১০. কেয়া আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে

।। ১০।।

দিনুকাকার বাড়িতে গিয়ে দেখি কেয়া আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। বলল, “বাবা একটু টায়ার্ড, আমি তোমাদের নিয়ে যাচ্ছি।”

“কোথায়?”

“তিমিরের অফিসে।”

“দিলীপবাবু স্যাম গ্রোভারের ব্যাপারটা জানেন কি?” একেনবাবু প্রশ্ন করলেন।

“আমি বলে দিয়েছি,” কেয়া বলল, “এখন জানেন।”

“আচ্ছা ব্যাপারটা কী?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“আহ, চলো না দেখবে।”

.

তিমিরের অফিসে পৌঁছে আমি পুরো সারপ্রাইজ। ঘরের মধ্যে যারা ছিল, তাদের সবাইকে চিনি। শুধু একজনকে ছাড়া। লম্বা দোহারা চেহারা, স্পোর্টস জ্যাকেট, চোখে চশমা। নাদিয়ার পাশে বসে আছেন, নিশ্চয়ই সুব্রত।।

“আসুন, আসুন,” বলে তিমির আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। “অন্যদের আপনারা বোধহয় চেনেন,” বলে সুব্রতর সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন।

“মিস্টার দত্তের ফিউনারেলের ব্যাপারে আমরা একটু আলোচনা করছিলাম। দু’-একটা ফর্মালিটির ব্যাপার তো আছে, সেই নিয়েই আলোচনা।”

“ভালোই হল স্যার, এখানেই সবাইকে পেলাম। আমারও দু’-একটা কনফিউশন আছে। এঁরা যখন আছেন, সেগুলো মিটিয়ে ফেলতে পারব।”

“কীসের কনফিউশন বলুন তো?” তিমির জিজ্ঞাসা করলেন।

“আমি খালি স্যার চিন্তা করছি, খুনটা করে লাভ কার হল?”

“তার মানে?” প্রশ্নটা করলেন দিলীপ শর্মা।

“অজয়বাবুর বহু টাকা থাকলে নাদিয়া ম্যাডামকে সন্দেহ করা যেত। কিন্তু তা তো ছিল না –তাই না?”

“যদ্দুর জানি, না।” দিলীপবাবুই সবার হয়ে উত্তর দিলেন।

“খুব বড় রকমের লাইফ ইন্সিওরেন্সও ছিল না, সুতরাং সেখান থেকেও তেমন কোনো প্রাপ্তি নেই।” নাদিয়ার দিকে তাকিয়ে খানিকটা আত্মগত হয়েই কথাটা বললেন একেনবাবু।

প্রথমেই নাদিয়ার নাম ওঠায়, নাদিয়ার মুখে একটা ছায়া দেখছিলাম, সেটা চলে গেল।

“এখন স্যাম গ্রোভার নাদিয়া ম্যাডামের প্রেমে পাগল ছিলেন। নাদিয়া ম্যাডাম ওঁকে বিয়ে না করে বাদামি চামড়ার অজয়বাবুকে বিয়ে করে বসলেন! তার জন্যে কি স্যাম গ্রোভার অজয়বাবুকে খুন করতে পারেন স্যার?” এবার দিলীপ শর্মার দিকে তাকালেন। একেনবাবু।

“এরকম তো মাঝে মাঝে হয়।” দিলীপবাবু একটু থতমত খেয়েই বললেন।

“ঠিক। কিন্তু স্যাম গ্রোভার তো জানতেন না যে, নাদিয় ম্যাডাম অজয়বাবুকে বিয়ে করেছেন।”

“তাহলে ই-মেলটা কে পাঠাল? আর বিয়ের প্রশ্ন আসছে কেন, প্রেমিককেও তো মানুষ খুন করে।” এবার সুব্রতবাবু মুখ খুললেন।

“ট্রু স্যার, ট্রু। আবার বন্ধুকেও মানুষ খুন করে। মানছি, ই-মেলটা একটা পাজল স্যার। প্রথমে ভেবেছিলাম, স্রেফ মজা করার জন্যে! কিন্তু না, তা ঠিক নয়।”

“তাহলে?” সুব্রত প্রশ্ন করলেন।

“আপনি যখন প্রশ্নটা তুললেন স্যার, তখন বলেই দিই। অজয়বাবুকে খুন করার একটাই মোটিভ হতে পারে যে উনি কোনো একটা সিক্রেট জেনে ফেলেছিলেন, যেটা খুনির পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক।”

.

হঠাৎ মনে হল ঘরটা নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।

“কী সিক্রেট?” এবার তিমির প্রশ্নটা করলেন, কিন্তু মুখে মনে হল একটা চাপা হাসি। “সেটায় আসছি স্যার, কিন্তু তার আগে বলি নেভাড়া নিয়ে আমার একটু কনফিউশন আছে স্যার।”

“কীরকম?” তিমির জিজ্ঞেস করলেন।

“আমি সুব্রতবাবুকেই জিজ্ঞেস করি। উনি হয়তো বলতে পারবেন?”

“কী কনফিউশন, বলুন?”

“স্যার, নেভাডাতে ম্যাডাম নাদিয়া আর অজয়বাবুর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে আপনি হঠাৎ ক্যালিফোর্নিয়াতে চলে গেলেন– সেটাই ম্যাডাম নাদিয়া আমাদের বলেছেন। সেটা কি ঠিক?”

“হ্যাঁ।”

“তার মানে স্যার ওঁদের বিয়ের খবরটা আপনি জানতেন না?”

“বিয়ের পর নাদিয়া ফোন করে জানিয়েছিল।”

“ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার। আপনার এত বন্ধু অজয়বাবু, তিনি বিয়ে করছেন। আপনি এত কাছে আছেন –তাও আপনাকে ডাকলেন না?”

“এর উত্তর যে দিতে পারত, সে তো নেই।”

“তা ঠিক স্যার। কিন্তু আপনার কী মনে হয়?”

“আমি কী বলব বলুন।”

“আপনি বিয়ের খবরটা জানার পরেও আর ওঁকে ফোন করেননি?”

“না।”

“কেন বলুন তো?”

“বলতে পারেন আমার অভিমান হয়েছিল।”

“রাইট স্যার। কিন্তু আপনি ম্যাডাম নাদিয়াকে প্রচুর সাহায্য করেছেন বাড়ি দেখে দেওয়া, জিনিসপত্র সেখানে তুলে দেওয়ার ব্যাপারে।”

“কারণ নাদিয়া আমার বন্ধু এবং অজয়ের স্ত্রী। আর অজয়ের ওপর অভিমান হলেও সে আমার বন্ধুই ছিল।”

“অন্য কোনো ব্যাপার নিয়ে আপনার সঙ্গে অজয়বাবুর মনোমালিন্য হয়নি?”

“অন্য ব্যাপার মানে?”

“এই ধরুন, আপনার কোনো একটা গোপন ব্যাপার অজয়বাবু জেনে ফেলেছেন –সে নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি।”

“হোয়াট ননসেন্স!” এবার সুব্রত সত্যিই বিরক্ত।

“ঠিক আছে স্যার, এ নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন নয়। এবার শুধু বলুন, আপনারা কি অজয়বাবুর গাড়িতে নেভাডা গিয়েছিলেন না আপনার গাড়িতে?”

“আমার গাড়িতে।”

“তা আপনি তো স্যার ক্যালিফোর্নিয়া চলে গেলেন ওঁদের দু’জনকে ফেলে!”

“না ফেলে রেখে যাইনি। আমি গাড়ির চাবি অজয়কে দিয়ে গিয়েছিলাম। যাতে ওরা সময়মতো ফিরতে পারে।”

“এটা ঠিক কাজ করেছিলেন স্যার। কিন্তু গাড়ির কথায় মনে পড়ে গেল, তিমিরবাবু বলছিলেন, আপনার গাড়ি নাকি এই ক’দিন আগে সারানোর পরে দু’দিনের মধ্যে আবার খারাপ হয়ে গিয়েছিল?”

“ঠিকই বলেছেন।”

“এই দু’দিন কি আপনি নানান জায়গায় ঘুরেছেন –সেইজন্য?”

“না, শুধু অফিসে গেছি আর ফিরেছি।”

“কত দূরে আপনার অফিস স্যার?”

“মিনিট কুড়ির পথ।”

“ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার।” বলে একেনবাবু তিমিরের দিকে তাকালেন, “আচ্ছা তিমিরবাবু, আপনি কি জানেন সুব্রতবাবুর গাড়িটা দু’দিনে কত মাইল চলেছে?”

“হ্যাঁ, আড়াইশো মাইলের মতো।”

আমি এবার বুঝতে পারলাম, পুরোটাই সাজানো নাটক। তিমিরের সঙ্গে আগেই একেনবাবুর এ নিয়ে কথা হয়েছে। সুব্রতও কেমন জানি থতমত খেয়ে গেল।

“তিমিরবাবু এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছেন স্যার। আপনি যে হন্ডা ডিলারের কাছে দু’বার নিয়ে গেছেন, তারাই বলেছে। রিপেয়ার শপে ঢোকানোর সময়ে গাড়ির মাইলেজ লিখে রাখে কিনা।”

“তা হলে নিশ্চয়ই ভুল করেছে প্রথমবার।”

“দ্বিতীয়বার নয় কেন স্যার?”

“দ্বিতীয়বারও করতে পারে।”

“না স্যার, দ্বিতীয়বার নয়। দ্বিতীয়বার করলে, এক্ষুনি ভেরিফাই করা যেত, তাই না?”

“আপনি কী বলতে চাচ্ছেন বলুন তো?” এবার সুব্রত বিরক্ত হয়ে উঠে পড়ল।

“আপনি উত্তেজিত হবেন না স্যার, বসুন। তার আগে আর একটা কথা বলুন স্যার, আপনাকে কি বছর দুই আগে নাদিয়ার স্বামী বা স্বামীর কোনো বন্ধু ই-মেলে ভয় দেখিয়েছিলেন?”

“আমরা ও রকম অনেক ইমেলই পেয়েছি।”

“আমি শুধু আপনার কথা জিজ্ঞেস করছি। আর শুধু একটা বিশেষ ইমেল- এর কথা –যেখানে নাদিয়ার নাম উল্লেখ করা ছিল।”

আমি স্পষ্ট দেখলাম সুব্রতর চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছে।

“আপনি এসব প্রশ্ন করার কে?”

তিমির এবার মুখ খুললেন, “ধরুন প্রশ্নটা আমিই করছি।”

“উত্তর হচ্ছে ‘না’।”

.

উত্তরটা শুনে তিমির একেনবাবুর দিকে তাকালেন।

“আপনাকে একটা কথা বলি স্যার, আপনি যদি ই-মেলটা ডিলিটও করে থাকেন, ওটা কিন্তু পুলিশের এক্সপার্টরা হার্ড ডিস্ক থেকে বার করতে পারবে। এবং গত কয়েকদিন আপনি কীভাবে কোথায় ইমেল পাঠিয়েছেন স্বনামে বা বেনামে- সেটাও কিন্তু বার করা যাবে।”

“আমি যেখানে বা যাকেই ই-মেল পাঠাই না কেন, তাতে কী এসে যায়?”

“কারণ ওটা দিয়ে স্যার একজনকে মিথ্যে করে খুনি সাজানো হচ্ছে। বোঝানো হচ্ছে, যে অজয়বাবুকে খুন করেছে, সে নাদিয়া ম্যাডামের প্রেমে পাগল এবং লোকটা আবার ভাল বাংলা জানে না! এরকম একটা লোক তো আছে স্যার।”

“সেটা কেন আমি করতে যাব?”

“সেটাই আমার প্রশ্ন স্যার, আপনি কেন সেটা করতে যাবেন, কারণ ম্যাডাম নাদিয়াকে আপনি ভালবাসেন এবং ওঁকে বিয়েও করেছেন। শুধু নামটা ব্যবহার করেছেন অজয়বাবুর। কেন?”

“তার মানে! সেটা করা কি এতই সোজা?” তিমির এবার গম্ভীরভাবে বললেন,”আইডেন্টিটি থেফট এখন আকচার হচ্ছে। বিয়েটা তো হয়েছে নেভাডাতে –সব কিছুই ওখানে একটু ঢিলেঢালা। একটা ড্রাইভার্স লাইসেন্স, সোশ্যাল সিকিউরিটি নম্বর।”

“রাইট স্যার। অজয়বাবুর ড্রাইভিং লাইসেন্স আপনি হাতিয়েছিলেন। আপনার দু’জনের চেহারার তফাত ছবিতে চট করে ধরা পড়বে না। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল, কী সেই সিক্রেট, যার জন্যে আপনাকে তড়িঘড়ি এসে খুন করতে হল, ম্যাডাম নাদিয়াকে এত অ্যাক্টিং করতে হল!”

“আমি এই অদ্ভুত অভিযোগের কোনো উত্তর দেব না।”

“আপনি উত্তর না দিলেও স্যার, ম্যাডাম নাদিয়া হয়তো দেবেন। তবে শুধু এটুকু বলি অজয়বাবু দেশ থেকে ফিরে খুন হবার আগে তিমিরবাবুর কাছে দু’-একটা কথা ইতিমধ্যেই বলে গেছেন অলিভারের মৃত্যু সম্পর্কে। কে সেই মাশরুমগুলো জোগাড় করেছিলেন……..।

নাদিয়া দেখি ভয় থরথর করে কাঁপার পর ফোঁপাতে শুরু করেছে! “আই ওয়ার্ড হিম নট টু….।” তারপরের কথাগুলো কান্নার মধ্যে জড়িয়ে গেল।