১০. গীর্জার পুকুরটা ঘন গাছপালায় ঘেরা

গীর্জার পুকুরটা ঘন গাছপালায় ঘেরা–ঢাকা, নির্জন, কেমন গা ছমছম করে, দুপুর বেলাতেও সন্ধ্যের মতো মনে হয়। মনে হয়, এক্ষুণি রাত হয়ে যাবে। কিন্তু ভয় করে না আনুর। ভাঙা ঘাটে শেষ ধাপে বসে ছিপটা ফেলে তাকিয়ে থাকে সবুজ পানির দিকে। এখানে এর আগে কোনদিন আসেনি সে। সেদিন বুলু ভাইদের বাড়িতে রাজমিস্ত্রীর কাজ হচ্ছিল, মিস্ত্রী বলেছে গীর্জার পুকুরের কথা।

রাস্তা থেকে প্রথমে চোখে পড়ে বড় আটচালা লম্বা টিনের ঘরটা। এর একদিকে লাইব্রেরী, বিনি পয়সায় ছোট ছোট বই দেয় পাদ্রীরা, আবার যতক্ষণ খুশি বসে বসে পড়ো ম্যাগাজিন, খবরের কাগজ, কেউ কিছু বলবে না। লাইব্রেরীর পাশে গীর্জা–ঘর। এই ঘরটার দক্ষিণে তিনটে টিনের বড় বড় ঘর। এখানে স্কুল। মাদার সর্বজয়া গার্লস স্কুল। মিশন থেকে স্কুলটা করে দিয়েছে। স্কুলের পেছনে থাকেন হেড মিসট্রেস জিনি সিসটার। পুরো নামটা শোনেনি আনু। এ নামেই সারা শহরে সবাই চেনে। সকাল বেলায় মেয়েরা দল বেঁধে হেঁটে হেঁটে স্কুলে আসে। মিনু আপা সালু আপা পড়ত এই স্কুলে। বাসা বদলের পর সেই যে কদিন কামাই দিল, আর যায় না ওরা। কেউ আর যেতে বলে না ওদের। বাসায় যখন ইচ্ছে হয়, বই নিয়ে বসে।

ফাৎনার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে কেমন সব ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সালু আপা ভারী আড্ডাবাজ হয়েছে। খালি ক্যারম খেলবে বুলু ভাইদের বাসায় গিয়ে। বাবার মুখ মনে পড়ে যায় আনুর। বাবাকে গিয়ে এবার বলবে। সেজ আপাকে বলবে, একটা দরখাস্ত করে দিতে ফুল ফ্রি–র জন্যে। ফুল ফ্রি হয়ে গেলে আবার মিনু আপা সালু আপা স্কুলে যেতে পারবে। ওদের জামাগুলো পুরনো হয়ে গেছে, ছিঁড়ে গেছে। একটা পাখি না পোকা কোথা থেকে তখন থেকে কিট কিট করে ডাকছে।

এইসব মুহূর্তে আনু একেবারে একা হয়ে যায়। চারদিকে কেউ নেই, কোথা থেকে বিচিত্র সব শব্দ উঠছে, ফাৎনাটা স্থির হয়ে আছে। মনে হয় আনুর ঘর নেই, বাড়ি নেই, ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই, তার কেউ নেই। সে কোনদিন বড় হবে না, মহিমপুর ছেড়ে কোথাও যাবে না। মনে হয় সব স্থির হয়ে গেছে।

একটা ঢিল এসে লাগে তার পিঠে। চমকে ওঠে আনু। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকায়। কি ব্যাপার? গীর্জা ঘর, স্কুল, জিনি সিস্টারের কোয়ার্টার সব দেখা যাচ্ছে দূরে, সেখানে কেউ নেই। আশেপাশে একেবারে ফাঁকা। গাছের ওপরেও কিছু চোখে পড়ল না আনুর। তাহলে তাকে ঢিল ছুঁড়ে মারলো কে?

কিসসু বুঝতে না পেরে বোকা হয়ে গেল আনু। তারপর আবার বসলো ছিপ নিয়ে। কিন্তু মনটা তার খুঁতখুঁত করতে লাগলো। এ সব নির্জন জায়গায় কত রকম কী আছে! আনু শুনেছিল, অনেকদিন আগে এক পাদ্রী আত্মহত্যা করেছিল। জোছনা রাতে তাকে নাকি এখনো দেখা যায় গীর্জা–ঘরে হাঁটতে, পুকুর পাড়ে বসে থাকতে, আবার তকতকে উঠোনে নাকি মাঝখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। আনুর সঙ্গে একটা খ্রিষ্টান ছেলে পড়ত পিটার পল দাস। সেই পিটার বলেছে, তার বাবা নাকি নিজের চোখে দেখেছে।

আনুর গা ছমছম করে ওঠে। কি জানি, সেই পাদ্রী ভূতটা না তো! এখন আরেকটা ঢিল এসে পায়ের কাছে লাগে। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে, পিন্টু : ফিচ ফিচ করে হাসছে বুড়ো জারুল গাছটার আড়ালে দাঁড়িয়ে। আনু অবাক হয়ে গেল। পিন্টু। গলা তুলে ডাকতে সাহস পেল না, পাছে গীর্জার লোকেরা টের পেয়ে যায়। এমনিতে সে চুরি করে মাছ ধরতে বসেছে। জিনি সিস্টার ভারী কড়া। ধরতে পারলে শাস্তি দেবেন। আনু তাই নিঃশব্দে ক্রুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো পিন্টুর দিকে। সে এখন এক পা এক পা করে কাছে এগিয়ে এলো।

মাছ ধরছিস?

আনু জবাব দেয় না। পিন্টু আবার বলে, এঃ, একটাও ধরতে পারিস নি।

আনু ফাৎনার দিকে তাকিয়ে থাকে। পিন্টুর সাথে তার সেই প্রথম দিনের ঝগড়ার পর মুখে ভাব হয়ে গেলেও মনে মনে কিছুতেই আনু ওকে ভালো চোখে দেখতে পারে নি। সারাক্ষণ এমন সব বিচ্ছিরি কথা বলতে থাকে আর ইশারা করে যে আনুর চোখ কান লাল হয়ে যায়। পিন্টু এখন বলে, বলে দেব তুই মাছ ধরছিস?

যা বলগে। বল না?

পিন্টু কী ভাবে। তার গা ঘেঁসে বসে আরো। খুব উদার একটা ভঙ্গিতে ঘাটে কাৎ হয়ে শুয়ে বলে, যা, বলবো না।

হাতটা আলগোছে ধরে পিন্টু। আনু ছাড়িয়ে নেয়। ফাটা বুঝি নড়ে ওঠে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফেলে আনু দূর, কিছু না। আজ আনুর বরাতটাই খারাপ। বাজে কথা বলেছে। ফাঁকি দিয়েছে। তারচেয়ে টোগরাই হাট পুলের নিচে গিয়ে বসলে ঢের মাছ ধরতে পারত আনু। পিন্টু পকেট থেকে সিগারেট বার করে, আর দেশলাই। আনু অবাক হয়ে জিগ্যেস করে, তুই সিগ্রেট খাস?

এবারে পিন্টু চুপ করে থাকে। ঠোঁটের ফাঁকে তেরছা হাসি ফুটিয়ে সিগারেটটা নেড়ে দেখে। তারপর পুরো চিৎ হয়ে শুয়ে ঠোঁটে গুঁজে দেয়। দেশলাই জ্বালায়। একমুখ ধোঁয়ার আড়ালে পিন্টুর মুখ ঢেকে যায়। কেমন অদ্ভুত দেখায়। গা শিরশির করে ওঠে আনুর। পিন্টু বলে, খাই তো। সিগারেট না টানলে কেউ বড় হয় না।

তোর বাবা কিছু বলে না?

বাবা জানেই না। চালের বাতায় খুঁজে রাখি, ভাত খেয়ে পায়খানায় বসে খাই। জানবে কি করে? বুদ্ধি থাকা চাই।

তখন ভীষণ ভয় করে আনুর। এখন যদি কেউ দেখে ফেলে। তাহলে সবাই ভাববে, আনুও সিগারেট খায়। সে অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। পিন্টু কোথা থেকে এলো শয়তানের মতো? যায়ও না ছেলেটা। আনু ছিপ তুলে নেয়, গুটিয়ে ফেলে সব। পিন্টু খপ করে তার হাত ধরে ফেলে।

কোথায় যাচ্ছিস?

হাত ছাড়।

আগে বল, কোথায় যাচ্ছিস?

বাসায়।

একটু বোস না ভাই।

পিন্টু হঠাৎ নরোম গলায় বলে উঠে বসে। আনু কী করবে বুঝে উঠতে না পেরে বসে। বলে, তাহলে তুই সিগারেট খেতে পারবি না।

দূর, ভয় কিরে? এখানে কে দেখছে?

না দেখুক। আমার ভালো লাগে না।

তুই খাবি একটা?

ফস্ করে পকেট থেকে সিগারেট বার করে পিন্টু। কিছু বলার আগেই আনুর হাতে খুঁজে দেয়।

খা না। কে দেখবে?

না, কক্ষনো না।

তুই গাধা। খেলে বুঝতি কী মজা। খা না। দ্যাখ, এইরকম করে টান দিবি, কিছু লাগবে না। বলতে বলতে পিন্টু টান দিয়ে দেখায়। তারপর নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে। তুই কিন্তু প্রথমে নাক দিয়ে আমার মতো ছাড়তে গেলে মাথা ঘুরে পড়ে যাবি। প্রথমে গিলবি না। টানবি আর ধোঁয়া ছাড়বি। ধর।

এক ধাক্কা দিয়ে তার হাত সরিয়ে দেয় আনু। হাতটা শানের ওপর গিয়ে পড়ে। ব্যথা লাগে পিন্টুর। লাফ দিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। চিৎকার করে বলে, এঃ সাধু মহারাজ। ঘুসখোরের ব্যাটা, তার ফুটানি কত!

মাথার ভেতরে দপ করে আগুন জ্বলে উঠল আনুর। একটা প্রচণ্ড ঘুষি সে বসিয়ে দিল পিন্টুর মুখে। পিন্টু মুখ দুহাতে ঢেকে বসে পড়ল। তারপর যখন তাকাল তার চোখ লাল হয়ে গেছে, পানি ভরে এসেছে। সে প্রথমেই এক কাণ্ড করল। আনুর পড়ে থাকা ছিপটা দুহাতে মুচড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল পুকুরে। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আনুর ওপর।

ইয়াসিনের কাছে কুস্তি শিখেছিল আনু। এখনো মনে আছে তার। চট করে সে সরে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে পড়ে গেল পিন্টু। তারপর দুজন দুজনকে ধরলো জাপটে। হাতে পায়ে লাথি মেরে ঘুষি দিয়ে গড়াতে গড়াতে শান বাঁধানো ঘাট পর্যন্ত চলে গেল ওরা। পিন্টুর গায়ে জোর কম না। আনু কিছুতেই আর সুবিধে করতে পারছে না। তার হাতটা বেকায়দায় পড়েছে, নিঃশ্বাস নিতে পারছে না, কোথায় যেন নোখ দিয়ে আঁচড়ে দিয়েছে পিন্টু, পুড়ে যাবার মতো জ্বালা করছে। হঠাৎ পিন্টু তার মাথাটা ধরে আছড়ে দিল শানের ওপর। বিকট আর্তনাদ করে উঠল আনু। পায়ের শব্দে লাফ দিয়ে পালাল পিন্টু।

কে, কারা, কে ওখানে?

একটা মাঝবয়সী দারোয়ান ছুটে এলো। আর তার পেছনে জিনি সিস্টার স্বয়ং। আনু উঠে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত দিয়ে দেখে রক্ত।

রক্ত! জিনি সিস্টারকে দেখে আনু বড় বড় করে বলে ওঠে, আমার দোষ নেই। আমাকে মেরে পালিয়েছে। সিগারেট খেতে বলে।

তারপর মাথাটা কেমন ঝিম দিয়ে আসে আনুর। চোখের সামনে জিনি সিস্টার, দারোয়ান, গীর্জা ঘরের চকচকে টিনের চাল—-সব দুলে ওঠে। তারপর আঁধার হয়ে যায়। সে বিড়বিড় করে বলে, রক্ত! বহুদূর থেকে ভেসে আসা কথার মতো সে শুনতে পায় জিনি সিস্টার বলছেন, ওকে ধর, পড়ে যাচ্ছে। ঘরে নিয়ে আয়।

চোখ মেলে দেখে জিনি সিস্টার সামনে বসে আছে। হাতে তার গরম দুধের গেলাশ। দেয়ালে মা–মেরীর ছবি। হাত দিয়ে দেখে, মাথায় ব্যাণ্ডেজ। উঠে বসতে চায় আনু। তিনি তাকে শুইয়ে দিয়ে বলেন, আরো একটু শুয়ে থাকো খোকা। কিছু হয়নি তোমার।

আনু আবার শুয়ে পড়ে। কেমন একটা অবসাদ সারা শরীরে, আর আনু কিছু না। দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয় সব—- পিন্টুর আসা, সিগারেট খাওয়া, মারামারি। ছিপটার জন্যে মন কেমন করে ওঠে। কত যত্ন করে বানিয়ে ছিল আনু। ভীষণ লজ্জা করতে থাকে তার। চুরি করে মাছ ধরতে এসে এইভাবে ধরা পড়ে গেল। আর সে কি ধরা পড়া! একেবারে জিনি সিস্টারের হাতে। চোখে তার পানি এসে যায়। পিন্টু তার বাবাকে ও ভাবে গাল দিতে গেল কেন? এর পরে আবার কোনদিন বললে আছড়ে মানুষ করে দেবে পিন্টুকে। আজ নেহাৎ তার হাতটা বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিল বলে।

চেয়ারে বসে আছেন জিনি সিস্টার। এই প্রথম তাকে এত কাছে থেকে দেখল আনু। অনেকটা মনিরের মা–র সমান। কিন্তু ছিপছিপে শ্যামল, গায়ে একটা গয়না নেই শুধু গলায় রূপোর চেনে স্কুশের লকেট, হাতে ঘড়ি, কালো চিকন পাড়ের শাদা শাড়ি পরনে। চোখের চশমার জন্যে ভারী গম্ভীর দেখাচ্ছে। কিন্তু কথাগুলো কী মিষ্টি। তার বড় আপার মতো মায়া করে কথা বলেন। আনু চোখ বুজে থাকে। আবার যখন চোখ খোলে তখন জিনি সিস্টার গেলাশটা এগিয়ে বলেন, খেয়ে নাও দিকি।

লজ্জা করে আনুর, কিন্তু উঠে বসে চো চো করে সবটা খেয়ে ফেলে। কেন যেন চোখে পানি এসে যায় তার। জিনি সিসটার জিগ্যেস করেন, কি নাম তোমার?

আনু।

কোন্ বাড়ির ছেলে তুমি?

কী বলবে আনু? বাবার নাম করতে সংকোচ হয়। আৰু কী দিয়ে সে পরিচয় দেবে নিজের বুদ্ধি করে শেষে বলে, আমার বোন পড়ত এই ইস্কুলে।

কে?

নাম করলো আনু। তখন ছোট্ট করে জিনি সিস্টার উচ্চারণ করলেন, ও।

অনেকক্ষণ আর কিছু বললেন না। অস্বস্তি করতে লাগল আনুর। ঝি এসে গেলাশ নিয়ে গেল। আনু মাথা নিচু করে রইলো। শেষে সে নিজেই বলল, পিন্টু, বশীদের ছেলে, চেনেন? আমাকে সিগারেট খেতে বলে। খারাপ কথা বলে। আমি ঘাটে চুপচাপ বসেছিলাম। আমি কিসসু করিনি।

জিনি সিস্টার হাসেন। আনু বুঝতে পারে ঘাটে চুপ করে বসে থাকার মিথ্যেটা ধরা পড়ে গেছে। সে সেটা ঢাকার জন্যে আবার বলে, আমার মাথা কেটেছে নাকি?

না। একটু কেটে গেছে। ওষুধ দিয়ে বেঁধে দিয়েছি। খারাপ ছেলের সঙ্গে কক্ষনো মিশো না। তুমি পড়ো?

হ্যাঁ, ফাইভে। এবার সিক্সে উঠব।

বাঃ, বেশ। তুমি এতো ভালো ছেলে, দুপুর বেলায় মাছ ধরতে বেরোও কেন? এখন লেখা পড়া করবার সময়।

চোখ নামিয়ে নেয় আনু। জিনি সিস্টারকে তার ভালো লাগে। ভয় করে না আর। তাই ভয় পায় না কথা শুনে। উনি তো জেনেই গেছেন আনু মাছ ধরতে এসেছিল। বলে, রোজ ধরি না। আমি পড়ি। ফোর থেকে সেকেণ্ড হয়ে ফাইভে উঠেছি।

এবার কি হবে?

কী জানি। আমার দুটো বই নেই।

মা–কে বোলো কিনে দিতে। তোমরা কভাই বোন?

পাঁচ বোন আর আমি। বড় ভাই ছিল, রেলে কাটা পড়ে মারা গেছে।

হ্যাঁ, আমি শুনেছি।

তখন আরো আপন মনে হয় তার জিনি সিস্টারকে। বলে, এখানে কত ফুল গাছ। আমি বাগান করেছিলাম, একটা ভালো গাছ পাই না।

তুমি বাগানও করো? আচ্ছা, তোমাকে আমি চারা দেব। কাল এসো। এক যেতে পারবে?

হ্যাঁ

মাথার ব্যাণ্ডেজে হাত বুলোতে বুলোতে আনু বলে। কিন্তু উনি উদ্বিগ্ন গলায় বলেন, তোমার মা দেখলে কি বলবেন? তোমাকে দিয়ে আসুক। এখন ভালো লাগছে না একটু?

আনু মাথা কাৎ করে সায় দেয়। জিনি সিস্টার দারোয়ানকে ডাকেন। আনু উঠে দাঁড়ায়।

আজ একটা মাছ ধরতে পারেনি সে, ছিপটা গেছে। মারামারি করে মাথা ফাটিয়েছে, তবু একটুও মন খারাপ করে না আনুর। যেন ভারী আশ্চর্য কিছু পেয়ে গেছে সে আজ। খুব বাহাদুর মনে হয় নিজেকে, ভিতরটা ফুরফুর করে ওঠে।

সুবিনয়, যা তো বাবা, একে বাসায় দিয়ে আয়

আনু বাইরে আসে। আকাশটা লাল হয়ে গেছে। তকতকে উঠোনটা আরো বড় দেখাচ্ছে। লাইব্রেরী ঘরে লোকেরা বসে বই পত্রিকার পাতা ওলটাচ্ছে। কয়েকটা মেয়ে ধপধপে ধোঁয়া কাপড় পরে, চুল টানটান করে বেঁধে গীর্জা ঘর ঝাড় দিচ্ছে। আবার কয়েকজন বাগানে পানি দিচ্ছে। ঠাণ্ডা ঝিরঝির বাতাস বইছে উত্তর থেকে। ফুল গাছগুলো ছবির মতো আঁকা হয়ে আছে যেন। টিনের বড় গেটটা পর্যন্ত এলেন জিনি সিস্টার। হঠাৎ বললেন, শোনো, তোমার বোনদের স্কুলে আসতে বোলো কাল থেকে। মা–কে বোলো আমি ফ্রি করে দেব। বোলো, জিনি সিস্টার বলে দিয়েছে। কেমন?

কাল আমাকে চারা দেবেন। আমি আসবো?

আচ্ছা, এসো।

বাড়ির দরোজায় মেজ আপার সঙ্গে দেখা। দরোজা ভেজিয়ে রাস্তা দেখছিলেন গাল পেতে। সুবিনয়ের সঙ্গে আনুকে দেখে চমকে উঠলেন তিনি।

এ–কী? তোর কি হয়েছে আনু?

কিছু না। ফুটবল খেলতে গিয়ে—-

হঠাৎ তার খেয়াল হয় সুবিনয় পাশে দাঁড়িয়ে : সে তাকে বললো, তুমি যাও দারোয়ান। এটা আমার বাসা।

সে চলে গেলে আনু সোৎসাহে বলতে থাকে, ফুটবল খেলতে গিয়ে মাথায় চোট লেগেছিল। জিনি সিস্টার, সর্বজয়া স্কুলের বড়দিমনি, ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিয়েছে। সালু আপা আর মিনু আপার ফুল ফ্রি করে দেবে বলছে, আমাকে ফুলের চারা দেবে, দেখো।

এসব কিছুই শোনেন না মেজ আপা। তার মাথার ব্যাণ্ডেজে হাত রেখে বলেন, শীগগীর চল তুই ভেতরে। মা দেখলে! ইস্, এত দুষ্ট হয়েছিস তুই।

আনুর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। সে বলে, যাও, যাও। মা কী বলবে? আমি ইচ্ছে করে মাথা ফাটিয়েছি, না? আর ওদের ফুল ফ্রি হয়ে গেল, সেটা কী? আমাকে বকবে, এঃ।

.

তারপর থেকে এমন হলো প্রায় রোজ যেত জিনি সিসটারের কাছে আনু। ফুলের চারা এনে লাগিয়েছে সে। গোলাপের দুটো কলমও এনেছে। বারান্দার পাশে আনুর বাগানটা এখন কী সুন্দর হয়েছে। গোলাপ যেদিন ধরবে সেদিন হবে আসল মজা। সেদিন একটা ফুল চুরি করে সেজ আপা খোঁপায় দিয়েছিল, আনু কী রাগ করলো। মা বললেন, একরকম করলে তোর সব গাছ আমি কেটে ফেলব। মানুষ হয়েছে না জানোয়ার হয়েছে একটা।

আজকাল কী হয়েছে, কথায় কথায় মা বিরক্ত হয়ে ওঠেন, চাঁচাতে থাকেন, গাল পাড়েন। সারাক্ষণ মুখটা কালো হয়ে থাকে। আনু কিসসু ভেবে পায় না। এ রকম হয়ে গেছেন কেন উনি? তার খুব রাগ হয় একেক সময়। মার সঙ্গে কথাই বলে না সে সারাদিন। আবার রাতে এসে মাথার কাছে বসেন। আস্তে আস্তে ডাকেন, ওঠ, বাবা আমার। ভাত খাবি না?

তখন আর কিসসু মনে থাকে না আনুর। তখন সে আবার আগের মতো হয়ে যায়। মার হাত জড়িয়ে ধরে আরো কিছুক্ষণ পড়ে থাকে। মা বলেন, তুই রোজ ভাত না খেয়ে ঘুমোলে শরীর খারাপ হয়ে যাবে যে। ওঠ। কাল থেকে সন্ধ্যার সময় ভাত বেঁধে দেব। ওঠ আনু।

সালু আপা মিনু আপা আবার স্কুলে যায়। ওদের একটা বছর নষ্ট হয়ে গেল। বাবাকে গিয়ে যখন সেদিন আনু বলল ওরা আবার স্কুলে যাচ্ছে, কী খুশি হলেন তিনি। লেখাপড়ার কথা শুনলে, এত খুশি হন বাবা। মুখটা সূর্যের মতো জ্বলজ্বল করে ওঠে। আনু আরো ভালো করে লেখাপড়া করবে। এবার যদি সে ফার্স্ট হতে পারে তো স্কা একটা কাণ্ড হয়। বাবা শুনে প্রথমে বিশ্বাসই করতে চাইবেন না। তখন আনু তাকে প্রোগ্রেস রিপোর্ট দেখাবে। বলবে, বৃত্তি পরীক্ষা দেবে। বৃত্তি পেলে কত ভালো হয়। এক পয়সা লাগবে না পড়তে, আবার মাস মাস ছটাকা করে পাবে। ছটাকায় কত কী করা যায়। আনু একজোড়া স্যাণ্ডেল কিনবে। খালি পায়ে তার এত লজ্জা করে স্কুলে। কিন্তু কোনদিন সে কথা বাসায় বলে না। সে তো বোঝে, কী কষ্টে সংসার চালাচ্ছেন মা। পানু ভাইর জন্যে টাকা দিল রেল কোম্পানি। সেই টাকা দিয়ে আপাদের বিয়ে দেবার কথা। তা থেকেও এখন পাঁচ টাকা দশ টাকা করে কমছে। এদিকে মামা প্রতি সপ্তাহে চিঠি লিখছেন টাকা চেয়ে। আজকাল মামার চিঠি মা পড়েনও না, জবাবও দেন না। মামার ওপরে ভীষণ রাগ হয় আনুর। তারচেয়ে মনিরের বাবা অনেক ভালো। রোজার ঈদে একশ টাকা পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু মা যেন কেমন! টাকা সই করে রাখলেন কিন্তু কদিন ধরে বারবার বলতে লাগলেন, না নিলেই হতো। এখন বড়লোকী দেখাচ্ছে।

সেই টাকা দিয়ে ঈদে নতুন জামা হলো। আনু একাই নামাজ পড়তে গিয়েছিল মাঠে। বাবা থাকতে ভোর বেলায় তোপ পড়বার আগে, অনেক আগে আনুকে নিয়ে মাঠে হাজির হতেন। বসতেন একেবারে প্রথম সারিতে। হাফেজ সাহেবের ঠিক পেছনে। তারপর একটা তোপ পড়তো, তার আধঘন্টা পরে আবার একটা। আবার যখন পড়তো, তখন সবাই কাতার বেঁধে দাঁড়াত। লোকেরা দৌড়ে দৌড়ে পুকুর থেকে ঝপাঝপ ওজু করে আসতো। গরিবদের জন্যে কাগজের রঙ্গিন টুপি বিক্রি হতো একআনা করে; সেই টুপি কিনবার জন্যে কাড়াকাড়ি লেগে যেত। জং পড়া পানির খালি ট্যাঙ্কে কাক ডাকতো কা–কা করে। হাফেজ সাহেব পাগড়ি পরে সামনে এসে দাঁড়াতেন তখন। একটি লোক চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে নামাজের নিয়ত বলে দিত। আবার বলত, যারা মনে রাখতে পারবেন না, তারা বলবেন, ইমামের যে নিয়ত আমারো সেই নিয়ত, আল্লাহ আকবর। যা হাসি পেত শুনে আনুর।

এবার একা গিয়ে সে সবার আগে বসেছিল। কিন্তু কারা এলেন, তাকে পাশে সরতে বলল। সেখান থেকেও শেষ পন্ত ঠেলাঠেলি করে তাকে পেছনের কাতারে ঠেলে দিল। কে ঠেলল, কখন ঠেলল, কিছুই জানে না। যখন সবাই কাতার ঠিক করবার জন্যে দাঁড়িয়েছে তখন আনু দেখে সে পেছনে পড়ে গেছে। চোখে পানি এসে গিয়েছিল তার। সামনে যারা দাঁড়িয়েছে। সবার ওপরে রাগ হচ্ছিল ভীষণ। সে ছোট বলে, কেউ তাকে পাত্তা দেয় না। সে একা বলে, কেউ তাকে তোয়াক্কা করে না। বাবার কথা এত মনে হলো তার। কোথা দিয়ে নামাজ শেষ হয়ে গেল, কিসসু বলতে পারবে না আনু, সারাক্ষণ বাবার কথা মনে পড়ছিল আর বুক ঠেলে ঠেলে কান্না উঠছিল। নামাজ শেষে আনু দেখে চোখে কিছুই দেখতে পারছে না সে। খালি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে সব।

বাসায় এসেই আবার ছুট ইস্টিশানে। মা টিফিনকারীতে সেমাই, পোলাও, গোশত দিয়ে দিয়েছেন। বড় আপা, মেজ আপা আর সেজ আপা তাকে মোট দুটাকা আর মা দুটাকা দিয়েছেন। বুলু ভাই এসে বারবার বলছে, চল, চল, গাড়ি ফেল করবি।

বুলু ভাই ঈদের দিন বেড়াতে যাচ্ছে রংপুর। সিনেমা দেখবে। আনু যাচ্ছে বাবাকে দেখতে। এর মধ্যে দাঁড়িয়েই সেমাই খেতে হলো বুলু ভাইকে। তার একমুহূর্ত সময় নেই। সালু আপা পানি দিতে গিয়ে অর্ধেক গায়ে ফেলে দিল তার। বুলু ভাই লাফিয়ে উঠলেন, এহেহে। দিল তো আমার জামা ভিজিয়ে। মারবো একটা।

গা দিয়ে ফুরফুরে আতরের গন্ধ বেরুচ্ছে। বাইরে বেরিয়ে এসে বুলু ভাই বলে, দাঁড়া আনু, আগে তোর সাথে কোলাকুলি করে নি।

সেদিন বাবার সঙ্গে পাঁচ মিনিটেই দেখা হয়ে গেল। অন্যদিন কত ঝামেলা, আজ ঈদের দিন কিনা, তাই চারদিকে কেমন আনন্দ আর দিল খোলর দরিয়া বয়ে যাচ্ছে। রঙিন জামাকাপড় পরে কত যে লোক এসেছে দেখা করতে। ভিড়ে যেন আর ঠাই হচ্ছে না। কলের গান বাজছে তারস্বরে, দূরে রেস্তোয়। পথের মোড়ে বাদর নাচের ডুগডুগি বাজছে। ঈদের স্পেশাল শো–এর ব্যাপার্টি বেরিয়েছে সিনেমার পোস্টার ঘাড়ে করে। সই সই গাড়ি মোটর রিকশা ছুটে চলেছে। সারা পৃথিবী যেন একতারে অনর্গল খলখল করে হাসছে। রোদ উঠেছে খুব। বাবা দেখা হতেই তার মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে চুমো খেলেন। জিগ্যেস করলেন, কিরে নামাজ পড়েছিস?

হ্যাঁ।

এই জামা কিনলি? বেশ মানিয়েছে। গাড়িতে খুব ভিড় হয়েছিল?

হা। সবাই রংপুরে সিনেমা দেখতে এলো, তাই।

একেবারে ঘেমে গেছিস।

বলতে বলতে বাবা তার মুখ হাত দিয়ে মুছিয়ে দেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিগ্যেস করতে থাকেন কে কি পরেছে আজ, কি করছে, ঈদ কেমন হলো। আনু বলে চলে, বড় আপা নীল শাড়িটা পরেছে। কিছুতেই পারব না। মা বলল তারপর। মেজ আপা একটা সবুজ, না কচি কলাপাতার মতো রং মা–র শাড়ি পরেছে। স্যাণ্ডেল কিনেছে নতুন, সাদা, চিকন দুফিতে। সেজ আপা বাক্স খুলে দেখে ওর ব্লাউজের ইস্ত্রী নষ্ট হয়ে গেছে, তাই কী মন খারাপ! আমি যখন আসি তখনো কিছু পরে নি।

আনু টের পায়, বাবা কল্পনার চোখ দিয়ে দেখছেন প্রত্যেককে। হাঁ করে গিলছেন তার কথাগুলো। চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠছে সব। তখন আনু আরো বিশদ করে বলতে থাকে। এক কথা বারবার করে বলতে থাকে। কিছু বাদ দেয় না। একটা বলতে বলতে আরেকটা মনে পড়ে যায়, খেই হারায়, আবার প্রথম থেকে বলে। বাবা একটুও বাধা দেন না! তন্ময় হয়ে শোনেন। তাঁর চোখে মুখে ব্যথা মেশানো খুশি বেলা শেষের মেঘের মতো ছড়িয়ে থাকে। আস্তে আস্তে মুখটা কেমন দূরে সরে যায়। আনুর মনে হয়, দূর থেকে বাবার একটা বড় ছবি দেখছে আনু! সে আপনমনে বলে চলে। তারপর চুপ করে যায়। বাবা চুপ করে থাকেন। টুপ টুপ টুপ টুপ করে সময় বয়ে যায় যেন। একটা নদীর মতো, বৃষ্টির ফোঁটার মতো, প্যাঁচার চোখ দুটোর মতো। আনু হঠাৎ চোখ তুলে জিগ্যেস করে, তোমাদের বাইরে যেতে দ্যায়?

কেনরে?

ঈদের নামাজ পড়তে।

ভেতরেই মৌলবি সাহেব আসে। এখানে জামাত হয়।

আনু অবাক হয়ে যায় শুনে। হাঁ করে বাবার কথাগুলো শোনে। কল্পনা করতে চেষ্টা করে উঁচু পাঁচিল ঘেরা জেলের মধ্যে ঈদের নামাজটাকে। বাইরে থেকে কয়েকটা গাছের মাথা দেখা যায় শুধু। আনু কল্পনা করে থই পায় না। বাবা একটু পরে বলেন, আনু জেলের মধ্যে একটা আলাদা দুনিয়া। ঠিক আল্লার দুনিয়ার মতো। কে কোথা থেকে এসেছে। নিজের স্বাধীনতা নেই। ওপর থেকে হুকুম হচ্ছে, সেই মোতাবেক কাজ করে চলেছে সবাই। যা দেয় তাই খেতে হয়। যা করতে বলে, তাই। নিজের ইচ্ছার কোনো শক্তি নেই। আবার একদিন হুকুম আসে, ছাড়া পেয়ে যায়। ঠিক দুনিয়াদারির মতো। হায়াৎ মওৎ, রেজেক, কাজকর্ম, সব যেমন আল্লার ইচ্ছায় হয়, তেমনি।

আনু আবছা আবছা বোঝে। বাবা মোহগ্রস্তের মতো কথাগুলো বলে চলেন। কি প্রসঙ্গ, কেন বলা, সে বুঝবে কিনা, কিছুই যেন তিনি ভাবছেন না। কেবল বলতে হবে, এই বোধটা থেকে বলছেন। আনু বুঝতে পারে না; কিন্তু কোথায় যেন কষ্ট হয় তার! মনটা ভারী উদাস হয়ে আসে। সব আনন্দ, হাসি, রোদ, অর্থহীন মনে হয়। যেন সবকিছু তাকে স্পর্শ না করে তার বাইরে বিরাট একটা চাকার মতো ঘুরছে। তার দুঃখ হয় না, কান্না পায় না, বাবা তার হাত ধরে আছেন, সে হাতটাও যেন আর বোঝা যায় না।

বেরিয়ে এসে কেমন শূন্য লাগে ভেতরটা। সে হাঁটতে থাকে। পেট্রোল পাম্পের সামনে দাঁড়িয়ে মোটরে তেল ভরা দেখে আনু। ঝরঝর শব্দ করে লেখা উঠছে এক–দুই–তিন কতটা পেট্রোল যাচ্ছে। ফুটপাথের ওপর দুটো লোক কোলাকুলি করছে। সিল্কের টুপি মাথায় বাচ্চা একটা ছেলে তার বাবার হাত ধরে কোথায় যাচ্ছে। ছেলেটা হাঁটতে পারছে না ঢিলে, বড়সড় নতুন কাপড়ের ভারে, টলমল করছে। রিকশার খুদে হর্ণ বিকট শব্দ করছে ঘ্যাঁ–পুঁ–ঘ্যাঁ–পুঁ। চাঁদোয়া টানানো রঙ্গিন শরবতের দোকানে ভিড় করে লোক বসেছে। বেঞ্চিতে। হাতে গেলাস নিয়ে একটু একটু করে চুমুক দিচ্ছে। নেবুর ঘ্রাণ বেরিয়েছে ভারী দাশ কোম্পানিতে গিয়ে বসে আনু। সিনেমা দেখে বুলু ভাই এখানে আসবে। এখানে থাকতে বলে গেছে তাকে। হিন্দুর দোকান। ওদের তো আর ঈদ না। তাই দোকানটা কেমন দেখাচ্ছে আজ। কুর্তি নেই, রঙিন কাগজের মালা নেই, হৈচৈ নেই—-একেবারে ঠাণ্ডা, অন্ধকার।

দাশবাবু বললেন, কী খোকা! বাবার সঙ্গে দেখা হলো? কেমন আছেন?

হ্যাঁ, ভালো।

বোসো তুমি। ঐখানটায় বোসো।

বলেই আবার কাজে লেগে গেলেন দাশবাবু। একটা কলের গান মেরামত করছেন তিনি। আনু তন্ময় হয়ে তাঁর কাজ করা দেখে। দেখতে দেখতে বেলা পড়ে আসে। বুলু ভাই আসে। মহিমপুরের গাড়ি আটটায় ছাড়ে। বুলু ভাই বলে, টাউন হলে বিচিত্রানুষ্ঠান হচ্ছে। যাবি? গাড়ির আগেই চলে আসব।

আসলে নাম তার ভার্জিনিয়া দাস। সেই থেকে জিনি সিস্টার। আনু শুনেছে মেজ আপার কাছে। মেজ আপার সঙ্গে ভারী ভাব হয়ে গেছে জিনি সিস্টারের। একদিন আনু নিয়ে গিয়েছিল বেড়াতে, বলে দিয়েছিলেন উনি। তারপর থেকে আর কোনদিন না হোক রোববারে মেজ আপা যাবেই। বলে দিয়েছিলেন সবাইকে নিয়ে যেতে। কিন্তু বড় আপা আজকাল বেরোয়ই না। মা বলেন, আমার আবার বেড়ানো? সেজ আপার প্রথম দিনই পছন্দ হয়নি জিনি সিস্টারকে। সেজ আপাও প্রথম দিন গিয়েছিল আনুর সঙ্গে। ফিরে এসে বলে, মাগো। কালো কুষ্টি। তার ওপর আবার চশমা। দেখলে গা জারিয়ে আসে।

মেজ আপা তাকে ধমক দিয়ে উঠেছিলেন, থাক আর তোকে গীত গাইতে হবে না। নিজে যা একখানা সুন্দরী, আয়নায় সুরত দেখিস।

আনু বুঝেই পায় না সেজ আপার এত অপছন্দ কেন। রাতে মেজ আপাকে সে চুপ করে বলে, জানিস, সেজ আপা আরো কী সব খারাপ কথা বলে। মাকে বলেছিল।

বলুকগে। আমার কী বাবা।

রোববারে যাওয়া চাই–ই মেজ আপার। মিশনের মেয়েগুলো ভোরে নেয়ে উঠে ঝকমক করে। পিঠের ওপর ছড়িয়ে দেয় চুল। থালায় করে ফুল নিয়ে গীর্জা ঘরে যায়। বেদি সাজায়। তারপর প্রার্থনা শুরু হয়। জিনি সিসটারের বাবা জন দাস পাদ্রী। তিনি গিয়ে বেদিতে দাঁড়ান। বক্তৃতা দেন। সাধু ভাষায় যখন কথা বলতে থাকেন এত মজা লাগে আনুর।

“একশত মেষের ভিতর নিরানব্বইটি গৃহে ফিরিয়া আসিলেও যে একটি প্রত্যাবর্তন করে নাই, রাখাল বালক তাহার নিমিত্ত গৃহ হইতে অন্ধকার অরণ্যসংকুল পথে বাহির হয়। এবং উচ্চস্বরে রোদন করিয়া ডাকিতে থাকে।“

তারপর বেজে ওঠে অর্গ্যান। গমগমে হয় ওঠে সারা গীর্জাঘর। মনে হয় শাদা দুধে কে যেন সমস্ত ভাসিয়ে ধুয়ে নির্মল করে দিয়ে যাচ্ছে। একসাথে ছেলেমেয়েরা গেয়ে ওঠে—- “শান্তিময় তোমার কোলে ডাকিয়া লও মোরে।” বারবার করে গায়। আবেগে মন্থর গম্ভীর শোনায় সম্মিলিত গলা। সুরের কাঁপনে বুকের মধ্যে গিয়ে পৌঁছায়। কেমন জড়িয়ে আসে সবকিছু। যেন বাস্তব থেকে স্বপ্নের দিকে দেবদূতের আস্তে আস্তে তুলে নিয়ে যাচ্ছে বাড়ি, ঘর, মানুষ, প্রকৃতি সবকিছু।

মিষ্টি খেতে দেন জিনি সিস্টার। এই গান আর মিষ্টির লোভে আনু রোববারে আসে। সারাক্ষণ মেজ আপা গল্প করতে থাকেন। ঘরের ভেতরে যান। আবার আনুকে বসিয়ে রেখে মেয়েদের ঘরে গিয়ে গল্প করেন। আনু বসে বসে দেখে সামনের চালাঘরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বাইবেলের গল্প বলছেন জিনি সিস্টার। ছবি দেখাচ্ছেন। একটা ছবি আনুর খুব ভালো লেগেছিল। যিশুখৃষ্ট ইদারার পাড়ে একটা মেয়ের কলসি থেকে আজলা ভরে পানি খাচ্ছেন। বেলা দশটা এগারোটা হয়ে গেলে তখন ওরা ফেরে। মা বকেন, তবু যাওয়ার কামাই হয় না। সেজ আপা টিটকিরি কাটেন, তবু মেজ আপার যাওয়া চাইই।

একদিন মেজ আপা বাসায় এসে মাকে বললেন, মা আমি মাস্টারি নিলাম।

শুনে প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলেন না মা। তখন মেজ আপা আবার বললেন, বিশদ করে। সর্বজয়া গার্লস স্কুলে ছাত্রীদের পড়বে। এখন মাসে পঁচাত্তর আর দশ টাকা অ্যালাউন্স দেবে! এতক্ষণে আনু বুঝতে পারে এইজন্যে আজ মিশনারী থেকে ফিরে আসবার সময় এত খুশি লাগছিল মেজ আপাকে। সে বলে, জিনি সিস্টার দিয়েছে চাকরি, না?

দেবে কি? আমি চেয়ে নিলাম। বাসায় বসে থেকে করব কি? পড়া তো আর হবে না। তবু দুটো টাকা এলে কাজে লাগবে।

মা জিগ্যেস করলেন, মাইনে কত বললি?

সব মিলিয়ে পঁচাশি।

দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে তখন তিনি বললেন, দ্যাখো আমার কপাল। মেয়ে হলো ছেলের সমান। এমন মা যেন সাতজন্মে কেউ না পায়।

থাক ও কথা মা।

মেজ আপা মা–র হাতের কাজ কেড়ে নিয়ে সেইটে করতে করতে বলে। আবার বলে, রোজ ভোর সাতটায় যেতে হবে। ফিরতে ফিরতে একটা। দাই এসে নিয়ে যাবে।

সেই সময়ে বড় আপা এলেন ঘরে। মা তার মুখের দিকে তাকালেন। কেমন নিরস কণ্ঠে তাকে শোনালেন, শুনলি, ও মাস্টারী নিয়েছে। মাসে পঁচাশি টাকা মাইনে।

চোখ বড় করে বড় আপা তাকিয়ে থাকেন মেজ আপার দিকে। মুখে একটু পর বলেন, ভালো তো।

তারপর নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে চলে যান। আনু বুঝতে পারে, শুনে বড় আপা কোথায় যেন কষ্ট পেয়েছেন। মা যেন টাকার কথাটা শুনিয়ে শুনিয়েই বললেন বড় আপাকে। অমন করে না বললে কী হতো? আনুর খুব রাগ হয় মা–র ওপর। মা আজকাল কী রকম যেন হয়ে যাচ্ছেন। এই সেদিন স্কুল থেকে বাসায় এসে শোনে বড় আপাকে বকছেন, বাপকে জেলে পাঠালি তাতে শান্তি নাই। এখন আমার হাড়মাংস চিবিয়ে খা, তাহলে পেট ভরবে। যমেও পছন্দ করে না তোকে?

ঘরে ঢুকে দেখে বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন বড় আপা। আনু সাহসই পেল না তার কাছে যাবার। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। বইখাতা ছুঁড়ে ফেলে বাইরে চলে যাচ্ছিল, মা চেঁচিয়ে উঠলেন, ইস্কুল থেকে এসে কোথায় চললি টো টো করতে। দাঁড়াও আজ তোমার একদিন কী আমার একদিন।

আনু রুখে দাঁড়িয়েছিল। ইস, তাকে মারবে এত শস্তা?

আনু উঠে দাঁড়ায়। মেজ আপা আর মা গল্প করতে থাকেন। স্কুলে চাকরি নেয়ার কথা শুনে আনুর কেমন খুশি হচ্ছিল, সেই খুশিটাও ম্লান হয়ে যায়। শোয়ার ঘরে এলে দেখে বড় আপা বসে গেছেন সেলাই নিয়ে। সুঁচে সুতো পরাচ্ছেন। আনু তার বিছানায় গিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর একসময় মুখ ফিরিয়ে বলল, তুই মন খারাপ করিস না। আমার ভালো লাগে না।

বড় আপা চকিতে মুখ তুলে তাকান। আনুকে দেখেন। তারপর মুখখানা হাসিমাখা করে সুতো টানতে টানতে বলেন, কই মন খারাপ করি রে? কই?

আনু আর কিছু বলে না। মুখ ফিরিয়ে নেয়। বড় আপা জোর করে হাসতে চেয়েছে। তাই আরো কেমন করুণ লাগছে। তাকিয়ে দেখা যায় না।

সেজ আপা শুনে ঠোঁট উলটে বললেন, ও তো খ্রিষ্টান হয়ে গেছে, তাই ওকে নিয়েছে। মা একটা বোকা, তাই খুশি কত তার। আমাকে কেটে ফেললেও যেতাম না বাবা।

আনুর কেমন সন্দেহ হয় শুনে। তবু সে ধমকে ওঠে, হিংসা হচ্ছে কিনা, তাই।

মনের মধ্যে কেমন করে ওঠে আনুর, সত্যি মেজ আপা খ্রিষ্টান হয়ে গেছে নাকি?

সেজ আপা আবার বললেন। তুই খোঁজ নিয়ে দেখগে, ওদের সব মাস্টারনী খৃষ্টান। একটা মোসলমান নেবে কিনা? কত দায় পড়েছে তাদের।

পরদিন আনু ভোরে মেজ আপাকে দিয়ে এলো স্কুলে। আজ দাই আসবে না। পথে জিগ্যেস করল সে, তুই খ্রিষ্টান হয়ে গেছিস আপা?

কে বলল রে?

এমনি। বল না? ওদের সব মাস্টারনী খ্রিষ্টান?

হ্যাঁ, কি হয়েছে?

তাহলে তোকে নিল কেন? মোসলমান নেয়?

নেবে না কেন? ওদের কত দরকার। এত খ্রিষ্টান পাবে কোথায়? জিনি সিস্টার কত ভালো দেখিস না।

তবু কেমন খচ খচ্‌ করে ভেতরটা। আর কিছু জিগ্যেস করে না সে। তার যেন মনে হয় সবাই কেমন দূরে সরে যাচ্ছে। মা, বড় আপা, মেজ আপা, সেজ আপা—- সবাই বদলে যাচ্ছেন। কি যেন একেকজনের ভেতরে ভেতরে হয়, আনু তার কিসসু জানতে পারে না। ভারী একা লাগে। কষ্ট হয়। কাউকে বলতে পারে না।

হঠাৎ মাস্টার সাহেবের কথা মনে পড়ে তার। নদীর পাড়ে সেদিন সন্ধ্যেটার ছবি ফিরে আসে। নদীর দিকে তাকিয়ে কথা বলছিলেন—-তুমি যখন বড় হবে, তখন বুঝবে। আনুর মনে হয়, সে বড় হয়ে গেছে। সে এখন সব বোঝে। স্কুলের দরোজায় সুবিনয়কে দেখে সে। বলে ওঠে, ঐ তো দারোয়ান। আমি যাই।

মেজ আপা টিনের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে যান।

এখন থেকে রোজ সকালে দাই এসে নিয়ে যায় তাঁকে। কত ভোরে ওঠেন মেজ আপা। তারো আগে মা উঠে রুটি বানাতে থাকে। চা দিয়ে রুটি খেয়ে মেজ আপা চলে যান ইস্কুলে। তারপর চা খেতে বসে সবাই। আনু আজকাল একা চা খায়। কাপটা নিয়ে চলে আসে বারান্দায়। বইগুলো পড়ে থাকে সামনে। রোদ উঠোনময় হয়ে যায়। কাক ডাকতে থাকে। বুলু ভাইদের বাড়িতে কলরব শোনা যায়। একেকদিন আনু খুব মন দিয়ে পড়ে। আবার একেক দিন কী হয় তার কিস্‌সু ভালো লাগে না। বসে বসে ছিপটা পাকা করে। টোপ বানায়। আজ কোথায় মাছ ধরতে যাবে, তাই ভাবে।

মা চিৎকার করে উঠেন, ওরে তোর চোদ্দ পুরুষ মাঝি ছিল কিনা। তুই ধরবি না তো কে ধরবে? মাছ ধরবি আর বাজারে বিক্রি করবি। লেখাপড়ার কি দরকার?

পালটা জবাব দেয় আনু, আমার বই নেই তো, আমি কি করব! দুখানা বই সাত টাকা লাগে। দিলেই হয়।

মা থামবেন কেন? তিনিও বলে চলেন, সাত টাকার জন্যে তোমার বিদ্যার জাহাজ ভাসে না, না? গরিবের ছেলে লেখাপড়া করে না? চেয়ে চিন্তে বই পড়ে না তারা? বই নাই তো এদ্দিন পরে বললি কেন? খবরদার বলতে পারবি না? যা আমার চোখের সামনে থেকে। যা সব, যা। গুষ্টি দূর হ।

আনু একটু ভয়ই পেয়ে যায়। ভয় পাবে না? মা–র চিৎকার শুনে আপারা পর্যন্ত গুটিগুটি পায়ে সরে পড়েছে। ছিপটা হাতে করে আনু বাইরে এসে দাঁড়ায়। যাক চুলোয়, আজ সে স্কুলেই যাবে না।

পরদিন সাতটা টাকা দেন মেজ আপা। বাসায় এসে সালু আপার কাছে সব শুনেছেন তিনি। আমাকে আগে বলিস নি কেন?

মাথায় হাত দিয়ে একটু পরে বলেন, দাঁড়িয়ে থাকিস না। বই কিনে নিয়ে আয়।

আনু তবু নড়ে না। কালকের রাগ আজ কান্না হয়ে আসতে চাইছে। টাকাগুলো মুঠো করে ধরে রাখে। তখন মেজ আপা বলেন, আচ্ছা, বইয়ের নাম লিখে দে, আমি সুবিনয়কে দিয়ে আনিয়ে নেবখন।

রাতেই বই দুটো এসে যায়। সুবিনয় দিয়ে গেলে আনু বাতির সামনে ধরে নেড়ে চেড়ে দেখে। গন্ধ শোকে নতুন বইয়ের। তক্ষুণি মলাট করে ফেলে। মেজ আপা তার পাশে বসে। বলেন, কি এবার থেকে পড়বি তো?

আনু ঘাড় কাৎ করে। তারপর এদিক ওদিক দেখে ফিসফিস করে মেজ আপাকে বলে, আমাকে একজোড়া স্যাণ্ডেল কিনে দিবি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *