১০
অনেকক্ষণ ধরে কে যেন কড়া নাড়ছে।
কড়া নাড়ার ধরনটা অদ্ভুত। দু’টি টোকা দিয়ে থেমে যাচ্ছে, আবার দু’টি টোকা দিচ্ছে। জানালার পর্দা সরিয়ে বিনু উকি দিল। অপরিচিত এক জন মানুষ। রোগা, মুখভর্তি দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। এর মাঝে দু’টি চোখ জ্বলজ্বল করছে।
বিনু ভয় পাওয়া গলায় বলল, ‘কে?’
লোকটি খুবই কোমল স্বরে বলল, ‘আমাকে তুমি চিনবে না। আমার নাম মিসির আলি।’
কোমল স্বর খুবই সন্দেহজনক। এ-রকম মিষ্টি গলায় একটা অপরিচিত লোক কথা বলবে কেন?
বিনু বলল, ‘বাবা তো একটু বাজার করতে গিয়েছে। আপনি আধ ঘন্টা পরে আসুন না।’
‘বাসায় বুঝি তুমি ছাড়া আর কেউ নেই?’
‘জ্বি-না!’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, দরজা খুলতে হবে না। আমি এখানেই আধ ঘন্টা অপেক্ষা করি।’
বিনু অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। মিসির আলি বললেন, ‘একটা কাজ কর, জানালা দিয়ে আমাকে একটা দেশলাই দাও।’
‘না?’
‘আসুন, আপনি ভেতরে এসে বসুন।’
মিসির আলি হেসে বললেন, ‘এখন বুঝি আমাকে আর দুষ্টু লোক মনে হচ্ছে ‘না।’
‘নৌকায় যখন ডাকাতি হয়, তখন ডাকাতরা কী করে, জান? আগুন চায়।’
‘এটা তো আর নৌকা না।’
মিসির আলি হেসে ফেললেন। মুনির যা বলেছে, তাই–এ মেয়েটির আচার-আচরণে খুব স্বাভাবিক একটি ভঙ্গি আছে। ঠিক সুন্দরী তাকে বলা যাবে না, তবে চেহারা খুব মায়াকাড়া। তার চেয়েও বড় কথা, ছবিতে এই মেয়েটিই কনে হয়ে বসে আছে। এই মেয়েটির বাঁ গালের কাটা দাগটাও ছবিতে নিখুঁত এসেছে।
‘বিনু, তুমি বস, তোমার সঙ্গে গল্প করি।’
‘আপনি আমার নাম জানলেন কীভাবে?’
‘মুনির বলেছে। মুনিরকে চেন তো? তোমার আব্বার সঙ্গে কাজ করে।’
‘খুব ভালো করে চিনি। আপনি কি ওঁর আত্মীয়?’
‘ঠিক আত্মীয় না হলেও খুব চেনা। মাঝে মাঝে অনাত্মীয় লোকজনকেও খুব চেনা মনে হয় না? মুনিরও সে-রকম।’
‘আপনি তো খুব সুন্দর করে কথা বলেন।’
‘তুমিও খুব সুন্দর করে কথা বল।’
‘বাবার কাছে কী জন্যে এসেছেন?’
‘ঠিক তোমার বাবার কাছে আমি আসি নি। আমি এসেছি তোমার কাছে।’
বিনু বিস্মিত হয়ে তাকাল। মিসির আলি একটা ছবির উল্টো পিঠ দেখিয়ে বললেন, ‘এখানে লেখা আছে, ‘আমাদের টগরমনি। বয়স এক বছর।’ এই হাতের লেখাটা কি তোমার?’
বিনু খুবই অবাক হয়ে লেখাটার দিকে তাকিয়ে রইল।’
‘বল, তোমার হাতের লেখা?’
‘জ্বি। কিন্তু আমি এ-রকম কিছু কখনো লিখি নি।’
‘তা আমি জানি।’
‘ছবিটা দেখি।’
‘উঁহু, ছবিটা এখন দেখাব না। পরে দেখাব। এখন অন্য একটা ছবি দেখ, বিয়ের ছবি। বর-কনে বসে আছে। তাদের ঘিরে আত্মীয়স্বজনরা দাঁড়িয়ে আছে। বর এবং কনের ছবি আমি কাগজ দিয়ে ঢেকে রাখব। তুমি শুধু অন্যদের ছবিগুলো দেখবে এবং বলবে এদের চেন কি না।’
‘তার আগে বলুন, আপনি কে?’
‘আমি আমার নাম তো আগেই বলেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকোলজি পড়াই। একটা ছোট্ট গবেষণা করছি। গবেষণাটা মুনিরকে নিয়ে।
‘ওকে নিয়ে গবেষণা করছেন, কিন্তু আমাকে এ-সব দেখাচ্ছেন কেন?
‘পরে তোমাকে বলব। তুমি এখন ছবিটা একটু দেখ তো। চিনতে পার এদের?’
‘হাঁ, দু’ জনকে বাদ দিয়ে সবাইকে চিনি। এরা সবাই আমার আত্মীয়। আমার খালা, আমার ফুপু। এটা হচ্ছে আমার বান্ধবী লিজা। এটা আমার বড় খালার মেয়ে কনক। ইনি আমার ছোট মামা।’
মিসির আলি ছবিটি পকেটে রেখে দিলেন।
বিনু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিছু বলতে গিয়ে সে বলল না। নিজেকে সামলে নিল। মিসির আলি বললেন, ‘তুমি কি কিছু বলবে?’
‘না।’
‘মনে হচ্ছিল কি জানি বলতে চাইছিলে?’
‘আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, এটা আমার বিয়ের ছবি। কিন্তু আমার বিয়ে হয় নি। আপনি এই ছবি কোথায় পেলেন?’
মিসির আলি চুপ করে রইলেন। বিনু কড়া গলায় বলল, ‘আপনি এখন যান। আমি দরজা বন্ধ করে দেব।’
মিসির আলি নিঃশব্দে উঠে এলেন। বিনু জানালার পর্দা ফাঁক করে তাকিয়ে আছে–তার মুখ বিষণ্ন। চোখে গাঢ় বিষাদের ছায়া। এই বিষাদের উৎস কী, কে জানে?