পরের দিন সকাল থেকেই চারদিকে ঝকঝকে রোদ। আবহাওয়ার যেমন, কোর্ট চত্বরেরও থমথমে ভাবও কেটে গেছে। বারিক বুড়ো তার বইপত্তর সাজিয়ে নিয়ে বসেছে। আজ সবার আগে চত্বরে মজমা মিলাবে মোসলেম উদ্দিন। এই কদিনে প্রকৃতিতে যেমন ময়লা আবর্জনা, মানুষের জামা কাপড়েও তাই। ফলে, তার পক্ষে এই নিয়ে একটা সহজ ভাষণ দিয়ে কাপড় কাঁচার পাউডার বিক্রির এখন মোক্ষম সময়। তাই তো হওয়া উচিত। তাছাড়া, আজগরের শরীর সবে সেরেছে, সে বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। তার নাস্তা খেয়ে আসতে আসতে একটু সময় লাগে। ইব্রাহিম শেখ কাল আসেনি, আজ আসলেও আসবে একটু দেরি করে। তাহলে সুকুমার আসরে নামবে মোসলেম উদ্দিনের পর পর। তাই সই। এই হিসেব।
এদিকে অন্যান্য যে সব খবরে চত্বর চনমনে, তা যেমন সবাই জানে, জানে বারিক আর মোসলেম উদ্দিনও। টাইপিস্টদের চত্বরেও তা নিয়ে আলাপ। এমনকি দিলদারও খবরাখবর এনেছে কিছু। তাতে সবার উৎকণ্ঠিত ভাব কিছুটা কম। আজ সকালেই আটক নেতাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। হক আর মোজাম্মেল উকিল আজ কোর্টে না আসলেও তাদের সহকর্মীরা তাদের পক্ষে কোর্টে উঠবে। এদিকে ছাত্ররা আজ আর মিছিল বের করেনি এখনও, যতদূর জানা গেছে তারা তা করেবে না। নয়টা নাগাদ কলেজ স্টেশনে ট্রেন থেমেছে। স্টেশন মাস্টার তাদের জানিয়েছে, এখন থেকে মেইল ট্রেনও কলেজ স্টেশনে দাঁড়াবে। ছাত্রদের দাবি বলে কথা।
কিছুক্ষণ আগে খবর এসেছে, তাতে সবাই আনন্দিত, আপাতত ট্রেন তুলে নেওয়া হবে না।
এ নিয়েও আলমের চায়ের দোকান, বারের সামনের পানের দোকান, সবখানেই আলাদা আলাদা হিসেব। যে যাই বলুক ট্রেন আর কোনওদিনও আগের মতন চলবে না। এখন কোনওদিন ষাটগম্বুজ স্টেশনে এসে ট্রেন পড়ে যাবে। কোনওদিন সকালের ট্রেন সময়মতো অফিসে ধরার জন্যে রূপসা স্টেশনে গিয়ে পৌঁছবে না। কোনওদিন লাইনচ্যুত হয়ে সারাদিনের ট্রেন বসে থাকবে। এরপর একসময়, আবার বাস মালিকদের চাপে সত্যি সত্যি ট্রেন তুলে নেওয়া হবে।
যদিও এই সবই ভবিষ্যতের কথা। এখন সে হিসেব মিলিয়ে কোনও লাভ নেই। এখনকার হিসেব এখনকার মতো। এখন যে ট্রেন ছেড়েছে, তাতে তাদের মতো ক্যানভাসারদের পেটের ভাত থাকল। কোর্ট কাঁচারি আপাতত আর বন্ধ হবে না। বারিক প্রতিদিন সকালে এসে বসতে পারবে। পাউডার বিক্রি করে, বাজার সদাই শেষ করে আগামী দিনের জন্যে পাউডার বানানোর জিনিসপত্তর কিনতে পারবে মোসলেম উদ্দিন। আলেকজানের কয়দিন কোনও কাজ ছিল না। মোসলেমের পাউডার বেচার কোনও সুযোগ নেই তো আলেকজানের হাতে কাজ থাকে কী করে।
তাহলে, এই কদিন বাদে, এখন মোসলেম উদ্দিন আবার প্রস্তুত। একটু বাদে নামবে সে। এর আগে চা খেয়ে এসেছে। মুখে দিয়েছে পান। একটা বিড়ি ধরানোর কথা ভেবেছিল, ধরায়নি। বিড়ির অত নেশা নেই মোসলেমের। কথা বলতে বলতে শ্বাস ঘন হয়ে এলে কখনও সখনও একটা দুটো টান দেয়। তা শুধু অনেকদিনের অভ্যাসের একটা দুটো টান কখনও কখনও চাঙা করে মোসলেম উদ্দিনকে।
ঘাড়ের বোচকা বাম হাতে নামিয়ে, ডান হাতে আকারে খুবই ছোটো ডুগডুগিটা বাজাতে বাজাতে মোসলেম লাঠিখানায় ভর দিয়ে চত্বরে দাঁড়াল। ফকফকে সাদা লুঙ্গি সাদা পাঞ্জাবি শার্ট আর যত্ন করে কাটা ও আচড়ানো দাড়িতে আজ মোসলেমকে লাগছে বেশ। সুকুমার সে কথা বারিক বুড়োকে বলল। বারিক জানাল, শুধু পা-খানা যা খোঁড়া, ল্যাংচে হাঁটে, তাছাড়া আরও বছর দশেক। আগে এই মোসলেমের দেখতে যা লাগত! সে সময়ে তারা দেখেছে। জামা কাপড়ে ওর চেয়ে ফিটফাট কোনও কোনও লোক আছে নাকি এই এলাকায়!
মোসলেমের জমায়েতে লোক হয়েছে। এই কয়দিন এমন মজমা মেলেনি, আজ এমনিতেই পাবলিকের আগ্রহ যেন একটু বেশি। তাছাড়া, গত কদিনের আবহাওয়া আর শহরের সমস্ত পরিস্থিতি নিয়ে একটা ছোটোখাটো ভাষণও সে দিল। সঙ্গে মফিজ শেখের কবিতার দুটো পঙক্তি। অবাক হল মোসলেম, তাদের নদীর ওপারের কেশবপুর ইস্কুলের সেই মাস্টার মশাইরা আজ তারে দেখলে নিশ্চয়ই খুশি হতেন। জীবনে বেশির ভাগ দিন সে কবিতা মুখস্থ করা নিয়ে মার খেত, আর আজ এমনিতে তার জ্ঞাতি ভাই মফিজ শেখের লেখা একটা কবিতার দুটো লাইন সে গড়গড় করে বলে দিতে পারল। আসলে এ সবই পেটের ব্যাপার। মানুষ আটকানোর জন্যে মাথাও কত সহজে কাজ করে। একেবারে সরাসরি প্রয়োজনীয় কাজ।
এই সময়ে বানর দুটো নিয়ে চত্বরের দিকে আসে আজগর। মোসলেম উদ্দিন তখন মজমায় একটা পুরনো ন্যাকড়া আর একটা পাঁচ টাকা কাদায় চটকে চলেছে। নীচে ইট দিয়ে কাৎ করে রাখছে গামলাটা! সেখানে কিছু পানি দিয়ে পাউডার ছেড়ে দিয়েছে। পানির ঘটিটা একটু আগে বারিক মোসলেম উদ্দিনের কাছে রেখে এসেছে। আজগরের মোসলেম কাজের দিকে খেয়াল দেয়ার দরকার নেই। মজমায় মোসলেম যেখানে বসেছে, ও জায়গায় একটু ফাঁক। বাকি অংশে মানুষ গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়ানো। আজগরের মুখে হাসি। সুকুমার আর বারিকের দিকে সেই হাসিমুখে তাকাল সে। তার মানে আজ মানুষজন ভালোই।
বারিককে বলে, ও কা, দেইচো, তোমার দোস্ত মজমা মিলাইচে কী ফাইন!
তুইও মিলে, তোরে মানা করতিচে কেডা?
মেলাবানে। আইজকে বান্দর দুইটে কথা শুনলি হয়।
তোর বান্দরে যদি তোর কতা না শোনে, তালি শোনবে কার কতা?”
বোজলা কাকা, এই চ্যাটের আজগরের কতা এই দুনিয়ায় কেউ শোনে না। না শোনে বান্দর দুইটে, না শোনে জরি–
জরিনাদি আবার কী করল? সুকুমার জানতে চায়।
এই যে জরিনার পার্টির লোক একজন পাওয়া গেইচে। এদেশে পার্টি আর একটা বাড়ল!
কেন হইচে কী পার্টি কোতায়?
এই যে হাসিনার পার্টির লোক আমলিগ, খালেদার পার্টির লোক বিএমপি আর জরিনার পার্টির লোক সুকুমার! হা হা হা। উঁচু গলায় হেসে সুকুমারের উদ্দেশে আজগর আরও যোগ করল, চোদ্দনা, সংসার তো করলি না বিটি মানুষ নিয়ে, ও বালের বুজবি কী?
সময় নেই অসময় নেই এমন খাপছাড়া কথা বলার স্বভাব আজগরের। সবই রঙ্গ করে বলা। কিন্তু একথায় হঠাৎ মন খারাপ হল সুকুমারের। ঝিলিকের কথা মনে পড়ল। সংসার তারা করেনি ঠিকই, কিন্তু ঝিলিককে পেয়ে সংসারের কথা মাথায় এসেছিল সুকুমারের। মনে হয়েছিল, যদি থাকে তো ঝিলিক থাক তার সঙ্গে, কোনওদিন যদি একঘরের নীচে একখানে, একখানা চালে মাথা গুঁজে জীবন কাটিয়ে দেয়া যেত। কিন্তু কোথায় কী? কোত্থেকে উড়ে এসেছিল, হঠাৎ আবার চলেও গেল। আসলে ঝিলিকের জীবনটা বরবাদ করে দিয়ে গেছে তার মামাতো ভাই। সুকুমার বিড়বিড় করে, ভক্তদা আসলে কোনও মানুষ না। একেবারে অমানুষের বাসা। কিন্তু সেই ভক্তদার কাছেই যাবার জন্যে একপায়ে খাড়া হইচে ঝিলিক!
আজগর এরপরই বারিকের সঙ্গে রঙ্গ তামাশা করতে শুরু করে। তার মানে এই কয়দিন একটানা শুয়ে থেকে, একটু নিয়ম মেনে আর কামার পট্টির পিছনের জল গলায় না ঢালায় আজগর বেশ সেরে উঠেছে। ভাবখানা চনমনে। আসলে পকেটে টান। অসুখ-বিসুখ। এইসব মিলে ও জায়গায় যাবার সুযোগ ঘটেনি। আর নয়, ওখানে না-যাওয়ার পাবলিক না আজগর। যেতই যে কোনওভাবে ওখানে।
বারিকের সঙ্গে ওই রঙ্গের ফাঁকে যখন সুকুমারের ওভাবে ঝিলিকের কথা মনে পড়েছে, যেন সেই ভাবনায় তার আর ছেদ না পড়ে, তাই সে রাস্তার পাশের কোনার পান-সিগারেটের দোকানের দিকে যায়। আর ভাবে, আচ্ছা গেল তো মেজো বউ! হ্যাঁ, ঝিলিককে এখনও সে মেজ বউয়ের ছাড়া ভাবতে পারে না। আসলে ঝিলিকও কি তাকে দেবরের বাইরে আর কিছু ভেবেছে? তাদের এক সঙ্গে থাকা নিয়ে ঝিলিকের ভিতরে কোনও দোটানা সে দেখেনি। কিন্তু তারপরও সে চলে গেল।
এখন সুকুমারের দোটানা। একটু পরে সে নামবে। মোসলেম উদ্দিনের প্রায় শেষ, তার আগে এখন এইভাবে ঝিলিকের কথা মনে আসছে কেন? মনে করছে শুধু সে, যে গেছে, সে তো তাকে মনে করছে না। কিন্তু এই যে গেল, জীবনে গেছে কোনওদিন ফুলতলা। খুলনা তারপর দৌলতপুর তারপর ফুলতলা। যদি সেখানে ওই মহিলারে না-পায়। যদি সেখানে ঝিলিকের কোনও অনিষ্ট হয়। কোন বুঝে যে গেল। চারপাশে কত কিছু শোনে। সুকুমার একলাই শোনে নাকি, এমন কথা সবাই শোনে জানে। তার উপর আবার ব্ল্যাকে শাড়ি বিক্রি করা মহিলা। আইজ বাগেরহাট কাল খুলনা পরশু যশোর, তারপরদিন সাতক্ষীরা তা বাদে মাগুরা ঝিনেদা। কোথায় যে যায় আর কোথায় যে যায় না, তার ঠিক আছে। কোথায় কোথায় ঠেলা খায়, কে জানে। কোথায় কী করে কে জানে। সেই চক্করের হাতে পড়ল মেজো বউ!
সুকুমার এক খেলা দেখানো মানুষ, সাতঘাট চরে বেড়ানো মানুষ, কিন্তু তার ভিতরে এক অদ্ভুত সারল্য আছে। সে তুলনায় জীবনভর এই জায়গায় কাটানো আজগর অনেক বেশি সেয়ানা। আর ইব্রাহিম শেখ তো তাকে বেচতে পারে। তা পারবেই, ইব্রাহিমের মতন কথায় ওস্তাদ লোক সে দেখেছে কয়জন। ইব্রাহিমের এখানে ওখানে যেতে হয়, তার ওই ওস্তাদি থাকা স্বাভাবিক, সালসা বেচতে হলে, ওইটুকু ওস্তাদি লাগেই। তবে এর বাইরে, সুকুমার যতটুকু ঘাগু হতে পারত তা নয়। হওয়া সম্ভবও নয় তার পক্ষে, ফুটবল খেলত, সেখান থেকে এই খেলা দেখানোয় এসেছে। অতশত মানুষ চেনা তার হয়নি। ফলে, ভিতরে ভিতরে ঝিলিককে নিয়ে তার আতঙ্ক কাটে না। কিন্তু একটু বাদে, এইমাত্র হাতে নেয়া ছোট্ট ডুগডুগিটা বাজিয়ে আসরে নামবে সে, তার কি এখন ঝিলিককে নিয়ে এভাবে চিন্তিত হওয়া চলে।
তবু, এখন একটু আনমনা, উদাসী সুকুমারের সাথ ছাড়ছে না ঝিলিক। কোথায় গেল। ফুলতলায় ওইসমস্ত মানুষজনের চেনে কিছু। কোনওদিন গেছে ও জায়গায়? জীবনে কোনওদিন সুখ পাইল না, এখন যদি আবার একটা কিছু হয়ে যায়? দেখা গেলে যশোর নিয়ে খারাপ পাড়ায় বেচে দিল। এখনও তো গায়ে কিছু মাংস আছে ঝিলিকের। খারাপ পাড়ায় একবার ঢোকলে আর কোনওদিন ওই জায়গা দিয়ে বের হতে পারবে না। তাহলে এই জীবন গেছে মেজো বউর! এই জীবনে কোনওদিন তাহলে ভরতরে আর দেখা হইচে! তার ভরত থাকপে কোথায় আর সে থাকপে কোথায়।
পানের দোকান পর্যন্ত যেতে যেতে সুকুমার এই সমস্ত ভাবে। একবার ভাবে আজই, পারলে এখনওই চলে যায় ফুলতার দিকে। কিন্তু, ফুলতালার কোথায় গিয়ে খোঁজবে? শুধু ওই মহিলার সঙ্গে ঝিলিকের কথায় কথায় জেনেছিল, ফুলতলা বাজারে দোকান আছে ওই মহিলার ভাইর। স্বামী ওই জায়গায় কোন একটা আড়তে কাজ করে। অথচ নাম জানে না, কিছু জানে না, এইভাবে ফুলতলায় সে কারে খুঁজে বের করবে? এ নিয়ে সুকুমারের দোটানা। সে জানে না কী করবে। নাম ধাম ঠিকুজি কুলজি কিছুই না জানা মানুষকে কীভাবে পাওয়া যাবে। আর ওই মহিলাকে না পেলে কোথায় ঝিলিক!
একটা সিগারেট ধরিয়ে বারিকের গাছতলার দিকে আসে সুকুমার। চত্বরের দিকে তাকায়। মোসলেম উদ্দিনের আসর প্রায় শেষের দিকে। গাছতলায় আজগরের পাশে জরিনা এসেছে। তার পাশে গোলাপ মিয়া। গলায় ঝোলানো কান পরিষ্কার করার যন্ত্রপাতি। কয়েকদিন বাদে গোলাপ মিয়ার সঙ্গে দেখা হল। সে এখন তক্কে তক্কে আছে মোসলেমের আসরটা ভাঙলে কোনও কান পরিষ্কারের কোনও খদ্দের পায় কি না। গোলাপ মিয়ার গায়ের জামাটা খুব ময়লা। সুকুমারের একবার বলতে মন চাইল, মোসলেম কাকার কাছ থেকে এক প্যাকেট পাউটার নিয়ে সে জামাটা ধুইলে পারে। নদীর জল এখন কী পরিষ্কার। যদিও এই জলে বেশ লবণ, কাপড় কাচলেও যেন খুব ভালো পরিষ্কার হয় না। মোসলেম উদ্দিন তার ক্যানভাসের জন্যে আনে সাপ্লাই কলের জল, চাপ কলের জল কখনও আনে না। তাতে নাকি ময়লা ছাড়ালেও একটা লালচে ভাব থেকে যায়। বলে, ওই পানিতে আয়রন! তা আয়রণ হোক আর নদীর পানিতে লোনাই হোক, গোলাপ মিয়া তো জামাডা এট্টু কাচলি পারে। এইরম জামা কাপড় নিয়ে মানুষের ধারে কান খোঁচানের জন্যি গোলাপের এট্টু লাজও করে না?
এখন সুকুমারের মাথা থেকে ঝিলিক খানিকক্ষণের জন্যে উধাও, সেখানে গোলাপ মিয়া। সিগারেট ধোঁয়া উড়িয়ে মোসলেম উদ্দিনের আর কতক্ষণ লাগবে তা দেখতে দেখতে যখন সে বারিকসহ সবার বেশ কাছাকাছি, তখন আজগরের পাশে হাঁটুমুড়ে বসা জরিনা বলে, ওই দেখি সুকুমার ভাইডি!
আজগরের জন্যে এটা কোনও সংবাদই নয়, সুকুমার এতক্ষণ এখানেই ছিল। সে জরিনাকে জানায়, তা কী হইচে। ওতো এইহেনেই ছেল!
আমি ভাবলাম, গলা নামায় জরিনা। এমনভাবে বলে যেন শুধু আজগরই শোনে, চইলে গেইচে নিকি?
যাবে কোয়ানে? মোসলেম কাকা উঠলিই ও নামবে।
সেইয়ে? আইজকে তুমি নামবা না?
যাবানে একবার। যাই, মোসলেম কার শেষ। বান্দর দুইটের ধারদে এট্টু ঘুইরে আসি।
আজগর উঠে খাড়াখাড়ি মাঠ পাড়ি দিয়ে ট্রেজারির দিকে যায়। সুকুমার এগোয় সদ্য ভঙ্গুর জমাতের দিকে। প্যান্টের পকেট থেকে বের করে ছোট্টো ডুগডুগিটা বাজায়। গোলাপ মিয়াকে বলে গিয়েছিল, সে মজমা মিলানোর পর পরই যেন তার বাক্স-বোচকা ওখানে রেখে আসে।
মোসলেমের আসর ভাঙতে না ভাঙতেই সুকুমার সেখানে আসায় আসরটা তেমন ভাঙল না। এতে বারিকে মুখে হাসি। তাদের দিকে আগুয়ান মোসলেমকে বলল, আইজ মনে হয়, পাবলিক থাকপে।
সুকুমারের খেল দেকতি তো থাকপেই।
হ্যাঁ, সুকুমার পকেট থেকে একটা ডিমবল অর্থাৎ টেবিল টেনিস খেলার বল বের করেছে। দুই আঙুলের মাঝখানে ওই একটা বলকে রেখে তা এমনভাবে সবার সামনে ঘুরাল যেন চারটা বল। তারপর আরও দুটো বল পকেটে থেকে বের করে। তা গিলে ফেলল, মুখ হা করল, মুখে নেই সে বল, তারপর আবার প্রত্যেকটি এক এক করে হাতে নিয়ে এল। এবার এই চারটি বল আঙুলগুলোর ফাঁকে রেখে ঘুরাতে ঘুরাতে ক্রমে একটি বলে রূপান্তরিত করল।
আসরের সমবেত জনতার হাতে তালি। আজ সত্যি সুকুমার জমিয়ে তুলছে। এতক্ষণে গোলাপ মিয়া সুকুমারের পাশে তার মালপত্র রেখে এসেছে। আর সেগুলো খুলতে খুলতে, ভিতর থেকে কোনও কিছু হাতড়ে বের করার আগে, একবারে ইব্রাহিম শেখের ভঙ্গিতে সমবেত জনতার উদ্দেশে সে বলে যেত নাগল, এই কয়দিনের অস্থিরতা, প্রাকৃতিক অনিশ্চয়তার পরে আপনাদের সামনে। এসেছি। আজ আপনারাও এসেছেন আমার সামনে। এই কোর্ট চত্বরে। একটি শতবর্ষী বৃক্ষের নীচে আমাদের আজকের প্রদর্শনী। আপনারা না থাকলে আমাদের পেটে ভাত আসে না। আবার আমরা–এলে এইটুকু আনন্দ বিনোদনও থাকে না। মামলা মোকদ্দমা কাজিয়া বিবাদ ফ্যাসাদ নিয়ে এইযোনে এসে এইটুকু আনন্দ নিয়েই ফিরে যাওয়া।
সুকুমার দম নেয়। বোচকা থেকে বের করে তিনটে টেনিস বল। কিন্তু তার মনে হচ্ছে আগের কথার আরও খানিকটা বলা দরকার। মানুষ আঠার মতন তার মজমায় লেগে আছে। জমায়েত ছোট হয়ে কাছে আসছে। তার খেলা দেখানোর জন্যে বৃত্ত একটু বড় হলেই ভালো। তাতে এরপর যখন ফুটবল পায়ে দিয়ে করসত দেখাবে সে, তখন তাতে সুবিধা হবে।
সুকুমার বলে চলে, এইখানে আনন্দ নিয়ে, চক্ষু দুটো ভরে এই খেলা দেখে, আমাকে দুটো পয়সা দিয়ে বাড়িঘরে ফিরে মা ভাই বোন বউ ছেলে মেয়েকে বলতে পারবেন, আজ খেলা দেখেছি। একটু আগে কিনলেন কাপড় কাঁচার পাউডার তাতে জামা কাপড় সাদা হবে আর খেলা দেখলে মন সাদা হবে। আনন্দ হবে। কী হবে না? জোরে বলেন?”
মোসলেম উদ্দিন বানর নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসা আজগরকে বলে, এই ছেমড়াও দেখি কতা জানে। শিহিছে কোহানদে? দেকতি মনে কয় নরম।
শিহিছে ইব্রাহিমের কতা শুইনে।
সুকুমার টেনিস বলগুলো একহাতে ধরে। একটা বাঁ হাতে নেয়। আবার বাম হাত ডান হাত করে। তারপর ডান হাতেরটা একটু উপরে ছুঁড়ে দিতে দিতে সমবেত জনতার একদিকে যায়। তাতে বৃত্ত বড় হয় ফিরে এসে গাছতলার দিকে দাঁড়িয়ে টেনিস বলটা একটু বেশি ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে বাম হাত থেকে আর একটা নিয়ে একই সময়ে উপরে দেয়। উপরেরটা হাতে আসতে আসতে আবার ছেড়ে পরেরটা তখন হাতে আসে। এরপর বাঁ হাতের বাকিটা। তিনটে বল এভাবে তার হাতে একই সঙ্গে উপরে নীচে হতে থাকে। জনতা তালি দেয়।
হাতের এমন আর একটা খেলাও দেখায়। ছোটো মুগুর সাইজের তিনটে কাঠির। তারপর পকেট থেকে একটা রাবারের বল বের করে সেটা তালুতে রেখে আবার উধাও করে দেয়। তালুতে আছে, তালুতে নেই। এমনকি একটা দিশলাইয়ের বাকসো এমনভাবে ঘোরায় হাতে। এই তালুতে আছে সেটা, পর মুহূর্তে নেই। আবার জনতার তালি।
এবার বোচকা থেকে ফুটবল বের করে সুকুমার। বের করার আগেই একপ্রস্ত করতালি। বোঝা গেল, সুকুমারের এই খেলায় জনতার উৎসাহের শেষ নেই। তারা টিভিতে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখে। ম্যারাদোনার পায়ের জাদুর কথা তাদের জানা আছে। স্টেডিয়ামে খেলা হলে এদের অনেকেই দেখতে যায়, টিকেট কাটতে না-পারলে পাশের গাছে উঠে দেখে। এখন তাদের সামনে বাইশ জনের খেলা না-হোক, একজন ফুটবল নিয়ে পায়ের জাদু দেখাবে।
সুকুমার বলটা হাতে নিয়েই বোঝে পাম্প একটু কম। এ কয়দিন খেলা না দেখানোয় বলটা একদিনও বের করে দেখা হয়নি। দেখা দরকার ছিল। যা হোক, এখন স্বাভাবিকের চেয়ে একটু জোরে লাথি দিতে হবে। সুকুমার মাথায় বলটা রাখে। সেখানে কয়েকবার উঠিয়ে নামিয়ে তারপর ঘাড়ের কাছে আনে। ঘাড় থেকে নিজের শরীর দ্রুত এক পাশে সরিয়ে আনে ডান পায়ে। ডান পায়ে থেকে বাম পায়ে। হাঁটুতে, হাঁটু দিয়ে খোঁচা দিয়ে আবার পায়ে। সেখান থেকে উরুতে। দুই উরুতে বার কয়েক নাচিয়ে আবার ঘাড়ে, ঘাড় থেকে সোজা ডান পায়ে। সেখান থেকে মাথায়।
জনতার তালি থামে না। সুকুমার বলটা মাথা থেকে দুই হাতে জড়িয়ে চুমু খায়। জনতার করতালি। টাকা পয়সা পড়ে কিছু। কেউ কেউ এসে সুকুমারের হাতে দেয়। সুকুমার বৃত্তাকারে যারা দাঁড়ানো তাদের কাছে যায়। তারা তার হাতে দেয়।
এই ব্যাপারটা একটু অকস্মাই ঘটে। এরপর অন্য আর কোনও খেলা সে দেখাবে কি না, মজমার জনতা তার জন্যে আর অপেক্ষাই করেনি। তারা ধরে নিয়েছে, এটাই সুকুমারের দেখানো শেষ খেলা। তাই যেন তাকে খেলা দেখানোর বকশিস হিসেবে এই আয়োজন।
সুকুমারও বলে, যাবেন না আপনারা। এরপর ল্যাঙেড়া পাহাড়ের বুড়া তুড়া নিয়ে আসতেছে একজন। দেখবেন বান্দরের খেইল।
এতে কাজ হল। আবার হল না। যারা বানর খেলা দেখবে তারা থাকল, যারা আজগরের বানর নাচানো দেখতে দেখতে অভ্যস্ত তারা চলে গেল।
সুকুমার ফিরল বারিকের গাছতলায়। তখনও সেখানে মোসলেম উদ্দিন আছে। আছে গোলাপ মিয়া আর জরিনাও। আজগর ডুগডুগি বাজাতে বাজাতে বানর দুটো নিয়ে এগিয়ে গেছে। যদিও এখন ফির সুকুমারের আসরের তুলনায় পাতলা।
সুকুমার কাছে আসতেই মোসলেম উদ্দিন বলেন, দেহালি আইজ, জন্মের ফাইন।
জরিনাও তাই বলে। কিন্তু মোসলেম সঙ্গে আরও বলে, তা এত কথা তুই শিকলি কোয়ানদে? খেলা যেরাম দেহাইচিস। কথাও কইচিস সেইরাম। বলে, মোসলেম বারিকেরও অনুমোদন চায়। তারা একটু আগে এই কথা আলোচনা করছিল। বারিক তার প্রায় মুদে থাকা চোখজোড়া খুলে অনুমোদন দিল ঠোঁটে লাগানো হাসিতে।
গোপালা মিয়া বলল, চা খাওয়াও। কামাইচো তো মন্দ না?
জরিনা বলে, যাবেনে, আগে বান্দর নাচানোর মজমাডা এট্টু শেষ হোক। বলে মোসলেম উদ্দিনের দিকে তাকাল। এখন মোসলেম যা বলবে তাই হবে।
সে সুকুমারের দিকে একটা আচা দিয়ে ঢাকা দেয়া ঘটিটা এগিয়ে দিয়ে বলে, নে, পানি খা। পানি খা। গলাটলা এহেবারে শুকোইয়ে গেইচে তোর। কতা কতিচিস যেন হাঁসের ছাও।
তা সত্যি, কদিন বাদে এতটা উঁচু গলায় কথা বলে সুকুমারের গলা থেকে আর স্বর বেরুচ্ছে না। এমনকি রোদের এই তীব্র তাপে এখন চোখেও আর দেকছে না কিছুই। একটু চা খেতে পারলে হত। কিন্তু আজগরের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।
একটু পরেই আজগর আসে। আজগরের আসর তেমন জমেনি। আসলে আজগর এখনও শরীরের তা যেমন পায়নি, একইসঙ্গে তার বানর দুটোই যে এই কদিনের জড়তায় খানিকটা জড়। আজগর আজ মর্দাটাকে মজমার মাঝখানেই দুটো পিটান লাগিয়েছে। তাতে অবশ্য কিছুটা কাজ হয়েছিল, কিন্তু আজগর নিজেই তেমন জুত পাচ্ছিল না।
ফিরে এসে আজগর বলে, আইজ সেরাম মজমা হল না।
মোসলেম উদ্দিন বলে, বাদ দে, আইজ যা পাইচিস্ এই কত। এদিকের অবস্থা এই। তারপর নিজে উঠিল জ্বরদে। শরীর জুতের না থাকলি কোনও কিছুই জমে না বাবাজি। এট্টু শরীরের দিকে খেয়াল দে এহোন, আর ওই কামারপট্টির পিছনে যাইস নে। গেলিও এট্টু কমাইয়ে যা।
জরিনা বলে, এই বিলে না কইয়ে, হাতের ওই লাঠিখান দিয়ে কলি পারেন?
সুকুমার বলে, বাদ দেন, চলেন চা খাই।
চা খাওয়ার জন্যে তারা আলমের চায়ের দোকানের দিকে যায়। দিলদার তাদের সঙ্গে রওনা দিয়েও গেল না। মোসলেম উদ্দিন তার কাছে জানতে চাইল, এ নাটাই, তুই যাবি না?”
দিলদার কিছু বলল না। আজগর তাকে বানর দুটো দেখিয়ে বলল, ও দুটোকে দেখতে। তখন অবশ্য দিলদার বলে, বারিক দুদু দেকপেনে।
আলমের দোকানে আজ বেশ ভিড়। স্বাভাবিক এই ভিড়। গত কদিন কোনও ভিড় ছিল না, যা ছিল তা অস্বাভাবিক। এর ভিতরে এখন চায়ের অর্ডার দিয়ে কখন সে চা পাওয়া যাবে কে জানে। দুপুর গড়িয়ে গেছে। মোসলেমের পেটে খিদে। সেই সকালে বেরিয়েছে। আজ আর বাজারে যাবে না। পাউডার বানানোর মতো জিনিসপত্তর আলেকজানের কাছে এখনও মজুদ আছে। সে বলে, নদীর পাড়ে চল, দেহি ছাত্তারের দোকানের চা পাই নিকি?
ডাকবাংলোর সামনে দিয়ে ছাত্তারের দোকানে গিয়ে তারা চা খায়। সুকুমার দুটো দাগঅলা কলা ছিঁড়ে জরিনার হাতে দেয়। তার আগে ছাত্তারকে জানায়, এই কলার দাম অর্ধেক। সুকুমার বানরের জন্যে কলা কিনছে দেখে আজগর বলে, আইজকে কামাই মনে কয় খারাপ হইনি, না?
মোসলেম উদ্দিন বলে, যে খেলা দেখাইচে! তুই পারবি ভাইডি। লাইগে থাহিস। তোর পেটে ভাত হবে।
সেয়া হত, জরিনা বলে, কিন্তুক কতদিন লাইসে থাহে, সেইয়ে দেহার।
কেন?”
ঝিলিক বুন্ডি কইচে, ওর কোনওতায় বেশিদিন লাইগে থাহে না।
কইচে তোমারে? সুকুমার বলে।
কইচে না। বেড়া মানুষ সব একপদ। জানা আছে আমাগে।
আজগর চার গোলাস মুখের কাছে নিয়ে সুকুমারকে দেখে। এইমাত্র ঝিলিকের কথা বলায় সে একটু আনমনা হল। কী হত, যদি এখন জরিনা এই কথা না বলত।
হইচে, তোরা ক তোগো ফাও কতা, আমি গেলাম। মোসলেম উদ্দিন পকেটে হাত দেয়। পকেটে হাত দেয়ার আগেও তার ফিনফিনে জামার পকেটে দশ টাকা খানা উঁকি দিতে দেখা গেছে। অবশ্য সুকুমার তাকে মানা করে। কিন্তু মোসলেম শোনে না। ছাত্তারকে চায়ের দাম আর আজগরের বানরের জন্যে দুটো দাগঅলা কলার দাম দেয়। তারপর তার লাঠিখানা হাতে নিয়ে লেংচে লেংচে চলে।
হাঁটায় একটা ছন্দ আছে মোসলেম উদ্দিনের। এই ছন্দটা না-থাকলে হয়তো খোঁড়া মানুষটা এভাবে হাঁটতে পারত না। সুকুমার দেখে। সারাটা জীবন এই করে কাটিয়ে দিল। কারও প্রতি অভিযোগ নেই, অনুযোগ নেই এমন একটা মানুষ। একথা বলে এই চত্বরের সবাই। আর বেশভূষা কী অসাধারণ। কোনওভাবেই মনে হবে না, এই লোকটা জামা কাপড় ধোয়ার পাউডার বিক্রির ক্যানভাস করে!
দুপুরের দিকেও নদীর পাড়ে এই রকম হাওয়া আসে, যেন কোনও দিনও একথা জানা ছিল না সুকুমারের! এই দুপুরের রোদের ভিতরে এমন হাওয়ায় মন উদাস হয়। এত গরম, তার ভিতরে এ হাওয়ায় মুহূর্তখানেকের স্বস্তি! এই যে এল, এরপর আবার হয়তো অনেকক্ষণ আসবে না। না আসুক, এইটুকু সময়ে তাকে যেভাবে এই জায়গা থেকে উড়িয়ে ফুলতলায় নিয়ে গেল, তা কি জানে?
আজগর বলে, কী হল?
জরিনা হাসে, বোজো না, কারে মনে পড়িচে।
সুকুমার জানতে চায়, উত্তরে এই নদী গেইচে কোন কোন দিক- হাত বাম দিয়ে উত্তর দিকে দেখায়।
আজগর বলে, আমি বিষ্টুপুরের পর আর যাই নিই উত্তরে। তয় নদী গেইচে খুলনা। এডা তো ভৈরব, আমরা কই দড়াটানা। যাইয়ে খুলনায় রূপসার সাথে মিলিছে। তার আরও উত্তরে দৌলতপুর ফুলতলা নওয়াপাড়া যশোর- আজগর তার কথা বলে যেতে থাকে। খেয়াল নেই, সুকুমার একসময় খুলনাতেই ছিল।
কেন, এই নদী বাইয়ে কোনও দিকে যাবা নিকি? জরিনা ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে সুকুমারকে বলে।
সুকুমার একবার জরিনাকে দেখে তারপর নদী দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। তাতে তার হয়তো রূপান্তর হয়। সেখান থেকে হঠাৎ চোখ ফিরিয়ে বলে, চলো, খাইয়ে নিই। দুপুর হইচে কহোন। সেইয়ের পর শরীরে জুত পালি রেলস্টেশনে যাইয়ে আর একবার খেলা দেহাবানে সন্ধ্যার আগে।
আজগর উৎসাহ দেয়, এডা কাজের কতা কইচিস, সেইয়ে কর।
তুমি যাবা নাকি?
নারে, আমার শরীরের সে গতি নেই।
জরিনা হাসে, উনি এহোন ওনার খোপে জরিনার কোলে মাতা দিয়ে শুইয়ে থাকপে। আর কবে উনি নবাব সিরাজ আমি আলেয়া। চেটের নবাব আমার। শালার ফাও চাইল গেল না কোনও কালে?
আজগর মুখ ছোটায়, ওরে সাউয়ো আমার, তুই কোন বাল ছিঁড়ে আটি বান্দিস?
দেহিচ্ছো সুকুমার ভাই, এরে এট্টু রসের কথা কলিও কীভাবে মুখ খারাপ করে।
বাদ দেও। চলো, আলতাফের হোটেলে যাই। আচ্ছা, আমার মালপত্তর রইচে বারিক খুড়োর ওই জায়গায়–
পাঁচটা পর্যন্ত কোনও সমস্যা নেই। বারিক আছে। তার আগে গেলি আলতাফের ওই জায়গায় খবর পাঠাবে নে।
একটু আগে জরিনা যা বলেছে, তাই ঘটল। খাওয়ার পরে একটা বিড়ি ধরিয়ে টানতে টানতে নিজের ঝুপড়ির পর্যন্ত এসে সেই কাজই করল আজগর। বাইরের দিকে বসা জরিনা, তার কোলে মাথা দিয়ে সে তন্দ্রা গেল। বিড়িটা শেষ হওয়ার আগেই চোখ জুড়িয়ে গেছে। মাথার কাছে দাঁড়ানো সুকুমারের বিড়ি তখনও শেষ হয়নি। জরিনা বলল, ঘুমোইয়ে গেলি বান্দর দুইটে নিয়ে আসপো।
আমি তালি কোর্টের দিকে যাই।
এক সাথে যাবানে। এহোন যাও আলতাফের উপরে যাইয়ে এট্টু চোখ বোজো।
দিনে চোখে ঘুম আসে না আমার। যাইয়ে বারিক খুড়োর ওই জায়গায় এট্টু বইসে থাইহে তারপর যাব রেল স্টেশন। ততক্ষণে বেলা পইড়ে আসপেনে।
জরিনা হাতের ইশারায় সুকুমারকে তার কাছে বসতে বলে। গলা নামায়। একটু ফিসফিসিয়ে সরে বলে, তোমাগো মদ্যি হইচে কী?
কী হবে?
ঝিলিক বুন্ডি চইলে গেল?
ছওয়ালরে দেকিত ইচ্ছে করে।
তুমি এট্টা বাদাইয়ে দিলি পারতা?
আমার নেই চাউল-চুলো। আর মামাতো ভাইর থুইয়ে যাওয়া বউ–
হইচে। মাইয়ে মানুষ যার সাতে থাহে তার। ওই মুনিগঞ্জ কালীবাড়ি যাইয়ে কপালে এট্টু সিন্দুর ছোঁয়াইয়ে লইয়ে আসলি হত, বাল কও নিকি?
জরিনাদি, হয় না ওভাবে।
হওয়ানোর ইচ্ছে থাকলি হয়।
তা হয়। কিন্তু আমাগো সে সুযোগ হয়নি।
হবে নে। যাও, মানুষটারে ফিরোইয়ে নিয়ে আসো।
সুকুমারের মুখের দিকে তাকিয়ে ঈষৎ হেসে জরিনা কথাটা বলল, সে কথায় দাবিও আছে। সুকুমার তখন পন্টুনের দিকে তাকানো। নদীর জল নেমে যাচ্ছে। বড়ো স্থির এই জল। আজকে যে গরম, এখন একবার ডুব দিয়ে এসে সে জরিনাকে স্থির মাথায় বলতে পারত, কী করবে। কিন্তু তা যাবে না।
জরিনা আবার জানতে চায়, কী যাবা? কী মায়া ওই মুখোনে। তোমার উপর কত দরদ।
জানি।
কও দেহি, আর কিছু ঘটিচে নিকি তোমাগো ভিতরে?
না, ঘটিনি।
ওই যে মোড়েলগঞ্জ গেল?
সে তো বাড়িঘরের খোঁজ নিতি। যে জন্যি গেইল, তাতে আমার সাতে কী?
চলো। কোর্টের দিক যাই। ঘুমোইয়ে গেইচে।
কোর্টের দিকে হাঁটতে হাঁটতে জরিনা জানতে চায়, আলতাফের ধারদেনা শোধ করিচো?”
হু।
ওই লোকের জন্যি তোমার কতডি টাকা বাইরোইয়ে গেল। ঋণ যে কবে সে শোধ করব?
ফাও কতা কইয়ে না, কাইলকে যদি আমার হয়? ওই রম অকম্মা হইয়ে থাহি?
কোর্ট চত্বর প্রায় ফাঁকা। বারিক তার বইপত্তর একটু আগেই গোছাতে শুরু করেছে। উলটো দিকে কোর্ট বিল্ডিংয়ের বারান্দার সিঁড়িতে বসে ঝিমোচ্ছে গোলাপ মিয়া। দাঁত তোলার সলেমান খাঁ নেই তার বাক্সর সামনে। শুধু টাইপিস্টদের বড়ো ঘরটার সামনে বসে আছে দিলদার। জরিনার দিকে চেয়ে হেসেছে। জরিনা দেখেনি। সুকুমার এমনি হাত নাড়ল। তারপর বারিককে বলল, কী খুড়ো, আইজকে আগে আগে?
আরে বাপু, যে গরম পড়িছে, মানুষ থাহে?
তোমার এই গাছতলায় কী ঠান্ডা, ওই জায়গায় এট্টু শুইয়ে নিলি পারো?
গাছতলায় ঘুম আসে না আমার।
সুকুমার তার মালপত্তর নিয়ে মেইন রোডের দিকে আসে। একটা রিকশার জন্যে অপেক্ষা করে। জরিনার কেন যেন মনে হয়, সুকুমার ঝিলিককে খুঁজতে যাবে। আবার সুকুমারেরও কেন যেন মনে হয়, জরিনা এখনও তাই চায়। সেই জন্যে তাকে বিদায় দিতে দাঁড়িয়ে আছে।
রিকসায় উঠে সুকুমার বলে, সন্ধ্যার বাদে লাস্ট ট্রেন ছাইড়ে গেলিই চইলে আসতিচি।
আচ্ছা। কিন্তু ভাইবে দেহো, তারে ফিরোইয়ে আনবা নিকি?
সুকুমার একটু উদাস। যেন কথা অন্য দিকে নিতে পারলে ভালো। সে ঝিলিকের হাতের দিকে তাকিয়ে বলে, কলা দুইটে আনলা না যে?
ভুইলে গেইচি। বান্দরঅলার মাথার ধারে রইচে। এহোন ওই দুইটের ওইহেনদে নিয়ে আইসে তারপর দেবানে।
সুকুমার রিকশাঅলার পিঠে আলত খোঁচা দেয়। তখনও জরিনা সুকুমারের দিকেই তাকিয়ে আছে। ওই কথা আবারও বলে, ভাইবে দেইহো
পিছন ফেরে সুকুমার, আচ্ছা।
জরিনা কোর্ট চত্বরে ঢুকছে। দিলদার বারিকের দোকানের কাছে দাঁড়িয়ে। আর কিছু দেখা গেল না। রিকশা কাজী নজরুল ইসলাম রোড হয়ে রেল রোডে পড়বে একটু পর।
…
রেল স্টেশনের চত্বরে, লেকের পাড় ঘেঁষে সুকুমারের খেলা দেখানো শেষ হওয়ার পর দিনের আলো আর প্রায় নেই। মালপত্তর গুছিয়ে সে লেকের পাড়ে বসে থাকে। তারপর এক কাপ চা খেয়েছে। পাশের ভাতের হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে। ট্রেনটা তখন ইঞ্জিন জুড়ে দিয়ে বার দুই হুইসেল দিয়েছে। সুকুমার জানে ট্রেন ছাড়তে আরও কিছুক্ষণ বাকি আছে। লেকের পাড়ে হাঁটুমুড়ে বসে সে ভাবে, লঞ্চঘাটে যাবে নাকি আজগর আর জরিনার কাছে, নাকি উঠে বসবে ট্রেনে। মেজো বউ ফুলতায় যেখানে গেছে, গেছে তো ঠিকঠাক? এখন গেলে সে আজ রাতে ফুলতলা পৌঁছতে পারবে? না পারুক, কাল সকালে যাবে ফুলতলা। আবার পরক্ষণেই ভাবে, না যাবে না। এখন রেল রোডের মুখে গিয়ে একটা রিকশায় উঠে চলে যাবে লঞ্চঘাটে। আজগর নিশ্চয়ই এতক্ষণে ঘুম থেকে উঠেছে।
হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় সুকুমার। মালপত্তর হাতে নেয়। সোজা স্টেশন বিল্ডিংয়ের ভিতর দিয়ে দাঁড়ার প্লাটফর্মে। আবার ভাবে, উঠবে ট্রেনে? এই ট্রেন রূপসা পৌঁছতে পৌঁছতে নটা সাড়ে নটা, ওপার গিয়ে কাল খুব ভোরে ট্রেনে অথবা বাসে যাবে ফুলতলা। ততক্ষণে মেজো বউ ওখানে থাকবে তো। তারপর ফুলতায় কাকে কোথায় কী খুঁজতে হবে তা ভাবে। তবু ট্রেনে উঠবে কি না, সেই দোটানা কাটে না তার!
ইঞ্জিনে আবারও বার দুই হুইসেল দিতেই সুকুমার আলগোছে ট্রেনে ওঠে। যেন যাবে বলেই এসেছিল, এখন কোনও দোটানার আভাস নেই। ট্রেনের ভিতরে খুব অন্ধকার। কামরা ওই কোনায় একটা লাইট জ্বলছে। তাও যেন টেমি!
সিটে বসার পর পরও সুকুমারের দোটানা কাটে না। নামবে নাকি? আবার ভাবে। একটু আগে সে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যাবেই, সেটা আবার কেটে গেছে। তার মনে হয়, নেমে যায়।
ট্রেন ছাড়ে। সুকুমার বসে থাকে। কামরায় আলো জ্বলেছে আরও দুই-একটা। প্রায় ফাঁকা কামরা।
লঞ্চঘাট থেকে শোনা যায় ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার হুইসেল। জরিনা আজগরকে বলে, সুকুমার ভাই মনে হয় চইলে গেল এই ট্রেনে।
আজগর বলে, না, আসপেনে।
জরিনা বলে, আসলি এতক্ষণ আসত। যাক, যাইয়ে যেন ঝিলিকের পায়!
এ সময় নদীর কূলজুড়ে বেশ বাতাস। আজগরের চুলে বিলি কাটতে কাটতে জরিনা বলে, মানষির মনে কত দুখ, সে যার দুখখো সেই বোঝে।
আজগর এই আধো অন্ধকারে জরিনার মুখ দেখে। একথা আগে কখনও বলেনি জরিনা!…
২০১৫-১৬