দশম পরিচ্ছেদ
চাকরি, কাজ–কাম ও ব্যবসা; উদ্যম, চেষ্টা, পরিশ্রম
চাকরি করা উত্তম কাজ, যখন তা হয় জাতির সেবা, যখন তাতে মর্যাদা ও ব্যক্তিত্ব নষ্ট না হয়। যখন জীবনধারণের সম্বল হয়ে পড়ে চাকরি, যখন সেটাকে দেশসেবা বলে মনে না হয়, তখন তা করো না। সত্য ও আইন অপেক্ষা উপরস্থ কর্মচারীকে যদি বেশী মানতে হয়, তাহলে সরে পড়। প্রভুর সামনে যদি মনের বল না থাকে, নিৰ্ভয়ে সত্য কথা বলতে না পারো, প্রয়োজন হলেই চাকরি ছেড়ে দেবার সঙ্গতি না থাকে, তাহলে বুঝবো চাকরি করার জন্য তুমি পাস করছে।
মনের স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে না পারলে তোমাতে ও পশুতে প্ৰভেদ থাকবে। না- জীবন তোমার মিথ্যা হবে। স্বাধীন হৃদয় সত্যের সেবক। কামার হও, সে-ও ভাল-নিজেকে যন্ত্র করে ফেল না।
সৎ জ্ঞানী ও মহৎ যিনি তিনি নিজেকে ব্যক্তিত্বহীন করতে ভয়ঙ্কর লজ্জা বোধ করেন— তিনি তাতে পাপ বোধ করেন।
চাকরি করে অন্যায়ভাবে পয়সা রোজগার করে ধনী হবার লোভ রাখ? তোমার চেয়ে মুদি ভাল। মুন্দির পয়সা পবিত্র।
অনেক যুবক থাকতে পারে, যারা কোন রকম একটা চাকরি সংগ্রহ করে সমাজের ভিতরে আসন প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই হলো! চুরির সাহায্যেই হোক বা অসৎ উপায় অবলম্বন করেই হোক, ক্ষতি নাই।
চরিত্র তোমার নিষ্কলঙ্ক। সামান্য কাজ করে পয়সা উপায় করে তাতে জাত যাবে না। চোর-অন্যায়ের সাহায্যে যে বাঁচতে চেষ্টা করে, তারই জাত যায়। অসৎ উপায়ে পয়সা উপার্জন করো না, মিথ্যার আশ্রয় নিও না। লোককে বিপদে ফেলে অর্থ সংগ্ৰহ করতে তুমি ঘৃণা বোধ করে!
ইউরোপের জ্ঞানীগুরু প্লেটো মিশর ভ্ৰমণকালে মাথায় করে তেল বেচে রাস্তা খরচ জোগাড় করতেন। যে কুড়ে, আসলে, ঘুষখের ও চোর, সে-ই হীন। ব্যবসা বা ছোট স্বাধীন কাজে মানুষ হীন হয় না, হীন হয় মিথ্যা, চতুরতা ও প্ৰবঞ্চনায়। পাছে জাত যায়, সম্মান নষ্ট হয়-এই ভয়ে পরের গলগ্রহ হয়ে মাসের পর মাস কাটিয়ে দিচ্ছে? সম্মান কোথায়, তা তুমি ঠিক পাওনি?
সৎ উপায়ে যে পয়সা উপার্জন করা যায়। তাতে তোমার আত্মার পতন হবে না। তোমার আত্মার পতন হবে। আলস্য ও অসাধুতায়। তোমারই স্পর্শে কাজ গৌরবময় হবে।
আমার দেশের লোক যেমন আজকাল বিলেতে যায়, এককালে তেমনি করে বিলেতের লোক গ্ৰীক ভ্ৰমণে যেতো।
বিলেত ফেরত লোককে কেউ ইট টেনে বা কুলির কাজ করে পয়সা করতে দেখেছে? বিলেতের পণ্ডিত দেশ ভ্ৰমণ দ্বারা অগাধ জ্ঞান অর্জন করেছিলগ্ৰীক-দেশ থেকে ফিরে এসে তিনি আরম্ভ করলেন এমন কাজ, যা তুমি আমি করতে লজা বোধ করবো। তাতে তাঁর জাত গিয়েছিল না। যার মধ্যে জ্ঞান ও গুণ আছে, সে কয়দিন নীচে পড়ে থাকে? লোক তাকে সম্মান করে উপরে টেনে তোলেই।
কাজে মানুষের জাত যায় না-এটা বিশ্বাস করতে হবে। কাজ হীন হয় ঐ সময় যখন কাজের ভিতর অসাধুতা প্রবেশ করে, আর কোন সময়ই নয়।
বিশ্ব-সভ্যতার এত দান তুমি ভোগ করছে—এসব কি করে হলো? হাতের সাহায্যে নয় কি? কাজ-কামকে খেলা মনে করলে চলবে না। মিন্ত্রীর হাতুড়ির আঘাত, কামারের কপালের ঘাম, কুলীর কোদালকে শ্রদ্ধার চোখে দেখো।
অনেকে বলে, তাদের জন্য কোন কাজ নাই। যে কাজই তারা করুক, যে দিকেই তারা হাঁটুক-কেবলই ব্যর্থতা। মুর্থ যারা তারাই একথা বলে। তাদের এ ব্যর্থতার জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। এই নৈরাশ্যের হা-হুতাশ তাদেরই অমনোযোগ আর কুড়েমির ফল।
ডাক্তার জনসন মাত্র কয় আনা পয়সা দিয়ে লন্ডনের মত শহরে যেতে উপস্থিত হয়েছিলেন, অথচ তিনি কারো কাছে কোন কালে হাত পাতেননি। এক বন্ধু তাঁকে এক সময় একজোড়া জুতো দিয়েছিলেন, অপমান করে তিনি জুতো পথে ফেলে দিয়েছিলেন। উদ্যম, পরিশ্রম ও চেষ্টার সামনে সব বাধাই জল হয়ে যায়। গুণ যার মধ্যে আছে, যে ব্যক্তি পরিশ্রমী, তাঁর দুঃখ নাই। জনসনকে অনেক সময় রাত্ৰিতে না খেয়ে শুয়ে থাকতে হতো, তাতে তিনি কোনদিন কষ্ট, ব্যথিত বা হতাশ হন নাই। বাধাকে চূর্ণ করে বীরপুরুষের মত তিনি যে নীতি রেখে গিয়েছেন, তা অনেক পণ্ডিতই পারবেন না।
গুণ থাকলেও চেষ্টা না করলে জগতে প্ৰতিষ্ঠা লাভ করা যায় না। আরভিং সাহেব বলেছেন, চুপ করে বসে থাকলে কাজ হবে না।
চেষ্টা কর—নাড়াচাড়া কর— এমন কি কিছু নারী ভিতর কিছু ফলাতে পারবে। কুকুরের মতো চীৎকার কার-সিংহ হয়েও ঘুমিয়ে থাকলে কি লাভ?
পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছ—তারপর মনে হচ্ছে তোমার মূল্য এক পয়সা নয়। জিজ্ঞাসা করি, কেন? জান না, এ জগতে যারা নিতান্ত আনাড়ী তারা মাসে হাজার হাজার টাকা উপায় করছে?
তোমার এই মর্মবেদনা ও দুঃখের কারণ, তুমি মুর্থ। মানুষ বালিতে সোনা ফলাতে পারে, এ তুমি বিশ্বাস করো না? তুমি কুড়ে— তোমার উদ্যম নেই— তুমি একটা আত্মপ্ৰত্যয়হীন অভাগা।
কাজ ছোট হোক বড় হোক, মন প্ৰাণ দিয়ে করবে। মূল্যহীন বন্ধুগণের লজ্জায় কাজকে ঘৃণা করো না। সকল দিকে, সকল রকমে তোমার কাজ যাতে সুন্দর হয় তার চেষ্টা করবে।
ফকস সাহেবকে এক সময়ে এক ভদ্রলোক বলেছিলেন, আপনার লেখা ভাল নয়। কাজের চারুতার প্রতি তাঁর এত নজর ছিল যে, তিনি সেই দিন হতে স্কুলের বালকের ন্যায় লেখাপড়া আরম্ভ করলেন এবং অল্পকালের মধ্যে তার লেখা চমৎকার হয়ে গেল।
উন্নতির কারণ হচ্ছে দৃষ্টি ও মনােযোগ। এক ভদ্রলোকের খানিক জমি ছিল। জমিতে লাভ তো হতোই না, বরং দিন দিন তার ক্ষতি হচ্ছিল। নিরুপায় হয়ে নামমাত্র টাকা নিয়ে তিনি এক ব্যক্তিকে জমিগুলি ইজারা দিলেন। কয়েক বছর শেষে ইজারাদার একদিন ভূ-স্বামীকে বললেন, যদি জমিগুলি বিক্রয় করেন। তাহলে আমাকেই দেবেন, আপনার কৃপায় এই কয় বছরে আমি অনেক টাকা জমা করতে সক্ষম হয়েছি। ভূ-স্বামী অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এত বছরের ভিতর যে জমিতে আমি একটা পয়সা উপায় করতে পারিনি, সেই জমি তুমি মাত্র কয়েক বছর চাষ করেই খরিদ করতে সাহস করছো? সে বললে, আপনার মতো অমনােযোগী ও বাবু আমি নই। পরিশ্রম ছাড়া আমি আর কিছুই জানি না। বেলা দশটা পর্যন্ত ঘুমানো আমার অভ্যাস নাই।
এক যুবক স্কট সাহেবের কাছে কিছু উপদেশ চেয়েছিল, যুবককে তিনি এই উপদেশটি দেন– কুড়েমি করো না, যা করবার তা এখনই আরম্ভ করো। বিশ্রাম যদি করতে হয় কাজ সেরে করবে।
সময়ের যারা সদ্ব্যবহার করে, তারা জিতবেই। সময়ই টাকা, সময় টাকার চেয়েও বেশী। জীবনকে উন্নত করো, কাজ করো, জ্ঞান অর্জন করো। চরিত্রকে ঠিক করে বসে। থেকে না! কৃপণের মতো সময়ের কাছ থেকে তোমার পাওনা বুঝে নাও। এক ঘণ্টা করে প্রতিদিন নষ্ট করো, বৎসর শেষে গুণে দেখো অবহেলায় কত কত সময় নষ্ট হয়েছে।
একঘণ্টা করে মাসে কত কাজ তোমার হয়েছে। তোমার কাজ দেখে তুমি নিজেই বিস্মিত হবে। প্রতিদিন তোমার চিস্তা একখানা কাগজে বেশী নয়, দশ লাইন করে রাখি, দেখবে, বছর শেষে তুমি একখানা সুচিস্তিত চমৎকার বই লিখে ফেলেছ। জীবনের ব্যবহার করো, দেখবে মৃত্যু তোমার কীর্তির নিশান উড়িয়ে দিয়েছে। জীবন আলস্যে, বিনা কাজে কাটিয়ে দাও, মৃত্যুকালে মনে হবে জীবনে তোমার একটা মিথ্যা অভিনয় ছাড়া আর কিছু হয় নাই—একটা সীমাহীন দুঃখ ও হাহুতশের সমষ্টি। জীবনশেষে যদি বলে, জীবনে কি করলাম? কিছু হলো না”—তাতে কি লাভ হবে? কাজের প্রারম্ভে ভেবে নাও, তুমি কোন কাজের উপযোগী, জগতে কোন কাজ করবার জন্যে তুমি তৈরী হয়েছ-কোন কাজে তোমার আত্মা তৃপ্তি লাভ করে।
সাধুতা ও সত্যের ভিতর দিয়ে যেমন উন্নতি লাভ করা যায়, এমন আর কিছুতে নয়। সত্য এবং সাধুতাকে লক্ষ্য রেখে ব্যবসা করো, তোমার উন্নতি অবশ্যম্ভাবী ৷ জুয়াচুরি করে দুদিনের জন্য তুমি লাভবান হতে পারো, সে লাভ দুদিনের। জগতে যে সমস্ত মানুষ ব্যবসায়ে উন্নতি করেছেন তাদের কাজ-কামে কখনো মিথ্যা-জুয়োচুরি ছিল না। ব্যবসা ভাল কাজ-এর ভিতর অমর্যাদার কিছু নাই। আগৌরব হয়। হীন পরাধীনতায়, মিথ্যা ও অসাধুতায়।
এক ব্যক্তি মুদি জীবনের লজ্জা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিল। মারার আগে একখানা কাগজে লিখে রেখে গিয়েছিলো—এ ইন জীবন আমার পক্ষে অসহনীয়। তাঁর মৃত্যুতে আমাদের মনে কোন দয়ার উদ্রেক হয় না। লোকটি এত হীন। ছোট ছিল যে, তার মুদি হয়ে বাঁচবার অধিকার ছিল না। কাজ-কাম বা ব্যবসাতে অগৌরব নাই। ঢাকার সুপ্ৰসিদ্ধ নবাব বংশের নাম পূর্ববঙ্গে প্ৰসিদ্ধ। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলিমউল্লা ছিলেন। একজন ব্যবসায়ী। জাতির কল্যাণ হয় ব্যবসার ভিতর দিয়ে। ব্যবসাকে যে শ্ৰদ্ধার চোখে দেখে না, সে মুর্থ। ইংরেজ জাতির এই গৌরব-গরিমার এক কারণ ব্যবসা। ব্যবসা না করলে তারা এত বড় হতে পারত না।
যে জিনিস নিজে কিনলে ঠিকেছ বলে মনে হলো, সে জিনিস ক্রেতাকে কখনও দিও না। কখনও অভিজ্ঞ ক্রেতাকে ঠকিও না। হয়ত মনে হবে তোমার লোকসান হলো, কিন্তু না— অপেক্ষা কর তোমার সাধুতা ও সুনাম ছড়াতে দাও, লোকসানের দাশগুণ এতে তোমার পকেটে ভর্তি হবে।
ব্যবসার ভিতর সাধুতা রক্ষা করে কাজ করায় অনেকখানি মনুষ্যত্বের দরকার হয়। যে ব্যবসায়ী লোভ সংবরণ করে নিজের সুনামকে বাঁচিয়ে রাখে। সে কম মহত্ত্বের পরিচয় দেয় না। মিষ্ট ও সহিষ্ণু ব্যবহার, ভদ্রতা এবং অল্পলাভের ইচ্ছা তোমার ব্যবসায়ী জীবনকে সফল করবে।
চাকরি, চাকরি-অনবরত চাকরির লোভে যুবকেরা সোনার শক্তিভরা জীবনকে দুয়ারে দুয়ারে বিড়ম্বিত করে দিচ্ছে। মিস্ত্রী, কামার, দরজী এরা কি সত্যিই নিম্নস্তরের লোক? অশিক্ষিত বলেই সভ্য সমাজে এদের স্থান নাই? যা তুমি সামান্য বলে অবহেলা করছ, তা কতখানি জ্ঞান, চিন্তা ও সাধনার ফল তা কি ভেবে দেখেছি? শিক্ষিত ব্যক্তি যে কোন কাজ করুক না কেন, তার সম্মান ও অর্থ দুই-ই লাভ হবে। আত্মার অফুরন্ত শক্তিকে মানুষের কৃপাপ্রার্থী হয়ে ব্যর্থ করে দিও না।