১০. গোল্লাছুট

বন্দী জীবন থেকে মুক্তির কোনও পথ নেই। কোনওদিন মুক্তি পাবো বলে মনে হয় না। নিজ ভূমে পরবাসী হওয়ার যন্ত্রণা অনেক। আমি আমার সকল যন্ত্রণা নিয়ে একা বসে থাকি। হাসপাতাল থেকে বিনা নোটিশে আমার বিচ্ছিত হওয়া দেখে ডাক্তাররা নিশ্চয়ই বিস্মিত এবং বিরক্ত। কিন্তু কী করতে পারি আমি! নিজের জীবনটি নিজের হাত থেকে ফসকে গেল হঠাৎ। আমার অক্ষমতাগুলো আমাকে দুমড়ে মুচড়ে আমাকে ক্ষুদ্র করে ফেলতে থাকে। কষ্ট কান্নায় বুক ভারি হয়ে আছে। কথা বলতে চাই, কাঁদতে চাই কিন্তু পারি না। দিন রাত পড়ে পড়ে গোঙাই কেবল। নিজেকে বকুলির মত মনে হয়। সেই বকুলি। কথা বলতে না পারা বকুলি। বকুলি টিকাটুলির মেয়ে। হাসপাতালে একদিন বকুলির মা তাকে নিয়ে এসেছিল। এর আগে কোনওদিন বকুলি বা তার মা হাসপাতালে আসেনি। হাসপাতালের কোথায় যেতে হয়, কি করতে হয় কোনও চিকিৎসা পেতে হলে, দুজনের কেউই জানে না। সকালে হাসপাতালে ঢুকেই দেখেছি দুজন বসে আছে বহির্বিভাগের বারান্দায়। একজনের ষোল সতেরো বছর বয়স হবে, আরেকজনের বয়স অনুমান করি তিরিশের মত। হাসপাতালের আঙিনায় এরকম কত মানুষই তো বসে থাকে। কিন্তু বারান্দায় চোখ পড়তেই দেখি অল্প বয়সী মেয়েটি আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। কেন তাকিয়ে আছে, আমাকে কি চেনে নাকি! একবার মনে হয়, হয়ত আমার রোগী ছিল কোনও এক সময়, তাই চিনেছে। আমি গাইনির বর্হিবিভাগে রোগী দেখতে ঢুকে যাই। দুপুরবেলা বেরিয়ে দেখি ওরা দুজন ঠিক একই জায়গায় একই রকম করে বসে আছে। আমি কি জানি কেন ধীরে ধীরে বসে থাকা দুজনের দিকে এগিয়ে যাই, বলি, ‘রোগী কে?’

‘বকুলি।’

‘ওর নাম বুঝি বকুলি!’

‘হ আমার মেয়ে। আমার মেয়ে বকুলি।’ তিরিশ হাত রাখেন ষোলর পিঠে।

‘কি অসুখ?’

‘বকুলি কথা কয় না।’

‘অসুখ কি? কি জন্য আসছেন এইখানে।’

‘বকুলি কথা কয় না।’

‘কথা কয় না তো বুঝলাম, অসুখ টা কি? পেটে অসুখ. নাকি বুকে অসুখ। বলেন, কিসের চিকিৎসা করতে চান।’

‘বকুলির কথা ফিরাইয়া দেন। বকুলি যেন আবার আগের মত কথা কয়।’

‘কবে থেইকা কথা কয় না?’

‘আজকে একমাস হইয়া গেল কোনও কথা কয় না।’

বকুলি আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, বড় ডাগর চোখে। কী আশ্চর্য সুন্দর চোখ। এরকম চোখ যদি আমার থাকত, মনে মনে ভাবি। বিধ্বস্ত চুল। কপালে ঘামে ভেজা কিছু চুল লেপটে আছে। পরনে একটি নীল সুতি শাড়ি। আলু থালু।

‘কেন কথা কয় না?’

‘তা তো জানি না।’ মহিলা মাথা নাড়ে। বকুলির দিকে তাকিয়ে এরপর বলে, ‘বকুলি কথা ক। ক কি হইছিল। কথা ক বকুলি। ও বকুলি কথা ক। একবার কথা ক। ক কথা। কথা ক।’

‘কী হইছিল যে কথা কয় না! একমাস আগে কিছু কি ঘটছিল?’

বকুলির মা এদিক ওদিক তাকিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে আসে আমার দিকে, আমার খুব কাছে এসে কানের কাছে মুখ রেখে আস্তে বলে, ‘ও নদীর ধারে পইড়া ছিল। মানুষে আইয়া খবর দিলে আমি গিয়া নিয়া আইছি।’

‘পইড়া ছিল কেন?’

‘কী জানি, কারা নাকি ধইরা নিছিল। গেছিল ত কামে। জিনজিরার ফ্যাক্টরিতে কাম করত। কাম থেইকা দুইদিন ফিরে নাই। পরে ত খবর পাইলাম।’

‘যখন নদীর পাড়ে পইড়া ছিল , জ্ঞান ছিল?’

‘তা ছিল। আমার সাথে উইঠা আইল। আমি তারে নিয়া আইলাম বাড়িত। এত জিগাইলাম কী হইছিল ক। বকুলি কথা কইল না। সেই যে কইল না। আইজও কয় না।’

‘খারাপ কিছু ঘটছিল নাকি?’

‘মানুষে কয় ব্যাটারা নাকি তার ইজ্জত নিছে।’

বকুলির মা ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। কেঁদে কেঁদে বলতে থাকে, ‘এক আশ্বিন মাসে বকুলি হইল, পরের আশ্বিনে তার বাপ মরল।.. ‘ আমার সময় নেই বকুলির মার গল্প শোনার, থামিয়ে দিয়ে বলি, ‘কালকে সকালে আইসা নাক কান গলা বিভাগে যাইয়া ডাক্তার দেখান। গলায় হয়ত কোনও অসুবিধা থাকতে পারে।’

আমি সরে আসি। প্রতিদিনই আমাকে মানুষের কষ্টের গল্প শুনতে হয়। হাজারও রকম কষ্টের মধ্যে এও এক কষ্ট।

বকুলির মা আমাকে পেছন থেকে ডাকে, ‘আপা, বকুলি কি কথা কইব না আর?’

‘জানি না।’

আবারও ডাকে, ‘আপা একটু খাড়ন।’

দাঁড়াই।

‘আপনের বড় মায়া। বকুলি যেন কথা কয়, এই ব্যবস্থাটা কইরা দেন। বোবা মেয়ে নিয়া আমি এখন কই যামু, কি করমু।’

‘কালকে আইসা ডাক্তার দেখান। শুনেন ডাক্তার কি কয়।’ হাঁটতে হাঁটতে বলি।

হাসপাতালের গেটের কাছ থেকে একটি রিক্সা নিয়ে উঠে বসি। তখনও বকুলি ওভাবেই বসা ছিল। বারান্দা থেকে বকুলির মা আমার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিল। সারা পথ আমার কানে কেবল বকুলির মার কথাটি বাজল,বকুলি কথা ক।

পরদিন বর্হিবিভাগের বারান্দায় আমার চোখ যায়, বকুলি যেখানে বসে ছিল। অনেক রোগীর ভিড়, কিন্তু বকুলি নেই, বকুলির মাও নেই। পরদিনও দেখি। না, বকুলি নেই। হয়ত এসেছিল, ডাক্তার দেখিয়েছে, ডাক্তার বলে দিয়েছে, বকুলির গলায় কোনও রোগ নেই। বকুলির মা নিশ্চয়ই তখন বারবারই বকুলিকে বলছিল, ‘বকুলি কথা ক, কথা ক বকুলি।’ সেই থেকে বকুলিকে খুঁজি আমি মনে মনে। হাসপাতালে ঢুকলেই বসে থাকা রোগীদের মধ্যে বকুলির মুখটি খুঁজি। খুব জানতে ইচ্ছে করে বকুলি কি শেষ পর্যন্ত কথা বলেছে কি না।

আমার নির্বাচিত কলাম ওদিকে শীতের সকালের মুড়ির মত বিক্রি হচ্ছে। খোকা একটির পর একটি সংস্করণ ছেপে যাচ্ছেন। এদিকে বন্দী আমি। জেলখানার দাগী আসামীর মত বন্দী। দাগী আসামীকে সম্ভবত এত গালিগালাজ করা হয় না, যত করা হয় আমাকে। বাড়িতে অতিথি এলেও উঁকি দিয়ে একবার দেখে যায় আমার বন্দীদশা। বাড়ির কুকুর বেড়ালও দেখে দরজার ফাঁক দিয়ে। হাঁস মুরগি হাঁটছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরে উঠোনে, আহা ওদের মত স্বাধীনতাও যদি আমি পেতাম! পরাধীনতা কাকে বলে আমি হাড়ে মজ্জায় টের পাই। চিৎকার করি, সকলে শোনে, কিন্তু তালা খোলে না। যে কাপড়ে এসেছিলাম, সেই কাপড়টিই পরা, আর কোনও কাপড় নেই যে পাল্টাবো। গোসলহীন গা থেকে বিশ্রি গন্ধ বেরোতে থাকে। ঘরে একটি বই নেই যে পড়ব। কোনও টেলিভিশন নেই যে দেখব, কোনও গানের যন্ত্র নেই যে গান শুনব। কোনও মানুষ নেই যে কথা বলব। কেবল শুয়ে শুয়ে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমার আর করার কিছু নেই। আমার এখন চোখে কোনও জল নেই যে জমবে। দুটো গালে জল শুকোতে শুকোতে দাগ পড়ে গেছে। দুশ্চিন্তা এসে পাশে শুয়ে থাকে, দুর্ভাবনার কণিকারা এখন রক্তের লাল সাদা কণিকার মত আমার রক্তে ভাসছে। সামনে একটি ঘোর কালো অন্ধকার ছাড়া কিছু নেই। দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতির কারণে চাকরিটি একদিন আমার চলে যাবে। কী করে আবার নিজের ভাঙা বাড়িঘর গুছোবো আমি! স্বপ্নের দালানকোঠা ধ্বসে পড়েছে। স্বপ্নহীন, ভবিষ্যতহীন, মরা মানুষের মত শুয়ে থাকি। এই আমাকে আমি চিনি না। এই আমার নাম আমি জানি না। যখন দলিত মথিত বঞ্চিত লাঞ্ছিত আমি সাহসে বুক বেঁধে উঠে দাঁড়িয়েছি, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি, সুন্দর একটি জীবন গড়ে তুলছি, তখনই আবার আমাকে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে ফেলা হল। বাবা জানেন না, বাবা আমার জীবনের কতটুকু ক্ষতি করেছেন। তাঁর মত লোকের কোনওদিনই জানা হবে না। কোনওদিনই তিনি কাছে এসে বসবেন না, জিজ্ঞেস করবেন না কোথাও কোনও অসুবিধে হচ্ছে কি না, হলে কী অসুবিধে, কোনওদিন জানতে চাইবেন না আমার সুখ বা দুঃখ বলে কিছু আছে কি না। এভাবে কত দিন আমাকে বন্দী করে রাখা হবে! কত মাস! কত বছর! কী অপরাধের শাস্তি আমি পাচ্ছি! আদৌ কি কোনও অপরাধ আমি করেছি! আমার লেখার প্রশংসা যেমন হচ্ছে, ইচ্ছেমত নিন্দাও হচ্ছে। এসবে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমি। সস্তা পত্রিকাগুলোয় প্রায়ই আমাকে নিয়ে লেখা হয়, আমাকে কুচি কুচি করে কাটা হয় সেসব লেখায়। আমার লেখা নিয়ে আলোচনা না করে কেবল মেয়ে হয়েছি বলে ব্যক্তিগত জীবন ঘাঁটে কিছু লোক। কেবল মেয়ে হয়েছি বলে খুব সহজে চরিত্রে কালিলেপন হয়ে যায়। বলে দিলেই হল যা ইচ্ছে তাই। মেয়েদের নিয়ে রটনা ঘটনা জিভে খুবই রোচে। কিছু লোক আমাকে নিয়ে মজা করছে বলে আমাকে বন্দী জীবন যাপন করতে হবে! এতে কি আমার না কি আমার বাবার মার আমার ভাই বোনের এক রত্তি কিছু লাভ হচ্ছে! বাবা জানেন না সুগন্ধায় আমার সম্পর্কে এসব লেখার মূল উদ্দেশ্যটি। বাবা জানেন না যে পত্রিকার লোকেরা পত্রিকার বিক্রি বাড়াবার জন্য বানিয়ে বানিয়ে মজাদার মুখরোচক খবর ছাপে। আমার জীবন জানার জন্য বাবার উচিত ছিল আমাকে জিজ্ঞেস করা, আমার জীবনের খবর আমার চেয়ে বেশি সুগন্ধার কোনও লোক জানে না। বাবার ওপর আমার রাগ হয়। ভীষণ রাগ হয়। ভীষণ রাগে আমি ছটফট করি। এ ঘরটি একসময় আমারই ঘর ছিল, এখন এই ঘরটিকে একটি কফিন বলে মনে হয়। যে আমি অসম্ভব সাহস আর দৃঢ়তা অনুভব করতাম নিজের ভেতর, সেই আমি দেখি হাত পা ছোঁড়া শিশুর মত। পাখি উড়ে বেড়াচ্ছিল বলে পাখিকে খাঁচায় এনে বন্দী করেছেন বাবা। আমাকে জন্ম দিয়েছেন, সেই অধিকারে তিনি ভেবেছেন তাঁর যা খুশি তিনি তা করতে পারেন। আর কতকাল আমাকে সইতে হবে তাঁর প্রভুত্ব, রাজত্ব, তাঁর নির্মমতা, তাঁর নির্বুদ্ধিতা! জন্মের ঋণ কি মৃত্যুর আগে শেষ হয় না! নিজের জীবনকে কি নিজের পছন্দ মত যাপন করার অধিকার আমার নেই! আমি ভেঙে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে থাকি। এত অসহায় আমি বোধহয় কখনও বোধ করিনি জীবনে। আমার লেখা পড়ে অনেকে বলে আমি নাকি সাহসী, আমি নাকি মেয়েদের শক্তি যোগাচ্ছি! তারা যদি দেখতে পেত কিরকম শক্তিহীন আমি, কি রকম সহায়সম্বলহীন, কি রকম অন্যের হাতে বাঁধা!

যে অবকাশ আমার চেতনায়, আমার স্মৃতিমেদুরতায়, যে অবকাশ আমার ভালবাসার ধন, সেই অবকাশকে হাবিয়া দোযখের মত মনে হয়। অবকাশ থেকে শেষ অবদি আমি পালাই। সকালে দরজার তালা খুলে মা মাত্র নাস্তা দিয়ে গেছেন, রান্নাঘর থেকে সুফির চিৎকার আর থালবাসন ভাঙার শব্দ শুনে তালা না লাগিয়েই মা দৌড়ে যান রান্নাঘরে। এ সময় পাহারা বসা নেই বৈঠক ঘরে। বাবা নেই বাড়িতে। দাদা ফার্মেসিতে। আমি যে কাপড়ে যেমন ভাবে ছিলাম, তেমনি দৌড়ে বেরিয়ে যাই। দ্রুত হাঁটতে থাকি আঁকাবাঁকা গলিতে। যে গলিতে আমি যেতে পারি বলে কেউ ধারণা করবে না। দৌড়োনোও সম্ভব নয়। দৌড়োলে লোকের সন্দেহ হবে। পেছনে আমি দেখতে চাই না কেউ আমাকে চুলের মুঠি ধরে টেনে নিতে আসছে কী না। যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি চাইছিলাম তখন, সেটি একটি রিক্সা, যেমন তেমন রিক্সা। সেটিকে বাড়ির পেছনের দিকে সুতিয়াখালি হাউজের দিকে যে রাস্তায় অবকাশের কেউই যায় না, সেদিকে যেতে বলি। আমি পালিয়েছি খবর পেয়ে কেউ আমাকে দৌড়ে ধরতে গেলে সেরপুকুর পাড়ের দিকে বা গোলপুকুরপাড়ের দিকে যাবে। সুতিয়াখালির গলি পার হয়ে রিক্সাকে যখন রাজবাড়ি ইশকুলের সামনে নিয়ে যাচ্ছি, বলি টাঙ্গাইল যাওয়ার বাসস্ট্যাণ্ডে যেতে। ঢাকা যাওয়ার বাসস্ট্যাণ্ডে পালানোর খবর পেয়ে বাবা স্বয়ং গিয়ে হাজির হতে পারেন।। টাঙ্গাইল যাওয়ার বাসস্ট্যাণ্ডে লোকাল ছাড়া আর বাস ছিল না। বাসে উঠেও আমার হৃদকম্প থামে না। লোকাল বাসেই উঠে পড়ি, লোকাল বাস টাঙ্গাইল যাওয়ার পথে যত বাসস্ট্যাণ্ড আছে সবকটাতে থেমে থেমে যাবে। আমার পক্ষে বাসস্ট্যাণ্ডে দাঁড়িয়ে এক্সপ্রেস বাসের জন্য অপেক্ষা করাও নিরাপদ নয়। কোনও থামাথামি না করে এক্সপ্রেস বাস সোজা টাঙ্গাইল যায়। কতক্ষণে এক্সপ্রেস এসে থামবে এখানে তার কোনও ঠিক নেই। বাসস্ট্যাণ্ডে অপেক্ষা করতে গেলে কেউ আমাকে চিনে ফেলতে পারে, কেউ খবর দিতে পারে বাবাকে অথবা বাবাই ঢাকার বাসস্ট্যান্ডে আমাকে না পেয়ে টাঙ্গাইল বাসস্ট্যাণ্ডে আমাকে খুঁজতে আসতে পারেন। রেলইস্টিশিনেও যেতে পারেন, তাই সেদিকে পা দিইনি। লোকাল বাসটি লককর ঝককর মুড়ির টিন। শহর এলাকাটি বাস যেন দ্রুত পার হয়, যেন খুব দ্রুত পার হয়। বার বার জানালার দিকে আমার অস্থির চোখদুটো চলে যাচ্ছে। বুকের দপদপ শব্দ আমি চাইলেও থামাতে পারছি না। বাসটি ধীরে ধীরে লোক তুলতে তুলতে লোক নামাতে নামাতে বাসের গায়ে থাপ্পড় মারতে মারতে এগোতে থাকে। আমি মেয়ে বলে সাধারণ কোনও সিটে আমাকে বসতে দেওয়া হয়নি। ড্রাইভারের পাশে যেখানে ইঞ্জিনের গরম এসে গা পুড়ে যেতে থাকে, যেখানে পা রাখার কোনও জায়গা নেই, দুটো পা কে বুকের কাছে মুড়ে বসে থাকতে হয় এবং কোনও নড়ন চড়ন সম্ভব নয়, সেই অসাধারণ সিটে বসতে হয়েছে। বাস পুরো আটটি ঘণ্টা নেয় টাঙ্গাইল পৌঁছতে। টাঙ্গাইলে নেমে ঢাকার বাস কোত্থেকে ছাড়ে খবর নিয়ে নিয়ে সেদিকে যাই। ঢাকার বাসে চেপে যখন ঢাকা এসে পৌঁছি, রাত তখন এগারোটা। কোথায় যাব আমি এত রাতে! আমার তো একটি ঘর ছিল, আশ্রয় ছিল। সেটি নেই। আত্মীয়স্বজন কাউকেই আমার আর আপন বলে মনে হয় না। আমি এদের সবার কাছ থেকে দূরে চলে যেতে চাই। আমি যাদের কাছে এত ব্রাত্য, তাদের আমি এই মুখ দেখাতে চাই না। তাদের সামনে আমার অনাকাঙ্খিত উপস্থিতি ঘটিয়ে চাইনা বিব্রত করতে। একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকলে অন্তত ফোন ব্যবহার করার সুযোগ পাবো। ক্ষিধেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। তার চেয়ে মন চোঁ চোঁ করছে বেশি। কার কাছে কার বাড়িতে আমি আশ্রয় চাইতে পারি এখন! মাথা ঘুরোচ্ছে, বেশিক্ষণ মাথাটি আমাকে ভাবতে দেয় না। মুখস্ত ছিল মিনারের ফোন নম্বরটি। সেটিতেই ডায়াল ঘোরাই। মিনার খবর শুনে অবাক! সে নাকি একদিন ফোন করেছিল হাসপাতালে, হাসপাতাল থেকে বলে দিয়েছে আমি ছুটিতে আছি। কেমন ছুটি কাটিয়েছি আমি তা আর তাকে বলি না। শুধু জিজ্ঞেস করি, এই রাতটা কি তার বাড়িতে আমি থাকতে পারব! মিনার একবাক্যে রাজি হয়। মোটর সাইকেলে এসে আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যায়। আমাকে, বৈঠক ঘরে একটি বাড়তি বিছানা ছিল অতিথিদের শোবার জন্য, দেওয়া হয়। পরদিন পার হয়। কী করে পার হয় আমি তার কিμছু জানি না। ঘুমিয়ে! অনেক ঘুম বাকি ছিল আমার। মনের ওপর যে ঝড় গেছে, সেটি শান্ত করতে আমার দরকার ছিল সাতদিন টানা বিশ্রামের। কিন্তু তার পর দিন মিনার বলল, তার মা নাকি বলছে এভাবে একটি মেয়ের এখানে থাকা ঠিক নয়, লোকে মন্দ বলবে, মিনার যেন আমাকে বিয়ে করে নেয়, তাহলে আমার থাকাটা এখানে জায়েজ হবে। সেদিনই শুনেছি এক লোক নাকি এসেছে সবুজ একটি খাতা নিয়ে, খাতাটি মিনার আমার কাছে নিয়ে আসে, নিয়ে আসে সই নিতে। আবার সেই সই। আমি বোধবুদ্ধি লোপ পাওয়া মানুষের মত সই করি। সইএর গূঢ় অর্থ কী তা বোঝার বা ভাবার সময়টুকু নিইনি। সই কেন করি, বাবার ওপর রাগ করে! আর কোনও আশ্রয় নেই বলে! এ দুটোর কোনওটিই আমি এখন মানতে পারি না। বাবার ওপর রাগ আমার অনেক হয়েছে, রাগ করে সই করা কেন, রাগ করে দেখিয়ে দেওয়া যেত যে যে জীবন আমি যাপন করছিলাম, সেই স্বনির্ভর জীবন আমি যাপন করার শক্তি সাহস স্পর্ধা সবই রাখি। কোনও আশ্রয় নেই তা ঠিক, কিন্তু আশ্রয় কেন আমি খোঁজার চেষ্টা করিনি! হাসপাতালে ডাক্তারদের জন্য কোনও হোস্টেল নেই, না থাক, মুখ নত করে হলেও কেন যাইনি আত্মীয়দের বাড়িতে! কেন ছোটদার বাড়িতে গীতার অত্যাচার সয়েও থাকিনি! কেন বড়মামার বাড়িতে বলে কয়ে জায়গার অভাব হলেও মেঝেতে ঘুমোবার ব্যবস্থা করিনি! রাতে ঘুমোনোর জন্যই তো! অপেক্ষা করতে পারতাম তার চেয়ে, খোকা হয়ত আমার জন্য কোনও বাড়ি পেতেন ভাড়া নেওয়ার! কেন আমি খোকাকে ফোন না করে মিনারের কাছে ফোন করেছি, অত রাতে খোকার দোকান খোলা থাকে না, খোকার বাড়ির নম্বর জানা ছিল না, কিন্তু পরদিন সকালেই কেন খোকাকে ফোন করে তার সহযোগিতা ভিক্ষে চাইনি! নাকি আমি নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়েছিলাম! নাকি সত্যি সত্যিই ধিককার দিতে শুরু করেছিলাম স্বামীহীন জীবনকে! নাকি আর দশটা মেয়ের মত স্বামী সন্তান নিয়ে সংসার করার সাধ হয়েছিল হঠাৎ! নাকি মিনারকে আমি ভালবেসেছিলাম! নাহ! ভালবাসা ওই দুদিনের দেখায় আর কথায় হয় না। নাকি পুরুষের নিবিড় আলিঙ্গন চাইছিলাম! স্পর্শ চাইছিলাম! উত্তাপ চাইছিলাম! তাই ছোট্ট একটি সইএর মধ্য দিয়ে সেই স্পর্শ, সেই উত্তাপ নিয়ে শরীরের গভীর গহন খেলাটি চাইছিলাম! দীর্ঘদিনের অতৃপ্ত শরীর চাইছিল তৃপ্ত হতে। একটি পুরুষ-শরীরের জন্য ভেতরে বান ডাকছিল! নাকি নিজেকে এতিম, অনাথ, নিস্পেষিত, গলিত দলিত কীটের মত মনে হচ্ছিল। এ জীবন কার পাতে গেল কার হাতে গেল তা নিয়ে ভাবনা করার কোনও কারণ দেখিনি! আমি ঠিক জানি না কী সেটি!

এক বাড়িতে থাকার জন্য বা এক বিছানায় রাত কাটানোর জন্য সইটি খুব প্রয়োজন। সই ছাড়া যদি কোনও ছেলে এবং মেয়ের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হয়, তবে ছেলের দোষ হয় না, দোষ হয় মেয়ের। মেয়েকে ছিনাল, বেশ্যা, মাগী, বদ, রাক্ষুসে ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। মিলনের সঙ্গে মিলন হওয়ার পর আমি জানি সই ছাড়াও মিলন হওয়া সম্ভব। আসলে কোনও সইই আমাকে বিয়ের কোনও অনুভূতি দেয় না। মিনারের নতুন আবরণটি দুদিনেই খসে গিয়ে আগের সেই মিনার, মোহাম্মদ আলী মিনার, কবিতার স্বামী বেরিয়ে আসে। কবিতার স্বামী কবিতার জন্য আকুল হয়ে কাঁদে, কবিতার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এই শোকে সে কাঁদে। জীবনে কি বিচ্ছিরিরকম ওলোট পালোট এসে গেছে। ইচ্ছে হয় সময়কে পেছনে নিয়ে যেতে, ইচ্ছে করে দেখতে মিনার আর কবিতা দুজন আবার আগের মত দুজনকে ভালবাসছে, দুজনে সুখে সংসার করছে।

হাসপাতালে কেউ খুব বেশি অবাক হয় না আমার ওই কদিনের অনুপস্থিতি নিয়ে। যে দিন বাবা আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যান আরমোনিটোলা থেকে, সেদিন সকালেই আমি জানি না যে বাবা আমার ছুটির একটি দরখাস্ত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন গাইনি বিভাগে। হাসপাতাল থেকে খোকার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। খোকা আমাকে জানান যে তিনি শান্তিবাগে একটি বাড়ি পেয়েছেন ভাড়ার জন্য। বাড়িঅলাকে বলেছেন তাঁর বোন ভাড়া নেবে বাড়ি, বোন ডাক্তার, একা থাকেন। বাড়িঅলা শিক্ষিত ভদ্রলোক। তিনি রাজি। বাড়িটি দোতলা, সুন্দর বাড়ি। ঝকঝকে। মিনার এদিকে বাড়ি খুঁজছে। সে একটি বড় বাড়ি খুঁজছে, অনেকগুলো শোবারঘরঅলা বাড়ি। তার আত্মীয়স্বজন থাকবে তার বাড়িতে। আমার ইচ্ছে শান্তিবাগের বাড়িটি ভাড়া নেওয়ার। সেটিই নিই। মিনারকে নিয়ে শান্তিবাগের বাড়িতে উঠি। আমাদের অনেকটা যার যার তার তার জীবন শুরু হয়। হাসপাতালে চলে যাই খুব সকালবেলা। সারাদিন মিনারের সঙ্গে আমার দেখা হয় না। আমি হাসপাতালে যাওয়ার পর সে বেরিয়ে যায়, ফেরে অনেক রাত করে। হয় মাতাল, নয় হাতে প্রতিরাতেই একটি মদের বোতল। ঘরে বসে পুরো বোতল না হলেও অর্ধেক বোতল সে শেষ করে খেয়ে। খেতে খেতে মাঝে মাঝে বিচিন্তার জন্য সম্পাদকীয় লেখে। মিনার যা কিছুই লেখে খুব দ্রুত লেখে। কাটাকুটি নেই, কলম থামিয়ে রেখে কখনও ভাবতে হয় না কি লিখবে। মদ তার মাথা খুলে দেয়। তবে যা কিছুই লেখে সে, ভাল লেখে। মিনার ইচ্ছে করলে খুব ভাল গল্প লেখক হতে পারত। আমি জানি না কেন সে ও কাজে হাত দিয়েও আবার বাদ দিয়েছে। হঠাৎ একদিন মদ খেতে খেতেই সে বলে পূর্বাভাস পত্রিকায় যেন আমি লেখা বন্ধ করে দিই। আমি কোনও কারণ খুঁজে পাই না আমার লেখা বন্ধ করার। এই পত্রিকায় আমার এই লেখা কোনও লেখাই হয়নি, ওই পত্রিকায় আমার ওই লেখা না লিখলেও চলত, ইত্যাদি অভিযোগ শুনে আমার মনে হতে থাকে, মিনার আমাকে দলামোচা করে খুব ক্ষুদ্র বানিয়ে তার হাতের মুঠোয় নিতে চাইছে। অমাতাল মিনারকে হয়ত বাইরের লোকেরা দেখে, আমার খুব একটা সুযোগ হয় না। আমি যতক্ষণ মিনারকে দেখি, মাতাল মিনারকেই দেখি। প্রতিরাতে তার মদ খাওয়া চাই। বাধা দিয়ে কাজ হয় না। সে খাবেই। শেষরাতের দিকে ঘুমোতে আসে। আমাদের সম্পর্কের মধ্যে এক সঙ্গম ছাড়া আর কিছুই থাকে না। সঙ্গম তুচ্ছ কোনও ব্যপার নয়। শরীর চায় এই সঙ্গম। শরীর জেগে ওঠে প্রতিরাতে। যে ব্যপারটি আমার জানা ছিল না, কিন্তু খুব শিগরি জানা হয় তা হল, মিনারের সঙ্গে দীর্ঘ বছর ধরে এক ধনী মহিলার প্রেম। মহিলা বিবাহিত। ইস্কাটনে মিনার যে বাড়িতে থাকত, সেটি ওই মহিলারই বাড়ি ছিল। মহিলার সঙ্গে প্রেমে কদিন ভাটা পড়লে মিনার আমার দিকে ঝুঁকেছিল। কিন্তু অচিরে প্রেম আবার জেগে ওঠে। আবার তাদের আগের মত দেখা হতে থাকে। কোনও একটি দিন নেই যে মদ না খেয়ে মিনার কাটাতে পারে। সে এরকমই ছিল। মদ খেয়ে রাতে এখানে ওখানে ফোন করত, আমাকেও করত হাসপাতালে। আমি ফোনে কোনও মদের গন্ধ পেতাম না, ভাবতাম ফোনের ওপারের মানুষটি বুঝি খুবই রসঘন প্রাণঘন ঘনশ্যাম। হায়! মাতাল কোনওদিন গলা ফাটিয়ে হাসছে, কোনওদিন বেধড়ক চিৎকার করছে, অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করছে, কোনওদিন প্যাণ্টের বেল্ট খুলে চাবকাচ্ছে। কোনও কারণ ছাড়াই করছে। ইচ্ছে হচ্ছে বলে করছে। বাড়িটির দোতলাকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে, দুভাগের একভাগে থাকে সোমারা। সোমা একুশ বাইশ বছর বয়সী একটি মেয়ে, প্রায়ই আমার সঙ্গে গল্প করতে আসে, মাতালের কাণ্ড কারখানা সীমা ছাড়িয়ে গেলে রাত বিরেতে এই সোমার কাছে আমাকে বাকি রাতটুকু পার করার জন্য আশ্রয় চাইতে হয়। উন্নাসিক মাতালটি কোন রাতে কি করবে তা কেউ জানে না। চুমু খাবে না চাবকাবে। মাতাল এক রাতে বাড়ি ফিরে ঘুমের মেয়েটিকে তুলে চাবকাতে থাকে। কি কারণ জানতে চাইলে কোনও উত্তর নেই। গালে শক্ত শক্ত চড় দিয়ে গাল লাল করে ফেলে। চোখে ঘুসি মেরে চোখের রক্ত ঝরায়। গলা টিপে ধরে, আমি পারি না তার শক্ত আঙুলগুলো থেকে নিজেকে বাঁচাতে। নিজেই একসময় ছেড়ে দিয়ে হাসতে হাসতে চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে দরজার বাইরে রেখে দরজা বন্ধ করে দেয়। সিঁড়িতে বসে রাত পার করতে হয়। পরের রাতেও এই হয়। সিঁড়ি থেকে আবার টেনে হিঁচড়ে ভেতরে নিতে চাইলে পরের রাতে রক্তাক্ত আমি প্রাণে বাঁচার জন্য দৌড়ে গিয়ে বাড়িঅলার বাড়িতে আশ্রয় নিই। লজ্জায় মাথা নত হয়ে থাকে। লজ্জা ভয় ঘৃণা হীনমন্যতা আশঙ্কা আমাকে কুঁকড়ে রাখে। আমি তো একাই ছিলাম, আমি সেই একাই আছি। আগে উপদ্রব ছিল না, এখন জলজ্যান্ত উপদ্রুব চোখের সামনে। ছি ছি ছি! এ কী করেছি আমি! কাকে আমি আমার আশ্রয় ভেবেছি! নিজে কি নিজের জন্য যথেষ্ট ছিলাম না! কিসের অভাব ছিল আমার! ঘৃণায় আমি মিশে যেতে থাকি মাটিতে, নিজের ওপর ঘৃণা আমার। নিজেকে এতটা অসন্মানিত হতে, এতটা হীন দীন হতে আমি নিজেই দিয়েছি। কী প্রয়োজন ছিল আমার অন্যের আশ্রয়ের! স্বামী নামক নিরাপত্তার! কী প্রয়োজন ছিল সমাজের সাধ মেটানোর! স্বামী সন্তান সংসার ইত্যাদির সামাজিক কাদায় কী ভীষণ ডুবে গেছি, যত বেরোতে চাই তত যেন পাকে পড়ি, টেনে নিয়ে যায় আরও গভীরে। রীতির জালে অন্যের মুখ চেয়ে নিজেকে জড়িয়েছি। নিজেই নিজের গলায় দড়ি দিয়েছি। লোকে এই দড়ি দেখলে পছন্দ করে বলে! আমি আর দড়িছেঁড়া গরু নই বলে! কলুর বলদের মত ঘুরছি! খামোকা বিয়ে নামের একটি কলংকের বোঝা ঘাড়ে চাপল। আমার বোধোদয় হবার পরও বোধ হারিয়েছিলাম, আবার নতুন করে বোধের উদয় হল। বিয়ে করলেও কলংক, না করলেও কলংক। যে কোনও একটি কলংক যদি আমাকে বরণ করতেই হয়, তবে বিয়ের কলংককে কেন! এই শিক্ষাটি কি আগে আমার হয়নি! তবে কেন আবার দুর্ভোগ পোহাতে যাওয়া! পুরুষমানুষকে চেনা কি আমার হয়নি! তবে কেন আবার চিনতে যাওয়া! কেন আবার স্বপ্ন রচনা করা! কেন ভাবা যে একজন যে কষ্ট আমাকে দিয়েছে, আরেকজন হয়ত সেই কষ্ট দেবে না! বোকা বুদ্ধু মেয়ে, কষ্ট ওরা দেবেই। এক রকম না হলে আরেক রকম! তুমি কারও ওপর আর নির্ভর কোরো না। কেউ সুখ দেবে তোমাকে, এই আশাটি আর কোরো না। আমি একাধিক বিয়ে করেছি, তার মানে একাধিক পুরুষের সঙ্গে শুয়েছি আমি, এই কলঙ্কটি আমার ত্বকের মত আমার গায়ে সেঁটে থাকে। লোকে আমার ত্বক দেখলেই কলঙ্কিনী বলে আমাকে বিচার করে। এমনকী রুদ্রও। এর মধ্যে দু বার রুদ্রর সঙ্গে দেখা হয়েছে। প্রথম দেখাটি ইত্যাদিতে, ইত্যাদি থেকে বেরিয়ে সেই ভীষণ ঝড় বৃষ্টির রাতে কোনও রিক্সা খালি পাওয়া যাচ্ছিল না, কোনও বেবি ট্যাক্সিও না। অপেক্ষা করতে করতে একটি বেবি পাওয়া গেল, তখন আরেকটির জন্য অপেক্ষা না করে রুদ্র আমার নেওয়া বেবিতে উঠে পড়ল। আমাকে শান্তিবাগ নামিয়ে দিয়ে সে ইন্দিরা রোডে চলে যাবে। সেদিন সেই ঝড়ের রাতে আধমাতাল রুদ্র আমার কোমর জড়িয়ে ধরে কোমরে চাপ দিয়ে বলল, তোমাকে খুব পেতে ইচ্ছে করছে! কী রকম পেতে! রুদ্র চোখ নাচায়। আমার শরীরটি পেতে তার ইচ্ছে করছে। কোমর থেকে তার হাতটি সরিয়ে দিয়ে মালিবাগের কাছে মাথা ভরা বৃষ্টির রাস্তায় নেমে যাই। গালে মুখে জলের বিন্দু, কোনটি বৃষ্টির, কোনটি চোখের জলের, জানি না। দীর্ঘ একটি শ্বাস যন্ত্রযানের শব্দের তলে চাপা পড়ে যায়। রুদ্রকে বিদায় দিয়ে মনে মনে বলি, ইচ্ছে হলে আমি তোমার সঙ্গে শুতে পারি। আরমানিটোলায় আমি ইচ্ছে করেছিলাম। এখন আমি ইচ্ছে করছি না। এতকাল অন্যের ইচ্ছের মূল্য দিয়েছি, এবার নিজের ইচ্ছের মূল্য দিতে চেষ্টা করছি। রুদ্রর সঙ্গে এর পরের দেখাটি সাকুরায়। কথা ছিল সাকুরায় দেখা হবে। রুদ্র আমাকে বলেছে সে তার সমগ্র বের করতে চায়। যত লেখা এ যাবৎ লিখেছে, সব মিলিয়ে একটি বই। আমি যেন তাকে সাহায্য করি। কী রকম সাহায্য! আমি যেন আমার প্রকাশককে দিয়ে তার সমগ্র ছাপার ব্যবস্থা করি। আমার বই ভাল চলছে, সে কারণে প্রকাশক যে আমার সব দাবি মেনে নেবেন, তা নয়। আমি খোকাকে কদিন বলেছি, রুদ্রর একটি সমগ্র কি বের করবেন! রুদ্র খুব চাচ্ছে। খোকা বললেন, অসম্ভব, চাইলেই হবে! আমাকে তো বিক্রির দিকটা দেখতে হবে। যদি সমগ্র না বের করতে চান, তবে অন্তত রাজনৈতিক কবিতা, প্রেমের কবিতা এরকম কিছু একটা বের করুন। এতে খোকা রাজি, কিন্তু সমগ্রতে রাজি নয়। আপাতত তাঁকে রুদ্রর সঙ্গে দেখা করার জন্য অনুরোধ করি। অন্তত দেখা তো করুন। সাকুরায় রুদ্র আর আমি দুজনই অপেক্ষা করি খোকার জন্য। খোকা আসেন। রুদ্র নিজ মুখে তার ইচ্ছের কথা জানায় খোকাকে। তখন ওই কথাই আবার তুলি, যে কথা তার সমগ্র বের করার ইচ্ছে শুনে বলেছিলাম, ‘তুমি সমগ্র বের করতে চাইছো কেন! সমগ্র তো মরবার পর বের হয়।’ রুদ্র তবু সমগ্র বের করবেই। কয়েকটি ঘণ্টা কেটে যায়। শেষ পর্যন্ত মিমাংসা কিছু হয় না, খোকা রাজি হন না সমগ্রতে। রুদ্রকে বার বার বলি, ‘বিদ্যাপ্রকাশ থেকে তোমার বই অবশ্যই বের হবে, তবে সমগ্র নয়। অন্য কিছু বের করো।’ অন্য কিছুতে রুদ্রর ইচ্ছে নেই। রুদ্রর ইচ্ছে সমগ্র।

‘আশ্চর্য তুমি কি মরে গেছো নাকি! অন্তত বুড়ো যদি হতে তাহলেও কথা ছিল। কত বয়স! পয়ত্রিশও তো হয়নি। এক্ষুনি তোমার সমগ্র করার ইচ্ছে কেন?’

অনমনীয় খোকা চলে যান। রুদ্রকে বড় বিষণ্ন দেখতে লাগে। রুদ্রর মন খারাপ দেখে আমারও মন খারাপ হয়ে যায়। সাকুরা থেকে বেরোই আমরা। আমি আর রুদ্র। পথই আমাদের ঠিকানা। ঘরের মানুষ হয়ে উঠেছি এখন পথের মানুষ। রুদ্রর হাঁটার কষ্ট সারেনি। পথে তাকে বার বার থামতে হয়। ইচ্ছে করে রুদ্রকে নিয়ে রিক্সায় সারা শহর আগের মত ঘুরি। আগের মত টিএসসির মাঠে বসে তুমুল আড্ডা দিই। ঝালমুড়ি আর চা খেতে খেতে কবিতার কবিতায় কথা কই। আগের সেই উতল প্রেমের দিন গুলো আবার ফিরে আসুক। মাঝখানে এই যে বিভেদ, বিচ্ছেদ, বিষাদ, বিরাগ সব এক নিমেষে উড়ে যাক। রুদ্রর শ্যাওলা পড়া বিষণ্ন চোখে চেয়ে বলি, একটি হাত হাতে নিয়ে, ‘তুমি ভেবো না, তোমার সমগ্র বের করার জন্য আবার আমি বলব খোকা ভাইকে।’

রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘রাজি তো হতে চাইছেন না।’

বলি, ‘দেখি, আমি বই দেব এই কনডিশনে রাজি করাতে পারি কী না। মানুষটা ভাল। তাকে আমি বুঝিয়ে বলব যে তোমার বই অবশ্যই বিক্রি হবে। তোমার জনপ্রিয়তা তো কম নয়। লোকে হরদম আবৃত্তি করছে তোমার কবিতা। বিক্রির দিকটাই কি সব প্রকাশক দেখে! কেউ কেউ তো ভাল কিছু, সে কম বিক্রি হলেও ছাপতে চান। খোকা ভাই বাংলাবাজারের অন্য প্রকাশকের মত অত কমার্সিয়াল দিক নিয়ে ভাবেন না। তিনি আজ রাজি না হলেও হয়ত অন্যদিন রাজি হবেন।’

রুদ্র খানিকটা স্বস্তি পায়। আমরা কিছুদূর পাশাপাশি হেটেঁ এরপর দুটো রিক্সা নিয়ে আমাদের ভিন্ন গন্তব্যের দিকে চলে যাই।

সেই চাবুকের রাতে, যে রাতে আমাকে বাড়িঅলার বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল, বাড়িঅলার বউ পারুল ভয়ে থরথর কাঁপতে থাকা আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন অনেক কিছু, কি করে মিনারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক হল, কেন হল। আমি কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে পারিনি, সাদা দেয়ালের দিকে নির্বাক তাকিয়েছিলাম। পারুল আমাকে বৈঠক ঘরের এক কোণে শুয়ে পড়তে বললেন। শুয়ে দেয়ালের দিকেই তাকিয়ে থেকেছি বাকি রাত। একটি মুহূর্তের জন্যও আমি চোখের পাতা এক করতে পারিনি। আমি কি বোবা হয়ে গিয়েছি! কেন আমি কিছুই বলতে পারছি না। কেন আমি কাঁদতে পারছি না। কেন আমি পাথর হয়ে আছি! কেন আমি চিৎকার করছি না! কেন আমি কোনও দেয়াল ভেঙে দিচ্ছি না! কেন আমি কাউকে গাল দিচ্ছি না! বকুলির কথা মনে পড়েছে। আমি কি বকুলি হয়ে যাচ্ছি! বকুলির মত বোবা! সেই যে বাবা আরমানিটোলায় সাজানো আমার সুখের সংসারটি ভেঙে দিলেন, আমার মেরুদণ্ড ভেঙে দিলেন, সেই থেকে মনে হয় অনেকদিন আমি বোবা হয়ে আছি। আমি কাউকে কিছু বলছি না। নিজের সঙ্গে কোনও কথা হয় না আমার। ভয় লজ্জা আমার কণ্ঠ রোধ করে আছে। আমি হেরে গেছি বার বার। যেন হেরে যাওয়াই আমার নিয়তি। এই সমাজ সংসার আমাকে আমার মত করে বাঁচতে দিচ্ছে না। আমার শক্তি সাহস উদ্দম, আমার অহংকার আমার ক্রোধ সব আমি কোথাও কারও কাছে বন্ধক দিয়ে বসে আছি। সামনের দেয়ালটি মনে হয় পা পা করে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। চারদিকের দেয়ালগুলো এগিয়ে আসছে। মাথার ভেতর থেকে মস্তিস্কগুলো ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বড় বড় করে শ্বাস নিতে চাইছি। যেন হাওয়াগুলো সব বেরিয়ে গেছে ঘরটি থেকে। বার বার নিজেকে বলি, এই বার তুই তোর কথা বল, তোর মত করে কথা বল তুই। অন্যের সুখের জন্য নিজের সর্বনাশ করিস না আর। নিজের দিকে তাকা তুই, নিজেকে একবার একটু ভালবাসতে চেষ্টা কর। অনেক তো হল, আর কত! আর কত সর্বনাশ করবি নিজের! সাদা দেয়ালে চোখ, দেয়ালটি মনে হয় আমার দিকে পা পা করে এগিয়ে আসছে। একটি দেয়াল নয়, চারদিকের সবগুলো দেয়াল এগিয়ে আসছে। আমি এপাশ ওপাশ করছি। কী এক ঘোরের মধ্যে আমি মাথা নাড়ছি। মাথা নাড়ছি আর অস্ফুট কণ্ঠে বলছি, কথা ক বকুলি। বকুলি কথা ক। কথা ক ..

বোবা হয়ে জেগে থাকা রাতটি পার হয়ে যখন ভোরের সূর্য ওঠে, আমি কথা বলি। পারুলকে বলি, এ বাড়ি থেকে যেন মিনারকে চলে যেতে বলেন তিনি, মিনার চলে গেলে আমি বাড়িটিতে ফিরব। পারুল আমাকে বলেছিলেন কোনও একটি মীমাংসা করে নিতে। আমি না বলেছি। বলেছিলেন পুরুষ মানুষ তো এরকম একটু আধটু করেই, আমি যেন ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখি আরেকবার। আমি পারুলকে বলেছি, এ আমি ঠাণ্ডা মাথাতেই ভাবছি, আগে যা কিছু করেছিলাম, মাথার ঠিক ছিল না অথবা মাথা গরম ছিল। বাড়িঅলার বাড়ি থেকে সেই ভোরবেলাতেই আমি বেরিয়ে গিয়েছি। আমি আর শান্তিবাগের অশান্তিতে ফিরিনি। পাখির বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। পাখি আমার জন্য একটি ঘরে লেখার টেবিল পেতে সাজিয়ে দিল ঘরটি। হাসপাতাল থেকে ফিরে পাখির সঙ্গে কিচির মিচির করে সময় পার হয়। লেখার চেয়ে মানুষের জীবনের গল্প শুনতেই আগ্রহ বেশি আমার। শান্তিবাগের বাড়িতে ভক্ত হিসেবে আমার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল, সেই থেকে আসা যাওয়া করতে করতে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে পাখির সঙ্গে। পাখি দশ তলার একটি অ্যাপার্টমেণ্টে থাকে। একা থাকে। স্বামীর সঙ্গে তালাক হয়ে গেছে। প্রাক্তন স্বামীটি থাকে আমেরিকায়। পাখি দেখতে সুন্দরী, এমন রং মেখে মুখের ভাঁজ ঢেকে রাখে যে বয়স বোঝার উপায় থাকে না। পাখি অনেকটা মা মা, অনেকটা বোন বোন। পাখি তার জীবনের সব গল্প অকপটে আমার সঙ্গে করে। পাখির একটি মেয়ে আছে, মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে, থাকে আরব দেশে। পাখি একা থাকে ঢাকায়। অবশ্য নিজের উপার্জন তেমন কিছু নেই। মাঝে মধ্যে এটা ওটা সেলাই করে বিভিন্ন কাপড়ের দোকানে সেসব বিক্রি করার চেষ্টা করে। স্বামীর সঙ্গে তালাক হওয়ার পর ঢাকার পল্লবীতে একটি বাড়ি ছিল, স্বামী কিনেছিল স্ত্রীর নামে, সেটি সে বিক্রি করে বড় এই অ্যাপার্টমেন্টটি কিনেছে। বাকি টাকা ব্যাংকে। একা থাকা পাখির যে মনের শক্তি, সেটি আমাকে মুগ্ধ করে। পাখি নাকি আমার লেখা পড়ে একা থাকার সাহস আর শক্তি পেয়েছে। আমার লেখা যে মানুষকে এমন শক্তি যোগায় তা আমার জানা ছিল না। কুষ্টিয়া থেকে পাখির বড় বোন এসেছিলেন, তিনিও আমার লেখা পড়েন। আমাকে দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেননি তিনি আমাকে দেখছেন। জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন বুকে। লাগামছাড়া প্রশংসার সামনে আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ়ের মত বসে থাকি। লেখা পড়ে আমাকে যে রকম ভাবে মানুষ, আমি সাংঘাতিক সাহসী, পুরুষ টুরুষ একেবারেই পছন্দ করি না, পুরুষ দেখলে গালে চড় কষিয়ে দিই, তলপেটে লাথি মেরে শুইয়ে দিই, অথচ মোটেও সেরকম নই দেখে, কেউ কেউ হয়ত অবাক হয়, আহত হয়। মুর্ছা যাবে যদি জানে আমাকে পুরুষের চাবুক খেতে হয়। পাখি এমন ভক্ত আমার, এই পাখির বাড়িতেও আমার আশ্রয়হীনতার অসহায়ত্ব নিয়ে অস্বস্তি হয়। আমি লক্ষ্য করি পাখি আমাকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য তার বাড়িতে থাকার কথা বলে না। বলে না যতদিন না আমি নিজের জন্য একটি ঘর পাই, ততদিন তার বাড়িকে নিজের বাড়ি মনে করে আমি থাকতে পারি। আমারও ইচ্ছে করে না পাখির কাছে করজোড়ে আরও কয়েকটি দিন ভিক্ষে চাইতে। পাখির বাড়িতে থাকার নির্দিষ্ট সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসে।

ঢাকা শহরে অনেক বন্ধু, বান্ধবী, অনেক আত্মীয় স্বজন, কিন্তু এ সময়, আমি জানি, কেউ আমাকে পেয়ে খুশিতে বাগবাগ করবে না। পাখির বাড়ি থেকে বিদেয় হওয়ার পর আশ্রয়হীন আমি হোটেলে থাকার সিদ্ধান্ত নিই। গুলিস্তানের একটি হোটেলে আমার জীবন শুরু হয়। রেস্তোরাঁয় খাওয়া। সারাদিন হাসপাতালে, রাতে ঘুমোনোর জন্য হোটেলে ফেরা। হোটেলে থাকা সহজ ব্যপার নয়। ঘিঞ্জি এলাকায় শহরের সস্তা হোটেলগুলোয় কোনও পুরুষই কোনও মহিলা-আত্মীয় নিয়ে ওঠে না। হোটেলের ম্যানেজারও চোখ কপালে তুলেছিলেন আমি থাকব শুনে। আবারও সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন খোকা। সুসময়ে অনেকেই আসে কাছে। দুঃসময়ে খুব বেশি মানুষের সন্ধান পাওয়া যায় না। আমার দুঃসময়ে খোকা সত্যিকার ভাইএর মত, বাবার মত, বন্ধুর মত পাশে থাকেন। আমার নিদারুণ নিরূপায় অবস্থা দেখে আর কারও মত আমাকে স্পর্শ করার কোনও সুযোগ খোঁজার চেষ্টা করেন না। খোকা হোটেলের ম্যানেজারকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে বলেছেন, ‘মা বোন তো সবারই আছে, কি কন! তাদের অসুবিধা তো আমাদের দেখতে হবে। উনি হচ্ছেন ডাক্তার, মিটফোর্ডে চাকরি করেন। আপাতত থাকার অসুবিধে বলে হোটেলে কদিন থাকতে হবে।’ ম্যানেজার শেষ পর্যন্ত রাজি হন। কেবল রাজিই নন, রাতে আমার ঘরের দরজায় কোনও রকম উৎপাত যেন না হয় সে দিকে কড়া নজরও রাখেন। তবু ঘরের ভেতর বেশির ভাগ রাতেই আমার ঘুম হয় না। দরজা কেউ লাথি দিয়ে ভাঙতে চাইলে ভেঙে ফেলতে পারে। মাতাল বদমাশদের আড্ডাখানা হোটেল, নিশ্চিত হই কী করে! হোটেল জীবনের অবসান ঘটে যখন শান্তিবাগের বাড়িঅলা জানান যে মিনারকে তারা বাড়ি থেকে নোটিশ দিয়ে বের করেছেন। মিনার তার জিনিসপত্র নিয়ে চলে গেছে। বাড়িটিতে উঠে আমার আবার আগের সেই আনন্দ ফিরে পাই। আরমানিটোলার বাড়িতে যেমন সুখের সংসার গড়েছিলাম, তেমন একটি সংসারের স্বপ্নে আবার আমি বিভোর হই। খালি বাড়ির মেঝেয় শুয়েই সুখনিদ্রা যাই। নিজের ওপর যে বিশ্বাস টুকু হারিয়েছিলাম, সেটি নিঃশব্দে, আমাকেও বুঝতে না দিয়ে ফিরে আসে। নিজেকে আর দীন হীন কীট সম কিছু মনে হয় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *