১০. চিত্রনাট্যের সম্মেলন

১০. চিত্রনাট্যের সম্মেলন

মিসেস ক্যুপারের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যোগ দেয়ার কথা ছিল না আমার। কারণ যেদিন হওয়ার কথা ছিল ওই অনুষ্ঠান, তার আগের দিন ফোন পেলাম স্টিভেন স্পিলবার্গের অফিস থেকে। জানতে পারলাম, তিনি আর পিটার জ্যাকসন হাজির হয়েছেন লন্ডনে, টিনটিনের সেই চিত্রনাট্য নিয়ে কথা বলতে চাইছেন আমার সঙ্গে। আরও জানতে পারলাম, রিচমন্ড মিউসের সোহো হোটেলে উঠেছেন তাঁরা।

ওই হোটেল ভালোমতোই চিনি আমি। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এককালে কার পার্কিং ছিল জায়গাটা। আর এখন পরিণত হয়েছে ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কেন্দ্রবিন্দুতে। হোটেলের চারদিকে সারি সারি প্রোডাকশন হাউস আছে। আরও আছে বিভিন্ন রকমের পোস্ট প্রোডাকশন ফ্যাসিলিটি। হোটেলের ভিতরে আছে দুটো স্ক্রিনিং রুম। গ্রাউন্ড ফ্লোরে আছে ‘রিফুয়েল’ নামের ব্যস্ত একটা রেস্টুরেন্ট। সেখানে দু’-একবার লাঞ্চ করেছি আমি।

পরের দুটো দিন ড্যামিয়েন ক্যুপার আর তার মায়ের কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেলাম। ডুবে থাকলাম টিনটিনের সেই চিত্রনাট্য নিয়ে। কারণ আমার জানা ছিল না, পরিচালক হিসেবে জ্যাকসন অথবা প্রযোজক হিসেবে স্পিলবার্গ ঠিক কী প্রতিক্রিয়া দেখাবেন আমার কাজে।

যা-হোক, নির্ধারিত দিনে সকাল ঠিক দশটায় হাজির হয়ে গেলাম সোহো হোটেলে। দ্বিতীয় তলার একটা রুমে নিয়ে যাওয়া হলো আমাকে। বড় একটা কনফারেন্স টেবিল আছে সেখানে। সেটার উপর রাখা আছে তিনটা গ্লাস আর ফিজি মিনারেল ওয়াটারের একটা বোতল। কয়েক মিনিট পরই উপস্থিত হলেন পিটার জ্যাকসন। বরাবরের মতোই অমায়িক দেখাচ্ছে তাঁকে। আগে বেশ মোটা ছিলেন, ওজন অনেক কমিয়েছেন। পরনের কাপড় ঢলঢল করছে।

কথা শুরু হলো আমাদের মধ্যে। লন্ডন, এখানকার আবহাওয়া, এখনকার সিনেমা… ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে কথা হলো তাঁর সঙ্গে; কিন্তু চিত্রনাট্যটা নিয়ে কোনো কথা বললেন না তিনি।

রুমের দরজাটা খুলে গেল আবার, এবার ভিতরে ঢুকলেন স্পিলবার্গ। সব সময় বলতে-গেলে একইরকম কাপড় পরেন তিনি, আজও ব্যতিক্রম করেননি… চামড়ার একটা জ্যাকেট, জিন্স, ট্রেইনার্স আর বেসবল ক্যাপ। চশমা আর দাড়ি দেখামাত্র চেনা যায় তাঁকে।

সবসময়ের মতো আরও একবার নিজেকে আমার মনে করিয়ে দিতে হলো, চোখের সামনে যা ঘটছে তা সত্যি… যে-রুমে বসে আছেন স্পিলবার্গ সেখানে বসে আছি আমিও। আসলে তিনি এমন কেউ, যাঁর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছি বার বার।

সরাসরি কাজের কথায় চলে গেলেন স্পিলবার্গ। জীবনে অনেক চিত্র-প্রযোজকের দেখা পেয়েছি আমি, তাঁদের সঙ্গে কাজ করার অথবা কথা বলার সৌভাগ্যও হয়েছে; কিন্তু স্পিলবার্গের মতো কাউকে দেখিনি কখনও। কাজই যেন তাঁর ধ্যানজ্ঞান। যে- ক’বার দেখা হয়েছে তাঁর সঙ্গে, আমাকে একবারও কোনো ব্যক্তিগত প্রশ্ন করেননি। তাঁর এই মনোভাব লক্ষ করে আমার মনে হয়েছে, যে-কাজ করেছি আমি, সেটার বাইরে আমার প্রতি কোনো আগ্রহই নেই তাঁর!

বললেন, ‘ভুল একটা বই বেছে নিয়েছেন আপনি।’

কথাটা আজগুবি মনে হলো আমার কাছে। ওয়েলিংটনে যখন ছিলাম, তখন আমি আর পিটার মিলে আলোচনা করে ঠিক করেছি, টিনটিনের সিনেমার জন্য কোন্ বইটা বেছে নেবো। তারপর টানা তিন মাস খাটুনি করে দাঁড় করিয়েছি আমি এই চিত্রনাট্য। সুতরাং যা বললেন স্পিলবার্গ, সেটা তাঁর মুখ থেকে শুনতে হবে… এ-রকম কিছু কল্পনাও করিনি কখনও।

‘দুঃখিত… বুঝলাম না কথাটা,’ আসলেই উচ্চারণ করেছিলাম কি না শব্দগুলো, সে-ব্যাপারে এখন আর নিশ্চিত না আমি।

‘দ্য সেভেন ক্রিস্টাল বল্স। প্রিজনার্স অভ দ্য সান। আমার মনে হয় সিনেমা বানানোর জন্য এসব বই উপযুক্ত না…

‘কেন?’

‘এসব বই নিয়ে সিনেমা বানাতে চাই না আমি।’

পিটারের দিকে তাকালাম আমি। মাথা ঝাঁকালেন তিনি।

‘ঠিক আছে!’

মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই আমার। কারণ পিটার জ্যাকসন পরিচালনা করবেন, আর স্পিলবার্গ প্রযোজনা করবেন। তাঁদের দু’জনের সামনেই আমার-লেখা চিত্রনাট্যের কপি আছে, কিন্তু সেটা নিয়ে কোনো আলোচনাই হবে না আমাদের মধ্যে। প্লট, চরিত্র, অ্যাকশন, কৌতুক… চিত্রনাট্যের কোনো কিছু নিয়েই কোনো কথা হবে না।

তার মানে আলোচনা করার মতো কোনো প্রসঙ্গই নেই।

পিটার বললেন, ‘সিরিজের তৃতীয় সিনেমা হিসেবে প্রিজনার্স অভ দ্য সান কাজে লাগাতে পারি আমরা।’ চিত্রনাট্যের কপিটা হাত দিয়ে ঠেলে একপাশে সরিয়ে দিলেন, তাকালেন স্পিলবার্গের দিকে। ‘তা হলে সিরিজের দ্বিতীয় কাহিনি হিসেবে কোন্ বই নিয়ে কাজ শুরু করবেন অ্যান্টনি?

অ্যান্টনি! মানে আমি! অর্থাৎ আমাকে বাদ দিচ্ছেন না স্পিলবার্গ।

কিন্তু স্পিলবার্গ কিছু বলার আগেই আবারও খুলে গেল রুমের দরজাটা। একইসঙ্গে বিস্ময় এবং গাঢ় হতাশা নিয়ে দেখতে পেলাম, হোথর্ন ঢুকছে রুমের ভিতরে। বরাবরের মতো স্যুট আর সাদা শার্ট পরে আছে। তবে এবার একটা কালো টাইও ঝুলিয়েছে।

মিসেস ক্যুপারের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের কথা মনে পড়ে গেল আমার।

ঠিক কোন্ জাতের একটা আলোচনায় বিঘ্ন সৃষ্টি করতে যাচ্ছে সে, সে-ব্যাপারে সম্ভবত কোনো ধারণাই নেই ওর। হয়তো জানেও না, এই আলোচনা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ আমার জন্য। এমনভাবে ভিতরে ঢুকছে, যেন আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে ওকে। আমাকে দেখতে পেয়ে হাসল… ভাবখানা এমন, আশা করেনি আমাকে দেখতে পাবে এখানে।

‘টনি,’ বলল সে, ‘আপনাকে খুঁজছিলাম।’

‘ব্যস্ত আছি,’ বললাম আমি, টের পেলাম রক্তের আকস্মিক জোরালো-প্রবাহে লাল হয়ে গেছে আমার গাল।

‘জানি। শেষকৃত্যানুষ্ঠান!

দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আপনি হয়তো ভুলেই গিয়েছিলেন।

‘আপনাকে আগেও বলেছি, আবারও বলছি। ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া সম্ভব না আমার পক্ষে।

‘কে মারা গেছেন?’ জিজ্ঞেস করলেন পিটার।

তাঁর দিকে তাকালাম আমি। আসলেই উদ্বিগ্ন বলে মনে হচ্ছে তাঁকে। টেবিলের আরেকধারে তখন পিঠ খাড়া করে বসে আছেন স্পিলবার্গ, বিরক্ত মনে হচ্ছে তাঁকে। অনুমান করে নিলাম, এমন একটা পৃথিবীতে বাস করেন তিনি, যেখানে অপ্রত্যাশিত কারও হঠাৎ ঢুকে পড়ার কোনো সুযোগ নেই… অথবা যদি ঢোকেও, তাঁর কোনো অ্যাসিস্টেন্টকে সঙ্গে না-নিয়ে ঢুকতে পারবে না। কারণ এসবের সঙ্গে তাঁর নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত।

‘কেউ না,’ পিটারের প্রশ্নের জবাবে বললাম আমি। এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না, হোথর্ন ঢুকে পড়েছে এ-রকম একটা জায়গায়। সে কি ইচ্ছাকৃতভাবে বিব্রতকর একটা পরিস্থিতিতে ফেলে দিতে চাইছে আমাকে? ওর দিকে তাকালাম। ‘আপনাকে বলেছি… আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব না।’

‘কিন্তু আপনাকে যেতে হবে। ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ।’

‘আপনি কে?’ হোথর্নকে জিজ্ঞেস করলেন স্পিলবার্গ।

এমন ভঙ্গিতে স্পিলবার্গের দিকে তাকাল হোথর্ন যে, মনে হলো, এই প্রথমবারের মতো দেখতে পেয়েছে তাঁকে। ‘আমি হোথর্ন। পুলিশে আছি।’

‘আপনি একজন পুলিশ অফিসার?’

‘না,’ বলে উঠলাম আমি। ‘তিনি একজন পরামর্শদাতা। একটা তদন্তের ব্যাপারে সাহায্য করছেন পুলিশকে।

‘একটা হত্যারহস্য,’ ব্যাখ্যা করার কায়দায় বলল হোথর্ন। তাকিয়ে আছে স্পিলবার্গের দিকে, ওর ভাব দেখে মনে হচ্ছে তাঁকে চিনতে পেরেছে যেন। ‘আপনাকে কি চিনি আমি?’

‘আমি স্টিভেন স্পিলবার্গ।’

‘আপনি কি সিনেমা লাইনের কেউ?’

কাঁদতে ইচ্ছা হলো আমার।

‘হ্যাঁ। আমি সিনেমা বানাই …

‘তিনি স্টিভেন স্পিলবার্গ, আর এই ভদ্রলোকের নাম পিটার জ্যাকসন,’ পরিচয় করিয়ে দিলাম আমি; কিন্তু কেন করলাম কাজটা, জানি না। পরিস্থিতির উপর হয়তো নিয়ন্ত্রণ পেতে চাইছে আমার মনের একটা অংশ। অথবা হয়তো ভাবছি, কোনো-না-কোনোভাবে বশ করতে পারবো হোথর্নকে…. ওকে তখন বের করে দিতে পারবো এই রুম থেকে।

‘পিটার জ্যাকসন!’ চেহারা উজ্জ্বল হলো হোথর্নের। ‘লর্ড অভ দ্য রিংস সিনেমাটা আপনিই বানিয়েছিলেন না?’

‘হ্যাঁ। দেখেছিলেন ওটা?’

‘ছেলের সঙ্গে বসে ডিভিডিতে দেখেছিলাম। ওর ধারণা, সিনেমাটা দারুণ।’

‘ধন্যবাদ।’

‘আসলে… ওই সিরিযের প্রথম সিনেমাটার কথা বলছি আমি। দ্বিতীয় সিনেমাটার ব্যাপারে সে-রকম নিশ্চিত ছিল না সে। কী যেন নাম ছিল দ্বিতীয় সিনেমাটার…?’

‘দ্য টু টাওয়ার্স।’ হাসছেন পিটার, তবে সে-হাসি পুরোপুরি আন্তরিক না।

আরও একবার পরিস্থিতির উপর নিয়ন্ত্রণ পেতে চাইলাম আমি। ‘স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের হয়ে বিশেষ একজন পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন মিস্টার হোথর্ন। এখন যে-কেস নিয়ে কাজ করছেন তিনি, সেটার উপর একটা বই লেখার দায়িত্ব পেয়েছি আমি…’

‘বইটার নাম ‘হোথর্ন ইনভেস্টিগেটস’,’ বলল হোথৰ্ন।

‘নামটা পছন্দ হয়েছে আমার,’ বললেন স্পিলবার্গ।

‘নামটা ভালো,’ একমত হলেন জ্যাকসন।

হাতঘড়ির দিকে তাকাল হোথর্ন। ব্যাখ্যা করার কায়দায় বলল, ‘এগারোটায় অনুষ্ঠিত হবে ওই শেষকৃত্যানুষ্ঠান।’

‘এবং আমি আগেও বলেছি আবারও বলছি, সেখানে যাওয়া সম্ভব না আমার পক্ষে। কেন সম্ভব না, সেটাও দেখতে পাচ্ছেন আপনি চোখের সামনে।’

‘আপনাকে যেতে হবে, টনি। মানে… যে বা যারাই চিনতেন ডায়ানা ক্যুপারকে, তাঁরাই কিন্তু যাচ্ছেন ওই অনুষ্ঠানে। তাঁরা কে কী বলেন অথবা কী করেন, সেটা দেখার এ-ই সুযোগ।

‘ডায়ানা ক্যুপার,’ বললেন স্পিলবার্গ, ‘তার মানে ড্যামিয়েন ক্যুপারের মা?’

‘হ্যাঁ। গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করা হয়েছে তাঁকে। তাঁর নিজের বাড়িতেই।’

‘শুনেছি। গত মাসে ড্যামিয়েন ক্যুপারের সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার। ওয়ার হর্স নামের একটা সিনেমার ব্যাপারে কথা বলতে এসেছিল সে।’

‘বেচারা!’ আফসোস করলেন পিটার জ্যাকসন। ‘এভাবে মারা গেল ওর মা!’

‘ঠিক বলেছেন,’ বললেন স্পিলবার্গ।

তাঁরা দু’জনই তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ভাবখানা এমন, আমি যেন সারাজীবন ধরে চিনি ড্যামিয়েন ক্যুপারকে। এবং তার মায়ের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যোগ না-দিয়ে আমি যেন জঘন্যতম কোনো কাজ করছি। আর হোথর্ন এমন এক ভাব ধরে আছে, যেন সে একজন দেবদূত … আমার শুভবুদ্ধির উদয় ঘটানোর জন্য হাজির হয়েছে।

স্পিলবার্গ বললেন, ‘আমার মনে হয় আপনার যাওয়া উচিত সেখানে, অ্যান্টনি।’

‘কিন্তু এই বইয়ের চেয়ে সিনেমাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে,’ বললাম আমি। পিটার বললেন, ‘আসলে… এই চিত্রনাট্যের ব্যাপারে বেশি কিছু বলার নেই এখন আর। কারণ আমরা যদি এটা নিয়ে কাজ করি, তা হলে সেটা হবে সিরিজের তিন নম্বর সিনেমা। আর দুই নম্বরটার ব্যাপারে এখনও কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারিনি আমরা। ওই ব্যাপারে না-হয় সপ্তাহ দু’-এক পর আলোচনা করা যাবে।

‘ইচ্ছা করলে কনফারেন্স কল করতে পারেন আপনি,’ বললেন স্পিলবার্গ।

তার মানে… টিনটিনের ব্যাপারে যে-আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, সেটা প্রকৃতপক্ষে দু’মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। আমার এত সাধের চিত্রনাট্য বলতে গেলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে। ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে আমাকেও। ব্যাপারটা মোটেও ভালো হয়নি আমার জন্য। পৃথিবীসেরা দু’জন চলচ্চিত্রনির্মাতার সঙ্গে আলোচনা করার কথা ছিল আমার, তাঁদের জন্য একটা সিনেমার চিত্রনাট্য লিখে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার বদলে আমাকে এখন যেতে হবে এমন কারও শেষকৃত্যে, যাঁকে কখনও সামনাসামনি দেখিনি।

পিটার জ্যাকসন আর স্পিলবার্গের দিকে তাকিয়ে হোথর্ন বলল, ‘আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে এবং কথা বলতে পেরে ভালো লাগল।’

‘অবশ্যই,’ বললেন স্পিলবার্গ। ‘ড্যামিয়েনকে আমার সমবেদনা জানিয়ে দেবেন প্লিয।’

‘ঠিক আছে, জানাবো।’

এবার আমার দিকে তাকালেন স্পিলবার্গ। ‘চিন্তা করবেন না, অ্যান্টনি। আপনার এজেন্টকে সময়মতো ফোন করবো আমরা।’

কিন্তু সে-ফোন আর আসেনি কখনও স্পিলবার্গের পক্ষ থেকে। টিনটিনকে নিয়ে প্রথম যে-সিনেমা বানিয়েছিলেন তিনি, সেটার নাম দ্য সিক্রেট অভ দ্য ইউনিকর্ন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পেয়েছিল সিনেমাটা, কিন্তু সারা পৃথিবীতে ৩৭৫ মিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যবসা করতে পারেনি। ওদিকে আমেরিকায় তেমন একটা সাড়া পাওয়া যায়নি এই সিনেমার ব্যাপারে। আর সে-কারণেই হয়তো টিনটিনকে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কাজ করার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাননি স্পিলবার্গ। অথবা হয়তো কাজ করছেন এখন… তবে আমাকে ছাড়া।

বাইরের করিডরে যখন বেরিয়ে এলাম হোথর্নের সঙ্গে, আমাকে সে বলল, ‘তাঁদের দু’জনকে চমৎকার বলে মনে হলো আমার কাছে।’

‘যিশুর দোহাই লাগে চুপ করুন!’ এতক্ষণে বিস্ফোরিত হলাম আমি। ‘বার বার বলেছিলাম ওই শেষকৃত্যে যেতে চাই না। কেন এখানে হাজির হলেন আপনি? এখানে যে আছি আমি, সেটাই বা জানতে পারলেন কী করে?’

‘আপনার অ্যাসিস্টেন্টকে ফোন করেছিলাম।’

‘আর মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গে গড়গড় করে সব বলে দিয়েছে আপনাকে?’

‘শুনুন,’ আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করল হোথর্ন। ‘টিনটিনকে নিয়ে কোনো কাজ করতে চান না আপনি আসলে। কারণ এটা বাচ্চাদের জন্য। আমি ভেবেছিলাম বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করা বন্ধ করে এবার বড়দের জন্য কিছু করতে চাইছেন।’

‘বাচ্চাদের জন্য! সিনেমাটা প্রযোজনা করতে যাচ্ছেন স্টিভেন স্পিলবার্গ!’

‘আপনি যে-বই লিখবেন আমাকে নিয়ে, দরকার হলে সেটা নিয়ে সিনেমা বানাবেন তিনি। একটা হত্যারহস্য! ওদিকে ড্যামিয়েন ক্যুপারকেও ভালোমতো চেনা আছে তাঁর।’

হোটেলের সদর-দরজা দিয়ে বেরিয়ে রাস্তায় হাজির হলাম আমরা।

হোথর্ন বলল, ‘আমাকে নিয়ে যদি কোনো সিনেমা বানানো হয়, তা হলে সেটাতে আমার ভূমিকায় অভিনয় করবে কে, বলতে পারেন?’

১১. শেষকৃত্যানুষ্ঠান

ব্রম্পটন সেমেট্রি ভালোমতোই চিনি। আমার বয়স যখন বিশের কোঠায়, তখন ওই কবরস্থান থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে এক ফ্ল্যাটে একটা রুমে থাকতাম। ওই কবরস্থানে বসে লেখালেখি করে পার করে দিতাম গ্রীষ্মের উষ্ণ বিকেলগুলো। কখনও কখনও উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটাহাঁটি করতাম সেখানে। কবরস্থানটা ছিল নিরিবিলি এক জায়গায় … ধুলো আর ট্রাফিক থেকে দূরে। আমার নিজের আলাদা একটা জগৎ ছিল সেখানে।

আমার কাছে ওই সেমেট্রি লন্ডনের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক আর হৃদয়গ্রাহী কবরস্থান বলে মনে হয়েছে সব সময়। কবরস্থানের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত একটা পথ চলে গেছে সরলরেখার মতো। রৌদ্রোজ্জ্বল কোনো দিনে যখন সে-পথ ধরে হাঁটতাম, মনে হতো, প্রাচীন রোমে হাজির হয়েছি যেন। নিজের জন্য খুঁজে নিতাম কোনো একটা বেঞ্চ, নোটবুকটা নিয়ে বসে পড়তাম সেখানে। কাঠবিড়ালি দেখতে পেতাম অনেক। মাঝেমধ্যে দেখা মিলত নিঃসঙ্গ কোনো শেয়ালের। কোনো কোনো শনিবার বিকেলে ও-রকম কোনো বেঞ্চে বসে শুনতে পেতাম স্ট্যামফোর্ড ব্রিজ ফুটবল ক্লাবের সমর্থকদের হুল্লোড়ের আওয়াজ। কবরস্থানের গাছের সারির ওপাশেই ছিল ক্লাবটা।

লন্ডনের কোনো কোনো জায়গা আমার-লেখালেখিতে কী বিচিত্র সব ভূমিকা পালন করেছে, ভাবলে আশ্চর্য লাগে এখন। সে-রকম এক ভূমিকা পালন করেছে থেমস নদী। এবং, নিঃসন্দেহে, অন্য এক ভূমিকা পালন করেছে ব্রম্পটন সেমেট্রি।

এগারোটা বাজতে মিনিট দশেক বাকি আছে, এমন সময় ওই কবরস্থানে পৌঁছালাম আমি আর হোথর্ন। মেইন গেটের দু’পাশে পাহারাদারের মতো দাঁড়িয়ে আছে দুটো লাল টেলিফোন বক্স; সেগুলোর মাঝখান দিয়ে পথ করে নিতে হলো আমাদেরকে। একটা সরু আর আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগোচ্ছি, পথনির্দেশক খুঁটি আছে এখানে। যানবাহন চলাচলের সুবিধার্থে নামিয়ে রাখা যায় ওটা। শোক প্রকাশ করতে এসেছে, এ-রকম কয়েকজন লোক হাঁটছে আমাদের আগে।

কবরস্থানের এই জায়গায় লতাগুল্মের সংখ্যা বেশি। এককোনায় দেখতে পেলাম মস্তকবিহীন একটা মূর্তি। সেটার একটা হাতও খসে পড়ে গেছে। আইফোনটা বের করলাম আমার পকেট থেকে, ছবি তুললাম ওই মূর্তির। অনতিদূরের ঘেসো জমিনে হেঁটেচলে বেড়াচ্ছে কয়েকটা কবুতর। ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে কী যেন।

পথের একটা কোনা ঘুরতেই সামনে দেখা মিলল ব্রম্পটন চ্যাপেলের। গির্জাটার পেছনের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লাম আমরা। খোলা দরজার পাশে কক্রীটে- বাঁধাই-করা চত্বরে নিথর দাঁড়িয়ে আছে একটা শবযান। কাঠের যে-কফিনের অর্ডার করেছিলেন মিসেস ক্যুপার, সেটা নিশ্চয়ই ওই শবযানের ভিতরেই আছে। আর সেটার ভিতরে… ভাবতে গিয়ে কেমন একটা মোচড় অনুভব করলাম তলপেটের ভিতরে… নিথর শুয়ে আছেন ওই ভদ্রমহিলা। কালো টেইলকোট পরিহিত চারজন লোক দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির পাশে; আমার ধারণা তারাই বহন করে গির্জার ভিতরে নিয়ে আসবে মিসেস ক্যুপারের কফিন।

মেইন এন্ট্রেন্সের সামনে হাজির হলাম আমি আর হোথর্ন। এখানে চার- পিলারযুক্ত একটা দরজা মুখ করে আছে উত্তরদিকে। ওই দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকবার জন্য ছোট একটা ভিড় তৈরি হয়েছে। উপস্থিত লোকদের কেউ কথা বলছে না অন্য কারও সঙ্গে। মাথা নিচু করে আছে সবাই… যেন এখানে আসতে হয়েছে বলে অপ্রস্তত বোধ করছে। ডায়ানা ক্যুপারকে কখনও দেখিনি আমি, অথচ তাঁর জন্য যাঁরা শোক জানাতে এসেছেন তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছি… ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত লাগছে আমার কাছে। সপ্তাহখানেক আগে ওই মহিলার ব্যাপারে কখনও কিছু শুনিওনি।

আমি সাধারণত কারও শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যোগ দিই না। আমার কাছে ব্যাপারটা কেমন ভয়ঙ্কর মনে হয়। ও-রকম কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিলে কেমন যেন মনমরা হয়ে যাই। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হলো, বয়স যত বাড়ছে আমার, কারও-না-কারও শেষকৃত্যে যোগ দেয়ার প্রস্তাব আসছে তত। অর্থাৎ আমার পরিচিত লোকেরা একে একে বিদায় নিতে শুরু করেছেন এই পৃথিবী থেকে। বন্ধুবান্ধব আর পরিচিত লোকদের উপকার করার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এমন কোনো ব্যবস্থা করে যাবো, যাতে আমার শেষকৃত্যে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানানো না-হয় তাদেরকে।

যাঁরা শোক জানাতে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন চিনতে পারছি আমি। আন্দ্রিয়া কুভানেক এসেছে। সে হয়তো বিদায় জানাতে চাইছে তাঁর পুরনো নিয়োগকর্ত্রীকে। গির্জার একটা কোনা সবে ঘুরেছি আমরা, সঙ্গে সঙ্গে একদিকের একটা দরজা দিয়ে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল মেয়েটা।

রেমন্ড কন্সকেও দেখতে পেলাম। নতুন-কেনা কালো একটা কাশ্মীরি কোট পরে আছেন তিনি। শুধু এই অনুষ্ঠানের জন্যই ওই কোট কিনেছেন, সন্দেহ হলো আমার। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন দাড়িওয়ালা এক যুবককে… ছেলেটা সম্ভবত তাঁর পার্টনার।

নার্ভাস দৃষ্টিতে তাকালাম হোথর্নের দিকে। সরু চোখে, সতর্ক দৃষ্টিতে ওই দু’জনকেই দেখছে সে। কিছু বলল না।

আরও একজন লোক আমাদের-মতোই-একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন কুন্সের দিকে। চেহারা দেখলে বোঝা যায় লোকটা হংকং চাইনি। মাথার লম্বা কোঁকড়া চুল নেমে এসেছে কাঁধের উপর। নিখুঁত ছাঁটের স্যুট পরেছেন, সঙ্গে সাদা শার্ট। পায়ে চকচকে কালো শু। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ওই লোককে চিনি আমি। তাঁর নাম ব্রুনো ওয়াং। ক্রুন্সের মতো তিনিও একজন থিয়েটার প্রযোজক। পাশাপাশি একজন সুপরিচিত জনহিতৈষী। যে-দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন কুন্সের দিকে, সেটা দেখে বুঝতে পারলাম, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নেই তাঁদের দু’জনের মধ্যে।

দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকবো আমি আর হোথর্ন, এমন সময় দেখা হয়ে গেল ওয়াঙের সঙ্গে। কুশলাদি বিনিময়ের পর জিজ্ঞেস করলাম তাঁকে, ডায়ানা ক্যুপারকে চিনতেন আপনি?’

‘তিনি আমার খুব প্রিয় একজন বন্ধু ছিলেন,’ জবাবে বললেন ওয়াং। নরম গলায় ধীরেসুস্থে কথা বলেন, শুনলে মনে হয় পরের বাক্যটা ভাবছেন মনে মনে, অথবা যেন আবৃত্তি করছেন কোনো কবিতা। ‘তিনি ছিলেন এমন একজন মহিলা, যাঁর মনে ছিল অনেক দয়া আর আন্তরিকতা। যখন শুনলাম মারা গেছেন তিনি, বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। আর আজ… এখানে হাজির হওয়ার পর… আমার মনটা বলতে গেলে ভেঙে যাচ্ছে।’

‘আপনি যেসব মঞ্চনাটক প্রযোজনা করতেন, সেগুলোতে বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি কখনও?’

‘না… দুঃখজনক হলেও সত্যি কথাটা। কাজটা করতে অনেকবার অনুরোধ জানিয়েছিলাম তাঁকে। কারণ আমি জানতাম, তাঁর রুচি একেবারেই অন্যরকম। যা- হোক, ত্রুটি বলতে যদি কোনো কিছু ছিল তাঁর, তা হলে সেটা হলো, খুবই দয়ালু একটা মন। সবাইকে খুব বিশ্বাস করতেন তিনি 1 …কয়েক সপ্তাহ আগেও তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলাম আমি। তাঁকে সতর্ক করে দিয়েছিলাম…’

‘কোন্ ব্যাপারে?’ জিজ্ঞেস করল হোথর্ন, আমাকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে সামনে চলে এসেছে।

এদিক-ওদিক তাকালেন ওয়াং। এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে আমরা তিনজন ছাড়া অন্য কেউ নেই বলা যায়। আমাদেরকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেছে বাকিরা, ঢুকে পড়েছে মূল গির্জার ভিতরে।

ওয়াং বললেন, ‘ওই ব্যাপারে কিছু বলতে চাইছি না।’

‘কেন, কী সমস্যা?’

আমি ভাবলাম, হোথর্নকে আসলে চিনতে পারেননি ওয়াং, তাই মুখ খুলতে চাইছেন না। বললাম, এঁর নাম ড্যানিয়েল হোথর্ন। পুলিশের একজন তদন্তকারী অফিসার। মিসেস ক্যুপারের কেসটা তদন্ত করছেন।’

‘রেমন্ড ক্লন্সকে চেনেন আপনি?’ জানতে চাইল হোথর্ন। খেয়াল করেছে, কিছুক্ষণ আগে ক্লুন্সের দিকে তাকিয়ে ছিলেন ওয়াং।

‘ঠিক চিনি বলা যাবে না। তবে… দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে আমাদের মধ্যে।’

‘তারপর?’

‘অন্য কারও ব্যাপারে খারাপ কিছু বলতে চাই না… বিশেষ করে এ-রকম কোনো জায়গায়। যা-হোক… যদি কিছু মনে না-করেন…. শেষকৃত্যানুষ্ঠানটা মিস করতে চাই না।’ তাড়াহুড়ো করে চলে গেলেন ওয়াং, ঢুকে পড়লেন গির্জার ভিতরে।

এখন আমরা দু’জন একা।

হোথর্ন বলল, ‘আভাসে-ইঙ্গিতে যা বললেন ওয়াং, শুনে অনুমান করে নিচ্ছি, মিস্টার কুন্সের সঙ্গে কোনো-একটা ঝামেলা চলছিল মিসেস ক্যুপারের। এবং সেটা মিটমাট করে নিতে চাইছিলেন তিনি। ‘

আমাদের থেকে কিছুটা দূরে, হাতে ক্যামেরা নিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে দু’জন লোক। এতক্ষণ খেয়াল করিনি ওদেরকে; একজনকে একটা ছবি তুলতে দেখে তাকালাম সেদিকে।

নিচু গলায় বিশ্রী একটা গালি দিল হোথর্ন।

ওর সেই গালি অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হলো না আমার। নিশ্চয়ই ড্যামিয়েন ক্যুপারের ছবি তুলবার জন্য এখানে হাজির হয়ে গেছে ওই সাংবাদিকেরা।

গির্জার ভিতরে ঢুকে পড়লাম আমরা দু’জন।

ভিতরটা অনেকটা গোলাকার। সারি সারি পিলারের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে গম্বুজাকৃতির একটা ছাদ। জানালা আছে বেশ কয়েকটা, কিন্তু সেগুলোর সবই মেঝে থেকে অনেক উঁচুতে, ফলে আকাশ ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না বাইরের। আমাদের সামনেই ধরাধরি করে নিয়ে আসা হলো কফিনটা। সেটা যেখানে রাখা হলো, সে-জায়গার মুখোমুখি লাগিয়ে দেয়া হয়েছে গোটা চল্লিশেক চেয়ার। তাকালাম কফিনটার দিকে। সেটা যতটা না কফিন বলে মনে হচ্ছে আমার, তার চেয়ে বেশি মনে হচ্ছে একটা পিকনিক বাস্কেট। চামড়ার দুটো স্ট্র্যাপের সাহায্যে মূল কাঠামোর সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে ঢাকনাটা। হলুদ-সাদা ফুলের একটা মালা সাজিয়ে রাখা হয়েছে ঢাকনার উপর। স্পিকার সিস্টেম আছে গির্জার ভিতরে; সেটাতে নিচু ভলিউমে বাজছে জেরেমিয়াহ ক্লার্কের ট্রাম্পেট। ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগল আমার কাছে। কারণ ওই বাজনা সাধারণত ব্যবহৃত হয় কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে।

যাঁরা হাজির হয়েছেন এই শেষকৃত্যানুষ্ঠানে, তাঁদেরকে দেখছি আমি। আশ্চর্য লাগছে… অনেক কম লোক এসেছেন, বারো-তেরোজনের বেশি হবে না। একেবারে সামনের সারিতে বসেছেন ব্রুনো ওয়াং আর রেমন্ড ক্লন্স, তবে নিজেদের মাঝখানে দূরত্ব বজায় রেখেছেন। আন্দ্রিয়ার পরনে সস্তা কালো চামড়ার-জ্যাকেট, একপাশে বসেছে। ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর জ্যাক মিডোসকেও দেখতে পাচ্ছি। থেকে থেকে হাই তুলছে। বসতে অস্বস্তি হচ্ছে তার… যে-চেয়ারে বসেছে সেটা বোধহয় ছোট হয়ে গেছে শরীরের তুলনায়।

এই অনুষ্ঠানে কোনো এক তারকার ভূমিকায় যে অভিনয় করতে হবে, জানা ছিল ড্যামিয়েন ক্যুপারের। চমৎকার ছাঁটের স্যুট, ধূসর শার্ট, আর সিল্কের কালো টাই পরেছে। তার পাশেই দেখতে পাচ্ছি গ্রেস লভেলকে। পরনে কালো পোশাক। তাদের দু’জনের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বসেছেন বাকিরা। ভাবখানা এমন, ড্যামিয়েন আর গ্রেস যেখানে বসেছে, সে-জায়গা যেন কোনো ভিআইপি এরিয়া যেন সে-জায়গার ধারেকাছে যাওয়া যাবে না। ড্যামিয়েনের পেছনে পেশীবহুল এক কৃষ্ণাঙ্গ লোক বসে আছে; অনুমান করে নিলাম, লোকটা ড্যামিয়েনের বডিগার্ড।

অন্য যাঁরা এসেছেন, তাঁদের সবাইকে চিনি না আমি; তবে আমার ধারণা, তাঁরা মিসেস ক্যুপারের হয় বন্ধু নয়তো সহকর্মী। কারও বয়সই পঞ্চাশের নিচে না। একেকজনের চেহারায় একেক রকম আবেগ দেখতে পাচ্ছি… বিরক্তি, কৌতূহল, গাম্ভীর্য। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, কারও চেহারাতেই দুঃখের কোনো ছাপ নেই। শোকের ছায়া দেখতে পাচ্ছি শুধু একজনের চেহারায়… লম্বাটে এক লোক, মাথায় এলোমেলো চুল, বসে আছেন আমার থেকে কয়েক চেয়ার দূরে। ভিকার উঠে দাঁড়িয়ে যখন এগিয়ে গেলেন কফিনের দিকে, ওই লোক তখন পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছলেন।

গির্জার ভিকার একজন মহিলা। তিনি বেঁটেখাটো, নাদুসনুদুস। দুর্বল হাসি লেপ্টে আছে চেহারায়। আর দশজন ভিকারের তুলনায় ভাবভঙ্গিতে আধুনিক। যে- সুর বাজছে, সেটা শেষ না-হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন, তারপর আগে বাড়লেন। হাতে হাত ঘষলেন, এরপর বলতে শুরু করলেন, ‘হ্যালো, এভরিবডি। খুবই সুন্দর এই গির্জায় আপনাদের সবাইকে আমন্ত্রণ জানাতে পেরে আমি খুব খুশি। রোমের সেইন্ট পিটার্সের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৮৩৯ সালে নির্মাণ করা হয়েছে এই গির্জা। চমৎকার একজন মহিলাকে শেষবারের মতো সম্মান জানানোর জন্য আজ এখানে একত্রিত হয়েছি আমরা; আমার ধারণা, ওই কাজ করার জন্য এই গির্জা বিশেষ একটা জায়গা, সুন্দর একটা জায়গা। আমরা যারা বেঁচে থাকি, তাদের জন্য মৃত্যু সব সময়ই কঠিন কিছু। ডায়ানা ক্যুপারকে আচমকা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে জীবনের পথ থেকে। নিষ্ঠুর এক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তিনি। কেন এ-রকম করা হলো তাঁর মতো একজন মানুষের সঙ্গে, এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি আমরা কেউ।

‘ডায়ানা ছিলেন এমন একজন মানুষ, যিনি সব সময়ই সাহায্য করতে চাইতেন অন্যদেরকে। অনেক টাকা দানখয়রাত করেছেন তিনি। গ্লোব থিয়েটারের বোর্ড অভ ডিরেক্টর্সে ছিলেন। তাঁর ছেলে একনামে পরিচিত আমাদের সবার কাছে। মায়ের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য সেই আমেরিকা থেকে এখানে উড়ে এসেছেন ড্যামিয়েন। যে-কষ্ট লাগছে তাঁর, সেটা টের পাচ্ছি আমরা; তারপরও বলবো, তাঁকে আজ এখানে দেখতে পেয়ে আমরা সবাই খুশি।’

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম আমি। দেখতে পেলাম আন্ডারটেকার রবার্ট কর্নওয়ালিসকে। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। ফিসফিস করে কী যেন বলছে আইরিন লযকে। শেষকৃত্যের জন্য আনুষ্ঠানিক পোশাক পরে আছে তারা দু’জনই। খেয়াল করলাম, আইরিন লয মাথা ঝাঁকাল, এবং তারপরই বাইরে চলে গেল কর্নওয়ালিস।

স্টিভেন স্পিলবার্গ আর পিটার জ্যাকসনের কথা কেন যেন মনে পড়ে গেল আমার। হয়তো এখনও সোহো হোটেলে আছেন তাঁরা দু’জন। অথবা হয়তো একটু তাড়াতাড়িই সেরে নিচ্ছেন আজকের লাঞ্চটা। তাঁদের সঙ্গে থাকার কথা ছিল আমার! টের পেলাম, আমাকে যে জোর করে নিয়ে আসা হয়েছে এখানে, সেজন্য ক্রোধ জেগে উঠছে আমার মনে।

‘ডায়ানা ক্যুপার ছিলেন এমন একজন মানুষ,’ বলছেন ভিকার, ‘যিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন নিজের মৃত্যুর ব্যাপারে। আজকের এই অনুষ্ঠানের সব কিছু আয়োজন করে গেছেন তিনি। এমনকী এইমাত্র যে-সুর শুনলেন আপনারা, সেটাও। যা-হোক, বাইবেলের গীতসংহিতার সাম থার্টি ফোর (Psalm 34 ) দিয়ে এই অনুষ্ঠানের কাজ শুরু করতে চাই আমি। আমার ধারণা, ডায়ানা যখন বেছে নিয়েছিলেন এই প্রার্থনাস্তব, তখন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, মৃত্যু আসলে ভয়ের কোনো কিছু না। কারণ এই স্তবকে বলা হয়েছে, ধার্মিক লোকের অনেক সমস্যা থাকতে পারে, কিন্তু প্রভু তাঁকে সব কিছু থেকে উদ্ধার করেন।’

বিশেষ ওই স্তব পাঠ করলেন ভিকার।

তারপর উঠে দাঁড়াল গ্রেস লোভেল। এগিয়ে গেল সামনে, সিলভিয়া প্লাথের ‘এরিয়েল’ আবৃত্তি করে শোনাল।

স্ট্যাটিস ইন ডার্কনেস
দেন দ্য সার্ক্সট্যান্সলেস ব্লু
পোর অভ টোর অ্যান্ড ডিসট্যান্সেস…

কবিতাটা সে মুখস্ত করে ফেলেছে দেখে ভালো লাগল আমার। শুধু মুখস্ত করেনি, আন্তরিকভাবে আবৃত্তিও করেছে।

সুন্দর দুই চোখ মেলে অদ্ভুত শান্ত দৃষ্টিতে লোভেলের দিকে তাকিয়ে আছে ড্যামিয়েন। কে যেন হাই তুলল আমার পাশে। তাকিয়ে দেখি, হোথৰ্ন।

সবশেষে ড্যামিয়েনের পালা। উঠে দাঁড়াল সে, ধীর পায়ে হেঁটে আগে বাড়ল। ঘুরল। এখন ওর মায়ের কফিনের দিকে উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। যা বলল, সংক্ষেপে বলল; আবেগের লেশমাত্র পেলাম না ওর কথায়।

‘বাবা যখন মারা যান, তখন আমার বয়স মাত্র একুশ। এখন আমি আমার মাকেও হারিয়েছি। মায়ের সঙ্গে যা ঘটেছে তা মেনে নেয়া কষ্টকর, কারণ বাবা অসুস্থ অবস্থায় মারা গেছেন, কিন্তু মায়ের উপর হামলা চালানো হয়েছে তাঁরই বাসায়। ঘটনাটা যখন ঘটেছে, আমি তখন আমেরিকায়। যা-হোক, মাকে বিদায় বলার সুযোগ পাইনি, সেজন্য সব সময় খারাপ লাগবে আমার। তবে এটা জানি, আমি যা করছি, তার জন্য আমাকে নিয়ে গর্বিত ছিলেন তিনি। এবং আমার মনে হয়, তিনি যদি বেঁচে থাকতেন তা হলে আমার নতুন শো উপভোগ করতে পারতেন… আগামী সপ্তাহ থেকে শুটিং শুরু হবে সেটার। নাম হোমল্যান্ড… এ- বছরের শেষ-নাগাদ প্রদর্শিত হবে।

‘আমি যে একজন অভিনেতা হতে চেয়েছি, সেটা সব সময় সমর্থন করেছেন মা। আমাকে সব সময় উৎসাহ দিয়েছেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, আমি একদিন তারকা হতে পারবো। যখন স্ট্র্যাটফোর্ডে ছিলাম, তখন আমার প্রতিটা প্রোডাকশন্সে গেছেন তিনি… দ্য টেম্পেস্টে এরিয়েল, হেনরি ফাইভ, ডক্টর ফস্টার্সে মেফিস্টোফিলিস। শেষের চরিত্রটা খুব প্রিয় ছিল তাঁর। তিনি সব সময় বলতেন, আমি নাকি তাঁর পুঁচকে শয়তান।

কথাটা শুনে, গুঞ্জনমিশ্রিত সহানুভূতির হাসি শোনা গেল শ্রোতাদের পক্ষ থেকে।

‘এখন থেকে আমি যখন স্টেজে থাকবো,’ বলছে ড্যামিয়েন, ‘তখন দর্শকদের সারির দিকে তাকিয়ে সব সময় খুঁজবো মাকে। কিন্তু আর কখনোই খুঁজে পাবো না তাঁকে… তাঁর আসন সব সময়ই খালি থাকবে। তাঁর সেই টিকিট বিক্রি করে দেয়া যেতে পারে অন্য কারও কাছে…

ড্যামিয়েনের শেষের কথাটার মানে বোঝা গেল না ঠিক। সে কি মজা করছে? আমার আইফোনে রেকর্ড করে নিচ্ছিলাম ড্যামিয়েন ক্যুপারের কথাগুলো। ওর বক্তৃতার এই পর্যায়ে এসে মনোযোগ হারিয়ে ফেললাম, কী বলছে সে তা আর শুনছি না। আরও কয়েক মিনিট কথা বলল সে, তারপর সাউন্ড সিস্টেমে বাজতে শুরু করল ‘এলিনর রিগবি’। খুলে দেয়া হলো সবগুলো দরজা, বাইরে বের হয়ে কবরস্থানে হাজির হলাম আমরা সবাই। উসুখুসু চুলের সেই লোক আমাদের ঠিক সামনে আছেন এখন! দ্বিতীয়বারের মতো চোখ মুছতে দেখা গেল তাঁকে।

কবরস্থানের পশ্চিম পাশে সমান ব্যবধানে স্থাপন করা হয়েছে কতগুলো স্তম্ভ, সেগুলোর পেছনে হাজির হলাম আমরা। একদিকের নিচু একটা দেয়ালের পাশে, অবিন্যস্ত ঘাসে ছাওয়া জমিনে খোঁড়া হয়েছে একটা কবর। দেয়ালের ওপাশে রেললাইন আছে। ওটা দেখা যাচ্ছে না, তবে যখন কবরটার দিকে এগোচ্ছি আমরা, তখন একটা ট্রেন চলে গেল সেখান দিয়ে… আওয়াজ শুনতে পেলাম।

একটা সমাধিফলকের উপর নজর পড়ল আমার। সেটাতে লেখা আছে: লরেন্স ক্যুপার, ৩ এপ্রিল ১৯৫০– ২২ অক্টোবর ১৯৯৯, দীর্ঘদিনের অসুস্থতায় ভুগবার পর এবং তিতিক্ষার শেষে। মনে পড়ে গেল, কেন্টে থাকতেন তিনি, এবং সম্ভবত সেখানেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তাঁকে এই জায়গায় সমাহিত করা হলো কেন, ভেবে আশ্চর্য লাগল।

আমাদের মাথার উপর ঝকঝক করছে সূর্যটা। তবে কয়েকটা গাছ ছায়া দিচ্ছে আমাদেরকে। বেলা বাড়ছে, আবহাওয়া মনোরম আর উষ্ণ। মৃতদেহের শেষযাত্রায় সেটাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য আমাদের থেকে পিছিয়ে পড়েছে ড্যামিয়েন ক্যুপার আর গ্রেস লভেল। ওদের সঙ্গে আছেন ভিকারও। তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছি আমরা, এমন সময় ডিটেক্টিভ ইন্সপেক্টর মিডোস এগিয়ে এল আমাদের দিকে

‘কেমন চলছে, হোথৰ্ন?’

‘খুব একটা খারাপ না, জ্যাক।’

অবজ্ঞার ভঙ্গিতে নাক সিঁটকাল মিডোস। ‘কোনো সমাধান বের করতে পেরেছেন? আপনি নিশ্চয়ই এত জলদি সমাধান করে ফেলতে চান না এই কেস?’

‘আসলে আপনার পক্ষ থেকে কোনো একটা জবাবের জন্য অপেক্ষা করছি আমি,’ বলল হোথর্ন।

সেক্ষেত্রে হতাশ করতে হচ্ছে আপনাকে। কাছাকাছি চলে এসেছি আমরা… ‘আসলেই?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি। মিডোস যদি হোথর্নের আগে সমাধান করে ফেলে এই কেস, তা হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে আমার বইয়ের।

‘হ্যাঁ। পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারবেন সব। এবং সেটা খুব শীঘ্রই। তবে এখন একটা কথা বলে রাখি আপনাকে… ব্রিটানিয়া রোডে সাম্প্রতিক সময়ে তিন- তিনটা চুরির ঘটনা ঘটেছে। এবং সবগুলো ঘটনার ধরণ প্রায় একইরকম… প্যাকেজ ডেলিভারির বাহানায় ডিসপ্যাঁচ রাইডারের বেশ ধরে হাজির হয়েছিল চোর। মোটরবাইকের হেলমেটে ঢাকা পড়ে ছিল তার চেহারা। এবং প্রতিবারই সে টার্গেট করেছে এমন সব মহিলাদের, যাঁরা নিজেদের বাসায় একা থাকতেন।’

‘এবং সে কি তাঁদের সবাইকে খুন করেছে?’

‘না। প্রথম দু’জনকে ধোলাই দিয়েছে। তারপর নিয়ে গিয়ে ঢুকিয়েছে কাবার্ডে, তালা দিয়ে আটকে রেখেছে সেখানে। এরপর তোলপাড় করে ফেলেছে পুরো বাসা। কিন্তু তার তৃতীয় শিকার অত বোকা ছিলেন না। বরং বলা যায় বেশ চালাক-চতুর ছিলেন। বাসায় ঢুকতে দেননি তিনি ওই লোককে। ফোন করেছিলেন ট্রিপল নাইনে। যা-হোক, এখন আমাদের জানা আছে, কার খোঁজ করছি আমরা। সিসিটিভি ফুটেজ দেখছি। আমার মনে হয় বাইকটা খুঁজে বের করতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না আমাদেরকে। আর ওটা খুঁজে পেলে ওটার মালিককেও ধরতে পারবো আশা করি।

‘ডায়ানা ক্যুপারকে কীভাবে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হলো, সে-ব্যাপারে আপনার থিউরি কী? বাকিদের মতো ওই মহিলাকেও কেন মারধোর করে ছেড়ে দিল না সেই মোটরবাইকার? কেন তাঁকে খুন করল?’

মিডোসের কাঁধ দুটো রাগবি খেলোয়াড়দের মতো; অনিশ্চিত ভঙ্গিতে ও-দুটো ঝাঁকাল সে। ‘যতদূর মনে হয়… কিছু-একটা গড়বড় হয়ে গিয়েছিল।’

গাছগুলোর ওপাশে একটা নড়াচড়া চোখে পড়ল আমার। অন্তিম বিশ্রামস্থলে নিয়ে আসা হচ্ছে ডায়ানা ক্যুপারকে। কবরটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ছোটখাটো একটা মিছিল। ওই লোকগুলোর মধ্যে, ফিউনারেল পার্লার থেকে আসা চারজন লোকও আছে। আরও আছেন ভিকার নিজে, ড্যামিয়েন ক্যুপার আর গ্রেস লোভেল। বেশ কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে ওই লোকগুলোকে অনুসরণ করছে আইরিন লয। দুই হাত পিছমোড়া ভঙ্গিতে হাঁটছে। নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে, সব কিছু সুচারুভাবে সম্পন্ন হচ্ছে। রবার্ট কর্নওয়ালিসের পাত্তা নেই কোথাও।

‘একটা কথা বলি?’ হঠাৎ বলে উঠল হোথর্ন… যা বলার মিডোসকে বলছে। ‘আমার মনে হয় আপনার থিউরি আসলে ভুয়া। যখন একসঙ্গে পুলিশ ডিপার্টমেন্টে কাজ করতাম আমরা তখনও ফালতু সব থিউরি আউড়াতেন আপনি, এবারও তা-ই করেছেন। যা-হোক, শেষপর্যন্ত যদি আপনার সেই মুখোশ পরিহিত ডিসপ্যাঁচ রাইডারকে চিহ্নিত করতে পারেন, যদি ধরতে পারেন, তা হলে আমার পক্ষ থেকে শুভকামনা জানিয়ে দেবেন তাকে। কারণ ওই লোক ব্রিটানিয়া রোডের ধারেকাছেও যায়নি… এই ব্যাপারে আপনার সঙ্গে যে-কোনো পরিমাণ টাকার বাজি ধরতে রাজি আছি আমি।’

‘কী বললেন?’ রেগে গেছেন মিডোস। ‘আমার থিউরি ভুয়া? পুলিশ ডিপার্টমেন্টে যখন ছিলাম তখন ফালতু সব থিউরি দিতাম? আপনি নিজে যখন পুলিশ ডিপার্টমেন্টে ছিলেন তখন কী ছিলেন, জানেন? জঘন্য একটা বেজন্মা। আপনার চাকরি যে চলে গেল, সেজন্য আমরা সবাই কী পরিমাণ খুশি হয়েছিলাম, হয়তো জানেনও না।’

‘আপনি যাদেরকে টার্গেট করেছিলেন তাদের কপালে কী ঘটেছে, সেসব আসলে লজ্জাজনক ব্যাপার ছাড়া আর কিছু না।’ সমান তেজের সঙ্গে বলল হোথর্ন, চকচক করছে ওর দুই চোখ। ‘শুনেছি আমি চলে আসার পর ওই লোকদের সবাই নাকি কমবেশি বিপদে পড়েছে। যা-হোক, ব্যক্তিগত কথা যখন চলেই এল… শুনলাম আজ বাদে কাল নাকি বিবাহবিচ্ছেদ ঘটতে চলেছে আপনার?’

‘কথাটা কে বলেছে আপনাকে?’ দেখে মনে হলো, একটুখানি হলেও ঝাঁকুনি খেয়েছে মিডোস।

‘আপনার সারা গায়ে লেখা আছে সেটা।’

ভুল বলেনি হোথর্ন। দেখে সাংঘাতিক অবহেলিত বলে মনে হচ্ছে মিডোসকে। কুঁচকে আছে তার স্যুট। শার্টটা ইস্ত্রি করা হয়নি কতদিন কে জানে। এমনকী শার্টের একটা বোতাম উধাও। অর্থাৎ তার স্ত্রী হয় মারা গেছে নয়তো তাঁকে ছেড়ে চলে গেছে।

হয়তো তর্কাতর্কি শুরু হয়ে যেত মিডোস আর হোথর্নের মধ্যে, কিন্তু তখনই হাজির হলো কফিনটা… দেখতে পেলাম, ঘেসো জমিনে নামিয়ে রাখা হলো সেটা, শুনতে পেলাম ক্যাচক্যাচ করে উঠল কফিনের কাঠ। কফিনের নিচে দুটো দড়ি আছে। ওটা দিয়ে পুরো কফিন পেঁচিয়ে বেঁধে দিতে কিছু সময় লাগল চার কফিন- বাহকের। দেখতে পেলাম, ওই লোকগুলোর দিকে সপ্রংশস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আইরিন ল্য।

তাকালাম ড্যামিয়েন ক্যুপারের দিকে। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে সে। পাশে কে আছে না-আছে সে-ব্যাপারে উদাসীন বলে মনে হচ্ছে তাকে। কাছেই দাঁড়িয়ে আছে গ্রেস, কিন্তু ড্যামিয়েনের হাত ধরেনি গ্রেস। বেশ কিছুক্ষণ আগে কয়েকজন ফটোগ্রাফারকে দেখেছিলাম; দূরে দাঁড়িয়ে আছে তারা, তবে তাদের ক্যামেরায় যুম লেন্স আছে। ধারণা করে নিলাম, যেসব ছবি তোলা দরকার তাদের, সেসব ছবি দূর থেকেই তুলে নিতে পারছে।

‘কফিনটা কবরে নামানোর সময় হয়েছে,’ জানান দিলেন ভিকার। ‘আসুন আমরা সবাই পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে দাঁড়াই। খুবই বিশেষ একটা জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে, আসুন আমরা সবাই নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চিন্তা করি ওই ব্যাপারে।’

কফিন নামানো হচ্ছে কবরে। আমার মনে হলো, কবরটা যেন অপেক্ষা করছিল ওই কফিনের জন্য। কবর ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ছোটখাটো একটা জটলা। সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে কবরে-কফিন-নামানোর দৃশ্য। রুমাল হাতে একটা লোককে দেখেছিলাম কিছুক্ষণ আগে, এখন খেয়াল করলাম ওটা দিয়ে চোখের কোনা মুছছেন তিনি। ব্রুনো ওয়াঙের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন রেমন্ড ক্লন্স, নিজেদের মধ্যে নিচু গলায় সংক্ষিপ্ত আলাপ সেরে নিলেন তাঁরা।

কবরের জমিনে কফিনটা নামিয়ে দিল চার কফিন-বাহক।

আর ঠিক তখনই, অনেকটা হঠাৎ করেই, বেজে উঠল একটা গান। গানটা বাচ্চাদের… একটা নার্সারি রাইম….

দ্য হুইলস অন দ্য বাস গো
রাউন্ড অ্যান্ড রাউন্ড
রাউন্ড অ্যান্ড রাউন্ড
রাউন্ড অ্যান্ড রাউন্ড
দ্য হুইলস অন দ্য বাস গো রাউন্ড অ্যান্ড রাউন্ড
অল ডে লং।

শব্দের মান বেশি ভালো না… কেমন যেন ফিনফিনে। শুনে মনে হচ্ছে, কোথাও যেন টুংটুং আওয়াজ হচ্ছে। প্রথম যে-চিন্তা আমার মাথায় এল তা হচ্ছে, কারও মোবাইল বাজছে। যাঁরা শোক প্রকাশ করতে এসেছেন তাঁরা তাকাচ্ছেন একজন আরেকজনের দিকে। আমার মতো সবাই হয়তো ভাবছেন, কার মোবাইল বাজছে। হয়তো ভাবছেন, এতগুলো লোকের মধ্যে কে বিব্রত হতে চলেছে। আগে বাড়ল আইরিন লয, সতর্ক হয়ে উঠেছে। কবরের সবচেয়ে কাছে দাঁড়িয়ে আছে ড্যামিয়েন ক্যুপার। আতঙ্ক আর উন্মত্ততার একটা মিশ্র আবেগ দেখা দিয়েছে তার চেহারায়। নিচের দিকে নির্দেশ করল, কী যেন বলল গ্রেস লোভেলকে। না-শুনতে পেলেও বুঝতে পারলাম, কী বলতে চাইছে সে।

কবরের ভিতর থেকে আসছে আওয়াজটা।

তার মানে… কফিনের ভিতরে বাজছে ওই নার্সারি রাইম।

রাইমটার দ্বিতীয় চরণ শুরু হয়ে গেছে…

দ্য ওয়াইপার্স অন দ্য বাস গো সুইশ, সুইশ, সুইশ
সুইশ, সুইশ, সুইশ,
সুইশ, সুইশ, সুইশ…

জমে যেন বরফে পরিণত হয়েছে চার কফিন-বাহক। হাত থেকে দড়ি ছেড়ে দিয়ে কফিনটা কবরে পড়ে যেতে দেবে কি না, অথবা কী করবে, বুঝতে পারছে না। হয়তো ভাবছে, কফিনটা যদি নামিয়ে দেয় কবরে, তা হলে মাটির এত গভীর থেকে আর শোনা যাবে না ওই রাইম। অথবা হয়তো ভাবছে, তুলে আনবে কফিনটা, তারপর কিছু-একটা করবে ওই রাইমের ব্যাপারে। আবার এ-রকমও ভাবতে পারে, নৃশংস আর অনুপযুক্ত একটা গান-সহ কি দাফন করবে মিসেস ক্যুপারকে?

এতক্ষণে মোটামুটি সবাই বুঝে গেছে, কোত্থেকে আসছে ওই গান। বুঝে গেছে, কোনো একজাতের ডিজিটাল রেকর্ডার অথবা রেডিও রাখা আছে কফিনের ভিতর। ডায়ানা ক্যুপার যদি নিজের জন্য মেহগনি কাঠের কফিন বেছে নিতেন, তা হলে ওই গান হয়তো ভেসে আসত না আমাদের কারও কানে। এতক্ষণে হয়তো শান্তিতে ঘুমানোর জন্য কবরে নামিয়ে দেয়া হতো ওই মহিলাকে।

কফিনের চিড়-ধরা কাঠ ভেদ করে এখনও শোনা যাচ্ছে গানটা…

দ্য ড্রাইভার অন দ্য বাস গোয ‘মুভ অন ব্যাক….

ফটোগ্রাফাররা উঁচু করে ধরেছে তাদের ক্যামেরা, সামনের দিকে এগিয়ে আসছে… কিছু-একটা গণ্ডগোল যে হয়েছে কোথাও, টের পেয়ে গেছে। ঠিক সে- মুহূর্তে ভিকারের উপর যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল ড্যামিয়েন ক্যুপার, তবে সেটা শারীরিকভাবে না, বরং মৌখিকভাবে… আসলে দোষারোপ করার জন্য কোনো একজনকে দরকার ছিল তার এবং হাতের কাছেই ছিল ওই মহিলা।

‘কী… হচ্ছেটা কী?’ খেঁকিয়ে উঠল ড্যামিয়েন। ‘এসব কার কাজ?’

কবরের কাছে পৌঁছে গেছে আইরিন লয, খাটো পায়ে যত দ্রুত সম্ভব দৌড়ানোর চেষ্টা করছে। ‘মিস্টার ক্যুপার… ‘ শুরু করল সে, কিন্তু শেষ করতে পারল না কথাটা… হাঁপাচ্ছে।

‘আমাদের সঙ্গে কোনো ধরনের মজা করতে চাইছে নাকি কেউ?’ দেখে কেমন অসুস্থ মনে হচ্ছে ড্যামিয়েনকে। ‘ওই গান কেন বাজানো হচ্ছে?’

‘কফিনটা তোলো,’ দায়িত্ব নিল আইরিন। ‘তুলে আনো ওটা।’

মুভ অন দ্য ব্যাক, মুভ অন দ্য ব্যাক…

‘আমাদের কাছ থেকে যে-টাকা নিয়েছেন আপনারা,’ আবারও খেঁকিয়ে উঠল ড্যামিয়েন, ‘তার প্রতিটা পয়সার জন্য আপনাদের বেজন্মা প্রতিষ্ঠানের নামে আদালতে মামলা ঠুকবো…

?

‘আমি খুবই দুঃখিত,’ বলে উঠল আইরিন। ‘বুঝতেই পারছি না…

যে-গতিতে কফিনটা কবরে নামিয়েছিল চার কফিন-বাহক, তার চেয়ে অনেক দ্রুত সেটা কবরের ভিতর থেকে বের করে আনল তারা। আরও একবার ঘেসো জমিনের উপর ধপ্ করে পড়ল কফিনটা। কল্পনার দৃষ্টিতে দেখতে পেলাম, কফিনের ভিতরে থাকা ডায়ানা ক্যুপারের শরীরটা দুলে উঠল এদিক-ওদিক। যাঁরা শোক প্রকাশ করতে এসেছেন, তাঁদের সবার চেহারার উপর নজর বুলিয়ে নিলাম চট করে। আসলে জানতে চাইছি, বিশেষ সেই গানের জন্য এঁদের কেউ দায়ী কি না। বোঝাই যাচ্ছে, ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে কাজটা। কেউ কি অসুস্থ কোনো মশকরা করতে চাইছে ক্যুপার পরিবারের সঙ্গে? নাকি বিশেষ কোনো বার্তা দিতে চাইছে?

রেমন্ড ক্লন্স আঁকড়ে ধরে রেখেছেন তাঁর পার্টনারকে। মুখে হাত চাপা দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ব্রুনো ওয়াং। আর আন্দ্রিয়া কুভানেক… আমার ভুল হতে পারে, কিন্তু কেন যেন মনে হলো, হাসছে সে। রুমালওয়ালা লোকটা দাঁড়িয়ে আছে কুভানেকের পাশে; তার চেহারায় এমন এক ভাব খেলা করছে যার মানে ঠাহর করতে পারলাম না। হাতটা মুখের কাছে তুললেন তিনি… মনে হলো এখনই বোধহয় ছুঁড়ে ফেলে দেবেন রুমালটা, অথবা হয়তো ফেটে পড়বেন হাসিতে। কিন্তু কোনোটাই করলেন না, বরং মোচড় কেটে ঘুরলেন, পিছিয়ে গেলেন বেশ কিছুটা। দেখতে পেলাম, দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন কবরস্থান থেকে। ব্রম্পটন রোডের দিকে এগিয়ে গেছে যে-রাস্তা, সেদিকে যাচ্ছেন।

দ্য ড্রাইভার অন দ্য বাস গোয ‘মুভ অন ব্যাক’
অল ডে লং

কিছুতেই থামছে না ওই গান। ওটা অতি প্রচলিত; গাইবার ভঙ্গি অতি উৎফুল্ল… বড়রা যখন ছোটদেরকে গান শোনান তখন সাধারণত ও-রকম ভঙ্গিতে গান করেন।

‘অনেক হয়েছে,’ শেষপর্যন্ত আর সহ্য করতে পারল না ড্যামিয়েন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সাংঘাতিক একটা মানসিক-ধাক্কা খেয়েছে সে। এই শেষকৃত্যানুষ্ঠান শুরু হওয়ার পর এই প্রথম আসল কোনো আবেগ দেখা দিল তার চেহারায়।

‘ড্যামিয়েন… ‘ তার হাত ধরার জন্য নিজের একটা হাত বাড়িয়ে দিল গ্রেস। কিন্তু ঝাড়া দিয়ে গ্রেসের হাতটা ছাড়িয়ে দিল ড্যামিয়েন। ‘বাসায় যাচ্ছি আমি। তুমি পাবে চলে যেয়ো। ফ্ল্যাটে দেখা হবে তোমার সঙ্গে।’

ফটোগ্রাফাররা যে সমানে ছবি তুলছে, জানি আমি। ড্যামিয়েন ক্যুপারের ব্যক্তিগত ট্রেনার-কাম-বডিগার্ড ফটোগ্রাফারদের লেন্স থেকে আড়াল করতে চাইছে ড্যামিয়েনকে, কিন্তু ওই লেন্সগুলো যেন চুম্বকের মতো আটকে আছে ড্যামিয়েনের সঙ্গে… যেন ছায়ার মতো অনুসরণ করে চলেছে তাকে।

ঝড়ের বেগে কবরস্থান থেকে বেরিয়ে গেল ড্যামিয়েন।

ঘুরে আইরিনের দিকে তাকালেন ভিকার, কেমন অসহায় দেখাচ্ছে তাঁকে। ‘কী করবো?’

চার কফিনবাহকের দিকে তাকাল আইরিন, ধৈর্য রাখার চেষ্টা করছে। ‘চলো কফিনটা গির্জায় ফিরিয়ে নিয়ে যাই। তাড়াতাড়ি!’

ঘেসো জমিনের উপর দিয়ে ডায়ানা ক্যুপারের কফিনটা দ্রুত টেনে নিয়ে চলল চার কফিন-বাহক। দৌড়াচ্ছে না, কিন্তু যত জলদি সম্ভব এগোনোর চেষ্টা করছে। কিছু-না-কিছু শালীনতা বজায় রাখার চেষ্টা করছে এখনও।

দূরে চলে গেছে কফিনটা, সেই রাইমও স্তিমিত হয়ে এসেছে অনেকখানি…

দ্য হর্ন অন দ্য বাস গো …

কিছুক্ষণের মধ্যে গির্জার ভিতরে ঢুকে পড়ল কফিন-বাহকরা।

তাদের গমনপথের দিকে তাকিয়ে আছে হোথর্ন। স্পষ্ট বুঝতে পারছি, সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার কোনো একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে ওর মাথায়।

‘বিপ, বিপ, বিপ,’ বেসুরো ভঙ্গিতে আউড়াল সে ছড়াগানটার কিছু অংশ, তারপর হাঁটা ধরল দ্রুত পায়ে।

কফিনটার গমনপথ অনুসরণ করে এগিয়ে যাচ্ছে গির্জার দিকে।

১২. রক্তের গন্ধ

শূন্য কবর ঘিরে বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকজন লোক… তাঁদের চেহারায় কেমন বিভ্রান্তির ছাপ। কফিনের পেছন পেছন রওয়ানা হলাম আমরা। দৃশ্যটা এখন স্মৃতির পর্দায় যতবার দেখি, ততবার মনে পড়ে যায় কোনো জাহাজের কথা– ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সাগরে যেন নিঃসঙ্গ ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে ওটাকে।

কেন যেন মনে হচ্ছিল, যা ঘটেছে তা দেখে আমোদিত হয়েছে হোথর্ন। একটু আগে যে-রসিকতা করা হয়েছে, সেটাই ওর আমোদের কারণ কি না, নিশ্চিত হতে পারলাম না। একটু আগে মিডোস নিজের থিউরির কথা বলেছে… মিসেস ক্যুপারের বাসায় নাকি চুরি সংঘটিত হয়েছিল, কিন্তু তালগোল পাকিয়ে ফেলে চোর, ফলে নৃশংস হামলা চালায় ওই মহিলার উপর। কিন্তু মিসেস ক্যুপারের বাসায় যা ঘটেছে, আমার বিবেচনায় সেটা পুলিশের স্বাভাবিক অভিজ্ঞতার বাইরে। আর সেজন্যই নিজের মতো করে তদন্ত করার সুযোগ পেয়ে গেছে হোথর্ন।

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। থপথপ করে হাঁটছে মিডোস, আসছে আমাদের পেছন পেছন। গির্জার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। আমাদের থেকে আর কিছুটা দূরে আছে ওটা।

‘কী মনে হয় আপনার?’ জিজ্ঞেস করলাম হোথর্নকে। ‘ওটা কী ছিল আসলে?’

‘আমার মনে হয় আসলে কোনো মেসেজ দেয়া হয়েছে আমাদেরকে,’ বলল হোথর্ন।

‘মেসেজ? কার জন্য?

‘নিশ্চিত করে বলবো না এখনই। তবে… ড্যামিয়েন ক্যুপারের জন্য হতে পারে। তার চেহারাটা দেখেছেন না?’

‘দেখেছি। আপসেট দেখাচ্ছিল।’

‘কাগজের মতো সাদা হয়ে গিয়েছিল তার চেহারা। একটা পর্যায়ে মনে হচ্ছিল আমার, লোকটা বুঝি মারাই যাবে!’

‘আচ্ছা, জেরেমি গডউইনের ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি তো?’

‘না… আমার মনে হয় না। কারণ ছেলেটা কোনো বাসের নিচে চাপা পড়েনি।

‘না, তা পড়েনি, কিন্তু এ-রকম কি হতে পারে না… ছেলেটা যখন গাড়িচাপা পড়েছিল তখন কোনো খেলনা-বাস বহন করছিল? অথবা… সে হয়তো বাসে সওয়ার হয়ে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করত…’

‘ঠিকই বলেছেন হয়তো। বাচ্চাদের নার্সারি রাইম শোনানো হয়েছে আমাদেরকে। তার মানে কোনো একটা মৃত বাচ্চার সঙ্গে কোনো-না-কোনো যোগসূত্র থাকতে পারে কোথাও-না-কোথাও।’ একটা কবর টপকাল হোথর্ন। ‘বাসায় ফিরে গেছে ড্যামিয়েন। তবে তার সঙ্গে অচিরেই দেখা করতে হবে আমাদেরকে। ভাবছি, কী বলার আছে লোকটার।’

‘ওই গাড়ি-দুর্ঘটনা ঘটেছে দশ বছর আগে,’ মাথায় যা আসছে, তা-ই বলছি আমি। ‘প্রথমে খুন করা হলো ডায়ানা ক্যুপারকে। তারপর ঘটল এই ঘটনা। আমার মনে হয় কেউ একজন বিশেষ একটা পয়েন্টের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে আমাদের।’

গির্জায় পৌঁছে গেলাম। কফিনটাও নিয়ে আসা হয়েছে ইতোমধ্যে। মিডোস এসে পৌঁছানো পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম আমরা।

মিডোসের শরীরটা নষ্ট হয়ে গেছে একেবারেই… এতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করেই হাঁপাচ্ছে। সে যদি খাবার নিয়ন্ত্রণ না-করে, ধূমপান না-ছাড়ে, আর ব্যায়াম না-করে, তা হলে এই কবরস্থানে চিরস্থায়ী বসবাসের জন্য আসতে হবে তাকে।

গির্জার ভিতরে ঢুকলাম। ইতোমধ্যে কাঠের পায়ার উপর বসিয়ে দেয়া হয়েছে কফিনটা। স্ট্র্যাপ খুলবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে আইরিন লয। সেদিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছেন ভিকার, তাঁর দৃষ্টি দেখে বোঝা যাচ্ছে মানসিক একটা ধাক্কা হজম করতে হয়েছে তাঁকে। কর্নওয়ালিস অ্যান্স সন্সের সেই চারজন লোকও হাত লাগিয়েছে। আমরা যখন ভিতরে ঢুকলাম, মুখে তুলে আমাদের দিকে তাকাল আইরিন লয।

‘এই ব্যবসায় সাতাশ বছর ধরে আছি আমি,’ বলল সে, ‘কিন্তু এ-রকম কোনো কিছু ঘটেনি আগে কখনও।’

আর কিছু না-হোক, অন্তত সেই নার্সারি রাইম মিউযিকটা বন্ধ হয়েছে। দ্রুত অভ্যস্ত হাতে কাজ শেষ করছে আইরিন, কাঠের মচমচানি শুনতে পাচ্ছি। কফিনের ঢাকনাটা তুলে ফেলল সে। কেন জানি না আঁতকে উঠে পিছু হটে গেলাম কিছুটা। ডায়ানা ক্যুপার মারা গেছেন সপ্তাহখানেক আগে; এতদিন পর তাঁকে দেখার কোনো ইচ্ছাই নেই আমার। কপাল ভালো… মসলিনের একখণ্ড কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে মরদেহটা। তাঁর শারীরিক অবয়ব ঠাহর করতে পারছি, তবে তাঁর নিষ্পলক খোলা চোখের দৃষ্টি অথবা একসঙ্গে-সেলাই-করে-রাখা ঠোঁট দুটো দেখতে হচ্ছে না। ঝুঁকে পড়ল আইরিন, ক্রিকেট বলের মতো দেখতে উজ্জ্বল কমলা রঙের কিছু-একটা তুলে নিল ডায়ানার দুই হাতের মাঝখান থেকে… ওটা বসিয়ে দেয়া হয়েছিল সেখানে। মিডোসের হাতে দিল জিনিসটা।

যারপরনাই বিরাগ নিয়ে জিনিসটা দেখছে মিডোস। ‘এটা কী, জানি না আমি।’

‘একটা অ্যালার্ম ক্লক,’ বলল হোথর্ন, হাত বাড়িয়ে দিল ঘড়িটা নেয়ার জন্য। ওটা ওর হাতে দিল মিডোস… দেখে মনে হলো জিনিসটা হস্তান্তর করতে পেরে খুশি হয়েছে।

তাকালাম ঘড়িটার দিকে। ওটা একটা ডিজিটাল অ্যালার্ম ক্লক। একধারে একটা বৃত্তাকার প্যানেল আছে, সঠিক সময়টা দেখা যাচ্ছে সেখানে। বেশ কয়েকটা ছিদ্র দেখা যাচ্ছে গায়ে… অনেকটা যেন আগের-দিনের রেডিও’র মতো। সুইচ আছে দুটো। একটা সুইচে চাপ দিল হোথর্ন। সঙ্গে সঙ্গে বাজতে শুরু করল…

দ্য হুইলস অন দ্য বাস গো রাউন্ড অ্যান্ড রাউন্ড…

‘বন্ধ করুন ওটা!’ চিৎকার করে উঠল আইরিন লয়।

কথামতো কাজ করল হোথর্ন। ব্যাখ্যা দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘এটা একটা এমপি থ্রি রেকর্ডিং অ্যালার্ম ক্লক। ইন্টারনেট ঘাঁটলে ও-রকম ঘড়ির খোঁজ পাওয়া যায় অনেক। আইডিয়াটা হচ্ছে, সকালে ঘুম থেকে তুলবার জন্য আপনার বাচ্চাদের প্রিয় কোনো গান ঢুকিয়ে রাখতে পারবেন এ-ধরনের কোনো ঘড়িতে। আমার ছেলের জন্যও এ-রকম একটা জিনিস জোগাড় করেছি আমি। তবে কোনো গান ঢোকাইনি ওটাতে, বরং আমার নিজের কণ্ঠ রেকর্ড করে দিয়েছি। কী রেকর্ড করেছি, জানেন? ‘ওঠ, ছোট্ট বেজন্মা কোথাকার, কাজ শুরু করে দে!’ কথাটা শুনলে আমার ছেলে যারপরনাই উল্লাস বোধ করে।’

ঘড়িটার দিকে ইঙ্গিত করলাম আমি। ‘ওটা অ্যাক্টিভেট করা হলো কী করে?’

জিনিসটা উল্টেপাল্টে দেখল হোথর্ন। ‘সাড়ে এগারোটায় সেট করা হয়েছিল অ্যালার্ম। যে-ই করে থাকুক কাজটা, চেয়েছিল, শেষকৃত্যানুষ্ঠানের মাঝ-পর্যায়ে যেন বেজে ওঠে অ্যালার্ম।’ তাকাল আইরিন লযের দিকে। ‘এই ঘড়ি ডায়ানা ক্যুপারের হাতে এল কী করে, সে-ব্যাপারে কোনো ধারণা আছে আপনার?’

‘না!’ হতাশ মনে হচ্ছে আইরিনকে; মনে হচ্ছে, সে ভাবছে তাকে দুষছে হোথৰ্ন।

‘এ-রকম কি হয়েছিল… কফিনটা রেখে চলে গিয়েছিল সবাই… মানে, কফিনের ধারেকাছে কেউ ছিল না?’

‘সদুত্তর পেতে চাইলে মিস্টার কর্নওয়ালিসকে জিজ্ঞেস করুন প্রশ্নটা।’

‘তিনি কোথায়?’

‘একটু তাড়াতাড়ি চলে গেছেন তিনি… যেতে হয়েছে আসলে। আজ বিকেলে তাঁর ছেলের স্কুলে একটা নাটক আছে।’ কমলা রঙের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে আইরিন। ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানের কারও এ-রকম কোনো কাজ করার কথা না।’

‘তার মানে কাজটা নিশ্চয়ই বাইরের কারও। সেজন্যই জিজ্ঞেস করেছিলাম, কফিনটা ফেলে রেখে বাইরে চলে গিয়েছিলেন কি না আপনারা সবাই?

‘হ্যাঁ,’ কেঁপে উঠল আইরিন, দেখে মনে হলো অস্বস্তিতে ভুগছে… কথাটা স্বীকার করতে রীতিমতো ঘৃণা বোধ করছে। ‘ফুলহ্যাম প্যালেস রোডে আমাদের অফিসে রাখা ছিল মিসেস ক্যুপারের লাশটা। আজ সেখান থেকেই এখানে নিয়ে আসা হয়েছে তাঁর মরদেহ। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দক্ষিণ কেনসিংটনের অফিসে লাশ রাখার জন্য যথেষ্ট জায়গা নেই। হ্যাঁমারস্মিথের কাছে একটা গির্জা আছে, সেখানে প্রায়ই মরদেহ রেখে দেয়া হয়, যাতে যিনি মারা গেছেন তাঁর আত্মীয়স্বজন সেখানে গিয়ে শোক জানাতে পারেন; মিসেস ক্যুপারের বেলায়ও করা হয়েছিল কাজটা।’

‘মিসেস ক্যুপারের জন্য শোক জানাতে গিয়েছিল ক’জন?’

‘সেটা এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। তবে ওখানে একটা ভিটির বুক আছে আমাদের। এবং শনাক্তকরণ ছাড়া সেখানে ঢুকতে দেয়ার কথা না কাউকে।’

‘আর এই গির্জার কী অবস্থা?’ জানতে চাইল হোথর্ন।

জবাবে কিছু বলল না আইরিন।

হোথর্ন বলে চলল, ‘আমরা যখন হাজির হলাম এই জায়গায়, তখন কফিনটা শবযানের ভিতরে ছিল। আর ওটা পার্ক করে রাখা হয়েছিল গির্জার পেছনদিকে। সেখানে কি সার্বক্ষণিকভাবে কোনো একজনকে নিযুক্ত রাখা হয়েছিল?’

মিসেস ক্যুপারের কফিন নিয়ে এসেছে যে-চারজন, তাদের একজনের দিকে তাকাল আইরিন।

দৃষ্টি নত করল লোকটা। ‘বেশিরভাগ সময় কফিনের সঙ্গেই ছিলাম আমরা, তবে সারাটা সময় ছিলাম না।’

‘আপনি কে?’ জিজ্ঞেস করল হোথর্ন।

‘আলফ্রেড লয। আমি ওই প্রতিষ্ঠানের একজন পরিচালক।’ লম্বা করে দম নিলেন তিনি। ‘আইরিন আমার স্ত্রী।’

বিষণ্ণ হাসি হাসল হোথর্ন। ‘সারাটা সময় ছিলেন না… কোথায় গিয়েছিলেন তা হলে?’

‘এখানে আসার পর শবযানটা পার্ক করে গির্জার ভিতরে ঢুকে পড়েছিলাম আমরা।’

‘আমরা মানে আপনারা চারজনই?’

‘হ্যাঁ।’

‘শবযানটা কি তখন লক করা ছিল?’

‘না।’

আইরিন বলল, ‘মৃত একজন মানুষকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে কেউ, এ-রকম কিছু দেখিনি আজপর্যন্ত।’

‘ভবিষ্যতে হয়তো এই ব্যাপারে অন্যকিছু ভাবতে হবে আপনাদেরকে,’ আইরিনের দিকে এগিয়ে গেল হোথর্ন, ভঙ্গিটা আক্রমণাত্মক। ‘মিস্টার কর্নওয়ালিসের সঙ্গে কথা বলা দরকার আমার। কোথায় পাবো তাঁকে?’

‘দিচ্ছি তাঁর ঠিকানা।’ একটা হাত বাড়িয়ে দিল আইরিন। সে-হাতে তার স্বামী একটা নোটবুক আর একটা কলম ধরিয়ে দিলেন। প্রথম পৃষ্ঠায় খসখস করে কয়েকটা লাইন লিখল আইরিন, ছিঁড়ে ফেলল পৃষ্ঠাটা, তারপর সেটা বাড়িয়ে ধরল হোথার্নের দিকে।

‘ধন্যবাদ।

‘এক মিনিট!’ একপাশে দাঁড়িয়ে আছে মিডোস, তাকে দেখে মনে হলো, যেন বুঝতে পেরেছে, কিছুই বলেনি এতক্ষণ। কিন্তু একইসঙ্গে… তার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম… বেশি কিছু বলার নেই আসলে, এবং সেটা সে নিজেও জানে। ‘অ্যালার্ম ক্লকটা নিয়ে যেতে হবে আমাকে। ওটা অন্য কারও হাতে পড়লে মূল্যবান কোনো সূত্র নষ্ট হয়ে যেতে পারে… আমাদের ফরেনযিক এক্সপার্টরা পছন্দ না-ও করতে পারে ব্যাপারটা।

হোথর্ন বলল, ‘আপনাদের তথাকথিত ফরেনযিক এক্সপার্টরা আদৌ কিছু খুঁজে পাবেন কি না এই ঘড়িতে, সন্দেহ আছে আমার।’

‘ইন্টারনেটের মাধ্যমে যদি কেনা হয়ে থাকে এই ঘড়ি,’ বলছে মিডোস, ‘তা হলে ক্রেতার পরিচয় বের করার ভালো একটা সম্ভাবনা আছে আমাদের।’

তার হাতে ঘড়িটা দিল হোথর্ন। ওটা খুব সাবধানে ধরার ভান করল মিডোস… ঘড়ির একপাশ আঁকড়ে ধরেছে বুড়ো আঙুলের সাহায্যে, অন্যপাশ ধরেছে তর্জনীর সাহায্যে।

‘গুড লাক,’ বলল হোথৰ্ন I

অর্থাৎ ভদ্র-ভাষায় বিদায় নিতে বলছে সে মিডোসকে।

.

মিসেস ক্যুপারের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যাঁরা শোক জানাতে এসেছিলেন, তাঁরা ফিনবরো রোডের এককোনায়, একটা গ্যাসট্রোপাবে একত্রিত হচ্ছেন। কবরস্থান থেকে হেঁটে ওই পাবে যেতে কয়েক মিনিট লাগে। তাড়াহুড়ো করে বাসায় ফিরে গেছে ড্যামিয়েন ক্যুপার, তবে চলে যাওয়ার আগে ওই পাবের কথা বলে গেছে। আর শেষকৃত্যের এই অনুষ্ঠান থেকে সে একাই চলে যায়নি, যাঁরা শোক প্রকাশ করতে এসেছিলেন তাঁদের প্রায় অর্ধেক লোকও চলে গেছেন ইতোমধ্যে। তবে গ্রেস লোভেল আছে, আর আছেন কয়েকজন পুরুষ ও মহিলা।

হোথর্ন বলেছিল, ড্যামিয়েন ক্যুপারের সঙ্গে কথা বলতে চায় সে। ইতোমধ্যেই যোগাযোগ করেছে রবার্ট কর্নওয়ালিসের সঙ্গে, একটা টেক্সট মেসেজও পাঠিয়ে দিয়েছে তার মোবাইল ফোনে। তবে সব কিছুর আগে যে-কাজ করতে চায় সে তা হলো, যাঁরা এখন আছেন ওই পাবে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিতে চায়। ওই লোকগুলো যদি ভালোমতো না-চিনতেন ডায়ানা ক্যুপারকে, তা হলে আসতেন না এই শেষকৃত্যানুষ্ঠানে… বলা ভালো, অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাওয়ার পরও রয়ে যেতেন না। কাজেই এই যে এখন একসঙ্গে আছেন তাঁরা, তাঁদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার এবং কথা বলার এটাই সুযোগ হোথর্নের। চলার গতি দ্রুত করল সে, ফুলহ্যাম রোড পার হয়ে ওই পাবে ঢুকে পড়লাম আমরা দু’জন।

এবং ঢোকামাত্রই দেখতে পেলাম গ্রেসকে। কালো পোশাক পরেছে, কিন্তু সেটা খুবই খাটো। ওই কাপড়ের উপরে পরেছে মখমলের টাক্সিডো জ্যাকেট, সেটার দু’দিকের কাঁধে প্যাড লাগানো আছে। বারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে, কারও শেষকৃত্যে অংশ নিতে আসেনি, বরং কোনো সিনেমার প্রিমিয়ারে যোগ দিতে এসেছে। কারও সঙ্গে কথা বলছে না। আমরা যখন এগিয়ে গেলাম ওর দিকে, আমাদেরকে দেখে হাসল নার্ভাস ভঙ্গিতে।

‘মিস্টার হোথর্ন!’ বোঝাই গেল, হোথর্নকে দেখে খুশি হয়েছে গ্রেস। ‘এখানে কী করছি, নিজেই জানি না আমি। এখানকার কাউকেই বলতে গেলে চিনি না।’

‘এঁরা কারা?’ জিজ্ঞেস করল হোথর্ন।

এদিক-ওদিক তাকাল গ্রেস, তারপর আঙুলের ইশারায় দেখিয়ে দিতে শুরু করল একেকজনকে। ‘ওই যে… রেমন্ড কুন্স। মঞ্চনাটকের প্রযোজক। তাঁর একটা নাটকে অভিনয় করেছে ড্যামিয়েন।’

‘তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে আমাদের।’

‘আর ওই যে… ডক্টর বাটারওয়ার্থ… ডায়ানার জেনারেল প্র্যাকটিশনার,’ মাথা ঝাঁকিয়ে লোকটাকে দেখিয়ে দিল গ্রেস। ভদ্রলোকের বয়স ষাটের ঘরে, মাথাটা কেমন কবুতরের মাথার মতো, পরনে তিন পিসের গাঢ় রঙের স্যুট। ‘ডাক্তারের পাশে যে-মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন তিনি তাঁর স্ত্রী। আর ওই যে… ওই কোনায় একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছেন না… তিনি ডায়ানার উকিল… চার্লস কেনওয়ার্দি। ডায়ানার উইল নিয়ে কাজ করছেন। এঁদের ক’জনকে ছাড়া বাকি কাউকে চিনি না।’

‘ড্যামিয়েন বাসায় চলে গেছেন, তা-ই না?’

‘হ্যাঁ। খুবই আপসেট হয়ে পড়েছিল সে। আমার কী মনে হয়, জানেন? মনে হয়, ওকে আপসেট করে দেয়ার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে বেছে নেয়া হয়েছিল ওই গান। কেউ একজন ভয়ঙ্কর কোনো তামাশা করেছে ওর সঙ্গে।’

‘ওই গান কি আপনাদের পূর্বপরিচিত?’

‘হ্যাঁ,’ দ্বিধা ফুটল গ্রেসের চেহারায়, বাকি কথা বলবে কি বলবে না তা নিয়ে সংশয়ে ভুগছে সম্ভবত। ‘গানটা আসলে ওই দুই ছেলের দুর্ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কাদের কথা বলছি, বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই? ওই গান টিমোথি গডউইনের সবচেয়ে প্রিয় গান। যখন কবর দেয়া হচ্ছিল ছেলেটাকে, তখন বাজানো হয়েছিল গানটা।’

‘আপনি জানতে পারলেন কী করে?’ জিজ্ঞেস করল হোথৰ্ন।

‘ড্যামিয়েন বলেছে আমাকে। এই ব্যাপারটা নিয়ে প্রায়ই কথা বলত সে।’ আমার কেন যেন মনে হলো, ড্যামিয়েনকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে গ্রেস। ‘নিজের আবেগ বা অনুভূতির কথা সবার কাছে বলে বেড়ানোর মতো মানুষ না সে। তারপরও ওই গান… বিশেষ সেই ঘটনার একটা মানে আছে ওর কাছে। এত বছর হয়ে গেছে, তারপরও ভুলতে পারে না সে ঘটনাটা।’ নিজের জন্য এক গ্লাস প্রোসেকো ঢেলে নিল, একচুমুকে প্রায় পুরোটাই চালান করে দিল পেটে। ‘ঈশ্বর, কী ভয়াবহ একটা দিন যে গেল আজ! আমি জানতাম আজকের দিনটা মোটেও ভালো কাটবে না। সকালে যখন ঘুম থেকে উঠলাম, তখনই টের পেয়েছিলাম ব্যাপারটা। কিন্তু এত খারাপ যে হবে, স্বপ্নেও ভাবিনি।’

হোথর্ন একদৃষ্টিতে দেখছে গ্রেসকে। হঠাৎ বলল, ‘আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, ড্যামিয়েনের মাকে তেমন একটা পছন্দ করতেন না আপনি। ‘

লাল হয়ে গেল গ্রেসের চেহারা। ‘কথাটা ঠিক না! কে বলেছে আপনাকে?’

‘তিনি খুব একটা পাত্তা দিতেন না আপনাকে… আপনিই বলেছিলেন একবার।

‘ও-রকম কিছু বলিনি আমি। শুধু বলেছিলাম, আমার চেয়ে বেশি অ্যাশলিইয়ের প্রতি আগ্রহ ছিল ড্যামিয়েনের মায়ের। আর কিছু না।’

‘অ্যাশলিই কোথায়?’

‘হাউনস্লো-তে, আমার বাবা-মায়ের কাছে। এখান থেকে বাসায় ফেরার সময় ওকে নিয়ে যাবো ওখান থেকে।’ বারের উপর মদের গ্লাসটা নামিয়ে রাখল গ্রেস। আমাদেরকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল এক ওয়েইটার, তার ট্রে থেকে আরেকটা গ্লাস তুলে নিল।

‘তার মানে মিসেস ক্যুপারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল আপনার,’ বলল হোথর্ন।

সে-কথাও তো কখনও বলিনি,’ কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল গ্রেস। ‘আমাদের জীবনে অ্যাশলিই আসার আগে ড্যামিয়েনের সঙ্গে অল্প কিছু সময় একা কাটাতে পেরেছি আমি। ড্যামিয়েনের মা একটু নার্ভাস ছিলেন… অ্যাশলিইয়ের কারণে হয়তো ভাটা পড়তে পারে ড্যামিয়েনের ক্যারিয়ারে। কথাটা শুনতে আপনাদের কেমন লাগছে বুঝতে পারছি, কিন্তু ড্যামিয়েনের মা ছিলেন আসলে নিঃসঙ্গ একজন মানুষ। লরেন্স মারা যাওয়ার পর আপন বলতে এক ড্যামিয়েনই ছিল তাঁর জীবনে। এবং ওর প্রতি মানসিকভাবে অনেকখানি ঝুঁকে পড়েছিলেন তিনি। ড্যামিয়েনের যে- কোনো সাফল্য তাঁর জন্য ছিল সব কিছু।

‘তার মানে ড্যামিয়েন আর মিসেস ক্যুপারের মাঝখানে চলে এসেছিল অ্যাশলিই?’

‘অ্যাশলিইয়ের এই পৃথিবীতে চলে আসাটা আসলে পরিকল্পিত ছিল না… আপনি যদি সেটাই বোঝাতে চেয়ে থাকেন তা হলে বলছি। তবে ড্যামিয়েন এখন ভালোবাসে মেয়েটাকে।’

‘আর আপনি? অ্যাশলিইয়ের কারণে আপনার ক্যারিয়ারের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না?’

‘মিস্টার হোথর্ন, আপনি এমন সব কথা বলেন, শুনলে মন-মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আমার বয়স মাত্র তেত্রিশ। আমি অ্যাশলিইকে অনেক ভালোবাসি। আর… যদি আগামী কয়েক বছর কাজ না-ও করি, তাতে তেমন কিছু আসে-যায় না আমার। এখন যেভাবে চলছে আমার জীবন, তাতে খুবই খুশি আমি।’

কেন যেন সন্তুষ্ট হতে পারলাম না কথাটা শুনে।

‘লস অ্যাঞ্জেলস কেমন লাগে আপনার?’ জিজ্ঞেস করল হোথর্ন।

‘ওখানে থিতু হতে একটু সময় লেগেছে আমার। হলিউড হিলসে একটা বাড়ি আছে আমাদের। সেখানে যখন থাকি… যখন সকালে ঘুম থেকে উঠি, আমি যে আছি সেখানে, মাঝেমধ্যে বিশ্বাসই হয় না। যখন নাটকের স্কুলে ক্লাস করতাম, তখন থেকেই একটা স্বপ্ন ছিল আমার… কখনও এ-রকম কোনো বাসায় থাকবো, যেখানে ঘুম থেকে উঠে চোখ মেললেই দেখা যাবে ‘হলিউড’ লেখাটা।’

‘আপনার নিশ্চয়ই নতুন নতুন অনেক বন্ধু আছে, তা-ই না?’

‘নতুন বন্ধুর কোনো দরকার নেই আমার। কারণ ড্যামিয়েন আছে আমার সঙ্গে।’ হোথর্নকে ছাড়িয়ে দূরে তাকাল গ্রেস। ‘যদি কিছু মনে না-করেন, এখানে আরও কয়েকজন লোকের সঙ্গে হাই-হ্যালো করতে হবে আমাকে। কথা ছিল, এখানে যাঁরাই এসেছেন, তাঁদের সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে হবে, তাঁদের সবার খেদমত করতে হবে। আর… এখানে বেশিক্ষণ থাকতেও চাই না আমি।’

আমাদেরকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল মেয়েটা। ওকে দৃষ্টি-দিয়ে অনুসরণ করল হোথর্ন। চেহারা দেখেই বুঝলাম, একরাশ চিন্তা ভর করছে ওর উপর।

‘এবার?’ জানতে চাইলাম আমি।

‘ডাক্তার,’ বলল হোথর্ন।

‘তিনি কেন?’

আমার দিকে ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকাল হোথর্ন। ‘কারণ ডায়ানা ক্যুপারকে খুব ভালোমতো চিনতেন তিনি। আমরা যদি ধরে নিই কোনো একটা সমস্যায় ভুগছিলেন ডায়ানা ক্যুপার, তা হলে আমরা এটাও ধরে নিতে পারি, সে-সমস্যার ব্যাপারে কথা বলেছিলেন তিনি সেই ডাক্তারের সঙ্গে। সবচেয়ে বড় কারণটা হচ্ছে,

ওই ডাক্তার নিজেও খুন করে থাকতে পারেন ডায়ানা ক্যুপারকে!

মাথা নাড়ল হোথর্ন, গ্রেসের দেখিয়ে দেয়া সেই তিন-পিসের-স্যুট পরিহিত লোকের উদ্দেশে পা বাড়াল। কাছে গিয়ে বলল, ‘ডক্টর বাটারওয়ার্থ।

‘বাটিমোর,’ হোথর্নের সঙ্গে হাত মেলালেন ডাক্তার। তিনি বিশালদেহী, গালে দাড়ি আছে। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। হোথর্ন যে তাঁর নাম ভুল বলেছে সেজন্য মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছেন, কিন্তু দোষ আসলে হোথর্নের না, বরং গ্রেসের– নামটা সে-ই বলেছিল আমাদেরকে। যা-হোক, হোথর্ন যখন বলল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে যোগাযোগ আছে ওর, তখন দেখলাম চেহারায় আগ্রহ দেখা দিয়েছে তাঁর।

ব্যাপারটা আগেও অনেকবার লক্ষ করেছি আমি। কোনো খুনের তদন্তের সঙ্গে যখন জড়িয়ে ফেলা হয় সাধারণ কোনো লোককে, তখন তারা সেটা উপভোগ করে। কেউ কেউ সাহায্য করার চেষ্টা করে, তবে তাদের সে-চেষ্টা আসলে ভান ছাড়া আর কিছু না।

‘কবরস্থানে ওটা কী ঘটল, বলুন তো?’ হোথর্নকে জিজ্ঞেস করলেন বাটিমোর। ‘বাজি ধরে বলতে পারি, মিস্টার হোথর্ন, ও-রকম কিছু আগে কখনও দেখেননি আপনি। কী মনে হয় আপনার? কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে করেছে কাজটা?’

‘আমার মনে হয়, কফিনের ভিতরে অ্যালার্ম ক্লক ঢুকিয়ে দেয়াটা কোনো দুর্ঘটনা না, স্যর,’ বলল হোথর্ন।

‘একদম ঠিক। ঘটনাটা তদন্ত করে দেখবেন আশা করি।

‘আসলে… মিসেস ক্যুপারের হত্যাকাণ্ডকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি।

‘আমি ভেবেছিলাম দোষী লোকটাকে ইতোমধ্যেই শনাক্ত করতে পেরেছেন আপনারা।’

‘চোর ছাড়া আর কারও কাজ না ওটা,’ বলে উঠলেন ডাক্তারের স্ত্রী। আকারে তিনি তাঁর স্বামীর অর্ধেক, বয়স পঞ্চাশের ঘরে।

‘নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্তে আসার আগে সম্ভাব্য সব দিক খতিয়ে দেখতে হবে আমাদেরকে,’ বলল হোথর্ন, তাকাল ডক্টর বাটিমোরের দিকে। ‘জানতে পেরেছি, মিসেস ক্যুপারের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন আপনি। তাঁর সঙ্গে শেষ কবে দেখা হয়েছিল আপনার, সেটা যদি বলতে পারেন, ভালো হয়।’

‘সপ্তাহ তিনেক আগে। ক্যাভেনডিশ স্কোয়ারে আমার ডাক্তারখানা আছে, সেখানে এসেছিলেন তিনি। সত্যি বলতে কী, আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন তিনি বেশ কয়েকবার।’

‘ইদানীং?’

‘গত কয়েক মাসে। ঘুমাতে সমস্যা হচ্ছিল তাঁর। নির্দিষ্ট বয়সের মহিলাদের বেলায় সমস্যাটা খুব সাধারণ। আর… বিভিন্ন রকম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাতেও ভুগছিলেন।’ ডানে-বাঁয়ে তাকালেন তিনি, সবার সামনে গোপন কথা বলে দিচ্ছেন ভেবে নার্ভাস হয়ে পড়েছেন কিছুটা। কণ্ঠ নিচু করলেন। ‘আসলে… ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল তাঁর। ‘

‘কেন?’ জানতে চাইল হোথৰ্ন।

‘মিস্টার হোথর্ন, আমি আপনার সঙ্গে শুধু মিসেস-ক্যুপারের-ডাক্তার হিসেবেই না, তাঁর বন্ধু হিসেবেও কথা বলছি। …সত্যি কথাটা হচ্ছে, তাঁর ছেলে যেভাবে জীবনযাপন শুরু করেছিল লস অ্যাঞ্জেলসে, সেটা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। প্রথম কথা, তিনি মোটেও চাননি ও-রকম কোনো জায়গায় গিয়ে থাকুক তাঁর ছেলে। পত্রপত্রিকায় তারকাদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গুজব প্রকাশিত হয় প্রায়ই; সে-রকম খবর পড়েছিলেন তিনি, আর সেগুলোতে বলা হয়েছিল, ড্রাগস এবং বিভিন্ন ধরনের পার্টির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে তাঁর ছেলে। অথচ বিন্দুমাত্র কোনো সত্যতা ছিল না ওসব খবরের। যারা নাম কামিয়ে ফেলেছে, তাদের ব্যাপারে বানিয়ে বানিয়ে যা-তা লেখাটা পত্রিকাওয়ালাদের একটা বদভ্যাস। কথাটা বলেছিলাম আমি মিসেস ক্যুপারকে। কিন্তু তিনি তখন বিশ্বাস করে বসে আছেন ওসব খবর, দুশ্চিন্তায় ভুগছেন; তাই তাঁকে ঘুমের ওষুধ প্রেসক্রাইব করি। শুরু করতে বলেছিলাম ‘অ্যাটিভ্যান’ দিয়ে, তাতে যদি কাজ না-হয় তা হলে খেতে বলেছিলাম ‘টেমাযেপাম’।’

মিসেস ক্যুপারের বাথরুমে পাওয়া ওষুধগুলোর কথা মনে পড়ে গেল আমার।

‘আমার প্রেসক্রিপশন কাজে লেগে গিয়েছিল,’ বলছেন বাটিমোর। ‘এপ্রিলের শেষের দিকে শেষবার দেখা হলো মিসেস ক্যুপারের সঙ্গে। তখন তাঁকে আরেকটা প্রেসক্রিপশন দিলাম…

‘তিনি ঘুমের ওষুধের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়তে পারেন ভেবে খারাপ লাগেনি আপনার?’

করুণার হাসি দেখা দিল ডক্টর বাটিমোরের চেহারায়। ‘মিস্টার হোথর্ন, কিছু মনে করবেন না, ওষুধের ব্যাপারে আপনি আসলে কিছু জানেন কি না জানি না… টেমাযেপামের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা আসলে খুবই কম। আর সে- কারণেই বিশেষ ওই ওষুধ খেতে দিই আমার-রোগীদেরকে। একটা মাত্র সমস্যা হতে পারে ওষুধটা খেলে… শর্ট টার্ম মেমোরি লস… কিন্তু যতদূর জানতে পেরেছি, যেদিন মারা গেছেন মিসেস ক্যুপার, সেদিনও তাঁর স্বাস্থ্য যথেষ্ট ভালো ছিল।’

‘কোনো ফিউনারেল পার্লারে যাওয়ার ব্যাপারে আপনার সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন তিনি?’

‘সরি?’

‘একটা ফিউনারেল পার্লারে গিয়েছিলেন তিনি। যেদিন মারা গেছেন, সেদিনই ব্যবস্থা করে গেছেন নিজের শেষকৃত্যের।’

চোখ পিটপিট করছেন ডক্টর বাটিমোর। ‘আমি… কী বলবো… হতভম্ব। কেন ওই কাজ করতে গেলেন তিনি, কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে আপনাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ওই সমস্যার কথা বাদ দিয়ে বললে, এটা ভাববার কোনো কারণই ছিল না মিসেস ক্যুপারের যে, তাঁর সময় শেষ। কাজেই যতদূর মনে হয়, যেদিন ওই ফিউনারেল পার্লারে গেছেন তিনি সেদিনই তাঁর খুন হওয়ার ব্যাপারটা কাকতালীয় ছাড়া আর কিছু না।’

‘আগেও বলেছি, আবারও বলছি, ভয়ঙ্কর কোনো এক চোর ঢুকে পড়েছিল মিসেস ক্যুপারের বাড়িতে,’ বললেন ডক্টর বাটিমোরের স্ত্রী।

‘ঠিক তা-ই, প্রিয়তমা। মিসেস ক্যুপারের জানার কথা না, খুন করা হবে তাঁকে। কাজেই পুরো ব্যাপারটা কাকতালীয় ছাড়া আর কিছু না।’

মাথা ঝাঁকাল হোথর্ন।

আমরা দু’জন সরে এলাম কিছুটা দূরে।

আমাদের কথা কেউ শুনতে পাবে না টের পেয়ে বিড়বিড় করে জঘন্য একটা গালি দিল হোথর্ন।

‘কেন গালি দিলেন?’ জানতে চাইলাম আমি।

‘কারণ ডক্টর বাটিমোর এতক্ষণ যা বলেছেন, সে-ব্যাপারে কোনো ধারণাই নেই তাঁর।’

থতমত খেয়ে গেলাম।

‘তিনি যা-যা বলেছেন, শুনেছেন আপনি। সেসব কথা অর্থহীন মনে হয়েছে আমার কাছে।’

‘কিন্তু… আমার তো সে-রকম মনে হয়নি?’

জবাবে কিছু বলল না হোথর্ন, এগিয়ে গেল চার্লস কেনওয়ার্দি… মানে মিসেস ক্যুপারের উকিলের দিকে। ওর পিছু পিছু গেলাম আমিও।

এখনও আগের কোনাতেই দাঁড়িয়ে আছেন কেনওয়ার্দি, কথা বলছেন এক মহিলার সঙ্গে। ধারণা করলাম, ওই মহিলা তাঁর স্ত্রী। লোকটা বেঁটেখাটো, গোলগাল। মাথায় কোঁকড়া রূপালি চুল। মহিলাও একই গড়নের, তবে স্বামীর চেয়ে বেশি মোটা। কেনওয়ার্দি পোর্সেকো খাচ্ছেন। আর তাঁর স্ত্রীর হাতে ফলের জুসের গ্লাস।

কেমন আছেন আপনি?’ হোথর্নের সম্ভাষণের জবাবে বললেন উকিল সাহেব। ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমিই কেনওয়ার্দি। আর এ হচ্ছে ফ্রিডা।’

হোথর্ন কী জানতে চায়, তা শোনার পর শুরু হলো তাঁর বকবকানি। তিনি ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে চেনেন মিসেস ক্যুপারকে। লরেন্স ক্যুপারের সঙ্গে এককালে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল তাঁর। অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারে ভুগে মারা গেছেন বেচারা। খুব দুঃখজনক ছিল ব্যাপারটা। কারণ ভালো একজন মানুষ ছিলেন লরেন্স। প্ৰথম শ্রেণীর ডেন্টিস্ট ছিলেন একজন। কেন্টের ফেভারশ্যামে থাকতেন। যা-হোক, ভয়ঙ্কর সেই দুর্ঘটনা যখন ঘটল, তখন বাড়িটা বিক্রি করে দিতে ডায়ানাকে সাহায্য করেছিলেন কেনওয়ার্দি। তারপর ডায়ানা চলে আসেন লন্ডনে।

হোথর্ন বলল, ‘সেই দুর্ঘটনার পরে যখন কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল মিসেস ক্যুপারকে, তখন কি তাঁকে আইনি শলাপরামর্শও দিয়েছিলেন?’

‘অবশ্যই। সত্যি বলতে কী, মিসেস ক্যুপারের বিরুদ্ধে আসলে কোনো কেসই ছিল না। বিচারক যা-রায় দিয়েছিলেন, সেটা একদম ঠিক ছিল।’

‘সেই বিচারকের সঙ্গে কি পূর্বপরিচয় ছিল আপনার?’

‘কে, ওয়েস্টন? পূর্বপরিচয় মানে একবার কি দু’বার দেখাসাক্ষাৎ হয়েছিল আমাদের মধ্যে। লোকটা ভালো মনের মানুষ। যা-হোক, ওই সময়ে আমি ডায়ানাকে বলেছিলাম, চিন্তার কিছু নেই… পত্রপত্রিকায় যে-খবরই বের হোক না কেন, বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। তারপরও সময়টা খুব খারাপ গেছে বেচারীর। খুবই আপসেট হয়ে পড়েছিলেন তিনি।’

‘তাঁর সঙ্গে শেষ কবে দেখা হয়েছিল আপনার?’

‘গত সপ্তাহে… যেদিন তিনি মারা গেছেন সেদিন। বোর্ড মিটিং ছিল আমাদের। আমরা দু’জনই ছিলাম গ্লোব থিয়েটারের বোর্ডে। জানেন কি না জানি না… ওই থিয়েটার কিন্তু একটা শিক্ষামূলক দাঁতব্য প্রতিষ্ঠান। কাজকর্ম চালিয়ে নেয়ার জন্য লোকজনের দান-খয়রাতের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করতে হয় আমাদেরকে

‘আপনারা সাধারণত কোন্ ধরনের নাটক করেন?’

‘মূলত শেক্সপিয়ার।’

আশ্চর্য লাগছে আমার। হোথর্নের মতো একজন মানুষ কিনা জানতে চাইছে গ্লোব থিয়েটারের ব্যাপারে! ওই থিয়েটারের ব্যাপারে আসলেই কিছু জানে না, নাকি না-জানার ভান করছে… নিশ্চিত হতে পারলাম না। আজ থেকে চার শত বছর আগে থেমস নদীর দক্ষিণ তীরে গড়ে উঠেছিল ওই থিয়েটার, পরে পুনঃনির্মিত হয়েছে। রানি এলিযাবেথের আমলের নাটকগুলোর নির্ভরযোগ্য মঞ্চ- উপস্থাপনার জন্য থিয়েটারটাকে বিশেশায়িত বলা চলে। যা-হোক, হোথর্নের মধ্যে এখন পর্যন্ত এমন কিছু দেখতে পাইনি যার ফলে মনে হতে পারে, নাটক, সাহিত্য, সঙ্গীত বা আর্টের প্রতি আগ্রহ আছে ওর। আবার, একইসঙ্গে, অনেক কিছুর ব্যাপারে অনেক কিছু জানে সে। কাজেই, হতে পারে, উকিল সাহেবকে বাজিয়ে দেখতে চাইছে আসলে।

বলল, ‘শুনলাম, সেদিনের বোর্ড মিটিঙে আপনাদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছিল?’

‘না তো! কথাটা কে বলেছে আপনাকে?’

জবাব দিল না হোথর্ন। ব্রম্পটন সেমেট্রি’র ব্যাপারে জানার জন্য ডায়ানা ক্যুপারকে ফোন করেছিল রবার্ট কর্নওয়ালিস, তখন ফোনের ও-প্রান্ত থেকে বাকবিতণ্ডার আওয়াজ শুনতে পাওয়া গেছে। কথাটা কর্নওয়ালিস নিজে বলেছে আমাদেরকে।

‘বোর্ড থেকে পদত্যাগ করেছিলেন মিসেস ক্যুপার,’ বলল হোথর্ন।

‘হ্যাঁ। তবে সেটা বিশেষ কোনো মতানৈক্যের কারণে না।’

‘তা হলে কেন করেছিলেন কাজটা?’

কোনো ধারণা নেই আমার। তিনি শুধু বলেছিলেন, পদত্যাগের ব্যাপারটা নিয়ে কিছু দিন ধরে ভাবছিলেন। তাঁর সেই ঘোষণা শুনে আমরা সবাই আশ্চর্য হয়ে যাই। কারণ একনিষ্ঠ সমর্থক বলতে যা বোঝায়, আমাদের থিয়েটারের জন্য তিনি ছিলেন ঠিক সে-রকম। বিভিন্ন সময়ে চাঁদা তুলবার ব্যাপারেও চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করতেন। শুধু তা-ই না, শিক্ষামূলক যেসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো, সেগুলোতেও অগ্রণী ভূমিকা ছিল তাঁর।’

‘কোনো কিছু নিয়ে নাখোশ ছিলেন তিনি?’

‘না… মোটেও না। ছ’বছর ধরে থিয়েটারের বোর্ডে ছিলেন। হয়তো ভেবেছিলেন, যথেষ্ট হয়েছে… আর না।’

অস্বস্তি দেখা দিয়েছে উকিল সাহেবের স্ত্রীর চেহারায়। ‘চার্লস, আমার মনে হয় আমাদের যাওয়া উচিত।’

‘ঠিক আছে, প্রিয়তমা।’ হোথর্নের দিকে তাকালেন কেনওয়ার্দি। ‘ওই বোর্ডের ব্যাপারে আপনাকে আর বিশেষ কিছু বলার নেই আমার। ব্যাপারটা গোপনীয়।

‘মিসেস ক্যুপারের উইলের ব্যাপারে কিছু বলতে পারবেন?’

‘হ্যাঁ। আমার ধারণা, আজ বাদে কাল এমনিতেও জানাজানি হয়ে যাবে ব্যাপারটা। সহজ হিসাব… নিজের সব কিছু ড্যামিয়েনকে দিয়ে গেছেন মিসেস ক্যুপার। তবে বিস্তারিত কিছু বলাটা এই মুহূর্তে সম্ভব না আমার পক্ষে। যা-হোক, আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে এবং কথা বলে ভালো লাগল, মিস্টার হোথৰ্ন। হাতেধরা গ্লাসটা নামিয়ে রাখলেন কেনওয়ার্দি। পকেট হাতড়ে বের করলেন গাড়ির চাবি, সেটা দিলেন স্ত্রীর হাতে। ‘চলো তা হলে, প্রিয়তমা। তুমিই যদি গাড়ি চালাও, ভালো হয়।

‘ঠিক আছে।’

‘চাবি… বিড়বিড় করে নিজের সঙ্গেই কথা বলছে হোথর্ন। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চার্লস আর ফ্রিডা কেনওয়ার্দির দিকে, দেখছে হেঁটে বেরিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু ওই দু’জনের প্রতি কোনো আগ্রহই নেই ওর। অন্য কোনো চিন্তায় হারিয়ে গেছে। গাড়ির চাবিটা এখনও ফ্রিডার হাতে। দেখতে পেলাম, দরজা দিয়ে যখন বেরিয়ে গেলেন তিনি, তখনও চাবিটা হাতে ধরে রেখেছেন।

বুঝতে পারলাম, ওই চাবি এমন কিছু একটা মনে করিয়ে দিয়েছে হোথৰ্নকে, যা মিস করেছিল আগে।

এবং তারপর… হঠাৎ করেই… নড়ে উঠল সে; যেন অদৃশ্য কেউ একজন সজোরে ধাক্কা দিয়েছে ওকে। এমনিতে পাণ্ডুরই বলা চলে ওর চেহারাটা, কাজেই যদি বলি রক্ত সরে গেল ওর চেহারা থেকে, তা হলে সেটা যথোপযুক্ত হবে না; বরং বলা উচিত, ভয়ানক কোনো উপলব্ধি হঠাৎ করেই যেন দেখা দিল ওর চেহারায়। সে যেন বুঝতে পেরেছে, কিছু একটা গড়বড় হয়ে গেছে কোথাও।

‘চলুন,’ বলল আমাকে।

‘কোথায়?’

‘ব্যাখ্যা করার সময় নেই। তাড়াতাড়ি আসুন।’

ইতোমধ্যেই হাঁটতে শুরু করে দিয়েছে সে। ওর সামনে হাজির হয়েছিল এক ওয়েইটার, ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল লোকটাকে। সোজা এগিয়ে যাচ্ছে দরজার দিকে।

দরজাটার কাছে দাঁড়িয়ে তখন পরিচিত কাউকে বিদায় জানাচ্ছিলেন কেনওয়ার্দি দম্পতি, তাঁদেরকে পাশ কাটিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম আমরা হুড়মুড় করে। হাজির হলাম এককোনায়, সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল হোথর্ন। রাগে ফুঁসছে।

‘সারা রাস্তায় কোনো ট্যাক্সি নেই কেন?’

ঠিকই বলেছে সে। অনেক যানবাহন চলাচল করছে রাস্তায়, কিন্তু একটা ট্যাক্সিও নজরে পড়ছে না।

কিছুক্ষণ পরই আমাদের উল্টোদিকে, রাস্তার আরেক ধারে একটা ট্যাক্সি থামল। ওটা থামিয়েছে এক মহিলা… তার দু’হাতে কয়েকটা শপিং ব্যাগ।

ট্যাক্সিচালকের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য চিৎকার করে উঠল হোথর্ন। ছুট লাগিয়েছে, কোন্ গাড়ি কোন্‌দিক দিয়ে আসছে সে-ব্যাপারে যেন কোনো পরোয়াই নেই… সে যেন অন্ধ। ওর চেয়ে একটু সতর্ক হয়ে রাস্তাটা পার হওয়ার চেষ্টা করলাম আমি… মনে পড়ে যাচ্ছে কবরস্থানটা খুব বেশি দূরে না এখান থেকে। শুনতে পেলাম রাস্তার সঙ্গে গাড়ির চাকার জোরালো ঘর্ষণের আওয়াজ… হঠাৎ ব্রেক চেপেছে কোনো ড্রাইভার; কেউ আবার সমানে বাজাচ্ছে হর্ন। কিন্তু যেভাবেই হোক শেষপর্যন্ত পৌঁছে গেলাম রাস্তার অপরপ্রান্তে।

হোথর্ন ইতোমধ্যেই জায়গা করে নিয়েছে ওই মহিলা আর ট্যাক্সিচালকের মাঝঝানে। মিটার চালু করে দিয়েছে লোকটা, নিভিয়ে দিয়েছে হলুদ বাতিটা।

‘এক্সকিউয মি,’ বলে উঠল মহিলাটা, তার কণ্ঠে একইসঙ্গে ঘৃণা আর ক্রোধ। ‘পুলিশ,’ মুখ ঝামটা মারল হোথর্ন, ‘ব্যাপারটা জরুরি।’

ওর আইডি কার্ড দেখতে চাইল না ওই মহিলা।

ট্যাক্সির ভিতরে ঢুকে বসেছি আমরা, এমন সময় ড্রাইভার জানতে চাইল, ‘কোথায় যেতে চান আপনারা?’

‘ব্রিক লেন,’ বলল হোথর্ন।

তার মানে ড্যামিয়েন ক্যুপারের বাসা।

সেদিনের সেই ট্যাক্সিযাত্রার কথা কখনও ভুলতে পারবো না আমি। ঘড়িতে তখন বারোটা বেজে কয়েক মিনিট, রাস্তায় যানজট তেমন বেশি না। তারপরও যখন দাঁড়িয়ে পড়ছে আমাদের ট্যাক্সি, অথবা যখনই লাল বাতি জ্বলে উঠছে সিগনালে, তখনই দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেন অত্যাচার চালাচ্ছে হোথর্নের উপর। আমার পাশেই বসে আছে সে, কেমন কুঁজো হয়ে গেছে পিঠটা। একটু পর পর মোচড়ামোচড়ি করছে।

হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে আমার মনে ভিতরে… সেসব জিজ্ঞেস করতে চাইছি হোথৰ্নকে। গাড়ির চাবি দেখে এমন কী কথা মনে পড়ে গেল ওর? ওই চাবি ড্যামিয়েন ক্যুপারের কথা মনে করিয়ে দিল কেন ওকে? নাকি কোনো বিপদে পড়েছে ড্যামিয়েন ক্যুপার?

মনে যত প্রশ্নই থাকুক, চুপ করে আছি। হোথর্নের মেজাজ কেমন সেটা ভালোমতোই জানা আছে আমার, কাজেই আমার উপর ওকে চটিয়ে দেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। তা ছাড়া… জানি না কেন… আমার মনের ভিতরে কেউ একজন যেন ফিসফিস করে বলছে, যা ঘটছে, আমারই কোনো ভুলের কারণে ঘটছে।

ফুলহ্যাম থেকে ব্রিক লেনের রাস্তাটা বেশ লম্বা। পশ্চিমদিক থেকে পুবদিক পর্যন্ত সারা লন্ডন পাড়ি দিয়ে সেখানে পৌঁছাতে হলো আমাদেরকে। আমরা যদি টিউব ট্রেনে করে আসতাম, তা হলে আমার ধারণা আরও তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে পারতাম। কয়েকটা স্টেশন পার হতে হলো আমাদেরকে… দক্ষিণ কেনসিংটন, নাইটসব্রিজ, হাইড পার্ক কর্নার… প্রতিবারই খেয়াল করলাম, মনে মনে কী যেন হিসেব করছে হোথর্ন। আমাদের সামনে গাড়িঘোড়ার সংখ্যা কত, সেটাই ভাবছে বোধহয়।

যা-হোক, শেষপর্যন্ত পৌঁছে গেলাম আমরা ড্যামিয়েন ক্যুপারের ফ্ল্যাটের কাছে। একলাফে ট্যাক্সি থেকে বেরিয়ে গেল হোথর্ন, ভাড়া দেয়ার দায়িত্ব ছেড়ে দিল আমার উপর। ৫০ পাউন্ডের একটা নোট ধরিয়ে দিলাম আমি ড্রাইভারের হাতে, ভাংতির জন্য অপেক্ষা করলাম না।

একধারের দুটো দোকানের মাঝখান দিয়ে সরু একটা সিঁড়ি উঠে গেছে উপরের দিকে, সেদিকে ছুট লাগিয়েছে হোথর্ন, আমিও ছুটলাম ওর পিছু পিছু। দ্বিতীয় তলার প্রবেশপথের কাছে হাজির হতে বেশি সময় লাগল না।

আশ্চর্য, দরজাটা আধখোলা।

ভিতরে ঢুকে পড়লাম আমরা।

প্রথমেই আমার নাকে বাড়ি মারল রক্তের গন্ধ। হত্যাকাণ্ডের উপর কম করে হলেও ডজনখানেক বই লিখেছি আমি, টেলিভিশনের জন্য নাটকও লিখেছি কিছু। কিন্তু বাস্তবজীবনে যে এ-রকম কোনো ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে, কল্পনাও করিনি কখনও।

ক্ষতবিক্ষত করে ফেলা হয়েছে ড্যামিয়েন ক্যুপারকে। রক্তের ছোটখাটো একটা পুকুরের পাশে পড়ে আছে সে। ওর শরীর থেকে বেরিয়ে সে-রক্ত ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে; ঢুকে যাচ্ছে ফ্লোরবোর্ডের ভিতরে। এমনভাবে পড়ে আছে, দেখে মনে হচ্ছে, কিছু একটা ধরার জন্য বাড়িয়ে দিয়েছে একটা হাত। সে-হাতের দুটো আঙুল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে প্রায়। আমার ধারণা, যে-ছুরি দিয়ে কমপক্ষে ছ’বার আঘাত করা হয়েছে ওকে, সেটার কবল থেকে বাঁচতে গিয়ে ওই অবস্থা হয়েছে আঙুল দুটোর। ছুরিটা শেষপর্যন্ত ঠাঁই নিয়েছে ওর বুকে… অনেকখানি ঢুকে আছে বুকের গভীরে ছুরির একটা ঘা ওর চেহারাতেও লেগেছে, এবং এই আঘাতটাই বেশি ভয়ঙ্কর লাগছে আমার কাছে। কারণ কেউ যদি একটা হাত অথবা একটা পা হারিয়ে ফেলে, তা হলেও তার পরিচয়টা রয়ে যায়। কিন্তু যদি কারও চেহারা নষ্ট হয়ে যায়, তা হলে তার পরিচয়টাও নষ্ট হয়ে যায়।

ছুরি দিয়ে ড্যামিয়েনের চেহারায় যে-আঘাত করা হয়েছে, তার ফলে উপড়ে গেছে ওর একটা চোখ, সেদিকের চামড়া অনেকখানি কেটে গিয়ে ঝুলে আছে মুখের উপর। আরও যেসব আঘাত করা হয়েছে ওকে, সেগুলো হয়তো ওর কাপড়ের কারণে বোঝা যাচ্ছে না, তবে এটা বোঝা যাচ্ছে, যে-ই করে থাকুক খুনটা, পাগলের মতো ছুরি চালিয়েছে সে ড্যামিয়েনের উপর। মাথাটা একদিকে কাত হয়ে আছে ওর, ফলে একদিকের গাল লেগে আছে মেঝের সঙ্গে; এই অবস্থায় ওর মাথাটা দেখে মনে পড়ে যাচ্ছে বাতাস বেরিয়ে-যাওয়া কোনো চুপসানো ফুটবলের কথা। জীবিত অবস্থায় যে-রকম ছিল, খুন হওয়ার পর মোটেও সে-রকম দেখাচ্ছে না ওকে। ওর কাপড় আর কালো চুল দেখে ওকে চিনে নিতে হচ্ছে আমার।

রক্তের গন্ধে কেমন যেন ভরাট হয়ে গেছে আমার নাক। মনে হচ্ছে, এমন কোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে এইমাত্র গভীর করে কোনো গর্ত খোঁড়া হয়েছে, ফলে মাটির গন্ধ পাচ্ছি। রক্তের গন্ধ যে ও-রকম, আগে কখনও জানা ছিল না। কিন্তু বিচ্ছিরি এই গন্ধ যেন বড় বেশি পেয়ে বসছে আমাকে। ফ্ল্যাটের ভিতরটা গরম, জানালাগুলো বন্ধ, দেয়ালগুলো কেমন যেন বেঁকে আসছে আমার দিকে…

‘টনি? কী হয়েছে? যিশুর দোহাই লাগে…

জানি না কেন, কিন্তু যে-কোনো কারণেই হোক ছাদের দিকে তাকিয়ে আছি আমি। আমার মাথার পেছনদিকটা কেমন যেন ব্যথা করছে। আমার উপর ঝুঁকে আছে হোথর্ন। কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুললাম, কিন্তু থেমে গেলাম। না, জ্ঞান হারাতে পারি না আমি। সেটা অসম্ভব। যা ঘটছে আমার সঙ্গে, তা পাগলামি হয়ে যাচ্ছে। বিব্রতকর একটা অবস্থায় পড়তে যাচ্ছি।

শেষপর্যন্ত জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।

১৩. নরা মানুষের জুতো

‘টনি? আপনি ঠিক আছেন?’

আমার উপর ঝুঁকে আছে হোথর্ন, আমার দৃষ্টিপথের পুরোটা জুড়ে দিয়েছে। তবে তেমন একটা উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে না ওকে। বরং, মনে হচ্ছে, হতবুদ্ধি হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, বীভৎস, ক্ষতবিক্ষত, এবং এখনও-রক্ত-পড়ছে এ-রকম কোনো লাশ দেখে জ্ঞান হারানোটা যেন অদ্ভুত কোনো ব্যাপার ওর কাছে।

সে জিজ্ঞেস করেছে, আমি ঠিক আছি কি না। না, ঠিক নেই আমি। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছি ড্যামিয়েন ক্যুপারের ফ্ল্যাটের মেঝেতে, মাথায় ব্যথা পেয়েছি। রক্তের গন্ধে এখনও যেন বন্ধ হয়ে আছে আমার নাক। সেই রক্তের উপরই পড়ে গেছি কি না, ভেবে কেমন যেন আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। না-দেখেও টের পেলাম চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে আমার। নিজের আশপাশের খানিকটা জায়গা হাতড়ালাম। না, আমার আশপাশ শুকনোই আছে।

‘আমাকে উঠতে বসতে সাহায্য করতে পারেন?’ বললাম হোথৰ্নকে।

‘অবশ্যই।’ দ্বিধা করল সে, কিন্তু তারপর আমার হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিল আমাকে।

আশ্চর্য, দ্বিধা করল কেন সে? হঠাৎ করেই প্রশ্নটা জাগল আমার মনে… নতুন কোনো উপলব্ধি হলো যেন। এই কেসের তদন্তের সময় এবং আমার রিসার্চের কাজে আমাকে যে-ক’দিন সাহায্য করেছে সে, আমাদের মধ্যে শারীরিক সংস্পর্শ বলতে গেলে ঘটেনি। একবারও আমার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে কি না, সন্দেহ। কারও সঙ্গেই হাত মেলাতে, অথবা অন্য কোনো রকম শারীরিক সংস্পর্শে যেতে দেখিনি আমি ওকে। তা হলে সে কি একজন জার্মোফোব… মানে, জীবাণুভীতি আছে ওর? নাকি পুরোপুরি অসামাজিক কেউ? যেটাই হোক, সমাধান করার জন্য নতুন আরেকটা রহস্য জুটল আমার কপালে।

একধারে কয়েকটা লেদার আর্মচেয়ার আছে, একটাতে বসে পড়লাম। ড্যামিয়েন ক্যুপারের লাশ আর রক্ত থেকে দূরে সরে এসেছি।

‘পানি খাবেন?’ জিজ্ঞেস করল হোথর্ন।

‘না। আমি ঠিক আছি।’

‘বমি-টমি করে দেবেন না তো? এই জায়গা এখন একটা ক্রাইম এরিয়া, এটা রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব।’

‘না, বমি করবো না।’

মাথা ঝাঁকাল হোথর্ন। ‘কারও লাশ দেখাটা চমৎকার কোনো কাজ না। আর… দেখেই বোঝা যাচ্ছে, খুনি তার ঝাল ঝেড়েছে ড্যামিয়েন ক্যুপারের উপর।’ মাথা নাড়ল। ‘লাশ ক্ষতবিক্ষত করে ফেলার ঘটনা আগেও দেখেছি। এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে লাশের চোখও উপড়ে ফেলা হয়েছিল…

‘ধন্যবাদ!’ টের পেলাম, বিবমিষা জেগে উঠছে আমার ভিতরে। লম্বা করে দম নিলাম।

‘কেউ একজন প্রচণ্ড ঘৃণা করত ড্যামিয়েন ক্যুপারকে।’

‘বুঝতে পারছি না ব্যাপারটা,’ বললাম আমি। শেষকৃত্যানুষ্ঠানের পর গ্রেস কী বলেছে, মনে পড়ে গেল। ‘পূর্বপরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে ড্যামিয়েন ক্যুপারকে, ঠিক না? কেউ একজন ওই মিউযিক প্লেয়ারটা রেখে দিয়েছিল কফিনের ভিতরে। কারণ সে জানত, বিশেষ ওই সুর পেয়ে বসবে ড্যামিয়েনকে। জানত, ওই সুর শুনে আপসেট হয়ে পড়বে ড্যামিয়েন, আলাদা হয়ে পড়বে সবার কাছ থেকে। আর সে-সুযোগই নিতে চেয়েছিল লোকটা… নাগালের মধ্যে একা পেতে চেয়েছিল ড্যামিয়েনকে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ড্যামিয়েনকে কেন? পুরো ব্যাপারটা যদি ডিলের সেই দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত হয়, তা হলে ড্যামিয়েনকে কোনোভাবেই দায়ী করা যায় না। যখন ঘটেছিল ঘটনাটা, তখন গাড়ির ভিতরে ছিল না সে।’

‘হুঁ, ভালো বলেছেন।

ব্যাপারটা ভেবে দেখার চেষ্টা করলাম। বেপরোয়া গাড়ি চালাচ্ছেন একজন মহিলা। তাঁর সেই গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মারা গেল একটা বাচ্চা। দশ বছর পর শাস্তি দেয়া হলো মহিলাকে। কিন্তু সে-শাস্তি কেন তাঁর ছেলেকেও দেয়া হবে? বাইবেলে যেমনটা বলা হয়েছে… চোখের বদলে চোখ… সে-রকম কিছুই কি ঘটছে? কিন্তু কেন যেন পুরো ব্যাপারটার কোনো মানেই দাঁড় করাতে পারছি না। ডায়ানা ক্যুপার ইতোমধ্যেই মারা গেছেন। ড্যামিয়েন ক্যুপারকে খুন করার মাধ্যমে ডায়ানা ক্যুপারের মনে কষ্ট দেয়ার ইচ্ছা যদি থাকে কারও, তা হলে তার উচিত ছিল আগে ড্যামিয়েনকে খুন করা।

আপনমনে বললাম, ‘বিশেষ ওই দুর্ঘটনার পর মিসেস ক্যুপার প্রথমেই পুলিশের কাছে যাননি, কারণ তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিল ড্যামিয়েন।’

কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল হোথর্ন, তবে আমি যা বলেছি সে-ব্যাপারে কিছু না। বরং বলল, ‘আপনাকে এখানে কিছুক্ষণের জন্য একা রেখে যেতে হবে আমাকে। ইতোমধ্যে নাইন নাইন নাইনে ফোন করেছি আমি। ফ্ল্যাটটা চেক করে দেখা দরকার।’

‘যান, চেক করুন।

ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে, সর্পিলাকার সেই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে।

আর্মচেয়ারে বসে আছি আমি, ভুলেও তাকানোর চেষ্টা করছি না ড্যামিয়েনের লাশের দিকে। ভয়াবহ যেসব ক্ষত তৈরি হয়েছে ওর শরীরে, সেগুলোর ব্যাপারে ভাবছি না। কাজটা মোটেও সহজ না। কারণ যখনই চোখ বন্ধ করে ফেলছি, রক্তের সেই গন্ধ যেন বাড়ি মারছে আমার নাকে। চোখ খুললেই দেখতে পাচ্ছি রক্তের সেই পুকুর, অথবা হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে-থাকা ড্যামিয়েনকে। শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে নিলাম, তাকালাম আরেকদিকে… আসলে আমার দৃষ্টিপথ থেকে বিদায় করে দিতে চাইছি ড্যামিয়েন ক্যুপারকে।

ঠিক তখনই গুঙিয়ে উঠল সে।

চমকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম আবার, ধরেই নিয়েছি যা শুনেছি তা আমার কল্পনা ছাড়া আর কিছু না। কিন্তু আবারও শুনতে পেলাম শব্দটা… কেমন বিভীষিকাময়। এখনও মেঝের সঙ্গে লেগে আছে ড্যামিয়েনের মাথা, আমার উল্টোদিকে তাকিয়ে আছে সে, কিন্তু আমি নিশ্চিত আওয়াজটা সে-ই করেছে।

‘হোথর্ন!’ চিৎকার করে উঠলাম। একইসঙ্গে টের পাচ্ছি, পিত্তরস উঠে আসছে আমার গলার কাছে। ‘হোথৰ্ন!’

সিঁড়িতে ধুপধাপ আওয়াজ হচ্ছে। হুড়মুড় করে উঠে আসছে হোথর্ন। ‘কী হয়েছে?’

‘ড্যামিয়েন!’ আবারও চেঁচালাম আমি। ‘বেঁচে আছে সে!’

ঘরের ভিতরে হাজির হলো হোথর্ন, সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এগিয়ে গেল লাশটার দিকে। ‘না, বেঁচে নেই।’

‘এই মাত্র তার গলার আওয়াজ শুনলাম।

আবারও গুঙিয়ে উঠল ড্যামিয়েন, এবার আগের চেয়েও জোরে। এবং ব্যাপারটা মোটেও আমার কল্পনা না। কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে লোকটা।

কিন্তু নাক সিঁটকানো ছাড়া আর কিছু করল না হোথর্ন। ‘যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন, টনি। এসব ভুলে যান, ঠিক আছে? মাংসপেশী শক্ত হয়ে আসছে ড্যামিয়েনের, এবং সেসব মাংসপেশীর মধ্যে লোকটার ভোকাল কর্ডের আশপাশের পেশীও আছে। শুধু তা-ই না, লোকটার পেটের ভিতরে কিছু গ্যাস আছে, সেগুলোও বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আর ওই শব্দও শুনতে পেয়েছেন আপনি। এ-রকম ঘটনা সব সময়ই ঘটে।’

‘ওহ্,’ কেন মরতে থাকতে গেলাম এখানে, ভেবে আফসোস লাগছে আমার। কেন এই জঘন্য বই লিখতে রাজি হলাম, সেটা ভেবেও আফসোস হলো।

একটা সিগারেট ধরাল হোথর্ন।

‘উপরতলায় কিছু খুঁজে পেয়েছেন?’ জানতে চাইলাম আমি।

‘অন্য কেউ নেই এখানে,’ বলল হোথর্ন।

‘আপনি জানতেন খুন করা হবে ড্যামিয়েনকে।’

‘জানতাম বললে ভুল হবে। বলা ভালো, আমি জানতাম, তার খুন হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

‘কীভাবে জানতে পারলেন?’

নিজের একহাতের তালুতে সিগারেটের ছাই ঝাড়ল হোথর্ন। বুঝতে পারছি, আমার প্রশ্নটার জবাব দেয়ার তেমন ইচ্ছা নেই ওর। বলল, ‘গাধামি করে ফেলেছি। তবে… আমরা দু’জন যখন প্রথমবার এলাম এখানে, আমার মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে দিয়েছিলেন আপনি।’

‘তার মানে ভুলটা আমার?

‘আপনাকে বলেছিলাম, আমি যখন কারও সঙ্গে কথা বলবো, তখন মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা দরকার আমার। আপনি যদি তখন ব্যাঘাত ঘটান, তা হলে যা ভাবছি আমি তা নষ্ট হয়ে যায়… আমার চিন্তার ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে যায়।’ একটু নরম হলো হোথর্নের কণ্ঠ। ‘তবে… দোষটা আমার। আমিই মিস করেছি ব্যাপারটা।’

‘কী মিস করেছেন?’

‘ড্যামিয়েন বলেছিল, তার মা নাকি এখানে এসেছিলেন, টেরেসের গাছগুলোতে পানি দিয়েছিলেন। বলেছিল, তার মা এমনকী তার মেইলও ফরওয়ার্ড করেছিলেন। কথাটা মনে রাখা উচিত ছিল আমার। আচ্ছা, আপনার কি মনে আছে, আমরা দু’জন যখন ডায়ানা ক্যুপারের বাসায় গিয়েছিলাম, তাঁর রান্নাঘরে পাঁচটা হুক দেখতে পেয়েছিলাম? মনে আছে?’

‘কাঠের একটা মাছের গায়ে লাগানো ছিল ওই হুকগুলো।’

‘ঠিক। এবং চারটা হুকে চার সেট চাবি ছিল।

‘একটা হুক খালি ছিল।’

‘হুঁ। কেউ একজন খুন করেছে মিসেস ক্যুপারকে। তারপর সুযোগ বুঝে বিশেষ এক সেট চাবি হাতিয়ে নিয়েছে ওই মাছের গা থেকে।’ থামল হোথর্ন, এইমাত্র যা বলল সেটা ভেবে দেখছে। ‘ব্যাপারটা কিন্তু একটা সম্ভাবনা হতে পারে।’

সদর-দরজার সঙ্গে যে-সিঁড়ি আছে, সেখান থেকে ভেসে আসছে একাধিক লোকের পায়ের আওয়াজ। ইউনিফর্ম পরিহিত দু’জন পুলিশ অফিসার হাজির হলো। প্রথমে লাশটার দিকে, তারপর আমাদের দিকে তাকাল তারা। বুঝবার চেষ্টা করছে, কী ঘটছে।

‘যেখানে আছেন, সেখানেই থাকুন আপনারা,’ বলল এক অফিসার। ‘আপনাদের মধ্যে কে ফোন করেছিলেন?

‘আমি,’ বলল হোথৰ্ন। ‘আসতে দেরি করে ফেলেছেন আপনারা।‘

‘আপনি কে, স্যর?’

‘প্রাক্তন ডিটেক্টিভ ইন্সপেক্টর হোথর্ন… একসময় এম.আই.টি.-তে ছিলাম। ডিটেক্টিভ ইন্সপেক্টর মিডোসের সঙ্গে ইতোমধ্যে যোগাযোগ করেছি। যা-হোক, বিশ্বাস করার মতো যথেষ্ট কারণ আছে আমার, চলমান একটা হত্যাকাণ্ডের তদন্তের সঙ্গে এই খুনের সম্পর্ক আছে। কাজেই স্থানীয় ডিটেক্টিভ ইন্সপেক্টরকে এবং মার্ডার স্কোয়াডে খবর দেয়াটাই বোধহয় ভালো হবে আপনাদের জন্য।’

দুই পুলিশ অফিসারকে কেমন নিরাশ বলে মনে হচ্ছে আমার। তাদের কারও কাছেই কোনো আগ্নেয়াস্ত্র নেই। কারও পরনে সানগ্লাস নেই। দু’জনই যুবক, চেহারায় স্থিরসংকল্পের ছাপ। একজন এশিয়ান, অন্যজন শ্বেতাঙ্গ। আমাদের সঙ্গে আর তেমন কোনো কথা বলল না তারা কেউ।

রেডিও বের করল একজন, কী ঘটেছে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে লাগল। এই সুযোগে ঘরটা নিজের মতো করে দেখে নিচ্ছে হোথর্ন। ওর দিকে তাকিয়ে আছি আমি।

ঘরের দরজার কাছে হাজির হলো সে, তারপর গেল টেরেসে। দরজার হাতলে যাতে হাত না-পড়ে যায়, সে-ব্যাপারে সতর্ক আছে। পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে সাবধানে ধরল হাতলটা। লক করা ছিল না ওই দরজা। টেরেসে গেল সে, তারপর গায়েব হয়ে গেল আমার দৃষ্টিপথ থেকে।

এখনও খুব খারাপ লাগছে আমার, তারপরও উঠে দাঁড়ালাম চেয়ার ছেড়ে, অনুসরণ করলাম হোথর্নকে। তাকালাম পুলিশের দুই অফিসারের দিকে। ফোন করার কথা ছিল তাদের, সেটা করেছে তারা। দেখে মনে হচ্ছে এখন আর কিছু করার নেই তাদের। অনিশ্চিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে… দেখছে কোথায় যাচ্ছি আমি। আমি কে, সেটাও জিজ্ঞেস করেনি।

টেরেসে, বিকেলের বাতাসে বেরিয়ে আসামাত্র ভালো লাগতে শুরু করল। এখানে কয়েকটা ডেকচেয়ার দেখতে পাচ্ছি। আরও আছে পাত্রে লাগানো বেশ কিছু গাছ। একধারে একটা গ্যাস বারবিকিউ-ও আছে। এসব দেখে স্টুডিয়ো’র কোনো সেটের কথা মনে পড়ে গেল।

একধারে দাঁড়িয়ে আছে হোথর্ন, তাকিয়ে আছে নিচের দিকে। খেয়াল করলাম, জুতো জোড়া খুলে ফেলেছে… খুব সম্ভব কোনো ফুটপ্রিন্ট রাখতে চাইছে না। আবারও ধূমপান করছে। সে এত বেশি সিগারেট খায় যে, আমার মাঝেমধ্যে মনে হয় কাজটা করে আসলে আত্মহত্যা করার জন্য। কম করে হলেও বিশটা সিগারেট খায় দিনে। সংখ্যাটা আরও বেশি হতে পারে। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুরে তাকাল।

‘খুনি এখানে অপেক্ষা করছিল,’ বলল সে। ‘শেষকৃত্যানুষ্ঠান থেকে যতক্ষণে এখানে ফিরে এসেছিল ড্যামিয়েন ক্যুপার, তার আগেই ব্রিটানিয়া রোডের সেই বাসা থেকে হাতিয়ে-নেয়া চাবি কাজে লাগিয়ে এই ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়েছিল খুনি। এবং ড্যামিয়েনকে খুন করে পালিয়ে গেছে এখান দিয়েই।’

‘এক মিনিট। এসব কথা আপনি জানলেন কীভাবে? আর… বার বার বলছেন লোকটা’… একজন পুরুষমানুষই যে খুন করেছে ড্যামিয়েন ক্যুপারকে, নিশ্চিত হলেন কী করে?’

‘পর্দা আটকানোর দড়ি কাজে লাগিয়ে শ্বাসরোধ করা হয়েছিল ডায়ানা ক্যুপারের। আর তাঁর ছেলেকে বলতে গেলে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছে। কাজেই খুনি হয়-কোনো পুরুষমানুষ, নয়তো প্রচণ্ড রাগী কোনো মহিলা।’

‘কিন্তু বাকিটা? খুন কীভাবে হয়েছে সে-ব্যাপারে নিশ্চিত হচ্ছেন কী করে?’

অনিশ্চিত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল হোথর্ন, কিছু বলল না।

‘আপনি যদি চান এই কেস নিয়ে কোনো বই লিখি, তা হলে সব কথা সোজাসাপ্টা বলতে হবে। অন্যথায়, এই কাজ বাদ দিতে হবে আমাকে।’ এ-রকম হুমকি আগেও দিয়েছি আমি, আবারও দিলাম।

‘ঠিক আছে।’ সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিল হোথর্ন। দেখলাম, বাতাসে একবার গোত্তা খেয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল সেটা। ‘নিজেকে খুনির জায়গায় বসান। কী চিন্তাভাবনা চলছে তার মাথায়, ভেবে দেখুন।’

‘যেমন?’

‘যেমন আপনি জানতেন, শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান থেকে এখানে ফিরে আসবে ড্যামিয়েন। আর তাই আপনি একটা এমপি থ্রি প্লেয়ার ঢুকিয়ে দিলেন কফিনের ভিতরে, আর চালিয়ে দিলেন সেই ‘দ্য হুইলস অন দ্য বাস’ ছড়াটা। ইচ্ছাকৃতভাবেই করলেন কাজটা, যাতে এখানে আসতে বাধ্য হয় ড্যামিয়েন। আবার এমনও হতে পারে, আপনি নিজেই গিয়েছিলেন কবরস্থানে… মিশে ছিলেন জনতার ভিড়ে, অথবা অদৃশ্য হয়ে ছিলেন কোনো একটা কবরফলকের আড়ালে। হয়তো শুনেছেন, ড্যামিয়েন তার গার্লফ্রেন্ডকে বলছে, ‘বাসায় ফিরে যাচ্ছি আমি।’ আর ঠিক তখনই পরিকল্পনাটা এঁটে নিলেন মনে মনে।

‘শুধু একটাই সমস্যা ছিল আপনার… বাসায় একা ফিরবে কি না ড্যামিয়েন, সে-ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন না। তার সঙ্গে হয়তো গ্রেসও ফিরে আসত। আবার এমনও হতে পারত, সঙ্গে করে ভিকারকে নিয়ে আসত ড্যামিয়েন। কাজেই আপনার আসলে এমন একটা জায়গা দরকার, যেখানে লুকিয়ে থেকে অপেক্ষা করতে পারবেন… যদি সে-রকম কোনো সুযোগ না আসে তা হলে চট করে পালিয়েও যেতে পারবেন।’ বুড়ো আঙুলের ইশারায় টেরেসের নিচটা দেখিয়ে দিল হোথর্ন। ‘নিচতলার দিকে একটা স্টেয়ারকেস নেমে গেছে।’

‘তার মানে… খুনি সম্ভবত ওই পথেই হাজির হয়েছিল?’

‘না। লিভিংরুমের দরজাটা লক করা ছিল, এবং ভিতর থেকে হুড়কো আটকানো ছিল।’ মাথা নাড়ল হোথর্ন। ‘খুনির কাছে চাবি ছিল। সদর-দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকেছে সে। তারপর নিজের জন্য লুকানোর একটা জায়গা খুঁজে নিয়েছে… হাজির হয়েছে এখানে। এই জায়গা যুৎসই ছিল তার জন্য। এখান থেকে জানালার কাঁচ ভেদ করে তাকিয়ে সহজেই দেখতে পেয়েছে সে, ড্যামিয়েন ক্যুপার একা এসেছে, নাকি তার সঙ্গে অন্য কেউ আছে। যা-হোক, একাই এসেছিল ড্যামিয়েন। এবং সেটাই চেয়েছিল খুনি। লিভিংরুমের ভিতরেচট করে ঢুকে পড়েছিল ড্যামিয়েনের অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে, এবং তারপর… ‘ বাকি কথা শেষ করল না।

‘আপনি বলেছেন, পরে এখান দিয়েই পালিয়ে গেছে লোকটা,’ মনে করিয়ে দেয়ার কায়দায় বললাম আমি।

‘এখানে একজায়গায় একটা ফুটপ্রিন্ট আছে,’ ইশারায় দেখিয়ে দিল হোথর্ন। তাকালাম আমি।

ফায়ার এস্কেপের একধারে, সিকি চাঁদের আকৃতির লাল একটা দাগ দেখা যাচ্ছে।

বুঝলাম, ওটা খুনির জুতোর তলার দাগ… কোনো কারণে পা দিয়ে ফেলেছিল ড্যামিয়েনের রক্তে।

ডায়ানা ক্যুপারের বাসার সেই ফুটপ্রিন্টের কথা মনে পড়ে গেল আমার। হতে পারে, দুটো ফুটপ্রিন্ট একই জুতোর।

‘পালিয়ে যাওয়ার সময় এই ফ্ল্যাটের সামনের দিকের দরজাটা ব্যবহার করার উপায় ছিল না খুনির,’ বলল হোথর্ন। ‘আপনি দেখেছেন, কীভাবে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে ড্যামিয়েনকে। রক্তের ছিটা কমবেশি লাগার কথা খুনির গায়েও। ওই অবস্থায় ব্রিক লেন ধরে যাবে সে, আর কেউ লক্ষ করবে না তাকে… সেটা কি সম্ভব? কাজেই আমার অনুমান, কোট অথবা ওই জাতীয় কিছু-একটা চাপিয়ে নিয়েছে সে গায়ে, তারপর এই ফায়ার এস্কেপ ধরে নেমে গেছে, শেষে নিচের গলি ধরে অদৃশ্য হয়ে গেছে।’

‘কফিনের ভিতরে সেই অ্যালার্ম ক্লক এল কী করে, জানতে পেরেছেন?’

‘এখনও না। কর্নওয়ালিসের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তবে আমার মনে হয় না, খুব জলদি ছাড়া পেতে চলেছি আমরা এখান থেকে। মিডোসের কাছে আনুষ্ঠানিক একটা বিবৃতি দিতে হতে পারে আপনার। আগেই বলে রাখি, বেশি কিছু বলবেন না ওকে। খুব ভালো হয়, যদি বোবা সেজে থাকার চেষ্টা করেন।’

পরের দুই ঘণ্টায় পুলিশের লোক দিয়ে গিজগিজ করতে শুরু করল ড্যামিয়েন ক্যুপারের ফ্ল্যাটটা। আমরা দু’জন চুপচাপ বসে আছি… কিছুই করার নেই। পুলিশের যে-দুই কন্সটেবল হাজির হয়েছিল সবার আগে, তারা খবর দিয়ে নিয়ে এসেছে তাদের ডিটেক্টিভ ইন্সপেক্টরকে; ওই লোক পরে খবর দিয়েছে মার্ডার ইনভেস্টিশন টিমকে। বিশেষ সেই দলের জনা ছয়েক সদস্য এখন হুড়ওয়ালা প্লাস্টিসাইড্ পেপার স্যুট পরে, মুখে মাস্ক আর হাতে গ্লাভস লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ফ্ল্যাটের এখানে-সেখানে। তাদের একজনের থেকে অন্যজনকে আলাদা করে চেনার কোনো উপায় নেই। হাজির হয়েছে পুলিশের একজন ফটোগ্রাফারও; লোকটা যখন কয়েক-মুহূর্ত-পর-পর অত্যুজ্জ্বল ফ্ল্যাশের সাহায্যে ফ্ল্যাটের এ-জায়গা সে-জায়গার ছবি তুলছে, তখন মনে হচ্ছে, এই ফ্ল্যাট যেন জমে যাচ্ছে কোনো বরফখণ্ডের মতো। একজন পুরুষ আর একজন মহিলা… দু’জনই ফরেনযিক টিমের সদস্য… ঝুঁকে আছে ড্যামিয়েনের মৃতদেহের উপর, কটন বাডের সাহায্যে লাশের হাত আর ঘাড় মুছছে খুব সাবধানে। ছুরিকাঘাতের সময় খুনির সঙ্গে যদি কোনো শারীরিক সংস্পর্শ ঘটে থাকে ড্যামিয়েনের, তা হলে হয়তো ড্যামিয়েনের দেহে খুনির ডিএনএ রয়ে যেতে পারে।

ড্যামিয়েনের লাশ যখন সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় হলো, তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল দু’জন অফিসার; পলিথিন দিয়ে পেঁচিয়ে দিল পুরো শরীরটা। দৃশ্যটা দেখে একইসঙ্গে প্রাচীন মিশর আর ফেডেরাল এক্সপ্রেসের কথা মনে পড়ে গেল আমার।

ফ্ল্যাটের সদর-দরজার সামনে সাদা আর নীল টেপ পেঁচিয়ে দিয়েছে পুলিশ, সিঁড়ির খানিকটাও আটকে দিয়েছে ওই টেপ। এই ফ্ল্যাটের উপরতলা আর নিচতলার অধিবাসীদের ব্যাপারে কী করবে পুলিশ, জানি না ঠিক। এখন-পর্যন্ত পুলিশের কোনো অফিসার কিছু জিজ্ঞেস করেনি আমাকে। তবে প্লাস্টিকের স্যুট পরিহিত এক মহিলা হাজির হয়েছিল আমার কাছে, আমার জুতো জোড়া খুলতে বলেছিল। কাজটা আমি করার পর ও-দুটো নিয়ে চলে গেছে সে। ব্যাপারটা হতভম্ব করে দিয়েছে আমাকে।

হোথর্নকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমার জুতো দিয়ে কী করবে পুলিশ?’

‘ফুটপ্রিন্ট,’ বলল হোথর্ন। ‘আনুষ্ঠানিক তদন্ত কার্যক্রম থেকে আপনাকে বাদ দিয়ে চায় ওরা আসলে।’

‘জানি। কিন্তু ওরা তো আপনার জুতো জোড়া নিল না?’

‘কারণ আমি আপনার চেয়ে অনেক বেশি সাবধান।’

নিজের পায়ের দিকে তাকাল সে। এখনও মোজা পরে আছে। তার মানে ড্যামিয়েনের লাশটা যখন দেখতে পেয়েছিল, তখনই হয়তো খুলে ফেলেছিল জুতো জোড়া।

‘আমার জুতো ফেরত পাবো কখন?’ জানতে চাইলাম।

অনিশ্চিত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল হোথৰ্ন।

এখানে আর কতক্ষণ থাকতে হবে আমাদেরকে?’

জবাব দিল না সে আবারও। আরেকটা সিগারেট দরকার হয়ে পড়েছে ওর, কিন্তু এখানে ধূমপান করতে দেয়া হবে না ওকে। এবং সে-কারণে বিরক্তি বোধ করছে সে।

কিছুক্ষণ পর হাজির হলো মিডোস। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে-থাকা লগ অফিসারের হাতেধরা কাগজে স্বাক্ষর করে ঢুকল ভিতরে। ড্যামিয়েন ক্যুপারের হত্যাকাণ্ডের কেস গ্রহণ করল আনুষ্ঠানিকভাবে। এবার তার এক অন্য রূপ দেখতে পেলাম আমি। শান্ত আছে, তবে কর্তৃত্বপূর্ণ একটা ভাব বজায় রেখেছে চেহারায়। ক্রাইম সিন ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলল কিছুক্ষণ, তারপর কথা বলল ফরেনযিক টিমের সঙ্গে। কিছু নোট নিল। শেষপর্যন্ত যখন এগিয়ে এল আমাদের দিকে, সরাসরি চলে গেল কাজের কথায়।

‘আপনারা কী করছেন এখানে?’

‘সান্ত্বনা জানাতে এসেছিলাম আসলে।

‘বাজে কথা বাদ দিন, হোথর্ন। সিরিয়াস একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছি আমি। নিহত লোকটা কি ফোন করেছিল আপনাকে? নাকি আপনি কোনোভাবে জানতে পেরেছিলেন বিপদে পড়তে পারেন তিনি?’

তার মানে, হোথর্ন যতটা বলেছিল, আসলে ততটা বোকা নয় মিডোস। একটা কথা ঠিকই বলেছে সে… হোথর্ন কোনোভাবে জানতে পেরেছিল কোনো একটা বিপদে পড়তে যাচ্ছে ড্যামিয়েন। কিন্তু কথা হচ্ছে, হোথর্ন কি স্বীকার করবে সেটা?

‘না,’ বলল হোথর্ন, ‘আমাকে ফোন করেনি ড্যামিয়েন।’

‘তা হলে এখানে এসেছেন কেন আপনি?’

‘আপনার কী মনে হয়? শেষকৃত্যের সেই ঘটনা… কিছু-একটা ছিল আসলে ওই ঘটনায়, এবং আপনি যদি আপনার সেই অস্তিত্বহীন চোরের পেছনে ঘুরে সময় নষ্ট না-করতেন, তা হলে আপনিও বুঝতে পারতেন। …ঠিক কী ঘটেছিল, সেটা ড্যামিয়েনের কাছ থেকে জানতে চাওয়ার ইচ্ছা ছিল আমার। কিন্তু এখানে যতক্ষণে পৌঁছালাম, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

চাবির কথাটা উল্লেখ করেনি সে। একটা ভুল যে করে ফেলেছে, সেটা স্বীকার করবে না কখনোই। কিন্তু বোধহয় ভুলে গেছে, আমি যদি কখনও লিখে শেষ করতে পারি এই বই… এটা যদি ছাপা হয় কখনও, তা হলে মিডোস অনায়াসেই পড়ে ফেলতে পারবে ব্যাপারটা।

‘আপনি বলতে চাইছেন আপনারা যতক্ষণে হাজির হয়েছেন এখানে, তার আগেই মারা গেছেন মিস্টার ক্যুপার?’

‘হ্যাঁ।’

‘এখান থেকে কাউকে চলে যেতে দেখেননি?’

‘টেরেসের একদিকে কোনো একজনের জুতোর তলার একটুখানি দাগ লেগে আছে… ড্যামিয়েনের রক্তে পা দিয়ে ফেলেছিল ভুলক্রমে… একটু কষ্ট করে যদি দেখে নেন, ভালো হয়। ওই দাগ দেখে লোকটার জুতোর মাপ অনুমান করতে পারবেন হয়তো। যা-হোক, আমি বলবো, ড্যামিয়েনকে খুন করার পর খুনি ফায়ার- এস্কেপ ধরে নেমে গেছে নিচের গলিতে। কাজেই আপনারা যদি সিসিটিভি ফুটেজ ঘাঁটেন, উপকার পেতে পারেন। তবে আমরা কাউকে দেখিনি। এখানে পৌঁছাতে আসলেই দেরি হয়ে গেছে আমাদের।’

‘ঠিক আছে তা হলে। আপনি বিদায় হতে পারেন এখন। আর সঙ্গে আপনার আগাথা ক্রিস্টিকেও নিয়ে যেতে পারেন।

আগাথা ক্রিস্টি বলতে আমাকে বোঝানো হয়েছে। আমি ক্রিস্টির দারুণ একজন ভক্ত, কাজেই মিডোসের কথাটা খারাপ লাগল।

উঠে দাঁড়াল হোথর্ন, ওর পিছু নিলাম আমি। কাঠের মেঝের উপর দিয়ে মোজা- পরা পায়ে হেঁটে হাজির হলাম সদর-দরজার কাছে।

কালো চামড়ার এক জোড়া জুতো বের করে আমাকে দিল হোথর্ন। নিচু গলায় বলল, ‘আপনার জন্য।’

‘কোথায় পেলেন?’

‘উপরতলায় যখন গিয়েছিলাম, কাবার্ডের ভিতর থেকে বের করে নিয়েছি।’ ইঙ্গিতে দেখাল পলিথিনে পেঁচানো ড্যামিয়েন ক্যুপারকে। ‘এই জুতো জোড়া খুব সম্ভব ড্যামিয়েনের… আপনার পায়ে লাগার কথা।’

দ্বিধা ফুটে উঠল আমার চেহারায়। ‘অন্য কারও জুতো…’

‘এসবের আর দরকার হবে না ড্যামিয়েনের,’ আশ্বাস দেয়ার ভঙ্গিতে বলল হোথৰ্ন।

আর কথা বাড়ালাম না, পরে নিলাম জুতো জোড়া। ইটালিয়ান জুতো, বেশ দামি। আমার পায়ে চমৎকার লেগে গেল।

এবার নিজের জুতো পরে নিল হোথর্ন। ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম আমরা। পুলিশের আরও কয়েকজন ইউনিফর্ম-পরিহিত অফিসারকে পাশ কাটিয়ে হাঁটতে লাগলাম ব্রিক লেন ধরে।

বাড়ির বাইরে পার্ক করে রাখা হয়েছে পুলিশের তিনটা গাড়ি। ‘প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স’ লেখা একটা ভ্যানও দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার একপাশে। তবে ওটা আসলে কারও ব্যক্তিগত না। ড্যামিয়েন ক্যুপারের লাশ মর্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসলে আনা হয়েছে কালো ওই ভ্যান।

উৎসুক জনতার ভিড় তৈরি হয়ে গেছে, তাদেরকে রাস্তার আরেক প্রান্তে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে। এই রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

তারপরও আমাদের সামনে এসে থামল একটা ট্যাক্সি, সেটার ভিতর থেকে বের হলো গ্রেস লোভেল। কনুই দিয়ে মৃদু একটা গুঁতো দিলাম আমি হোথর্নকে। শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যে-কাপড় পরে গিয়েছিল মেয়েটা, এখনও সেটাই পরে আছে। একহাতে ঝুলছে হ্যান্ডব্যাগ। তবে এবার অ্যাশলিই আছে তার সঙ্গে। গোলাপি একটা পোশাক পরেছে বাচ্চাটা, মায়ের হাত ধরে রেখেছে!

থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল গ্রেস, এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। যা ঘটছে, তা দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। আমাদেরকে দেখতে পেয়ে তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এল।

‘কী হয়েছে?’ জানতে চাইল সে। ‘পুলিশ কেন এসেছে এখানে?

‘কিছু মনে করবেন না…’ বলল হোথর্ন, ‘ভিতরে যেতে পারবেন না আপনি। খারাপ খবর আছে।’

‘ড্যামিয়েন…?’

‘খুন করা হয়েছে তাঁকে।’

আমার মনে হয় কথাটা আরেকটু কোমলভাবে বলা উচিত ছিল হোথর্নের। কারণ ওর ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে আছে তিন বছর বয়সী একটা মেয়ে। সে যদি শুনে ফেলে থাকে কথাটা, এবং বুঝে ফেলে থাকে, তা হলে কী হবে?

মেয়েটাকে নিজের দিকে টেনে নিল গ্রেস, রক্ষা করার কায়দায় জড়িয়ে ধরেছে মেয়েটার কাঁধ। ফিসফিস করে বলল, ‘কী বলতে চাইছেন?’

‘শেষকৃত্যানুষ্ঠানের পর কেউ একজন হামলা চালিয়েছে ড্যামিয়েনের উপর।’

‘সে কি… মারা গেছে?

‘হ্যাঁ… বলতে খারাপই লাগছে… কিন্তু ঠিক সেটাই ঘটেছে।’

‘না। সম্ভব না। আপসেট হয়ে পড়েছিল ড্যামিয়েন। বলেছিল, বাসায় ফিরে যাবে। আসলে ভয়ঙ্কর সেই তামাশা শোনার পর পরই…’ হোথর্নকে ছাড়িয়ে বাড়ির দরজার দিকে তাকাল গ্রেস, তারপর আবার তাকাল হোথর্নের দিকে। এতক্ষণে বোধহয় বুঝতে পারছে, চলে যাচ্ছি আমরা। ‘কোথায় যাচ্ছেন আপনারা?’

‘ফ্ল্যাটের ভিতরে মিডোস নামের একজন ডিটেক্টিভ ইন্সপেক্টর আছেন। তদন্তের দায়িত্ব এখন তাঁর উপর। আমার ধারণা আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইবেন তিনি। তবে যদি আমার একটা পরামর্শ শোনেন… এই মুহূর্তে ফ্ল্যাটের ভিতরে যাওয়ার দরকার নেই আপনার। কারণ এখন সেখানে যাওয়াটা খুব একটা সুখকর হবে না আপনার জন্য। …আচ্ছা, এতক্ষণ কোথায় ছিলেন আপনি? আপনার বাবা-মায়ের সঙ্গে?’

‘হ্যাঁ। অ্যাশলিইকে নিয়ে আসার জন্য গিয়েছিলাম সেখানে।

‘তা হলে বরং এক কাজ করুন… আবার গিয়ে চড়ুন ওই ট্যাক্সিতে, ফিরে যান আপনার বাবা-মায়ের কাছে। নিজের প্রয়োজনেই আপনাকে খুঁজে নেবেন মিডোস।’

‘আমি কি ফিরে যেতে পারবো? যদি যাই, ওরা হয়তো ভাববে… ‘

‘ওরা কিছুই ভাববে না। কারণ যা ঘটেছে, তার সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত না আপনি। শেষকৃত্যানুষ্ঠানের পর আপনি ছিলেন পাবে… আমাদের সঙ্গে।’

‘আমি সেটা বলিনি।’ কিন্তু কথা আর বাড়াল না গ্রেস, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। মাথা ঝাঁকাল। ‘ঠিকই বলেছেন। ভিতরে যেতে পারবো না আমি… বিশেষ করে অ্যাশলিই যখন আছে আমার সঙ্গে তখন।

‘বাবা কোথায়?’ প্রথমবারের মতো কথা বলে উঠল অ্যাশলিই। দ্বিধান্বিত বলে মনে হচ্ছে তাকে। মনে হচ্ছে, একসঙ্গে এত পুলিশ দেখে ভয় পেয়েছে।

‘বাবা নেই এখানে,’ বলল গ্রেস। ‘নানা-নানীর কাছে ফিরে যাচ্ছি আমরা।’

‘আপনি কি চান এখন কেউ একজন থাকুক আপনার সঙ্গে?’ গ্রেসকে জিজ্ঞেস করলাম আমি। ‘যদি আপত্তি না-থাকে আপনার, তা হলে আপনার সঙ্গে যেতে কোনো অসুবিধা নেই আমার।’

‘না। কাউকে লাগবে না আমার।’

অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে থাকতে কখনোই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না আমি। কারণ তারা কখন অভিনয় করছে আর কখন করছে না, সেটা ঠিক ঠাহর করতে পারি না। যেমন গ্রেস। আপসেট দেখাচ্ছে তাকে। অশ্রু দেখা দিয়েছে চোখে। মনে হয়তো সাংঘাতিক চোটও পেয়েছে। তারপরও… আমার ভিতরের একটা অংশ যেন বলছে আমাকে… আসলে অভিনয় করছে মেয়েটা। কেন যেন মনে হচ্ছে, ট্যাক্সিতে যখন ছিল সে, তখনই সেরে নিয়েছে অভিনয়ের মহড়াটা।

ট্যাক্সির কাছে ফিরে যাচ্ছে গ্রেস, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি আমরা তাকে। অ্যাশলিইকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল, সামনের দিকে ঝুঁকে কী যেন বলল ড্রাইভারকে। কিছুক্ষণ পর চলে গেল ট্যাক্সিটা।

‘দ্য গ্রিভিং উইডো,’ বিড়বিড় করে বলল হোথর্ন।

কিন্তু কথাটা কান এড়াল না আমার। ‘আসলেই কি তা-ই মনে করেন?

‘না, টনি। একবার এক তুর্কি দম্পতির বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলাম। সেখানে শোকের যে-বহিঃপ্রকাশ দেখেছি, সেটা, কিছুক্ষণ আগে গ্রেসের ভিতরে যে- শোক দেখা গেল তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল। যা-হোক, আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন তা হলে বলবো, আমাদের কাছে অনেক কিছুই গোপন করেছে মেয়েটা।’ একটুখানি হাসল হোথর্ন। ‘ড্যামিয়েন কীভাবে মারা গেছে, এমনকী সেটাও জিজ্ঞেস করেনি সে।’

১৪. উইল্‌স্‌ডেন গ্রীন

বাড়িটা ১৯৫০ সালের; ওটার মতোই দেখতে আরেকটা বাড়ির সঙ্গে একদিক দিয়ে লাগোয়া। প্রথম তলায় ব্যবহার করা হয়েছে লাল ইট, সেগুলোর সঙ্গে আছে হালকা ধূসর পলেস্তারার আবরণ। ছাদ ত্রিকোণাকৃতির। দেখলে মনে হয়, একইসঙ্গে তিনজন আর্কিটেক্ট কাজ করেছে বাড়িটা বানানোর সময়, অথচ তাদের কারও সঙ্গেই কারও দেখা হয়নি তখন। আয়নার প্রতিবিম্বের মতো দেখতে লাগোয়া বাড়িটার কারণে মনে হয়, ওই তিনজন তাদের কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট। কাঠের ফেন্সের কারণে ভাগ হয়ে গেছে বাড়ি দুটোর ড্রাইভওয়ে, তবে দুই বাড়ির চিমনি একটাই। প্রতিটা বাড়িতে একটা করে বে-উইন্ডো আছে। সে-জানালা দিয়ে তাকালে প্রথমেই চোখে পড়বে অসম-আকারের-সমতল-পাথর দিয়ে বানানো শানবাঁধানো ফুটপাত। নিচু একটা দেয়ালের দিকে এগিয়ে গেছে ওই ফুটপাত, সে-দেয়ালের অপর পাশে স্পেয়িড রোড। আমার ধারণা, ওই বাড়িতে চারটা বেডরুম আছে। সামনের দিকের জানালায় ঝুলছে একটা পোস্টার; ওটা প্রকৃতপক্ষে উত্তর লন্ডনের একটা অনাথশালার জন্য প্রতিযোগিতবিহীন ফান-রানের বিজ্ঞাপন। একদিকে দেখতে পাচ্ছি একটা গ্যারেজ, সেটার দরজা খোলা। ভিতরে নিথর দাঁড়িয়ে আছে উজ্জ্বল সবুজ রঙের একটা ভক্সহল অ্যাস্ট্রা। আরও আছে একটা ট্রাইসাইকেল এবং একটা মোটরবাইক। জায়গা নিয়ে ওগুলোর মধ্যে মারামারি লেগে গেছে যেন।

সদর-দরজার প্রবেশপথটা খিলানাকৃতির; দরজাটা নকল-মধ্যযুগীয়, সেটাতে লাগানো আছে ফ্রস্টেড কাঁচের মোটা প্যানেল। অভিনব একটা ওয়েলকাম ম্যাট দেখতে পাচ্ছি দরজার সামনে; সেটাতে লেখা আছে: ‘কুকুর নয়, সেটার মালিক থেকে সাবধান!

হোথর্ন যখন চাপ দিল ডোরবেলে, স্টার ওয়ার্স-এর থিম সঙের শুরুর দিকের কয়েকটা লাইন শুনতে পেলাম। তবে আমার মনে হয় ওটার বদলে যদি চপিনের ফিউনারেল মার্চ শুনতে পেতাম, তা হলে মানানসই হতো বেশি। কারণ এই বাড়িতেই থাকে রবার্ট কর্নওয়ালিস।

যে-মহিলা দরজা খুলে দিল তার চেহারায় হাসিখুশি একটা ভাব আছে, কিন্তু একইঙ্গে মারমুখী ভাবও আছে। ব্যাপারটা যেন এ-রকম… গত একটা সপ্তাহ ধরে আমাদের আগমনের জন্য অপেক্ষা করছিল সে। আমাদের দিকে কিছুটা এগিয়ে এল; ভঙ্গি দেখে মনে হলো, এখনই যেন বলবে, এসেছেন শেষপর্যন্ত? এত দেরি হলো যে?

তার বয়স প্রায় চল্লিশ; দেখলে মনে হয় মাঝবয়সের দিকে প্রচণ্ড গতিতে এগিয়ে চলেছে। চালচলনে ফুটে আছে সম্পূর্ণ বেপরোয়া একটা ভঙ্গি। ঢলঢলে আর বেখাপ্পা একটা জার্সি পরে আছে, সেটার সঙ্গে পরেছে বাজে ফিটিঙের জিন্স। সেটার একদিকের হাঁটুতে এমব্রয়ডারির সাহায্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ফুলের একটা নকশা। মাথায় কোঁকড়া চুল। অল্প যে-ক’টা গহনা দেখা যাচ্ছে গায়ে সেগুলো কেমন ছোট-ছোট আর মোটা-মোটা। ওজন বেশি। লন্ড্রিতে দেয়ার জন্য একগাদা কাপড় চেপে ধরেছে একদিকের বগলের নিচে। একহাতে দেখা যাচ্ছে একটা কর্ডলেস টেলিফোন। কিন্তু ওসব কাপড় অথবা ওই টেলিফোনের কোনো কিছুর প্রতিই তার কোনো খেয়াল আছে বলে মনে হয় না। ওসবের কারণে দরজাটা খুলতে কষ্ট হলো তার; কল্পনার চোখে দেখতে পেলাম, একটা হাঁটু উঁচু করে সেটাতে ঠেস দিয়ে কাপড়ের বোঝা সামাল দিল, একইসঙ্গে কান আর কাঁধের সাহায্যে চেপে ধরল টেলিফোনটা।

‘মিস্টার হোথর্ন?’ বলল সে, তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মনোরম কণ্ঠ শুনলে উচ্চ-শিক্ষিত বলে মনে হয় তাকে।

‘না,’ বললাম আমি, ইশারায় দেখিয়ে দিলাম হোথর্নকে। ‘তিনি হোথর্ন।

‘আমি বারবারা। প্লিয ভিতরে আসুন। কিছু মনে করবেন না… আমাদের বাড়ির ভিতরটার অবস্থা বেশি ভালো না। রবার্ট অন্য একটা ঘরে আছে। শেষকৃত্যানুষ্ঠানে কী ঘটেছে, সেটা আইরিন বলেছে আমাদেরকে। শুনে মনে আঘাত পেয়েছি আমি। …আপনারা তো পুলিশে আছেন, তা-ই না?’

‘এই কেসে পুলিশকে সাহায্য করছি আমি,’ বলল হোথৰ্ন।

‘এদিক দিয়ে আসুন! এই যে, এদিকে একটা রোলার স্কেট পড়ে আছে, খেয়াল রাখবেন। বাচ্চাগুলোকে এতবার বলেছি এসব যাতে হলে ফেলে না-রাখে… কথা শুনতে চায় না ওরা।’ বগলের নিচে চেপে রাখা কাপড়ের গাদার উপর চোখ পড়ল বারবারার। ‘আমার অবস্থা দেখুন! আমি দুঃখিত। ডোরবেলটা যখন বাজল, তখন এসব মাত্র ধুতে দিচ্ছিলাম। আমার ব্যাপারে কী ভাবছেন আপনারা, কে জানে!’

রোলার স্কেটটা টপকালাম আমরা দু’জন, এগিয়ে চলেছি হলওয়ে ধরে। এখানে-সেখানে পড়ে আছে কোট, ওয়েলিংটন বুট আর বিভিন্ন সাইজের কিছু জুতো। একদিকে একটা চেয়ারের উপর রাখা আছে মোটরবাইকের একটা হেলমেট। দুটো বাচ্চা ছুটে বেড়াচ্ছে সারা ঘরে। তাদেরকে দেখতে পাচ্ছি না আমরা, কিন্তু তাদের উঁচু কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছি… ছুটতে ছুটতে মনের আনন্দে চেঁচাচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত পরই একদিকের একটা খোলা দরজা দিয়ে ছুটে বের হলো তারা… দুটো ছেলে, দু’জনেরই চুল ধূসর, বয়স পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে। আমাদের দিকে একবারমাত্র তাকাল, তারপরই ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল আরেকদিকে। এখনও চিৎকার করছে।

‘টবি আর সেবাস্টিয়ান,’ বললেন বারবারা। ‘আর কিছুক্ষণ পর গোসলে ঢুকবে ওরা দু’জন, তারপর যদি একটু শান্তি পাই আমি! আপনাদের বাসায় কি বাচ্চাকাচ্চা আছে? …মাঝেমধ্যে আমার কী মনে হয়, জানেন? মনে হয়, এই বাড়ি যেন কোনো একটা যুদ্ধক্ষেত্র!’

এদিক-ওদিক তাকালাম আমি। বাচ্চা দুটো সারা বাড়ি তছনছ করে ফেলেছে। রেডিয়েটরের উপর পড়ে আছে কাপড়, সব জায়গায় ছড়িয়েছিটিয়ে আছে বিভিন্ন রকমের খেলনা… ফুটবল, প্লাস্টিকের তলোয়ার, স্টাফ-করা পশুপাখি, টেনিসের পুরনো র‍্যাকেট, প্লেয়িং কার্ডস, লেগোর পিস। এসব এড়িয়ে নিজেদের চলাচলের জন্য জায়গা করে নেয়া আসলেই মুশকিল কাজ। তারপরও যখন হাজির হলাম লিভিংরুমে, পুরনো এই বাসা বেশ আরামদায়ক বলে মনে হলো আমার কাছে। ফায়ারপ্লেসের ধারে দেখা যাচ্ছে শুকিয়ে-আসা ফুল, মেঝেতে বিছানো আছে সী- গ্রাস কার্পেট। একধারে দেখা যাচ্ছে একটা পিয়ানো, তবে সেটা আর কাজ করে কি না সন্দেহ। গোলাকৃতির পেপার ল্যাম্পশেডগুলো দেখলে মনে হয় ওগুলো কখনোই সেকেলে হয়ে যাবে না। দেয়ালে দেয়ালে ঝুলছে বেশ কিছু পেইন্টিংস; বিমূর্ত চিত্রকলা ঠাঁই পেয়েছে ওগুলোতে, তবে সবগুলোই বর্ণিল। দেখলে মনে হয় সাধারণ কোনো ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে কেনা হয়েছে ওসব।

বারবারার পেছন পেছন তাদের কিচেনে যাচ্ছি, এমন সময় হোথর্ন বলল, ‘আপনার স্বামীর ব্যবসায় কি আপনিও কাজ করেন, মিসেস কর্নওয়ালিস?’

‘ঈশ্বর, না! আর আমাকে বারবারা বলে ডাকতে পারেন।’ একটা চেয়ারের উপর ধপ করে সব কাপড় নামিয়ে রাখল সে। ‘আমি একজন ফার্মাসিস্ট… তবে পার্ট-টাইম। ‘বুটস’-এর স্থানীয় একটা শাখায় কাজ করি। ওই কাজ যে খুব ভালো লাগে আমার, তা না, কিন্তু সংসারের খরচাপাতি জোগাতে গেলে কিছু-একটা করতে হয়।

কিচেনে হাজির হলাম আমরা। ঘরটা আলোকোজ্জ্বল, তবে এলোমেলো। একধারে একটা ব্রেকফাস্ট বার আর সাদা রঙের দেহাতি গড়নের একটা টেবিল আছে। সিঙ্কের উপর স্তূপ করে রাখা হয়েছে নোংরা জিনিসপত্র। সেগুলোর পাশেই আবার দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার কিছু তৈজস। কাজের সময় কোন্‌টা লাগবে না-লাগবে, সেটা কীভাবে নির্ধারণ করে বারবারা, ভেবে খানিকটা আশ্চর্য হলাম। রান্নাঘরে ফ্রেঞ্চ উইন্ডো আছে, একটা বাগানের দিকে মুখ করে আছে সেটা। আকারে সবুজ একটা আয়তক্ষেতের চেয়ে কিছু বড় হবে ওই বাগান, সেটার এককোনায় গজিয়ে আছে কিছু লতাগুল্ম, বেড়া দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়েছে সেগুলো। টবি আর সেবাস্টিয়ান কলোনি স্থাপন করেছে ওখানেও… একটা ট্র্যাম্পোলিন দেখতে পাচ্ছি, আরও দেখতে পাচ্ছি একটা ক্লাইম্বিং ফ্রেম। লনের বেশিরভাগ জায়গা শেষ করে দিয়েছে ওসব জিনিস।

টেবিলটার এককোনায় বসে আছে রবার্ট কর্নওয়ালিস। ব্রম্পটন চ্যাপেলে যে- স্যুট পরে ছিল, সেটাই পরে আছে, তবে টাই পরেনি। কিছু হিসাবপত্র দেখছে। একজন ফিউনারেল ডিরেক্টরকে তাঁর পার্লারের বাইরে এভাবে বসে থাকতে দেখে আশ্চর্য লাগল আমার।

‘এই যে, রবার্ট,’ বারবারা জানিয়ে দিল আমাদেরকে… যেন পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে তার স্বামীর সঙ্গে। তারপর তাকাল কর্নওয়ালিসের দিকে। তিরস্কার করার ঢঙে বলল, ‘তুমি এখনও ওসব নিয়ে বসে আছ? সাপার রান্না করতে হবে আমাদেরকে, বাচ্চাগুলোকে ঘুম পাড়াতে হবে। এদিকে পুলিশ এসে হাজির হয়েছে বাসায়।

‘শেষ করে ফেলেছি,’ হিসাবনিকাশের খাতাটা বন্ধ করল কর্নওয়ালিস। তাকাল আমাদের দিকে, ইশারায় দেখিয়ে দিল তার সামনের দুটো চেয়ার। ‘মিস্টার হোথর্ন, প্লিয বসুন।’

‘চা খাবেন আপনারা?’ জিজ্ঞেস করল বারবারা।

‘না, কিছু লাগবে না। ধন্যবাদ।’

‘কড়া কিছু দেবো? …রবার্ট, ফ্রিজের ভিতরে ওয়াইনের বোতলটা আছে না?’ মাথা নেড়ে মানা করে দিলাম আমি।

‘আমি একগ্লাস খাবো… যদি কিছু মনে না-করেন আপনারা। যত যা-ই হোক আজ উইকএন্ড। তোমার লাগবে, রবি?’

‘না, ধন্যবাদ।’

টেবিলের আরেকপ্রান্তে বসে পড়লাম আমি আর হোথর্ন।

‘শেষকৃত্যানুষ্ঠানের ব্যাপারে আমাকে জানিয়েছে আইরিন,’ শুরু করল কর্নওয়ালিস। ‘আমি যে কী পরিমাণ আতঙ্কিত হয়েছি, বলে বোঝাতে পারবো না আপনাদেরকে। আমার আগে আমার বাবা চালিয়েছেন আমাদের ওই প্রতিষ্ঠান, তাঁর আগে চালিয়েছেন আমার দাদা। আপনাদেরকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, ও- রকম কিছু ঘটেনি আগে কখনও।’

কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল হোথর্ন, কিন্তু কর্নওয়ালিস বলে চলল, ‘আমি যে তখন উপস্থিত থাকতে পারিনি সেখানে, সেজন্য দুঃখিত। আমার প্রতিষ্ঠান যেসব শেষকৃত্যের আয়োজন করে, সাধারণত সবগুলোতেই উপস্থিত থাকি। কিন্তু… আইরিন হয়তো বলেছে আপনাদেরকে… আমার ছেলের স্কুলে একটা নাটকের আয়োজন করা হয়েছিল…

‘সপ্তাহের পর সপ্তাহ পরিশ্রম করে ওই নাটকের ডায়ালগগুলো মুখস্ত করেছিল আমাদের ছেলেটা,’ বলল বারবারা। ‘প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে করেছে কাজটা খুব সিরিয়াসলি নিয়েছিল ব্যাপারটা।’ বড় একটা গ্লাস ওয়াইনে ভর্তি করে নিয়ে আমাদের সঙ্গে এসে বসল। ‘কাজেই ওই নাটক দেখতে যদি না-যেতাম আমরা, আমাদেরকে কখনোই ক্ষমা করত না সে। আসলে অভিনয়টা মিশে আছে ওর রক্তের সঙ্গে… সব সময় নাটক নিয়েই কথা বলে। এবং কাজও করে দারুণ! ‘

‘তারপরও ওই নাটক দেখতে যাওয়া উচিত হয়নি আমার,’ মাথা নাড়ল কর্নওয়ালিস। ‘তখনই কেমন যেন লাগছিল আমার কাছে… বার বার মনে হচ্ছিল, কিছু একটা গড়বড় হবে কোথাও না কোথাও।

‘কেন, মিস্টার কর্নওয়ালিস?’

জবাব দেয়ার আগে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল কর্নওয়ালিস। ‘মিসেস ক্যুপারের মৃত্যুর ব্যাপারে সব কিছুই আসলে অস্বাভাবিক। মিস্টার হোথর্ন, শুনলে হয়তো আশ্চর্য লাগবে আপনার, কিন্তু নৃশংস হত্যাকাণ্ড আমার কাছে নতুন কিছু না। দক্ষিণ লন্ডনে আমাদের আরেকটা শাখা আছে, এবং সেখানকার পুলিশ একাধিকবার খবর দিয়েছে আমাদেরকে… কাউকে খুন করা হয়েছে ছুরিকাঘাতের মাধ্যমে, কেউ আবার শিকার হয়েছে গ্যাং ভায়োলেন্সের। কিন্তু মিসেস ক্যুপারের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। যেদিন নিজের শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করে গেলেন তিনি… কে জানত, সেদিনই সেটা দরকার হয়ে পড়বে তাঁর। যা-হোক, আইরিনকে থাকতে বলেছিলাম মিসেস ক্যুপারের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে। জানতাম, পুলিশ যাবে সেখানে, সাংবাদিকরা যাবে। আর যাবে ড্যামিয়েন ক্যুপার। আসলে… আমি ঠিক ভরসা করতে পারিনি আলফ্রেডের উপর… সে হয়তো একা হাতে সব কিছু সামলাতে পারত না। তারপরও… আমার থাকা উচিত ছিল সেখানে।’

‘ড্যামিয়েন ক্যুপারের সঙ্গে কথা বলার দরকারও ছিল না তোমার,’ বললেন বারবারা। ক্রিস-এর একটা বোল আছে টেবিলের উপর, সেটা টেনে নিল নিজের দিকে, একমুঠো ক্রিস্স নিল। বাগানে গিয়ে হাজির হয়েছে টবি আর সেবাস্টিয়ান, সমানে লাফাচ্ছে ট্র্যাম্পোলিনের উপর, উত্তেজিত ভঙ্গিতে হাসছে। ওদের সেই লাফালাফি আর হাসির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি আমরা। ‘ড্যামিয়েন ক্যুপার তোমার প্রিয় অভিনেতাও।’

‘ঠিক।

‘যত জায়গায় যেসব অভিনয় করেছে সে, সব দেখেছি আমরা।’

‘আপনাদেরকে দেয়ার মতো একটা খবর আছে আমার কাছে,’ বলল হোথৰ্ন। ‘এবং সেটা শুনলে হয়তো বিস্মিত হবেন আপনারা।’ হাত বাড়িয়ে একটা ক্রিস তুলে নিল সে; এমনভাবে ধরে আছে সেটা, যেন ওটা কোনো একটা অপরাধের প্রমাণ। ‘ড্যামিয়েন ক্যুপারকেও খুন করা হয়েছে।’

‘কী?’ হোথর্নের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন কর্নওয়ালিস।

‘আজ বিকেলে খুন করা হয়েছে তাকে। তার মায়ের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের বড়জোর এক কি দেড় ঘণ্টা পর।’

‘কী বলছেন এসব? এটা অসম্ভব!’ কর্নওয়ালিসকে দেখে মনে হচ্ছে, বড় রকমের মানসিক-ধাক্কা খেয়েছে।

আমি ভেবেছিলাম, ড্যামিয়েন ক্যুপারের খুন হওয়ার খবরটা ইতোমধ্যে প্রচারিত হয়েছে টিভিতে, অথবা ছড়িয়ে গেছে ইন্টারনেটের বদৌলতে। কিন্তু মিস্টার ও মিসেস কর্নওয়ালিস বোধহয় তাদের বাচ্চাদের নিয়ে এত ব্যস্ত ছিল যে, ওই খবর দেখার বা শোনার মতো সময় পায়নি।

‘কীভাবে খুন করা হয়েছে ড্যামিয়েনকে?’ জানতে চাইল বারবারা। তাকে দেখেও মনে হচ্ছে, মানসিক ধাক্কা খেয়েছে।

‘ছুরিকাঘাত। ব্রিকলেনে যে-ফ্ল্যাট আছে তার, সেখানেই করা হয়েছে খুনটা।’

‘কে খুন করেছে তাকে, জানেন?’

‘এখনও না। …আশ্চর্য লাগছে, ডিটেক্টিভ ইন্সপেক্টর মিডোস এখনও যোগাযোগ করেননি আপনাদের সঙ্গে।’

‘আমরা কিছু শুনিনি।’ একবার হোথর্নের দিকে, পরেরবার আমার দিকে তাকাচ্ছে কর্নওয়ালিস… কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজছে বোধহয়। ‘শেষকৃত্যানুষ্ঠানে কী ঘটল… দুটো ঘটনার মধ্যে কি কোনো যোগসূত্র আছে? মানে… আমার মনে হয় না-থেকে পারেই না! আইরিন যখন ঘটনাটা বলল আমাকে, আমি তখন ভাবলাম, পুরো ব্যাপারটা মানসিকভাবে-অসুস্থ কারও তামাশা ছাড়া আর কিছু না…

‘কেউ একজন তার মনের ঝাল মিটিয়েছে ড্যামিয়েনের উপর,’ হোথর্নকে বলল বারবারা। ‘সেটাই বলতে চাইছেন আপনি, তা-ই না?’

‘আপাতদৃষ্টিতে আর কোনো ব্যাখ্যা নেই আমার কাছে। তবে… পুরো ব্যাপারটা আমার অভিজ্ঞতার বাইরে… মানে, এ-রকম কিছু দেখিনি আগে কখনও।’ ক্রিসটা মুখে দিতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল হোথর্ন, কী যেন ভাবল কিছুক্ষণ। তারপর ওটা রেখে দিল বোলে। ‘কেউ একজন একটা এমপিথ্রি রেকর্ডিংযুক্ত অ্যালার্ম ক্লক রেখে দিল কফিনের ভিতরে। সাড়ে এগারোটার সময় বাজতে শুরু করল ওই ঘড়ি… চালু হয়ে গেল একটা নার্সারি রাইম। কাজেই যদি বাজি ধরি কেউ একজন ইচ্ছাকৃতভাবে এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করেছে কাজটা, তা হলে মনে হয় না ভুল হবে। আমি এখন যা জানতে চাই তা হলো, ওই ঘড়ি কীভাবে গেল মিসেস ক্যুপারের কফিনের ভিতরে।’

‘কোনো ধারণা নেই আমার।

‘একটু ভেবে বলছেন না কেন?’ দেখে মনে হচ্ছে যারপরনাই বিরক্ত হয়েছে হোথর্ন। বিরক্ত হওয়ারই কথা। সারা বাড়ি অগোছালো, বাগানে সমানে চিৎকার করছে বাচ্চা দুটো… সেই তখন থেকে লাফিয়েই চলেছে, এদিকে কুড়মুড় শব্দে ক্রিস চিবুচ্ছে বারবারা… উইলসডেন গ্রীন, মানে এই বাসার সব কিছু বোধহয় স্নায়ু ধ্বংস করে দিচ্ছে হোথর্নের।

এমন এক দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকাল কর্নওয়ালিস যে, দেখে মনে হলো, সে বোধহয় সাহায্য প্রার্থনা করছে ওই মহিলার কাছে। তারপর তাকাল হোথর্নের দিকে। ‘আপনাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, আমার অধীনে কাজ করে, এমন কেউ ওই ঘড়ি রাখেনি মিসেস ক্যুপারের কফিনের ভিতরে। কর্নওয়ালিস অ্যান্ড সন্সে যে বা যারাই আছে, তারা কম করে হলেও পাঁচ বছর ধরে কাজ করছে। তাদের বেশিরভাগই আমাদের পরিবারেরই সদস্য- কাছের বা দূরের আত্মীয়। আমি নিশ্চিত কথাটা আপনাকে আগেও বলেছে আইরিন। যা-হোক, হ্যাঁমারস্মিথে আমাদের একটা কেন্দ্রীয় মর্গ আছে, হাসপাতাল থেকে সেখানে সরাসরি নিয়ে আসা হয়েছিল মিসেস ক্যুপারের লাশ। তাঁকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করি আমরা, তাঁর চোখ দুটো বন্ধ করে দিই। মিসেস ক্যুপার চাননি, রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাঁর লাশের পচন রোধ করা হোক। লাশটা দেখার কথা বলা হয়নি কাউকে; যদি হতোও, কোনো ভুল করার সুযোগ ছিল না।

‘নিজের জন্য প্রাকৃতিক উইলো উইভ কাঠের কফিন বেছে নিয়েছিলেন মিসেস ক্যুপার। সে-রকম একটা কফিনের ভিতরই রাখা হয়েছিল তাঁর লাশ। কফিনের ভিতরে কখন রাখা হয়েছিল তাঁকে সেটাও বলে দিই… সকাল আনুমানিক সাড়ে ন’টার দিকে। আমি অবশ্য তখন ছিলাম না সেখানে। তবে যে-চারজন লোক কফিন বহন করে নিয়ে গিয়েছিল গির্জায়, তারা ছিল। যা-হোক, সাড়ে ন’টার পর ওই চারজন কফিনটা বয়ে নিয়ে গিয়ে রাখে শবযানে। উঠানের মতো ব্যক্তিগত একটুখানি জায়গা আছে আমাদের, সেখানে ইলেকট্রিক গেটও আছে। কাজেই রাস্তা থেকে চাইলেই কেউ হুট করে ঢুকে পড়তে পারবে না আমাদের সেই কেন্দ্রীয় মর্গে। সেখান থেকে পরে কফিনটা নিয়ে যাওয়া হয় ব্রম্পটন সেমেট্রিতে।’

‘তার মানে মর্গ থেকে কবরস্থানে যাওয়ার সারাটা পথে কেউ-না-কেউ সার্বক্ষণিকভাবে চোখ রেখেছিল মিসেস ক্যুপারের কফিনের উপর?

‘হ্যাঁ। তবে… যতদূর অনুমান করতে পারি, তিন কি বেশি হলে চার মিনিটের জন্য কফিনটা আমাদের সবার চোখের আড়ালে ছিল। কখন ঘটেছিল ঘটনাটা তা-ও বলে দিই… গির্জার পেছনের কার পার্কে যখন হাজির হয়েছিল কফিনটা, তখন। যা- হোক, এ-রকম কোনো ঘটনা ভবিষ্যতে যাতে আর কখনও না-ঘটে, খেয়াল রাখবো।’

‘তার মানে ওই তিন কি চার মিনিটের মধ্যেই কেউ একজন অ্যালার্ম ক্লকটা ঢুকিয়ে দিয়েছে কফিনের ভিতরে?’

‘হ্যাঁ… তা-ই মনে হয় আমার।’

‘কফিনের ঢাকনা খুলে ফেলাটা কি সহজ কোনো কাজ? মানে… কেউ চাইলেই করতে পারবে সেটা?’

জবাব দেয়ার আগে কিছুক্ষণ ভাবল কর্নওয়ালিস। ‘হ্যাঁ… কফিনের ঢাকনা খুলে ফেলাটা মোটেও কঠিন কিছু না… বড়জোর কয়েক মুহূর্ত লাগবে যে-কারও। কফিনটা যদি সনাতনী কিছু হতো… অর্থাৎ নিরেট কাঠ দিয়ে বানানো থাকত, তা হলে ঢাকনাটা স্ক্রু দিয়ে আটকানো অবস্থায় থাকত কফিনের মূল কাঠামোর সঙ্গে। কিন্তু উইলো কফিনের ক্ষেত্রে ঢাকনা সাধারণত শুধু দুটো স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা অবস্থায় থাকে।’

ওয়াইন খাওয়া শেষ বারবারার। আমাদেরকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনারা কি আসলেই ড্রিঙ্ক নেবেন না?’

‘না, ধন্যবাদ,’ বললাম আমি।

বারবারা বলল, ‘আমি আরেক গ্লাস খাবো। খুন আর মৃত্যু নিয়ে এত কথা শুনতে কেমন যেন লাগছে। রবার্টের কাজ নিয়ে আমরা সাধারণত বাসায় কোনো আলোচনা করি না। বাচ্চারা এসব ঘৃণা করে। অ্যান্ড্রিউ… মানে আমাদের সবচেয়ে বড় ছেলের স্কুলে একবার একটা আলোচনা হলো… কার বাবা কী করে সেসব নিয়ে। সে তখন বানিয়ে বানিয়ে সারা ক্লাসের সামনে বলে দিল, ওর বাবা একজন অ্যাকাউন্টেন্ট।’ হেসে উঠল সে। ‘অথচ অ্যাকাউন্টেন্সির কিছুই জানে না রবার্ট।’ টেবিল ছেড়ে উঠে এগিয়ে গেল ফ্রিজের দিকে, নিজের জন্য ঢেলে নিল আরেক গ্লাস ওয়াইন।

ফ্রিজের দরজাটা যখন লাগিয়ে দিচ্ছে, তখন আরেকটা ছেলে ঢুকল কিচেনে। তার পরনে ট্র্যাকস্যুটের ট্রাউজার আর একটা টি-শার্ট। টবি আর সেবাস্টিয়ানের চেয়ে লম্বা। চুলের রঙ গাঢ়। সে-চুলের বোঝা কেমন অমার্জিত ভঙ্গিতে ঝুলে আছে চেহারার উপর। ‘টবি আর সেব বাগানে কেন?’ জিজ্ঞেস করল। পরমুহূর্তেই দেখতে পেল আমাদেরকে। ‘আপনারা কারা?

‘এই যে… এর নামই অ্যান্ড্রিউ,’ পরিচয় করিয়ে দিল বারবারা। তাকাল বড় ছেলের দিকে। ‘এঁরা পুলিশের লোক।

‘পুলিশের লোক? কেন? কী হয়েছে?’

‘তোমার চিন্তা করার মতো কিছু হয়নি, অ্যান্ড্রিউ। হোমওয়ার্ক শেষ করেছ?’

মাথা ঝাঁকাল ছেলেটা।

‘তা হলে ইচ্ছা করলে টেলিভিশন দেখতে পারো।’ ছেলের উদ্দেশে হাসল বারবারা। ‘স্কুলে যে-নাটকে অভিনয় করেছ তুমি আজ, সেটার ব্যাপারে এই দুই ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছিলাম আমরা। মিস্টার পিনোকিও!’

‘আমি যখন বড় হবো,’ বলছে অ্যান্ড্রিউ, ‘তখন একজন অভিনেতা হবো।’

‘ওসব নিয়ে এখনই কথা বলার দরকার নেই, অ্যান্ড্রিউ,’ বলে উঠল কর্নওয়ালিস। ‘আমাদেরকে যদি সাহায্য করতে চাও, বাগানে গিয়ে তোমার ভাইদের বলো, ঘুমাতে যাওয়ার সময় হয়েছে।

বাগানে এতক্ষণে ক্লাইম্বিং ফ্রেমের কাছে গিয়ে হাজির হয়েছে টবি আর সেবাস্টিয়ান। একে অপরের উদ্দেশে চিৎকার করছে সমানে। অতিমাত্রায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে দু’জনই।

মাথা ঝাঁকাল অ্যান্ড্রিউ। যা করতে বলা হয়েছে তাকে, সেটা করার জন্য রওয়ানা হলো বাগানের উদ্দেশে।

‘আপনাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারি?’ কর্নওয়ালিসের উদ্দেশে বললাম আমি। জানি পরে এই ব্যাপারটা নিয়ে আমার সঙ্গে রাগ করতে পারে হোথর্ন, তারপরও কৌতূহল বোধ করছি। ‘এই কেসের সঙ্গে আদৌ কোনো যোগসূত্র নেই আমার প্রশ্নটার, তারপরও জানতে ইচ্ছা করছে, জীবিকার জন্য এই কাজ বেছে নিলেন কেন।

‘মানে আন্ডারটেকার হলাম কেন, সেটাই তো জানতে চাইছেন?’ দেখে মনে হলো না, আমার প্রশ্ন শুনে বিব্রত হয়েছে কর্নওয়ালিস। ‘আসলে এই কাজ আমি বেছে নিয়েছি বলার চেয়ে, বলা ভালো, এই কাজই বেছে নিয়েছে আমাকে। দক্ষিণ কেনসিংটনে আমাদের যে-অফিস আছে, সেটার দরজায় একটা সাইনবোর্ড লাগানো আছে… দেখেছেন বোধহয়। এটা আমাদের পারিবারিক ব্যবসা। আমার মনে হয় এই ব্যবসা চালু করেছিলেন আমার দাদার দাদার দাদা, তারপর থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে এটা চলে আসছে আমাদের মধ্যে। একদিন হয়তো আমার তিন ছেলের কোনো একজন আমার থেকে বুঝে নেবে ব্যবসার দায়িত্ব।’

বাইরে অন্ধকার ঘনাচ্ছে। টবি আর সেবাস্টিয়ান তাদের বড় ভাইয়ের সঙ্গে তর্কাতর্কি করছে… বাসায় ফিরতে চাইছে না তারা, ওদিকে অ্যান্ড্রিউ চেষ্টা করছে ওদেরকে ফিরিয়ে আনতে।

কর্নওয়ালিস বলল, ‘কিছু মনে করবেন না… আর কোনো প্রশ্ন যদি জিজ্ঞেস না- করার থাকে আপনাদের, তা হলে এখন বরং আসুন আপনারা। টবি আর সেবাস্টিয়ানকে ঘুম পাড়াতে হবে।’

উঠে দাঁড়াল হোথর্ন। ‘খুব উপকার করলেন আমাদের।’

কথাটা আদৌ সত্যি কি না, সন্দেহ আছে আমার।

বারবারা বলল, ‘আপনারা যদি কিছু জানতে পারেন, তা হলে আমাদেরকে জানাবেন? বিশ্বাস করতে এখনও কষ্ট হচ্ছে আমার, খুন করা হয়েছে ড্যামিয়েন ক্যুপারকে। প্রথমে তার মা, তারপর সে। এরপর কে, সেটাই ভাবছি!’

উঠে বাগানে চলে গেল… ছেলেদেরকে ফিরিয়ে আনবে।

আমাদেরকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল কর্নওয়ালিস।

আমরা যখন শেষবিকেলের ধূসর আলোয় শানবাঁধানো ফুটপাতে বেরিয়ে এসেছি, তখন কর্নওয়ালিস বলল, ‘আপনাদেরকে আরেকটা কথা বলা উচিত বলে মনে করছি। অবশ্য… কথাটা প্রাসঙ্গিক হবে কি না বুঝতে পারছি না… ‘

‘বলুন,’ বলল হোথর্ন।

‘দু’দিন আগে একটা টেলিফোন কল এসেছিল আমার। কেউ একজন ফোন করে জানতে চেয়েছিল, কবে এবং কোথায় অনুষ্ঠিত হবে মিসেস ক্যুপারের শেষকৃত্যানুষ্ঠান। ওপ্রান্তের কণ্ঠটা ছিল একজন পুরুষের। লোকটা বলেছে, সে নাকি মিসেস ক্যুপারের বন্ধু এবং তাঁর শেষকৃত্যে যোগ দিতে চায়। আমি তখন তার নাম জানতে চাইলাম, কিন্তু সেটা বলতে অস্বীকৃতি জানাল সে। সত্যি বলতে কী… লোকটার আচরণ তখন… কী বলবো… সন্দেহজনক লেগেছিল আমার কাছে। তাকে উন্মত্ত বা বিকৃতমস্তিষ্ক বলছি না, কিন্তু তার কণ্ঠ শুনে আমার মনে হয়েছিল, প্রচণ্ড কোনো মানসিক চাপের মধ্যে আছে। নার্ভাস বলে মনে হচ্ছিল তাকে। এমনকী, কোত্থেকে ফোন করেছিল সে, সেটাও বলেনি।

‘আপনি যে ওই শেষকৃত্যের তদারকিতে আছেন, সেটা ওই লোক জানল কী করে?’

‘কথাটা আমিও ভেবেছি, মিস্টার হোথর্ন। আমার কী মনে হয়, জানেন? আমার মনে হয়, ওই লোক আমাকে ফোন করার আগে পশ্চিম লন্ডনের সমস্ত আন্ডারটেকারকে ফোন করেছে এবং তাদের সবার কাছে একই কথা জানতে চেয়েছে। আবার এমনও হতে পারে, আমাদের প্রতিষ্ঠান যেহেতু অন্য সবার চেয়ে বড় এবং একনামে-পরিচিত, সেহেতু আমাদেরকে দিয়েই শুরু করেছে খোঁজখবর। যা-হোক, আমি তখন খুব বেশিকিছু চিন্তা করিনি এই ব্যাপারে। ওই লোক যা-যা জানতে চেয়েছিল, বিস্তারিত বলে দিয়েছি। কিন্তু আজ যখন আইরিন বলল কী ভয়ানক ঘটনা ঘটে গেছে মিসেস ক্যুপারের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে, তখন মনে পড়ে গিয়েছিল রহস্যময় সেই লোকের কথা।

‘লোকটা যে-নম্বর থেকে ফোন করেছিল আপনাকে, সেটা বোধহয় নেই আপনার কাছে, না?’

‘আছে। আমাদের কাছে যতগুলো ইনকামিং কল আসে, সবগুলোর রেকর্ড রাখি আমরা। …একটা মোবাইল নম্বর থেকে আমাকে ফোন করেছিল লোকটা। নম্বরটা দেখা গিয়েছিল আমাদের সিস্টেমে।’ পকেট থেকে একটা ভাঁজকরা কাগজ বের করে হোথর্নকে দিল কর্নওয়ালিস। ‘সত্যি বলতে কী, এটা আপনাকে দেবো কি না, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলাম। আমি আসলে কাউকে কোনো ঝামেলায় ফেলতে চাই না!’

‘ব্যাপারটা দেখবো, মিস্টার কর্নওয়ালিস।’

‘হয়তো এটা কিছুই না… সময়ের অপচয় আর কী।’

‘সময় অনেক আছে আমার হাতে।’

বাসার ভিতরে ঢুকে পড়ল কর্নওয়ালিস, দরজা লাগিয়ে দিল।

ভাঁজ-করা কাগজটা খুলল হোথর্ন, দেখল কী লেখা আছে সেটাতে। তারপর হেসে ফেলল। ‘এই নম্বর আমার পরিচিত।

‘কীভাবে?’

‘জুডিথ গডউইন একটা নম্বর দিয়েছিলেন আমাকে… সে-নম্বরের সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে এটা। এই নম্বর তাঁর স্বামী অ্যালান গডউইনের।’

কাগজের টুকরোটা আগের মতো ভাঁজ করে পকেটে ঢুকিয়ে রাখল হোথর্ন। এখনও হাসছে।

ভাবখানা এমন, এ-রকম কিছু-একটা পেয়ে গেছে, যা আশা করছিল অনেকদিন ধরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *