১০. চা বাগানে এডভেঞ্চার

১০. চা বাগানে এডভেঞ্চার

ভোরবেলা গেস্টহাউসের পিছনে ছোটখাটো হইচইয়ের শব্দ শুনে বল্টুর ঘুম ভাঙল। জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখল, বানরের বাচ্চাটা যেখানে বাঁধা ছিল সেখানে খালি শেকলটা হাতে নিয়ে ইদরিস মিয়া দাঁড়িয়ে আছে। তার চেহারা উত্তেজিত। হাত-পা নেড়ে কথা বলছে। কেউ একজন তার বানরের বাচ্চা চুরি করে নিয়ে গেছে। সে জন্য সে খুব রেগে আছে। চোরকে ধরতে পারলে তার কী অবস্থা করবে সেটা সে বারবার বলে যাচ্ছিল।

বল্টু কোনো কথা না বলে পিছনে সরে এল। বোকা মানুষটা বুঝতেও পারছে না যে কেউ বানরের বাচ্চাটকে চুরি করে নি। সেটাকে ছেড়ে দিয়েছে।

সকালে যখন সবাই মিলে নাশতা করছে তখন নান্টুর আব্লু ইদরিস মিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার, ইদরিস মিয়া? সকালে খুব চেঁচামেচি শুনলাম!”

ইদরিস মিয়া বলল, “আর বলবেন না স্যার। আমার বানরের বাচ্চাটা কে যেন চুরি করে নিয়ে গেছে।”

নান্টুর আম্মু বললেন, “বানরের বাচ্চা কে চুরি করবে? এটা কি সোনাদানা? কোথায় নিয়ে রাখবে?”

ইদরিস মিয়া বলল, “ম্যাডাম, মার্কেটে বানরের অনেক দাম। আমার এটা ছিল যাকে বলে বিরল প্রজাতির বানর।”

বল্টু বলল, “কচু প্রজাতির বানর। আলকাতরা দিয়ে কালো দাগ দিয়ে রেখেছিল পিচ্চি বানরটাকে।”

“মোটেই আলকাতরার দাগ না।”

“তাহলে কলপের দাগ–”

“মোটেও না।”

“বানর কখনো ডোরাকাটা হয় না। বাংলাদেশের প্রাণী নামে আমি একটা বই পড়েছি। সেখানে সব রকমের বানরের ছবি ছিল। কোনো ডোরাকাটা বানর ছিল না সেখানে।”

ইদরিস মিয়া উদাস ভঙ্গি করে বলল, “আল্লাহর দুনিয়ায় কত কিসিমের জানোয়ার আছে, সবগুলির কথা কি বইয়ে লিখেছে?”

নান্টু বলল, “রাতের বেলা কোনো বাঘ-ভালুক এসে বানরের বাচ্চাটাকে খেয়ে ফেলে নি তো!”

ইদরিস মিয়া বলল, “না। গলার বেল্টটা কেটেছে যন্ত্র দিয়ে। অনেক এক্সপার্ট চোর!”

বল্টু আর মুনিয়া একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। কেউ সেটা লক্ষ করল না।

.

নাশতা করে সবাই মিলে গেল চা-বাগানের শ্রমিকদের এলাকায়। সেখানে দুটি ছোট বাচ্চার সঙ্গে তাদের খাতির হয়ে গেল। ওরা তাদের সবকিছু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাল। তাদের সবচেয়ে পছন্দ হলো একটা মন্দির। ভেতরে মা-কালীর একটা মূর্তি, খুব ভয়ঙ্কর দেখতে। বল্টু আর নান্টু কখনোই এ রকম মূর্তি দেখে নি। তারা খুব অবাক হয়ে দেখল।

দুপুরে খাওয়ার পর নান্টুর আব্বু-আম্মু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য একটু বিছানায় গড়িয়ে নিলেন। ঠিক এই সময় বল্টু নান্টুকে বলল, “চলো।”

নান্টু তার আঙুল নাচাল। তার মানে “কোথায়?”

“মনে নাই? আমাদের ভাঙা বাড়িটা দেখতে যেতে হবে? ইদরিস মিয়া যেখানে আমাদের নিতে চায় নি।”

নান্টু মাথা নাড়ল। বলল, “চলো।”

বল্টু ফিসফিস করে বলল, “চাচা-চাচি যেন টের না পায়। তাহলে কিন্তু একা যেতে দেবে না। সঙ্গে ইদরিস মিয়াকে দিয়ে দেবে।”

নান্টু বলল, “ঠিক আছে।” বল্টু বলল, “দাঁড়া, আমার ব্যাগটা নিয়ে নিই।”

নান্টু আবার তার আঙুল নাচাল, যার অর্থ “তোমার ব্যাগের ভেতর কী আছে?”

বল্টু বলল, “অনেক যন্ত্রপাতি। ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর অস্ত্র।”

নান্টু আর বল্টু চুপি চুপি গেস্টহাউস থেকে বের হয়ে মাত্র রাস্তায় পা দিয়েছে, তখনই পিছন থেকে মুনিয়ার গলার আওয়াজ শুনতে পেল। “ওই নাট-বল্টু, তোমরা কোথায় যাচ্ছ একা একা?”

দুজনই দাঁড়িয়ে গেল। বলল, “ওই তো, ওদিকে।”

“ওদিকে মানে কোনদিকে?”

বল্টু হাত নেড়ে বলল, “ওই তো ওদিকে।”

মুনিয়া একটু অধৈর্য হয়ে বলল, “এদিক-ওদিক করছ কেন? ঠিক করে বলো।”

এবারে নান্টু বলল, “মানে, আমরা যাচ্ছি মানে, এই তো মানে—”

মুনিয়া রেগে বলল, “দেখ নান্টু, ঠিক করে কথা বল। তা না হলে তোকে ওই গাছের সাথে লটকে রেখে দেব।”

বল্টু বুঝতে পারল, এখন যদি ঠিক করে না বলে তাহলে তারা বিপদে পড়ে যাবে। তাই সত্যি কথাই বলে দিল, “আমরা একটা ভাঙা পোড়োবাড়ি দেখতে যাচ্ছি।”

“কী আছে ওই পোড়োবাড়িতে?”

“জানি না। মনে হয় খুব ইন্টারেস্টিং হবে?”

“কেন?”

“আমরা যখন যেতে চাইছিলাম তখন ইদরিস মিয়া আমাদের যেতে দিতে চায় নাই!”

“তাই নাকি?”

“হ্যাঁ। এ জন্যে এখন যাচ্ছি।” মুনিয়া বলল, “আম্মু আর আব্বু শুনলে কিছুতেই যেতে দেবে না।”

“চাচা-চাচিকে সে জন্যেই তো কিছু বলি নাই।”

“আমি কিন্তু বলে দেব।”

“তুমি আমাদের সাথে চলো।”

মুনিয়া কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “ঠিক আছে। তাহলে চল, আমিও দেখে আসি জায়গাটা।”

নান্টু বলল, “তাহলে তুমি আব্বু-আম্মুকে বলে দেবে না তো?”

“ঠিক আছে বলব না।”

তখন তিনজন আবার রওনা দিল। চা-বাগানের পাশ দিয়ে একটা ছোট রাস্তা। দুটো টিলার মাঝখান দিয়ে সেই রাস্তা ধরে চলে গেলে একটা শুকনো খাল। সেই শুকনো খালের উল্টোদিকে ভাঙা পোড়োবাড়ি।

তিনজন কথা বলতে বলতে ছোট রাস্তাটা ধরে হাঁটতে থাকে, দুপাশে সুন্দর চা-বাগান, তার মাঝখানে বড় বড় ছায়াগাছ। গাছে পাখি কিচিরমিচির করছে। শুনে মনে হয় ওরা বুঝি কিছু নিয়ে খুব ব্যস্ত।

বেশ খানিকক্ষণ হেঁটে তারা একটা শুকনো খাল পেল ঠিকই, কিন্তু মনে হলো এটা অন্য একটা শুকনো খাল। সেই খাল ধরে হাঁটতে হাঁটতে তারা একটা জঙ্গলের মতো জায়গায় চলে এল। নিশ্চয়ই রাস্তা ভুল করেছে। তাই তারা যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে ফিরে যেতে শুরু করল। বেশ খানিকক্ষণ হেঁটেও তারা এবারে আর আগের শুকনো খালটা খুঁজে পেল না। আবার আগের রাস্তায় গিয়ে অন্য একটা জায়গায় হাজির হলো। সেখান থেকে আবার আগের জায়গায় ফিরে আসতে গিয়ে নতুন একটা জঙ্গলে হাজির হলো। তখন তারা বুঝতে পারল, তারা হারিয়ে গেছে।

এতক্ষণ কেউ কোনো কথা বলে নাই। তারা হারিয়ে গেছে বোঝার পর নান্টু কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “এখন যদি বাঘ-ভালুক আমাদের খেয়ে ফেলে?”

মুনিয়া বলল, “ধুর গাধা। এখানে কোনো বাঘ-ভালুক নাই।”

“যদি ভূত আসে?”

“দিনের বেলা ভূত আসবে কেন?”

“একটু পরেই তো রাত হবে।”

“তার আগেই আমরা রাস্তা পেয়ে যাব।”

“যদি না পাই? যদি সারা জীবন আমাদের এখানে থাকতে হয় টারজানের মতো?”

মুনিয়া বলল, “বোকার মতো কথা বলিস না গাধা।”

বল্টু বলল, “আমার ব্যাগে কম্পাস আছে, বাইনোকুলার আছে। পেট্রল আছে, ম্যাচ আছে। দরকার হলে একটা বড় আগুন জ্বালাব। তখন কোনো বাঘ-ভালুক আমাদের কাছে আসবে না। আর আগুন দেখে মানুষেরা আমাদের কাছে চলে আসবে।”

বল্টুর কথা শুনে নান্টু একটু শান্ত হলো। বল্টু বলল, “এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। আমরা একটু হাঁটি।”

“হ্যাঁ, চলো।” মুনিয়া বলল, “এই জায়গাটাকে সেন্টার করে একেকবার একেকদিকে হাঁটি।”

বল্টু তার ব্যাগ থেকে কম্পাসটা বের করে বলল, “প্রথমে হাঁটি উত্তর দিকে।”

“ঠিক আছে।”

তারা তিনজন মাত্র কিছুদূর গেছে, ঠিক তখনই গাছের ওপর এক ধরনের হুটোপুটির শব্দ শোনা গেল। ওপরে তাকিয়ে দেখল গায়ে দাগ দেওয়া সেই বানরের বাচ্চাটা। গাছের ডালে ঝুলে ঝুলে সেটা একটা ভাল থেকে আরেকটা ডালে লাফাচ্ছে। বল্টু বলল, “আরে! আমাদের পিচ্চি বানর।”

নান্টু বলল, “এটা নাকি চুরি হয়ে গিয়েছিল?”

বন্দু বা মুনিয়া নান্টুর কাছে আসল ব্যাপারটা আর বলল না। ছোট মানুষ। কথাটা পেটে রাখতে না পারলে বিপদ হয়ে যাবে। বল্টু বলল, “চুরি হয় নাই মনে হচ্ছে। পালিয়ে গেছে।”

বানরের বাচ্চাটা মুখে নানা রকম শব্দ করে এক ডাল থেকে অন্য ডালে লাফাতে লাগল। কোনো একটা কারণে বানরের বাচ্চাটা খুব উত্তেজিত। বল্টু বানরের বাচ্চাটাকে ডাকল। বলল, “এই যে পিচ্ছি! আসো এদিকে। কী হয়েছে তোমার? এত লাফ-ঝাঁপ দিচ্ছ কেন?”

বানরের বাচ্চাটা তখন এক গাছ থেকে অন্য গাছে লাফ দিয়ে বেশ সামনে চলে গিয়ে সেখানে হুটোপুটি করতে লাগল। বল্টু বলল, “আমার মনে হয় এই পিচ্চি বানর আমাদের কোনো একটা জায়গায় নিয়ে যেতে চাইছে।”

মুনিয়া বলল, “তোমার তা-ই মনে হয়?”

“হ্যাঁ। দেখো না সামনে এসে লাফাচ্ছে।”

“চলো তাহলে যাই।”

দেখা গেল বল্টুর ধারণা সত্যি। তারা হাঁটতে শুরু করলে বানরের বাচ্চাটাও এক গাছ থেকে অন্য গাছে লাফিয়ে লাফিয়ে এগোতে থাকে। হাত-পা ছুঁড়ে চিৎকার করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে। বানরের বাচ্চার পিছু পিছু যেতে যেতে হঠাৎ করে তারা তাদের শুকনো খাল আর খালের পাশে সাদা পোড়োবাড়িটা পেয়ে যায়। কাছাকাছি একটা গাছে বসে বানরের বাচ্চাটা নানা ধরনের শব্দ করতে থাকে।

বল্টু বলল, “বানরের বাচ্চাটা আমাদের ওই ভাঙা বাসাটায় যেতে বলছে।”

মুনিয়া বলল, “হ্যাঁ। আমারও তা-ই মনে হচ্ছে।”

নান্টু বলল, “এই বাসাটায় বাঘ-ভালুক বা ভূত নাই তো?”

বল্টু বলল, “চা-বাগানে বাঘ-ভালুক থাকে না। আর ভূত বলে কিছু নাই।”

অন্য সময় হলে না এটা নিয়ে একটু তর্ক করত। কিন্তু এখন সে কিছু বলল না।

বল্টু বলল, “চলো যাই।”

মুনিয়া বলল, “চলো।”

তিনজনে শুকনো খালটা পার হয়ে সাবধানে ভাঙা বাসাটার দিকে যেতে থাকে। কাছাকাছি জঙ্গলের মতো অনেক গাছগাছালি। সেগুলোর ভেতর দিয়ে তারা কাছাকাছি হাজির হলো। একসময় বাসাটার চারপাশে দেয়াল ছিল। এখন ভেঙে গেছে। সেই ভাঙা দেয়ালের ভেতর দিয়ে তারা ঘরের সীমানার ভেতর ঢুকে গেল। বাসাটা ধ্বংসস্তূপের মতো পড়ে আছে, নানা রকম গাছপালা আর জঞ্জাল। ইদরিস মিয়ার কথা সত্যি হতেও পারে। জায়গাটা আসলেই হয়তো সাপখোপে ভরা। বানরের বাচ্চাটাকে আশপাশে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তার হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে। বাচ্চাটা এখানে আসতে ভয় পাচ্ছে। কিন্তু কারণটা কী?

তিনজন সাবধানে আরেকটু এগিয়ে গেল। ঢিবির মতো একটা জায়গায় কিছু শুকনো ডালপালার কাছাকাছি পৌঁছাতেই তারা হঠাৎ বিশাল একটা হুটোপুটির শব্দ শুনতে পেল। ভয় পেয়ে চমকে উঠে পিছনে সরে এল তিনজনেই। কোথা থেকে শব্দটা আসছে দেখার জন্য তারা ভালো করে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখল, ঢিবির মতো জায়গাটা আসলে একটা বড় খাঁচা। শুকনো ডালপালা দিয়ে খাঁচাটা ঢেকে রাখার চেষ্টা করেছে কেউ। খাঁচাটার ভেতর অনেকগুলো ছোট-বড় বানর গাদাগাদি করে ভরে রাখা। বানরগুলো এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিল। ওদের তিনজনকে দেখে হুটোপুটি শুরু করেছে। খাঁচার শিকগুলো ধরে তাদের দিকে জুলুজুলু করে তাকিয়ে কাতর এক ধরনের শব্দ করছে।

বল্টু বলল, “কতগুলো বানর, দেখেছ?”

মুনিয়া বলল, “হ্যাঁ। খাঁচার ভেতর আটকে রেখেছে।”

নান্টু বলল, “কেন?”

মুনিয়া বলল, “শুনিসনি, বানর অনেক দামে বিক্রি হয়!”

“বানর ধরে বিক্রি করে?”

“হ্যাঁ।”

“কে?”

বল্টু বলল, “নিশ্চয়ই ইদরিস মিয়া।”

মুনিয়া বলল, “কত বড় বদমাইশ!”

বানরগুলো আবার লাফ-ঝাঁপ দিয়ে চেঁচামেচি করতে থাকে। তাদের কথা কেউ বুঝতে পারে না, কিন্তু মনে হয় তারা যেন বলছে, “প্লিজ! প্লিজ, আমাদের বের করে দাও।”

বল্টু কিছুক্ষণ বানরগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “এই বানরগুলোকে ছেড়ে দিতে হবে।”

মুনিয়া বলল, “হ্যাঁ।”

তারা তিনজন আবার খাঁচাটার কাছে এগিয়ে যায়। একপাশে খাঁচার দরজা। সেখানে বিশাল একটা তালা ঝুলছে। মুনিয়া বলল, “এত বড় তালা কেমন করে খুলব?”

বল্টু কিছুক্ষণ তালাটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তালাটা তো খোলা যাবে না, কিন্তু আংটাটা কেটে ফেলতে পারি।”

“কেমন করে কাটবে?”

“আমার কাছে হ্যাঁক-স, আছে।”

নান্টু জিজ্ঞেস করল, “হ্যাক-স কী?”

বল্টু বলল, “লোহা কাটার করাত।”

বল্টু ব্যাগটা নিচে রেখে সেখান থেকে হ্যাঁকস বের করে আংটাটা কাটতে শুরু করল।

কাজটা যত সহজ মনে হচ্ছিল, আসলে মোটেও তত সহজ নয়। আংটাটা শক্ত করে ধরে রাখাই খুব কঠিন। তার মধ্যেও যতটা সম্ভব ধরে রেখে তারা করাত চালাতে থাকে। শেষ পর্যন্ত আংটাটা কাটা শেষ হয়। বল্টুর ব্যাগ থেকে একটা স্ক্রু-ড্রাইভার বের করে সেটা দিয়ে চাপ দিতেই আংটাটা একটু আলগা হয়ে গেল। সেই ফাঁকটুকু দিয়ে তালাটা বের করে এনে তারা মাত্র দরজাটা খুলেছে, ঠিক তখন একটা হুঙ্কার শুনতে পেল, “কে রে এইখানে?”

.

তিনজন ভয়ানক চমকে ওঠে। পিছনে তাকিয়ে দেখে, ইদরিস মিয়া আর তার পিছনে মোটামতো আরেকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটার হাতে একটা লম্বা দা। এই রকম দাকে মনে হয় কিরিচ বলে।

ইদরিস মিয়ার চোখ লাল। মুখটা কেমন যেন বাঁকা হয়ে আছে। দেখে ভয় লাগে। দাতে দাঁত ঘষে সে বলল, “সোনার চান, পিতলা ঘুঘু। তোমরা এইখানে কী করে?”

মুনিয়া কথা বলার চেষ্টা করল। বলল, “না, মানে ইয়ে–দেখলাম অনেকগুলো বানর …”

ইদরিস মিয়া ধমক দিয়ে বলল, “অনেকগুলো বানর দেখার জন্যে তোমাদের এইখানে আসতে কে বলেছে?”

“না, কেউ বলে নাই। এদিক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম …”

ইদরিস মিয়া খেঁকিয়ে উঠে বলল, “আমার সাথে রংবাজি করো? আমি কিছু বুঝি না?”

নান্টু কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “আপু, আমার ভয় করছে।”

ইদরিস মিয়া বলল, “অনেকক্ষণ পর একটা সত্যি কথা বলেছে একজন। ভয় করছে। ভয়ই করার কথা। তোমাদের জায়গায় আমি থাকলে ভয়ে আমার পেটের ভাত চাউল হয়ে যেত।”

মুনিয়া বলল, “কেন?”

“এখনো বুঝো নাই, কেন?” ইদরিস মিয়া মুখ খিঁচিয়ে বলল, “বান্দরের জন্যে তোমাদের অনেক পিরিতি তো? তাহলে সেইটাই করা যাক। তোমাদের তিনজনকে আমি এখন এই বান্দরের খাঁচায় ঢুকাব। বান্দর তো কাছে থেকে দেখো নাই। কাল সকালের মধ্যে তোমাদের কারও শরীরে ছাল-চামড়া থাকবে না।”

মুনিয়া ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কেন আমাদের বানরের খাঁচায় ঢুকাবেন?”

“তার কারণ, এইটাই তোমাদের জায়গা। বুঝেছ?”

ইদরিস মিয়া কেমন যেন হিংস্র মুখে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। বল্টু তার ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে একটা বেলুন বের করে আনে। সেটা হাতে নিয়ে বলল, “আপনি আমাদের কাছে আসবেন না। আসলে ভালো হবে না কিন্তু।”

“কেন?”

“আমার হাতে এটা কিন্তু বোমা। কাছে আসলে কিন্তু ফাটিয়ে দেব।”

ইদরিস মিয়া হঠাৎ গলা ফাটিয়ে হাসতে শুরু করে। সঙ্গের লোকটাকে দেখিয়ে বলল, “এই দেখ! বোমা! বোমা দেখেছিস?” ইদরিস মিয়া আবার হায়েনার মতো খ্যাকখ্যাক করে হাসতে হাসতে বলল, “সোনার চান! এইটা কী বোমা? অ্যাটম বোমা নাকি? আমার কাছেতো মনে হচ্ছে এইটা একটা বেলুন!”

বল্টু বলল, “এটা বোমা।”

“ঠিক আছে, দেখি তোমার বোমাটা” বলে একরকম ছোঁ মেরে সে বল্টুর হাত থেকে বোমাটা নিয়ে নিল। বলল, “ঠিক আছে, তোমার বোমাটা আমি ফাটাই, দেখি কী হয়!”

ইদরিস মিয়া বেলুনটাকে দুই হাতে চেপে ধরতেই সেটা সশব্দে ফেটে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটল। ইদরিস মিয়া আর তার সঙ্গে মানুষটি নিজেদের চোখ চেপে ধরে চিৎকার করে উঠল।

মুনিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

“বেলুনের ভেতর মরিচের গুঁড়া ভরে রেখেছিলাম। বেলুনটা ফেটে চোখে মরিচের গুঁড়া ঢুকে গেছে।”

মানুষগুলো নিজেদের চোখ চেপে ধরে ছটফট করছে। মুখে অশ্রাব্য গালি দিতে দিতে কাছে এসে তাদের ধরার চেষ্টা করল। ততক্ষণে তারা টান দিয়ে খাঁচার দরজা খুলে দিয়েছে। ইদরিস মিয়া চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। এর মধ্যেই হাত-পা ছুঁড়ে সে তাদের ধরার চেষ্টা করতে থাকল। নান্টু আর মুনিয়া সময়মতো সরে গেল। কিন্তু পিঠে বিশাল ব্যাগ থাকায় বল্টু সময়মতো সরতে পারল না, ইদরিস মিয়া তাকে ধরে ফেলল। ইদরিস মিয়া চোখে কিছু দেখছে না। এই অবস্থাতেই সে বল্টুকে নিচে ফেলে কিল-ঘুসি মারার চেষ্টা করে।

ঠিক তখনই একটা অত্যন্ত বিচিত্র ব্যাপার ঘটল। কাছাকাছি একটা গাছের ওপর থেকে গায়ে ডোরাকাটা বানরের বাচ্চাটা ইদরিস মিয়ার মুখের ওপর লাফিয়ে পড়ে তার কানটা কামড়ে ধরল। ইদরিস মিয়া চিৎকার করে বানরটাকে সরাতে চেষ্টা করে, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। খাঁচার ভেতর থেকে হুড়মুড় করে একটার পর একটা বানর বের হয়ে ইদরিস মিয়া আর অন্য মানুষটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল। তাদের নিচে ফেলে আঁচড়ে-কামড়ে যা একটা অবস্থা করতে শুরু করল তা আর বলার নয়। মুনিয়া কোনোমতে বল্টুকে টেনে তুলে বলল, “পালা এখান থেকে।”

পিছনে বানরের একটা দলের চিৎকার-চেঁচামেচি-হইচই, ইদরিস মিয়া আর তার সঙ্গের অন্য মানুষটার বিকট আর্তনাদ শুনতে শুনতে তারা ছুটে পালাতে লাগল। কোন দিক দিয়ে যাচ্ছে তারা বুঝতে পারছিল না। হঠাৎ দেখল, কয়েকজন চা-শ্রমিক গান গাইতে গাইতে যাচ্ছে। গেস্টহাউসের কথা বলতেই তারা মুনিয়া, বল্টু আর নান্টুকে গেস্ট হাউজে পৌঁছে দিল। ততক্ষণে সূর্য ডুবে গিয়ে অন্ধকার নেমে এসেছে।

নান্টুর আব্বু-আম্মুকে বিষয়টা বোঝানোর সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু মানুষ লাঠিসোটা ও টর্চলাইট নিয়ে খালের পাড়ে সাদা বাড়ির দিকে রওনা দিল। ইদরিস মিয়া আর তার সঙ্গীরা বানরের হাত থেকে উদ্ধার পেয়ে ততক্ষণে অবশ্য নিজেরাই হাতড়ে হাতড়ে ফিরে আসার চেষ্টা করছে। মরিচের গুঁড়ার কারণে চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। বানরের আঁচড়ে-কামড়ে সারা দেহ রক্তাক্ত। জামা-কাপড় ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো হয়ে গেছে। ইদরিস মিয়ার কানের লতির খানিকটা অংশ বানরেরা কামড়ে ছিঁড়ে ফেলেছে। তার ওপর। ওদের রাগ মনে হয় সবচেয়ে বেশি!

খবর পেয়ে চা-বাগানের ম্যানেজার ছুটে এলেন। দৌড়াদৌড়ি করে ইদরিস মিয়া আর তার সঙ্গীকে হাসপাতালে পাঠালেন।

.

১১. শেষ কথা

পরদিন ভোরে বাসায় ফিরে যাওয়ার জন্য যখন মাইক্রোবোসে জিনিসপত্র ভোলা হচ্ছে, তখন হঠাৎ গাছের ডালে একটু হুটোপুটির শব্দ শুনে বল্টু ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখে, বানরের বাচ্চাটা একটা ছোট ডাল ধরে ঝুল খেয়ে মুখে বিচিত্র শব্দ করছে।

বল্টু বলল, “দেখো,দেখো, পিচ্চি বানরটা এসেছে।”

মুনিয়া বলল, “আমরা চলে যাচ্ছি তো, তাই আমাদের গুডবাই বলতে এসেছে।”

বল্টু একটু এগিয়ে গিয়ে বানরের বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলল, “খুব সাবধানে থাকবি কিন্তু। কেউ যেন আর তোকে ধরতে না পারে। ধরতে পারলে কিন্তু তোর খবর আছে!”

বানরের বাচ্চাটা কী বুঝল কে জানে। হঠাৎ গাছ থেকে নেমে বল্টুর কাছে সাবধানে এগিয়ে এল। তার পা ধরে দাঁড়িয়ে বল্টুর দিকে তাকাল। বল্টু সাবধানে বানরের বাচ্চাটা কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “আমরা কিন্তু চলে যাচ্ছি। তোকে যদি ধরে, আমরা কিন্তু আর তোকে বাঁচাতে পারব না। কাজেই সাবধান!”।

বানরের বাচ্চাটা হাত নেড়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করল। বল্টু মাথা নেড়ে বলল, “ভালো থাকিস। দুষ্টুমি করবি না। যদি তোদের স্কুল থাকে, স্কুলে যাবি। লেখাপড়া করবি। ঠিক আছে?”

বানরের বাচ্চাটা কোল থেকে নেমে আবার গাছে উঠে ডাল ধরে ঝাঁকাতে থাকল। তখন সবাই অবাক হয়ে দেখল, আশপাশের গাছগুলোতে অসংখ্য বানর নিঃশব্দে বসে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

মুনিয়া বলল, “দেখেছ, বানরগুলো আমাদের গুডবাই বলতে এসেছে!”

নান্টু বলল, “আমরা ওদের ছেড়ে দিয়েছিলাম, সে জন্যে! তাই না, আপু?”

মুনিয়া বলল, “হ্যাঁ।”

তাদের মাইক্রোবাসটা যখন চা-বাগানের কাঁচা রাস্তা দিয়ে আস্তে আস্তে যেতে শুরু করল, তখন বানরগুলোও কাছাকাছি গাছের সারির ভেতর দিয়ে তাদের সঙ্গে সঙ্গে আসতে লাগল। সবার আগে বানরের বাচ্চাটি। যখন তারা বড় রাস্তায় উঠে গেল, তখন বানরগুলো থামল।

মাইক্রোবাসটা যখন চলে যাচ্ছে তখন তারা পিছন ফিরে দেখল, বানরগুলো একটা গাছে বসে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

মুনিয়া বলল, “আহা! দেখেছ, বানরগুলো কত সুইট!”

নান্টু বলল, “আসলে আমার বানর হয়েই জন্ম নেওয়া উচিত ছিল।”

.

কেউ লক্ষ করল না, বল্টু খুব সাবধানে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ দুটো মুছে নিল। তার চোখে কেন পানি এসেছে, কে জানে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *