১০. গোস্তাকি মাফ করবেন

খরাবী দিলকী ইস হ হ্যায় কেহ্ য়হ্ সমঝা নহীঁ জাতা,
কেহ্ আবাদী ভী য়াঁ থী য়া-কে বীরাহ মুদ্দৎ কা।।
(হৃদয় আমার এমন উজাড় হয়েছে যে বোঝাই যায় না
এখানে কোনও দিন বসতি ছিল, না কি যুগ যুগ ধরে উজাড় হয়েই আছে।)

মির্জাসাব, ভাইজানেরা, গোস্তাকি মাফ করবেন, বদনসিব মান্টোর কথা এবার আপনারা একটু শুনুন। পেটের ভেতরে কথারা গলগল করে উঠছে, বাঁধ মানতে চাইছে না, আমি কথা বলতে শুরু করলে ইসমত শুধু হাসত আর মুখের ভেতর বরফ নিয়ে নাড়াচাড়া করত, বরফ খেতে কী যে ভালবাসত ইসমত, আর আমি কথা বলে যেতাম, পগালের মতো বলে যেতাম, শফিয়া বেগম মাঝে মাঝে এসে আমার মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসত। আমি জানি, ওরা আমার কথা, বেশীক্ষণ সহ্য করতে পারত না, মুখে তে সব সময় খিস্তি, কথার আগে-পিছে শালা ছাড়া বলতেই পারতাম না; কী করব বলুন মির্জাসাবের মতোই তো পথে পথে, চায়ের দোকানে, কফিখানায় কেটে গেছে আমার জীবন; আম্মিজান ছাড়া কে ছিল আমার, যে আমার দিকে ফিরে তাকাবে?

বাবার কথা তেমন কিছু বলার নেই, মির্জাসাব। রইস আদমি, লুধিয়ানার সমরালায় সরকারি অফিসার, দু-দুটো বিয়ে করেছিলেন। তাঁর ছোট বিবির ছেলে আমি। আমার দিকে কোনওদিন ফিরেও তাকাননি। মায়ের সঙ্গেই ছিল আমার সব খুনসুটি, আমি তাকে ডাকতাম বিবিজান। আর আমার নিজের বোন ইকবাল। মির্জাসাব, বাবা যেন একটা জিনের ছায়া, যে-ছায়াটা সারা জীবন আমাকে ছেড়ে যায় নি। অনেক পরে আমি কাক্কার জাজমেন্ট গল্পটা পড়ে চমকে উঠেছিলাম। সেই গল্পেও এক বাবা, দৈত্যের মতো এক বাবা, যার জন্য ছেলে জানলা দিয়ে। নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। মির্জাসাব, আমার প্রত্যেকটা গল্পে ওইরকম কেউ না কেউ একটা দৈত্যের মতো বাবা হয়ে ফিরে এসেছে, আর তাকে আমি হত্যা করতে চেয়েছি।

আমার বাবা মৌলবি গুলাম হাসান তাঁর বড় বিবির তিন ছেলেকে লেখাপড়া শেখালেন, বিদেশে পাঠালেন, প্রতিষ্ঠিত করলেন, আর এই মান্টোকে ছেড়ে দিলেন রাস্তায়-যাও শালা, ঘুরে বেড়াও, বেওয়ারিশ কুকুরের মতো, লোকের ফেলে দেওয়া মাংসের হাড়ি খুঁজে খাও। মহম্মদ হাসান, সীদ হাসান, সালিম হাসান-তাঁর বড় বিবির তিন ছেলে ইংল্যান্ডে মির্জাসাব, আর আমি সমরালার রাস্তায়, কী করছি? বাদরের নাচ দেখছি, আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার খেলা দেখছি। ম্যাট্রিক অবধি পড়াশুনো করে ছেড়ে দিলাম। কে দেবে পড়ার খরচ? মৌলবি গুলাম হাসান তাঁর তিন ছেলেকে ইংল্যান্ডে রইস আদমি বানাবেন না? মির্জাসাব আমি আর কী করি, একদিন শরাবখানায় ঢুকে পড়লাম। পুলিশ আমাকে মারতে মারতে জেলখানায় নিয়ে গেল। কদিন পরে খালাসও পেয়ে গেলাম, কীভাবে কে জানে। তারপর প্রায়ই শরাবখানায় যেতে শুরু করলাম। বিবিজানের বাক্স থেকে পয়সা চুরি করা এভাবেই শুরু হল। শরাবের পর ঘুম, ঘুমের ভেতরে খোয়াব, আর সেই খোয়াবে কে এসে দাঁড়াত জানেন? মৌলবি গুলাম হাসান, শালা শুয়ার কা বাচ্চা, আমি ওর দিকে পাথর ছুড়তাম, গু ছুড়তাম, কিচর ছুড়তাম, লোকটা তবু হা হা করে হাসত, এত বেশরম আদমি। খবিশ, জানেন মির্জাসাব, ওই লোকটা আমার জীবনের অপদেবতা ছাড়া কিছু না। আমার দিকে কীভাবে তাকিয়ে থাকত জানেন? যেন আমি একটা পোকা, নর্দমা থেকে উঠে এসে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েছি। আম্মিজানকে কী বলত জানেন, এই লাফাঙ্গাটাকে এত ভালবাসো কেন বিবি, ওকে তো আসলে দায়েরে পাঠানো উচিত।

দায়ের, হ্যাঁ দায়েরেই তো আমার সারা জীবন কেটে গেল মির্জাসাব। শুধু গল্প লেখার জন্যই। তো কতবার দায়েরে গিয়ে দাঁড়াতে হল আমাকে। ছোটবেলা থেকে আগুনের ফণা এসে ঘিরে ধরল আমাকে। মীরসাবের সেই শেরের কথা মনে আছে মির্জাসাব?

দিলকে তঈঁ আতশ-এ-হিজরাঁ-সে বচায়া নহ্ গয়া
ঘর জলা সামনে পর হমসে বুঝায়া নহ্ গয়া।।
(হৃদয়টাকে বিরহের দাহ থেকে বাঁচানো গেল না;
দেখতে দেখেতে ঘর পুড়ে গেল তবু আগুন নিভাতে পারলাম না।)

তেমনই এক আগুনের ভেতরে গিয়ে আমি দাঁড়িয়েছিলাম ছেলেবেলায়। মির্জাসাব, সেই দিন থেকে আমি আগুনের বাসিন্দা হলাম। নাকি আগ কা দরিয়া বলবেন? যাই বলুন না কেন, পুড়তে পুড়তে তেতাল্লিশটা বছর পার হয়ে গেল। শাফিয়া বেগম বলত, এইভাবে নিজেকে পুড়িয়ে কী পেলেন মান্টোসাব?

– কিস্সা, বেগম।

-কাদের কিস্সা?

-ওই যে ওরা-ওরা-বড় রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে, দেখতে পাচ্ছ না? ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মধ্যে মিশে দাঁড়িয়ে আছে।

-কারা?

-মান্টোর আত্মারা।

আগুনের গল্পটা আগে বলে নিই মির্জাসাব। ভাইজানেরা, জেনে রাখুন, এই সেই মান্টো, সাদাত হাসান কবেই মারা গেছে, কিন্তু মান্টো আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়েছিল। একদম সাচ বাত। এক বঁদ ঝুটা নেহি। মান্টো ঝুটা জানে না, ঝুটা জানত না, তাই ওরা তাকে বারবার কোর্টে টেনে নিয়ে গেছে, সাহিত্যের বড় বড় বান্দারা বলেছে, মান্টো আবার লিখতে পারল কবে, আর কমিউনিস্টরাও তো ছেড়ে কথা বলেনি, শালা মান্টো, শুয়ারকা বাচ্চা, সাহিত্যের নামে কিচর ছড়িয়ে যাচ্ছে। বন্ধু বলে যারা আমার পরিচয় দিয়েছে, তারাই আমাকে নিয়ে হেসেছে, বলেছে আমি সিনিক, প্রতিক্রিয়াশীল। আমি নাকি মরা মানুষের পকেট থেকেও সিগারেট বার করে ধরাই। ছোটবেলায় যে-আগুনের ওপর আমি গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, সেই আগুন ছাড়া আর কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা ছিল না আমার, মির্জাসাব। কবেই তো আপনি একটা শের-এ লিখেছিলেন :

গম-এ হস্তী-কা, অসদ, কিস-সে হো জুজ মর্গ ইলাজ,
শমা হর র-মে জলতী হৈ সহর হোনে তক।।
(মৃত্যু ছাড়া জীবনযন্ত্রণার আর কী ওষুধ আছে আসাদ,
প্রদীপকে তো সবরকমের জ্বলা জ্বলতেই হবে ভোর হওয়া পর্যন্ত।)

ধরা যাক, ১৯১৮-তে যদি আমি জন্মে থাকি, যদি অবশ্য মৌলবি গুলাম হাসান তা স্বীকার করেন, তা হলে তখন আমি দশ কী বারো বছরের একটা কুত্তা। আপনারা জানেন না, সেবার লন্ডনের পিকাডিলি সার্কাসে চোখে কালো কাপড় বেঁধে গাড়ি চালিয়ে হল্লা মাচিয়ে দিয়েছিল মাস্টার খুদা বক্স। সে কী হইচই তখন। শালা, আমরা যেন দুনিয়াদারি পেয়ে গেছি। তা, কী হল জানেন, সেবারই এক কাণ্ড ঘটল, যেন খোদাই খবর পাঠালেন আমার কাছে। মির্জাসাব, আপনি তো জানেন, এটা একটা ঘটনা কীভাবে জীবনটা পূর্ণিমার রাতের সমুদ্রের মতো বদলে দেয়। যেমন সেই বেগম ফলক আরা। আমি জানি, আপনি কখনও আর তাঁর কথা বলবেন না; ইক কী তা তো আপনি তাঁর কাছেই শিখেছিলেন। হাফিজসাব তো আপনার জন্যই লিখেছিলেন :

চ কু হলে বীনশে মা খাকে আস্তানে শুশস্ত
কুজা রবমে বফর্মা অযী জনাব কুজা।।
(আমরা যে মিলেছিলাম একদা সে সুখস্মৃতির হল অবসান
কী করে, আপনি মিলাল সে সব মোহনী মায়া, সেই অভিমান!)

হ্যাঁ, কাউকে কাউকে কবর দিতে হয়, হৃদয়ের একেবারে গভীরের দরগায়, সে তো পীরস্থান, এই শরীরের ভিতরের জন্নত, যেখানে আমিও কবর দিয়েছিলাম ইসমতকে-ইসমত চুঘতাই বরফ চিবোতে কী যে ভালবাসত। বাসনার সেই দরগায় বেগম নেই; নেই তো নেই; তাতে আমি কী করতে পারি, মির্জাসাব, কে আমার জন্নত আর জাহান্নমে থাকবে আর থাকবে না, তা তো আমরা ঠিক করতে পারি না, মির্জাসাব, ঠিক করে দেন তিনি, আল-ফতাহ্। কথাটা আপনি মানেন তো?

এই মিশকিনকে মাফ করুন ভাইসব, মান্টো তার কিস্সা থেকে বারে বারেই গায়েব হয়ে যাচ্ছে। এটাই আমার স্বভাব ছিল। যদি আমার কিস্সাগুলো আপনারা পড়তেন, তা হলে বুঝতে পারতেন, মান্টো এই আছে তো, এই নেই, একটা কোফর আত্মার মত পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। না পালিয়ে তো উপায় ছিল না। সাদাত হাসান কখনও মান্টোর মুখোমুখি দাঁড়াতে পারত না। সাদাত হাসানের কত ঠাটঠমক, কত আভিজাত্য, এই রকম পোশাক চাই, ওইরকম লাহোরি জুতো না হলে তাঁর চলবে না, আনারকলি বাজারে কারনাল বুট শপ থেকে অন্তত দশ থেকে বারো জোড়া চপ্পল কিনতেই হবে; কত তার খুশখেয়াল। আর মান্টো তার কান ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলত, শালা শুয়ারকা বাচ্চা, নবাবি মারাচ্ছ, যা লিখছ, তার নিয়তি জান? কালো কাপড়ে মুখ বেঁধে অন্ধকূপে ফেলে দেবে ওরা তোমাকে। সারা হিন্দুস্থান ম ম করবে তোমার লেখার বদবুতে। শালা, শুয়ার কাহিকা, ঠাণ্ডা গোস্ত লেখো, এত বড় কাফের তুমি? কী বলে ওরা, শুনেছ? শুধু নারী-পুরুষের মাংসের গল্প লিখেছ, রেড লাইট এরিয়া ছাড়া আর কী আছে তোমার লেখায়! হাত তুলে দিলাম মির্জাসাব, না কিছু নেই, হত্যা আছে, ধর্ষণ আছে, মৃতের সঙ্গে সঙ্গম আছে, খিস্তির পর খিস্তি আছে-আর এই সব ছবির পেছনে লুকিয়ে আছে। কয়েকটা বছর-রক্তে ভেসে যাওয়া বছর-১৯৪৬, ১৯৪৭, ১৯৪৮-আছে নো ম্যানস ল্যান্ড, দেশের ভেতরে একটা ভূখণ্ড, যেখানে টোবা টেক সিং মারা গেছিল। টোবা টেক সিং-এর নাম আপনারা শোনেন নি। শুনবেনই বা কোথা থেকে? সে তো একটা উন্মাদ ছাড়া আর কিছু ছিল না!

না, না, ঘাবড়াবেন না ভাইজানেরা, আগুনের কিস্সাটা এবার শুরু হবে। টোবা টেক সিংকে। নিয়ে গাঁজাল পাড়তে বসব না আমি। তবে কি জানেন, এই মান্টোকে তো অনেকে নানাভাবে বুঝতে চেষ্টা করেছে-এই শুয়োরের বাচ্চাটা আসলে কে -পাগল, না ম্যানিয়াক, মানসিক রোগী, না ফরিস্তা-মানুষের এই সবটা বোঝার ইচ্ছের ওপর আমার হিসি করে দিতে ইচ্ছে করত, কী করে বুঝবি রে শালা, তুই কি আমার মতো করে কখনও সূর্যাস্ত দেখেছিস, তা হলে কী করে বুঝবি, আমি কেন প্রথমেই মেয়েদের পায়ের দিকে তাকাতাম, তাই বোঝার চেষ্টা ছাড়, মান্টোকে যদি কোথাও খুঁজতেই হয়, তা হলে ওর কিস্সাগুলো পড়-ওই যে লোক আর মেয়েমানুষগুলোকে দেখছিস, রাস্তার, চাওলের, রেন্ডিপট্টির, বম্বের স্টুডিওর-ওই-ওই ওদের মধ্যে মান্টোকে খুঁজে পেলেও পেতে পারিস। ওরা বলত, এইসব কিস্স না কিচর? আরে ভাই, যে সময়টায় বেঁচে আছি, তাঁকে যদি বুঝতে না পারিস, তা হলে আমার আফসানাগুলো পড়, আর আমার কিস্সাগুলো যদি সহ্য করতে না পারিস, তা হলে বুঝবি, এই সময়টাকেই সহ্য করা যায় না। কিন্তু এসব বলে লাভ কী? ওরা তো মান্টোর গায়ে গনগনে আগুনের শিক দিয়ে দাগা দিয়ে। দিয়েছে, ও আবার লেখক নাকি, ও তো পর্নোগ্রাফার, মানুষের জীবনের নোংরা দিকগুলো নিয়েই ওর কারবার। অথচ যখনই আমি কোন গল্প শুরু করেছি, ৭৮৬ সংখ্যা, বিসমিল্লার নাম লিখতে ভুলিনি। ভাইজানেরা, এসবই আমার জ্বলন্ত কয়লার ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার ইনাম।

মাস্টার খুদা বক্সের কথাটা মনে আছে তো আপনাদের? সেই চোখে কালো কাপড় বেঁধে গাড়ি চালিয়ে পিকাডিলি সার্কাসে নতুন সার্কাসের খেল দেখিয়েছিলেন। খুদা বক্সের পর অমৃতসরে আল্লারাখা নামে একজন এসে হাজির হলেন, তিনি নাকি খুদা বক্সের গুরু, রাস্তার ওপর গর্ত খুঁড়ে তিনি তাতে কয়লা জ্বালিয়ে দিলেন, তারপর সেই গনগনে আগুনের ওপর দিয়ে হাঁটতেন। আল্লারাখাসাবের জাদু দেখতে তো দিনের পর দিন ভিড় বাড়তে লাগল। কত কথা, কত কিস্য। ছড়িয়ে পড়ল তাঁকে নিয়ে। আমি চুপচাপ বসে লোকটাকে দেখে যেতাম। জ্বলন্ত কয়লার ওপর দিয়ে কীভাবে হেঁটে যায় একজন মানুষ? হাঁটার পর তিনি পা তুলে দেখাতেন, একটাও ফোস্কা পড়েনি। বিবিজানের কাছে আল হাল্লাজের গল্প শুনেছিলাম আমি। একবার হাল্লাজ অনেককে নিয়ে মরুভূমি পেরিয়ে মক্কায় যাচ্ছিলেন। হাঁটতে হাঁটতে খিদেয় যাত্রীরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তারা হাল্লাজকে বলল, এখানে একটু খেজুর পাওয়া যাবে না পীরসাব?

হাল্লাজ হেসে বললেন, খেজুর খাবে?

-জি, বহুৎ ভুখ। আর পা চলে না।

-দাঁড়াও। হাল্লাজ মরুভূমির হাওয়ায় হাত ঘোরাতেই দেখা গেল তাঁর হাতে খেজুরভরা এক পাত্র।

আবার চলা শুরু, আবার খিদের জ্বালায় মরুভূমির ওপর বসে পড়া। সে এক সময় ছিল ভাইজানেরা, তাই না মির্জাসাব, যখন জীবন মানেই ছিল মরুভূমির পর মরুভূমি পেরিয়ে যাওয়া। আর রাতগুলো কেটে যেত মরুভূমির আকাশের তারাদের সঙ্গী হয়ে। সে পথ পীর, সাধক, হজরতের। কত, কতদিন আগে আমরা সে পথ থেকে সরে গিয়ে এই দোজখের দিকে চলে এসেছি, আমাদের হল্লাগুল্লায়, নরকে, পচা মাংসের গন্ধে।

খিদে মেটাতে এবার ওরা হালুয়া খেতে চাইল।

হাল্লাজ হেসে বললেন, শুধু হালুয়া খেলেই পেট ভরবে, না আর কিছু চাই?

-না হুজুর। ওটুকু পেলেই আবার আমরা যেতে পারব।

-তা বটে। খাঁচাটুকু না থাকলে দীন-এর পথে যাবেই বা কী করে? বলে আবার তিনি হাওয়ায় হাত ঘুরিয়ে হালুয়া হাজির করলেন। তার সুবাসে ভরে গেল মরুভূমি। হালুয়া খাওয়ার পর

একজন বলল, এমন হালুয়া তো বাগদাদ ছাড়া কোথাও পাওয়া যায় না পীরসাব।

হাল্লাজ হেসে বলেছিলেন, বাগদাদ আর মরুভূমি, সবই খোদার কাছে এক জায়গা।

-আর খেজুর কোথা থেকে পেলেন?

হাল্লাজ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, যেন একটা গাছ। বললেন, এবার আমাকে ধরে ঝাঁকাও।

-কেন পীরসাব?

-দেখোই না। হাল্লাজ হাসলেন।

সবাই হাল্লাজকে ধরে ঝাঁকাতে লাগল; হাল্লাজ যেন খেজুর গাছ হয়ে গেলেন, ঝরে পড়তে লাগল পাকা খেজুর। গাঢ় বাদামী খেজুর সূর্যের আলোয় মনির মতো ঝকঝক করতে লাগল।

আল্লারাখাসাবের জাদু দেখতে দেখতে আমি মনসুর হাল্লাজের এই গল্পটার কথাই ভাবছিলাম। মির্জাসাব, এ তো তা হলে নিছক জাদু, হাত সাফাইয়ের খেল নয়। একজন মানুষ যদি খেজুর গাছ হয়ে যেতে পারে, তবে জ্বলন্ত কয়লার ওপর দিয়ে হাঁটতে পারবে না কেন? তা হলে কত কুয়ত নিয়ে একজন মানুষ এই দুনিয়ায় আসে? কিন্তু সেই ক্ষমতার কতটুকুই বা প্রকাশ পায়? কতটুকু আমরা দেখতে পাই? কেন দেখতে পাই না, মির্জাসাব? মীরসাবের সেই শেরটা আপনার মনে আছে?

বা রে দুনিয়ামেঁ রহো গমজদহ্ য়া শাদ রহো
অ্যায়শা কুছ করকে চলে যাঁ কেহ্ বহুত য়াদ রহো।।
(মানুষের মধ্যেই থাকো, দঃখও পাবে আবার সুখও পাবে
এমন কিছু করে যাও যেন সহজে তোমায় লোকে ভুলতে না পারে।)

দুনিয়ামেঁ রহো। বুঝতে চেয়ো না ভাইজানেরা। দুনিয়ামেঁ রহো, য্যায়সা এক কিতাব। তাঁর পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় শুধু সব লিখে নিয়ে যেও।

তারপর কী হল, বলি, আপনাদের মুখগুলো বেজার হয়ে উঠেছে, বুঝতে পারছি।

সেদিন হঠাৎ আল্লারাখাসাব বললেন। তোমরা খোদাকে বিশ্বাস করো?

-জি হুজুর। ভিড়ের ভেতর আওয়াজ উঠল।

-আর আমাকে?

-হুজুর নবি। সবাই বলে ওঠে।

আল্লারাখাসাব হা হা করে হেসে উঠলেন। -নবি? নবিকে দেখেছ? নবি কে জান?

-হুজুর, বলুন।

-তা হলে একটা কিস্সা বলি শোনো। আবু সঈদ আবুল -খয়রের কথা শুনেছ কখনও? খোরাসানের সুফি সাধক। সে সব বারোশো-তেরোশো বছর আগের কথা। তখন দুনিয়াটা কেমন ছিল জান?

-কেমন হুজুর?

-কতরকম হাওয়া বইত। আর সেই হাওয়া গায়ে লাগিয়ে এক একজন এক-একরকম পাগল হয়ে যেত। বলতে বলতে হেসে উঠলেন আল্লারাখাসাব।-তা পীর আবু সঈদ একদিন তাঁর শিষ্য দরবেশকে নিয়ে বনের মধ্য দিয়ে চলেছেন। সেই বনে থাকত বিষাক্ত সব সাপেরা। হঠাৎ একটা সাপ এগিয়ে এসে আবু সঈদের পা পেঁচিয়ে ধরল। শিষ্য তো ভয়ে একেবারে। পাথর হয়ে গেছে। শিষ্যের অবস্থা দেখে আবু সঈদ বললেন, ভয় পেও না। এই সাপটা আমাকে সেজদা জানাতে এসেছে। ও আমাকে কামড়াবে না। তুমি কি চাও, ও তোমাকেও সেজদা জানাক?

-নিশ্চয়ই। দরবেশের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

-নিজেকে যতক্ষণ না ভুলে যেতে পারবে, ও কখনও তোমাকে সেজদা জানাবে না। ইনি হচ্ছেন। একজন নবি ভাইসব। তাঁর নিজের বলে আর কিছু নেই। শুধু আল্লার কথা জানাবেন বলেই এই দুনিয়ায় এসেছিলেন। নাও, এবার পরীক্ষা দাও।

কীসের পরীক্ষা? কী পরীক্ষা চান আল্লারাখাসাব? ভিড়ের সবাই এ-ওর মুখের দিকে তাকায়।

-আল্লাকে বিশ্বাস করো বলেছ। আমাকেও করো। তা হলে যার বিশ্বাস আছে, এগিয়ে এসো, আমার সঙ্গে আগুনের ওপর দিয়ে হাঁটো।

আল্লারাখাসাবের কথা শুনে ভিড় আস্তে আস্তে পাতলা হতে থাকে। কেউ চুপি চুপি সরে যায়, কেউ আগুনের দিকে তাকিয়ে দৌড়ে পালায়। আর তখন, আমি আর বসে থাকতে পারলাম না। মির্জাসাব, এগিয়ে গেলাম আল্লারাখাসাবের দিকে। জুতো-মোজা খুলে কুর্তা গুটিয়ে নিলাম।

আল্লারাখাসাব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই আমার সঙ্গে হাঁটবি বেটা?

-জি।

-আয় তা হলে। তিনি আমার হাত ধরে টানলেন। কলমা বল। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহহা মোহম্মাদুর রসুলাল্লাহ।

-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহো মোহম্মাদুর রসুলাল্লাহ।

কলমা বলতে বলতে মনে হল, শরীরটা যেন হাওয়ার মতো হালকা হয়ে গেছে। আমি আল্লারাখাসাবের হাত ধরে আগুনের বৃত্তের মধ্যে ঢুকলাম, মির্জাসাব। তার পেছন পেছন হাঁটতে লাগলাম জ্বলন্ত কয়লার ওপর দিয়ে। হ্যাঁ, মির্জাসাব, সেই আমি নিজেকে প্রথম খুঁজে পেলাম। আমার বাবার চোখরাঙানির বাইরে, আমার উচ্চশিক্ষিত বৈমাত্রেয় ভাইদের অবজ্ঞার বাইরে, আমার নিজের পথে, আল্লারাখাসাবের পেছনে পেছনে, আগুনের বৃত্তের ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে। না, আমার পায়ে ফোস্কা পড়েনি, মির্জাসাব।

সত্যি বলতে কী, লাওয়ারিশের মতো কেটে যেত দিনগুলো। স্কুলের পড়াশোনা করতে তো একদম ভাল লাগত না। স্কুলে পড়ার সময়েই সাহিত্য আমার মজ্জায় যেন মিশে গিয়েছিল। আগা জাফর কাশ্মীরির নাটক করার জন্যই একটা দল তৈরী করেছিলাম আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে। একদিন বাবা এসে হারমোনিয়াম, তবলা-সব ভেঙে দিলেন। বললেন, এসব করা যাবে না। আর ততই আমার রোখ চেপে গেল। পড়ার বই ফেলে নানা রকম আফসানা পড়তাম; বড়দের জন্য লেখা, আমার বয়েসে যেসব বই কেউ পড়ে না। স্কুলে বদ ছেলে হিসেবেই নাম পেয়ে গেলাম টমি। তিনবারের চেষ্টায় থার্ড ডিভিশনে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করলাম, আর মজার কী জানেন, আমি ফেল করেছিলাম উর্দুতে। হা-হা, ভাবুন মির্জাসাব, উর্দুতে আমি ফেল করেছিলাম।

সে এক দিন গেছে ভাইজানেরা। পড়াশুনো তো ডকে উঠল; আমি ভিড়ে গেলাম জুয়াখেলার আড্ডায়। কর্তা জামাল সিং-এ ছিল দেনু আর ফজলুর জুয়ার ঠেক। সেখানে ফ্ল্যাশ খেলতাম আমি। প্রথমে নবিশ থাকলেও, ঘাঁতঘোঁত সহজেই বুঝে নিলাম, আমার দিন-রাত কেটে যেতে লাগল জুয়ার ঠেকে। কতদিন যে এভাবে চলেছিল, কে জানে। একদিন খুব বোর হয়ে গেলাম জানেন। নিজেকে নিয়ে সব সময় বাজি ধরা বিরক্তিকর লাগল। আমি তাহলে কেউ নই? শুধু এমন একটা মাল, যাকে নিয়ে বাজি ধরা যায়? ঠিক করলাম, বেশ, চলো মান্টো, এবার তা হলে অন্য পথে যাওয়া যাক। জীবনে পথ তো আর একটা নয়। এবার না হয় অন্য পথেই হেঁটে। দ্যাখো। কিন্তু কী করব? জুয়ার ঠেক ছেড়ে কোথায় যাব? রাস্তাই আমাকে জায়গা দিল, এ-পথ থেকে সে-পথ, এ-গলি থেকে ও-গলি, আমি খোয়বের ঘোরে ঘুরে বেড়াই, রাস্তার কুকুরদের সাথে ভাব হয়ে গেল, ওদের সঙ্গে বসে থাকতাম, আদর করতাম, ওরা আমার গা চেটে দিত। কবরস্থানগুলোতে ঘুরে বেরিয়েছি, ফকিরদের পাশে বসে কত গল্প শুনেছি, মির্জাসাব, সে-সব। গল্প হারিয়ে গেছে, আমি লিখতে পারি নি।

এর আগেই ১৯১৯-এ জালিয়ানওয়ালাবাগে সেই হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে। তখন আমার বয়স সবে সাত। কিন্তু আমি দেখেছিলাম, সারা পাঞ্জাব জেগে উঠেছে, অমৃতসরের পথে পথে মিছিল, স্লোগান। ভগৎ ছিলেন আমার আদর্শ। আমার পড়ার টেবিলে ভগৎ সিংয়ের একটা ছবি ছিল। পথে পথে যখন ঘুরে বেড়াচ্ছি, তখন একদিন জালিয়ানওয়ালাবাগের একটা গাছের তলায় বসে মনে হয়েছিল, পৃথিবীটাকে এমনভাবে তছনছ করে দেওয়া যায় না, যাতে টমিগুলো আমাদের ওপর আর নির্বিচারে গুলি চালাতে না পারে? জানেন মির্জাসাব, বেশ কয়েকবার বোমা তৈরির কথাও ভেবেছিলাম। শালা অমৃতসর উড়িয়ে দেব, সাদা শুয়োরের বাচ্চাগুলোকে দেশ ছাড়া করবই। বালা, আশিক, ফকির হুসেন, ক্যাপ্টেন ওয়াহিদ, জ্ঞানী অরুর সিংদের এইসব কথা বলতাম। ওরা হো হো করে হাসত। সব দোস্ত আমার। ওদের কথা মৌজ করো, মস্তি করো, গুলি মারো অমৃতসরের। আজিজের হোটেলে বসে আমরা গাঁজা খেতাম। আজিজের কাবাবের সঙ্গে জমে যেত গাঁজার দম। আশিক ছবি তুলত, ফকির লিখত কবিতা, জ্ঞানী অরুর সিং ছিল দাঁতের ডাক্তার। ক্যাপ্টেন যে কে, তা আর মনে নেই। গাঁজার দম মেরে রফিক গজনবির স্টাইলে গান ধরত আশিক। আর আনোয়ার, ছবি আঁকত, সেই গান শুনে শুধু বাঃ বাঃ করে। যেত। আজিজের অন্ধকার হোটেলে আনোয়ার মাঝে মাঝে নিজেও গেয়ে উঠত, এ ইশ কহি লে চল। আখতার শেরানির কবিতাকে ও গান বানিয়ে নিয়েছিল। আজিজের হোটেল এখন কোন কবরে কে জানে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *