১০. গনি সাহেব বললেন

গনি সাহেব বললেন, কী মিজান সাহেব, আপনাকে এ রকম দেখাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ?

জ্বি না।

শরীর খারাপ হলে বাসায় চলে যান। সবারই বিশ্রাম দরকার।

মিজান সাহেব বললেন, আমার স্যার শরীর ঠিক আছে।

তাহলে কি মন খারাপ? মন খারাপ হবার তো কোনো কারণ নেই, ছেলে ফিরে এসেছে।

মিজান সাহেব অপ্রাসঙ্গিকভাবে বললেন, আমি স্যার গতকাল রহমানের বাসায় গিয়েছিলাম। কথা বলেছি।

বাচ্চাটা ভালো?

জ্বি ভালো।

আর বাচ্চার মা?

সেও ভালো। স্যার আমার ধারণা হিসাবের গণ্ডগোলের সঙ্গে রহমানের কোনো সম্পর্ক নেই।

গনি সাহেবের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল। পরক্ষণেই তা স্বাভাবিক হয়ে গেল। তিনি হাসি মুখে বললেন, আপনি কি সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করলেন নাকি?

জ্বি না। তবে তারা টাকাটা কী করে জোগাড় করেছে এটা শুনলাম। খুব কষ্ট করে টাকা জোগাড় করেছে। জমি জমা, ঘর সব বিক্রি করে একটা বিশ্রী অবস্থা।

আহা বলেন কী!

আমার খুব খারাপ লাগল।

খারাপ লাগারই কথা।

গনি সাহেব পান মুখে দিতে দিতে বললেন, তাহলে আপনার কী ধারণা? টাকাটা গেল কোথায়? আমার কাছে টাকার পরিমাণ খুবই নগণ্য। ওটা কিছুই না কিন্তু এ রকম একটা ব্যাপার তো হতে দেয়া যায় না, তাই না?

মিজান সাহেব চুপ করে রইলেন। গনি সাহেব বললেন, ব্যাপারটা ঘটেছে ক্যাশ সেকসনে তাই না?

জ্বি।

রহস্য উদ্ধার হওয়া দরকার। তা নইলে ভবিষ্যতে যে আরো বড় কিছু হবে না তার গ্যারান্টি কি? তাই না?

জ্বি।

পুলিশের হাতে ব্যাপারটা দিয়ে দিলে কেমন হয় বলুন তো? পুলিশ কিছু করতে পারবে না জানা কথা। কখনো পারে না, তবু পুলিশ যদি নাড়াচাড়া করে তাহলে সবাই একটু ভয় পাবে। কি, ঠিক বলছি না?

মিজান সাহেব কিছু বললেন না।

গনি সাহেব বললেন, আমার চিটাগাং ব্রাঞ্চের একটা খবর আপনাকে বলি। ফরেন কারেন্সিতে এগার লাখ টাকার একটা সমস্যা। আমার সবচে বিশ্বাসী যে মানুষটা চিটাগাং-এ আছে তাকেই সন্দেহ করতে হচ্ছে। বুঝতে পারছেন অবস্থাটা?

মিজান সাহেব বললেন, আমার ওপর কি আপনার কোনো সন্দেহ হয়?

কারো ওপর আমার সন্দেহ হয় না। আবার কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না। বিশ্বাস করা উচিতও না। আদমের উপর আল্লাহ বিশ্বাস করেছিলেন। সেই বিশ্বাসের ফলটা কি হল বলুনঃ আদম গন্ধম ফল খায় নি? খেয়েছে। মিয়া বিবি দুজনে মিলেই খেয়েছে। চা খান। চা দিতে বলি। বুঝলেন মিজান সাহেব, যে কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্যাশ সেকসান হল তার হাট। হার্টের ছোট অসুখ ধরা পড়ে না। কিন্তু এই ছোট জিনিস হঠাৎ বড় হয়ে যেতে পারে। যখন হয় ঘুমের মধ্যে মৃত্যু হয়ে যায়। কেউ বুঝতেও পারে না। ঠিক কি না, বলুনঃ নির্বোধ মানুষরা সাধারণত সৎ হয়। এই জন্যে ক্যাশে দরকার নির্বোধ ধরনের লোক। মুশকিল হচ্ছে কি, এই নির্বোধ ধরনের লোকদের আবার অন্যরা সহজেই ব্যবহার করে। কাজেই নির্বোধ ধরনের লোক ক্যাশে অচল। সমস্যাটা দেখতে পারছেন? ভীষণ সমস্যা।

চা এসে গেছে। মিজান সাহেব চায়ে এক চুমুক দিয়েই কাপ নামিয়ে রাখলেন। ঠাণ্ডা গলায় আবার বললেন, আপনি কি আমাকে সন্দেহ করছেন?

গনি সাহেব বললেন, না করছি না। আপনি আমার অতি বিশ্বাসী লোকদের এক জন। এই বৎসর থেকে আপনার বেতন পাঁচশ টাকা বাড়ানো হয়েছে। দুএক দিনের মধ্যে চিঠি পাবেন। তবে মিজান সাহেব, ঐ যে বললাম, বাবা আদমের কাহিনী। চা খান। চা ঠাণ্ডা হচ্ছে।

মিজান সাহেব চা খেতে পারলেন না। তাঁর বমি বমি লাগছে।

গনি সাহেব বারটার দিকে রোজ একবার বাসায় টেলিফোন করে তাঁর ছেলের খোঁজ নেন। আজও টেলিফোন করলেন। তাঁর স্ত্রী সম্ভবত টেলিফোনের কাছেই বসে থাকেন, কারণ একবার রিং হওয়া মাত্র টেলিফোন তুলে তিনি চিকন গলায় বলেন, আপনি কে বলছেন?

আজ বেশ কয়েকবার রিং হবার পর তিনি টেলিফোন ধরলেন এবং যথারীতি বললেন, আপনি কে বলছেন?

গনি সাহেব শীতল গলায় বললেন, বাবু কোথায়?

বাসায় নাই।

বাসায় নাই মানে? কী বলছ এসব।

বড় জামাই নিয়া গেছে।

বড় জামাই নিয়ে গেছে মানে। এর মানে কি? কোথায় নিয়ে গেছে?

ফরিদপুর।

গনি সাহেবের মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। ব্যাপারটা কি দ্রুত আঁচ করতে চেষ্টা করলেন। তেমন কিছু ধরতে পারলেন না। তাঁর কপালে ঘাম জমল। তিনি থমথমে গলায় বললেন,

ফরিদপুর নিয়ে গেছে কেন?

ঐখানে এক পীর সাহেব আছেন, পীর সাহেব দোয়া পড়লে সব ভালো হয়।

আমি বলি নি যে, জামাইয়ের সঙ্গে বাবু কোথাও যাবে না? বলি নি?

এখন নিতে চাইলে আমি না করি ক্যামনে? জামাই মানুষ।

কখন নিয়ে গেছে।

সকালে। আপনি বাইরে যাওয়ার একটু পরে।

আমাকে এতক্ষণ বল নি কেন? কেন তোমার এত সাহস হল? কোত্থেকে এত সাহস পেলে?

ও পাশে ফোঁস-ফোঁস শব্দ হচ্ছে। গনি সাহেবের স্ত্রী কাঁদতে শুরু করেছেন। এই কান্না অবশ্যি খুব সাময়িক। টেলিফোন রেখে দেয়া মাত্র কান্না থেমে যাবে।

গনি সাহেব টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। তিনি তাঁর জামাইদের বিশ্বাস করেন না। তাঁর ধারণা বাবুকে বড় জামাই একা নিয়ে যায় নি। তিন জনই এর সঙ্গে আছে। এই নিয়ে যাবার পেছনে দীর্ঘ পরিকল্পনা থাকা বিচিত্র না। হয়ত বিকেলে বড় জামাই ফিরে এসে কাঁদো কাঁদো গলায় বলবে—একটা সর্বনাশ হয়েছে। বাবু পুকুরে পড়ে গেছে। কিংবা বলবে বাবুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি সিগারেট কিনবার জন্যে গিয়েছি—বাবু দাঁড়িয়েছিল ফিরে এসে দেখি……

যদি এ রকম কিছু হয় তিনি কী করবেন? তিন জামাইয়ের বিরুদ্ধে পুলিশ কেইস করবেন? জামাইদের হাতকড়া বেঁধে নিয়ে যাবে—তিনি দেখবেন? পত্রিকায় ছবি ছাপা হবে। বাবু হত্যা রহস্য। অবশ্যি পত্রিকার লোক এটা নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করবে না। কোনো সুন্দরী মেয়ে হত্যার সঙ্গে জড়িত না থাকলে খবরের কাগজের লোকজন উৎসাহ পায় না। বাবু হত্যায় কেউ কোনো উৎসাহ পাবে না। অপ্রকৃতিস্থ একটা শিশুর হত্যায় কিছুই যায় আসে না। খবরের কাগজের ভেতরের দিকের পাতায় খবরটা ছাপা হতে পারে। কিংবা হয়ত ছাপাই হবে না। রোজ কত হত্যাকাণ্ড ঘটছে। হত্যার খবরে মানুষের এখন আর আগ্রহ নেই।

গনি সাহেব তার দ্বিতীয় জামাই এবং ছোট জামাইকে টেলিফোন করলেন। তিনি জানতে চান তারা ঢাকাতেই আছে না ফরিদপুর গেছে। দুজনকেই পাওয়া গেল। শ্বশুরের টেলিফোন পেয়ে তারা গরমের দিনের মাখনের মতো গলে গেল। প্রতিটি বাক্যে তিনবার করে বলছে, আব্বা, আব্বা, আব্বা।

গনি সাহেব মনে মনে বললেন, ফাজিলের দল, নিজের বাবাকে দিনে কবার আৰ্বা ডাকি? কবার জিজ্ঞেস করিস-আব্বা আপনার শরীরটা এখন কেমন?

গনি সাহেব শান্ত ভঙ্গিতে দুজামাইয়ের সঙ্গেই কথা বললেন। কথার মধ্যে বাবু বা বড় জামাইয়ের প্রসঙ্গ একবারও এল না।

তিনি দুপুরে বাসায় খেতে যান।

আজ গেলেন না।

চুপচাপ বসে রইলেন। কিছুই ভালো লাগছে না।

একবার ভাবলেন মিজান সাহেবকে ডেকে খানিকক্ষণ গল্প করবেন। এই চিন্তা বাদ দিলেন। এখন টিফিনের সময়। এই সময়ে ক্ষুধার্ত এক জন মানুষকে বসিয়ে রাখার কোনো মানে হয় না। তাছাড়া মানুষটা একটা ধাক্কা খেয়েছে। ধাক্কা সামলানোর সুযোগ দেয়া দরকার। ধাক্কাটা তিনি ইচ্ছা করেই দিয়েছেন। এর দরকার আছে। মনের ভেতর একটা ভয় থাকুক, ভয় মানুষকে বেঁধে রাখে।

পুলিশের খবর দেবার কথাটা তিনি এমনি বলেছেন। পুলিশের সঙ্গে কোনো ব্যাপারে তিনি যেতে চান না। পুলিশ মানেই ঝামেলা। যদিও ঝামেলার প্রয়োজন আছে।

তবে তিনি কাজ করবেন তাঁর মতো। তিনি বুঝিয়ে দেবেন যে তিনি একই সঙ্গে সন্দেহ করেন আবার ভালোও বাসেন। পাঁচ শ টাকা বেতন বেড়ে যাচ্ছে এই বাজারে এটা কম কথা না। তাছাড়া তিনি মিজান সাহেবের ফেল করা ছেলেটাকেও চাকরি দেবেন। অবশ্যই দেবেন। বংশ পরম্পরায় কৃতজ্ঞতার জালে বেঁধে রাখবেন। ব্যবসা বড় হচ্ছে এই সময়ে বিশ্বাসী লোক দরকার। একদল বিশ্বাসী লোক তাঁর সঙ্গে থাকবে অথচ তারা জানবে তারা পুরোপুরি বিশ্বাসী নয়।

চট্টগ্রাম ব্রাঞ্চের ব্যাপারে তিনি মিথ্যা কথা বলেছেন। বার লাখ টাকার কোনো ব্যাপার না। সেখানেও লাখ খানিক টাকার গণ্ডগোল। এটা খারাপ না। এটা ভালো। সবাই জানবে এত টাকার একটা সমস্যা আছে। তারা আরো সাবধান হবে। তবু কিছু গোলমাল বৎসর দুই পর-পর দেখা দেবে।

গনি সাহেব মাথা খেলিয়ে এই পদ্ধতি বের করেছেন। এই পদ্ধতি বের করতে তাকে অনেক মাথা খেলাতে হয়েছে। এই পদ্ধতিও হয়ত সঠিক না। এর মধ্যে ভুল ভ্ৰান্তি থাকতে পারে। সব পদ্ধতিতেই আছে।

এই পদ্ধতির পুরোটা তাঁর নিজের না খানিকটা মুনিরের কাছে শিখেছেন। মুনির এই বয়সেই বিশাল কনস্ট্রাকশান ফার্মের মালিক। সে একদিন বলেছিল, হিসাবে একুশ লক্ষ টাকার একটা গণ্ডগোল করে রেখেছি। নিজেই করেছি। এতে লাভ কী হয়েছে জানেন, গনি সাহেব? লাভ একটাই হয়েছে—আমার সব কটা লোক কুঁচের আগায় বসে আছে। হা হা হা। সবাই ভাবছে যে-কোন মুহুর্তে চাকরি চলে যেতে পারে। অথচ যাচ্ছে না। এতে কাজ হয়। ভালো কাজ হয়। আপনি আমার বন্ধু মানুষ। আপনি টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করেছেন বলে এত দূর উঠতে পেরেছি। আপনাকে একটা কৌশল শিখিয়ে দিলাম। সব সময় হিসাবের একটা গণ্ডগোল বাঁধিয়ে রাখবেন। তারপর দেখবেন সব কেমন ঘড়ির কাঁটার মতো চলছে। টিক টিক টিক টিক।

গনি সাহেব আবার মিজান সাহেবকে ডেকে পাঠালেন, মধুর স্বরে বললেন, খাওয়া-দাওয়া হয়েছে মিজান সাহেব?

জ্বি।

বসুন বসুন।

তিনি বসলেন।

গনি সাহেব বললেন, দেশের জন্যে কিছু কাজ করতে চাই। কী ভাবে তা করা যায় কিছু ভেবেছেন?

জ্বি না।

ভাবুন। ভেবে বের করুন। আর আপনার ছেলেকে নিয়ে আসতে বলেছিলাম না? আনছেন না কেন?

মিজান সাহেব চুপ করে রইলেন।

আজই তো আনার কথা তাই না?

জ্বি।

যদি আসে সরাসরি আমার কাছে নিয়ে আসবেন। কম্পুটার সেকশনে দিয়ে দেব। ভালোমতো ট্রেনিং নিকা কম্পুটার কোম্পানি ট্রেনিং দিয়ে দেবে। কোনো অসুবিধা নেই। আপনার শরীরটা কি খারাপ নাকি?

জ্বি খারাপ।

যান, বাসায় চলে যান। বাসায় গিয়ে বিশ্রাম করুন।

মিজান সাহেব চলে যাবার পর পরই গনি সাহেব টেলিফোন পেলেন বড় জামাই বাবুকে নিয়ে ফিরেছে। অনেক দিন পর বাইরে ঘুরতে পেরে বাবু খুব খুশি। পীর সাহেব তাকে একটা কবচ দিয়েছেন। জাফরান দিয়ে কোরানের আয়াত লেখা একটা প্লেট দিয়েছেন। সেই প্লেট যোয়া পানি প্রতি বুধবার খালি পেটে খেতে হবে।

তিনি মনে মনে বললেন-হারামজাদা। গালিটা কাকে দিলেন তিনি নিজেও বুঝলেন না। নিজের জামাইদের না পীর সাহেবকে? নাকি পৃথিবীর সব মানুষদের?

তাঁর চেহারায় বিরক্তির ভাব কখনো ফোটে না। আজ ফুটেছে। তিনি টেলিফোন নামিয়ে রেখে ভ্রূ কুঁচকে খানিকক্ষণ ভাবলেন তারপর টেলিফোন করলেন রমনা থানায়। রমনা থানার ওসি বিগলিত গলায় বলল, কেমন আছেন স্যার?

ভালো। আপনার শরীর কেমন?

জ্বি আপনার দোয়া। কিছু করতে হবে?

জ্বি না। একটু ভয় দেখানোর দরকার হয়ে পড়ল যে ও সি সাহেব।

ভয় দেখানোর দরকার হলে দেখাব। হাজতে এনে প্যাদানি দিয়ে দেব। ব্যাপার কি?

ব্যাপার কিছুই না। ক্যাশের টাকা-পয়সার ব্যাপারে একটা ঝামেলা হয়েছে। কয়েকজনকে একটু ভয় দেখানো।

কোনো অসুবিধা নেই। আপনি একটা এফ আই আর করে রাখুন। তার পর দেখুন কি করছি।

না না তেমন কিছু করতে হবে না। ভদ্রভাবে একটু জিজ্ঞাসাবাদ করবেন এতেই কাজ হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *