয়া কেন অন্য পতিকে ভজনা করিলে? এই অপরাধে আমার কোপে পতিত হইয়াছ, এজন্য তুমি কিছুকাল নরলোকে বসতি করিবে।’
মিত্রদেব আরও বললেন, ‘তুমি বুধের পুত্র কাশিরাজ পুরূরবার নিকটে যাও, তিনি তোমার ভর্তা হইবেন।’
এইভাবে ঊর্বশী শাপগ্রস্ত হয়ে প্রতিষ্ঠান নগরে পুরূরবার নিকট হাজির হল। ঊর্বশী শাপবশতঃ বহু বংসর নরলোকে বাস করে শাপমুক্ত হয়ে ইন্দ্রের সভায় ফিরে গিয়েছিল।
এদিকে মহাত্মা মিত্র ও বরুণের তেজঃপুঞ্জ সেই কুম্ভে পতিত হয়ে দুইজন তেজোন্ময় ঋষিশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ সম্ভূতা হয়েছিলেন। যে কুম্ভে বরুণবীর্য্য পরিত্যক্ত হয়েছিল মিত্রদেব ঊর্বশীকে উদ্দেশ্য করে সেই কুম্ভে প্রথমতঃ যে তেজঃ নিকেষ করেন, তাতে অগস্ত্য উৎপন্ন হয়ে মিত্রকে ‘আমি তোমার পুত্র নহি’ এই কথা বলে প্রস্থান করলেন। কিছুকাল পরে ইক্ষ্বাকুগণের কুলদেবতা তেজস্বী বসিষ্ঠ,—মিত্র এবং বরুণ উভয়ের তেজঃ প্রভাবে সেই কুম্ভ হতে উৎপন্ন হলেন।(৩)
নিমি প্রসঙ্গে এই উপাখ্যানটি জুড়ে দেওয়ায় ধরে নেওয়া যায় বীজের অঙ্করোদগম তথ্যের সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে। এই উপাখ্যান মূলতঃ জ্যোতিবিজ্ঞান তথ্যের রূপক।
শতভিষা নক্ষত্রর বৈদিক নাম বরুণ। মিত্র অর্থে সূর্য। কুম্ভ রাশির শতভিষা নক্ষত্রে উত্তরায়ণাদির ইংগিত এখানে রাখা হয়েছে। ঊর্বশী ছায়াপথ তথা সুরগঙ্গার প্রতীক। জ্যেষ্ঠ নক্ষত্রর বৈদিক নাম ইন্দ্র।
ইন্দ্ৰযজ্ঞ অর্থে জ্যেষ্ঠ নক্ষত্রে শারদবিষুব। এক হাজার বছর পরে শারদবিষুব যখন অনুরাধা নক্ষত্রে, তখন উত্তরায়ণ শতভিষা নক্ষত্রে এবং বাসন্তবিষুব রোহিনী নক্ষত্রে, যার বৈদিক নাম বিধাতা (ব্রহ্মা)। অয়নচলন হেতু বিষুবস্থানের পরিবর্তনের ইংগিত দেওয়ার জন্য কাহিনীতে নিমির শাপে বসিষ্ঠর বিদেহ হওয়া। কায়ালাভের জন্য বসিষ্ঠ ব্ৰহ্মার শরণাপন্ন হন; এই বক্তব্যর দ্বারা রোহিনী নক্ষত্রে বাসন্তবিষুব ইংগিত করা হয়েছে।
অতঃপর বরুণালয়ে; অর্থাৎ, শতভিষা নক্ষত্রে উত্তরায়ণের ইংগিত। এই নক্ষত্রটি ছায়াপথে নিমজ্জমান, এজন্য বলা হয়েছে ঊর্বশীর হৃদয় বরুণের প্রতি আসক্ত এবং বরুণেরও তার প্রতি অনুরাগ আছে। সেকালের উত্তরায়ণ দিনে সূর্য শতভিষা নক্ষত্রে অবস্থান করত। সূর্যর ক্লান্তিপথে শতভিষা নক্ষত্রে অবস্থান অল্প সময়ের জন্য, সুতরাং ছায়াপথে সূর্যর অবস্থান সাময়িক; এই কারণে ঊর্বশী মিত্রদেবকে প্রাধান্য দেয়।
যে কুম্ভে বরুণবীর্য পরিত্যক্ত হয়েছিল মিত্রদেব ঊর্বশীর উদ্দেশ্যে সেই কুম্ভে প্রথমতঃ যে তেজঃ নিকেশ করেন তাতে অগস্ত্য উৎপন্ন হয়, অর্থাৎ শতভিষা নক্ষত্রে:সূর্য অস্ত গেলে (দিবাবসানে সূর্যতেজ থাকে না, যেন তেজ পরিত্যাগ করা হল) তখন অগস্ত্য তারার উদয় হয়। এই নক্ষত্রটি সূর্যর ক্লান্তিপথের অনেক দূরে এই কারণে কাহিনীতে বলা হয়েছে অগস্ত্য উৎপন্ন হয়েই মিত্রকে বলেছিল, আমি তোমার পুত্র নই।
অনুরূপ, শতভিষানক্ষত্রে সূর্যোদয়ের প্রাক্কালে বসিষ্ঠ তারার উদয় হয়। সুতরাং বাহ্যিকভাবে উপাখ্যানটি অলীক ও অশ্লীল মনে হলেও মূলতঃ একটি সময়কালের অয়নস্থান নির্দেশ করা হয়েছে। মিত্রদেবের অভিশাপে উৰ্বশী কিছুকাল নরলোকে কাশিরাজ বুধের পুত্ৰ পুৰ্বরবার ভার্যা হয়েছিল।
এখানে ‘কাশি শব্দটিকে স্থানবাচক ধরা হলে পুৰ্বরবার প্রতিষ্ঠান নগর অর্থে বর্তমানের গঙ্গাতীরবতী বারানসী, যা অতি প্রাচীনকাল হতেই প্রতিষ্ঠিত নগরী। উপাখ্যানের এই প্রসঙ্গে স্বর্গগঙ্গার পরিবর্তে মর্তের গঙ্গানদীকে নির্দেশ করা হয়েছে।
বুধ অর্থে জ্ঞানী। এখানে বলা যায় কাশির রাজাগণ হয়ত প্রথম কৃষি সম্পদের প্রকৃত মূল্যায়ণ করেছিলেন। যেমনটি দেখা যায় অন্যান্য পুরাণে মিথিলার জনক রাজা স্বহস্তে হলকর্ষণ করছেন। নিমি প্রসঙ্গে ঊর্বশী পুৰ্বরবা কাহিনীর অবতারণা করায় এই চরিত্র দুটিকে এই ভাবে বিশ্লেষণ করা যায়।
বীজদেহে অংকুর উন্মেষের পরবর্তী পর্যায়ের নাম উদাবসু।
উদ্ (ঊৰ্দ্ধ, উৎকর্য, প্রাকট্য, প্রকার, বিভাগ, শক্তি ভাব, প্রাধান্য, বন্ধন)—আ (বৈশিষ্ট্য অর্থে)—বসু (রত্ন, ধন, জল, বকবৃক্ষ, অনল, রশ্মি)। তাহলে উদাবসু শব্দের অর্থ দাঁড়ায় জল বা অনল বা রশ্মির বৈশিষ্ট্যময় প্রকাশ। অর্থাৎ, অঙ্কুরের বহির্প্রকাশ। এই অবস্থায় সকল বীজের অঙ্কুরের রং সাদা এবং পাতলা আবরণের মধ্যে খানিকটা জলীয় পদার্থ থাকে মাত্র।
অঙ্কুরের প্রথম প্রকাশিত অংশ পরবর্তীকালের শিকড়, দ্বিতীয় ধাপে কাণ্ডর আবির্ভাব; অর্থাৎ, নন্দিবৰ্দ্ধন। নন্দি (দ্যুত্যঙ্গ, আনন্দ) বৰ্দ্ধন (বৃদ্ধি)। দ্যুত্যিঙ্গ,—দুৎ (কিরণ) + অঙ্গ; অর্থাৎ, আনন্দে যে বৃদ্ধিলাভ করে, ভাবার্থে গাছের উপরাংশ—যা মাটি ভেদ করে প্রকাশ পায়। বিজ্ঞান পরিভাষায় উদাবসু এবং নন্দিবৰ্দ্ধন হল যথাক্ৰমে ভ্ৰণ-মূল এবং ভ্রূণ-মুকুল (Protuding of radicle and then exposure of plumule)
পরবর্তী পর্যায় সুকেতু,– সু (সুন্দর) কেতু (স্থান, চিহ্ন, ধ্বজ) যার। সুন্দর ধ্বজ; অর্থাৎ, ভ্রূণ-মুকুলে পাতার বিকাশ। এ অবস্থায় তখনও পাতা সমেত অঙ্কুরের রং সাদা। তার কারণ ক্লোরোফিলের আবির্ভাব ঘটেনি। ভূণ-মুকুল বা ভূণ-কাণ্ডে সবেমাত্র পাতার বিকাশকে বলা হয়েছে সুকেতু।
এই ক্ষীণ অবস্থার আরেক নাম দেবরাত। এই দেবরাত দেবতাগণের নিকট হতে হরধনু প্রাপ্ত হন। হর (শিব, অগ্নি, গদ্যভ) ধনু (চাপ, পিয়াল বৃক্ষ, তৃণতা, রণতা, তৃণত্ব, কাণ্ড)। অর্থাৎ, দেবরাত পর্যায়ে অগ্নিসংযুক্ত তৃণত্বলাভ,—ক্লোরোফিলের আবির্ভাব। দেবরাত,—চারার ক্ষীণাবস্থায় আপনার পরিচয় প্রকাশ অর্থাৎ কোন গোত্ৰিয়।
এবার বৃহদ্ৰথ,—বৃহৎ (মহান) যার রথ (দেহ); মহানদেহী। অন্য অর্থ ইন্দ্র (সূর্য)। এবার ক্লোরোফিলের সাহায্যে সূর্যকিরণ হতে আহার সংগ্রহ শুরু হওয়ায় রং সবুজ হয়ে চারাগাছে পরিণত হয়েছে।
পরের অবস্থা মহাবীর। মহাবীর অর্থ হনুমান (মরুতাত্মজ)। হনুমান জন্মগ্রহণ করেই উদিয়মান সূর্যকে ভক্ষ্যবস্তু মনে করে ঊর্ধ্বের ঝাঁপ দিয়েছিল। বৃক্ষশিশুও অনুরূপ উধ্বগতি লাভ করে। এই তথ্য প্রকাশের কারণে এই পর্যায়কে মহাবীর আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
উদাবসু হতে সুকেতু, দেবরাত, বৃহদ্ৰথ ও মহাবীর পর্যন্ত বিজ্ঞান পরিভাষায় বলা যায় ভ্রূণ-মুকুল হতে চারার তিন বা চারটি পত্রের উন্মীলন পর্যায়।
সুধৃতি,—সু (সুন্দর) ধৃতি (ইষ্টি, তুষ্টি, ধৈর্য্য, কারণ, সুখ)। অতি সুখে মানুষ যেমন ডগমগ হয়, চারাগাছও এই অবস্থায় সুপুষ্ট। এই অবস্থায় চারাগাছের ডালপালা বা ঝাড়ের বিস্তার ঘটে। শস্যচাষে চলিত কথায় বলে ‘বিয়েন ছাড়া’। অর্থাৎ, দেহজ কোষ বিভাজন প্রক্রিয়ার দ্বার একটি চারাগাছের গায়ে কতিপয় নতুন চারার উদ্ভব। (Tillering phase)
প্ৰগলভতা প্রকাশের নাম ধৃষ্টকেতু। ধৃষ্ট (প্ৰগলভ, উদ্ধত, নির্লজ্জ) কেতু। ধৃষ্টকেতু হল চারার, পরিপূর্ণতা লাভ হেতু মঞ্জর ধারণের উপযুক্ত অবস্থা I (Panicle premordial stage) |
হৰ্ষশ্ব অর্থ ইন্দ্র, হরিৎবর্ণ অশ্ব, ইন্দ্রাশ্ব। হরি অর্থ সিংহরাশি। পুষ্যা নক্ষত্রে দক্ষিণায়নাদিতে বৰ্ষাঋতুর শুরু হলে সূর্যর সিংহরাশিতে অবস্থানকালে পুরো বর্ষা চাষের জমিতে তখন সবুজের মেলা। চারাগাছের এই যৌবনের রংএর সঙ্গে হরিৎ বর্ণ সূর্য-রশ্মির সামঞ্জস্য টেনে পর্যায়টিকে হর্যশ্ব বলা হয়েছে। অর্থাৎ, মঞ্জরী উন্মোচন অবস্থা (Panicle initiation stage) ।
এবার প্রতীন্ধক। প্রতি—(প্রতিনিধি, মুখ্যসদৃশ, লক্ষ্মণ, স্বভাব)–ইন্ধ (প্রজ্জ্বলিত করা)+অক (চিহ্ন করণ)। অর্থাৎ, গাছের ভবিষ্যৎ প্রতিনিধিকে উদ্ভাসিত করণ। বীজ (প্রতিনিধি)-এর আবির্ভাব ঘটানোর জন্য ফুল ফোটার পূর্বমুহূর্ত, যাকে বলে কুঁড়ি আসা, শস্যের ক্ষেত্রে ‘থোর নামা’। এই পর্যায়ের পর ফুল ফোটে, নিজের রূপগন্ধ ছড়িয়ে গর্ভকোষের পুষ্টিসাধনের ব্যবস্থা করে।
হর্যশ্ব এবং প্রতীন্ধক এই দুই পর্যায়ের মাঝে আরেকটি পর্যায় আছে। চাষীরা শস্যক্ষেতের গাছ দেখে পর্যায়ক্ৰমে মন্তব্য করে, ‘থোর গিলবে’ (হর্যশ্ব), ‘থোর গিলেছে’ (মরু) এবং ‘ফুলাবার সময় হয়েছে’, অর্থাৎ থোর বা শীষের বহির্প্রকাশ ঘটছে (প্রতীন্ধক)।
‘থোর গিলেছে’ পর্যায়ের নাম মরু। মরু অর্থ পর্বত। পর্বত,— পর্বন্+ ত (তপ্) অস্যর্থ্যে। অর্থ পর্বযুক্ত, পর্ববান মেঘ। পর্বন্ শব্দের অর্থ লক্ষণভেদ, বৎসরের বিশেষকাল-বিষুবায়নকাল ইত্যাদি। অতএব ‘মরু’ শব্দ দ্বারা এখানে শস্যগুলোর লক্ষণাত্তর ইংগিত করা হয়েছে যা শারদবিষুব কালে ঘটে থাকে। ইক্ষ্বাকু বংশের ‘মরু’ শব্দটি বিশ্লেষণে অর্থ ধরা হয়েছিল জলশূন্য স্থান। একই শব্দ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহারের এটি সুন্দর উদাহরণ। মরু ও প্রতীন্ধক হল মঞ্জরীর উন্মেষ (Boot stage)।
প্রতীন্ধকের পর কীর্তিরথ। কীর্তি অথ যশ, সমজ্ঞা, প্রসাদ, শব্দ, দীপ্তি, বিস্তার। কীর্তিরথ অর্থে যে দেহ শব্দময় (স্পন্দনময়) বা দীপ্তিময়। এই তালিকায় পরবর্তী পর্যায়ে আরও একবার এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। তখন অর্থ দাঁড়াবে বিস্তারিত দেহ, তাকেও অবশ্য দীপ্তিময় বলা যায়। কীর্তিরথ পর্যায়ে মঞ্জরী-পত্রের বৃদ্ধি (Panicle size is increasing and the flag leaf enlarges)।
গাছের বৃন্ত ভেদ করে শীষের আত্মপ্রকাশ মুহূর্ত, যার পরই শীষ দেখা যাবে। এই অবস্থার নাম দেবমীঢ়। দেব (মেঘ) +মীঢ় (মূত্রিত, কৃতমূত্র, মূতিয়াছে এরূপ)। শব্দটি অদ্ভুত, কিন্তু বক্তবাটি সুন্দর। শস্য গাছের মূল হতে শীষের উদ্ভব ঘটে। শিকড় মাটি হতে জল টানে। সেই জলই যেন আগামী দিনের শীষ। শীষটি গাছের প্রতিটি গুছির মধ্যভাগ দিয়ে উপরের দিকে উঠে একটা ডাঁটা (Stern) সৃষ্টি করে। শেষে বৃন্ত ভেদ করে আত্মপ্রকাশ। গাছ যেন উপস্থি, মূত্রাশয় জলসিক্ত মৃত্তিকা, ডাঁটা (Stem) মূত্রনালী আর শীষ মূত্রাশয় হতে মূত্র নির্গমনের বহির্প্রকাশ। শীষের উদ্ভব ও পুষ্টি জলের উপর নির্ভরশীল। দেবমীঢ় শব্দে তাই সুস্পষ্ট। এই প্রসঙ্গে কলাগাছের উদাহরণ দেওয়া যায়। ফলন্ত কলাগাছের বাকল ছাড়ালে ভিতরে দেখা যাবে মূল হতে মোচ পর্যন্ত থোরের বিস্তার। ধান, গম ইত্যাদি শস্যগাছেও এই প্রকারই ঘটে।
এবার শীষের পুষ্পিত হওয়ার পালা। এই প্রক্রিয়ায় থাকে চন্দ্রকিরণের প্রভাব। সুতরাং চন্দ্রকিরণের প্রতিক্রিয়া বুঝাতে এই পর্যায়ের নাম বিবুধ। শব্দটির অর্থ দেব, পণ্ডিত, চন্দ্র। বিবুধ ও দেবমৗঢ় হল পুষ্পাবস্থা। শস্যগুল্ম যথা ধান স্বপরাগী; পুষ্পবিন্যাস পুষ্পবৃন্তের নিম্নাংশ হতে ঊর্ধ্বাংশে সজ্জিত হয় (Fl০wering stagé – Paddy self pollinated crop. It starts from node porti০n i. e. from downward to upward)।
এবার মহীধ্রক। মহীধ্র অর্থ পর্বত; অর্থাৎ, পুনরায় লক্ষণান্তর বুঝাচ্ছে। লক্ষণের কি পরিবর্তন হয়? শীর্ণ শীর্ষে খুব ছোট ছোট ফুল ফোটে, ধীরে ধীরে পুষ্টল হয়, দানার আবির্ভাব ঘটে। ধানচাষের ক্ষেত্রে দানার তরল অবস্থাকে বলে ‘দুধ’, তার পরের অবস্থা ‘চাল গেলা’ (গলাধঃকরণ)। এই অবস্থা প্রকাশ করার জন্য পুনরায় ‘কীর্তিরথ’ শব্দটি প্রয়োগ করা হয়েছে। মহীধ্রক ও কীর্তিরথ শব্দ দুটিতে দুগ্ধাবস্থা (Milk stage) বুঝান হয়েছে।
ধান, গম ইত্যাদি শস্যদানা একাধারে খাদ্যবস্তু এবং বীজ। এই দানা বা বীজের তিনটি অংশ। উপরের আচ্ছাদনটি লম্বা কেশরযুক্ত, তার নীচে স্বর্ণাভ পাতলা একটি খোসা এবং শেষে মূল দানা বা বীজ। ধানে প্রথমে কেশরযুক্ত তুঁষ, তার নীচে ভূষি বা কুড়ে এবং শেষে চাল (অর্থাৎ দানা)। গমেও তাই। শস্যদানার এই তিন অবস্থা বুঝাতে মহারোমা, স্বর্ণরোমা এবং হ্রস্বরোমা নাম করণ করা হয়েছে। রোম অর্থ লোম, তনুরুহ (দেহজাত)। শস্যের দুগ্ধাবস্থা ক্ৰমশঃ বাষ্পীভবণ প্রক্রিয়া দ্বারা কঠিন হয়ে পূর্ণ শস্য দানায় পরিণত হয়। মূল দানার উপরে ভূষি এবং তার উপরে তুঁষ (Hard grain with bran and husk—daugh stage)।
দানা বা বীজের (হ্রস্বরোমার) দুই পুত্র, সীরধ্বজ এবং কুশধ্বজ।
সীরধ্বজ = সীর (সূর্য হল, অর্কবৃক্ষ) ধ্বজ (চিহ্ন)।
কুশধ্বজ ==কুশ (জল) ধ্বজ (চিহ্ন)।
অর্থাৎ, বীজ বা দানার (হ্রস্বরোমা)পুষ্টি ও পরিপক্কতার জন্য জল এবং সূর্যতাপ উভয়ই প্রয়োজন। যেহেতু এর পরই শস্যজাতীয় উদ্ভিদের ভূমিকা শেষ হয়ে যায়, সেকারণে জনক বংশের এখানেই অবলুপ্তি। সীরধ্বজের কন্যা হিসাবে অযোনিসম্ভূতা সীতার আবির্ভাব সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র অধ্যায়। এখানে ‘সীর’ শব্দে ‘হল’ অর্থ ধরে ভূমিকৰ্ষণ ক্রিয়াকে ব্যক্ত করা হয়েছে। রামায়ণ এবং অন্যান্য পুরাণে জনকরাজ সীরধ্বজকে প্রথম হলকর্ষণ করতে দেখা যায়। জমি চাষের পর বীজবপন করে কৃত্রিম উপায়ে ফসল উৎপাদনের জন্য হল (লাঙ্গল)-কে যিনি নিজের কার্যক্রমের প্রতীক (ধ্বজ হিসাবে গ্রহণ করেন, তিনি সীরধ্বজ; অর্থাৎ কৃষক। এই কারণে তিনি বিশেষভাবে চিহ্নিত একজন জনক। যজ্ঞে অর্থাৎ যথাসময়ে ভূমিকৰ্ষণকালে সীতা প্রাপ্তি। জমিতে হলকর্ষণ করলে ফালের মুখে যে অগভীর নালা সৃষ্টি হয় তার নাম সীতা। অপর কন্যা ঊর্মিলার জন্ম সম্পর্কে কোন উল্লেখ নাই। এই সীতা-সমন্বিত জমিকে দেখায় যেন ঊর্মি(ঢেউ)ময়। সীতার পরে ঊর্মির প্রকাশ ঘটে, একারণে ঊর্মিলা কনিষ্ঠা।