১০. চার দিন ধরে মতিন সাহেব

গত চার দিন ধরে মতিন সাহেব দোতলায় আমার সঙ্গে আছেন। এই চার দিন সারাক্ষণই তিনি আমার সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে আছেন। আমি বাজারে যাচ্ছি।–তিনি সঙ্গে যাচ্ছেন। আমি ইজাবুদ্দিন সাহেবের কাছে কাঁদেরের খোঁজে যাচ্ছি, তিনি আছেন। আজকেও বেরুবার জন্যে কাপড় পরছি, দেখি তিনিও কাপড় পারছেন।

আমি থমথমে স্বরে বললাম, কোথায় যাচ্ছেন আপনি?

আপনার সঙ্গে যাচ্ছি।

আজ আমি একটা বিশেষ কাজে যাচ্ছি। আপনি আমার সঙ্গে যাচ্ছেন না।

মতিনউদ্দিন সাহেব অত্যন্ত অবাক হলেন, সে কি, আমি এক-একা থাকব কীভাবে!

যে-ভাবেই থাকেন থাকবেন।

তাঁকে রেখেই আমি বের হয়ে এলাম। এই লোকটি দিনে দিনে অসহ্য হয়ে উঠছে। এখন মনে হচ্ছে, সঙ্গে টাকা পয়সা নেই। আমার কাছে সেদিন একটি মিনোন্টা এস এল আর ক্যামেরা বিক্রি করতে চাইলেন। আমি বললাম, আপনার টাকা পয়সা নেই নাকি?

কিছু আছে। যা নিয়ে এসেছিলাম, খরচ হয়ে যাচ্ছে।

কাজটাজ কিছু দেখেন।

কী দেখিব বলেন? ইউনিভার্সিটিতে কোনো পোস্ট এডভ্যাটাইজ করছে না। মাস্টারী ছাড়া আর কিছু তো করতেও পারব না আমি।

আত্মীয়স্বজন কে কে আছে আপনার?

আত্মীয়স্বজন কেউ নেই।

কেউ নেই মানে! এক জন বড়ো ভাই তো আছেন জানি। গাড়ি করে আপনাকে নিয়ে যাওয়ার যার কথা ছিল।

ও রকিব ভাই, সে অনেক দূরসম্পর্কের আত্মীয়। তাছাড়া আমাকে সে পছন্দও করে না।

নীলুরাও তো শুনেছি আপনার আত্মীয়া, ওদের সঙ্গে চলে গেলেন না কেন?

মতিনউদ্দিন সাহেব ইতস্তত করে বললেন, ওরা আমাকে এখন আর পছন্দ করে না। বিলুর ধারণা আমার মাথা খারাপ। দেখেন তো অবস্থা! তবু আমি যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু নীলু। খুব রাগ করল।

মতিনউদ্দিন সাহেবকে এক ঘরে রেখেই আমি চলে এলাম। সারাক্ষণ কাউকে গাদাবোটের মতো টেনে বেড়ানর কোনো অর্থ হয় না। বাইরে বেরিয়ে আবার আমার খারাপ লাগতে লাগল। সঙ্গে নিয়ে এলেই হত। রাস্তার মোড় পর্যন্ত এসে থমকে দাঁড়ালাম, ফিরে গিয়ে ডেকে নিয়ে আসব? ঠিক তখনি কে যেন ডাকল, ও ছোড उठाई, e cহাष्ट उठाহুঁ।

চমকে তাকিয়ে দেখি, কাদের মিয়া। রিকশা করে আসছে। চোখ কোটরাগত, কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে আছে।

এই কাদের, এই।

রিকশা ভাড়াডা দেন ছোড ভাই।

কখন ছাড়া পেলি?

এক ঘণ্টার মতো হইব। বালা আছেন ছোড ভাই? আজিজ সাব আর নেজাম সাবে বালা?

তুই ভালো?

মতিনউদ্দিন সাবের শইলড কেমন?

বলতে বলতে কাদের মিয়া হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। সেই রিকশায় করেই কাদেরকে ঘরে নিয়ে এলাম।

ছোড ভাই, পেটে ভূখ লাগছে, চাইরডা ভাত খাওন দরকার।

তুই চুপচাপ বসে থাক। আমি ভাত বসাচ্ছি। শুয়ে থাকবি?

জ্বি-না।

ঘরে ঘি আছে। গরম গরম ভাত খাবি ঘি দিয়ে। রাত্ৰে মতিনউদ্দিন সাহেব রানা করবে। খুব ভালো রাধে।

কাদের বসে বসে ঝিমুতে লাগল। সে কোথায় ছিল, কেমন ছিল–আমি কিছুই জিজ্ঞেস করলাম না।

ছোড ভাই, নিচতলাটা দেখলাম খালি।

ওরা দেশের বাড়িতে চলে গেছে।

বালা করছে, খুব বালা কাম করছে।

ভাত খেতে পারল না। কাদের। খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করে উঠে পড়ল।

কিছুই তো মুখে দিলি না, এই কাদের।

শইলডা জুইত নাই ছোড ভাই।

শুয়ে থাক, আরাম করে শুয়ে থাক। ভয়ের কিছু নেই।

সন্ধ্যার পর থেকে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হল। এবং যথারীতি কারেন্ট চলে গিয়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে পড়ল। তাকিয়ে দেখি হারিকেন জ্বালিয়ে মতিনউদ্দিন সাহেব নেজাম সাহেবের ঘর থেকে বেরুচ্ছেন। এতক্ষণ সেখানেই বসে ছিলেন। আমার তাঁর কথা মনেই হয় নি। আমাকে দেখেই একগাল হেসে বললেন, ঝড়-বৃষ্টির রাতে মিলিটারি বের হবে না। আরাম করে ঘুমান যাবে। ঠিক না শফিক সাহেব?

এই বলেই কাদেরের দিকে তাঁর চোখ পড়ল। ভীতস্বরে বললেন, মরে গেছে নাকি?

না, মরে নি।

আসছে কখন?

বিকালে।

আপনি আমাকে খবর দেন নি কেন? কেন আমাকে খবর দেন নি?

মতিন সাহেব বড়োই রেগে গেলেন। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, তার চোখমুখ লাল হয়ে উঠেছে।

আমাকে কেউ মানুষ বলে মনে করে না। যখন কাদেরকে ধরে নিয়ে গেছে, তখনো কেউ আমাকে বলে নি। আমি জেনেছি। এক দিন পরে। কেন আপনার আমার সঙ্গে এ-রকম করেন? আমি কী করেছি?

হৈ-চৈ শুনে কাদের জেগে উঠল। মতিনউদ্দিন সাহেব হঠাৎ অত্যন্ত নরম স্বরে বললেন, তোমার জন্যে আমি খুব চিন্তা করেছি। কাদের। হয়রত শাহজালাল সাহেবের দরগাতে সিন্নি মানত করেছি।

অ্যাপনের শইলড) বাংলা?

আমার শরীর বেশি ভালো না কদের। রাত্রে ঘুম হয় না। কিন্তু তোমার পায়ে কী হয়েছে? ভেঙে ফেলেছে নাকি?

মা, ভাঙে নাই!

বললেই হয়, ভাঙে নি? নিশ্চয়ই ভেঙেছে। পায়ে কোনো সেন্স আছে? চিমটি দিলে বুঝতে পোর?

জ্বি, পারি।

মতিনউদ্দিন সাহেব খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তুমি রাজাকারে ভর্তি হয়ে যাও কাদের মিয়া। তাহলে মিলিটারি তোমাকে কিছু করবে না। ভয়ডর থাকবে না, আরাম করে ঘুমাতে পারবে। যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারবে। নব্বুই টাকা বেতন পাবে, তার সঙ্গে খোরাকি। ভালো ব্যবস্থা। ভর্তি হয়ে যাও। কালকেই যাও।

আমি অনেকক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম মতিন সাহেবকে। লোকটির বয়স হঠাৎ করে যেন অনেক বেড়ে গেছে। অনিদ্রার জন্যে চোখের নিচে গাঢ় হয়ে কালি পড়েছে। মোটাসোটা থাকায় আগে যেমন সুখী—সুখী লাগত, এখন লাগে না। কেমন উদভ্ৰান্ত চোখের দৃষ্টি। সমস্ত চেহারাটাই কেমন যেন রুক্ষ।

মতিন সাহেব সেই রাত্রে আমাকে খুবই বিরক্ত করলেন। একটা চিঠি লিখছিলাম। তিনি পেছন থেকে বারবার সেই চিঠি পড়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। আমি রাগী গলায় বললাম, কী করছেন এই সব!

দেখছি মিলিটারির বিরুদ্ধে কিছু লিখেছেন। কিনা। চিঠি এখন সেন্সার হয়। আপনার লেখার জন্যে শেষে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে।

আপনার ভয় নেই, মিলিটারির বিরুদ্ধে কিছু লিখছি না।

কী লিখেছেন, পড়ে শোনান।

আপনি ঘুমাতে চেষ্টা করেন মতিন সাহেব।

রাত্রে তো আমি ঘুমাই না। তার উপর আজকে আধার ইলেকট্রিসিটি নেই। মিলিটারির জন্যে খুব সুবিধা।

মতিন সাহেব।

জ্বি

আপনি দয়া করে আপনার ঘরে যান তো।

কেন, আমি থাকলে কী হয়? আমি তো আর আপনাকে বিরক্ত করছি না। বসে আছি চুপচাপ।

বহু কষ্টে রাগ থামালাম আমি। নেজাম সাহেব কবে যে ফিরবেন, আর কবে যে এই গ্রহের হাত থেকে বাঁচিব কে জানে? মতিন সাহেব হঠাৎ উঠে জানালা বন্ধ

করতে লাগলেন।

জানালা খোলা থাকলে অনেক দূর থেকে আলো দেখা যায়। এত রাত পর্যন্ত আলো জ্বালা খুব সন্দেহজনক।

গরমে সিদ্ধ হয়ে মরণব মতিন সাহেব।

গরম কোথায়, হারেকোনটা নিভিয়ে দেন। দেখবেন শীত–শীত লাগবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *