১০. জংলা ভিটায়

জংলা ভিটায় এখন আর যাওয়া যায় না।

নাবাল জায়গা। আষাঢ় মাসের গোড়াতেই পানি উঠে গেছে। দক্ষিণ কান্দা দিয়ে খুব সাবধানে হেঁটে জলমগ্ন ভিটার আশেপাশে যাওয়া গেলেও এখন আর কেউ যায় না। দক্ষিণ কান্দায় খুব সাপের উপদ্রব হয়েছে। সিরাজ মিয়ার একটি বকনা বাছুর সাপের হাতে মারা পড়েছে।

তবু নূরুদ্দিন জংলা ভিটায় যাবার জন্যে এক সকালে লালচাচীর বাড়ি এসে উপস্থিত। লালচাচীর খোন্দা নিয়ে সে যাবে জংলা ভিটায়। তার সঙ্গে গোটা দশেক লার বড়শি। বড়শি কটি পেতে দিয়েই সে চলে আসবে। লালচাচী চোখ কপালে তুলে বলল, তোর মাথাডা পুরা খারাপ নুরা। এই চিন্তা বাদ দে।

লালচাচী নুরুদ্দিনের কোনো যুক্তিই কানে তুলল না। ব্যাপারটিতে যে ভয়ের কিছুই নেই, খোন্দায় বসে থাকলে সাপখোপ যে কিছুই করতে পারবে না, লালচাচীকে তা বোঝা গেল না। লালচাচী খুব রেগে গেল, এক কথা এক শ বার কইস না নুরা। আমারে চেইস না। আমার মন-মিজাজ ঠিক নাই।

তাঁর মন-মেজাজ ঠিক নেই -কথাটি খুব সত্যি। গুজব শোনা যাচ্ছে, সিরাজ মিয়া আরেকটি বিয়ে করবে। মেয়ে নিমতলির, নফিস খাঁর ছোট মেয়ে। সিরাজমিয়াকেও দোষ দেওয়া যায় না। যখন বিয়ে করে, তখন সে কামলা মানুষ। সরকার বাড়ি জন খাটত। ছোট ঘরের মেয়ে ছাড়া কামলা মানুষের কাছে কে মেয়ে দেবে। সেই দিন আর এখন নেই। নতুন ঘর তুলেছে সিরাজ মিয়া। এই বৎসর টিনের ঘর। দেবে। এক বান টিন কেনা হয়েছে।

এ ছাড়াও একটি কারণ আছে। সিরাজ মিয়ার এখনো কোনো ছেলেপুলে হয় নি। তিনটি বাচ্চা আতুর ঘরে মারা গিয়েছে। অনেকের ধারণা সিরাজ মিয়ার বৌয়ের উপর জ্বীনের আছর আছে। লক্ষণ সব সেই রকম। প্রথমত সে অত্যন্ত রূপসী। বাছবিচারও নেই। ভরসন্ধ্যায় অনেকেই তাকে এলোচুলে ঘরে ফিরতে দেখেছে।

সিরাজ মিয়া অবশ্যি বিয়ের প্রসঙ্গে কিছুই বলে না। তবে তার হাবভাব যেন কেমন কেমন। ইদানীং সে প্রায়ই নিমলি যায়। নৌকা বাইচের ব্যাপারেই নাকি তার যাওয়া লাগে। কিন্তু দৌড়ের নৌকা নিয়ে যাবার সময় কেউ কি নয়া শার্ট গায়ে দেয়?

লালচাচী নুরুদ্দিনকে বিকাল পর্যন্ত বসিয়ে রাখল। যত বারই নুরুদ্দিন উঠতে চায়, তত বারই সে তাকে টেনে ধরে বসায়। নতুন এই সমস্যায় কী করণীয়, সেই ব্যাপারে পরামর্শ চায়। যেন নুরুদ্দিন খুব এক জন বিচক্ষণ ব্যক্তি। নুরুদ্দিন বড়দের মত গম্ভীর গলায় বলে, চাচারে পান-পড়া খাওয়া।

পান-পড়ার কথা লালচাচীর অনেক বার মনে হয়েছে, কিন্তু এ গ্রামে পানপড়া দেওয়ার লোক নেই। ভিন গ্রাম থেকে আনতে হবে। লোক জানাজানির ভয়ও আছে। লালচাচী হঠাৎ গলার স্বর নামিয়ে বলল, তুই আইন্যা দিতে পারবি? সুখানপুকুরে এক জন কবিরাজ হুনছি পান-পড়া দেয়।

আইচ্ছা।

একলা যাওন লাগব কিন্তুক।

আইচ্ছা।

কেউরে কওন যাইত না। কাকপক্ষীও যেন না জানে।

কেউ জানত না।

নুরুদ্দিনের বড় মায়া লাগে। লালচাচীর যে আবার বাচ্চা হবে, তা সে জানত। না। চোখ-মুখ সাদা হয়ে গেছে, হাত-পা ভারি হয়েছে। চোখের নিচে কালি পড়ে এখন যেন আরো সুন্দর দেখায়, শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছা হয়। লালচাচী বলল, হা কইরা কী দেখস?

তোমার বাচ্চা হইব চাচী?

কথার ঢং দেখা চুপ থাক।

নুরুদ্দিন এক বার শেষ চেষ্টা করে চাচী, দেও না তোমার খোন্দাটা। যাইয়াম আর আইয়াম।

আইচ্ছা যা। দেইখ্যা আয়তর জংলা ভিটা। দিরং করি না।

দিরং হইত না।

খোন্দায় উঠবার মুখে নুরুদ্দিন দেখল সোহাগীর দল তাদের বাইচের নৌকা নিয়ে মহড়া দিতে বেরিয়েছে। সিরাজ চাচা মাথায় একটি লাল গামছা বেঁধে নৌকার আগায়। নৌকা ছুটছে তুফানের মতো। গানের কথা শোনা যাচ্ছে—

ওগো ভাবীজান, বাইচ বাইতে মর্দ লোকের কাম
ওগো ভাবীজান, বাইচ বাইতে মর্দ লোকের কাম।

এই বারের বাইচে দুইটি খাসি এবং একটি গরু দেওয়া হয়েছে। আশেপাশের সাতটি গ্রামের মধ্যে কম্পিটিশন। ভাবসাব যা দেখা যাচ্ছে, এ বৎসর সোহাগীর দল বোধহয় জিতেই যাবে।

জংলা ভিটাকে আর চেনা যায় না। পানিতে ড়ুবে একাকার। কেমন যেন একটা ভ্যাপসা পচা গন্ধ। বাঁশের ঝোপ আরো যেন ঘন হয়েছে। চারদিক দিনমানেই অন্ধকার। জংলা ভিটা ড়ুবিয়ে পানি ডেফল গাছের গুড়ি পর্যন্ত উঠেছে। খালের মাঝামাঝি লম্বা জলজ ঘাস জন্মেছে। সেই সব ঠেলে খোন্দা নিয়ে এগোনই যায় না। নুরুদ্দিন ভেসে বেড়াতে লাগল। এক জায়গায় দেখা গেল চার-পাঁচটি থইরকল গাছ। এখানে থইরকল গাছ আছে, তা কোনো দিন তার চোখেই পড়ে নি। থোকা থোকা। থইরকল পেকে লাল টুকটুক করছে। কী আশ্চর্য! নুরুদ্দিন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল।

এই সময় অদ্ভূত একটি কাণ্ড হল। হঠাৎ চার দিক সচকিত করে থইরকল গাছ থেকে অসংখ্য কাক একসঙ্গে কা-কা করে উড়ে গেল। উত্তর দিকের ঘন বাঁশবনে হাওয়ার একটা দমকা ঝাপটা বিচিত্র একটি হা-হা শব্দ তুলল। তার পরপরই নুরুদ্দিন শুনল একটি অল্পবয়সী মেয়ে যেন খিলখিল করে হেসে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে চারদিক নিচুপ। গাছের পাতাটিও নড়ে না। চারদিক শুনশান।

নুরুদ্দিন ভয়কাতর স্বরে বলল, কে গো, কেডা?

আর তখন তার চোখে পড়ল জংলা বাড়ির ভিটার কাছে যেখানে জলশ্যাওলায় ঘন সবুজ হয়ে আছে, সেখানে মাথার চুল এলিয়ে উপুড় হয়ে মেয়েটি ভাসছে। অসম্ভব ফর্সা, তার একটি হাত ছড়ান। হাতভর্তি গাঢ় রঙের ছড়ি। এই সময় প্রবল একটা বাতাস এল। মেয়েটি ভাসতে ভাসতে এগিয়ে আসতে লাগল নুরুদ্দিনের দিকে। যেন ড়ুবসাঁতার দিয়ে ধরতে আসছে তাকে।

 

আকাশ-পাতাল জ্বর নিয়ে বাড়ি ফিরল নুরুদ্দিন। মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছে। চোখ গাঢ় রক্তবর্ণ। লোকজন ঠিক চিনতে পারছে না। আমিন ডাক্তার এসে যখন জিজ্ঞেস করল, কী হইছে নূরু?

নুরু ফ্যালফ্যাল করে তাকাল।

কী হইছে ক দেহি নুরু?

ভয় পাইছি চাচা। কী দেখছস?

একটা মেয়েমানুষ সাঁতার দিয়া আমারে ধরতে আইছিল। হাতের মইধ্যে লাল চুড়ি।

প্রচণ্ড ঝড় হল সেই রাত্রে। ঘনঘন বিজলি চমকাতে লাগল। কালাচাঁন খবর আনল নিমতলির দোষ-লাগা তালগাছে বজ্ৰপাত হয়েছে।

পরদিন আমিন ডাক্তার নৌকা নিয়ে সারা দুপুর জংলা বাড়ির ভিটায় ঘুরে বেড়াল। কোথায়ও কিছু নেই। থইরকল গাছগুলি দেখে সেও নুরুদ্দিনের মতোই অবাক হল। উজান দেশের গাছ। ভাটি অঞ্চলে কখনো হয় না। গাছগুলিতে গাঢ় লাল রঙের ফল টুকটুক করছে। আমিন ডাক্তার আরো একটি জিনিস লক্ষ করল, জংলা বাড়ির ভিটা পানিতে ড়ুবে গেছে। কোনো বৎসর এরকম হয় না।

সোহাগীতে রটে গেল পাগলা নুরা রাসন্ধ্যায় গিয়েছিল জংলা বাড়ির ভিটাতে। গিয়ে দেখে পরীর মত একটা মেয়ে নেংটা হয়ে সাঁতার কাটছে। নুরাকে দেখে সেই মেয়ে খিলখিল করে হাসতে হাসতে ড়ুবসাঁতার দিল।

নুরুদ্দিনের জ্বর সারতে দীর্ঘদিন লাগল। নিমতলির পীর সাহেব নিজে এসে তাবিজদিলেন। গৃহবন্ধন করলেন। বারবার বলে গেলেন আর যেন কোন দিন জংলা ভিটায় না যায়। জায়গাটাতে দোষ হয়েছে। নিমতলির তালগাছে যে থাকত সে জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছে। জংলা ভিটায় এসে তার আশ্রয় নেওয়া বিচিত্র নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *