ছলছল কলবল সাগরের জল। নীল নীল ঢেউ। ঢেউয়ের পিঠে অজস্র বুদ্বুদ, সাদা সাদা ফেনা। দিনরাত বকবক করে ঢেউগুলো। বুঝি তাই অত ফেনা ওদের মুখে।
এক ধ্যানে চেয়ে থাকে কদম। যেন ওই সাগরের বুকে লেখা রয়েছে নবিতুনের খবর।
কার যেন হাতের এক জোড়া সহানুভূতি নেবে এসেছে কাঁধে। মুখ ফেরায় কদম।
বাড়ির কথা মনে পড়েছে বুঝি? মনটা কেমন-কেমন করে? চোখ আর মুখে স্নেহ ঢেলে হাসছে মন্তু সারেং।
ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞ নাবিক মন্তু সারেং। মুখ দেখেই বুঝি টের পেয়ে যায় সব নাবিকের মনের কথা।
তা ভাইপোর যখন মন খারাপ, আজ তোমার ছুটি। যাও, উপরে গিয়ে হাওয়া খাও গিয়ে। স্নেহ মেশানো নরম স্বর মন্তু সারেংয়ের।
কদমের কাঁধে রাখা দুখানি হাত মন্তু সারেংয়ের, সে হাতের ঈষৎ চাপে আর নিবিড় হলো স্নেহের স্পর্শ। বলল মন্তু সারেং, চলো আমিও যাই। কিন্তু, তার আগে একটু চা। কি বলো?
গরম পানি এনে চা করতে লেগে গেল মন্তু সারেং।
শুধু আজ নয় সব সময়ই মন্তু সারেংয়ের স্নেহে কেমন গলে যায় কদম।
মন্তু সারেংয়ের অনেক জবরদস্তি। চোখ রাঙানিতেও হিক্ সাহেবের পরেই মন্তু সারেং। নিষিদ্ধ দ্রব্যের গোপন বেচাকেনায় নীতিহীন বিবেক বর্জিত মন্তু সারেং। সেই গোপন হাটের প্রলোভনটা কদমের কানে এখনও ফিসফিসিয়ে বলে মন্তু সারেং। আর প্রলোভন, কুমন্ত্রণা সবই যখন ব্যর্থ তখন রয়েছে মন্তু সারেংয়ের খোঁটা, খোলাখুলি ধমক। কদম জানে ফিরতি খেপে রুতুন্দা জাহাজের কামটা জুটছে না কদমের কপালে। তবু কোন দিন মন্তু সারেংয়ের মুখের উপর একটা কড়া জবাব দিতে পারল না কদম, কেননা মন্তু সারেংয়ের দিলে রয়েছে মহব্বত।
মন্তু সারেং হয়তো জানে স্নেহের কাঙাল কদম। সেই স্নেহ দিয়েই বুঝি ওকে বশ করবে মন্তু সারেং।
টিন খুলে দুমুঠ মুঠি বের করল মন্তু সারেং। সেই বাংলাদেশের মুড়ি, সঙ্গে করে নিয়ে চলেছে মন্তু সারেং। দেশের কথাটা যখন খুব বেশি করে মনে পড়ে কেবলমাত্র তখনই বুঝি ঢাকনিটা খুলে এক আধমুঠ মুড়ি বের করে নেয়, দাঁতের নিচে কুড়ুম কুসুম চিবিয়ে চলে মুড়িগুলো। মুড়ি আর চায়ের মগটা কদমের দিকে বাড়িয়ে দেয় মন্তু সারেং।
মন্তু সারেংয়ের স্নেহটা বাপজানের কথাই মনে করিয়ে দেয় কদমকে। মনে করিয়ে দেয় ষোল বছরে পাকাপাকি জাহাজি হবার আগেও সেই চৌদ্দ বছর বয়সটির কথা। মনে করিয়ে দেয় চৌদ্দ বছর বয়সে বাপজানের সাথে প্রথম এবং শেষবার একই জাহাজে সমুদ্র যাত্রার সেই রোমাঞ্চিত দিনগুলোর কথা। সেটা ছিল যুদ্ধের জামানা। জাহাজটা ছিল ছোট। পথটাও সংক্ষিপ্ত। খিদিরপুর থেকে কলম্বো। কলম্বো থেকেই ফিরে এসেছিল বাপ-বেটা!
ফিরে এসে বামনছড়িতে মাস দুয়েকের বেশি ছিল না মজল সারেং। বেরিয়ে পড়েছিল লম্বা সায়েরে। সেই যে গেল মজল সারেং আর ফিরে আসেনি বামনছাড়িতে।
ধাক করে একটা শব্দ হলো। পেছন ফিরে দেখল কদম, দরজাটা ভেজিয়ে বেরিয়ে গেল মন্তু সারেং।
কাপড়ের চেয়ারটা খুলে সাগরের দিকে মুখ করে বসল কদম। আদি তরঙ্গের নিষ্ঠুর হিংস্রতা এই সাগর, এই সাগর ছিনিয়ে নিয়েছে কদমের বাপজানকে। মর্মান্তক সেই দিনগুলির কথা অনেকের মুখেই শুনেছে কদম। কিন্তু মন্তু সারেংয়ের বয়ানটা গেঁথে রয়েছে কদমের বুকের ভেতর। মন্তু সারেং ছিল বাপজানের ডান হাত, সেই একই জাহাজের সাথী।
বিঘ্নসংকুল পথ। চারদিকে বিপদ। পানির নিচে বিপদ– শক্রর টর্পেডো। পানির উপর বিপদ– ভাসমান মাইন, শত্রুর যুদ্ধজাহাজ। বিপদ মাথার উপর আকাশে– শত্রুর বোমারু বিমান। যে কোন সময় যে কোন দিক থেকে পানির অদৃশ্য তল থেকে অথবা আসমান থেকে, পলক না ফেলতেই বিপদ এসে ছেঁকে ধরতে পারে।
শত্রুর শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে হাজারো সতর্কতা আর আত্মরক্ষার নিখুঁত প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে চলেছে ওদের জাহাজ। মিত্রপক্ষের বন্দরে বন্দরে পৌঁছিয়ে দিচ্ছে অতি দরকারি ঔষধপত্তর, রসদ।
কিন্তু সব সতর্কতাই ব্যর্থ গেল। অকেজো হয়ে রইল আত্মরক্ষার যত আয়োজন ডেকের উপর আকাশের দিকে তাক করে বিমানবিধ্বংসী কামান, মাইন সুইপার, ডেস্ট্রয়ার, জঙ্গি জাহাজের রক্ষাব্যুহ। পানির তলা থেকে জার্মান টর্পেডো ফুটো করে দিয়েছে ওদের জাহাজ। গলগলিয়ে পানি ঢুকছে ওদের জাহাজে। কিছুক্ষণের মধ্যে কয়েক টুকরো হয়ে ডুবে গেল জাহাজখানা।
ডুবন্ত তরীর অসহায় নাবিকের দল। ডিনামাইটের বিস্ফোরণে কারো শতচ্ছিন্ন দেহ উৎক্ষিপ্ত হলো আকাশের দিকে। তারপর হাত পা অস্থি আলাদা আলাদা জুপ জুপ পড়ে গেল সাগরজলে। কেউবা আস্ত ছিটকে পড়ল। ঢেউয়ের ঝাপটায় তলিয়ে গেল। মৃতদেহ হয়ে ভেসে উঠল কিছু দূর। অন্যরা কর্তব্যপরায়ণ কাপ্তানের সুশৃঙ্খল নির্দেশে একে-একে ঝাঁপিয়ে পড়ল মাথা সমান উঁচু সব তরঙ্গের রুদ্র বুকে। কেউবা বাঁচল। বাকিরা হলো সামরিক অর্থে নিখোঁজ, লৌকিক অর্থে মৃত। মন্তু সারেং কোন উদ্ধারকারী জাহাজে উঠে বেঁচে গেল। যুদ্ধের খাতায় নিখোঁজের তালিকায় স্থান পেল মজল সারেং।
এখানেই শেষ। এখানেই থামত মন্তু সারেং। দুচোখের সহানুভূতি ভরা দৃষ্টিটা রাখত কদম সারেংয়ের ওপর। তারপর চোখজোড়া অকস্মাৎ ফিরিয়ে নিত সাগরের দিকে। কী এক বিক্ষোভ বেরিয়ে আসত মন্তু সারেংয়ের বুক ফুড়ে– এই, এই সেই আটলান্টিক। বড় পাজি বড় নচ্ছার এর পানি। নচ্ছার…নচ্ছার। বিশাল বিশাল ফেনিয়ে ওঠা ঢেউগুলোর দিকে স্থির চোখ কদমের। নচ্ছার পাজি হৃদয়হীন ওই সাগরটার ওপর মন্তু সারেংয়ের মতো কদমেরও অনেক রাগ। এই সাগর কেড়ে নিয়েছে ওর বাপজানকে।
মাটির মানুষ, মাটিতেই কবর নেয় ওরা। কিন্তু সাগরের মানুষ। তার কবর তো সাগরের শয্যায়। এটাই তো স্বাভাবিক। উলটোটা উলটোই। সেটা ব্যতিক্রম। হয়তো তাই এত রাগ নিয়েও সাগরের প্রতি কী এক টান কদমের, বারবার সাগরের কাছেই ফিরে আসতে হয় ওকে।
বাপজান মিশে আছে নীল নীল ওই ঢেউয়ের সাথে। রূপ তার ভেসে বেড়ায় দিগন্তবিসারী ওই পানির কোলে। বাপজানই সমুদ্র চিনিয়েছে কদমকে। বাপজানই সমুদ্রের অচ্ছেদ্য বন্ধনে বেঁধে গেছে ওকে। তাই কি এত রাগ নিয়েও সমুদ্রকে ভালবাসে কদম?
দিন যায়। রাত যায়। রুতুন্দা সাঁতার কেটে চলেছে।
কূলের নিশানা নেই। ইশারা নেই একটুখানি সবুজের। সামান্য চিহ্ন নেই লোকালয়ের শক্ত মাটির– যেখানে বাস করে মানুষ। শুধু পানি আর পানি। পানির নাচন। তরঙ্গের আস্ফালন।
এমন গহিন সাগরে কার না ভয় জাগে? কার না বুক কাঁপে? কিন্তু রুতুন্দা জাহাজের নাবিক, অনেক সাগর দেখা, অনেক যুদ্ধজয়ী নাবিক ওরা। ওদের ভয় নেই। ওরা জানে কূল আসবেই।
ওরা জানে এমনি করে পানি ভাংতে ভাংতে একদিন দূরে, বহুদূরে দেখা যাবে তটরেখা। স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হবে সাগর আর মাটির সীমানা। এসে যাবে বন্দর। রুতুন্দা উজাড় করে ঢেলে দেবে তার বুকের ধন, পৃথিবীর নানা দেশের নানা জাতের মানুষের তৈরি পণ্য সম্ভার। আবার নতুন পণ্যে নতুন ধনে খালি বুকটা ভরে নেবে রুতুন্দা। সাঁতার দেবে আর এক মহাসাগরে, আর এক মহাদেশের উদ্দেশ্যে। এমনি করে সাগরে সাগরে পানিতে আর মাটিতে দেশে দেশে আর মানুষে মানুষে মিতালির দূত হয়ে অবিরাম ছুটে চলবে রুতুন্দা।
সেই রুতুন্দার ছোট সারেং কদম। সাগর যার বাপের কবর। বামনছাড়ির মাটিতে যার ঘর। কথাগুলো ভাবতে গিয়ে যেন আনন্দের রেশ পায় কদম, কি গর্বে ফুলে ওঠে ভেতরটা।
কাপ্তানের পুলটার উপর দাঁড়িয়ে আছে কদম। সারা জাহাজে এই জায়গাটির যেমন বিশিষ্ট মর্যাদা তেমনি রয়েছে একটি উন্মুক্ত নিরালা সৌন্দর্য। একটু দূরে চোখে দূরবিন লাগিয়ে চারদিকে দেখছে কাপ্তান হিকস।
আকাশে সূর্য আছে। কিন্তু রৌদ্র নেই। দূরে যেখানে সাগরের নীল আর আকাশের নীল গায়ে গায়ে মিলে শুয়েছিল এতক্ষণ সেই নীলোজ্জ্বল দিগ্বলয়টা ঢাকা পড়েছে কালো মেঘের নিচে।
অজস্র মেঘ। সমুদ্রের বুক থেকে উঠে যাচ্ছে, আকাশের দিকে মিছিল করে। যতই উপরে যাচ্ছে ফুলে যাচ্ছে, কেঁপে উঠছে, ছড়িয়ে পড়ছে রাশি রাশি! ছড়িয়ে পড়ছে আকাশময় নানা আকারের নানা বর্ণে। সেই কখন থেকে এমনি পর্দার পর পর্দা ফেলে ঢেকে নিয়েছে সূর্যটাকে। সূর্যের সাথে সমুদ্রের চিরকালের সখ্য। সেটা বুঝি পছন্দ নয় ওই মেঘগুলোর। নাবিকেরা চেয়ে চেয়ে দেখে সাগরের আকাশে। মেঘমালার চিরন্তর খেলা। কদম দেখে। দূরবিনটা চোখ থেকে নামিয়ে কাপ্তান হিকসও বুঝি তাই দেখছে সিসা রঙ একটি মেঘ। কপালে তার ঝকঝকে হীরকের মতো সাদা রঙ মেঘের মস্ত বড় এক টিপ। একটি গোলাপি বর্ণা মেঘ, মাথায় তার কালো মতো জটা, সেই মেঘটা দৌড়ে এসে গিলে ফেলল সিসা রঙ মেঘটাকে। সিসা রঙ মেঘটাকে আর দেখা যায় না!
ছিমছাম গঠন লম্বাকৃতি একখানি মেঘ কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়ার মতো ঘুরতে ঘুরতে উঠে আসে উপরের দিকে। মাঝ আকাশ অবধি উঠেই ভেঙে গেল মেঘটা। অসংখ্য হয়ে চঞ্চল পায়ে হাল্কা ডানায় উড়ে চলে গেল। এমনি সব মেঘের খেলা। সাগরের আকাশে। এ খেলার কোন শেষ নেই। যেমন শেষ নেই কদমের পায়ের নিচে ওই অশান্ত স্রোতের।
যেন আচমকাই সমুদ্রের পাঁজর ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে অনেক কালো মেঘ। কালোর মাঝেও বিচিত্রবর্ণ আর গোত্র ভাগ ওদের। কোনটা কাজল কালো, কোনটা ধূসর কালো, কোনটা হালকা ধাচের, কোনটিবা নিকষ আঁধারের মতো কালো।
দৌড়ে আসে কালো মেঘশ্রেণী। দৌড়ে এসে গ্রাস করে ধলা মেঘ, বেগুনি মেঘ, তামা রঙ মেঘ, সমস্ত মেঘ। বিশাল এক কালো মেঘ একে-একে লঘু গায়ে উড়ে বেড়ানো সব মেঘগুলোকেই রাহুর মতো গিলে ফেলল। গিলে নিয়ে স্ফীততর হলো।
সাগর আর আসমানের চেহারাটা গেল বদলে। সমুদ্র হলো গোমরা মুখ। আকাশ হলো কালো মুখ, বিষণ্ণ।
যে আকাশের দিকে চেয়ে বিপন্ন নাবিক দিক খোঁজে, ভরসা খোঁজে যে আকাশের স্থির প্রশান্তি প্রিয়াবিরহী নাবিকের বুক দেয় ভরে। সেই আকাশটার অমন কালো মুখ দেখে কথায় ভরে যায় নাবিকের মন। মেঘেডোবা আকাশের ব্যথা ওরা ছাড়া আর কেই-ইবা বোঝে এমন করে? এ যেন হিংসাকাতর ঈর্ষাকাতুর ওই কুৎসিত কালো মেঘটার গভীর এক ষড়যন্ত্র, সমুদ্রের বিরুদ্ধে, সমুদ্র-বিচারী নাবিকদের বিরুদ্ধে। যেন আঘাত পেয়েই দৃষ্টিটা পানির দিকে ঘুরিয়ে নেয় কদম।
বেতার ঘরের অপারেটার এসে কি যেন খবর দেয় কাপ্তান হিকসকে। চঞ্চল আর অস্থির হয়ে ওঠে কাপ্তান হিস। বাজিয়ে দেয় বিপদের সংকেত ঘণ্টা। জোরে জোরে ডাক দেয় ভেঁপু।
এস ও এস এসেছে। বিপন্ন কোন জাহাজের ডাক এসেছে–বিপদে রক্ষা করো। জাহাজ ডুবছে।
সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে গেল রুতুন্দার গতি। বেতারের সংকেত ধরে ছুটে চলল। ইঞ্জিনের যত জোর, প্রপেলারের যত শক্তি, সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুটে চলল রুতুন্দা।
রুদ্ধশ্বাসে পল গুনে চলে রুতুন্দার নাবিক। ওরা প্রস্তুত। বিপদের সাজসরঞ্জাম আর পোশাক লয়ে তৈরি ওরা! ওরা ঝাঁপিয়ে পড়বে গহিন পানিতে, বুক দিয়ে ঢেকে দেবে সমুদ্রটাকে, রক্ষা করবে বিপন্ন যাত্রীদের। এই তো নাবিকের ধর্ম।
অকুস্থলে পৌঁছে গেল ওরা।
জাহাজটা ডুবছে। ওটাকে ভাসিয়ে রাখার সকল চেষ্টাই ব্যর্থ গেছে। ঝপাঝপ জীবন তরীগুলো ভাসিয়ে পানিতে নেমে পড়ল রুতুন্দার দক্ষ নাবিক, কদম সারেং, মন্তু সারেং, ডি সিলভা, আরও অনেকে। পানির দিকে নামিয়ে দিল দড়ির সিঁড়ি। উপরে দাঁড়িয়ে তদারক করছে কাপ্তান হিকস।
শিশু, নারী আর মায়ের দল। ওদেরই রক্ষা করতে হবে সবার আগে। এটা আন্তর্জাতিক ধর্ম। ওরা উঠে আসে নৌকোয়। জোরে জোরে বৈঠা ফেলে রুতুন্দার নাবিক। আসমান উঁচু ঢেউগুলোকে অগ্রাহ্য করে চলে ওদের নৌকো। এক একটা দলকে নিরাপদে রুতুন্দায় তুলে দিয়ে আবার ছুটে যায় ওরা।
ইতিমধ্যে এসে গেছে আর এক জাহাজ। ওরা লেগে গেছে উদ্ধারের কাজে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ডুবছে জাহাজটা সব যাত্রীকে বাঁচাতে পারল না ওরা।
দ্রুত ডুবছে জাহাজটা। এখনো অনেক যাত্রী জাহাজে। জোরে, আরো জোরে বৈঠা ফেলে কদম সারেং, মন্তু সারেং, ডি সিলভা।
কান্নার রোল পড়েছে রুতুন্দা জাহাজে। যে শিশু রক্ষা পেল বাবা তার এখনো ডুবন্ত জাহাজে। যে বধূ পৌঁছল নিরাপদ আশ্রয়ে মাত্র কয়েক হাত দূরেই স্বামী তার তলিয়ে চলেছে জলের অতলে ওরই চোখের সুমুখে। তাই শিশু আর মেয়েরা কান্না জুড়েছে। ওদের আকূল কান্না ছাপিয়ে যায় সমুদ্রের গর্জন।
জোরে আরো জোরে বৈঠা ফেলে কদম সারেং, মন্তু সারেং, ডি সিলভা। কিন্তু না, সব যাত্রীকে বুঝি বাঁচানো গেল না। জোয়ানরা ইতিমধ্যেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে অগাধ পানিতে। ঢেউয়ের সাথে যুঝে যুঝে ওরা সাঁতার কাটছে দুপাশের উদ্ধারকারী দুটোর দিকে। কাপ্তান হিকস ওপর থেকে ছুঁড়ে দিয়েছে বয়া আর লাইফবেল্ট।
তবু সবাইকে কি বাঁচাতে পারল কদমের দল? যারা ভেসে গেল তাদের জীবনের পাড়ে টেনে তুলবার কোন উপায় নেই। তবুও এদিক-ওদিক আর একবার ভালো করে দেখে নিল ওরা। তারপর বাজিয়ে দিল ভেঁপু। রুতুন্দার খোলা ডেকে বসে হাঁপাচ্ছে কদম। ওর নাবিক জীবনের এ অভিজ্ঞতা প্রথম।
রুতুন্দা জাহাজটা দুলে উঠল। ক্লান্তিতে বুজে আসা চোখটা বারেক মেলে দেখল কদম, খানিক দূরে ডুবে যাওয়া জাহাজের মাস্তুলের মাথাটা এখনো জেগে রয়েছে পানির ওপর।