১০. কৃষ্ণগহ্বরের কণাবাদী বলবিদ্যা*
[* ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকা’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ।]
এই শতাব্দীর প্রথম তিনটি দশক তিনটি তত্ত্বের উত্থান দেখেছে। এ তত্ত্বগুলো পদার্থবিদ্যা এবং বাস্তবতা সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন এনেছে। পদার্থবিদরা এখনও এগুলোর নিহিতার্থ অনুসন্ধান করছেন আর চেষ্টা করছেন এগুলোকে পরস্পরের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে। তিনটি তত্ত্ব হল : বিশিষ্ট অপেক্ষবাদ (১৯০৫), ব্যাপক অপেক্ষবাদ (১৯১৫) এবং কণাবাদী বলবিদ্যার তত্ত্ব (১৯২৬)। প্রথম তত্ত্বটির প্রধান দায়িত্ব ছিল অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের, দ্বিতীয় তত্ত্বটির সম্পূর্ণ দায়িত্ব ছিল তাঁর এবং তৃতীয় তত্ত্বটির বিকাশে একটা প্রধান ভূমিকা ছিল আইনস্টাইনেরই, তবুও আইনস্টাইন কখনোই কণাবাদী বলবিদ্যাকে মেনে নেননি। তার কারণ এ তত্ত্বে আপতন (chance) এবং অনিশ্চয়তার উপস্থিতি। তার মনের ভাব প্রকাশ পায় তার বহু উল্লিখিত বিবৃতিতে : ঈশ্বর জুয়া খেলেন না। অধিকাংশ পদার্থবিদই কিন্তু বিশিষ্ট অপেক্ষবাদ এবং কণাবাদী বলবিদ্যা সহজেই মেনে নিয়েছিলেন। তার কারণ এ তত্ত্বগুলোর দেওয়া বিবরণ প্রত্যক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। অন্যদিকে ব্যাপক অপেক্ষবাদ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অগ্রাহ্য করা হয়েছিল, কারণ তত্ত্বটিকে মনে হয়েছিল গাণিতিকভাবে খুবই জটিল। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগারে এর সত্যতা পরীক্ষা করা যায় না এবং এটা ছিল একটা বিশুদ্ধ চিরায়ত তত্ত্ব, যার সঙ্গে কণাবাদী বলবিদ্যাকে মানিয়ে নেওয়া যায় না। সেজন্য, প্রায় পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত ব্যাপক অপেক্ষবাদ নিয়ে কেউ বিশেষ নাড়াচাড়া করেনি।
১৯৬০ এর দশকের প্রথম দিকে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক পর্যবেক্ষণ খুবই বাড়তে শুরু করে। ফলে ব্যাপক অপেক্ষবাদের চিরায়ত তত্ত্বে আকর্ষণ পুনরুজ্জীবিত হয়। তার কারণ কোয়াসার (quasar), পালসার (pulsar) এবং ঘনবিন্যস্ত X রশ্মির উৎস (compact X Ray sources) এর মতো যে সমস্ত নতুন পরিঘটনা আবিষ্কৃত হচ্ছিল, সেগুলোর ইঙ্গিত ছিল অতি শক্তিশালী মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের অস্তিত্বের। এই ক্ষেত্রগুলোর বিবরণ শুধুমাত্র ব্যাপক অপেক্ষবাদের সাহায্যেই দেওয়া যেতে পারে। কোয়াসাররা তারকার মতো বস্তুপিণ্ড, তবে সেগুলো নিশ্চিতভাবে সম্পূর্ণ নীহারিকাগুলোর চাইতে বহু গুণ উজ্জ্বল। অবশ্য তাদের বর্ণালির রক্তিমতা যা নির্দেশ করে ওগুলো যদি ঐরকম দূরত্বে অবস্থিত হয় তাহলে। পালসারগুলো সুপারনোভা বিস্ফোরণের অবশিষ্টাংশ। এগুলো দ্রুতহারে মিটমিট করে। বিশ্বাস করা হয় পালসারগুলো অতি ঘন নিউট্রন তারকা। ঘনসন্নিবিষ্ট x রশ্মির উৎসগুলো মহাকাশযানের ভিতরকার যন্ত্রপাতি দিয়ে আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলো নিউট্রন তারকা হতে পারে। কিংবা হতে পারে আরও উচ্চতর ঘনত্ববিশিষ্ট প্রকল্পিত বস্তুপিণ্ড (hypothetical objects) অর্থাৎ কৃষ্ণগহ্বর।
যে পদার্থবিদরা এই নব আবিষ্কৃত কিংবা প্রকল্পিত বস্তুপিণ্ডগুলোতে ব্যাপক অপেক্ষবাদ প্রয়োগ করতে চেষ্টা করেছিলেন তাঁদের একটা সদস্যা ছিল এই তত্ত্বকে কণাবাদী বলবিদ্যার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া। গত কয়েক বছরে এমন কিছু উন্নয়ন হয়েছে, যা থেকে আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে আমরা মহাকর্ষের একটা সুসঙ্গত কণাবাদী তত্ত্ব পাব। এই তত্ত্বের স্থলসত্বক (macroscopic) বস্তুপিণ্ডগুলো সাপেক্ষ ব্যাপক অপেক্ষবাদের সঙ্গে মতৈক্য থাকবে এবং আশা করা যায়, এগুলো গাণিতিক অসীমত্ব থেকে মুক্ত থাকবে। এই অসীম তত্ত্বগুলো অন্যান্য কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্বগুলোর ঘাড়ে বহুদিন ভূতের মতো চেপে বসে আছে। এই বিকাশগুলোর অধুনা আবিষ্কৃত কৃষ্ণগহ্বরের সঙ্গে যুক্ত কোয়ান্টাম ক্রিয়া নিয়ে কাজ করতে হবে। কৃষ্ণগহ্বরগুলোর এবং তাপগতিবিদ্যার বিধিগুলোকে উল্লেখযোগ্যভাবে সংযুক্ত করে এই বিকাশগুলো।
কি করে কৃষ্ণগহ্বরের সৃষ্টি হতে পারে সেটা আমি সংক্ষেপে বলছি। সূর্যের চাইতে দশ গুণ ভরসম্পন্ন একটা তারকা কল্পনা করুন। এর জীবনকাল হবে প্রায় এক হাজার কোটি বছর। এর অধিকাংশ সময়ই তারকাটি অক্সিজেনকে হিলিয়ামে রূপান্তর করে নিজের কেন্দ্রে তাপ উৎপন্ন করবে। মুক্ত শক্তি তারকাটিকে তার নিজস্ব মহাকর্ষ থেকে রক্ষা করার মতো যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করবে। ফলে, এমন একটা বস্তুপিণ্ড সৃষ্টি হবে যার ব্যাসার্ধ সূর্যের ব্যাসার্ধের পাঁচ গুণ। ঐ রকম একটা তারকার পৃষ্ঠ থেকে পলায়ন করে মুক্ত হওয়ার মতো গতিবেগ হবে সেকেন্ডে প্রায় ১০০০ কিলোমিটার। অর্থাৎ যদি তারকাটির পৃষ্ঠ থেকে একটা বস্তুপিণ্ডকে উল্লম্বভাবে সেকেন্ডে ১০০০ কি. মি.-র কম গতিবেগে নামিয়ে নিয়ে আসবে এবং সেটা তারকার পৃষ্ঠে ফিরে আসবে। তবে এর চাইতে বেশি গতিবেগসম্পন্ন একটা বস্তুপিণ্ড অসীমে মুক্ত হবে।
তারকাটির কেন্দ্ৰকীয় (nuclear) জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে তার বহির্মুখ চাপ রক্ষা করার মতো কিছু থাকবে না এবং তারকাটি তার নিজস্ব মহাকর্ষের ফলে চুপসে যেতে শুরু করবে। তারকাটি যেমন সঙ্কুচিত মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রও ততই শক্তিশালী হবে এবং পলায়নের গতিবেগ (escape velocity) বৃদ্ধি পাবে। ব্যাসার্ধ ৩০ কি. মি. তে নেমে এলে পলায়নের গতিবেগ বৃদ্ধি পেলে সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কি. মি. হবে অর্থাৎ আলোকের গতিবেগের সমান হবে। তারপর থেকে নির্গত কোন আলোকই অসীমে নিষ্ক্রমণ করতে পারবে না। সে আলোক মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের আকর্ষণে আবার ফিরে আসবে। বিশিষ্ট অপেক্ষবাদ অনুসারে আলোকের চাইতে বেশি গতিবেগে কিছুই চলাচল করতে পারবে না। সুতরাং আলোক যদি নিষ্ক্রমণ করতে না পারে, তাহলে আর কিছুই সেখান থেকে নিষ্ক্রমণ করতে পারবে না।
এর ফল হবে একটা কৃষ্ণগহ্বর : স্থান-কালের একটা অঞ্চল সেখান থেকে অসীমে নিষ্ক্রমণ সম্ভব নয়। কৃষ্ণগহ্বরের সীমানার নাম ঘটনা দিগন্ত। আলোকের যে তরঙ্গমুখ তারকা থেকে অসীমে নিষ্ক্রমণ করতে বিফল হয় সেটা কিন্তু সোয়ার্জচাইল্ড (Schwarzchild) ব্যাসার্ধ থেকে চলাচল করে। ব্যাসার্ধটা হল, 2GM/Vc। এখানে G নিউটনের মহাকর্ষীয় ধ্রুবক। M হল তারকাটির ভর এবং C আলোকের গতিবেগ। সূর্যের ভরের দশ গুণ ভরসম্পন্ন একটা তারকার সোয়ার্জচাইল্ড ব্যাসার্ধ প্রায় ৩০ কিলোমিটার।
সিগনাস এক্স– 1 (Cygnus X-l) নামক এক্স রশ্মির উৎসের মতো দ্বি তারকাতন্ত্রের ভিতরে এই জাতীয় কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্বের অভিভাবন করার (suggest) মতো যথেষ্ট ভাল সাক্ষ্য প্রমাণ এখন রয়েছে। বেশ কিছু সংখ্যক অধিকতর ক্ষুদ্র কৃষ্ণগহ্বর হয়ত মহাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে। এগুলো তারকা চুপসে গিয়ে সৃষ্টি হয়নি; হয়েছে উত্তপ্ত ঘন মাধ্যমের অত্যন্ত উচ্চচাপগ্রস্ত অঞ্চল চুপসে যাওয়াতে। যে বৃহৎ বিস্ফোরণে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছিল সেই বিস্ফোরণের স্বল্পকাল পরে ঐরকম উত্তপ্ত ঘন মাধ্যম ছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। যে কোয়ান্টাম ক্রিয়ার বিবরণ আমি এখানে দেব সেই কোয়ান্টাম ক্রিয়া সাপেক্ষ এই আদিম কৃষ্ণগহ্বরগুলোর বৃহত্তম গুরুত্ব রয়েছে। এক হাজার কোটি টন ভরের (প্রায় একটা পর্বতের ভরের সমান) একটা কৃষ্ণগহ্বরের ব্যাসার্ধ হবে প্রায় ১০-১৩ সেন্টিমিটার (একটা নিউট্রন কিংবা প্রোটনের আকার)। এটা একটা সূর্য প্রদক্ষিণ কক্ষে থাকতে পারে কিংবা থাকতে পারে একটা নীহারিকাকেন্দ্র প্রদক্ষিণ কক্ষে।
কৃষ্ণগহ্বর এবং তাপগতিবিদ্যার (thermodynamics) একটা সম্পর্ক থাকতে পারে। এ সম্পর্কে প্রথম ইঙ্গিত এসেছিল ১৯৭০ সালের একটা গাণিতিক আবিষ্কারের পর। এই আবিষ্কার অনুসারে ঘটনা দিগন্তের পৃষ্ঠের (surface) ক্ষেত্রফল অর্থাৎ কৃষ্ণগহ্বরের সীমানার (boundary) একটা ধর্ম হল কৃষ্ণগহ্বরের ভিতর যখন অপর (additional) পদার্থ কিংবা বিকিরণ পতিত হয় তখন সবসময়ই কৃষ্ণগহ্বরের সীমানা বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া যদি দুটি কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষের পর তারা একটি কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টি করে তাহলে যে কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টি হবে তার ঘটনা দিগন্ত বেষ্টনীর যে ক্ষেত্রফল হবে সেটা আগেকার কৃষ্ণগহ্বর দুটির ঘটনা দিগন্তের বেষ্টনীর ক্ষেত্রফলের যোগফলের চাইতে বেশি হবে। এই ধর্মগুলো থেকে অভিভাবন করা যায় একটি কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্তের ক্ষেত্রফলের সঙ্গে তাপগতিবিদ্যার এন্ট্রপি (entropy) কল্পনের একটা সাদৃশ্য রয়েছে। তাপগতিবিদ্যার বিখ্যাত দ্বিতীয় বিধি বলে এনট্রপি সবসময়ই কালের সঙ্গে বৃদ্ধি পায়।
কৃষ্ণগহ্বরের ধর্মগুলোর সঙ্গে তাপগতিবিদ্যার ধর্মগুলোর সাদৃশ্য ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস্ এম. বার্দিন James M. Bardeen), মিউডন অবজারভেটরীর (Meudon Observatory) ব্র্যান্ডন কার্টার এবং আমি সম্প্রসারিত করেছি। তাপগতিবিদ্যার প্রথম বিধি বলে একটা তন্ত্রের এনট্রপির সামান্য পরিবর্তনের সঙ্গে তন্ত্রটির শক্তির আনুপাতিক পরিবর্তন হয়। আনুপাতিকতার উপাদানকে (factor of proportionality) বলা হয় তন্ত্রটির তাপমাত্রা। বার্দিন, কার্টার এবং আমি দেখলাম কৃষ্ণগহ্বরের ভরের পরিবর্তনের সঙ্গে ঘটনা দিগন্তের ক্ষেত্রফলের পরিবর্তনের একটা সদৃশ বিধি পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে আনুপাতিকতার উপাদানের সঙ্গে একটা রাশি জড়িত। তার নাম পৃষ্ঠ মহাকর্ষ (surface gravity)। যদি মেনে নেওয়া যায় ঘটনা দিগন্তের ক্ষেত্রফল এনট্রপির সঙ্গে তুলনীয় তাহলে মনে হবে পৃষ্ঠ মহাকর্ষ তাপমাত্রার সঙ্গে তুলনীয়। দেখা যায় পৃষ্ঠ মহাকর্ষ ঘটনা দিগন্তের প্রত্যেক বিন্দুতেই এক। ঠিক যেমন যে বস্তুপিণ্ডের তাপের সুস্থিতি রয়েছে (thermal equilibrium) তার প্রতিটি বিন্দুতেই তাপমাত্রা এক। এই তথ্য উপরে উল্লিখিত সাদৃশ্যকে আরও শক্তিশালী করে।
যদিও এনট্রপি এবং ঘটনা দিগন্তের একটা স্পষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে তবুও ঐ অঞ্চলকে কি করে কৃষ্ণগহ্বরের এনট্রপি বলে শনাক্ত করা যায় সেটা স্বতঃপ্রতীয়মান ছিল না। কৃষ্ণগহ্বরের এনট্রপি কথাটির অর্থ কি হয়? বিনিশ্চায়ক অভিভাবন (crucial sug gestion) করেছিলেন জেকব ডি. বেকেনস্টাইন Jecob D. Bekensiten) ১৯৭২ সালে। তিনি তখন প্রিস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গ্র্যাজুয়েট ছাত্র ছিলেন। এখন তিনি রয়েছেন ইজরায়েলের নেগেভ (Negev) বিশ্ববিদ্যালয়ে। ব্যাপারটা এরকম হয়– মহাকর্ষের ফলে চুপসে গিয়ে যখন কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টি হয় তখন সেটা দ্রুত একটা সুস্থিত অবস্থায় স্থিতি লাভ করে (settles down to a stationary state)। এই অবস্থার বৈশিষ্ট্য শুধুমাত্র তিনটি স্থিতিমাপ (parameters) ভর, কৌনিক ভরবেগ এবং বৈদ্যুৎ আধান। এই তিনটি ধর্ম ছাড়া যে বস্তুগুলো চুপসে গেছে তার অন্য কোন লোম নেই নামক উপপাদ্য দিয়ে পরিচিত। এই উপপাদ্য প্রমাণ করা হয়েছিল কার্টার (Carter), অ্যালবার্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্নার ইজরায়েল, লন্ডনের কিংস্ কলেজের ডেভিড সি. রবিনসন এবং আমার সংযুক্ত গবেষণার দ্বারা।
লোমহীনতার উপপাদ্যের নিহিতার্থ : মহাকর্ষের ফলে চুপসে যাওয়ার সময় বিরাট পরিমাণ সংবাদ হারিয়ে যায়। উদাহরণ : কৃষ্ণগহ্বরের অন্তিম অবস্থা–যে বস্তুপিণ্ড চুপসে গেছে সেটা পদার্থ কিংবা বিপরীত পদার্থের দ্বারা গঠিত ছিল; কিংবা সেটা গোলীয় ছিল অথবা অত্যন্ত অনিয়মিত গঠনের ছিল–তার সঙ্গে সম্পর্কহীন। অন্য কথায় একটা নির্দিষ্ট ভর, কৌণিক ভরবেগ এবং বৈদ্যুৎ আধান সমন্বিত কৃষ্ণগহ্বর বহুসংখ্যক বিভিন্ন গঠনের পদার্থ চুপসে যাওয়ার ফলে হওয়া সম্ভব। সত্যি কোয়ান্টাম ক্রিয়াকে যদি অগ্রাহ্য করা যায় তাহলে আকারের configurations) সংখ্যা হতে পারে অসীম। কারণ কৃষ্ণগহ্বর গঠিত হয়ে থাকতে পারে অনিশ্চিত বৃহৎ সংখ্যক, অনিশ্চিত স্বল্প ভরের কণিকাগুলোর মেঘ চুপসে যাওয়ার ফলে।
কণাবাদী বলবিদ্যার অনিশ্চয়তার নীতির নিহিতার্থ কিন্তু বলে, m ভরসম্পন্ন একটা কণিকার আচরণ হবে h/mc তরঙ্গদৈর্ঘ্যসম্পন্ন একটা তরঙ্গের মতো। এক্ষেত্রে h প্লঙ্ক (Plank) এর ধ্রুবক (ক্ষুদ্রসংখ্যা ৬.৬২% ১০২৭ সেকেন্ড) এবং C আলোকের গতিবেগ। একটি কণিকা মেঘে চুপসে গিয়ে একটি কৃষ্ণগহ্বর তৈরি করার সামর্থ্য পেতে হলে মনে হয় এই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের যে কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টি হবে তার চাইতে ক্ষুদ্র হতে হবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে–একটা নির্দিষ্ট ভর, কৌণিক ভরবেগ এবং বৈদ্যুতিক আধানসম্পন্ন কৃষ্ণগহ্বর তৈরি করতে পারে এরকম আকৃতির (configuration সংখ্যার খুব বেশি হলেও অসীম নয়। বেকেনস্টাইনের অভিভাবন ছিল এই সংখ্যার লগারিদম (logarithm)-কে একটা কৃষ্ণগহ্বরের এনট্রপি রূপে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। সংখ্যাটির লগারিদম হবে কৃষ্ণগহ্বর যখন সৃষ্টি হয় তখন যে সংবাদগুলো ঘটনা দিগন্তের ভিতর দিয়ে হারিয়ে গিয়ে উদ্ধারের অতীত হয়েছিল তার পরিমাণের একটা মাপ।
বেকেনস্টাইনের অভিভাবনের আপাতদৃষ্ট মারাত্মক ভুল ছিল : যদি একটা কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্তের ক্ষেত্রফলের সঙ্গে আনুপাতিক সাত এনট্রপি থাকে তাহলে তার পৃষ্ঠ মহাকর্ষের সঙ্গে আনুপাতিক সান্ত (finite) তাপমাত্রাও থাকা উচিত। এর নিহিতার্থ একটি কৃষ্ণগহ্বর শূন্য ছাড়া অন্য যে কোন তাপমাত্রায় তাপ বিকিরণের সঙ্গে সুস্থিত থাকতে পারে (in equilibrium)। অথচ চিরায়ত কল্পন অনুসারে এরকম কোন সুস্থিত অবস্থা হওয়া সম্ভব নয়। তার কারণ কৃষ্ণগহ্বরের উপর যে তাপ বিকিরণই পড়বে তাকেই সে বিশোষণ করে নেবে কিন্তু সংজ্ঞা অনুসারে তার পরিবর্তে সে কিছু উৎসর্জন (emit) করতে পারবে না।
১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এই কূটাভাসের (paradox) অস্তিত্ব ছিল। সেই সময় আমার গবেষণার বিষয় ছিল : কণাবাদী বলবিদ্যা অনুসারে কৃষ্ণগহ্বরের নিকটবর্তী পদার্থের আচরণ কি হবে? আমি আবিষ্কার করলাম কৃষ্ণগহ্বর স্থির হারে কণিকা উৎসর্জন করে বলে মনে হয়। এ আবিষ্কারে আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম। সেই সময় অন্য সবার মতো আমি এই অনুশাসন বাক্য (dictum) মেনে নিয়েছিলাম যে কৃষ্ণগহ্বর কিছু উৎসর্জন করতে পারে না। তাইতে বোকা হয়ে যাওয়ার মতো এই অভিক্রিয়ার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমি খুবই চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু এই অভিক্রিয়া যেতে রাজি হয়নি। শেষ পর্যন্ত আমি ওকে মেনেই নিলাম। এটা যে একটি বাস্তব ভৌত পদ্ধতি শেষ পর্যন্ত সেটা আমাকে বিশ্বাস করাল এই তথ্য : যে কণিকাগুলো নির্গত হয় তার বর্ণালি নির্ভুলভাবে তাপীয় (thermal)। কৃষ্ণগহ্বর সাধারণ তপ্ত বস্তুপিণ্ডের মতো কণিকা সৃষ্টি করে এবং উৎসর্জন করে। তার তাপমাত্রা পৃষ্ঠ মহাকর্ষের আনুপাতিক এবং ভরের ব্যস্ত আনুপাতিক (inversly proportional)। এর ফলে বেকেনস্টাইনের অভিভাবন কৃষ্ণগহ্বরের সান্ত এনট্রপি আছে–সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে যায়। তার কারণ এর নিহিতার্থ হল কৃষ্ণগহ্বর শূন্য ছাড়া কোন একটা শান্ত তাপমাত্রায় তাপীয় সুস্থিতি লাভ করতে পারে।
তারপর থেকে কৃষ্ণগহ্বরগুলো তাপীয় উৎসর্জন করতে পারে এ তথ্যের গাণিতিক সাক্ষ্য অনেকের দ্বারাই প্রমাণিত হয়েছে। তাদের সমাধানের পদ্ধতিও ছিল বিভিন্ন। উৎসর্জন বোঝার একটি উপায় কণাবাদী বলবিদ্যার নিহিতার্থ অনুসারে সমগ্র স্থান (space) কণিকা এবং বিপরীত কণিকার জোড়ে পূর্ণ। সবসময়ই তারা জোড়ে জোড়ে সৃষ্ট হচ্ছে, পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে আবার নিকটবর্তী হচ্ছে এবং পরস্পরকে বিনাশ করছে। এই কণিকাগুলোকে কল্পিত কণিকা বলার কারণ বাস্তব কণিকাগুলোর মতো এগুলোকে কণিকা অভিজ্ঞাপক যন্ত্রের সাহায্যে (particle detector) প্রত্যক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায় না। সে যাই হোক, তাদের পরোক্ষ অভিক্রিয়া কিন্তু মাপা যায়। তাদের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়েছে একটি ক্ষুদ্র স্থানচ্যুতি (shift) দিয়ে (ল্যাম্ব শিফট –Lamb shift)। কল্পিত কণিকাগুলো উত্তেজিত হাইড্রোজেন পরমাণুর আলোক বর্ণালিতে এই বিচ্যুতি সৃষ্টি করে। কৃষ্ণগহ্বরের উপস্থিতিতে একজোড়া কল্পিত কণিকার একটি কৃষ্ণগহ্বরে পতিত হতে পারে, ফলে জোড়ের অন্যটির বিনাশপ্রাপ্ত হওয়ার মতো কোন অংশীদার থাকে না। পরিত্যক্ত কণিকা কিংবা বিপরীত কণিকা তার জোড় কৃষ্ণগহ্বরে পতিত হওয়ার পর নিজেও কৃষ্ণগহ্বরে পড়তে পারে, তবে সেটা ছাড়া পেয়ে অসীমেও গমন করতে পারে। সেখানে তাদের মনে হবে কৃষ্ণগহ্বর থেকে উৎসর্জন করা বিকিরণ।
এই ক্রিয়া দেখার আরেকটি উপায় জোড়ের যে কণিকাটি কৃষ্ণগহ্বরে পড়ে, ধরুন সেটা বিপরীত কণিকা। সেটাকে কালে পশ্চাত্মখী চলমান বাস্তবিক কণিকাই ভাবা। অর্থাৎ যে বিপরীত কণিকা কৃষ্ণগঘেরে পতিত হচ্ছে সেটাকে ভাবা যায় কৃষ্ণগহ্বর থেকে আগন্তুক একটি কণিকা কিন্তু সেটা কালে পশ্চাৎমুখী চলমান। যে বিন্দুতে কণিকা বিপরীত কণিকা জোড় প্রথমে বাস্তবায়িত হয়েছিল। কণিকাটি যখন সেই বিন্দুতে পৌঁছায়, তখন সেটা মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের দ্বারা বিক্ষেপিত (scattered) হয়, ফলে সেটা কালে সম্মুখে চলাচল হয়।
সুতরাং কণাবাদী বলবিদ্যা একটি কণিকার কৃষ্ণগহ্বরের ভিতর থেকে নিষ্ক্রমণ অনুমোদন করে। চিরায়ত বলবিদ্যা এরকম অনুমোদন করে না। তবে পারমাণবিক এবং কেন্দ্রীয় পদার্থবিদ্যায় এমন অনেক পরিস্থিতি আছে যেখানে এমন কতগুলো বাধা রয়েছে যেগুলো চিরায়ত নীতি অনুসারে কণিকাগুলো ভেদ করতে পারে না। কিন্তু কণাবাদী বলবিদ্যার নীতি অনুসারে সেগুলো সুড়ঙ্গপথে (tunnel through) যেতে পারে।
কৃষ্ণগহ্বরের চারপাশের বাধার স্থূলতা কৃষ্ণগহ্বরের আকারের আনুপাতিক। এর অর্থ সিগনাস X-১ (Cygnus X-l) এ বিদ্যমান বলে প্রকল্পিত কৃষ্ণগহ্বরের আকারের কৃষ্ণগহ্বর থেকে খুব সামান্য সংখ্যক কণিকাই নিষ্ক্রমণ করতে পারে, কিন্তু ক্ষুদ্রতর কৃষ্ণগহ্বর থেকে তারা দ্রুত বেরিয়ে যেতে পারে। বিস্তৃত গণনায় দেখা যায় নির্গত কণিকাগুলোর এমন একটি তাপীয় বর্ণালি রয়েছে যেটা তাপমাত্রার অনুরূপ। সেই তাপমাত্রা কৃষ্ণগহ্বর ভরের হ্যাঁসপ্রাপ্তির সঙ্গে দ্রুত বৃদ্ধি পায়। সূর্যের ভরের মতো ভরসম্পন্ন একটি কৃষ্ণগহ্বরের তাপমাত্রা চরম শূন্যের এক কোটি ভাগের এক ভাগ মাত্র। কৃষ্ণগহ্বর থেকে এই তাপমাত্রার তাপীয় বিকিরণ মহাবিশ্বের বিকিরণের সাধারণ পশ্চাৎপটে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হবে। অন্যদিকে মাত্র একশ’ কোটি টন ভরের একটি কৃষ্ণগহ্বর অর্থাৎ একটি প্রোটনের আকারে আদিম একটি কৃষ্ণগহ্বরের তাপমাত্রা হবে বার হাজার কোটি কেলভি (Kelvin), এটা এক কোটি ইলেকট্রন ভোল্টের শক্তির অনুরূপ। এরকম তাপমাত্রার একটি কৃষ্ণগহ্বর ইলেকট্রন পজিট্রনের জোড় সৃষ্টি করতে পারবে এবং সৃষ্টি করতে পারবে ফোটন। নিউট্রিনো এবং গ্র্যাভিটনের (অনুমিত মহাকর্ষীয় শক্তি বহনকারী কণিকা) মতো শূন্য ভরসম্পন্ন কণিকা। একটি আদিম কৃষ্ণগহ্বর ছয় হাজার মেগাওয়াট হারে শক্তি মুক্ত করবে। এই পরিমাণ শক্তি চারটি বড় শক্তি উৎপাদন কেন্দ্রের উৎপাদনের সমান।
কৃষ্ণগহ্বর থেকে কণিকা উৎসর্জন হলে কৃষ্ণগহ্বরটির ভর এবং আকার স্থির হারে হ্রাস পায়। এর ফলে আরও অধিকসংখ্যক কণিকার ছিদ্রপথে নির্গমন সহজতর হয় এবং এই নির্গমন ক্রমবর্ধমান হারে চলতে থাকে, যতক্ষণ না এই নির্গমনের ফলে কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়। শেষ পর্যন্ত মহাবিশ্বের সমস্ত কৃষ্ণগহ্বরই এভাবে উবে যায়। তবে একটি বৃহৎ কৃষ্ণগহ্বরের ক্ষেত্রে এই উবে যাওয়ার কাল সত্যিই খুব দীর্ঘ। সূর্যের সমান ভরসম্পন্ন একটি কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব প্রায় ১০৬৬ বছর। অন্যদিকে একটি আদিম কৃষ্ণগহ্বরে বৃহৎ বিস্ফোরণের পরে যে এক হাজার কোটি বছর অতীত হয়েছে (যাকে আমরা কালের আরম্ভ বলে জানি) তার ভিতরেই প্রায় সম্পূর্ণ উবে গেছে। এরূপ কৃষ্ণগহ্বর এখন পায় দশ কোটি ইলেকট্রন ভোল্টের সমান শক্তিসম্পন্ন কঠিন গামা রশ্মি উৎসর্জন করবে।
SAS-2 নামক উপগ্রহের গামা রশ্মি বিকিরণের মহাজাগতিক পশ্চাৎপট মাপনের ভিত্তিতে করা ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে তখন কর্মরত ডন এন, পেজ (Don N. Page) এবং আমার গণনা অনুসারে দেখা যায় মহাবিশ্বে আদিম কৃষ্ণগহ্বরের গড় ঘনত্ব নিশ্চয়ই হবে প্রতি ঘন আলোক বছরে প্রায় দুইশত-র কম। যদি কৃষ্ণগহ্বরগুলো নীহারিকাগুলোর জ্যোতিষচক্রে’ (halo) কেন্দ্রীভূত হয় তাহলে আমাদের নীহারিকায় স্থানীয় ঘনত্ব হতে পারে এই রাশির দশ লক্ষ গুণ বেশি। জ্যোতিষচক্র বলতে বোঝায় দ্রুত চলমান তারকাগুলোর যে পাতলা মেঘে নীহারিকাগুলো ডুবে রয়েছে সেইগুলো। নীহারিকাগুলো সমগ্র মহাবিশ্বে সমভাবে বন্টিত নয়। এর নিহিতার্থ হল পৃথিবীর নিকটতম আদিম কৃষ্ণগহ্বরের দূরত্ব হবে অন্ততপক্ষে পুটো গ্রহের দূরত্বের সমান।
কৃষ্ণগহ্বরের উবে যাওয়া শেষ অবস্থায় এত দ্রুত হবে যে, এর অন্ত হবে একটা ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে। এই বিস্ফোরণে কতটা শক্তিশালী হবে সেটা নির্ভর করবে কতরকম শ্রেণীর মৌলকণা এর ভিতরে আছে তার উপরে। বহু লোকের এখন বিশ্বাস সবরকম মৌলকণাই হয়ত গঠিত হয় দুরকম বিভিন্ন কার্ক দিয়ে। এ বিশ্বাস যদি সত্য হয় তাহলে অন্তিম বিস্ফোরণের শক্তি হবে এক কোটি এক মেগাটন হাইড্রোজেন বোমার সমান। অন্যদিকে সার্ন (CERN অর্থাৎ জেনেভায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় গবেষণার জন্য ইউরোপীয় সংগঠন) এর আর. হ্যাঁগেডন (R. Hagedorn) একটি বিকল্প প্রস্তাব উপস্থিত করেছিলেন। তার যুক্তি উচ্চ থেকে উচ্চতর অসীম সংখ্যক মৌলকণা আছে। একটি কৃষ্ণগহ্বর যত ক্ষুদ্রতর এবং তপ্ততর অসীম সংখ্যক মৌলকণা আছে। একটি কৃষ্ণগহ্বর যত ক্ষুদ্রতর এবং তপ্ততর হবে ততই সেটা বৃহত্তর এবং বৃহত্তর সংখ্যক বিভিন্ন জাতির কণিকা উৎসর্জন করবে এবং এমন একটি বিস্ফোরণ সৃষ্টি করবে যেটা কার্ক প্রকল্পের ভিত্তিতে গণনা করা বিস্ফোরণের চাইতে এক লক্ষ গুণ বেশি শক্তিশালী। সুতরাং একটা কৃষ্ণগহ্বর পর্যবেক্ষণ করে মৌলকণা পদার্থবিদ্যা সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুতুপূর্ণ সংবাদ পাওয়া যাবে। এ সংবাদ অন্য কোন উপায়ে পাওয়া নাও যেতে পারে।
একটা কৃষ্ণগহ্বরের বিস্ফোরণে বিরাট পরিমাণ উচ্চ শক্তিসম্পন্ন গামা রশ্মি উৎপন্ন হয়ে উপচে পড়বে, যদিও একটা উপগ্রহ কিংবা বেলুনে অবস্থিত গামা রশ্মি অভিজ্ঞাপক (Gamma Ray detectors) যন্ত্রের সাহায্যে এগুলো পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হতে পারে, তবুও একটা বিস্ফোরণ থেকে নির্গত গামা রশ্মি’র ফোটন উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ধরার যুক্তিসঙ্গত সম্ভাবনা আছে এরকম বৃহৎ আকারের একটা অভিজ্ঞাপক যন্ত্রকে আকাশে ওড়ানো বেশ কঠিন হবে। একটা সম্ভাবনা : স্থানে যাতায়াত করে এরকম যানের সাহায্যে (space shuttle) পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে এরকম কক্ষেই একটা বৃহৎ গামা রশ্মি অভিজ্ঞাপক যন্ত্র লাগানো। একটা সহজতর এবং স্বল্পতর ব্যয়বহুর পদ্ধতি হবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের উচ্চতর স্তরকে অভিজ্ঞাপক যন্ত্ররূপে ব্যবহার করা। একটা উচ্চ শক্তিসম্পন্ন গামা রশ্মি বায়ুমণ্ডলে ঢুকে পড়লে ইলেকট্রন-পজিট্রন জোড়ের বর্ষণ সৃষ্টি করবে। প্রথমে বায়ুমণ্ডলের ভিতর দিয়ে তার গতি হবে আলোকের বায়ুমণ্ডলের ভিতর দিয়ে গতির চাইতে বেশি (বায়ু অণুদের সঙ্গে প্রতিক্রিয়ার ফলে আলোকের গতি হ্রাস পায়)। এভাবে ইলেকট্রন এবং পজিট্রন এক ধরনের স্বরভিত্তিক আকস্মিক বৃদ্ধি (sonic boom) কিংবা বিদুৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রে অভিঘাত তরঙ্গ সৃষ্টি করবে। এগুলোকে ভূপৃষ্ঠ থেকে দৃশ্যমান আলোকের ঝলকরূপে চেনা যায়।
ডাবলিনের বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের নীল এ পোর্টার (Neil A. Porter) এবং ট্রেভর সি. উইল্স (Trevor C. Weekes) এর প্রাথমিক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যদি হ্যাঁগেডন (Hagedorn) এর তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণীর অনুরূপ কৃষ্ণগহ্বরের বিস্ফোরণ হয় তাহলে প্রতি ঘন আলোকবর্ষ পিছু, প্রতি শতাব্দীতে নীহারিকা আমাদের অঞ্চলে কৃষ্ণগহ্বরের বিস্ফোরণের সংখ্যা দুই-এর চাইতেও কম হওয়ার কথা। এর নিহিতার্থ হবে আদিম কৃষ্ণগহ্বরের ঘনত্ব, প্রতি ঘন আলোক বছরে দশ কোটিরও কম। এই ধরনের পর্যবেক্ষণে সুগ্রাহিতা (sensitivity) অনেক বেশি বৃদ্ধি করা সম্ভব হওয়া উচিত। এতে যদি আদিম কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে কোন পরা (positive) সাক্ষ্য না পাওয়া যায় তাহলেও তারা খুবই মূল্যবান হবে। ঐরকম কৃষ্ণগহ্বরগুলোর ঘনত্বের উচ্চমানের একটা নিম্নসীমা বেঁধে দিয়ে পর্যবেক্ষণগুলো নির্দেশ করবে আদিম মহাবিশ্ব নিশ্চয়ই অত্যন্ত মসৃণ এবং বিক্ষোভবিহীন (nonturbulant) ছিল।
বৃহৎ বিস্ফোরণ কৃষ্ণগহ্বর বিস্ফোরণের অনুরূপ কিন্তু তার মান তুলনায় অনেক বৃহৎ সুতরাং আশা করা যায় কৃষ্ণগহ্বর কি করে কণিকা সৃষ্টি করে সেটা বোঝা গেলে বৃহৎ বিস্ফোরণ কি করে মহাবিশ্বের সব জিনিস সৃষ্টি করে সেটা বোঝার পথ দেখাবে। কৃষ্ণগহ্বরে পদার্থ চুপসে যায় এবং চিরদিনের মতো হারিয়ে যায় কিন্তু তার স্থানে নতুন পদার্থের সৃষ্টি হয় সুতরাং হতে পারে মহাবিশ্বের একটা পূর্বতন দশা ছিল। সেই দশায় পদার্থ চুপসে গিয়েছিল এবং বৃহৎ বিস্ফোরণে নতুন করে পদার্থ সৃষ্টি হয়েছিল।
যে পদার্থ চুপসে গিয়ে কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হয়েছিল, তার যদি সব কেটেছেঁটে অবশিষ্ট কোন বৈদ্যুৎ আধান (net electric charge) থাকে তাহলে ফলস্বরূপ যে কৃষ্ণগহ্বর হল সে কৃষ্ণগহ্বরও ঐ বৈদ্যুৎ আধান বহন করবে। এর অর্থ কৃষ্ণগহ্বর চেষ্টা করবে কল্পিত বৃহৎ কণিকার যে জোড়গুলোর বিপরীত আধান থাকবে সেগুলোকে আকর্ষণ করতে এবং যেগুলোর আধান সমরূপ থাকবে তাদের বিকর্ষণ করতে। সুতরাং কৃষ্ণগহ্বর পছন্দ করবে সেই কণিকাগুলোকে উৎসর্জন করতে যেগুলোর আধানের লিঙ্গ তার নিজের সমরূপ হবে। ফলে তার আধান দ্রুত নিঃশেষ হবে। একইভাবে যে পদার্থগুলো চুপসে যাচ্ছে, তাদের যদি অবশিষ্ট কোন কৌণিক ভরবেগ (net angular momentum) থাকে তাহলে যে কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টি হবে সেটা ঘূর্ণায়মান হবে এবং পছন্দ করবে যে কণিকাগুলো কৌণিক ভরবেগ বহন করে দূরে অপসরণ করে সেই কণিকাগুলো উৎসর্জন করতে। কৃষ্ণগহ্বরে বৈদ্যুৎ আধান, কৌণিক ভরবেগ এবং যে পদার্থ চুপসে গিয়েছিল তার ভর স্মরণে রাখার (remembers) এবং অন্য সব কিছু ভুলে যাওয়ার (forgets) কারণ এই তিনটি রাশি দীর্ঘ পাল্লা ক্ষেত্রগুলোর সঙ্গে long range fields) যুগিত : আধানের বেলায় বিদ্যুৎচুম্বকীয় ক্ষেত্র এবং কৌণিক ভরবেগ আর ভরের বেলায় মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র।
Princeton বিশ্ববিদ্যালয়ের রবার্ট এইচ. ডিক (Robert H. Dicke) এবং মস্কো স্টেট উইনিভার্সিটির লাদিমের ব্যাগিন্স্কি (Vladimir Braginsky), এই দুইজনের গবেষণায় ইঙ্গিত পাওয়া যায় ব্যারিয়ন সংখ্যা (baryon number) নামাঙ্কিত কণাবাদী ধর্মের সঙ্গে জড়িত কোন দীর্ঘ পাল্লার ক্ষেত্র নেই (ব্যারিয়ন এক শ্রেণীর কণিকা, প্রোটন এবং নিউট্রনও সেই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত)। সেজন্য কিছু ব্যারিয়ন সগ্রহ চুপসে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট কৃষ্ণগহ্বর তার ব্যারিয়ন সংখ্যা ভুলে যাবে এবং সমপরিমাণ ব্যারিয়ন এবং বিপরীত ব্যারিয়ন বিকিরণ করবে। সুতরাং কৃষ্ণগহ্বরটি যখন অদৃশ্য হল, তখন কণিকা পদার্থবিদ্যার সবচাইতে আকাঙ্ক্ষিত বিধিগুলোর একটাকে ভঙ্গ করা হল। এই বিধির নাম ব্যারিয়ন সংরক্ষণ বিধি (law of barion conservation)।
কৃষ্ণগহ্বরগুলোর একটা সসীম এন্ট্রপি রয়েছে –বেকেনস্টাইনের এই প্রকল্পের সামঞ্জস্যের জন্য যদিও কৃষ্ণগহ্বরগুলোর তাপীয় বিকিরণ প্রয়োজন কিন্তু প্রথমে মনে হয়, কণিকা সৃষ্টির বিস্তৃত কণাবাদী বলবিদ্যাভিত্তিক গণনায় তাপীয় বর্ণালি সমন্বিত একটা উৎসর্জন সৃষ্টি করবে। এটা একটা অলৌকিক ব্যাপার বলে মনে হয়। এর ব্যাখ্যা : নির্গত কণিকাগুলোর কৃষ্ণগহ্বর থেকে সুড়ঙ্গপথে নির্গত হওয়া। যে অঞ্চল থেকে এগুলো নির্গত হয় সে অঞ্চল সম্পর্কে বাইরের একজন পর্যবেক্ষকের তার ভর, কৌণিক ভরবেগ এবং বৈদ্যুৎ আধান ছাড়া কোন জ্ঞান নেই –উল্লিখিত তথ্যের এটাই ব্যাখ্যা। এর অর্থ যে সমস্ত নির্গত কণিকাগুলোর একই শক্তি, কৌণিক ভরবেগ এবং বৈদ্যুৎ আধান রয়েছে, তাদের ‘সর্বপ্রকার সংযুক্তি কিংবা আকারের একইরকম সম্ভাবনা রয়েছে’। সত্যিই কৃষ্ণগহ্বরের একটা টেলিভিশন সেট কিংবা দশ খণ্ড চামড়া বাঁধানো প্রাউস্ট (Proust) রচনাবলি উৎসর্জনের সম্ভাবনা আছে কিন্তু কণিকাগুলোর যে সংরচনা (configuration) এই উদ্ভট জিনিসগুলোর অনুরূপ হবে তার সম্ভাবনা এত অল্প যে প্রায় মিলিয়ে যাওয়ার মতো ক্ষুদ্র বলা চলে। যে আকারে কণিকাগুলো উৎসর্জিত হবে সেগুলোর বৃহত্তম সংখ্যার বর্ণালি প্রায় তাপীয় বর্ণালির মতো।
কৃষ্ণগহ্বর থেকে উৎসর্জনের কণাবাদী বলবিদ্যার সঙ্গে সাধারণত জড়িত অনিশ্চয়তা কিংবা ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতার চাইতেও একটু বেশি অনিশ্চয়তা এবং ভবিষ্যদ্বাণী করার অক্ষমতা থাকবে। চিরায়ত বলবিদ্যায় কণিকাটির অবস্থান এবং গতিবেগ দুই-ই মাপা সম্ভব। কণাবাদী বলবিদ্যায় অনিশ্চয়তা নীতি বলে এই দুটি মাপনের একটা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব। পর্যবেক্ষক কণিকাটির অবস্থান কিংবা গতিবেগ–এই দুটির একটি মাপনের সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন। কিন্তু দুটি সম্পর্কে পারেন না। পরিবর্তে তিনি অবস্থান এবং গতিবেগের একটা সমন্বয়ের মাপনফল সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন অর্থাৎ পর্যবেক্ষকের নির্দিষ্ট নিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী করার সামর্থ্য কার্যক্ষেত্রে অর্ধেক হয়ে যায়। কৃষ্ণগহ্বরের ব্যাপারে পরিস্থিতি আরও খারাপ। যেহেতু কৃষ্ণগহ্বর থেকে উৎসর্জিত কণিকাগুলো এমন অঞ্চল থেকে আসে, সে সম্পর্কে পর্যবেক্ষকের জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত, সেজন্য তিনি নির্দিষ্ট ও নিশ্চিতভাবে একটা কণিকার গতিবেগ কিংবা অবস্থান সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন না, কিংবা পারেন না এ দুটির সমন্বয় সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে। তিনি শুধু পারেন কতগুলো কণিকা নির্গত হবে তার সম্ভাব্যতা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে। সেজন্য মনে হয় আইনস্টাইন যখন বলেছিলেন ঈশ্বর জুয়া খেলেন না তখন তার ভুল হয়েছিল দ্বিগুণ। কৃষ্ণগহ্বর থেকে উৎসর্জিত কণিকাগুলো বিচার করলে মনে হবে ঈশ্বর শুধুমাত্র জুয়া খেলেন তাই নয়, অনেক সময় তিনি জুয়ার খুঁটিগুলো এমন জায়গায় বিক্ষেপ করেন যে সেগুলোকে আর দেখতে পাওয়া যায় না।