কে ওই মেয়েটি?
এই প্রথম!
ছবিতে দেখেছেন আগে। চাক্ষুষ এই প্রথম। যুবতী হাতে তুলে নেন ধাতব আগ্নেয়াস্ত্র, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকেন বারবার। রোমাঞ্চ আর উত্তেজনা পাল্লা দিয়ে দৌড়তে শুরু করে শিরা-উপশিরায়। এই তা হলে রিভলভার, আসল! কিন্তু গুলি কোথায়, কার্তুজ? তর সয় না যুবতীর, জিজ্ঞেস করেই ফেলেন।
—দিদি… বুলেট?
‘দিদি’ হাসেন সস্নেহে, টের পান একুশ বছরের যুবতীর ছটফটানি।
—বুলেট পরে। কীভাবে যন্ত্রটা ব্যবহার করবি সেটা আগে দেখিয়ে দিই। ভাল করে বুঝে না নিলে এ যন্ত্র কিন্তু পোষ মানার নয়। দে ওটা আমায়…
অনিচ্ছা সত্ত্বেও রিভলভারের হাতবদলে বাধ্য হন যুবতী। খুঁটিনাটি বোঝাতে শুরু করেন ‘দিদি’।
—বুলেট চাইছিলি না? বুলেট ঢোকাতে হয় চেম্বারে। এই হল চেম্বার। এইভাবে খুলবি আর একটা একটা করে গুলি ঢোকাবি এই পাঁচটা ফুটোর মধ্যে। এবার চেম্বারটা দ্যাখ কীভাবে বন্ধ করছি। হল বন্ধ? ব্যস, তোর রিভলভার এখন লোডেড।
যুবতী শুনতে থাকেন অখণ্ড মনোযোগে।
—এইটা হল ব্যারেল, ট্রিগার টিপলে যেখান থেকে গুলি ছুটবে। একটা কথা সবসময় মনে রাখবি, লোড যখন করবি, মানে বুলেট ভরবি যখন চেম্বারে, ব্যারেলের মুখ কক্ষনো নিজের দিকে রাখবি না, নেভার! কোনওভাবে অসাবধানে ট্রিগারে হাত পড়ে গেলে নিজেই অক্কা পাবি। ভরবি সাইড করে, এইভাবে।
শুটিংয়ে আসল কথা কিন্তু ‘গ্রিপ’, তুই কীভাবে ধরছিস অস্ত্রটাকে। লক্ষ কর, আমি কীভাবে ধরছি। আঙুলগুলোর পজিশন দ্যাখ মন দিয়ে। ধরলি? এবার নিশানা। এই যে সামান্য উঁচু জিনিসটা ব্যারেলের সামনের দিকে দেখছিস, একে বলে ‘ফোরসাইট ইউ’। টার্গেটের সঙ্গে এটাকে স্ট্রেট লাইনে রাখলে মিস হওয়ার সম্ভাবনা কম। ধর, আমি তোকে গুলি করব মাথায়… একটু দূরে গিয়ে দাঁড়া… দ্যাখ… তোর মাথার সঙ্গে কীভাবে স্ট্রেট লাইনে ‘align’ করছি ‘ফোরসাইট ইউ’…
গুলি যখন করবি, গায়ের জোরে ট্রিগার চাপবি না। সামান্য চাপই যথেষ্ট। আর হ্যাঁ, যেটা মোস্ট ইম্পরট্যান্ট, কাঁধ থেকে হাতের কবজি অবধি পুরো সোজা রাখবি, টানটান। একদম ‘locked’ থাকবে ওই অংশটা, ‘muscle movement’ হবে মিনিমাম। যা বললাম, বুঝলি? গুলি না ভরে, যেভাবে বললাম, কয়েকদিন ‘dry practice’ করলেই দেখবি সড়গড় হয়ে যাবে। এবার, এই নে তোর বুলেট।
কাঁধের ঝোলা থেকে মহিলা বার করেন চামড়ার ছোট থলি, উপুড় করে দেন টেবিলে। ঠনঠন শব্দে ছড়িয়ে পড়ে এক ডজন কার্তুজ। যুবতী চেম্বারে বুলেট ভরার মহড়া শুরু করেন। এক… দুই… তিন… চার।
‘দিদি’ দেখতে থাকেন নিষ্পলক। একটু পরে ধীর গলায় জিজ্ঞেস করেন, কী রে, পারবি তো?
যুবতী চোখ তুলে তাকান। হাসিখুশি মুখটা বদলে গিয়েছে কঠিন সংকল্পে। ‘দিদি’ আর একটি প্যাকেট বার করেন ঝোলা থেকে।
—এটা রেখে দে।
—কী এটা?
—পটাশিয়াম সায়ানাইড।
.
কী আছে এখানে আজ? কোনও হোমরাচোমরা আসছেন? এত পুলিশ কেন?
কলেজ স্ট্রিট চত্বরে সেদিন সকাল থেকেই তুঙ্গ ব্যস্ততা। অন্যদিন বেলা বাড়তে কখনওসখনও দেখা মেলে জোড়াসাঁকো থানার টহলদারি গাড়ির। আজ অন্য ছবি। ভোর থেকেই এলাকায় চক্কর দিচ্ছে পুলিশের একাধিক গাড়ি। রাস্তার মোড়ে মোড়ে মোতায়েন সশস্ত্র পুলিশকর্মী। যারা বন্দুক উঁচিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। সাদা পোশাকে কিছু বলিষ্ঠ চেহারার লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে যত্রতত্র। সজাগ দৃষ্টি তাঁদের। এক ঝলক দেখলেই বোঝা যায়, এরা পথচারী নন। প্লেন ড্রেসে পুলিশই। লালবাজারের বড়কর্তারা সরেজমিনে ঘনঘন দেখে যাচ্ছেন পুলিশি ব্যবস্থা।
ব্যাপারটা কী? এত সাজসাজ রব? কেষ্টবিষ্টু আসছেন কোনও? কে?
স্বয়ং বড়লাট! বাংলার তৎকালীন রাজ্যপাল মহামহিম স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে আয়োজিত সমাবর্তন উৎসবের প্রধান অতিথি। তিনিই মানপত্র তুলে দেবেন সফল ছাত্রছাত্রীদের হাতে। বহু গণ্যমান্য অতিথির সমাবেশ ঘটতে চলেছে অনুষ্ঠানে। নিরাপত্তা নিয়ে ন্যূনতম ঝুঁকি নিতে নারাজ কলকাতা পুলিশ। বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে তৈরি হয়েছে নিশ্ছিদ্র চক্রব্যূহ। মাছিও গলতে পারবে না হাজার চেষ্টা করেও।
কলেজ স্ট্রিটে গাড়ি ঢুকছে একের পর এক, থামছে মূল প্রবেশদ্বারের সামনে। আমন্ত্রিতরা ঢুকছেন। ঢুকছে ছাত্রছাত্রীরাও দল বেঁধে, হইহল্লা করতে করতে। পোশাক আলাদা আজ। রোজকার ধুতি-শার্ট-প্যান্ট বা শাড়ির উপরে আজ কালো গাউন। ডিগ্রি নেওয়ার শুভমুহূর্তের প্রচলিত পরিধান। অন্যরকম সাজে ভারী সুন্দর লাগছে ছেলেমেয়ের দলকে। আজ তো ওদেরই দিন!
.
হাঁফাতে হাঁফাতে বেথুন কলেজের গেটে এসে পৌঁছন ইলা সেন। কলেজেরই ছাত্রী, উত্তেজনায় গলা কাঁপছে।
—এইমাত্র খবর পেলাম, প্রেসিডেন্সির পিকেটারদের মেরে সরিয়ে দেবে পুলিশ। লালবাজার থেকে ফোর্স রওনা দিয়েছে। প্রয়োজনে নাকি গুলি চালাবে।
—সে কী! এক্ষুনি চল!
আইন অমান্য আন্দোলনের সমর্থনে বেথুন কলেজের সামনে পিকেটিং করছিলেন ছাত্রীরা। শুধু বেথুনেরই নন, অন্য কলেজের ছাত্রীরাও রয়েছেন। ইলার মুখে খবর পেয়েই দৌড়লেন দল বেঁধে। গন্তব্য, প্রেসিডেন্সি কলেজ। যেখানে ছাত্রদের ‘বন্দে মাতরম’ স্লোগানে তখন ঝনঝনিয়ে উঠেছে বইপাড়া।
ছাত্রীরা যখন পৌঁছলেন, রণভূমির চেহারা নিয়েছে কলেজ স্ট্রিটের এ মাথা থেকে ও মাথা। পুলিশের সঙ্গে প্রবল ধস্তাধস্তি শুরু হয়েছে ছাত্রদের। পিকেটিং কিছুতেই চলতে দেবে না উর্দিধারীরা, আর ছাত্ররাও যেনতেনপ্রকারণে জারি রাখবে আইন অমান্য আন্দোলন। রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে গোলমালের জেরে। বাস-ট্রাম দাঁড়িয়ে স্থাণুবৎ।
লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে গিয়েও লাভ হচ্ছে না যখন বিশেষ, বাহিনীর নেতৃত্বে থাকা অফিসার নির্দেশ দিলেন সশস্ত্র সিপাইদের, গুলিচালনার প্রস্তুতি নিতে।
ছাত্রীদল সিদ্ধান্ত নিলেন মুহূর্তের মধ্যে। গুলি চালাবে? বললেই হল? চালাক দেখি! দেখি, কত গুলি আছে ওদের? হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে গেলেন ছাত্রদের সামনে। চালাক গুলি, তবে আগে আমাদের উপর।
সে এক দৃশ্য! মানবশৃঙ্খল তৈরি করে ফেলেছে একদল কলেজছাত্রী। ঘিরে রেখেছে প্রেসিডেন্সির বিক্ষোভরত ছাত্রদের। বিনা যুদ্ধে এক সেন্টিমিটারও জমি ছাড়ার প্রশ্নই নেই। ছাত্রীদের এহেন রণং দেহি মূর্তিতে হতচকিত হয়ে পড়ল পুলিশ, স্তিমিত হয়ে পড়ল আগ্নেয়াস্ত্রের আস্ফালন।
অফিসার থামালেন সিপাইদের। একদল নিরস্ত্র কলেজছাত্রীর উপর গুলি চালানো অসম্ভব। হিতে বিপরীত হবে। প্রতিবাদের আগুন শুধু শহরে নয়, ছড়িয়ে পড়বে দেশব্যাপী। এ ঝুঁকি নেওয়া যায় না। পিছু হঠতে বাধ্য হল পুলিশ। ব্যাক টু লালবাজার।
ফিরে যাওয়ার আগে অফিসার সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকান ছাত্রীব্যূহের একদম মাঝখানে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে। যে অবিচলিত ভঙ্গিতে একটু আগেই তাঁর চোখে চোখ রেখে চোস্ত ইংরেজিতে বলেছে, ‘Break the cordon if you must… but be sure, over our dead bodies!’
‘অবরোধ সরাতে হলে সরান, কিন্তু আমাদের মৃতদেহের উপর দিয়ে যেতে হবে!’ কে মেয়েটি? বয়স তো দেখে মনে হচ্ছে খুব বেশি হলে আঠারো-উনিশ। এই সহজাত সাহস এত অল্প বয়সে আসে কোথা থেকে?
ভাবতে ভাবতেই গাড়িতে স্টার্ট দেন অফিসার। জয়ধ্বনি কানে আসে ছাত্রছাত্রীদের। বন্দে মাতরম! কানে আসে সমস্বরে রবিঠাকুরের গান, ‘নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার…’
.
কটকের Ravenshaw Collegiate School-এর প্রধান শিক্ষক বেণীমাধব দাস। স্ত্রী সরলা আর দুই মেয়েকে নিয়ে সংসার। কল্যাণী বড়, তার চার বছরের ছোট বীণা। ইনিই সেই বেণীমাধব, যাঁর বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকার অভিযোগ এনেছিল স্কুলে স্বদেশি ভাবধারা প্রচারের, রাতারাতি বদলি করে দেওয়া হয়েছিল কৃষ্ণনগরে। ইনিই সেই প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক, যাঁর দেশপ্রেমের আদর্শ গভীর প্রভাব ফেলেছিল কটকের ওই স্কুলেই পাঠরত ছাত্র সুভাষচন্দ্রের চেতনায়-মননে।
কল্যাণী-বীণার শৈশব এবং কৈশোরে বাবা-মা ছাড়াও প্রভাব ছিল বড়মামার। অধ্যাপক বিনয়েন্দ্রনাথ সেনের। যাঁর প্রতিষ্ঠিত নীতি-বিদ্যালয়ের প্রভাব সে যুগে জাতির চরিত্রগঠনে ছিল সুদূরপ্রসারী।
বাবা সন্ধেবেলা গল্প বলতেন বিভিন্ন দেশের বরণীয় সমাজবিপ্লবীদের, শোনাতেন দেশের জন্য তাঁদের নিঃস্বার্থ ত্যাগস্বীকারের কাহিনি। দুই বোন ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনত মন্ত্রমুগ্ধ।
সরলা তাড়া দিতেন মেয়েদের…
—হ্যাঁ রে, তোরা শুবি না? অনেক রাত হল, কাল স্কুল আছে তো!
—মা… প্লিজ় আর একটু… বাবা গল্পটা শেষ করুক।
প্রশ্রয়ের হাসি হাসতেন সরলা। ভাবতেন, ওদের এসব শোনাই উচিত, তবে না চরিত্রের বুনিয়াদ মজবুত হবে। স্বামী-কন্যাদের সঙ্গে নিজেও যোগ দিতেন গল্পে।
সরলার বিরল সংগঠনী ক্ষমতা ছিল। ভাইয়ের প্রতিষ্ঠিত নীতি-বিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ তো ছিলই, পাশাপাশি দুঃস্থ মহিলাদের জন্য ‘পুণ্যাশ্রম’ গড়ে তুলেছিলেন একক প্রচেষ্টায়।
সেটা বিংশ শতকের প্রথমার্ধ। কল্যাণীর জন্ম ১৯০৭ সালে, বীণার’১১-য়। উদারমনস্ক শিক্ষিত পরিবারে এমন মা-বাবার ভাবধারায় বেড়ে ওঠা দুই কিশোরী যে গতানুগতিক জীবনে আকৃষ্ট হবেন না, দেশব্যাপী স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমিতে যে পরাধীনতার গ্লানিতে অবধারিত আক্রান্ত হবেন, স্বাভাবিকই ছিল।
কল্যাণীর ছিল মায়ের মতোই সাংগঠনিক দক্ষতা। ১৯২৮ সালে বিএ পাশ করার পর কলকাতায় এলেন এমএ পড়তে। সহপাঠী সুরমা মিত্র, কমলা দাশগুপ্ত প্রমুখের সহযোগিতায় গড়ে তুললেন ‘ছাত্রীসংঘ’। সভানেত্রী সুরমা, সম্পাদিকা কল্যাণী। কলকাতার স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের নিয়ে সংগঠন। ক্রমে ব্যাপ্তি বাড়ল, যোগ দিলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, সুহাসিনী গাঙ্গুলী, সুলতা করের মতো ছাত্রীরা, যাঁরা পরে সক্রিয় অংশ নেবেন দেশমুক্তির সংগ্রামে। এলেন কল্যাণীর সহোদরা বীণাও, যিনি তখন এলগিন রোডের St Johns Diocesan Girls’ Higher Secondary School-এর ছাত্রী।
‘ছাত্রীসংঘ’-র মেয়েদের দিন কাটত হইহই ব্যস্ততায়। সারাদিন ক্লাস করার পর কোনওদিন লাঠিখেলায় মেতে ওঠা ‘যুগান্তর’ গোষ্ঠীর বিপ্লবী দীনেশ মজুমদারের তত্ত্বাবধানে। কোনওদিন ছুরি চালানোর অনুশীলন লাগাতার। কখনও দল বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়া কলেজ স্কোয়ারের পুকুরে। কখনও দ্রুত সাইকেল চালানোর মহড়া। পাশাপাশি ফার্স্ট এইড-এর প্রাথমিক পাঠ নিয়মিত।
দেশে চলছে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তির নিরন্তর সংগ্রাম,‘ছাত্রীসংঘ’ সেই লড়াইয়ের আঁচমুক্ত থাকে কী করে? যে-কোনও পরিস্থিতির মোকাবিলায় নিজেদের মানসিক এবং শারীরিক ভাবে তৈরি রাখতে স্কুল-কলেজের একঝাঁক ছাত্রী ছিলেন দৃঢ়সংকল্প। জন্মভূমির হিতার্থে যে-কোনও ত্যাগস্বীকারে প্রস্তুত।
দেশ জুড়ে তখন চলছে আইন অমান্য আন্দোলন। কলেজে কলেজে শুরু হল পিকেটিং। ‘বন্দে মাতরম’ স্লোগানে মুখর হয়ে উঠল শহরের বিভিন্ন কলেজ ক্যাম্পাস। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রদের লাগাতার এবং সোচ্চার পিকেটিং চিন্তায় ফেলল লালবাজারকে।
কড়া হাতে দমনের সিদ্ধান্ত হল। অনেক হয়েছে, ছাত্র আন্দোলন এর বেশি বাড়তে দেওয়া যায় না। ফোর্স রওনা দিল কলেজ স্ট্রিটে। নির্দেশ স্পষ্ট, লাঠিপেটায় মিটে গেলে ভাল, না মিটলে প্রয়োজনে গুলি। পরের ঘটনাক্রম লিখেছি আগে, বেথুন কলেজের গেট থেকে ছাত্রীদের প্রেসিডেন্সি যাত্রা, মানবশৃঙ্খল গড়ে তোলা এবং কিংকতর্ব্যবিমূঢ় পুলিশের রণে ভঙ্গ দেওয়া।
ছাত্রীদলের নেতৃত্বে থাকা মেয়েটিকে দেখে চমৎকৃত হয়েছিলেন লালবাজারের পোড়খাওয়া অফিসার। কে ওই মেয়েটি, যে উদ্যত বন্দুকের নলকে উপেক্ষা করে সটান বলেছিল, ‘over our dead bodies?’ কী নাম ওই দৃপ্ত যুবতীর?
.
বীণা দাস। দিদি কল্যাণী ছিলেন স্থিতধী সংগঠক। বীণা তুলনায় বেশি আবেগপ্রবণ, বেপরোয়া। মিষ্টি স্বভাবের জন্য স্কুলে তুমুল জনপ্রিয়। ছাত্রীরা তো বটেই, স্কুলের সিস্টাররাও চোখে হারান বীণাকে। পরীক্ষায় প্রথম স্থান তো বাঁধাই, বিতর্কে-আবৃত্তিতে-গল্প লেখায় ধারেকাছে কেউ নেই। সিস্টারদের অনেক আশা প্রিয় ছাত্রীকে নিয়ে। অধ্যাপনা করবে, নাকি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে (ICS) বসবে? মেয়ের যা এলেম, যে পেশাতেই যাক, সিদ্ধিলাভ অনিবার্য।
বীণা অবশ্য প্রথামাফিক ‘ভাল মেয়ে’ হওয়ায় তীব্র অবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন ততদিনে। চারদিকে যা ঘটছে, নিয়মনিষ্ঠ জীবনের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানোতে মন সায় দিচ্ছে না কিছুতেই। বেথুন কলেজে ভর্তি হলেন স্কুলের পাট চুকিয়ে। দুই সহপাঠী, সুহাসিনী দত্ত এবং শান্তি দাশগুপ্ত ছিলেন একটি ছোট বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত। যাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আলাপে বীণা যেন হাতে চাঁদ পেলেন। যোগ দিলেন বন্ধুদের গোষ্ঠীতে, দেশের জন্য সীমিত সাধ্যে কিছু করার সুযোগ পেয়ে আনন্দে আত্মহারা প্রায়।
তিরিশের দশকের প্রথমার্ধ। সে বড় অস্থিরতার সময় বাংলায়। বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ডে ব্যতিব্যস্ত ব্রিটিশ প্রশাসন। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের দুঃসাহসিক প্রয়াস আলোড়ন ফেলে দিয়েছে দেশময়। কয়েকমাস পরে অগস্টের ২৫ তারিখে দোর্দণ্ডপ্রতাপ পুলিশ কমিশনার টেগার্টকে হত্যার ব্যর্থ চেষ্টা হল ডালহৌসি স্কোয়ারে। নিহত হলেন অনুজাচরণ সেনগুপ্ত। গ্রেফতার হলেন দীনেশ মজুমদার।
ঢাকায় ইনস্পেকটর জেনারেল লোম্যানকে গুলি করে হত্যা করে বিপ্লবী বিনয় বসু তখন পলাতক। কিছুদিন পরে ফের আবির্ভাব বিনয়ের, দীনেশ গুপ্ত ও বাদল গুপ্তের সঙ্গে।’৩০-এর ডিসেম্বরের ৮ তারিখে রাইটার্সের বিখ্যাত অলিন্দ যুদ্ধে ত্রিমূর্তির অভিযান, গুলি করে হত্যা অত্যাচারী পুলিশ অফিসার সিম্পসনকে।’৩১-এর শেষার্ধে দুই স্কুলকিশোরী শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী ঘটাল এক অভাবনীয় ঘটনা। কুমিল্লার ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে হত্যা করে দ্বীপান্তরিত হল যাবজ্জীবন।
প্রত্যাঘাতে প্রতিহিংসাই দস্তুর ছিল ব্রিটিশ সরকারের। ধরপাকড় শুরু হল বেপরোয়া। বীণাদের ছোট দলটির অনেকেও গ্রেফতার হলেন। বিচলিত বীণা স্থির করলেন, এবার এমন কিছু করবেন, এবং একাই করবেন, যাতে ভিত নাড়িয়ে দেওয়া যায় প্রশাসনের। আতঙ্ক গ্রাস করে পুলিশকে।
কিন্তু কী করবেন? চিন্তা করতে থাকেন সারারাত। নিদ্রাহীন।
একসময় ভাবনা আসে বিদ্যুৎঝলকের মতো, উঠে পড়েন ধড়মড়িয়ে। আজই একবার ‘দিদি’র বাড়ি যাওয়া দরকার।
.
—তুই যা বলছিস, ভেবেচিন্তে বলছিস? অত সোজা নয়…
কমলা দাশগুপ্ত প্রথমে হেসেই উড়িয়ে দেন বীণার পরিকল্পনা। কমলার জন্ম ঢাকায়, ১৯০৭ সালে। বেথুন কলেজে বিএ পড়ার সময় বিপ্লবী গোষ্ঠীর সংস্পর্শে আসেন, স্নাতকোত্তর পড়াকালীন যোগ দেন ‘যুগান্তর’ দলে। দলের প্রয়োজনে বাড়ি ছেড়ে থাকতেন একটি মেয়েদের হস্টেলের ম্যানেজার হিসাবে। বোমা-পিস্তল রাখা এবং বিপ্লবীদের সরবরাহ করার কাজ করতেন হস্টেল থেকেই। পিস্তল ব্যবহারে ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
বীণা তাঁর সহপাঠী কল্যাণীর ছোট বোন, বেথুনেরই ছাত্রী। কমলা খুব স্নেহ করেন হাসিখুশি স্বভাবের মেয়েটিকে। দেশপ্রেমের আদর্শে স্থির, কিন্তু একটু বেশি আবেগপ্রবণ। এত বড় সিদ্ধান্ত কি স্রেফ আবেগের বশে নেওয়া উচিত?
—আবেগ দিয়ে সব লড়াই হয় না বীণা, তা ছাড়া এটা বিরাট ঝুঁকি হয়ে যাবে। ধরা পড়বিই, জীবনটাই হয়তো জেলে কেটে যাবে। লড়াইটাই করতে পারবি না আর।
—শুধু আবেগ দিয়ে তো লড়ছি না দিদি। লড়ছি তো বুদ্ধি দিয়েও। ধরা পড়ব, সেটাও জানি। পালানোর জন্য তো যাচ্ছি না ওখানে। যে-কোনও শাস্তির জন্য প্রস্তুত। তুমি আর ‘না’ কোরো না, একটা রিভলভার জোগাড় করে দাও।
—যদি ফাঁসি হয় তোর?
—আমি হাসতে হাসতে চলে যাব, দেখো তুমি।
—যদি দ্বীপান্তর হয়, পারবি সহ্য করতে?
—হলেও কোনও চিন্তা নেই। ওখানে তো শান্তি-সুনীতি আছে, ওদের পড়িয়ে দিব্যি সময় কাটবে।
—পুলিশের অত্যাচার যদি সহ্য করতে না পারিস?
—সে সুযোগ ওরা যাতে না পায় সেই চেষ্টা তো করবই। পটাশিয়াম সায়ানাইড তো থাকছেই পকেটে।
কমলা বুঝে যান, এ মেয়ে মনস্থির করে ফেলেছে। একে আর বোঝানো বৃথা। তবু বোঝালেন পরের কয়েকদিন আপ্রাণ। বীণা অনড় থাকলেন সিদ্ধান্তে। ঘনিষ্ঠ সহযোগী সুধীর ঘোষের সঙ্গে পরামর্শ করলেন কমলা। রিভলভার কেনার ২৮০ টাকা জোগাড় করলেন, যা দিয়ে সুধীর ব্যবস্থা করলেন আগ্নেয়াস্ত্রের। পাঁচ চেম্বার বিশিষ্ট .৩৮০ বোরের বেলজিয়ান রিভলভার। কমলা যা হাতে তুলে দিলেন বীণার, সঙ্গে কার্তুজ আর পটাশিয়াম সায়ানাইড। বিশদে বুঝিয়ে দিলেন অস্ত্র ব্যবহারের পদ্ধতি।
—এইটা হল ব্যারেল, ট্রিগারে চাপ দিলে যেখান থেকে গুলি ছুটবে… শুটিংয়ে আসল কথা কিন্তু ‘গ্রিপ’… তুই কীভাবে অস্ত্রটাকে ধরছিস…
.
৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩২। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হল গমগম করছে। তিলধারণের স্থান নেই।
—আজ আমরা সমবেত হয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক সমাবর্তন উৎসবে। উপস্থিত ছাত্রছাত্রীদের কাছে আজ এক গর্বের দিন। গর্ব আমাদেরও, কারণ, আজকের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করছেন বাংলার মহামান্য রাজ্যপাল স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন। যাঁর কাছে আমরা সবিশেষ কৃতজ্ঞ তাঁর মহামূল্যবান সময়ের কিছুটা আমাদের জন্য ব্যয় করতে সম্মত হওয়ায়।’
চতুর্থ সারিতে বসা বীণার কানে একটা শব্দও ঢুকছে না। চারপাশে একবার তাকায়। হলভর্তি লোক মনোযোগ দিয়ে শুনছে উপাচার্যের স্বাগত ভাষণ। বিরক্ত লাগে বীণার। এত মন দিয়ে কী শুনছে এরা? একই থোড়-বড়ি-খাড়া, খাড়া-বড়ি-থোড়ই তো চলে আসছে বছরের পর বছর। কখন শেষ হবে এই চর্বিত চর্বণ? কখন শুরু হবে রাজ্যপালের অভিভাষণ?
কালো গাউনের ভিতরের ডান দিকের পকেটে রাখা আগ্নেয়াস্ত্রের উপর একবার হাত বুলিয়ে নেয় সে। পটাশিয়াম সায়ানাইড রাখা আছে বাঁ দিকের পকেটে। আলতো ছুঁয়ে দেখে। মনে মনে আর একবার ঝালিয়ে নেয় প্ল্যান।
স্ট্যানলি জ্যাকসনকে মারতে হবে, যখন ভাষণ দিতে উঠবেন, শুরু করবেন বক্তৃতা। এখন মঞ্চের মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন মাঝের চেয়ারে। দু’পাশে আরও আটটা চেয়ারে বাকি বিশিষ্টরা। এখন কিছু করা মুশকিল। ঠিকই করে এসেছে সে, যখন বক্তৃতা দেবেন পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে, তখনই মোক্ষম সময়। কিন্তু ভাষণটা শুরু হবে কখন? আর কত দেরি? উসখুস করতে থাকে সে। শুভস্য শীঘ্রম।
—এখন বক্তব্য পেশ করবেন প্রধান অতিথি স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন, যাঁর মূল্যবান উপদেশ ছাত্রছাত্রীদের আগামীদিনের চলার পথে পাথেয় হয়ে থাকবে।
বীণার স্নায়ু টানটান হয়ে ওঠে নিমেষে। অবশেষে! উপস্থিত সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ব্রিটিশরাজের প্রভুত্বে প্রকাশ্য আঘাত হানার। রিভলভারে শেষবারের মতো হাত বুলিয়ে নেয় বীণা। কী কী যেন বলেছিল কমলাদি? গ্রিপটাই আসল… ফোরসাইট ইউ… আর যেন কী? মনে পড়ছে না কেন? কতবার ড্রাই প্র্যাকটিস করেছে গত সপ্তাহে, হিসাব নেই কোনও। তবু গুলিয়ে যাচ্ছে কেন শেষ সময়ে? গলাটাও একটু শুকিয়ে গেছে যেন। একটু জল পেলে ভাল হত। এমন হচ্ছে কেন? ভয়?
মানসিক অস্থিরতায় চিরকাল যা করে এসেছেন, সেটাই করেন বীণা। বাবাকে স্মরণ করেন। বেণীমাধব প্রায়ই বলেন, জীবনে অনেক ঝড়ঝাপটা আসবে, ভয় পাবি না কখনও। ভয়কে জয় করা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। আদর্শে যদি বিশ্বাস স্থির থাকে, ‘ভয়’ নিজেই ভয় পেয়ে পালাবে। বুক চিতিয়ে দাঁড়াবি ‘ভয়ের’ সামনে।
রাজ্যপালকে খুন করেছে আদরের মেয়ে, এটা জানলে কি বাবা খুশি হবেন? মনে হয় না। বরং ৬৭/১ একডালিয়া রোডের বাড়িতে বসে বাবা দুঃখ পাবেন খুব, মা-ও। বেণীমাধব নিখাদ দেশপ্রেমিক, কিন্তু উগ্র সহিংস আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন না কোনওদিন। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি, সহিংস না হয়ে উপায়ই বা কী আর? শাসকের উগ্র দমনপীড়নের মুখে কতদিন আর অহিংস থাকা যায়? কতদিন অন্য গাল বাড়িয়ে দেওয়া যায় এক গালে থাপ্পড় খাওয়ার পর? বীণা উঠে পড়েন চেয়ার ছেড়ে।
—Ladies and Gentlemen, distinguished guests and my dear students…
It is indeed a privilege for me…
মধ্যপথে থেমে যান দীর্ঘদেহী রাজ্যপাল। ওই কালো গাউন পরা মেয়েটি চেয়ার ছেড়ে ওভাবে ছুটে আসছে কেন তাঁর দিকে? কী বার করছে ওটা? আরে, ওটা তো রিভলভার!
জ্যাকসন ছিলেন শারীরিক ভাবে অত্যন্ত সক্ষম। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ক্রিকেটার ছিলেন। ইংল্যান্ডের হয়ে কুড়িটা টেস্ট খেলেছিলেন। মূলত ব্যাটসম্যান এবং পার্টটাইম বোলার। পরিসংখ্যান, টেস্ট কেরিয়ারে মোট রান ১৪১৫, গড় ৪৮.৭৯। পাঁচটি সেঞ্চুরি সহ। উইকেট ২৪, গড় ৩৩.২৯।
প্রথম বুলেট যখন ছিটকে এল বীণার রিভলভার থেকে, জ্যাকসন মাথা সরালেন নিমেষে, বাউন্সারে ‘ডাক’ করার ভঙ্গিতে। বাঁচিয়ে দিল স্বভাবজাত ক্রিকেটীয় রিফ্লেক্স, মাথার দু’ ইঞ্চি পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল বুলেট। হুলুস্থুল পড়ে গেল সেনেট হলে। উপাচার্য হাসান সুহরাওয়ার্দী চকিতে মঞ্চ থেকে নেমে চেপে ধরলেন বীণার ঘাড়। প্রথম গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় বীণাকেও দিশেহারা দেখাচ্ছে তখন। ট্রিগার চাপলেন মরিয়া, পরপর তিনবার। জ্যাকসন ততক্ষণে সরে গিয়েছেন একপাশে, গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। সেনেট হলে উপস্থিত সাদা পোশাকের পুলিশ ঘটনার আকস্মিকতার ঘোর কাটিয়ে ধরে ফেলল একুশ বছরের যুবতীকে। পটাশিয়াম সায়ানাইডের প্যাকেটে হাত দেওয়ার আগেই।
খবর ছড়িয়ে পড়ল উল্কাগতিতে। ডিগ্রি নেওয়ার অনুষ্ঠানে গভর্নরের উপর গুলি চালিয়েছে এক ছাত্রী। অল্পের জন্য প্রাণরক্ষা হয়েছে রাজ্যপালের।
পরের দিনের কাগজে হেডিং : ‘Girl assassin shoots at Governor, misses target.’
.
বীণাকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হল ইলিসিয়াম রো (বর্তমানের লর্ড সিনহা রোড)-র অফিসে। সেখান থেকে লালবাজার। জিজ্ঞাসাবাদে শারীরিক নির্যাতন ততটা ছিল না, যতটা ছিল অসম্মানজনক প্রশ্নাবলিতে মানসিক নির্যাতন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বীণা মুখ খুললেন না পুলিশকর্তাদের শত চেষ্টাতেও। সন্দেহের বশবর্তী হয়ে পুলিশ ধরল কমলাকেও, মার্চের পয়লা তারিখ। ছয় বছরের কারাবাস বরাদ্দ হল কমলা দাশগুপ্তের।
বীণার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হল ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৭ (খুনের চেষ্টা) ধারা এবং অস্ত্র আইনে। ডায়াসেশন স্কুলের হস্টেলের একটি ঘরে লুকিয়ে রেখেছিলেন কিছু গুলি। যা উদ্ধার করল পুলিশ। বীণা নির্দ্বিধায় দোষ কবুল করে নেওয়ায় বিচারপর্ব সম্পন্ন হল দিনসাতেকের মধ্যেই। রায় বেরল ১৫ ফেব্রুয়ারি। নয় বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।
কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বীণা ঘোষণা করলেন সদর্পে, ‘হ্যাঁ, আমি রাজ্যপালকে মারতে চেয়েছিলাম। দুর্ভাগ্য, পারিনি। স্ট্যানলি জ্যাকসন আমার পিতৃপ্রতিম, তাঁর বা তাঁর পরিবারের প্রতি আমার কোনও ব্যক্তিগত বিদ্বেষ নেই, কখনও ছিল না। কিন্তু তিনি এমন এক সরকারের প্রতিভূ, এমন এক শাসনব্যবস্থার মূর্ত প্রতীক, এমন এক supreme symbol, যা আমার দেশকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রেখেছে দমনপীড়নের মাধ্যমে। আমি আঘাত হানতে চেয়েছিলাম সেই প্রতীকের উপর।’
জ্যাকসন বেঁচে গিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু চেষ্টা বৃথা যায়নি বীণার। তাঁর অকুতোভয় অভিযান যে ব্রিটিশ সরকারকে আমূল নাড়িয়ে দিয়েছিল, সমসময়ের নথিপত্রে তার প্রমাণ মেলে। শাসকের বিরুদ্ধে শাসিতের ক্রোধ-ক্ষোভ-ঘৃণা কোন অসহনীয় পর্যায়ে গেলে কলেজছাত্রী রাজ্যপালকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় কনভোকেশনে, বুঝতে বাকি থাকেনি প্রশাসনের। রাতারাতি নিরাপত্তা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীদের। যাঁদের সাময়িক হলেও আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল প্রাণভয়।
কারাবাসের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার দু’বছর আগে রাজবন্দিনি হিসাবে মুক্তি পান বীণা, ১৯৩৯ সালে। যোগ দেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে। সক্রিয় অংশ নেন ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে। ফের গ্রেফতার বরণ, তিন বছরের কারাবাস। Bengal Provincial Legislative Assembly (স্বাধীনতার পর West Bengal Legislative Assembly)-র সদস্যা ছিলেন ১৯৪৬-৫১। স্বাধীনতা যখন আসন্ন, লিখেছিলেন নিজের জীবনকথা, ‘শৃঙ্খল-ঝঙ্কার’। সহযোদ্ধা বিপ্লবী যতীশ ভৌমিকের সঙ্গে বিবাহ স্বাধীনতা প্রাপ্তির বছরে।
শেষ জীবন কাটিয়েছিলেন পাহাড়ের কোলে, হৃষীকেশে। প্রয়াণ ১৯৮৬-র ২৬ অক্টোবর। অবহেলায়, একাকী, লোকচক্ষুর অন্তরালে।
.
অগ্নিযুগের বাংলায় নারীশক্তির ভূমিকা এবং অবদান নিয়ে বইপত্র আছে কিছু। গবেষণাও যে অমিল, এমন নয়। কিন্তু বীণা দাসের মতো অগণিত দেশব্রতী নারী আত্মত্যাগের যে দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছেন স্বাধীনতা সংগ্রামের অভিযাত্রায়, তা যে প্রাপ্য প্রচার এবং মূল্যায়ন থেকে অনেকাংশে বঞ্চিতই থেকেছে ইতিহাসের পাতায়, লেখাই যায় সংশয়হীন।
ভুল শুধরে নেওয়ার সময় এসেছে। সময় এসেছে বাংলার বিপ্লবী নারীদের অবদানের পুনর্মূল্যায়নের। সময় এসেছে মনে রাখার, ‘অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’।