১০. গন্ধ পাচ্ছি

গন্ধ পাচ্ছি। বেশ গন্ধ পাচ্ছি। নিত্যহরি ভট্‌চায্যির নাককে ফাঁকি দেওয়া কঠিন কাজ। আমার ঘরে ঢুকেই ভদ্রলোক চিৎকার করে উঠলেন। রাতের অন্ধকার তখনও কাটেনি। সেই সময়েই নিত্যহরিবাবু নিজের ঘর ছেড়ে ছাদে উঠে এসেছেন। রাত্রে ওঁর মোটেই ঘুম আসে না; তাই আড্ডা দিয়ে সময় কাটাবার জন্যে আমার ঘরে চলে এসেছেন। আমার তোশক এবং বিছানা চাদরের অবস্থা ঘরে ঢুকেই তিনি বুঝতে পারলেন। বললেন, তা বেশ বেশ। আমাদের শাস্ত্রেই রয়েছে যস্মিন্ দেশে যদাচার।

গতরাত্রে আমার ঘরে যে কাণ্ড হয়েছিল তা এবার তার কাছে নিবেদন করলাম, বললাম, মাতাল সায়েবটা বিছানার উপর উঠে যা কাণ্ড করলে।

ন্যাটাহারি আমাকে কতখানি বিশ্বাস করলেন তা তার কথা থেকেই বুঝলাম। মুখ বেঁকিয়ে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, মশাই, এই নিত্যহরি ভট্টাচার্যও তার বাবাকে একদিন বলেছিল যে, তাকে শিখ পাঞ্জাবিতে ধরে নিয়ে গিয়েছিল।

রহস্যটা হৃদয়ঙ্গম না-করতে পেরে ওঁর মুখের দিকে তাকালাম। ন্যাটাহরিবাবু অসন্তুষ্ট হয়েই বললেন, কতবার আর রিপিট করব? আপনার বাবা কি আপনাকে দুধের বদলে পিটুলি গোলা খাইয়ে মানুষ করেছেন? আপনার ব্রেনটা যে কিছুই মনে রাখতে পারে না।

আমি চুপ করে রইলাম। নিত্যহরিবাবু বললেন, বাবার কাছে আমি শিখ-পাঞ্জাবির গল্প বানিয়ে ছাড়লাম। বাবা ঋষিতুল্য সরল মানুষ, আমাকে বিশ্বাস করলেন। মহাপাপ করেছিলাম। উপরে যিনি রয়েছেন, তিনি তো সব দেখছেন। সেখানে ফাঁকি দেবার উপায় নেই। সব কর্মের নগদ বিদায় দেবার জন্যে থলে নিয়ে তিনি সংসারের ফটকে বসে রয়েছেন। না হলে, রাঢ়ী শ্রেণি, ফুলিয়া মেল, ভরদ্বাজ গোত্র নিত্যহরি ভট্টচার্যকে ধোপর কাজ করতে হয়? দুনিয়ার পাপ দুহাতে ঘাঁটতে হয়? সারারাত ধরে এই পোড়া হোটেলের ঘরে ঘরে, খোপে খোপে যত পাপ তৈরি হচ্ছে, যত অনাচার বালিশে, তোশকে, চাদরে, কাপড়ে মাখামাখি হচ্ছে তা সব আমাকে পরিষ্কার করতে হয়? নিত্যহরিবাবু আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন।

তারপর যেন আমাকে সাবধান করবার জন্যেই বললেন, এমন হত না মশাই! বাউনের ছেলে, লেখাপড়া শিখে আমিও এতদিনে বাবার মতো বঙ্গবাসী কিংবা রিপন কলেজে একটা প্রেপেচারি করতে পারতাম। প্রেপেচার তো আমার বাবাও ছিলেন। প্ৰেপেচারের রক্তই তো মশাই এই শর্মার শিরায় শিরায় বইছে। নিত্যহরিবাবু হঠাৎ চুপ করে গেলেন। কী ভেবে গভীর হতাশার সঙ্গে বললেন, সে রক্তের এক ফোটাও আজ আর এই শরীরে নেই, কবে জল হয়ে গিয়েছে। শিরা কেটে দিলে নিত্যহরির দেহ থেকে এখন যা বেরোবে সে আর রক্ত নয়, সে কেবল সাবান আর সোডার ফেনা।

নিত্যহরিবাবু বললেন, ইস্কুলে পড়তে পড়তেই বয়ে গিয়েছিলাম, মশাই। একদিন রাত্রে তো মদ গিললাম। পাল্লায় পড়ে বেপাড়ায় গেলাম। কিন্তু বাবা আমার মাটির মানুষ। বই ছাড়া কিছুই বুঝতেন না। মাও তথৈবচ। পরের দিন ওঁরা জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার? রাত্রে ফিরলি না কেন? আমি বললাম, ময়দানে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ওখান থেকে সোজা ফিরছিলাম; এমন সময় শিখ-পাঞ্জাবির পাল্লায় পড়লাম। ওরা ধরে নিয়ে গেল। সারারাত কান্নাকাটি করায় আজ সকালে ছেড়ে দিল।

নিত্যহরিবাবু একবার ঢোক গিললেন।গায়ে আমার মদের গন্ধ ছাড়ছিল। তবু মা আমায় বিশ্বাস করলেন, শিখ-পাঞ্জাবিদের বিছানায় শুয়ে আমার এই . অবস্থা হয়েছে। আপনিও বলছেন, ওই বাঁটকুলে সায়েব আপনার বিছানা নষ্ট করে দিয়ে গিয়েছে। দেখবেন মশাই।

আমি মৃদু হাসলাম। নিত্যহরিবাবু বললেন, কলকাতায় কত কচি কচি ছেলের বারোটা এইভাবে হোটেলে, রেস্তোরাঁয় আর খারাপ জায়গায় বেজে যাচ্ছে, তার খবর তো আর গরমেন্ট রাখে না। বেচারা গরমেন্টকেই শুধু দোষ দিই কেন, বাপেরাই রাখে না। তারা ভাবছে, তাদের ছেলেদের শিখ-পাঞ্জাবিতেই ধরে নিয়ে যাচ্ছে।

নিত্যহরিবাবু ততক্ষণে আমার বিছানা থেকে চাদরটা গুটিয়ে নিতে আরম্ভ করছেন। গুটোতে গুটোতে বললেন, তোষকটাও পালটিয়ে দিই। দূরে থাকুন। পাপ থেকে দুরে থাকবার চেষ্টা করুন।

নিত্যহরিবাবুকে বললাম, হাত ধোবেন? নিত্যহরিবাবু রেগে উঠলেন। কতবার আর খোবো? হাত ধুয়ে ধুয়ে তো চামড়া পচে গেল। এই সমস্ত হোটেলটাকে যদি বিরাট একটা ডেটলের গামলায় চুবিয়ে রাখা যেত, তবে আমার শান্তি হত।

ওঁর ভাবগতিক দেখে আমার আর কথা বলতে সাহস হচ্ছিল না। কিন্তু নিত্যহরিবাবু ছাড়লেন না। গম্ভীরভাবে বললেন, ভালো করেননি মশাই। ছিলেন শর্টহ্যান্ডবাবু, ভালো কথা। কাউন্টারের আসুন-বসুন-বাবু হলেন, তাও চলে যায়। কিন্তু তাতির আবার এড়ে গোরু কেনার শখ হল কেন? ওই রাতের নাচে যাবার কী দরকার ছিল?

বললাম, শখ করে কী আর গিয়েছি, নিত্যহরিদা? চাকরিটা তো রক্ষে করতে হবে?

কে যেন নিত্যহরিদার ক্রোধাগ্নিতে জল ঢেলে দিল। চাকরির কথাতে জ্বলন্ত নিত্যহরিদা দপ করে নিবে গেলেন। আস্তে আস্তে বললেন, হ্যাঁ, ঠিক ভাই। এই পোড়া পেটটার জন্যে দুনিয়াতে লোকে কী না করছে? এই পোড়া পেট না থাকলে ন্যাটাহরি শর্মাও দুনিয়ার লোকের পরনের কাপড় ঘেঁটে মরত না।

আমি বললাম, এই পোড়া পেটটাই তো আমাদের সর্বনাশ করেছে। এই পেট না থাকলে ক্যাবারে গার্ল কনিকেও দেহ উলঙ্গ করে নেচে বেড়াতে হত না। ন্যাটাহারিবাবু এবার গম্ভীর হয়ে উঠলেন। বললেন, পেট ছাড়াও একটা জিনিস আছে, তার নাম স্বভাব। আপনাদের এই মেমসায়েবকে আমার কিন্তু ভালো লাগেনি।

ভাগলাম, গতরাত্রের ঘটনাটা বোধহয় তিনি জেনে গিয়েছেন। কিন্তু ন্যাটাহারিবাবুর কথা থেকেই বুঝলাম তিনি অন্য ঘটনার কথা বলছেন। নাকের চশমাটা সোজা করে নিয়ে নাটাহারিবাবু বললেন, হ্যাঁ বাপু, যা সারাজন্ম সাপ্লাই করে আসছি, দুটো একস্ট্রা বালিশ চাও বুঝতে পারি। তা না। আর এত লোক থাকতে কিনা আমাকে! আমি তো মশাই ট্যারা! আরে মশাই, আমি খোজ করতে গিয়েছি আরও বালিশ লাগবে কিনা। তার উত্তর সোজাসুজি দিয়ে দে। তা না, ঠান্ডা ঘরের গরম মেমসায়েব রেগেই আগুন। বলে কিনা, আমার অ্যাসিস্ট্যান্টকেও আমার লাগোয়া এয়ারকন্ডিশন ঘর দিতে হবে।

আমি বললাম, আমি বালিশের মালিক, ঘরের মালিক নই। তবু, মেমসায়েব, এই কথা বলতে পারি, শাজাহান হোটেল আপনাকে ঠান্ডা ঘর দিলেও, আপনার অ্যাসিস্টান্টকে দিতে পারবে না। মেমসায়েব বললেন, তাহলে সে কোথায় থাকবে? আমি বললাম, যেখানে শাজাহান হোটেলের

অন্য সবাই থাকে—ছাদে।

মেমসায়েব মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। এই শাজাহান হোটেলে মাসের পর মাস কত নাচের মেয়ে আসছে, তারা কেউ তো অ্যাসিস্টান্ট নিয়ে মাথা ঘামায় না। তারা এসে খোঁজ করে কোথায় তাকে ঘর দেওয়া হয়েছে। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করার ব্যবস্থা ঠিক আছে কিনা। বিছানা নরম আছে কিনা। বালিশ ঠিক আছে কিনা। ন্যাটাহারিবাবু এবার থামলেন।

আমি বললাম, তাতে হয়েছে কী?

যা হবার তা হয়েছে! ন্যাটাহারিবাবু মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে বললেন, আহা!

ন্যাটাহারিবাবুর মাথা চাপড়ানোর কারণ বুঝতে না পেরে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ন্যাটাহারিবাবু বললেন, ভগবান কি আপনার মাথায় এক ফোটাও ঘি দেননি? আপনি কি চোখে দেখতে পান না? অমন লক্ষ্মী প্রতিমার মতো মেমসায়েব; আর কোথায় ওই বামনাবতার। কিন্তু মশাই, কি বলব। শাস্ত্রেই বলছে-যার সঙ্গে যার মজে মন, কিবা হাড়ি কিবা ডোম! কোথায় অত বড়ো নাচিয়ে, যার জন্যে আমাদের সায়েবরা হাজার হাজার টাকা খরচ করছেন, আর কোথায় তার ল্যাংবোট বামন—যার শো থাকল আর না থাকল। অথচ বাঁটকুলের সে কী তেজ! বলে কিনা-কনি, তুমি এখানে থেকে যাও, আমি চললাম। সেই শুনে ছুঁড়ির মুখ শুকিয়ে আমসি। বললে-প্লিজ, তুমি রাগ কোরো না। আমি যা হয় করছি। বামন তো জানে ঘুড়ি তার মুঠোর মধ্যে। তাই আরও রাগ দেখালে। বললে, তুমি এখানে থেকে যাও, নাচো, লোকের হাততালি কুড়োও। আমার এসবের দরকার নেই। কনি তখন বলে কি জানেন? নিজের কানে না শুনলে আমি বিশ্বাসই করতাম না। সে আমাকে জিজ্ঞাসা করলে, ছাদে আমাকে একটা ঘর দিতে পারো না?

নিত্যহরি ভটচায্যি এত বছর এই শাজাহান হোটেলের ময়লা কাপড় ঘেঁটে মরছে। সে সব বোঝে। মনে মনে বললাম, পাশাপাশি ঘর চাও নিশ্চয়! মুখে বললাম, আমি জানি না। জিমি সায়েবকে ডেকে দিচ্ছি।

জিমি সায়েব এসে কী করলে জানি না। দেখলাম, ল্যামব্রেটা উপরে চলে গেল। মেমসায়েব ঠান্ডা ঘরেই রয়ে গেলেন। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হল, মাঝখান থেকে পুওর উলুখাগড়ার ভেলুয়েবল লাইফটা চলে গেল। আমি কোথায় জিজ্ঞাসা করতে গেলাম, রাত্রে একস্ট্রা বালিশ লাগবে কিনা। রেগে গিয়ে তার উত্তরই দেওয়া হল না। বরং ন্যাকা সেজে, রেগে গিয়ে জিজ্ঞাসা করা হল-বালিশ? ঘরে তো দুটো বালিশ রয়েছে। সিঙ্গলরুমে আর বালিশ নিয়ে কি আমি রোস্ট করে খাব?

কালী, কালী, ব্রহ্মময়ী মা আমার! নিত্যহরিবাবু এবার উঠে পড়লেন। যাই আমি। এতক্ষণে ধাপাগুলো কাজে ফাঁকি দিয়ে গাঁজা টানতে বসে গিয়েছে নিশ্চয়। যাবার সময় ভদ্রলোক আমার চাদর আর বালিশ দুটো নিজেই তুলে নিলেন।

আমি বাধা দিতে গেলাম। বললাম, বেয়ারা রয়েছে, সে নিয়ে যাক। না-হয় আপনার ধোপাদের কাউকে পাঠিয়ে দিন। আপনি..

ন্যাটাহারিবাবু পরমুহূর্তে নিজের অজ্ঞাতেই বোধহয় নবরূপে প্রকাশিত হলেন। তার চোখদুটো মুহূর্তের জন্য জ্বলে উঠল। বললেন, ছেলেপুলে নেই বলে আমার মধ্যে ভগবান কি মায়া দয়া দেননি? তুমি আমাকে এত বড় কথা বললে? তোমার থেকেও আমার ছেলের বয়স কত বড় হতে পারত তা তুমি জানো? ন্যাটাহারিবাবু কথা শেষ না-করেই ঘর থেকে দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেলেন।

এই ভোরবেলাতেই আমার ঘরে যে এমন একটা ব্যাপার হয়ে যাবে, তার জন্যে গুড়বেড়িয়া প্রস্তুত ছিল না। সে ঘরে ঢুকে বললে, আপনার চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

চা-এর পাত্র শেষ করে ঘরের বাইরে এসে দেখলাম, কনি কখন ছাদের উপরে উঠে এসেছে। কটিমাত্র বস্ত্রাবৃত হয়ে কনি শাজাহান হোটেলের মাথায় বসে সূর্যদেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার চেষ্টা করছে। ভোরবেলার সূর্যকিরণে এমন সব গোপন পদার্থ থাকে, যার সান্নিধ্যে সুন্দরীদের সৌন্দর্য নাকি আরও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। কে জানে, হয়তো তাই। কিন্তু ভোরবেলায় এই প্রকাশ্য সূর্যসেবায় উপস্থিত অন্যান্য জীবদের যে সামান্য অসুবিধা হতে পারে, তা যেন কনির খেয়াল নেই।

সুসজ্জিত বেশবাসে রোজিও ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। মার্কোপোলো এই সময় কিছু ডিক্টেশন দিয়ে কাজের বোঝা হাল্কা করে রাখেন। আমাকে দেখেই রোজি তির্যক দৃষ্টিশর নিক্ষেপ করল। আমি বললাম, গুড মর্নিং।

রোজি আমার শুভেচ্ছা ফেরত দিল না। বরং দাঁত দিয়ে হাতের নখ কাটতে আরম্ভ করল। রেগে গিয়ে আমি বললাম, মিস্টার মার্কোপোলোও সেদিন তোমাকে বলেছেন—ব্লেড দিয়ে নখ কাটতে হয়।

হয়তো রোজিকে এমন ভাবে বলা আমার উচিত হয়নি। কিন্তু ওর উপর আমার কেমন একটা সহজাত রাগ ছিল। রোজি প্রথমে লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। ঠিক রাঙা নয়। বীরভূমের রাঙামাটির পথে কিছুক্ষণ হাঁটলে কালো জুতোর যেমন রং হয়, ওর মুখের রং ঠিক সেই রকম হয়ে উঠল। রোজি বললে, আমি এখনই জিমিকে সঙ্গে করে মার্কোপোলোর কাছে যাচ্ছি। দরকার হলে বোসকেও ডাকব।

এবার সত্যি আমার ভয় হল। জিমি লোকটা মোটেই ভালো নয়। শুধু শুধু এই সকাল বেলায় গায়ে পড়ে রোজিকে অপমান করা আমার উচিত হয়নি। কিন্তু যা হবার তা হয়েই গিয়েছে। রোজি ছাড়বে না। শাজাহান হোটেল থেকে আমাকে তাড়াবার সামান্য সুযোগ পেলে সে তো ব্যবহার করবেই। গম্ভীরভাবে বললাম, মার্কোপোলোকে তুমি কী বলবে?

আমি বলব, এই ছোকরাকে কিছুতেই রাখা চলতে পারে না।

মনের রাগ চেপে রেখে বললাম, কেন? কী তোমার ক্ষতি করেছি?

রোজি এবার দুষ্টু হেসে, আড়চোখে কনির উলঙ্গ দেহের দিকে তাকিয়ে, ফিসফিস করে বললে, আমার ক্ষতি নয়, তোমার নিজের ক্ষতি। তোমার

বয়সের কোনো ইয়ংম্যানকে ছাদের ঘরে রাখা কিছুতেই উচিত নয়।

আমি এবার ভরসা পেলাম। রোজি এবার হাতের চাবিটা ঘোরাতে ঘোরাতে বললে, ডোন্ট বি ওভারকনফিডেন্ট। ওই রাক্ষসীটা তোমার মাথা খাবার জন্যে হাঁ করে রয়েছে, আমি বলে রাখলাম। রোজি আমাকে উত্তর দেবার কোনোপ্রকার সুযোগ না-দিয়ে, নাচের লীলায়িত ভঙ্গিতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে আরম্ভ করলে।

 

আমি আর একবার অবাক হয়ে আমার চারিদিকের পৃথিবীকে দেখতে লাগলাম। এ কি আমি স্বপ্ন দেখছি? যে-আমি এই মুহূর্তে শাজাহান হোটেলে চাকরি নিয়ে বসে আছি, সেই আমিই কি একদিন কাসুন্দেতে বাস করত? সুধাংশু ভট্টাচার্যের বাড়িতে প্যাটারসনদা, চিনিদা, কানাইদা, পুলিনদা, কেষ্টদা, রবেদার সঙ্গে গল্প করত? এই-আমিই কি একদিন মেট্রো সিনেমাতে ছবি দেখতে এসে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল? একবার মনে হল স্বপ্নের মধ্যে রয়েছি। আমি—দুনিয়াতে শাজাহান হোটেল বলে কিছুই নেই; কাসুন্দের টোলে বসে, বিজয়া দশমীর দিন সিদ্ধি খেয়ে মাথা গোলমাল করে ফেলেছি। আবার পর মুহূর্তে কনির দিকে নজর পড়ে গেল। ওই তো স্কটল্যান্ড-দুহিতা কনি ভারতীয় সূর্যের কিরণে তার দেহটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে স্নান করাচ্ছে। এইটাই সত্য, কাসুন্দেটাই স্বপ্ন। শাজাহান হোটেল থেকে চুরি করে কয়েক পেগ হুইস্কি চড়িয়ে আমি স্বপ্ন দেখছি—কাসুলে বলে একটা জায়গা ছিল, সেখানে একদিন

আমার যাতায়াত ছিল।

আস্তে আস্তে ঘরের ভিতর থেকে ছাদের কেন্দ্রে চলে এলাম। ন্যাটাহারিবাবুর আত্মা যেন আমার উপর ভর করেছে। মনে হল, কনি সূর্য-বিলাস করছে, না, সর্বপাপঘ্ন দিবাকরের জ্যোতিতে নিজেকে শুদ্ধ করে নিচ্ছে।

আমাকে দেখেই কনি ধড়মড় করে উঠে বসল। বললে, গুড মর্নিং।

আমি বললাম, গুড মর্নিং।

কনি এবার বললে, তোমরা এত বোকা কেন? এমন সুন্দর ছাদটাকে তোমরা সানবেদিঙের জন্য ভাড়া দাও না কেন? রিজার্ভড ফর সানবেদি করে তোমরা অনেক টাকা রোজগার করতে পার।

আমার উত্তর দেওয়ার আগেই ছাদের একটা ঘর থেকে গ্রামোফোন বেজে উঠল। কনি সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল, কে এমন বেরসিক? এই ভোরবেলায় কোনোরকম শব্দ আমি সহ্য করতে পারি না।

আমার মনে হল শব্দটা যেন মিস্টার গোমেজের ঘর থেকে ভেসে আসছে। কনি অধৈর্য হয়ে বললে, যে বাজাচ্ছে, সে নিশ্চয়ই তোমাদের কলিগ। তুমি কি তাকে গ্রামোফোন বন্ধ করতে বলবে? সারারাত তো আমাকে গানের মধ্যে ড়ুবে থাকতে হবে। আবার এখনও?

যা ভেবেছি তাই। সোজা মিস্টার গোমেজের ঘরে গিয়ে দেখলাম, বুশশার্ট এবং পায়জামা পরে একটা চেয়ারে মিস্টার গোমেজ চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। সামনে একটা গ্রামোফোন রেকর্ড আপন মনে বেজে চলেছে। আমি কিছুই বলতে পারলাম না। এই ভোরবেলায়, এই সোনা-ছড়ানো সকালে বেলাশেষের গান কেন? এখনই যেন পশ্চিম দিগন্তে ক্লান্ত সূর্য অস্ত যাবেন। আমাদের বিদায় নেবার মুহূর্ত যেন সমাগত। সঙ্গীতের কিছুই বুঝি না আমি। কিন্তু মনে হল, কেউ যেন আমাকে কোকেন ইঞ্জেকশন দিয়ে ধীরে ধীরে অবশ করে দিচ্ছে।

গোমেজ আমাকে দেখে বিষণ্ণ হাসিতে মুখটা ভরিয়ে দিলেন। ফিসফিস করে বললেন, শুনুন, মন দিয়ে শুনুন।

আমারও শোনবার ইচ্ছে করছিল। কিন্তু কনি এতক্ষণে হয়ত চিৎকার করতে শুরু করবে। কানে কানে বললাম, কনি আপনাকে ডাকছে।

গোমেজ এবার বিরক্তভাবে বাইরে বেরিয়ে এলেন। গোমেজকে দেখেই কনি একটা টার্কিশ তোয়ালে নিজের দেহের উপর বিছিয়ে দিলে; আস্তে আস্তে বললে, মিস্টার গোমেজ, এই ভোরবেলায় কোনো শব্দ আমার ভালো লাগে না।

কে যেন গোমেজের দেহে বিদ্যুতের চাবুক মারল। এই হোটেলে তার অবস্থা কি গোমেজের জানতে বাকি নেই। হোটেলের প্রধান ভরসা কনি, যার জন্যে এক রাত্রে আট-নহাজার টাকার বিক্রি বেড়ে যায়, তার ইচ্ছের উপর যে সামান্য একজন বাজনদারের মতামতের কোনো মূল্য নেই তা তিনি জানেন, তবু তার দেহটা মুহূর্তের জনে চমকে উঠল। কনি গোমজের এই পরিবর্তন দেখতে পেরেছে। তোয়ালেটা সরিয়ে আরও খানিকটা রৌদ্র উপভোগ করবার জন্যে প্রস্তুত হতে হতে সে বললে, কী হল?

গোমেজ কোনোরকমে বললেন, মিস কনি, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার অসুবিধে ঘটাবার জন্যে আমার লজ্জার শেষ নেই। তবে আজ আমাদের জীবনের একটা স্মরণীয় দিন সেই জন্যেই।

গোমেজ সোজা এইবার নিজের ঘরে চলে যাচ্ছিলেন। কনি হঠাৎ তার মাদুর থেকে উঠে পড়ল। স্লিপিং গাউনটা পরতে পরতে বললে, মিস্টার গোমেজ! কনি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠেছে।

গোমেজ কিছুই শুনতে পেলেন না। সোজা নিজের ঘরে গিয়ে গ্রামোফোনটা বন্ধ করে দিলেন। কনি ততক্ষণে ছুটতে ছুটতে গোমেজের ঘরে গিয়ে ঢুকল। আমিও পিছন পিছন গিয়ে দেখলাম কনি বলছে, আজকের তারিখে কী হয়েছিল?

গোমেজ এখন কাউকে ভয় পাচ্ছেন না। ম্যানেজমেন্টের আদরিণী, দর্শকদের প্রিয় কনি যেন তার কোনো ক্ষতি করতে পারে না। আস্তে আস্তে তিনি বললেন, তুমি নাচো, তুমি গান গাও। আর তুমি জানো না আজকের তারিখটা কী?

কনি ভয় পেয়ে গিয়েছে। মন্ত্রবলে গোমেজ যেন তাকে সম্মোহিত করবার চেষ্টা করছেন। কোনোরকমে সে বললে, আমার অজ্ঞতা ক্ষমা করো। বলল আজকের তারিখে কী হয়েছিল?

অপমানিত সঙ্গীতজ্ঞ নিজের মনেই বললেন, সুরের রাজা, আমাদের রাজাধিরাজ, আজকের দিনে অজ্ঞাত অখ্যাত অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু আজও তিনি আমার রাজা। আমি রক-অ্যান্ড-রোল বাজাই, আমি ক্যাবারেতে সঙ্গীতের সুর দিই, তবু আজও তিনি আমার রাজা।

আমি আর চুপ করে থাকতে পারিনি। বলে ফেলেছিলাম কে? বীঠোফেন?

মাথা নেড়ে আস্তে আস্তে গোমেজ বলেছিলেন, আমার রাজা অন্য জন। তিনি দরিদ্র। তিনি খ্যাতি পেয়েছিলেন, আবার খ্যাতি হারিয়েও ছিলেন। একজন ধর্মযাজকের বাড়িতে তিনি বাজাতেন। যাজক একদিন লাথি মেরে আমাদের রাজাকে বের করে দিয়েছিলেন। আমাদের দরিদ্র রাজা তারপর শুধু দুঃখই পেয়েছেন। তাই বোধহয় অন্যের দুঃখ তিনি বুঝতেন। কিন্তু পৃথিবীতে কে তার মূল্য দেয়? সুরের রাজা অনাদর, অবজ্ঞা, অবহেলার মধ্যে মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে মর্ত্যলীলা সাঙ্গ করলেন। কিন্তু আহা, সে মৃত্যুর মধ্যেও কী অপরূপ সৌন্দর্য! মৃত্যুপথযাত্রীর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে তার যুবতী স্ত্রী বললেন, কিছু বলবে? হা, তিনি বলতে চাইলেন। কিন্তু সংসারের কথা নয়, গানের কথাও নয়। কোনোরকমে শ্বাস টানতে টানতে বললেন, কথা দাও, আমার মৃত্যুসংবাদ এখন প্রকাশ করবে না। বেচারা আলব্রেৎস শহরের বাইরে গিয়েছে। বন্ধুর আমার ফিরতে কয়েকদিন দেরি হতে পারে। অথচ এখনই জানাজানি হলে, আমার চাকরিটা অন্য লোকে নিয়ে নেবে। তুমি তো জানো, একটা চাকরি ওর কত প্রয়োজন। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এমন কথা একমাত্র মোৎসার্টই বলতে পারতেন। এমন মন বলেই তো এমন সুর জন্ম নিতে পেরেছিল।–গোমেজ এবার নীরব হলেন।

এই মুহূর্তে মোসার্টকে কবরে শুইয়ে দিয়ে যেন গোমজ ফিরে এসেছেন। ছলছল চোখে গোমেজ বললেন, চাকরি না থাকার কী যন্ত্রণা তিনি জানতেন। তাই মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সুরের রাজা বন্ধুকে ভুলতে পারেননি।

আর পারেননি তার মৃত্যুর গানকে। Mozart’s Requiem–K626–মৃত্যুর কয়েক মাস আগে একজনের ফরমায়েশে সামান্য কয়েকটা আগাম টাকার বিনিময়ে তিনি এই সুর সৃষ্টি করতে আরম্ভ করেছিলেন। অসুস্থ দেহে সঙ্গীত সরস্বতীর পুজোর মধ্যেই তিনি কাঁদতেন। বলতেন, এ আমার নিজেরই রিকুয়েম। আমি বেশ বুঝছি, আমার মৃত্যুর গান আমি নিজেই রচনা করে যাচ্ছি। কিন্তু এই বিকল দেহ আমাকে গান শেষ করবার সময় দেবে তো? আমার যে এই সুর শেষ করতেই হবে।

মৃত্যুর কিছু আগে মোৎসার্ট তার প্রিয় শিষ্য এবং বন্ধুদের বিছানার পাশে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কথা বলবার শক্তি তখন তার নেই। ইঙ্গিতে বললেন—শুরু করো—Mozart’s Requiem। তারপর গানের চরমতম মুহূর্তে এসে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। মোৎসার্ট সংজ্ঞাহীন। অচৈতন্য অবস্থায়ও মনে হলো সেই গানই গেয়ে চলেছেন।

তার শেষ কথা কী জানো?–গোমেজ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন। আমি দেখলাম কনিও কেমন হয়ে উঠেছে। সে ফ্যালফ্যাল করে হোটেলের এক সামান্য বাজনদারের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

গ্রামোফোনের উপর মোসার্টের রিকুয়েম চড়াতে চড়াতে গোমেজ বললেন, তার শেষ কথা,-Did not tell you that I was writing this for myself?

মৃত্যুর গান তখন যন্ত্রের বুকের মধ্যে গুমরে গুমরে মরছে। এক অব্যক্ত যন্ত্রণা দেহের বন্দিশালা থেকে মুক্ত হয়ে যেন মহাশূন্যে মিশে যাবার জন্যে ছটফট করছে। জীবনের প্রভাতবেলায় আমরা মৃত্যুসন্ধ্যার সাক্ষাৎ পেলাম। শুভদৃষ্টির লগ্নেই যেন আমার বন্ধুকে বিধবা যোগিনীর সাজে দেখলাম।

গোমেজ যেন তার জড় দেহটাকে শাজাহান হোটেলের ছাদে ফেলে রেখে কোন সুদুরের উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছেন। আর কনি হঠাৎ সচেতন হয়ে নিজের উলঙ্গ দেহটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে স্লিপিং গাউনের ভিতর বন্দি করে ফেললে। কনি কাঁদছে।

আমার বিশ্বাস হয়নি, চোখটা মুছে নিয়ে আবার দেখলাম, সত্যিই আমাদের রাত্রের রমণী কনির গণ্ডেও অশ্রুর রেখা। আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার আগে গোমেজকে সে বললে, আই অ্যাম স্যরি। তারপর ধীরে ধীরে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

কনির সঙ্গে সঙ্গে আমিও ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। গোমেজকে এতদিন ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। একটা রেস্তোরাঁর সাধারণ বাজনদার বলেই ধরে নিয়েছিলাম। অনেকদিন আগে বাজিয়েদের সম্বন্ধে সায়েব একবার বলেছিলেন, হোটেলে কিংবা রেস্তোরাঁয় সঙ্গীত পরিবেশন করে বলেই এরা কিছু জানে না, এমন নয়। কলকাতার হোটেলে এমন সঙ্গীতশিল্পী দেখেছি, সুযোগ এবং সুবিধে পেলে যে হয়তো বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করতে পারত।

বোসদাও বললেন, গোয়ানিজ খ্রিস্টান ছোকরাগুলোকে তোমরা চেনো না। সঙ্গীতে এদের জন্মগত অধিকার। সঙ্গীত ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। এদের জীবনে যেন আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। সারা দিন চেলো, ভায়োলিন, ক্ল্যারিওনেটগুলো কোলের পাশে নিয়ে শুয়ে আছে। সময় হলেই যন্ত্রের মতো জামাকাপড় পরে নিচে নেমে যাচ্ছে। মমতাজ রেস্তোরাঁয় উপস্থিত অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্যে একমনে বাজিয়ে তারা আবার যন্ত্রের মতোই উপরে ফিরে আসে। জামাকাপড় খুলে ফেলে বিছানায় শুয়ে পড়ে। এদের যেন আর কোনো জীবন নেই।

এরই মধ্যে প্রভাতচন্দ্র গোমেজ যেন ব্যতিক্রম। তিনিও যন্ত্রের মতো শাজাহান হোটেলে সঙ্গীত পরিচালনা করে থাকেন বটে, কিন্তু অবসর সময়ে অন্য এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেন। যে পৃথিবীতে সুরের রাজারা সবার অলক্ষ্যে এসে ভিড় করে থাকেন।

গোমেজের ঘর থেকে বেরিয়ে কনি আবার রৌদ্রে এসে বসলো। সে যেন হঠাৎ পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। প্রভাতচন্দ্র গোমেজ তার সব গর্ব এবং দম্ভকে মুহূর্তে নষ্ট করে দিয়েছে।

কনি সূর্যের দিকে পিঠ দিয়ে বললে, এমন বোদ যদি আমরা ইউরোপে প্রতিদিন পেতাম, তা হলে আমাকে আর করে খেতে হত না। আমি ওর কথার অর্থ বুঝতে না পেরে কনির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কনি হেসে বললে, এমন রোদে পুড়তে পেলে আমাদের দেশের প্রত্যেকটা মেয়ে সুন্দরী হয়ে উঠত। এখন যারা অ্যাট্রাকটিভ, তারা প্রকৃতির খেয়াল; তখন সুন্দরী হওয়াটাই নিয়ম হয়ে যেত—আমাদের আর কদর থাকত না।

রাত্রের ক্যাবারে সুন্দরীদের যে একটা সাধারণ জীবন থাকে, তার সঙ্গে সে সহজ হয়ে কথা বলা যায়, তা ওর সঙ্গে কথা না বলতে পারলে আমার কিছুতেই বিশ্বাস হত না। কনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, ভাবছি, এবার থেকে প্রত্যেক বছর একবার ভাবতবর্ষে আসবার চেষ্টা করব। তা হলে গায়ের রংটা ভদ্রস্থ করে নেওয়া যাবে। কনি আরও বললে, দাঁড়িয়ে রয়েছ কেন? একটা সূর্যমুখী চেয়ার আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললে, বসে পড়ো।

আমি বসলাম। কনি বললে, হ্যারিকে দেখেছ?

আমার ধারণা ছিল, রাতের মত্ততার পর ল্যামব্রেটা এখনও ঘুমিয়ে আছে। কনিও তাই ভেবেছিল। আমি বললাম, আমি দেখছি মিস্টার ল্যামব্রেটা এখনও ঘুমুচ্ছেন কিনা।কনি বললে, যদি হ্যারি, ঘুমিয়ে থাকে, তবে ওকে ডিসটার্ব কোরো না।

মনে মনে একটু রাগ হল। একজন ক্যাবারে গার্ল-এর সাকরেদ কিছু এমন ভি-আই-পি নন যে, তাকে ব্রেকফাস্টের সময়েও ডিসটার্ব করা যাবে না। মুখে অবশ্য বললাম, আমরা হোটেলে কাজ করি, লোককে ডিসটার্ব-না–করার আর্ট আমাদের জানা আছে।

ল্যামব্রেটার ঘরের দরজা বন্ধ। জানালা দিয়ে উঁকি মেরেই কিন্তু আমার ভয় হল। বিছানায় কেউ শুয়ে আছে বলে মনে হল না। ভালো করে দেখবার জন্যে জানালাটা সম্পূর্ণ খুলে দিলাম। কোথায় ল্যামব্রেটা? সে তো বিছানায় নেই। ল্যামব্রেটা তবে কি বাথরুমে? কিন্তু সেখান থেকেও তো কোনো শব্দ আসছে না। এবার দরজার গোড়ায় এসে নিজের ভুল বুঝলাম। দরজাটা চাবি বন্ধ।

কনি আমাকে ওখানে অপেক্ষা করতে দেখেই উঠে এল। নিজের দেহটা সম্বন্ধে সে মোটেই সচেতন নয়। দেহটা আছে এই পর্যন্ত। সেটা ঢাকা থাকল, না খোলা রইল, সেটা চিন্তা করবার বিষয়ই নয়। কনি দরজার কাছে এসেই প্রশ্ন করলে, হ্যারি ভিতরে নেই?

দরজা তো বন্ধ। আমি বললাম।

কনি এবার ভয়ে শিউরে উঠল। কোথায় গেল সে?

আমাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উদ্বিগ্ন কনি অধৈর্য হয়ে উঠল। কিছু বলছ না কেন? চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে?

ভালো বিপদে পড়া গেল। কোথায় ল্যামব্রেটা, তা আমি কেমন করে জানব? কনির চোখ ছলছল করছে। কোনোরকমে সে বললে, তুমিই এর জন্যে দায়ী। কেন তুমি রাত্রে আমাকে ডেকে আনলে? একটা নিরীহ ছোট্ট মানুষ যদি তোমার ঘরে গিয়ে একটু গোলমাল করেই থাকে, সেটা সহ্য করা যায় না?

কনির কথা শুনে আমি অবাক। আমাকে আক্রমণ করা তখনও শেষ হয়নি। কনি বলে চলল, এই যে আমি, এত সহ্য করি। আমি ও হ্যারি যে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত মানুষের হাজার রকম অত্যাচার মুখ বুজে হজম করে যাই, আমরা তো কারুর কাছে কমপ্লেন করি না।

কনির সজল চোখের দিকে আমি অপ্রস্তুত অবস্থায় তাকিয়ে রইলাম। কনি আমার কাছে এগিয়ে এসে বললে, জানো, গতকাল ও বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল? ঘরের মধ্যে ঢুকে কতবার ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম, ক্ষমা চাইলাম, তবু হ্যারি আমার সঙ্গে কথা বললে না। অভিমানে সে মুখ ঘুরিয়ে থাকল।

আমি হয়তো কিছু বলতাম। কিন্তু তার আগেই ছাদের টেলিফোনটা বেজে উঠল। দ্রুতবেগে গিয়ে টেলিফোনটা ধরলাম। রোজি কথা বলছে। হ্যালো, রোজি? কী ব্যাপার?

না ইয়ংম্যান, তোমার সঙ্গে রোজির ক্যাপাসিটিতে কথা বলছি না। টেলিফোন অপারেটারের ডিসেন্ট্রি হয়েছে। বোর্ডে বসতে পারছে না, তাই আমি কাজ করছি।

অপরকে সাহায্য করার যে মনোবৃত্তি তুমি দেখাচ্ছ, তা সত্যি প্রশংসাযোগ্য। আমি বললাম। রোজি বললে, তোমাকে ডিসটার্ব করার ইচ্ছে আমার ছিল না। ফোন এসেছে। একজন ভদ্রলোক তোমাদের কনির সঙ্গে কথা বলবার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছেন। তাকে দিলাম।

হ্যালো! ওদিক থেকে একজন বলে উঠল। আমি বললাম, ইয়েস। ভদ্রলোক কনি দি উয়োম্যানের মধুকণ্ঠ শোনবার জন্যে প্রস্তুত হয়েছিলেন। তার জায়গায় পুরুষকণ্ঠ শুনে একেবারে হতাশ হলেন। বললেন, হামি একটু কোনির সঙ্গে বাতচিত করতে চাই।

কে আপনি? আমি প্রশ্ন করলাম।

হামি একজোন পাবলিক আছি। ঘোড়া ডিসকাশন ওঁর সাথে কোরা দোরকার।

আমি বললাম, স্যরি। ওঁর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলা যায় না। উনি কোনো অপরিচিত লোকের সঙ্গে কথা বলেন না।

পাবলিক ভদ্রলোকটি একটু অসন্তুষ্ট হলেন। এ আপনি কী কোথা বোলছেন। কেলকাটায় আমাদের সঙ্গে মীট না করলে, পরিচয় কী কোরে হেবে?

হোটেলে চাকরি করলে রাগ করবার উপায় নেই। শরীরে রাগ থাকলে তার কপালে হোটেলের অন্ন নেই। তাই ভদ্র ভাষায় দুঃখ প্রকাশ করে বললাম, কনির সঙ্গে দেখাও হয় না; ফোনেও কথাবার্তা চলে না।

পাবলিকটি বললেন, প্রাইম মিনিস্টারের সঙ্গে পর্যন্ত ফোনে কোথা চোলে, আর আপনাদের কোনি দি উয়োম্যানের সঙ্গে কোথা চোলে না?

বললাম, আজ্ঞে, তাই। তবে আপনার যদি কিছু জিজ্ঞাস্য থাকে, বলতে পারেন; আমি কনিকে জানিয়ে দেব।

ভদ্রলোক হতাশ হয়ে বললেন, তামাম দুনিয়ার অনেক হোটেল আমি দেখেছি, কিন্তু কেলকাটার মতো ব্যান্ ম্যানারস্ কোথাও দেখিনি। তারপর নিবেদন করলেন, হামার মোশয়, জানবার দোরকার ছিল, হামার

প্রেজেন্টেশন উনি পেয়েছেন কিনা।

কী প্রেজেন্টেশন? আমি প্রশ্ন করলাম। দূর থেকে দেখলাম কনি আমার দেরিতে অধৈর্য হয়ে উঠছে।

পাবলিকটি বললেন, কুছু ফ্লাওয়ার আর কুছু ফুরুট পাঠিয়েছি আজ সোকালে। এখনও উনি পাননি?

যদি পাঠিয়ে থাকেন, তবে নিশ্চয়ই পাবেন। এই বলে ফোনটা নামিয়ে দিলাম। কনি আমার কাছে ছুটে এসে বললে, কোনো খারাপ খবর নাকি?

আমি গম্ভীরভাবে বললাম, না। কথা শেষ করতে না-করতেই দেখলাম একটা বিশাল ফুলের তোড়া এবং এক ঝুড়ি ফল নিয়ে গুড়বেড়িয়া উপরে উঠে এল। গুড়বেড়িয়া সেগুলো মেমসায়েবের চরণতলে নিবেদন করলে। দেখলাম, ফুলের তোড়া থেকে একটা কার্ড ঝুলছে। তাতে সেই পাবলিক ভদ্রলোকটির নাম এবং টেলিফোন নম্বর রয়েছে।

কনি উপহারের দিকে ফিরেও তাকাল না। সে তখন ছোট মেয়ের মতো কাঁদতে আরম্ভ করেছে। ওকে সেই মুহূর্তে দেখে মনে হল, সে যেন আমাদের আমতা বা ডোমজুড়ের কোনো সরল মেয়ে; আমাদের এই বিশাল শহরে তার সাথী হঠাৎ হারিয়ে গিয়েছে।

গুড়বেড়িয়া মেমসায়েবকে কাঁদতে দেখে ঘাবড়ে গেল। জিজ্ঞাসা করলে, কী হয়েছে? মেমসায়েবের কি ফুল পছন্দ হয়নি? আমি বললাম, আমাদের বেঁটে সায়েবের কোনো খবর রাখো?

গুড়বেড়িয়া আমাদের রক্ষে করে দিল। সে বললে, বেঁটে সায়েব? তিনি তো বেড়াতে বেরিয়ে গিয়েছেন। যাবার আগে ল্যামব্রেটা শুড়বেড়িয়ার কাছে খবর নিয়েছেন, কাছাকাছি কোথায় বেড়ানো যায়। গুড়বেড়িয়া বলেছে সেন্ট্রাল অ্যাভিন ধরে কিছুটা হাঁটলেই এসপ্ল্যানেড পড়বে। তারপর চৌরঙ্গী ধরে গেলেই গড়ের মাঠ-হাওয়া খাবার জায়গা। সায়েব তখনই গুড়বেড়িয়াকে একটা আধুলি দিয়ে বেরিয়ে চলে গিয়েছেন।

কনি এবার একটু সাহস ফিরে পেল। তার মেঘভরা মুখে কিছুক্ষণের জন্যে হাসির সূর্যকে দেখতে পাওয়া গেল। বললে, দাঁড়াও, একটু মজা করা যাক। পায়ের গোড়া থেকে সে ফুলের তোড়াটা তুলে নিয়ে, কার্ডটা খুলে ফেলে দিল। আমার কাছ থেকে একটুকরো কাগজ নিয়ে তাতে কয়েকটা কথা লিখলে। ল্যামব্রেটার ঘরে ঢুকে কনি একটা ফুলদানির খোঁজ করতে লাগল। বললে, এ কেমন হোটেল যে, প্রত্যেক ঘরে ফুলদানি নেই?

বললাম, নিচের সব ঘরে আছে। শুধু ছাদে নেই।

কেন? এখানে যারা থাকে, তারা কি মানুষ নয়? কনি একটু বিরক্ত হয়েই মন্তব্য করল। তারপর একটা কাচের গেলাসের মধ্যেই যত্ন করে ফুলগুলোকে সাজিয়ে রাখল।

সাজানো শেষ করে দরজা বন্ধ করতে করতে কনি বললে, জানো হ্যারি অবাক হয়ে যাবে। ভাববে, এই অচেনা শহরে কনি কোথা থেকে তার জন্যে ফুল জোগাড় করে আনল! হ্যারিকে খুশি করবার একটা সুযোগ পেয়ে কনি নিজেও বেশ খুশি হয়ে উঠেছে।

কিন্তু সে আনন্দ কেবল কয়েক মুহূর্তের জন্যে। আমার হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কনি আবার চিন্তিত হয়ে পড়ল। আমি বললাম, এত ভাববার কী আছে? এখনই ভদ্রলোক এসে পড়বেন।

কনি তেমন ভরসা পেল না। সে বললে, আমার ভয় লাগে। বামন মানুষ, কোথাও রাস্তা পেরোতে গিয়ে হয়তো বিপদ বাধিয়ে বসল।

আমি আবার ভরসা দিলাম। বললাম, দেখুন না, এখনই এসে পড়বেন। আর মনে মনে বললাম, এত আদিখ্যেতা কেন? বদমেজাজী লোকটা যতক্ষণ বাইরে থাকে, ততক্ষণই ভালো। এসেই তো আবার গোলমাল করবে।

আমার ভবিষ্যদ্বাণী যে এমনভাবে মিলে যাবে আশা করিনি। আমার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছাদের দরজা খুলে যিনি ঢুকলেন, তিনি ল্যামব্রেটা। ল্যামব্রেটার মেজাজ এখন বেশ ভালো রয়েছে। সে গুনগুন করে গান গাইছে। গানটা কি, আমি বুঝতে পারিনি। কনি নিজেও বুঝতে না পেরে ল্যামব্রেটার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী গান গাইছ, হ্যারি?

হ্যারির ইংরিজি উচ্চারণ সাবধানে অনুসরণ করে বুঝতে পারলাম সে কি গান গাইছে। খাঁটি ভারতীয় প্রথায় হাততালি দিয়ে ল্যামব্রেটা গাইছে–জয়জয় রঘুপতি রাঘব রাজারাম।

ল্যামব্রেটা কি সত্যিই পাগল হয়ে গেল? সে বললে, কনি, ওয়ান্ডারফুল গান। তারপর নেচে নেচে ভুল উচ্চারণে গাইতে লাগল—পাটিটো প্যাভনো সীটারাম।

ল্যামব্রেটাকে কনি প্রশ্ন করলে, কী করছিলে এতক্ষণ? আমি ভেবে ভেবে মরি।

ল্যামব্রেটা বললে, ওইটাই তো তোমার স্বভাব। তারপর ব্যঙ্গমিশ্রিত কণ্ঠে বললে, আমার জন্যে ভেবে তোমার তো ঘুম হয় না! আমার জন্যে ভেবে ভেবে তোমার নেকেড় ড্যান্সের রিদম নষ্ট হয়ে যায়!

কনি ল্যামব্রেটার কাছ থেকে এই উত্তর শোনবার জন্যে প্রস্তুত ছিল না। তার চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। সে বললে, হ্যারি! পৃথিবীতে এত লোক থাকতে তুমি আমাকে এই কথা বললে!

প্রভাতের প্রসন্নতা সত্যিই হ্যারির উপর তার প্রভাব বিস্তার করেছে। সে সঙ্গে সঙ্গেই নিজের ভুল বুঝতে পারল। কনির হাতটা ধরে বললে, তোমার সঙ্গে রসিকতা করছিলাম। তুমি এখনও ছোট্ট গার্লের মতো; আমার রসিকতা বোবক না?

কনিও আমার সামনে অপ্রস্তুত হয়ে চোখের জল মুছে নিল। ল্যামব্রেটা বললে, মাঠ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে নদীর ধারে চলে গিয়েছি বুঝতে পারিনি। সেখানে দেখলাম, একদল লোক ফুটপাতের উপর বসে বসে গান গাইছে। ভেরি সুইট গান। ভেরি নাইস পিপল। রিয়েল জেন্টলমেন। তারা আমাকে দেখেই গান বন্ধ করে দিয়েছিল। আমাকে তারা নমস্কার করলে। আমি বললাম, তোমরা কী গান গাইছ? তোমাদের সুইটহার্টদের জন্য গান? ওরা মার্কেন্টাইল ফার্মের বেয়ারা, দারোয়ান, আমার কথা বুঝতে পারলে না। বললে, ভোরবেলায় এখন কেবল গড়। কেবল সীতারাম। সীতারাম।

একজন দেখলাম একটু চালাক। ইংরিজিতে বললে, ঠিক বলছেন হুজুর–সীতারামঞ্জীর হার্টও ভেরি সুইট।

ওয়ান্ডারফুল গান শুনে ল্যামব্রেটা নিজেকে আর সংযত রাখতে পারেনি। গঙ্গার ধারে, ক্যালকাটা সুইমিং ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে সেও গান ধরলেরঘুপতি রাঘব রাজারাম।

কলকাতার ফুটপাতের নাগরিকরা সায়েবকে নিয়ে কী করবে বুঝতে পারছিল না। সায়েবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাদের কষ্ট হচ্ছে। অথচ সায়েবকে কোথায় বসতে দেবে? সায়েবের তখন গানের নেশা ধরে গিয়েছে। সে নিজেই এসে ওদের শতরঞ্জির মধ্যিখানে বসে পড়ল। সায়েব জীবনে অনেক গান নকল করেছে। এই গানও সে ধরে ফেলেছে। হাতে তাল দিতে দিতে, গানের অর্থ না বুঝে সে তখন প্রচণ্ড উল্লাসে গেয়ে চলেছে-রঘুপতি রাঘব।

সায়েবকে তার গানের সঙ্গীরা যত্ন করেছে। বলেছে, হুজুর আমরা কয়েকটা ফুল দেব আপনাকে? সায়েব বলেছে, নিশ্চয়ই। ফ্লাওয়ার দাও। ওরা সায়েবকে গোটা কয়েক গাঁদাফুল দিয়েছে। বলেছে, একলা একলা ফিরতে পারবেন তো? সায়েব বলেছে, হ্যাঁ।

ওরা কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারেনি। বলেছে, কলকাতা হুজুর, ভেরি ব্যাড প্লেস। তারপর ওদেরই একজন সায়েবের সঙ্গে শাজাহান হোটেলের গেট পর্যন্ত এসেছে।

পকেট থেকে কয়েকটা গাঁদাফুল বের করে ল্যামব্রেটা আমাদের দেখাল। বললে, ওয়ান্ডারফুল।

গুনগুন করে নতুন শেখা গান গাইতে গাইতে ল্যামব্রেটা নিজের ঘরে ঢুকল। পরম যত্নে দেওয়া গাঁদাফুলগুলো টেবিলের উপর রাখল। কনির রূপমুগ্ধ কলকাতার এক পাবলিকের পাঠানো মূল্যবান ফুলের তোড়া সত্যিই ওই সামান্য কয়েকটা গাঁদাফুলের কাছে নিষ্প্রভ হয়ে রইল।

আমি নিজের ঘরে চলে গিয়ে ডিউটিতে যাবার জন্যে প্রস্তুত হতে লাগলাম। কিন্তু আবার বাধা পড়ল। বাথরুমে যাবার জন্যে দরজাটা খুলতে যাচ্ছি এমন সময় গুড়বেড়িয়া এসে বললে, মেমসায়েব আপনাকে ডাকছেন।

আবার গেলাম। আমাকে দেখেই ল্যামব্রেটা বললে, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। কনিকে সমস্ত দুপুর ধরে আমি শেখাব, তারপর আজ রাত্রে আমরা দুজনে গাইব-রঘুপতি রাঘব রাজারাম। প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ। কনি বললে, তোমার কী মনে হয়? গুড় আইডিয়া?

আমার মুখটা শুকিয়ে গেল। আমি বললাম, আপনারা আর্টিস্ট, আপনারা যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন।

কনি বললে, তা তো জানি। কিন্তু শাজাহান হোটেলের অতিথিরা কি খুশি হবেন?

ল্যামব্রেটা বললে, ওয়ান্ডারফুল। প্রত্যেকটা মানুষ খুশি হতে বাধ্য।

বললাম, গডের নাম শোনবার জন্যে কেউ হোটেলে আসে না।

কনি বললে, তাদের রুচি তো আপনারা তৈরি করবেন। আমি উত্তর দিলাম, মিস্টার স্যাটা বোস বলেন, রুচি অনেকদিন আগে তৈরি হয়ে গিয়েছে। এক যুগের কলকাতাওয়ালারা তাদের রুচির ছাঁটটা আরেক যুগের হাতে দিয়ে বিদায় নেন। তারা আবার অন্য যুগের হাতে সেই ছাঁটটা দিয়েই চলে যান। তাই শাজাহান হোটেলের কোনো পরিবর্তন হয় না। এখানে সেই

আদি অকৃত্রিম মনোরঞ্জনের ব্যবস্থাই চালু রয়েছে।

ল্যামব্রেটা অসন্তুষ্ট হয়ে বললে, তা হলে এই গানটা চলবে না?

চলার কোনো সম্ভাবনা নেই, আমি উত্তর দিলাম।

কনি বললে, তোমার মতের উপর কথা চলে না।

আমি বললাম, ওই গানের মধ্যে এমন একটা লাইন আছে, যাতে আমাদের অতিথিরা অফেন্ডেন্ড হতে পারেন।

কোন লাইনটা? ল্যামব্রেটা চিৎকার করে উঠল।

সব কো সুমতি দে ভগবান। আমি বললাম। আমাদের অতিথিরা কী ভাববেন? তাদের কি সুমতি নেই?

ল্যামব্রেটা রেগে গিয়ে বললে, তোমরা আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাও। এখনই ঘর থেকে চলে যাও। আমি এখন বিশ্রাম নেব।

কনিও ভয় পেয়ে গেল। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এল। আমিও আর-এক মুহূর্তে দেরি করলাম না। আমাদের পিছনে ল্যামব্রেটা দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলে। কনি বললে, সকালের দিকে ওর মেজাজ সাধারণত ভালো থাকে। আজ ভোরবেলাতেই চটে উঠল।

আমি নীরবে হাসলাম। কনি বললে, স্যরি, তোমাকে অনেকক্ষণ আটকে রাখলাম। এখন চলি। আবার দেখা হবে রাত্রে। মমতাজ রেস্তোরাঁয়।

 

মমতাজ-এ তিলধারণের জায়গা নেই। সমস্ত টেবিল থেকে আগেই বুকড় হয়ে গিয়েছে। হাই সার্কেলের চাপে পড়ে বোসদা দুএকটা এক্সট্রা টেবিলও কোনোরকমে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এমন সব স্তর থেকে মাঝে মাঝে অনুরোধ আসে যে, না বলা যায় না।

জিমি আবার কয়েকজন লোককে সামনের দিকে বসবার ব্যবস্থা করে গেল। বোসদা বললেন, সামনের কয়েকটা রোতে বসবার জন্যে লোকে ঘুস দিতেও রাজি। জিমিটা পারে না এমন কাজ নেই।

মদের সেল আরও বেশি। আবগারি ইন্সপেক্টর উঁকি মেরে দেখে খুশি হয়ে চলে গেলেন। গবর্নমেন্টের ইনকাম বেড়ে যাবে। আবগারী শুল্ক, ফুর্তি শুল্ক খাতে অনেক টাকা ট্রেজারিতে জমা পড়বে।

জামা-কাপড় পরে হ-এর মধ্যে ঢুকে দেখলাম, আজ কয়েকজন মহিলা এসেছে। কলকাতা কালচারের অঙ্গ এই ফ্লোর-শো। শিক্ষিতা এবং আধুনিকা ভারত-ললনারা তাই এই তীর্থভূমিতে না-এসে পারেন না।

বোসদা হল-এর মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাকে দেখে মৃদু হেসে বললেন, আমরা যে রেটে সভ্য হয়ে উঠছি, তাতে অদূর ভবিষ্যতে মডার্ন ভারতীয়রা স্ত্রীর সঙ্গে ছেলেমেয়েদের হাত ধরে বেলিডান্সারদের দেখতে আসবেন। পশ্চিম যে দরজা খুলে দিয়েছেন! সাধে কি আর কবিগুরু লিখে গিয়েছিলেন—দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে এই শাজাহানের মহামানবের সাগরতীরে।

যে-মহিলারা পুরুষের এই হংসরাজ্যে বকের মতো বসে আছেন, তাদের সাজ-সজ্জার বর্ণনা বোসদার এক অধ্যাপক বন্ধু কিছুদিন আগে দিয়ে গিয়েছেন। তার নামও কী এক বোস। শাজাহান হোটেলের ভিতরটা দেখবার কৌতূহলে তিনি একবার এসেছিলেন। কলকাতার মধ্যবয়সী আধুনিকাদের দু-একজনকে দেখে ভদ্রলোক বলেছিলেন, এঁদের সাজ-সজ্জায় সম্পূর্ণ নতুন রীতি। এমন আছে-আভাস ব্লাউজ ও মিছে-আবরণ শাড়ি আমাদের পূর্ব পুরুষদের কল্পনারও অতীত ছিল।

বোসদা হেসে বন্ধুকে বলেছিলেন, দেখতে এসেছ দেখে যাও। কিন্তু মহাজনদের পথ অনুসরণ কোরো না। তোমাদের সাহিত্যিক নগেন পাল অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্যে প্রথম এসেছিলেন। কিন্তু ফাদে পড়ে গিয়েছেন তাই এখনও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করছেন। রোজ একবার বার-এ না এলে তার চলে না।

নগেন পালকে আজও দেখলাম। ক্যাবারে সুন্দরীর আবির্ভাব প্রতীক্ষায় ঘরের এক কোণে একটা হুইস্কির পেগ নিয়ে বসে আছেন। নগেন পাল সামনে ছোট্ট একটা নোটবই রেখেছেন। মদের ধাক্কায় কোনো আইডিয়া এলেই ওখানে নাকি লিখে রাখেন।

আরে মশাই! এদিকে শুনুন। দেখি ফোকলা চ্যাটার্জি আমাকে ডাকছেন। আজকেও তিনি এসে গিয়েছেন। ফোকলা চ্যাটার্জির সামনে এক লাজুক ছোকরা চুপচাপ বসে রয়েছে। চুলগুলো ঢেউখেলানো। মুখের মধ্যে নবযৌবনের নিস্পাপ সরলতা এখনও ছড়িয়ে রয়েছে। ইভনিং স্যুট পরেছে ছেলেটি।

দেখুন, এর কোনো মানে হয়? অরেঞ্জ স্কোয়াশ খেয়ে কখনও ক্যাবারে দেখা যায়? আপনি বলুন তো? ফোকলা আমাকে প্রশ্ন করলেন। ছোকরা দেখলাম এক গ্লাস অরেঞ্জ স্কোয়াশ নিয়ে বসে আছে।

ফোকলা বললেন, তুই নির্ভয়ে একটু ড্রিঙ্ক কর। কেউ জানতে পারবে। আমি মামা হয়ে তোকে অ্যাডভাইস দিচ্ছি। কেউ জানতে পারবে না। বাড়িতে তো বলে এসেছি, তুই আমার সঙ্গে বেরোচ্ছিস। অত যদি ভয়, আজ রাত্রে আমার কাছে থেকে যাবি।

ফোকলা আমাকে বললেন, আপনাদের হোটেলের সবচেয়ে দামি ককটেল কী আছে? তাই দিয়েই ভাগ্নের হাতেখড়ি দিই।

আমি বললাম, সিলভার গ্রেড। এক পেগ সাড়ে বারো টাকা।

ওতে কী আছে? ফোকলা জিজ্ঞাসা করলেন।

বললাম, ভদকা, ফ্রেশ লাইম, সিরাপ আর ডিম। হাতেখড়ির পক্ষে সুবিধে হবে কি? তার থেকে ম্যানহাতান ককটেল দিই না? হুইস্কি, ভারমুথ আর শেরি shaked with ice।

ফোকলা রেগে উঠলেন। বললেন, মশায়, এটি আমার ভাগ্নে। ভাগ্নী নয়। ভারমুথ দিয়ে ব্যাটাছেলের অন্নপ্রাশন হয়, আমি কখনও শুনিনি। আর দাম তো দেখছি সাড়ে চার টাকা। তাতে কী মাল থাকবে?

সিলভার গ্রেড-এর অর্ডার দিয়ে দরজার কাছে এসে দেখলাম বোসদা হাসছেন। বললেন, যার হাতেখড়ি হচ্ছে, সে কে জানো? মিসেস পাকড়াশীর সন্তান। পাকড়াশী সাম্রাজ্যের প্রিন্স অফ ওয়েলস।

এবার শো আরম্ভ হবার কথা। আমাকে স্টেজের উপরে উঠে বলতে হবে, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলম্যান, আই প্রেজেন্ট টু ইউ কনি দি উয়োম্যান।

কিন্তু ল্যামব্রেটা এখনও হাজির হয়নি। কনিও নেই। হল থেকে বেরিয়ে তাড়াতাড়ি লিফটে চড়ে উপরে এসে দেখলাম, দরজার সামনে ন্যাটাহারিবাবু দাঁত বার করে হাসলেন।

কনি আর ল্যামব্রেটাকে দেখেছেন? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

ন্যাটাহারিবাবু বললেন, আমাকে এখন জ্বালাতন করবেন না। আপনার বামনাবতার কালকে আমার দুটো বালিশ ছিড়ে ফেলেছে। ঘরের মধ্যে তুলোতে বোঝাই।

কনির ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় টোকা দিলাম। কিন্তু কোথায় কনি? কনি ভিতরে নেই। দরজা খোলা পড়ে রয়েছে।

প্রথমে বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। শো আরম্ভ হবার এই প্রয়োজনীয় মুহূর্তে ভদ্রমহিলা কোথায় গেলেন? পাঁচ টাকার টিকিট কেটে, আর পঞ্চাশ টাকার মদ্যপান করে যাঁরা মমতাজ-এর সুকোমল চেয়ারে বুদ হয়ে বসে আছেন, তারা যদি এখন শোনেন ফ্লোর-শো বন্ধ, তা হলে এই রাত্রে শাজাহান হোটেলের কর্মচারীদের কপালে কী আছে তা কল্পনা করে আমি শিউরে উঠলাম। টিকিটের দাম হয়তো ফিরিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু মদ? সে তো আর পাকস্থলী থেকে উদ্ধার করে বোতলে আবার ঢেলে দেওয়া যাবে না। ফলে এখনই কাচের গেলাস ভাঙবে, টেবিল চেয়ার উল্টোবে, এবং ফোনে পুলিসের শরণ নেওয়া ছাড়া আমাদের অন্য কোনো গতি থাকবে না। এমন অবস্থা অনেকদিন আগে একবার হয়েছিল শুনেছি। পুলিস এসে মাতালদের হাত থেকে হোটেল কর্মচারীদের কোনোরকমে রক্ষে করেছিলেন কিন্তু মুশকিল হয়েছিল তার পরই। ইংলন্ডেশ্বরের সেবক পুলিসবৃন্দ শাজাহান হোটেলে সেবিত হবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। মাতালদের তাড়িয়ে তারাই আবার সেদিন মাতাল হয়ে গিয়েছিলেন। সেদিন তারা মমতাজের টেবিল চেয়ার দখল করে বসেছিলেন। মেনু কার্ড দেখে দামি দামি ডিনারের অর্ডার দিয়েছিলেন। ওয়াইন কার্ডের দিকে নজর দিয়ে বারম্যানদের হাঁক দিয়ে বলেছিলেন, হ্যায় খিদমার হুইস্কি শরাব, ব্লতি পানি লে আও। মাটির তলায় অন্ধকার সেলারে শাজাহানের সযত্ন সঞ্চিত ব্ল্যাক লেবেল, ব্ল্যাক ডগ, ডিম্পল স্কট, ভ্যাট এবং জনি ওয়াকারের বোতলগুলো সেদিন যেন আসন্ন সর্বনাশের আশঙ্কায় আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে উঠেছিল। ঐশ্বর্যময় শাজাহানের মণিমুক্তো লুট করে চেঙ্গিজ খাঁয়ের দল সেদিন যখন বিদায় নিয়েছিলেন, তখন ম্যানেজারের কেঁদে ফেলবার মতো অবস্থা। অথচ কিছুই বলবার উপায় ছিল না। কারণ ওঁরা ম্যানেজারের একান্ত অনুরোধে কোনো কাস্টমারকে গ্রেপ্তার করেননি। গ্রেপ্তার করলেই কোর্ট-ঘর এবং কোর্ট-ঘর মানেই ব্যাড পাবলিসিটি।

কনির শূন্য ঘরে এসে প্রথমেই সেই ভয় হল। কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। ছাদে উঠে এলাম। আমার ঘরে ঢুকতে যাচ্ছি, এমন সময় পাশের ঘর থেকে পরিচিত কণ্ঠস্বর কানে ভেসে এল। ল্যামব্রেটা বলছে, যাও। তোমার যদি এতই দরদ, একলা যাও।

কনি কাতর স্বরে বললে, প্লিজ, তুমি অবুঝ হয়ো না। চলো।

ল্যামব্রেটা এবার ফোঁস করে উঠল। আমার গায়ে হাত দিও না বলছি। ভাবছ এতেই আমি গলে যাব।

ফিসফিস করে কনিকে বলতে শুনলাম, এই আস্তে, লোক শুনতে পাবে।

ল্যামব্রেটা এবার তড়াং করে লাফিয়ে উঠল। সে বললে, কিছুতেই নয়। আমি যাব না।

ঘর থেকে বেরিয়ে আমি এবার ল্যামব্রেটার ঘরে সামনে এসে দাঁড়ালাম। দরজায় নক করলাম। কনি এবার বেরিয়ে এল। রাত্রের সোয়ের জামাকাপড় পরে সে প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। তার দেহ থেকে মূল্যবান ফরাসি সেন্টের গন্ধ ভুরভুর করে ছড়িয়ে পড়ছে। আমাকে দেখেই কনি সব বুঝতে পারলে। আর একবার ভিতরে ঢুকে গিয়ে বললে, গেস্টরা রেগে উঠছেন, তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে নাও।

ল্যামব্রেটা মুখে হাত দিয়ে বিছানায় চুপচাপ বসেছিল। গম্ভীর মুখে, বিরক্ত কণ্ঠে বলল, ইউ উয়োম্যান আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও। আমাকে ডিস্টার্ব কোরো না।

একটা কুৎসিতদর্শন বামনের বিরক্ত ব্যক্তিত্বের সামনে দাঁড়িয়ে কনি ভয় পেয়ে গেল। কনি বুঝতে পারছে না, সে কী করবে। আমি এবার ঢুকে পড়ে বললাম, আর দেরি হলে আমাদের হোটেলে আগুন ধরে যেতে পারে।

কনি বললে, দোহাই তোমার, চলো। ল্যামব্রেটা বললে, ঠিক হ্যায়, এই শেষবারের মতো চললাম। দেখি কাল থেকে কে আমাকে ঘর থেকে বের করতে পারে।

আমি ও কনি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। ল্যামব্রেটা নিজের জামাকাপড় পরতে লাগল। কনির মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। বললে, ওর যে কী সব অন্যায় হুকুম। বলুন তো-ক্যাবারে ইজ ক্যাবারে। অভিনয়ের সঙ্গে জীবনের কী সম্পর্ক আছে? হ্যারিকে কিছুতেই বোঝাতে পারি না। একেবারে ছেলেমানুষ। বলে কিনা শোতে কোনো লোকের কোলে তুমি বসতে পারবে না।

কনিকে এতক্ষণ কিছুই বলিনি। এবার বললাম, এমন লোক নিয়ে দল তৈরি করলে আপনার জনপ্রিয়তা কমে যাবে। অভিনয়ে আপনি কী করলেন আর না করলেন তার কৈফিয়ত আপনি অন্য কাউকে দেবেন কেন?

কনি বললে, ঠিক বলেছেন। আমার নিজের দলের আর্টিস্ট রোজ আমাকে জ্বালাতন করবে, এ অসহ্য। তারপরেই যেন ল্যামব্রেটার জুতোর শব্দে ভয় পেয়ে গিয়ে বললে, ও যেন শুনতে না পায়।

 

লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন! আজ অভিজ্ঞ অভিনেতার মতোই রঙ্গমঞ্চের সামনে মাইক ধরে দাঁড়ালাম। গুড ইভনিং। শাজাহান হোটেলের এই মধুর সন্ধ্যায় আপনারা আশা করি আমাদের ফরাসি সেফের রান্না এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে চয়ন করা মদ উপভোগ করেছেন। নাউ, আই প্রেজেন্ট টু ইউ কনি। কনি, দি উয়োম্যান। আপনাদের বৈচিত্র্যময় জীবনে আপনারা অনেক উয়োম্যান দেখেছেন, কিন্তু হিয়ার ইজ দি উয়োম্যান।—যা এই শতাব্দীতে ভগবান একটিই সৃষ্টি করেছেন!

গত রাত্রের মতো আবার আলো নিভল। গত রাত্রের সেই মানুষগুলোই আজও যেন এখানে বসে রয়েছে; কিংবা যারা এখানে আসে তাদের সবারই স্বভাব এক। কেননা আজও সেই রকম গুঞ্জন উঠল। তারপরই সেই ছন্দপতন। প্রত্যাশী মানুষদের আশাভঙ্গ। কনি দি উয়োম্যান নেই। তার বদলে মানবতার ল্যামব্রেটা।

কিন্তু ল্যামব্রেটা? এই মুহূর্তে তাকে দেখে কে বলবে সে কয়েক মিনিট আগেও বিছানায় পড়েছিল; কিছুতেই আসতে চাইছিল না। সেই ক্লান্ত, বদমেজাজী, বিমর্ষ লোকটা যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে। অন্য একটা বামন যেন তিন ফুট উঁচু টুপি হাতে বলছে, শুড় ইভনিং লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন। আমিই…মেয়েমানুষ কনি। আমার জন্য এই রাত্রি পর্যন্ত আপনারা যে বসে রয়েছেন এর জন্য আমি গর্ব বোধ করছি।

তারপর গতকালও যা হয়েছিল, ঠিক তাই হল। আলো নিভে গিয়ে হঠাৎ কনি কোথা থেকে হাজির হল। সামনের সারির একজন ভদ্রলোক চিৎকার করে উঠলেন, আমার কোলে কে যেন বসেছে। অন্ধকারের মধ্যে বললাম, ভয় পাবেন না।

আজ বোধহয় কনি লোক চিনতে ভুল করেছিল, একেবারে বুঝনদার লোকের কোলে গিয়ে বসে পড়েছিল। লোকটি চিল্কার করে বললে, পেয়েছি! আলো জ্বালাবেন না।

এই রকম অবস্থার জন্যে সব সময়ই প্রস্তুত থাকবার নির্দেশ বোসদা আমাকে বারবার দিয়েছিলেন। এক মুহূর্ত দেরি না করে, আলোটা জ্বালিয়ে দেবার ইঙ্গিত করলাম। মমতাজের সব আলোগুলো সঙ্গে সঙ্গে সবার চোখ ধাঁধিয়ে জ্বলে উঠল। বিপদের সঙ্কেত পেয়ে যেন আলোর দমকল নক্ষত্ৰবেগে কোথা থেকে ছুটে এল। কনি এবার জোর করে ভদ্রলোকের কোল থেকে উঠে এল।.কনি হাঁপাচ্ছে। কিন্তু সেদিকে নজর দেবার মতো সময় কারুর ছিল না।

কনির নাচ শুরু হয়ে গেল। নাচের প্রাগৈতিহাসিক ছন্দ যেন দামামা বাজিয়ে রাতের অতিথিদের অন্তরের পশুটাকে জাগিয়ে তুলছে। বাধাবন্ধহীন সেই অরণ্যশক্তি কোট-প্যান্ট-টাই-এর খাঁচা ভেঙে এই মুহূর্তেই বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ল্যামব্রেটাও সেখানে এসে হাজির হয়েছে। সুন্দরী কনির প্রতি তার অনুরাগের বিচিত্র ভঙ্গি দর্শকদের দেহে আরও সুড়সুড়ি দিচ্ছে। সে বেচারা যে কনির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে, এবং কনির মন জয় করবার জন্যে পরিশ্রম করতে করতে ঘেমে নেয়ে উঠেছে, তা আর কারুরই বুঝতে বাকি নেই।

উপস্থিত মহিলারাও সে দৃশ্য দেখেও লর্ড, বলে অস্বস্তিতে সঙ্গীদের দেহে ঢলে পড়েছেন, কিন্তু তাদের মুখের প্রশ্রয়পূর্ণ চাপা হাসিতেই বোঝ যায়, তারা আধুনিকা। রুচির কোনো অনুদার আইন দিয়ে পুরুষদের তারা বেঁধে রাখতে চান না।

ল্যামব্রেটা চেষ্টা করছে, কনির দৃষ্টি আকর্ষণ করবার। কিন্তু কনির সেদিকে মোটেই খেয়াল নেই। পুরুষসর্বস্ব এই সান্ধ্য মেলায় সে যেন যৌবন ও সৌন্দর্যের দম্ভে উড়ে বেড়াচ্ছে।

স্টেজ থেকে নেমে এসে দর্শকদের সারিতে দাঁড়িয়েছিলাম। একজন মহিলাকে ল্যামব্রেটা সম্বন্ধে বলতে শুনলাম-পুওর ফেলল। আহা বেচারি। ভদ্রমহিলার সঙ্গী বললেন, অযথা দুঃখ কোরো না। এরা অভিনয় করছে। মহিলা তার সঙ্গীর হাতটা চেপে ধরে, দেহটাকে তার দেহের খুব কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, বাজে বোকো না, ডার্লিং। সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে। ওর চোখে যে আগুন দেখছি, তা কিছুতেই অভিনয় নয়। আমরা মেয়েমানুষ, সব বুঝতে পারি!

মহিলা বোধহয় এবার আমাকে দেখতে পেলেন। সঙ্গীকে তিনি কী যেন ফিসফিস করে বললেন। সঙ্গী আমাকে ডেকে বললেন, এক্সকিউজ মি, কনি আর ওই বামনটার সম্পর্ক কী?

বললাম, জানি না।

ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন, ওরা কি এক ঘরে রাত্রি কাটায়?

বললাম, না, আমরা ওঁদের দুটো ঘর দিয়েছি।

মহিলা এবার আলোচনায় অংশ গ্রহণ করলেন। বললেন, তাতে কিছুই বোঝা যায় না, ডার্লিং। এঁরা তো হোটেলের লোক, এ-সব ব্যাপারে এক্সপার্ট। জিজ্ঞাসা করো।

মধ্যবয়সী এই মহিলার রুচিহীন জিজ্ঞাসার উত্তর দেবার ইচ্ছে আমার ছিল। হোটেলে চাকরি করে আমরা যেন চোরদায়ে ধরা পড়েছি। আমাদের যেন ঘরসংসার নেই, ন্যায়-অন্যায় বোধ নেই। লজ্জাশরম নেই। ভদ্রমহিলা বোধহয় আমার মনের অবস্থা বুঝলেন। মুখ বিকৃত করে বললেন, মাগো! এই মেয়েগুলোর চোখে কোনো পর্দা নেই।

পর্দা কোথায় আছে তা সরে আসতে আসতেই দেখলাম। আমাদের সন্ধানী চোখগুলোকে অমান্য করে টেবিলের তলায় শাড়ির পা একটা ট্রাউজারের পা-কে বেপরোয়াভাবে জড়িয়ে ধরেছে। সভ্যতার গহন অরণ্যে একটা মাকড়সার জালের সঙ্গে আর একটা মাকড়সার জাল জট পাকিয়ে গিয়েছে।

কনি নাচছে। সঙ্গে ল্যামব্রেটাও নাচছে। কনির দেহের গতি ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে ল্যামব্রেটার বেগও দ্রুততর হচ্ছে। তাতে তাল দিয়ে সে যেন এই রূপসী যুবতীর মন হরণের চেষ্টা করছে। কিন্তু ল্যামব্রেটা হাঁপিয়ে উঠছে। লম্বা ঠ্যাঙ দিয়ে যে দূরত্ব কনি একবার অতিক্রম করছে, ল্যামব্রেটাকে সেখানে তিনবার পা ফেলতে হচ্ছে।

কনি বোধহয় বুঝতে পারছে, তার সঙ্গীর দম ফুরিয়ে আসছে। কনির রুমালটা হঠাৎ মেঝেতে পড়ে গেল। করুণায় গদগদ বামন সেটি তুলে সুন্দরীর করকমলে প্রত্যর্পণ করে বোধহয় একটু আশার আলো দেখতে পেলো। সেই মুহূর্তেই কনি তার সঙ্গীকে কী যেন বললে। এবার কনি হঠাৎ অগ্নিমূর্তি ধারণ করলে। দুরের দর্শকরা ভাবলেন, কনির ভদ্রতার সুযোগ নিয়ে বামনাবতার বোধহয় কোনো কুপ্রস্তাব করেছিল। কনি হঠাৎ নাচের ভঙ্গিতেই ল্যামব্রেটাকে তাড়া করলে। বলতে লাগল-পাজি শয়তান, দুর হটো। তোমার এইটুকু দেহে এত কুবদ্ধি?

ভয় পেয়েই যেন ল্যামব্রেটা আরও কুঁজো হয়ে স্টেজের বাইরে এসে দাঁড়াল। আর তাকে বিদায় করে নিশ্চিন্ত হয়ে লাস্যময়ী কনি তার যৌবন নৃত্য শুরু করলে। আমার দৃষ্টি তখন কনির নাচের দিকে নেই। আমি তখন একমনে ল্যামব্রেটার দিকে তাকিয়ে আছি। ল্যামব্রেটা গতকাল অনেকক্ষণ ধরে নেচেছিল। আজ অনেক আগেই ফিরে এসেছে। অন্য কেউ বুঝল না। কিন্তু আমি বুঝলাম ল্যামব্রেটার দম ফুরিয়ে আসছিল। সে আর পারছিল না। ওর সেই অবস্থা দেখেই কনি হঠাৎ নিজের রুমালটা মেঝেতে ফেরে দিলে। ল্যামব্রেটার ভাড়ামির সুযোগ নিয়ে বললে, তুমি এবার বিশ্রাম নাও।

বেচারা হাপরের মতো হাঁপাচ্ছে। ঘামে দেহের জামাকাপড়গুলো ভিজে উঠেছে। কনির কিন্তু ক্লান্তি নেই। সে আবার দম দেওয়া লাটুর মতন নাচতে শুরু করেছে। মমতাজ-এর সব আলোগুলো কখন নিভে গিয়েছে। শুধু একটা রঙীন আলোর রেখা কনির অর্ধউলঙ্গ দেহের উপর পড়ে তাকে আরও রহস্যময়ী করে তুলেছে।

ল্যামব্রেটা নিজেকে একটু সামলে নিয়েছে মনে হল। আমার দিকে সে এবার একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সে-অন্ধকারেও মনে হল, তার চোখ দুটো মোটরের হেডলাইটের মতো জ্বলছে। ফিসফিস করে সে আমাকে বললে, যে লোকটার কোলে কনি প্রথমে গিয়ে বসেছিল, তাকে তুমি চিনতে পারবে? তার মাথায় আমি সোডার বোতল ভাঙব। আমাকে তোমরা এখনও চেনোনি। লোকটা কনিকে খামচে দিয়েছে।

আমি বললাম, রাগ করবেন না। চুপ করে থাকুন।

ল্যামব্রেটা বললে, আব্দার নাকি? এভরিহয়ার লোকরা কনির উপর অত্যাচার করবে, আর আমি সহ্য করে যাব?

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, মিস্টার ল্যামব্রেটা, আপনার সঙ্গে ডিবেটিং করবার মতো সময় আমার নেই। এই যে হলঘরে এতগুলো লোক দেখছেন তাদের মর্জির উপর আমার চাকরি নির্ভর করছে। এরা যদি কোনোরকমে অসন্তুষ্ট হয়ে খাওয়া বন্ধ করে দেয়, তাহলে আমরা না খেতে পেয়ে মারা যাব।

ল্যামব্রেটা হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, ইফ দে ফাস্ট, উই স্টার্ভ। কিন্তু খেতে আরম্ভ করে ওরা যে কনিকে খেয়ে ফেলবে। তখন?

হা ঈশ্বর, এ কোন পাগলের হাতে পড়লাম? তোমরা এখানে নাচতে এসেছ। তার জন্যে আমাদের মালিকের কাছ থেকে তোমরা অনেক টাকা নিচ্ছ। অনেক টাকা দিতে হচ্ছে বলে, মালিকরা খাবার ও মদের দাম বাড়িয়ে দিয়ে আরও টাকা তুলে নিচ্ছেন। এর মধ্যে আমরা, দরিদ্র কর্মচারীরা, কোথা থেকে আসি? আমাকে আমার কাজ করতে দাও। চিৎকার করে বলতে দাও, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, শাজাহান হোটেলের তরফ থেকে আপনাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছি। আপনাদের ক্লান্ত দেহ এবং মনকে দুদণ্ড শান্তি দেবার জন্যই আমরা এখানে সামান্য আয়োজন করেছি। এর মধ্যে কোথাকার তুমি হরিদাস পাল, আমাদের বিরক্ত করতে আসছ কেন?

ল্যামব্রেটা আমার ব্যবহারে বোধহয় আরও বিরক্ত হয়ে উঠল। বললে, দেখাচ্ছি। তোমাদের আমি মজা দেখিয়ে ছাড়ব।

 

ইতিমধ্যে প্রথম অঙ্ক সমাপ্ত হয়েছে। শাজাহান হোটেলের ইলেকট্রিসিয়ান এই পুরুষ মেলায় আমার ইঙ্গিতে সুইচ টিপে প্রায় নিরাবরণ কনিকে লজ্জার হাত থেকে রক্ষা করেছে। তার পরের মুহূর্তেই আবার আলো জ্বলে উঠেছে। স্ক্রিনের পিছনে এসে একটা আলখাল্লা পরে কনিও তখন হাঁপাচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে সে প্রশ্ন করলে, হ্যারি কোথায়?

আমি বললাম, ওঁকে ঠিক রাখা আমাদের মতো সামান্য লোকের কাজ নয়। রেগেমেগে কোথায় যে উধাও হলেন কে জানে।

কনি মাথার চুলগুলো ঠিক করতে করতে নিজের ডান হাতের কনুইয়ের কাছে হাত বোলাতে লাগল। হাত বোলাতে বোলাতে বললে, তোমাদের এখানে অনেকে এত ড্রিঙ্ক করে সে মাথা ঠিক রাখতে পারে না। ভদ্রলোক নিশ্চয়ই সম্পূর্ণ আউট হয়ে গিয়েছিলেন।

আমি কনির মুখের দিকে তাকালাম। কনিও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধভাবে বললে, একটু আয়োডিন দিতে পারো? ভদ্রলোক বোধহয় নখ কাটেন না; নেশার ঘোরে এমনভাবে খামচে দিয়েছেন যে হাতটা জ্বালা করছে।

ল্যামব্রেটা এবার কোথা থেকে এসে হাজির হল। বললে, ভদ্রলোক? কাদের তুমি ভদ্রলোক বলছ, কনি? দেখলাম ল্যামব্রেটা কোথা থেকে একটু তুলো এবং আয়োডিন জোগাড় করে এনেছে। কনির হাতটা ধরে পরম যত্নে সে আঁচড়ানো জায়গাটা আয়োডিন দিয়ে পরিষ্কার করতে লাগল। কনি চোখ বুজে বললে, উঃ! হ্যারি, আমার লাগছে।

ল্যামব্রেটা গম্ভীরভাবে বললে, শয়তানদের মাথায় ভগবানের অভিশাপ নেমে আসুক।

কনি শান্ত হয়ে, নিজের জ্বালা ভুলে গিয়ে স্নেহভরা কণ্ঠে বললে, ছিঃ হ্যারি, ভগবানের নামে কাউকে গালাগালি দিতে তুমিই না আমাকে বারণ করেছিলে? তাতে সে অমঙ্গল হয়।

হ্যারি বললে, একদম বাজে কথা। এই ডার্টি ডেভিলদের সর্বনাশের জন্য তুমি যা খুশি করতে পার, গড় বাধা দেবেন না। তিনি তোমাদের উপর মোটেই অসন্তুষ্ট হবেন না। বরং, আই ক্যান অ্যাসিওর ইউ, তিনি সুখী হবেন। তিনি তোমাদের আশীর্বাদ করবেন

এতদিন পরে, আজও লিখতে লিখতে আমি কনি ও সেই কুৎসিতদর্শন ল্যামব্রেটাকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। মানুষের এই সংসারে, ঈশ্বরের আশীর্বাদে কত বিচিত্র চরিত্রের সংস্পর্শে এলাম। কিন্তু সু এবং কু, ন্যায় এবং অন্যায়ের এই অপরূপ প্রদর্শনীতে স্রষ্টার যে কি পরিকল্পনা রয়েছে তা আজও আমার কাছে পরিস্ফুট হল না। আজও আমার চোখের সামনে সেই রাত্রের দৃশ্যটা হঠাৎ পুরনো চলচ্চিত্রের নতুন প্রিন্টের মতো উজ্জ্বল হয়ে ভেসে ওঠে। আমি দেখি ল্যামব্রেটা ঈশ্বরের দিকে হাত বাড়িয়ে বলছে, ও লর্ড, কার্স দেম। হে ঈশ্বর, এদের তুমি অভিশাপ দাও। তোমার ধিক্কার বজ্রসম এই ঐশ্বর্যময় অথচ কুৎসিত সভ্যতার উপর নেমে আসুক। কে জানে, এই অর্ধ উন্মাদ বামনের সেই কাতর প্রার্থনা উদাসী সৃষ্টিকর্তার কানে পৌঁছেছিল কি না। হাজার হাজার বছরের মানুষের ইতিহাসে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অপমানিত মানবাত্মা কত বিচিত্র ভাষায় বার বারই তো সেই একই কাতর আবেদন জানিয়েছে। কিন্তু ফল হয়েছে কি?

ন্যাটাহারিবাবু একবার বলেছিলেন, ভগবান? ওঁর নাম করবেন না, মশাই। ঘেন্না ধরে গিয়েছে। উনিও আর এক গবরমেন্ট। ঠিক গবরমেন্ট আপিসের মতো ওঁর কাজ কারবার। ওঁর আপিসে যদি কোনোদিন যান, দেখবেন হাজার হাজার পিটিশন রোজ এসে জমা হচ্ছে। ভগবানের কর্মচারীরা সব নো অ্যাকসন, মে বি ফাইল্ড লিখে ফাইলে ঢুকিয়ে রাখছে। কস্মিন্ কালে কেউ কোনোদিন সে-সবে হাত দেয় না।

ন্যাটাহারিবাবু আরও বলেছিলেন, হাসছেন মশায়? রক্ত গরম আছে, মনটা কচি কচি আছে, ফিক করে হেসে নিন। একদিন কিন্তু কাদতে হবে। বলে রাখলাম, শুধুই কাঁদতে হবে। তখন বিশ্বাস হবে আমার কথা। তখন জানতে পারবেন, ভগবানের আপিসে আর একটুও জায়গা নেই। কত বড় বড় লোকের ফাইল সেখানে পাথরের মতো অচল হয়ে পড়ে আছে—আর আপনি ভাবছেন আপনার ফাইল, এই ন্যাটাহারি ভট্টাচার্যির ফাইল ভগবান মন দিয়ে দেখবেন? ভগবানের টাইম নেই মশাই। পেটি কেস ডিসপোজালের টাইম অতবড় অফিসারের থাকতে পারে না।

হয়তো আমার ছেলেমানুষি। হয়তো এমন মন নিয়ে শাজাহান হোটেলে চাকরি করতে যাওয়া আমার মোটেই উচিত হয়নি। কিন্তু ল্যামব্রেটা ও কনিকে স্টেজের পিছনে একলা রেখে বেরিয়ে আসতে আসতে মনে হচ্ছিল গডের অফিসে আর একটা ফাইল বাড়ল। ল্যামব্রেটা সায়েবের পিটিশন সেখানে গিয়ে রেজিস্ট্রি হবে। কিন্তু কে জানে বোধহয় ওই পর্যন্তই। ওইখানেই আবেদনের মৃত্যু। ল্যামব্রেটা অপেক্ষা করবে। কনি অপেক্ষা করবে। ভাববে, এইবার বোধহয় খবর আসবে। তারপর একদিন অপেক্ষার শেষ হবে। কনির যৌবনে ভাটার টান পড়বে। ল্যামব্রেটার ভাতে টান পড়বে। শাজাহান কেন, পৃথিবীর কোনো ক্যাবারেতেই তাদের আর দেখা যাবে না। নতুন কনি নতুন কোনো বামনের সঙ্গে লীলায়িত ভঙ্গিতে পাদপ্রদীপের সামনে এসে দাঁড়াবে। তারাও আবার মদে মত্ত অতিথিদের আহ্বান জানিয়ে বলবে, গুড ইভনিং, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন। জেন্টলমেনরা উৎফুল্ল হয়ে উঠবেন। তাদেরই মধ্যে কে আবার তার হিংস্র কামোন্মত্ত নখ দিয়ে সেদিনের কনিকে ক্ষতবিক্ষত করে দেবেন। সেদিনের বামন ল্যামব্রেটাও হয়তো আজকের মতোই অধৈর্য হয়ে আবার আবেদন জানাবে। কিন্তু কিছুই হবে না। আবার ফাইল খোলা হবে। আবার বিচারের প্রত্যাশায় অধীর ল্যামব্রেটা দিন গুনতে থাকবে।

কিন্তু এসব কি আমি ভাবছি? আমি হোটেলের রিসেপশনিস্ট। আমার, এখন অনেক কাজ আছে। ক্লান্ত নর্তকী যখন কিছুক্ষণের বিশ্রামের জন্য জনচক্ষুর অন্তরালে গিয়েছেন, তখন আবার বিশ্রামের সময় নয়। তখন দাঁড়িয়ে চিন্তা করবার জন্যে হোটেল আমাকে মাইনে দিয়ে রাখেনি। এখনই আমার মাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো উচিত। বিনয়ে বিগলিত হয়ে উপস্থিত ভদ্রমহোদয় এবং ভদ্রমহিলাদের জানানো উচিত, কনি দি উয়োম্যান এখনই আসবেন। মাত্র কিছুক্ষণ আপনারা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন। আমাদের বেয়ারাদের হুকুম দিয়ে মদিরা আনুন। তারপর আবার সে আসছে।

এখানেই শেষ নয়। আরও আছে। শাজাহান হোটেলের ক্যাবারে অ্যানাউন্সার, আমার আরও কাজ আছে। সেই কাজ এখন আমাকে ধীর মস্তিষ্কে, সার্কাস পার্টির ক্লাউনদের মতো নিপুণভাবে করতে হবে। সেই সব কাজ কেমনভাবে আমি করতে পারি, তার উপরই আমার চাকরির ভবিষ্যৎ। তার উপর নির্ভর করবে, শাজাহান হোটেলের বিনামূল্যে বিতরিত অন্ন আমার টেবিলে কতদিন এসে হাজির হবে।

মাইকে প্রয়োজনীয় ঘোষণা করে আমি স্টেজ থেকে ফ্লোরে নেমে এলাম। এবার অতিথিদের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের তদারক।

একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর আমাকে ডাকলেন, হ্যালো, স্যর, একটু শুনুন। ফোকলা চ্যাটার্জির টেবিলের কাছে এগিয়ে গেলাম। তিনি বললেন, না-হয় সামনের টেবিলে বসিনি। তাই বলে একটু আমাদের কমফর্টের দিকে নজর দেবেন না!

আমি বললাম, সে কী! আপনাদের হুকুম তামিল করবার জন্যেই তো আমরা রয়েছি।

ফোকলা বললেন, দেখুন না, ভাগনেকে নিয়ে কী বিপদে পড়েছি। শুধু বলছে, ফিরে চলল, ফিরে চলো।

মাস্টার পাকড়াশীর দিকে তাকালাম। বেচারার চোখে ঘুম জড়ো হয়ে রয়েছে। মিস্টার চ্যাটার্জি বললেন, ভাগনেটাকে হাতেখড়ি দিতে নিয়ে এলাম, একটু আদর-আপ্যায়ন করুন-না-হলে শাজাহান হোটেল সম্বন্ধে ওর খারাপ ওপিনিয়ন হয়ে যাবে।

আমি জুনিয়র পাকড়াশীকে নমস্কার করে বললাম, আপনার কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো? আপনার মামার সঙ্গে আমাদের অনেক দিনের সম্পর্ক, নিজের মনে করে শাজাহান হোটেলকে ব্যবহার করবেন।

মামা এবার ভাগনেকে বললেন, হ্যাঁ ব্রাদার, স্পোর্টিং স্পিরিটে লাইফ এনজয় করবে। কতক্ষণের জন্যেই আর আমরা এই পৃথিবীতে ব্যাটিং করতে এসেছি। যতক্ষণ ক্রিজে থাকবে, উইকেটের চারদিকে পিটিয়ে খেলে যাও।

শ্রীমান পাকড়াশী ক্রিকেটের উপমায় একটু হেসে ফেললে। মামা বললেন, তোমার বাবার সমালোচনা করা উচিত নয়। কিন্তু ওঁর নজর শুধু বিজনেসের দিকে। উইকেটের চারদিকে পিটিয়ে খেলবার চেষ্টা করলেন না। শূন্য গেলাসের দিকে নজর দিয়ে মামা এবার বললেন, গেলাসে যে কিছুই নেই। তাই বলি, কথাবার্তায় ফ্লো আসছে না কেন। পেট্রল ট্যাঙ্ক খালি থাকলে গাড়ি চলবে কী করে? কিছু একটা কুইকলি সাজেস্ট করুন।

আদি অকৃত্রিম হুইস্কি। ওর মতো জিনিস নেই। আমি বললাম।

ফোকলা চ্যাটার্জি সন্তুষ্ট হলেন না। রুললেন, মশাই, প্লেন অ্যান্ড সিম হুইস্কি তো সেই অ-আ-ক-খ পড়বার সময় থেকে চালিয়ে আসছি। স্পেশাল ককটেল কিছু সাজেস্ট করুন।

বললাম, পিঙ্ক লেডি।

জিনের সঙ্গে ডিমের সাদাটা মিশিয়ে যা তৈরি হয় তো? না মশাই, ওটা আমার মোটেই ভালো লাগে না।

তা হলে হোয়াইট লেডি।

জিন আর লাইমের ভদ্র নাম। না মশাই। আপনার ইমাজিনেশন এমন পুওর হয়ে যাচ্ছে কেন? জিন ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছেন না। আমাদের বন্ধু স্যাটা বোসকে ডাকুন।

সত্যসুন্দরদা আমার ইঙ্গিতে দ্রুতবেগে এগিয়ে এলেন। ফোকলা চ্যাটার্জি হাসতে হাসতে বললেন, যেমন আমার ভাগনে তেমন আপনার এই শিষ্যটি। এখনও নভিস। একটা সুটে ড্রিঙ্কের বুদ্ধি দিতে পারছে না। শ্রীমানের কাছে মামার প্রেস্টিজ আর থাকবে না।

সত্যসুন্দরদার চোখ দুটো বুদ্ধির দীপ্তিতে নেচে উঠল। অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে বললেন, এই সব ছেলেছোকরারা নতুন আইডিয়া নিয়ে আসছে। আর আমরা আপনারা সেকেলে হয়ে পড়ছি। সেইজন্যে আমি যে ড্রিঙ্ক সাজেস্ট করছি তার নাম ওল্ড ফ্যাশন্ড। ক্যানাডার হুইস্কির সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে ফুট সোডা।

ফোকলা বললেন, চমৎকার। বোসদা বললেন, মার্জনা করবেন, এই ড্রিঙ্ক আপনার পছন্দ না হলে আমি যা সাজেস্ট করতাম তার নাম মস্কো মিউল।

অ্যাঁ! এই বুড়ো বয়সে মিউল। ছি ছি লোকে বলবে কী! ফোকলা চ্যাটার্জি হা-হা করতে লাগলেন।

শ্রীমান পাকড়াশী এবার আস্তে আস্তে বললে, আমি কিন্তু মামা আর খাব না। ফোকলা বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলেন, কি মুশকিলেই যে পড়া গেল। ওরে, তুই আর খোকাটি নেই! বাড়িতে ফিরে গিয়ে তোর ব্যর্থ সার্টিফিকেটটা একবার এঞ্জামিন করে দেখিস। সেই তো সেবার ভূমিকম্পের বছরে তোর জন্ম হল। তোর বাবার তখন ঘোর দুর্দিন। ডিপ্রেসনে সব যেতে বসেছে। তুই হয়েছিস খবর পেয়ে পাকড়াশী সায়েবকে কংগ্রাচুলেশন জানিয়ে বিলেত থেকে চিঠি পাঠালাম। তা তোর বাবা আমাকে কী লিখে পাঠালে জানিস? হা-হা-হা। ফোকলা চ্যাটার্জি যেন অট্টহাসিতে ভেঙে পড়লেন।

পাকড়াশী-জুনিয়র মামার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। হাসির ঝড়টা কোনোরকমে সামলে নিয়ে ফোকলা বললেন, তোর বাবা লিখলে, কী করে সংসার চলবে জানি না। বোঝ, মাধব পাকড়াশী নিজের হাতে লিখছে, সে একটা ছেলে অ্যাফোর্ড করতে পারে না। সেই সব চিঠি ছিড়ে ফেলে দিয়ে কি বোকামিই যে করেছি! বোস সায়েব আমাকে সেকেন্ড ড্রিঙ্কটাই দাও। আমি ও ফ্যাশন্ড নই। মস্কো মিউল ছাড়া আমাকে কিছুই মানায় না। ক্যালকাটা ডক্তি বলে যদি কিছু থাকে তাও দিতে পারো।

আর ওঁকে? পাকড়াশী-জুনিয়রের দিকে ইঙ্গিত করে আমি প্রশ্ন করলাম। বোসদা বললেন, মিস্টার চ্যাটার্জি, এরা ইয়ংম্যান। জীবনটা এখন এদের কাছে স্পার্কলিং রাইন ওয়াইনের মতো। আপনার অনুমতি নিয়ে মিস্টার পাকড়াশীকে স্পার্কলিং রেড হক দিই। ওয়ান্ডারফুল জিনিস। আমার জন্ম-বছরে বোতলে ভরা হয়েছিল।

ওয়ান্ডারফুল, ওয়ান্ডারফুল! এইজন্যেই স্যাটা বোসকে না-হলে আমার চলে না। শাজাহান হোটেল মাইনাস স্যাটা বোস ইজিকলটু মাধব ইন্ডাস্ট্রিজ মাইনাস মাধব, হ্যামলেট মাইনাস প্রিন্স অফ ডেনমার্ক, বাংলা সাহিত্য মাইনাস রবি ঠাকুর, রামকৃষ্ণ মিশন মাইনাস বিবেকানন্দ, অ্যান্ড লাস্ট বাট নট দি লিস্ট ফোকলা চ্যাটার্জি মাইনাস ড্রিঙ্ক। হা-হা করে হাসছেন ফোকলা চ্যাটার্জি কিন্তু হাসতে হাসতেই যেন তিনি কেমন হয়ে পড়লেন। স্যাটাদাকে বললেন, ড্রিঙ্ক ছাড়া আমি থাকতে পারি না মশাই। কিছুতেই পারি না। বেলা পড়লেই, সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার যেমনি কলকাতাকে ঘোমটা পরিয়ে দেয়, অমনি আমি যেন কেমন হয়ে যাই। কিছুতেই নিজেকে আটকে রাখতে পারি না। বেলা যে পড়ে এল জলকে চল, পুরনো সুরে কে যেন আমাকে ডাকতে আরম্ভ করে।

ফোকলা চ্যাটার্জির এই আকস্মিক পরিবর্তনে শুধু আমি নয়, পাকড়াশী জুনিয়রও ভয় পেয়ে গেল। সে বললে, মামা! মামা তখন সত্যসুন্দরদার হাতটা ধরে বলছেন, আমার কেন এমন হয় বলতে পারেন? বেগ, বয়রা, অর স্টিল, প্রতিদিন আমাকে মাল টানতেই হবে।

বোসদা বললেন, মিস্টার চ্যাটার্জি, বিচলিত হবেন না। কিন্তু ফোকলা চ্যাটার্জির চোখ দুটো তখন সজল হয়ে উঠেছে। কালো পাথরের অনুর্বর বুকে হঠাৎ যেন শ্বেত পদ্মের কুঁড়ি ফুটতে শুরু করেছে। ফোকলা চ্যাটার্জি নিজেকে সামলাবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে বললেন, আমি মানুষ না মশাই। আমি জানোয়ার। আমি একটা মস্কো মিউল। না-হলে, নিজের ভাগনেকে নিয়ে কেউ ড্রিঙ্ক করতে আসে? জানেন, ওর নাম আমিই দিয়েছিলাম। সারা জীবন ধরে নিন্দের বোঝা বয়ে বয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাই দিদি যখন চিঠি লিখে পাঠালে, ভাগনের একটা নাম দিয়ে দিও, তখন আমার মাথায় একটা নামই এসেছিল—অনিন্দ্য। অনিন্দ্য পাকড়াশীর মুখের দিকে ফোকলা চ্যাটার্জি পরম স্নেহভরে তাকিয়ে রইলেন। তার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে, টেনে নিয়ে বললেন, এখনো ফ্রেশ রয়েছে।

বোসদা মিস্টার চ্যাটার্জির ড্রিঙ্কগুলো আনবার জন্যে বেয়ারাকে বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ফোকলা চ্যাটার্জি বারণ করলেন। গোপনে নিজের মনের মধ্যে ওই কুৎসিতদর্শন লোকটা যেন কিসের হিসেব করছেন। কেন যে ওঁর মনের মধ্যে এই সব চিন্তা জট পাকিয়ে বসল তাও বোঝা যাচ্ছে না। বোসদাকে তিনি বললেন, একটু দাঁড়ান। ভেবে নিই। হঠাৎ ফোকলা চ্যাটার্জি উঠে। দাঁড়ালেন। পকেট থেকে পুরনো বিলগুলোর টাকা বের করে টেবিলের উপর রেখে বললেন, অনিন্দ্য, চলে আয়।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো অনিন্দ্য পাকড়াশীও উঠে পড়ল। মদের নেশায় ফোকলা চ্যাটার্জি কি একেবারে বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন? এই সামান্য কয়েকটা পেগে বোন্ড আউট হবার ছেলে তো ফোকলা চ্যাটার্জি নন। এই তো কয়েক মুহূর্ত আগেও তিনি উইকেটের চারদিকে পিটিয়ে খেলার পরামর্শ দিচ্ছিলেন। বোসদা বললেন, মিস্টার চ্যাটার্জি, ক্যাবারের শেষ অঙ্ক দেখবেন না?

ফোকলা চ্যাটার্জি বিষণ্ণভাবে অসম্মতি জানালেন। আস্তে আস্তে বললেন, আই অ্যাম স্যরি, স্যাটা। অনিন্দ্যকে এখানে আনা আমার কিছুতেই উচিত হয়নি।

আমাদের বিস্মিত ও অভিভূত করে ফোকলা চ্যাটার্জি নিজের ভাগনের হাত ধরে যখন অসমাপ্ত আনন্দসভা থেকে বিদায় নিলেন, মমতাজের আলোগুলো তখন আবার নিভতে আরম্ভ করেছে। বেয়ারারা তখন শেষবারের মতো দ্রুতগতিতে ভদ্রমহোদয়দের টেবিলে ড্রিঙ্ক পৌঁছে দেবার চেষ্টা করছে।

 

আবার নাচ শুরু হল। রঙিন আলোর মেলায় মেয়েমানুষ কনির ফানুস নৃত্য। সারা অঙ্গে ফানুস বেঁধে কনি যেন প্যারাসুটবাহিনী হয়ে স্টেজের উপর এসে নামল।

স্টেজে নামবার আগে কনিকে প্রশ্ন করেছিলাম, তোমার হাত কেমন? কনি বলেছিল, আমার ও-সব মনে থাকে না। হ্যারিই ওতে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। কনি আরও বলেছিল, এখন স্টেজে যাবার মুখে আমাকে ওইসব অপ্রীতিকর ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিও না। ওতে আমার মুড নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

আমি আর মনে করিয়ে দিইনি। কনিও এবার অতিথিদের সম্মুখে উপস্থিত হবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে নিল। আশ্চর্য! যে এতক্ষণ এমন বিষণ্ণ গাম্ভীর্যে নিজেকে পরিপূর্ণ রেখেছিল সে-ই যে নিমেষের মধ্যে এমন চটুল লাস্যময়ী হয়ে উঠতে পারে, তা নিজের চোখে না দেখলে কিছুতেই বিশ্বাস করতাম না।

উপস্থিত অতিথিরা উল্লসিত হয়ে উঠলেন। চিৎকার উঠল। সিটি বাজল। প্রতিদিন যা হয়, যুগ যুগ ধরে শাজাহান প্রমোদকক্ষে যা হয়ে আসছে, তারই পুনরাবৃত্তি হল। তবু কেন জানি না, বেশ বুঝতে পারলাম, কোথায় যেন ছন্দপতন ঘটেছে। গত রাত্রে যে ফনি নেচেছে, সে যেন আজ এখানে উপস্থিত নেই। তার নৃত্যে প্রাগৈতিহাসিক উদ্দামতার অভাব ছিল না, তার নয়নে বিষাক্ত সপিণীর ভয়াবহতাও ছিল। তবু পান্থশালার নর্তকী আজ ক্লান্ত, তার মুড সত্যিই নষ্ট হয়ে গিয়েছে।

আজও দর্শকরা ফানুস ফাটালেন। সর্বজাতির কামনা-কলুষিত উল্লাস যেন একদেহে মমতাজের এই ঐতিহাসিক কক্ষে লীন হয়ে গেল। তবু সংক্ষিপ্ত। বিষণ্ণ নর্তকী আজ অনেক আগেই দর্শকদের শিকারীচোখকে ফাঁকি দিয়ে অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। আবার আলো জ্বলে উঠল। মৃদু গুঞ্জনে মমতাজের হঘর ভরে উঠল। বাড়ি ফেরবার তাড়ায় কে আগে হলঘর থেকে বেরিয়ে যেতে পারে তার জন্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল।

মাইকটাকে যথাস্থানে সরিয়ে দিয়ে, বেয়ারাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে হল থেকে বেরোতে গিয়ে সত্যসুন্দরদার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।

কনি কোথায়? সত্যসুন্দরদা প্রশ্ন করলেন।

বললাম, জানি না, আলো নেভার সঙ্গে সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছে।

সত্যসুন্দরদা বললেন, বেশ গোলমেলে পরিস্থিতিতে পড়া গেল। ম্যানেজার অসন্তুষ্ট হয়েছেন। লাস্ট সিকোয়েন্সের সময় জিমি দাঁড়িয়ে ছিল। সে বোধহয় মার্কোর কাছে লাগিয়েছে।

শুনলাম, ম্যানেজার কনির মনঃসংযোগর অভাব লক্ষ্য করেছেন। জিমির সঙ্গে তার অনেক কথা হয়েছে। জিমি বলেছে, কম্পিটিশনের মার্কেট, একবার বদনাম রটলে আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। অন্য হোটেলে তিন তিনটে মেয়ে আগামীকাল থেকে একসঙ্গে নাচতে শুরু করবে। ওরা বলে বেড়াচ্ছে, এক মায়ের তিন মেয়ে। তিন বোন না ছাই। আঠারো বছর বয়সের আগে চুড়িরা কেউ কারুর মুখ দেখেনি। আর এখানে বিজ্ঞাপনের জোরে তিন বোন হয়ে গিয়েছে।

বোসদা বললেন, ম্যানেজার কী করে ল্যামব্রেটার কথা শুনল? তুমি কিছু বলেছ?

আমি?

বোসদা বললেন, ওঁদের ধারণা যত নষ্টের গোড়া ওই বেঁটে সায়েব। ওর জন্যেই কনির নাচ খারাপ হচ্ছে।

আমি বললাম, ও বেচারীর কী দোষ?

একজন পাবলিকই তো কনিকে আঁচড়ে দিয়ে সব গণ্ডগোল করে দিল।

বোসদা বললেন, ম্যানেজার কিছু একটা করবেন। সেইজন্যেই আমাকে ডেকেছিলেন।

কী করবেন? আমি প্রশ্ন করলাম।

বোসদা হাসলেন। বললেন, এত উতলা হচ্ছ কেন? এত বড়ো হোটেল চালাতে হলে ম্যানেজমেন্টকে কত কী করতে হয়।

আমার কেন জানি না ভয় হল, কনির কোনো ক্ষতি হবে। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বোসদা যেন বুঝতে পারলেন। হেসে বললেন, বলেছি না, এর নাম পান্থশালা। কেউ এখানে থাকবে না। কারুর উপর মায়া বাড়িয়ে না।

আমি বোসদার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। চোখ দুটো সরিয়ে নিলাম! বোসদা বললেন, দোষ তো কনিরই। হোটেলের চাকরবাকরগুলো পর্যন্ত বামনটাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করছে। জিমি নিজে বললে, কনি তার বামনের জন্যেও একটা এয়ারকন্ডিশান ঘর দাবি করেছিল।

আমি তখন ওসব শুনতে চাই না। ম্যানেজার ও জিমি কী ফন্দি এঁটেছেন তাই জানতে চাই। কিন্তু জানা হল না। বোসদা কিছু প্রকাশ করতে রাজি হলেন না। আমিও বোসদার মুখচোখের ভাব দেখে আর জোর করতে সাহস করলাম না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *