১০.
ঘরে ফেরায় যে এত আরাম, আগে সেভাবে টের পায়নি ভাস্কর। বাড়ির বাইরে তো অনেকবার থেকেছে। বেড়াতে গেছে, অফিসের কাজেও থাকতে হয়েছে বাইরে বাইরে, কখনও বা টানা দু’-তিন মাস, তখন কিন্তু ফিরে এলে ঠিক এমন অনুভূতি জাগেনি। ভাল হয়তো লেগেছে, তবে এ ভাল লাগার প্রকৃতি যেন অন্যরকম। যেন এই বাড়ির প্রতিটি ঘর, প্রত্যেকটি আসবাব, দরজা জানলা বালিশ বিছানা আলো পাখা টিভি, এমনকী রঙিন পরদাগুলো পর্যন্ত মুখিয়ে ছিল, দিন গুনছিল, ভাস্কর কবে আসবে। একান্ত বালিশটির ওম, বিছানার আদর, সোফার নরম আপ্যায়ন, সবই বুঝি ভাস্করের নতুন নতুন ঠেকে। মনটা তর হয়ে যায়।
দশ-দশটা দিন পরেও আমেজটা রয়ে গেছে। সকালে জলখাবার খেয়ে আজ একটা ডিভিডি চালিয়ে বসে ছিল ভাস্কর। হিন্দি সিনেমা। পুরনো দিনের মজার ছবি। পাপানের গরমের ছুটি পড়েছে, সেও সেঁটে গেছে পাশে। বাপ ছেলেতে কিশোরকুমারের উদ্ভট কাণ্ডকারখানা দেখে হেসে কুটিপাটি।
সিনেমা প্রায় শেষ, ডিভিডি’র বাক্সখানা ঘাঁটছিল ভাস্কর। দেখছিল, পরে কোনটা চালানো যায়। হঠাৎই ঘাড় তুলে জোরে জোরে নাক টানল। সঙ্গে সঙ্গে কোটরে ঢোকা চোখজোড়া চকচক। আপন মনে বলে উঠল, বেড়ে গন্ধ ছেড়েছে তো!
ওমনি পাপানের মন্তব্য, ঠাম্মা মাছ ভাজছে।
ইলিশ! ইলিশ!
বলতে বলতে ভাস্কর সোফা ছেড়ে উঠেছে। অল্প দুলে গেল মাথা, স্থির দাঁড়িয়ে সামলালো নিজেকে। উফ, কবে যে এই দুর্বলতাটুকু কাটবে! আর খুকখুকে কাশিটা!
পায়ে পায়ে ভাস্কর রান্নাঘরের দরজায় এল। বনানী কড়ায় খুন্তি নাড়ছিল, ছেলেকে দেখে হাসল মৃদু। বলল, সোহিনী আজ মাছটা ভাল এনেছে রে।
কপাট ধরে ভাস্কর বলল, সে তো ঘ্রাণেই মালুম পাচ্ছি।
ও এখন আর তত আনাড়ি নেই। মাছ মাংস আলু পটল, সবই বেশ দেখে দেখে আনে।
আমার জন্যই তো অভ্যেসটা হল। বলে যেন একটু সুখ পেল ভাস্কর। ভুরু নাচিয়ে বলল, আজ তুমি হাত লাগিয়েছ যে বড়?
সুষমাকে দিয়ে সব হয় নাকি? রোজকার ডাল-ঝোলটাই ওর আসে।
তা কী বানালে?
যা তুই পছন্দ করিস। ঝিঙে-লঙ্কা-কালোজিরে দিয়ে পাতলা ঝোল। আর কাঁটাচচ্চড়ি। দু’পিস শুধু ভেজে রাখলাম, তোর আর সোহিনীর জন্য। কড়ার মাছ ছোট প্লেটে নামিয়ে গ্যাস নে ভাল বনানী, আমার কাজ শেষ। এবার তোমরা টুকটুক করে স্নানে যাও।
দাঁড়াও, সোহিনী ফিরুক।
ডাক্তার কী বলেছে মনে নেই? ঘড়ি মেপে চলতে হবে। ঠিক সময়ে খাওয়া, ঠিক টাইমে ঘুম…। পৌনে বারোটা বাজে, কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে বারোটায় তোমায় ভাত দেব।
মা’র ছোট্ট শাসনটুকু মন্দ লাগল না ভাস্করের। আজকাল সকলেরই তার ওপর কড়া নজর। একটু অনিয়ম হল, কি হল না, ওমনি বকুনি। ভালর জন্যই বলে নিশ্চয়ই, ভাস্করের ভালই তো চাইছে সবাই। এই যে ভাস্কর খানিকটা খাড়া হয়েছে, সে তো এদেরই চেষ্টায়। ইচ্ছেশক্তির জোরে। নয় কী?
আনমনে সোফাতেই ফিরল ভাস্কর। সিনেমা শেষ হতেই কার্টুন চালিয়ে দিয়েছে পাপান। গোল্লা গোল্লা চোখে দেখছে রোডরানার শো। ভাস্করের একটু খুনসুটি করতে সাধ জাগল। টুকুস কেড়ে নিয়েছে রিমোট, পুটুস বন্ধ করল টিভি। পাপান রিমোটের জন্য ঝাঁপাতেই হাত পিছনে, চোখের ইশারায় বাথরুম দেখাচ্ছে ছেলেকে। কী আশ্চর্য, পাপান হাউমাউ জুড়ল না। একটুক্ষণ গা মোচড়াল, তারপর সুড়সুড় স্নানে গেছে।
খেলাটা জমল না, তবুও ভাস্কর খুশি। হাবভাব অনেক বদলে গেছে ছেলের। মাত্র দু’মাস বাবাকে অসুস্থ দেখে এখন সে কত বাধ্য! কী বুঝদার! সর্বদা খেয়াল রাখে, উত্তেজনা এখন বাবার জন্য ঠিক নয়। কাল তো রীতিমতো চোখ পাকিয়ে বলছিল, আর বেশিক্ষণ লুডো নয় বাবা, তোমার স্ট্রেন পড়বে! আত্মজের এই উদ্বেগটুকুও তো এখন ভাস্করের বেঁচে থাকার রসদ।
রান্নাঘর থেকে বেরিয়েছে বনানী। খাওয়ার জায়গা থেকেই গলা ওঠাল, কী রে, এখনও বসে? গেলি না স্নানে?
ভাস্কর ফিক করে হাসল, তুমি দেখছি ফেউয়ের মতো লেগে আছ!
ছেলেমানুষি করিস না বাবুন। তোর কিন্তু লেট হয়ে যাবে।
তোমার নাতি ঢুকল যে।
অ্যাই, তোদের ঘরের বাথরুম তো ফাঁকা। বনানী কাছে এসে ঠেলল ভাস্করকে। স্নেহমাখা সুরে বলল, এমন করলে তো তোরই ক্ষতি।
ওই ঠেলাটুকুতে একটা নরম আবেগও মিশে আছে যেন। ভাস্কর উঠল। ধীর পায়ে ঢুকেছে শয়নকক্ষের লাগোয়া টয়লেটে। স্নানের জায়গাটা বড্ড ছোট, হাত ছড়ালে দেওয়ালে ঠেকে যায়। খানিক জড়সড় হয়েই যেন দাঁড়াতে হয় শাওয়ারের নীচে। তবু জল গায়ে পড়তেই বিচিত্র এক সুখানুভূতি। হাসপাতালে টানা দেড় মাস স্নান হয়নি, বুক মাথা বাঁচিয়ে শুধু হাত-পা মুছিয়ে দিত। এখন প্রতিটি জলকণা যেন রোমকূপে শিহরন জাগায়। স্নানে যে এত রোমাঞ্চ, এও তো ভাস্কর এবার বাড়ি এসে জানল।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে ভাস্কর দেখল সোহিনী ফিরেছে, ব্যাগ থেকে কীসব বার করে রাখছে আলমারিতে। জিন্সের ওপর সাদা টপ পরেছে সোহিনী, পোশাকটায় সোহিনীকে কেমন বাচ্চা বাচ্চা দেখায়। চড়া রোদ থেকে ফিরল, মুখটা লালচে হয়ে আছে। ঝুঁটিবাঁধা চুল ঈযৎ এলোমেলো।
চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে মুগ্ধ নয়নে বউকে দেখছিল ভাস্কর। না তাকিয়েও ঠিক টের পেয়েছে সোহিনী। আলমারি লাগিয়ে ঝট করে তাকিয়েছে, কিছু বলবে?
না তো। ভাস্কর দ্রুত ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ…হ্যাঁ তো।
কী?
এত দেরি করলে?
কম কাজ সারলাম? টেলিফোন বিল, ইলেকট্রিক বিল… ব্যাঙ্কেও একটু দরকার ছিল…। তোমার বমির ওষুধটাও তো ফুরিয়ে গিয়েছিল…
একদিনে এত কাজ করার দরকার কী সোহিনী? তুমি তো এখন ছুটিতে। রোজই নয় একটা একটা করে…
তাতে তো তোমারই অসুবিধে।
কেন?
বা রে, তা হলে তো আমায় রোজই বাইরে বেরোতে হয়। তখন তো তুমিই কাঁদুনি গাইবে, প্রতিদিন বেরিয়ে যাচ্ছ…! তারচেয়ে একদিনেই সব সেরে এলাম, সেটা ভাল নয়?
সোহিনীর স্বর বড্ড শীতল। উঁহুঁ, সোহিনীর তো এমনই বাচনভঙ্গি। ভাব আছে, অথচ তার প্রকাশ নেই। অন্তত ভাস্করের তো সেরকমটাই মনে হয় আজকাল। নইলে ছুটি নিয়ে কি সোহিনী ঘরে বসে থাকত!
ভাস্কর হেসে বলল, আমার কাজগুলো সব একে একে তোমার ঘাড়ে চাপছে।
কী করা যাবে? তুমি তো এখন ফিট নও।
ভাস্করের বলতে ইচ্ছে হল, যতটা আনফিট ভাবছ ততটা তো আমি আর নই সোহিনী। হাঁটাচলা তো করছি। একা হয়তো নয়, তবু বাড়ির বাইরে তো যাচ্ছি। তোমরাই তো বলো, রোগটা আমার কমার পথে। এক্স-রে আর স্ক্যান রিপোর্ট অনুযায়ী, লাম্পগুলো কিছু না হোক পাঁচ ভাগের এক ভাগ তো কমেছে। নির্ভুল চিকিৎসা হলে হয়তো পুরোপুরি…। তখন তোমার কাঁধের জোয়াল আমি সরিয়ে নেব, দেখে নিয়ো।
হাসিমুখেই ভাস্কর বলল, আমার অসুখে তোমার এক্সপিরিয়েন্স কত বেড়ে গেল, সেটাও একবার ভাবো।
তা বাড়ল।
মা আজ তোমার আনা ইলিশমাছের খুব তারিফ করছিল।
ওটা মাছওয়ালার দয়া। আমায় ঠকায়নি।
কার কাছ থেকে কিনেছ বলো তো? মাছের বাজারে ঢুকে ডানদিকে যে মোটা মতন লোকটা বসে…?
সেখান থেকেই তো নিতে বলেছ। বিশ্বনাথ, না কী যেন নাম…! চুলের গার্ডার খুলে ড্রেসিংটেবিলে রাখল সোহিনী। তেরচা চোখে টাইমপিসটা দেখে নিয়ে বলল, যথেষ্ট বকবক করেছ। এবার গিয়ে খেতে বসো। আর হ্যাঁ, ইলিশমাছে তোমার অম্বল হতে পারে। খেয়ে উঠে অবশ্যই অ্যান্টাসিড খাবে।
এই সতর্কতা কি নেহাতই কেজো হতে পারে? ভাস্কর ভালবাসে বলেই না ইলিশমাছ এনেছে সোহিনী! আবার খেয়ে যাতে ভাস্করের শরীর খারাপ না হয়, সেদিকটাও মাথায় রেখেছে! দুটো ভাবনাই কি সোহিনীর অন্তরের ছবিটা ফুটিয়ে তোলে না?
মনে মনে মুচকি হেসে ভাস্কর খাওয়ার টেবিলে গেল। সেখানে তখন পাপানের সঙ্গে একটা ছোটখাটো যুদ্ধ বেধেছে বনানীর। নাতি ইলিশমাছ ছোঁবে না, ঠাকুমা তাকে চাখাবেই।
ভাস্কর চেয়ার টেনে বসে বলল, নে না ব্যাটা, একদিন টেস্ট কর।
এঁহ্, আমার গন্ধ লাগে। আমি শুধু চিকেনই খাব।
কী যে চিকেন শিখেছিস! খাসির মাংসও তো ছুঁস না!
আই হেট মাটন।
আরে ব্যাটা, দুনিয়ায় মানুষ অনেক কিছুই হেট করে। আবার ঠিকঠাক টেস্ট করলে হয়তো সেটাই ফেভারিট হয়ে যায়।
ভাস্করের এ হেন মহৎ বাণীও মাঠে মারা গেল। পাপানের কোনও হেলদোল নেই, সে ঠোঁট টিপে আছে। অগত্যা ক্ষান্ত হল বনানী। ভাস্করের ভাত বাড়ছে। গলা নামিয়ে বলল, তোকে কি চচ্চড়িটা দেব?
ভাস্কর হাত উলটে বলল, জিজ্ঞেস করার কী আছে?
না…তোর তো শাকসবজি খাওয়া বারণ… ডাক্তার তো তোকে শুধু প্রোটিন দিতে বলেছে…
ছাড়ো তো। একদিন খেলে কী এমন ক্ষতিবৃদ্ধি হবে!
খুব অল্প দিই তা হলে।
উৎসাহ নিয়েই চচ্চড়ি মুখে দিল ভাস্কর, তবে কেমন যেন গন্ধ লাগল। মাছও কেমন আঁশটে আঁশটে! বর্ষা এখনও আসেনি বলে মাছটাই কি স্বাদহীন? নাকি ভাস্করের জিভেই রুচি ফেরেনি? ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মাছ আনছে সোহিনী। কাল বড়ি-টোম্যাটো দিয়ে পাবদার ঝোলও পানসে পানসে ঠেকল। ভেটকির যা স্বাদ, তেলাপিয়ারও তাই। এমনটা চলতে থাকলে আহারের ইচ্ছেটাই হয়তো উবে যাবে।
নাহ্, ভেঙে পড়লে চলবে না। ভাস্করকে তো এই দশাটা কাটিয়ে উঠতেই হবে। কোনওক্রমে ভাতটুকু শেষ করল ভাস্কর, তাড়াতাড়ি ঘরে এসে অ্যান্টাসিড গলায় ঢালল। বমির ট্যাবলেটও গিলল একটা। বসেছে বিছানায়, বালিশে ঠেসান দিয়ে। গলাটা ফের খুশখুশ করছে। একটু কাফ সিরাপ খেয়ে নেবে নাকি?
সোহিনীর স্নান সারা। ভেজা চুল ঝাড়ছে। ভাস্করকে দেখতে দেখতে বলল, কী হল? আবার গা গুলোচ্ছে?
একটু একটু।
এইজন্যই ইলিশ কেনার আগে দশবার ভাবছিলাম। কোনও গুরুপাকই তোমার সহ্য হচ্ছে না।… কাল থেকে ফের পোনাই আনব।
চিন্তা কোরো না। সবে তো দশ দিন হল… আস্তে আস্তে তো প্রবলেমটা কমবে!
গুড থট্। এটাই বজায় রাখো। সোহিনী বিছানার ধারে এল। স্মিত মুখে বলল, এখনই শুয়ো না যেন!
ভাস্কর মিনতির সুরে বলল, একটু বোসো না কাছে!
বা রে, আমার বুঝি খিদে পায়নি?
এক মিনিট। একটু।
সোহিনীর হাতে চিরুনি। সামান্য ইতস্তত করে বসল বিছানায়।
ভাস্কর চোখ বুজেছে। ঈষৎ কাতর গলায় বলল, বুকটা বড্ড জ্বালা জ্বালা করছে। একটু হাত বুলিয়ে দেবে?
হাত বুলোলে কি জ্বালা কমে? হাত কি ওষুধ?
দাও না গো।
শুধু বুকে নয়, মাথাতেও আঙুল চালাচ্ছিল সোহিনী। আজকাল এই ধরনের আবদারে সোহিনী না করে না। কতকাল সোহিনীকে পায়নি ভাস্কর, দূরে দূরেই তো সরে থাকে। তবু এই স্পর্শে কোনও কামভাব জাগে না ভাস্করের, বরং অচেনা এক মনকেমন করা ভাল লাগায় ভরে যায় হৃদয়। এই সান্নিধ্যটুকুর জন্যই তো অনন্তকাল বেঁচে থাকার লোভ হয়।
তিন-চার মিনিট পর সোহিনীর কোমল স্বর শুনতে পেল ভাস্কর, এবার আমি যাই?
মুহূর্তের জন্য সোহিনীর হাতটা চেপে ধরল ভাস্কর, মুহূর্ত পরে ছেড়েও দিয়েছে। ফিসফিস স্বরে বলল, তুমি যা বলবে, আমি তাই মানব সোহিনী। শুধু তুমি পাশে থাকো। তা হলেই আমি ভাল হয়ে যাব।
সোহিনী উঠে যাওয়ার পর কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল ভাস্কর, সোহিনীর ডাকেই জাগল। চোখ খুলে দেখল, মাথার নীচে দুটো বালিশ নিয়ে সে দিব্যি পরিপাটি শুয়ে। কে তাকে এমন সযত্নে শোওয়াল? সোহিনী?
ভাস্কর চোখ রগড়ে উঠে বসল। বোধে আসতে তার একটু সময় লাগে এখন। বিড়বিড় করে বলল, ক’টা বাজে?
প্রায় পাঁচটা। আজ অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছ।
চা হয়ে গেছে?
বসিয়েছি। …তোমার অফিসের একজন লোক এসেছে।
কে?
নাম জিজ্ঞেস করিনি।…বুড়ো মতন। বলল, দরকারি কাজ আছে।
সামান্য ধন্দ নিয়ে ড্রয়িংহলে এসে ভাস্কর অবাক। বদ্রিপ্রসাদ! আড়ষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নামিয়ে সোফায় বসে।
ভাস্করকে দেখামাত্র বদ্রি উঠে দাঁড়িয়েছে। দু’হাত তুলে ভাস্কর বলল, আরে, বোসো বোসো। হঠাৎ তুমি?
আপনার মাইনের চেকটা নিয়ে এলাম স্যার।
ভাস্করের মনে পড়ল, অ্যাকাউন্ট্যান্ট ফোন করেছিল। বলেছিল চেকটা বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে। প্রসন্ন মুখে ভাস্কর বলল, থ্যাঙ্ক ইউ। থ্যাঙ্ক ইউ বদ্রি। দাঁড়াও, তোমায় অথোরাইজেশন লেটারটা লিখে দিই।
ও ভি বানানো আছে। কালো ফোলিওব্যাগ খুলে বাদামি খাম বার করল বদ্রি। সসম্ভ্রমে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, চৌধুরীসাহেব সব রেডি করে দিয়েছেন।
সঞ্জয় চৌধুরীর কাজ সত্যিই নিখুঁত। শুধু অধিকার প্রদানপত্রই বানায়নি, যথাস্থানে দস্তখতও করিয়ে নিয়েছে বদ্রিপ্রসাদের। পাঠিয়েছে চেকপ্রাপ্তির রসিদও। শুধু তিন জায়গায় ভাস্করের সইটুকুই যা বাকি। গত মাসেও বলতে হয়নি, হাসপাতালেই তুহিন বেরা দিয়ে গিয়েছিল চেক।
নাহ্, সহকর্মীরা ভাস্করকে সত্যিই ভালবাসে। নইলে সোহিনী কিংবা তরুণদাকে তো ছুটতে হত অফিসে।
সইগুলো সারতে সারতে ভাস্কর বলল, কেমন আছ বদ্রি?
আপনি কেমন আছেন স্যার?
দেখে কী বুঝছ?
বহুৎ দুবলা হয়ে গেছেন। বলেই তাড়াতাড়ি শুধরে নিয়েছে বদ্রি, বিমারিতে তো এমন হয়ই।
উম্। কোত্থেকে একটা বাজে রোগ ধরল! কাগজ দু’খানা বদ্রিকে ফেরত দিল ভাস্কর, চা খাবে তো?
জিজ্ঞাসার প্রয়োজন ছিল না, সোহিনী এনেছে। বদ্রির জন্য প্লেটে সন্দেশও। ভাস্কর উল্লসিত স্বরে বলল, সোহিনী, একে চিনে রাখো। অফিসে বদ্রিই আমার গার্জেন। টিফিন খেতে দেরি হলে এমন বকে…
বদ্রি জিভ কাটল, কী যে বলেন! …স্যার আমায় খুব ভালবাসেন। যখন যা চাই, স্যারের কাছে মিলে যায়। বলতে বলতে হঠাৎ বুঝি খেয়াল হয়েছে, পকেট থেকে দুটো একশো টাকার নোট বার করে বলল, রেখে দিন স্যার। আপনার কাছে উধার ছিল।
আরে, ও আর লাগবে না। তুমি রাখো।
না স্যার। আপনার এখন খরচার সময়…
ভাস্কর হেসে ফেলল। সোহিনী-তরুণদা তাকে জানাতে চায় না, তবে বন্যার মতো টাকা বেরোচ্ছে এতে তো কোনও সন্দেহ নেই। সেখানে এই সামান্য… এ তো বালির বাঁধও নয়। তবু বদ্রিকে আর জোর করতে পারল না। বাধল। স্যারের বিপদের সময়ে ফেরত দিচ্ছে… এও কি কম প্রাপ্তি?
সোহিনী বসেছে সোফায়। বলল, নিন, একটু মিষ্টি খান।
বদ্রি তবু সংকুচিত, এসবের কী দরকার ছিল ম্যাডাম?
আরে, নাও, নাও। ভাস্কর প্লেটখানা বাড়িয়ে দিল, প্রথম আমার বাড়িতে এলে…
মনটা বহুৎ খারাপ ছিল স্যার। হাসপাতালে একদিনও যেতে পারিনি… আমার হাসপাতালকে বহুৎ ডর লাগে।
ঠিক আছে রে বাবা। এসেছ তো।
বদ্রি আর কিছু বলল না। চা-সন্দেশ শেষ করল চুপচাপ। তারপর হঠাৎই হাত মুছে ফোলিওব্যাগ থেকে একটা শালপাতার ঠোঙা বার করেছে। ভাস্করকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, পরসাদ আছে স্যার। কালীমা-কা। ঠনঠনিয়ার কালীমাতা স্যার বহুৎ জাগ্রৎ। আপনার জন্য আমি কালীমার কাছে মন্নত মেনেছি, জরুর বিমারি সেরে যাবে।
প্রসাদটা কপালে ছুঁইয়ে টেবিলে রাখল ভাস্কর। বদ্রিও উঠে পড়েছে। সোহিনীকে নমস্কার করে বলল, আজ তা হলে আসি ম্যাডাম?
আবার আসবেন।
জি।…স্যার যে কবে জয়েন করবেন, অফিসে দিল্ লাগে না।
আপন মনে বলতে বলতে চলে যাচ্ছে বদ্রি। ঈষৎ কুঁজো হয়ে হাঁটছে যেন। পিছু পিছু গিয়ে সোহিনী দরজা বন্ধ করল। ফিরে মিটিমিটি হাসছে, তোমার ভক্ত হনুমানটি তো বেশ।
ভাস্কর হেসে বলল, অফিসে ওরকম আরো দু’-চার পিস আছে। মানুষটা তো আমি খারাপ নই। তুমি তো আমাকে এক্সপ্লোরই করলে না!
খুঁড়লে সোনা-হিরে মিলত বুঝি?
কে জানে, হয়তো তার চেয়েও দামি কিছু।
সোহিনীর ঠোঁটে অদ্ভুত একটা হাসি ফুটেও মিলিয়ে গেল। পরক্ষণে রসিকতা জুড়েছে, তুমি কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়েছ।
কীরকম?
যেভাবে প্রসাদ কপালে ঠেকালে… আমি তো জানতাম ঠাকুরদেবতায় তোমার বিশ্বাস নেই!
ভাস্করের হাসি নিভল। হয়তো সোহিনী ভুল বলেনি, কিন্তু এখন কেন যেন তার মনে হয়, একটু-আধটু বিশ্বাস থাকা ভাল। অবিশ্বাস-সন্দেহে কিছুই কি মেলে? বরং চোখকান বুজে ভরসা রাখতে পারলে খানিকটা বুঝি জোর পাওয়া যায়। এ কি তার মানসিক দৌর্বল্য? হতেও পারে। ভাস্কর তো এমন কিছু অতিমানব নয়, মৃত্যুর সঙ্গে দাবা খেলতে তার বুক কাঁপে বই কী। কত অজস্র ঘরের খেলা, চাল দেওয়া কি সোজা? ঈশ্বর গোছের কারওকে যদি সহযোগী হিসেবে মেলে, ক্ষতি কোথায়! তা ছাড়া এই প্রসাদ তো একজনের শুভকামনা। তাকে কেন মর্যাদা দেবে না ভাস্কর?
ঘরে মোবাইল বাজছে। সোহিনী পা চালিয়ে ধরতে গেল। দু’-এক সেকেন্ড তুম্বো মুখে বসে থেকে ভাস্কর গিয়ে দাঁড়াল ব্যালকনিতে। জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি, পড়ন্ত বেলায় এখনও সূর্যের কী ঝাঁঝ! বেশিক্ষণ তাকানো যায় না, চোখ ধাঁধিয়ে ওঠে। বাতাসও যথেষ্ট গরম। সূর্য ডুবলে নিশ্চয়ই খানিকটা ঠান্ডা হবে। তখন কি একবার বেরোবে সোহিনীর সঙ্গে? পরশুর মতো? কিছুই নয়, ধীরে ধীরে ছোট পার্কটা অবধি হেঁটে কিছুক্ষণ বসে থাকা। পাশে সোহিনী, চারপাশে এক চলমান পৃথিবী…কী যে ভাল লাগছিল! মনে হচ্ছিল, এভাবেই যদি বসে থাকা যেত সারাটা জীবন! বুড়ো হয়ে গেছে ভাস্কর, সোহিনী বুড়ি, তখনও দু’টিতে মিলে পাশাপাশি…!
অন্দর থেকে বনানীর ডাক, রোদ লেগে যাবে বাবুন, চলে আয়।
কল্পদৃশ্যটা আঁখিপাতায় নিয়ে ভাস্কর সোফায় ফিরল। দুধে প্রোটিনগুঁড়ো গুলে রেখে গেছে মা, সঙ্গে একটি ডিমসেদ্ধ। পানীয়টি মোটেই সুস্বাদু নয়, ভাস্কর গিলে নিল এক চুমুকে। মুখ ঈষৎ বিকৃত করে ডিমসেদ্ধয় কামড় দিয়েছে, অমনি স্মৃতির পলকা টোকা। কবে যেন ডিমসেদ্ধ খেতে ডাকছিল মা, ভাস্কর ভীষণ রাগ দেখাল? হাসপাতালে তো সেদ্ধ ডিম ছুঁত না। এখন কেমন সোনামুখ করে খাচ্ছে! হা হা, ভাস্কর কি পালটে গেল?
নিজেকেই নিজে কটাক্ষ হেনে ড্রয়ার টেনে ডিভিডি’র বাক্সখানা বার করল ভাস্কর। চল্লিশ-পঞ্চাশটা সিনেমা, বেশির ভাগই হিট হিন্দি ফিল্ম। ওপরের গোটা সাত-আট শুধুই হাসির। অনুপমের উপহার। প্রায়ই বিকেল-সন্ধেয় আসছে তানুপম, হাতে একটা না-একটা ডিভিডি। কেন যে আনে রোজ? ভাস্কর তো অত দেখে উঠতে পারছে না। যতই হাসিমজার ছবি হোক, টানা দু’-তিন ঘণ্টা ঠায় পরদার দিকে তাকিয়ে থাকা… ওফ্, মাথা টনটন করে। তবু অনুপম বারণ শুনলে তো। তার থিয়োরি, পুরোটা কেন দেখবি, খালি ফানি সিক্সেয়েন্সগুলো চালা! প্রাণ খুলে হাসলে বডিতে নাকি অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ে, স্বাভাবিক প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে ওঠে!
কে জানে, হতেও পারে। অনুপম নিশ্চয়ই না জেনে, না বুঝে বলছে না! ভাস্করকে চাঙ্গা করতে কতভাবেই না চেষ্টা চালাচ্ছে সবাই, তার তো উচিত যথাযোগ্য প্রতিদান দেওয়া! নাহ্, ভাস্করকে লড়তেই হবে।
ডিভিডি প্লেয়ারে একটা ইংরেজি ছবি ঢোকাল ভাস্কর। শুরু থেকেই বেদম হইহুল্লোড়। প্রতিটি দৃশ্যেই পেট গুলিয়ে হাসি আসে। ভাস্কর বেশ জমে যাচ্ছিল, সোহিনী এসেছে পাশে। পরদায় দৃষ্টি রেখেই ভাস্কর আলগোছে জিজ্ঞেস করল, তখন কার ফোন এল?
তরুণদা।
কী বলে?
মেডিকেল ইনশিয়োরেন্সের ক্লেম ফর্ম নিয়ে আসার কথা ছিল, আজ পারবে না। কোন এক উকিল নিয়ে নাকি সল্টলেকে ছোটমামার বাড়ি যাচ্ছে। কী সব উইল-টুইলের ব্যাপার।
ও। তা ক্লেম জমা দিতে দেরি হলে তোমার টাকাপয়সাও তো আটকে থাকবে।
এক দিনে আর কী তফাত? কাল হবে।
তবু…। তুমি আমার অ্যাকাউন্ট থেকে তুলে নাও না, চেক লিখে দিচ্ছি।
সে দেখা যাবেখন। সোহিনী যেন খানিক আনমনা, কাল একবার ডাক্তারের চেম্বারে যেতে হবে।
কেন?
তোমার ব্লাডের কী কী টেস্ট হবে, জেনে আসব। পরশুই করাতে দেব। সোহিনী ঘাড় ফিরিয়ে ভাস্করকে দেখল, হাতে তো বেশি সময় নেই, কামিং বৃহস্পতিবারে তো তোমার কেমো।
ভাস্কর একটু যেন নড়ে গেল। আপন মনে বলল, একটা কেমোতে কি কিছু উন্নতি হবে?
খানিকটা তো বটেই। তবে মোট ছ’টা হলে তখনই…
কেমোথেরাপি তো খুব পেনফুল। …আমি নিতে পারব, সোহিনী?
মনে জোর আনো। কঠিন অসুখের জন্য কড়া ওষুধ তো লাগবেই।
আর কোনও কথা নেই। নিজের মনে চলছে হাসির ছবি, বিচিত্র এক ঠাট্টার মতো। ভাস্করের দৃষ্টি মেঝেয়। বারান্দা দিয়ে একফালি রোদ্দুর এসে পড়েছে ঘরে। মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে।
হলুদ রশ্মিটা বুঝি চোখে লাগছিল সোহিনীর। ভুরু কুঁচকে বলল, পরদাটা টেনে দিই?
থাক না। ভাস্কর যেন নিজেকেই শোনাল, আলোটুকু আসতে দাও।
.
১১.
বিন্দু বিন্দু তরল প্রবেশ করছে কবজি দিয়ে। শিরাপথ বেয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে গোটা দেহে। মাথার পিছনে মনিটরের বিপ বিপ৷ লম্বা সরু রেখা ঢেউ খেলছে পরদায়। উঠছে, নামছে, উঠছে নামছে।
দৃশ্যটা একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল অনুপম। টমাস মুলবেরিকে মনে পড়ছে। টমাসের মতোই ভাস্কর চোখ বুজে শুয়ে। মাঝে মাঝে বিকৃত হচ্ছে। মুখ, একটু যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে ভাস্কর। ভয় থেকে? নাকি যন্ত্রণায়? টমাস তো বলত, কেমোথেরাপি চলার সময়ে তেমন ব্যথাবেদনা হয় না। তবে কি অন্য কোনও প্রতিক্রিয়া? ভাস্করের অবচেতনার?
কেবিনে নার্স ছাড়াও সাদা অ্যাপ্রনধারী এক মধ্যবয়সি। ডাক্তার নয়, ডাক্তারকে অনুপম চেনে। ফার্মাসিস্ট? যে ভাস্করের কেমোথেরাপির ডোজটা বানিয়েছে? অনুচ্চ স্বরে অনুপম লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, আর কতক্ষণ চলবে?
লোকটা ঘড়ি দেখল, তিনটে তো বাজবেই।
কখন স্টার্ট হয়েছে?
ন’টা নাগাদ।
মোট ক’টা সাইকল্ যাচ্ছে?
তিরিশটা। এখনও আরও চারটে বাকি।
কোনও প্রবলেম ডেভেলাপ করেনি তো?
নাহ্। উনি তো বেশ স্টেডিলি নিচ্ছেন।
আশা করি ভিজিটিং আওয়ারে দেখা করা যাবে!
এমনিতে কোনও অসুবিধে নেই। তবে বেশি কথা না বলানোই ভাল।
লোকটা উঠে রবার-পাইপ পরীক্ষা করছে। আর তাকে বিরক্ত না করে অনুপম বেরিয়ে এল। চিন্তিত মুখে লিফটে নামছে। লাউঞ্জে এসে সোহিনীদের খুঁজল। বিশাল হলে এখন লোকজন নেই বিশেষ। কাউন্টারের মেয়েগুলো খানিক গল্পগাছা করছে। সোজা গেলে হাসপাতালের বহির্বিভাগ। সেখানেই যা একটু ভিড় দেখা যায়। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত জায়গাটায় উচ্চকিত শব্দ নেই, শুধু অস্পষ্ট এক মিশ্র ধ্বনি কানে বাজে।
তরুণই দেখেছে অনুপমকে। অল্প গলা তুলে ডাকল, এই যে…এদিকে।
কোনায় স্টিলের চেয়ারে সোহিনী, তরুণ আর ভাস্বতী। সোহিনীর মুখ অসম্ভব রকমের শুকনো, বোঝাই যায় সে ভারী উদ্বেগে আছে। ভাস্বতীর মধ্যেও কেমন এক বিহ্বল ভাব। একমাত্র তরুণেরই খুব বেশি বিকার নেই।
অনুপম মুখোমুখি বসতেই ভাস্বতীর প্রশ্ন, কেমন দেখলে?
নরমাল। বলেও অনুপম যেন হোঁচট খেয়েছে। স্বাভাবিক শব্দটা কি আর ভাস্করের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? ঝটিতি সংশোধন করে বলল, চলছে তো।
তোমার দিকে তাকাল? কিছু বলল?
উঁহুঁ।
বাবুন তো চোখ খুলছেই না। কথা তো বন্ধই। তরুণ সহজ সুরেই বলল, বেজায় ঘাবড়েছে বেচারা। ট্যাক্সিতে আসার সময় থেকেই তো স্পিকটি নট।
সকালে আমি গাড়িটা নিয়ে গেলে বোধহয় সুবিধে হত, তাই না? অনুপম কুণ্ঠিতভাবে বলল, আসলে একদম মাথায় আসেন…
স্বাভাবিক। তোমায় কত কিছুর মধ্যে থাকতে হয়…! তরুণের স্বরে যেন আবছা বিদ্রূপ, ফেরার সময়ে যদি নিয়ে যেতে পারো। দেখো।
ভাস্বতী জিজ্ঞেস করল, কাল বাবুনকে ছাড়বে কখন?
সকালেই তো রিলিজ করার কথা। তবে তখন শুনলে তো, ডাক্তারবাবু বললেন, আই অ্যাম কিপিং মাই ফিঙ্গার্স ক্রস্ড। যদি রাতে এভরিথিং গোজ রাইট… মানে কেমোজনিত কোনও সাইড এফেক্ট যদি না দেখা দেয়…
তোমার কী ধারণা? সাইড এফেক্ট হবে?
কী করে বলব! শরীরটা তো আমার নয়, বাবুনের। ও কতটা সহ্য করতে পারে, না পারে…
বমি-টমি হবে নাকি? রেডিয়েশানের পর যেমন…?
অনেক কিছুই হতে পারে। হয়তো অ্যাকিউট কাশি শুরু হল, সঙ্গে জ্বর… কিংবা ডায়রিয়া…। ইনফ্যাক্ট, পেশেন্টের তো এখন খুবই ডেলিকেট কন্ডিশন, যে-কোনও ইনফেকশন ওকে ধরে নিতে পারে। আর একটা জিনিস স্মরণে রেখো, বাবুনের ক্যান্সারটা ইজ ইন ফোর্থ স্টেজ। অনেকটাই ছড়িয়েছে। ব্রেনেও সেকেন্ডারি লাম্প গ্রো করেছে। সুতরাং কেমোটাও পড়ছে সবচেয়ে কড়া ডোজে। তাই বুঝতেই পারছ, এই কেসে কিছুই প্রেডিক্ট করা সম্ভব নয়। এক ঘণ্টা পরে কেমন থাকবে, তাও বলা মুশকিল।
থামো তো। ভাস্বতীর ভুরুতে বিরক্তি, তুমি এমন ক্যাজুয়ালি বলো!
যা ফ্যাক্ট তা তো শুনতেই হবে ভাস্বতী। এবং তা মানতেও হবে।
ভাস্বতীর মুখ কালো হয়ে গেছে। অনুপম লক্ষ করল, সোহিনীও নীরক্ত প্রায়। ভাস্করের এই জামাইবাবুটি যেন কেমন কেমন। দুষ্পাচ্য কথাগুলো মুখের ওপর না বললেই কি নয়?
তরুণকে থামাতে অনুপম তড়িঘড়ি বলে উঠল, ভাস্করের কেমোতে কী ড্রাগ ইউজ করছেন ডাক্তারবাবু?
ট্যাক্সল, আর সিস্প্ল্যাটিন। আমারই কোম্পানির ওষুধ। টোটাল কিটে টোয়েন্টি পারসেন্ট ডিসকাউন্ট পেয়েছি। এখানে অবশ্য আজ ওযুধের ডবল খরচা লেগে যাবে।
গায়ে পড়ে টাকাপয়সার কথা বলছে কেন তরুণদা? নিজের কেরামতি জাহির করা নাকি? লোকটা জান লাগিয়ে করছে, তবে বড় দেখানেপনা আছে। কী আর করা, যে মানুষ যেরকম।
ভাবল বটে অনুপম, সঙ্গে সঙ্গে এও মনে হল, পারতপক্ষে তার সামনে খরচখরচার প্রসঙ্গ তোলে না সোহিনী। কেন? এখনও কি সোহিনী তাকে আপন ভাবে না? অনুপম কি এখনও নিছক পারিবারিক বন্ধু? বাইরের লোক? নাকি সোহিনী দাঁতে দাঁত কষে গোটা লড়াইটা একাই লড়তে চায়? যেন গোটা দুনিয়ার সঙ্গে অনুপমকেও দেখাবে, ভাস্করকে বাঁচাতে সে একাই প্রাণপাত করছে!
এমন ভাবনায় যত না দুঃখ, তার চেয়ে বেশি বুঝি থাকে অসহায়তা। মনে হয় যেন সোহিনী তাকে বিশ্বাস করে না। হয়তো ধারণা জন্মেছে, ভাস্করের শারীরিক সুস্থতা অনুপমের কাম্য নয়।
ভাবনাটা কি ভুল? অনুপম জানে না। এই মুহূর্তে জানতে চায়ও না। মাথা নামিয়ে বসে আছে চুপচাপ।
ভাস্বতী উসখুস করছে। অনুপমকেই বলল, ওপরে গিয়ে আর একবার দেখে আসবে ভাই, বাবুনের আর কদ্দুর?
অনুপম উঠতে যাচ্ছিল, তরুণ বাধা দিল, তুমি বোসো। আমি দেখছি।
তরুণ লিফ্ট অভিমুখে এগোতেই ভাস্বতী অপ্রস্তুত স্বরে বলল, আসলে কী হয়েছে জানো? আমরা আজ থাকতে পারব না। একটু তাড়া আছে।
অনুপম ভদ্রতাবশে জিজ্ঞেস করল, যাবেন কোথাও?
আমি না, যাবে তোমাদের তরুণদা। রাজা তো নর্থ বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে চান্স পেয়েছে… আজই নিউ জলপাইগুড়ি যাওয়া… সাড়ে ন’টায় ট্রেন… তোমাদের তরুণদাও থাকছে সঙ্গে…। রাজার হস্টেল অ্যাডমিশনের বন্দোবস্ত সেরে কাল রাতের গাড়িতে ফিরবে। এখনও প্যাকিং-ট্যাকিং কিছু হয়নি…
ও।
আমার যে কী বিচ্ছিরি লাগছে… বাবুনের এই ক্রিটিকাল টাইমটাতেই…
কিচ্ছু হবে না দিদি, তোমরা যাও। কিছুক্ষণ নয়, যেন বহু যুগ পর সোহিনীর স্বর ফুটল, আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব।
ভাস্বতী বলল, তুই একা কেন, অনুপমও তো আছে। ও পাশে থাকাটাও তো বড় নিশ্চিন্দি।
ভাস্বতীর বলার ভঙ্গিটি যথেষ্ট আন্তরিক। ক’দিন আলাপে মহিলাকে বেশ পছন্দই করে ফেলেছে অনুপম। মাঝে মাঝে তরুণের কথাবার্তায় তাও একটা বাঁকা সুর থাকে, কিন্তু ভাস্করের দিদি অনেক সোজাসরল। অকারণ কৌতূহলে অনুপমকে বিব্রত করার চেষ্টা নেই কখনও।
অনুপম আগ্রহ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, রাজা কী নিয়ে পড়বে?
সিভিল পেয়েছে। ওটাই ওর ইচ্ছে ছিল। খারাপ হবে?
না না, খুবই ভাল। এখন তো চারদিকে আবার প্রচুর কনস্ট্রাকশন ওয়ার্ক চলছে, সিভিলদের বাজার যথেষ্ট হাই।
তোমাদের তরুণদাও তাই বলে। সবাই কম্পিউটার নিয়ে পড়লে ঘরবাড়ি বানাবে কে!
অনুপম হেসে ফেলল, শুধু ঘরবাড়ি বানানোই কি সিভিলদের কাজ? রাস্তাঘাট, ব্রিজ, নতুন টাউনশিপ, কোনও কিছুই তো সিভিল ছাড়া হবে না। তা ছাড়া এটা তো বেসিক সাবজেক্ট, এতে অনেক গবেষণার সুযোগ থাকে।
বলছ? কিন্তু ভাই আমার যে মন খুঁতখুঁত করছে।
কেন?
ছেলেটা দুম করে অত দূরে চলে যাবে…
কাছেপিঠে কোথাও পেল না?
সে তো পাচ্ছিলই। আজেবাজে কলেজে। কোথাও টিচার নেই, কোথাও এখনও বিল্ডিংই ওঠেন…। তোমাদের যাদবপুরে চান্স পেলে কী ভালই না হত। তুমি রাজাকে চোখে চোখে রাখতে পারতে। কোনও উড়নচণ্ডীপনা ওর চলত না।
ওটা আপনার ধারণা দিদি। অনুপম হেসে বলল, ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ঢুকে ছেলেরা এমন লায়েক হয়ে যায়, মাস্টারমশাইদের উলটে ট্যাঁকে গোঁজে।
তবু…পলিটিক্স-ফলিটিক্সে জড়িয়ে পড়লে…
কেউ আটকাতে পারবে না। এখানকার এডুকেশনে এখন এমন একটা পরিবেশ…। এই তো, লাস্ট সেমেস্টারের যখন রেজাল্ট বেরোল… যারা ফেল করেছে তাদের পাশের দাবিতে ইউনিয়ন বসে গেল ধর্নায়। কেউ যদি পড়াশোনায় ফাঁকি মারতে চায়, লিডাররা এখন তাদের আশ্রয়।
রাজা অবশ্য ওরকম নয়। লেখাপড়াটা করে। বলে থেমেছে ভাস্বতী, ছেলেটার জন্য আমার খুব ভয় করছে, জানো।
কেন?
নর্থ বেঙ্গলে শুনি খুব র্যাগিং হয়…
কতটা কী হয়, ঠিক বলতে পারব না দিদি। তবে…। অনুপম সামান্য ইতস্তত করে বলল, একেবারে র্যাগিং নেই এমন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বোধহয় পাওয়া যাবে না।
তাই? না?
হুম্। ব্যাপারটা খুবই খারাপ, থাকা উচিত নয়। নিষেধ করে আইনও তৈরি হয়েছে। তবু আছে। এ যেন অনেকটা পণপ্রথার মতো। …আমাদের সময়েও র্যাগিং ছিল।
তা বটে। বাবুন তো প্রথম প্রথম বাড়ি এসে বলত, শিবপুরের হস্টেলে ফিরতে ওর পা কাঁপছে।
খুবই টর্চার হত তখন। আমার বরাত ভাল, এক ভদ্রসভ্য সিনিয়ার শেল্টার দিয়েছিল। বিনিময়ে তার শয়ে শয়ে পাতার নোট কপি করতে হয়েছে। …আর ভাস্করের কপাল মন্দ, ও পড়ে গেল একদল ড্রাগখোরের খপ্পরে। তারা তো একদিন ভাস্করকে ঘুম থেকে তুলে দোতলার ছাদ থেকে লাফ দিতে বাধ্য করেছিল।
ওমা, তাই? কখনও বলেনি তো?
তেমন চোট পায়নি বলে জানতে পারেননি। খুব ভাল অ্যাথলিট ছিল তো…
হুম্। স্কুলে হাইজাম্প, লংজাম্পে বরাবর ফার্স্ট হয়েছে। ফুটবলও খেলত। স্কুল টিমের হয়ে। ভাস্বতী ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল, সেই বাবুনের আজ কী হাল! তখনকার বন্ধুরা যদি এখন বাবুনকে দেখে…
আচমকা কথা খেই হারিয়ে ফেলল। অনুপমও শব্দহীন সহসা। ঠান্ডা লাউঞ্জে যেন পলকা গুমোট। সোহিনী তাকিয়ে আছে সম্মুখপানে, তাকিয়েই আছে। দৃষ্টিতে কোনও ভাষা নেই। নাকি অনুপমই পড়তে পারছিল না সোহিনীকে?
তরুণ ফিরতে স্বস্তি মিলল। গটগট পায়ে এসে তরুণ বলল, ওভার।
সব ঠিকঠাক তো?
নইলে এখনই নামতাম নাকি? তোমরা তো আমার ফোন পেতে।
কী করছে বাবুন?
নয়ন মেলেছে। কথাও বলল আমার সঙ্গে।
আমি একবার যাব?
না গেলেও চলে। রেস্ট নিতে দাও।
বাবুনকে বলেছ, কাল তুমি থাকবে না?
পেশেন্টের সঙ্গে অত গালগল্পের কী দরকার! যদি কোনও রিঅ্যাকশান হয়!… সোহিনীই জানিয়ে দেবে। বলতে বলতে তরুণের চোখ অনুপমে, তোমরা দু’জন নিশ্চয়ই এখন থাকছ?
হ্যাঁ। ভিজিটিং আওয়ার পর্যন্ত আছি।
গুড। তরুণের দৃষ্টি এবার সোহিনীতে, তুমি তা হলে কাল বাবুনকে নিয়ে অনুপমের গাড়িতেই ফিরছ?
সোহিনী ঠোঁট ফাঁক করার আগে অনুপম বলল, অবশ্যই। আমি তো আসবই।
জানি ব্রাদার। তুমি সোহিনীর পাশে আছ বলেই তো শান্তিতে যেতে পারছি।
কথাটার কোনও গূঢ় অর্থ আছে কি না বুঝতে পারল না অনুপম। হাসল অল্প। তারপর তরুণ-ভাস্বতীকে এগিয়ে দিতে এল বাইরেটায়।
আষাঢ় মাস পড়ে গেল, এখনও সেভাবে বৃষ্টির দেখা নেই। ঘন মেঘ জমে আকাশে, দু’-এক পশলা ঝরিয়ে উবে যায়, তারপর আকাশ ঝকঝকে নীল। আজও আছে মেঘ, তবে হাওয়াও চলছে জোর, ঝাপটা দিচ্ছে এলোমেলো। বোঝাই যায়, পর্জন্যদেব স্থায়ী হবেন না। কবে যে পাকাপাকি বর্ষা নামবে!
তরুণদের ট্যাক্সিতে তুলে দিয়ে অনুপম লাউঞ্জে ফিরল। বসেছে সোহিনীর পাশে। সোহিনী একই রকম স্থির। থুতনিতে হাত রেখে ভাবছে কী যেন, আবার যেন ভাবছেও না।
দুপুরে আসার পর থেকেই অনুপম দেখছে সোহিনী আজ আশ্চর্য রকমের নীরব। ঝড়ের আগে সমুদ্রতল যেমন নিস্তরঙ্গ হয়ে যায়, এ কি তেমনই? নাকি বলার মতো আর কথাই নেই সোহিনীর? হারিয়ে গেছে কথা? নাকি ফুরিয়ে গেছে?
সোহিনীকে সবাক করার চেষ্টা করল অনুপম। গলা নামিয়ে বলল, একবার ওপরে ঘুরে আসবে?
সোহিনীর ঠোঁট ফাঁক হল সামান্য, প্রয়োজন আছে কোনও?
না…জাস্ট একবার দাঁড়িয়ে আসা…। ভাস্কর হয়তো এক্সপেক্ট করছে। করুক একটু। আমি ভিজিটং আওয়ারে যাব।
ভুরু কুঁচকে সোহিনীকে দু-এক পল দেখল অনুপম। গলা আরও নামিয়ে বলল, এসেছ তো সেই কোন সকালে,…খাওয়াদাওয়া করেছ?
দুপুরে ক্যাফেটেরিয়ায় টোস্ট-ওমলেট নিয়েছিলাম।
ব্যস?
ইচ্ছে করছিল না। দিদি এমন জোর করল…
ঠিকই করেছেন। সারাদিন উপোস থাকলে ভাস্কর ভাল হয়ে যাবে নাকি?
চকিতে ঘুরেছে সোহিনী। চোখ অনুপমে। কী মর্মভেদী দৃষ্টি! হঠাৎই শীতল স্বরে বলল, আমার খিদে মরে যাচ্ছে অনুপম।
কথাটার ব্যঞ্জনা যেন আঘাত করল অনুপমকে। আধফোটা স্বরে বলল, টেনশনে ওরকমটা হয় সোহিনী।
হয়তো তাই।
চলো, কফি খেয়ে আসি।
উঠেছে সোহিনী। ক্যাফেটেরিয়াটা লনের ওপারে। সোহিনীর পাশাপাশি সবুজটুকু মাড়িয়ে অনুপম এল সেখানে। দু’জনে বসেছে টেবিলে। মুখোমুখি।
অনুপম জিজ্ঞেস করল, শুধু কফি নেবে?
বলো না যা হয় কিছু।
আমার কিন্তু খিদে আছে। গলায় একটু রসিকতা আনল অনুপম। বুঝি বা সমে ফেরাতে চাইল সোহিনীকে। হাসিমুখেই বলল, সেই সকাল দশটায় দুটো ভাত খেয়ে বেরিয়েছি…
তুমি এলে কোত্থেকে? ইউনিভার্সিটি?
ইয়েস ম্যাডাম। তিনখানা ক্লাস ছিল। একটা নিয়েই পালিয়ে এলাম। খুব ডিসটার্বড লাগছিল। জলের গ্লাসে ছোট্ট চুমুক দিল অনুপম, বার্গার বলে দিই তা হলে?
অর্ডার দিয়ে অনুপম বলল, সকালে ক’টায় ভাস্করকে নিয়ে এলে?
কখন যেন বেরোলাম…? সাড়ে সাতটা।
ওর লাস্ট ব্লাড রিপোর্টগুলো তো ভালই ছিল। হিমোগ্লোবিন ইলেভেন পয়েন্ট এইট…
ডব্লুবিসি কাউন্টও চার হাজারের নীচে নামেনি…
আফটার রেডিয়েশান… যথেষ্ট এনকারেজিং। কফি-বার্গার রেখে গেছে বেয়ারা। কাপটা ঠোঁটে ছুঁইয়ে অনুপম বলল, ভাস্করের মেডিকেল ইনশিয়োরেন্সের টাকা পেলে?
সবে তো ক্লেম জমা পড়ল। ধরো আরও দেড়-দু’মাস।
তার মধ্যে আরও তো দুটো কেমো আছে। জোর করেই টাকার প্রসঙ্গে আজ ঢুকল অনুপম, হিউজ এক্সপেন্স। গোটা খরচটাই তোমার একার ঘাড়ে।
নাহ্, এবারের চেকটা ভাস্কর সই করেছে। আপাতত ওতেই চলবে।
সঙ্গে সঙ্গে চুপসে গেছে অনুপম। মাথা নিচু করে কফি খাচ্ছে। নিজেকে খুব বোকা বোকা লাগছে কি?
হঠাৎই সোহিনীর প্রশ্ন, কী বুঝছ অনুপম?
কীসের কী?
এই… ভাস্করের ব্যাপারে?
অনুপম ধাঁধায় পড়ল। ঠিক কী জানতে চায় সোহিনী? সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে ভাস্কর জীবনের দিকে উঠবে কিনা? নাকি নেমেই যাবে অতল অন্ধকারে? অথবা দুটোর একটাও নয়? এ শুধুই এক অসুস্থ মানুষের ব্যাধি সম্পর্কে সরল অনুসন্ধিৎসা? কোন জবাবটা সোহিনীর মনোমত হবে?
আচমকা অনুপমের চোখে ছবিটা ঝলসে উঠল। হাসপাতালে সোহিনীর কাঁধ চেপে ধরে আছে ভাস্কর… অসহায়ভাবে তাকাচ্ছে সোহিনী…!
কেন যে ওই দৃশ্য ঘুরেফিরে দেখা দেয়!
ফের সোহিনীর গলা, কী হল? চুপ যে?
অনুপমের স্বর ঘড়ঘড় বেজে উঠল, সবে তো আজ প্রথম কেমো গেল। এখনও আরও পাঁচটা। তারপর তো বোঝাবুঝি।
অর্থাৎ ভাল হয়ে যেতে পারে?
ওর যা স্টেজ… সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তবে ক্যান্সারে কিছুই অসম্ভব নয়। বিশেষত ওর শরীর যেভাবে রেডিয়েশান অ্যাকসেপ্ট করল… ভয়ংকর কোনও সাইড এফেক্ট ছাড়াই…। জাস্ট ক’দিন একটু ডিপ্রেশন, বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরা…। লাস্ট পাঁচ-ছ দিন তো সেগুলোও অনেক কম।
হ্যাঁ। সোহিনী যেন আনমনে বলল, সেই হাল-ছাড়া ভাবটা গেছে। এখন বাঁচার ইচ্ছেটা প্রবল।
এবং ওই ইচ্ছেটাই ওকে শক্তি জোগাচ্ছে। ফার্স্ট কেমোটা আজ সুষ্ঠুভাবেই হল, এটাও একটা পজিটিভ সাইন। সুতরাং আশা করতে তো দোষ নেই, ওর লাইফস্প্যান প্রলম্বিত হবে।
সোহিনী নিঝুম। বেশ খানিকক্ষণ পর স্বগতোক্তির মতো বলল, ভাল। বাঁচুক। সেরে উঠুক।
অনুপমও যেন জোরের সঙ্গে বলল, আমরা সবাই তো তাই চাই সোহিনী।
এর পর আর কোনও কথা থাকে না। থাকলেও কি অনুপম তা উচ্চারণ করতে পারে? কিংবা সোহিনী? করা যায়?
লাউঞ্জে ফিরে অনুপম দেখল, সোহিনীর দাদা এসেছে। কৌশিককে নিয়ে ওপরে গেল সোহিনী। অনুপমও দাঁড়াল না আর। কোত্থেকে একটা বিশ্রী অবসাদ ভর করছে শরীরে, হাসপাতালে আর একমুহূর্ত থাকতে ইচ্ছে করছে না। সটান গিয়ে বসল স্টিয়ারিং-এ। সোহিনীকে না জানিয়েই বেরিয়ে পড়েছে।
অন্যমনস্ক হাতে গাড়ি চালাচ্ছিল অনুপম। সিগনাল না দেখে জেব্রা লাইন পেরোল দু’-দুবার, ধমক খেল সার্জেন্টের। একবার তো আগের গাড়িটায় প্রায় ধাক্কা মারছিল, কোনওক্রমে ব্রেক কষে সামলাল। আশ্চর্য, হলটা কী তার?
বাড়ি পৌঁছে সবে দরজা খুলে নামছে, সামনে ফুলদা-ফুলবউদি। মেজাজ আরও খিঁচড়ে গেল অনুপমের। যুগল মূর্তির একত্রে দর্শন তো মোটেই শুভ নয়। বোধহয় কোনও নেমন্তন্নবাড়ি চলেছে। ফুলদার পরনে ধোপদুরস্ত পাজামা, কারুকাজ করা চকচকে পাঞ্জাবি। ফুলবউদির অঙ্গেও বাহারি সিল্ক, হাতে উপহারের রঙিন প্যাকেট।
আড়ে তাদের দেখে নিয়ে অনুপম গ্যারেজের শাটার ওঠাচ্ছিল, রন্টু গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসেছে, তোর কাছে একটা ক্যুরিয়ার এসেছিল রে অন্তু। একখানা আমেরিকান ম্যাগাজিন দিতে। আমি সই মেরে রেখে দিয়েছি।
‘দিয়ে যেয়ো,’ বলতে গিয়েও কোঁৎ করে গিলে নিল অনুপম। ফুলদা বাড়িতে ঢোকা মানে মহা অশান্তি। এটা ঘাঁটবে, ওটা শুঁকবে, ফসফস গায়ে ডিয়োডরেন্ট স্প্রে করবে…! অবলীলায় বলবে, তোর আফটার-শেভটার দারুণ গন্ধ, এটা আমি নিলাম…!
গলা ঝেড়ে অনুপম বলল, থাকুক তোর কাছে, কোনও এক সময়ে গিয়ে নিয়ে নেব।
কেয়া পাশ থেকে বলে উঠল, তুমি পায়ের ধুলো দেবে! অত সৌভাগ্য কি হবে আমাদের?
বউকে ইশারায় থামতে বলে রন্টু গলা নামাল, হ্যাঁরে, দাদা তোকে কিছু বলেছে?
কোন দাদা?
আমার দাদা, ঝন্টুবাবু।… ওর সঙ্গে তো মেজদার জোর বেধে গেছে।
তোদের কোনও ঝুটঝামেলায় আমি নেই। আমার বিরক্ত লাগে।
তা বললে তো চলবে না চাঁদু। তুমিও একটা ফ্ল্যাট বাগাচ্ছ!
প্লিজ ফুলদা, যা না কোথায় যাচ্ছিস।
তাড়া নেই গো। সামনেই যাব। কেয়া একখানা আহ্লাদি হাসি ছুড়ে দিল, তেকোনা পার্ক। ওর এক বন্ধুর দামড়া মেয়ের জন্মদিন।
কেয়াকে আদৌ পাত্তা না দিয়ে গাড়িতে বসল অনুপম। ব্যাক করে গ্যারেজে ঢোকাবে। দ্যাবাদেবী তবু দাঁড়িয়ে। ঈষৎ খর গলাতেই অনুপম বলল, কী হল? আরও কথা আছে নাকি?
কেয়া মিষ্টি করে হাসল। গলায় দরদ মাখিয়ে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁগো, তোমার বন্ধুর বউটিকে তো আর দেখি না!
এখন আসছে না। ব্যস্ত আছে।
বরের অসুখ নিয়ে?
এও জেনে গেছে? নিশ্চয়ই মেজদার রটনা। ভায়া মেজদা মেজবউদি, সেখান থেকে আর একজন…। পরচর্চা ছাড়া এদের কি আর কাজ নেই?
অনুপম রূঢ় স্বরে বলল, ঠিকই ধরেছ।
এতদিন লাগছে… খুব কঠিন রোগ বুঝি?
একটা বাক্যে কতগুলো যে প্রশ্ন লুকিয়ে! কেয়া বুঝি ঘ্রাণ পেতে চায়, অসুখটা সত্যি, না ভাঁওতা… সোহিনী-অনুপমের সম্পর্কটা আদৌ আছে কি না… বরের সঙ্গে সোহিনীর ঝামেলা বেধেছিল কি…!
এক ফুঁয়ে কেয়াকে নিভিয়ে দিল অনুপম। থমথমে মুখে বলল, জেনে করবেটা কী, অ্যাঁ?
সরাসরি ঠোক্করটা দিয়ে একটা বিজাতীয় পুলক অনুভব করল অনুপম। গাড়ি তুলল গ্যারেজে। হনহন ফ্ল্যাটে ঢুকে টের পেল মুখফোঁড় জবাব দেওয়ার তৃপ্তিটুকু আর নেই। বরং মেজাজ যেন আরও তিতকুটে। পণ্ডিতিয়ার বাড়িতে থাকতে থাকতে সেও যেন কেমন একটা হয়ে যাচ্ছে! কারও সঙ্গে রুক্ষ ব্যবহার করা তো তার স্বভাব নয়!
নাকি অনুপমের মেজাজটাই আজ চঞ্চল? না হলে সোহিনীকে একবার জিজ্ঞেসও করল না কাল কখন তার গাড়িটা প্রয়োজন? ফোন করবে এখন? থাক, এখনও ভিজিটিং আওয়ার চলছে, রাত্তিরেই না হয়…
পোশাক বদলে একটা স্নান সারল অনুপম। তারপর এক কাপ কালো কফি বানিয়ে অভ্যেস মতো ই-মেল খুলেছে। কী কাণ্ড, আবার লীনার চিঠি! সপ্তাহে দ্বিতীয়বার! এমনটা তো ঘটে না!
চিঠিটা পড়ে অনুপম গুম। আগের পত্রে আভাস ছিল, এবার খোলাখুলি লিখেছে মেয়ে। মারিয়া আর জোহানের একেবারেই বনিবনা হচ্ছে না, প্রতি রাতে তুমুল ঝগড়া চলে দু’জনের, হাতাহাতি পর্যন্ত গড়ায়। স্বাভাবিক কারণে লীনা সন্ত্রস্ত। বাবার কাছে জানতে চায়, তার এখন কী করা উচিত।
চিঠির শেষটুকু বড্ড পীড়াদায়ক। লিভিং ইন হেল্ পাপা। কোয়াইট ইন আ ফিক্স। ডোন্নো হোয়াট টু ডু।
কী পরামর্শ দেবে অনুপম? মেয়েকে বলবে হস্টেলে গিয়ে বাস করো? নাকি লিখবে, আমি তো আছি রে, তোর ভয় কী, এখানে চলে আয়, এটাই তোর আসল বাড়ি…? কিন্তু মেয়ে আর পুঁচকেটি নেই, টিন-এজে পড়ল বলে। ও দেশ ছেড়ে এই শহরে তার পক্ষে কি মানিয়ে নেওয়া সম্ভব? রণবীর-সুনেত্রা তো চলে এসেছিল, মেয়ে কলকাতায় এমন মনমরা হয়ে পড়ল, বাধ্য হয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে বেচারাদের আবার ছুটতে হল নিউ ইয়র্ক। অনুপমও কি মেয়ের জন্য ফের শিকাগোয়…? এখানে আর কীসের টান? সোহিনী তো তদগতচিত্তে স্বামীসেবায় আকণ্ঠ ডুবে, যেন সাবিত্রীকেও হার মানাবে! যমকে ঘেঁষতেই দেবে না ভাস্করের কাছাকাছি! এদিকে অনুপম যে…! কিন্তু অনুপমই তো সোহিনীকে বলেছিল, সে যেন লড়াইয়ের ময়দান থেকে সরে না আসে! কথাটা কি তবে অনুপম মন থেকে বলেনি?
জ্বালা ধরানো চিন্তা। অনুপম জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল। সোহিনী কিংবা লীনা, কাউকে নিয়েই ভেবে বুঝি লাভ নেই। অনুপমের অধিকারই নেই ভাবার। আঠেরো বছর বয়স অবধি লীনার ওপর মারিয়ারই ষোলো আনা হক, আইন মোতাবেক। অতএব অনুপমের মেয়েকে চাওয়া, না-চাওয়া তো নিতান্তই মূল্যহীন। আর মারিয়ার যা জেদ, মেয়েকে ছাড়লে তো।
কী যে করছে মারিয়া! অনুপম একটা হতাশ শ্বাস ফেলল। মেয়ের মুখ চেয়েও তো দ্বিতীয় বিয়েটায় খানিক মানিয়ে-গুছিয়ে চলতে পারত। ওফ্, কত যে পাগলামি করেছে একসময়ে। মতের অমিল হল, তো ওমনি আছড়ে আছড়ে ডিশ ভাঙছে, গ্লাস ভাঙছে…। এবারকার মতো মারপিটটা করতে পারেনি অবশ্য। আহা রে, অনুপমের মেয়েটা খুব কষ্ট পাচ্ছে। খুউব।
মারিয়াকে দু’ছত্র লিখলে হয়। এখন তো অনুপম আর তত শত্রু নয়, তার সঙ্গে মেয়ের ব্যাপারে ঠান্ডা মাথায় আলোচনা করে…। থাক গে, ওতে আবার ঝালটা না মেয়ের ওপর পড়ে। বাবার কাছে কাঁদুনি গেয়েছে বলে। বুঝবেও না, মেয়ের কাছে বাবা ব্যাপারটা মোটেই ফেলনা নয়।
বরং দু’-চারটে দিন যাক। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করে তারপর না হয় লীনা আর মারিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
মেলবক্স বন্ধ করে এবার অনুপমের কাজে বসার পালা। একখানা প্রশ্নপত্র বানাতে হবে। আজই করে আসা উচিত ছিল, হয়নি। যেভাবেই হোক কাল ডিপার্টমেন্টে পৌঁছোনো চাই। প্রশ্ন তৈরির হ্যাঙ্গাম আছে। বেশ কয়েকটা নতুন প্রবলেম দেওয়া দরকার, যাতে টোকাটুকির পরিমাণটা কমে।
কাজ চুকতে ঢুকতে গাঢ় হল সন্ধ্যা। বাইরে বৃষ্টি নেমেছে ঝমরঝম। আওয়াজটা কান পেতে একটুক্ষণ শুনল অনুপম। তারপর প্রেশার কুকারে খিচুড়ি বসিয়ে দিল। মশলা মাখানো পমফ্রেট মাছ বার করল ফ্রিজ থেকে। ভাজছে তেলে।
তখনই ফোন এল। সোহিনীর।
সোহিনীর স্বরে যেন অভিমান, তুমি চলে গেলে কেন?
যাইনি তো, বলতে গিয়েও অনুপম গিলে নিল। জিভে ছোট্ট মিথ্যে, হঠাৎ একটা দরকারি কাজ মনে পড়ল…
একটা ফোন করে দেবে তো। নেমে আমি তোমায় খুঁজছি, শেষে গাড়ি নেই দেখে বুঝলাম…। সোহিনী ক্ষণকাল নীরব থেকে বলল, কাল আসছ তো?
ক’টায় যেতে হবে?
সাড়ে আটটা। আমি লাউঞ্জে থাকব।
যদি চাও, তোমায় তুলে নিতে পারি।
না না, কষ্ট করে উলটোপথে আসবে কেন। আমার প্র্যাকটিস হয়ে গেছে। চলে যাব।
বেশ।
দেরি কোরো না, প্লিজ। তুমিও না থাকলে বড় হেল্পলেস ফিল করব।
অনুপম কি তরুণের পরিবর্ত? আস্তে করে অনুপম বলল, ডোন্ট ওরি। আমি টাইমেই পৌঁছোব। …ভাস্করকে কেমন দেখলে?
একটু যেন অ্যাজিটেটেড। বাড়ি আসার জন্য খুব বায়না করছিল। ভুলিয়ে— ভালিয়ে শান্ত করেছি।
অনুপমের চোখে আবার সেই ছবি! সোহিনীকে আঁকড়ে ধরেছে ভাস্কর… সোহিনী সরতে পারছে না…!
নাকি সোহিনীই চাইছে না সরতে?
নিরুত্তেজ স্বরে অনুপম বলল, ভালই করেছ। রেস্ট নাও। ছাড়ছি।
রাতে খিচুড়িটা কেমন আলুনি আলুনি ঠেকল। মাছভাজাও যেন পোড়া পোড়া। খেয়ে উঠে অনুপম একটা সিগারেট ধরাল। এখনও বৃষ্টি পড়ছে। যান্ত্রিক লয়ে। শব্দটায় কোনও মাধুর্য নেই, কান দুটোকে বড় ক্লান্ত করে দেয়। গরমও যেন কমছে না, গুমোট গুমোট লাগছে।
সিগারেট নিভিয়ে হঠাৎই ল্যাপটপ খুলল অনুপম। ক্যান্সারের তথ্যপঞ্জিতে বোঝাই ওয়েবসাইটে ঝটিতি প্রবেশ করেছে। আগেও ঢুকেছে কয়েকবার, রোগ আর রোগীদের হালহকিকত খুঁজতে। আজ শুধু পরিসংখ্যান ঘাঁটছে। জীবন নয়, মৃত্যুর। একটা গবেষণাপত্রে এসে থামল আঙুল। দুশো চুরানব্বই জন ফুসফুস আক্রান্ত ফোর্থ স্টেজ ক্যান্সার পেশেন্টদের নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে একদল গবেষক। সাতানব্বই জন দ্বিতীয় দফার কেমোটাও পেরোতে পারেনি! ছ’টা কেমো শরীরে গ্রহণ করে দু’বছরের বেশি বেঁচেছে মাত্র সতেরো জন!
ভাস্কর কোন দলে পড়ে? সাতানব্বই? না সতেরো?
অনুপম দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলল। এই অনুপমকে তুই চিনিস অনুপম!
.
১২.
বিকেলে ম্যানেজারের চেম্বারে একটা মিটিং ছিল আজ। সোহিনীদের শাখায় আর এক দফা আধুনিকীকরণের কাজ আরম্ভ হচ্ছে, তাই নিয়ে খানিক কচকচানি। গ্রাহক পরিষেবায় বিঘ্ন ঘটলে স্টাফদের কী কী করণীয়, তার একটা লম্বা ফিরিস্তি আওড়াল শুভঙ্কর গুপ্ত। বেশিক্ষণ লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে বলে কেউ যদি কটু মন্তব্য করে, নো চটাচটি… কাউন্টার যেন কদাচ ফাঁকা না থাকে, সর্বদা মাথায় রাখতে হবে গ্রাহকরাই লক্ষ্মী… ইত্যাকার ছেঁদো উপদেশ। পরিশেষে এক কাপ চা, দুটো থিন অ্যারারুট বিস্কুট, এবং পূর্ণ সহযোগিতার আবেদন, ব্যস সভা সমাপ্ত।
একে একে বেরোচ্ছিল সবাই। টেবিলে ফিরতে ফিরতে সোহিনী বিরক্ত মুখে বলল, পাঁচটার সময়ে ডেকে এই ফাজলামির কোনও মানে হয়? অকারণে দেরি করিয়ে দিল!
মালবিকা চোখ নাচাল, মিটিং-এর আসল উদ্দেশ্যটা বুঝলি? ইনডাইরেক্টলি শোনাল, এখন যেন কেউ ছুটি-টুটি না নেয়।
সর্বনাশ। সোহিনীর মুখ পলকে আমসি, আমাকে হয়তো পরের উইকে আবার…। ওর থার্ড কেমোর সময় তো এসে গেল।
তোর কেস আলাদা। তোকে তো ছাড়তেই হবে। মালবিকা নিজের সিটে বসল। ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলল, তুই তা হলে তিন নম্বরটা করাচ্ছিস? বলছিলি যে, পিছিয়ে যেতে পারে!
সেই সম্ভাবনাই বেশি। তবু… ডাক্তারবাবু টেন্টেটিভ ডেট দিয়ে রেখেছেন।…
অনুশ্রী ব্যাগ কাঁধে সোহিনীর কাছেই আসছিল। মালবিকার টেবিলে ব্যাগটা নামিয়ে বলল, হ্যাঁরে, তোর হাজব্যান্ড এখন আছেন কেমন? প্রবলেমগুলো কমল?
কই আর। একদিন একটু বেটার, তো পরদিন তিনগুণ খারাপ। বমি বমি ভাবটা তো সারাক্ষণ। জল খেলেও এখন ওয়াক তোলে। পাতলা পাতলা ঝোল, হালকা স্টু, স্যুপ, কিচ্ছু হজম করতে পারছে না। খেতেই চায় না। একটা আতঙ্ক জন্মে গেছে, খেলেই বুঝি ডায়রিয়া হবে।
সেকেন্ড কেমোটা বোধহয় শরীর নিতে পারেনি রে।
তাই তো দেখছি। লাস্ট ব্লাড রিপোর্টটাও তো খারাপ। ডব্লুবিসি কাউন্ট মিনিমাম চার হাজার থাকার কথা। মেডিসিন-টেডিশিন পড়েও এখন ছাব্বিশশো। হিমোগ্লোবিন তো সাতে নেমেছে।
ডাক্তাররা কী বলছে?
ওষুধ দিয়েছে গাদাখানেক। তাদের অভিমত, সিম্পটমগুলো কন্ট্রোলে আনতেই হবে। ওদিকে উলটো ভয়ও দেখিয়ে রাখছে। টাইমলি কেমো না হলে হয়তো মূল ডিজিজটা…। সোহিনী দু’দিকে মাথা নাড়ল, আমি আর ভাবতে পারছি না রে।
মালবিকা সোহিনীর পিঠে হাত রাখল, সময় যখন খারাপ চলে, এরকমই হয় রে। কিচ্ছু ঠিকঠাক থাকে না।
এ কথা সোহিনীর চেয়ে বেশি আর কে বোঝে দুনিয়ায়! জীবনটাই তো চটকে ঘ্যাঁট হয়ে যাচ্ছে। প্রথম কেমোর পর থেকেই যা চলছে…। ভাস্করকে হাসপাতাল থেকে এনে ভেবেছিল, এবার হয়তো ক’টা দিন হাঁপ জিরোতে পারবে। কোথায় কী, আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে বদলে গেল পরিস্থিতি। ধুম জ্বর, বমি, পেট খারাপ…। ডিহাইড্রেশানে এমন নেতিয়ে পড়ল, হাসপাতালে নিয়ে স্যালাইন দিতে হল। তারপর ক্রমে ক্রমে বিগড়োচ্ছে রক্তের হাল। শ্বেতকণিকা কমে গেল, হিমোগ্লোবিন নামছে…। তাও প্লেটলেট ব্লাড় আর তাজা রক্ত দিয়ে কোনওমতে ঘাটতি পূরণ করা গিয়েছিল। দ্বিতীয় কেমোটাও হয়ে গেল মানে মানে। কিন্তু এবার যে কী হবে! পেটের গোলমাল তো যখন তখন। মাড়িতেও বিশ্রী ঘা হয়েছে। লেই লেই করে না দিলে কিচ্ছু মুখেই দিতে পারে না। দুর্বলতা এতই প্রকট, বাথরুমটা যাওয়ার পর্যন্ত ক্ষমতা নেই। কাঁহাতক আর ছুটি খোয়ানো যায়, দিনের বেলার জন্য সোহিনীকে একজন নার্স রাখতেই হল। তাতেই বা কতটুকু ছাড়, সারারাত সোহিনীর কীভাবে যে কাটে! হঠাৎ হঠাৎ ধড়মড় বসে হ্যা হ্যা হাঁপায় ভাস্কর, বলে শ্বাস নিতে পারছি না… তক্ষুনি ওষুধ দাও, পিঠ ডলো, বুকে হাত বোলাও…। আধঘণ্টা পর পর বাথরুম পাবে, অথচ ইউরিনালে অনীহা। তাকে তখন ধরে ধরে নিয়ে চলো…। গলা শুকোচ্ছে অহরহ, জল চাই, আবার দু’ঢোক গিললেই মুখের সামনে গামলা এগিয়ে দাও…। ভাগ্যিস তেমন ঘেন্নাপিত্তি নেই সোহিনীর, নইলে কবে যে নিজেই বিছানায় পড়ে যেত।
তা এত বিশদ বর্ণনা কি সহকর্মীদের দেওয়া যায়? যেটুকু বলে, তাতেই যা আহা উহু-র বান ছোটে, সোহিনী কুঁকড়ে থাকে। সমবেদনাও কৃপা বলে মনে হয়। এই যে সোহিনীকে ক্যাশ থেকে সরিয়ে লোনে দেওয়া হল, ভার খানিকটা তো লাঘব হয়েছে, তবু এর জন্যেই যেন মরমে মরে থাকে সোহিনী। কবে যে সে ফের বুকভরে নিশ্বাস নিতে পারবে!
অফিস থেকে বেরোল সোহিনী। হাঁটছে অন্যমনস্ক পায়ে। ভাবার চেষ্টা করল, বাড়ি ফেরার পথে আজ কী কী কাজ আছে। তুলোর একটা বড় প্যাকেট কিনতে হবে, ভাস্করের জন্য নরম দেখে একখানা টুথব্রাশ, ভাস্করের ঘুমের ওষুধ… আর কী যেন? আর কী যেন? হ্যাঁ, শাশুড়ি বলছিলেন বেদানা আনতে। বেদানার রস নাকি রক্ত বাড়ায়। বাজারেও ঢুকতে হবে একবার। বাড়িতে একজন শয্যা নিলে বাকি পেটগুলো তো বসে থাকে না, তাদের জোগাড়জাঁতিও তো করতে হয়। বাবা বলছিল, স্প্রিং চিকেন ভাস্করের হজম হলেও হতে পারে। তবে সেটি সর্বত্র মেলে কি? গড়িয়াহাট বাজারে নেমে খুঁজবে?
অটো ধরতে সোহিনী দাঁড়াল, ফুটপাথের ধার ঘেঁষে। কখন যেন পিছনে রূপক আর জয়দেব। রূপককে দেখলে সোহিনী কেমন যেন অসহজ বোধ করে ইদানীং। অফিসে যখনই সোহিনীর টেবিলে আসে, ওমনি মনে পড়ে রূপকের সিডিটা সম্পর্কে কিছু তো জানানো হল না! হয়তো রূপক জানতে চায়ই না, তবু সোহিনীর অমনটাই লাগে। চিন্তার এ এক বিচিত্র মতিগতি।
আলগা হেসে রূপক বলল, ম্যানেজারের লেকচার শুনলেন সোহিনীদি?
হুঁ।
এদিকে কোর ব্যাঙ্কিং হচ্ছে, ওদিকে পে-রিভিশনের নামটি নেই।
তা তোমরা স্ট্রাইক ডাকছ না কেন? একদিন তা হলে ছুটি পাই।
জয়দেব বলল, হবে, হবে। ডিসেম্বরে একটা বড় ঝাঁকুনি দেওয়ার চান্স আছে। টানা তিন দিন।
সোহিনীর মুখ ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, তখন আমার ছুটির প্রয়োজন থাকবে তো? ঠোঁট টিপে বলল, ঝাঁকাও। ঝাঁকাও। যাতে ঝুলিতে কিছু পড়ে। অন্তত আমার পিএফ লোনটা যেন এক লপ্তে শোধ করে দিতে পারি।
আপনার সত্যি খুব খরচা যাচ্ছে সোহিনীদি।…এ অসুখ যেন শত্রুর বাড়িতেও না ঢোকে।
অসুখ কি কারও পারমিশান নিয়ে আসে ভাই? না কারও ইচ্ছে শোনে?
তা ঠিক। জয়দেব পলক ভাবল কী যেন, বলল, যদি কিছু মাইন্ড না করেন, একটা কথা বলব?
কী?
এন্টালিতে আমাদের পাড়ায় এক কবিরাজ আছেন। খুব নাম। লোকে বলে ধন্বন্তরি। যদি দাদার কাগজপত্রগুলো একটু জেরক্স করে দেন, সঙ্গে এখনকার সমস্ত উপসর্গ… তা হলে একবার ওঁকে দেখাতে পারি। আপনাদের যেমন ট্রিটমেন্ট চলছে চলুক, সঙ্গে যদি ওঁর ওষুধও… বলা তো যায় না, কাজ হতেও তো পারে।
অন্য ধরনের চিকিৎসায় সোহিনীর তেমন আস্থা নেই। তবু মুখের ওপর না বলতে পারল না। মা সেদিন কোন এক সাধুবাবার মন্ত্রপূত কবচ পাঠাল, সেটাকেই কি সে প্রত্যাখ্যান করতে পেরেছে? সে মনস্থির করেছে, ভাস্করের আরোগ্য কামনায় যে যা করতে চায়, কোনওটাতেই বাধা দেবে না। শাশুড়ি তো প্রতি শনি-মঙ্গলবার কালীঘাট ছুটছেন, সুষমার জিম্মায় সংসার ফেলে। কী ভক্তিভরে ছেলেকে প্রসাদী পেঁড়া খাওয়ান, যেন ওটি এক কুচি জিভে দিলেই ভাস্করের লাম্পগুলো মিলিয়ে যাবে—এই যুক্তিহীন ক্রিয়াও তো সোহিনী নির্বিবাদে মেনে নিচ্ছে।
কেন মানছে? সোহিনী ভাস্করের মঙ্গল চায় বলে? ভাস্করকে সুস্থ দেখতে চায় বলে? হতে পারে। নাকি পরে যাতে তাকে কেউ কোনওভাবে দুষতে না পারে…? তাও হতে পারে। কোনটা যে সঠিক, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভাবার মতো ক্ষমতাও বুঝি এখন নেই সোহিনীর।
ঠোঁটে একটা ভাঙা হাসি টেনে সোহিনী বলল, বেশ তো, দেব। চেষ্টায় তো লোকসান নেই।
কালই আনছেন তা হলে?
জবাব দেওয়া হল না। একখানা অটো এসে দাঁড়িয়েছে। পিছনটা ভরতি, ড্রাইভারের পাশে আধঝোলা হয়ে বসল সোহিনী। দুপুরে আজ জোর বৃষ্টি নেমেছিল, রাস্তায় এখনও জায়গায় জায়গায় জল। বর্ষা এবার দেরিতে এল বটে, তবে শ্রাবণ যেন পুষিয়ে দিচ্ছে। গত সপ্তাহে একদিন তো পুরো শহর থইথই। আজ সে তুলনায় কিছুই নয়, তাও বেপরোয়া অটোর চাকায় ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে জল, সোহিনীর সালোয়ারে কাদার ছিটে। নোংরা নোংরা দাগ।
গড়িয়াহাট বাজারও কাদায় কাদা। পা টিপে টিপে হাঁটছিল সোহিনী। যা যা চাইছিল, পেয়ে গেল ঘুরে ঘুরে। বাড়তির মধ্যে নিল গোটা চারেক শিঙিমাছ। কেটেকুটে, টুকরো করে। হড়হড়ে আঁশবিহীন শিঙি-মাগুর দেখলে সোহিনীর গা শিরশির করে। কিন্তু এতেও নাকি রক্ত হয়। কর্নফ্লেক্স নেবে একটা? বাবা ছেলে দু’জনেই খেতে পারে। দুধে ভিজিয়ে ন্যাতা ন্যাতা করে দিলে ভাস্করের গলা দিয়ে কি নামবে না? থাক, বোঝা বেশি ভারী হয়ে যাচ্ছে। কর্নফ্লেক্সটা নয় পাড়া থেকেই কিনবে।
বাকি পথটুক আর অটো মিনিবাস নয়, ট্যাক্সি। শরীর জুড়ে ভয়ানক ক্লান্তি, বাস-অটোর গাদাগাদি আর সয় না। সিটে হেলান দিয়ে সোহিনী বাইরে তাকাল। দোকানপাট, গাড়িঘোড়া, মানুষজন, আলোআঁধার, সব মিলিয়ে পৃথিবীটা কী সুন্দর চলছে। শুধু সোহিনীর জীবনটাই কেমন উলটেপালটে গেল। জয়দেবের কথামতো আয়ুর্বেদিক করে দেখবে? যদি ফল মেলে! অনুপম বলে, দেহের প্রতিটি কোষই নাকি এক একটি জীবন। কোষের মধ্যে আছে জিন, সেই জিনেই লেখা থাকে কখন ভাঙবে কোষ, তৈরি হবে আর একটা নতুন প্রাণ। ক্যান্সারে আক্রান্ত কোষ এসব নিয়মশৃঙ্খলা কিছুই নাকি মানে না। অবিরাম বাড়িয়ে চলে সংখ্যা, নতুন কোষগুলোও হয় অপরিণত, জিনের লিখন ফোটার আগেই তারা বেড়ে যায় বহুগুণ। ফলে গড়ে ওঠে মাংসপিণ্ড, ছড়িয়ে যায় যত্রতত্র, স্বাভাবিক কোষগুলো ক্রমশ কোণঠাসা হতে থাকে। কোষের এই বিভাজন বন্ধ করতেই নাকি কেমোথেরাপি। কিন্তু গোটা শরীরের যেখানে যে কোষ ভাঙছে, তাকেই সে মেরে দেয়। স্বাভাবিক কোষ, অস্বাভাবিক কোষ, বাছার তার ক্ষমতা নেই। আর সেই কারণেই নাকি বেশ কিছু স্বাভাবিক কোষ মরে গিয়ে নানান বিপত্তি ঘটে। তাই না ভাস্করের শরীরে আজ এত গন্ডগোল। আয়ুর্বেদিক ওষুধ কি এই কোষ ভাঙাভাঙি রুখতে পারে না? কে জানে, হয়তো আরও ভালই পারবে। এই তো সেদিনই অনুপম কোথায় পড়েছে, এখন জৈব ওষুধেও নাকি চিকিৎসা হচ্ছে ক্যান্সারের। গাছগাছালি, শিকড়বাকড়ও তো এক ধরনের জৈব ওষুধ, নয় কি?
অনুপমকে আজ জিজ্ঞেস করতে হবে। যদি আসে অবশ্য। নিয়ম করে প্রতি সন্ধ্যায় আজকাল ঢুঁমারতে পারে না অনুপম, কীসব গবেষণাপত্রের কাজ চলছে। তবে সপ্তাহে দু’-চার দিন ঘুরে যায়ই। বন্ধুর কাছেই বসে থাকে, সোহিনীর সঙ্গে দু’-চারটের বেশি কথা হয় না, তবু অনুপমের উপস্থিতিটুকু সোহিনীকে অনেকটা বল জোগায়। মনে হয়, আছে, আছে, অনুপম পাশে আছে।
ফ্ল্যাটে ফিরে সোহিনী দেখল ড্রয়িংহলে আজও গুচ্ছের লোক। প্রায়ই এখন কেউ না কেউ হাজিরা দিয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশই ভাস্করের আত্মীয়স্বজন। দর্শন দিয়ে কর্তব্য সারে বোধহয়। আজ কেওড়াপুকুরের পিসি, আর পাটুলির জ্যাঠতুতো দাদা-বউদি। ভাস্বতীও বসে বনানীর পাশে।
জমায়েতে চিলতে হাসি বিলিয়ে সোহিনী ডাইনিং টেবিলে রাখল মালপত্রগুলো। বনানীও সঙ্গে সঙ্গে উঠে এসেছে। জিনিসগুলো রাখছে যার যার জায়গায়। অনুচ্চ স্বরে সোহিনীকে বলল, তরুণ শিঙাড়া এনেছিল। এখনও গরম আছে। খাবে?
একটু পরে। আগে হাতমুখ ধুয়ে নিই।
চা-ও খাবে তো?
পরে।… সিস্টার চলে গেছে?
ড্রেস-টেস বদলে তো রেডি। বোধহয় তোমার জন্যেই ওয়েট করছে।
কারণটা সোহিনী জানে। চটপট কমন বাথরুমটায় ঢুকে হাতে-মুখে সাবান দিয়ে নিল। এখানে এক সেট ঘরোয়া সালোয়ার-কামিজও রাখা আছে, বদলে নিল কাদামাখা পোশাক। রোগীর কাছে যথাসম্ভব পরিচ্ছন্ন হয়েই যাওয়া উচিত। কাহিল শরীর সহজেই বাইরের জীবাণু টানে।
শোওয়ার ঘরে গিয়ে সোহিনী দেখল, তরুণ গল্প করছে কালো মতন রোগাসোগা নার্স মেয়েটির সঙ্গে। ভাস্কর পাশ ফিরে শুয়ে, একটু যেন কুঁকড়ে-মুকড়ে। মুখ দেওয়ালে ফেরানো।
ভুরুতে হালকা ভাঁজ নিয়ে ভ্যানিটিব্যাগ থেকে পার্স বার করল সোহিনী, আপনারা কতক্ষণ তরুণদা?
তোমার ননদ তো সেই দুপুর থেকে। আমি আধ ঘণ্টাটাক। তরুণ নার্স মেয়েটিকে দেখাল, ওকে বোধহয় আজ…
জানি। উইক্লি পেমেন্টটা দিতে হবে। সোহিনী এক গোছা একশো টাকার নোট মেয়েটিকে বাড়িয়ে দিয়েছে, দেখুন তো ভাই, ঠিক আছে কিনা।
নোট গুনে মেয়েটি ঘাড় নাড়ল, রসিদ সই করা আছে। টেবিলে।
সোহিনীর চোখ ভাস্করে। মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, ওভাবে শুয়ে কেন? জ্বর এসেছে নাকি?
না, না। দাদা তো ওইভাবেই রয়েছেন। সেই বিকেল থেকে।
খেয়েছে ঠিকঠাক?
দুপুরে অতি সামান্য গলা ভাত। তাও মাসিমা অনেক কাকুতি-মিনতি করার পর।
বমি হয়নি তো?
তখন তো করেননি। তবে চারটে নাগাদ হরলিক্সের সঙ্গে বিস্কুট খাইয়েছিলাম, সেটা পুরোটাই…। তারপর থেকে তো ঝিম মেরে পড়ে। মুখ ফেরাচ্ছেনই না মোটে। রাতের খাবারটা তো এখনও দেওয়া গেল না।
অর্থাৎ ঝক্কিটা সোহিনীকেই নিতে হবে। এখন বসে বসে… পোষায়?
মেয়েটি বলল, আমি তা হলে যাই?
আজ কিন্তু আপনি লেট করেছিলেন ভাই। প্লিজ টাইমটা মেনটেন করবেন। আমার অফিস থাকে, আপনার দেরি হলে আমি টেনশনে পড়ে যাই।
কিছু একটা বলতে গিয়েও যেন বলল না মেয়েটি। দু’-এক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে গেছে।
তরুণ মুচকি হেসে বলল, তোমার তো বেশ উন্নতি হয়েছে! পট করে শুনিয়ে দিলে!
সোহিনী মলিন হাসল। রোগের সান্নিধ্যে থেকে তার যে কত বদল ঘটেছে, তরুণদা তার কতটুকু খবর রাখে!
চুপচাপ বিছানার ধারে এল সোহিনী। কোমল স্বরে ভাস্করকে ডাকল, কী গো, তাকাবে না?
সাড়া নেই।
স্যুপ আনব। খাবে?
টুঁ শব্দটি নেই।
তরুণ ফিসফিস করে বলল, চেপে যাও। সিস্টার বোধহয় বকেছে টকেছে। গোঁসা হয়েছে বাবুর। খানিক বাদে না হয়…
অগত্যা ড্রয়িংহলে এল সোহিনী। সঙ্গে তরুণ। কেওড়াপুকুরের পিসি উঠি উঠি করছিল, সোহিনীকে দেখে বসেছে ফের। ভারী দরদি গলায় বলল, আহা রে, বউটার চোখমুখ একেবারে বসে গেছে গো!
পাটুলির বউদি ওমনি পোঁ ধরেছে, বেচারার ধকলটা কী যাচ্ছে একবার ভাবুন। একাধারে সংসার, ওদিকে অফিস, সঙ্গে বর হাসপাতাল ডাক্তার…
বাবুনের জন্য বউ যা করছে, ভাবা যায় না গো। এমন প্রাণঢালা সেবা আমিও পারতাম কিনা সন্দেহ।
সত্যি, শয্যা নেওয়া রোগীর যত্ন কি যে সে কাজ! শ্বশুরমশাই তো সেরিব্রাল হয়ে মাত্র মাসখানেক ছিলেন, তাতেই আমার জিভ বেরোনোর দশা। আপনার ভাইপো তো তখনই বলত, কী করে পারছ…! এখন সোহিনীকে দেখে মাথা হেঁট হয়ে যায়।
পাটুলির দাদা বলল, একে বলে হৃদয়ের টান, বুঝলে। ওটা যদি থাকে, মানুষ সব পারে।
এধরনের পিঠ চাপড়ানো আদৌ বরদাস্ত হয় না সোহিনীর। তবু শুনতে হচ্ছে ইদানীং। লোকে বাড়ি বয়ে এসে বলে যাচ্ছে। সোহিনী নিঃশব্দে সরে গেল। ঢুকেছে ছেলের ঘরে। মাথা নিচু করে কী যেন করছে পাপান। বোধহয় অঙ্ক। সোহিনীর আজকাল ছেলেকে নিয়ে বসাই হয় না, ছেলে নিজের পড়াশোনা নিজেই সারে। খুব শান্ত হয়ে গেছে পাপান। এতালবেতাল বায়নাক্কা নেই, যখন তখন টিভি খোলে না, ঘরেই থাকে, খুটুরখাটুর করে নিজের মনে। বোঝাতে হয়নি, পাপান জানে বাড়িতে এখন গভীর সংকট। উচ্ছ্বাস হইচই এখন মানায় না।
সোহিনী ছেলের মাথায় হাত রাখল, কী রে, অঙ্ক পারছিস তো?
হচ্ছে। পাপান ঘাড় নাড়ল। নাক কুঁচকে বলল, ডেসিম্যালে একটু প্রবলেম।
দশমিক শেখাচ্ছে?
স্টার্ট হয়েছে।
তাই?
অঙ্ক বইটা হাতে নিল সোহিনী। দেখছে। সহজভাবেই শেখানো, তবে একটু বুঝিয়ে দিলে বোধহয় পাপানের সুবিধে হয়।
মিনিট পনেরো বুঝি ছেলেতে ডুবে ছিল সোহিনী, দরজায় ছায়া। বনানী। হাতে চা-শিঙাড়া।
কুণ্ঠিত স্বরে বনানী বলল, লোক ছিল বলে দিতে পারছিলাম না… খেয়ে নাও। শিঙাড়া চাটুতে গরম করে দিয়েছি।
বনানী আজকাল বুঝি একটু বেশিই খেয়াল রাখছে পুত্রবধূর। এ যেন এক ধরনের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। রুগ্ণ ছেলের দেখাশোনা করার প্রতিদান। নাকি এ এক ধরনের অসহায়তা? অজান্তেই সোহিনীর ওপর একটা নির্ভরতা চলে আসছে বনানীর?
সোহিনী শুধু চা-টা নিয়ে বলল, শিঙাড়া থাক মা। আর ইচ্ছে করছে না।
সেই ভাল। ছেড়ে দাও। অম্বল হবে।
দিদিরাও চলে গেল?
ওরা বাবুনের ঘরে। বুলু বাবুনকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। বনানী খানিক ইতস্তত করে বলল, বুলু আজ থাকবে। ছেলে ছেড়ে ওরও একা একা লাগে, আমার সারাটা দিন…
অর্ধসমাপ্ত বাক্যটা যেন চোরা হাহাকারের মতো বাতাসে ছড়িয়ে গেল। পাক খাচ্ছে। সোহিনীকেও ছুঁয়ে রইল একটুক্ষণ।
সোহিনী বলল, আজ কেন, দিদি ক’দিন থাকুক না। আপনারও একটা সঙ্গী হয়।…তরুণদা তো রোজই আসে, এখান থেকেই নয় রাতে খেয়ে যাবে।
আমিও তাই বলছিলাম। তরুণের তো শুধু সকালটাই অসুবিধে। তা সে না হয় একবেলা একটু কষ্ট করে…
কথার মাঝেই ভাস্বতীর প্রবেশ। দু’হাত নেড়ে বলল, ওফ্, কিছুতেই পারলাম না…! দেখো, একমাত্র হয়তো তোমার হাতেই…
বনানী তাড়াতাড়ি বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, যাও সোহিনী। পাপানকে আমরা দেখছি।
কাপ রান্নাঘরে রেখে সোহিনী ফের ভাস্করের কাছে এল। বসেছে ভাস্কর। হাঁটু মুড়ে। কুঁজো হয়ে। কী রোগা যে হয়ে গেল ভাস্কর! মাত্র দু’মাস আগে যে দেখেছে, সেও বুঝি চিনতে পারবে না। কণ্ঠার হাড় উঁচু, পাঁজরগুলো যেন গোনা যায়। প্রায় সব চুল ঝরে গিয়ে বয়স লাফিয়ে বিশ বছর বেড়ে গেছে। হাত দুটো সরু সরু। কাঠি কাঠি।
টেবিল থেকে চিকেন স্যুপের বাটিটা নিয়ে সোহিনী বিছানায় বসল। চামচে স্যুপ তুলে ভাস্করের মুখের সামনে ধরেছে, দেখি, হাঁ করো।
ঠোঁট টিপে আছে ভাস্কর। চোখ দুটো তার অদ্ভুত রকমের ঘোলাটে। শীতল।
হল কী তোমার? এমন করছ কেন?
জবাব নেই।
এমন করলে শরীর টিকবে কী করে?
এবার ঘঙঘঙে স্বর বেজেছে, টিকে কী হবে? আবার তো হাসপাতালে পুরে বিষ ঢালবে।
ওহ্, এক্ষুনি তো তোমায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না।…নাও, এবার মুখ খোলো।
একটু বুঝি কাজ হল। গিলছে ভাস্কর। ধীরে, অতি ধীরে। প্রায় অর্ধেকটা খেয়ে নিল। আর সম্ভব নয়, বাটি সরিয়ে রাখল সোহিনী। তোয়ালেতে মুখ মুছিয়ে দিচ্ছে।
তখনই ভাস্বতীর গলা কানে এল। মা আর মেয়ের কথা চলছে ডাইনিং টেবিলে। তেমন উচ্চস্বরে নয়, তবে শোনা যায়।
ভাস্বতী বলল, ও বাবুনের জন্য সত্যিই জান লড়িয়ে দিয়েছে। অথচ তুমি বলতে, ও নাকি বাবুনকে ভালবাসে না।
আমার ভুল ভেঙেছে রে বুলু। বিপদের ক্ষণেই তো মানুষের আসল রূপটা দেখা যায়। গোটা রাত জেগে জেগে ও যেভাবে বাবুনকে সামলায়…
বাবুন যদি বাঁচে, সোহিনীর জোরেই বাঁচবে।
শুনতে শুনতে সোহিনীর বুক উত্তাল সহসা। এ সব কী বলে মা-মেয়ে? ভাস্করের এত কাছের মানুষ এরা, এখনও টের পায়নি, সোহিনী শুধু কর্তব্য করছে! ভেতরে যে কী চরম ফাঁকি, তা কি কেউ দেখতে পাচ্ছে না? এও কি সম্ভব?
নাকি গোপন সোহিনীকে এরা চিনে ফেলেছে? এই প্রশংসা হয়তো নিছকই শ্লেষ! হয়তো ইচ্ছে করেই সোহিনীর শ্রবণে ধাক্কা দেওয়া!
ভাস্কর ফের মুখ ঘুরিয়ে শুয়েছে। দম বন্ধ করে ভেতরের ঝড়টাকে সামলাল সোহিনী। নিজেকে যথাসম্ভব স্থিত করে ঘর ছাড়ল।
পাপানের আহার শেষ। টেবিলে বাকিদের খাবার-দাবার সাজাচ্ছে বনানী। ভাস্বতী সাহায্য করছে হাতে হাতে। বনানী ডাকল জামাইকে। তরুণ সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিল, উঠে ডাইনিং টেবিলে এল।
ভাস্বতী সোহিনীকে বলল, তুমি দাঁড়িয়ে কেন? বসে পড়ো।
হ্যাঁ, বসি। …তোমরা?
সবাই খাব।
সরল মেনু। রুটি, আলুচচ্চড়ি, মুরগির ঝোল, স্যালাড। পাতে শসা-পেঁয়াজ নিয়ে তরুণ বলল, আজ বাবুনের অন্কোলজিস্টকে মিট করেছিলাম। উনি একটা সাজেশন দিলেন।
সোহিনী চোখ তুলল, কী?
বলছিলেন, ওরাল মেডিসিনে তো বাবুন তেমন রেসপন্ড করছে না… ব্লাড কাউন্ট বেটার করতে হলে… যাতে ডব্লুবিসি, হিমোগ্লোবিন বাড়ে… একবার হসপিটালে দিলে ভাল হত। আবার একবার প্লেটলেট আর হোল ব্লাড দিয়ে কতটা কী হয় উনি দেখতে চান। রেজাল্ট যদি আশাপ্রদ লাগে, মোটামুটি টাইমলি থার্ড কেমোটা করা যাবে। প্রয়োজন বুঝলে কেমো স্টার্ট করার আগে আর একবার ব্লাড দেবে।
কিন্তু এখন আবার ওকে হসপিটালে…? যেরকম শেকি হয়ে গেছে…!
বুঝতে পারছি। …নইলে যে কেমোটাও অনির্দিষ্টকাল পিছিয়ে যাচ্ছে! সেটাও তো খুব কাজের কথা নয়। সেকেন্ড কেমোর পর এক্স-রে তো দেখলে… শ্যাডো এবার মোটেই কমেনি। সুতরাং কেমোর সাইকল্ ব্রেক করাটাও ঝুঁকির ব্যাপার হয়ে যাবে।… সেকেন্ড কেমোর পরে একুশ দিন কবে যেন হচ্ছে? নেক্সট ফ্রাইডে না?
হ্যাঁ…। সোহিনী একবার বনানীর পাংশু মুখখানা দেখে নিল। দ্বিধান্বিত গলায় বলল, তবু তরুণদা…এখনও ওর এতরকম সাইড এফেক্ট…বড় কষ্ট পাচ্ছে…
মাঝে আট-ন’টা দিন তো রইল। ওষুধ যা চলছে… কমতেও তো পারে।
তাও ধরুন, রক্ত দিয়েও তেমন ইমপ্রুভ করল না… প্লাস, যদি সাইড এফেক্টগুলোও থেকে যায়…
তখন হবে না কেমো। আমরা আরও অপেক্ষা করব। তা বলে ট্রিটমেন্টটা প্রপার ছন্দে রাখার ট্রাই কেন নেব না? ব্লাড নিতে তো বাবুনের কোনও কষ্ট নেই।
তরুণের প্রস্তাব অযৌক্তিক নয়। তবু যেন সোহিনী সাহস পাচ্ছিল না। অনুপম কেন যে আজই এল না? অনুপমের মতামতটা নিলে হত।
তরুণ কি অন্তর্যামী? মুরগির ঝোলে রুটি ডুবিয়ে ফস করে বসে বসল, একবার অনুপমের সঙ্গে ডিসকাস করে নেবে নাকি?
সোহিনী চমকে তাকাল, কেন?
কারণ অনুপম অনেক কিছু জানে। বোঝে। ওর অ্যাডভাইসটা নিশ্চয়ই মূল্যবান।
সূক্ষ্ম একটা বিদ্রূপের কাঁটা অনুভব করল কি সোহিনী? একই সঙ্গে অনুপমের পরামর্শ নেওয়ায় একটা বেড়িও পড়ল, নয় কি?
সোহিনী গম্ভীর মুখে বলল, না না, আপনি যা ভাল বোঝেন, তাই করুন।
বলছ? …তা হলে কাল-পরশু-তরশু বাদ দাও। শুক্রবার ওকে অ্যাডমিট করি।
তিন দিন দেরি কেন? ভাস্বতী অবাক, বাবুনের ব্লাড তো ‘এ’ পজিটিভ। রক্ত পাওয়ার তো অসুবিধে নেই।
আহা, কাল ছোটমামার কাজ না? বৃহস্পতিবার নিয়মভঙ্গ। আমি শ্মশানযাত্রী, দু’দিনই আমায় থাকতে হবে। …তুমিও তো যাচ্ছ।
হুম্। কাল দুপুরে একবার ঘুরে আসব। ভাস্বতীকে একটু যেন দুঃখী দেখাল, সত্যি, তোমার ছোটমামার কী লাক! এই সবে উইল করলেন… দুটো মাসও বোধহয় কাটেনি… সজ্ঞানে চলে গেলেন।
আগেই বুঝেছিল আয়ু ফুরিয়েছে।
বোঝা যায়?
কী জানি। হয়তো যার ফুরোয়, সে সিগনাল পায়। তরুণ হো হো হাসছে, আমি অবশ্য তেমন কিছু এখনও পাইনি।
ননদ-নন্দাইয়ের লঘু আলাপচারিতা সেভাবে শুনছিল না সোহিনী। নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করল। আঁচিয়ে নিয়ে একবার দেখে এল পাপানকে। ঘুমিয়ে পড়েছে। টেবিল খালি হতে এঁটো বাসনগুলো নামাল রান্নাঘরে। বনানী খাবার তুলছে। ভাস্বতী টেবিল মুছে নিল।
তরুণ জুতোমোজা পরে তৈরি। সোহিনীকে বলল, তা হলে ওই কথাই রইল? পাক্কা? বাবুনকে তুমি মেন্টালি রেডি করে ফেলো।
সোহিনী কলের পুতুলের মতো ঘাড় নাড়ল, দেখছি।
বলা সহজ, কিন্তু কাজটা যে কী দুরূহ! ভাস্করকে ওষুধ খাওয়াল সোহিনী, বাথরুম নিয়ে গেল, কিন্তু কিছুতেই কথাটা মুখে আনতে পারল না। বিজবিজে একটা চিন্তা নিয়ে শুয়েছে।
মাঝরাতে হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি। জানলা দিয়ে ছাট আসছে। খাট থেকে নেমে কাচের পাল্লাগুলো টেনে দিল সোহিনী। ঘরে এখন জোরালো রাতবাতি। হলদেটে আলোয় নিরীক্ষণ করল ভাস্করকে। স্লিপিং পিল পড়েছে, চক্ষু দুটি নিমীলিত, তবে ঘুমোচ্ছে কিনা ঠাহর হয় না। হয়তো এখনই উঠে বলবে…!
সোহিনীর তেষ্টা পাচ্ছিল। ড্রয়িংহলে এসে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা জল ঢালল গলায়। গোটা ফ্ল্যাট আশ্চর্যরকম নিঃসাড়, বৃষ্টির ধ্বনি ছাড়া কিছুই কানে আসে না। একা একা দাঁড়িয়ে থাকলে কেমন গা ছমছম করে।
পায়ে পায়ে সোহিনী ব্যালকনির দরজায়। বাইরে বুঝি আরও গভীর নিশুতি। জলকণার পরদার ওপারে চরাচর আবছা। অপার্থিব। সামনের রাস্তায় পথবাতির বিচ্ছুরণ কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে। তীব্র তরঙ্গ হেনে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। ক্ষণপরে বিকট শব্দে কড়কড়াৎ বাজ।
কান চেপে দৌড়ে ঘরে ফিরল সোহিনী। যা ভেবেছিল তাই, ভাস্কর হাঁটু জড়িয়ে বসে। থুতনি প্রায় বুকে ঠেকেছে।
সোহিনী নরম গলায় বলল, আওয়াজে ঘুম চটকে গেল তো! নাও, আবার শুয়ে পড়ো।
ভাস্কর ক্ষীণ স্বরে বলল, আমার গলা ব্যথা করছে।
এ আবার কী নতুন উপসর্গ? অ্যাদ্দিন তো মাড়িতে…
হচ্ছে। ভাস্কর শিশুর মতো বলল, হলে আমি কী করব!
টিউবলাইট জ্বালিয়ে সোহিনী ড্রয়ার থেকে পেনসিল টর্চ বার করল। ভাস্করের থুতনি ঠেলল সামান্য, দেখি আবার কী বাধালে। হাঁ করো।
মুখগহ্বরে আলো ঘুরিয়ে পর্যবেক্ষণ করল সোহিনী। উঁহু, মাড়িতে একটা ঘা ছাড়া কিছুই তো দৃশ্যমান নয়। টর্চ সরিয়ে বলল, ধুৎ, ও তোমার মনের ভুল। কিচ্ছু নেই।
তুমি সব সময়ে আমার কষ্ট কমিয়ে কমিয়ে দেখতে চাও। বলছি, আছে। বলছি, আছে।।
অস্থিরভাবে মাথা ঝাঁকাচ্ছে ভাস্কর। সোহিনী একটু ঘাবড়ে গেল। কাঁধে হাত রেখে বলল, আচ্ছা, আচ্ছা, মানছি। কিন্তু এগুলো তো সারাতে হবে।
আমি কীভাবে সারাব?
তোমার রক্তের জোর কমে গেছে। একটু রক্ত বাড়লেই দেখবে সব প্রবলেম চলে গেছে।
মিথ্যে কথা। আমার আর এসব সারবে না।
তা বললে চলে! তোমাকে না বাঁচতে হবে!
আমার বাঁচা মরা কোনও কিছুর আর ইচ্ছে নেই। শুধু দয়া করে আমায় আর ওই বিষটা দিয়ো না।
ঠিক আছে, তাই হবে। তুমি না চাইলে আর কেমো নয়। কিন্তু শরীরে রক্ত তো নিতেই হবে।
অকস্মাৎ যেন বিস্ফোরণ ঘটল। ভাস্করের ভাঙা ভাঙা গলা আছড়ে পড়েছে, ও, তুমি আমাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে কেমো দিতে চাও? …আমি জানি, আমি জানি, তুমি কোনওদিন আমায় সহ্য করতে পারোনি। ঘেন্না করো। ঘেন্না করো। যাকে চাও, সে এখন এসে গেছে তো… তাই তুমি এখন আমাকে দগ্ধে দগ্ধে মারবে। সব বুঝি। সব বুঝি। আমি তোমাদের পথের কাঁটা। টেনে হিঁচড়ে যেভাবে হোক আমাকে উপড়ে ফেলতে চাইছ…
সোহিনী নিস্পন্দ। সোহিনী পাথর। মনের কোন অন্ধ কুঠরিতে সন্দেহটা পুষে রেখেছিল ভাস্কর!
সোহিনীর হাত থেকে টর্চটা পড়ে গেল। কাচ চুরমার।
.
১৩.
বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রবেশ করেই অনুপমের মনে হল, হাওয়া আজ অন্যরকম। বাতাসে যেন বারুদের ঘ্রাণ।
অনুমানটা ভুল নয়। গাড়ি পার্ক করতে করতে অনুপমের নজরে পড়ল, অফিস বিল্ডিং-এর সামনে পুলিশ ভ্যান। চতুর্দিক পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। শিরস্ত্রাণ চাপিয়ে, ঢাল-লাঠি-বন্দুক নিয়ে যত্রতত্র টহল দিচ্ছে উর্দিধারীরা। নিজেদের বিভাগের দোতলা বাড়িটায় পৌঁছোনোর আগেই কান ফাটিয়ে বোমার আওয়াজ, সঙ্গে চিৎকার, কোলাহল, ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটাছুটি করছে তরুণ-তরুণীর দল। এরপর কি বুঝতে বাকি থাকে কী ঘটছে!
অনুপমের মেজাজটা দড়কচা মেরে গেল। নিত্যি নিত্যি ছাত্রদের এই মারপিট কি সহ্য করা যায়? কী নিয়ে আজ বাধল? এখন তো ছাত্র ইউনিয়নের ইলেকশনও নেই! নতুন ছেলেমেয়ে ভর্তির সময়ে গোলযোগ খানিক হয়েছিল, তবে সেও তো থেমে গেছে! আজকাল অবশ্য ইস্যু লাগে না, যে-কোনও সামান্য বিবাদই হাতাহাতি মারামারির পর্যায়ে যায়। কে যে কোত্থেকে আনে ঈশ্বরই জানেন, বোমা সর্বদাই মজুত। সংঘর্ষ বাধলেই মুড়িমিছরির মতো পড়তে থাকে। এদেশে লেখাপড়ার যে কী হবে? কলেজ ইউনিভার্সিটিতে এবার তালা ঝুলিয়ে দিলেই হয়।
বিরস মনে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল অনুপম, হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। প্যাসেজে চার-পাঁচটা ছেলেমেয়ে নিজেদের মধ্যে ভারী উত্তেজিতভাবে কী যেন বলাবলি করছে। একটা ঢ্যাঙা মতো ঝাঁকড়াচুলো লাফিয়ে লাফিয়ে নামল দোতলা থেকে। তির বেগে ছুটছিল, হঠাৎ থমকে থেমে দু’হাত নেড়ে ডাকছে বন্ধুদের।
ছেলেটা শুভম না?
অনুপম গলা উঁচিয়ে ডাকল, এই, শোনো।
শুভম জটলাটার পানে তাকাতে তাকাতে এগিয়ে এসেছে, কিছু বলছিলেন স্যার?
হচ্ছেটা কী, অ্যাঁ? কী নিয়ে লাগালে আজ?
আমরা লাগাইনি স্যার। তিনটে ফ্রেশার মেয়েকে টিজ্ করছিল, আমাদের ছেলেরা প্রোটেস্ট করতেই ওরা অ্যাটাক করেছে। বোমায় আমাদের চারজন ইনজিয়োর্ড হয়েছে স্যার। একজন হসপিটালে। …আজ ওদের ছাড়া নেই।
কী করবে? ওদের আটটাকে ফেলবে? তারপর ওরা তোমাদের ষোলোটাকে? তোমরা ওদের বত্রিশটাকে?
দু’-এক সেকেন্ড বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল শুভম। তারপর চুল ঝাঁকিয়ে বলল, আপনি জানেন না স্যার, ওরা আমাদের ক্যাম্পাসটাকে গন্দা করে দিচ্ছে।
কিন্তু তেড়ে যে যাচ্ছ… পুলিশ তো ধরবে।
ফুঃ। পুলিশের সেই ক্ষমতা আছে নাকি? একজনকে ছুঁয়ে দেখুক। অ্যাইসান কড়কান খাওয়াব…! অদূরে পরপর কয়েকটা বোমা ফাটল, সঙ্গে সঙ্গে শুভমের চোখ চঞ্চল। খানিকটা যেন উদভ্রান্ত স্বরে বলল, চলি স্যার। কমরেডদের পাশে দাঁড়াতে হবে। প্রতিরোধ গড়তে হবে।
কোনওক্রমে কথা ক’টা বলে দৌড়েছে শুভম। পলক ফেলার আগেই দৃষ্টিসীমার বাইরে। জটলাটাও যাচ্ছে পিছন পিছন।
খানিকক্ষণ হতভম্ব দাঁড়িয়ে থেকে অনুপম বিচিত্র মুখভঙ্গি করল। বিরক্তি, বিস্ময়, অসহায়তা আর হতাশা মেশানো। তালা খুলে ঢুকল নিজের কক্ষে। চেয়ারে বসে দু’হাত ছড়িয়ে দিয়েছে। আজ ক্লাস হওয়ার তো কোনও সুযোগই নেই, গোটা দিনটাই বেকার। কী করবে এখন? প্রমিত রায় নামে একটি ছেলে সম্প্রতি তার অধীনে গবেষণা শুরু করেছে, কাজের একটা খসড়া মতন দিয়ে গেছে ছেলেটা, সেটা নিয়ে বসবে? যা ধুন্ধুমার কাণ্ড চলছে, ঠান্ডা মাথায় কাজে মনোযোগী হওয়া কঠিন। খসড়াটা নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবে? কিন্তু বাড়ি গিয়ে কাগজপত্র নিয়ে বসে গেলে আর বেরোতে ইচ্ছে করে না। তা ছাড়া বিকেলে আবার তো যাদবপুরেই আসবে, সোহিনীদের বাড়ি। আজ ভাস্করকে রক্ত দিতে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, বিকেলে ভাস্করের চলে আসার কথা, গিয়ে একবার বেচারাকে তো দেখে আসতেই হয়।
পরশু সোহিনীদের বাড়ি গিয়েছিল অনুপম, তখনই রক্ত দেওয়ার কথাটা শুনল। তার আগের দিন ফোন করেছিল সোহিনী, অনুপমকে অবশ্য তখন বলেনি। যাক গে, ব্যাপারটা সোহিনীর, যদি সে অনুপমকে জানানোর প্রয়োজন না মনে করে, তানুপমের কীই বা করার আছে! তবে ভাস্করকে বারবার এভাবে টানাহেঁচড়া করাটা কি ঠিক? দিন দশেক পর একবারই ভরতি করে, রক্ত-টক্ত দিয়ে, তৃতীয় দফার কেমোটা কি সেরে নেওয়া যেত না?
সোহিনীদের প্ল্যানটা বোধহয় ভাস্করেরও মনঃপূত নয়। মুখে অবশ্য কিছু বলছিল না ভাস্কর, তবে পরশু একদম চুপ মেরে ছিল। একটু যেন বেশিই নিশ্চুপ। ফোর্থ স্টেজ ক্যান্সার রোগীর দীর্ঘকাল বেঁচে থাকার তিনটে উদাহরণ শোনাল অনুপম, তবু ভাস্করের যেন কোনও প্রতিক্রিয়াই হল না। এত কীসের নিরাসক্তি? বাঁচার স্পৃহা আছে নিশ্চয়ই। নইলে কেমোথেরাপির প্রসঙ্গ যখন আলতোভাবে একবার তুলল অনুপম, অন্য দিনের মতো ভাস্কর হাঁউমাউ তো করলো না!
সোহিনীকে পরশু বড় উদাস দেখাচ্ছিল। যেন দূরমনস্ক। অনুপম যখন ভাস্করের ঘরে, একবার মাত্র ঢুকেই বেরিয়ে গেল। অনুপম যখন রওনা দিচ্ছে, সোহিনী ব্যালকনিতে। ডেকে জিজ্ঞেস করা হয়নি, আজ সকালে অনুপম গাড়ি নিয়ে যাবে কিনা। সোহিনী কি তাতে আহত হয়েছে? কী যে করে অনুপম, আগ বাড়িয়ে কিছু করতে যাওয়াও তো ঝকমারি। ভাস্করের তরুণদাটি এমন চিমটি কাটা কথা বলে! যেন বিপদের সময়ে সোহিনীর পাশে দাঁড়ানোর পিছনে অনুপমের কোনও উদ্দেশ্য আছে! তরুণ ব্যানার্জি লোকটা মহা ধূর্ত। একটা কিছু আঁচ করেছে বোধহয়।
দরজায় টকটক আওয়াজ। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে খাটো পরদা সরিয়ে একটা গোল মুখ, আসতে পারি স্যার?
অনুপম নড়ে বসল, আসুন।
খর্বকায় পুরুষ্ট লোকটা ব্রিফকেস হাতে ভেতরে এল। বছর পঞ্চাশ বয়স, ভরাশ্রাবণেও সুটেড-বুটেড, কালো ডাই করা চুল চকচক করছে। মাথা ঝুঁকিয়ে অনুপমকে অভিবাদন জানাল লোকটা। সপ্রতিভ স্বরে বলল, আমার নাম অজিত সাহা। কনস্ট্রাকশনের ব্যাবসা করি।
ও। কোনও অর্ডারের ব্যাপারে এসেছেন বুঝি? কিন্তু আমি তো ডিপার্টমেন্টাল হেড নই। ওসব ডক্টর চাকলাদার দেখেন।
আমি কোনও অফিশিয়াল কাজে আসিনি স্যার। একটা পারসোনাল প্রয়োজন ছিল।
আমার সঙ্গে?
হ্যাঁ স্যার। বসব?
লোকটার কথায় বিশেষ ঘোরপ্যাঁচ নেই। মিনিট তিনেকের মধ্যে অনুপমকে সমঝে দিল, সে এক বিল্ডিং প্রোমোটার। এবং অনুপমদের পণ্ডিতিয়ার বাড়িটা ভেঙে ফ্ল্যাট বানাতে ইচ্ছুক।
শুনে আদৌ প্রীত হল না অনুপম। ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, তা আপনি এখানে কেন? মাই পারসোনাল ম্যাটার শুড নট বি ডিস্কাসড্ হিয়ার।
তা হলে কোথায় মিট করব বলুন? আপনাদের বাড়িতে তো দেখা করা সম্ভব নয়। প্রচুর বখেড়া আছে। আমি আপনার সঙ্গে একটু নিরিবিলিতে বসতে চাই।
অ। অনুপম ভুরু কুঁচকে দু’-এক সেকেন্ড ভাবল। তারপর হেসে ফেলেছে, আপনার উৎসাহ তো কম নয়! এই হট্টগোলের মাঝে হাজির হয়েছেন!
গন্ডগোলের ভয় পেলে আমাদের চলে না স্যার। যে লাইনে কাজ… বোমা ছুরি পিস্তল, অনেক কিছুই সামলাতে হয়।
অজিত সাহা লোকটিকে মন্দ লাগছিল না অনুপমের। হেসেই বলল, বুঝেছি। আপনি অকুতোভয়। এবার আপনার আগমনের হেতুটা শোনা যাক।
বাহ্, ভারী সুন্দর ভাষায় বললেন তো! অজিতের চোখে মুগ্ধতা, আপনার দাদারাও যদি আপনার মতো হতেন…
দেখুন, আমি কারও নিন্দেমন্দ শোনা পছন্দ করি না। কাজের কথা বলুন।
প্রথমেই তা হলে একটা ইনফর্মেশন দিই স্যার। আপনি জানেন না… সম্ভবত জানতেও পারবেন না… কামিং সানডের পরের সানডে আপনার দাদারা, এবং দুই দিদি আমার অফিসে বসছেন।
তাই বুঝি? তা আমার কাছে লুকোনো হবে কেন?
কারণ আপনার দাদাদের ধারণা, এসব ঝুটঝামেলায় আপনি নিজেকে জড়াতে চান না। এবং তাঁরা যে ডিডই করুন, আপনি তাতে এগ্রি করবেন।
ঠিকই তো বলে। আমি ওসব বুঝিও না, ওসব নিয়ে মাথা ঘামাই না।
খুবই স্বাভাবিক। আপনি জ্ঞানীগুণী মানুষ…বিদ্যাচর্চায় ডুবে থাকেন… বৈষয়িক ব্যাপারে কেন নিজেকে জড়াবেন! কিন্তু স্যার, আমি যে আপনাকে চাই।
মানে?
তোমার আন্তরিক বাসনা, ওই মিটিংটিতে আপনি পায়ের ধুলো দিন।
তাতে লাভ?
আছে। একা আমার নয়, সবার। অজিত সাহা গলা ঝাড়ল, আসলে হয়েছে কী… আপনার দিদি-দাদারা প্রত্যেকেই স্বাধীন মতবিশিষ্ট নাগরিক। আপনার মতো বিদ্বান মানুষকে আর কী বলব, আপনি তো জানেনই… আমাদের এই গণতান্ত্রিক দেশে প্রতিটি স্বাধীন নাগরিকের মত ভিন্ন ভিন্ন হয়।…এটা খুবই ভাল। অতি স্বাস্থ্যকর লক্ষণ। তবে আমার মতো একজন ব্যাবসাদারের পক্ষে অতগুলো মতকে একসঙ্গে গুরুত্ব দেওয়া তো সম্ভব হবে না।
বুঝেছি। প্রত্যেকেরই চাহিদা আলাদা।
কী সহজে আপনি ধরে ফেললেন স্যার!
কিন্তু আমি মিটিং-এ থাকলে তফাত কী হবে?
বিস্তর ফারাক হবে স্যার। আপনার দাদারা আপনাকে খুব সমীহ করেন। আপনার মতো লার্নেড ম্যান যদি উপস্থিত থাকেন, আর আমার প্রস্তাবগুলো যদি ন্যায্য হয়… তা হলে আপনার খাতিরেই সবাই সেটা মেনে নেবেন। আপনার মতো ব্যক্তির সামনে তাঁরা তো অন্যায্য কিছু বলতে পারবেন না।
বটে? তা হলে আপনার প্রস্তাবগুলো তো আমার আগে শুনে রাখা দরকার।
ফ্ল্যাট তো স্যার সবার মিলবেই। আপনার দিদিদেরও। হয়তো দু’-পাঁচ-দশ স্কোয়্যার ফুট ছোট-বড় হবে…
তাতে কী আসে যায়! আমি না হয় ছোট ফ্ল্যাটই নেব।
এটা তো আপনার মহানুভবতা। সবাই তো আপনার মতো উদার নন। আমি… ফ্ল্যাটের সঙ্গে টাকাও দেব। তবে ওঁরা যা চাইছেন, ততটা বোধহয় পারব না। কারণ বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট বানাতে না হোক এইটিন্থ মান্থ টাইম…।
এই দেড় বছর আপনাদের পাঁচ ভাইকে তো কোথাও থাকার বন্দোবস্ত করে দিতে হবে। আর আপনার মতো রেসপেক্টেবল মানুষকে তো যে সে জায়গায় রাখা যায় না… এতেও তো একটা খরচ আছে স্যার। না হোক, পার হেড দেড়-দু’লাখ। ওই টাকাটুকুই যা কনসেশন চাই। …ভেবে দেখুন স্যার, সাত-সাতখানা ফ্ল্যাট আপনাদের দেওয়ার পর আমার আর কত প্রফিট থাকে? আপনার যা ব্রেন…ডেটা দিয়ে দিলে দু’মিনিটে হিসেব কষে নেবেন।
অজিতের সরল স্তুতিবাক্যগুলো দিব্যি উপভোগ করছিল অনুপম। সে যে তার দাদাদের চেয়ে অনেকটাই পৃথক গোত্রের, এটা বুঝতে পেরেছে বলে অজিতকে যেন আরও বেশি করে পছন্দ হচ্ছিল। স্মিত মুখে অনুপম বলল, বেশ তো আপনি তা হলে দাদাদের বলুন, যেন আমাকে প্রেজেন্ট থাকতে অনুরোধ জানায়।
অবশ্যই। অবশ্যই। আপনি সেধে যাবেন কেন? আপনার সম্মান ক্ষুণ্ণ হবে। শুধু ডেট আর টাইমটা খেয়াল রাখবেন। এই সানডের পরের সানডে। সকাল দশটা।
অজিত বিদায় নেওয়ার পর অনুপম মিনিট কয়েক চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রইল। তৃপ্ত মুখে। গুণ আছে লোকটার, তিতকুটে মেজাজটা চমৎকার ঝরঝরে করে দিল। এবার নিশ্চয়ই কাজে বসা যায়।
প্রমিতের খসড়ার প্রিন্ট-আউটখানা সবে খুলেছে অনুপম, ওমনি মোবাইল বাজছে। ও প্রান্তে বিভাগীয় সহকর্মী ডক্টর বিজন ঘোষ রায়।
হ্যাঁ বিজনবাবু, বলুন? দিনটা তো পুরো বরবাদ, তাই না?
সে আর বলতে!…আপনি নাকি এখনও ডিপার্টমেন্টে?
হ্যাঁ, আমার রুমে। কেন?
ওফ্, আপনাদের মতো ভালমানুষদের নিয়ে হয়েছে মুশকিল। …করছেনটা কী?
একটা ড্রাফ্ট দেখছি…
রাখুন আপনার পড়াশোনা। এত আত্মভোলা হলে চলে! …শুনেছেন কি, স্টুডেন্টদের একটা গ্রুপ মেন গেট অবরোধ করতে চলেছে? টিচিং, ননটিচিং, কোনও স্টাফকে তারা বেরোতে দেবে না।
তাই?
ইয়েস স্যার। আপনি সাতেপাঁচে থাকেন না, তাই বলছি… ইমিডিয়েটলি লিভ দ্য ক্যাম্পাস। আমি রেজিষ্ট্রারের চেম্বারে। আমিও দু’মিনিটে বেরিয়ে পড়ছি।
থ্যাঙ্কস। থ্যাঙ্কস ফর দ্য নিউজ।
ঝটপট খসড়াটা বগলে নিয়ে অনুপম ঘরে তালা মারল। বিল্ডিং-এর বাইরে এসে দেখল, পুলিশের গাড়ি আর নেই, ছাত্রছাত্রীরা জমছে একে একে। লম্বা লম্বা পা ফেলে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল অনুপম। তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে গেটের বাইরে।
প্রায় বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে, আবার মোবাইলে কুককুক। গাড়ি চালাতে চালাতে ফোন ধরে না অনুপম, তুলে মনিটরটা দেখল ঝলক।
এবং দেখেই চমকেছে। সোহিনী!
হঠাৎ সোহিনী? এই দুপুরবেলায়? সোহিনীর তো এখন হাসপাতালে থাকার কথা…!
মগজে ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের বিপবিপ। ঝটাকসে গাড়ি সাইড করল অনুপম। ফোন কানে চেপেছে, হঠাৎ আমায় স্মরণ? এই মেঘলা দিনে।
ওপারে সোহিনীর কম্পিত স্বর, সব বুঝি শেষ হয়ে গেল অনুপম।
হোয়াট?
ব্লাড নেওয়ার সময়ে হঠাৎ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট… সঙ্গে সঙ্গেই বোধহয়…। সোহিনীর গলা বুজে এল, ওরা অবশ্য তাও আইসিসিইউ-তে নিয়ে গেল। বলল, ভেন্টিলেশনে রাখছে…
ক্ষণিকের জন্য অনুপমের স্বর নেই। তারপর অস্ফুটে বলল, আর কেউ আছে ওখানে?
শুধু তরুণদা।
আমি আসছি। এক্ষুনি।
ফোন অফ করে স্টিয়ারিং-এ নিশ্চল বসে আছে অনুপম। ভাস্করের মৃত্যুটা তো অবধারিতই ছিল। আজ, না হলে কাল, নয়তো তার ক’দিন পরে…। কিন্তু কী আশ্চর্য, কণামাত্র দুঃখ হচ্ছে না কেন? বরং যেন এক অপরূপ মুক্তির বাতাস…!
অনুপম থরথর কেঁপে উঠল। ছি, ছি, তার বন্ধু এক্ষুনি মারা গেছে, আর সে কিনা…! সভ্য, সুশিক্ষিত, মহানুভব অনুপম আদতে তবে এক নরাধম? কীটস্য কীট? যে কিনা বন্ধুর স্ত্রী হস্তগত হচ্ছে, এই চিন্তায় বন্ধুর মৃত্যুতে পুলকিত হয়?
অনুপমের ভীষণ কান্না পাচ্ছিল। নিজের ক্ষুদ্রতায়। হীনতায়।
যদি সোহিনী কোনওদিন এই মুহূর্তটাকে জানতে পারে? যদি পারে…!
.
১৪.
পুজোর পর থেকে এবার বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। সকাল-সন্ধে হিম পড়ছে রীতিমাফিক। শীতঋতু এখনও খানিক দূরে, তবু যেন বাতাসে তার পদধ্বনি শোনা যায়।
অফিস থেকে বেরিয়ে আজ পণ্ডিতিয়ায় এল সোহিনী। আসে মাঝে মাঝে। নীল কুয়াশামাখা অন্ধকার অন্ধকার গলিটুকু পেরিয়ে অনুপমের দরজায় এসেছে। কলিংবেলে হাত রাখল। ঘন্টি বাজিয়ে ঘড়ি দেখল একবার।
পাল্লা খুলতে অনুপমের যেন একটু সময় লাগল। শান্ত গলায় ডাকল, এসো।
শয়নকক্ষে নয়, বাইরের ঘরে বসেছে সোহিনী। ভ্যানিটিব্যাগ সেন্টারটেবিলে রেখে জিজ্ঞেস করল, আজ কেমন? জ্বরটা ছেড়েছে?
সিজন চেঞ্জের জ্বর ক’দিনই বা থাকে!
রাতে শোওয়ার সময়ে এবার ফ্যানটা কমিয়ে দিয়ো।
আলতো হাসল অনুপম। জিজ্ঞেস করল, কফি খাবে?
ইচ্ছে করছে না।
প্রত্যাশিত উত্তর। অনুপম জোর করল না। বসেছে দূরের সোফায়।
ঘরে টিউবলাইটের ফ্যাকাশে সাদা আলো। সোহিনীর চোখ ঘুরল আলোটায়, টিউবটায় তেমন জ্যোতি নেই।
হুম্। বদলাতে হবে।
পালটাবে? বাড়ি তো ছেড়েই দিচ্ছ।
এখনও দেরি আছে। ভাঙাভাঙি শুরু তো সেই জানুয়ারিতে।
কোথায় থাকবে কিছু ঠিক হল?
সাহা তো বলছে পাড়াতেই দেবে। দেখি কী করা যায়। অনুপম মাটির দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবল। চোখ তুলে বলল, ভাবছি ক্রিসমাসে একবার শিকাগো ঘুরে আসি।
মেয়ে ডাকছে বুঝি?
ঠিক সেভাবে নয়। তবে লাস্ট মেলটাতে মনে হল, গেলে হয়তো খুশিই হবে।
মেয়ে তো এখন মায়ের সঙ্গেই…
হ্যাঁ। আলাদা অ্যাপার্টমেন্টে উঠে গেছে। জোহানের সঙ্গে ডিভোর্সটা পেয়ে গেলে ওরা সম্ভবত অন্য জায়গায় চলে যাবে। সামটাইম ইন নেক্সট ইয়ার। বোধহয় দেশটাই ছাড়ছে।
তাই নাকি? কোথায় যাবে?
কানাডা। কুইবেক সিটি। মারিয়া আদতে ফ্রেঞ্চ তো, কানাডার ওই সাইডটা ওর খুব প্রিয়। আমাকেও কয়েকবার বলেছিল, চলো ফ্রেঞ্চ কানাডায় শিফ্ট করি।
এখনও তো যেতে পারো।
অনুপম আবার একটু হাসল। বড় অনুজ্জ্বল হাসি। বোধহয় একটা শ্বাসও পড়ল। কিছুই বলছে না আর। সোহিনীও নীরব। এমনই হয় আজকাল। কথা থাকে না। কথা খুঁজতে হয়।
সোফায় হেলান দিয়ে বসেছে অনুপম। ডান হাতের চেটোয় ঘষছে বাঁ হাত, আপন মনে। হঠাৎই বলল, তা শ্রীমান পাপানের লেখাপড়া চলছে কেমন?
এই তো… গিয়ে ওকে নিয়ে বসব। কিছু একটা বলতে পেরে সোহিনী যেন স্বস্তি পেল, সামনেই তো পরীক্ষা।
পাপানের জন্য একটা টিউটর দেখো এবার। তুমি আর কত…
যদ্দিন পারছি, করি। তারপর না হয়…
ছেলেটাকে অনেকদিন দেখিনি।
গেলেই পারো।
যাব।
আবার কথারা নিখোঁজ। আবার নিঃশব্দ বসে থাকা। বাতাসের শব্দ শোনা। ফ্যাকাশে আলোর তাপটুকু নেওয়া।
হঠাৎ সোহিনী বলল, মা’র হাঁটুর অপারেশনটা হচ্ছে।
কবে?
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি।
হুঁ। সার্জারি শীতে করানোই ভাল। তাড়াতাড়ি হিলিং হয়।
ফের ঘর জুড়ে দুঃসহ স্তব্ধতা। এক-দু’ মিনিট। নাকি অনন্তকাল? অন্তত সোহিনীর তো তাই মনে হচ্ছিল। অনুচ্চ স্বরে সোহিনী বলল, এবার তা হলে উঠি?
অনুপম সোজা হয়ে বসল, যাবে?
আমার দেরি হলে মা খুব উতলা হয়ে পড়েন। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন ব্যালকনিতে।
মাসিমার শরীর ঠিক আছে? কী একটা চোখের প্রবলেম হচ্ছে বলছিলে…
হুঁ। দেখাতে হবে। ছানি পড়ছে বোধহয়। সোহিনী ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়াল। এক পা গিয়েই থমকেছে। চেন খুলে অনুপমের দরজার চাবিটা বার করল ম্লান হেসে বলল, এটা রাখো। প্রায়ই ভাবি দিয়ে যাব, ভুলে যাই।
টেবিলেই থাক।
চাবিটা নামিয়ে দিয়ে সোহিনী পায়ে পায়ে দরজায়। অনুপমও এসেছে সঙ্গে। পাল্লাটা ধরে বলল, তুমি কিন্তু বেশ রোগা হয়ে গেছ সোহিনী।
তাই? হবে হয়তো। …যাই।
বলেও কে জানে কেন একটুক্ষণ অপেক্ষা করল সোহিনী। আগে এই সময় অনুপম বলত, যাই নয়, বলো আসি।
এখন আর বলে না অনুপম। সোহিনীও কি শুনতে চায়?
অনুপম আর সোহিনীর মাঝে এখন এক ছায়ার প্রাচীর। একজন মৃত মানুষ। যার অবয়বই নেই, তাকে অতিক্রম করা যায় কি?
সোহিনী জানে না। অনুপমও না।
______